২.৪ বাথরুমের দরজা বন্ধ ও খোলার শব্দ

ঘরের মধ্য থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ ও খোলার শব্দ পাওয়া গেল। হুকুম চাঁদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, বেয়ারাকে নাশতা আনার নির্দেশ দিলেন।

মেয়েটি খাটের ধারে গালে হাত দিয়ে বসেছিল। হুকুম চাঁদ ঘরে ঢুকলে মেয়েটি দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলখানি মাথায় তুলে দিল। তিনি চেয়ারে বসলে মেয়েটি মেঝের দিকে তাকিয়ে আবার খাটের কোণায় বসল। একটা নিঝুম নীরবতা বিরাজ করুল কিছুক্ষণ। তারপর হুকুম চাঁদ কিছুটা সাহস দেখালেন। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

তোমার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে। আমি চায়ের কথা বলেছি।

মেয়েটি তার কালো ডাগর চোখ দু’টো হুকুম চাঁদের ওপর নিক্ষেপ করে বলল, আমি বাড়ি যেতে চাই।

আগে কিছু খেয়ে নাও। ড্রাইভারকে আমি বলে দেব তোমাকে বাড়িতে রেখে আসতে। তুমি কোথায় থাক?

চন্দননগর। ইন্সপেক্টর সাহেবের থানা ওখানেই।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। হুকুম চাঁদ তাঁর গলা পরিষ্কার করে বললেন, তোমার নাম কি?

হাসিনা, হাসিনা বেগম।

হাসিনা। তুমি সত্যি সুন্দরী। তোমার মা তোমাকে সুন্দর নামই রেখেছে। ঐ বৃদ্ধা মহিলা কি তোমার মা?

এই প্রথমবার মেয়েটি মৃদু হাসল। এ রকম প্রশংসা তার আগে কেউ করেনি। স্যার নিজেই তার প্রশংসা করেছেন এবং তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন।

না স্যার। উনি আমার দাদি। আমার জন্মের পরেই আমার মা মারা যায়।

তোমার বয়স কত? আমি জানিনে। ষোলো বা সতেরো হতে পারে। আবার আঠারোও হতে পারে। আমি শিক্ষিত হয়ে জন্মাইনি। তাই আমার জন্ম তারিখ আমি লিখে রাখতে পারিনি।

মেয়েটি তার নিজের রসিকতায় মৃদু হাসল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও হাসলেন। বেয়ারা একটা ট্রেতে ডিম, রুটি ও চা নিয়ে এলো।

চায়ের কাপ গুছিয়ে দেয়ার জন্য মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। রুটিতে মাখন লাগিয়ে দিল। একটা ছোট প্লেটে রুটি রেখে সে হুকুম চাঁদের সামনে টেবিলের ওপর প্লেটটি রাখল।

আমি কিছু খাব না। আমি চা পান করেছি।

মেয়েটি ছিনাল মেয়ের মতো ভণিতা করে বলল, আপনি কিছু না খেলে আমিও কিছু খাব না।

যে ছুরি দিয়ে সে রুটিতে মাখন লাগাচ্ছিল তা টেবিলের ওপর রেখে সে বিছানার ওপর বসল।

ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব বেশ খুশি হলেন।

আমার কথায় রাগ করো না, তিনি বললেন। তিনি মেয়েটির কাছে গিয়ে তার কাঁধের ওপর হাত রাখলেন।

তোমাকে অবশ্যই কিছু খেতে হবে। কাল রাতে তুমি কিছুই খাওনি।

মেয়েটি তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি খেলে আমি খাব। আপনি না খেলে আমি খাব না।

ঠিক আছে। তুমি যখন অনুরোধ করছি তখন আমি খাব। হুকুম চাঁদ মেয়েটির কোমর ধরে তাকে উঠিয়ে টেবিলের ধারে তাঁর নিজের কাছে এনে বসালেন। আমরা দুজনেই খাব। এসো, আমার কাছে বসো।

মেয়েটি তার জড়তা কাটিয়ে উঠে হুকুম চাঁদের কোলে এসে বসল। মাখন লাগানো রুটি তাঁর মুখে তুলে দিল। গালভর্তি রুটি মুখে হুকুম চাঁদ যখন থাক থাক যথেষ্ট হয়েছে বলে মাথা নাড়ালেন, তখন সে হাসল। গোঁফে আটকে থাকা মাখনও সে সযত্নে মুছে দিল।

এ পেশায় তুমি কতদিন আছ?

এটা কি ধরনের অবিবেচকের প্রশ্ন। কেন, জন্মাবার পর থেকেই। আমার মা গায়িকা, তার মাও গায়িকা ছিল। তাঁর মা-ও…

আমি গান গাওয়ার কথা বলছি না। অন্য বিষয়ের কথা বলছি, হুকুম চাঁদ ব্যাখ্যা করে বললেন। অতঃপর তিনি যেন উত্তরের অপেক্ষায় রইলেন।

অন্য বিষয় বলতে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন? ঔদ্ধত্যের সাথেই বলল মেয়েটি। টাকার জন্য আমরা কখনও অন্য কোন কাজে যাই না। আমি গান গাই ও নাচি। নাচ ও গান বলতে কি বোঝায় তা আপনি জানেন বোধ হয়। আপনি অন্য বিষয় জানতে চান। এক বোতল হুইস্কি আর অন্য বিষয়। ব্যস!

কিছুটা অপ্ৰস্তৃতভাবে হুকুম চাঁদ কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন। না, না… আমি অন্য কিছু করি না।

মেয়েটি হাসল। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের গালে হাত লাগিয়ে বলল, বেচারা ম্যাজিস্ট্রেট। আপনার কুমতলব আছে, কিন্তু আপনি ক্লান্ত। আপনার নাক ডাকছে রেল ইঞ্জিনের মতো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নাক ডাকার অনুকরণ করে সে হাসিতে ফেটে পড়ল।

মেয়েটির চুলে হাত বুলাচ্ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। তাঁর নিজের মেয়ে বেঁচে থাকলে তাঁর বয়সও ষোলো, সতেরো বা আঠারো হতো। এজন্য অবশ্য তাঁর মনে কোন অপরাধবোধ নেই। তাঁর এই সময় কাটানো শুধু পরিতৃপ্তির অস্পষ্ট অনুভূতির জন্যই। মেয়েটির সাথে তিনি ঘুমাতে চান না, তার সাথে যৌন মিলনও তাঁর কাম্য নয়, এমন কি তিনি তাকে স্পর্শ করতে বা তার ঠোঁটে চুমুও খেতে চান না। তিনি চান মেয়েটি তাঁর কোলে বসে বুকে মাথা রেখে ঘুমাক।

আবার আপনি চিন্তা করছেন।

মেয়েটি মাথা চুলকাতে চুলকাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল, এক কাপ চা নিয়ে সে পিরচের ওপর কিছুটা ঢালল।

চানিন। চিন্তামুক্ত হন।

চা ভর্তি পিরিচটা সে তাঁর দিকে এগিয়ে দিল।

না, না। আমি চা খেয়েছি। তুমি খাও।

ঠিক আছে। আমি চা খাচ্ছি। আপনি আপনার চিন্তা নিয়ে থাকুন। মেয়েটি শব্দ করে চা খেতে শুরু করল। হাসিনা। তিনি নামটি বার বার বলতে চাইলেন। হাসিনা।

বলুন। হাসিনা তো শুধু আমার নাম। আপনি আর কিছু বলছেন না কেন?

হুকুম চাঁদ তার হাত থেকে খালি পিরিচটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন। মেয়েটিকে তিনি আরও কাছে টেনে নিলেন, তার মাথাটা নিজের মাথার কাছে নিয়ে এলেন। মেয়েটির মাথার চুলে তিনি হাত বুলাতে লাগলেন।

তুমি কি মুসলমান?

হ্যাঁ। আমি মুসলমান। এ ছাড়া হাসিনা বেগম আর কি হতে পারে? এক দাড়িওয়ালা শিখ?

চন্দননগর থেকে মুসলমানদের সরানো হয়েছে বলে আমি জানি। তুমি ওখানে কিভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছ?

অনেকে অবশ্য চলে গেছে। ইন্সপেক্টর সাহেব আমাদের চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন কিছু না বলা পর্যন্ত থাকতে বলেছেন। গায়িকারা অবশ্য হিন্দু বা মুসলমান নয়। সব ধর্মের লোকই আমার কাছে গান শুনতে আসে।

চন্দননগরে আর কোন মুসলমান আছে?

হ্যাঁ … আছে, ইতস্তত করে বলল হাসিনা। আপনি তাদের বলতে পারেন মুসলমান, হিন্দু বা শিখ বা অন্য কিছু পুরুষ বা মহিলা। ওখানে এখনও একদল হিজড়া আছে। কথাগুলো বলার সময় তার মুখমণ্ডলে রক্তিমাভা দেখা দিল।

হুকুম চাঁদ তাঁর হাত দু’টো চোখের ওপর রাখলেন।

বেচারা হাসিনা বিহ্বল হয়ে পড়েছে। আমি প্ৰতিজ্ঞা করছি আমি হাসব না। তুমি হিন্দু বা মুসলমান নও। কিন্তু হিজড়া যেমন হিন্দু বা মুসলমান নয়, ঠিক তেমনটি তুমি নও।

আমাকে পরিহাস করবেন না।

আমি তোমাকে পরিহাস করছি না। চোখের ওপর থেকে হাত দু’টো সরিয়ে নিলেন হুকুম চাঁদ। হাসিনার মুখমণ্ডলে রক্তিমাভা আরও বেশি করে দেখা গেল। আমাকে বল, হিজড়াদের কেন সরিয়ে দেওয়া হলো না।

আমি জানি। আপনি আমাকে উপহাস করবেন না- কথা দিলে আমি বলব।

কথা দিলাম।

মেয়েটি উদ্দীপিত হলো।

হিন্দু আধ্যুষিত এলাকায় এক বাড়িতে একটা শিশুর জন্ম হয়। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সত্ত্বেও হিজড়ারা ঐ বাড়িতে গান গাওয়ার জন্য যায়। হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের লোক তাদের পাকড়াও করে। মুসলমান বলে তারা ওদের মেরে ফেলতে চায়। আমি অবশ্য শিখদের পছন্দ করি না। মেয়েটি ইচ্ছাকৃতভাবেই কথা থামিয়ে দিল।

তারপর কি হলো? বেশ আগ্রহ নিয়েই হুকুম চাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন।

মেয়েটি হাসল। হিজড়ারা যেভাবে আঙ্গুল ফাঁক করে হাতে তালি দেয়, সেভাবেই সে হাতে তালি দিল।

তারা ঢোল বাজিয়ে কৰ্কশ পুরুষ কণ্ঠে গান ধরল। তারা এত দ্রুত পাক দিতে শুরু করল যে, তাদের পরনের নিম্নাঙ্গের কাপড় বাতাসে উড়ে তাদের সাথেই ঘুরল। তারপর তারা নাচ থামিয়ে উন্মত্ত লোকদের নেতাদের কাছে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা আমাদের সব কিছু দেখেছ। এখন বল, আমরা হিন্দু না মুসলমান?

তাদের কথায় উপস্থিত সবাই উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু শিখরা হাসল না।

হুকুম চাঁদও হাসলেন।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। শিখরা তাদের কৃপাণ নিয়ে এসে ভয় দেখাল, আজ তোমাদের আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের অবশ্যই চন্দননগর ছেড়ে চলে যেতে হবে। না হলে তোমাদের আমরা মেরে ফেলব। একজন হিজড়া তখন হাতে তালি মেরে একজন শিখের দাড়িতে আঙ্গুল বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কেন? তোমরা কি সবাই আমাদের মতো হয়ে সন্তানহীন থাকবে? এ কথায় শিখরাও হেসে ওঠে।

ভাল কথা, হুকুম চাঁদ বললেন। কিন্তু এসব ঝামেলার সময় তুমি খুব সাবধানে থাকবে। কয়েকদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে না।

আমি আতঙ্কিত নই। আমরা বহু লোককে খুব ভাল করে জানি। তাছাড়া আমাকে রক্ষা করার জন্য এত বড় একজন ক্ষমতাবান ম্যাজিষ্ট্রেট আছেন। আপনি যতদিন আছেন। ততদিন আমার মাথার একটা চুলও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।

হুকুম চাঁদ মেয়েটির মাথার চুলে হাত বুলাতে লাগলেন। কোন কথা বললেন না। মেয়েটি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, আপনি কি চান আমি পাকিস্তানে চলে যাই?

হুকুম চাঁদ তাকে আরও কাছে টেনে নিলেন। তাঁর দেহে জ্বর জ্বর ভাবের উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। হাসিনা। গলা পরিষ্কার করে তিনি আবার বললেন, হাসিনা। তাঁর মুখ দিয়ে কথা বেরোল না।

হাসিনা, হাসিনা, হাসিনা। আমি কি কালা? আপনি কিছু বলছেন না কেন?

আজ তুমি এখানে থাকবে। থাকবে তো? তুমি এখান থেকে এখনই চলে যেতে চেয়ো না।

আপনি শুধু একথাই বলতে চান? আপনি যদি আপনার গাড়ি না দেন, তাহলে এই বৃষ্টিতে পাঁচ মাইল পথ কিভাবে যাব? কিন্তু আপনি যদি আমাকে আরও এক রাত থাকতে এবং গান গাইতে বলেন, তাহলে আমাকে মোটা অংকের টাকা দিতে হবে।

হুকুম চাঁদ আশ্বস্ত হলেন। টাকা কি? কৃত্রিম প্রেম নিবেদন করে তিনি বললেন, তোমার জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে প্ৰস্তুত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *