৩১. সাহেব ডাক্তারের হাতযশে

সাহেব ডাক্তারের হাতযশে, কি সত্যর শাখা-লোহার পুণ্যে, অথবা নবকুমারের নিজেরই পরমায়ুর জোরে বেঁচে গিয়েছিল নবকুমার। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেন কে জানে সত্যকে সে নিজের জীবনদাত্রী বলেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে সেই থেকে।

অতএব সে জীবনটা নিয়ে সত্য যা করতে পারে করুক। যে দেশে অসুখ করলেই সাহেব ডাক্তার পাওয়া যায়, মৃত্যুভয় বলে বিভীষিকাটাই থাকে না, সত্য যদি নবকুমারকে সেই দেশে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সেই চাওয়াটাকে আর হাস্যকর অবান্তর বলে উড়িয়ে দেয় না নবকুমার।

কাজেই সত্যর কাজ কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে। হয়তো এই জন্যেই লোকে বলে থাকে, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে। নবকুমারের এই মারাত্মক রোগটাও শেষ অবধি সত্যর জীবনে অন্তত সত্যর মতে, পরম মঙ্গল ডেকে এনেছে। ছেলেদের মানুষ করতে চায় সত্য, মানুষের মত মানুষ। আর সে মানুষ হতে হলে জগৎটাকে দেখতে হয়।

অবশ্য তার পরও কি আর কাঠখড় পোড়াতে হয় নি? অনেক হয়েছে। অবশেষে আস্তে আস্তে মেঘ কেটে সূর্যকিরণের আভাস দেখা যাচ্ছে।

ভবতোষ মাস্টারের চেষ্টায় নিতাই আর নবকুমারের এক-একটা চাকরি যোগাড় হয়েছে কলকাতায়। নিতাইয়ের রেলি ব্রাদার্সে, নবকুমারের সরকারী দপ্তরে।

অতএব ওদের এখন এক পা রথে এক পা পথে। নবকুমার অবশ্য মা-বাপের কাছে নিজে প্রস্তাব করে নি, করতে পারে নি, সত্যকেই বলতে হয়েছে। তবে কথা বন্ধ করেছেন তারা ছেলে বৌ দুজনের সঙ্গে।

এলোকেশী আজকাল খাওয়া শোওয়া ব্যতীত বাড়িতে থাকেন না বললেই হয়। আর নীলাম্বর সন্ধ্যার দিকে হরিসভায় যেতে শুরু করেছেন।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত সদু সত্যর উপর একটু খাপ্পা ছিল। কিন্তু সত্যর সাহেব ডাক্তার ডাকা রূপ অসাধ্য সাধনের পর থেকে সদুও যেন কেমন মহিমাস্তব্ধ।

মাঝে মাঝে নিজের জীবনের খাতাটাও বুজি উল্টো দেখতে শুরু করেছে আজকাল সদু। সদু যদি ওই রকম নির্ভীক হতে পারত! পারলে হয়তো সদুর জীবনটা এমন বরবাদ হয়ে যেত না। হয়তো বিপথগামী স্বামীকে সুপথে টেনে এনে সংসার করতে পারত। কিন্তু সত্যর মত বলার শক্তি সদুর নেই। সত্যর মত বলতে জানে না সদু মনে-জ্ঞানে যে কাজে দোষ দেখব না, পাপ দেখব না, সে কাজে নিন্দের ভয় করব কেন? নিন্দে সুখ্যাতির ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটাও তো এক রকম স্বার্থপরতা। কিসে লোকে আমায় নিন্দে করবে, আর কিসে আমার সুখ্যাতি করবে এই চিন্তায় যদি স্বামী-পুত্তুরের ভালটি পর্যন্ত না দেখি সেটা তো ঘোর স্বার্থপর কাজ। ১৮৬

সদু উঠে-পড়ে লেগে স্বামীকে শোধরাতে পারত, তা পারে নি সদু, ভয় খেয়েছে। সদু মামার বাড়িতে এসে অকারণে মামা-মামীকে বাঘের মত ভয় করে মরেছে। ন্যায়-অন্যায় কথাটি কখনো বলতে পারে নি। সদু ভীতু।

সত্য সাহসী।

তাই সত্য আজ ডোবার ঘোলা জল থেকে মুক্ত হয়ে সাগরে তরী ভাসাতে গেল।

পাড়াপড়শীর ঘরে সত্যর বয়সী যে সব বৌ-ঝি আছে, তাদের মধ্যেও সত্য একটা আলোড়ন এনেছে বৈকি। তাদের দিনরাত্রির চিন্তার অনেকখানি দখল করে রেখেছে সত্য।

কী আশ্চর্য!

কী বিস্ময়!

কী অলৌকিক!

ঠিক তাদেরই মত একটা মেয়েমানুষ স্বামীপুত্র নিয়ে কলকাতায় বাসায় যাচ্ছে! আর কিসের কবল থেকে? না এলোকেশীর মত ভয়ঙ্করীর কবল থেকে! ওদের স্বামীরা এখন কিছুদিন যাবৎ দাম্পত্যসুখের মাধুর্য থেকে বঞ্চিত। কারণ সেই নিভৃত নির্জনে তাদের স্ত্রীরা এখন অনবরত নবকুমারের সাহস ও প্রেমের দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে।

হতভাগ্য স্বামীরা নবকুমারকে ‘স্ত্রৈণ’, ‘মেয়েমানুষের বশ’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না।

তবে বৌগুলোর অসুবিধে এই সত্যর সঙ্গে একবার নির্জনে দেখা করে স্বামীদের স্ত্রৈণ করে তোলবার মন্তরটা শিখে নেবে এ উপায় নেই। বাঁড়ুয্যে-গিন্নীর বৌয়ের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে তাদের প্রতি কড়া নিষেধ আছে, আর ঘাটে আসার সময় শাশুড়ী পিশাশুড়ী কি বড় ননদ, নিদেনপক্ষে একটা পুঁচকে ননদও পাহারাদার থাকে।

অতএব মন্তর শেখা হয় না।

অবশ্য ওপরওয়ালাদের শুনিয়ে তারা সত্যকে ছিছিক্কার দেয়। যে মেয়েমানুষ বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ীর সেবারূপ মহৎ কর্মে জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলেদের ভাল ইস্কুলে পড়াব ছুতো করে বাসায় যায়, সে মেয়েমানুষকে শত ধিক দেবে না আর মেয়েমানুষরা?

কিন্তু দিক।

সত্যর কানে এসব আসেও না।

এলেও সত্যর কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে না। সে তখন শুধু যাবার প্রস্তুতিসাধনে যত্নবতী।

এই সময় কথাটা একদিন পাড়ল সত্য।

হয়তো সেটাকেও ওই প্রস্তুতি হিসেবেই ধরেছে সে। অথবা এক অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াবার আগে জন্মের শোধ জন্মভূমিকে দেখার বাসনা তাকে প্রবলভাবে পেয়ে বসে। কারণটা যাই হোক, কথাটা পাড়ে সত্য, যাবার আগে একবার ওখানে ঘুরে আসব।

ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে অথবা ঘুরে আসলে ভাল হয়, কি ঘুরে আসা কর্তব্য এসব ভাষার ধার দিয়ে যায় নি সত্য।

ঘুরে আসব!

তার মানে ব্যাপারটা স্থির সিদ্ধান্তের কোঠায়। এখন ব্রহ্মার ব্যাটা বিষ্ণু এলেও সে সিদ্ধান্তের রদ হবে এ আশা নেই কারো।

এলোকেশী বিরস মুখে বলেন, যাবে ভাল কথা। তা আমাকে বলতে এলে কেন? শুধোচ্ছ? নাকি অনুমতি নিচ্ছ?

হ্যাঁ, কথা আবার কইছেন এলোকেশী বৌয়ের সঙ্গে। তার কারণ কথা কওয়াই তার রোগ। মুখ বুজে দু-দণ্ড থাকা তার কোষ্ঠীতে নেই। কথা বন্ধ করব ভেবেও কয়ে ফেলেন।

সত্য তার বড় বড় চোখ দুটো একবার তুলে তাকিয়ে দেখে বলে, নাঃ, সে মিথ্যে রঙ্গর দরকার দেখি না। যাব যখন মনস্থ করেছি, যাওয়ার ব্যবস্থাই করতে হবে। জানানটা দিলাম, ঠাকুরকে বলবেন পঞ্জিকাটা একবার দেখে দিতে।

এলোকেশী স্ব-স্বভাবে এসে পড়েন।

ভেঙিয়ে উঠে বলেন, বাপ উদ্দিশ করে না। বাপের বাড়ি যাবে কোন্ সুবাদে?

বাপকে একবার পেন্নাম করতেই যাব। সত্য আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস মুখে বলে, মা বাপের কর্তব্য আছে, সন্তানের নেই?

তা বেশ, কোর্তব্য করো। যেও বাপকে পেন্নাম করতে। আমার ছেলে বিনি আভ্যানে যাবে তা বলে রাখছি।

সত্য উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এমন এক-একটা অনাছিষ্টি কথা বল তুমি! তোমার ছেলেকে তুমি আটকাবে তো আমি এতখানি রাস্তা যাব কি পাড়ার লোকের সঙ্গে!

তোমার আবার সঙ্গ! এলোকেশী পিচ্ করে একটা পিচ ফেললেন, ডাকাতে তোমায় দেখে ভয় পাবে মা!

পেলেই মঙ্গল। সত্যও কথায় ইতি টানে, তবু লোকসাক্ষী একটা বেটা-ছেলে সঙ্গে থাকা ভাল। আর বাবাকে পেন্নাম করা তো বাবার জামাইয়েরও কাজ!

ইল্লিমারি টুসকি! আরও কত শুনব! বলে, রাখালি কত খেলাই দেখালি! শ্বশুর আবার কবে কার গুরুঠাকুর হল, তা তো জানি না!

মেয়েমানুষের যদি এত হয় তো বেটাছেলের একেবারেই বা হবে না কেন, তাও তো জানি নে মা। মা-বাপ উভয় পক্ষেই গুরুজন। বলে এবার উঠেই যায় সত্য।

জানত এই রকমই হবে। তাই আর অনুমতি চাওয়ার প্রহসনটা করতে চেষ্টা করে নি।

.

প্রবলের জয় অবশ্যম্ভাবী।

পঞ্জিকা দেখে যাত্রার দিন দেখাও হয়, এবং শুভ মুহূর্ত অনুযায়ী “যাত্রা” করে স্বামী-পুত্রকে নিয়ে পালকিতে গিয়ে ওঠেও সত্য। বিশেষ কোনও বাধা আর আসে না। হালই ছেড়ে দিয়েছে তারা।

পালকি সত্যর শ্বশুরবাড়ির গ্রাম ছাড়ায়, পালকির দরজা সরিয়ে মুখ বাড়ায় সত্য।

নবকুমার বলে, ঘোমটা খুলে মুখ বাড়াচ্ছ কেন? কে কোথায় দেখে ফেলবে!

সত্য পুলক-কম্পিত স্বরে বলে, দেখলেই বা! আর তো এখন আমি শ্বশুরবাড়ির বৌ নয়!

বলছি কি তা নয়?

তবে মুখ বুজে থাক। মুখে তো লেখা নেই বৌ কি ঝি? দেখো না ওখানে গিয়ে কি রকম গাছকোমর বেঁধে দস্যিবিত্তি করে বেড়াই!

বড় ছেলে তুডু’র এসব আলোচনা হৃদয়ঙ্গম হবার বয়স হয়েছে। সে সহসা বলে ওঠে, য্যাঃ! তুই আবার গাছকোমর বাঁধবি কি?—

আবার তুই! সত্য তীব্র ভর্ৎসনায় বলে ওঠে, কত দিন বলেছি মাকে তুই বলতে নেই, তুমি বলতে হয়। তবু

সহসা কথার মাঝখানে হেসে ওঠে নবকুমার, হয়েছে। খুব শাসন হয়েছে। বড় একটা মানুষ ও, তাই সুশিক্ষে দেওয়া হচ্ছে। আমি তো বুড়ো বয়েস অবধি মাকে তুই বলেছি।

সত্যর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। বলে, তুমি যা যা করেছিলে বুড়ো বয়স অবধি, তার দৃষ্টান্ত তুমি অন্য সময় ছেলের কানে ঢেলো। আমি যখন একটা শিক্ষাদীক্ষা দিতে আসব, তখন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝগড়া দিতে এসো না।

বাবাঃ! কী হল? কিসে যে কি হয় তোমার বোঝা দায়!

নবকুমার বোঝে একটু বেকায়দা হয়ে গেছে। ক্ষণপূর্বের সেই পুলকোচ্ছল লাবণ্যময়ী মূর্তি অন্তর্হিত হয়ে গেল ওই কাঠিন্যের আড়ালে। তাই আপসের সুর ধরে সে। সত্যি সত্যবতীর ওই চাপল্য, ওই লাবণ্য, ওই আহ্লাদে আলো হয়ে ওঠা মুখ কী অপূর্ব! কিন্তু বড় ক্ষণস্থায়ী! মুহূর্তে মেঘে ঢাকা পড়ে যায়!

আর যায় নবকুমারেরই বোকামিতে। অথচ নবকুমার কিছুতেই বুঝতে পারে না কিসে কি হয়ে যায়, কিসে কি হয়ে যেতে পারে।

সত্যবতীর নাগাল কোনদিনই কি পাবে সে?

.

কিন্তু সত্যর মুখের মেঘ কাটাতে পেরেছে নবকুমারের আত্মজ।

তুড়ু ইত্যবসরে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে বলছে, মামার বাড়ি গিয়ে ভাল ছেলে হতে হয়, না মা? না না, সব বাড়িতেই ভাল ছেলে হতে হয়। শুধু মামার বাড়ি গিয়ে আরো বেশী বেশী ভাল হতে হয়। তা আমি তো সেসব জানিই, কিন্তু ওই খোকা বোকাটা? কিছু জানে না, মামার বাড়ি গিয়ে শুধু অ্যাঁ অ্যাঁ করে কাঁদবে।

ছেলের ওই অ্যাঁ অ্যাঁ ভঙ্গীতে হেসে ফেলেছে সত্য।

না, অন্তত এই পথটুকুতে তেমন ভয় নেই নবকুমারের। মেঘ স্থায়ী হবে না। বুঝি গতির মধ্যেই আছে এক অপূর্ব পুলকের স্বাদ। তাই মুহূর্তে মুহূর্তে কিশোরীর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে সত্য।

ওগো দেখ দেখ, ওই মাঠে কি কালো গরুটা! ঠিক যেন গয়ার পাথরবাটি। …তুড়ু দেখ দেখ, ওই পুকুরটায় কত পদ্ম ফুটেছে! ছোটবেলায় আমরা ওই পদ্ম গাদা গাদা তুলতাম। মামার বাড়ি চল, দেখাব তোকে সেই পুকুর। আচ্ছা হ্যাঁগো, ওই গাছটা কি বল তো? ঠিক ধরতে পারছি না। পাতাগুলো বেশ কেমন নতুন ধরনের। ওমা ওমা, কী চমৎকার বুনো ফুল বুনো ফুল গন্ধ এল! ঠিক আমাদের ওখানের মতন!

নিজের খুশিতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে চলেছে সত্য, স্বামী-পুত্র উপলক্ষ মাত্র।

নবকুমার হাঁ করে চেয়ে থেকে সেই মুখের দিকে।

এতদিন ঘর করছে, দু-দুটো ছেলের বাপ হল, এমন প্রকাশ্য দিনের আলোয় এত স্পষ্ট করে কবে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে পেরেছে তার লাবণ্যময়ী স্ত্রীর মুখের দিকে!

বাসায় যাওয়ার ভয়টা একটু কমে এসেছে, এখন বরং একটু একটু রোমাঞ্চময় উন্মাদনা। সেখানে গুরুজনের রক্তচক্ষুর ভয় নেই, নেই পাড়া-পড়শীর গুরুভয়।

শুধু নবকুমার আর সত্য!

চাকরির ভয়টা খুব জোর আছে। তবে ভাবতোষ মাস্টার প্রচুর ভরসা দিয়েছেন। বলেছেন নবকুমার যা ইংরিজি জানে, তার সিকি ইংরিজি শিখেও সাহেবের অফিসে কাজ করছে কত লোক। নবকুমার ঢুকতে না ঢুকতে সায়েবের নেকনজরে পড়ে যাবে নির্ঘাত। আরো বলেছেন, গ্রামে পড়ে থেকে জমিজমার উপস্বত্বে জীবন কাটানোর ইচ্ছেটা এ যুগে অচল ইচ্ছে।

কলকাতায় গিয়ে দুটো কামিজ করাতে হবে আর একজোড়া সু-জুতো। এ নইলে তো আর অফিসে যাওয়া যাবে না।

ভবতোষ তাদের জন্যে একটা বাসাও ঠিক করে রেখেছেন নাকি। নিজে তিনি মেসে থাকেন, কিন্তু নবকুমারের তো তা চলবে না। সে যখন ফ্যামিলি নিয়ে যাচ্ছে। নিতাইটার মন্দ কপাল। ওর বৌকে বাসায় আনতে পারবে না। নিতাইয়ের মামা বলেছেন, বৌ কলকাতার বাসায় গেলে তার হাতে আর তাদের খাওয়া চলবে না।

এত বড় শাস্তির ভয় তুচ্ছ করে বরের সঙ্গে বাসায় যাবে এত সাহস নাকি নিতাইয়ের বৌয়ের নেই।

অতএব নিতাইকেও নবকুমারের হাঁড়িতে জায়গা দিতে হবে। বৌটাকে যদি আনতে পারত নিতাই! বেশ দুটো বৌতে থাকত একসঙ্গে। হোক বামুন-কায়েত, কেউ কারুর ভাতের হাঁড়ি নাড়তে না যাক, দুজনে একত্রে বসা, গল্প করা, চুল বাধা, পান সাজা, এসব তো করতে পারত।

তা হবার জো নেই।

বেচারী নিতাইটাকে তাদেরই একটু যত্ন-আত্তি করতে হবে।

ভবতোষ বলেছেন, খুব খাসা বাড়ি। তিন-চারখানা ঘর, মস্ত দরদালান। রান্নাঘর, ভাড়ারঘর, উঠোন, কুয়োতলা। জলের কলও নাকি আছে। বাড়ির ভেতরে নয়, দরজার কাছে। থাক। তার জল খেয়ে জাতজন্ম না খোয়ানোই ভাল, কুয়োর জল যখন আছে!

সে যা হয় হবে।

প্রধান কথা ভাড়া। বড্ডই গায়ে লাগবে। বাপের কাছ থেকে তো আর টাকা চাইতে যাবে না নবকুমার!

কিন্তু ভবতোষ বলেছেন, কলকাতায় ও-রকম বাড়ি দশ টাকাতেও সহজে মেলে না, নেহাত বাড়িটা ভবতোষের এক বন্ধুর বাড়ি বলেই আট টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

হোক।

নবকুমার তো তেমনি মাইনেও পাচ্ছে আটান্ন টাকা! এত বড় মোটা মাইনের চাকুরের পক্ষে ওতে কাতর হওয়া ঠিক নয়।

যাক তাই হোক।

তা বলে নিতাইয়ের প্রস্তাব সে নেবে না! নিতাই বলেছে, ভাড়ার ভাগ দেবে। না, ছিঃ! নবকুমারের এত বন্ধু নিতাই, তাই কখনো নেওয়া যায়?

কিন্তু কে জানে সেখানে সত্যর মেজাজ কেমন থাকবে! এখানে তো ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট, সেখানে যতই হোক নিতাই একটা পর ছেলে! সত্য যদি তার সামনে মেজাজ দেখায়!

নাঃ, তা বোধ হয় করবে না।

সেদিকে সভ্য আছে।

এখন কবে সেই দিনটি আসে! যবে সেই অজানা অচেনা দরদালানে বসে দুই বন্ধু অফিসের ভাত খাবে! আর সত্য এলোচুল দুলিয়ে কোমরে কাপড় জড়িয়ে ছুটোছুটি করে রান্না করবে! পরিবেশন করবে!

এই সমস্তই সম্ভব হবে সত্যর শক্তিতে।

বিগলিত প্রেমে সত্যর দিকে তাকিয়ে দেখে নবকুমার।

কিন্তু সত্যর তখনও দৃষ্টি লক্ষ্যভেদী, নাসারন্ধ্র স্ফীত, সমস্ত চেতনা একাগ্র। সহসা চেঁচিয়ে ওঠে সে, ওই তো, ওই তো জটা-দাদাদের বাড়ির চিলেকোঠা, ওই গাঙ্গুলি-কাকাদের উঠোনে বাজপড়া নারকোল গাছটাও বেহারারা, ডান দিকে ডান দিকে।

পথ দেখিয়ে দেওয়ার ভার সে নিজে নিয়েছে।

.

পালকি নামাতেই একটা বিরাট চাঞ্চল্যে ঢেউ উঠেছিল, তার পর জানা হতেই আকাশ থেকে পড়ল সবাই। না বলা না কওয়া এমন করে মেয়ে কেন উপস্থিত? এমন তো হবার কথা নয়!

কি মূর্তি নিয়ে নামছে?

কে ফেলে দিয়ে যেতে এসেছে?

ওগো না গো না!

ষড়ৈশ্বর্যময়ী রাজরাণীর বেশে এসেছে সে কার্তিক-গণেশের হাত ধরে, ভোলানাথকে সঙ্গে করে!

মন কেমন করছিল তাই দেখতে এসেছে বাপকে, বাপের বাড়ির সবাইকে। এসেছে জন্মভূমিকে দেখতে।

বারবাড়ির কলরোল মিটিয়ে অন্দরমহলের দিকে এগোল সত্য, চারিদিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে।

আর যেই ভেতর-বাড়ির উঠোনে পা ফেলল, তুমুল একটা কান্নার রোল উঠল। বিলাপধ্বনি মিশ্রিত রোল।

আলাদা করে বোঝবার উপায় নেই গলা কার। ঐকতান বাদন। বাড়ির সকলের সঙ্গে পাড়ার মহিলারও যোগ দিয়েছেন অনেকে।

কিন্তু নতুন কার জন্যে বিলাপ? ভুবনেশ্বরীর ঘটনা তো অনেক দিনের হয়ে গেছে।

না, বিশেষ কারও জন্যে বিলাপ নয়, আর সদ্য শোকের কাতরতাও নয়। খানিকটা সত্যর আবির্ভাবে আনন্দাশ্র আর বাকীটা সত্যর এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিকালের মধ্যে সংসারের যা যা শোকাবহ ঘটনা ঘটেছে, তারই ফিরিস্তি জানিয়ে নতুন করে বিলাপ-ক্রন্দন।

এই ক্রন্দনরোলের মাঝখানে দিশেহারা সত্য ছেলে দুটোর হাত ধরে উঠোনের একধারেই দাঁড়িয়ে থাকে, আর বারবাড়িতে নবকুমার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে উৎকর্ণ হয়ে বসে থাকে। সামনে শ্বশুর বসে, কিন্তু তাকে প্রশ্ন করবে এত বুকের পাটা নবকুমারের নেই। সেই যে প্রণাম করে ঘাড় হেট করে বসেছে, বসেই আছে।

তা ছাড়া তিনি তো দেখা যাচ্ছে নির্বিকার। বাড়ির মধ্যে এত বড় ক্রন্দনরোল যখন ওঁকে তিলমাত্র বিচলিত করতে পারছে না, তখন ব্যাপারটায় গুরুত্ব নেই বলেই মনে হচ্ছে।

নবকুমারও পাড়াগাঁয়ের ছেলে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে কান্নাকাটির ঘটনা তার একেবারে অজানা নয়, তাই ক্রমশ সে নিশ্চিন্তে হয় আর রোলটাও আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে।

ঈষৎ নড়েচড়ে রামকালীই কথা বলেন।

কখন বেরিয়েছ?

আজ্ঞে–! নবকুমার চমকে তাকায়।

রামকালী তাকিয়ে দেখেন। একটি স্বাস্থ্যবান সুকান্তি পুরুষের দেহে এখনো যেন একখানা লাজুক কিশোরের মুখ! সুন্দর সুকুমার, কিন্তু বুদ্ধির ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে মনে মৃদু আক্ষেপের হাসি হাসেন। একে স্নেহ করা যায়, ভরসা করা যায় না। হয়তো এই জন্যেই ভগবান সত্যকে অমন দৃঢ় মজবুত করে গড়েছেন, ও লতার মত আশ্রয় চাইবে না, বনস্পতির মত আশ্রয় দেবে।

একটা নিঃশ্বাস পড়ল।

মনে করলেন সত্যর কপালে চির দুঃখ। রামকালীর মেয়ে রামকালীর ললাটলিপিই পেয়েছে। কত দুঃখী রামকালী! কত সুখী ছিল ভুবনেশ্বরী!

আগে স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি রামকালী, এমন করে কখনো ভাববেন, নিজেকে কখনো দুঃখীর কোটায় ফেলবেন।

নবকুমারের ওই তটস্থ সুরের “আজ্ঞে” শুনে রামকালী মৃদু হেসে আর একবার বললেন, কতক্ষণ বেরিয়েছ?

আজ্ঞে, সেই প্রাতঃকালে দুটো ফেনাভাত খেয়েই

কথাটা বলেই বোধ করি নিজের বেকুবিটা বুঝতে পারে নবকুমার, প্রাতঃকাল কে আরও মোক্ষম করে বোঝাবার জন্যে ওই ফেনাভাতের প্রসঙ্গটা না আনলেই হত। প্রাতঃকালই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মুখের কথা হাতের ঢিল!

রামকালী ব্যস্ত হয়ে বলেন, সেকি! এতটা সময় লেগেছে। তা হলে তো–না না, আর বসে থাকা নয়। শীঘ্রই হাতমুখ ধুয়ে

নবকুমার এবার কিঞ্চিৎ স্পষ্ট গলায় বলে, না না, ব্যস্ত হবেন না। পথে পালকি নামিয়ে আহার হয়েছে। সঙ্গে জলপান ছিল।

তা হোক। বেলা পড়ে এসেছে। ওরে কে আছিস?

একসঙ্গে অনেকগুলো নানা বয়সের ছেলে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এরা আশেপাশে উঁকিঝুঁকি মারছিল, শুধু সামনে আসতে ভরসা পাচ্ছিল না।

রামকালী বলেন, অন্দরে গিয়ে বল গে, বাবাজীর হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করতে।

হাতমুখ ধোয়াটা একটা সাঙ্কেতিক শব্দ। মূল অর্থ জলখাবারের ব্যবস্থা করা। ওরা দু-একজন ব্যস্ত হয়ে চলে যায়, দু-একজন দাঁড়িয়ে থাকে। আর কে একজন খপ করে বলে বসে, জামাইবাবুর কী মজা! কেন কলকাতার বাসায় গিয়ে থাকবে!

রামকালী ঈষৎ চমকে ওঠেন।

ভাবেন, এটা আবার কি কথা!

সত্য তো ঘোমটা ঢাকা অবস্থায় একটা প্রণাম করেই ভেতরে চলে গেছে, নবকুমারের সামনে বাপের সঙ্গে কথা বলে নি, তা ছাড়া ছিল পাড়াপড়শীর হুল্লোড়।

নবকুমার মেয়েদের মত লজ্জার ভান করে বসে আছে। রামকালী ঈষৎ কৌতুকের স্বরে বলেন, কলকাতার বাসার কথা কি বলছে?

প্রশ্নটা নবকুমারকে।

নবকুমার উত্তর না দিয়ে পারে না। তাই আস্তে আস্তে বলে, হ্যাঁ, সেই রকমই স্থির হয়েছে।

শুনে সুখী হচ্ছি। এখন কলকাতায় উন্নতির নানাবিধ পন্থা হয়েছে। কোনও কর্মের চেষ্টা হয়েছে নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। মাস্টারমশাই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

রামকালীর জামাতা, তাই কর্তব্যবোধেই প্রশ্ন করেন রামকালী, কোথায়?

ইয়ে, আ-আজ্ঞে সরকারী দপ্তরে।

সুখের কথা। তা কোথায় থাকবার ঠিক করেছ? মেসে?

আজ্ঞে না। বাসায়। মাস্টারমশাই বাসাও ঠিক করে দিয়েছেন।

রামকালী অবশ্য বেতন কত তা জিজ্ঞেস করেন না, শুধু সামান্য চিন্তিত স্বরে বলেন, তা হলে তো পাঁচকের ব্যবস্থা করতে হবে। একা বাসা নিয়ে–

নবকুমার আর বেশীক্ষণ লজ্জা বজায় রাখতে পারে না, পুলক গোপনের উচ্ছ্বসিত আভা মুখে মেখে বলে ওঠে, পাচকের দরকার হবে না। তুড়ু খোকার মা, ইয়ে, আপনার মেয়েই তো যাচ্ছে!

আমার মেয়ে! সত্য! সত্য! কলকাতায় বাসায় যাচ্ছে!

নবকুমার থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। বুঝতে পারে না রামকালীর এই স্বরটা ঠিক কোন ভাবব্যঞ্জক। একটু যেন বিচলিত মনে হল না?

হ্যাঁ, কিঞ্চিত বিচলিত হয়েছেন রামকালী।

অনেকদিন আগের একদিনের কথা মনে পড়ে গেছে।

বালিকামূর্তি নিয়ে সত্য ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। আর তার সামনে ভেসে উঠেছে আর একখানা ভয়ব্যাকুল মুখ। সেই মুখের সামনে আঙুল তুলে বলছে সত্য, তোমার যে এত ভয় কিসের মা! এই তুমি দেখে নিও, কলকাতায় আমি যাব, যাব, যাব!

সত্য তার প্রতিজ্ঞা রাখছে, কিন্তু তা দেখে গর্বে আনন্দে বিস্ময়ে পুলকে কে মুগ্ধ হবে?

নিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, সাহস করতে পারছে সুখের বিষয়। তা তোমার মাতাপিতার ব্যবস্থা?

দিদি আছে। পড়শীরা আছে।

হু। তা ওঁরা আপত্তি করলেন না?

এবার আর নিজেকে সংবরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে নবকুমারের। প্রায় একগাল হেসে ফেলে বলে, আপত্তি কি আর তারা না করেছেন। কিন্তু আপত্তি টিকলে তো? এ ধুয়ো ধরল, ছেলেদের ভাল ইস্কুলে পড়ানো চাই! বুদ্ধির রাজা তো!

ওর ওই উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে সহসা ওর ওপর ভারী একটা স্নেহ অনুভব করলেন রামকালী। অন্দরে পাঠিয়ে দিলেন নবকুমারকে।

.

অন্দরের অবস্থা তখন হাস্যমুখর। সত্যর ছেলেদের নিয়ে ঠাট্টা-আমোদ চলছে দিদিমা সম্পর্কীয়াদের। সত্যকে ঘিরে বসেছে বাকী সবাই।

রাসুর নতুন বৌ, শিবজায়ার আইবুড়ো নাতনীরা, রাসুর দুই ভাদ্রবৌ আর ভাগ্নী দুটো এবং পড়শীবাড়ির নবীন-প্রবীণার দল। মোক্ষদার বেশী কথা বলার ক্ষমতা আর নেই, তবু আসরের একপাশে বসে আছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। শুধু সারদা এ আসরে অনুপস্থিত। সারদার মরবার সময় নেই।

তার ঔদাসীন্যের কাছে সত্যর নতুনত্ব, অপূর্ব, বৈচিত্র্যের বহুমুখিত্ত্ব, সব কিছুই পরাস্ত মেনেছে।

কিন্তু আর সবাই তো সারদা নয়, তাই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নিজে আর কাউকে কোনও প্রশ্ন করবার সময় পাচ্ছে না সত্য। অথচ সে তো নিজেকে দেখাতে আসেনি, সবাইকে দেখতে এসেছে।

কিন্তু কৌতূহল যে সকলেই অদম্য। দু-দুটো ছেলে হয়ে গেল, তারা ডাগরটি হল, যোগাযোগ তো নেই। ওরা অবিশ্যি ছেলেদের অন্নপ্রাশনে বলে পাঠিয়েছিল, কিন্তু রামকালী তো তখন তীর্থে ঘুরছেন। তবে ফিরে এসে তো কই—?

কিন্তু এত দিন কেন আসে নি সত্য আর এখন এমনই হুট করে এল কেন, এ প্রশ্ন চাপা পড়ে গেল। এখন প্রশ্ন কলকাতার বাসা! সেইখানেই সহস্র কৌতূহলের প্রশ্ন। কে সাহস দিল সত্যকে? কে দেখবে সেখানে সত্যকে? শ্বশুর-শাশুড়ী বেঁচে থাকতে বরের সঙ্গে বাসায় যাবার পরিকল্পনটা তার মাথায় এলোই বা কি করে, আর তাদের অনুমতিই বা পেল কোন্ অলৌকিক সাধনার জোরে?

তা ছাড়া

গেলে জাত যাবে কিনা, ম্লেচ্ছর জল খেতে হবে কিনা, জুতো মোজা পরতে হবে কিনা, বরের সঙ্গে “ল্যাণ্ডে ফেটিং” চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতে বাধ্য হতে হবে কিনা ইত্যাদি বহুবিধ খাপছাড়া প্রশ্ন তো আছেই।

অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত সত্য এক সময় বলে ওঠে, বাব্বাঃ! নিজের পাঁচালীই গাইলাম এই অবধি, তোমাদের খবরাখবর কিছু শুনতে দাও?

মোক্ষদা ক্লান্ত আর্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, আমাদের আবার খবর! যারা মরে নি তারা এখনো বিধাতার অন্নজল ধ্বংসাচ্ছে এই খবর।

বাঃ, ও কি কথা!

ঠিক কথাই বলেছি সত্য। চিরটাকাল তোকে মুখ, করেছি, ভেবেছি হাড়ির হাল হবে তোর। এখন দেখছি তুই-ই টেক্কা মারলি! তুই-ই দেখালি! বেশ করেছিস এ মতলব করেছিস। এখন সবাই বলছে ইংরিজি বিদ্যের জয়জয়কার। ছেলে দুটোকে যদি কলকেতায় ইংরিজি ইস্কুলে দিতে পারিস

শিবজায়া সম্প্রতি বিধবা হয়েছেন এবং কিছুক্ষণ আগে গগণভেদী চিৎকার করে সত্যকে বুঝিয়েছেন, সত্যর মা পরম পুণ্যবতী ছিল, মরে পুণ্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছে এবং জগতে যে যেখানে শাঁখা-নোয়ার গৌরব নিয়ে এখনো টিকে আছে, তারা যেন এই বেলা সেই গৌরব বজায় থাকতে পৃথিবী থেকে সরে পড়ে। এখন শিবজায়া মুখে কাপড় ঢাকা দিয়ে শুয়েছিলেন পোড়ামুখ কাউকে দেখাবেন না বলে।

কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দিনী মোক্ষদার এই বাক্য শুনেই তাঁর নির্বেদ ভঙ্গ হল। মুখের কাপড় সরিয়ে বলে উঠলেন, বললে ভাল ছোটঠাকুরঝি! জন্ম গেল ছেলে খেয়ে, আজ বলছে ডান! বলি একাল সেকাল সবাইয়ের বাংলা সমসক্রিত’য় চলল, বেশী বিদ্যান হল তো ফার্সি, আর এখন ওই মেলেচ্ছ ভাষা না শিখলে আর

ফার্সিটাও মেলেচ্ছ ভাষা সেজবৌ!

ওমা শোন কথা! জন্মকাল ফাসি’র কথা শুনে এলাম, কই কখনো তো শুনি নি মেলচ্ছ ভাষা!

সত্য এবার কথা বলে, থাক পিসঠাকুমা ওসব জাত থাকা জাত যাওয়ার গপ্পো! ও তোমার যা যাবার সে যাবেই। তা কে রুখতে পারবে? ও কথা ছাড়ো। তোমার এমন হাল হল কি করে তাই বল? এত তীর্থধর্ম করে হাওয়া বদল করে এসেছ, শরীর তো ভাল হবার কথা!

আর ভাল!

মোক্ষদা জিভে একটা শব্দ করেন, আমার ভাল একেবারে সেই যমরাজ এলে তবে। বর তো কখনো চোখে দেখি নি, ওই যম বরের চতুদ্দোলাতে চড়েই যাব। তবে একালে ভাল আর কজন আছে? সেই সেবারও যে গা দেখেছিস সে আর নেই। মানুষের দেবদ্বিজে ভক্তি যাচ্ছে, গুরুলঘু জ্ঞান যাচ্ছে, মানুষ মনিষত্ব সব ঘুচেছে। দেখবি, ঘুরে ঘুরে দেখবি তো? দেখিস সুখ পাবি না।

.

দিন সাতেক থাকার পর ফিরতিপথে অনবরত সেই কথাই ভাবতে ভাবতে চলে সত্য। ভাবে আর মনে মনে বলে, দেখেছি পিসঠাকুমা, দেখে বুঝেছি তোমার কথাই ঠিক। সুখ পেলাম না। সেই আগের গা আর নেই। নেই আগের সুখ আনন্দ তৃপ্তি।

এবারও ছেলেবেলাকার খেলার জায়গাগুলোয় গিয়ে গিয়ে বসে দেখেছে সত্য, চেষ্টা করেছে আগের দিনের সুর বাঁধতে, কিন্তু পারে নি। শেষ পর্যন্ত সেটা হাস্যকর হয়ে উঠেছে। ছেলেদের দেখাবে বলে ফট করে একদিন গাছে চড়তে গিয়েছিল, ছেলেরাই এমন হাঁ হাঁ করে উঠল যে নেম আসতে হল। সেই সাঁতারের পীঠস্থান বড় দীঘিতে গিয়ে সাঁতার দিয়েছে, সুখ পায় নি। নোনা আতা আর নোড় কুড়োতে গিয়ে কেমন যেন পাগলামি মনে হয়েছে, তবু কুড়িয়ে এনে ঘেঁচে আচার করবে বলে রেখে দিয়ে ফেলে রেখেছে। বুঝেছে সুখ পাবে না ওতে।

সুখ তো সবটা নিয়ে।

সেই সবটা, সম্পূর্ণটা, অখণ্ডটা কোথায়? কোথায় সেই আগের সঙ্গী-সঙ্গিনীরা?

আর কোন্‌খানে সুখ পাবে সত্য? এর মাঝখানে কোথায় খুঁজে পাবে রামকালী চাটুয্যের সেই মাঠবেড়ানো সেই দস্যি মেয়েটাকে? যাকে খুঁজে পাবার জন্যে এত তোড়জোড় করে আসা?

আর সেই মেয়েটার মা, তার ছায়াও কি থাকতে নেই? সব ধুয়ে মুছে পরিস্কার হয়ে গেছে? বদলে গেছে।

সব বদলে গেছে।

সত্যর সেই চেনা জগৎটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সত্যর আসনটি। সত্যর জন্মভূমির মাটিতে সত্য এখন আগন্তুক, বহিরাগত। এখন এখানে চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখলেও চুপ করে যেতে হয় মনে হয়, থাক! দুদিনের জন্যে এসে আর বেপরোয়া দুঃসাহসে বলতে পারা যায় না, এ বাপু তোমাদের অন্যায়ই।

নইলে এ কদিনে দেখলেও তো কম নয়। অনেক অন্যায্য ঘটনা ঘটছে এখন সংসারে। তার কারণ বাবাই যেন কেমন একটু উদাসীন হয়ে গেছেন। আগে পাড়ার ছেলেদের এতটুকু বেচাল করবার জো ছিল না, এখন বাড়ির ছেলেরাও ওঁর সামনেই যা ভয় করে, আড়ালে সমীহর বালাই নেই।

পাড়াতেই কত দেখল।

জটাধার বৌ এখন গলা তুলে শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে। আর জটাদা নাকি বৌয়ের কাছে জোরহস্ত। সত্যর মামারবাড়িতে ভাইয়ে ভাইয়ে হাঁড়ি ভেন্ন হয়ে গেছে। দু বাড়িতে দুদিন নেমন্তন্ন খেতে হয়েছে সত্যকে। তুষ্ট গয়লা পক্ষাঘাত হয়ে বিছানায় পড়ে, তুঠুর বৌ কেঁদে কেঁদে লোকের দোর-দোর ঘুরছে, কিন্তু কেউ আর ওর কাছে ঘি-দুধ নেওয়ার গা করছে না, টালবাহানা করে অন্যের কাছে নিচ্ছে। বলে কিনা, তুষ্টুর বৌয়ের পাতা দই? মুখে করা যায় না। তুষ্টুর বৌ আবার ঘি তৈরি করতে শিখল কবে?

জিনিস একটু যদি নীরেসই হয়, তা বলে চিরদিনের লোকটার দুঃখ-কষ্টর সময় দেখবে না? মানুষ আর জন্তু-জানোয়ারের তবে তফাৎ কি?

লুকিয়ে দুটো টাকা দিয়ে এসেছিল সত্য তুষ্টুকে, তুষ্টুর চোখ দিয়ে জল পড়েছিল। বলেছিল, বাপের মতন মনটি। কবরেজ মশাই আছেন, তাই এখনো বেঁচে আছি।

কুমোর-জেঠা, কামার-খুড়ো, ধোপাপিসি কারুর সঙ্গে দেখা করতে বাকি রাখেনি সত্য, কিন্তু আগের মতন কেউ সহাস্যে বলে নি, এসেছিল? আয় বোস।

আসন পেতে দিয়ে বলেছে, আসুন দিদিঠাকরুণ, বসুন।

আশ্চর্য, একসঙ্গে সবাই কি করে বদলে গেল?

.

বদলায় নি শুধু গ্রামটা। বদলায় নি গাছপালা মাঠ বন দীঘি পুকুর। এরাই শুধু উচ্ছ্বসিত আনন্দে স্বাগত জানিয়েছে মাথা নেড়ে নেড়ে, কোলাহল করে করে। আবার বিদায়কালে তারাই বিষণ্ণ বিধুর দৃষ্টি মেলে মৌন বেদনার মত তাকিয়ে থেকেছে।

এরাই শুধু বদলায় নি।

কিন্তু ওদের কাছে আর কতটুকু আশ্রয়? আশ্রয় চায় হৃদয়ের কাছে, প্রাণোত্তাপের কাছে। কোথায় সেই উত্তাপ? সকলেই ভাল করে যত্ন করেছে আর বলেছে, ওরে বাবা, দুদিনের জন্য এসেছ! কেউ বলে নি, তুই যে আমাদের চিরদিনের!

সত্যর মা বেঁচে থাকলে কি অন্য রকম হত না? মার কাছে কি সত্যর সেই শৈশবটি সোনার কৌটায় তোলা থাকত না? সত্য এসে দাঁড়ালে মা সেই কৌটোটি খুলে ধরে হাসিমুখে বলত না, এই দেখ কিছু হারায় নি তোর। সব আছে। আমি তুলে রেখেছি।

তা হলে হয়তো সত্যর সেই পুতুলের বাক্সটাকেও এসে দেখতে পেত সত্য। মা বলত, এই দেখ, তোর হাতের কাপড় পরানো এই তোর বড়বৌ, মেজবৌ, ন’বৌ’ সেবারে এসে যেমন রেখে গিয়েছিলি তেমনই আছে।

হ্যাঁ, ঠাকুমার শ্রাদ্ধে এসে সেবারে নিজের ফেলে যাওয়া পুতুলবাক্স সাজিয়েছিল সত্য, তারপর তো তার নিজেরই জীবনের মধ্যে এল পুতুল ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনা। …মাটির পুতুলের কথা আর কে ভেবেছে!

সত্য হয়ত মার ছেলেমানুষিতে হাসত। তবু সুখ পেত। মা না থাকলে বাপের বাড়ি এসে সুখ নেই। নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল সত্য। অত বড় সংসারের মধ্যে সেই মানুষটাকে, অনেকের মধ্যে একজন মাত্র ছাড়া আর তো কোনদিন কিছু ভাবে নি। হঠাৎ আজ ধরা পড়েছে, সেই একজন ছাড়া সমস্ত অনেকেই অর্থহীন।

তবু ওরই মধ্যে পিস্ঠাকুমার কাছে দুদণ্ড বসলে প্রাণটা ঠাণ্ডা হত। কিন্তু সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটার এত দুরবস্থা হয়েছে যে দেখলে প্রাণটা ফাটে।

সত্য বলেছিল, অতিরিক্ত খেটেখেটেই তুমি এমনি করে দেহ ভেঙেছ পিঠাকুমা! তোমার সেই শরীর-স্বাস্থ্য এই কবছরে এমনি হয়েছে?

মোক্ষদা ধিক্কারের হাসি হেসে বলেছেন, অতিরিক্ত যদি না খাটব তো সেই ভূতের মত আঁকড়া গতর নিয়ে করতাম কি বল? ভেতরের ভূতই রাত-দিন ছুটিয়ে মারত!

আর এখন যে সেই ভূত তোমাকেই জীর্ণ করে ফেলল!

মরুক গে। যে কদিন পৃথিবীর অনুজলের বরাত আছে গড়িয়ে গড়িয়ে বাঁচবই। তারপর যে পারবে সে মুখে এক মুড়ো আগুন দিয়ে চিতেয় তুলে দেবে। যার ছেদ্দায় আসবে সে এক মুঠো পিণ্ডি দেবে। যার জন্য একটা দিন অশৌচ পালবার কেউ নেই, তার আবার বাঁচা-মরা!

সত্য ব্যথিত হয়ে বলেছিল, বাবাই তোমার সব করবে পিঠাকুমা।

মোক্ষদা উদাস কণ্ঠে বলেছিলেন, তা অবিশ্যি করবেন। রামকালী মহৎ মানুষ, হয়তো মায়ের মতন করেই পিসির ছেরাদ্দ করবেন, তবু মনে মনে তো জানবেন যা করছি বাহুল্য করছি, ভিক্ষে দিচ্ছি।

আশ্চর্য!

মোক্ষদাকে দেখে আগে কি কেউ কখনো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছে, এ সংসার মোক্ষদার নিজের নয়? এখানে মোক্ষদার জন্যে তেরাত্তির অশৌচ পালবার মতও কেউ নেই? মোক্ষদা মরলে যে তার মুখে আগুন দেবে, পিণ্ডি দেবে, সে দয়া করেই দেবে? মোক্ষদার প্রাপ্য পাওনা বলে দেবে না?

অত দাপট তবে কোন ভিতের ওপর খাড়া ছিল। নাকি কোথাও কোনও ভিত ছিল না বলেই ফোপরা দাপটটা অত বড় করে তুলে ধরতেন মোক্ষদা? জানতেন হাতটা একটু শিথিল হলেই মুহূর্তে ভূমিসাৎ হয়ে যাবে ফাঁকা ইমারত?

ভাবতে ভাবতে—

ছেলে দুটোকে একটু কাছে টেনে নিয়ে বসল সত্য। এরাই জোর, এরাই ইমারতের ভিত।

.

সারদাকে বুঝতে পারে নি সত্য।

নাগালই পায় নি সারদার।

অবিশ্যি সারদাই সর্বদা খাইয়েছে, মাখিয়েছে, যত্ন করেছে। সত্য ছেলেবেলায় যা যা খেতে ভালবাসত সেগুলি মনে করে বেঁধে দিয়েছে, হেসে হেসে বলেছে, বুঝলি তুড়ু, তোর দাদামশাইয়ের সংসারে এ হেন জিনিস মজুত থাকতে তোর মার রুচি পছন্দ ছিল পুঁইমেটুলি ভাজা, শশাপাতার বড়া, তেতো পুঁটির টক!

কিন্তু সত্য যখন বলতে গিয়েছিল, যাই বল বৌ, খুব মহত্ত্বটা দেখিয়েছ তুমি! নতুন বৌ বলছিল, তুমি একপ্রকার দেবী তখন কেমন কঠিন হয়ে উঠেছিল সারদা। ভয়ানক তীক্ষ্ণ একটা হাসি হেসে বলেছিল, তোমার তো বুদ্ধি-সুদ্ধি আছে ঠাকুরঝি, পরের মুখে ঝাল খাচ্ছ কেন?

বুদ্ধিসুদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণ থাকা সত্ত্বেও কথাটার নিহিতার্থ ঠিক ধরতে পারে নি সত্য। আর সর্বদাই লক্ষ্য করেছে, পুরনো অন্তরঙ্গতার দরজা কিছুতেই খুলতে রাজী নয় সারদা।

আর বড়দা?

তার সঙ্গে তো কথাই কইতে ইচ্ছে হয় নি সত্যর। বড়দা যে ওই গিন্নিবান্নি সারদার স্বামী, অত বড় দুটো ছেলের বাপ, তা যেন খেয়ালেই নেই বড়দার। যেন নতুন বৌয়ের নতুন বর! তার কথা নিয়েই সত্যর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা ফষ্টি-নষ্টি! ছিঃ!

কারো সঙ্গেই যেন কথা কয়ে সুখ হয় নি।

অবিশ্যি বিদায়কালে সকলেই ব্যাকুলতা দেখিয়েছে, চোখের জল ফেলেছে, আবার কবে দেখা হবে বলে হা-হুতাশ করেছে। কেউ কেউ ডাক ছেড়েও কেঁদেছে, কিন্তু সত্যর নিজেরই যেন ভেতরের শিকড় ছিঁড়ে গেছে। তাই নিজেও সে চোখের জল ফেললেও, যে প্রাণ নিয়ে এসেছিল সে প্রাণটা নিয়ে ফিরছে না।

রামকালী তো চিরদিন সকলেই দূরের মানুষ, শুধু দুঃসাহসী সত্যই পারত সেই দূরত্বের বর্ম ভাঙতে। কিন্তু সে দুঃসাহসিক আবদার সত্য নিজেই আর করতে পারে নি। সময়ও পায় নি। সর্বদা নবকুমারকেই কাছে কাছে রেখেছেন রামকালী। আর সত্যকে টেনেছে মেয়েমহলে। তবে নবকুমারকে যে রামকালী ভালোবেসেছেন ওইটাই পরম তৃপ্তি।

আসার সময় বাপকে প্রণাম করে স্বামীর উপস্থিতি ভুলে রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠেছিল, তুমি তোমার এই দুঃসাহসী আস্পদ্দাওলা মেয়েকে ক্ষমা করেছ বাবা, সেই সাহসেই বলছি, আমি তোমার এক সন্তান, যেন সময়কালে সেবাযত্বের অধিকার পাই।

রামকালীর গলাটা কি একটু কেঁপে উঠেছিল?

চারিদিকের হা-হুতাশের শব্দে সেটা ধরতে পারে নি সত্য। শুধু কথাটাই শুনতে পেয়েছিল। মেয়ের মাথাটা ধরে একটু নাড়া দিয়ে বলে উঠেছিল রামকালী, চিরকালের পাকা বুড়ী! বাবার জন্যে তো খুব সুব্যবস্থা দিচ্ছিস! সেবার পাত্র হবই বা কেন রে?

এ কথার আর উত্তর দিতে পারেনি সত্য, সেই গভীর একটু স্নেহস্পর্শে ভেতর থেকে উথলে কান্না এসেছিল তার। কাঁদতে কাঁদতে আর কান্না চাপতে চাপতে পালকিতে উঠেছিল।

পালকিতে উঠেও তাই কথা কইতে পারে নি অনেকক্ষণ।

হঠাৎ একসময় নবকুমার বলে উঠল, তোমার বাবা আমাদের এই তুচ্ছ জগতের মানুষ নয়।

চকিত হয়ে স্বামীর দিকে তাকাল সত্য।

বাতাস লেগে লেগে ততক্ষণে গালের জলের ধারাটা শুকিয়ে উঠেছে, চোখটা জল শুকিয়ে ভারী থমথমে হয়ে রয়েছে।

নবকুমার আবার বলল, সেকালের রাজা-রাজড়াদের সব যেমন ভাব ছিল তেমনি ভাব। ভয়ও যত করে ভক্তিও তত আসে। এমন বাপ পাওয়া পরম পুণ্যি।

সত্যর মুখের কাছে একবার আসে, তবু তুমি দেখছ ভাঙা রাসের ঠাকুর! আগের মানুষকে যদি দেখতে! এমন মন ভেঙেছে, শরীর ভেঙেছে! কিন্তু বেদনাবিধুর চিত্তে অত কথা বলতে ইচ্ছে হয়। শুধু আস্তে বলে, মা থাকতে তো দেখলে না! মাকেও দেখলে না! এই আক্ষেপটা রয়ে গেল।

মনে মনে বলে, দেখ কেন আমি বাপের গরবে গরবিনী!

কিন্তু তবু মেয়েসন্তান।

বাপের সে গরব শুধু মনের মধ্যে তুলে রাখবার। সে গৌরবে অধিকার নেই ভোগের দাবী নেই। ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, ছেড়ে থাকতে হবে। সেই গৌরবের ছায়ায় বসে জীবনকে ধন্য করবার উপায় নেই; জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবার পথ নেই। ভগবান, কেন এই পোড়া সমাজ গড়েছিলে?

সমাজের ব্যাপারে ভগবানকেই দোষ দেয় সত্য। তারপর বাইরের মৌন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, বিদেয় নিচ্ছি তোমাদের কাছে। হয়তো বা জন্মের শোধ। পা বাড়াচ্ছি অকূলের দিকে। এখন দেখি জিতি কি হারি! রামকালী চাটুয্যের মেয়ে, যদি হারেও, তবু হার মানবে না।

.

বারুইপুর ফিরে এসেই কলকাতায় যাওয়ার তোড়জোড়। যাত্রাকালে মা বাপ কেউই কথা বললেন না, ঠিক যাত্রাকালে তো বাড়ি থেকে বেরিয়েই গেলেন, যা কিছু করলো সদু।

কিন্তু আশ্চর্য, নবকুমার যেন এই বিরাট লোকসানটাকে আর লোকসান বলে মনে করছে না। রামকালীকে দেখে এসে পর্যন্ত ‘বাপ’ সম্পর্কে যে একটা উঁচু ধারণা তার জন্মেছে, তার সঙ্গে নীলাম্বরের এই মেয়ে-সংকীর্ণতা যেন বড় বেশী দৃষ্টিকটু লাগলো তার। ইচ্ছে হচ্ছিল মা-বাপের এই দুর্ব্যবহারের প্রসঙ্গ নিয়ে সত্যর সঙ্গে কিছু আলোচনা অর্থাৎ নিন্দাবাদ করে, কিন্তু সত্যর ভয়েই সাহস করল না। এগিয়ে চলল নতুন জীবনের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *