২.২ ভূমির আদিকৃষকেরা

ভূমির আদিকৃষকেরা
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ২

এইমাত্র আমরা দেখেছি যে আদিম যাযাবরদের মধ্যে নারীর ভাগ্য ছিলো খুবই কঠিন, এবং কোনো সন্দেহ নেই যে-নিষ্ঠুর অসুবিধাগুলো বিকল করে রেখেছিলো নারীকে, সেগুলো দূর করার কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয় নি। তবে পরে পিতৃসুলভ স্বৈরাচারের উদ্যোগে বলপ্রয়োগ করে নারীকে যেমন পীড়ন করা হয়েছে, তেমন পীড়নও করা হয় নি। কোনো সংস্থা দূর করে নি দু-লিঙ্গের অসাম্য, আসলে কোনো সংস্থাই ছিলো না–ছিলো না সম্পত্তি, ছিলো না উত্তরাধিকার, ছিলো না আইন। ধর্ম ছিলো ক্লীব : উপাসনা করা হতো কোনো অলিঙ্গ টোটেমের।

সংস্থা ও আইন দেখা দেয় যখন যাযাবররা বসতি স্থাপন করে হয়ে ওঠে কৃষিজীবী। পুরুষকে আর বিরূপ প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় না; বিশ্বের ওপর সে যে-রূপ চাপিয়ে দিতে চায়, তার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে ভাবতে শুরু করে বিশ্ব ও নিজের সম্পর্কে। এসময়ে লৈঙ্গিক পার্থক্য প্রতিফলিত হয় মানবগোষ্ঠির সংগঠনে, এবং এটি ধারণ করে এক বিশেষ রূপ। কৃষিসমাজে নারীকে মাঝেমাঝে ভূষিত করা হতো এক অসাধারণ মর্যাদায়। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় সন্তান যে-নতুন গুরুত্ব অর্জন করে, মূলত তার সাহায্যেই ব্যাখ্যা করতে হবে এ-মর্যাদাকে। বিশেষ এলাকায় বসতি স্থাপন করে পুরুষ তার ওপর প্রতিষ্ঠা করে নিজের মালিকানা, এবং সম্পত্তি দেখা দেয় যৌথরূপে। সম্পত্তির জন্যে দরকার পড়ে তার মালিকের থাকবে উত্তরপুরুষ, এবং মাতৃত্ব হয়ে ওঠে এক পবিত্র ভূমিকা।

বহু গোত্র বাস করতো সংঘের অধীনে, তবে এর অর্থ এ নয় যে নারীরা থাকতো সাধারণভাবে সব পুরুষের অধিকারে–এখন আর মোটেই মনে করা হয় না যে অবাধ যৌনতা কখনো ছিলো সাধারণ রীতি–তবে পুরুষ ও নারী ধর্মীয়, সামাজিক, ও আর্থনীতিক অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুধু একটি দল হিশেবে : তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ছিলো নিতান্তই এক জৈবিক সত্য। বিবাহ–একপতিপত্নীক, বহুপত্নীক, বা বহুস্বামীক–তার রূপ যা-ই হোক-না-কেননা, ছিলো একটা ঐহিক আকস্মিকতা, এটা কোনো অতীন্দ্রিয় বন্ধন সৃষ্টি করতো না। এটা স্ত্রীটিকে কোনো দাসত্ববন্ধনে জড়াতো না, কেননা সে তখনো যুক্ত থাকতো তার নিজের গোত্রের সাথে।

এখন, অনেক আদিম মানবগোষ্ঠিই অজ্ঞ ছিলো সন্তান জন্মদানে পিতার ভূমিকা সম্বন্ধে (অনেক ক্ষেত্রে একে আজো সত্য বলে মনে হয়); সন্তানদের তারা মনে করতো তাদেরই পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মার পুনর্জন্মগ্রহণ বলে, যে-প্রেতাত্মারা বাস করতো কোনো গাছে বা প্রস্তরে, কোনো পবিত্র স্থানে, এবং নেমে এসে ঢুকতে নারীদের শরীরে। অনেক সময় মনে করা হতো যে এ-অনুপ্রবেশ যাতে সহজ হয়, তার জন্যে নারীদের কুমারী থাকা ঠিক হবে না; তবে অন্যান্য জনগোষ্ঠি বিশ্বাস করতো যে এটা নাক দিয়ে বা মুখ দিয়েও ঘটতে পারে। তা যা-ই হোক, এতে সতীত্বমোচন ছিলো গৌণ, এবং অতীন্দ্রিয় প্রকৃতির কারণে খুব কম সময়ই এটা ছিলো স্বামীর বিশেষাধিকার।

তবে সন্তান জন্মদানের জন্যে মা ছিলো সুস্পষ্টভাবে আবশ্যক; মা-ই ছিলো সেজন, যে নিজ দেহের ভেতরে জীবাণুটিকে রক্ষা করতে ও তার পুষ্টি যোগাতো, সুতরাং তার মাধ্যমেই গোত্রের জীবন বিস্তার লাভ করতে দৃশ্যমান বিশ্বে। এভাবে সে পালন করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অধিকাংশ সময়ই শিশুরা অন্তর্ভুক্ত হতে তাদের মায়ের গোত্রে, ধারণ করতো গোত্রের নাম, এবং পেন্সে গোত্রের অধিকার ও সুযোগসুবিধা, বিশেষ করে গোত্রের অধিকারে যে-জমি থাকতো, তা ব্যবহারের অধিকার। সংঘের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীরা পেতো নারীদের কাছ থেকে : নারীদের মাধ্যমে ভূমি ও শস্যের মালিকানা নিশ্চিত করা হতো গোত্রের সদস্যদের মধ্যে, এবং বিপরীতভাবে এ-সদস্যরা তাদের মায়েদের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো এই বা ওই এলাকার জন্যে। আমরা তাই অনুমান করতে পারি যে এক অতীন্দ্রিয় অর্থে মৃত্তিকার মালিক ছিলো নারীরা : ভূমি ও তার শস্যের ওপর নারীদের ছিলো অধিকার, যা ছিলো যুগপৎ ধর্মীয় ও আইনগত। নারী ও ভূমির মধ্যে বন্ধন ছিলো মালিকানার থেকেও ঘনিষ্ঠ, কেননা মাতৃধারার ব্যবস্থায় বৈশিষ্ট্যই ছিলো নারীকে মৃত্তিকার সাথে সত্যিকারভাবে সমীভূত করা; উভয়ের মধ্যেই জীবনের চিরস্থায়িত্ব–যা ছিলো মূলত প্রজনন–লাভ করা হতো তার ব্যক্তিক মূর্তপ্রকাশদের, অবতারদের জন্মদানের মাধ্যমে।

যাযাবরদের কাছে সন্তানের জন্মকে নিতান্ত আকস্মিক ঘটনার বেশি কিছু মনে হতো না, এবং মৃত্তিকার সম্পদের কথা ছিলো তাদের অজানা; কিন্তু কৃষিজীবী বিস্মিত হতে উৎপাদনশীলতার রহস্যে, যা দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠতো তার হলরেখায় ও মাতার শরীরের ভেতরে : সে বুঝতে পারতো সেও জন্মেছে ওই পশু ও শস্যের মতো, সে চাইতো তার গোত্র জন্ম দিক আরো পুরুষ, যারা তার গোত্রকে স্থায়িত্ব দেয়ার সাথে ভূমির উর্বরতাকেও দেবে স্থায়িত্ব; প্রকৃতিকে তার মনে হতো মায়ের মতো : ভূমি হচ্ছে নারী এবং নারীর ভেতরে বাস করে সে-একই দুর্বোধ্য শক্তিগুলো, যেগুলো বাস করে মাটির গভীরে। এ-কারণেই কৃষিকাজের ভার অনেকটা দেয়া হতো নারীর ওপর; পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মাদের যে ডেকে আনতে পারে নিজের শরীরের ভেতরে, তার সে-শক্তিও থাকার কথা যা দিয়ে সে রোপন করা জমিতে ফলাবে ফল ও শস্য। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো সৃষ্টিশীল কাজের ব্যাপার ছিলো না, ছিলো ইন্দ্রজালের ব্যাপার। এ-পর্যায়ে শুধু মাটির শস্যরাজি সংগ্রহের মধ্যে পুরুষ আর নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি, তবে সে তখনো নিজের শক্তিকে বুঝতে পারে নি। নিজেকে অক্রিয় বোধ করে, যেপ্রকৃতি নির্বিচারে ঘটাতে জীবন ও মৃত্যু, তার ওপর নির্ভরশীল থেকে দ্বিধান্বিতভাবে সে দাঁড়িয়ে ছিলো কৌশল ও যাদুর মধ্যে। একথা সত্য, কম বা বেশি স্পষ্টভাবে সে বুঝতে পারে যৌনকর্মের এবং যে-সব কৌশলে সে ভূমিকে আবাদযোগ্য করে তুলছে, তার কার্যকারিতা। এ-সত্ত্বেও সন্তান ও শস্যকে দেবতাদের দান বলেই মনে করা হতো এবং বিশ্বাস করা হতো যে নারীর শরীর থেকে বয়ে আসা রহস্যময় প্রবাহগুলো এ-বিশ্বে নিয়ে আসে জীবনের রহস্যময় উৎসে নিহিত সম্পদরাশি।

এসব বিশ্বাসের মূল খুবই গভীরে প্রোথিত এবং আজো টিকে আছে ভারতি, অস্ট্রেলীয়, ও পলিনেশীয় অনেক গোত্রের মধ্যে। অনেক গোত্রে বন্ধ্যা নারীকে ভয়ঙ্কর মনে করা হয় বাগানের জনে, অনেক গোত্রে মনে করা হয় যে ফলন হবে প্রচুর যদি ফসল কাটে গর্ভবতী নারী; আগে ভারতে রাতের বেলা নগ্ন নারীরা জমির চারদিকে লাঙল চালাতো ইত্যাদি। এক উপবিষ্ট অস্তিত্বের মধ্যে বন্দী করে মাতৃত্ব ধ্বংস করে নারীকে; তাই এটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে যে যখন সে থাকে চুলোর ধারে তখন পুরুষ শিকার করে, মাছ ধরে, এবং যুদ্ধ করে। আদিম মানুষদের উদ ছিলো ছোটো, সেগুলোর অবস্থান ছিলো গ্রামের সীমার মধ্যেই; এবং তাদের কৃষিকাজ ছিলো একটা গৃহস্থালির কাজ; এবং প্রস্তুর যুগের হাতিয়ার ব্যবহারেো খুব বেশি শক্তির দরকার পড়তো না। অর্থনীতি ও ধর্ম কৃষিকাজের ভার ছেড়ে দিয়েছিলো নারীর হাতে। যখন গার্হস্থ্যশিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে, তাও হয় তাদের জন্যে দুর্ভাগ্য : তারা মাদুর বোনে ও কাঁথা সেলাই করে এবং বানায় হাঁড়িপাতিল। তাদের মধ্য দিয়েই গোত্রের জীবন সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত হতো; সন্তান, পশু, শস্য, হাঁড়িপাতিল, দলের সব ধরনের সমৃদ্ধি নির্ভর করতে তাদের শ্রম ও ঐন্দ্রজালিক শক্তির ওপর তারা ছিলো সমাজের আত্মা। এ-শক্তি পুরুষের মনে জাগাতো ভয়মেশানো ভক্তি, যা প্রতিফলিত হতো তাদের উপাসনায়। সমগ্র বিরুদ্ধ প্রকৃতির সারসংক্ষেপ ঘটেছিলো নারীতে।

যেমন ইতিমধ্যেই আমি বলেছি, পুরুষ কখনো অপর-এর কথা না ভেবে নিজের সম্পর্কে ভাবে না; সে বিশ্বকে দেখে দ্বৈততার প্রতীকে, যা প্রথমত যৌন ধরনের নয়। কিন্তু পুরুষের থেকে ভিন্ন হয়ে, যে-পুরুষ নিজেকে নির্দেশ করে পুরুষ বলেই, স্বাভাবিকভাবেই নারীকে নির্দেশ করা হয় অপর বলে; অপর হচ্ছে নারী। যখন নারীর ভূমিকা বৃদ্ধি পায়, তখন সে পুরোপুরিভাবে নির্দেশ করে অপর-এর এলাকা। তারপর দেখা দিতে থাকে সে-দেবীরা, যাদের মধ্য দিয়ে পুজো করা হয় উর্বরতার ধারণাকে। সুসায় পাওয়া গেছে মহাদেবীর, মহামাতার আদিতম মূর্তি, যার বস্ত্র দীর্ঘ এবং কেশবিন্যাস উচ্চ, অন্যান্য মূর্তিতে যাকে আমরা দেখতে পাই মিনারের মুকুটশোভিত। ক্রিটে খননকার্যের ফলে এমন কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে। কখনো কখনো সে স্কুল ও অবনত, কখনো কখনো তন্বী ও দণ্ডায়মান, কখনো বস্ত্রপরিহিত এবং প্রায়ই নগ্ন, তার দুই বাহু চেপে আছে তার স্ফীত স্তনযুগলের নিচে। সে স্বর্গের রাণী, তার প্রতীক কপোত; সে নরকেরও সম্রাজ্ঞী, যখন সে হামাগুড়ি দিয়ে চলে তখন সাপ তার প্রতীক। সে আবির্ভূত হয় পর্বতে ও অরণ্যে, সমুদ্রে, ঝরনাধারায়। সবখানেই সে সৃষ্টি করে জীবন; যদিও সে হত্যা করে, তবু সে আবার জীবন দেয় মৃতকে। চপলা, বিলাসিনী, প্রকৃতির মতো নির্মম, একই সাথে প্রসন্ন ও ভয়ঙ্করী সে রাজত্ব করে সমগ্র অ্যাজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, ফ্রিজিয়া, সিরিয়া, আনাতোলিয়ায়, সমগ্র পশ্চিম এশিয়ায়। ব্যাবিলনিয়ায় তাকে বলা হতো ইশতার, সেমেটীয়রা বলতো আস্তারতে, এবং গ্রিকরা বলতো গাইয়া, বা সিবিলে। মিশরে তাকে আমরা দেখতে পাই আইসিস রূপে। পুরুষ দেবতারা ছিলো তার অধীনে।

সুদূর স্বর্গ ও নরকের পরম দেবীপ্রতিমা, নারী সব পবিত্র সত্তার মতোই মর্ত্যে পরিবৃত ছিলো ট্যাবুতে, সে নিজেই ট্যাবু; সে ধারণ করতো যে-শক্তি, তারই জন্যে তাকে দেখা হতো এক ঐন্দ্রজালিক, অভিচারিণীরূপে। প্রার্থনায় তার আবাহন করা হতো, কখনো সে হয়ে ওঠে যাজিকা, যেমন হতে প্রাচীন কেল্টদের ড্রইডদের মধ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে অংশ নেয় গোত্রীয় শাসনকর্মে, এমন কি হয় একক শাসক। এ-সুদূর যুগগুলো আমাদের জন্যে কোনো সাহিত্য রেখে যায় নি। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের মহাপর্বগুলো তাদের পুরাণ, কীর্তিস্তম্ভ, ও ঐতিহ্যধারার মধ্যে সংরক্ষণ করেছে সেসময়ের স্মৃতি, যখন খুবই মহিমান্বিত অবস্থান অধিকার করে ছিলো নারীরা। নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, ঋগ্বেদ-এর যুগের উঁচু অবস্থান থেকে নারীর পতন ঘটতে থাকে ব্রাহ্মণ্য যুগে, এবং ঋগ্বেদ-এর যুগে পতন ঘটেছিলো পূর্ববর্তী আদম স্তর থেকে। ইসলামপূর্ব যুগে বেদুইন নারীরা উপভোগ করতে কোরানে প্রদত্ত মর্যাদার থেকে অনেক উচ্চতর মর্যাদা। নিওবি, মিডিয়ার মহামূর্তিগুলো এমন এক যুগের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, যখন মাতারা গর্ববোধ করতো তাদে্র সন্তানদের নিয়ে, মনে করতো সন্তানেরা একান্তভাবে তাদেরই সম্পদ। এবং হোমারের কাব্যে অ্যান্ড্রোমাকি ও হেকিউবার ছিলো এমন গুরুত্ব, যা ধ্রুপদী গ্রিস আর নারীকে দেয় নি।

এসব তথ্য এমন অনুমানের দিকে এগিয়ে দেয় যে আদিম কালে সত্যিই ছিলো নারীরাজত্বের একটা যুগ : মাতৃতন্ত্র। বাখোফেনের প্রস্তাবিত এ-প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন এঙ্গেলস, এবং মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণকে তিনি বলেছিলেন নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। তবে নারীর সে-স্বর্ণযুগ আসলে একটি কিংবদন্তি মাত্র। একথা বলা যে নারী ছিলো অপর, এর অর্থ হচ্ছে দুলিঙ্গের মধ্যে কখনোই পারস্পরিক সম্পর্ক বিরাজ করে নি; ভূমি, মাতা, দেবী–

পুরুষের চোখে সে কোনো সঙ্গী প্রাণী ছিলো না; তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিলো মানবিক এলাকার বাইরে, সুতরাং সে ছিলো ওই এলাকার বাইরের। সমাজ চিরকালই থেকেছে পুরুষের; রাজনীতিক শক্তি চিরকালই থেকেছে পুরুষের হাতে। সর্বসাধারণ বা সামাজিক কর্তৃত্ব সর্বদাই থাকে পুরুষের অধিকারে, আদিম সমাজ বিষয়ক এক গবেষণার শেষ দিকে ঘোষণা করেছেন লেভি-স্ট্রাউস।

পুরুষের কাছে সব সময়ই সহকর্মী হচ্ছে আরেকজন পুরুষ, আরেকজনও তারই মতো, যার সাথে গড়ে ওঠে তার পারস্পরিক সম্পর্ক। সমাজের মধ্যে এক রূপে বা অন্য রূপে গড়ে ওঠে যে-দ্বৈততা, তাতে এক দল পুরুষ বিপক্ষে যায় আরেক দল পুরুষের; নারীরা হয় তাদের সম্পত্তির অংশ, যা থাকে দু-দল পুরুষেরই দখলে এবং যা তাদের মধ্যে বিনিময়ের একটি মাধ্যম। নারী কখনোই নিজের পক্ষ থেকে পুরুষের বিপরীতে একটি পৃথক দল গড়ে তোলে নি। তারা কখনোই পুরুষের সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ ও স্বায়ত্তশাসিত সম্পর্কে আসে নি। বিয়ের মধ্যে থাকে যে পারস্পরিক বন্ধন, তা পুরুষেরা ও নারীরা স্থাপন করে না, বরং নারীর মাধ্যমে তা স্থাপিত হয় পুরুষদের ও পুরুষদের মধ্যে, নারীরা তাতে থাকে শুধু প্রধান ব্যাপার, বলেছেন লেভি-স্ট্রাউস। নারীটি যে-সমাজের অন্তর্ভুক্ত, তার বংশধারা নির্দেশের রীতি যাই হোক-না-কোনো, তাতে নারীর প্রকৃত অবস্থার কোনো বদল ঘটে না; তা মাতৃধারাই হোক, বা পিতধারাই হোক, বা উভয়ধারাই হোক, বা অভিন্ন ধারাই হোক, সে সব সময়ই থাকে পুরুষদের অভিভাবকত্বে। একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে বিয়ের পর নারী থাকবে কার কর্তৃত্বে, পিতার না বয়োজ্যষ্ঠ ভ্রাতার–এমনকি এ-কর্তৃত্ব সম্পসারিত হতে পারে নারীর সন্তানদের পর্যন্ত না কি সে থাকবে তার স্বামীর কর্তৃত্বে। নারী, নিজের দিক দিয়ে, কখনোই তার ধারার প্রতীকের থেকে বেশি কিছু নয়… মাতৃধারার বংশধারা হচ্ছে নারীটির পিতা বা ভ্রাতার অভিভাবকত্ব, যা পেছনের দিকে সম্প্রসারিত হয়ে গিয়ে পৌঁছে ভাইয়ের গ্রামে, এটা লেভি-স্ট্রাউস থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি। সে নিতান্তই অভিভাবকত্বের মধ্যস্থতাকারী, সে অভিভাবক নয়। সত্য হচ্ছে বংশধারার রীতি অনুসারে সম্পর্ক নির্ণীত হয় দুটি দলের পুরুষের মধ্যে, দুটি লিঙ্গের মধ্যে নয়।

বাস্তবিকভাবে নারীর প্রকৃত অবস্থা এক বা অন্য ধরনের কর্তৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত নয়। এমন হতে পারে যে মাতৃধারার পদ্ধতিতে তার অবস্থান অতি উচ্চে; তবু আমাদের সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে কোনো গোত্রের  প্রধান বা রাণীরূপে কোনো নারী থাকলেই বোঝায় না যে সেখানে নারীরাই সার্বভৌম : মহান ক্যাথেরিনের সিংহাসন আরোহণের ফলে রাশিয়ার কৃষক নারীর ভাগ্যের কোনো বদল ঘটে নি; এবং এমন পরিস্থিতিতে নারী প্রায়ই বাস করে শোচনীয় অবস্থায়। উপরন্তু, এমন ঘটনা খুবই দুর্লভ যেখানে স্ত্রীটি বাস করে তার গোত্রের সঙ্গে, আর তার স্বামীকে দেয়া হয় তার সাথে স্বল্পকালীন, এমনকি সংগোপন সাক্ষাতের অনুমতি। অধিকাংশ সময়ই সে যায় স্বামীর করার জন্যে, এটি এমন ঘটনা যা পুরুষের প্রাধান্য প্রদর্শনের জন্যে যথেষ্ট।

অধিকতর ব্যাপক পরিবর্তনমূলক ব্যবস্থায় পরস্পরসংবদ্ধ হয় দু-রকম কর্তৃত্ব, একটি ধর্ম, আর অপরটি ওঠে পেশা ও ভূমিচাষ ভিত্তি করে। ঐহিক সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের আছে এক বিশাল সামাজিক গুরুত্ব, এবং দাম্পত্য পরিবার, ধর্মীয় তাৎপর্যহীন হয়ে পড়লেও, মানবিক স্তরে যাপন করে এক তীব্র জীবন। এমনকি যে-সব জনগোষ্ঠিতে বিরাজ করে মহাযৌনস্বাধীনতা, সেখানেও যে-নারী পৃথিবীতে একটি শিশু আনে, তাকে বিবাহিত হওয়া সঙ্গত; সে একলা নিজের সন্তান নিয়ে একটি দল গঠনে অসমর্থ। এবং তার ভাইয়ের ধর্মীয় তত্ত্বাবধান অপ্রতুল : একটি স্বামীর উপস্থিতি দরকার। তার সন্তানের ব্যাপারে পুরুষটির প্রায়ই থাকে গুরুদায়িত্ব। তারা তার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয় না, তবুও তাকেই তাদের ভরণপোষণ ও লালনপালন করতে হয়। স্বামী ও স্ত্রীর, পিতা ও পুত্রের মধ্যে স্থাপিত হয় সঙ্গমের, কর্মের, অভিন্ন স্বার্থের, প্রীতির বন্ধন।

অতীন্দ্রিয় ও আর্থনীতিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য একটি অস্থির ব্যাপার। পুরুষ প্রায় সর্বদাই তার ভ্রাতপুত্রের থেকে নিজের পুত্রের সাথে অনেক বেশি দৃঢ়ভাবে লগ্ন থাকে; যখন সময় আসে সে নিজেকে পিতা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই বেশি পছন্দ করে। এ-কারণেই বিবর্তন যখন পুরুষকে আত্মসচেতনতা ও নিজের ইচ্ছে প্রয়োগের পর্যায়ে নিয়ে আসে, তখন প্রতিটি সমাজ পিতৃতান্ত্রিক রূপ ধারণ করতে থাকে। তবে একথাটিকে গুরুত্ব দিতে হবে যে এমনকি যখন সে বিহ্বল ছিলো জীবনের, প্রকৃতির, ও নারীর রহস্যের মুখখামুখি, তখনও সে কখনো শক্তিহীন ছিলো না; যখন, নারীর ভয়ঙ্কর ইন্দ্রজালে সন্ত্রস্ত হয়ে, সে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করে অপরিহার্যরূপে, তখনও সেই নারীকে প্রতিষ্ঠিত করে এই রূপে এবং এভাবে এ-স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সে-ই কাজ করে অপরিহার্যরূপে। নারীর উর্বরতাশক্তি সত্ত্বেও পুরুষই থেকেছে নারীর প্রভু, যেমন পুরুষই মালিক উর্বর ভূমির; যার ঐন্দ্রজালিক উর্বরতার সে প্রতিমূর্তি, সে-প্রকৃতির মতো পুরুষের অধীনে, অধিকারে, শশাষণের মধ্যে থাকাই নারীর নিয়তি। পুরুষের কাছে সে পায় যে-মর্যাদা, তা তাকে দিয়েছে পুরুষই; পুরুষ প্রণাম করে অপরকে, উপাসনা করে দেবী মাতার। তবে এভাবে নারীকে যতো শক্তিশালীই বলেই মনে হোক, সে এটা লাভ করেছে শুধু পুরুষের মনের ভাবনার মধ্য দিয়েই।

পুরুষ যতো মূর্তি তৈরি করেছে, সেগুলোকে যতোই করা মনে হোক-না-কোননা, আসলে সেগুলো পুরুষেরই অধীন; এবং এ-কারণে সেগুলোকে ধ্বংস করার শক্তিও সব সময় রয়েছে তার আয়ত্তে। আদিম সমাজে ওই অধীনতা স্বীকার করা হয় না এবং খোলাখুলিভাবে প্রয়োগ করা হয় না, তবে ঘটনার প্রকৃতি অনুসারে এর আছে অব্যবহিত অস্তিত্ব; এবং পুরুষ যখনই অর্জন করবে স্পষ্টতর আত্মসচেতনতা, যখনই সে সাহস পাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ও প্রতিরোধ করতে, তখনই প্রয়োগ করা হবে একে।

নারীর মধ্যে বহুবার পুনর্জন্ম নিতো যে-টোটেমি পিতৃপুরুষ, পশু বা বৃক্ষবাসী কারো নামে সে ছিলো এক পুরুষ-নীতি; নারী পিতৃপুরুষের অস্তিত্বকে স্থায়িত্ব দিতো দেহে, কিন্তু তার ভূমিকা ছিলো শুধুই পুষ্টিসাধনের, তা কখনো সৃষ্টিশীল ছিলো না। কোনো এলাকায়ই নারী সৃষ্টি করতো না; সন্তান ও অন্ন দিয়ে সে রক্ষা করতো গোত্রের জীবন, তবে এর বেশি কিছু নয়। সীমাবদ্ধতায় বন্দী হয়ে ধ্বংস হয় নারী, সে পুনর্জন্ম ঘটাতে থাকে শুধু সমাজের স্থিত বৈশিষ্ট্যের, আর আটকে থাকে তাতেই। তখন পুরুষ এগিয়ে যায় সে-সব কর্মকাণ্ডে, যা সমাজকে খুলে দেয় প্রকৃতি ও অন্য মনুষ্যমণ্ডলির দিকে। পুরুষের যোগ্য কাজ ছিলো যুদ্ধ, শিকার, মাছধরা; সে লুণ্ঠন করে সম্পদ নিয়ে এসে দান করতে নিজের গোত্রকে; যুদ্ধ, শিকার, ও মাছধরা বোঝাতা অস্তিত্বের প্রসারণ, অস্তিত্বকে বিশ্বের দিকে প্রসারিত করে দেয়া। পুরুষ একাই থাকতো সীমাতিক্ৰমণতার প্রতিমূর্তি। তখনও তার পৃথিবী-নারীর ওপর সম্পূর্ণ আধিপত্য করার বাস্তব উপায় ছিলো না; তখনও সে পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করে নি–তবে এর মাঝেই পুরুষের মনে বাসনা জাগে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার।

আমার মতে এ-বাসনার মধ্যেই খুঁজতে হবে বহির্বিবাহ নামক প্রসিদ্ধ প্রথাটির গভীরপ্রাথিত কারণ, যে-প্রথা মাতৃধারার সমাজগুলোতে যা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। পুরুষ যদি জন্মদানে তার ভূমিকা সম্পর্কে অজ্ঞও থাকে, তবু বিয়ে তার জন্যে এক বিশাল গুরুত্বের ব্যাপার : বিয়ের মধ্য দিয়েই সে অর্জন করে পুরুষের মর্যাদা, এবং একখণ্ড জমি হয় তার। গোত্রটির সাথে সে জড়িত তার মায়ের মাধ্যমে, তার মাধ্যমে সে জড়িত তার পূর্বপুরুষদের ও তার সমস্ত কিছুর সাথে; কি তার সমস্ত ঐহিক ভূমিকায়, কর্মে, বিবাহে, সে মুক্তি পেতে চায় এ-বৃত্ত থেকে, সীমাবদ্ধতার ওপর জ্ঞাপন করতে চায় সীমাতিক্ৰমণতা, সে উন্মুক্ত করতে চায় এক ভবিষ্যৎ, যা খুবই ভিন্ন সেঅতীতের থেকে, যার গভীরে লুপ্ত তার মূল। বিভিন্ন সমাজে স্বীকৃত সম্পর্কের রীতি অনুসারে অজাচার নিষিদ্ধকরণ নেয় বিভিন্ন রূপ, তবে আদিম কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত এটা ধারণ করে আছে একই অর্থ : পুরুষ তা অধিকার করতে চায় সে যা নয়, সে তার সাথে মিলন চায় যাকে মনে হয় তার নিজেকে থেকে অপর। সুতরাং স্ত্রী তার স্বামীর মানার অংশী হবে না, তাকে হতে হবে স্বামীর কাছে অপরিচিত, এবং এভাবে তার গোত্রের কাছে অপরিচিত। আদিম বিবাহ অনেক সময় অনুষ্ঠিত হয়, সত্যিকার বা প্রতীকী, অপহরণের মধ্য দিয়ে, এবং নিশ্চিতভাবেই অপরের ওপর যেহিংস্রতা চালানো হয়, তা-ই হচ্ছে ওইজনের বিকল্পতার অতিশয় স্পষ্ট ঘোষণা। বলপ্রয়োগ করে নিজের স্ত্রীকে গ্রহণ করে যোদ্ধা দেখায় যে সে অপরিচিতদের সম্পদ নিজের অধিকারে আনতে এবং জন্মসূত্রে তার জন্যে নির্ধারিত হয়েছে যে-নিয়তি, তার সীমা ভেঙে ফেলতে সমর্থ। বিচিত্র রীতিতে স্ত্রী-ক্রয়–কর দান, সেবা দান–যদিও কম নাটকীয়, তবুও তার তাৎপর্য একই।

অল্প অল্প করে পুরুষ কাজ করতে থাকে তার অভিজ্ঞতা অনুসারে, এবং তার প্রতীকী উপস্থাপনে, যেমন তার বাস্তব জীবনে, যা জয়লাভ করে তা হচ্ছে পুরুষনীতি। চেতনা জয়ী হয় জীবনের ওপর, সীমাতিক্রমণতা জয়ী হয় সীমাবদ্ধতার ওপর, কৌশল জয় লাভ করে ইন্দ্রজালের ওপর, এবং যুক্তি জয় লাভ করে কুসংস্কারের। ওপর। মানুষের ইতিহাসে নারীর অবমূল্যায়ন হয়ে ওঠে একটি আবশ্যক পর্ব, কেননা নারীর মর্যাদা তার সদর্থক মূল্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, প্রতিষ্ঠিত পুরুষের দুর্বলতার ওপর। নারীতে মূর্তি পরিগ্রহ করে প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকর রহস্যগুলো, আর তখনই পুরুষ মুক্তি পায় নারীর অধিকার থেকে, যখন সে নিজেকে মুক্ত করে প্রকৃতি থেকে। লৌহ যুগ থেকে ব্রোঞ্জ যুগে অগ্রগতি তার শ্রমের মাধ্যমে তাকে সমর্থ করে মাটির ওপর তার প্রভুত্ব স্থাপনে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কৃষক মৃত্তিকার বাধাবিঘ্নের অধীন, বীজের অঙ্কুরোগমের অধীন, ঋতুর অধীন; সে অক্রিয়, সে প্রার্থনা করে, সে প্রতীক্ষা করে; এ-কারণেই একদা টোটেমি প্রেতাত্মারা ভিড় জমিয়েছিলো পুরুষের বিশ্বে; কৃষক তার চারপাশের এ-শক্তিগুলোর চপলতার অধীন। যন্ত্ৰকুশল পুরুষ, এর বিপরীতে, নিজের নকশা অনুসারে তৈরি করে তার যন্ত্রপাতি; তার পরিকল্পনা অনুসারে তার হাত দিয়ে একে সে গঠন করে; অক্রিয় প্রকৃতির মুখখামুখি হয়ে সে জয় করে প্রকৃতির প্রতিরোধ এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে তার সার্বভৌম ইচ্ছা। যদি সে নেহাইয়ের ওপর তার আঘাত দ্রুততর করে, তাহলে কম সময়ের মধ্যে সে তৈরি করে তার হাতিয়ার, আর সেখানে কোনো কিছুই শস্যের পেকে ওঠাকে ত্বরান্বিত করতে পারে না। সে যা তৈরি করছে, তা তৈরিতে সে নিজের দায়িত্ব বুঝতে পারে : তার দক্ষতায় বা অপটুতায় এটি তৈরি হবে বা ভাঙবে; সতর্ক, চতুর, সে তার দক্ষতাকে এমন এক উৎকর্ষের স্তরে নিয়ে যায় যে সে তাতে গর্ববোধ করে : দেবতাদের অনুগ্রহের ওপর তার সাফল্য নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে নিজের ওপর। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে সে তার সহচরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে, সে তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়। এবং যদিও সে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে কিছুটা জায়গা দেয়, তবু সে বোধ করে যে যথাযথ কৌশল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ; অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধ গ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান এবং বাস্তব স্বার্থগুলো প্রথম স্থান। সে দেবতাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়। তবে সে তাদের নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যেমন সে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনে তাদের থেকে; সে তাদের হাতে ছেড়ে দেয় অলিম্পীয় স্বর্গের ভার এবং পার্থিব এলাকাটি রাখে নিজের হাতে। মহাদেবতা প্যান ম্রিয়মাণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন বেজে ওঠে প্রথম হাতুড়ি ঘায়ের শব্দ এবং শুরু হয় পুরুষের রাজত্ব।

পুরুষ বুঝতে পারে তার শক্তি। তার সৃষ্টিশীল বাহুর সাথে তার তৈরি বস্তুর সম্বন্ধ থেকে সে বুঝতে পারে কার্যকারণ : বপন করা বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটতে পারে, আবার নাও পারে, কিন্তু আগুনের সংস্পর্শে পান দেয়ার সময়, যন্ত্রপাতি তৈরির সময় ধাতু সব সময়ই সাড়া দেয় একই ভাবে। যন্ত্রপাতির জগতটিকে বোঝা সম্ভব স্পষ্ট ধারণা অনুসারে : এখন দেখা দিতে পারে যৌক্তিক চিন্তা, যুক্তি ও গণিত। সম্পূর্ণ বর্জন করা হয় বিশ্ব সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণা। নারীর ধর্ম অবদ্ধ ছিলো কৃষির রাজত্ব কালের সাথে, অপর্যবসেয় সময়কালের, আকস্মিকতার, সুযোগের, প্রতীক্ষার, রহস্যের রাজত্ব কালের সাথে; হোমো ফাবের-এর রাজত্বকাল হচ্ছে স্থান অনুসারে সময়কে নিয়ন্ত্রণের, প্রয়োজনীয় ফলাফলের, পরিকল্পনার, কর্মের, যুক্তির রাজত্বকাল। এমনকি যখন সে জমিতে কাজ করে, তখনও সে এতে কাজ করে যন্ত্রকুশল পুরুষরূপে; সে আবিষ্কার করে যে মাটিকে উর্বর করা যায়, জমিকে পতিত রাখা ভালো, এই-এই বীজ ব্যবহার করতে হবে এই-এইভাবে। সে শস্যকে ফলতে বাধ্য করে; সে খাল খোঁড়ে, জল সেঁচে বা নিষ্কাশন করে, সে রাস্তা বানায়, মন্দির তৈরি করে : সে সৃষ্টি করে এক নতুন বিশ্ব।

যে-সব মানবগোষ্ঠি থেকে যায় দেবী মহামাতার নিয়ন্ত্রণে, যারা রক্ষা করে চলে মাতধারার শাসন, তারা বন্দী হয়ে পড়ে সভ্যতার আদিম স্তরে। নারীকে ততোটা মাত্রায়ই ভক্তি করা হতো, পুরুষ যতোটা হয়ে পড়েছিলো নিজের ভয়ের দাস : পুরুষ নারীকে ভক্তি করতো প্রেমে নয়, ত্রাসে। পুরুষ তার নিয়তি অর্জন করতে পারতো শুধু নারীকে সিংহাসনচ্যুত করে। তারপর থেকে পুরুষ সার্বভৌমরূপে স্বীকার করে শুধু সৃষ্টিশীল শক্তি, আলো, মনন, শৃঙ্খলা প্রভৃতি পুরুষ-নীতিকেই। দেবী মহামাতার পাশে দেখা দেয় আরেকটি দেবতা, পুত্র বা প্রেমিক, যে তখনো ছিলো দেবী মহামাতার অধীনে, কিন্তু সব বৈশিষ্ট্যেই সে দেবী মহামাতার মতো, এবং তার সহচর। সেও প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে এক উর্বরতা নীতির, বৃষরূপে দেখা দেয় মিনোতাউর, নীল নদী উর্বর করে তোলে মিশরের নিম্নাঞ্চল। সে মারা যায় শরতে এবং পুনর্জীবন লাভ করে বসন্তে, যখন তার অবেধ্য কিন্তু সান্ত্বনাহীনভাবে শোকাতুর স্ত্রী-মাতা নিজের শক্তি নিয়োগ করে খুঁজে পায় তার মৃতদেহ এবং পুনর্জীবন দেয় তাকে। এ-যুগলকে আমরা প্রথম আবির্ভূত হতে দেখি ক্রিটে, এবং তারপর দেখতে পাই ভূমধ্যসাগরীয় সমস্ত উপকূলে : মিশরে এটা আইসিস ও হোরাস, ফিনিশিয়ায় আস্তারতে ও অ্যাডোনিস, এশিয়া মাইনরে সিবিলে ও আত্তিস, এবং হেলেনি গ্রিসে এটা রিয়া ও জিউস।

এবং এর পরই সিংহাসনচ্যুত করা হয় মাহামাতাকে। মিশরে, যেখানে নারীর পরিস্থিতি থাকে অসাধারণভাবে অনুকূল, সেখানে নাট, যে হয় আকাশমণ্ডলের প্রতিমূর্তি, এবং আইসিস, উর্বরতার প্রতিমূর্তি, নীলনদের পত্নী এবং ওসিরিস রয়ে যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবী, কিন্তু তবুও সেখানে রা, যে দেবতা সূর্যের আলোর, পৌরুষ শক্তির, সে হয়ে ওঠে পরম প্রধান। ব্যাবিলনে ইশতার হয়ে ওঠে বেল-মার্দুকের পত্নী মাত্র। বেল-মার্দুক সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও সামঞ্জস্যবিধানকারী। সেমিটিদের দেবতাও পুরুষ। যখন সর্বশক্তি নিয়ে দেখা দেয় জিউস, তখন ক্ষমতাহীন হয়ে ওঠে গাইয়া, রিয়া, ও সিবিলে। দিমিতার থাকে একটি দ্বিতীয় মর্যাদার দেবী। বৈদিক দেবতাদের পত্নী আছে, কিন্তু স্বামীদের মতো পুজো পাওয়ার অধিকার তাদের নেই। রোমীয় জুপিটারের সমকক্ষ তো নেই কেউই।

তাই পিতৃতন্ত্রের বিজয় কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিলো না, আর তা প্রচণ্ড কোনো বিপ্লবের ফলও ছিলো না। মানবজাতির সূচনা থেকেই নিজেদের জৈবিক সুবিধা পুরুষকে দিয়েছে নিজেদের সর্বেসর্বা ও সার্বভৌমরূপে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা; তারা এ-অবস্থান কখনো ছেড়ে দেয় নি; তারা একদা তাদের স্বাধীন অস্থিত্বের একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছিলো প্রকৃতি ও নারীর কাছে; কিন্তু পরে তারা তা আঁবার অধিকার করে নেয়। অপর-এর ভূমিকা পালনের জন্যে দণ্ডিত নারী এছাড়াও দণ্ডিত হয় শুধু অনিশ্চিত শক্তি ধারণে : দাসী অথবা দেবী, নারী কখনো নিজের ভাগ্য নিজে বেছে নেয় নি। পুরুষ দেবতা সৃষ্টি করে; নারীরা তাদের পুজো করে, বলেছেন ফ্রেজার; পুরুষই ঠিক করে তাদের পরম দেবতা পুরুষ হবে না নারী হবে; পুরুষ নারীর জন্যে যা ঠিক করেছে, নারীর অবস্থা সব সময়ই হয়েছে তা-ই; নারী কখনোই তার নিজের বিধান আরোপ করে নি।

তবে যদি নারীর শক্তির মধ্যে থাকতো উৎপাদনশীল শ্রম, তাহলে হয়তো পুরুষের সাথে নারীও জয়ী হতো প্রকৃতির ওপর; তাহলে মানবপ্রজাতি দেবতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতো পুরুষ ও নারী উভয়েরই মধ্য দিয়ে; কিন্তু নারী নিজের জন্যে হাতিয়ারের প্রতি সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারে নি। এঙ্গেলস নারীর মর্যাদাহানির একটি অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র : একথা বলা যথেষ্ট নয় যে ব্রোঞ্জ ও লোহা আবিষ্কার উৎপাদনের শক্তিগুলোর ভারসাম্য নষ্ট করেছিলো গভীরভাবে এবং এর ফলেই নারী পতিত হয়েছিলো নিম্নাবস্থানে; নারী যে-পীড়ন ভোগ করেছে, তা ব্যাখ্যার জন্যে এনিম্নতার ধারণা যথেষ্ট নয়। নারীর জন্যে যা ছিলো দুর্ভাগ্যজনক, তা হচ্ছে সে শ্রমিকের সহকর্মী না হওয়ার ফলে সে বাদ পড়ে যায় মানবিক মিটজাইন থেকেও। নারী দুর্বল এবং তার উৎপাদন শক্তি কম, এটা তার বাদ পড়া ব্যাখ্যা করতে পারে না; নারী যেহেতু পুরুষের কর্মপদ্ধতি ও চিন্তারীতিতে অংশ নেয় নি, যেহেতু নারী দাসত্বের বন্ধনে রয়ে গেছে জীবনের রহস্যময় প্রক্রিয়ার কাছে, তাই পুরুষ নারীর মধ্যে নিজের মতো কোনো সত্তাকে দেখতে পায় নি। যেহেতু সে গ্রহণ করে নি নারীকে, তার চোখে যেহেতু নারীকে মনে হয়েছে অপর-এর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে, তাই পুরুষের পক্ষে নারীর পীড়নকারী ছাড়া আর কিছু হয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। পুরুষের ক্ষমতা লাভের ও সম্প্রসারণের ঈলা নারীর অশক্তিকে পরিণত করেছে একটি অভিসম্পাতে।

নতুন কৌশলগুলো খুলে দিয়েছিলো যে-সব সম্ভাবনা, পুরুষ চেয়েছিলো সেগুলো চূড়ান্তরূপে বাস্তবায়িত করতে : সে কাজে লাগাতে থাকে দাসশ্রমশক্তি, সহকর্মী পুরুষদের সে পরিণত করে দাসে। নারীদের শ্রমের থেকে দাসদের শ্রম যেহেতু ছিলো অনেক বেশি কার্যকর, তাই গোত্রের মধ্যে নারী যে-আর্থনীতিক ভূমিকা পালন করতো, তা সে হারিয়ে ফেলে। নারীর ওপর সীমিত কর্তৃত্বের থেকে দাসের সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে প্রভু পেতো তার সার্বভৌমত্বের অনেক বেশি আমূল স্বীকৃতি। তার। উর্বরতার কারণে পুরুষ তাকে ভক্তি ও ভয় করতে বলে, পুরুষের কাছে সে অপর ছিলো বলে, এবং অপর-এর উদ্বেগজাগানো চরিত্রের সে অংশী ছিলো বলে, নারী এক রকমে তার ওপর নির্ভরশীলতায় আবদ্ধ রাখতো পুরুষকে, এবং একই সময়ে সে নির্ভরশীল থাকতো পুরুষের ওপর; প্রকৃতপক্ষে সে উপভোগ করতে প্রভু-দাসের সম্পর্কের পারস্পরিকতা, এবং এভাবে সে এড়িয়ে যায় দাসত্বকে। এবং দাস কোনো ট্যাবু দিয়ে সুরক্ষিত ছিলো না, দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ একটি পুরুষ ছাড়া সে আর কিছু ছিলো না, ভিন্ন নয় তবে নিকৃষ্ট : তার প্রভুর সাথে তার সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক প্রকাশ পেতে বহু শতাব্দী কেটি যায়। সুসংগঠিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দাস ছিলো মানুষের মুখধারী এক ভারবাহী পশু; প্রভু তার ওপর প্রয়োগ করতো স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ব, যা মহিমান্বিত করতে তার গর্বকে–এবং সে দাঁড়ায় নারীর বিরুদ্ধে। পুরুষ যা কিছু অর্জন করে, তা অর্জন করে নারীর বিরুদ্ধে, পুরুষ যতো শক্তিশালী হয়, ততো পতন ঘটে নারীর।

বিশেষ করে, সে যখন হয়ে ওঠে ভূমির মালিক, তখন সে দাবি করে নারীরও মালিকানা। আগে সে আবিষ্ট ছিলো মানা দিয়ে, ভূমি দিয়ে; এখন তার আছে একটি আত্মা, তার আছে কিছুটা ভূমি; নারীর থেকে মুক্তি পেয়ে এখন সে নিজের জন্যে দাবি করে নারী এবং উত্তরপুরুষ। সে চায় যে সাংসারিক কাজকর্ম সবই হবে তার নিজের, এর অর্থ হচ্ছে সব কর্মীর মালিক হবে সে নিজে; সুতরাং সে দাস করে তোলে তার স্ত্রী ও সন্তানদের। উত্তরাধিকারী তার প্রয়োজন, যাদের মধ্য দিয়ে দীর্ঘায়িত হবে তার পার্থিব জীবন, কেননা সে তাদের হাতে দিয়ে যাবে তার সম্পত্তি; এবং মৃত্যুর পর তার আত্মার শান্তির জন্যে তারা পালন করবে নানা কৃত্যানুষ্ঠান। ব্যক্তিমালিকানার ওপর স্থাপিত হয় গৃহদেবতাপ্রথা, এবং উত্তরাধিকারী সম্পন্ন করে এমন একটি কাজ, যা একই সঙ্গে আর্থনীতিক ও অতীন্দ্রিয়। তাই যেদিন কৃষিকাজ আর ঐন্দ্রজালিক কর্ম থাকে না, হয়ে ওঠে এক সৃষ্টিশীল কাজ, পুরুষ বুঝতে পারে সে এক সৃষ্টিশীল শক্তি, সেদিন একই সাথে সে অধিকার দাবি করে নিজের সন্তান ও শস্যের ওপর।

আদিম কালে মাতৃধারার স্থানে পিতধারার প্রতিষ্ঠার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভাবাদর্শগত বিপ্লব ঘটে নি; তারপর মাতা পতিত হয় ধাত্রী ও দাসীর শ্রেণীতে, কর্তৃত্ব ও অধিকার থাকে পিতার হাতে, যা সে অর্পণ করে যায় উত্তরাধিকারীদের হাতে। সন্তান উৎপাদনে পুরুষের ভূমিকা তখন বোঝা হয়ে গেছে, তবে এছাড়াও দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করা হয় যে শুধু পিতাই জন্ম দেয়, মা শুধু তার দেহের ভেতরে প্রাপ্ত জীবাণুটির পুষ্টি যোগায়, যেমন এস্কিলুস বলেছেন ইউমেনিদেস-এ। আরিস্ততল বলেছেন নারী বস্তুমাত্র, আর সেখানে পুরুষ-নীতি হচ্ছে গতি, যা উক্তৃষ্টতর ও অধিক স্বর্গীয়। উত্তরপুরুষকে একান্তভাবে নিজের করে নিয়ে পুরুষ অর্জন করে পৃথিবীর ওপর আধিপত্য ও নারীর ওপর প্রভুতু। যদিও প্রাচীন পুরাণে ও গ্রিক নাটকে এটাকে দেখানো হয়েছে একটি প্রচণ্ড সগ্রামের পরিণতি হিশেবে, কিন্তু আসলে পিতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছিলো একটি ক্রমসংঘটিত পরিবর্তন। পুরুষ শুধু তাই পুনরায় জয় করে নেয়, যা একদা ছিলো তারই অধিকারে, সে আইনপদ্ধতিকে করে তোলে বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোনো যুদ্ধ হয় নি, কোনো জয় ছিলো না, পরাজয় ছিলো না।

তবে এ-প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোর আছে সুগভীর অর্থ। যে-মুহূর্তে পুরুষ দৃঢ়ভাবে নিজেকে ঘোষণা করে কর্তা ও স্বাধীন ব্যক্তিরূপে, তখনই দেখা দেয় অপর ধারণাটি। সেদিন থেকেই অপর-এর সাথে সম্পর্কটি হয় নাটকীয় : অপর-এর অস্তিত্ব হচ্ছে একটি হুমকি, একটি বিপদ। প্রাচীন গ্রিক দর্শন দেখিয়েছে যে বিকল্পতা, অপরত্ব হচ্ছে নেতির মতোই জিনিশ, তাই অশুভ। অপরকে উত্থাপন করাই হচ্ছে এক ধরনের ম্যানিকীয়বাদ সংজ্ঞায়িত করা। এ-কারণেই ধর্মগুলো আর আইনের বিধানগুলো এতো বৈরী আচরণ করে নারীর সাথে। মানবজাতি যে-সময়ে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে পুরাণ ও আইন, তখন চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা : পুরুষই বিধিবদ্ধ করতে থাকে নানা বিধান। নারীকে অধীন অবস্থান দেয়া তাদের জন্যে ছিলো খুবই স্বাভাবিক, তবু ভাবতে পারি যে পুরুষ সন্তান ও গবাদিপশুর প্রতি যতোটা সদয়তা দেখিয়েছে, তা সে দেখাতে পারতো নারীর প্রতিও–কিন্তু একটুও দেখায় নি। নারীপীড়নের বিধিবিধান প্রণয়ন করতে করতে বিধানকর্তারা ভয় পায় নারীকে। নারীর ওপর এক সময় আরোপ করা হয়েছিলো যে-দুটি বিপরীত শক্তি, তার থেকে এখন তার জন্যে রাখা হয় শুধু অশুভ বৈশিষ্ট্যগুলো : একদা পবিত্র, এখন সে হয় দূষিত। আদমের সহচরীরূপে দেয়া হয়েছিলো যে-হাওয়াকে, সে সম্পন্ন করে মানবজাতির বিনাশ; পৌত্তলিক দেবতারা যখন মানুষের ওপর চরিতার্থ করতে চেয়েছিলো প্রতিহিংসা, তখন তারা উদ্ভাবন করেছিলো নারী; এবং নারীজীবদের মধ্যে প্রথম জন্ম নিয়েছিলো যে, সেই প্যান্ডোরা মানুষের জন্যে খুলে দিয়েছিলো সমস্ত দুর্ভোগগুলো। তাই নারী অশুভের কাছে উৎসর্গিত। আছে এক শুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে শৃঙ্খলা, আলোক, ও পুরুষ; এবং এক অশুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার, ও নারী, বলেছেন পিথাগোরাস। মনুর বিধানে নারী গর্হিত সত্তা, যাকে করে রাখতে হবে দাসী। লেভিটিকাস নারীকে তুলনা করেছে গৃহপতির ভারবাহী পশুর সাথে। সোলোনের বিধানে নারীকে কোনো অধিকার দেয়া হয় নি। রোমান বিধি তাকে রেখেছে অভিভাবকের অধীনে, তার মধ্যে দেখেছে মৃঢ়তা। গির্জার বিধান তাকে নির্দেশ করেছে শয়তানের প্রবেশপথ বলে। কোরানে নারীকে করা হয়েছে প্রচণ্ড তিরষ্কার।

এবং তবুও শুভর দরকার অশুভ, ভাবের দরকার, এবং আলোর দরকার অন্ধকার। পুরুষ জানে তার বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে, তার জাতিকে স্থায়িত্ব দেয়ার জন্যে নারী অপরিহার্য; নারীকে তার দিতে হবে সমাজে একটি অবিচ্ছেদ্য স্থান : পুরুষ যে-শৃঙ্খলা স্থাপন করেছে, নারী তা যতোটা মেনে চলবে, তাকে ততোটা মুক্ত করা হবে তার আদিকলঙ্ক থেকে। এ-ধারণাটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে মনুর বিধানে : বৈধ বিবাহের মাধ্যমে নারী অর্জন করে তার স্বামীর গুণাবলি, নদী যেমন সমুদ্রে হারায় নিজেকে, এবং মৃত্যুর পর তাকে স্থান দেয়া হয় একই স্বর্গে। একইভাবে বাইবেলেও অঙ্কিত হয়েছে সতীনারীর এক প্রশংসিত চিত্র (প্রবাদ ২১, ১০-৩১)। খ্রিস্টধর্ম মাংসকে ঘৃণা করলেও শ্রদ্ধা করে পবিত্র কুমারীকে, সতী ও অনুগত স্ত্রীকে। ধর্মসাধনে সহচরী হিশেবে নারী পালন করতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ভূমিকা : ভারতে ব্রাহ্মণী, রোমে ফ্ল্যামিনিকা উভয়ই তাদের পতিদের মতো পবিত্র। যুগলের মধ্যে পুরুষটিই প্রাধান্য করে, তবে প্রজননের জন্যে, জীবন নির্বাহের জন্যে, এবং সমাজের শৃঙ্খলার জন্যে দরকার হয় পুরুষ ও নারী নীতির মিলন।

অপর-এর, নারীর, এ-পরস্পর বিপরীত মূল্যই প্রতিফলিত হবে তার বাকি ইতিহাসে; আমাদের কাল পর্যন্ত তাকে রাখা হবে পুরুষের ইচ্ছের অধীনে। তবে এটা হবে দ্ব্যর্থক : সম্পূর্ণরূপে অধিকারে ও নিয়ন্ত্রণে এনে নারীকে নামিয়ে দেয়া হবে বস্তুর পর্যায়ে; তবে পুরুষ যাই জয় ও অধিকার করে, তাকেই আবৃত করে দিতে চায় নিজের গৌরবে; পুরুষের কাছে মনে হয় যে অপর এখনো ধারণ করে আছে তার কিছুটা আদিম ইন্দ্রজাল। কী করে স্ত্রীকে একইসঙ্গে দাসী ও সঙ্গিনী করা যায়, এ-সমস্যাটিকে সে সমাধান করার চেষ্টা করবে, তার মানসিকতার বিবর্তন ঘটতে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; এবং ঘটাতে থাকবে নারীর নিয়তিরও বিবর্তন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *