২.০২ নৃসিংহগ্রাম

নৃসিংহগ্রাম

পরের দিন প্রত্যুষেই সুব্রত সাইকেলে নৃসিংহগ্রামের দিকে রওনা হয়ে গেল। কিরীটী আর একটা দিন সুব্রতর ওখানে একা একা থাকবে না এবং সেটা ভালও দেখায় না, অনেকেরই হয়ত সন্দেহের উদ্রেক করবে, তাই বিকাশের ওখানে গিয়েই উঠল। ঠিক হল সুব্রত নৃসিংহগ্রাম থেকে ফিরে এলে অবস্থা বিবেচনা করে যা হোক তখন একটা ব্যবস্থা করলেই হবেখন। রায়পুর থেকে নৃসিংহগ্রাম প্রায় আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ মাইলের কিছু বেশী হবে। যানবাহনের মধ্যে এক গরুরগাড়ি, প্রায় দু-তিন দিনেরও বেশী পথ, তাছাড়া রায়পুর থেকে ট্রেনে চেপে দুটো স্টেশন পরে ছোট একটা স্টেশনে নেমে মাইল চোদ্দ-পনের ঘোড়ায় চেপেও যাওয়া যায়। শেষোক্ত উপায়েই বেশীর ভাগ সকলেনৃসিংহগ্রামে যাতায়াত করে। বিশেষ করে রায়পুরের রাজবাড়ির লোকেরা। গরুর গাড়ি যাতায়াতের জন্য যে পথটা আছে, সেটা একটা অপরিসর কাঁচা রাস্তা, মাইল পনের-ষোল গেলেই ঘন শালবন। প্রায় পাঁচ-ছ মাইল লম্বা শালবন পেরুলেই দুর্ভেদ্য জঙ্গল; জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু একটা রাস্তা চলে গেছে। রাজাবাহাদুর যখন নৃসিংহগ্রামে যান, মোটরে চেপে ঐ রাস্তা দিয়েই যান। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যে পাঁচ-ছ মাইল রাস্তা, ঐ রাস্তাটা যেমন বিপদসংকুল তেমনি দুর্গম।

জঙ্গল পার হলে, মাইল পনের-ষোল গিয়ে এদের—মানে রায়পুর স্টেটের একটা ছোটখাটো শালকাঠের কারখানা আছে। সেখানে শালবন থেকে গাছ কেটে এনে কাঠ চেরাই ইত্যাদি হয়। তারপর সেখান থেকে গরুরগাড়িতে চাপিয়ে দূরবর্তী রেল স্টেশনে চালান দেওয়া হয়। কাঠের কারখানা থেকে নৃসিংহগ্রামটির দূরত্ব প্রায় মাইলখানেক হবে। স্টেটের যতগুলো মহাল আছে, তার মধ্যে নৃসিংহগ্রামই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ।

জায়গাটি দৈর্ঘ্যেও প্রস্থে মাইল দুয়েকের বেশী হবে না। চারপাশে ছোট ছোট পাহাড়। ছোট একটি পাহাড়ী নদী আছে, তার উৎস ওরই একটি পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা ঝর্ণা থেকে।

আর আছে পাহাড়ের উপরে ছোট একটি গুহার মধ্যে পাথরের তৈরী একটি নৃসিংহদেবের মূর্তি। সেইজন্যই জায়গাটির নাম নৃসিংহগ্রাম হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ধারণা যে নৃসিংহদেবের মূর্তিটি নাকি অত্যন্ত জাগ্রত। প্রতি শনিবার সেখানে সকলে পুজো দিয়ে আসে। তাছাড়া চৈত্র-পূর্ণিমাতে খুব ধুমধাম করে একবার পুজা হয়। সে-সময় সেখানে ছোটোখাটো একটা মেলাও বসে। স্থানীয় অধিবাসীরা বেশীর ভাগই সাঁওতাল ও বাউরী। দু-চার ঘর পাহাড়ীও আছে। বেশীর ভাগ লোকই স্টেটের শালকাঠের কারখানায় কাজ করে জীবিকানির্বাহ করে। সামান্য চাষ-আবাদও আছে। স্থানটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। সেইজন্যেই হয়ত সুদূর অতীতে কোনো একসময় রাজাদের কোনো পূর্বপুরুষ এখানে স্থানীয়ভাবে বসবাস করবার ইচ্ছায় প্রকাণ্ড একটি প্রাসাদ তৈরী করেছিলেন। বহুদূর থেকে প্রাসাদের চূড়া দেখা যায়। প্রাসাদটি মুসলমানের আমলের স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন দেয়। শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের পিতাও বৎসরের মধ্যে অন্তত তিন-চার মাস নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদে এসে কাটিয়ে যেতেন। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের সময় হতেই সে নিয়মের ব্যতিক্রম শুরু হয়। তারপর শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের ও সুধীনের পিতার মৃত্যুর পর আর বিশেষ কেউ একটা নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদে এসে দু-একদিনের বেশী কাটায়নি। প্রাসাদের এক অংশে এখন কাছারীবাড়ি করা হয়েছে।

এখানকার নায়েব বা ম্যানেজার শিবনারায়ণ চৌধুরী নিজের ইচ্ছায় যতটা করেন সেই মতই সব হয়। শিবনারায়ণের কোনো কাজের সমালোচনা রাজাবাহাদুর স্বয়ংও কোনোদিন করেন না।

সুব্রত কতকটা ইচ্ছা করেই ট্রেনে না গিয়ে সাইকেলে চেপে রওনা হয়েছিল। আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ মাইল পথ এমন বিশেষ কিছুই নয়। তাছাড়া যেতে যেতে চারপাশ ভাল করে দেখতে দেখতেও যাওয়া যাবে। আসবার সময় রাজবাড়ি থেকে বন্দুক দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সুব্রত মৃদু হেসে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। সঙ্গে এনেছে একটা সাত সেলের হান্টিং টর্চ, একটি বড় দোলা ছুরি, একটা দড়ির মই ও সামান্য টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিসপত্র। প্রথম দিকে বেশ একটু বেগের সঙ্গেই সাইকেল চালিয়ে সুব্রত বেলা প্রায় গোটা দশেকের মধ্যেই জঙ্গলের মাঝামাঝি পৌঁছে গেল।

বেশ ঘন জঙ্গল। দিনের বেলাতেও বড় বড় পত্রবহুল বৃক্ষ সূর্যের আলোকে প্রবেশাধিকার দেয় না। আগে নাকি এই বনে বাঘও দেখা যেত, এখনও যে একেবারে নেই তা নয়, কচিৎ কখনও দু-একটা দেখা যায়। হাতী আছে, আর আছে বন্য বরাহ ও হরিণ।

বনের মধ্য দিয়ে যে পথটি চলে গেছে, অতিকষ্টে সে পথ দিয়ে একটা টুরার মোটর গাড়ি যেতে পারে। পথটিকে পায়ে-চলা-পথ বলাই উচিত।

জঙ্গলের মধ্যেই একটা বড় গাছের তলায় বসে সুব্রত সঙ্গে টিফিন-ক্যারিয়ারে ভর্তি করে যে লুচি-তরকারী এনেছিল তার সদ্ব্যবহার করলে।

আহারাদির পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সুব্রত আবার রওনা হল। জঙ্গল পেরিয়ে শালবনে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা প্রায় তিনটে হয়ে গেল। সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে। শালবনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে সুব্রত সাইকেল চালিয়ে চলে। চৈত্রের ঝরা পাতায় চারদিক ঢেকে গেছে; মধ্যাহ্নের মন্থর বাতাসে ঝরা পাতাগুলি উড়ে উড়ে মর্মরধ্বনি তোলে, উদাস-করুণ চৈত্ররাগিনী যেন।

স্তব্ধ মধ্যাহ্নেভেসে আসে মাঝে মাঝে ঘড়িয়ালের উদাস মন্থর ডাক।

হেথা হোথা বুনো কবুতরের মৃদু গুঞ্জন। শালবনের চতুর্দিকে ইতস্তত কুটজ কুসুমের মন-ভোলানো শোভা। ফিকে বেগুনি ও ধুলোটে সাদা রংয়ের অজস্র ফুল ধরেছে তাতে গুচ্ছে গুচ্ছে।

বাতাস তীব্র একটা কটু গন্ধ ভাসিয়ে আনে। রঙিন মধুলোভী প্রজাপতি উড়ে উড়ে বেড়ায় ফুলে ফুলে। সুব্রতর কেমন যেন নেশা লাগে। সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে চলে সে।

সূর্য যখন একেবারে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার বিষণ্ণ বিধুর ছায়া, সুব্রত এসে নৃসিংহগ্রামে প্রবেশ করল। কোথায় একটা কুকুরের ডাক শোনা যায়।

শিবনারায়ণকে আগেই সংবাদ দেওয়া ছিল, প্রাসাদের সামনে প্রশস্ত চত্বরে এসে সুব্রত পা-গাড়ি হতে নামল।

অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে কে একজন দীর্ঘ অস্পষ্ট ছায়ার মত দাঁড়িয়েছিল। সুব্রত তাকেই প্রশ্ন করল, নায়েব চৌধুরী মশাই কোথায় বলতে পারেন?

ছায়ামূর্তি গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলে, আমারই নাম শিবনারায়ণ চৌধুরী, মহাশয়ের নামটি কি জানতে পারি কি? কোথা হতে আগমন হচ্ছে?

কল্যাণ রায়, রায়পুর থেকে আসছি।

ও, আপনিই কল্যাণ রায়! আসুন, নমস্কার। শিবনারায়ণের কণ্ঠস্বর আনন্দে উচ্ছলিত হয়ে ওঠে। তারপরই চিৎকার করেন, ওরে দুঃখীরাম, সুখন-আলো জ্বালিসনি এখনও! আসুন কল্যাণবাবু, ভেতরে আসুন, আপনারই জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পা-গাড়ি ওখানেই থাক, ওরাই তুলে রাখবেখন।