২.৩ ২১শে জুন-৩০শে জুন ১৯৬৬

২১শে জুন ১৯৬৬ মঙ্গলবার

আকাশটা আজ মেঘে ভরে রয়েছে। বৃষ্টি নাই। শুনলাম জেলের ডিআইজি সাহেব এদিকে আসবেন, যদিও আজ এখানে আসার কোনো কথা নাই। তিনি আসবেন ঐ গর্তটা দেখতে। বৃষ্টি পেয়ে দূর্বা ঘাসগুলি বেড়ে উঠেছে লিকলিক করে, সমস্ত মাঠটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে। বাজে গাছ আমি তুলে ফেলে দিই। একটু ভাল লাগলেই ওর ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়াই আর যে পরগাছা চোখে পড়ে তাকেই ধ্বংস করি।

শুনলাম মানিক ভাইকেও আলাদা রাখবার হুকুম হয়েছে। কিন্তু রাখবে কোথায়? সেল এরিয়ায় আমাকে একলা রাখা হয়েছে। ২৬ সেলে সিকিউরিটি, পুরানা হাজত এবং ১/২ খাতায় ডিপিআর বন্দিরা। আই বি তো হুকুম দিয়েই চলেছে সকল আওয়ামী লীগারদের আলাদা আলাদা রাখতে হবে। তাদের কষ্ট দিতে হবে। তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে হবে।

মানিক ভাই ও মোস্তফা সরওয়ারকে ‘এ’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। মোমিন সাহেব, হাফেজ মুছা ও শাহাবুদ্দিন চৌধুরীকে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। শামসুল হক সাহেব, রাশেদ মোশাররফ ও ওবায়দুর রহমানকে এখনও সি ডিভিশনে রাখা হয়েছে, কারণ এরা নাকি ইনকাম ট্যাক্স দেয় না। ১৫০০ শত টাকার উপরে আয় হলে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এমএ পাশ করলেও ‘সি’ ক্লাস হতে হবে। টাকা থাকলেই বড় ক্লাস, শিক্ষার দাম নাই। পদের দাম নাই, সম্মানের দাম নাই। এমনকি পদমর্যাদারও দাম নাই।

আমি জেল কর্তৃপক্ষকে বললাম, যদি কোনো প্রফেসার, ডিসি, এসপি কোনোমতে ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার হতে বাধ্য হয় তারও সি ক্লাস হবে এবং রোজ দেড় টাকায় খাওয়া ও নাস্তার সকল কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে। রাস্তার কত পাগলকে ডিপিআর করেছে। শামসুল হক সাহেবের বাবার সম্পত্তি আছে, নিজে কাজকর্ম করেন না। জেলা, আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ও এমপিএ ছিলেন, তাকেও যদি ক্লাস না দেওয়া হয় আর দেড় টাকার খাওয়াই যদি খেতে হয় তার বিচার তো এখন হতে পারে না, পরে দেখা যাবে। ওবায়দুর রহমান এমএ পাশ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তাকেও সি ক্লাস। রাশেদ মোশাররফের বাবা বড়লোক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক, বিরাট বাড়ি ঢাকা শহরে, নিজেও ছোটখাট ব্যবসা করে, তাকেও সি ক্লাস। কাকে দুঃখের কথা বলব? যে কোনো রাস্তার লোক টাকা উপার্জন করেছে দুর্নীতি করে, ইনকাম ট্যাক্স দেয় তাকে দিতে হবে ক্লাস ‘এ’। আমি তো ওদের সাথে দেখা করতে পারব না আর সান্ত্বনাও দিতে পারব না। এইবার সরকার আমাদের জবর খেলা দেখাচ্ছে। ইতরামির চরমে পৌঁছেছে।

এভাবে অত্যাচার চলতে থাকলে বাধ্য হব বোধ হয় এর প্রতিবাদ করতে। আমি বার বার জেল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ করেছি। বার বার বলতে আমার লজ্জাও করে। জেল কর্তৃপক্ষ এক কথাই বলেন, ‘আমাদের কোনো হাত নাই। আমরা হুকুম তামিল করি।’ আমার মনে হয় আমাদের যে কষ্ট হতেছে তাতে তারা লজ্জিত হয়। কিন্তু কি করবে? ছোটলোক যেখানে শাসন চালায় তখন আর ভদ্রতা আশা করা কষ্টকর! আমি জানি উপরের কড়া হুকুম, আমার কাছে কেউই থাকতে পারবে না। কারও সাথে আলাপ করতে পারব না। একাকী রাখতে হবে। মনে মনে ভাবি আমি কষ্ট না পেলে আমাকে কষ্ট দেয় কে? যতই কষ্টের ভিতর আমাকে রাখুক না কেন, দুঃখ আমি পাব না। কারণ, কোনো ব্যথাই আমাকে দুঃখ দিতে পারে না এবং কোনো আঘাতই আমাকে ব্যথা দিতে পারে না। এরা মনে করেছে বন্ধু শামসুল হককে জেলে দিয়ে যেমন পাগল করে ফেলেছিল, আজ আর তার কোনো খোঁজ নাই, কোথায় না খেয়ে বোধ হয় মরে গিয়েছে। আমাকেও একলা একলা জেলে রেখে পাগল করে দিতে পারবে। আমাকে যারা পাগল করতে চায় তাদের নিজেদেরই পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

কিছু কিছু সরকারি কর্মচারী যারা ইংরেজদের কাছ থেকে শিখেছে তারা এর পিছনে আছে। আমি তাদের জানি, যদি বেঁচে থাকি তবে এর বিচার একদিন হবে, আর যদি মরে যাই তবে সহকর্মীদের বলে যাবো তাদের নাম। কঠোর সাজা যেন দেওয়া হয়। জীবনে যেন না ভোলে। সাবধান করে দিয়ে যাবো ক্ষমতায় গেলে এরাই সবার পূর্বে এসে আনুগত্য জানাবে এবং প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাবে।

খবরের কাগজ আজ আর এল না। সাংবাদিকরা প্রতিবাদ দিবস পালন করছে নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে এবং মানিক ভাই ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। কোনো কাগজই আসে নাই।

দিনটা মেঘলা, সূর্যের মুখ দেখলাম না। তবে বৃষ্টি হয় নাই। সন্ধ্যার পরে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়। আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত দু’টায় এক পাগল আজও ক্ষেপে গিয়েছিল। তবে ঘুম বেশি নষ্ট করতে পারে নাই।

 

২২শে জুন ১৯৬৬ বুধবার

ভোর থেকে ভীষণভাবে বৃষ্টি নেমেছে। থামবার নামও নিতেছে না। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে যেয়ে দেখি ডিম দিয়েছে একটা। যতগুলি ডিম আমাকে এ পর্যন্ত দিয়েছে সবই নষ্ট। যাদের ডিমের কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয় তারা বাজার থেকে পচা ডিম কিনে আনে। বাধা দেবে কে? মুখতো বন্ধ। কন্ট্রাক্টর সাহেব নিশ্চয়ই জানে কেমন করে মুখ বন্ধ করতে হয়। দোষ কাকে দিব? সমস্ত দেশটায় যাহা চলছে এখানেও সেই একই অবস্থা। দেখার লোকের অভাব। কেহ ভাল হতে চেষ্টা করলে তার সমূহ বিপদ।

একটা ঘটনা আমার জানা আছে। এক থানায় একজন কর্মচারী খুব সৎ ছিলেন। ঘুষ তিনি খেতেন না। কেহ ঘুষ নিক তিনি তাহাও চাইতেন না, সকলে তাকে বোকা বলতে শুরু করে-ছোট থেকে বড় পর্যন্ত। একদিন তার এক সহকর্মী তাকে বলেছিল, সাধু হলে চাকরি থাকবে না। বড় সাহেবের কোটা তাকে না দিলে খতম করে দিবে। তিনি তাহা শুনলেন না। বললেন, ঘুষ আমি খাব না, আর ঘুষ দিবও না। সত্যই ভদ্রলোক ঘুষ খেতেন না। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই মিথ্যা মামলায় তাকে চাকরি হারিয়ে কোর্টে আসামি হতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকে তিনি মুক্তি পান, চাকরি আর করেন নাই। সকল জায়গায়ই একই অবস্থা আজকাল, এখন অনেক বেশি। কাহাকেও ভয় করে না। সোজাসুজিই এসব চলছে।

কারাগারের অবস্থা বাইরে যারা আছেন বুঝবেন না। অনেক কর্মচারী আছে যারা এক পয়সাও ঘুষ খায় না। এমন কি জেলের কোনো জিনিসও গ্রহণ করেন না। আমি অনেককে জানি। তাদের চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নাই। যাক, আমার জিনিসপত্র মন্দ নাই, আমার ব্যাপারে সকলেরই সহানুভূতি আছে। আমাকে ভাল জিনিস দিতে পারলে এরা খুশিই হয়। ডিম এই সময় একটু বেশিই নষ্ট হয়। চেষ্টা নিশ্চয়ই তারা করেন, ভাল ডিম পায় না কি করবে? আমি যাহা চাই তাহাই তারা দিতে চেষ্টা করে। যদিও আমি খাওয়ার দিকে বেশি খেয়াল দিই না। কোনোদিন নিজ হাতে লিখেও দেই না। যাহা দরকার ৫ টাকার মধ্যে দিয়ে দেবেন, যদি না হয় খবর দেবেন-বাজার থেকে নিজেই টাকা দিয়ে কিনে আনবো, না হয় বেগম সাহেবা দেখা করতে এলে বলে দিব। কয়েদি থেকে কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই আমার দিকে খেয়াল রাখে, যাতে কোনো কষ্ট না হয়। ডাক্তার সাহেবরাও নিজের ইচ্ছায় কিছু কিছু জিনিস আমাকে দিয়ে থাকে, বলার প্রয়োজন হয় না। আমি যাহা পাই নিজে খেয়েও আমার চারজন মেট, বাবুর্চি, ছাফাইয়া, ফালতুরা খেয়েও কিছু কিছু অন্য কয়েদিদের দেওয়া হয়-যারা আমার সেলের সামনে কাজকর্ম করে, পানি দেয়, বাগান পরিষ্কার করে। সকলকে একদিনে দেওয়া যায় না। তাই এক এক দিন এক এক জনকে দেওয়া হয়। বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি কিছু কিছু বাঁচাইয়া একদিন একটু বেশি পাক করে কয়েকজনকে দিও। যাহা হউক যারাই আমার আশে পাশে আছে সকলকেই একদিন না একদিন কিছু দিতে পেরেছি এবং দিতেও থাকব। তবে মেট, ফালতু, বাবুর্চি আর ছাফাইয়া প্রত্যেক বেলায় ভাগ পায়। এদের রেখে আমি খাই কি করে! আমার পক্ষে সম্ভব নহে। চা একটু বেশি খরচ হয়। আমি আমার নিজের টাকা দিয়ে কিনে আনি। জেলের নিয়ম, আমার কাছে থাকবে, আমার জন্য পাক করবে, আমার ঘর পরিষ্কার করবে, কাপড় ধুইয়ে দিবে কিন্তু আমার সাথে খাইতে পারবে না। তাদের খাওয়া বাইরের থেকে আসবে। মানে সরকারি চৌকি থেকে। যাহা পায় তাহা তো পাবেই। আমি ওদের না দিয়ে খাই কেমন করে? আমি না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু ওদের না দিয়ে খেতে পারব না।

আজ নাস্তা খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কারণ বৃষ্টি হতেছে ভীষণভাবে। মনে হয় আকাশ ফেটে গিয়েছে। ঘুমাতে পারলাম না। পুরানা কাগজগুলি পড়তে লাগলাম—যা সামান্য বাকি ছিল। তারপর আবার চা। আবার বই নিয়ে বসা। বৃষ্টি হলে একাকী খুবই খারাপ লাগে। সময় যেতেই চায় না। ১২টায় সিকিউরিটি জমাদার সাহেব এলেন, কিছু বাজার করতে হবে, বিস্কুট চাই, মুড়ি চাই, আমার বাড়িতে মুড়ি খাবার অভ্যাস। বাড়িতে খবর দিলে পাঠাইয়া দিতো। কষ্ট দিতে ইচ্ছা হয় না বেচারীকে। সকল কিছুই তো তার করতে হয়, আমি তো মুসাফির। বাড়িতে আমি বেগম সাহেবার মুসাফির। এখানে সরকারের মুসাফির।

আমি বাইরে যেয়ে হাঁটতে লাগলাম, কারণ বৃষ্টি থেমে গেছে। এই সুযোগ ভাল করে ব্যবহার করলাম। একমাত্র পরিশ্রম।

গোসল করে এসে ভাত খেয়ে আবার বই নিয়ে বসলাম। জেল লাইব্রেরি থেকে কয়েকখানা বই দিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে কাগজ এল। দেখলাম হাইকোর্টে মামলা করেছে নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে ও মানিক ভাইকে বন্দি করার বিরুদ্ধে।

 

২৩শে জুন ১৯৬৬ বৃহস্পতিবার

মিজানুর রহমান চৌধুরী এম. এন. এ-কে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক ছিল। মনে হতেছে কাহাকেও বাইরে রাখবে না। এখন সমস্ত পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান তো একটা বড় কারাগার’। কথা বলার শক্তি নাই। জেলায় জেলায় ১৪৪ ধারা। ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত। তফাজ্জল হোসেন (মানিক ভাই)কে গ্রেপ্তার করে আলাদা রাখার ব্যবস্থা। গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে কর্মীদের বিরুদ্ধে। মিজানকে এনেও দশ সেলে রাখা হয়েছে। ডিভিশন আসতে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগে, এই কয়দিন যে খাওয়া দেয় তা নাই বললাম। অপেক্ষা করে আছি কতজনকে আনবে জেলে। তবু দাবি আদায় হবে, রক্ত যখন বাঙালি দিতে শিখেছে।

বন্যা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। চাউলের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা মন হয়ে গেছে। জনগণের আর শান্তি নাই। শান্তি চেয়ে আনা যায় না, আদায় করে নিতে হয়। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। অত্যাচারী ভয় পেয়ে যাবে। যে অত্যাচার করে টিকে থাকতে চায় তার মেরুদণ্ড খুব দুর্বল। আঘাত করলেই ভেঙে যাবে।

আজকাল কাগজে আর রাজনৈতিক খবর পাওয়া যায় না-বোধ হয় তা বন্ধই করে দিয়েছে। জুলুম প্রতিরোধ দিবসের সংবাদ ছাপাইতে পারবে না। দাও না বন্ধ করে আওয়ামী লীগের অফিসের দরজা। কাহাকেও যখন বাইরে রাখবা না, তখন আর অফিসের দরকার কি?

দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকালে অনেকগুলি তুললাম।

আমার মোরগটা আর দুইটা বাচ্চা আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ঘাস থেকে পোকা খায়। ছোট কবুতরের বাচ্চাটা দিনভর মোরগটার কাছে কাছে থাকে। ছোট মুরগির বাচ্চারা ওকে মারে, কিন্তু মোরগটা কিছুই বলে না। কাক যদি ওকে আক্রমণ করতে চায় তবে মোরগ কাকদের ধাওয়া করে। রাতে ওরা একসাথেই পাকের ঘরে থাকে। এই গভীর বন্ধুত্ব ওদের সাথে। এক সাথে থাকতে থাকতে একটা মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ অনেক সময় বন্ধুদের সাথে বেঈমানী করে। পশু কখনও বেঈমানী করে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পশুরাও বোধ হয় মানুষের চেয়ে একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ।

চা বানাতে বললাম। আজ যাকে পাওয়া যায় তাকেই চা খাওয়াতে বললাম। সাধারণ কয়েদিরা একটু চায়ের জন্য কত ব্যস্ত। তাই আমি বলে দিয়েছি যে-ই চা খেতে চাইবে তাকেই দিবা। আমার মেটটা একটু কৃপণ, সহজে কিছু দিতে চায় না। যদি আমার কম পড়ে যায়, বাইরের থেকে আসতে দেরি হলে অসুবিধা হবে। তাকে বলে দিয়েছি, কম পড়ে পড়ক, আনতে দেরি হয় হউক, চাইলে দিতে হবে। কিইবা আমি দিতে পারি, এই নিষ্ঠুর কারাগারে।

বিকালে আজ আবার নতুন করে কেডস সু পরে হাঁটতে শুরু করলাম। না হাঁটলে তো খাওয়াই হজম হবে না। ব্যায়াম আমার প্রয়োজন। তাই সময় পেলেই একটু ঘোরাঘুরি করি। পাশের ২০ সেলে পাবনার সাংবাদিক রণেশ মৈত্র থাকেন। ল’ পরীক্ষা দিতে এসেছেন পাবনা থেকে এখানে, আজ শেষ পরীক্ষা হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন পরীক্ষা দিলেন?’ বললেন, মন্দ হয় নাই। আমার সামনে দিয়েই তার যেতে হয়, যেখানে থাকেন। সেইখানে। রণেশ বাবু যে কোনোদিন পাবনা চলে যাবেন। তবুও মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখা হতো ভদ্রলোকের সাথে। বাবু চিত্ত সুতার খবর দিলেন, রণেশ বাবু গেলেও তার একলা থাকতে আপত্তি নাই। কারণ দূর থেকে হলেও আমার সাথে দেখা হয়। জেল কর্তৃপক্ষকে বলতে বললেন। আমার কথা তারা শুনবে কেন? সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।

জমাদার সাহেব এসে হাজির হয়েছেন। বন্ধ করতে শুরু করেছেন, এমন সময় ডিপুটি জেলার সাহেব এলেন আমাকে দেখতে। তাকে নিয়ে দুইখানা চেয়ার নিয়ে ঘাসের উপর বসলাম। বোধহয় আজই ঘাসের উপর চেয়ার নিয়ে দুইজন বসলাম। একা আমি প্রায়ই বসে থাকি, একাই তো থাকি। তাকে বললাম, আমার অন্যান্য সহকর্মীদের খাওয়ার খুব কষ্ট হতেছে একটা কিছু করেন। চোর ডাকাতের থেকেও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা খারাপ হয়ে গেছে? তাদের কষ্ট দিতেই হবে? তিনি বললেন, আমাদের বলে আর লাভ কি! আমরা তো হুকুমের চাকর। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। খট করে তালাবন্ধ। আমিও বই আর খাতা নিয়ে বসলাম।

 

২৪শে জুন ১৯৬৬ শুক্রবার

ভোরে ঘুম থেকে উঠতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। উঠতে ইচ্ছাই হয় না। মেট চা নিয়ে এসে হাজির। বিছানায় বসেই চা খেলাম। দেখলাম আকাশের অবস্থা ভাল। আমার ঘরের দরজার কাছে একটা কামিনী ও একটা শেফালী গাছ। কামিনী যখন ফুল দেয় আমার ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে থাকে। একটু দূরেই দুইটা আম আর একটা লেবু গাছ। বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন আরও সবুজ আরও সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ভাল লাগল দেখতে। মাঠটা সবুজ দূর্বায় ভরে উঠেছে। তারপর গাছগুলি, বড় ভাল লাগলো। বাইরেই যেয়ে বসলাম। দেখলাম এদের প্রাণ ভরে। মনে হলো যেন নতুন রূপ নিয়েছে। মোরগ মুরগির বাচ্চা ও কবুতরটা মাঠটা ভরে ঘুরে

বেড়াচ্ছে।

একজন এসে বলল, আপনার দলের সুলতান কে? তাকে আজ ভোরে নিয়ে এসেছে গ্রেপ্তার করে। ঢাকায় বাড়ি। বললাম, বুঝেছি। সুলতান আওয়ামী লীগ অফিসের ‘Whole time worker’, সকল সময়ের কর্মী। বড় নিঃস্বার্থ কর্মী সমস্ত ঢাকা শহর তার নখদর্পণে। প্রত্যেকটা কর্মী ও তাদের বাড়ি ও চিনে। কাজ করতে কখনও আপত্তি করে না। দিন রাত সমানে কাজ করে যায়। হুকুম দিলেই তামিল করে। নিজস্ব একটা মতবাদও আছে।

সুলতানের ফুফুই সুলতানদের তিন ভাইকে মানুষ করেছে। এদের সাথে আমার বড় মধুর সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৫৪ সালে যখন আমি মন্ত্রী হলাম—শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রিসভায়; কয়েকদিন পরেই মন্ত্রীত্ব ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার ১৯২-ক ধারা জারি করল। হক সাহেবকে বাড়িতে বন্দি করল, আমাকে মিন্টু রোডের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে আনল। আমার স্ত্রীও তখন নতুন ঢাকায় এসেছে। বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে যদিও কলিকাতা গিয়াছে কয়েকবার আমাকে দেখতে, কিন্তু ঢাকায় সে একেবারে নতুন; সকলকে ভাল করে জানেও না। মহাবিপদে পড়লো। সরকার হুকুম দিয়েছে ১৪ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে। টাকা পয়সাও হাতে নাই বেশি। বাড়ি ভাড়া কোথায় পাওয়া যায়। তখন বন্ধু ইয়ার মহম্মদ খান, হাজী হেলালউদ্দিন সাহেবের মারফতে এই সুলতানের নাজিরা বাজারের বাড়ি ভাড়া করে দেয়। পাশের বাড়িতে সুলতানরা তিন ভাই আর ফুফু থাকতো। বৃদ্ধা ভদ্র মহিলা আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের এত আদর করতেন—যে না দেখেছে সে কল্পনাও করতে পারবে না। পুলিশ তো প্রায়ই আমার বাড়িতে আসতো, কোনো আত্মগোপনকারী কর্মী আশ্রয় নিয়েছে কিনা জানতে। এক জাত কর্মচারী আছে সুযোগ সন্ধানী, যখন যেমন তখন তেমন’। এরা তেমনি।

ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মহা বিপদেই পড়ে গেল আমার স্ত্রী। সেই হতে এই সুলতানদের সাথে আমার ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠতা হয়ে রয়েছে। আমরা ও আমার ছেলেমেয়েরা এদের কোনো দিন ভুলি নাই। আর আমরা বুড়িকে নানী বলি। কোনো কিছু ভাল পাক হলে আমাদের না দিয়ে খায় না। সুলতানও আমার কাছে থাকে। পার্টির কাজ করে। আমার মনে হয় সুলতান গ্রেপ্তার হওয়াতে পার্টির খুবই ক্ষতি হয়েছে। সকল কর্মকর্তা, কর্মীদেরও গ্রেপ্তার করছে দেখে মনে হয় অফিসের পিয়নটাকেও গ্রেপ্তার করতে পারে! মোনায়েম খান সব পারেন। তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নাই দুনিয়াতে। আইয়ুব খান সাহেব ভাল লোকই পেয়েছেন, রতনে রতন চেনে! তবে উপকার থেকে ক্ষতিই বেশি হবে। শীঘ্রই প্রমাণ পাবেন, কিছুটা পেয়েছেনও বটে!

সুলতানকে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের কাছে রাখে নাই। রেখেছে। অন্যান্য ডিপিআরদের সাথে।

দুপুরে কাগজ এলে মর্নিং নিউজে দেখলাম করাচী আওয়ামী লীগ সভাপতি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, জেল থেকে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মালিক গোলাম জিলানী, খাজা মহম্মদ রফিক, জনাব সিদ্দিকুল হাসান তাকে জানাইয়াছে যে, তারা শেখ মুজিবুরের ৬ দফা প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নাই। আমি জানি সত্যের জয় একদিন হবেই। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরাও একদিন এই ৬ দফা সমর্থন করে পাকিস্তানকে মজবুত করবেন। সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর জুলুম চলছে। সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নাই। আজ পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা কারাগারে বন্দি। আওয়ামী লীগ আজ জেলখানায়। মানুষকে জেলে নিতে পারে কিন্তু নীতিকে জেলে নিতে পারে না।

কনভেনশন মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি জনাব আসলাম খান। বোধ হয় পূর্বে কেহ এই ভদ্রলোকের নাম শোনেন নাই, নতুন আমদানি। জনাব বলেছেন, সারা বাংলা ঘুরে ৬ দফার সমর্থক পেলেন না। বন্ধু একটু ধীরে চলুন, বাংলাদেশকে চিনতে এখনও আপনার বহুদিন লাগবে! বেশি দালালি করে লাভ নাই। ভুট্টো সাহেবের অবস্থা দেখেও শিখলেন না! আপনার পূর্বে আরও কয়েকজন সেক্রেটারি বড় বড় বক্তৃতা করেছেন, তারা কোথায়? বোধ হয় এখন আর খোজ খবর নাই।

ড. মির্জা নূরুল হুদা সাহেব ৬ দফার উপর কটাক্ষ করে বলেছেন, পাকিস্তান দুর্বল হয়ে যাবে। যাহা হউক, পাকিস্তান দুই টুকরা হয়ে যাবে এ কথাতো তারা বলেন নাই। ড. হুদা সাহেবকে আমার জানা আছে। মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পূর্বে কি বলেছেন, আর মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পরে কি বলছেন! হায়রে মন্ত্রীত্ব, তোমার কি জাদু! যাকেই হার দিয়েছ তাকেই বশ করে ফেলেছ।’

সন্ধ্যার দিকে জেলার সাহেব এলেন। কয়েকদিন ছুটিতে ছিলেন। তার শ্বশুর মারা গিয়াছেন। জেলার সাহেব খুব হাসিখুশি লোক। অমায়িক ব্যবহার। শুধু বললাম, আমার দলের লোকগুলিকে অত কষ্টে না রাখলেই পারতেন। এরাই বোধ হয় সকলের থেকেই খারাপ লোক? বুঝি, আপনাদের অসুবিধা! একজন দ্রলোক আওয়ামী লীগের কাকে কোথায় রাখা হবে ফোন করে বলে দেন। তাহার হুকুম আপনাদের তামিল করতেই হবে, কি বলেন? যাহা হউক, আমাদেরও সহ্যের সীমা আছে। আমাকে একলা রেখেছেন ঠিক আছে, একলাই থাকব। এমন অনেক আমি রয়েছি। কিন্তু এদের নিজেদের পাকের ব্যবস্থা নিজেদের সামনেই করতে দিন। দেখাশোনা করে খাবে। তাহাও যদি সরকার বাধা দেয় তবে জানাবেন, আমাদের পথ আমরাই বেছে নিব। তবে আপনারা এতো দ্র ব্যবহার করেন যে কিছুই আমরা করতে পারি না। আমার সহকর্মীদের পূর্বেই বিভিন্ন জেলে বদলি করে দিয়েছেন। দেখেন চিন্তা করে। বেচারার মনটাও খারাপ। তালাবন্ধের সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি কথা বন্ধ করলাম। ঘরে ঢুকতেই বাতি নিভে গেল। বিজলি পাখাও বন্ধ হয়ে

 

গেল। হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে বই নিয়ে বসলাম। অনেক রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করলাম। মাঝে মাঝে বাইরের দিকে চেয়ে অন্ধকারটা একটু দেখে নিই। যাকে বলে চক্ষু জুড়াই।

আবার ড. এম. নূরুল হুদা সাহেবের বক্তৃতা ভাল করে পড়লাম। একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন, হঠাৎ একজনের দয়ায় মন্ত্রী হয়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই রাজনীতি সম্বন্ধে কি বলতে কি বলে ফেলেছেন, বোধ হয় নিজেই বুঝতে পারেন নাই। তাই কথাগুলি লিখে রাখলাম ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে।

“The Finance Minister also brought serious allegations against the advocates of Six-Point Programme of Awami League. He said that certain forces continued to have the Consortium Aid postponed. These forces also thrust a war on Pakistan. But their two actions failed to break Pakistan as the People stood united like a rock. Then came the Six-Point Programme of the Awami League.

This Programme really aims at setting up a weak national government, which means a weak Pakistan, the Finance Minister commented. The most important thing is however, the timing of the Programme, he added.

Pakistan Observer 24.6.1966

মন্ত্রীত্বের লোভে ভদ্রলোক এত নিচে নেমে গিয়েছেন যে একটা দলের বা লোকের দেশপ্রেমের উপর কটাক্ষ করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না। যদি বলতে হয় পরিষ্কার করে বলাই উচিত।

রাত অনেক হয়েছে, শুয়ে পড়া ছাড়া আর উপায় কি?

 

২৫শে জুন ১৯৬৬ শনিবার

আজ অনেকক্ষণ বেড়ালাম। পড়তেও ইচ্ছা হয় না। চুপ করে একাকী বসে থাকার চেয়ে হাঁটতে ভাল লাগে। তাই হাঁটতে লাগলাম আপন মনে। বেগম সাহেবা বাড়ির আম ও বিস্কুট পাঠাইয়াছেন। এতগুলি কি করে একলা মানুষ খাব? ভালই হয়েছে কয়েদিগুলিকে খাওয়াতে পারব, ওদের কিসমত তো ফাঁকা। বৎসরে দয়া করে যদি একদিন আম দেওয়াও হয় সেগুলি বাজারের সকলের নিকৃষ্ট। কন্ট্রাকটার সরবরাহ করে থাকেন কিনা! কাজেই বুঝতেই পারেন কি আম দেওয়া হয়। আম কেটে যারা সামনে বসে কাজ করে তাদের সকলকে কিছু কিছু দিতে বললাম। আর আমায় যারা দেখাশোনা করে তাদের জন্য তো আছেই।

বই নিয়ে বসেছি। জমাদার সাহেব ও কম্পাউন্ডার সাহেব এলেন। বসলেন আমার ঘরে। বললাম, খবর কি? দেশে খুব পানি হয়েছে, ফসলের কি হবে বলা যায় না। কম্পাউন্ডার সাহেব বললেন, একটা মেয়ে ও একটা ছেলেকে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছিল। দু’জনে প্রেম করে বিবাহ করেছিল। মেয়ের বাবা মামলা করে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে আনিয়েছে। আজ ছেলেটা মামলায় জিতেছে। মেয়েটাকে নিয়ে চলে গিয়েছে, গাড়ি নিয়ে এসেছিল। মেয়েটার খুব ফুর্তি। কম্পাউন্ডার সাহেবও খুব খুশি হয়েছেন বলে মনে হলো। বললাম, আপনিও খুব খুশি হয়েছেন দেখছি! বললেন, ওদের দুজনের আনন্দ দেখে আমার খুব ভাল লেগেছে। বললাম, ‘প্রথম জীবনের উন্মাদনায় এই রকমের হয়ে থাকে, কিন্তু ফলাফল শেষ পর্যন্ত বেশি ভাল হয় না। এমন অনেক প্রমাণ আছে। ছেলে ও মেয়ে একে অন্যকে পছন্দ করে বিবাহ করুক তাতে আপত্তি নাই, তবে উদ্ধৃঙ্খলতা এসে গেলে সমাজ ধ্বংস হতে বাধ্য। দেখা গেছে এমন অনেক হয়েছে শেষ পর্যন্ত সুখী হতে না পেরে অনেক অঘটন ঘটেছে। তাই আজকাল দেখবেন আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। যার পরিণাম ভাল না। শুরুও হয়ে গেছে এ দেশে এর ফলাফল। নারী শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে, নারী শিক্ষা না হলে দেশের মুক্তি আসতে পারে না। কিন্তু শিক্ষার নামে যে নির্লজ্জতা বেড়ে যেতেছে এদিকেও সমাজের নজর দেওয়া উচিত। ওর কাজ আছে, আমার মতো সরকারের অতিথি উনি নন, তাই চলে গেলেন। বহু ইনজেকশন দিতে হবে।

আমি বইয়ের মধ্যে মন দিলাম। মেট এসে হাজির, স্যার ডাব খাবেন না? বললাম, আনো। পেটের ব্যথা, পেট খারাপ হয়েই থাকে। তাই ডাব মাঝে মাঝে খাই। ডাব খেয়ে পাইপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আবার ফুলের বাগানে। একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালবাসতে আরম্ভ করেছি। যাদের ভালবাসি ও স্নেহ করি, তারা তো কাছে থেকেও অনেক দূরে। ইচ্ছা করলে তো দেখাও পাওয়া যায় না। তাই তাদের কথা বার বার মনে পড়লেও মনেই রাখতে হয়। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের সাথে তো মাসে দু’বার দেখা হয় আর কারও সাথে তো দেখা করারও উপায় নাই। শুধু মনে মনে তাদের মঙ্গল কামনা করা ছাড়া উপায় কি!

গোসল করে খেয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম। মতিয়ার নামে একটা ছেলে আমাদের সেল এরিয়ার পানি দেয়। বাড়ি টাঙ্গাইল, স্কুলে পড়তো। দুই পক্ষে ফুটবল খেলা নিয়ে গোলমাল হয় এবং একটা খুন হয়। সেই মামলায় ছয় বৎসর জেল হয়েছে। আমার কাছে এসে বলল, জেলার সাহেবকে একটু বলে দিতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা জেল থেকে দিতে চায়, তার অনুমতির বন্দোবস্ত করতে। বললাম, জেলার সাহেব আসলে অনুরোধ করব—যদি শোনেন। ছেলেটা এখানে এসে কাগজ পড়ে। শুনলাম ওকে জেলের আইন ভঙ্গ করার জন্য জেলার সাহেব একবার শাস্তি দিয়েছেন, তাই অনুমতি দিতে চান না। রাগ করে আছেন। জেলার সাহেব ওকে নিজের অফিসে প্রথমে নিয়েছিলেন, সেখানে গোলমাল করার জন্য তাড়াইয়া দিয়েছেন। তবুও ওকে বললাম, জেলার সাহেব আসলে অনুরোধ করব।

কাগজ এল। মর্নিং নিউজে দেখলাম জনাব খান আবদুস সবুর খান বলেছেন বাংলাদেশের লোক আওয়ামী লীগের ধাপ্পা ধরে ফেলেছে, জুলুম প্রতিরোধ দিবস কেহই পালন করে নাই। পিন্ডি চলেছেন, তার নেতাকে খুশি করতে পারবেন একথা বলে। তাই হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ঐ কথা। এসব কথা বলে বাঙালির দাবি আর দমাতে পারবেন না, এ কথা ভাল করে জেনে রাখুন সবুর সাহেব। জেল, জুলুম, মামলা সমানে চালাইয়াছেন। কাগজ বন্ধ করেছেন, এতেই গণআন্দোলন বন্ধ হয় না, সেরকম ভেবে থাকলে ভুল করেছেন।

মর্নিং নিউজ সবুর সাহেবের নামের দুই পাশেই ‘খান’ লাগাইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানি কায়দা। আগে ছিল আবদুস সবুর খান, এখন হয়েছেন খান আবদুস সবুর খান। চমৎকার, এই তো চাই! পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিত লোকেরা যে গোপনে গোপনে হাসেন একথা বুঝেও বোঝেন না এই ভদ্রলোকেরা। এই মুসলিম লীগের এক নেতা সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে তার পূর্ব-পুরুষের গোরস্থান খুঁজেছিলেন। আজ সবুর সাহেব বোধ হয় ওদিকে অন্য কিছু খোঁজ করছেন?

ন্যাপের অন্যতম এমপিএ আহমেদুল কবির সাহেব ৫ একর জমির খাজনা মওকুফ করতে দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমি চার বৎসর পূর্বে ২৫ বিঘা জমির উপর থেকে খাজনা মওকুফ করার দাবি করে অনেক জনসভা ও আন্দোলন করেছি। এমন কি সর্বদলীয় বিরোধীদলের ১২ দফা দাবির মধ্যেও আওয়ামী লীগের এই দাবি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলাম। যদিও মরহুম খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। ন্যাপের কোনো কোনো নেতা ৬ দফা গোপনে গোপনে সমর্থন করলেও লজ্জায় বলেন না, আর কেউ কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। দিন আসছে ৬ দফা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মেনে এদেশে রাজনীতি করতে হবে না। তবে রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন অনেকেই।

বিকালে খবর পেলাম মিজান খুব ঘুমাচ্ছে। বোধ হয় ওকে রাতে ঘুমাতে দেয় নাই।

সন্ধ্যায় দেখলাম পুরানা বিশ সেলে নারায়ণগঞ্জের খাজা মহীউদ্দিনকে নিয়ে এসেছে। ওর বিরুদ্ধে অনেকগুলি মামলা দিয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে ওকে পরীক্ষা দিতে অনুমতি দিয়েছে। ডিভিশন দেয় নাই। ভীষণ মশা, পরশু পরীক্ষা, মশারিও নাই। তাড়াতাড়ি একটা মশারির বন্দোবস্ত করে ওকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার কাছাকাছি যখন এসে গেছে একটা কিছু বন্দোবস্ত করা যাবে। বেশি কষ্ট হবে না। খাজা মহীউদ্দিন খুব শক্তিশালী ও সাহসী কর্মী দেখলাম। একটুও ভয় পায় নাই। বুকে বল আছে। যদি দেশের কাজ করে যায় তবে এ ছেলে একদিন নামকরা নেতা হবে, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। ত্যাগ করার যখন প্রাণ আছে, আদর্শ যখন ঠিক আছে, বুকে যখন সাহস আছে একদিন তার প্রাপ্য দেশবাসী দেবেই।

 

২৬শে জুন ১৯৬৬ রবিবার

ভোর রাত্র থেকেই মাথা ভার ভার লাগছিল। বিছানা ছাড়তেই মাথার ব্যথা বেড়ে গেল। আমার মাথায় যন্ত্রণা হলে অসহ্য হয়ে উঠে। অনেকক্ষণ বাইরে বসে রইলাম, চা খেলাম, কিছুতেই কমছিল না। ওষুধ আমার কাছে আছে, ‘স্যারিডন’, কিন্তু সহজে খেতে চাই না। আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুলে বেশি লাগে তাই অনেকক্ষণ বাইরে যেয়ে হাঁটতে লাগলাম। বাতাসে ভালই লাগছিল। ব্যথা একটু কম কম লাগছিল।

আজ তো রবিবার। কয়েদিরা কাপড় পরিষ্কার করবে। ঠিক করেছি, স্যারিডন সহজে খাব না। মেট ও পাহারা কাহাকেও কিছু বললাম না। প্রায় দশটার দিকে আরাম লাগছিল। বাইরে থাকতে মাথা ব্যথায় অনেক সময় কষ্ট পেতাম। স্যারিডন দুই তিনটা খেয়ে চুপ করে থাকতাম। আধা ঘণ্টা পরেই ভাল হয়ে যেতাম। আবার কাজে নেমে পড়তাম। রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। আমি বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই। কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।

ডিপুটি জেলার সাহেব এলেন। কিছু সময় পরে জমাদার সাহেব তার ফৌজ নিয়ে হাজির। আমার ঘর তালাশ করবে। কোনো কিছু বেআইনি লুকাইয়া রাখি কি না? এটা জেলের নিয়ম। রাজবন্দিদের ঘরগুলি সপ্তাহে একবার করে তালাশি দেওয়া হয়ে থাকে। তবে আমার ঘর তালাশি বেশি করে না। এসে দেখে যায়। কারণ জানে বেআইনি কাজ আমি করি না। আর বেআইনি জিনিস আমার কাছে থাকে না। তবে আসলেই আমি নিজেই বলি বের হয়ে যেতেছি, আপনারা তালাশ করে দেখে নিন। ইচ্ছা করলে এরা শরীর তল্লাশি করতে পারে, তবে জেলার ও ডিপুটি জেলার ছাড়া অন্য কেহ পারে না। সিপাহিরা ঘরের ভিতর আসল না, শুধু জমাদার সাহেব ভিতরে এসে ঘুরে গেলেন।

আমি বললাম, প্রত্যেক সপ্তাহে আসেন কিছুই পান না। একবার বলবেন, আমি কিছু বেআইনি মাল রেখে দিব। এরা খোঁজ করে কোনো চিঠিপত্র বাইরে পাঠাই কিনা? কোনো অস্ত্রপাতি আনি কিনা বাইরে থেকে, যা দিয়ে পালাতে পারি। রাজবন্দি অস্ত্রপাতি আনে এ খবর আমার জানা নাই। তবে অনেক সময় চিঠিপত্র পাওয়া গেছে রাজবন্দিদের কাছ থেকে। এরা এক সেল থেকে অন্য সেলে যোগাযোগ রাখে। এক এরিয়া থেকে অন্য এরিয়ার সাথেও যোগাযোগ রাখে। যখন জেল কর্তৃপক্ষ অথবা সরকারের সাথে বোঝাপড়া করতে চায় তখন যাতে একসাথে করতে পারে। সেজন্যই যোগাযোগটা করে। আজকাল তাহাও করে না। কারণ বিচার কোথায়?

জমাদার চলে গেলেন। ডিপুটি জেলার সাহেব বসলেন কিছু সময়। আমার সহকর্মীদের উপর সরকারের এই ব্যবহারের কথা বললাম। আওয়ামী লীগ কর্মীদের ও মানিক ভাইকে যে অবস্থায় রেখেছে দুষ্ট প্রকৃতির কয়েদিদেরও সেভাবে রাখা হয় না। এদের বলে লাভ নাই জানি, কারণ, গ্রেপ্তার করে জেলগেটে পৌঁছাইয়া হুকুম দিয়ে যায় কোথায় কাদের রাখা হবে।

যদি জেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে তবে পাকের বন্দোবস্ত বন্দিদের হাতেই দিতে পারে। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তা করছে না। আমার সাথে আমার দলের কাহারও এক জেলে থেকেও দেখা হয় না। আমি একদিকে আর অন্যরা অন্যদিকে। বোধ হয় জেলের মধ্যে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। সরকারের হুকুম আমার কাছে কাহাকেও দেওয়া হইবে না, কাহারও সাথে যোগাযোগ রাখতে পারব না। আমার খবর বন্দি নেতা কর্মীরা পায় কিনা জানি না, তবে ওদের খবর আমি রাখি, কি অবস্থায়—তাদের রাখা হয়েছে।

ডিপুটি জেলার সাহেব চলে গেলেন। রবিবার ছুটির দিন। তবুও এদের ছুটি নাই, অনেক কাজ। নারায়ণগঞ্জ থেকে চটকল ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল মান্নানকে নিয়ে এসেছে। জামিন দেয় নাই, নারায়ণগঞ্জে মামলায় তাকে আসামি করেছে। ভদ্রলোক কাছেও ছিল না। শুনলাম নারায়ণগঞ্জে মশা কামড়াইয়া তার হাত মুখ ফুলাইয়া দিয়াছে। আরও বহু লোককে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ জেলে রেখেছে। অনেক ছাত্রও আছে। জামিন পায় নাই। কাপড় দেয় নাই, ডিভিশন দেয় নাই। প্রত্যেকটা লোক অর্ধেক হয়ে গেছে। তিন শতের উপর লোককে আসামি করেছে। যাকেই পেয়েছে গ্রেপ্তার করে জেলে দিতেছে।

‘জাতীয় সরকার’ অত্যাচার করো, ফলাফল একদিন পেতে হবে, বেশি দেরি নাই। তখন আবার ‘নিষ্ঠুর’ বলিও না। কাহারা এই অত্যাচার করছেবাঙালিরা, চাকরির জন্য। এরা বোঝে না কাদের জন্য এই লোকগুলি জীবন দিল? কার জন্য এরা কষ্ট ভোগ করছে? এদের অনেকেরই ছেলেমেয়ে না খেয়ে কষ্ট পেতেছে। কিছুদিন পরে বের হয়ে দেখবে কেউ নাই, সব শেষ। যে লোকটা উপার্জন করে, দিন মজুরি করে সংসার চালাতে তাকে আটকিয়ে রাখলে তার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা মা না খেয়ে থাকবে। আস্তে আস্তে মরে শেষ হয়ে যাবে। এই খবর কি সরকার জানে না? আমাদের দেশের এই শিক্ষিত চাকরিজীবীদের মধ্যে কিছুসংখ্যক লোক আছে পদোন্নতির জন্য তারা কত যে সংসার ধ্বংস করেছে তার কি কোনো সীমা আছে?

খাজা মহীউদ্দিন পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে। আর একটা ছেলেমিলকী তাকে অনুমতি দেওয়া হয় নাই। জেল কর্তৃপক্ষ ঢাকার এসডিওকে জানাইয়াছিল। তিনি বলেছিলেন, ডিসি সাহেবের সাথে পরামর্শ করে জানাবেন। আগামীকাল সকালে পরীক্ষা শুরু হবে। কোনো খবর এসডিও সাহেব দেন নাই। বোধ হয় ঢাকার ডিসি সাহেব গভর্নর সাহেবের অতি প্রিয় লোক। অনুমতি দেন নাই। খুব মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। একটা বৎসর নষ্ট হয়ে গেল। ফিস দিয়েছে, সকল কিছু প্রস্তুত, কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয় নাই।

পুরানা ২০ সেলে তাকে বললাম দূর থেকে, ‘ভেব না ভাই। আমাকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাহির করে দিয়েছিল। যারা বাহির করে দিয়েছেন তাদের অনেকেই আমার কাছে এসেছিলেন। ক্ষমা করে দিয়েছিলাম—পরে শোধ নিতে পারতাম, নেই নাই। খোদার উপর নির্ভর করো।’ খাজা মহীউদ্দিন যে কি খেয়ে পরীক্ষা দিবে তাই ভাবলাম। ডিপুটি জেলার সাহেবকে বললাম, একটু খেয়াল রাখবেন ছেলেটার দিকে। আমার কাছে তো কিছু কিছু জিনিস আছে কিন্তু দেবার তো হুকুম নাই। তবুও ভাবলাম, বেআইনি হলেও আমাকে কিছু দিতে হবে। দেখা হয়েছিল। আমার সেলের কাছ দিয়ে যেতে হয়। আমি এগিয়ে যেয়ে ওকে আদর করে বললাম, ‘ভেব না, তুমি পাশ করবা। মাথা ঠান্ডা করে লেখবা।’

আজ বাজার থেকে আমার খাবার টাকা বাঁচিয়ে দু’টা মুরগি এনেছি। বাগান দিয়ে এরা ঘুরে বেড়ায়। সূর্য অস্ত গেল, আমরাও খাঁচায় ঢুকলাম। বাড়িওয়ালা বাইরে থেকে খাচার মুখটা বন্ধ করে দিল। বোধহয় মনে মনে বলল, আরামে থাক, চোর ডাকাতের ভয় নাই, পাহারা রাখলাম।

 

২৭শে জুন ১৯৬৬ সোমবার

নিজের শরীরও ভাল না; বাবুর্চি কেরামত আলীরও রাত্রে খুব জ্বর হয়েছে। বললাম হাসপাতালে যেতে, রাজি হলো না। দেখলাম জ্বর এখনও আছে। নতুন লোক এনে পাকাইতে দিলে মুখে দেওয়া যাবে না। কোনোমতে একে শিখাইয়া নিয়েছি।

ডাক্তার এলে ওষুধ দিলাম। শুয়েই রইল, শুয়ে শুয়ে দেখাইয়া দিল, একজন ফালতু কোনোমতে পাক করে আনল।

আজ আমার পড়তে ভাল লাগছে না, মাথা ঘুরছে। পাশেই নতুন বিশ-এর ২নং ব্লক, পাঁচটা সেল। কয়েকজন নামকরা কয়েদি, একজন মোক্তার বাবু, পটুয়াখালী বাড়ি—আর নুরুদ্দিন নামে ডাকাতি মামলার আসামি একজন নতুন কয়েদিকে এখানে আনা হয়েছে। তার বাড়ি গোয়ালন্দ মহকুমায়। ভদ্রলোকের ছেলে, বাড়ির অবস্থা ভাল, লেখাপড়াও জানে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে তার গান শুনছিলাম। চমৎকার গান গায়। ভারী সুন্দর গলা। যদি সত্যিই সাধনা করত তাহলে বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়কদের অন্যতম গায়ক হতো। আইন মানে না। কথা শোনে না। যথেষ্ট মার খেয়েছে এই কারাগারে এসে। কাউকেই মানে না, যা মুখে আসে তাই বলে। সমস্ত মার্ক কেটে দিয়েছে জেল কর্তৃপক্ষ। কোনো মার্ক পাবে না। তিনমাসে কয়েদিরা ১৮ দিন থেকে ২৩ দিন পর্যন্ত মার্ক পেয়ে থাকে। মানে ভালভাবে জেল খাটলে আইন ভঙ্গ না করলে কয়েদিদের নয় মাস সাড়ে নয় মাসে বৎসর। যত মার্ক শুরুতে পেয়েছিল তা আবার কেড়ে নিয়েছে জেল কর্তৃপক্ষ। পুরা দশ বৎসর খাটতে হবে। ভালভাবে থাকলে সাত বৎসর বা কাছাকাছি জেল খাটলেই খালাস পেত। এখন ওকে পুরা জেল খাটতে হবে। আমাকে বলে, পুরাই খেটে যাব। আর যাবারও ইচ্ছা নাই। মরলেও ভাল হতো। বাবা ভাইরা কোনো খবর নেয় না। ডাকাতি ও খুনের মামলায় জেল হয়ে তাদের ইজ্জত মেরেছি। একবার ওর মা ফরিদপুর জেলে দেখতে এসেছিল। তাকেও নিষেধ করে দিয়েছে। ২২ বৎসর বয়সে জেলে এসেছে। স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে ৭/৮ বৎসর পর্যন্ত কয়েদির খাওয়া খেয়ে, মশার কামড় সহ্য করে। স্বভাবের জন্য অত্যাচার সহ্য করে করে স্বাস্থ্য নষ্ট করে ফেলেছে। সকলেই বলে, ‘লোক সাংঘাতিক’!

আমি বললাম, নুরু কেন জীবন নষ্ট করলে বলতে পার? বাবা-মার মুখে চুনকালি দিলে, বংশের ইজ্জত নষ্ট করলে, কারাগারে কষ্ট করলে, কি লাভ হলো? তোমাকে জেলেও সকলেই খারাপ বলে। যে কয়দিন থাক, ভালভাবে থাক, তাড়াতাড়ি জেল খেটে বাড়ি যাও। বাবা-মার কাছে ফিরে যাও, আর এ পথে পা বাড়িও না। বলল, স্যার আমার দুঃখের কথা না-ই শুনলেন। চেষ্টা করব আপনার কথা রাখতে, তবে কি মুখে আর বাবা-মার কাছে যাবো? তাই গোলমাল করে পুরা জেল খাটতে চাই। বাইরে যেয়ে আর হবে কি? মরতে পারলে ভাল হয়। আমি বললাম, তোমার জেল থেকে বের হবার পূর্বে (সম্ভাবনা কম) যদি আমি বের হই, তবে দেখা করো। তোমার বাবা ও ভাইকে আমি চিঠি দিব। কিন্তু বের হলে কিছুদিন বাড়ির বাইরে যেতে পারবা না এবং ঐ কুপথে আর পা বাড়িও না। সে বলল, আপনার কাছে আমাকে নিয়ে নেন। আমি বললাম, আমার আপত্তি নাই। তোমাকে আমার কাছে দিবে না। গান গাও নুরু, তোমার গান শুনি, ভাল লাগছে তো আমারও। অনেক গান গাইল, বললাম, ‘বাংলার মাটির সাথে যার সম্বন্ধ আছে সেই গান গাও।’ আমি বারান্দায় মাটিতে বসে পড়লাম। নুরু ওর সেলের বারান্দার কাছে বসে গান করতে শুরু করল। অনেকক্ষণ গান শুনলাম। পরে আবার হাঁটতে লাগলাম।

ভাত খেয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। কাগজ এল, কাগজ পেয়ে বইটা রেখে দিলাম। কাগজ এলেই হাসেম মিয়া জেলের মেম্বর, পাহারাও বরিশাল বাড়ি, একবার প্রেসিডেন্ট ছিল ইউনিয়ন বোর্ডের; আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়ে ৬ বৎসর জেল খেটে এসেছে সে, মতিয়ার রহমান টাঙ্গাইল বাড়ি ও রফিক আমার এখানকার ছাপাইয়া—এরা ছুটে আসে কাগজ পড়তে। বোঝার মতো লেখাপড়া এরা সকলেই জানে। তাই বাংলা কাগজগুলি ওদের দিয়ে দিই পড়তে। খবর কিছুই থাকে না আজকাল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এত বেশি যে কেহই কিছু লেখতে সাহস পায় না।

বিকালে সিভিল সার্জন সাহেব আমাকে দেখতে এলেন। বললাম, ভালই আছি। তবে জেল কোড অনুযায়ী কোনো লোককে দুই মাসের বেশি একলা থাকতে দেওয়া নিষেধ, অথচ আমাকে একলা রাখা হতেছে। এর বেশি বললাম না কারণ ডাক্তার হিসাবে চমৎকার লোক। রোগীকে রোগী হিসেবেই দেখেন। কাহাকেও কয়েদি হিসেবে দেখেন না। কয়েদিরা যাতে ভালভাবে ঔষধ পায়, খাওয়া পায় তার দিকে যথেষ্ট নজর আছে।

কিছু সময় পরে বের হয়ে পড়লাম ঘর থেকে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। দেখলাম জেলার সাহেব আসছেন। কয়েক মিনিট বসে তিনি চলে গেলেন। আমার বাগানের প্রশংসাও করলেন।

আবার একাকী ঘুরতে ঘুরতে সময় হয়ে এল। আজকে দশমিনিট দেরি হলো দরজা বন্ধ করতে। রাজবন্দিদের দরজা বন্ধ করা উচিত না। ইংরেজের সময়ও অনেক কাল পর্যন্ত রাজবন্দিদের দরজা বন্ধ করার হুকুম ছিল না।

দরজা বন্ধ কেন? গলা টিপে মারো, তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি নাই। শুধু শোষণ বন্ধ কর। জনগণের অধিকার ফেরত দাও।

 

২৮শে জুন ১৯৬৬ মঙ্গলবার

কি বিপদেই না পড়েছি! বাবুর্চি বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, পাক করবে কে? নতুন একজন আনলে আবারও আমার কয়েকদিন না খেয়ে থাকতে হবে। আমার তো তেমন কোনো ধারণাও নাই, তবুও বাবুর্চিকে নিয়ে একটা পাক প্রণালী আবিষ্কার করেছি। মেট বলল, একটা মুরগি এনেছিলাম, ডিম দিয়েছে। খুব খুশি জেলখানায় আবার মুরগিতে ডিম দেয়? বললাম, খুব ভাল, রেখে দেও, মুরগিকে বাচ্চা দেওয়াব। ডিম কিন্তু খাওয়া চলবে না।

২৬ সেলে সিকিউরিটি বন্দিরা থাকেন। ১৯৫৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে এখনও আছেন। সরকার ছাড়বার নাম নিচ্ছেন না। তারাও জানেন না কি করে মাথা নত করতে হয়। অনেকেই আছেন যারা ইংরেজ আমলেও দুই চার বার জেল খেটেছেন।

সেই ২৬ সেল থেকে আমার জন্য কুমড়ার ডগা, ঝিংগা, কাকরোল পাঠিয়েছেন। তাঁদের বাগানে হয়েছে, আমাকে রেখে খায় কেমন করে! আমার কাছে পাঠাতে হলে পাঁচটি সেল অতিক্রম করে আসতে হয়, দূরও কম না। বোধ হয় বলে-কয়ে পাঠিয়েছেন। তারা যে আমার কথা মনে করেন আর আমার কথা চিন্তা করেন, এতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। এঁরা ত্যাগী রাজবন্দি দেশের জন্য বহু কিছু ত্যাগ করছেন। জীবনের সবকিছু দিয়ে গেলেন এই নিষ্ঠুর কারাগারে। আমি তাদের সালাম পাঠালাম। তারা জানেন, আমাকে একলা রেখেছে, খুবই কষ্ট হয়, তাই বোধ হয় তাঁদের এই সহানুভূতি।

আজ ফলি মাছ দিয়েছে। বাবুর্চি বলল, কোপতা করতে হবে। বাবুর্চি জানে না, কেমন করে করতে হয়, আমিও জানি না। তবু করতে হবে। বললাম, বোধ হয় এইভাবে করতে হয়। বাবুর্চি ও আমি পরামর্শ করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করলাম। সেইভাবেই করা হলো। যখন খেতে শুরু করলাম মনে হলো কোপতা তো হয় নাই, তবে একটা নতুন পদ হয়েছে। কি আর করা যায়, চুপ করে খেয়ে নিলাম। বললাম, বাবারা, বাড়িতে যে রকম খাই তার ধারে কাছ দিয়েও যায় নাই। যাহা হউক খেয়ে ফেল, ফলি মাছ তো!’ মনে মনে হাসলাম, পাস করা বাবুর্চি আমি! ভাগ্য ভাল, বাইরের লোক ছিল না, থাকলে কোপতা আমার মাথায় ঢালতো। এই সময়ই মনে হলো একলা হয়ে

সুবিধাই হয়েছে।

খবরের কাগজ এসেছে। ভাসানী সাহেবের রাজনৈতিক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। যখন গুলি চলছিল, আন্দোলন চলছিল, গ্রেপ্তার সমানে সমানে চলেছে তখন দেখলাম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আবার দেখলাম দুই তিন দিন পরে কোথায় যেতে ছিলেন পড়ে যেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। হঠাৎ অসুস্থ মানুষ আবার বাড়ির বাহির হলেন কি করে? যখন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য কর্মীরা কারাগারে—এক নারায়ণগঞ্জে সাড়ে তিনশত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে, তখনও কথা বলেন না। আওয়ামী লীগ যখন জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করল তখন একদল ভাসানীপন্থী প্রগতিবাদী(!) এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে সরকারের সাথে হাত ও গলা মিলিয়েছে। এখন তিনি হঠাৎ আবার সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং নিজে ময়দানে নামবেন।

মওলানা সাহেব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে আইয়ুব খানকে সমর্থন করে চলেছেন। মওলানা সাহেবের সাথে যদি যুক্তফ্রন্ট করতে হয় তবে আইয়ুব সাহেবই বা কি অন্যায় করেছেন? মওলানা সাহেব তো দেশের সমস্যার চিন্তা করেন না। বৈদেশিক নীতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশে গণআন্দোলন বা দেশের জনগণের দাবি পূরণ ছাড়া বৈদেশিক নীতিরও কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। জনগণের সরকার কায়েম হলেই, জনগণ যে বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করতে বলবে, নির্বাচিত নেতারা তাহাই করতে বাধ্য। ডিক্টেটর যখন দেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেছে এবং একটা গোষ্ঠীর স্বার্থেই বৈদেশিক নীতি ও দেশের নীতি পরিচালনা করছে তার কাছ থেকে কি করে এই দাবি আদায় করবেন আমি বুঝতে পারছি না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, খাদ্য, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে তখন পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে এখন এসেছেন যুক্তফ্রন্ট করতে! আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতা ও কর্মীই কারাগারে বন্দি। কেহ কেহ আত্মগোপন করে কাজ করছে, এখন যে কয়েকজন বাইরে আছে তারা কিছুতেই এদের সাথে যোগদান করতে পারে না। আর ছয় দফা দাবি ছেড়ে দিয়ে কোনো নিম্নতম কর্মসূচি মেনে নিতে পারে না। ছয় দফাই হলো নিম্নতম কর্মসূচি। কোনো আপোষ নাই। জনগণ যখন এগিয়ে এসেছে তখন দাবি আদায় হবেই। আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে। জনগণকে আর ধোঁকা দেওয়া চলবে না। অনেক জগাখিচুড়ি পাকানো হয়ে গেছে। আর না। ভাসানী সাহেব এগিয়ে যান আইয়ুব সাহেবের দল নিয়ে। এখন তো তিনি সুখেই আছেন, আর কেন মানুষকে ধোঁকা দেওয়া? আওয়ামী লীগ বা তার নেতারা যদি ছয় দফা দাবি ত্যাগ করে আপোষ করতে চান তারা ভুল করবেন। কারণ তাহলে জনগণ তাদেরও ত্যাগ করবে।

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মানিক বাবু ও আবদুল মান্নানের জন্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন করা হইয়াছে। বিচারে কি হয় দেখা যাক।

 

২৯শে জুন ১৯৬৬ বুধবার

ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির পানি গায়ে লেগে, মশারির একটা অংশ ভিজে গিয়াছে। খুব ঘুমিয়েছিলাম, টের পাই নাই। বৃষ্টি হতেছে, মুষল ধারে। যখন বৃষ্টির খুব প্রয়োজন ছিল তখন হয় নাই, এখন যখন বৃষ্টির প্রয়োজন নাই তখন খুব হতেছে। বন্যায় দেশের খুবই ক্ষতি হয়েছে। চাউল তেল ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। মোনায়েম খান সাহেবের বক্তৃতায় পেট ভরে যাবে সকলের। তিনি বলেন, আল্লাহর তরফ থেকে বন্যা হয়েছে। কষ্টের ভিতর দিয়ে খোদা লোককে পরীক্ষা করে থাকেন। কি আর বলা যায়! বন্যা কনট্রোল করতে পারে আজকাল দুনিয়াতে। অনেক দেশে করেছেও। একটু চক্ষু খুলে দেখলে ভাল হয়। ভদ্রলোকের দোষ কি? কিই-বা জানেন আর কিই-বা বলবেন। খান সাহেব এদিক দিয়ে ভাল লোক, স্বীকার করেন যে। তিনি নূরুল আমীন সাহেবের হুকুমে গুন্ডামি করে বেড়াতেন। এখন তিনি লাট হয়েছেন। ভাল কথা। গুন্ডার পরে পান্ডা। পাড়ার পরে নেতা, এইতো হলো নেতার ডেফিনেশন।

হঠাৎ পেট দিয়ে রক্ত পড়লো অনেক ফিনকি দিয়ে, চেয়ে দেখলাম, সবই লাল। ব্যাপার কি? পাইলস তো সেরে গিয়াছে, অনেক আগেই, প্রায় তিন বৎসর হলো। পেটে কোনো অসুখ নাই। তাই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

আবার সকাল দশটায় একবার পায়খানায় যাই। দেখি আবার রক্ত, বুঝলাম আবার পাইলস হয়েছে। কিন্তু চিন্তা করে লাভ কি? ভুগতে তো হবেই। ডাক্তার সাহেব এলেন। বললেন, ঔষধ দিতেছি। ঔষধ পাঠাইয়া দিলেন। খুব সাবধানে থাকি আমি জেলে। শরীর রক্ষা করতে চাই, বাঁচতে চাই, কাজ আছে অনেক আমার। তবে একটা ছেড়ে আর একটা ব্যারাম এসে দেখা দেয়।

কাল জাতীয় পরিষদ থেকে বিরোধী দল একই দিনে দুইবার পরিষদ কক্ষ বর্জন করে—স্পিকারের রুলিংয়ের প্রতিবাদে। আমার মনে হয় বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের এই পরিষদ থেকে পদত্যাগ করাই উচিত। এই পরিষদের যা ক্ষমতা তাতে এর সদস্য হওয়ার অর্থ কি? দুনিয়াতে পার্লামেন্টের যে কনভেনশন আছে তার ধারে কাছ দিয়েও এরা যায় না।

প্রেসিডেন্ট, সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে একটা পরিষদ করেছে দুনিয়াকে দেখানোর জন্য। বিরোধী দলের নেতাকে বলতে দেয় না স্পিকার, এই প্রথম শুনলাম।

চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছেন আইয়ুব সাহেবের সাথে নতুন পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য। আপনাকে আমরাও স্বাগতম জানাই। চীনের সাথে বন্ধুত্ব আমরাও কামনা করি। তবে দয়া করে সার্টিফিকেট দিবেন না। আগে আপনি ও আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বড় বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়াছেন। লাভ হবে না। আপনারা জনগণের মুক্তিতে বিশ্বাস করেন, আর যে সরকার জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া আপনাদের উচিত না। এতে অন্য দেশের ভিতরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হয়। এই ব্যাপারে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও আপনাদের পথ এক না হওয়াই উচিত।

১৯৫৭ সালে আমি পাকিস্তান পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে চীন দেশে যাই। আপনি, আপনার সরকার ও জনগণ আমাকে ও আমার দলের সদস্যদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং আমাকে আপনাদের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দিয়ে যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আজও আমি ভুলি নাই। আমি আপনাদের উন্নতি কামনা করি। নিজের দেশে যে নীতি আপনারা গ্রহণ করেছেন আশা করি অন্য দেশে অন্য নীতি গ্রহণ করবেন না। আপনারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আর আমার দেশে চলেছে ধনতন্ত্রবাদ, আর

ধনতন্ত্রবাদের মুখপাত্রকে আপনারা দিতেছেন সার্টিফিকেট। আপনারা আমেরিকান সরকারের মতো নীতি বহির্ভূত কাজকে প্রশ্রয় দিতেছেন। দুনিয়ার শোষিত জনসাধারণ আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন। যেমন আমেরিকানরা নিজের দেশে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আর অন্যের দেশে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গণতন্ত্রকে হত্যা করে ডিক্টেটর বসাইয়া দেয়।

আজ তো আমার দেখা হওয়ার কথা নাই, এর মধ্যে জমাদার সাহেব এসে বললেন, চলেন আপনার, সাক্ষাৎ’। তাড়াতাড়ি যেয়ে দেখি আমার স্ত্রী আসে নাই। তার শরীর অসুস্থ কয়েকদিন ধরে। ছেলেমেয়েরা এসেছে। ছোট ছেলেটা আমাকে পেয়ে কিছু সময় ওর মায়ের কথা ভুলে গেল। ছেলেমেয়েরা ওদের লেখাপড়ার কথা বলল। আমার মা খুলনায় আছে, অনেকটা ভাল। ছোটখাট অনেক বিষয় বলল। অনেক আবদার। আমার কষ্ট হয় কিনা! ছোট মেয়েটা আমার কাছে কাছে থাকে, যাতে ওকে আমি আদর করি। বড় মেয়েটা বলছে, আব্বার চুলগুলি একেবারে পেকে গেল। বড় ছেলে কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। লজ্জা পায়। আমার কোম্পানির ম্যানেজার এসেছিল, ব্যবসা সম্বন্ধে আলোচনা করতে। বললাম যে, যারা আমাদের ব্যবসা দেয় তাদের আমার কথা বলতে, নিশ্চয়ই ব্যবসা দিবে। ছোট ছেলেটার, তার মার কথা মনে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বললাম, তোমরা যাও না হলে ও কাঁদবে।

ছেলেমেয়েরা চলে গেল। দেখলাম ওরা যেতেছে। মনে পড়ল নিশ্চয়ই রেণুর শরীর বেশি খারাপ নতুবা আসতো। সামান্য অসুস্থতায় তাকে ঘরে রাখতে পারত না। জেলের ভিতর চলে এলাম আমার জায়গায়। আমি তো একা আছি, এই নির্জন ইটের ঘরে। আমাকে একলাই থাকতে হবে। চিন্তা তো মনে আসেই।

 

৩০শে জুন ১৯৬৬ বৃহস্পতিবার

সকালে উঠে হাঁটছিলাম। ৭ তারিখের হরতালের দিনে যে ছেলেগুলিকে ধরেছিল তার মধ্যে কয়েকটা ছেলেকে আমার কাছেই পুরানা ২০ সেলে রেখেছিল। নাস্তা নিতে বের হয়েছে। দু’টা ছেলে আমাকে দেখে বলছে, স্যার আমাদের সাজাও দেয় নাই যে খেটে খাবো, আবার জামিন নেওয়ারও কেহ নাই। আমরা গ্রাম থেকে চাকরির জন্য এসেছিলাম। বলুন তো এদের কি উত্তর দেব? ওরা কি বোঝে আমিও কয়েদি? শুধু কয়েদি নয় আলাদা করে রেখেছে, একাকী। কিছুই না বলে চুপ করে রইলাম। মনে মনে বললাম, এ অত্যাচার আর কতদিন চলবে! দয়া মায়া কি এদের নাই! শাসকগোষ্ঠী বা সরকারি কর্মচারীদের কি ছেলেমেয়েও নাই যে এরা বোঝে না! যদি কেহ অন্যায় করে থাকে, বিচার করো তাড়াতাড়ি। এই জেলে অনেক লোক আছে যারা দুই তিন বৎসর হাজতে পড়ে আছে সামান্য কোনো অপরাধের জন্য। যদি বিচার হয় তবে ৬ মাসের বেশি সেই ধারায় জেল হতে পারে না। বিচারের নামে একি অবিচার! আমার মনের অবস্থা আপনারা যারা বাইরে আছেন বুঝতে পারবেন না। কারাগারের এই হঁটের ঘরে গেলে বুঝতে পারতেন।

শরীরটা ভাল যেতেছে না। ভাল বইপত্র দিবে না, Reader’s Digest পর্যন্ত দেয় না। মনমতো কোনো বই পড়তেও দিবে না। এইভাবে শাসন চলতে পারে না। এর ফলাফল ভয়াবহ হবে দেখেও এরা বোঝে না। ইংরেজ যাবার সময় যেমন তাদেরই তাবেদারদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল আর তা হবে না। একথা বুঝেও বোঝে না।

ঘরে চলে এলাম, জমাদার সিপাহি মেট পাহারা হৈ চৈ লাগাইয়া দিয়েছে। বড় সাহেব আসবে ডিগ্রি এলাকায়। আমাদের দেখতে আসেন, কিছু বলার থাকলে তিনি শোনেন। প্রায় দশটার সময় সদলবলে আসলেন আমার ঘরে, বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছি? খুব ভাল আছি। আমার কিছু বলার নাই। ঠিক করেছি কোনো কিছুই বলব না। একলাই জেল খেটে যাবো। যতদিন রাখতে হয় রাখুক, কিছুই আসে যায় না। জীবনে একলাই জেল খেটেছি অনেক দিন।

তিনি চলে গেলেন। আবার বই নিয়ে বসলাম।

দুপুরে কাগজ এলে দেখলাম সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদ, নিখিল পাক সংবাদপত্র সমিতি ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত যুক্ত কমিটি অদ্য দৈনিক ইত্তেফাকের বিরুদ্ধে গৃহীত সরকারি ব্যবস্থার প্রতিবাদে আগামী ৫ই জুলাই একদিন প্রতীকী ধর্মঘট পালনের জন্য সংবাদপত্র শিল্প ও সংবাদ সরবরাহ সংস্থাসমূহের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। ৫ই জুলাই সান্ধ্য পত্রিকা ও ৬ই জুলাই কোনো প্রভাতি পত্রিকা যাহাতে প্রকাশিত হতে না পারে সেই জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন। সমন্বয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেনের গ্রেপ্তার ও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করেন।

নিশ্চয় এটা একটা শুভ সূচনা। কারণ আজ ইত্তেফাক ও ইত্তেফাক সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা, কাল আবার অন্য কাগজ ও তার মালিকের উপর সরকার হামলা করবে না কে বলতে পারে! সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই, এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শাসকগোষ্ঠী কোন পথে নিয়ে চলেছে ভাবতেও ভয় হয়! আজ দলমত নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান উচিত।

আজ জুন মাস শেষ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *