২.৪ মধ্যযুগব্যাপী থেকে আঠারো শতকের ফ্রান্স পর্যন্ত

মধ্যযুগব্যাপী থেকে আঠারো শতকের ফ্রান্স পর্যন্ত
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ৪

       নারীর অবস্থার বিবর্তন কোনো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ছিলো না। যখন ঘটতো বড় ধরনের বহিরাক্রমণ, তখন সন্দেহ দেখা দিতো সব সভ্যতা সম্বন্ধেই।রোমন আইন নিজেই পড়ে এক নতুন ভাবাদর্শের, খ্রিস্টধর্মের, প্রভাবে; এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে বর্বররা সফল হয় তাদের আইন চাপিয়ে দিতে। আর্থনীতিক, সামাজিক, ও রাজনীতিক পরিস্থিতিকে একেবারে উল্টে দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয় নারীর পরিস্থিতিতে।

খ্রিস্টীয় ভাবাদর্শ নারীপীড়নে কম ভূমিকা পালন করে নি। সন্দেহ নেই সুসমাচারে আছে একটু সদয়তার শ্বাস, যা প্রসারিত যেমন নারীদের প্রতি তেমনি কুষ্ঠরোগীদের প্রতিও; এবং সে-হীনজনেরাই, দাসেরা ও নারীরা, চরম সংরাগে আঁকড়ে ধরেছিলো এ-নতুন আইন। আদিখ্রিস্টীয় পর্বে নারীদের বেশ কিছুটা মর্যাদা দেয়া হতো, যখন তারা আত্মসমর্পণ করতো দাসত্বের কাছে; পুরুষের পাশাপাশি শহিদ হিশেবে তারাও সাক্ষ্য দিতো। কিছু উপাসনায় তারা নিতে পারতো শুধু গৌণ স্থান, ‘ডিকনিস’রা অধিকার পেতো শুধু রোগীর সেবা ও দরিদ্রদের সাহায্য করার মতো অযাজকীয় কাজের। আর বিয়েকে যদি ধরি এমন একটি প্রথা বলে যাতে দরকার পারস্পরিক বিশ্বস্ততা, তাহলে স্পষ্ট দেখা যায় যে স্ত্রীকে পুরোপুরি অধীন করা হয় স্বামীর : সেইন্ট পলের মাধ্যমে বর্বরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নারীবিদ্বেষী ইহুদি ঐতিহ্য।

সেইন্ট পল নারীদের আদেশ দেন আত্মবিলোপের ও সতর্কতার সাথে চলার; তিনি পুরোনো ও নতুন উভয় টেস্টামেন্ট অনুসারে নারীকে করেতোলেন পুরুষাধীন। ‘যেহেতু নারীর থেকে পুরুষ নয়; কিন্তু পুরুষের থেকে নারী। নারীর জন্যে পুরুষ সৃষ্টি হয় নি; কিন্তু নারী পুরুষের জন্যে’। এবং আরেক স্থানে : ‘কেননা স্বামী হচ্ছে স্ত্রীর মাথা, যেমন খ্রিস্ট হচ্ছে গির্জার মাথা… সুতরাং গির্জা যেমন খ্রিস্টের অধীনে, তেমনি নারীরা সব কিছুতে তাদের স্বামীদের অধীনে’। যে-ধর্মে দেহকে মনে করা হয় অভিশপ্ত, সেখানে নারীরা হয়ে ওঠে শয়তানের ভয়াবহতম প্রলোভন। তারতুলিয়ান লিখেছেন : ‘নারী, তুমি শয়তানের প্রবেশদ্বার। তুমি এমন একজনকে নষ্ট করেছো, যাকে শয়তানও সরাসরি আক্রমণ করার সাহস করতো না। তোমার জন্যেই ঈশ্বরের পুত্রকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে; তোমাকে সব সময় থাকতে হবে শোকে এবং ছিন্নবস্ত্রে’। সেইন্ট অ্যান্ড্রোস : ‘আদমকে পাপে প্রলুব্ধ করেছিলো হাওয়া এবং আদমপ্রলুব্ধ করে নি হাওয়াকে। এটা ন্যায়সঙ্গত ও ঠিক যে নারী তাকে মানবে প্রভু ও মালিক হিশেবে, যাকে সে পাপিষ্ঠ করেছিলো’। এবং সেইন্ট জন ক্রাইসোস্টম : ‘বন্যপশুদের মধ্যেও নারীদের মতো ক্ষতিকর কাউকে পাওয়া যায় না’। চতুর্থ শতকে যখন গির্জীয় আইন বিধিবদ্ধ হয়, বিয়েকে গণ্য করা হয় মানুষের নৈতিক দুর্বলতার প্রতি একটি স্বীকৃতিরূপে, যা খ্রিস্টীয় শুদ্ধতার সাথে অসমঞ্জস। ‘এসো আমরা হাতে তুলে নিই কুড়োল এবং বিয়ের নিষ্ফল গাছকে কেটে ফেলি গোড়া থেকে,’ লিখেছেন। সেইন্ট জেরোম। গ্রেগরি ৬-এর সময় থেকে, যখন পুরোহিতদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় কৌমার্যব্রত, অধিক প্রচণ্ডতার সাথে জোর দেয়া হতে থাকে নারীপ্রকৃতির ভয়ঙ্করতার ওপর : গির্জার সব পিতাই নিন্দা করেন নারীর হীনতাপূর্ণ অশুভ প্রকৃতির। সেইন্ট টমাস এ-ঐতিহ্যের প্রতিই ছিলেন বিশ্বস্ত, যখন তিনি ঘোষণা করেন যে নারী হচ্ছে শুধু এক ‘আকস্মিক’ ও অসম্পূর্ণ সত্তা, এক ধরনের অশুদ্ধ পুরুষ। ‘পুরুষ নারীর ওপরে, যেমন খ্রিস্ট মানুষের ওপরে,’ তিনি লিখেছেন। ‘এটা অপরিবর্তনীয় যে নারীর নিয়তিই হচ্ছে পুরুষের অধীনে বাস করা, এবং তার প্রভুর কাছে থেকে সে কোনো কর্তৃত্ব পায় নি’। তাছাড়া, গির্জীয় বিধি পণ ছাড়া নারীর জন্যে আর কোনো বৈবাহিক সুবিধার ব্যবস্থা করে নি, ফলে নারী হয়ে ওঠে আইনতভাবে অযোগ্য ও শক্তিহীন। পুরুষসুলভ পেশাগুলোই শুধু তার জন্যে বন্ধ হয়ে যায় না, এমনকি বিচারালয়ে তার সাক্ষ্য দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়, এবং তার প্রামাণিক সাক্ষ্যেরও কোনো গুরুত্ব থাকে না। গির্জার পিতাদের প্রভাব কিছুটা পড়েছিলো সম্রাটদের ওপরও। জাস্টিনিয়ানের বিধান নারীকে স্ত্রী ও মাতা হিশেবে মর্যাদা দেয়, কিন্তু তাকে এ-ভূমিকারই অধীন করে রাখে; লিঙ্গের জন্যে নয়, পরিবারের মধ্যে তার পরিস্থিতির জন্যেই নারী অর্জন করে আইনগত অযোগ্যতা। বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ হয় এবং বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে হয় প্রকাশ্যে। সন্তানদের ওপর মাতার কর্তৃত্ব পিতার সমানই থাকে; স্বামী মারা গেলে সে হয় সন্তানদের বৈধ অভিভাবক। সেনেটের ভেল্লিয়ীয় বিধি সংশোধন করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে নারী তৃতীয় পক্ষের মঙ্গলের জন্যে চুক্তি করতে পারে; তবে সে তার স্বামীর পক্ষে চুক্তি করতে পারতো না; তার পণ হয়ে ওঠে অচ্ছেদ্য–এটা হয় উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানদের প্রাপ্য বিষয়সম্পত্তি এবং তার জন্যে নিষিদ্ধ করা হয় এটা বিক্রি বা হস্তান্তরিত করা।

এসব আইন বর্বরদের অধিকৃত এলাকাগুলোতে সংস্পর্শে আসে জর্মনীয় প্রথার। শান্তিকালে জর্মনদের কোনো দলপতি থাকতো না, পরিবার ছিলোএক স্বাধীন সমাজ, যাতে নারীরা সম্পূর্ণভাবে ছিলো পুরুষের অধীন, তবে তাকে ভক্তি করা হতো, কিছু অধিকারও তার ছিলো। বিয়ে ছিলোএকপতিপত্নীক; এবং ব্যভিচারের শাস্তি ছিলো কঠোর। যুদ্ধকালে স্ত্রী স্বামীর সাথে যেতো যুদ্ধে, জীবনে ও মৃত্যুতে তার সাথে ভাগ্যের অংশী হয়ে, জানিয়েছেন তাসিতুস। নারীর নিকৃষ্টতার কারণ ছিলো তার দৈহিক দুর্বলতা, ওটি নৈতিক ছিলো না, এবং যেহেতু নারীরা ভূমিকা পালন করতো যাজিকার ও দৈবজ্ঞার, তাই তারা হয়তো ছিলো পুরুষদের থেকে শিক্ষিত।

এসব প্রথাই চলে মধ্যযুগে, নারী থাকে চূড়ান্তরূপে পিতা ও স্বামীনির্ভর। ফ্র্যাংকরা রক্ষা করতো না জর্মনীয় সতীত্ববোধ : বহুবিবাহের প্রচলন ছিলো; সম্মতি ছাড়া নারীকে বিয়ে দেয়া হতো; ছেড়ে দেয়া হতো স্বামীর খেয়ালখুশিতে; এবং তাকে গণ্য করা হতো চাকরানি বলে। আইন তাকে রক্ষা করতোজখম ও তিরষ্কার থেকে, তবে সেটা পুরুষের সম্পত্তি ও তার সন্তানদের মাতা হিশেবে। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে, একই বদল ঘটে যেমন ঘটেছেরোমে : অভিভাবকত্ব হয় রাষ্ট্রীয়, তা নিরাপত্তা দেয় নারীকে, তবে চলতে থাকে তার দাসীত্ব।

আদিমধ্যযুগের বিধ্বংসী উৎপ্লব থেকে যখন উদ্ভূত হয় সামন্তবাদ, নারীর অবস্থা হয়ে ওঠে অতিশয় অনিশ্চিত। সামন্তবাদ গোলমাল পাকিয়ে তোলে সার্বভৌমত্ব ও সম্পদের কর্তৃত্বের মধ্যে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত অধিকার ও ক্ষমতার মধ্যে। এজন্যেই এ-ব্যবস্থায় একবার উন্নতি আবার অবনতি ঘটে নারীর অবস্থার। প্রথমে, নারীর ছিলো না কোনো ব্যক্তিগত অধিকার, যেহেতু তার ছিলো না রাজনীতিক ক্ষমতা; এর কারণ হচ্ছে একাদশ শতক পর্যন্ত সামাজিক বিন্যাস প্রতিষ্ঠিত ছিলো শুধু জোরের ওপর; ফিফ ছিলো সামরিক জোরে অধিকৃত ভূসম্পত্তি, যে-শক্তি নারীদের ছিলো না। পরে, পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকলে নারী উত্তরাধিকারী হতে পারতো; স্বামীই ছিলো ওই ফিফের রক্ষক ও অধিকারী, এবং আয়ের প্রাপক; নারী ছিল ওই ফিফেরই একটা অংশ।

সামন্তরাজ্য আর পারিবারিক ব্যাপার ছিলোনা; এর মালিক ছিলো সামন্তাধিপ, এবং সে ছিলো নারীরও মালিক। সামন্তাধিপ নারীর স্বামী ঠিক করতো, এবং তার সন্তানদের মালিক হতো, স্বামী মালিক হতো না, আর সন্তানদের নিয়তি হতো এই যে তারা হয়ে উঠতো সামন্তাধিপের দাস, যারা রক্ষা করতো তার ধনসম্পদ। তার ওপর একটি স্বামী চাপিয়ে দিয়ে তার নিরাপত্তা বিধানের জন্যে নারী হতো সামন্তরাজ্যের ও সামন্তরাজ্যের প্রভুর দাসী; খুব কম সময়ই এসেছে যখন নারীর ভাগ্য এর থেকে বেশি নির্মম ছিলো। উত্তরাধিকারিণী–এটা বোঝাতো ভূমি ও দুর্গ। বারো বা তার কম বয়সে তাকে বিয়েদেয়া হতো কোনো ব্যারনের সাথে। বেশি বিয়ে মানেই ছিলো বেশি সম্পত্তি, তাই ঘনঘন রদ হতো বিয়ে, গির্জা যা ভণ্ডামোর সাথে অনুমোদন করতো। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও দূরতম সম্পর্কিত দুজনের বিয়ের বিরুদ্ধে যে নিষেধ ছিলো, তাতে সহজেই পাওয়া যেতো বিয়ে রদের অজুহাত। একাদশ শতকের অনেক নারী এভাবে ত্যাজ্য হয়েছে চার পাঁচবার করে।

বিধবা হলে নারীর কাছে প্রত্যাশা হতো যে সে অবিলম্বে ধরবে একটি নতুন প্রভু। শাঁসোঁ দ্য জেস্ত-এ দেখতে পাই যে শার্লেমেন স্পেনে নিহত তার ব্যারনদের সব বিধবাকে দলবেঁধে বিয়ে করছে; এবং অনেক মহাকাব্যে পাওয়া যায় যে রাজা বা ব্যারন স্বেচ্চাচারিতার সাথে হস্তান্তরিত করে দিচ্ছে মেয়েদের ও বিধবাদের। স্ত্রীদের চুল ধরে টেনে পেটানো হতো, কঠোর শাস্তি দেয়া হতো। নাইটদের আকর্ষণ ছিলো না নারীর প্রতি; তাদের অশ্বকেই তাদের কাছে মনে হতো বেশি মূল্যবান। শাঁসোঁ দ্য জেস্ত-এ তরুণীরাই সব সময় প্রণয়ে উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তাদের কাছে চাওয়া হতো একপক্ষীয়একনিষ্ঠতা। কঠোর শারীরিক কাজের মধ্যে রূঢ়ভাবে লালনপালন করা হতো বালিকাদের, এবং দেয়া হতো না কোনো শিক্ষা। বড়ো হয়ে তারা শিকার করতো বন্যপশু, বিপজ্জনক তীর্থযাত্রা করতো, প্রভু রাজ্যের বাইরে থাকলে রক্ষা করতো ফিফ। এ-প্রভুপত্নীদের কেউ কেউ পুরুষদের মতোই হতো লোলুপ, দুরাচারী, নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী; তাদের হিংস্রতার নানা ভয়াবহ গল্প ছড়িয়ে আছে। তবে এগুলো ব্যতিক্রম; সাধারণত প্রভুপত্নীরা জীবন কাটাতে চরকা কেটে, উপাসনা করে, পতির অপেক্ষায় থেকে, এবং অবসাদে মরে গিয়ে।

দ্বাদশ শতকে মিদিতে ‘নাইটসুলভ প্রেম’-এর আবির্ভাব হয়তো নারীর ভাগ্যকে একটু কোমল করে তুলেছিলো, এর উদ্ভব যেভাবেই হোক, প্রভুপত্নী ও তার তরুণ ভৃত্যের সম্পর্ক থেকেই হোক বা হোক কুমারীউপাসনা থেকে বা হোক সাধারণ ঈশ্বরপ্রীতি থেকে। ভদ্র প্রেমের ব্যাপারটি কখনো বাস্তবে ছিলো কি না সন্দেহ, তবে এটা নিশ্চিত যে গির্জা ত্রাতার মাতৃপুজোকে এমন এক স্তরে উন্নীত করেছিলো যে বলা যায় এয়োদশ শতকে ঈশ্বরকে পরিণত করা হয়েছিলো নারীতে। অভিজাত নারীদের স্বচ্ছল জীবনে সুযোগ আসে আলাপচারিতার, ভদ্ৰ আচরণের এবং ঘটে কবিতার বিকাশ। আকুইতেনের এলিনোর ও নাভারের ব্লাশের মতো বিদুষীরা পৃষ্ঠপোষকতা করেন কবিদের, এবং সংস্কৃতির বিপুল বিকাশ নারীদের দেয় এক নতুন মর্যাদা। নাইটসুলভ প্রেমকে অনেক সময় প্লাতোয়ী প্রেম বলে গণ্য করা হয়েছে; কিন্তু সত্য হচ্ছে সামন্ত স্বামীরা ছিলো কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরাচারী, এবং স্ত্রীরা খুঁজতো পরকীয়প্রেমিক; নাইটসুলভ প্রেম ছিলো অপরিহার্য লোকাচারের বর্বরতার এক ধরনের ক্ষতিপূরণ। যেমন এঙ্গেলস বলেছেন, ‘প্রেম, শব্দটির আধুনিক অর্থে, উদ্ভূত হয়েছিলো প্রাচীন কালে প্রথাবদ্ধ সমাজের বাইরে। যৌন প্রেমের খোঁজে যেখানে থামে প্রাচীন কাল সেখানেই শুরু হয় মধ্যযুগ : ব্যভিচার’। যে-পর্যন্ত বিবাহপ্রথা টিকে থাকবে ততোদিন পর্যন্ত প্রেম ধরবে ওই রূপই।

তবে সামন্তবাদ যখন শেষ হয়ে আসে, তখন নাইটসুলভ প্রেম নয়, ধর্ম নয়, কবিতাও নয়, অন্য কিছু কারণ কিছুটা প্রতিষ্ঠা দেয় নারীদের। রাজকীয় ক্ষমতা বাড়ার সাথে সামন্ত প্রভুরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে তাদের কর্তৃত্ব, হারিয়ে ফেলে তাদের ভৃত্যদের বিয়ে দেয়ার ক্ষমতা এবং তাদের সন্তানদের সম্পদ খরচের অধিকার। যখন থেকে ফিফ রাজাকে সামরিক সাহায্য দেয়ার বদলে অর্থ দিতে শুরু করে, তখন থেকে এটা হয়ে ওঠে নিছক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি সম্পত্তি, এবং দু-লিঙ্গকে সমভাবে না দেখার আর কোনো কারণ থাকে না। ফ্রান্সে কুমারী ও বিধবা নারীদের ছিলোপুরুষদের মতো সমস্ত অধিকার; ফিফের স্বত্বাধিকারী হিশেবে নারী বিচারকার্য করতো, চুক্তিতে স্বাক্ষর করতো, আইন জারি করতো। এমনকি সে সামরিক দায়িত্বও পালন করতো, পরিচালনা করতো সৈন্য ও যুদ্ধে অংশ নিতো : জোয়ান অফ আর্কের আগেও ছিলো নারী সৈনিক, এবং যদিও এ-তরুণী বিস্ময়জাগিয়েছিলো, সে কোনো কেলেঙ্কারি সৃষ্টি করে নি।

এতো সব ব্যাপার সম্মিলিত হয়েছিলো নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে ওগুলো একসাথে লোপ করা হয় নি। শারীরিক দুর্বলতা আর বিবেচনার বিষয়ছিলো না, তবে বিবাহিত নারীর অধীনতা সমাজের কাছে মঙ্গলজনক বলে মনে হয়। তাই সামন্তবাদ চলে যাওয়ার পরেও বৈবাহিক কর্তৃত্ব টিকে থাকে। দেখতে পাই একই অসঙ্গতি, যা টিকে আছে আজো : যে-নারী সমাজের সাথে সম্পূর্ণরূপে সংহত, তারই সুযোগসুবিধা সবচেয়ে কম। নাগরিক সামন্তবাদে বিয়ে তা-ই রয়ে যায়, যা ছিলো সামরিক সামন্তবাদে : স্বামী তখনও ছিলো স্ত্রীর অভিভাবক। যখন বুর্জোয়ারা দেখা দেয়, তারাও মেনে চলে একই আইন; মেয়ে ও বিধবার পুরুষের মতো একই অধিকার; কিন্তু বিয়ে হলেই নারী হয়ে ওঠে প্রতিপাল্য, যাকে পেটানো যায়, যার আচারব্যবহারের ওপর সারাক্ষণ চোখ রাখতে হবে, এবং যার টাকাপয়সা যথেচ্ছ ব্যয় করা যাবে। একলা নারীর দক্ষতা স্বীকার করা হয়েছে; তবে সামন্তবাদের কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত বিবাহিত নারীকে পরিকল্পিতভাবে বলি দেয়া হয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির কাছে। স্বামী যতো ধনী হতো স্ত্রী ততো বেশি নির্ভরশীল হতো স্বামীর ওপর; স্বামী নিজেকে যতো বেশি মনে করতো সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতাশীল, গৃহপতি হিশেবে সে হতো ততো বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ। অন্যদিকে, সাধারণ দারিদ্র্য দাম্পত্যবন্ধনকে করে তোলে পারস্পরিক বন্ধন। সামন্তবাদ নারীকে মুক্ত করে নি, ধর্মও করে নি। মধ্যযুগের উপাখ্যান ও উপকথাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে শ্রমজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ও কৃষকদের এমন এক সমাজ, যাতে স্ত্রীকে পেটানোর শারীরিক জোর ছাড়া স্ত্রীর ওপর স্বামীর আর কোনো জোর ছিলো না; তবে স্ত্রীটি জোরের বিরুদ্ধে আশ্রয় নিতো ছলনার, এবং এভাবে দম্পতিটি বাস করতো সাম্যের মধ্যেই। তখন ধনী নারী তার আলস্যের মূল্য শোদধ করতো অধীনতা দিয়ে।

মধ্যযুগেও নারীর ছিলো কিছু সুযোগসুবিধা, কিন্তু ষোড়শ শতকে কিছু আইন করা হয়, যা টিকে থাকে প্রাচীন ব্যবস্থাব্যাপী; সামন্ত লোকাচার বিলুপ্ত হয়েছিলো এবং কিছুই আর চুলোর সাথে নারীকে বেঁধে রাখার পুরুষের বাসনা থেকে নারীকে রক্ষা করতে পারে নি। এ-বিধান নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করে ‘পুরুষসুলভ’ পদ, তাকে বঞ্চিত করে সমস্ত নাগরিক যোগ্যতা থেকে কুমারীকালে তাকে রাখে পিতার কর্তৃত্বে, পরে তার বিয়ে না হলে যে তারে পাঠিয়েদিতো সন্ন্যাসিনীদের মঠে, এবং আর যদি বিয়ে হতো, তাহলে তাকে ও তার সম্পত্তিকে ও তার সন্তানদের পুরোপুরি রাখতো স্বামীর কর্তৃত্বে। স্বামীকে দায়ীকরা হতো স্ত্রীর সমস্ত ঋণভার ও আচরণের জন্যে, এবং জনশাসনমূলক কর্তৃপক্ষ ও তার পরিবারের কাছে অপরিচিতদের সাথে তার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলো না। কাজে ও মাতৃত্বে সহযোগীর থেকে একটি দাসী বলেই তাকে মনে হতো : সে সৃষ্টি করতো যে-সব জিনিশ, মূল্য, মানুষ, সেগুলো তার সম্পদ হতো না, হতো পরিবারের, সুতরাং সে-পুরুষটির, যে ছিলো পরিবারের প্রধান। অন্যান্য দেশেও নারীর অবস্থা ভালো ছিলো না : তার কোনোরাজনীতিক অধিকার ছিলো না এবং লোকাচার ছিলো কঠোর। ইউরোপি সব আইনগত বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো গির্জীয় আইন, রোমীয় আইন, ও জর্মনীয় আইনের ভিত্তির ওপর–যার সবগুলোই ছিলো নারীবিরূপ। সব দেশেই ছিলো ব্যক্তিমালিকানা ও পরিবার এবং এগুলো চালানো হতো এসব সংস্থার দাবি অনুসারে।

এ-সব দেশেই পরিবারের কাছে সতীনারীদের দাসীত্বের অন্যতম ফল ছিলো বেশ্যাবৃত্তির অস্তিত্ব। ভণ্ডামোর সাথে সমাজের প্রান্তে লালিত বেশ্যারা সমাজে পালন করতো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। খ্রিস্টধর্ম এদের ওপর বর্ষণ করেছে প্রচণ্ড তিরস্কার, কিন্তু মেনে নিয়েছে এক অপরিহার্য অশুভ বলে। সেইন্ট অগাস্টিন ও সেইন্ট টমাস উভয়েই বলেছেন বেশ্যাবৃত্তি বিলোপের অর্থ নীতিভ্রষ্টতা দিয়ে সমাজকে বিপর্যস্ত করা : ‘প্রাসাদের কাছে পয়ঃপ্রণালি যেমন নগরের কাছে বেশ্যারা তেমন’। আদিমধ্যযুগে লোকাচার এতো লাম্পট্যপূর্ণ ছিলো যে বেশ্যাদের দরকারই পড়তো না; কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠিত হয়বুর্জোয়া পরিবার এবং কঠোর একপতিপত্নীক বিয়ে নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়, তখন পুরুষদের প্রমোদ খুঁজতে হয় ঘরের বাইরে।

বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে শার্লেমেনের, এবং পরে ফ্রান্সে চার্লস ৯-এর, এবং আঠারো শতকে অস্ট্রিয়ায় মারিয়া তেরেসার সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়একইভাবে। সমাজসংস্থাই বেশ্যাবৃত্তিকে দরকারি করে তোলে। যেমন শপেনহায়ার সাড়ম্বরে বলেছিলেন : ‘একপতিপত্নীক বিয়ের বেদিতে বেশ্যারা হচ্ছে নরবলি’। লেকি, ইউরোপি নৈতিকতার ঐতিহাসিক, একই ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন কিছুটা ভিন্নভাবে : ‘চূড়ান্ত রকমের পাপ, তারাই হচ্ছে সদগুণের শ্রেষ্ঠতম অভিভাবক’। গির্জা এবং রাষ্ট্র একইভাবে নিন্দা করেছে ইহুদিদের সুদের কারবার ও বেশ্যাদের বিবাহবহির্ভূত কামের; কিন্তু আর্থিক ফটকাবজি ও বিয়ের বাইরের প্রেম ছাড়া সমাজ চলতে পারে নি; তাই এসব কাজ ছেড়ে দেয়া হয় হীনবর্ণদের ওপর, যাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ঘেটোতে বা নিষিদ্ধপল্লীতে। ইহুদিদের মতো বেশ্যাদেরও বাধ্য করা হয় পোশাকের ওপর পরিচয়সূচক চিহ্ন ধারণ করতে; পুলিশের কাছে তারা ছিলো অসহায়; তাদের অধিকাংশের জীবন ছিলো কঠিন। তবে অনেক বেশ্যা ছিলো স্বাধীন; অনেকে বেশ ভালো আয় করতো। যেমন ঘটেছিলো গ্রিক অভিজাত গণিকাদের কালে বীরত্বব্যঞ্জকতার কালের বিলাসবহুল জীবনযাত্রাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যপূর্ণ নারীর সামনে খুলে দিয়েছিলো সুযোগসুবিধার নানা দরোজা, যা দিতে পারতো না ‘সতীনারী’র জীবন।

ফ্রান্সে অবিবাহিত নারীর অবস্থা ছিলো একটু অদ্ভুত : দাসীত্বে আবদ্ধ স্ত্রীর সাথে তার স্বাধীনতা ছিলো চমকপ্রদভাবে বিপরীত; সে ছিলো একজন অসামান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তবে আইন তাকে যা দিয়েছিলো, লোকাচার তাকে বঞ্চিত করে তার সব কিছু থেকে; তার ছিলো সব নাগরিক অধিকার। তবে এগুলো ছিলো বিমূর্ত ও শূন্যগর্ভ; তার আর্থনীতিক স্বাধীনতা ছিলো না, সামাজিক মর্যাদাও ছিলো না; সাধারণত বয়স্ক অবিবাহিত কন্যাটি জীবন কাটিয়েদিতো পিতার পরিবারের ছায়ায় বা তার মতোদের সাথে যোগ দিতে সন্ন্যাসিনীদের মঠে, যেখানে সে আনুগত্য ও পাপ ছাড়া আর কোনো রকমের স্বাধীনতার দেখা পেতো না–যেমন অবক্ষয়ের কালের রোমের নারীরা স্বাধীনতা পেয়েছিলো শুধু পাপের মধ্য দিয়ে। নেতিবাচকতা তখনও ছিলো নারীর নিয়তি, যেহেতু তাদের মুক্তি ছিলো নেতিবাচক।

এমন অবস্থায় নারীর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নেয়া, বা নিতান্ত তার উপস্থিতি জ্ঞাপন করাও ছিলো স্পষ্টতই বিরল। শ্রমজীবী শ্ৰেণীদের মধ্যে অর্থনীতিক পীড়ন দূর করে দিয়েছিলো লিঙ্গের অসাম্য, তবে এটা ব্যক্তিকে বঞ্চিত করেছিলো সব সুযোগ থেকে; অভিজাত ও বুর্জোয়াদের মধ্যে নারীরা ছিলো চোখ রাঙানির তলে : নারীর ছিলো শুধু পরগাছার জীবন; তার কোনো শিক্ষা ছিলো না; শুধুমাত্র অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই সে পারতোকোনো বাস্তব পরিকল্পনা নিতে ও বাস্তবায়িত করতে। রাণীদের ও রাজপ্রতিভূদেরই ছিলো এ-দুর্লভ সুখ; তাদের সার্বভৌমত্ব তাদের উন্নীত করতোনিজেদের লিঙ্গ থেকে ওপরে। ফ্রান্সে সালিক আইন নারীদের নিষিদ্ধ করে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে; তবে স্বামীদের পাশে থেকে, বা স্বামীদের মৃত্যুর পরে, তারা কখনো কখনো মহাভূমিকা পালন করেছে, যেমন, পালন করেছেন সেইন্ট ক্লোতিলদা, সেইন্ট রাদেগোঁদ, এবং কাস্তিলের ব্লাশ। সন্ন্যাসিনীদের মঠে বাস নারীদের মুক্ত করতো পুরুষ থেকে : কিছু মঠাধ্যক্ষা ছিলেন খুবই ক্ষমতাশালী। এলোইজ মঠাধ্যক্ষা হিশেবে যতোটা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ততোটা খ্যাতিই অর্জন করেছিলেন প্রেমের জন্যে। যে-অতীন্দ্রিয় সম্পর্ক তাদের জড়িয়ে রাখতো ঈশ্বরের সাথে, তার থেকে নারী-আত্মা লাভ করতে সব প্রেরণা ও পুরুষ-আত্মার শক্তি; এবং সমাজ তাদের প্রতি যে-ভক্তি দেখাতো, তা তাদের শক্তি যোগাতো কঠিন সব কাজ সম্পন্ন করতে। জোয়ান অফ আর্কের দুঃসাহসিক কাজে রয়েছে কিছুটা অলৌকিকতা; এছাড়া এটা ছিলো এক সংক্ষিপ্ত ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসিক কাজ। তবে সিয়েনার সেইন্ট ক্যাথেরিনের কাহিনী তাৎপর্যপূর্ণ; এক স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে বাস করে সিয়েনায় তিনি অর্জন করেন মহাসুখ্যাতি তার সক্রিয় হিতসাধনের সংকল্পের মধ্য দিয়ে। ঐশ্বরিক অধিকার বলে রাণীরা এবং উজ্জ্বল গুণাবলির জন্য সন্তরা লাভ করতেন এমন সামাজিক সমর্থন, যা তাদের সমর্থ করতো পুরুষের সমান হয়েকাজ করতে। এর বিপরীতে অন্য নারীদের কাছে চাওয়া হতো বিনীত নিশ্চুপতা।

মোটামুটিভাবে, মধ্যযুগের পুরুষ নারী সম্পর্কে পোষণ করতো বিরূপ ধারণা। প্রণয়াবেদনমূলক কবিতার কবিরা প্রেমকে করে তুলেছিলেন মর্যাদাসম্পন্ন; রম্যা দ্য লা রোজ-এ তরুণদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে দয়িতাদের তুষ্টিতে আত্মনিয়োগ করার জন্যে। তবে এ-সাহিত্যের (ক্রবাদুরদের সাহিত্য দিয়ে অনুপ্রাণিত) বিপরীতে ছিলো বুর্জোয়াপ্রেরণার সাহিত্য যাতে নারীদের আক্রমণ করা হয়েছে হিংস্রভাবে : উপকথা, রম্যোপাখ্যান এবং গাথায়তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে আলস্যের, ছেনালিপনার এবং কামুকতার। তাদের নিকৃষ্টতম শত্রু ছিলো যাজকেরা, যারা দোষ চাপাতো বিয়ের ওপর। গির্জা বিয়েকে পরিণত করেছিলো এক পবিত্র ভাবগম্ভীর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, আবার তা নিষিদ্ধ করেছিলো খ্রিস্টীয় অভিজাতদের জন্যে : ‘নারী নিয়েঝগড়া’র মূলেই ছিলো একটা অসঙ্গতি। বহু যাজক নারীদের দোষত্রুটি, বিয়ের মধ্যে পুরুষের শহিদত্বের যন্ত্রণা, ও আরো বহু কিছু সম্পর্কে লিখেছে’ বিলাপ’ ও তীব্র ভৎসনা; এবং তাদের বিরোধীপক্ষ দেখাতে চেয়েছে নারীর শ্রেষ্ঠত্ব। এ-ঝগড়া চলেছে পঞ্চদশ শতক ধরে, যতোদিন না আমরা দেখতে পাই প্রথম একজন নারী তার লিঙ্গের পক্ষে কলম ধরেছেন, যখন ক্রিস্তিন দ্য পিসা তাঁর এপিত্র ও দিয়ো দ’আমুর-এ চালান যাজকদের বিরুদ্ধে এক প্রাণবন্ত আক্রমণ। পরে তিনি মত দেন যে যদি বালিকাদের ঠিকভাবে শিক্ষা দেয়া হতো, তাহলে তারাও ছেলেদের মতো ‘বুঝতে পারতো সব কলা ও বিজ্ঞানের সূক্ষতা’। ওই সাহিত্যিক যুদ্ধের ফলে নারীদের অবস্থার কোনোই বদল ঘটে নি; ওই ‘ঝগড়া’ ছিলো এমন এক প্রপঞ্চ, যা সামাজিক প্রবণতাকে বদলে দেয়নি, বরং ঘটিয়েছে তার প্রতিফলন।

পনেরো শতকের শুরু থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত নারীর আইনগত মর্যাদা থাকে অপরিবর্তিত, তবে সুবিধাভোগী শ্ৰেণীগুলোতে তার বাস্তব পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। লিঙ্গ নির্বিশেষে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্যে ইতালীয় রেনেসাঁস ছিলো একটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী অনুকূল পর্ব। নারীরা হয় ক্ষমতাশালী রাজ্ঞী, সামরিক যোদ্ধা, এবং নেত্রী, শিল্পী, লেখক, ও সুরস্রষ্টা। এ-নারীদের অধিকাংশই চেতনা, রীতিনীতি, ও অর্থসম্পদে ছিলেন স্বাধীন অভিজাত গণিকা, এবং তাদের অপরাধ ও প্রমত্ত আনন্দোৎসবগুলো পরিণত হয়েছে কিংবদন্তিতে। পরের শতাব্দীগুলোতে যে-নারীরা মুক্ত থাকতে পেরেছিলেন ওই সময়ের কঠোর সাধারণ নৈতিকতা থেকে, মর্যাদা ও ধন অনুসারে তারা ভোগ করেন একই স্বাধীনতা। ক্যাথেরিন দ্য মেদিচি, এলিজাবেথ, ইসাবেলা প্রমুখ রাণী এবং তেরেসা ও ক্যাথেরিনের মতো সন্তরা দেখিয়েছিলেন অনুকূল পরিস্থিতিতে নারীরা কী অর্জন করতে পারে; তবে এঁদের ছাড়া নারীদের ইতিবাচক অর্জন ছিলো খুবই কম, কেননা ষোড়শ শতক ভরেও তাদের দেয়া হয় নি শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা।

সতেরো শতকে অবকাশপ্রাপ্ত নারীরা নিজেদের নিয়োগ করেন শিল্পসাহিত্য চর্চায়, উচ্চ সামাজিক স্তরে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে বলে তাঁরা সালগুলোতে পালন করতে থাকেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফ্রান্সে মাদাম দ্য রবিলে, মাদাম দ্য সেভিয়ে, ও অন্যান্য বিপুল খ্যাতিলাভ করেন, এবং অন্যত্র রাণী ক্রিস্তিন, দ্য শুরমান, ও অন্যান্য ছিলেন সমান বিখ্যাত। এসব গুণ ও মর্যাদার ভেতর দিয়ে উচ্চ শ্রেণীর বা খ্যাতিমান নারীরা ঢুকতে শুরু করেন পুরুষের জগতে, শেষে মাদাম দ্য মাইয়তেনর মধ্যে দেখতে পাই সে-পরিস্থিতিতে এ কুশলী নারীর পক্ষে দৃশ্যের আড়ালে থেকে কতোটা প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। এবং আরো কিছু ব্যক্তিত্ব বাইরের জগতে খ্যাতি লাভ করে মুক্তি পেয়েছিলেন বুর্জোয়া পীড়ন থেকে; দেখা দেয় তখন পর্যন্ত অজ্ঞাত একটি প্রজাতি : অভিনেত্রী। মিঞ্চে প্রথম নারী দেখা গিয়েছিলো ১৫৪৫-এ। এমনকি সতেরো শতকের শুরুতেও অধিকাংশ অভিনেত্রীই ছিলেন অভিনেতাদের স্ত্রী, কিন্তু পরে তারা কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীন হয়ে ওঠেন। নিনো দ্য লেক্ল ছিলেন অভিজাত গণিকার পরম প্রতিমূর্তি, যিনি তাঁর স্বাধীনতা ও মুক্তিকে নিয়েগিয়েছিলেন চূড়ান্তে, যা অনুমোদিত ছিলো না নারীদের জন্যে।

আঠারো শতকে বাড়তে থাকে নারীস্বাধীনতা। লোকাচার তখনও ছিলো কঠোর : বালিকারা পেতো সামান্য শিক্ষা; তার সাথে কথা না বলেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো বা পাঠিয়ে দেয়া হতো সন্ন্যাসিনীদের মঠে। উঠতি মধ্যবিত্তশ্রেণীটি স্ত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয় কড়া নৈতিকতা। তবে বিশ্বরমণীরা যাপন করতে অত্যন্ত কামময় জীবন, এবং উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীটি সংক্রামিত হয়েছিলো এসব উদাহরণ দিয়ে; সন্ন্যাসিনীদের মঠ বা গৃহ কিছুই আর দমন করতে পারতো না নারীদের। আবারও, এসব স্বাধীনতার বড়ো অংশই ছিলো বিমূর্ত ও নঞর্থক : বিনোদন খোঁজার বেশি কিছু ছিলো না। তবে বুদ্ধিমান ও উচ্চাভিলাষীরা সুযোগ সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন। সাল অর্জন করে নতুন গৌরব; নারীরা লেখকদের দিতেন নিরাপত্তা ও প্রেরণা, সৃষ্টি করতেন তাদের পাঠক; তারা পড়তেন দর্শন ও বিজ্ঞান, এবং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নবিজ্ঞানের জন্যে স্থাপন করেন গবেষণাগার। রাজনীতিতে মাদাম দ্য পপাদর ও মাদাম দু বার-এর নাম দুটি নির্দেশ করে নারীর ক্ষমতা : তাঁরাই আসলে চালাতেন রাষ্ট্র। অভিনেত্রীরা ও নাগরালি করা নারীরা উপভোগ করতেন বিপুল খ্যাতি। এভাবে প্রাচীন ব্যবস্থা জুড়ে যে-নারীরা কিছু করতে চাইতেন, তাঁদের জন্যে সাংস্কৃতিক মণ্ডলই ছিলো সবচেয়ে সুগম্য। তবে তাঁদের কেউই দান্তে বা শেক্সপিয়রের উচ্চতায় পৌছোন নি, এর কারণ তাঁদের পরিস্থিতির সাধারণ নিম্নতা। এ রুম অফ ওয়ান্স অৌন-এ ভার্জিনিয়া উম্ফ শেক্সপিয়রের এক কল্পিত বোনের তুচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনের সাথে তুলনা করেছেন শেক্সপিয়রের শিক্ষা ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার জীবনের। মাত্র আঠারো শতকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক নারী, মিসেস আফ্রা বেন, একজন বিধবা, পুরুষের মতো লিখে অর্জন করেন জীবিকা। অন্যরা অনুসরণ করেন তার উদাহরণ, তবে এমনকি উনিশ শতকেও তাঁদের অনেকে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হতেন। তাদের এমনকি ‘একটি নিজের ঘরও’ ছিলো না; অর্থাৎ তাঁদের ছিলো না সে-বস্তুগত স্বাধীনতা, যা আন্তর মুক্তির অন্যতম আবশ্যক শর্ত। ভার্জিনিয়া উম্ফ বলেছেন ইংল্যান্ডে নারী লেখকেরা সব সময়ই জাগিয়েছেন শত্রুতা।

সামাজিক ও মননশীল জীবনের মৈত্রির ফলে ফ্রান্সে অবস্থা ছিলো কিছুটা অনুকূল; তবে, সাধারণভাবে, জনমত ছিলো ‘নীলমুজোদের’ প্রতি বিরূপ রেনেসাঁস থেকেই উচ্চবংশীয় ও বুদ্ধিমান নারীরা, এরাসমুস ও অন্যান্য পুরুষের সঙ্গে, নারীদের পক্ষে লিখে এসেছেন। নারীর শত্রুরা অবশ্য চুপ ছিলো না। তারা আবার জাগিয়ে তোলে মধ্যযুগের পুরোনো যুক্তিগুলো, এবং প্রকাশ করে বর্ণমালা, যার প্রতিটি অক্ষরে নির্দেশ করা হয় নারীর একেকটি দোষ। নারীদের মূঢ়তাকে আক্রমণ করার জন্যে দেখা দেয় এক ধরনের লম্পট সাহিত্য–কাবিনে সাতিরিক ইত্যাদি। আর ধার্মিকেরা নারীদের অবজ্ঞা করার জন্যে উদ্ধৃত করতে থাকে সেইন্ট পলকে, গির্জার পিতাদের ও ধর্মযাজকদের।

নারীদের সাফল্যই তাদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলে নতুন আক্রমণ : প্রেসিওজ নামের আক্রান্ত নারীরা জনমতকে বিরূপ করে তোলেন; প্রেসিওজ রিদিকিল ও ফাম সভাঁতেদের করতালি দিয়ে সমর্থন জানানো হতো, যদিও মলিয়ের নারীদের শত্রু ছিলেন না : তিনি জোর করে বিয়ে দেয়াকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেন, দাবি করেন তরুণীর হৃদয়ানুভূতির স্বাধীনতা এবং স্ত্রীর মর্যাদা ও স্বাধীনতা। বোসে প্রচারণা চালাতেন নারীদের বিরুদ্ধে, বোইলো লেখেন প্রহসন। পোলাঁ দ্য ল বার, ওই সময়ের প্রধান নারীবাদী, ১৬৭৩-এ প্রকাশ করেন দ্য লেগালিতে দে দো সেক্স। পুরুষেরা, তিনি মনে করেন, তাদের বিপুল শক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের লিঙ্গকে সুবিধা দেয়ার জন্যে, এবং নারী অভ্যাসবশত সায় দেয় তাদের অধীনতার প্রতি। তারা কখনো সুযোগ পায় নি, স্বাধীনতাও নয় শিক্ষাও নয়। তাই তাদের অতীতের কাজ দিয়ে তাদের বিচার করা যাবে না, তিনি যুক্তি দেন, এবং কিছুই নির্দেশ করে না যে তারা পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট। তিনি নারীর জন্যে দাবি করেন প্রকৃত শিক্ষা।

এ-বিষয়েও দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো আঠারো শতক। কিছু লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নারীদের আত্মা অমর নয়। রুশো নারীদের বলি দেন স্বামী ও মাতৃত্বের কাছে, এভাবে তিনি কথা বলেন মধ্যবিত্তের পক্ষে। ‘নারীর সমস্ত শিক্ষা হতে হবে পুরুষাপেক্ষী,’ তিনি বলেন; ‘… নারীকে তৈরি করা হয়েছিলো পুরুষের অধীন হওয়ার জন্যে এবং তার অবিচার সহ্য করার জন্যে’। আঠারো শতকের গণতান্ত্রিক ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ভাবাদর্শ অবশ্য ছিলোনারীর প্রতি অনুকূল; অধিকাংশ দার্শনিকের কাছেই মানুষ বলে মনে হতো নারীকে, যারা শক্তিশালী লিঙ্গের অন্তর্ভুক্তদের সমতুল্য। ভলতেয়ার নারীর ভাগ্যের অবিচারকে নিন্দা করেছেন। দিদরো মনে করতেন নারীর নিকৃষ্টতার বেশির ভাগই সমাজের তৈরি। হেলভেতিউ দেখান যে নারীর শিক্ষার উদ্ভটত্বই সৃষ্টি করে নারীর নিকৃষ্টতা। তবে মার্সিয়ে হচ্ছেন সেই একক পুরুষ, যিনি তাঁর তাবলো দ্য পারিতে ক্ষুব্ধ বোধ করেছেন শ্রমজীবী নারীর দুর্দশায় এবং নারীশ্রম সম্পর্কে তুলেছেন মৌলিক প্রশ্ন। নারীকে পুরুষের সমান শিক্ষা দেয়া হলে নারী হবে পুরুষের সমতুল্য, এটা বিবেচনা করে কঁদরসে চেয়েছেন নারীরা প্রবেশ করুক রাজনীতিতে। ‘আইন দ্বারা নারীকে যতো বেশি দাসত্বে বন্দী করা হয়েছে,’ তিনি বলেন, ‘ততো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে তাদের সাম্রাজ্য…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *