2 of 4

২.১১ ইবন আল-মনসুর এবং দুই নারীর কাহিনী

ইবন আল-মনসুর এবং দুই নারীর কাহিনী

শাহরাজাদ বললো-রাত শেষ হতে এখনও বাকি রয়েছে। ইবন আল-মনসুরের জীবনে যেসব অদ্ভুত। আর দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটেছিলো তাদেরই কিছু আজ জাঁহাপনাকে শোনাব। রাতটা বৃথা নষ্ট করে লাভ কী?

শাহরিয়ার জিজ্ঞাসা করলেন–এই ইবন আল-মনসুরটি কে? এর নাম তো কোনদিন শুনিনি। শাহরাজাদ বললো-শুনুন তাহলে।

জাঁহাপনা, এর আগে আপনাকে খলিফা হারুণ অল-রাসিদের কাহিনী বলেছি। নিজের রাজ্য আর প্রজাদের মঙ্গলের চিন্তায় রাত্রে তাঁর ঘুম হোত না। একদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে আলি এপাশ-ওপাশ করছেন। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করে বুঝলেন ঘুম আর আসবে না। তখন বিরক্ত হয়ে গায়ের চাদরখানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন তিনি। শয়নকক্ষের বাইরে মসরুর তরবারি হাতে নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। হাতে তালি দিয়ে খলিফা তাকে ডাকলেন। সে কাছে এসে কুর্নিশ করতেই তিনি বললেন—

মসরুর, আদৌ ঘুম আসছে না চোখে। মাথাটা বোধহয় গরম হয়েছে। এখন কী করি বলত?

মসরুর বললো—ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে। এই রাত্রে রাস্তার ওপরে একটু পায়চারি করবেন? মাথাটা তাহলে ঠাণ্ডা হবে; সেই সঙ্গে শান্ত হবে মন! তারপরে বোধহয় ঘুমোতে আর অসুবিধে হবে না। প্রাসাদের বাইরে রাত্রিটি কী ঠাণ্ডা, কী চমৎকার! আসুন, আমরা গাছের ফাকে-ফাকে ফুলের গন্ধ শুকে-শুকে ঘুরে আসি। তারাতে ছেয়ে গিয়েছে আকাশ; একটু পরেই চাঁদ উঠবে। চাঁদের আলো নদীর জলে নামবে গোছল করতে। খুব ভালো লাগবে আপনার।

খলিফা বললেন-না, মসরুর, আজ রাত্ৰিতে এসব ভালো লাগবে না আমার।

মসরুর বললো।–তাহলে থাক। জাঁহাপনা, আপনার হারেমে তিনশ মেয়ে রয়েছে। প্রত্যেকের জন্যেই আলাদা-আলাদা ঘর রয়েছে। আপনি আসছেন বলে প্রত্যেককেই আমি সংবাদ দিয়ে আসি। তারা সব তৈরি থাকবে। লুকিয়ে-লুকিয়ে আপনিও তাদের নগ্ন চেহারা দেখবেন। ভালো লাগতে পারে আপনার।

—মসরুর, এই প্রাসাদ আমার, মেয়েরাও আমার। কিন্তু ওদের সঙ্গ পেতে আজ রাত্রিতে আমার ভালো লাগছে না।

—জাঁহাপনা, আপনার সাম্রাজ্যে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির অভাব নেই, অভাব নেই সাধু আর কবিদের। আদেশ পেলে, তাঁদের আমি নিয়ে আসতে পারি। সাধু-সন্তদের উপদেশ আপনাকে

–মসরুর, আজ রাত্ৰিতে তাও আমার ভালো লাগবে না।

—জাঁহাপনা, এ-প্রাসাদে দুনিয়ার উৎকৃষ্ট সরাব রয়েছে।

—আমার কিছু ভালো লাগছে না।

—জাঁহাপনা, আমার মাথাটা কেটে নেবেন? তাহলে হয়ত আপনার মনের অবসাদ কেটে যাবে।

রাত শেষ হয়ে এলো দেখে শাহরাজাদ থামলো।

 

তিনশো সাতচল্লিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শুরু হলো গল্প। মসরুরের কথা শুনে হা-হা করে হেসে উঠলেন খলিফা হারুন অল রসিদ। তারপরে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন-ভালো বলেছ। আজ হোক, কাল হোক, একদিন সে-প্রয়োজন আসতে পারে হয়ত। যাক, তুমি প্রাসাদে ঢুকে দেখে এসো। যাকে দেখে বা যার কথা শুনে আমার ভালো লাগতে পারে এমন কেউ সেখানে রয়েছে কিনা জেনে এসে আমাকে সংবাদ দাও। খলিফার নির্দেশ পেয়ে বেরিয়ে গেলো মসরুর আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ফিরে এসে কপাল চাপড়ে বললো—জাঁহাপনা, বড়ই দুর্ভাগ্যের কথা—সে রকম কাউকেই পেলাম না।

কাউকেই পেলেনা?

—আজ্ঞে, আপনার ভালো লাগতে পারে এমন কেউ আমার চোখে পড়লো না। তবে বুড়ো শয়তান ইবন আল-মনসুর গুড়িাশুডি দিয়ে এক কোণে শুয়ে রয়েছে দেখলাম।

—কোন ইবন আলের কথা বলছি তুমি? দামাস্কাসের?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, জাঁহাপনা; সেই বদমাইশটার কথাই বলছি।

—যাও, তাকে শীগগির এইখানে নিয়ে এসো।

মসরুর সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে খলিফার সামনে নিয়ে এলো। আল মনসুর কুর্নিশ করে বললেন–আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, জাঁহাপনা।

প্রত্যাভিবাদন করে খলিফা বললেন-ইবন আল-মনসুর, আপনার জীবনের কিছু দুঃসাহসিক কাহিনী আমাকে শোনাবেন?

—জাঁহাপনা, নিজের চোখে যা দেখেছি সেই রকম কোন কাহিনী আপনি শুনবেন, না, যা শুনেছি সেইরকম কোন কাহিনী?

—নিজের চোখে যা দেখেছেন এরকম বিস্ময়কর কোন কাহিনীই বলুন। কানে শোনার চেয়ে চোখে দেখার ঘটনা অনেক বেশী চিত্তাকর্ষক। নিন, তাড়াতাড়ি শুরু করুন।

—তাহলে, শুনুন জাঁহাপনা। সেই রকম একটি কাহিনীই আপনাকে আমি বলছি। মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, চোখ-কান-মন সব সজাগ রাখবেন। জাঁহাপনা, আপনি নিশ্চয় শুনেছেন, প্রতি বছরই কয়েক দিনের জন্যে আমি বাসোরা হয় যাই। সেখানে আপনার নায়েব আমীর মুহম্মদ আল-হাসামী থাকেন। তারই সঙ্গে দিনকত কাটিয়ে আসি। একবার তার প্রাসাদে গিয়ে দেখি আমীর সাহেব সেজোগুঁজে তৈরি। শিকারে যাবেন তিনি। ঘোড়ার ওপরে বসে রয়েছেন আমীর। যাত্রা শুরু করলেই হয়। আমাকে দেখেই বললেন—উঠে এসো সাহেব। শিকারে ঘুরে আসবে।

আমি বললাম—মাফ করুন, জাঁহাপনা; ঘোড়া দেখলেই আমার গা বমি-বমি করে। সেজন্যে আমি গাধাই বেশী ভালোবাসি। শিকারে যেতে পারি, কিন্তু গাধার পিঠে, তাকে কি চলবে?

আমার কথা শুনে আমীর তো হো হো করে হেসে উঠলেন—ঠিক আছে, ঠিক আছে। শিকারে তোমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই বুঝতে পারছি। তুমি তাহলে প্রাসাদেই থাক। আমি থাকব না। বলে কোন অসুবিধে হবে না তোমার। না ফিরে আসা পর্যন্ত থেকে কিন্তু, পালিয়ে যেয়ে না।

শিকারে চলে গেলেন আমীর। আমি রয়ে গেলাম প্রাসাদে। দিন কয়েক থাকার পরে ভাবলাম-প্রতি বছরই তো আমি এখানে আসি। বেড়ানোর মধ্যে প্রাসাদ থেকে বাগান, আর বাগান থেকে প্রাসাদ। তা বাপুহে, এইভাবে চললে, শেখার কথা দূরস্থান-কিছু জানতেও পারবে না, দেখতেও পাবে না, একবার শহরটাকেও তুমি ঘুরে দেখলে না। এবার সুযোগ এসেছে। সুযোগ তোমার হাতে অনেক। আমীরও নেই। এবার আল্লার নাম করে বেরিয়ে পড়। বাসোরার পথে পথে কত মজার-মজার জিনিস ছড়িয়ে রয়েছে প্ৰাণ ভরে একবার দেখে নাও। তাছাড়া, পেটের কথাটাও ভাবতে হবে বৈকি! স্রেফ বসে থাকলে, এই সব গুরুপাক খাবার হজম হবে। কেমন করে? হাঁটা চলা করলে ক্ষিদেও পাবে, মনও প্রফুল্ল থাকবে। গুরুপাক খাওয়া আর ততোধিক জমকালো পোশাকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। তাই প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে ঘুরতে শুরু করলাম।

জাঁহাপনা, বাসোরাতে রাস্তা রয়েছে প্রায় সত্তরটি। তাদের প্রত্যেকটিই প্রায় আড়াইশ মাইল করে লম্বা। এ সবই আপনি জানেন। একবার ঘুরতে-ঘুরতে রাস্তার গোলকধাঁধায় আমি হারিয়ে গেলাম। পাছে লোক আমাকে বেয়াকুফ ভাবে এইজন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও পারলাম না। আমি রাস্ত হারিয়ে ফেলেছি পাছে এটা কেউ বুঝতে না পারে সেইজন্যে আরও জোরে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে-হাঁটতে ভেতরটা আমার শুকিয়ে গেলো; মনে হলো গায়ের চর্বিটুকুও বুঝি গলে যায়। সেই নিদারুণ রোদে, তেষ্টাও পেলো খুব।

জল না পাই, একটু ছায়া পেলেও চলে। এই ভেবে একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম। ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিতেই হবে। নাহলে, মারা যাব। গলিতে ঢুকে সুন্দর একটাবাড়ি দেখতে পেলাম। বেশ বড় বাড়ি। দরজার ওপরে একটা সিল্কের পর্দা ঝুলছে—পর্দােটা আবার অৰ্দ্ধেক গোটানো। সামনে সুন্দর একটা বাগানও রয়েছে। সেই বাগানের ভেতরে মার্বেল পাথরে বাঁধানো সারি-সারি বসার আসন। মাথার ওপরে আঙুর গাছের লতা ছায়া ফেলেছে সেই আসনগুলির ওপরে। এই রকম একটা আসনে গিয়ে আমি বসলাম।

কপালের ঘাম মুছে ফেলে সবেমাত্র বসেছি। এমন সময় হঠাৎ মেয়েলী গলার একটা গানের কলি আমার কানে ভেসে এলো। গানটি দুঃখের। অবাক হয়ে গানটা শুনলাম আমি :

আমার হৃদয় গুহা থেকে চঞ্চল হরিণটি
যখন উধাও হয়ে গেলো, দুঃখ এসে তখন
সেই শূন্য স্থানটি পূর্ণ করে দিলো। আমাকে
সে ছেড়ে গেলো কেন? আমাকে যাতে
কুমারীরা ভালোবাসে সেই জন্যে
আমি তো কোন ছলাকলার আশ্রয় নিইনি
চুম্বন অথবা অলীকদমের।

আমার মনে হলো এই গানের ভেতরে অদ্ভুত কোন রহস্য রয়েছে। এমন সুন্দর কণ্ঠের মত মেয়েটি যদি সুন্দর হয় তাহলে এ-বিশ্বে সে-ই হবে অদ্বিতীয়া।

আমি ধীরে-ধীরে উঠে ভেতরে ঢোকার দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। চেষ্টা করলাম পর্দাটা একটু তুলে ধরার। কিছুই দেখা গেলো না। হঠাৎ পিছন ফিরে দেখি বাগানের ঠিক মাঝখানে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় তাদের মধ্যে একজন বাঁদী। আর একটি মেয়েই গান গেয়েছিলো। সে মেয়েটি দেখতে সত্যিই সুন্দরী। বাঁদীর হাতে একটা বীণা।

তাদের দেখে একটা বয়োৎ মনে পড়ে গেলো আমার :

মেয়েটির প্রতিটি চোখের কোনো একটি
ক্ষুদে দুষ্টু ব্যাবিলনের আগুন জ্বলছে।
জুঁই ফুলের মত সাদা তার ঘাড়ের ওপরে
আলো, তরোয়াল আর কুসুমদান।
রাত্রির অন্ধকার তার সেই
শ্বেত সৌন্দর্যকে অভিনন্দন জানায়।
তার কুচ দুটি কি নরম মাংস পিণ্ড—
পরম স্নেহে গোল করা
কিংবা হস্তপৃষ্ঠ আইভরী।
অথবা এমনও হতে পারে যে
ওই দুটি কুচ পরম স্নেহে দিলা পাকানো
সাদা মাংসের তাল।

বিশ্বাস করুন, জাঁহাপনা; সেই রূপ দেখে নিজেকে আমি ধরে রাখতে পারিনি। একটি আবেশে আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।–ইয়া আল্লা। সম্ভব হলে চোখ দিয়ে তাকে আমি গিলেই ফেলতাম।

কে চেঁচাল দেখার জন্যে মেয়েটি মাথা ঘোরাল তার। পর পুরুষ দেখে সে তাড়াতাড়ি নিজের নাকাবে তার মুখটা ঢেকে ফেললো। আমার এই অভদ্র ব্যবহারে রেগে গিয়ে বাঁদীেটাকে আমার কাছে পাঠালো। বীণাটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বাঁদীটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে-আসতে বললো-এই যে শেখ, বলি, ব্যাপারটা কী? পরের বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে বাড়ির মেয়েদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করে না তোমার? এদিকে তো দেখছি বুড়ো বয়েস; চুল, দাড়ি দুই-ই পেকেছে। সময় হয়েছে কবরে যাওয়ার। মেয়েদের রূপ দেখার জন্যে এত নোলা কিসের, অ্যাঁ। এর আগে কী করেছিলে?

বসে-থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি বেশ চেঁচিয়েই বললাম—তোমার কথা কিছুটা সত্যি। বয়সটা তো আর লুকানোর উপায় নেই। কিন্তু যদি নোলা বা লজ্জার কথা বলো সেটা হলো অন্য ব্যাপার।

ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো আটচল্লিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ :

মনসুর বললেন—আমার কথা শুনে মেয়েটি গটমট করে আমার সামনে এগিয়ে এসে বললো—তোমার ওই সাদা চুলের চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? চুল পেকেছে বলেই তো লজ শরাম সব শেষ হয়েছে। নইলে, অন্য লোকের হারেমের দরজায় এসে কোন আহম্মক এভাবে উঁকি দেয়?

কুর্নিশ করে বললাম—আল্লার দিব্যি, আমার পাকা দাডির বদনাম করো না। এখানে ঢোকাটা লজজ শরমের ব্যাপারই নয়।

—তাহলে ব্যাপার কী জানতে পারি?

—তেষ্টা। তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তাইত ঢুকে পড়েছি; মানে, নেহাৎ জানের দায়ে।

—ঠিক আছে। আল্লার কসম খেয়ে যখন বললেন তখন আপনাকে বিশ্বাস করলাম।

এই বলে মেয়েটি ফিসফিস করে তার বাঁদীকে বললো-যাও, ভদ্রলোককে এক গ্লাস শরবৎ এনে দাও।

বাঁদীটিা দৌড়েই গেলো; তারপরে সোনার প্লাসে শরবৎ নিয়ে হাজির হলো। এক হাতে তার ঢাকা দেওয়া শরবতের গ্লাস, আর এক হাতে তোয়ালে। শরবতের গ্লাসটা আমার হাতে সে এগিয়ে দিলো। কী সুগন্ধ ঠাণ্ডা শরবৎ! ঢকঢ়ক করে না খেয়ে চেকেচেকে একটু একটু করে খাই, আর সুন্দরীর দিকে আড়াচোখে তাকাই। অর্থাৎ তাকেও পান করাই বলে; তবে কিনা রূপসুধা। যত ধীরেই ধীরেই খাই না কেন, খাওয়া এক সময় শেষ হলো; সেই সঙ্গে ছলনা। খালি গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে তোয়ালে দিয়ে চোখ আর মুখ মুছে ফেললাম। সেই গন্ধমাখা তোয়ালে দিয়ে ঘাড়, গদোন সব ভালো করে মুছলাম। তা-ও শেষ হলো এক সময়। অগত্যা তোয়ালেটাও ফিরিয়ে দিতে হলো। এবার? না; চলে আসতে পারলাম। কই? একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমার নড়বার কোন লক্ষণ দেখতে না পেয়ে মেয়েটি ঝাঝাল কণ্ঠে বললো-এবার পথ দেখ।

আবিষ্টের মত বললাম—যেতে তো হবেই। কিন্তু একটা চিন্তা আমাকে কুরে-কুরে খাচ্ছে। এইজন্যে মোটেই শান্তি পাচ্ছি নে! কী করব ভেবে পাচ্ছি নে তা-ও।

—চিস্তা কীসের?

প্রতিটি ঘটনাকে যদি উলটো দিক থেকে দেখি তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি এক সঙ্গে করে দেখলে সেটাই বা কী দাঁড়াবে? এ সব ঘটনা তো মহাকালের অঙ্গ।

-ওসব বড়-বড় ব্যাপার, বড়-বড় চিন্তা! ইহকালের নোংরামী অথবা পাপের জন্যে আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হয়। যাক গে। ওসব কথা। তা মশাই, তোমার এমন কী সমস্যা দেখা দিলো যার সমাধানের জন্যে আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

বললাম-আমি এই বাড়ির মালিকের কথা ভাবছিলাম। তাঁর কথা বেশ মনে পড়ছে আমার! আর এক বাড়িতে গল্প করতে-করতে তিনি আমাকে এই বাড়ির কথা বলেছিলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ; বেশ মনে পড়ছে। আল্লাহর নামে বলছি তিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। শ্রেষ্ঠ বন্ধুও বলতে পারি।

—তোমার সেই শ্রেষ্ঠ বন্ধুটির নাম মনে রয়েছে? আলবাৎ। তার নাম হচ্ছে আলি বিন মহম্মদ। তাঁর মত নামকরা জহুরী বাসোরায় দুটি ছিলো না। কত লোক খাতির করত তাকে। অনেক কাল তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। মনে হচ্ছে তিনি আর নেই। তার কি কোন সন্তান নেই?

মেয়েটির চোখদুটি কানায় কানায় ভরে উঠলো; তারপরে সেই জল মুক্তার বিন্দুর মত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো; বললো—আল্লা বিন মুহম্মদের আত্মাকে শান্তি দিন। আপনি যখন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তখন আপনাকে বলতে বাধা নেই। তিনি একটি মেয়ে রেখে গিয়েছেন। তার নাম বুদুর। মেয়েটিই তার তাবৎ সম্পত্তির মালিক।

তুমি; তুমিই বোধহয় সেই বুদুর-না?

হ্যাঁ; আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। —তার মুখে হাসি ফুটলো।

আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তোমাকে আশীৰ্বাদ করেন, মঙ্গল করেন তোমার। তোমার ওই ভারি সিল্কের নাকাব্য ভেদ করে দেখছি কী দুঃখ তোমার? এই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে তোমার দুঃখটা কী? কী দুঃখ তোমার? খুলে বলো। আল্লা বোধ হয়। সেই জন্যেই আমাকে এইখানে পাঠিয়েছেন। তোমার সব দুঃখ কষ্ট আমি সারিয়ে দেব।

কিন্তু গোপনীয় কথা কেন আপনাকে বলব? আপনার নাম জানিনে, পরিচয় জানি নে। আপনার চরিত্রও আমার অজানা।

আমি কুর্নিশ করে বললাম-এ দাসের নাম ইবন আল-মনসুর। নিবাস দামাস্কাসে। সকলের মালিক খলিফা হারুণ অল-রাসিদ আমাকে স্নেহ করেন। বন্ধুর মর্যাদা দিয়ে আমাকে তিনি কিনে নিয়েছেন।…

আমার কথা শেষ হতে না হতেই বুদুর বললো—আর পরিচয়ের দরকার নেই। আসুন, আসুন। ভেতরে আসুন। আপনাকে স্বাগত জানাই। আপনাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখানোর সুযোগ আমাকে দিন।

এই বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে সোজা ভেতরের ঘরে চলে গেলো। বসার ঘরটা বাগানের ধারেই। সেইখানে আমরা তিনজনে বসলাম! ভালোভালোখোনা এলো। খানা খেতে খেতে বুদুর বললো-আমার মুখে দুঃখ-কষ্টের ছাপ দেখে কারণ জানতে চেয়েছেন। সবই আপনাকে বলব; কিন্তু একটি শর্তে। এই কাহিনী আপনি গোপন রাখবেন। এ হলফা আপনাকে করতে হবে।

যেটা গোপন বলে মনে করব সেটা গোপনেই থাকবে। আমার এই মনটা বদ্ধ। ইস্পাতের বাক্সের মত। এর চাবি গেছে খোয়া।

বেশ, আমার তাহলে কাহিনী শুনুন।

বাঁদী আমার পাতে কিছু গোলাপজাম তুলে দিলো। বুদুর শুরু করলো তার কাহিনী : গল্পের সারাংশ, অর্থাৎ, বলতে গেলে আমারই কাহিনী, এই যে যখন ভালোবাসলাম তখন আমার মনের মানুষ আমার কাছ থেকে অনেক দূরে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলো বুদুর।

আমি বললাম-আল্লাহ তোমাকে দুহাত ভরে রূপ দিয়েছেন! তুমি যাকে ভালোবেসেছিলে সে নিশ্চয় তোমার মত রূপবান, স্বাস্থ্যবান কোন যুবক। কী নাম তার?

আপনি যথার্থই বলেছেন মনসুর সাহেব। সে সত্যিই সুন্দর। তার নাম জুবাইর বিন উমাইর। তিনি একজন আমীর। তাঁর মত রূপবান যুবক এই বসোরাহয় অথবা ইরাকে আর একটিও নেই। দুঃস্বপূর্ণ

ঠিকই বলেছ তুমি। অমন না হলে তোমার ভালোবাসা সে কেমন করে পাবে? তোমার ভালোবাসার কাহিনী কিছু বলে।

কাহিনীর কথা বলছেন? সে যে অনেক, অনেক। অন্তরঙ্গ হাতে-হাতে কালের রজজুতে বাঁধা পড়েছিলো। কিন্তু জুবাইর শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।–তাও একটি মাত্র সন্দেহের বশে।

চেঁচিয়ে উঠলাম আমি-ই আল্লা! তোমার মত মেয়েকে সন্দেহ? ঝড়ো হাওয়ায় পদ্মফুল কাদায় লোটাতে পারে। তাই বলে তাকে সন্দেহ করতে হবে? সন্দেহ খাঁটি হলেও তোমার মুখের দিকে তাকালে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাওয়া উচিৎ।

স্নান হেসে বললো বুদুর—তবু যদি কোন পুরুষঘটিত ব্যাপার হোত। কিন্তু ব্যাপারটা একটা মেয়েকে নিয়ে। এই যে দেখছেন, এই মেয়েটিকে নিয়ে সন্দেহ।

বললাম-আল্লাহ, জুবাইরকে করুণা করুন। এমন কথা শয়তানেও বিশ্বাস করবে না। একটা মেয়েকে আর একজন মেয়ে কেমন করে ভালোবাসবো? ভারি বিশ্রী ব্যাপার তো! সন্দেহ হলো কেমন করে?

গোছল করার সময় এই মেয়েটি আমার গা ঘষে দেয়। ওই সময়টা ও আমার সঙ্গে-সঙ্গে থাকে। একদিন গোছালের পরে ও আমার চুল বেঁধে দিচ্ছিল। আমার গায়ে জড়ানো ছিলো মাত্র একটা তোয়ালে। গরম কমানোর জন্যে মেয়েটি আমার গা থেকে সেই তোয়ালেট সরিয়ে দেয়। চুল বাঁধা শেষ হলে আমার রূপ দেখে কী ভেবে গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে চুমু খেয়ে বললো—যদি পুরুষ হতাম তাহলে ভালোবাসা কাকে বলে তা তোমাকে বুঝিয়ে দিতাম। এর চেয়ে ঢের বেশী দেখাতে পারতাম তোমাকে।

এই কথা বলে মেয়েটি নানান ঢঙে আমাকে চটকাতে লাগলো। ছেলে-মানুষ তো। কতটুকুই বা আর জানে? ও এই সব করছে, হঠাৎ আমীর ঘরের ভেতরে ঢুকে এলো। আমাদের দুজনকে ওইভাবে দেখামাত্র সে ঘর ছেড়ে চলে গেলো। যে ভালোবাসা কাউকে দেওয়া যায় না। সেই ভালোবাসাই আমাদের দুজনকে আনন্দ দিতে পারে।

চিরকুট পেয়েই বাইরে বেরিয়ে এলাম। অনেক খুঁজলাম তাকে। পেলাম না। সে চলে গিয়েছে। তারপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনদিনই আমাদের দেখা হয়নি। কোন খবরও দেয় নি সে।

তোমাদের শাদী হয় নি?

না। লোকজন সাক্ষী রেখে আমাদের শাদী হয় নি। ভালোবাসাঁই ছিলো আমাদের বন্ধন। আমরা একসঙ্গে থাকতাম। কোনো অনুসন্ধান করি নি আমরা।

আমি একবার চেষ্টা করব? দুটো হৃদয় আবার জোড়া দিতে পারলে আমিই সবচেয়ে বেশী খুশি হব। তুমি রাজি?

বুদুরের চোখে জল। সে বললো—আমাদের দুজনের পথ দুদিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ঈশ্বর আপনাকে দুটি পথের মাঝখানে এনে দিয়েছেন। সব সময় মনে রাখবেন যার হৃদয়ে কোন দয়ামায়া নেই। আপনি সেই লোকের উপকার করতে যাচ্ছেন। একখানা চিঠি লিখে আপনার হাতে আমি দেব। সেটি আপনি জুবাইরকে দেবেন। আপনার কথা যাতে সে শুনে সেদিকে চেষ্টা করবেন। এর বেশী আর কিছু বলার নেই আমার।

তারপরে বাঁদীকে দিয়ে দোয়াত কলম আনিয়ে সে চিঠি লিখলো—

প্রিয়তম,

কতকাল আর বিরহ সইব বলো? বেদনা আর মনকষ্ট রাতের ঘুম আমার কেড়ে নিয়েছে। অনেকদিন হলো তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছ। স্বপ্নে দেখলে তোমাকে ঠিক আমি চিনতে পারি নে।

তুমি দরজা খুলে চলে গিয়েছ। পাড়ার লোকে খোলা দরজা দিয়ে কত কথা বলে যায়। আমার গায়ে কাদা ছিটোয়। প্রিয়তম, আমি তোমার কাছে কী অপরাধ করেছি। ওঠে; চোখ তুলে দেখা। সন্দেহ ঝেড়ে ফেলো। দেখবে, যেদিন এক হব সেদিনের কথা ভাবতেও কি আনন্দ। আমাদের মিলনে ঈশ্বর আমাদের আশীর্বাদই করবেন। ঈশ্বরও তাই চান। তুমি আর মুখ ফিরিয়ে থেকে না।–ইতি।

এই সময় ভোরের পাখি ডেকে উঠলো। চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো উনপঞ্চাশতম রজনী :

পরের দিন রজনীতে আবার গল্প বলতে শুরু করলো শাহরাজাদ :

চিঠি লিখে, ভাঁজ করে, খামে সেটি বন্ধ করে তার ওপরে মোহরের ছাপ দিলো বুদুর। তারপরে এক হাজার দিনারের সঙ্গে সেটি আমার পকেটে গুঁজে দিলো সে। আমি বাধা দিয়েও পারলাম না। তার মৃত পিতার প্রতি আনুগত্যের সুবাদেই এটা আমার করা উচিৎ বলেই মনে করলাম আমি। আর বিলম্ব না করেবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম; তারপরে সোজা হাজির হলাম। জুবাইর বিন উমাইর-এর বাড়িতে। উমাই এর বাবার সঙ্গেও যথেষ্ট পরিচয় ছিলো আমার। তিনিও আজ আর বেঁচে নেই।

তাদের বাড়িতে গিয়ে শুনলাম শিকারে গিয়েছে উমাইর। কী আর করি! অপেক্ষা আমাকে করতেই হবে। সুতরাং বসে রইলাম। তবে বেশীক্ষণ বসতে হয় নি। তাড়াতাড়িই ফিরে এলো উমাইর। আমার নাম ধাম পরিচয় পেয়ে হাত জোড় করে অনেক ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললো—এতক্ষণ আমি ছিলাম না বলে দুঃখিত। কিন্তু আমার আতিথ্য গ্রহণ আপনাকে আজ করতেই হবে। এ-বাড়ি আপনার নিজেরই বলে ভাববেন। কোন রকম সংকোচ করবেন না। কী বলব। জাঁহাপনা? ছেলেটা আস্ত, একটা দাবানল। অগ্নিশিখা নয়। মেয়েটার মুখে দুঃখের ছাপ কেন পড়েছে তা যেন এবার বুঝতে  পারলাম। দুচোখ ভরে তাকেই দেখতে লাগলাম।

উমাইর ভাবলো ভেতরে যেতে আমি বোধ হয় সঙ্কোচ বোধ করছি। তাই সে আমার হাত দু’খানা ধরলো। আমিও ধরলাম তার হাত; মনে হলো, চন্দ্র, সূর্য, তারা—সারা বিশ্বটাকেই আমি যেন আঁকড়ে ধরেছি। খানার সময় তখন উপস্থিত। পরম সমাদরে সে আমাকে খানা খাওয়ার ঘরে নিয়ে গেলো! ক্রীতদাসরা সামনে পেতে দিলো সাদা চাদর। চাঁদরের ওপরে সাজিয়ে দিলো খোরাসানের সোনা আর রূপোর থালা। তারপরে এলো থালাভর্তি কত রকমের রান্না মাংস। শুকনো, ঝোল, ঝাল। সব কটাই চমৎকার খেতে। সব চেয়ে সুখাদ্য ছিলো পাখির মাংস। পেস্তা, বাদাম, আর আঙুরের রসে ভেজানো সেই মাংস। তারপরে গরম রুটির সঙ্গে অদ্ভুৎ প্রক্রিয়ায় মেশানো এক রকমের মাছ। অবশ্য তার সঙ্গে সেই বিখ্যাত স্যালাডও ছিলো যা মুখে দেওয়ামাত্র গলে জল হয়ে যায়। ক্ষিদেটাও চনমান করে ওঠে। তারপরে সেই সুগন্ধী চাল—তার আর তুলনা নাই। কী বলব জাঁহাপনা একেবারে কাজী ডুবিয়ে খেয়েছি। সে কী অপরূপ গন্ধ বিরিয়ানীর! সরাবের কথা নাইবা আর বললাম।

জাঁহাপনা, আপনি ভাববেন না যে কাজের কথা ভুলে গিয়ে হঠাৎ আমি ভোজনবিলাসী হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি কথাটা বলতে কি প্রথমটা খাবারের দিকে নজর না দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম আমি। রীতি অনুসারে খাওয়া শুরু করার জন্যে নিমন্ত্রকই আহ্বান জানায়। সেই রীতিটি মেনে নেওয়ার আগেই আমি বললাম-আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, আপনার এই সব সুখাদ্য আমি স্পর্শ করব যতক্ষণ না। আপনি কথা দেন যে আমার প্রার্থনা আপনি মঞ্জর করবেন।

আপনার প্রার্থনা কী না জেনে কী করে তা মঞ্জর করব? তবে আপনি আমার আতিথ্য গ্রহণ না করে চলে যাবেন এ কিছুতেই আমি হতে দেব না। আপনার প্রার্থনা নিশ্চয় মঞ্জর হবে।

তার কথার জবাবে পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে তার হাতে দিলাম। চিঠিখানা খুলে পড়লো সে। পড়তে-পড়তে চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো তার। চিঠিখানা ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে-পিষতে বললো—ইবন আল-মনসুর, আপনার যা ইচ্ছে হয়। আমাকে বলবেন। আমি তা মেনে নেব। কিন্তু দয়া করে এই চিঠিটার বিষয়ে আমাকে আর কিছু বলবেন না। চিঠির জবাব আমি দেব না; বা, এ ব্যাপারে আপনাকেও কিছু বলব না।

তার কথা শুনে উঠে চলে আসছিলাম। পেছন থেকে আমার জামা টেনে ধরে সে বললো— আপনি আমার অতিথি! আমি কেন ওকে ছেড়ে আসছি। যদি শোনেন তাহলে এ-ব্যাপারে। আপনিও আমাকে জোর করবেন না। আপনি ভাববেন না যে ওর চিঠি বা খবর নিয়ে আপনার আগে আর কেউ আসে নি। আমাকে আগে কিছু বলবেন না। ও আমাকে কী বলতে চেয়েছে আপনাকে আমি সব কিছু বলে দেব।

আশ্চর্যের ব্যাপার, সত্যিই ছেলেটি সব বলে দিলো। তারপরে বললো—আমার কথা শুনুন, এর ভেতরে নিজেকে আপনি ফালতু জড়িয়ে ফেলবেন না। বরং এখানে বিশ্রাম করুন, যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকুন। আপনাকে সেবা করার সুযোগ দিন আমাকে।

তার কথায় কেমন যেন অবাক হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু আতিথ্য গ্রহণ না করে পারলাম না। সারাদিন খানাপিনা আর খোসগল্পে আমীরের সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম। কোন গানও শুনলাম না, বাজনাও শুনলাম না। অথচ ও দুটোই হচ্ছে ভোজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। বেশ অবাকই হলাম আমি। কথাটা বলেই ফেললাম। আমীরের মুখখানায় কে যেন সঙ্গে-সঙ্গে এক শিশি কালি ঢেলে দিলো। বুঝলাম, ভেতরে সে বেশ একটা অস্বস্তি বোধ করছে। একটু থেমে সে বললো— ভোজের আসরে গান বাজনার পাট অনেক দিনই আমি চুকিয়ে দিয়েছি। তবে আপনি যদি চান সে-ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি।

এই বলে উমাইর ক্রীতদাসীকে গান গাইতে বললো। ক্রীতদাসীটি কাপড়ে জড়ানো একটা ভারতীয় বীণা নিয়ে এসে আমাদের সামনেই বসে পড়লো; তারপরে একটা গৎ বাজিয়ে ভারতীয় বীণা নিয়ে এসে আমাদের সামনেই বসে পড়লো; তারপরে একটা গৎ বাজিয়ে শোনালো :

মধুর পেয়ালা আছে, সঙ্গে আছে পেয়ালা মদের
তুমি কি এখনও তা পান করনি?
যে যাতনা আমাদের আনন্দ দেয়
যে চুম্বন আমাদের বিরক্ত করে
তা কি তুমি অনুভব করনি?
যে গোলাপ অন্ধকারে পুড়ে যায়
তার সুবাস কি এখনও তুমি পাওনি?

গানের রেশ কাটতে-না-কাটতেই উমাইর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। গাইয়ে মেয়েটি বললো।–শেখ, আপনিই এর জন্যে দায়ী। ওঁর সামনে অনেক দিনই আমি গান গাইনি, বা বাজনা বাজাইনি। দুঃখের গান শুনলোইে ওর ভেতরটা কেমন যেন জ্বলেপুড়ে যায়। তারপরই উনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

সত্যি সত্যিই আমি বড় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। কৃতকর্মের জন্যে দুঃখ হলো আমার! তাকে আর বিরক্ত করতে নিষেধ করে মেয়েটি আমাকে আমার শোওয়ার ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

পরের দিন ভোরবেলাতেই চলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলাম আমি। একজন নফরকে ডেকে বললাম-আমি চললাম। তোমার মনিবকে আমার ধন্যবাদ জানিয়ে বলে দিয়ো!

এমন সময় অন্য একটি নফর এসে আমার হাতে এক হাজার দিনার আর একটা চিরকুট দিয়ে গেলো। শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাকে বিদায় দিয়েছে উমাইর। গতকাল অজ্ঞান হওয়ার ফলে আপনার যে অসুবিধে হয়েছিলো তার জন্যে সে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তাকে আবার আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। যে কাজের জন্যে এসেছিলাম তার কিছুই হলো না। হতাশ হয়ে আমি বুদুরের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।

বাড়ির সামনে বাগানের কাছে এসে দেখলাম বুদুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে। কোন কথা বলার আগেই সে বললো-ইবন আল-মনসুর, কোন কাজ হলো না তা হবে না যে তা আমি জানতাম।

তারপরে আমাদের মধ্যে যেসব কথা হয়েছিলো সেসব কথা বুদুর হুবহু বলে গেলো।

আমি তো অবাক! ও আমার পেছন গুপ্তচর পাঠিয়েছিলো নাকি?

জিজ্ঞাসা করলাম–তুমি এসব জানলে কেমন করে? তুমি কি ধারে-কাছে কোথাও লুকিয়ে ছিলে?

আল মনসুর, প্রেমিকার কাছে কোন কথাই লুকানো থাকে না। সবই আমার অদৃষ্ট। আপনার কোন দোষ নেই।

তারপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বললো-প্রেমের দেবতা, মনের দেবতা, আত্মার দেবতা-আল্লা আমাকে শক্তি দাও। আমার এই প্রেমিকইন জীবনে আমি ভালোবাসতে পারি। হে ঈশ্বর, জুমাইয়ের বুকে যদি এতটুকু প্রেম বলে কিছু থাকে সেইটুকু নিয়ে ওর বুক জুড়ে যন্ত্রণা দাও। জুলতে-জুলতে ও যখন আমার কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে হাজির হবে তখন আমি ওর দিকে ফিরেও তাকব না।

তারপর মেহনতের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলো বুদুর। আমি আমীর মুহম্মদের সঙ্গে দেখা করে বাগদাদে ফিরে এলাম।

পরের বছর যথারীতি আবার বাসোরায় ফিরে গেলাম। একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি, জাঁহাপনা, আমীর মুহম্মদ একবার আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিলেন। বছরে একবার করে সেই টাকা আমি কিস্তিতে নিয়ে আসতাম। সেই কারণেই বাসোরাতে আমাকে যেতে হয়। সেবারে বাসোরায় পৌঁছিয়েই মনে হলো বুদুরের খবরটা একবার নিয়ে যাই। প্রেমিক যুগলের সংবাদ অনেকদিন পাইনি কি না।

বুদুরের বাড়ির বাগানের কাছে গিয়েই দেখি দরজা বন্ধ। চারপাশ চুপচাপ। বুকটা হঠাৎ ছাৎ করে উঠলো। দরজার জাফরীর ভেতর দিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার সন্দেহটা ঘনীভুতই হলো। দেখি নতুন একটা কবর বসেছে। কবরটা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। তার ওপরে একটা উইলো গাছ। গাছের ডালটা কবরের ওপরে ঝুকে পড়েছে! কবরের ওপরে কী একটা যেন লেখাই রয়েছে। দূর থেকে সেটা পড়তে পারলাম না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে। মেয়েটা শেষপর্যন্ত মরে গেলো? আহা বেচারা! যৌবনের ফুল ভোগে লাগলো না—বৃথাই ঝরে নষ্ট হয়ে গেলো! এমন রূপ-এত যৌবন-ভোগে লাগলো না!

রাত শেষ হয়ে এলো। চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো পঞ্চাশতম রজনী :

পরের দিন শাহরাজাদ। আবার গল্প বলতে শুরু করলো।

ভারাক্রান্ত মনে উমাইরের বাড়িতে ফিরে এলাম। সেখানে আর এক বিস্ময় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো।বাড়ি ঘর দোর সব ভেঙে চুরমার। খা-খাঁ করছে সব। সেই প্রাচীর একেবারে ধূলিসাৎ। অমন সুন্দর বাগান কীটা ঝোপে ভরপুর। দরজা-জানালাও গিয়েছে ভেঙে। কোন লোকজন নেই। আমার কথার উত্তর দেবে কে? শেষ পর্যন্ত ছেলেটাও গেলো মরে! ইয়া আল্লাহ। একটা বয়োৎ মনে পড়ে গেলে আমার।

দ্বারের গোবরটা দেখেই আমার চোখে জল এলো,
সেই আতিথেয়তার যুবরাজ আজ কোথায়?
আমার সঙ্গে যাঁরা বসতেন
সেই আনন্দময় অতিথিরা আজ কোথায়?
মাকড়সারা প্রশ্ন করছে—
উত্তর দিচ্ছে বাতাস।

দুঃখে আমার বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছিল। কালো একটা ক্রীতদাস পেছন থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো-চুপ কর বুড়ো। অমন করে চেঁচাচ্ছে কেন অ্যাঁ! দরজার কাছে অনবরত ভ্যাজ ভ্যাজ করছ।

বললাম–না না। চেঁচাব কেন? মনের দুঃখে কত কথাই না। আজ মনে পড়েছে। আমার এক বন্ধু মারা গিয়েছে তারই জন্যে দুঃখ করছি আর কি।

-কে তোমার বন্ধু গো?

—জুবাইর বিন উমাইর।

—বালাই, ষাট। তিনি মরতে যাবেন কেন? ঈশ্বরের কৃপায় তিনি ভালোই আছেন। লোকে কত মান্যিগণ্যি করে তাকে।

–তা’লে এইবাড়ি ঘর-বাগান সব গেলো কোথায়? এমন খাঁ-খাঁ করছে কেন?

–ভালোবাসার জন্যে।

–কী বললে! ভা-লো-বা-সা।

–হ্যাঁ, সাহেব, হ্যাঁ। আমীর উমাইর বেঁচে আছেন—এইটুকু শুধু বলতে পারি। তবে তিনি এখন মরোমরো। দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকেন। উঠতে পারেন না। কোন শক্তিই নেই ওঠার। বিছানার সঙ্গে একেবারে লেপটে রয়েছেন। ক্ষিদে পেলেও বলতে পারেন না, আমাকে খেতে দাও, তেষ্টা পেলেও বলতে পারেন না, আমাকে জল দাও।

নিগ্রো ক্রীতদাসটির কথা শেষ হতে না হতেই আমি বললাম—তুমি শিগগির ভেতরে যাও। উমাইরকে বল—মনসুর সাহেব এসেছেন। আমি এইখানে অপেক্ষা করছি–সেটাও বলে দিও।

ভেতরে ঢুকে গেলো ক্রীতদাসটি; তারপরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে আবার ভেতরে ঢুকলো। যেতে-যেতে সে বললো-সাবধান, আমীর সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন না। বলবেন কোন কম্মে? কানে তো কিছুই শুনতে পান না। তিনি। গায়ে হাত দিয়ে ইশারা করলে তবেই বোঝেন কিছুটা। আপনাকে কয়েকটা ইশারা শিখিয়ে দেব।

ঢুকলাম ভেতরে। দেখলাম, আমীর উমাইর একটা পালঙ্কের ওপরে শুয়ে রয়েছেন। এমন হাডিড়সার হয়ে পড়েছেন যে বুকের পাঁজরাগুলিও স্বচ্ছন্দে গোনা যায়। রক্তশূন্য। প্রথমে তো আমি চিনতেই পারিনি। চোখেও তার দৃষ্টি বলতে কিছু নেই। কুর্নিশ করলাম; অভিবাদন জানালাম। কাকস্য পরিবেদনা। ওপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই।

ক্রীতদাসটি আমকে ফিসফিস করে বললো-কবিতা ছাড়া কিছু শুনতে পান না। উনি। কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। একটু অসহায়-ও মনে হলো নিজেকে। অবশ্য এ-অবস্থা বেশীক্ষণ থাকে নি। যেন অনেক দূর থেকে বলছি। এই রকম উদাত্ত কষ্ঠে কবিতা বলতে শুরু করলাম।–

এখনও বুদুর তোমার ক্ষত-বিক্ষত আত্মাকে
শিক্ষা দিচ্ছে। অথবা, তুমি কি এখনও তার
নির্দেশ দেখতে পাচ্ছে না? অথবা, এখনও কি
তুমি বিনিদ্র রজনী যাপন করছ?
তুমি মুখ, মূখ, প্রেমিক মুখ তুমি।

এতেই কাজ হলো। ধীরে-ধীরে চোখ খুললো জুমাইর। ক্ষীণ কণ্ঠে বললো—স্বাগতম, ইবন। বিন-মনসুর। আমার অবস্থা তো দেখছেন। সব বিলিয়ে দিয়ে আজ আমি ফকির।

—আজ্ঞে, আপনার কি কোন কাজে লাগতে পারি?

—কেবল আপনিই পারেন। আমাকে বাঁচাতে। আমার একখানা চিঠি কি আপনি দয়া করে বুদুরের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমার সব কথা তাকে বুঝিয়ে বলবেন? আপনি ছাড়া আর কেউ একাজ পারবে না।

আপনার আদেশ শিরোধার্য।

অবাক কাণ্ড! মুখ থেকে কথাটা বেরোতে না বেরোতে উমাইর পালঙ্ক থেকে উঠে ‘বসলো। তারপরে হাতের তালুতে এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখতে শুরু করলো—

প্রিয়তমে,

আমি বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছি। হতাশার অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। এক সময় ভেবেছিলাম ভালোবাসাটা বোকামি; ভেবেছিলাম, ওর মত সহজ আর হালকা জিনিস আর নেই। কিন্তু তোমার অদৃশ্য ভালোবাসার উত্তাল তরঙ্গের ধাক্কায় প্রতিদিনই আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। ভালোবাসাকে একদিন তুচ্ছ করেছিলাম। আজ মনে হচ্ছে। এ মহাসাগরের সীমাও নেই, তলও নেই। হৃদয় আমার আজ ক্ষতবিক্ষত। তোমার কাছে না গেলে এ ক্ষত আমার সারবে না। তোমার বুকে আমার স্থান দাও। বিগত দিনের কৃতকর্মের জন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি নতজানু হয়ে। আমাকে দয়া করে ক্ষমা কর। ভেবে দেখ, একদিন আমরা দুজনে দুজনকে কত ভালোই না বসতাম। তোমার বিরহে আমি মারা যাব। এতটা নিষ্ঠুর নিশ্চয় তুমি হবে না…ইত্যাদি—ইতি…

চিঠিখানা ভাঁজ করে খামের মুখ বন্ধ করলে উমাইর। তারপরে শিলমোহর করে আমার হাতে তুলে দিলো। বুদুরের কী হয়েছে তাও জানি নে। তা সত্ত্বেও, খামটা আমি নিলাম। আবার ছুটিলাম বুদুরের বাড়ির দিকে। সামনের বাগান পেরিয়ে সোজা ভেতরে চলে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না।

বসার ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলাম। মেঝেতে কাপেট পাতা। দশটা ফরসা রঙের বাঁদী গোল হয়ে বসেছে বুদুরকে মাঝখানে রেখে। মনে হয় যেন সূর্য উঠেছে। চেহারায় চেকনাই দিয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশী। স্বাস্থ্যটাও বেশ ভালো হয়েছে। যৌবনের পুরো জোয়ার লেগেছে তার শরীরে। পরিধানে ছিলো ওর সকালের পোশাক। কুর্নিশ করে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কথার জবাবে সে একটু হেসে বললো-আসুন, আসুন-ইবন আল-মনসুর; কোন সংকোচ করবেন না। এতে আপনারই বাড়ি।

–আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। সব ভালো তো? তা এখনও তোমার গায়ে সকালের পোশাক কেন?

—আর বলবেন না, মনসুর সাহেব। সেই মেয়েটি মারা গিয়েছে। ওই বাগানে তার কবর। বলতে-বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটি। বাঁদীরা তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে।

ভেবেছিলাম কথা বলব না। কিন্তু শেষে বললাম-পরম করুণাময় ঈশ্বর, তোমার মঙ্গল করুন, তার আত্মাকে শান্তি দিন। তুমি মেয়েটিকে খুব ভালোবাসতে, দেখেছি। মেয়েটিও ভালোবাসত তোমাকে। তার জন্যে যে তোমার কান্না পাবে সে কথাও ঠিক। খোদাতালা তাকে তার কাছে টেনে নিয়েছেন।

-হ্যাঁ; মেয়েটা আমার খুব প্রিয় ছিলো।

বেশ নরম হয়ে পড়েছে বুদুর। ভাবলাম, এই সময়। আর দেরি না করে উমাইর চিঠিটা তাকে দিয়ে বললাম— তোমার জবাবের ওপরে তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে, বুদুর। তোমার উত্তরের আশায় বেচারার প্রাণটুকু এখনও কোনমতে টিকে রয়েছে।

চিঠিটা পড়তে-পড়তে বুদুরের মুখে তেতো হাসি ফুটে বেরোল। তারপরে সে বললো—এত গত বছরই না সে ঘেন্নায় আমার চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছিলো? আর এরই মধ্যে আমার অভাবে সে একেবারে মরমর! থাক; আমার উদ্দেশ্য সার্থক। গত বছর আমি তাকে আর কোন খবর দিইনি। আমার উদাসীনতা তাকে ক্রমেই হতাশ করেছে। সে যাতে আবার আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে তার জন্যে আমি কী না করেছি। কিন্তু প্রতিবারই সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো একান্নতম রজনী :

পরদিন রজনীতে আমার শুরু করলো শাহরাজাদ।

আমি বললাম-ঠিকই করেছ তুমি। সে যে অন্যায় করেছে তার জন্যে সামান্য একটু গালাগালি দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়াটা তোমার উচিৎ হবে না। তবে একটা কথা আমি বলি। ক্ষমা কিন্তু মানুষের আত্মার একটি মহৎ গুণ। তা ছাড়া আরও একটা কথা রয়েছে। এই বিশাল প্রাসাদে এই রূপ আর যৌবন নিয়ে একা এক নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে লাভ কী হবে তোমার? সে যদি মরেই যায়, তাহলে তুমিই কি শান্তি পাবে? সারা জীবনটা কি তোমার কষ্ট আর তুনুশোচনায় কাটবে না?

—আপনি বোধ হয় ঠিকই বলেছেন। আমি তার চিঠির জবাব দেব।

তারপরে কাগজ-কলম নিয়ে সে লিখতে বসলো। জাঁহাপনা, আপনাকে কী বলব। সে চিঠির যেমন ভাব তেমনি ভাষা। ভাবে ভাষায় একেবারে গলাগলি। আপনার রাজত্বের সবচেয়ে ভালো লেখকও বোধ হয় ওভাবে লিখতে পারবেন না। আমি অবশ্য হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারব না; সেই চিঠির বিষয়বস্তুটাই কেবল আমি নিজের ভাষায় বলছি—

প্রিয়তম,

আমাদের যে কেন বিচ্ছেদ ঘটেছিলো অনেক চেষ্টা করে তা আমি জানতে পারিনি। অতীতে আমার কোন অপরাধে হয়ত সেই বিচ্ছেদ সম্ভব হয়েছিলো। তবে, সে-অতীতের আজ মৃত্যু হয়েছে। অতীতের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে অসূয়াটুকুরও। তুমি আমার কাছে কবে ফিরে আসবে তারই পথ চেয়ে বসে থাকব প্রিয়তম। তোমার গালে চোখ দুটো ডুবিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব আমি। কতকাল যে ঘুমোইনি, তা জান? এবার সোনার মিষ্টি ঘুম আসছে, জেনে কতই না আনন্দ হচ্ছে।

যে পানীয় জীবনের সব তৃষ্ণা মেটাতে পারে তুমি এলে আমরা। দুজনে সেই পানীয় আকণ্ঠ পান করব। কেমন? পান করতে করতে যদি মাতাল হয়ে যাই তাহলেও কেউ আমাদের কিছু বলবে না, বলার কেউ নেই।

তোমার আসার পথ চেয়ে রইলাম।

–ইতি

বুদুরের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে বললাম—এই চিঠিখানা তাকে নিঃসন্দেহে চাঙ্গা করে তুলবে। সব দুঃখের অবসান হবে তার।

আমি বেরিয়ে আসব। এমন সময় আমার জামার আস্তিন ধরে বললো।—মনসুর সাহেব, আজ রাত্রেই আমরা দুজনে বেহেস্তের রাত তৈরি করতে পারি-একথা তাকে বলতে পারেন।

আমার যা আনন্দ হচ্ছিল তা আর আপনাকে কী বলব জাঁহাপনা! প্রায় ছুটতে ছুটতে আমীর উমাইর-এরবাড়ি চলে গেলাম। দেখলাম, আমীর সাহেব দরজার দিকে নিম্পলক নেত্ৰে তাকিয়ে বসে রয়েছে।

চিঠিখানা পড়তে-পড়তেই তার চোখ দুটো জলে ভরে টাইটুম্বর হয়ে গেলো। আনন্দে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। হঠাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ধীরে-বীরে জ্ঞান ফিরে এলে সে জিজ্ঞাসা করলো—ও কি নিজের হাতে এ চিঠি লিখেছে?

বললাম বিলক্ষণ! পায়ে করে কেউ চিঠি লিখতে পারে। এতো আমি জানতাম না।

আমার কথা শেষ হ’তে না হ’তেই পেছনের দরজায় চুডির ঝুনঝুন শব্দ আর সিল্কের কাপড়ের খসখস আওয়াজ আমার কানে এলো। মনে হলো, কোন মহিলা যেন পড়িকি-মারি ভাবে ছুটে আসছে। হ্যাঁ, হাঁ; যা ভেবেছি তাই। হুড়মুড় করে ছুটে এলো বুদুর। সে এক অপরূপ দৃশ্য জাঁহাপনা। ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। দুটি প্রেমিক-প্রেমিক বিপরীত দিক থেকে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে পরস্পরের কণ্ঠালগ্ন হয়ে একেবারে এক হয়ে গেলো। কথা বলার শক্তি কারও নেই। থাকবে কেমন করে? এক জনের ঠোঁট যে আর একজনের মুখের মধ্যে।

তাঁরা দাঁড়িয়ে রইলো আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে জুমাইর বুদুরের হাত ধরে তাকে বসতে বললো। কিছুতেই বসবে না বুদুর। অনেক অনুনয় বিনয়, সাধ্য-সাধনাতে তাকে বসানো গেলো না। জুমাইর তো ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলো। ই আল্লা, তরোটা তীরে এসে শেষ পর্যন্ত ডুবে যাবে নাকি?

আমি বললাম-কী হলো বুদুর? বস!

-আমাদের মধ্যে চুক্তি হলেই আমি বসব।

-কিসের চুক্তি?–কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্নটা করি আমি।

বুদুর বললো-সেটা আমাদের দুজনের ব্যাপার। —এই বলে সে তার মনের মানুষের কানে-কানে কী সব কথা যেন ফিসফিস করে বললো। আমি অবশ্য শুনতেও পাই নি, বুঝতেও পারি নি।

জুমাইর বললো-বুঝতে পেরেছি। নিশ্চয় সেটা এখন করতে হবে।

এই বলে একটা ক্রীতদাসকে ডেকে সে যেন কিছু একটা নির্দেশ দিলো। সাক্ষী। শাদীর শর্তাবলী লেখা হলো দুজনের। তারপরে দুজনকে শাদীর হলফনামা পড়ানো হলো। তারা যখন চলে গেলো বুদুর তাদের প্রত্যেককে এক হাজার করে দিনার দিয়ে দিলো। খুব তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেলো। তারা যখন চলে গেলো কাজীদের সঙ্গে আমিও চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছি এমন সময় আমীর বাধা দিয়ে বললো—দুখের দিনে আমাদের বন্ধু ছিলেন। আপনি। সুখের দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন এ কেমন কথা?

কী আর করি। ‘আনন্দের ভোজে কে না যোগ দিতে চায় বলুন। বলুন, জাঁহাপনা।’

সারা রাত ধরে খানা পিনা আর হই। হুল্লোেড় চললো। আমার জন্যে ঘর একটা আগেই ঠিক করা ছিলো। ভোর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই ঘরে বিশ্রাম নিতে আমি চলে গেলাম।

পরদিন ঘুম ভাঙতে স্বাভাবিক ভাবেই দেরি হয়ে গেলো আমার। গোছল সেরে প্রার্থনায় বসলাম। তারপরে বসার ঘরে গিয়ে তাদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে নবদম্পতী এসে হাজির হলো। বাঃ! এক রাত্রির মধ্যেই তাদের চেহারা একেবারে পালটে গিয়েছে। চেনাই যাচ্ছে না। আর। সুখ আর তৃপ্তিতে ঝকঝকি করছে তাদের মন। সদ্য গোছল করে এসেছে তারা-দেখতে তাজা গোলাপ ফুলের মত। খুব ভালো লাগছিলো আমার। তাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম—ভালোয় ভালোয় সব চুকে গিয়েছে। তোমাদের এই মিলনে আমারও কিছু ভূমিকা রয়েছে। এবার আমার বিদায় নেওয়ার পালা। যাওয়ার আগে একটা কৌতূহল মেটানোর ইচ্ছে রয়েছে।

—কী আপনার কৌতূহল?—প্রশ্ন করলো আমীর।

জিজ্ঞাসা করলাম—প্রথম দিন যখন তোমার বাড়িতে এলাম সেদিন দেখলাম তুমি বেশ চটে রয়েছ। কেন বলত? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে-তোমাদের বিচ্ছেদ হয়েছিলো কেন? বুদুরের কথা আমি অবশ্য আগেই শুনেছি। বুদুরের বাচ্চ বাঁদী ওর খোপা বেঁধে দিচ্ছিল। তাই দেখে তুমি রেগে ওর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো। এটা অবশ্য ওরই কথা। কিন্তু আমার মনে একটা খটকা লেগেছে। একমাত্র ওই তুচ্ছ ঘটনাটাই কি তোমার সেদিন বেরিয়ে আসার কারণ ছিলো? আমার ধারণা, এর পেছনে নিশ্চয় অন্য কোন বড় কারণ রয়েছে। সেটা কী?

আমীর মৃদু হেসে বললো-আপনি যথেষ্ট বিজ্ঞ, এবং বুদ্ধিমান। বুদুরের সেই মেয়েটা মরে গিয়েছে। আমার রাগও তাই কমে গিয়েছে। তবে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটা প্রথম কেমন করে হলো সেটা বলতে এখন আর কোন অসুবিধে আমার নেই।

—তাহলে বলে।

–ব্যাপারটা খুবই সামান্য। আমরা একবার নৌকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে বুদুরও ছিলো। ওদের কয়েকটা ব্যাপার দেখে মাঝি আমাকে আড়ালে বললো-মালিক, যে মেয়ে তার

বউকে কি কোন স্বামী বরদাস্ত করতে পারে? জানেন, ওরা একদিন আমার নৌকায় বসে জড়াজডি করে প্রেমের গান গাইছিলো। কী সাংঘাতিক সে গান। শুনে তো আমি ভিমি খাই আর কী! শুনবেন?

আমার ভেতরে যতটুকু উষ্ণতা রয়েছে
সবই ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
কারণ আমার প্রেমিক আর আগের মত নেই।
তার প্রেম তাই গরিলা হয়ে গেলো।
আজকাল আমি যতই ছলা-কলা দেখাই না কেন
তার পরিবর্তন হয়েছে অনেক।
তার হৃদয়টা এখন মাথায় রূপান্তরিত
তার বাকি সবই নরম তুলতুলে।

মাঝির কথা শুনে আমার মাথা গেলো ঘুরে; চোখে নামলো অন্ধকার! সত্যিই তো! একদিন দৌড়ে গেলাম বুদুরের বাড়ি। যা দেখলাম। সে কথা। আপনি আগেই বলেছেন। মাঝির সন্দেহটা তাহলে মিথ্যে নয় সেটা আমি নিজের চোখেই দেখে এলাম। যাক গে; সে সব এখন অতীত। যা অতীত তা অতীত-ই থাক। আমরা দুজনে ওসবই ভুলে যাব। ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো বাহান্নতম রজনী :

পরের দিন রজনীতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ :

কথা শেষ করে আমীর আমার দিকে একটা দিনারের থলে এগিয়ে দিয়ে বললো—আপনি আমাদের জন্যে যা করেছেন। সারা জীবনে তা আমরা ভুলতে পারব না। আপনি মাঝখানে না দাঁড়ালে হয়ত আমরা মারাই যেতাম। এটার মধ্যে তিন হাজার দিনার রয়েছে। আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এটা আপনাকে গ্রহণ করতেই হবে। তা না হলে আমরা দুঃখ পাব।

আমি তাদের আর দুঃখ দিতে পারলাম না। থলেটা নিয়ে তাদের আশীর্বাদ করে বেরিয়ে এলাম।

যা বাবা! ওটা কিসের আওয়াজ! মনসুর সাহেব গল্প থামিয়ে যে দিক থেকে আওয়াজটা আসছিলো সেই দিকে তাকালেন। তাজ্জব কী বাত্ রে বাবা! খলিফা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আর এদিকে মনসুর সাহেব আপন মনে গল্প বলে যাচ্ছেন। মনসুরের সুন্দর গল্পটি শুনতে শুনতে খলিফার বিক্ষিপ্ত চিন্তা কখন শান্ত হয়েছে, কখন তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন তা তিনি টেরই পাননি। পাছে হারুন অল-রাসিদের ঘুম ভেঙে যায়। এই ভয়ে পা টিপে-টিপে তিনি বেরিয়ে এলেন খাস কামরার বাইরে। আরও আস্তে-আস্তে প্রধান খোজা প্রধান ফটক খুলে দিলো। মনসুর বাইরে চলে গেলেন।

গল্প শেষ করে শাহরাজাদ চুপ করে বসে রইলো একটু, তারপুরে শাহরিয়ারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো—আশ্চর্য জাঁহাপনা, যে গল্প শুনে হারুন অল-রাসিদ ঘুমিয়ে পড়লেন সেই গল্প শুনে আপনার চোখে ঘুমের বাষ্পটুকুও তো দেখা যাচ্ছে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *