২. বিমা-কম্পানি সেন্টেনারিয়ান

৬. বিমা-কম্পানি সেন্টেনারিয়ান

পরের দিন সকালবেলায় কিন-ফো একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। জীবন সম্বন্ধে তার আগ্রহহীনতার কিন্তু মোটেই কোনো ব্যত্যয় হয়নি। তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর ডান তীর ধরে খানিকটা গেলেই পড়ে একটা কাঠের সাঁকো–মার্কিন আর ইংরাজ বসতির মধ্যে এই সাঁকোটাই যোগাযোগ রক্ষা করে আছে। সাঁকো পেরিয়ে গিয়ে মিশন চার্চ, আর তার খানিক পরেই মার্কিন দূতাবাস; কিন-ফো মিশন চার্চ পেরিয়ে গিয়ে একটা সুন্দর বাড়িতে ঢুকে পড়লো–মার্কিন দূতাবাস অব্দি আর গেলো না।

বাড়িটির ফটকেই মস্ত পিত্তল ফলকে লেখা :

দি সেন্টেনারিয়ান।

ফায়ার অ্যাণ্ড লাইফ ইনশিওরেন্স কম্পানি

মূলধন : ২০,০০০,০০০ ডলার

প্রধান প্রতিনিধি : উইলিঅম জে. বিডুল্‌ফ

কোথাও না-থেমে কিন-ফো সোজা বারান্দা পেরিয়ে একটা হলঘরে গিয়ে ঢুকলো, তারপর সেখান থেকে ভিতরের আরেকটা ঘরের সুয়িং দরজা খুলে সোজা একটা আপিশঘরে ঢুকে পড়লো; ছোটো পিল্পে-বসানো খাড়া একটা বুক সমান উঁচু রেলিং দিয়ে আপিশটা দুটো ঘরে ভাগ করা। কতগুলো বাক্স, মোটা ধাতুনির্মিত আংটা লাগানো কতগুলো মস্ত হিশেবের খাতা, একটা মার্কিন সিন্দুক, দুটো-তিনটে টেবিলে কর্মরত কয়েকজন কেরানি, আর স্বয়ং উইলিঅম জে. বিডুলফের জন্য অজস্র খুপরি আর দেরাজওলা একটা টেবিল–এইসব আশবাব দিয়েই ঘরটা সাজানো; দেখে ঠিক য়ু সুঙের কোনো প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয় না, বরং নিউ-ইয়র্কের ব্রডওয়ে হলে বোধহয় আরো মানাতো।

উইলিঅম জে. বিডুল্‌ফ একটা নামজাদা আগুন ও জীবনবিমা কম্পানির সমগ্র চিনদেশের প্রধান প্রতিনিধি-কম্পানির হেড আপিশ হচ্ছে শিকাগোয়। সেন্টেনারিয়ান–শতবর্ষ যাদের পরমায়ু–কম্পানির নামটা এমন লাগসই হয়েছে যে জনপ্রিয়তার বুঝি সেটাই সবচেয়ে বড় কারণ। জগতের সব দেশেই এই কম্পানির প্রতিনিধি ও শাখা রয়েছে–আর কম্পানির বিধিসংহিতা অত্যন্ত উদার ও উদ্দীপক বলে ব্যবসা ক্রমশ কেঁপেই উঠছে। এমনকী চিনেম্যানরা শুক্কু এই বিমাব্যবস্থায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, যার ফলে এই ধরনের বহু কম্পানি আজকাল করে খাচ্ছে। আগুনের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য অনেকেই বাড়ি-বিমা করে ফেলেছে এর মধ্যে; জীবনবিমাও আজকাল নেহাৎ কম হচ্ছে না। সেন্টেনারিয়ানের প্রতীকচিহ্ন যে-ঢালটি, হরদম আজকাল আশপাশের বাড়ির গায়ে তা চোখে পড়ে–এমনকী কিন-ফোর মতো বড়োলোকের পাড়ার ইয়ামেনগুলোতেও প্রায়ই ওই ছোট্ট প্রতীকচিহ্নটি দেখা যায়। অগ্নিবিমা সংক্রান্ত যাবতীয় কর্ম বহু আগেই সম্পন্ন করেছিলো কিন-ফো, কাজেই আজ হন্তদন্ত হয়ে সে যে আপিশে এসে উইলিঅম জে. বিডুলফের খোঁজ করছে, তা নিশ্চয়ই ওজন্যে নয়।

বিডুল্‌ফ ভিতরেই ছিলেন; এখানে দিন-রাত্রি ফোটো তোলা হয়, এই বিজ্ঞপ্তি আঁটা দোকানের ফোটোগ্রাফারের মতো চব্বিশ ঘণ্টাই তিনি লোকের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। বয়েস বোধহয় পঞ্চাশ হবে তার, মার্কিন কেতার দাড়ি-গোঁফমণ্ডিত মুখমণ্ডল; পরেন নিখুঁত মিশকালো পোশাক, গলায় ধবধবে শাদা গলবন্ধ। বিনীতভাবে তিনি জিগেশ করলেন, জানতে পারি কি কার সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করলাম?

উত্তরে হলো, একেবারে অচেনা বোধ করি নই। আমি শাংহাই-র কিন-ফো।

আরে! তা-ই তো! সত্যি তো! শাংহাইর মিস্টার কিন-ফো–আমাদেরই তো মক্কেল। পলিসি নাম্বার ২৭,২০০। যদি আপনার আরো-কোনো কাজে লাগতে পারি তো নিজেকে ধন্য মনে করবো–

ধন্যবাদ, কিন-ফো বললো, আপনার সঙ্গে গোপনে দু-একটি কথা আছে।

গোপনে? নিশ্চয়ই, আসুন–

তক্ষুনি মক্কেলকে ভারি দরজাওলা পরদাটকা একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো : এখানে বসে কেউ যদি রাজদ্রোহের শলাপরামর্শও করে তবু কারু সে-কথা শোনবার উপায় নেই, এমনকী সবচেয়ে ধূর্ত তি-পাওকেও এখানে আড়ি পাততে গিয়ে ব্যর্থ হতে হবে। কিন-ফো ইংরেজি জানে; বিডুল্‌ফের চিনে ভাষা রপ্ত আছে : ফলে কথা বলতে গিয়ে কোনো অসুবিধেতেই পড়তে হলো না তাদের।

বিডুল্‌ফের ইঙ্গিতে গ্যাসচুল্লির ধারে পাতা মস্ত একটা দোলনা-চেয়ারে গিয়ে বসলো কিন-ফো–আর তক্ষুনি কাজের কথা পাড়লো।

এক্ষুনি আমি সেন্টেনারিয়ানে একটি জীবনবিমা করতে চাই।

আপনার কাজে লগাতে পেরে খুবই খুশি হলুম। যৎসামান্য যা প্রাথমিক কাজ আছে তা এক্ষুনি চুকে যাবে–তারপর কেবল পলিসিতে আমাদের দুজনকে দস্তখৎ করতে হবে। আশা করি আপনি অনেক দিন বেঁচে থাকতে চান।

অনেক দিন বেঁচে থাকতে চাই? তার মানে? কিন-ফো বাধা দিয়ে বলে উঠলো, আমার ধারণা ছিলো লোকে হঠাৎ একদিন অল্প বয়েসে মরে যেতে পারে এই ভয়েই জীবনবিমা করে থাকে।

না, না, ঠিক তার উলটো; আমাদের কম্পানিতে জীবনবিমা করার মানে হলো নতুন পরমায়ু পাওয়া : আমাদের মক্কেলরা একশো বছর বাঁচতে বাধ্য। শতবর্ষ পরমায়ু পাওয়ার সবচেয়ে বড়ো গ্যারান্টিই হলো সেন্টেনারিয়ানে জীবনবিমা করা।

বিডুল্‌ফের কথাগুলো ঠাট্টা কিনা বোঝবার জন্য কিন-ফো মুখ তুলে তাকালো তার দিকে : কিন্তু না, জজসাহেবের মতোই গম্ভীর আর সীরিয়াস বিডুল্‌ফ। তার মুখ-চোখের ভঙ্গি দেখে প্রচুর সন্তোষলাভ করে কিন-ফো আবার কাজের কথায় এলো : আমি দু-লক্ষ ডলারের জীবনবিমা করতে চাই।

এত-বড়ো অঙ্কের জীবনবিমা এর আগে কেউ করেনি; কিন্তু এ-কথা শুনে বিডুল্‌ফের মুখের ভাবে বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য পরিবর্তন দেখা দিলো না। একটুও অবাক না-হয়ে বিডুল্‌ফ দু-লক্ষ ডলারকথাটা পুনরাবৃত্তি করে নির্বিকারভাবে তার নোটবইতে টুকে নিলেন।

কত করে প্রিমিয়াম দিতে হবে এই জন্য? কিন-ফো জিগেশ করলো।

বিডুল্‌ফ একটু হাসলেন : একটু ইতস্তত করে শেষে বলেই ফেললেন তিনিঃ এটা জানেন নিশ্চয়ই যে আপনি যাদের এই বিমার ওয়ারিশান করে যাবেন, তাদের হাতে আপনার মৃত্যু হলে তারা এই প্রিমিয়াম থেকে এক কানাকড়িও ফিরে পাবে না।

হ্যাঁ, তা আমার জানা আছে।

বিডুল্‌ফ আবারও জিগেশ করলেন, জানতে পারি কি কী ধরনের বিপদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য আপনি বিমা করতে চাচ্ছেন?

সবরকম বিপদের হাত থেকেই, বলা বাহুল, তক্ষুনি জানালো কিন-ফো।

বেশ, এবার বিডুল্‌ফ ধীরে-ধীরে স্পষ্ট করলেন, চিন সাম্রাজ্যের বাইরে কি ভিতরে, জলে কিংবা স্থলে, দ্বন্দ্বযুদ্ধে কি আদালতের বিচারে কি রণক্ষেত্রে–যেখানেই মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিক না কেন, সর্বত্র সবকিছুর বিরুদ্ধে আমরা ইনশিওর করে থাকি। কিন্তু আপনি তো বুঝতেই পারছেন একেক ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের হার অত্যন্ত বেশি থাকে–কারণ সব বিপদ তো আর সমান নয়–কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বেশ চড়া প্রিমিয়ামই দিতে হয়।

যা লাগবে তা-ই দেবো, কিন-ফো বললে, একটা আশঙ্কার কথা আপনার ওই ফর্দতে নেই; সেন্টেনারিয়ান আত্মহত্যার বিরুদ্ধেও ইনশিওর করে কিনা, তা আপনি বলেননি।

করে বৈকি, নিশ্চয়ই করে, অত্যন্ত পরিতোষের সঙ্গে হাত কচলাতে-কচলাতে বিডুল্‌ফ বললেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি লাভ হয় ওতেই। আমাদের মক্কেলদের মধ্যে যাঁরা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে ইনশিওর করেন, তারাই কিন্তু জগতে সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচেন। তবু, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এ-ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের হার অসম্ভব চড়া হয়ে থাকে।

প্রিমিয়ামের হার কোনো বাধাই নয়। জীবনবিমা করার বিশেষ কারণ আছে আমার। যা লাগবে তা-ই আমাকে দিতে হবে বৈকি।

বেশ, তাহলে তো ভালোই, বলে বিডুল্‌ফ তাঁর নোটবইতে আরো কতগুলি তথ্য টুকে নিলেন। আমার ভুল হলে শুধরে দেবেন : আপনি জলে-ডুবে-মরা, আত্মহত্যা দ্বন্দ্বযুদ্ধে মৃত্যু–এ-সবের বিরুদ্ধে বিমা করতে চান–

স্বভাববিরুদ্ধ অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে কিন-ফো বাধা দিলে, সব-কিছুর বিরুদ্ধে বিমা করতে চাই, সব-কিছুর বিরুদ্ধে!

বিডুল্‌ফ আবারও তার এই মহৎ উদ্দেশ্যের কথা শুনে সাধুবাদ জানালেন : বেশ। তাহলে তো কথাই নেই–

কত প্রিমিয়াম দিতে হবে, এটাই এবার বলুন।

আমাদের প্রিমিয়ামের হার একেবারে অঙ্ক কষে নির্ভুলভাবে বের করা আছে। আমাদের কম্পানির গর্বই এটা যে হিশেবে আমাদের কোনো ভুল হয় না–কম্পানির শক্ত খুঁটিই এটা। আগের মতো দ্যপারসিয়োর তালিকার উপর আর নির্ভর করতে হয় না আমাদের।

দ্যপারসিয়ো? তা আবার কী? কিন-ফো কিঞ্চিৎ অধীর হলো।

আপনি জানেন না? বিডুলফের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো, দ্যপারসিয়য়া ছিলেন একজন নামজাদা নিবন্ধক–বিমার কিস্তির হার সম্বন্ধে মস্ত বিশেষজ্ঞ–অবশ্য অনেকদিন আগে জন্মেছিলেন তিনি–সত্যি-বলতে, এখন আর বেঁচে নেই। তৎকালে বিমার কিস্তির হার সম্বন্ধে যে-সুবিপুল সারণি বা নির্ঘণ্ট তিনি তৈরি করেছিলেন, ইওরোপের বিভিন্ন কম্পানিতে এখনো সেটাই ব্যবহৃত হয়। তখন লোকের পরমায়ু এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিলো। আমরা কিন্তু এখন লোকের আয়ুর হার বেড়ে গেছে ধরে নিয়েই নতুন সারণি তৈরি করেছি–তার ফলে আমাদের মক্কেলরা অনেক বেশি সুবিধে পান; তারা যে শুধু অনেক দিন বেঁচেই থাকেন তা নয়, তাদের প্রিমিয়ামও দিতে হয় অনেক কম।

আমাকে কী হারে প্রিমিয়াম দিতে হবে, সেটা বলতে বললে আপনাকে কি মুশকিলে ফেলা হবে? সেন্টেনারিয়ানের তারিফ শুনতে-শুনতে কিন-ফো বিরক্ত হয়ে উঠছিলো : বিডুল্‌ফ যে প্রশংসার পুনরাবৃত্তি না-করেই তাকে সহজে মুক্তি দেবেন, এটা তার মনে হচ্ছিলো না।

বিমার কিস্তির হার বলবার আগে আপনাকে একটু বিরক্ত করবো। আপনার এখন বয়স কত, সেটা একটু জানা দরকার।

একুত্রিশ। কিন-ফো জানালে।

একুত্রিশ? বিডুল্‌ফ তক্ষুনি জানালেন, একুত্রিশ বছর বয়সে অন্য কম্পানিতে আপনাকে শতকরা ২.৮৩ হিশেবে প্রিমিয়াম দিতে হবে কিন্তু সেন্টেনারিয়ানে লাগবে মাত্র ২.৭২ হিশেবে। দেখলেন তো, আমাদের কাছে এসে আপনার কত লাভ হলো। আচ্ছা দেখি : দু-লক্ষ ডলারের জন্য আপনাকে বার্ষিক ৫৪০০ ডলার প্রিমিয়াম দিতে হবে।

কিন্তু তা নিশ্চয়ই ও-সব সাধারণ আশঙ্কার জন্য,–কিন-ফো বাধা দিয়ে জিগেশ করলে।

হ্যাঁ, বিডুল্‌ফ সায় দিলেন।

কিন্তু সমস্ত আশঙ্কার বিরুদ্ধে, প্রতিটি বিপদের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে, আত্মহত্যার আশঙ্কার বিরুদ্ধে, বিমা করলে কত পড়বে? কিন-ফো জানতে চাইলো।

তা ঠিক–সেক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের হার অন্য– বলে বিডুল্‌ফ তার নোট বইয়ের পাতা উলটে একেবারে শেষ পাতায় চলে গিয়ে এক ছাপা তালিকা বার করলেন। এক নজর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি মুখ তুলে আস্তে-আস্তে বললেন, এ-ক্ষেত্রে আমরা বোধহয় শতকরা পঁচিশ–এই হারের কমে পারবো না।

তার মানে বার্ষিক পঞ্চাশ হাজার ডলার প্রিমিয়াম দিতে হবে, কিন-ফো বিশদ করতে চাইলো।

ঠিক তাই।

কীভাবে দিতে হবে টাকাটা? মক্কেল জানতে চাইলো।

বছরে একবারে থোক টাকাটাও দিতে পারেন, আবার ইচ্ছে করলে মাসিক কিস্তিতেও দিতে পারেন।

তাহলে প্রথম দু-মাসের প্রিমিয়াম হিশেবে কত টাকা দিতে হবে?

আগাম দিলে দু-মাসের জন্য দিতে হবে ৮,৩৩৩ ডলার। এখন–অর্থাৎ এপ্রিলের শেষে দিলে–৩০শে জুন তার মেয়াদ ফুরোবে।

পকেট থেকে নোটের তাড়া বের করে কিন-ফো তক্ষুনি সব চুকিয়ে দিতে চাইলো।

একটু ক্ষমা করতে হবে, বিডুল্‌ফ বললেন পলিসি চালু করার আগে আরেকটা ছোট্ট ব্যাপারে একটু নিয়মরক্ষা করে নিতে হবে।

তাই নাকি? তা সেটা কী, শুনি। কিন-ফো জিগেশ করলো।

আমাদের ডাক্তার গিয়ে আপনাকে একবার পরীক্ষা করে দেখবেন। আপনার এমন-কোনো অসুখ আছে কি না যার ফলে হঠাৎ একদিন আপনি দুম করে মরে যেতে পারেন, এ-বিষয়ে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন দিতে হবে তাঁকে।

কিন্তু, কিন-ফো বাধা দিলো, আমি যখন যাবতীয়, অসুখবিসুখ, বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, আত্মহত্যার বিরুদ্ধেই বিমা করছি, তখন এই ডাক্তারি পরীক্ষার প্রহসন আর কেন?

বিডুল্‌ফ আকর্ণ হাসলেন। এমনও তো হতে পারে যে এখুনি আপনার হয়তো এমন-কোনো অসুখ রয়েছে যার ফলে দু-মাসেই আপনাকে অক্কা পেতে হলো–তখন তো আমাদের দু-লক্ষ ডলার ডাহা লোকশান দিতে হবে!

কিন্তু আত্মহত্যার সম্ভাবনাই যখন রয়ে গেছে তখন অসুখ-বিশুখে আর বেশি কী ক্ষতি হবে, কিন-ফো একেবারে নাছোড়বান্দা।

মক্কেলের হাতটি নিজের করতলে গ্রহণ করে আস্তে চাপ দিয়ে বিডুল্‌ফ বললেন, আপনাকে কি আগেই বলিনি যে আমাদের কাছে যাঁরা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে বিমা করেন, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচেন? অবশ্য এই সঙ্গে আরেকটা তথ্যও আপনাকে জানাই : আমাদের এখানে বিমা করলে সেন্টেনারিয়ান সবসময় গোপনে আপনার সব-কিছুতেই কড়া নজর রাখবে। তাছাড়া কিন-ফোর মতো মস্ত ধনী যে কোনোকালে আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারেন, সেই সম্ভাবনা কি সুদূরপরাহত নয়?

কিংবা এমনও তো হতে পারে যে এ-কথাটা অত্যন্ত বেশি করে ভাবছে বলেই জীবন-বিমা করার কথা উদিত হয়েছে তার মনে। কিন-ফো উত্তর দিলে।

উঁহু, মোটেই তা নয়, বিডুল্‌ফও পালটা জবাব দিলেন, সেন্টেনারিয়ানে বিমা করার অর্থই হলো দীর্ঘজীবী হওয়া–শেষকালটা সুখে কাটানো।

যুক্তিতর্কে বিড়লফকে যে কাৎ করা যাবে না, কিন-ফো তা স্পষ্ট বুঝতে পারলে।

বিডুল্‌ফ জিগেশ করলেন, এই দু-লক্ষ ডলারের ওয়ারিশান কাকে করে যাবেন আপনি?

এ-কথাটাই আমি বলতে চাচ্ছিলুম, কিন-ফো উত্তর দিলে, আমি চাই যে আমার মৃত্যুর পর আমার প্রিয় বন্ধু ওয়াং পাক পঞ্চাশ হাজার ডলার, বাকি দেড় লক্ষ ডলার পান পেইচিঙের মাদাম লা-ও।

বিডুল্‌ফ তার নোটবইতে নির্দেশগুলো টুকে নিলেন, তারপর জানতে চাইলেন মাদাম লা-ওর সঠিক বয়স এখন কত।

মাদাম লা-ওর একুশ। কিন-ফো জানালো।

বিডুল্‌ফের চোখের তারায় কৌতুক ঝলমল করে উঠলো, এ-টাকা পেতে-পেতে তিনি থুরথুরে বুড়ি হয়ে যাবেন। আর আপনার বন্ধু ওয়াং–তার বয়েস–

পঞ্চান্ন—

আপনার দার্শনিক বন্ধুর হাতে এ-টাকা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই তো দেখছি না।

দেখাই যাবে, কিন-ফো দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

আপনি যদি একশো বছর বাঁচেন, তাহলে এখন যার বয়েস পঞ্চান্ন, সে আপনার মৃত্যুর পর টাকা পাবে বলে আশা করে থাকলে বোকামি করবে।

কিন-ফো কোনো কথা না-বলে ভদ্রতার যাবতীয় অভিব্যক্তি সমেত মাথা নুইয়ে তাকে অভিবাদন করে আপিশ থেকে বেরিয়ে এলো।

পরদিন সেন্টেনারিয়ানের ডাক্তার তার বাড়ি এলেন। তিনি সে-প্রতিবেদন পাঠালেন কম্পানিকে, তার ভাষা ছিলো এই রকম : শরীরের গঠন লোহার, পেশীগুলো যেন ইস্পাত, আর ফুশফুশ যেন অর্গানের হার।

কাজেই কিং-ফোর বিমার আবেদনপত্র অগ্রাহ্য করার কোনো কারণই উঠলো না। যথাকালে পলিসিতে নামসই করলো তারা। লা-ও আর ওয়াং অবশ্য–বলাই বাহুল্য-এ সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গও জানতে পেলো না। পলিসিতে যে তাদেরই ওয়ারিশান করা হয়েছে, এ-কথা জানার কোনো উপায় তাদের ছিলো না : কেবল যদি নানারকম জটিল ও অভাবিত পরিস্থিতি দেখা দেয়, তাহলেই হয়তো কোনোদিন এ-সম্বন্ধে তারা জানতে পারবে।

.

৭. মৃত্যুর উদ্যোগ

ভবিষ্যৎকে গোলাপি দেখে জে. উইলিঅম বিডুল্‌ফ যতই কেন-না খুশি হয়ে উঠুন, সেন্টেনারিয়ানের সামনে যে অচিরেই দু-লক্ষ ডলার হারাবার বিষম ফঁড়া খাঁড়ার মতো ঝুলছে তাতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন-ফো যে অবশেষে নিজের নিরুৎসুক জীবনে পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিতে চাচ্ছে, এ-বিষয়ে আর কোনো ভুল নেই। এত ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও এতকাল যখন বেঁচে-থাকা সম্বন্ধে তার কোনো উৎসাহ বা মোহ ছিলো না, তখন এই ভীষণ দারিদ্রের মধ্যে জীবনকে টেনে লম্বা করার ইচ্ছে যে তার থাকবে না, অন্তত তা যে নেই, এটা তো অত্যন্ত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

যে চিঠিটা সুন-এর জন্য অনেক দেরি করে তার হাতে এসে পড়েছিলো, তাতে এই সংবাদ ছিলো যে ক্যালিফরনিয়ার সেনট্রাল ব্যাঙ্ক হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সমস্ত লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ কিন-ফোর সব টাকাই ছিলো এই ব্যাঙ্কে; একেবারে লবি মহল থেকে সংগৃহীত এই সংবাদ; অচিরেই খবরের কাগজে এই নিয়ে তুমুল শোরগোল উত্থিত হবে। কিন-ফো যে নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত, এ-কথা তখন আর কারুই জানতে বাকি থাকবে না। ওই ব্যাঙ্কের বাইরে আর-কোথাও তার কোনো-এক কর্পদকও নেই; শাংহাইর বাড়িটা অবশ্য বেচে দেয়া যায়, কিন্তু তাতে এমন টাকা পাওয়া যাবে না, যাতে তার পোশাতে পারে, যাতে তার কোনোক্রমে দিন গুজরান হয়। হাতে যৎসামান্য যে-টাকা ছিলো, তাই দিয়েই বিমার কিস্তি দিয়েছে সে; অবশ্য তিয়েনৎসিন জাহাজ কম্পানিতে তার কিছু শেয়ার আছে–কিন্তু তাতে তার সমস্ত দায়দায়িত্ব আদৌ মিটবে না।

এ-রকম পরিস্থিতি উত্থিত হলে কোনো ইংরেজ বা ফরাশি হয়তো চাকরি-বাকরি করার কথা ভাবতে : খেটে খাবে না-হয়, তাতে আরকী! কিন্তু এ-সব ব্যাপারে ধনাঢ্য চিনেদের মতামত ভিন্ন : বরং, চাকরি-বাকরি করার চেয়ে, আত্মহত্যা করা ভালো; পরিত্রাণের এটাই সেবা উপায় বলে তাদের মনে হয়। অন্তত এক্ষেত্রে কিন-ফো যে সত্যিকার চিনেম্যান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এমনিতে চিনেদের সাহস বা বীরত্বের পরিচয় পাবার জো নেই; ছাই-ছাপা থাকে যেন তা; কিন্তু গোপনে তার বিকাশ হয় অদ্ভুতভাবে। মৃত্যুকে তারা যেন ধর্তব্যেই আনে না; এ-সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন। অসুখ-বিশুখে তারা কখনো কাতর হয় না; মাথার উপর মৃত্যু ঝোবুল্যমান জেনেও কোনো পাষণ্ড ভয় পায় না-নির্ভীকভাবে জল্লাদের সম্মুখীন হয়। মৃত্যুদণ্ড দেখে-দেখে, অপরাধীদের অসহ্য নিগ্রহ ও নির্যাতন দেখে-দেখে, সব চিনেম্যানই যেন কোনো খেদ ছাড়াই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে।

কাজেই তাদের আলাপ-আলোচনায় কথায়-বার্তায় প্রায়ই যে মৃত্যুর কথা ওঠে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। ও-দেশে সবাই পূর্বপুরুষদের পুজো করে, সার্বজনীন প্রথা এটা; কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদ–সবখানেই অন্তত একটা ঠাকুরঘর থাকবেই–সেখানে বাড়ির মৃত পরিজনদের নানা স্মৃতিচিহ্ন জমানো থাকে, আর মৃতদের সম্মানে প্রতি বছর দ্বিতীয় মাসে একটা করে উৎসবও হয়। নবজাতকের জন্য দোলনা আর বিয়ের পোশাক-আশাক যে-দোকানে বেচে, সেখানেই আবার পাওয়া যায় মৃতের জন্য কফিন : জন্ম মৃত্যু বিবাহ–এক দোকানেই সব চাহিদা মিটে যায়। সত্যি-বলতে আগে থেকে কফিন কিনে রেখে দেয়া আধুনিক চিনে বেশ আভিজাত্যের লক্ষণ; কফিন না-থাকলে বাড়িঘর যেন ফাঁকা ঠেকে চিনেদের কাছে : এমনকী কখনো আবার ছেলে তার বাবাকে শ্রদ্ধাভক্তির নিদর্শন রূপে কফিন কিনে উপহার দেয়; বাড়ির ঠাকুরঘরে রাখা হয় কফিনটা–বছর-বছর রং করা হয় কফিনটাকে, নানারকম কারুকাজ করা হয় ওই মেহগিনির কাঠের গায়ে, আর কখনো আবার এমনও হয় যে নশ্বর দেহের জীর্ণবিশেষ সমেত আস্ত কফিনটাই পোর না-দিয়ে ওই ঠাকুরঘরে সযত্নে রক্ষা করা হলো। এককথায় চিনেদের ধর্মভাবনার মূল ভিত্তিই হলো মৃতের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন : এটা বলতেই হয় যে তার ফলেই তাদের কুলগৌরবের ধারা ও সংগতি অব্যাহত থাকে।

কিন-ফো এমনিতে খুব ঠাণ্ডা, কিছুতেই উত্তেজিত হয় না; তাই একটুও কাতর না-হয়েই সে অনায়াসে মৃত্যুর কথা ভাবতে পারে। কেবল যে-দুজনের প্রতি তার একটু স্নেহ ছিলো তাদের জন্য তো টাকাকড়ির ব্যবস্থা করেই দিলো : এবার আর মরতে বাধা কোথায়? আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে সে মনে-মনে, কিন্তু একবারও তার এটা মনে হচ্ছে না যে আত্মহত্যা করাটা অন্যায় বা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে–এই বোধই তার ছিলো না বরং তার দৃঢ় বিশ্বাসই ছিলো এই-যে সে সম্পূর্ণ আইনসংগত কাজই করতে যাচ্ছে। এখন আর-কোনো দ্বিধা নেই তার মনে, সম্পূর্ণ মনস্থির করে ফেলেছে সে : এখন আর কারু ক্ষমতা নেই–এমনকী ওয়াং-এরও না–তাকে এই সংকল্প থেকে টলায়। ওয়াং অবশ্য কোনো সন্দেহই করেনি যে কিন-ফোর মনে এই আছে–সুনও তার হুজুরের হাবভাবে এমন-কিছু লক্ষ করেনি যাতে প্রভুর পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আঁচ পেতে পারে–কেবল একটা বিষয়ে তার একটু খটকা লেগেছিলো : তার ভুলচুকের জন্য কিন-ফো আজকাল আর তাকে মোটেই বকা-ঝকা করে না : মাঝে-মাঝে তার যে বকুনি বা মারটার প্রাপ্য হয়নি তা নয়–তবু সব দোষ সত্ত্বেও তার সাধের বরাহপুচ্ছ বা বেণীটি যে দিব্য বেঁচে যাচ্ছে–এতেই সে খুশি।

একটা কথা চিনে ভাষায় খুব শোনা যায় : বাঁচতে চাও তো কোয়ংতুঙে, আর মরতে হলে লাই-চু। এর অর্থ অবশ্যি খুবই সরল : ফুর্তি আর ভোগবিলাসের জন্য যা একটা লোকের লাগতে পারে, কোয়াংতুঙে তার সবই মেলে–আর লাই-চু হলো কফিনের ব্যাবসার রাজধানী। অনেক দিন আগেই কিন-ফো লাই-চু থেকে একটা চমৎকার কফিন এনে রেখেছিলো। কফিনটা শাংহাইতে পৌঁছোললা কেউই তা দেখে মোটেই অবাক হয়নিঃ সযত্নে একটা ঘরে রেখে দেয়া হয়েছিলো ওটা : মাঝে-মাঝে মোম মাখিয়ে তার যত্নও নেয়া হতো বেশ; কিন-ফোর কবে মৃত্যু হবে, কবে সেটা কাজে লাগবে সেইজন্যে অ্যাদ্দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি। কফিন-কেনার সময় কিন-ফো অবশ্য একটা শ্বেত মোরগও কিনেছিলো : ভূতপ্রেত যাতে কিন-ফোকে না-পেয়ে এই মোরগটার আত্মাতেই ভর করতে পারে।

কেবল কফিন কিনেই অবশ্য তুষ্ট হয়নি কিন-ফো। তার অন্ত্যেষ্টির সময় কী-কী করা হবে না-হবে, সে-সম্বন্ধে সে বিশদ নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলো : ইহলোকের কোনো ব্যাপারেই তার কোনো রুচি না-থাকলে কী হবে, পরলোক সম্বন্ধে সে কিন্তু মোটেই উদাসীন ছিলো না। পালা, খড় থেকে বানানো এক রকম দামি কাগজে সে তার যাবতীয় নির্দেশ লিখে রেখেছিলো : শাংহাই-র ইয়ামেনটা ওই তরুণী বিধবাকে দেবার পর ওয়াংকে যেন তা-ই পিং সম্রাটের বিখ্যাত তৈলচিত্রটি দেয়া হয়–সেন্টেনারিয়ানের টাকাকড়ি ছাড়াও ও-সব তারা পাবে; কীভাবে তাকে কবর দেয়া হবে, সে-বিষয়ে সমস্ত কথা সে লিখে গিয়েছিলো তারপর। যেহেতু তার কোনো আত্মীয় নেই, সেইজন্য তার শবযাত্রার মিছিলের পুরোভাগে যেন থাকে তার বন্ধুরা সবাইকে অবশ্য ধবধবে শাদা চৈনিক শোকবস্ত্র পরে আসতে হবে। গোরস্থান অব্দি রাস্তার দু-পাশে–শহরতলি দিয়ে যখন মিছিল যাবে–দুইসারে থাকবে দাসদাসীরা–তাদের হাতে থাকবে টাঙি, নীল ছাতা বা রেশমি পর্দা–কারু-বা হাতে থাকবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কর্মসূচি-লেখা মস্ত সব প্ল্যাকার্ড; তাদের পরনে নাকি থাকবে কালো আলখাল্লা, শাদা ঝাপ্পা, আর লাল টুপি। পুরোবর্তী বন্ধুবর্গের পরে কাঁসর বাজাতে-বাজাতে যাবে আপাদমস্তক রক্তিমবসন পরা এক কুলুজিরক্ষকতার পরে থাকবে কিন-ফোর একটি প্রমাণমাপের ছবি-তার চারপাশে ঝলমলে কাজ করা থাকবে। তারপর থাকবে আরেকদল বন্ধু–তাদের কাজ হবে একটু পরে-পরে মূৰ্ছিত হয়ে-পড়া, আর সেইজন্যেই একদল লোক কয়েকটা কুশান নিয়ে যাবে সঙ্গে-সংজ্ঞা হারালে যাতে শোয়ানো যায় তাদের। তারপর যাবে আরেকদল তরুণ, সোনালি-নীল চাঁদোয়া থাকবে রোদবৃষ্টির হাত থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য–আর তাদের কাজ হবে টুকরো-টুকরো শাদা কাগজ ছড়িয়ে দেয়া-কাগজগুলোর মধ্যে ছোট ফুটো থাকবে একটা করে–যাতে ওই ফুটো দিয়ে ভূতপ্রেত অপদেবতা সব চলে যায়–না-হলে তারাও তো সেই মিছিলে যোগ দিয়ে বসবে কিনা।

এর পরে আসবে অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো কফিন-বওয়া গাড়ি। আসলে অবশ্য গাড়ি নয়–মস্ত একটা পাল্কিতেই বসানো থাকবে কফিনটা– চারপাশে থাকবে সোনালি ড্রাগন আঁকা বেগনি রঙের রেশমি পরদা, পঞ্চাশজন বেয়ারা বয়ে নিয়ে যাবে সেই পাল্কি। আর তার দু-পাশে থাকবে দুইসারে পুরোহিত-ধূসর, লাল, আর হলদে রঙের আস্তিন ছাড়া কামিজ থাকবে তাদের পরনে। সমস্বরে সুর করে মন্ত্র আওড়াবে তারা, আর একেকটা মন্ত্র শেষ হলে তুমুলভাবে বেজে উঠবে কাঁসর-ঘণ্টা, শিঙা ও ক্ল্যারিয়োনেট। সব শেষে যাবে শোকাকুল ঘোড়ার গাড়ির সারি–কেচোয়ান ও জিনশুদু শাদা রঙের হবে–যাতে শোকের প্রকাশ সম্বন্ধে কোনো সংশয় না-থাকে।

কিন-ফো এটা ভালো করেই জানতো যে তার অন্ত্যেষ্টির জন্য এই যে নির্দেশ সে দিয়ে যাচ্ছে তা যথাযথ পালন করতেই তার অবশিষ্ট সম্পত্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে–কিন্তু তবু এটা একটা ভাবলে ভুল করা হবে যে সে খুব-একটা অদ্ভুত কাজ-করেছে-চিনেরা একে মোটেই কোনো অসাধারণ বাতিক বলে ভাববে না। কোয়াংতুং বা ক্যান্টন, শাংহাই কি পেইচিং-সর্বত্রই প্রায় রোজই এমনি শবযাত্রার মিছিল বেরোয় : মৃতকে সম্মান দেখাবার জন্য এটুকুই যদি না-করা গেলো তবে আর চৈনিকজন্ম সার্থক হবে কী করে?

কিন-ফো ঠিক করেছিলো পয়লা মে তারিখে সে ইহলোক থেকে চিরতরে বিদায় গ্রহণ করবে। এই স্থির করতে-করতে বেলা পড়ে গেলো; বিকেলবেলায় অবশেষে ল-ওর কাছ থেকে একটি চিঠি এসে হাজির। বিগতপতি এই তরুণী তার যথাসর্বস্ব–তার পরিমাণ অবশ্য খুব-বেশি নয়–দিয়ে দিচ্ছে তাকে; প্রতিবাদ করে সে জানিয়েছে যে কিন-ফোর সম্পত্তির প্রতি তার একটুও লোভ ছিলো না কখনও, এখনো নেই; তার ভালোবাসা অপরিবর্তিতই আছে–আর তা-ই থেকে যাবে চিরকাল; অল্প আয় তো হয়েছে কী–তাতেই তাদের তুষ্ট ও সুখী হতে বাধা কোথায়?

কিন্তু কিন-ফো তার সংকল্প থেকে নড়বার পাত্র নয়। আমার মৃত্যুর যাবতীয় ফসল সে ভোগ করুক, এটাই আমি চাই, আপন মনেই সে ঠিক করলো।

কীভাবে যে আত্মহত্যা করবে, সেটাই এখনো ঠিক করা বাকি রয়ে গেছে। এই বিষয়েই মনোনিবেশ করলে সে এবার। আশা করলে হয়তো শেষকালে জীবদ্দশায় কোনো আবেগ বা আকুলতার স্বাদ না-জুটলেও মৃত্যুর মুহূর্তে চরম কোনো উত্তেজনা ভোগ করে যেতে পারবে।

ইয়ামেনের চৌহদ্দির মধ্যে ছিলো চারটে ছোটো কিন্তু আশ্চর্যসুন্দর পটমণ্ডপ : এত সুন্দর চন্দ্রাতপ-সংবলিত মণ্ডপ বানাতে কেবল চৈনিক শিল্পীরাই পারে। মণ্ডপগুলির নাম কিন্তু খুব অর্থময় : সুখসন্তোষের মণ্ডপ বলা হতো একটাকে–কিন-ফো পারতপক্ষে কোনো দিন সেখানে যেতে চাইতো না; আরেকটার নাম ছিলো সৌভাগ্যের প্রেক্ষাগৃহ–কিন-ফোর সেটাকে চিরকাল জঘন্য ঠেকতোবমি পেতে যেন ওখানে যাবার কথা ভাবলেই; আরেকটির নাম ছিলো প্রমোদবিতান–যার সম্বন্ধে তার মনে কোনো আকর্ষণই ছিলো না; চতুর্থটির নাম ছিলো দীর্ঘপ্রাণের বনভবন!

কিন-ফো কেবল এটুকুই ঠিক করেছিলো যে সে-রাতে সে দীর্ঘপ্রাণের বনভবনেই রাত্রিবাস করবে, পরদিন প্রাতঃকালে সবাই আবিষ্কার করবে যে চিরনিদ্রার অসীম সুখে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। তবু আরেকটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বাকি থেকে গেলো তার-মরবে কী করে? জাপানিদের মত পেট চিরে ফেলবে, হারাকিরি করবে? মান্দারিনদের মতো রেশমি সুতো দিয়ে ফাঁস দেবে নাকি নিজেকে? না কি সুগন্ধি হামামের জলে শুয়ে থাকবে হাতের ধমনী কেটে ফেলে–অতীতের রোমক নাগরিকরা যেমন করতো; নানাভাবে আলোচনা করার পর কোনোটাকেই তার গ্রহণযোগ্য মনে হলো না; সবগুলোই কেমন অমানুষিক ও নৃশংস ঠেকলো তার কাছে; দাস-দাসীদের কাছে প্রতিটি পদ্ধতিই হয়তো অরুচিকর ঠেকবে। আফিমের কয়েকটি দানা আর তার সঙ্গে আরো নিশ্চিত ও সূক্ষ্ম কোনো বিষ মিশিয়ে নেয়াই বোধহয় সবচেয়ে ভালো : কোনো ব্যথা নেই, কষ্ট নেই–মুহূর্তে চলে যাবে সে ইহলোকের সব বন্ধনের বাইরে। হ্যাঁ, বিষ-মেশানো আফিমই সবচেয়ে ভালো। এবার মারণাস্ত্র নির্বাচন। করতে তার আর দেরি হলো না।

সুর্য যত পশ্চিমে ঢলে পড়লো তত সে অনুভব করলো যে আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র তার পরমায়ু–আর ততই শেষবার শাংহাইয়ের রাস্তায় বেড়াতে বেরুবার ইচ্ছা করতে লাগলো তার-ওয়াং-পো নদীর তীর ধরে এতকাল সে তার উদাসীন দিনগুলোয় অর্থহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে–আজ শেষবার ছলোছলো জলকল্লোল শোনবার ভারি ইচ্ছা করলো তার। সারা দিনে আজ একবারও ওয়াং-এর সঙ্গে দেখা হয়নি–ইয়ামেনের কোথাও তার দার্শনিক বন্ধু ও উপদেষ্টাকে দেখতে পায়নি কিন-ফো।

আস্তে-আস্তে সে ছাড়িয়ে এলো ইংরেজ বসতি। প্রণালীর উপরকার সাঁকো পেরিয়ে ঢুকে পড়লো ফরাশি অঞ্চলে; যতক্ষণ-না চৈনিক বন্দরে এসে পৌঁছুলো, ততক্ষণ ধরে জেটি ধরে সে এগিয়েই চললো, তারপর শহরের দক্ষিণ শহরতলির রোমান ক্যাথলিক গির্জে পর্যন্ত এসে ডান দিকে মোড় বেঁকে সে লউঙ-হো প্যাগোডার রাস্তা ধরলো।

এখানে কোনো বসতি নেই, সামনে খোলা প্রান্তর, মস্ত এক জলাভূমি চলে গেছে সামনে, অনেক দূরে–মিন উপত্যকার অরণ্যদেশ পর্যন্ত। আসলে এটা ধানখেতই–কেবল মাঝে-মাঝে খাল কেটে সেচের জল নিয়ে-আসা হয়েছে। সমুদ্র থেকে; আর দূরে-দূরে আছে কিছু জীর্ণ খোড়োবাড়ি, হলুদ মাটি-লেপা মেঝে সে-সব বাড়ির–আশপাশে জলের তলা থেকে ধানের চারা মুখ তুলে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এই সরু গলি দিয়ে লোক আসতে দেখে চারপাশের পশুপক্ষীরা চট করে পালিয়ে যাচ্ছে : কতগুলো কুকুর ডেকে উঠলো ঘেউ-ঘেউ, শাদা ছাগলগুলো হুড়মুড় করে সরে গেলো দূরে–হাঁস-মুরগিগুলোও কোলাহল করে ছিটকে চলে যেতে দেরি করলো না।

ধানখেত হলে কী হবে, কোনো আগন্তুকের কাছে এই জলা জায়গাটা বিশ্রী ঠেকবে। চিনদেশের সব শহরের বাইরেই যে-মস্ত প্রান্তরগুলো পড়ে থাকে সব কেমন যেন গোরস্থানের মতো ফাঁকা দেখায়। আর এখানে তো আশপাশে সত্যিই কত-যে কফিন এলোমেলো পড়ে আছে তার ঠিক নেই। কোথাও মাটির ঢিবি দেখে বোঝা যায় যে গোর দেবার জন্য মাটি কাটা হয়েছে–পিরামিডের মতো ওই মাটির ঢিবিগুলো উঠে গেছে উপরে–একটার চেয়ে আরেকটা বেশি উঁচু-যেন কোনো জাহাজ মেরামতের কারখানায় উঁচু মাচান। শোনা যায় যে তার শাসকরা নাকি কাউকে গোর দেয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছে–সত্যি-মিথ্যে কে জানে, কিন্তু এটা ঠিক যে একটার গায়ে আরেকটা কফিন দিয়ে-দিয়ে মাচান মতো করে ফেলে রাখা হয়েছে এখানে; কোনো কফিনের গায়ে চিনে দারুশিল্পীর চমৎকার কাজের নমুনা দেখা যায়–কোনো কফিনের গায়ে আবার কোনো কারুকাজই নেই। কোনো-কোনো কফিন ঝকমকে ও আনকোরা, কতগুলো কফিনের কাঠ আবার পচে গিয়েছে : যেন ঘুণাক্ষরে তাদের ধ্বংসের কাহিনী লেখা; কালক্রমে হয়তো সত্যিই এদের একদিন পোর দেয়া হবে–এখানে পড়ে পড়ে সেই অনাগত দিনেরই প্রতীক্ষা করছে তারা।

এই অদ্ভুত দৃশ্য অবশ্য কিন-ফোর আদৌ অচেনা নয়; সে এ-সবের দিকে তাকিয়েও দেখলো না একবারও; তাকালে ইওরোপীয় পোশাকপরা লোক দুটি কিছুতেই তার নজর এড়িয়ে যেতো না। ইয়ামেন থেকে তাকে কেবল চোখে-চোখে রাখা ছাড়া আর-কোনো উদ্দেশ্য বোধহয় তাদের নেই : কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পুরো রাস্তা তারা তারই মতো কখনো দ্রুত কখনো আস্তে হেঁটে চলে এসেছে। মাঝে-মাঝে নিজেদের মধ্যে কী-সব বলাবলি করেছে তারা কে জানে : স্পষ্ট বোঝা যায় তার উপর নজর রাখার জন্যই গোয়েন্দা হিশেবে তারা নিযুক্ত হয়েছে। দুজনেরই বয়েস ত্রিশের নিচে, দুজনেই স্বাস্থ্যবান ও ক্ষিপ্র, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, বেশ শক্ত-সমর্থ; কিছুতেই যাতে কিন-ফো তাদের চোখের আড়াল না-হয়, সে-সম্বন্ধে অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে সবসময়। প্রায় মাইল তিনেক যাবার পর কিন-ফো যখন পিছন ফিরলো, তখন গন্ধ-পাওয়া ডালকুত্তোর মতো তারাও তক্ষুনি ফিরে দাঁড়ালো।

রাস্তায় কয়েকটি জীর্ণ-শীর্ণ-হতশ্রী ভিখিরিকে দেখে কিন-ফো তাদের কিছু-কিছু ভিক্ষে দিতে ভোলেনি; এবার একটু এগিয়ে সে রাস্তায় কয়েকটি খ্রিস্টান চিনে রমণীকে দেখতে পেলো : ফরাশি মিশনারি রমণীদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছে তারা, পিঠে তাদের বাস্কেটরাস্তায় কোনো অনাথ শিশু দেখতে পেলে তাদের তুলে নিয়ে অনাথআশ্রমে পৌঁছে দেয়াই তাদের কাজ। লোকে কিন্তু তাদের ন্যাকাড়া-কুড়ুনি বলে ডাকে : আর সত্যি-বলতে রাস্তা থেকে তারা যা কুড়িয়ে নেয় তা কেবল ন্যাকড়ার ফালি ছাড়া বোধহয় আর-কিছু নয়। কিন-ফো তাদের হাতে মানিব্যাগ উপুড় করে দিলে। পাছু-নেয়া গোয়েন্দা দুটি অবাক হয়ে একটু মুখ চাওয়াচায়ি করলে : চিনেদের স্বভাবে তো এত বদান্যতা নেই! মাথা খারাপ না-হলে তো কোনো চিনেম্যান কিছুতেই এমন কাজ করবে না!

কিন-ফো যখন জেটির কাছে ফিরে এলো, তখন অন্ধকার করে এসেছে; কিন্তু জলে যাদের বাস, যারা শাম্পানে কি নৌকোয় থাকে, তাদের কর্মচাঞ্চল্যের কিন্তু অবসান হয়নি তখনো। চারপাশে শোরগোল শোনা যাচ্ছে, তারই মধ্যে হাওয়ায় ভেসে আসছে গানের কলি; কেউ গান গাইছে বোধহয়। কিন-ফো একটু থমকে দাঁড়ালো। পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেবার আগে শেষ গানটা শুনে গেলে মন্দ হয় না!

ওয়াং পো নদীর কালো জালের মধ্যে দিয়ে শাম্পান বাইতে-বাইতে একটি তরুণ তঙ্কাদিরি গান ধরেছে একা গলায় :

কুসুমে সাজাই আনমনা ছোটো ভেলা,
ধীরে পড়ে আসে বেলা।
স্তুতি করে বলি নীল দেবতাকে,
এখনো কি ঘরে ফেরাবে না তাকে–
ব্যাকুল হৃদয় খুঁজে ফেরে যাকে?
কবে সে আসবে? কাল?

কাল? কিন-ফো মনে-মনে ভাবলো, কাল এমন সময়ে আমি কোথায় থাকবো?

জানি না সে-কোন ঘন বরিষনে সে যে
গেছে কোনকালে সেজে।
চিনের দেয়াল পেরিয়ে কোথায়
গেছে সে, কে জানে! গোপন ব্যথায়
ভয়ে কেঁদে মরি : বোঝে না কি তাও?
আসবে না তবে কাল?

কতকাল হলো কোন দূরে চলে গেছে–
জানি না আছে কি বেঁচে?
কেন সোনা চেয়ে দূরে আছো পড়ে?
বসন্ত যায়, দুই পাখি* ওড়ে,
গোধূলিলগন অফুরান ঝরে
পড়ে যায়।–এসো কাল!

[* দুই পাখি–কিংবদন্তির দুই ফিনিক্স পাখি–চিনদেশে পরিণয়ের প্রতিভাস।]

ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেলো গানের সুর। কিন-ফোর মনে অদ্ভুত সব ভাবনা জেগে উঠলো। টাকাকড়িই যে পৃথিবীর সব-কিছু নয় তা সে মানে–কিন্তু টাকাকড়ি ছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকারও কোনো মানে হয় না, তার এই মত তবু পালটালো না।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলো সে। সেই গলদঘর্ম গোয়েন্দা দুটি অবশেষে তার উপর আর নজর রাখতে অক্ষম হলো। কিন-ফো নীরবে, সকলের অলক্ষিতে, দীর্ঘপ্রাণের বনভবনের দিকে এগিয়ে গেলো; দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েই চট করে আবার দরজা বন্ধ করে দিলো সে। অন্ধকারে ঢাকা ছোট্ট ঘর, কোথাও আলোর লেশমাত্র নেই; দেশলাই জ্বালিয়ে ঝুঁকে পড়ে মেঝের উপরকার কাঁচের লণ্ঠনটা জ্বেলে দিলো সে। হাতের কাছেই নিরেট সবুজ পাথরের একটা টেবিল পড়ে আছে; তার উপর রয়েছে এক বাক্স আফিং আর মারাত্মক কয়েক জাতের বিষ।

কয়েকদানা আফিং তুলে নিয়ে একটা লাল রঙের মাটির পাইপে ভরে নিয়ে সে ধূমপানের জন্য প্রস্তুত হলো৷ আর-কোননাদিন জাগবো না এই ঘুম থেকে, বললো সে।

কিন্তু হঠাৎ সে পাইপটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। গোল্লায় যাক সব, চেঁচিয়ে উঠলো সে, কোনো অনুভূতিই ইচ্ছে না আমার কোনো তীব্র স্বাদ ছাড়া মরা চলবে না–সেই স্বাদ মৃত্যুভয়েরই হোক কি অন্যকিছুরই হোক। এভাবে কোনো কিছু বোধ না-করেই নিঃসাড়ে মরে যাবো? তা হতেই পারে না! দীর্ঘপ্রাণের বনভবনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে বাইরে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ওয়াং-এর ঘরের দিকে।

.

৮. যে-চুক্তিটা ইয়ার্কি নয়

ওয়াং তখনো অবশ্য শুয়ে পড়েনি; একটা সোফায় হেলান দিয়ে বসে পেইচিং হরকরার শেষ সংখ্যাটা পড়ছিলো; তাতার সুলতানের স্তুতি পড়তে-পড়তে বারেবারে ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিলো তার।

কিন-ফো যেন ফেটে পড়লো ঘরের মধ্যে; নিজেকে একটা আরাম-কেদারায় ছুঁড়ে দিয়ে সে বলে উঠলো, ওয়াং, আমার একটা উপকার করতে হবে তোমায়!

আস্তে-আস্তে কাগজটা নামিয়ে রাখলো দার্শনিকবর। তুমি বললে একটা কেন, হাজারটা উপকার করার চেষ্টা করবো।

না-না, অত দরকার নেই–আপাতত একটা হলেই যথেষ্ট। আমি যা বলি, দয়া করে–তা-ই করো; বাকি নশো নিরানব্বইটা উপচিকিষা থেকে তোমায় আমি মুক্তি দেবো। এটা অবশ্য আগেই বলে রাখছি যে তার পরে কিন্তু তুমি আমার কাছে থেকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা কিছুই পাবে না।

তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন-ফো, ওয়াং বললো, একটু বিশদ করে বোঝাবে?

প্রথমে তোমাকে জানাই যে, গম্ভীর গলায় বললো কিন-ফো, আমি আমার শেষ কপর্দকটুকুও হারিয়ে বসেছি–একেবারে শেষ হয়ে গেছি আমি, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত!

সত্যি? ওয়াং এমনভাবে কথাটা বললো যে এ-কথা শুনে সে যে আদৌ বিচলিত হয়েছে তা মোটেই বোধ হলো না–বরং তার গলার স্বর শুনে উলটো ধারণাটাই হতে পারে।

হ্যাঁ, সত্যি। সুন যে-চিঠিটা দিতে ভুলে গিয়েছিলো, তার কথা মনে আছে তোমার? ওই চিঠিতেই এ-খবর ছিলো যে ক্যালিফরনিয়ার ব্যাঙ্ক লাল বাতি জ্বেলেছে। আমার কাছে তার অর্থ কী বুঝতে পারছো তো–একেবারে শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত হারিয়ে-বসা! এই ইয়ামেন, আর খুচরো হাজার খানেক ডলার কেবল আছে এই মুহূর্তে–ধারদেনা শোধ করতেই তা চলে যাবে–মাস-দুই চালাবার মতো সংগতিও আমার নেই।

তাহলে, ওয়াং বললে, ধনকুবের কিন-ফোর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে না। এখন?

না–এখন কিন-ফো একটি পথের ভিখিরি মাত্র; কিন্তু ধনী-নির্ধন– এ-সব বিশেষণে এখন আর-কিছু এসে-যায় না। দারিদ্রকে আমি মোটেই ভয় করিনি।

ঠিক বলেছো, সোফাছেড়ে উঠলো ওয়াং, যোগ্য কথা শুনতে পেলাম তোমার কাছে : আমার তাহলে উফুল্ল হবার মতো কিছু ফল হয়েছে। এতদিন কেবল একটা গাছ-পাথরের সঙ্গে তোমার তুলনা চলতো–এবার তুমি বাঁচতে শিখবে। কনফুসিয়ুস কী বলেছেন মনে করে দ্যাখো। যত দুঃখ আমরা চাই, তত আমরা কোনোদিনই পাই না। নিশ্চয়ই নুন সচুন-এর সেই কথাগুলো তোমার মনে আছে–সেই-যে : জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই; ভাগ্যের চাকা বিরাম জানে না, অবিশ্রাম তার ঘূর্ণন; দখিন হাওয়া থাকে অল্প দিনই; কিন্তু ধনী বা নির্ধন যা-ই হও না কেন, তুমি তোমার কর্তব্য করে যাও।” বৎস কিন-ফো, আমাদের এক্ষুনি পথে বেরিয়ে পড়তে হয় তবে : রুটি রোজগারের ধান্দায় বেরুতে হয় এবার তাহলে

দার্শনিকের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে বুঝি সেই মুহূর্তেই এই বিলাসভবন থেকে বেরিয়ে যাবে।

ধীরে, বন্ধু ধীরে–এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই, বললে কিন-ফো, দারিদ্রকে আমি ভয় করি না–এ-কথার অর্থ এই নয় যে আমি দারিদ্রকে সহ্য করতে যাচ্ছি–আমার উদ্দেশ্য মোটেই তা নয়।

তার মানে? তোমার উদ্দেশ্য কী তাহলে?

মরে-যাওয়া–

মরে-যাওয়া! দার্শনিকের কণ্ঠস্বর ঘৃণায় তীব্র হয়ে উঠলো, এটা তুমি নিশ্চয়ই ভালো করেই জানো যে যারা সত্যি-সত্যি আত্মহত্যা করতে চায়, তারা আগে থেকে ঢাক পিটিয়ে বেড়ায় না : বরং সবসময় তাদের ইচ্ছেটাকে গোপন রাখার চেষ্টাই তারা করে।

কিন-ফো অত্যন্ত শান্ত গলায় বললে, আমি যে এখনো বেঁচে আছি, তা নেহাই দৈবের দয়া!

কী বলতে চাচ্ছো তুমি?

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যখন দেখলুম সেই মুহূর্তেও কোনো তীব্র অনুভূতি হচ্ছে না, ওয়াং-এর কথা গ্রাহ্য না-করেই কিন-ফো বলে চললো, ঠিক তখনই আমি যে-বিষ খেতে যাচ্ছিলুম, তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তোমার কাছে এসেছি!

হুম, বুঝলুম। তখন বুঝি ভাবলে দুজনে একসঙ্গে মরাই ভালো, হেসে বললো ওয়াং।

মোটেই তা নয়। তুমি বেঁচে থাকো, আমি তা-ই চাই, ওয়াং।

কেন? আমার বাঁচা উচিত কেন? দার্শনিক জিগেশ করলো।

আমাকে খুন করার জন্য, বললো কিন-ফো, তোমার কাছ থেকে এই অনুগ্রহটা ভিক্ষে করতেই আমি এসেছি।

একেবারে আঁৎকে দেয়ার মতো প্রস্তাব; কিন্তু ওয়াং যে এ-কথা শুনে বিন্দুমাত্র অবাক হয়েছে, তা কিন্তু মোটেই মনে হলো না।

কিন-ফো সাগ্রহে অধীরভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলো–হঠাৎ তার মনে হলো ওয়াং-এর চোখের তারা যেন মুহূর্তের জন্য ঝিকিয়ে উঠলো। অতীতের সেই তাই-পিং তবে জেগে উঠলো নাকি তার রক্তে? এই দীর্ঘ আঠারো বছরের ব্যবধানও অতীতের সেই রক্ততৃষাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি? সেই ভুলে-যাওয়া আদিম আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গ কি নতুন করে আবার জ্বালিয়ে দিলো তাকে–রক্তে রাঙাবার জন্য হাতদুটি তার আবার নিশশিপ করে উঠেছে কি-তার আশ্রয়দাতার সন্তানের রক্তেই কি সে নতুন করে তার পিপাসা মেটাতে চায়?

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ থেকে সেই স্ফুলিঙ্গ নিভে গেলো। আরো গম্ভীর, আরো প্রশান্ত হয়ে এলো তার চোখমুখ। আস্তে গিয়ে আবার সে সোফাটিতে বসে পড়ে চিন্তিত স্বরে বললে, এই উপকারটিই তবে প্রার্থনা করতে এসেছিলে তুমি?

হ্যাঁ, তাই। বধ করো তুমি আমাকে–তার আগে তোমাকে জানিয়ে যাই যে তুমি আমাদের ঋণ বহুগুণে শোধ করেছে ওয়াং-তোমাকে কোনো পাপ স্পর্শ করবে না!

এ-কথা তুমি ভেবে বলছো, কিন-ফো? জানো, এ-কথার অর্থ কী? জানতে চাইলো ওয়াং।

খুব ভালো করেই জানি। বললো কিন-ফো, তুমি তো জানো যে ষষ্ঠ মাসের আঠাশ তারিখে অর্থাৎ পঁচিশে জুন আমার একুত্রিশ বছর পূর্ণ হবে। তার আগেই আমি মরতে চাই–আর তোমার হাতেই আমার মৃত্যু হবে–এই মর্মে একটা চুক্তি করে নিতে চাই আমি।

আমার হাতে? কবে? কোথায়? কীভাবে? ওয়াং জিগেশ করলো তাকে।

কবে, কোথায়, কীভাবে–এ-সব বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এ-সব আমি জানতেই চাই না। বসে কি দাঁড়িয়ে, ঘুমিয়ে কি জেগে, দিনে বা রাতে, প্রকাশ্যে বা গোপনে, ছোরা বসিয়ে কি বিষ খাইয়ে–এ-সব প্রশ্নের উত্তর তুমি খুঁজো, এ-সব জিজ্ঞাসার সমাধান তুমি কোরো। আমি শুধু বলতে চাই যে ওই তারিখের মধ্যেই যেন আমি তোমার হাতে মরি। কেবল একটা শর্ত আমি দিতে চাই–আমি যেন তা আগে থেকে টের না-পাই। এইভাবেই তাহলে পরবর্তী পঞ্চান্ন দিন আমি কোনোকিছুর প্রত্যাশায় কাটাতে পারবো–প্রতি মুহূর্তে ভাববো তবে–ওই বুঝি আমার মৃত্যু এলো–ওই বুঝি সব শেষ হয়ে যায়!”

কিন-ফো আগাগোড়া এমন উত্তেজিতভাবে কথা বলে যাচ্ছিলো, যে তা তার স্বভাবের সঙ্গে মোটেই মেলে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই অস্বাভাবিক আবেগ তার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। তার জীবনবিমার মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পাঁচ দিন আগেই সে নিজের আয়ুর সীমা টেনে দিতে চেয়েছে। কারণ এটা সে এই হঠাৎ-আসা বাঁধভাঙা আবেগ সত্ত্বেও জানে যে ওই বিমার দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দেবার মতো সংগতি তার মোটেই নেই।

দার্শনিক বসে-বসে চুপটি করে তার সব কথা শুনলো, মাঝে-মাঝে তাকিয়ে দেখলো তাকে–আর অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইলো ঘরের দেয়ালে ঝুলে-থাকা তাই-পিং সম্রাটের ছবিটার দিকে; এটা সে স্বপ্নও জানে না যে কিন-ফো তার ইষ্টিপত্রে তাকেই এই ছবিটা দিয়ে গেছে।

আমার বক্তব্য শুনলে তো, একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে কিন-ফো, তোমার কোনো আপত্তি নেই নিশ্চয়ই এই শর্তে–আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমার নিশ্চয়ই কিছু বলার নেই? আমাকে হত্যা করতে রাজি আছো আশা করি?

ব্যস্ত হয়ে সম্মতির ইঙ্গিত করলে ওয়াং। বিদ্রোহের সেই রক্তরাঙা দিনগুলোতেও এর চেয়েও কত ভীষণ কাজ তাকে যে করতে হয়েছে, হয়তো সে-সব কথাই এখন তার মনে পড়ে যাচ্ছে হঠাৎ। কিন্তু কিন-ফোর প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে সে উলটো আরেকটা প্রশ্ন করলো, তুমি ঠিক জানো যে বুড়ো বয়েস পর্যন্ত দিব্যি বেঁচে থাকার ইচ্ছে তোমার আর নেই।

তোমাকে বলি, ওয়াং, আমার সংকল্প আর বদলাবে না। থুরথুরে বুড়ো বড়োলোক হওয়াটাই মন্দের একশেষ-গরিব বুড়োমানুষ তো আরো অসহ্য।

আর পেইচিঙের সেই সুন্দরীটি? তার কথা ভেবেছো? না কি তাকে একেবারে ভুলে গিয়েছো তুমি? এই প্রবাদটা জানো না–উইলোর সঙ্গে উইলোর, ফুলের সঙ্গে ফুলের, আর হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ হলে শত বসন্তের হাওয়া দেয়?

কিন-ফো একটু তাচ্ছিল্যভরে কঁধ ঝাঁকালো। সেই শত বসন্তের হাওয়ার আগে যে একশোটা শীতকালের কনকনে হাওয়া বয়ে যাবে! চুপ করে কী যেন ভাবলো সে তারপর, বললো, না, লা-ও আমাকে বিয়ে করে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়বে। আশাভঙ্গের বেদনা ছাড়াও দুঃখে-বিষাদে ভরে যাবে সে। আমার মৃত্যুতে বরং সে কিছু টাকাকড়ি পাবে। আর তুমিও পাবে, ওয়াং-তোমার কথাও আমি ভুলিনি। তোমার জন্যে পঞ্চাশ হাজার ডলার রেখে গেছি আমি।

কোনো-কিছুই তো আর বাকি রাখোনি, সবকিছুই যে ভেবে ঠিক করে রেখেছো দেখছি, দার্শনিক বললো, আমাকে তো কোনো আপত্তিই তুলতে দিচ্ছো না!

উঁহু, এখনো একটা বাধা থেকে গেছে, কিন-ফো উত্তর দিলে, তুমি সে-কথা একেবারেই তুললে না দেখে আমি খুব অবাক হচ্ছি। আমাকে খুন করবে বলে যে রাজি হলে, তারপরে যে পুলিশ তোমায় খুনী বলে খুঁজে বেড়াবে

বোকা আর ডরপোকেরাই শুধু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, ওয়াং অর্থপূর্ণ মন্তব্য করলে, আমি ওই ঝুঁকি নিতে রাজি আছি।

তবু আমি আগে থেকেই তোমাকে রক্ষাকবচ দিয়ে যাই,কিন-ফো বললে, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়–এই মর্মে একটা চিরকুট লিখে দিয়ে যাবো তোমাকে। সেটা দিয়ে তুমি নিজেকে বাঁচাতে পারবে।

শান্তভাবে টেবিলের কাছে গিয়ে একটা কাগজে বড়ো-বড়ো হরফে খশখশ করে লিখে দিলে সে :

বেঁচে-থাকাটা এতই বিরক্তি আর অরুচি জাগাচ্ছিলো যে আমি নিজে থেকেই মৃত্যু প্রার্থনা করে নিয়েছি। কিন-ফো।

.

৯. উৎকণ্ঠা

নতুন মক্কেলের উপর নজর রাখবার জন্যে উইলিঅম জে. বিডুল্‌ফ যে-দুজন গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিলেন, সেন্টেনারিয়ানের আপিশে বসে পরদিন সকালে তাদের সঙ্গেই তার কথা হচ্ছিলো।

ক্রেগ বলছিলো, কাল সন্ধেবেলা তাকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিলুম-বেড়াতে শহর থেকে দূরে গিয়েছিলো সে।

ফ্রাই বললে, আর, তাকে দেখে কখনোই এটা মনে হয়নি যে সে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে

তার পিছন-পিছন আবার তার ইয়ামেনেই ফিরে এসেছিলুম আমরা, ক্রেগ জানালো।

কিন্তু, ফ্রাই সেই সঙ্গে যোগ করে দিলো, বাড়ির ভিতরে যাবার কোনো সুযোগ ছিলো না আমাদের।

আজ সকালবেলা সে কেমন আছে? বিডুল্‌ফ জিগেশ করলেন।

পালিকাও-র সাঁকোটার মতোই দিব্যি শক্তসমর্থ, একযোগে বলে উঠলো দুজনে।

আসলে ক্রেগ আর ফ্রাই তুতো ভাই। সত্যিকার আমেরিকান বলতে যা বোঝায় দুজনেই তার সেরা নজির। শ্যামদেশীয় যমজ হলেও বুঝি তাদের স্বভাব চরিত্রের এত মিল দেখা যেতো না। তাদের চিন্তাধারা এক মেধা অভিন্ন, অভিপ্রায়েও কোনো অমিল নেই–মনে হয় তাদের উদরও বুঝি একটাই। পরস্পরের হাতে-পায়েও বুঝি দুজনেরই সমান অধিকার রয়েছে। কথা বলার সময় একজনে কোনো বাক্য শুরু করলে, আরেকজনে সেটা শেষ করে।

না, বাড়ির ভিতরে ঢোকার কোনো সুযোগ সত্যি তোমাদের ছিলো না, বিডুল্‌ফ মন্তব্য করলেন।

গোয়েন্দা দুজন ঘোষণা করলো যে সেটা কখনোই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু তবু বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই হবে তোমাদের–যে-করেই হোক এ-কাজটা হাশিল করতে হবে, বিডুল্‌ফ বলতে লাগলেন, কম্পানি কিছুতেই দু-লাখ ডলার হারানোর ক্ষতি সহ্য করতে পারবে না। এই দু-মাস কিন-ফোর উপর কড়া নজর রাখতে হবে তোমাদের–যদি আরেক কিস্তির টাকাটা দেয়, তাহলে তো আরো বেশি দিন তাকে চোখে-চোখে রাখতে হবে।

বাড়িতে একটা চাকর আছে, ফ্রাই শুরু করলো।

ক্রেগ শেষ করলো, বোধকরি বাড়ির ভিতর কী হয়-না-হয় তার হদিশ সে বালাতে পারবে।

বেশ, তাহলে তাকেই পাকড়াও করো, বিডুল্‌ফ উত্তর করলেন, চিনেম্যানরা যে-সব জিনিশ ভালোবাসে, সেই সব ভেট দিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দাও তার সঙ্গে : সুরা, টাকা, চণ্ড–দরকার হলে সব-কিছু উৎকোচ দিতে হবে; তাহলেই দেখবে চটপট তোমাদের কাজ হাশিল হয়ে যাবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী গোয়েন্দা দুজন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুনের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেললো : এক গেলাশ মার্কিন সুরা বা যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমুদ্রা–কোনোটাতেই সুনের আদৌ কোনো অনীহা ছিলো না।

জেরা করে-করে তার পেট থেকে অনেক কথাই বের করে নেয়া গেলো। তার প্রভুর হাব-ভাবে ইদানীং কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েছে কি? না, তেমন-কোনো পরিবর্তন ঠিক দেখা যায়নি, তবে আজকাল সুনকে তিনি একটু বেশি লাই দিচ্ছেন। মারাত্মক অস্তর-টস্তর থাকে কি তাঁর কাছে? না, অস্ত্রশস্ত্র কিছুই তার কাছে থাকে না। বেঁচে থাকেন কেমন করে? অত্যন্ত শাদশিধে খাদ্য গ্রহণ করে। ঘুম থেকে ওঠেন ক-টার সময়? ভোর পাঁচটায়। সুন তার কাজে যোগ দেবার পর থেকেই দেখেছে যে রাতে নটা-দশটার বেশি তিনি কখনোই জেগে থাকেন না। সবসময়েই কি গোমড়া মুখে বসে-বসে ভাবেন? দেখে কি মনে হয় যে বেঁচে আর ভালো লাগছে না? না কি হতাশ অবসাদে আচ্ছন্ন থাকেন সবসময়? না, যদিও কোনোকালেই খুব ধুম-ধাম হৈচৈ আমোদ-আহ্লাদ খুব-একটা পছন্দ করতেন না, তাই বলে মুখকালো করে বসেও থাকতেন না; সত্যি-বলতে, দু-তিন দিন ধরে তাকে বরং আগের চেয়ে ঢের বেশি প্রফুল্লই দেখা যাচ্ছে। তার কাছে কি কোনো বিষের পুরিয়া আছে? হঠাৎ একদিন বিষ খেয়ে বসবেন বলে কি মনে হয়? উঁহু, অন্তত সুনের তো তা সম্ভব ঠেকছে না; সত্যি-বলতে আজই সকালে সুন গিয়ে কিন-ফোর কথায়। ওয়াং-পো নদীর জলে একগাদা আফিমের গুলি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছে–কিন-ফোর নাকি মনে হয় তা থেকে আচমকা কোনো বিপদ-আপদ হতে পারে।

বিডুল্‌ফের আশঙ্কা জাগাতে পারে, এমন-কোনো তথ্যই পাওয়া গেলো না এই জেরা থেকে। ধনীর দুলাল কিন-ফোকে এমন পরিতৃপ্ত ও প্রফুল্ল দেখা যায়নি কোনো দিন। তবু ক্রেগ আর ফ্রাই তাদের কর্তব্যকর্মে ঢিলে দেয়ার কথা ভাবতে পারলে না; একটুও আলগা করলো না তারা পাহারা–তাদের। গোয়েন্দাগিরি সব মান-সম্ভ্রম তো আর ধুলোয় লুটোবার ঝুঁকি নেয়া যায় না–আগের চেয়েও তীক্ষ্ণ চোখে ও দৃঢ়তর অধ্যবসায়ের সঙ্গে তারা কিন-ফোর উপর নজর রাখতে লাগলো; একটা মাছিও যাতে তাদের নজর এড়িয়ে গলে যেতে না-পারে সে বিষয়ে সাবধানতার কোনো কমতি ছিলো না তাদের; সব শুনে-টুনে এটা তারা ধরেই নিয়েছিলো যে নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করার মলব কিন-ফোর নেই, তাই কিন-ফো বাড়ি থেকে। বেরোলেই তারা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তার পাছু নেয়; তাছাড়া সুনের সঙ্গে আরো চুটিয়ে বন্ধুতা করলে তারা, আর এমন হাতখোলা ও দরাজদিল বন্ধু। পেয়ে সুনের মুখের কুলুপ খুলে গেলো।

আর কিন-ফো নিজে? যেই সে ঠিক করছে যে আর বেশিদিন বেঁচে থাকবে না, অমনি যেন জীবনের জন্য মমতা গজাতে আরম্ভ করেছে তার মধ্যে। কী-হয় কী-হয় এই উৎকণ্ঠা, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা, অনিশ্চিতি আর সন্দেহ–সব মিলিয়ে তার মধ্যে এমন রোমাঞ্চ আর এমন উত্তেজনার সৃষ্টি হতে লাগলো, যার স্বাদ সে আগে কোনো দিনই পায়নি। মাথার উপর সে নিজেই ঝুলিয়ে দিয়েছে দামোক্লেসের খড়গ–সেই অনিবার্য কুঠার যে কখন বিদ্যুৎগতিতে নেমে আসে তার কোনো স্থিরতা নেই বলেই প্রতিটি মুহূর্ত এখন তার পরম উত্তেজনায় কেটে যায়।

সে-রাতে ওই চুক্তি করে নেয়ার পর থেকে কিন-ফো আর ওয়াং-এর মধ্যে আর-কোনো কথা হয়নি । বস্তুত তাদের মধ্যে আর দেখাই হয়নি; হয়তো দার্শনিক ওয়াং আজকাল বেশির ভাগ সময়ই বাড়ি থাকে না, আর নয়তো নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে-বসে সে ভাবে কেমন করে কিন-ফোকে বধ করা যায়–হয়তো তাই-পিং বিদ্রোহীদের দলে থাকার সময় নরহত্যার যে-সব পদ্ধতি সে জেনেছিলো তা-ই মনে-মনে বিচার করে দেখছে কিন-ফোর বেলায় তার কোনটা প্রয়োগ করা যায়। ওয়াং কী করে সময় কাটাচ্ছে আজকাল, এ-সম্বন্ধে অনেক রকম অনুমানই শুধু করতে পারে কিন-ফো; কিন্তু ওই অনুমান করতে গিয়েই নতুন আরেকটি চেতনার সঙ্গে পরিচয় হলো কিন-ফোর, তার নাম কৌতূহল; কিন্তু কৌতূহল তাকে আর এক মুহূর্তেরও স্বস্তি দিচ্ছে না।

এখন কেবল খাবারটেবিলেই দেখা হয় দুজনের–কিন্তু কথাবার্তা হয় খুবই সাধারণ বিষয়ে। তাছাড়া ওয়াংকে আজকাল কেমন চাপা আর বিষণ্ণ ঠেকে, কথাবার্তা খুব কম বলে; চোখ কেমন যেন উদাস ও শূন্য থাকে–তার চশমার মস্ত কাঁচগুলোও তা গোপন রাখতে পারে না; আগে বেশ খেতে পারতো সে; এখন যেন কিছুই আর মুখে রোচে না; কোনো সুখাদ্য বা মূল্যবান মদ্য তার আহারে রুচি দিতে পারে না। ওদিকে কিন-ফো আজকাল প্রতিটি খাবারই তারিয়ে-তারিয়ে খায়। অসম্ভব খিদে পায় তার আজকাল, রোজ সে যে কেবল প্রচুর খাচ্ছে তা-ই নয়, হজমও করে ফেলছে অনায়াসে। এটা অন্তত বোঝা যাচ্ছে ওয়াং আর যা-ই করুক তার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়ে তাকে মারতে চায় না।

যে-অদ্ভত কর্মের ভার পড়েছে ওয়াং-এর উপর, তা সম্পন্ন করার সব সুযোগই তার আছে : কিন-ফোর শোবার ঘরের দরজা আজকাল হাট করা থাকে; দিন-রাতে যখন খুশি অনায়াসে সে-ঘরে ঢুকতে পারে ওয়াং, ঘুমন্ত বা জাগ্রত–যে-কোনো মুহূর্তেই সে ছোরা বসাতে পারে তাকে। এভাবে যদি ওয়াং তাকে আক্রমণ করে, তাহলে যা-যা হতে পারে, সব ভেবে দেখেছে কিন-ফো : ভগবান করুন ওয়াং-এর হাত যেন ফসকায় না, ছোরাটা যেন। সোজা তার বুকে বসে যায়। কিন্তু ভাবনাটায় কিন-ফো দু-এক দিনেই এত অভ্যস্ত হয়ে গেলো যে শেষকালে কয়েকদিন পরেই সে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগলো; রাতের বেলা শোবামাত্র গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়ে, সকালে যখন ওঠে তখন বেশ ঝরঝরে আর হালকা লাগে নিজেকে।

মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলো ওয়াং, এতকাল কত যত্নআত্তি পেয়েছে সে-এখানে; হয়তো সেই জন্যেই এই বাড়ির ভিতর রক্তপাত করতে তার হাত উঠছে না–কিছুদিন পরে অন্তত এই রকমই মনে হলো কিন-ফোর। ফলে এই মুশকিল আসান করার জন্য, আর তাকে সব দিক দিয়ে সুযোগ করে-দেবার জন্য কিন-ফো রোজ একা শহর ছাড়িয়ে দূরে-দূরে। বেড়াতে যেতে লাগলো–যে সব রাস্তায় লোক চলাচল কম, সে রাস্তাগুলোই বেছে নেয় সে সবসময়। গভীর রাত অব্দি শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত পল্লিতে সে সময় কাটায়। রোজ-রোজ সে-সব পাড়ায় রক্তপাত হয়, ছুরি-ছোরা চলে–কিন্তু ওয়াংকে সবরকম সুযোগ দেয়া চাই তো! অন্ধকারে সরু গলি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে শেষরাত অব্দি–মাতাল আর নেশাখোরেরা টলতে টলতে চলে যায় তার আশপাশ দিয়ে, ধাক্কা দেয় কখনো, নেশার ঘোরে প্রলাপ বকে–শেষে ভোর হয়ে আসে; দূরে মিষ্টিওলাদের ঘুন্টি আর হাঁক শোনা যায় : মান-তৌ মান-তৌ! কিন্তু সব ফিয়ার লেন থেকেই দিব্যি বহাল তবিয়তে ফিরে আসে সে; এটা সে এখনো টের পায়নি যে যতই উড়নচণ্ডি তার চলা-ফেরা হোক না কেন, ক্রেগ আর ফ্রাই এই দুই মাসতুত ভাইয়ের কড়া নজর সে মুহূর্তের জন্যও এড়িয়ে যেতে পারে না।

এই ভাবেই যদি দিন কাটতে থাকে, তাহলে–কিন-ফো মনে-মনে ভীত হয়ে উঠলো–শেষকালে তার ওই নিস্পৃহ ও নিঃসাড় দিনগুলো না আবার ফিরে আসে! এখনি তো ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে অথচ একবারও ওই আসন্ন মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে না।

মে মাসের বারো তারিখে অবিশ্যি এমন-একটা ঘটনা ঘটলো, যা তার কল্পনাকে আবার উশকে দিয়ে গেলো। ওয়াং-এর ঘরের দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো কিন-ফো। হঠাৎ ভিতরে চোখ পড়ে যায় তার, তাকিয়ে দ্যাখে একটা মস্ত ধারালো ছুরি হাতে নিয়ে ওয়াং আঙুল বুলিয়ে তার ধারটা কেমন আছে পরীক্ষা করে দেখছে; দেখেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো থমকে গেলো কিন-ফো : তাকিয়ে দেখলো একটা গাঢ় বেগুনি রঙের অত্যন্ত সন্দেহজনক বোতলে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলো ওয়াং; তারপর টেনে তুলে শূন্যে সেটাকে উঁচিয়ে ধরলো–আর তার মুখের ভাব বদলে গিয়ে কেমন যেন ভয়ংকর হয়ে উঠলো, যেন তার শরীরের সব রক্ত চোখে উঠে এসেছে।

ওয়াং যাতে টের না-পায় যে সে সবই দেখতে পেয়েছে, এই ভেবে কিন-ফো তাড়াতাড়ি পা টিপেটিপে চলে গেলো। হুম! এই ব্যাপার তাহলে! তা ভালোই হলো! খাশা! তোফা! চমৎকার!

সারা দিন আর কিন-ফো ঘর ছেড়ে একবারও বেরুলো না; কিন্তু ওয়াং আর কিছুতেই আবির্ভূত হলো না। রাত এলো, কিন-ফো শুয়ে পড়লো চটপট; সকাল হয়ে এলো–কিন্তু তখনও দিব্য বহালতবিয়তে বেঁচে আছে সে। কিঞ্চিৎ রুষ্টই হলো কিন-ফো। ব্যাপারটা বড্ড বিরক্তিকর হয়ে উঠছে না? খামকাই এতটা উত্তেজিত হয়েছিলো সে–এখন তার সব অনুভূতিই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে! আস্ত একটি লেটলতিফ এই ওয়াং, গড়িমশি করেই দশটা দিন কাটিয়ে দিলে! হচ্ছে হবে করে সময় কাটাতে পারছে সে কী করে? নিশ্চয়ই শাংহাইয়ের ভোগ-বিলাস তাকে একেবারে দুর্বল করে দিয়ে গেছে–বুকের পাটা বলে কিছুই আর নেই তার।

ওয়াং এদিকে আরো শুকিয়ে যেতে লাগলো। সবসময়েই মুখ কালো হয়ে আছে তার, কেমন যেন বিষণ্ণ আর করুণ হয়ে আছে–কেবল ছটফট করে, এক মুহূর্তও যেন স্বস্তি পায় না। অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়ায় সে ইয়ামেনে; লাই-চু থেকে দামি কফিনটা এনে যে-ঘরে রাখা হয়েছে, বারেবারে সেই ঘরটায় গিয়ে ঢুকে পড়ে। ইতিমধ্যেই সুনের কাছ থেকে কিন-ফো জেনে গিয়েছে যে ওয়াং নাকি সেই কফিনটার ধুলো ঝেড়ে সাফসুফ করে রঙ করার হুকুম দিয়েছে। ফিশফিশ করে সুন জানালো, আপনার আরামের জন্য সব সাফসুফ করে রাখছেন তিনি। আপনার যাতে কোনো কষ্ট না-হয়, সেদিকে তার কড়া নজর।

আরো তিনটি দিন কেটে গেলো, কিন্তু কোনোকিছুই ঘটলো না। তাহলে কি ওয়াং একেবারে শেষ দিনে বুকে ছুরি বসাবার কথা ভাবছে? যতক্ষণ-না পুরো সময় উৎরোচ্ছে, ততক্ষণ কিছু করার মতলব তাহলে তার নেই? তা-ই। যদি হয়, তাহলে তো এই মৃত্যুতে মোটেই কোনো বিস্ময় রইবে না।

পনেরো তারিখে আরেকটা অর্থপূর্ণ খবর কানে এলো কিন-ফোর। গত রাতটা তার অদ্ভুত ছটফটানির মধ্যে কেটেছে; সকালে, ছটার সময়, একটা ভারি বিশ্রী মন-খারাপ-করা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে তার : স্বপ্নে দেখেছে নরকের অধীশ্বর যুবরাজ ইয়েন তাকে ডেকে ভীষণ হুকুম দিচ্ছেন যে চিন সাম্রাজ্যের আকাশে দ্বাদশ সহস্রতম চাঁদ না-ওঠা পর্যন্ত সে যেন যুবরাজের ধারে কাছে না-ঘেঁষে। তার মানে আরো একশো বছর বেঁচে থাকতে হবে তাকে, আরো এ ক শো টি ব ছ র! নাঃ, তার সংকল্পে বাধা দেবার জন্যই যেন সবাই এখন একযোগে ষড়যন্ত্র করছে। ফলে সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলো, মেজাজ তখন তেরিয়া হয়ে আছে। সুন যখন সকালে তাকে পোশাক-আশাক পরাতে এলো, তখন তো সে জগতের উপর রেগে টং হয়ে আছে!

বেরিয়ে যা ঘর থেকে–মেরে তাড়াবার আগে বেরিয়ে যা, রাস্কেল!

এ-ক-দিন সদয় ব্যবহার পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো সুন; হঠাৎ এই সম্ভাষণ শুনে সে একেবারে আঁৎকে উঠলো। কিন্তু একটা জরুরি খবর পৌঁছে দিতে হবে বলে তার আর পশ্চাদপসরণ করা হলো না।

বেরিয়ে যা বলছি, হুংকার দিয়ে উঠলো কিন-ফো।

আমি কেবল বলতে চাচ্ছিলুম যে–সুন শুরু করলো।

বেরো, স্কাউনড্রেল কোথাকার! কিন-ফোর গর্জন।

যে ওয়াং-সুন তবু বলবার চেষ্টা করলো।

ওয়াং! হুঁ, তা ওয়াং কী করেছে? কিন-ফে তার বেণী ধরে টান দিলো সজোরে।

বেণীটা উদ্ধার করার জন্য কত রকম কায়দা করলো সুন–যত চোট বুঝি তার বেণীর উপর দিয়েই যায়, এই ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো সে; কিন্তু কিন-ফোর বারংবার প্রশ্নের উত্তরে শেষকালে তাকে বলতেই হলো : আপনার কফিনটা দীর্ঘপ্রাণের বনভবনে নিয়ে যেতে বলেছেন তিনি!

হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে কিন-ফোর সারা মুখ ভরে গেলো। তাই নাকি?

হা, সেই হুকুমই তো দিয়েছেন।

নে, এই দশটা তায়েল নে। যা, দেখে আয়–ওর হুকুম যেন চটপট পালন করা হয়।

সুনের আর বিস্ময়ের সীমা রইলো না; তায়েল দশটা কুড়িয়ে নিয়ে সে হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কর্তার যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে, এ-বিষয়ে তার একটুও সন্দেহ নেই। ভাগ্যিশ, পাগলামিটা এমন বদান্যতাতেই সীমাবদ্ধ।

এবার কিন-ফো একেবারে নিঃসন্দেহ হলো। অবশেষে যে দীর্ঘপ্রতীক্ষিত সংকটকাল আসন্ন, ওয়াং-এর এই হুকুমই তার স্পষ্ট প্রমাণ! কিন-ফো নিজে যেখানটায় আত্মহত্যা করতে চাচ্ছিলো, ওয়াং যে তাকে সেখানেই বধ করার সংকল্প করেছে, এ-সম্বন্ধে তার কোনো সংশয় রইলো না। ঈশ! কী আস্তে যে কাটলো দিনটা–এত বড়ো দিন বোধহয় কোনোদিন আর আসেনি। ঘড়ির কাটাগুলো অবধি যেন কুঁড়ের বাদশা হয়ে গেছে-নড়তেই চায় না মোটে। কিন্তু তবু একসময় ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো, রাত নেমে এলো ইয়ামেনের উপর।

দীর্ঘপ্রাণের বনভবনেই রাত কাটাবার সংকল্প করেছিলো কিন-ফো। ঢোকবার সময় সে স্থির জানতো যে আর সে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে না ভিতর থেকে। একটা নরম সোফায় শুয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগলো। আশপাশে কেউ কোথাও নেই; সব কেবল স্তব্ধ, চুপচাপ ও থমথমে; সাত-পাঁচ, কত এলোমেলো কথা মনে পড়ে যেতে লাগলো তার; অতীতকে এখন কোন দূর স্বপ্নের মতো মনে হলো তার–তেমনি অবাস্তব ও তেমনি ঠুনকো পলকা; মনে পড়ে গেলো কী ভীষণ নির্বেদ আর নিস্পৃহা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো এতকাল; সম্পদের চেয়ে দারিদ্রই বা ভালো হলো কোথায়? মনে পড়ে গেলো লা-ওকে; তার স্মৃতির ভিতর সে-ই শুধু ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল; এখনও তার ভালোবাসার কথা মনে পড়ে বুকটা কেমন করে উঠলো, নিশ্বাস দ্রুত এলো; কিন্তু না–তার দুর্দশায় ওই দেবীকে সে টেনে আনতে চায় না।

রাত নিঃঝুম হয়ে এসেছে; সমস্ত প্রকৃতি যেন ঘুমিয়ে পড়েছে–কি চেতন কি অচেতন–কেউ কোথাও জেগে নেই। কিন-ফো উৎকর্ণ হয়ে শোনবার চেষ্টা করলো। তার চোখ দুটো যেন অন্ধকার ভেদ করে তন্নতন্ন করে কাকে খুঁজতে চাচ্ছে। কতবার যে মনে হলো কেউ বুঝি দরজার কুলুপ খোলবার চেষ্টা করছে। আতঙ্ক আর কামনায় মেশানো সে-এক ভীষণ অনুভূতি! ঘুমিয়ে পড়ছে না কেন সে? তার সুপ্তির মধ্যেই না-হয় তাই-পিং-এর সর্বনেশে আবির্ভাব হোক!

কিন্তু আস্তে-আস্তে সকাল হয়ে এলো। তখন সূর্য ওঠেনি, কেবল পুবদিকটায় একটু শাদা ছোপ দিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ সশব্দে বনভবনের দরজা খুলে গেলো। সময় হলো তবে এতক্ষণে! ধড়মড় করে উঠে বসলো কিন-ফো! যেন একটা ছিন্ন প্রায় মুহূর্তের বৃন্তে থরথর করছে তার সমস্ত জীবন।

কিন্তু এ তো ওয়াং নয়! এ যে সুন! তার হাতে একটা চিঠি, আর চিঠির গায়ে বড়ো-বড়ো করে লেখা : জরুরি! এক ফোঁটাও দেরি না করে নিয়ে এসেছি, প্রভুকে জানালো সুন।

কিন-ফো চিঠিটা একরকম ছিনিয়েই নিলে তার হাত থেকে। সান ফ্রান্সিসকোর ডাকঘরের ছাপ খামের উপর। খাম খুলে চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিতেই সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো তার কাছে। ক্ষিপ্তের মতো ছুটে বেরুলো কিন-ফো ঘর থেকে, ডাক দিলো : ওয়াং, ওয়াং!

তীরের মতো ছুটে গেলো সে দার্শনিকের কোঠায়, পরমুহূর্তেই আবার বেরিয়ে এলো তেমনি সবেগে; তখনো সে গলা ফাটিয়ে ডাক দিচ্ছে : ওয়াং, ওয়াং, ওয়াং!

কিন্তু ওয়াংকে কোথাও পাওয়া গেলো না। তার বিছানা দেখে বোঝা গেলো রাতে কেউ তাতে শোয়নি। ডেকে ভোলা হলো সব লোকজনকে। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো গোটা ইয়ামেন : ওয়াং-এর কোনো চিহ্নই পাওয়া গেলো না–অত বড়ো মানুষটা যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে–ঠিক কর্পূরের মতো যেন। ওয়াং যে এখান থেকে পিঠটান দিয়েছে, তাতে আর-কোনো সন্দেহই নেই এখন!

.

১০. কড়া পাহারা

সব ধাপ্পা, জানেন বিডুল্‌ফ, বিলকুল ধাপ্পাবাজি! সান ফ্রান্সিসকোর চিঠিটা পাবার পরেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেন্টেনারিয়ানের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কিন-ফো; উত্তেজিতভাবে হাত-পা নেড়ে সে আবার বললে, মার্কিন ব্যাবসাদারির একটা কারদানি ছাড়া আর কিছুই নয় এই ব্যাপারটা!

তা যা-ই বলুন, তারা যে খুবই চালাক, এটা তো মানবেন, অত্যন্ত মোলায়েমভাবে জানালেন বিডুল্‌ফ, সবাই বিশ্বাস করে বসেছিলো তো–তাদের চাল তো সফল হয়েছে।

অন্তত আমার লোক যে বিশ্বাস করেছিলো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, বললে কিন-ফো, কিন্তু এই চিঠিতে সে জানাচ্ছে হঠাৎ সব লেনদেন বন্ধ করে দেয়াটা ছিলো নাকি ব্যাবসারই একটা চাল। –হুঁড়মুড় করে শেয়ারের দর শতকরা আশি টাকা পড়ে যায়–কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার সব কাজকারবার শুরু হয়েছে। ব্যাঙ্ক নিজেই সব শেয়ার কম দামে কিনে নিয়েছে–; এ-সম্বন্ধে তদন্ত হতেই দেখা গেলো যে সব উত্তর তাদের মুখাগ্রে। বাকি অংশীদারদের এবার তারা শতকরা পৌনে দুশো করে মুনাফা দেবে। এই চিঠি না-পেলে আমি তো ধরে বসে রইতুম যে একেবারে দেউলে হয়ে গেছি।

হুম, বিডু বললেন, আর দেউলে হয়ে গেছেন ভেবেই বুঝি আত্মহত্যার সংকল্প নিয়েছিলেন?

অনেকটা তাই–তবে, না ব্যাপারটা ঠিক তা ছিলো না। যে-কোনো মুহূর্তে খুন হয়ে যাবো বলেই প্রত্যাশা করেছিলুম আমি।

তা আত্মহত্যাই করুন, আর খুনই হোন–মোদ্দা ব্যাপারটা আমাদের কাছে সমান : কড়কড়ে দু-লাখ ডলার লোকশান দিতে হতো আমাদের। আপনি যে এখনো বেঁচে আছেন, এইজন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাই, বলে খাঁটি মার্কিন কেতায় বিডুল্‌ফ কিন-ফোর করমর্দন করলেন।

ম্যানেজারের কাছে এ-বার সব কথাই খুলে বললো মক্কেলটি। একটি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে তাকে হত্যা করার জন্য সে যে এক বন্ধুর সঙ্গে চুক্তি করেছে, খুনের জন্য বন্ধুটি যাতে কোনো শাস্তি না-পায় এইজন্য সে যে একটি অভয়পত্র লিখে দিয়েছে–এ-সব কোনো কথাই কিন-ফো আর গোপন করলো না।

কিন্তু বিষম ব্যাপারটা এই-যে, কিন-ফো জানালো, চুক্তিটা বহালই আছে এখনো। চুক্তি অনুযায়ী আমাকে খুন করতেই হবে তাকে–আর সে যে মোটেই তার কথার কোনো খেলাপ করবে না, নির্দিষ্ট দিনের মধ্যেই সে যে আমাকে খুন করবে–তাতে আমার কোনো সন্দেহই নেই।

তা এই ভাড়াটে আততায়ীটি কি সত্যি আপনার বন্ধু? বিডুল্‌ফ জানতে চাইলেন।

হ্যাঁ। শুধু তা-ই নয়, আমার মৃত্যুর পর সে পঞ্চাশ হাজার ডলার পাবে।

হুম! হ্যাঁ, এবার বুঝলাম। বন্ধুটি নিশ্চয়ই দার্শনিক ওয়াং–আপনার বিমায় যাঁর নাম আছে। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই এমন বিষম কাজ করার মতো লোক নন?

কিন-ফো আরেকটু হলে বলেই ফেলতো যে-”আপনি ভুল ভেবেছেন, বিডুল্‌ফ; আসলে সে একজন তাই-পিং–এর আগে সে এমন-সব দুষ্কর্ম করেছে যে তার শিকাররা সবাই যদি সেন্টেনারিয়ানের মক্কেল হতো, তবে কোনকালেই কম্পানিকে লাল বাতি জ্বেলে পাততাড়ি গুটোতে হতো কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে শামলালো কিন-ফোনা, ওয়াংকে সে কিছুতেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারবে না। ওই তাই-পিং বিক্ষোভের রক্তরাঙা দিনগুলোর পর আঠারো বছর কেটে গেছে–কিন্তু তবু এখনো কেউ যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পায় যে ওয়াং ওই তাই-পিংদের একজন ছিলো, তাহলে শাসকগোষ্ঠীর রোষ থেকে তার আর নিষ্কৃতি নেই। সে যে ওয়াং-এর কৃতকর্মের নজির থেকে জানে ওয়াং যেমন করেই হোক চুক্তির সব নির্দেশ পালন করবে, এ-কথা সে সেইজন্যেই জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছিলো না।

একটু ভেবে বিডুল্‌ফ আবার বললেন, তাহলে আর কী, একটা খুব সোজা রাস্তা খোলা আছে আপনার কাছে–ওয়াং-এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করুন, গিয়ে বলুন যে চুক্তিটা আপনি বাতিল করে দিতে চাচ্ছেন এখন : সব বুঝিয়ে-শুঝিয়ে তার কাছ থেকে ওই অভয়পত্রটা ফেরৎ নিয়ে নিন।

ও-কথা বলাই, খুব সহজ, কিন-ফো উত্তর দিলে, মুশকিল হচ্ছে এই-যে ওয়াং নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, ওর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না–কোথায় গেছে কেউ জানে না।

হায়-হায়! বিডুল্‌ফ আর্তনাদ করে উঠলেন, তাহলে তো বিষম ব্যাপার! এতক্ষণে তাঁকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখালো।

কেউই কোনো কথা বললো না কিছুক্ষণ।

ধরে নিচ্ছি যে এখন আর আপনি খুন হতে চান না, নিস্তব্ধতা ভেঙে বিডুল্‌ফ বললেন।

ঠিক তার উলটো–কেন চাইবো মরতে? ওই সাময়িক ব্যাঙ্কবিপর্যয়ের ফলে আমার সম্পত্তি প্রায় ডবল হয়ে গেছে–আমার বাঁচার ইচ্ছেও তেমনি দ্বিগুণ হয়েছে এখন। শিগগিরই বিয়ে করতে চাই।

বটেই তো! অমায়িকভাবে হাসলেন বিডুল। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন ওয়াং-এর কোনো খোঁজ না-পাওয়া অব্দি আমি মোটেই নিরাপদ নই। অন্তত যতদিন আমার জীবনবিমার মেয়াদ না-ফুরোয়, ততদিন তো বটেই।

মৃদু গলায় মন্তব্য করলেন বিডুল্‌ফ, ততদিন আমাদের আপিশও মোটেই নিরাপদ নয়।

পঁচিশে জুন অব্দি আমার জীবন মারাত্মক বিপদের মধ্যে পড়ে থাকবে, কিন-ফো জানালো।

হ্যাঁ, পঁচিশে জুন পর্যন্ত যত ঝক্কি যত ঝামেলা সব সেন্টেনারিয়ানকেই ভোগ করতে হবে, দুই হাত মুঠো করে পিছনে নিয়ে আস্তে-আস্তে পায়চারি শুরু করলেন বিডুল্‌ফ।

শুনুন, কী করতে হবে আমাদের, একটু ভেবে তিনি বললেন, যে করেই হোক আপনার ওই দার্শনিক বন্ধুকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে–এমনকি যদি তিনি মাটির তলায় গিয়ে লুকিয়ে থাকেন, তবু

যেন খুঁজে বার করতে পারেন, এই কামনা করি, কিন-ফো উত্তর দিলে।

আর ইতোমধ্যে আপনাকে রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের আপনাকে আত্মহত্যার হাত থেকে যেভাবে বাঁচিয়েছি, সেইরকম একটা কিছু–

কিন-ফো চমকে উঠলো, তার মানে? আপনি কী বলছেন, আমি তো তা কিছুই বুঝতে পারছি না!

কেন, যেদিন থেকে আপনি জীবনবিমা করলেন, সেদিন থেকেই তো আমার দুটি লোক আপনাকে সবসময় নজরবন্দী করে রেখেছে। ছায়ার মতো আপনার পিছন-পিছন-গেছে তারা সবসময়, কী করেন না-করেন–সব লক্ষ করেছে!

আর আমি তা একবারও টের পাইনি!

আপনারও যদি গোয়েন্দাগিরিতে ওদের মতো দক্ষতা থাকতো, তাহলেই হয়তো টের পেতেন–কিন্তু ওরা খুব সাবধানি লোক। ওরা যে এখন এই আপিশ অবধি আপনাকে অনুসরণ করে এসেছে, সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আপনাকে ভিতরে ঢুকতে দেখেছে ওরা-কখন বেরোন এখান থেকে, বেরিয়ে কোথায় যান, সব খোঁজখবর নেবার জন্য নিশ্চয়ই এখন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

এও কি সম্ভব? যেন নিজেকেই জিগেশ করলে কিন-ফো।

ক্রেগ! ফ্রাই! কণ্ঠস্বর একটুও না-চড়িয়েই বিডুল্‌ফ হাঁক পাড়লেন।

ঘরে এসে ঢুকলো দুজনে।

আপনার অনুমতি পেলে এদের হাতে আমি এখন একটা নতুন কাজের ভার দিতে চাই। এতক্ষণ এরা আপনাকে আপনার নিজের হাত থেকেই রক্ষা করে আসছিলো–আপনি যাতে আত্মহত্যা করে না-বসেন, সেদিকে কড়া নজর রেখেছিলো এরা; এবার থেকে এরা আপনাকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবে–এমনভাবে এরা আপনাকে পাহারা দেবে যে ওয়াং আপনার গায়ে আঁচড়টিও কাটতে পারবে না।

এই ব্যবস্থা মেনে না-নিয়ে কোনো উপায় ছিলো না কিন-ফোর, কোনো বিকল্প না। কোনো দ্বিরুক্তি না-করেই গোয়েন্দা দুজন নতুন কাজের ভার নিয়ে নিলো।

এখন তাদের সামনে আশু কর্তব্য কী, এবার তা-ই ঠিক করতে হয়। বিডুল্‌ফের মতে সামনে এখন নাকি দুটো রাস্তাই কেবল খোলা আছে; এক হয় কিন-ফো এখন বোজ চব্বিশ ঘণ্টা তার বাড়িতেই থাকবে ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের পাহারায়–খেয়াল রাখবে যাতে কারু অলক্ষিতে ওয়াং বাড়িতে ঢুকতে না-পারে : আর নয়তো ওয়াংকে তারা তন্নতন্ন করে খুঁজে বার করবার চেষ্টা করবে–ওই ভয়ংকর দলিলটা ওয়াং-এর কাছ থেকে উদ্ধার না-করা পর্যন্ত আর-কোনো দিকেই নজর দেবে না।

তাহলে ওয়াংকেই খুঁজে বার করার ব্যবস্থা করুন, কিন-ফো বললে, কিনফুসিয়ুসের এই চেলাটির কাছে ইয়ামেনের সব অন্ধিসন্ধি কঁকফোকর জানা–ইচ্ছে করলেই সে অনায়াসে সকলের অগোচরে ভিতরে ঢুকে পড়তে পারবে।

হ্যাঁ, সম্ভব হলে ওয়াংকে তো খুঁজে বার করবো বটেই, বিডুল্‌ফ সম্মতি দিলেন, কিন্তু আপনাকেও মোটেই চোখের আড়াল করা চলবে না।

ওয়াং-এর কোনো অনিষ্ট করবেন না তো আপনারা, কিন-ফো আবেদন করলো।

জীবিত বা মৃত–হিড়হিড় করে টেনে আনতে হবে তাকে,বললে ক্রেগ।

জ্যান্ত বা মড়া–তাকে খুঁজে বার করতেই হবে, ফ্রাই প্রতিধ্বনি তুললো।

মৃতদেহ এনে আর কী লাভ হয় জীবিত-নয়তো নয়, কিন-ফো আবার আবেদন করলো।

কর্মসূচি স্থির হয়ে গেলে বিডুলফের কাছ থেকে বিদায় নিলো কিন-ফো; বাড়ি ফেরবার সময় তাকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাতেই হোক দেহরক্ষী দুজনকেই সঙ্গে নিতে হলো।

সুন যখন আবিষ্কার করলে যে ক্রেগ আর ফ্রাই এখন থেকে ইয়ামেনের মধ্যেই থাকবে, তখন তার আর খেদের সীমা থাকলো না। আর-কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না তাকে : তার মানে ওই রজত-মুদ্রাগুলি আর তার বরাতে নেই। আর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো কিন-ফোও এদিকে পূর্ণোদ্যমে আবার তার আলস্য আর ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য কাঁচি ব্যবহার করতে আরম্ভ করে দিলে! বেচারা সুন! তখনও যদি সে জানতে পেতো ভবিষ্যৎ তার জন্য কী তুলে রেখেছে শিকেয়!

বাড়ি ফিরেই কিন-ফো প্রথমে পেইচিঙে একটি ফোনোগ্রাম পাঠাবার উদ্যোগ করলে। সে যে হৃত সম্পদ আবার ফিরে পেয়েছে এ-কথা জানাতে সে একটুও দেরি করলো না। আবার সেই প্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে লা-ও তার আনন্দ যে কোথায় রাখে ভেবেই পেলো না। ফোনোগ্রামের মূল বার্তা সম্বন্ধে তার কোনো আকর্ষণ ছিলো না–যে-কণ্ঠস্বর চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো বলে ভেবেছিলো আবার তার ধ্বনিস্পন্দন কানে যেতেই সে আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠলো। কিন-ফো জানিয়েছে যে সপ্তম চাঁদ দিগন্তের কোলে ঢলে পড়বার আগেই সে গিয়ে লা-ওর পাশে দাঁড়াবে–আর-কোনো দিনও মুহূর্তের জন্য তার পাপ ছেড়ে যাবে না তারপর; কিনতু তার আগে লা-ওকে দেখতে যাবার উপায় নেই তার, কারণ দ্বিতীয়বার লা-ওকে বিধবা করতে চায় না সে।

চিঠির শেষ কথাগুলোর অবশ্য কোনো মর্মোদ্ধার করতে পারলো না লা-ও। কিন্তু তার ভালোবাসার ধন সে যে আবার ফিরে পাবে, আর কখনো। যে তাকে তার হারাতে হবে না–এই কথা জেনেই সে সেদিন পিকিং-এর সবচেয়ে সুখী তরুণী হয়ে উঠলো।

কিন-ফোর সমস্ত জীবন এরমধ্যেই আদ্যোপান্ত বদলে গেছে। তার রূপান্তর, যাকে বলে, এখন অতি সম্পূর্ণ। হৃত সম্পদ ফিরে পেতেই তার জীবনদর্শনই বদলে গিয়েছে একেবারে : এই সেদিন কোয়াংতুঙে সে তার যে বন্ধুদের ভোজসভায় আপ্যায়িত করেছিলো, তারা যদি তাদের সেই নিস্পৃহ ও নিরুত্তাপ বন্ধুকে এখন দেখতে পেতো, তাহলে কিছুতেই চিনতে পারতো না। আর ওয়াং? সে হয়তো কিন-ফোকে দেখে নিজের কাণ্ডজ্ঞান ও পঞ্চেন্দ্রিয়কেই। অবিশ্বাস করতে শুরু করে দিত।

ওয়াং-এর কোনো চিহ্নই কোনো হদিশই পাওয়া যায়নি এখনো। সবগুলি বিদেশী বসতি, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, উপকণ্ঠ ও শহরতলি তন্নতন্ন করে। খোঁজা হলো–শাংহাইয়ের সব কোনাখামচিতে সন্ধান করা হলো—তার পাত্তা পাবার জন্য অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সব তি-পাও বা গুপ্তচর লাগানো হলো–কিন্তু কিছুই ফল হলো না–কোনো সূত্র, বা ইঙ্গিত বা চিহ্নই পাওয়া গেলো না তার।

ক্রেগ আর ফ্রাই ক্রমেই কি-রকম অস্থির হয়ে উঠলো; সব দেখেশুনে বড্ড অস্বস্তি লাগছে তাদের; ফলে তারা আঠার মতো লেগে রইলো কিন-ফোর সঙ্গে–তার সঙ্গে শোয়, পারলে এক কাপড়ই বুঝি পরে; সেদ্ধ ডিম ছাড়া আর-কিছু খেতে নিষেধ করলো তারা কিন-ফোকে–সেদ্ধতে নাকি বিষ মেশাবার উপায় থাকে না, তারা বোঝাতে চেষ্টা করলো কিন-ফোকে। এত সব বাধা-নিষেধের বিরুদ্ধে বিন-ফোর সমস্ত অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে উঠলো। এ তো সেন্টেনারিয়েনের লোহার সিন্দুকে বন্দী হয়ে থাকার শামিল–তাহলে এই দু-মাস সেখানে থাকলেই হয়–প্রত্যুত্তরে এই কথাই সে বললো তাদের।

কম্পানির স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বিডুল্‌ফ অবশ্য একবার বলেছিলেন যে কিস্তির টাকা ফিরিয়ে দিয়ে না-হয় বিমার পলিসিটি বাতিল করে ফেলা হোক। কিন-ফো কিন্তু সে-প্রস্তাবে কিছুতেই কর্ণপাত করলো না। একবার যখন চুক্তি হয়েছে, তখন তার সমস্ত ফলাফলও ভোগ করতে হবে-বেগতিক দেখে তা আর খারিজ করা চলবে না। তাকে একটুও টলাতে না-পেরে বিডুল্‌ফ শেষটায় হাল ছেড়ে দিলেন; তবে তাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বললেন যে যে-কম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে তিনি গর্ব অনুভব করেন, কিন-ফো যে সেখানেই বিমা করেছে, এটা তার মস্ত সৌভাগ্যেরই লক্ষণ।