২.০৮ সীতারাম চা লইয়া আসিলে

বৈকালে সীতারাম চা লইয়া আসিলে ব্যোমকেশ তাহাকে বলিল‌, ‘সীতারাম‌, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। বছর দুই আগে একদল বেদে এসে এখানে তাঁবু ফেলে ছিল। তোমাকে বুলাকিলালের কাছে খবর নিতে হবে‌, বাড়ির কে কে বেদের তাঁবুতে যাতায়াত করত–এ বিষয়ে যত খবর পাও যোগাড় করবে।’

সীতারাম বলিল‌, ‘জী হুজুর। বুলাকিলাল এখন বাবুদের নিয়ে শহরে গেছে‌, ফিরে এলে খোঁজ নেব।’

সীতারাম প্রস্থান করিলে বলিলাম‌, ‘বেদে সম্বন্ধে কৌতুহল কেন?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বিষ! সাপের বিষ কোথেকে এল খোঁজ নিতে হবে না?’

‘ও—’

এই সময় পাণ্ডেজি উপস্থিত হইলেন। তাঁহার কাঁধ হইতে চামড়ার ফিতায় বাইনাকুলার বুলিতেছে। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একি; দূরবীন কি হবে?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘আনিলাম। আপনার জন্যে‌, যদি কাজে লাগে।–সকলে আসতে পারিনি‌, কাজে আটকে পড়েছিলাম। তাই এবেলা সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় আসতে আসতে দেখি রামকিশোরবাবুও শহর থেকে ফিরছেন। তাঁদের ইঞ্জিন বিগড়েছে‌, বুলাকিলাল হুইল ধরে বসে আছে‌, রামকিশোরবাবু গাড়ির মধ্যে বসে আছেন‌, আর জামাই মণিলাল গাড়ি ঠেলছে।’

‘তারপর?’

‘দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়ি টেনে নিয়ে এলাম।’

‘ওঁদের আদালতের কাজকর্মচুকে গেল?’

‘না‌, একটু বাকি আছে‌, কাল আবার যাবেন। —তারপর‌, নতুন খবর কিছু আছে নাকি?’

‘অনেক নতুন খবর আছে।’

খবর শুনিতে শুনিতে পাণ্ডেজি উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। বিবৃতি শেষ হইলে বলিলেন‌, আর সন্দেহ নেই। ঈশানবাবু তোষাখানা খুঁজে বার করেছিলেন‌, তাই তাঁকে কেউ খুন করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে‌, কে খুন করতে পারে?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘রামকিশোরবাবু থেকে সন্নিসি ঠাকুর পর্যন্ত সবাই খুন করতে পারে। কিন্তু এটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়। আরও প্রশ্ন আছে।’

‘যেমন?’

‘যেমন‌, বিষ এল কোথেকে। সাপের বিষ তো যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না। তারপর ধরুন‌, সাপের বিষ শরীরে ঢ়োকবার জন্যে এমন একটা যন্ত্র চাই যেটা ঠিক সাপের দাঁতের মত দাগ রেখে যায়।’

‘হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ-?’

‘ইনজেকশনের ছুঁচের দাগ খুব ছোট হয়‌, দু’চার মিনিটের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। আপনি ঈশানবাবুর পায়ে দাগ দেখেছেন‌, ইনজেকশানের দাগ বলে মনে হয় কি?’

‘উহুঁ। তাছাড়া‌, দুটো দাগ পাশাপাশি—’

‘ওটা কিছু নয়। যেখানে রুগী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সেখানে পাশাপাশি দু’বার ছুচ ফোটানো শক্ত কি?’

‘তা বটে।–আর কি প্রশ্ন?’

আর‌, ঈশানবাবু যদি গুপ্ত তোষাখানা খুঁজে বার করে থাকেন তবে সে তোষাখানা কোথায়?’

‘এই দুর্গের মধ্যেই নিশ্চয় আছে।’

‘শুধু দুর্গের মধ্যেই নয়‌, এই বাড়ির মধ্যেই আছে। মুরলীধর যে সাপের ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াবার চেষ্টা করছে‌, তার কারণ কি?’

পাণ্ডেজি তীক্ষা চক্ষে চাহিলেন‌, ‘মুরলীধর?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তার অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মোট কথা‌, ঈশানবাবু আসবার আগে তোষাখানার সন্ধান কেউ জানত না। তারপর ঈশানবাবু ছাড়া আর একজন জানতে পেরেছে এবং ঈশানবাবুকে খুন করেছে। তবে আমার বিশ্বাস‌, মাল সরাতে পারেনি।’

‘কি করে বুঝলেন?’

‘দেখুন‌, আমরা দুর্গে আছি‌, এটা কারুর পছন্দ নয়। এর অর্থ কি?’

‘বুঝেছি। তাহলে আগে তোষাখানা খুঁজে বার করা দরকার। কোথায় তোষাখানা থাকতে পারে; আপনি কিছু ভেবে দেখেছেন কি?’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল‌, বলিল‌, ‘কাল থেকে একটা সন্দেহ আমার মনের মধ্যে ঘুরছে—’

আমি বলিলাম‌, ‘গজাল!’

এই সময় সীতারাম চায়ের পাত্রগুলি সরাইয়া লইতে আসিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চাহিয়া বলিল‌, ‘বুলাকিলাল ফিরে এসেছে।’

সীতারাম মাথা ঝুঁকাইয়া পাত্রগুলি লইয়া চলিয়া গেল। পাণ্ডে জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘ওকে কোথাও পাঠালেন নাকি?’

‘হ্যাঁ‌, বুলাকিলালের কাছে কিছু দরকার আছে।’

‘যাক। এবার আপনার সন্দেহের কথা বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঐ গজালগুলো। কেবল সন্দেহ হচ্ছে ওদের প্রকাশ্য প্রয়োজনটাই একমাত্র প্রয়োজন নয়‌, যাকে বলে ধোঁকার টাটি‌, ওরা হচ্ছে তাই।’

পাণ্ডে গজালগুলিকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিলেন‌, ‘হুঁ। তা কি করা যেতে পারে।’

‘আমার ইচ্ছে ওদের একটু নেড়েচেড়ে দেখা। আপনি এসেছেন‌, আপনার সামনেই যা কিছু করা ভাল। যদি তোষাখানা বেরোয়‌, আমরা তিনজনে জানিব‌, আর কাউকে আপাতত জানতে দেওয়া হবে না।–অজিত‌, দরজা বন্ধ কর।’

দরজা বন্ধ করিলে ঘর অন্ধকার হইল। তখন লণ্ঠন জ্বালিয়া এবং টর্চের আলো ফেলিয়া আমরা অনুসন্ধান আরম্ভ করিলম। সর্বসুদ্ধ পনরোটি গজাল। আমরা প্রত্যেকটি টানিয়া ঠেলিয়া উঁচু দিকে আকর্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। গজালগুলি মরিচা-ধরা কিন্তু বজের মত দৃঢ়্‌্‌, একচুলও নড়িল না।

হঠাৎ পাণ্ডে বলিয়া উঠিলেন‌, ‘এই যে! নড়ছে-একটু একটু নড়ছে–!’ আমরা ছুটিয়া তাঁহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। দরজার সামনে যে দেয়াল‌, তাহার মাঝখানে একটা গজাল। পাণ্ডে গজাল ধরিয়া ভিতর দিকে ঠেলা দিতেছেন; নড়িতেছে কিনা আমরা বুঝিতে পারিলাম না। পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘আমার একার কর্ম নয়। ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনিও ঠেলুন।’

ব্যোমকেশ হাঁটু গাড়িয়া দুই হাতে পাথরে ঠেলা দিতে শুরু করিল। চতুষ্কোণ পাথর ধীরে ধীরে পিছন দিকে সরিতে লাগিল। তাহার নীচে অন্ধকার গর্ত দেখা গেল।

আমি টর্চের আলো ফেলিলাম। গর্তটি লম্বা-চওড়ায় দুই হাত‌, ভিতরে একপ্রস্থ সরু সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে।

পাণ্ডে মহা উত্তেজিতভাবে কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন‌, ‘শাবাশ! পাওয়া গেছে তোষাখানা। —ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আবিষ্কর্তা‌, আপনি আগে ঢুকুন।’

টর্চ লইয়া ব্যোমকেশ আগে নামিল‌, তারপর পাণ্ডেজি‌, সর্বশেষে লণ্ঠন লইয়া আমি।। ঘরটি উপরের ঘরের মতাই প্রশস্ত। একটি দেওয়ালের গা ঘেষিয়া সারি সারি মাটির কুণ্ডা। কুণ্ডার মুখ ছোট ছোট হাঁড়ি‌, হাঁড়ির মুখ সারা দিয়া ঢাকা।। ঘরের অন্য কোণে একটি বড় উনান‌, তাহার সহিত একটি হাপরের নল সংযুক্ত রহিয়াছে। হাপরের চামড়া অবশ্য শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে‌, কিন্তু কাঠামো দেখিয়া হাপর বলিয়া চেনা যায়। ঘরে আর কিছু নাই।

আমাদের ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছিল‌, পেট মোটা কুণ্ডাগুলিতে না জানি কোন রাজার সম্পত্তি রহিয়াছে। কিন্তু আগে ঘরের অন্যান্য স্থান দেখা দরকার। এদিক-ওদিক আলো ফেলিতে এককোণে একটা চকচকে জিনিস চোখে পড়িল। ছুটিয়া কাছে গিয়া দেখি-একটি ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ। তুলিয়া লইয়া জ্বালাইবার চেষ্টা করিলম‌, কিন্তু টর্চ জ্বালাই ছিল‌, জ্বলিয়া জ্বলিয়া সেল ফুরাইয়া নিভিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঈশানবাবু যে এ ঘরের সন্ধান পেয়েছিলেন‌, তার অকাট্য প্রমাণ।’।

তখন আমরা হাঁড়িগুলি খুলিয়া দেখিলাম। সব হাঁড়িই শূন্য‌, কেবল একটা হাঁড়ির তলায় নুনের মত খানিকটা গুড়া পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ একখামচা তুলিয়া লইয়া পরীক্ষা করিল‌, তারপর রুমালে বাঁধিয়া পকেটে রাখিল। বলিল‌, নুন হতে পারে‌, চুন হতে পারে‌, অন্য কিছুও হতে পারে।’

অতঃপর কুণ্ডাগুলি একে একে পরীক্ষা করা হইল। কিন্তু হায় সাত রাজার ধন মিলিল না। সব কুণ্ডা খালি‌, কোথাও একটা কপর্দক পর্যন্ত নাই।

কিন্তু কিছু মিলিল না।

উপরে ফিরিয়া আসিয়া প্ৰথমে গুপ্তদ্বার টানিয়া বন্ধ করা হইল। তারপর ঘরের দরজা খুলিলাম। বাহিরে অন্ধকার হইয়া গিয়াছে; সীতারাম দ্বারের বাহিরে ঘোরাঘুরি করিতেছে। ব্যোমকেশ ক্লান্তিস্বরে বলিল‌, ‘সীতারাম‌, আর একদফা চা তৈরি কর।’

চেয়ার লইয়া তিনজনে বাহিরে বসিলাম। পাণ্ডে দমিয়া গিয়াছিলেন‌, বলিলেন‌, ‘কি হল বলুন দেখি? মাল গেল কোথায়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে। এক‌, সিপাহীরা সব লুটে নিয়ে গিয়েছে। দুই‌, ঈশানবাবুকে যে খুন করেছে‌, সে সেই রাত্রেই মাল সরিয়েছে। তিন‌, রাজারাম অন্য কোথাও মাল লুকিয়েছেন।’

‘কোন সম্ভাবনাটা আপনার বেশি মনে লাগে?’ ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া বিলাকা’ কবিতার শেষ পংক্তি আবৃত্তি করিল‌, ‘হেথা নয়‌, অন্য কোথা‌, অন্য কোথা‌, অন্য কোনখানে।’

চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বুলাকিলালের দেখা পেলে?’

সীতারাম বলিল‌, ‘জী। গাড়ির ইঞ্জিন মেরামত করছিল‌, দু-চারটে কথা হল।’

‘কি বললে সে?’

‘হুজুর‌, বুলাকিলাল একটা আস্ত বুদ্ধ। সন্ধ্যে হলেই ভাঙি খেয়ে বেদম ঘুমোয়‌, রাত্তিরের কোনও খবরই রাখে না। তবে দিনের বেলা বাড়ির সকলেই বেদের তাঁবুতে যাতায়াত করত। এমনকি‌, বুলাকিলোলও দু-চারবার গিয়েছিল।’

‘বুলাকিলাল গিয়েছিল কেন?’

‘হাত দেখাতে। বেদেনীরা নাকি ভাল হাত দেখতে জানে‌, ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে। বুলাকিলালকে বলেছে ও শীগগির লাট সাহেবের মোটর ড্রাইভার হবে।’

‘বাড়ির আর কে কে যেতো?’

‘মালিক‌, মালিকের দুই বড় ছেলে‌, জামাইবাবু্‌, নায়েববাবু্‌, সবাই যেতো। আর ছোট ছেলেমেয়ে দুটো সর্বদাই ওখানে ঘোরাঘুরি করত।’

‘হুঁ, আর কিছু?’

‘আর কিছু নয় হুজুর।’

রাত্রি হইতেছে দেখিয়া পাণ্ডেজি উঠিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে রুমালে বাঁধা পুঁটুলি দিয়া বলিল‌, ‘এটার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করিয়ে দেখবেন। আমরা এ পর্যন্ত যতটুকু খবর সংগ্ৰহ করেছি। তাতে নিরাশ হবার কিছু নেই। অন্তত ঈশানবাবুকে যে হত্যা করা হয়েছে‌, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ‌, বাকি খবর ক্রমে পাওয়া যাবে।’

পাণ্ডেজি রুমালের পুঁটুলি পকেটে রাখিতে গিয়া বলিলেন‌, ‘আরে‌, ডাকে আপনার একটা চিঠি এসেছিল‌, সেটা এতক্ষণ দিতেই ভুলে গেছি। এই নিন।–আচ্ছা‌, কাল আবার আসব।’

পাণ্ডেজিকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ চিঠি খুলিয়া পড়িল‌, জিজ্ঞাসা করিলম‌, সত্যবতীর চিঠি নাকি?’

‘না‌, সুকুমারের চিঠি।’

‘কি খবর?’

‘নতুন খবর কিছু নেই। তবে সব ভাল।’