২. লারার নজর নিউইয়র্ক

দ্বিতীয় পর্ব । প্রথম অধ্যায়

১৯৮৪ সাল। লারার এবার নজর নিউইয়র্ক। হাওয়ার্ডের কাছে সে তার পরিকল্পনার কথাটা জানাল। কিন্তু হাওয়ার্ড সমর্থন করল না। হাওয়ার্ডের আচরণের মধ্যে কেমন একটা নিস্পৃহভাবে।

হাওয়ার্ড বলল–নিউইয়র্ক শহরটাকে তুমি চেনো না লারা। লারা আমরা বরং

লারা স্বাভাবিকভাবে বলল–গ্রেস বে-তে থেকে যখন চিকাগো শহরে এসেছিলাম, তখন আমাকে এসব কথাই শুনতে হয়েছিল। যেখানে তুমি বাড়ি তৈরী করো না কেন, চিকাগো কিংবা নিউইয়র্ক কিংবা টোকিও, নিয়মনীতি সব জায়গাতেই এক, তাহলে কেন আমরা মিথ্যে ভয় পাব।

হাওয়ার্ড বলল–তুমি এখানে চমৎকার কাজ করেছে। চিকাগো শহরের মানচিত্রটাই পাল্টে দিয়েছো। তুমি আর কী চাও?

লারা মৃদু হেসে জবাব দিল–আমি তো তোমায় আগেই বলেছি হাওয়ার্ড, আমি আরো চাই। নিউইয়র্কে একটা ক্যামেরন প্লাজা তৈরী করব। তারপর ক্যামেরন সেন্টার। আর শুনতে চাও? আমি একদিন পৃথিবীর সবথেকে উঁচু বাড়িটা তৈরী করতে চাই। তা হবে ওই নিউইয়র্কে। ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজ এবার চলেছে নিউইয়র্ক জয় করতে।

হাওয়ার্ড আর কিছু বলার সাহস পেল না। নিউইয়র্কে চারিদিকে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় যারা জায়ান্ট, তারা এখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। যেমন ছিলেন জিকেন ডরফস, হ্যারি হেলানসলে, ডোনাল্ড ট্রাস্ট, কাউন্স ইত্যাদি।

লারা হাওয়ার্ডকে বলল–আমি ওদের ক্লাবে যোগ দেব।

হাওয়ার্ড বলল–বেশতো।

এরপর শুরু হল শহরটাকে ঘুরে দেখার কাজ। এবং অবশ্যই পছন্দ মতো জায়গা আবিষ্কার করা। লারা আগে জানত না, শহরটা এত প্রাণময়। অজস্র আকাশচুম্বী বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। নদীর চারপাশ ঘিরে আকাশ দৈত্যরা আকাশকে গিলতে চলেছে। অসংখ্য গাড়ির ভিড়। প্রাণচঞ্চল এই মহানগরীতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল লারার। গ্রেস বে আর চিকাগো থেকে সত্যি শহরটা একেবারে আলাদা।

লারা আর এক মুহূর্ত দেরী করতে রাজী নয়। একটা কাজ এখনই করতে হবে। পেশাদার শ্রমিকদের নিয়ে একটা সমন্বয়কারী টিম বানাতে হবে।

রিয়েল এস্টেটের ব্যাপারে অভিজ্ঞ আইনজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। ম্যানেজমেন্ট টিম তৈরী করতে হবে।

লারা বলল–আমার কাছে যে বিল্ডিং-এর লিস্টটা আছে, সেগুলি আমার পছন্দ। এখন একজন ভালো স্থপতি দরকার। এই বাড়িগুলো যারা তৈরী করেছে, সেই আর্কিটেক্টের সঙ্গে আমি এখনই দেখা করতে চাই।

লারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে হাওয়ার্ড বুঝতে পারল। হাওয়ার্ড বলল–ব্যাঙ্ক থেকে যাতে ক্রেডিট পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাটা আমিই করব। চিকাগোতে আমাদের অনেকগুলো সম্পত্তি আছে, তাই ক্রেডিট পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। এখন সেভিংস আর লোন কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। কয়েক জন রিয়েল এস্টেট ব্রোকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

–বাঃ, চমৎকার।

–লারা, এসব করার আগে ঠিক করে বলল তো তোমার পরবর্তী প্রোজেক্টটা কী হবে?

লারা অনেকক্ষণ ধরে হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর বলল–আমি কি এব্যাপারে কিছুই বলিনি?

–না তো! অবাক হল হাওয়ার্ড।

লারা বলল–আমরা ম্যানহাটন সেন্টার হসপিটাল কিনতে চলেছি।

হাওয়ার্ড আর কোনো কথা বলল না। এই ভাবনাটা তার মাথায় আসেনি।

কয়েকদিন আগে লারা ম্যাজিসিয়ান এভিন্যুতে একটা হেয়ার ড্রেসারের কাছে গিয়েছিল। ওর চুলটা যখন ঠিক করছিল, তখন পাশের বুথ থেকে কিছু কথাবার্তা ওর কানে আসে। ও শুনতে পায় ম্যানহাটন সেন্টার হসপিটালের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। যে কোনো সময় সেটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কর্মচারীদের মাইনে পত্র মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কথা বলছিল, সে ওই হাসপাতালের সুপারভাইজার। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে ওই। হাসপাতালে চাকরি করেছে। লারা মন দিয়ে তার কথাগুলো শুনছিল। খবরটা এখনো কাগজে বেরোয়নি। শুধুমাত্র হাসপাতালের কর্মচারীরাই জানে। খবরটা চেপে রাখা হয়েছে। লারার চুলটা ঠিক হতে আরো কিছুক্ষণ দেরী ছিল। সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল।

হেয়ার ড্রেসার মহিলা বলল–এখনো কিছুটা বাকি আছে, মিস ক্যামেরন।

লারা বলল ঠিক আছে। বাকিটা পরে হবে। আমার একটু তাড়া আছে। কিছু মনে করো না।

পুরো পেমেন্ট দিয়ে লারা ওখান থেকে চলে এসেছিল। মাথায় তখন একটাই ভাবনা  ঘুরপাক খাচ্ছে, যে করেই হোক ম্যানহাটন সেন্টার হসপিটাল কিনতে হবে, এই সুযোগটাই তাকে গ্রহণ করতেই হবে।

হাসপাতালটা ঘুরে দেখল সে। কোনো ব্লকই বাদ দিল না। এখানে একটা নতুন কাইসক্যাপার তৈরী করা যাবে। কয়েকটা ব্লক বাড়ানো যাবে। এগুলো হবে একেবারে নীচে। ওপরে থাকবে কয়েকটা লাক্সারি কন্ডো মিনিয়াম। জায়গাটা একেবারে বদলে যাবে।

লারা হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে মালিকের নাম জানতে চাইল। ওরাল স্ট্রিটের রজার বার্মিংহাম নামে এক ব্যক্তি হাসপাতালের মালিক। তার অনেকগুলি অফিস আছে। তার মধ্যে একটিতে মিস্টার বার্মিংহাম বসেন।

লারা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। লারা তাকাল মালিক রজার বার্মিংহামের দিকে। মৃদু হেসে বলল–শুনলাম ম্যানহাটন সেন্টার হসপিটালটা বিক্রি আছে? ভদ্রলোক অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–কোথায় শুনেছেন?

–ব্যাপারটা কি সত্যি?

–হ্যাঁ, সত্যি।

–আমি হাসপাতালটা কিনতে আগ্রহী। আপনি কত দাম দিয়েছেন।

বার্মিংহাম লারার দিকে তাকালেন। বললেন–দেখুন মিস, আমি তো আপনাকে ঠিক জানি না। এসব ব্যাপারে যখন তখন আলোচনা করা যায় না। নব্বই মিলিয়ন ডলার সোজা ব্যাপার নয়।

লারার কাছে দামটা খুব চড়া ঠেকল। কিন্তু এই হাসপাতালটা তার চাই। আরম্ভটা তাহলে উড়ে চলার মধ্যে দিয়ে শুরু হবে।

লারা বলল–আমরা কি ওই বিষয়ে কথা বলতে পারি?

–সে তো বটেই।

লারা একটা একশো ডলারের নোট বার্মিংহামের হাতে দিল। বার্মিংহাম অবাক হয়ে তাকাল লারার দিকে। জিজ্ঞাসা করল–এটা কী জন্য?

লারা বলল–এটা আটচল্লিশ ঘন্টার জন্য। আপনারা তো এখনো বিক্রির ব্যাপার কোনো রকম ঘোষণা করেননি। আমি যদি আপনার দামটা দিতে পারি, তা হলে খুবই ভালো হবে দেখা যাক।

আবার রজার বললেন–আমি তো আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না।

লারা জবাব দিল–আপনি একটা কাজ করুন মিস্টার বার্মিংহাম। চিকাগোর মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্কে ফোন করুন। ওখানকার প্রেসিডেন্ট বব ভ্যান্সকে ডেকে পাঠান।

রজার বার্মিংহাম বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন লারার দিকে। তারপর মাথাটা একবার নেড়ে নিলেন, টেলিফোন গাইডটা তুললেন। নাম্বার বের করে সেক্রেটারী লাইনটা পেয়েই বার্মিংহামকে দিয়ে দিল।

বার্মিংহাম বললেন মিস্টার ভ্যান্স, আমি নিউইয়র্ক থেকে রজার বার্মিংহাম বলছি। এখানে মিস

লারার দিকে তাকাল। লারা নামটা বলল–লারা ক্যামেরন।

বার্মিংহাম ফোনে বললেন মিস লারা ক্যামেরন বসে আছেন। উনি এখানকার একটা সম্পত্তি কিনতে আগ্রহী। আপনি ওকে চেনেন নাকি?

রজার বার্মিংহাম বব ভ্যান্সের কথা শুনে গেলেন। এরপর বব ভ্যান্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। এবার ভালোভাবে তাকালেন লারার দিকে। বললেন–আপনি চিকাগোতে বেশ বিখ্যাত দেখছি।

–আমি নিউইয়র্কেও আমার উপস্থিতির ছাপ রাখব। মৃদু হাসল লারা।

বার্মিংহাম একশো ডলারের নোটটার দিকে একবার তাকালেন। বললেন–এটা দিয়ে আমি কী করব?

–আপনি কয়েকটা কিউবান সিগার কিনতে পারবেন। দেখি, এর মধ্যে আপনার সমস্যাটা সমাধান করা যায় কিনা।

বার্মিংহাম ওখানে বসে লারার দিকে তাকালেন। বললেন–ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত। ঠিক আছে, আমি আপনাকে আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দিচ্ছি। আপনি ভেবে আমাকে বলবেন।

লারা ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

.

লারা হাওয়ার্ডকে বলল–এবার একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে পুরো ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে।

লারা এখন খুবই গম্ভীর হয়ে উঠছে। সে জানে, অনেকগুলো সমস্যা সমাধান করার পর তবে হাসপাতালের স্বপ্নটা সফল হবে।

–সব মিলিয়ে কত লাগবে ভেবে দেখেছো?

লারা জবাব দিল-সম্পত্তি বাবদ নব্বই মিলিয়ন ডলার। এরপর আরো দুশো মিলিয়ান ডলার খরচ হবে হাসপাতাল ভাঙতে এবং তার ওপর বাড়ি তৈরী করতে।

হাওয়ার্ড লারার দিকে তাকাল–তাহলে মোট দুশো নব্বই মিলিয়ন ডলার, ঠিক তো?

লারা বলল–ঠিকই বলেছে।

হাওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করল–টাকাটা কোথা থেকে আসবে?

লারা বলল–আমরা ধরে নেব, চিকাগোতে যারা আমাদের সহযোগী সংস্থা, তাদের কাছ থেকে। ব্যাপারটা খুব একটা সমস্যা হবে না।

–কিন্তু এটা খুব ঝুঁকির বিষয়, সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো লারা?

–এতেই তো আমার উত্তেজনা। জুয়ায় জেতার মতো আনন্দ অন্য কিছুতে আছে কি?

হাওয়ার্ড কিছু না বলে চোখ দুটো বন্ধ করল। বেচারী, বেশী দূর ভাবনাচিন্তা করতে সে মোটেই পারে না।

চিকাগোর থেকে নিউইয়র্কে অনেকগুলো রাস্তা বেশী আছে। এখানে যে কোনো বাড়ি তৈরী করার জন্য সহজেই টাকার সংস্থান হয়ে যায়। নিউইয়র্কে নিয়মকানুন খুব একটা জটিল নয়। লারার কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করে ব্যাঙ্ক খুবই খুশী হল। আটচল্লিশ ঘন্টার আগেই লারা ক্যামেরনের লোন একরকম পাশ হয়ে গেল। সবটাই হাতে পেয়ে গেল সে। লারা এসে হাজির হল রজার বার্মিংহামের অফিসে। তারপর ওর হাতে তিন মিলিয়ান ডলারের একটা চেক তুলে দিল।

লারা বলল–এটা ব্যবসায়িক চুক্তির অগ্রিম পেমেন্ট। আমি আপনার দামটা দিতে পারব। এছাড়া আপনি একশো ডলার রাখতে পারেন।

রজার বার্মিংহাম ভাবতে পারেন নি, লারা এত তাড়াতাড়ি কাজটা করে ফেলতে পারবে।

পরের ছমাস ধরে হাওয়ার্ড কেলার ব্যাঙ্কের যাবতীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আর্কিটেক্টের সঙ্গে বিল্ডিং-এর প্ল্যানের ব্যাপারেও কথাবার্তা হল। এপ্রিল মাস নাগাদ কাজ আরম্ভ হল। লারা তখন ক্রমশ আরো উত্তেজিত হয়ে উঠছে। রোজ সকাল ছটায় উঠে লারা সাইটে পৌঁছে যায়। সকলের কাজকর্ম ভালোভাবে লক্ষ্য করে। প্রথম পর্যায়টা ওর খুবই খারাপ লাগে। এই পর্যায়ে ওর বিশেষ কিছু করার নেই। লারার ইচ্ছে একসঙ্গে গোটা ছয়েক প্রোজেক্ট হাতে নিয়ে এগোতে।

লারা একদিন হাওয়ার্ড কেলারকে বলল–শোনো, আমরা অন্য কোনো ব্যবসায় মন দিতে পারি না?

–তা সম্ভব নয়। এই ব্যাপারটায় নজর রাখতে হবে। গোলমাল দেখা দিলে তা আমরা সামলাতে পারব না।

থেমে গেল হাওয়ার্ড কেলার। লারা ওর দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি মিছিমিছি চিন্তা করছে। কোনটা তোমাকে ভাবাচ্ছে?

–আমাকে ভাবাচ্ছে সেভিংস আর লোন কোম্পানীর সঙ্গে সই করা চুক্তিগুলো।

–কেন আমরা তো টাকা হাতে পেয়েছি।

হাওয়ার্ড বলল–আসলে শেষের দিকের শর্তটা আমার ভালো লাগছে না। পনেরোই মার্চের মধ্যে শেষ না হলে, সব ওদের হাতে চলে যাবে। তখন আমরা সব কিছু হারাব।

গ্রেস বের কথা মনে পড়ে গেল লারার। ওখানে একই রকম সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বন্ধুরা সহযোগিতার হাত না বাড়ালে লারা আজ এইখানে এসে পৌঁছছাতে পারত না। তবে এখানকার ব্যাপারটা একদম আলাদা। এখানে অত ঝঞ্জাট ঝামেলা নেই। কেউ বসে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে না।

লারা মৃদু হেসে বলল–অত ভাববার কিছু নেই। নির্দিষ্ট তারিখের আগে বাড়ি বানানোর কাজ শেষ হয়ে যাবে। এখন অন্য একটা প্রোজেক্ট নিয়ে আমরা অনায়াসে মাথা ঘামাতে পারব।

লারা আর হাওয়ার্ড পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে মনে হল, তার বোধহয় দুই মেরুর বাসিন্দা।

ম্যানেজারের সঙ্গে লারা দেখা করা শুরু করল। মার্কেটিং ম্যানেজার লারার কথার জবাবে বলল–নীচের দিকে যে রিটেইল সেন্টারগুলো আছে, সেগুলো সই হয়ে গেছে। অর্ধেকের বেশী কন্ডোনিয়াম নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাড়িটা শেষ হবার আগে তিন-চতুর্থাংশ কিনে ফেলা সম্ভব হবে।

–কিন্তু আমি তো বাড়িটা শেষ হবার আগেই সবটা কিনতে চাই। লারা বলে উঠল।

ঠিক এই সময় হাওয়ার্ড কেল্লার অফিসে ঢুকল। সে লারাকে বলল–তুমি ঠিকই বলেছো লারা, বাড়িটা ঠিক সময়েই শেষ হবে।

লারা বলল–সবটাই অর্থের ব্যাপার। আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমি বুঝতে পারছি, এখানে অর্থের জোগান ঠিক থাকলে কোনো সমস্যা হয় না।

বাড়ির কাজ ঠিক মতো এগোচ্ছে। লারা আর হাওয়ার্ড দুজনেই খুশী। জানুয়ারী মাসের পনেরো তারিখে বাড়ির কাজ অর্ধেক শেষ হয়ে গেল। তখনো কাজ শেষ হতে ষাট দিন বাকি। লারা: চুপচাপ দাঁড়িয়ে শ্রমিক আর কর্মচারীদের কাজকর্ম দেখছিল।

হঠাৎ একদিন একজন শ্রমিকের হাত থেকে একটা রেঞ্জ ছিটকে এসে লারাকে আঘাত করল। পিঠে আঘাত পেল সে। কিছুটা ভয় পেয়ে গেল লারা। আঘাত অবশ্য তেমন গুরুতর কিছু ছিল না। শ্রমিকটি তার কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।

লারা ভাবল, এর মধ্যে কোনো অনিচ্ছাকৃত অপরাধ নেই তো? সে ওই শ্রমিককে আর কাজে রাখল না। অন্যান্য শ্রমিকরা সব দেখল। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হল। তারা লারার কাছে এগোবার সাহস পেল না।

এর পরের দিনটা ছিল সোমবার। সকালে লারা বিল্ডিং সাইটে হাজির হল। ওর মনে হল, কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। চারদিক একদম নিস্তব্ধ। কাজ হবার কোনো চিহ্ন নেই।

সামনে একজন দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করল লারা কী ব্যাপার কাজ বন্ধ কেন? এখন তো সকাল সাতটা।

–আমরা আর কেউ কাজ করব না। লোকটা নিস্পৃহ ভাবে জবাব দিল। আমরা ঠিক করেছি, একটা অভিযোগের জবাবদিহি আপনাকে করতে হবে। 

–কী অভিযোগ? লারার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে।

–আপনি একজন শ্রমিককে অসম্মান করে বরখাস্ত করেছেন।

ব্যাপারটা লারা ভুলেই গিয়েছিল। এখন মনে পড়ে গেল। সে বলল–হ্যাঁ, ও অমনোযাগী হয়ে পড়েছিল। আরো বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারত।

–এই শহরের কোনো শ্রমিকের অসম্মান করার অধিকার আপনার নেই।

লারার মুখটা লাল হয়ে উঠল। লারা বলল–ওর আচরণটা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। আমার ধারণা, ও ইচ্ছে করেই রেঞ্জটা আমার দিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়েছিল। সেইজন্য আমি ওর ওপর রেগে গেছি। তাই আমি ক্ষমা চাইছি। কিন্তু ওকে আমি কাজে ফিরিয়ে নেব না।

ফোরম্যান অর্থাৎ ওই লোকটা বলল–ও নিজেই এখানে আর কাজ করবে না বলেছে। আমরাও করব না।

–এটা কি চালাকি নাকি? যখন যা খুশী করা যায়?

–আমাদের ইউনিয়ান চায় না, আপনার কাজ করতে। ইউনিয়ানের সকলের সঙ্গে কথা বলেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

লোকটা একপা-একপা করে পেছন দিকে পেছোতে লাগল। লারা ওকে ডেকে বলল, দেখ, আমি আমার কাজের জন্য দুঃখিত। ওকে কাজে ফিরিয়ে নিচ্ছি। তোমরা কাজে যোগ দাও।

ফোরম্যান লারার দিকে তাকিয়ে বলল–মিস ক্যামেরন, আপনি আবার ভুল করছেন। ও এখানে কোনোদিন কাজ করবে না। মনে রাখবেন, নিউইয়র্ক খুব ব্যস্ত শহর। এখানে কাজের কোনো অভাব নেই। চলি, নমস্কার।

লোকটা চলে গেল। লারা নিশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। এমন একটা সমস্যা যে হতে পারে সে ভাবতেই পারেনি। সেখান থেকে দ্রুত চলে এল লারা। হাওয়ার্ড কেলারকে খবরটা দিতে হবে।

হাওয়ার্ড বলল–আমি শুনেছি, ইউনিয়ানের সঙ্গে এই ব্যাপারে ফোনে কথা হয়েছে।

–ওরা কী বলল? লারা জানতে চাইল।

–পরের মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর ওরা আলোচনায় বসবে। শুনে লারা আরো অবাক হয়ে গেল। সে বলল–পরের মাস? আর দুটো মাস মাত্র সময় আছে। বাড়িটাও শেষ হয়নি।

–ও ব্যাপারটা আমি ওদের বলেছি।

–কী বলল ওরা?

–ওরা বলল, এই সমস্যাটা ওদর নয়। লারার মনে হল, সে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল–এখন তা হলে আমরা কী করব?

হাওয়ার্ডের সমস্ত মুখে তখন আশঙ্কার আনাগোনা। সে বলল–তা তো জানি না। কিছুক্ষণ চিন্তা করল লারা, তারপর বলল–হাওয়ার্ড, আমি একটা উপায় বের করেছি।

–কী?

–অন্য কোনো কোম্পানীর লোক দিয়ে কাজটা শেষ করব।

–লারা, তুমি এখানকার নিয়ম নীতি জানো না। ইউনিয়ান খুব শক্তিশালী। কেউই কাজে হাত দেবে না।

লারা এবার বলে উঠল–আমার কাজ যদি শেষ না হয়, তাহলে ওই লোকটাকে আমি একেবারে শেষ করে দেব।

–তাহলে হয়তো কিছু একটা হতে পারে।

লারা অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। সে বলে উঠল–আমি লোকটাকে গুলি করে মারব।

–কেন?

–এসব আমি পরোয়া করি না। লারা বলল।

–তাহলে একটা ভালো উকিল রাখতে হবে। হাওয়ার্ড অনুরোধ করল।

–তুমি কাউকে চেনো?

–না, আমি কাউকে চিনি না। তবে শ্যাম গসটেন বলে যে অ্যাটর্নির সঙ্গে তুমি

কথা বলছিলে, সেখানে আরো একজন ছিল। তার নাম পল মার্টিন। শুনেছি উকিল হিসাবে ওর নাম আছে। ইউনিয়ানের ব্যাপারগুলো ও নিজেই দেখাশুনা করে।

–ওর ফার্ম কোথায়?

–জানি না। 

লারা এবার তার সেক্রটারীকে ডাকল। বলল–শোনো ক্যাথি, ম্যানহাটনে একজন উকিল আছে তার নাম পল মার্টিন। তার ঠিকানা বের করো।

হাওয়ার্ড বলল–তার আগে ওর ফোন নাম্বারটা দাও। আগে থেকে অ্যাপয়মেন্ট করতে হবে।

–অত সময় নেই। আজই ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে। দেখা যাক, ও আমাদের সাহায্য করতে পারে কিনা। যদি না পারে তা হলে অন্য কিছু ভাবব।

লারা তখন একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছে। যে করেই হোক সুড়ঙ্গ থেকে তাকে বেরোতে হবে।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়

ওয়াল স্ট্রিটের একটি অফিস বিল্ডিং-এর পঁচিশ তলায় পল মার্টিনের অফিস। ঘরটা ছোটো, তবে সুন্দর করে সাজানো। পল মার্টিনের বয়স ষাটের কাছাকাছি। মাথার চুল সাদা। মুখে বেশ কিছু রেখার সমষ্টি। নাকটা ছুঁচলো। পরনে পুরোনো আমলের পোশাক। পল মার্টিন বললেন–বলুন কী করতে পারি?

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে লারা বলল–আমার নাম লারা ক্যামেরন। রিয়েল এস্টেট ডেভলপার। আমার একটা বিল্ডিং তৈরী হচ্ছিল। ইউনিয়নের সঙ্গে একটা গোলমালের জন্য কাজটা বন্ধ হয়ে গেছে।

পল মার্টিন শুনে গেলেন, কিছু বললেন না।

লারা আবার বলল–আসলে একটা শ্রমিকের আচরণে আমি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাকে বরখাস্ত করে দিই। ইউনিয়ান ধর্মঘট ডেকে বসে।

পল মার্টিন বললেন–এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?

–শুনেছি, আপনি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারেন।

ঠোঁট উল্টে নিস্পৃহভাবে পল মার্টিন বললেন–আপনি ভুল শুনেছেন। আমি করপোরেট অ্যাটর্নি। বিল্ডিং বা ইউনিয়নের ব্যাপারে আমি কোনো সাহায্য করতে পারি না।

লারার মুখটা শুকিয়ে গেল। সে বলল–আপনি কি কোনো ভাবেই সাহায্য করতে পারেন না, মিস্টার মার্টিন?

–আমি বরং আপনাকে কয়েকটা পরামর্শ দিচ্ছি, এক কাজ করুন, আপনি একজন লেবার লইয়ারকে ধরুন। সে যাতে ইউনিয়নকে কোর্টে নিয়ে যায়। তার ব্যবস্থা করুন।

–কিন্তু আমাদের অত সময় নেই। আমরা একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে গেছি। যাই হোক, এছাড়া আর কী করতে পারি।

হঠাৎ লারার মনে হল পল মার্টিন একদৃষ্টে তার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। পল মার্টিন বললেন–আর একটা কথা বলি মিস ক্যামেরন। বিল্ডিং-এর কাজ মেয়েদের জন্য নয়। আপনি বরং এধরনের ব্যবসা ছেড়ে দিন।

লারা এবার গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল তাহলে মেয়েদের ব্যবসা কী ধরনের হওয়া উচিত? সব সময় খালি পায়ে থাকা আর সন্তান প্রসব করা, রান্না ঘরে কাটানো?

–ঠিকই বলেছেন আপনি, ওগুলোই মহিলাদের নিজস্ব কাজ। পল মার্টিন বললেন।

লারা উঠে দাঁড়াল, যেভাবেই হোক নিজের রাগকে সংযত করতে হবে।

সে বলল–মিস্টার মার্টিন, আপনি বোধহয় এখনো ডায়নোসোরের যুগে পড়ে আছেন। আপনি বোধহয় জানেন না যে, নারীরা এখন স্বাধীন।

পল মার্টিন বললেন,–না, আমি জানি না।

–ধন্যবাদ, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। চলি। লারা চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এক নিঃশ্বাসে এলিভেটরে চড়ে রাস্তায় এল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস আবার বেরিয়ে এল ওর বুকের গভীর থেকে। এখন একটা সুতোর ওপর ঝুলছে তার ভবিষ্যৎ। সে একেবারে খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে। অনেক ঝুঁকি অতিক্রম করে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এই সমস্যার কোনো সমাধান আছে কি?

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে লারা হাঁটছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। তার মানে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হবে। লারা নিজের ভাবনাতে এত ব্যস্ত ছিল যে, বৃষ্টির কথা তার খেয়াল ছিল না। হঠাৎ যেন ম্যাজিকের মতো বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। আকাশ প্রায় পরিষ্কার। লারা আকাশের দিকে তাকাল। না, কুয়াশার আস্তরণ ঢেকে রেখেছে সমস্ত আকাশকে। রোদ্দুর একদম ম্লান, আচ্ছন্নের মতো লারা হাঁটতে লাগল। হঠাৎ তার কানে গেল যন্ত্রপাতির শব্দ। ও অবাক হয়ে ভাবল, কোথায় কাজ হচ্ছে? তারপর যেদিক থেকে শব্দ আসছে, সেদিকে ছুটতে শুরু করল। সাইটের কাছে এসে থেমে গেল ও। নিজের চোখকে বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছে না। পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেছে। শ্রমিক আর কর্মচারীতে জায়গাটা ভরে গেছে। ফোরম্যান ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, গুড মর্নিং মিস ক্যামেরন।

লারা বলল–আমি তো ভেবেছিলাম, আপনারা কাজ করছেন না।

ফোরম্যান বলল–সামান্য একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। বুনো অর্থাৎ ওই শ্রমিকটার এইভাবে রেঞ্জটা ফেলা উচিত হয়নি। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলে আপনি সাংঘাতিক জখম হতেন। এমন কী মারাও যেতেন হয়তো।

লারা বলল–কিন্তু?

–ভাববেন না, ও চলে গেছে। আর কখনো এরকম ঘটনা ঘটবে না। কাজও ঠিক সময়ে আমরা শেষ করব।

লারার মনে হল, ও যেন দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, ওর মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ পল মার্টিনের মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

অফিসে গিয়েই সে পল মার্টিনকে ফোন করল। কিন্তু পাওয়া গেল না। বিকেল তিনটের সময় আবার পলকে ফোন করল। সেবারেও পাওয়া গেল না। বিকেল পাঁচটার সময় সে নিজেই হাজির হল পল মার্টিনের চেম্বারে। এবার পলের দেখা পেল।..

চেম্বারে ঢুকে লারা বলল–আমি দুবার ফোন করেছিলাম।

–আমি ছিলাম না। বলুন মিস ক্যামেরন, কী করতে পারি?

–আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি।

–কেন বলুন তো?

–ইউনিয়ানের ঝামেলাটা মিটে গেছে।

–তাতে আমার কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। পল বললেন।

লারা বলল–আবার সবাই ঠিক মতো কাজে যোগ দিয়েছে। আশা করছি, ঠিক সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ হয়ে যাবে।

পল বললেন–অভিনন্দন।

লারা বলল–আপনি যদি আপনার প্রাপ্য বিলটা পাঠিয়ে দেন তাহলে–

–মিস ক্যামেরন, আমার মনে হচ্ছে, কোথাও একটা বিভ্রান্তি ঘটেছে। আপনার সমস্যা মিটেছে বলে আমি খুবই খুশী। এর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।

লারা বলল–ঠিক আছে, আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।

–ঠিক আছে।

লারা চলে গেল। একটু বাদে পলের সেক্রেটারী তার অফিসে ঢুকে বলল–স্যার, মিস ক্যামেরন এই প্যাকেটটা আপনার জন্য রেখে গেছেন।

–কৌতূহলী হয়ে প্যাকেটটা হাতে তুলে নিলেন পল মার্টিন। ছোটো একটি প্যাকেট লাল রিবন দিয়ে বাঁধা। প্যাকেটটা খুললেন তিনি। ভেতরে রুপোর তৈরী সশস্ত্র যোদ্ধা, পুরোনো আমলের। তার মানে, পলকে পুরোনো পন্থী মনে করেছে ওই মেয়েটি। লারার নাম তিনি আগে শুনেছিলেন। কিন্তু মেয়েটি যে এত কম বয়সী, সেটা তার ধারণার মধ্যে ছিল না। শুধু তাই নয়, পল দেখামাত্র আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন। তবে প্রেম করার পথে ওনার বয়সটা অনেক বেশী। লারা কথা বলে বেরিয়ে যাবার পর অনেকক্ষণ একলা বসে ভেবেছিলেন পল মার্টিন। লারার সম্পর্কে চিন্তা করছিলেন। তারপর তুলে নিয়েছিলেন রিসিভারটা। এখন সেটা মনে করতেই তিনি মৃদু হাসলেন।

.

তৃতীয় অধ্যায়

নতুন বাড়িটার কাজ ঠিকমতো এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেকদিন সকালে লারা নিয়ম করে সেখানে যায়। সেখানকার সকলের ব্যবহারে কেমন একটা পরিবর্তন এসেছে। সকলেই ঠিকভাবে কাজটা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

লারা মনে মনে ভাবে পল মার্টিনের জন্যই এসব সম্ভব হয়েছে। পল মার্টিনকে আরো একবার আমন্ত্রণ জানাবে সে।

একদিন সে পল মার্টিনকে ফোন করল। তাকে পাওয়া গেল। ভরাট গলা শোনা গেল কী ব্যাপার মিস ক্যামেরন? কাজ কেমন হচ্ছে?

–ভালোই, আজ সন্ধ্যাবেলায় কি আপনি ফ্রি আছেন? একসঙ্গে ডিনার করলে কেমন হয়?

পলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–শুনুন মিস ক্যামেরন, আমি বিবাহিত, স্ত্রী আর ছেলেদের সঙ্গেই ডিনার খেতে বেশী পছন্দ করি।

এই ধরনের কথা শুনতে হবে লারা কখনো তা ভাবেনি। সমস্ত পুরুকে সে এ পর্যন্ত নাচিয়ে এসেছে। তবে কি পলের কাছে হার স্বীকার করতে হবে? ফোনটা কেটে গেল। একরাশ অভিমান এসে গ্রাস করল লারাকে।

পল ভেতরে গিয়ে সেক্রেটারীকে বলল–শোনো, মিস ক্যামেরন যদি আবার ফোন করে, তাহলে বলবে আমি নেই।

সেক্রেটারী বলল ঠিক আছে, স্যার।

পল মার্টিন এ বয়সে নতুন করে ঝামেলাতে জড়াতে চায় না। লারা ক্যামেরন এখন তার কাছে বিপদের আগুন শিখা।

বিছানাতে শুয়ে আছে লারা। হাতে একটা ম্যাগাজিন।

হাওয়ার্ড ঘরে ঢুকে বলল কী করে ইউনিয়ানকে হাতের মুঠোয় করে ফেললে বলল তো? মনে হচ্ছে, তুমি বুঝি এক স্বপ্নের জাদুকরী।

হাওয়ার্ড থেমে গেল। লারা হেসে উঠল। মুখে কিছু বলল না। আবার পল মার্টিনের উদ্দেশ্যে হৃদয় ভরা বার্তা পাঠাবে। তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। না, পলকে তার প্রাপ্যটা

পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। হাওয়ার্ডের হাতে একটা চেক দিয়ে বলল–হাওয়ার্ড পঞ্চাশ হাজার ডলারের এই চেকটি তুমি পল মার্টিনের কাছে পাঠিয়ে দিও। কেমন?

হাওয়ার্ড চলে গেল। পরের দিন চেকটা ফেরত চলে এল। সঙ্গে নোট। লারা অবাক হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, প্রাপ্য অর্থ না পাওয়ায় পল বুঝি রেগে গেছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল। সে পলকে ফোন করল।

সেক্রেটারী পোষাপাখির মতো বলল–পল অফিসে নেই।

লারা ভাবতে পারছে না। পল কী চাইছেন? ষাট বছর বয়সী ওই মানুষটির কী পছন্দ? কেনই বা এতটা উপকার করলেন? সেদিন রাতে লারা স্বপ্ন দেখল পল মার্টিনকে। পরের দিন হাওয়ার্ড কেলার দুটো টিকিট নিয়ে এসেছে। চিকাগোর বিখ্যাত গায়কের গান ও নাচের অনুষ্ঠান।

হাওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করল–তুমি কি যাবে?

–তুমি বরং আমাকে টিকিট দুটো দাও। দেখি কী করতে পারি।

হাওয়ার্ড দুখানা টিকিট তাকে দিল। লারা তার মধ্যে একটা টিকিট হাওয়ার্ডের হাতে দিয়ে বলল–নাও, এখনই পল মার্টিনের কাছে দিয়ে এসো।

–ঠিক আছে।

হাওয়ার্ড কেলার চলে গেল। লারা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। লারা জানে, পল মার্টিন এ আমন্ত্রণ রাখবেন না।

পরের দিন টিকিটটা হাতে পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন পল মার্টিন। কেমন একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছেন তিনি। মেয়েটাকে ঠিক মতো বুঝতে পারছেন না। সেক্রেটারীকে জিজ্ঞাসা করলেন–আমি কি শুক্রবার সন্ধ্যাবেলা ফ্রি আছি?

–আপনার জামাইয়ের সঙ্গে একটা ডিনার আছে।

–ওটা বাতিল করে দাও।

এই কথা শুনে সেক্রেটারী খুবই অবাক হল। এর আগে বসকে এমন আচরণ করতে দেখেনি সে।

সে বলল–ঠিক আছে স্যার।

এই মুহূর্তে পলকে দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল সেক্রেটারীর। পল তখন দুটো চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। দেখলেই বোঝা যায়, গভীর চিন্তায় তিনি মগ্ন।

.

লারা থিয়েটার হলের সিটে বসেছিল। পাশের সিটটা তখনো ফাঁকা আছে। পল তাহলে এলেন না? ওনার কথা ভেবে লাভ নেই, আধ ঘণ্টা অনুষ্ঠানটা মন দিয়ে দেখল লারা। তারপর আর ভালো লাগছে না। উঠবে কিনা ভাবছে, এমন সময় কে যেন পাশের সিটে এসে বসলেন। অন্ধকারে লারা ঠিক বুঝতে পারল না। কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–এখান থেকে চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

লারা রীতিমতো অবাক হয়েছে। এই প্রথম পল মার্টিন কথা রেখেছেন।

তারা শহরের পূর্ব প্রান্তের একটা রেস্তোরাঁতে গেলেন। লারা স্কচের অর্ডার দিল।

কিন্তু পল কিছুতেই পান করবেন না। তিনি বারবার বললেন, আমি ড্রিঙ্ক করি না।

ডিনার প্লেট এল। পল মার্টিন ছুরিটা একবার ঠেকালেন। তারপর বললেন–মিস। ক্যামেরন, সত্যি সত্যি বলুন তো, আপনি আমার থেকে কী চাইছেন?

লারা বলল–আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে রাজি নই। আপনি আপনার প্রাপ্য অর্থ ফেরত পাঠিয়েছেন, তা আমার খুবই খারাপ লেগেছে।

–আমি তো আগেই বলেছি, আপনার জন্য আমি কিছুই করিনি। তাহলে টাকা নেব কেন?

–কিন্তু, লারা বলল।

–আপনার বিল্ডিং-এর কাজ ভালো চলছে তা আমি শুনেছি।

–হ্যাঁ।

পলকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে চুপ করল লারা।

পল বললেন মিস ক্যামেরন আপনি সত্যি খুব সুন্দরী।

–হ্যাঁ, এর পাশাপাশি আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি। আমি মনুমেন্ট তৈরি করতে চাই। আমার জীবনের একমাত্র ইচ্ছে, সবাই যেন আমার নাম মনে রাখে। কতগুলো প্রাণহীন বাড়ি তৈরি করার স্বপ্ন আমার নেই। বাড়ি তৈরি করাটা আমার আদর্শ। এসবের মধ্যে দিয়ে আমি ইতিহাস হয়ে থাকবো।

লারা আবার বলল–আমি নিউইয়র্কের সব থেকে বিখ্যাত রিয়েল এস্টেট ডেভলপার হতে চাই।

লারার কথা বলার মধ্যে তার সরলতা প্রকাশ পাচ্ছে।

পল মার্টিন মৃদু হাসলেন। বললেন–আপনি বিখ্যাত হলে আমি কিন্তু মোটেই অবাক হবে না।

লারা জিজ্ঞাসা করল–আপনি শেষ পর্যন্ত আমার ডাকে সাড়া দিলেন কেন?

পল ভাবলেন–এখানে সত্যি বলা উচিত। কিন্তু সত্যি কথাটা তার মুখ দিয়ে বেরোল না। শেষ পর্যন্ত আমতা আমতা করে বললেন–অনুষ্ঠানটা খুবই ভালো হবে শুনেছিলাম।

লারা বলল ঠিক আছে, চলুন তাহলে আবার আমরা ফিরে যাই।

পল মার্টিন মাথা নাড়লেন। বললেন না, আমি শুধুমাত্র বিবাহিত নই। আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসি। বলতে পারেন একটু বেশীই ভাললাবাসি। আপনার অনুরোধ আমি রাখতে পারব না।

লারা ম্লান হাসল। |||||||||| –আপনাকে যত দেখছি, ততই ভালো লাগছে। ঠিক আছে, পনেরোই মার্চ বাড়ি তৈরি শেষ হয়ে যাবে। তারপর আমরা একটা পার্টি দেব। আপনি আসবেন তো?

অনেকক্ষণ কী যেন ভাবলেন পল মার্টিন। কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। শান্ত গলায় বললেন–ঠিক আছে, আসব।

লারা আর পল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।

.

নতুন বাড়িটার উদ্বোধন অনুষ্ঠান। বিরাট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। শহরের গণ্যমান্য মানুষেরা সেই পার্টিতে হাজির হয়েছে। প্রেসের লোকরা যথারীতি এসে গেছে।

হাওয়ার্ড কেলার এসে বলল–লারা লোকজন সবাই এসে গেছে।

লারা তখন বিশেষ একজনকে খুঁজছিল। তিনি হচ্ছেন পল মার্টিন। তখনো পর্যন্ত পল মার্টিন এসে পৌঁছায়নি।

লারা অতিথিদের সম্ভাষণ করছে। প্রত্যেকের হাতে পানীয়ের বোতল। অনুষ্ঠান প্রায় মাঝপথে, লারা বুঝতে পারল, পল আসবেন না। তখনই পল হাজির হলেন। পল আসার সঙ্গে সঙ্গে পার্টির মেজাজ একেবারে বদলে গেল। সকলেই পলের সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহী। দেখা গেল, অতিথিদের বেশীর ভাগই পলের অনুরাগী। ইউনিয়নের নেতা থেকে শ্রমিক কর্মচারী সকলে। লারা আশ্চর্য হয়ে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল পলের একটা কথা।

–মিস ক্যামেরন আমি করপোরেট অ্যাটর্নি। ইউনিয়নের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক

লারা ক্রমশ জটিলতার আবর্তে পড়ে যাচ্ছে। পল মার্টিন তখন মেয়রের এক সহযোগীর সঙ্গে করমর্দন করছে। কাছেই দাঁড়িয়েছিল ইউনিয়ানের কিছু কর্তাব্যক্তি। সবশেষে লারার। কাছে এসে হাজির হলেন পল।

লারা মৃদু হেসে বলল–আপনি এসেছেন, আমি খুবই খুশী হয়েছি।

পল মার্টিন বিরাট বিল্ডিংটায় চোখ বুলিয়ে বললেন–অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনি একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।

–ধন্যবাদ। কিন্তু এই ধন্যবাদের কিছুটা আপনারও প্রাপ্য পল।

লারাকে ভীষণ সুন্দরী আর যৌন আবেদনময়ী লাগছে। আরো মোহিনী হয়ে উঠেছে সে। আরো আকর্ষণীয়া, আরো যৌবনবতী।

পল মার্টিন একবার তাকাল ওর দিকে।

লারা হেসে বলল–পার্টি এবার শেষের মুখে। চলুন আমরা একসঙ্গে ডিনার করি।

পল আবার বললেন–আমি তো আগেই বলেছি, আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সঙ্গে ডিনার করতে আমি অভ্যস্ত। ঠিক আছে। আজ দুজনে একান্তে বসে ড্রিঙ্ক করব, কেমন?

লারা মৃদু হেসে বলল–বেশ তো তাই হবে।

পল এখনো লারার কাছে এক উজ্জ্বল দীপশিখা।

.

শেষ পর্যন্ত অনেক অনুরোধে পল ঘরটাকে দেখে প্রশংসা করে বললেন–বাঃ, তোমার ঘরটা তো বেশ চমৎকার। তোমার ছোটোবেলার কথা তুমি কি কিছু বলবে আমাকে?

পলের অনুরোধ লারা রাখল। লারা প্রথম থেকে সব কিছু বলে গেল। শুধুমাত্র সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল, সেটা গোপন রাখল। জীবনের সব কথা সকলের কাছে বলা যায় কি? সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের বয়স তখন ছিল ষাট বছর। পল মার্টিনের বয়সও ষাট হয়েছে। অথচ দুজনে যেন দুই. পৃথিবীর বাসিন্দা। ম্যাক অ্যালিস্টারের নজর ছিল লারার সুন্দর দেহটার ওপর। আর পল লারার শরীরের দিকে নজর দিচ্ছেন না। এটাই পলের চরিত্রের সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য।

লারা এবার জড়িয়ে ধরল পলকে। বলল–পল, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

–আমি তোমার বাবার মতো লারা।

–মোটেই না। তোমার দেহটা কত সুন্দর আর সুগঠিত। মেয়েদের চোখে তুমি কত আকর্ষণীয় তা তুমি জানো কি?

লারার এই কথা শুনে পল হেসে উঠলেন। বললেন–তুমি মিথ্যে প্রশংসা করছে। এক সময় আমার শরীর সুগঠিত ছিল। কিন্তু এখনও কি তা আছে?

লারা আগে থেকেই নিজের পোশাক খুলে ফেলেছিল। এবার পলের পোশাক একটা একটা করে খুলে ফেলল। দুই অসম বয়সী নারী পুরুষের হৃদয়ে তখন সমুদ্রের জোয়ার লেগেছে। নিজের স্ত্রীর কাছে পল মার্টিন এত সুখ পাননি।

লারা তার কামনার পুরুষকে উজাড় করে দিল সব কিছু। যখন সব কিছু শেষ হল তখন দুজনেই ফিরে এল বাস্তব পৃথিবীতে। পল পোশাক পরে নিলেন। বললেন লারা, শহরের পশ্চিমদিকে একটা জমি বিক্রি আছে। জমির মালিক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

–ঠিক আছে। আমি দেখে আসব।

লারা পোশাক পরে নিল। পরম আবেশে পলকে চুমু খেলেন। বললেন–আবার দেখা করবে তো?

–করব।

বিদায় নিলেন পল মার্টিন। কিছুক্ষণ পর হাজির হলেন হাওয়ার্ড কেলার। পলের জমির কথাটা শুনে হাওয়ার্ড বলল–লারা তোমাকে একটা কথা বলব।

–কী কথা?

–পল মার্টিনের থেকে দূরে থাকাই ভালো। লোকটা একটা মাফিয়া। ওর পূর্ব পুরুষ সিসিলির লোক। ও নিজে ওখানে ছিল।

লারা নিস্পৃহভাবে বলল–ওর মধ্যে মাফিয়ার কোনো পরিচয় এখনো পর্যন্ত আমি পাইনি। ওকে আমার হিতাকাঙ্খী বন্ধু বলেই মনে হয়েছে। তুমি কি সাইটটা দেখতে যাবে? 

–যাব। সাইটটা খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে।

–ওটা কিনে ফেলতে হবে।

দশদিনের মধ্যেই চুক্তিপত্র সম্পাদিত হল। উপহারস্বরূপ লারা পল মার্টিনকে একটা ফুলের তোড়া পাঠিয়ে দিল।

.

১৯৮০ সালে রোনাল্ড রেগন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। ইরানের শাহর জীবনবসান হল। আমেরিকার ব্যবসাকেন্দ্র ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম সান্ড্রা ডে কনোর নামে মহিলা সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হলেন। ইতিমধ্যে লারার ব্যবসা আরো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তারা একটির পর একটি জমি কিনছেন আর নতুন করে বাড়ি তৈরি করেছেন।

আর্কিটেক্টরের সঙ্গে আলোচনা হল। লারা বলল–আপনি হোটেল কাম রেস্টুরেন্টের ডিজাইন করুন, যা আর কারোর নেই। সবাই যেন নতুন এই হোটেলে থাকার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

আর্কিটেক্ট ভদ্রলোক খুব খুশী হল লারার কথা শুনে। সে বলল–বেশ তাই হবে। আমি কথা দিচ্ছি, আপনার এই হোটেল শহরের সেরা হোটেলে পরিণত হবে।

লারা বলল–তাড়াতাড়ি করুন। আমার কোনো ব্যাপারে বেশী দেরি সয় না। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলটা তৈরি করতে।

আর্কিটেক্ট চলে গেল। লারা হাওয়ার্ডকে জিজ্ঞাসা করল–কী রকম লাগছে?

হাওয়ার্ড বলল–চমৎকার বস।

ওর মুখে সর্বপ্রথম বস শব্দটা শুনল লারা। শুনে খুশী হল।

পরের দিন চালর্স খুবই খুশী হয়ে বলল–তুমি আরো সফল হও, এই কামনা করি।

লারা বলল–এই তো সবে শুরু। সামান্য ভাবল। তারপর আবার বলল–চার্লস, তুমি কি আমার ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজে যোগ দেবে? আমি তোমাকে কোম্পানির একটা বড়ো অংশ দেব।

চার্লস বলল–না, তোমাকে এজন্য ধন্যবাদ। তুমি তো সবেমাত্র শুরু করেছে, এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে।

এই কথা শুনে লারা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল–ঠিক আছে, কিন্তু তোমার সঙ্গ আমি হারাতে চাই না। তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো, কেমন?

–বেশ তো।

লারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লারা বুঝতে পারল, তার জীবনটা আবার একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

.

তৃতীয়বার পল মার্টিন এলেন লারার কাছে। লারা পলের হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন–তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, ডার্লিং।

খুলে দেখলেন পল। ভেতরে একডজন দামী শার্ট আর একডজন দামী টাই।

পল হেসে উঠলেন–এসব আমার অনেক আছে।

–এগুলো তার থেকে আলাদা। তুমি এগুলো পরলে একলাফে তোমার বয়স অনেকটা কমে যাবে।

হেসে উঠলেন লারা। এর পরের ঘটনা দ্রুতবেগে ঘটতে থাকল।

লারার ইচ্ছেমতো পল মার্টিন আপাদমস্তক যুবক হয়ে গেলেন। শুরু হল উত্তেজনাময় একটা রোমান্টিক জীবন। পলের জীবনের নিস্তরঙ্গ ভাবটা এক নিমেষে কেটে গেল। পলের স্ত্রী স্বামীর এই পরিবর্তনটা দেখতে পেলেন না। এদিকে লারার হোটেল তৈরির পরিকল্পনা তখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। তারা আর দুবছর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। কেলার এবং আরো ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে লারা তার মনের ইচ্ছাটা জানিয়ে দিল। বড়ো জোর এক বছরের মধ্যে কাজটা শেষ করতে হবে। সুযোগ যখন এসেছে, তখন তাকে মুঠোবন্দী করাটাই দরকার।

.

চতুর্থ অধ্যায়

শেষ পর্যন্ত লারা পল মার্টিনকে তার হোটেল তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিল। হাওয়ার্ডকে নিয়ে একটা কমিটি মিটিংও করা হল।

পল সব শুনে বললেন সবই তো বলেছে। কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত বিপদজ্জনক না হয়ে দাঁড়ায়।

লারা বলল–কেন? এরকম কথা কেন বলছো? যাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছি, তারা তো সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করবে বলেছে।

পল খুব শান্তভাবে বললেন–শোনো লারা, যে কোনো কোম্পানি তোমাকে এরকম আশ্বাস দিতে পারে। কিন্তু পরে সমস্যা দেখা দেয়।

লারা মৃদু হেসে বলল–আমি মস্ত বড়ো কিছু একটা করতে চাইছি। নিউইয়র্কে আমি সব থেকে বেশী বাড়ি বানাতে চাই। সব থেকে উঁচু বাড়িটা আমি তৈরি কর। আমি এখানে আরামদায়ক হোটেল বানাব। ভবিষ্যতে নিউইয়র্ক হবে আমার নিজস্ব শহর।

পল মার্টিন লারার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন–তারপর বললেন আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি।

লারা মৃদু হাসল সেকথা শুনে।

কয়েকদিনের মধ্যে লারা নিজের অফিসে ব্যবহারের জন্য একটা আনলিস্টেড টেলিফোন কিনে নিল। নাম্বারটা একমাত্র পল মার্টিনকেই দিল। পলের অফিসেও সেরকম একটা ফোন রাখা হল। যাতে তারা দুজনে নিভৃতে কথা বলতে পারে। এবার কথাবার্তা শুরু হল। মাঝে মধ্যে পল বিকেলের দিকে লারার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে হাজির হতেন। লারা এখন পলের কাছে এমন একটা নেশার মতো, যাকে সহজে ছাড়া সম্ভব নয়।

.

ব্যাপারটা হাওয়ার্ড কেলারের কানে পৌঁছোলো।

হাওয়ার্ড বলল, তুমি ভুল করছে। লোকটা কিন্তু মোটেই ভালো নয়। আমি আগে বলেছি, আবারও বলছি, ও কিন্তু খুব বিপজ্জনক।

হাওয়ার্ডের এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করল লারা। লারা বলল–হাওয়ার্ড, তুমি ওকে চেনো না। এত চমৎকার লোক এর আগে আমি কখনো দেখিনি।

হাওয়ার্ড বলল–তুমি কি ওর সঙ্গে প্রেম করছো?

হাওয়ার্ডের এই প্রশ্ন শুনে লারা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একবার ভাবল-সত্যি কথাটা সোজাসুজি জানিয়ে দেবে। কিন্তু সেটা বলা কি উচিত হবে? পল মার্টিন তার জীবনের প্রয়োজনীয় সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে দিয়েছে, একথা সত্যি। কিন্তু পল কি সত্যি সত্যি লারাকে ভালোবাসেন? লারা নিস্পৃহ কণ্ঠস্বরে বলল, না, প্রেম করার মতো অনুভূতি এখনো আমার হয়নি।

–তাহলে ওকি তোমার সঙ্গে প্রেম করছে?

–হতে পারে।

হাওয়ার্ড গম্ভীর হয়ে বললেন–আমি আবার তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, ভেবেচিন্তে কাজ করো। লোকটা কিন্তু সুবিধার নয়।

লারা মৃদু হাসল। উঠে গিয়ে হাওয়ার্ড কেলারের গালে একটা চুমু খেলেন। বললেন–হাওয়ার্ড, তোমার এই সতর্ক করে দেওয়ার ব্যাপারটা আমার খুবই ভালো লাগছে, বিশ্বাস করো।

হাওয়ার্ড হাঁ করে লারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হাওয়ার্ডের চোখে লারা সত্যি এক রহস্যময়ী নারী।

কনস্ট্রাকশন সাইটে গিয়ে লারা রিপোর্ট স্কিমটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিল। পাশেই দাঁড়িয়েছিল পোজেক্ট ম্যানেজার পিট রিড।

লারা বলল রিপোর্ট দেখছি চেরাই কাঠ কিনতে অস্বাভাবিক খরচ করা হয়েছে। এত কাঠ কী হবে?

–মিস ক্যামেরন, আপনাকে আগে বলা হয়নি, আপনি ঠিকই বলেছেন, অসংখ্য কাঠ পাওয়া যাচ্ছে না। সেগুলো দুবার করে অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

রিডের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে লারা মন্তব্য করল–তার মানে কেউ চুরি করেছে?

–মনে হচ্ছে তাই হবে।

–কে এই কাজ করতে পারে বলে মনে হয় আপনার?

–ঠিক বলতে পারছি না।

–রাতের দারোয়ান নেই।

–সে তো কিছু দেখেনি বলছে।

–তাহলে দিনের বেলাতেই ঘটনাটা ঘটেছে।

লারাকে বেশ চিন্তিত দেখাল। সে বলল–আপনি আমাকে জানিয়ে ভালোই করেছেন রিড। আমাদের আরো ভালোভাবে নজর রাখতে হবে।

সেদিন বিকেলে লারা একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিয়োগ করলেন। তার নাম স্টিভ কানে। লারা ওকে সবকিছু বলল। শুনে মিস্টার কানে বললেন দিনের বেলা সবার চোখের সামনে অত কাঠ কীভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব!

–সেটা তো আপনি আমাকে বলবেন।

–আপনি বলছেন, রাতে দারোয়ান থাকে।

–হ্যাঁ।

–অবশ্য এটা হতে পারে। দারোয়ান এ ব্যাপারে জড়িত।

লারা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–দেখুন মিস্টার কানে, ওসব হতে পারে ভাবনা ছেড়ে দিয়ে আপনি আসল দোষীকে সনাক্ত করুন।

–আপনি আমাকে কোম্পানীর একজন কর্মচারী হিসাবে পরিচয় দেবেন।

–আপনি আগে সাইটে যান, আপনার কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।

–ঠিক আছে। স্টিভ কানে বিদায় নিলেন।

পরের দিন স্টিভ গিয়ে হাজির হল সাইটে। হাওয়ার্ড কেলারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করল। কেলার বলল ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখছি।

পাঁচদিন পরের ঘটনা স্টিভ কানে লারার অফিসে এসে হাজির হয়েছে।

লারা জিজ্ঞাসা করল কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল?

–সবটাই আমি জানতে পেরেছি, স্টিভ বলল।

লারা বলল তাহলে রাতের ওই দারোয়ান?

–না, কাঠ আপনার বিল্ডিং সাইট থেকে চুরি যায়নি।

লারা অবাক হয়ে গেল। স্টিভ বলল–আসলে অত কাঠ আসেনি। ওটা অন্য একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জার্নিতে শুধু বিলটা ডবল করে দেখানো হয়েছে। তার মানে খুব কৌশলে কারচুপি করা হয়েছে।

–এর পিছনে কে আছে বলে আপনি মনে করেন?

স্টিভ নামটা ঘোষণা করল। নামটা শুনে লারা সত্যি সত্যি অবাক হয়ে গেল।

.

পরের দিন বিকেলবেলা কমিটির মিটিং ছিল। লারার আইনজীবী টেরি হিল সেখানে ছিলেন। হাওয়ার্ড কেলার, জিন বেলন অর্থাৎ প্রোজেক্ট ম্যানেজার, এবং পিট রিডও ছিল

সেই মিটিং-এ। এছাড়া কনফারেন্স টেবিলে একজন আগন্তুক বসেছিল।

লারা তার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল–উনি হচ্ছেন মিস্টার কনরয়।

সবাই তাকাল ওনার দিকে। মিস্টার কনরয় মৃদু হাসলেন।

লারা বলল–এবার আমরা রিপোর্টটা নিয়ে আলোচনা করব।

পিট রিড বলল–আমরা ঠিক সময়ে শেষ করতে পারব কাজটা। আর চারটে মাস দরকার। আপনি ঠিকই বলেছেন মিস ক্যামেরন, কাজ খুব তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে। এর মধ্যে আমরা ইলেকট্রিক্যাল, কাঠের কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি।

লারা বলল–বাঃ, চমৎকার।

হাওয়ার্ড কেলার জিজ্ঞাসা করল–কাঠ চুরির ব্যাপারে কী জেনেছেন?

–কিছু জানা যায়নি। আমরা চোখ কান খোলা রেখেছি। পিট রিড বলল।

লারা বলল আমার মনে হয় না, আর এ নিয়ে জল ঘোলা হবে। আমরা দু-তিনদিনের মধ্যে চোরকে বের করব।

লারা মিস্টার কনরয়ের দিকে তাকাল। বলল–মিস্টার কনরয়, স্পেশ্যাল ফ্রড স্কোয়াড এর লোক, উনি ডিটেকটিভ।

পিট রিড জিজ্ঞাসা করল–এখানে উনি কী করবেন?

লারা খুব শান্তভাবে বলল উনি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছেন মিস্টার রিড।

–কিছুই তো বুঝতে পারছি না। উঠে দাঁড়াল পিট রিড। ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছিল। লারা বলল মিস্টার রিড, আমাদের কোম্পানির কাঠ অন্য কনস্ট্রাকশন ফার্মকে আপনি বিক্রি করে দিয়েছেন। যখন আমি রিপোর্টটা খুঁটিয়ে দেখেছি, তখনই বুঝতে পেরেছি সবকিছু। আপনি আগে কেন কিছু বলেননি?

পিট রিড বলে উঠল–আমি? আমি? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, মিস ক্যামেরন।

লারা এবার মিঃ কনরয়ের দিকে তাকিয়ে বলল–এবার আপনি ব্যবস্থা করুন।

লারা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল–আসুন, আবার হোটেলের ব্যাপারে আলোচনা করা যাক।

সকলেই অবাক হয়ে গেছে। লারা এত বুদ্ধিমতী এবং কুশলী তা অন্যরা কিছুতেই বুঝতে পারেনি।

.

হোটেল তখন সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। লারার ওপর চাপ বাড়ছে। কেউ যেন ফাঁকি দিতে না পারে সে ব্যাপারে লারা সজাগ। মাঝরাতে লারা ফোন করতে শুরু করল। হাওয়ার্ডকে একদিন মাঝরাতে ফোন করে লারা বলল হাওয়ার্ড, এখনো ওয়ালপেপারের জাহাজ এসে পৌঁছোল না।

–হে ঈশ্বর, তার জন্য তুমি রাত তিনটের সময় ফোন করছো? হাওয়ার্ড ক্লান্ত গলায়, বলল।

–সে কী হাওয়ার্ড, তুমি একথা বলছো। হোটেল খুলতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি, তুমি তা জানো। আমরা তো ওয়ালপেপার ছাড়া খুলতেই পারব না।

–ঠিক আছে, সকাল হোক, তখন দেখা যাবে।

–এখন তো সকাল চারটে বাজতে চলল। এখনই ফোন লাগাও।

–আচ্ছা, দেখছি।

হাওয়ার্ড ফোনটা রেখে দিল। লারাও রিসিভারটা একবার নাড়াচাড়া করে রেখে দিল। যতই সময় এগিয়ে আসছে ততই তার হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ছে।

একদিন সে অ্যাড এজেন্সির প্রধানের সঙ্গে দেখা করল। ভদ্রলোকের নাম টম স্কট। লারা বলল, মিস্টার স্কট আপনার ছোটো ছেলে আছে?

টম অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন–না, কেন বলুন তো?

লারা টমের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে বলল–আমার মাথায় একটা নতুন ধরনের

sms, ভss বিজ্ঞাপন এসেছে। সেখানে একটা বাচ্চার প্রয়োজন। আমার আগের বিজ্ঞাপনটা ঠিক মতো লাগেনি। এতে উত্তেজনার অভাব আছে। আমাদের হোটেল নিউইয়র্কের সব থেকে আধুনিক হতে পারে, বিজ্ঞাপন সেরকম হওয়া দরকার। আপনি কি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন? আপনি ঠিকমতো বিজ্ঞাপন রেডি করতে পারবেন তো?

–পারব মিস ক্যামেরন। আপনি আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন।

–ঠিক আছে, পরের সোমবার আমি একটা নতুন বিজ্ঞাপন দেখতে চাই কেমন?

লারা উঠে পড়ল। মিঃ স্কট অবাক চোখে লারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

.

দেশের সর্বত্র বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়েছে। খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের পাতায় বড়ো বড়ো করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।

টম স্কট হাসি মুখে বলল মনে হচ্ছে একটা বিরাট সাড়া পড়ে যাবে।  

–আপনি ঠিকই বলেছেন।

লারা খুব শান্তভাবে তাকাল টমের দিকে। তারপর বলল আমার ঠিক বলায় কিছু যায় আসে না। আমি চাই, আপনি ঠিক বলবেন। আর সে জন্যই আপনাকে বেতন দেওয়া হয়েছে।

লারা জেরি টাউনসেন্ডের দিকে তাকাল।

–লারা বলল, আমন্ত্ৰণী পত্র সব জায়গাতে পাঠানো হয়েছে তো?

–হ্যাঁ, আমি ইতিমধ্যে অনেকের উত্তর পেয়েছি। উদ্বোধনের দিন প্রায় সবাই আসছেন। বিরাট একটা পার্টির আয়োজন করা হবে।

–হ্যাঁ, হাওয়ার্ড বলল পাশ থেকে অনেক খরচ হবে।

–ব্যাঙ্কারদের মতো কথাবার্তা বলো না হাওয়ার্ড, এজন্য আমরা এক মিলিয়ন ডলার খরচ করব।

হাওয়ার্ড বলে উঠল–ঠিক আছে।

লারা আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। তখন তার মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, নিউইয়র্কের বুকে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হবে।

দুসপ্তাহ বাদে উদ্বোধন হবে। সব কিছুই এখন পর্যন্ত ঠিকমতো চলছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এসে গেছে। ওয়ালপেপার এসে গেছে। বিরাট হলটা সাজানো হয়েছে। লারা দেখল, সব ঠিক-ঠাক আছে কিনা।

কোথায় একটা ইলেকট্রিক্যাল ফায়ার প্লেস কাজ করছে না। লারা সঙ্গে সঙ্গে সেটা সারাবার নির্দেশ দিল। চারদিকে মুগ্ধ দৃষ্টি রাখছে সে।

হোটেলের উদ্বোধনের দিন লারা ভোর চারটের সময় উঠে পড়েছে। তাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। একবার চাইল পল মার্টিনের সঙ্গে সমস্ত বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে। সেই মুহূর্তে পলকে ফোনে পাওয়া সম্ভব হল না। অবশেষে পোশাক পরে লারা বেরিয়ে পড়ল।

লারা মনে মনে ভাবল, প্রতিটি ঘরের অবস্থা কেমন তা একবার মনের মণিকোঠায় দেখতে হবে। কোথাও কোনো গোলমাল আছে কী? না, সব কিছু ঠিক আছে।

সন্ধ্যা ছটা। আমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে আসতে আরম্ভ করেছে। গেটের সামনে ইউনিফর্ম পরিহিত প্রহরী সবাইকার কার্ড পরীক্ষা করে দেখছে। বিভিন্ন শ্রেণীর লোকেদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। অ্যাথলিট থেকে শিল্পী, এগজিকিউটিভ রাজনৈতিক নেতা, গায়ক সকল শ্রেণীর মানুষেরা আজ এখানে আসবেন। তারা প্রত্যেকের সাথে করমর্দন করছে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করছে–কে কেমন আছেন?

লারার পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়ার্ড কেলার।

লারা জিজ্ঞাসা করল হাওয়ার্ড, মেয়র এখনো আসেননি?

–না, উনি একটু ব্যস্ত।

–তার মানে, আমি এখনো অতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারিনি কী বলো?

–পরে নিশ্চয়ই তোমার সম্পর্কে ওনার ধারণা পাল্টাবেন।

তখনই মেয়রের একজন সহযোগী এসে হাজির হল।

–আসুন। আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি।

এখনই এসে হাজির হবার কথা টড গ্রেসনের। নিউইয়র্ক টাইমস-এর আর্কিটেক্ট চারাল ব্রিটিক, ওনার সমালোচনার খ্যাতি আছে। লারা একটু নার্ভাস হয়ে পল মার্টিনের কথা ভাবছিল। তখন সস্ত্রীক পল মার্টিন এলেন। এই প্রথম লারা পলের স্ত্রীকে দেখতে পেল। দেখতে আকর্ষণীয় এবং যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পন্না। লারার মনের মধ্যে তখন এক ধরনের অপরাধবোধ জেগে উঠেছে।

পল হেসে বললেন–মিস ক্যামেরন, আমি পল মার্টিন, উনি আমার স্ত্রী নীনা। আমাদের আমন্ত্রণ করার জন্য ধন্যবাদ।

লারা করমর্দন করে সহাস্যে বলল–আপনারা এসেছেন, আমি খুব আনন্দিত। এই জায়গাটাকে আপনারা নিজেদের জায়গা বলে ভাববেন।

পল মার্টিন চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। তিনি বললেন–সত্যি চমৎকার লাগছে। আমি বিশ্বাস করি, আপনি নিশ্চয়ই সফল হবেন।

নীনাও বললেন–আমিও তাই মনে করি।

লারা মনে মনে ভাবল, নীনা কি পলের সঙ্গে লারার সম্পর্কের ব্যাপারটা জানে? কিন্তু এসব ভাবার মতো সময় তখন লারার ছিল না। এক-এক করে অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন।

একঘণ্টা বাদে লারা লবিতে দাঁড়িয়েছিল। হাওয়ার্ড এসে হাজির হল সেখানে। বলল–কী ব্যাপার লারা, তুমি এখানে একলা চুপটি করে কী ভাবছো? সবাই তোমায় দেখতে চাইছেন। বলরুমে সবাই খাওয়া-দাওয়া করছেন। তুমি যাবে না?

–আমি টড গ্রেসনের জন্য অপেক্ষা করছি।

–ওই সমালোচক! ওকে তো আমি ঘন্টা খানেক আগে দেখেছি।

–কী?

–অন্যদের সঙ্গে উনি তো হোটেল টাওয়ারে গেলেন।

–তুমি তো আগে বলোনি।

–আমি জানি ব্যাপারটা জানো তুমি।

লারা বলল–কী বললেন উনি? ওনার কি পছন্দ হয়েছে? দেখে তোমার কী মনে হল?

হাওয়ার্ড বলল–উনি এখনো পর্যন্ত কিছু বলেননি।

হাওয়ার্ডের এইকথা শুনে লারা খুবই অবাক হয়ে গেল। সাংবাদিকদের নাড়ি নক্ষত্র সে জানে, তার মানে কোথায় একটা গোলমাল হয়েছে।

বিড়বিড় করে লারা বলল–একটাও কথা বলেন নি?

–না।

লারা বলল খানিকটা উদ্বেগ এবং অবাক মেশানো কণ্ঠস্বরে ভালো লাগলে নিশ্চয়ই বলতেন। না, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে না।

হাওয়ার্ডের দৃষ্টিতে শূন্যতা ভেসে এল।

.

চমৎকার ভাবে পার্টি শেষ হল। প্রত্যেকে হোটেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেউ কেউ বললেন নিউইয়র্কে এই হোটেলটাই হবে এক নম্বর। খানাপিনা এবং রুম সার্ভিস সকলের পছন্দ হয়েছে। লারা মনে মনে ভাবল, এখন নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক যদি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন, তাহলেও কিছু এসে যাবে না। প্রত্যেকে অভিভূত। সকলেই লারাকে অভিনন্দন জানিয়ে একে একে বিদায় নিল।

লারা দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিল। হাওয়ার্ড বলল–এতটা সফল হবে ভাবতে পারিনি।

–নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিক্রিয়া এখনো জানি না।

–তার মানে? লারার মন তখনো ওই সাংবাদিকের চিন্তায় আচ্ছন্ন। হঠাৎ লারার মনের ক্যানভাসে পল মার্টিনের মুখটা ভেসে উঠল।

.

কয়েকটা দিন কেটে গেছে। লারার হাতে ধরা ছিল নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি কপি। তখন সবেমাত্র ভোর হয়েছে। লারা অবাক হয়ে দেখল, ক্যামেরন প্লাজা সম্পর্কে প্রশংসা বাক্যের ছড়াছড়ি। বলা হয়েছে, নিউইয়র্কে একটি নতুন সংযোজন, যার মধ্যে রুচি সৌন্দর্য শিল্পবোধ সবকিছুর পরিচয় লুকিয়ে আছে। এর বেশী প্রশংসা আর সম্ভব নয়। লারার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল। অত ভোরে ছুটে গিয়ে হাওয়ার্ডকে ফোন করল।

হাওয়ার্ড বলল কী ব্যাপার এত ভোরে?

খুশীতে উজ্জ্বল কিশোরীর মতো লারা বলল হাওয়ার্ড, তুমি…

–কী বলতে চাইছো?

–আমি কাগজটা পড়ছি, শোনো।

পুরো সমালোচনাটা লারা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। সব শুনে হাওয়ার্ড হাই তুলে বলল–চমৎকার হয়েছে। এবার একটু ঘুমোতে যাও। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।

লারা বলে উঠল–ঘুমোব? আমার সঙ্গে রসিকতা করছো? আমার এখন নতুন সাইটের প্রয়োজন। ব্যাঙ্ক খুললেই আমি আবার লোনের ব্যাপারে আলোচনা করব। তুমি বলছো ঘুমোতে?

–ঠিক আছে তাই করো।

লারার এই উজ্জ্বলতা হাওয়ার্ড বোধ হয় সহ্য করতে পারে না। সে ইচ্ছে করেই লাইনটা কেটে দিল।

ক্যামেরন প্লাজা এখন সকলের কাছে গর্বের বিষয়। হোটেলের সমস্ত রুম বুক হয়ে। গেছে। ওয়েটিং লিস্টে অসংখ্য নাম আছে। শহরের অভিজাত মানুষরাও অন্তত একটি রাত ওই হোটলে কাটাতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।

লারা হাওয়ার্ডকে বলল–এই তো সবে শুরু। আমরা সমস্ত নামকরা বিল্ডারদের অতিক্রম করতে চাই। আমাদের খ্যাতি গগনস্পর্শী হবে, সাধারণ বিল্ডাররা অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তবেই তো সফলতাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা সম্ভব।

হাওয়ার্ড লারার এই অভিনব পদ্ধতিকে বুঝতে পারে না। সে সহজ সুন্দর জীবন যাত্রার প্রত্যাশী।

লারা পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য তখন ছটফট করছে। এবার আবার ব্যাঙ্কলোনের ব্যবস্থা করতে হবে। লারা রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ব্রোকারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। তাদেরকে ডিনারে আমন্ত্রণ করা হল। ডাউন টাউনে আরো দুখানা সাইট পেয়ে গেল। কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হয়ে গেল। পল মার্টিন একদিন ফোন করে লারাকে বললেন–তুমি বিজনেস উইক দেখেছো? তুমি সবাইকে একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে।

লারা বলল–কেন? কী হয়েছে?

পল বলল–তুমি তো বছরের সেরা মহিলা ব্যবসায়ীর সম্মান পেয়েছে।

পল আবার বললেন, তুমি কি ডিনারের জন্য সময় দিতে পারবে?

লারা বলল–হ্যাঁ, তোমার জন্য আমি সব সময় মুক্ত।

পল বললেন–তা, আমি জানি।

–নিজেকে মুক্ত করতে আমার বেশীক্ষণ সময় লাগবে না।

লারার এই কথা শুনে পল হেসে উঠলেন।

.

আর্কিটেকচারাল ফার্মের একজন পার্টনারের সঙ্গে লারা কথা বলছিল। ওদের দেওয়া রপ্রিন্ট লারার হাতে ধরা আছে। পরের বিল্ডিংটা কী ধরনের হবে, তা দেওয়া আছে, ওই সুপ্রিন্টের মধ্যে। ঠিক এই সময় লারার সেক্রেটারী ঘরে ঢুকল। বিব্রত ভঙ্গিতে লারার দিকে তাকিয়ে বলল–একটু দেরী হয়ে গেছে ম্যাডাম।

লারা নিস্পৃহভাবে বলল–পনেরো মিনিট।

–দুঃখিত মিস ক্যামেরন। আমি—

–ঠিক আছে, পরে কথা বলব।

পার্টনারের সাথে আলোচনায় যোগ দিল লারা। দুঘণ্টা বাদে তার সেক্রেটারী ক্যাথিকে ডেকে পাঠাল। ক্যাথি এল, মুখটা ম্লান।

লারা প্রশ্ন করল–তোমার কি কাজ ভালো লাগছে না?

–হ্যাঁ।

–তাহলে? এই নিয়ে সপ্তাহে তিনবার লেট হল। এটা তো চলতে পারে না। ক্যাথি ম্লান স্বরে বলল–আমি দুঃখিত। শরীরটা ভালো নেই।

–সমস্যাটা কী?

–আসলে রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না। একটা ক্ষতের মতো হয়েছে।

–কী হয়েছে?

–একটা জায়গায় মাংস উঁচু হয়েছে।

–ডাক্তার দেখাও নি? তোমার পরিবারের লোকজনরা কেমন?

–ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয়নি।

লারা রিসিভারটা টেনে নিল। ডায়াল করে অপেক্ষা করতে লাগল। ও প্রান্তে কণ্ঠস্বর শোনা যেতে সে বলল–ডাঃ পিটারসকে একবার দিন।

রিসিভারটা রেখে লারা ক্যাথির দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি একবার ডাক্তারকে দেখিয়ে নাও।

ক্যাথি এবার কেঁদে ফেলল মিস ক্যামেরন, আমার মা আর দাদারও ক্যানসার হয়েছিল। তারা মারা গেছে। তাই ডাক্তারের কাছে যেতে আমার ভয় লাগছে।

ফোনটা বেজে উঠতেই লারা ও প্রান্তে ডাঃ পিটারসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। লারা বলল–হ্যালো ডাক্তার, আমি আমার সেক্রেটারী ক্যাথি টারনারকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। ওর একটা টিউমার হয়েছে। আপনি সমস্ত ব্যবস্থা করুন।

লারা মৃদু হেসে বলল যাও ক্যাথি, উনি প্রয়োজন হলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করবেন। অপারেশন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা নেই। শ্লোওয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালের নাম শুনেছো তো?

ক্যাথির চোখে জল এসে গেল। সে বলল–অসংখ্য ধন্যবাদ।

ক্যাথি চলে গেল। হাজির হল হাওয়ার্ড কেলার! উদ্বিগ্ন মুখ তার।

সে বলল–লারা, একটা সমস্যা হয়েছে?

–কীরকম?

–ফরটিনথ স্ট্রিটে যে সম্পত্তি আমরা কিনেছি তার সবটাই খালি করে ফেলা হয়েছে। কেবল একটা মাত্র অ্যাপার্টমেন্টে কয়েকজন ভাড়াটিয়াকে তোলা সম্ভব হচ্ছে না, ওরা রাজী হচ্ছে না। আবার জোর করাও সম্ভব নয়।

–আরো টাকার লোভ দেখাও।

–টাকার কোনো প্রশ্ন নেই। দীর্ঘকাল ধরে ওরা ওখানে আছে। এখন ছাড়তে চাইছে না।

–তাহলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

–তুমি কী বলতে চাইছো, বুঝিয়ে বলো।

–চলো আমি একবার দেখে আসি।

যাবার পথে রাস্তায় অসংখ্য গৃহহীন নারী পুরুষ লারার নজরে পড়ল। এত উন্নত শহর কিন্তু বাসস্থানের অভাব কেন? রাস্তায় শুয়ে তোক দিন কাটাচ্ছে? এটা হল সভ্যতার অন্ধকার দিক।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেল। সাততলা উঁচু ইটের তৈরি অ্যাপার্টমেন্ট, মাঝের ব্লকটা আরো জীর্ণ। এখন যদি ভাঙা না হয় তাহলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিছুটা দূরে একটা বুলডোজার রাখা আছে।

লারা জিজ্ঞাসা করল কজন ভাড়াটিয়া আছে?

হাওয়ার্ড বলল–ষোলোজনকে আমরা তুলে দিয়েছি। আর দুটো বাকি।

–তার মানে ষোলোটা ঘর খালি।

–হ্যাঁ। এবার হাওয়ার্ডকে বিভ্রান্ত দেখাল।

লারা বলল–প্রত্যেকটা এখন ভর্তি করে ফেলল। ওই যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকগুলো, ওদের এখানে নিয়ে এসো।

–তার মানে, তুমি কি ওদের লিজ দিতে চাইছো?

–আরো নানা। লারা মৃদু হাসল। বলল–লিজ দিতে চাইছি না। আমি গৃহহীনদের গৃহ দিতে চাইছি। নিউইয়র্কে হাজার হাজার মানুষ পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যদি কয়েকটাকে আমরা সুন্দর ছাদের তলায় রাখতে পারি, তাহলে ভালোই হবে। একটু বেশী করেই লোক ঢোকাবে। আর খাবার ব্যবস্থাও করবে।

হাওয়ার্ড এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। লারার এই কথার বক্তব্য সে বুঝতে পারছে না। একজন বিজনেস ওম্যান এসব দয়াদাক্ষিণ্যের কথা বলছে কেন?

লারাকে সে জিজ্ঞাসা করল–কী যে করতে চাইছো বুঝতে পারছি না! হাসতে হাসতে লারা জবাব দিল হাওয়ার্ড, আমি এমন একটা কাজ করতে চাই, যা নগর পিতারা করতে পারেনি। গৃহহীনদের বাসস্থানের ব্যবস্থা।

লারা আরো ভালোভাবে দেখল। কতগুলো জানলা আছে তাও দেখল। তারপর বলল–সমস্ত জানলাগুলো বোর্ড দিয়ে বন্ধ করে দাও।

–তার মানে?

–আমরা বাড়িটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যে, মনে হবে, এটা পরিত্যক্ত। ওপরের অ্যাপার্টমেন্টটা তো আমাদের দখলেই আছে। ওখানে একটা গানও তো আছে।

–হ্যাঁ।

–ছাদের ওখানে একটা কার্ডবোর্ড লাগিয়ে দাও, যাতে কোনো দৃশ্য চোখে না পড়ে।

–কিন্তু।

–আমি যা বলছি, তাই করো।

লারা অফিসে চলে এল। ট্রিসিয়া অর্থাৎ তার আর কর্মচারী বলল, ডাঃ পিটারস আপনাকে ফোন করতে বলেছেন।

–বেশ তো ফোন করো ওনাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাঃ পিটারসের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আমি ক্যাথিকে পরীক্ষা। করেছি।

–কী পেলেন?

–ওটা টিউমার, সম্ভবত ম্যালিগনান্ট। এখন ম্যাসটেকটমি করাই সব থেকে ভালো।

–আমি দ্বিতীয় একটা মতামত চাই।

–তুমি যখন বলছে, কিন্তু আমি একজন ডিপার্টমেন্টাল হেড।

–তা সত্বেও বলছি, ওকে পরীক্ষা করার জন্য আর কেউ তো আছে। ক্যাথি এখন, কোথায়?

–তোমার অফিসের দিকে রওনা হয়েছে।

–ধন্যবাদ।

লারা চিন্তিত মনে রিসিভার রেখে দিল। তারপর ইন্টারকমের বোতামটা টিপে বলল–ক্যাথি এলে আগে আমার কাছে পাঠাবে।

.

কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হতে এখনো তিরিশ দিন বাকি আছে। লারার মনে দুশ্চিন্তার রেখা। সে মনে মনে ভাবল, ওই ভাড়াটেগুলো খুবই একগুঁয়ে। দেখা যাক, ওরা কতদিন এইভাবে ওখানে থাকতে পারে। হঠাৎ লারার চিন্তায় ছেদ পড়ল। ক্যাথি অফিসে ঢুকেছে। তার চোখ দুটো ফ্যাকাশে।

লারা বলল আমি শুনেছি, তোমার জন্য সত্যি খুব খারাপ লাগছে।

–এবার আমি মরে যাব ম্যাডাম।

ক্যাথি কেঁদে ফেলল। লারা উঠে গিয়ে ক্যাথির কাঁধে হাত রাখল। বলল এখনো তেমন কিছু হয়নি। এসব ক্যানসারের অনেক আধুনিক চিকিৎসা আছে। ছোট্ট একটা অপারেশনের পর তুমি আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবে।

–মিস ক্যামেরন, অত খরচপত্র।

–ওসব চিন্তা করে তোমার লাভ নেই। ডাঃ পিটারস আরো একবার তোমাকে পরীক্ষা করবেন। যদি মনে হয় অপারেশন করতে হবে, তাহলে উনি তাই করবেন। এখন বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও।

ক্যাথি কান্না ভেজা গলায় বলল–কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ…।

কথা শেষ করতে পারল না সে।

লারা বলল–ঠিক আছে, এখন বাড়ি যাও।

ক্যাথি বেরিয়ে এসে রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তখনই ক্যাথির মনে হল, সত্যি লারা ক্যামেরন এমন একজন মহিলা, যার মনের অতল তলের সন্ধান কেউ কোনোদিন পাবেন

.

পঞ্চম অধ্যায়

পরের সোমবার লারার অফিসে একজন এসে হাজির হয়েছে।

লারা বলল–কী ব্যাপার?

আগন্তুক বলল মিস্টার ও’ ব্রায়ান আপনাকে সিটি কমিশনার অফিসে দেখা করতে বলেছে।

–কী জন্য?

–তা তো বলেননি।

লারা ইন্টারকমে হাওয়ার্ডকে ডাকল। তারপর বলল হাওয়ার্ড, তুমি এখন মিস্টার ও’ ব্রায়ানকে আমার এখানে ডেকে পাঠাও। সামান্য ব্যস্ত থাকায় যেতে পারছি না।

ঠিক আছে বলে হাওয়ার্ড ইন্টারকম বন্ধ করল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ও’ ব্রায়ান হাজির হলেন। লালচে মুখ, জাতে আইরিশ।

লারার অফিসে ঢুকে বললেন মিস ক্যামেরন?

–হ্যাঁ, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। বলুন, কী করতে হবে?

–আপনার বিরুদ্ধে আইন ভাঙার অভিযোগ আছে।

–তাই নাকি? কী ব্যাপার বলুন তো।

–আপনি যে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, সেখানে শ-খানেক ভবঘুরে লোককে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

লারা মৃদু হাসলো। বলল আমি করেছি অবশ্য তার কারণ আছে। শহরের গণ্যমান্য লোকেরা যখন ওদের বাসস্থানের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, তখন আমি ইচ্ছে করেই সেই কাজে হাত দিয়েছি। ওরা আশ্রয় পেয়েছে এটা কি অপরাধ?

ঠিক তখন হাওয়ার্ড কেলার অফিস ঘরে ঢুকল। লারা ও ব্রায়ানের সঙ্গে হাওয়ার্ড কেলারের পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে লারা বলল–আমি মিস্টার ও’ ব্রায়ানকে বলছিলাম, কেন আমরা ওইসব গৃহহীনদের সাহায্য করেছি।

–আপনি কি ওদের ডেকে ডেকে ঢুকিয়েছেন মিস ক্যামেরন?

–ঠিকই বলেছেন।

–এর জন্য একটা লাইসেন্সের দরকার। আপনার আছে?

–কীসের লাইসেন্স? লারা অবাক হল।

ও’ ব্রায়ান বললেন আপনি যদি কাউকে আশ্রয় দিতে চান, তাহলে শহরের পুরপিতার কাছ থেকে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু কঠিন শর্ত আছে।

লারা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–দুঃখিত মিস্টার ও’ ব্রায়ান। আমি এটা একেবারেই। জানতাম না। ঠিক আছে, আমি এখনই লাইসেন্স নেবার ব্যবস্থা করছি।

ও’ ব্রায়ান বললেন এখন তা আর হবে না।

–কেন? লারা জানতে চাইল।

ও’ ব্রায়ান এর জবাবে বললেন–ওখানকার কিছু ভাড়াটিয়া আপনার নামে অভিযোগ করেছেন। আপনি নাকি গায়ের জোরে ওদের তুলতে চাইছেন।

–যত সব বাজে কথা। লারা গর্জন করে উঠল।

–মিস ক্যামেরন, নগর কর্তৃপক্ষের আদেশানুসারে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ওইসব ভবঘুরে লোকদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে। এই কাজটা হয়ে যাবার পর আরো একটি নির্দেশ আপনাকে মানতে হবে। আপনি যে সমস্ত জানলা বোর্ড দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন, সেগুলো খুলে দিতে হবে।

লারার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। আর কিছু?

–না, আর কিছু নেই। ও হ্যাঁ, আরো একটা আছে। ছাদের ওপরের বাগানটা আপনি বোর্ড দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন। সেই বোর্ডটাও খুলতে হবে।

–যদি আমি এগুলো না মানি, তাহলে কী হবে?

ও’ ব্রায়ান মৃদু হেসে বললেন–আপনি মানবেন আমি জানি। কারণ আপনি নিশ্চয়ই অহেতুক হয়রানি চান না। অযথা কোটঘর করে লাভটা কি? আপনি খ্যাতির যেখানে উঠে গেছেন, সেখানে কোর্টঘরের জন্য সময় দিতে পারবেন না। বুঝতেই পারছেন, আচ্ছা, চলি।

ও’ ব্রায়ান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দুজনে তাকিয়ে থাকল সেদিকে। হাওয়ার্ড লারাকে বলল–আমরা বরং এখনই ভবঘুরে লোকগুলোকে রাস্তায় বের করে

ও’ ব্রায়ান মুন না। অযথা কোথদতে পারবেন না বুম থাকল সেদিকে দিই।

লারা ছোট্ট করে বলল–না।

–তুমি কী বলছো লারা? লোকটার কথা শোনোনি?

লারা জবাবে বলল–শোনো, আমি যা বলছি তাই করো। তুমি আরো কিছু ভবঘুরে লোকদের জোগাড় করো। আমি চাইছি, ওই অ্যাপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা ঘরে ভবঘুরেরা বসবাস করবে।

সামান্য ভেবে নিয়ে তারা আবার বলল–টেরি হিলকে ডাকো। ওকে সমস্যাটা বলল, এই মাসের শেষে হয় ওই ছজন ভাড়াটিয়াকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের করে দিতে হবে। তা না হলে আমাদের তিন মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

হাওয়ার্ড আর কিছু বলার চেষ্টা করল না। লারার কাজ কর্মের ব্যাপারে নাক গলাতে সে মোটেই রাজি নয়।

ইন্টারকমটা বেজে উঠল। |||||||||| –ডঃ পিটারস।

লারা রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলল–ডঃ পিটারস, আমি লারা বলছি।

–ক্যাথির অপারেশন সাকসেস ফুল। ও ভালো আছে।

–বাঃ চমৎকার। লারা বলল, কখন যাব ওকে দেখতে?

–আজই বিকেলবেলা আসতে পারেন।

–ধন্যবাদ। বিলটা আমাকে তখনই দেবেন। আমি হাসপাতালে পঞ্চাশ হাজার ডলার ডোনেশন দিতে চাই। কর্তৃপক্ষকে বলুন।

–ঠিক আছে। ডঃ পিটারস ফোন ছেড়ে দিলেন।

লারা রিসিভারটা রেখে সেক্রেটারীকে ইন্টারকমে জানাল ট্রিসিয়া, ক্যাথি যে কেবিনে আছে, সেখানে বেশ কিছু তাজা ফুল পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি চারটে নাগাদ দেখতে যাব ওকে।

ইন্টারকম তখন বন্ধ হয়েছে। ঘরে ঢুকল টেরি হিল। লারা বলল কী ব্যাপার?

–আপনাকে অ্যারেস্ট করার একটা ওয়ারেন্ট নিয়ে এখনই আসছে পুলিশ ফোর্স।

–কে? লারা অবাক হয়ে জানতে চাইল।

টেরি হিল বলল–আপনাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আপনি ভবঘুরেদের ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের করে দেননি। তাই তো?

–হ্যাঁ।

–কিন্তু আপনি কেন করেননি? জানেন তো, এখানে একটা কথা চালু আছে।

–কী কথা?

–সিটি হলের সঙ্গে কেউ লড়তে যাবেন না। ওদের বিরুদ্ধে জেতা অসম্ভব।

–তুমি সত্যি বলছো আমাকে গ্রেপ্তার করতে আসছে?

লারা উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল।

টেরি হিল বলল আপনাকে ওরা তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিল।

–ঠিক আছে, ওদের বের করে দেওয়া হবে। একথা বলে লারা হাওয়ার্ডের দিকে তাকাল। বলল–দেখছো হাওয়ার্ড কী সমস্যা, তুমি বরং লোকগুলোকে বের করে দাও। কিন্তু একেবারে রাস্তাতে নয়। আমাদের আরো খালি রুম আছে। যাদের সঙ্গে এই অ্যাপার্টমেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই, সেখানেই বরং ওদের থাকার ব্যবস্থা করো। এক ঘণ্টার মধ্যেই কাজটা শেষ করে ফেল।

লারা টেরি হিলের দিকে তাকিয়ে বলল–আমি এখন এখান থেকে চলে যাচ্ছি। পরে যা হোক হবে। আশা করি ব্যাপারটা মিটে যাবে।

ইন্টারকমটা বেজে উঠল। লারা শুনতে পেল সেক্রেটারীর কণ্ঠস্বর ড্রিস্ট্রিকট অ্যাটর্নির অফিস থেকে দুজন ভদ্রলোক এসেছেন দেখা করতে।

লারা হাওয়ার্ডকে ইশারা করলেন। হাওয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারকমে বললেন ওদের বলে দাও মিস ক্যামেরন এখন অফিসে নেই।

ইন্টারকমে কিছুক্ষণ পর শোনা গেল–ওরা জানতে চাইছেন কখন ক্যামেরনের দেখা পাওয়া যাবে।

হাওয়ার্ড আবার লারার দিকে তাকাল। লারা ঘাড় নাড়ল। হাওয়ার্ড ইন্টারকমে জানাল তা ঠিক বলতে পারছি না। ইন্টারকম বন্ধ করে দিল। লারাকে বলল, এখন কী করবে লারা?

–শোনো হাওয়ার্ড, আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।

–ঠিক আছে।

হাওয়ার্ড আর কথা বাড়াল না।

.

যে কোনো হাসপাতালের ছবি লারাকে অত্যন্ত বিষণ্ণ করে তোলে। হাসপাতালের কথা মনে হলেই বাবার মুখটা ভেসে ওঠে। শয্যাশায়ী মুখটা ফ্যাকাশে, হঠাৎ যেন একলাফে বয়সটা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বাবার কণ্ঠস্বর এখনো কানে বাজে–তুমি এখানে কী। করছে লারা? যাও বোর্ডিং হাউসে চলে যাও।

ক্যাথির রুমে গিয়ে লারা ঢুকল। ঘরটা ফুলে ফুলে ভর্তি। ক্যাথি বিছানার ওপর বসেছিল।

লারা জিজ্ঞাসা করল এখন কেমন আছো?

ক্যাথি বলল ডাক্তারের কথানুযায়ী ভালোই আছি।

–তুমি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবে। তোমাকে আমার কাজকর্মে ভীষণ প্রয়োজন।

ক্যাথি কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরে বলল–আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব।

–কোনো প্রয়োজন নেই। লারা হাসতে হাসতে বলল। তারপর বিছানার পাশ থেকে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। টেরি হিলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ফোনে তাকে পাওয়া গেল।

লারা জিজ্ঞাসা করল–ওরা কি এখনো ওখানে আছে?

টেরি হিলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–হ্যাঁ, ওরা এখনো আছে। যতক্ষণ না আপনি ফিরছেন।

–ঠিক আছে। হাওয়ার্ডকে তো বলেছি, ওদের সবাইকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের করতে। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি যাচ্ছি ওখানে।

রিসিভারটা লারা রেখে দিয়ে ক্যাথিকে বলল–শোনো ক্যাথি, তোমার যা কিছু দরকার হবে, আমাকে জানিও কিন্তু। আমি আগামীকাল আবার আসব।

হাসপাতাল থেকে লারা বেরিয়ে এল। এই মুহূর্তে তাকে কিছু একটা করতেই হবে।

.

লারা এসে পৌঁছলো আর্কিটেকচারাল অফিসে। দেখা করল মিস্টার ক্লার্কের সঙ্গে। ভদ্রলোক লারাকে দেখেই অবাক–আরে কী সৌভাগ্য, মিস ক্যামেরন, আপনি স্বয়ং।

ভদ্রলোকু করতে পারি? |||||||||| –ঔটের প্রজে

লারা বলল–ফোরটিনথ ষ্টীটের প্রজেক্টটার প্ল্যানটা কি এখানে পাব?

–হ্যাঁ, অবশ্যই পাওয়া যাবে। ক্লার্ক জবাব দিল। সে একটা ড্রয়িং বোর্ডের কাছে এগিয়ে গেল। বলল, এই যে এখানে।

লারা ড্রয়িংটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। একটি আকাশছোঁয়া অট্টালিকার স্কেচ। অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। দোকানও আছে।

–আমি এই প্ল্যানটা পালটাতে চাই। লারা বলল, ঠিক এরকম নয়, অন্যভাবে।

–অন্যভাবে বলতে?

ক্লার্ক অবাক হয়ে জানতে চাইল।

–এই যে পুরোনো বিল্ডিংটা রয়েছে পেনসিল দিয়ে লারা জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেখাল। এই বিল্ডিংটার কেনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে, এর চারপাশ দিয়ে নতুন বিল্ডিং হবে।

–অর্থাৎ পুরোনো বিল্ডিংটা সমেতই প্রোজেক্ট তৈরি হবে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সুন্দর দেখাবে না, তাছাড়া অন্য সমস্যাও…

ক্লার্ক মাঝপথে কথা থামিয়ে দিল।

–হ্যাঁ, আমি যা বলছি, তেমনটিই হবে। লারা স্পষ্টভাবে বলল, বিকেলে ড্রয়িংটা আমার অফিসে পাঠিয়ে দেবেন।

লারা সেখানে আর দাঁড়াল না।

গাড়িতে উঠে বসল। ফোন করল টেরি হিলকে হাওয়ার্ড ফোন করেছিল?

–হ্যাঁ, খালি করে দেওয়া হয়েছে। জবাব দিল টেরি হিল।

–বাঃ, দারুন। ডিস্ট্রিকট অ্যাটর্নিকে জানিয়ে দিও, যে, দুদিন আগেই ওদের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, খালি করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সময়মতো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। আমি অফিসে যাচ্ছি, ওরা কি এখনও আমাকে অ্যারেস্ট করতে চাইবে? ব্যাপারটা লক্ষ্য রেখো।

ফোনে কথা বলা শেষ করে লারা বলল–পার্কটা ঘুরে চলো, ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল। একটু বেশি সময় পরেই অফিসে পৌঁছোনো দরকার।

আধঘন্টা কেটে গেল।

লারা অফিসে এল। ওরা নেই, চলে গেছে। লারা গ্রেপ্তার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল।

.

হাওয়ার্ড কেলার আর টেরি হিলের সঙ্গে লারা কথা বলছে।

–ভাড়াটিয়াগুলো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। হাওয়ার্ড বলল–বেশি টাকার লোভ দেখিয়েছি। হাতে মাত্র পাঁচ দিন সময় তারপরেই ভেঙে দিতে হবে। এছাড়া কোনো পথ নেই।

লারা বলল, মিঃ ক্লার্ককে বলেছি, একটা নতুন প্ল্যান তৈরি করতে।

কেলার বিস্ময়ের সুরে বলল–এটা কি করে সম্ভব! নতুন বিরাট কনস্ট্রাকশানের মাঝে ওই রকম সেকেলে একটা বাড়ি। ব্যাঙ্কের কাছ থেকে আরও কিছু সময় নেওয়া দরকার।

লারা গম্ভীর স্বরে বলল–না। সময় বাড়িয়ে লাভ নেই। কনট্রাক্টরকে বলল আমরা আগামীকালই বিল্ডিং তৈরির কাজে হাত দেবো।

–আগামীকাল?

লারা হাওয়ার্ডকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলল–কাল সকালে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ফোরম্যানের কাছে যাও। তাকে ব্লু-প্রিন্ট-টা দেবে।

হাওয়ার্ড কেলার ও টেরি হিল নীরবে লারার কথা মেনে নিল।

.

পরের দিন সকালবেলা। বুলডোজারের ঘরঘর শব্দে পুরোনো বিল্ডিং-এর বাসিন্দাদের ঘুম ভেঙে গেল। তারা জানলা খুলে বাইরের দিকে তাকালো। দেখলো বুলডোজারটা পুরোনো বিল্ডিং-এর চারপাশটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। তখন ভাড়াটিয়ারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের মধ্যে একজন বলল সাবধান, আর এক পাও এগোনোর চেষ্টা করবেন না। আপনারা যদি এই বিল্ডিং-এ হাত দেন তাহলে সিটি কর্তৃপক্ষকে আমরা জানাতে বাধ্য হব। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন বাসিন্দা ওই ভদ্রলোকের পাশে এসে। দাঁড়িয়েছে। তারা তাকে উৎসাহ দিতে থাকল।

–আপনারা মিথ্যে আতঙ্কিত হয়েছেন। আমরা এই বিল্ডিং-এ হাত দেবো না। সিটি কর্তৃপক্ষের সেই রকমই নির্দেশ আছে। ফোরম্যান তাদের আশ্বস্ত করলেন।

একথা শুনে ভাড়াটিয়ারা আরও উদ্বিগ্ন হল। সেই বাসিন্দা রু প্রিন্টটা দেখতে চাইল।

ফোরম্যান তাকে ড্রইংটা দেখালো। সেটা দেখে ওই ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল এখানে একটা বিশাল প্লাজা তৈরি করা হবে। অথচ আমাদের বিল্ডিংটা অক্ষত থাকবে। না না এটা করা ঠিক হবে না। দিনরাত চীৎকার চেঁচামেচি হবে। চারদিকে নোংরার সৃষ্টি হবে।

ফোরম্যান ক্রুব্ধ হয়ে বললেন–আমি এসবের কিছু জানি না। আমাকে কাজ করতে দিন। এখান থেকে আপনারা সরে যান।

বাসিন্দারা দূরে সরে গিয়ে বুলডোজারের ধ্বংসলীলা দেখতে লাগল।

.

আধঘণ্টা কেটে গেছে। লারার সেক্রেটারী বলল–আপনার সঙ্গে একজন কথা বলতে চান। নাম তার হারসে।

লারা বলল–বলে দিন আমি ব্যস্ত। বিকেলবেলা আবার হারসে ফোন করলো। এবারে লারা তার সঙ্গে কথা বললেন। রিসিভারের ওপ্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল আমি হারসে বলছি। আমি পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই মিস ক্যামেরন।

–বলুন, লারা বললেন।

–আমরা সব ভাড়াটিয়ারা ঠিক করেছি যে আপনার প্রস্তাব আমরা মেনে নেবো। তাই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিতেও রাজি আছি আমরা। হারসে বলল।

লারা বললেন–আগে তো আপনারা কেউ মানেননি। হঠাৎ আপনাদের মত পাল্টানোর কারণ কি?

মিঃ হারসে বলল–আমাদের চারপাশে আপনারা বিল্ডিং তৈরি করবেন। এর মাঝখানে থেকে নিশ্চিন্তে দিন কাটানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। আমরা ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে চাই না মিস ক্যামেরন।

লারা কঠিন স্বরে বললেন–আপনি ভুল করছেন মিঃ হারসে। আপনারা মিথ্যেই ভয় পাচ্ছেন। তাছাড়া আপনারা কোথায় যাবেন বা কীভাবে থাকবেন সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। তবে যদি আপনারা আগামী মাসের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট খালি করেন তাহলে আমার প্রথম অফারটা আপনাদের মানতেই হবে।

হারসে খানিকক্ষণ ভাবলো। শেষে বলল–ঠিক আছে মিস ক্যামেরন। আমি অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করি। তারপর আপনাকে জানাবো।

লারা ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।

.

পরের মাস থেকেই নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়ে গেল। লারার সুখ্যাতি আকাশ ছুঁয়েছে। ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজ নিউইয়র্ক ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে বিস্তার লাভ করেছে। ব্রুকলিন, ওয়াশিংটন ডিসি প্রভৃতি শহরে হোটেল বিল্ডিং, শপিং সেন্টার, মল ইত্যাদি তৈরি করেছে। প্রত্যেকটিতে রুচি ও সৌন্দর্যবোধের অভিনবত্ব আছে। ইতিমধ্যে ডালাস আর লস এঞ্জেলসে ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজ পা রেখেছে। এখন ব্যাঙ্ক ও বিভিন্ন লোন কোম্পানী লারাকে ঋণ দিতে এগিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয় ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরাও তাকে লোন দিতে আগ্রহী। লারার কোম্পানি ছাড়া আর কোনো নামের অস্তিত্ব নেই।

একদিন ক্যাথি এসে হাজির লারার অফিসে। দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হল। লারা খুব খুশি ক্যাথিকে পেয়ে।

লারা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন–আশা করি তোমার কাজের গতি ফিরে এসেছে?

–হ্যাঁ, বিস্মিত হয়ে ক্যাথি জবাব দিল।

–ঠিক আছে। আমি তোমাকে একজিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে আমার কোম্পানিতে যোগ দিতে অনুরোধ করছি।

–আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই, ক্যাথি বলে উঠল।

লারা তাকে বাধা দিয়ে বললেন–আরে না না। আমি তোমার প্রাপ্য সম্মান দিয়েছি।

এমন সময় ক্যাথির হাতের দিকে লারার দৃষ্টি পড়ল। ক্যাথির হাতে একটা বই ছিল। সেটা দেখিয়ে লারা বললেন–এটা কি?

–এটা একটা ম্যাগাজিন। আপনি কি খেতে পছন্দ করেন তা এরা জানতে উৎসাহী। আপনি–?

লারা মিনিট খানেক চুপ করে রইলেন। তারপর সুর নরম করে বললেন–ঠিক আছে, আমি আমার প্রিয় খাবার রান্নার প্রণালী ওদেরকে জানাব।

লারার সম্মতি পেয়ে ক্যাথি খুব খুশি। সে সেখান থেকে চলে গেল। মাস তিনেক পর একদিন ম্যাগাজিনে লারার প্রিয় খাবার আর প্রণালী প্রকাশিত হল। লেখাটা লারার নজর এড়ায়নি। তিনি বোর্ডিং হাউসের বোর্ডারদের জন্য এই রেসিপিটা রান্না করেছেন। বোর্ডাররা তার রান্নার প্রশংসা করেছে। এমন সময় লারার বাবার কথা মনে পড়ল। তার বাবা হাসপাতালে শয্যাশায়ী। লারা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ম্যাগাজিনটাকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলল।

.

লারার এখন খুব নাম ডাক। এক কথায় সবাই তাকে চেনে। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে উনি মাঝে মধ্যেই হোটেলে খেতে যান। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পুরুষদের যাতায়াত আছে। তাদের মধ্যে কেউ লারাকে নানা ধরনের কুপ্রস্তাব দেবার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের লারা অবজ্ঞা করেন। তার আচরণে এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে ওঠে। উনি তার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারের সন্ধান করেন। অথচ এখনও তিনি সেই বিশেষ পুরুষটির দেখা পাননি।

প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় লারার ঘুম ভাঙে। তারপর ফ্রেস হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তার গন্তব্যস্থল যেখানে নতুন বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে সেখানে। বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখেন। সেই সময় তাঁর অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। বাবার কথা বিশেষ করে তাঁর মনে পড়ে। লারা যে বোর্ডিং হাউসের ভাড়া আদায় করতে পারেন তা তার বাবা বিশ্বাস করতে পারেননি। সবাই কাজে ব্যস্ত। বুলডোজারের আওয়াজে জায়গাটা মুখরিত। চারদিকে কাজের শব্দে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। আবার ভাবনাটা তাকে পেয়ে বসল। তার মনে পড়ে গেল, তিনি বাবার কাছ থেকে কোনোদিন ভালোবাসা পাননি। তিনি মনে মনে তার সৃষ্টির সংবাদ দিলেন বাবাকে। বললেন বাবা, এই মহানগরী আমার হাতের মুঠোয়। আমি এই শহরটাকে কিনেছি।

লারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

.

পল মার্টিন ও লারা ক্যামেরন মুখোমুখি বসে আছে। শ্রমিক কর্মচারী ও নতুন বিল্ডিং সম্পর্কে লারা পলকে বুঝিয়ে বলছিলেন।

 পল জানাল, দিন কয়েকের জন্য সে লস এঞ্জেলস যাচ্ছে। লারাকে সে সঙ্গিনী হিসাবে পেতে চায়।

লারা বলল আমার পক্ষে যাওয়া এখন সম্ভব নয়। তাহলে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে বিল্ডিং তৈরির কাজ শেষ হবে না।

পল মার্টিন এগিয়ে এসে লারাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে চুমু দিল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় চলে গেল।

.

জায়গাটার পাশ দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করলেও এই প্রথম লারার নজরে পড়ল সেই ফাঁকা জায়গাটা, ওরাল স্ট্রিটের ওপর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে। অনেকদিন ধরে মনের মধ্যে এরকম একটা স্বপ্ন পাখি পুষেছিল লারা, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং-এর মালকিন হবে সে।

স্টাফদের সবাইকে লারা অফিসে ডেকে পাঠাল। তার মনের ইচ্ছের কথা জানাল। হাওয়ার্ড বলল তুমি যে সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং করতে চাইছো, এর জন্য পরিশ্রমের ব্যাপারটার কথা কি ভেবে দেখেছো?

–ভেবেছি, ক্যামেরন টাওয়ার্সের জন্য আমি দিনরাত পরিশ্রম করতে রাজি।

–প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আসবে?

লারা এক টুকরো কাগজ হাওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে দিল। হাওয়ার্ড পড়ল। বলল–সত্যি, তুমি ভীষণ আশাবাদী।

–না, আমি বাস্তববাদী। যে কোনো ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমাকে অর্থ দিতে সর্বদা প্রস্তুত। সব ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি। স্টিভ মার্চিসনকে তো তুমি চেনো। জমিটার ব্যাপারে ও আগে থেকেই কথা বলেছিল।

–হ্যাঁ, মনে আছে। আমাদের একটা জমি নিয়ে ওর সঙ্গে বচসা হয়েছিল। আমাদের ও হুমকি দিয়েছিল, তাই না?

–হ্যাঁ, নিউইয়র্কের অন্যতম সফল রিয়েল এস্টেট ডেভলপার। তবে ওর মতো নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর লোক বোধহয় খুব একটা নেই।

–লোকটা কাউকে খুন করতেও পিছপা হয় না।

লারা মৃদু হেসে বলল–হাওয়ার্ড, তুমি অনর্থক চিন্তা করো না।

.

ক্যামেরন টাওয়ার্স শেষ হতে বেশী দেরী নেই। লারা এখন গ্লামারস রমণী। সে নারী জগতের আদর্শ। সর্বস্তরের মহিলারা তাকে দেবীজ্ঞানে পুজো করে। সমাজের উঁচু মহল থেকে নীচু মহল পর্যন্ত লারার নাম মুখে মুখে ফেরে। প্রেস তার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য উদগ্রীব। ক্যামেরাম্যান তার একটা ছবি নেওয়ার জন্য পেছন পেছন ঘুরছে। সংক্ষেপে বলা যায়, লারা এখন মুকুটহীন শাহাজাদীতে পরিণত হয়েছে।

খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের পর্দায়–সর্বত্র লারা ক্যামেরন সদর্পে উপস্থিত। লারার রূপমুগ্ধের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

একদিন একটা অনুষ্ঠানে লারা হাজির ছিল। সেখানে শহরের মেয়রও এসেছেন। লারাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হল। সে মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে যখন বক্তব্য রাখছিল তখন স্টিভ মার্চিসনকে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল। এই অনুষ্ঠানে ওর তো থাকার কথা নয়! এটা তো তারই অনুষ্ঠান। সে তাড়াতাড়ি বক্তৃতা শেষ করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

গাড়িতে ওর সঙ্গে ছিল জেরি টাউনসেন্ড। লিমুজিন গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটছিল। ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজের একজিকিউটিভ সুইট ক্যামেরন সেন্টারের পঞ্চদশ তলাতে।

লারা জেরিকে নিয়ে তার অফিসে এসে ঢুকল।

–তোমার বাবা কেমন আছেন? লারা জিজ্ঞাসা করল।

প্রশ্ন শুনে জেরি অবাক হয়ে গেল। এত ব্যস্ততার মধ্যেও মিস ক্যামেরন তার বাবার সমস্ত খবর মনে রেখেছে! সে বলল–খুব একটা ভালো নয়।

–হ্যাঁ, আমিও তাই শুনেছি। রোগটা বিদঘুঁটে। শেষ পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।

–আপনি এত খবর জানলেন কী করে?

–কয়েকজন ডাক্তার তোমার বাবার অসুখটা সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। আমি ওই হসপিটালে একটা প্রয়োজনে গিয়েছিলাম। তখন আমি শুনেছি।

–এই রোগ শুনেছি কখনো সারে না। জেরি বিবর্ণ মুখে বলল।

–রোগ মাত্রই ভয়ঙ্কর। সুইজারল্যান্ডের এক ডাক্তার শুনেছি এই ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণা করে সুফল পেয়েছেন। তিনিই তোমার বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। খরচ আমি বহন করব।

জেরি টাউনসেন্ড হতবাক হয়ে গেল। সত্যিই এই রহস্যময়ী নারীকে সঠিকভাবে চিনতে পারা এক রকম অসম্ভব ব্যাপার।

.

এদিকে পৃথিবী তখন ইতিহাস গড়ে চলেছে। রোনাল্ড রেগন দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধান হলেন মিখাইল গর্বাচভ।

ডেট্রয়েটে লারা গড়ে তুলল হাউসিং ডেভলপমেন্ট। নীচু আয়ের লোকেরা এখানে বসবাস করতে পারবে। ।

১৯৮৬, ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে ইভান বোয়েস্কির তিন বছরের জেল হয়ে গেল। এখবর শুনে লারা একটু ভাবনায় পড়ল। অবশ্য তখনো পুরোদমে বিভিন্ন জায়গায় লারার বাড়ি তৈরির কাজ চলছে।

জার্মান থেকে কয়েকজন ব্যাঙ্কার এল নিউইয়র্কে লারার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু লারার পক্ষে বেশী সময় দেওয়া সম্ভব নয়। সে জানাল, এয়ারপোর্টেই সে তাদের সাথে কথা বলে নেবে। সে আলোচনা অবশ্য সফল হল।

লারা এখন ছুটে চলেছে স্টিভ মার্চিসনের পেছনে। লোকটাকে হারাতে হবে।

একদিন কথা প্রসঙ্গে হাওয়ার্ড বলল–লারা, তোমার একটু পিছিয়ে থাকা উচিত।

–স্টিভ পিছিয়ে গেলে তখন ভাববো। লারার স্পষ্ট জবাব।

এত ব্যস্ততার মধ্যেও লারা পল মার্টিনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। তার আলমারী এখন নানা পোশাক ও গয়নাতে ঠাসা।

একদিন তার সেক্রেটারী ক্যাথি একটা সুন্দর এবং সৌখিন কাগজে মোড়া প্যাকেট এনে টেবিলে রাখল। কে যেন উপহার পাঠিয়েছে। প্যাকেট খুলে দেখা গেল নোংরা কাগজপত্র ভরা, একটা ছাপানো কার্ডও আছে। সেখানে লেখা আছে ফ্র্যাঙ্ক ক্যামবেল ফিউন্যারাল চ্যাপেল।

লারা ঠিক বুঝতে পারল না। সে ক্যাথিকে ওটা বাইরে ফেলে দিতে বলল।

প্রতিটি কর্মচারীর নাম ও জন্মদিন লারার কণ্ঠস্থ। ওদের সুবিধা অসুবিধার প্রতি তার নজর আছে। এমন কী, ওদের স্বামী বা স্ত্রী এবং সন্তানসন্ততিদের কুশল সম্পর্কে সে খোঁজ নেয়। লারার প্রশংসায় সকলে পঞ্চমুখ কিন্তু লারার সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই। সে নিজের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল রচনা করে রেখেছে।