০২. বিনিময় (দ্বিতীয় অধ্যায়)

বিনিময়
দ্বিতীয় অধ্যায়

এটা পরিষ্কার যে পণ্যেরা নিজেরা বাজারে যেতে পারে না এবং নিজেরাই নিজেদের বিনিময় করতে পারে না। সুতরাং আমাদের যেতে হবে তাদের অভিভাবকবৃন্দের কাছে; এই অভিভাবকেরাই তাদের মালিক। পণ্যেরা হল দ্রব্যসামগ্ৰী , সুতবাং মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের নেই। যদি তাদের মধ্যে বিনিময়ের অভাব দেখা দেয়, তা হলে সে বলপ্রয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ সে তাদের দখল নিয়ে নিতে পারে।(১) যাতে করে এই দ্রব্যসামগ্ৰীগুলি পণ্যরূপে পৰ্ব্ব স্পরের সঙ্গে বিনিময়ের সম্পর্কে প্ৰবেশ করতে পারে, তার জন্য তাদের অভিভাবকদেরই তাদেরকে স্থাপন করতে হবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে; তাদের অভিভাবকেরাই হচ্ছে সেই ব্যক্তিরা যাদের ইচ্ছায় তারা পরিচালিত হয়, অভিভাবকদের কাজ করতে হবে এমন ভাবে যাতে একজনের পণ্য অন্য জন আত্মসাৎ না করে এবং পরস্পরের সন্মতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত একটি প্রক্রিয়া ছাড়া কেউ তার পণ্যকে ছেড়ে না দেয়। সুতরাং অভিভাবকদের পরস্পরকে স্বীকার করে নিতে হবে ব্যক্তিগত স্বত্বের অধিকারী বলে। এই আইনগত সম্পর্কই আত্মপ্ৰকাশ করে চুক্তি হিসেবে-তা সেই আইনগত সম্পর্কটি কোন বিকশিত আইনপ্ৰণালীর অঙ্গ হোক, বা না-ই হোক, এই আইনগত সম্পর্কটি দুটি অভিপ্ৰায়ের মধ্যকার বাস্তব অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই অর্থনৈতিক সম্পর্কটিই নির্ধারণ করে দেয় এই ধরনের প্রত্যেকটি আইনগত প্রক্রিয়ার বিষয়বস্তু।(২) ব্যক্তিদের উপস্থিতি এখানে কেবল পণ্যসমূহের প্রতিনিধি তথা মালিক হিসাবে। আমাদের অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আমরা সাধারণভাবে দেখতে পাব যে অর্থনৈতিক রঙ্গমঞ্চে যেসব চরিত্র আবিভূতি হয়, সেসব চরিত্র তাদের নিজেদের মধ্যে যে অর্থনীতিগত সম্পর্কগুলি থাকে, সেই সম্পর্কগুলিরই ব্যক্তিরূপ ছাড়া অন্য কিছু নয় ।

যে ঘটনাটি একটি পণ্যকে তার মালিক থেকে বিশেষিত করে, তা প্ৰধানতঃ এই যে, পণ্যটি বাকি প্রত্যেকটি পণ্যকে তার নিজেরই মূল্যের দৃশ্যরূপ বলে দেখে থাকে । সে হল আজন্ম সমতাবাদী ও সর্ব-বিবাগী, অন্য যে কোনো পণ্যের সঙ্গে সে কেবল তার আত্মাটিকে নয়, দেহটিকেও বিনিময় করতে সর্বদাই প্ৰস্তুত-সংশ্লিষ্ট পণ্যটি যদি এমনকি ম্যারিটনেসি থেকেও কুরূপ হয়, তা হলেও কিছু এসে যায় না। পণ্যের মধ্যে বাস্তববোধ সংক্রান্ত ইন্দ্ৰিয়ের এই যে অভাব, তার মালিক সে অভাবের ক্ষতিপূরণ করে দেয় তার নিজের পাঁচটি বা পাঁচটিরও বেশি ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা। তার কাছে তার পণ্যটির তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবহারমূল্য নেই। তা যদি থাকত, তা হলে সে তাকে বাজারে নিয়ে আসত না। পণ্যটির ব্যবহারমূল্য আছে। অন্যদেব কাছে, কিন্তু তার মালিকদের কাছে তার একমাত্র প্রত্যক্ষ ব্যবহারমূল্য আছে বিনিময়-মূল্যের আধার হিসেবে, এবং, কাজে কাজেই, বিনিময়ের উপায় হিসেবে।(৩) অতঃপর যে পণ্যের মূল্যে উপযোগের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনে ( সেবায় ) লাগতে পারে তাকে সে হাতছাড করতে মনস্থির করে। সমস্ত পণ্যই তাদের মালিকদের কাছে ব্যবহার মূল্য বিবজিত কিন্তু তাদের অ-মালিকদের কাছে ব্যবহার মূল্য-সমন্বিত । সুতরাং পণ্যগুলির হাত বদল হতেই হবে । আর এই যে হাত-বদল তাকেই বলা হয় বিনিময়, বিনিময় তাদেরকে পরস্পরের সম্পর্কের স্থাপন করে মূল্য হিসেবে এবং তাদেরকে বাস্তবায়িতও করে মূল্য হিসাবে। সুতরাং ব্যবহার মূল্য হিসেবে বাস্তবায়িত হবার “আগে পণ্যসমূহকে অবশ্যই বাস্তবায়িত হতে হবে বিনিময়-মূল্য হিসেবে।

অন্যদিকে, মূল্য হিসেবে বাস্তবায়িত হবার আগে তাদের দেখাতে হবে, যে তারা ব্যবহার-মূল্যের অধিকারী। কেননা যে শ্রম তাদের উপরে ব্যয় করা হয়েছে তাকে ততটাই ফলপ্ৰসু বলে গণ্য করা হবে, যতটা তা ব্যয়িত হযেছে এমন একটি রূপে যা অন্যাঠের কাছে উপযোগপূর্ণ। ঐ শ্রম অন্যান্যের কাছে উপযোগপূর্ণ কিনা, এবং কাজে কাজেই, তা অন্যান্যের অভাব পূরণে সক্ষম। কিনা, তা প্রমাণ করা যায়। কেবলমাত্র বিনিময়ের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

পণ্যের মালিকমাত্রেই চায় তার পণ্যটিকে হাতছাড়া করতে কেবল এমন সব পণ্যের বিনিময়ে, যেসব পণ্য তার কোন-না-কোন অভাব মেটায়। এই দিক থেকে দেখলে, তার কাছে বিনিময় হল নিছক একটি ব্যক্তিগত লেনদেন। অন্যদিকে, সে চায় তার পণ্যটিকে বাস্তবায়িত করতে, সমান মূল্যের অন্য যে-কোনো উপযুক্ত পণ্যে রূপান্তরিত করতে-তার নিজের পণ্যটির কোন ব্যবহার-মূল্য অন্য পণ্যটির মালিকের কাছে আছে কি নেই, তা সে বিবেচনা করে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, তার কাছে বিনিময় হল আর্থিক চরিত্রসম্পন্ন একটি সামাজিক লেনদেন। কিন্তু এক প্ৰস্ত এক ও অভিন্ন লেনদেন একই সঙ্গে পণ্যের সমস্ত মালিকদের কাছে যুগপৎ একান্তভাবে ব্যক্তিগত এবং একান্তভাবে সামাজিক তথা সার্বিক ব্যাপার হতে পারে না।

ব্যাপারটাকে আরেকটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যাক। একটি পণ্যের মালিকের কাছে, তার নিজের পণ্যটির প্রেক্ষিতে, বাকি প্রত্যেকটি পণ্যই হচ্ছে এক-একটি সমার্ঘ সামগ্ৰী এবং কাজে কাজেই, তার নিজের পণ্যটি হল বাকি সমস্ত পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্রী। কিন্তু যেহেতু এটা প্রত্যেক মালিকের পক্ষেই প্রযোজ্য, সেহেতু কাৰ্যতঃ কোন সমার্ঘ সামগ্ৰী নেই, এবং পণ্যসমূহের আপেক্ষিক মূল্য এমন কোনো সাবিক রূপ ধারণ করেন, যে-রূপে মূল্য হিসেবে সেগুলির সমীকরণ হতে পারে এবং তাদের মূল্যের পরিমাণের তুলনা করা যেতে পারে। অতএব এই পর্যন্ত; তারা পণ্য হিসেবে পরস্পরের মুখোমুখি হয় না, মুখোমুখি হয় কেবল উৎপন্ন দ্রব্য বা ব্যবহার-মূল্য হিসেবে। তাদের অসুবিধার সময়ে আমাদের পণ্য-মালিকেরা ফাউস্টের মতোই ভাবে “Im Antang war die That”। সুতরাং ভাববার আগেই তারা কাজ করেছিল এবং লেনদেন করেছিল। পণ্যের স্বপ্রকৃতির দ্বারা আরোপিত নিয়মাবলীকে তার সহজাত প্ৰবৃত্তি বলেই মেনে চলে। তারা তাদের পণ্যসমূহকে মূল্য-রূপে, এবং সেই কারণেই পণ্যরূপে, সম্পর্কযুক্ত কত্বতে পারে না–সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে অন্য কোন একটিমাত্র পণ্যের সঙ্গে তুলনা না করে। পণ্যের বিশ্লেষণ থেকে আমরা তা আগেই জেনেছি। কিন্তু কোন একটি বিশেষ পণ্য সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। সুতরাং নির্দিষ্ট সামাজিক প্রক্রিয়ার ফলে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে ঐ বিশেষ পণ্যটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করে এবং বাকি সমস্ত পণ্যের মূল্য এই বিশেষ পণ্যটির মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। এইভাবে ঐ পণ্যটির দেহগত রূপটিই সমাজ-স্বীকৃত সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্রীর রূপে পরিণত হয়। সর্বজনীন সমার্ঘ রূপে পরিণত হওয়াটাই এই সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে ওঠে। উক্ত সর্ব-ব্যাতিরিক্ত পণ্যটির নির্দিষ্ট কাজ। এই ভাবেই তা হয়ে ওঠে-“অৰ্থ”। “Illi unum consilium habent et virtutem et virtutem et potestatem suam bestiae tradunt. Et ne quis possit emere aut vendere, nisi qui habet characterem aut nomen bestiae, aut numerum nominis ejus.” (Apocalypse.)

‘অর্থ হচ্ছে একটি স্ফটিক , বিভিন্ন বিনিময়ের মাধ্যমে শ্রমের বিবিধ ফল কাৰ্যক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে সমীকৃত হয় এবং এইভাবে নানাবিধ পণ্যে পরিণত হয়; সেই সব বিনিময়ের ধারায় প্রয়োজনের তাগিদে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই স্ফটিক গড়ে ওঠে। বিনিময়ের ঐতিহাসিক অগ্রগমন ও সম্প্রসারণের ফলে পণ্যের অন্তঃস্থিত ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্যের মধ্যে তুলনাগত বৈষম্যটি বিকাশ লাভ করে। বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যে এই তুলনা-বৈষম্যের একটি বাহিক অভিব্যক্তি দেবার জন্য মূল্যের একটি স্বতন্ত্র রূপ প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা দেখা দেয় এবং যতকাল পর্যন্ত পণ্য এবং অর্থের মধ্যে পণ্যের এই পার্থক্যকরণের কাজ চিরকালের জন্য সুসম্পন্ন না হয়েছে ততকাল পৰ্যন্ত এই আবশ্যকতার অবসান ঘটে না। তখন, যে-হারে উৎপন্ন দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তরণ ঘটে থাকে, সেই হারেই একটি বিশেষ পণ্যের ‘অর্থ”-রূপে রূপান্তরণ সম্পন্ন হয়।(৪)

দ্রব্যের পরিবর্তে দ্রব্যের প্রত্যক্ষ বিনিময় (দ্রব্য-বিনিময় প্রথা) এক দিকে মূল্যের আপেক্ষিক অভিব্যক্তির প্রাথমিক রূপে উপনীত হয়, কিন্তু আরেকদিকে নয়। সেই রূপটি এই : ও পণ্য ক = ঔ পণ্য খাঁ। প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময়ের রূপটি হচ্ছে এই ও ব্যবহার মূল্য ক = ঔ ব্যবহার মূল্য খ।(৫) এই ক্ষেত্রে কী এবং খ জিনিস দুটি এখনো পণ্য নয়। কিন্তু কেবল দ্রব্য-বিনিমযের মাধ্যমেই তারা পণ্যে পরিণত হয়। যখন কোন উপযোগিতা-সম্পন্ন সামগ্ৰী তার মালিকের জন্য একটি না-ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করে তখনি বিনিময় মূল্য অর্জনের দিকে সেই সামগ্ৰীটি প্রথম পদক্ষেপ অৰ্পণ করে, এবং এটা ঘটে কেবল তখনি যখন তা হয়ে পড়ে। তার মালিকের আশু অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কোন জিনিসের অতিরিক্ত কোন অংশ। জিনিসগুলি নিজের তো মানুষের বাইরে অবস্থিত এবং সেই কারণেই তার দ্বারা পরকীকরণীয়। যাতে করে এই পরকীকরণ পারস্পরিক হয়, সেই জন্য যা প্রয়োজন তা হল পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরস্পরকে ঐ পরকীকরণীয় জিনিসগুলির ব্যক্তিগত মালিক হিসাবে এবং, তার মানেই, স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা। কিন্তু সর্বজনিক সম্পত্তির উপরে ভিত্তিশীল আদিম সমাজে-ত প্ৰাচীন ভারতীয়-গোষ্ঠী সমাজের পিতৃ-তান্ত্রিক পরিবারই হোক, বা পেরুভীয় ইনকা রাষ্ট্ৰই হোক-কোথাও এই ধরনের পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্যমূলক অবস্থানের অস্তিত্ব ছিল না। সেই ধরনের সমাজে স্বভাবতই পণ্য-বিনিময় প্রথম শুরু হয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, যেখানে যেখানে তারা অনুরূপ কোন সমাজের বা তার সদস্যদের সংস্পর্শে আসে! যাই হোক, যত দ্রুত কোন সমাজের বাইরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্রব্য পরিণত হয় পণ্যে তত দ্রুতই তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে অভ্যন্তরীণ লেনদেনের ক্ষেত্রেও দ্রব্য পরিণত হয় পণ্যে। কখন কোন হারে বিনিময় ঘটবে, তা ছিল গোডার দিকে নেহাৎই আপতিক ব্যাপার তাদের মালিকদের পারস্পরিক ইচ্ছার পরকীকরণই বিনিময় যোগ্য করে তোলে। ইতিমধ্যে উপযোগিতা-সম্পন্ন বিদেশীয়-দ্রব্য সামগ্রীর অভাববোধও ক্রমে ক্ৰমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বিনিময়ের নিত্য পুনরাবৃত্তির ফলে তা হয়ে ওঠে একটি মামুলি সামাজিক ক্রিয়া। কালক্রমে অবশ্যই এমন সময় আসে যে শ্রমফলের অন্ততঃ একটা অংশ উৎপন্ন করতে হয় বিনিময়ের বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে। সেই মুহুর্ত থেকেই পরিভোগের জন্য উপযোগিতা এবং বিনিময়ের জন্য উপযোগিতার মধ্যকার পার্থক্যটি দৃঢ় ভাবে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করে। কোন সামগ্রীর ব্যবহার-মূল্য এবং তার বিনিময়-মূল্যের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়। অন্য দিকে যে পরিমাণগত অনুপাতে বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিনিময় ঘটবে, তা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাদের নিজেত্ব নিজের উৎপাদনের উপরে। প্রথাগত ভাবে এক-একটি জিনিসের উপরে এক-একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের ছাপ পড়ে যায়।

প্ৰত্যক্ষ দ্ৰব্য-বিনিময় ব্যবস্থায় প্রত্যেকটির জন্যই তার মালিকের কাছে প্ৰত্যক্ষ ভাবেই একটি বিনিময়ের উপায় এবং অন্য সকলের কাছে একটি সমার্ঘ সামগ্রী কিন্তু সেটা ততখানি পর্যন্তই, যতখানি পর্যন্ত তাদের কাছে তার থাকে ব্যবহার-মূল্য। সুতরাং এই পর্যায়ে বিনির্মিত জিনিসগুলির নিজেদের ব্যবহার মূল্য থেকে বা বিনিময়কারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনবোধ থেকে নিরপেক্ষ কোন মূল্য রূপ অর্জন করে না। বিনির্মিত পণ্যের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গেই একটি মূল্য-রূপের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। সমস্যা আর তার সমাধানের উপায় দেখা দেয় একই সঙ্গে। বিভিন্ন মালিকের হাতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য না থাকলে এবং সেই সমস্ত পণ্য একটি মাত্র বিশেষ পণ্যের সঙ্গে বিনিমেয় এবং মূল্য হিসেবে সমীকৃত না হলে, পণ্য-মালিকের। কখনো তাদের নিজেদের পণ্যসমূহকে অন্যদের পণ্যসমূহের সঙ্গে সমীকরণ করে না এবং বৃহৎ আকারে বিনিময় করে না। এই শেষ উল্লেখিত পণ্যটি অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের সমার্ঘ সামগ্রী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সাধারণ সামাজিক সমার্ঘ সামগ্রীর চরিত্র অর্জন করে যদিও অত্যন্ত সংকীর্ণ পরিধির মধ্যেই। সে সমস্ত তাৎক্ষণিক সামাজিক ক্রিয়াগুলির প্ৰয়োজনে এই বিশেষ চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, তা এই ক্রিয়াগুলির প্রয়োজনমাফিক কাজ করে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অকেজো হয়ে থাকে। ঘুরে ফিরে এবং সাময়িক ভাবে এই চরিত্রটি কখনো এই পণ্যের সঙ্গে কখনো ঐ পণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়। কিন্তু বিনিময়ের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে তা দৃঢ় ভাবে এবং একান্ত ভাবে বিশেষ বিশেষ ধরনের পণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে যায় এবং ক্ৰমে ক্ৰমে ‘অর্থ”-রূপে সংহতি লাভ করে। এই বিশেষ প্ৰকৃতির পণ্যটি কোন পণ্যে লগ্ন হবে, তা গোডার দিকে থাকে আপতিক। যাই হোক না কেন, এ ব্যাপারে দুটি ঘটনার প্রভাব চূড়ান্ত ভূমিকা নেয়। হয়, এই “অৰ্থ-রূপ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাইরে থেকে বিনিময় মারফৎ পাওয়া জিনিসগুলির সঙ্গে নিজেকে লগ্ন করে—আর বাস্তবিক পক্ষে দেশজ দ্রব্যাদির মূল্য প্ৰকাশের এগুলিই হচ্ছে আদিম ও স্বাভাবিক কঁপ; নয়তো তা নিজেকে লগ্ন করে গবাদিপশুজাতীয় উপযোগিতাপূর্ণ জিনিসের সঙ্গে-যেসব জিনিস দেশজ পরকীকরণীয় ধনসম্পদের প্রধান অংশ; যাযাবর গোষ্ঠীগুলিই অর্থ-রূপ প্রবর্তনের ব্যাপারে পথিকৃৎ, কেননা তাদের সমস্ত পার্থিব ধনসম্পদ কেবল অস্থাবর জিনিসপত্রেরই সমষ্টি আর সেই জন্যই সেগুলি সরাসরি পরকীকরণীয় এবং কেননা তাদের জীবনযাত্রার ধরনই এমন যে তারা নিরন্তর বিদেশী গোষ্ঠীসমূহের সংস্পর্শে আসে এবং দ্রব্যাদি বিনিময়ের প্রয়োজন অনুভব করে। মানুষ অনেক ক্ষেত্রে মানুষকেও, ক্রীতদাসের আকারে, অর্থের আদিম সামগ্ৰী হিসেবে ব্যবহার করেছে কিন্তু কখনো জমিকে এ কাজে ব্যবহার করেনি। এমন ধরনের ধারণার উদ্ভব হতে পারে কেবল কোন বুর্জোয়। সমাজে যা ইতিমধ্যেই অনেকটা বিকাশ-প্ৰাপ্ত। সপ্তদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে এই ধরনের ধারণা চালু হয় এবং এক শতাব্দী পরে, ফরাসী বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে, এই ধারণাটিকে জাতীয় আকারে কার্যকরী করার প্রথম প্রচেষ্টা হয়।

যে অনুপাতে বিনিময় স্থানীয় সীমানা ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং পণ্য-মূল্য ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে হতে অমূর্ত মনুষ্য-শ্রমে রূপ লাভ করে, সেই অনুপাতে অর্থের চরিত্র এমন, সব পণ্যে নিজেকে লগ্ন করে যে-পণ্যগুলি সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে কাজ কারাবার জন্য প্ৰকৃতির দ্বারাই নির্দিষ্ট হয়ে আছে। ঐ পণ্যগুলি হচ্ছে বিভিন্ন মহাৰ্ঘ ধাতু।

‘যদিও সোনা এবং রূপে প্ৰকৃতিগত ভাবে অর্থ নয়। কিন্তু অর্থ প্রকৃতিগত ভাবেই সোনা এবং রূপো’—(৬) এই যে বক্তব্য তার সত্যতা প্ৰতিপন্ন হয় এই ধাতুগুলির অর্থ হিসাবে কাজ করার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন দেহগত গুণাবলীর দ্বারা।(৭) যাই হোক, এই পৰ্যন্তু আমরা কেবল অর্থের একটিমাত্র কাজের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি; সে কাজটি হল পণ্য-মূল্যের অভিব্যক্তি হিসেবে অথবা পণ্যমূল্যের বিভিন্ন পরিমাণ যে-সামগ্রীর মাধ্যমে কাজ করে সেই সামগ্ৰীটি সামাজিক বৰ্ণনা হিসেবে কাজ করা। মূল্য প্ৰকাশের যথোপযুক্ত রূপ, অমূর্ত অবিশেষিত এবং সেই কারণেই সমান মনুষ্য-শ্রমের যথোপযুক্ত মূর্তরূপ—এমন একটি সামগ্রীই-যার নমুনামাত্র প্রদর্শনে তার অভিন্ন গুণগুলি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে-এমন একটি সামগ্রীই কেবল হতে পারে ‘অৰ্থ। অন্যদিকে, যেহেতু মূল্যের বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যে যে পার্থক্য, তা কেবল পরিমাণগত, সেইহেতু অর্থ-পণ্যটিকে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যেরই সক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে এবং সেইজন্যই তাকে হতে হবে ইচ্ছামতো বিভাজ্য এবং পুনর্মিলিত হবার ক্ষমতাসম্পন্ন। সোনা এবং রূপো প্রকৃতিগতভাবেই এই গুণাবলীর অধিকারী।

অর্থ-পণ্যের ব্যবহার-মূল্য দ্বৈত। পণ্য হিসেবে বিশেষ ব্যবহার মূল্য (যেমন, সোনা য। কাজে লাগে দান্ত বাধাবার উপাদান হিসেবে, বিলাস-দ্রব্যাদির কঁচামাল হিসেবে ইত্যাদি) ছাড়াও, তা অর্জন কৰ্বে একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবহার-মূল্য-নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা থেকে যার উদ্ভব।

অর্থ হচ্ছে সমস্ত পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ বিশেষ বিশেষ সমার্ঘ সামগ্ৰী সেই হেতু অর্থের তথা সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰীটির সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ সমার্ঘ সামগ্ৰীগুলি কাজ করে বিশেষ বিশেষ পণ্য হিসাবে।(৮)

আমরা দেখেছি যে বাকি সমস্ত পণ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যে মূল্য-সম্পর্ক সমূহ বিদ্যমান, সেই সম্পক সমূহেরই প্রতিক্ষেপ হচ্ছে অর্থ-রূপ-যা উৎক্ষিপ্ত হয়েছে একটি মাত্র পণ্যের উপরে। সুতরাং ঐ অর্থও যে একটা পণ্য(৯) তা কেবল তাঁদের কাছে একটা নতুন আবিষ্কার বলে প্রতীয়মান হবে যারা তাঁদের বিশ্লেষণ শুরু করেন। অর্থের পূর্ণ-বিকশিত রূপটি থেকে। অর্থরুপে রূপান্তরিত পণ্যটি বিনিময়-ক্রিয়ার ফলে মূল্য-মণ্ডিত হয় না, কেবল তার নির্দিষ্ট মূল্যরূপ প্ৰাপ্ত হয়। এই দুটি সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা আলাদা ব্যাপারকে একাকার করে ফেলে কিছু কিছু লেখক এই সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌছেছেন যে সোনা এবং রূপের মূল্য হচ্ছে কাল্পনিক(১০) কতকগুলি ব্যাপারে অর্থের নিছক প্ৰতীকগুলিই যে অর্থের কাজ করে থাকে তা থেকে আরো একটা ভ্ৰাস্ত ধারণার উদ্ভব হয় তা এই যে অর্থে নিজেই একটা প্ৰতীক মাত্র। যাই হোক এই ভ্ৰাস্তির পেছনে একটি মানসিক সংস্কার উকি দেয় তা এই যে কোন সামগ্রীর অৰ্থরূপ সেই সামগ্ৰীটি থেকে বিচ্ছেদ্য কোন অংশ নয়, বরং সেটা হল এমন একটা রূপ যার মাধ্যমে কতকগুলি সামাজিক সম্পর্কের আত্মপ্ৰকাশ ঘটে। এই দিক থেকে প্রত্যেকটি পণ্যই হচ্ছে একটি প্রতীক কেননা যেহেতু তা হচ্ছে মূল্য, সেই হেতু সে হচ্ছে তার উপরে ব্যয়িত মনুষ্য-শ্রমের বস্তুগত লেফাফা মাত্ৰ।(১১) কিন্তু যদি ঘোষণা করা হয় যে একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন-পদ্ধতির অধীনে বিভিন্ন সামগ্ৰী কর্তৃক অজিত সামাজিক চরিত্রগুলি কিংবা শ্রমের সামাজিক গুণাবলী কর্তৃক অজিত বস্তুগত রূপগুলি নিছক প্ৰতীক মাত্র, তা হলে একই নিঃশ্বাসে এটাও ঘোষণা করা হয় যে, এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলি মানবজাতির তথাকথিত সর্বজনীন সম্মতির দ্বারা অনুমোদিত খেয়ালখুশিমতো দেওয়া অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আঠারো শতকে এই ধরনের ব্যাখ্যা বেশ সমর্থন লাভ করেছিল। মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কগুলি নানান ধাঁধা-লাগানা রূপ ধারণ করেছিল, সেগুলি ব্যাখ্যা করতে না পেরে, লোকে চেয়েছিল সেগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে একটা গৎবাঁধা বৃত্তান্ত হাজির করে সেগুলিকে তাদের অদ্ভুত দৃশ্যরূপ থেকে বিবস্তু করতে।

এর আগেই উপরে মন্তব্য করা হয়েছে যে পণ্যের সমার্ঘ্যরূপ তার মূল্যের পরিমাণ বোঝায় না। সুতরাং যদিও আমরা এ-বিষয়ে অবহিত থাকতে পারি। যে সোনা হচ্ছে অর্থ, এবং সেই কারণেই তা বাকি সব পণ্যের সঙ্গে সরাসরি বিনিমেয়, তবু কিন্তু এই তথ্য থেকে আমরা এটা কোন ক্রমেই জানতে পারিন যে এতটা সোনার, ধরা যাক, ১০ পাউণ্ড সোনার মূল্য কতটা। অন্যান্য পণ্যেধ ক্ষেত্রে যেমন, অর্থের ক্ষেত্রেও তেমন, অন্যান্য পণ্যের মাধ্যমে ছাড়া সে তার নিজের মূল্য প্রকাশ করতে পারে না। এই মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময়ের পরিমাণ দিয়ে এবং তা প্ৰকাশিত।– হয় একই পরিমাণ শ্রম সময়ে উৎপাদিত অন্য যে-কোন পণ্যের মাধ্যমে।(১২) তার মূল্যের এবং বিধ পরিমাণগত নির্ধারণ তার উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রেই দ্ৰব্য-বিনিময় প্রথার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যখন তা অর্থক্কাপে চলাচল করতে শুরু করে তাধ আগেই কিন্তু তার মূল্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। সতের শতকের শেষের দশকগুলিতেই এটা প্ৰতিপন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, অর্থ হচ্ছে একটা পণ্য , কিন্তু এই বক্তব্যে আমরা যা পাই তা হল এই বিশ্লেষণের শৈশব্যাবস্থা। অর্থ যে একটা পণ্য সেটা আবিষ্কার করা তেমন একটা সমস্যা নয়; সমস্যা দেখা দেয়। তখন যখন আমরা চেষ্টা করি কেন, কিভাবে, কি উপায়ের মাধ্যমে পণ্য অর্থে পরিণত হয়।(১৩)

মূল্যের সব চাইতে প্রাথমিক অভিব্যক্তি থেকে আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি যে ও পণ্য ক = ঔ পণ্য খ, দেখতে পেয়েছি যে যে সামগ্ৰীটি অন্য একটি সামগ্রীর মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই সামগ্ৰীটি প্ৰতীত হয় যেন তার এই, সম্পর্ক থেকে নিরপেক্ষভাবেই এক সমার্ঘ রূপ আছে-যে-রূপটি হচ্ছে এমন একটি সামাজিক গুণ যা প্ৰকৃতি তাকে দান করেছে। আমরা এই মিথ্যা প্ৰতীতিকে বিশ্লেষণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত তার চূড়ান্ত প্ৰতিষ্ঠা অবধি গিয়েছি; এই চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা তখনি পূর্ণ-সম্পন্ন হয় যখনি সর্বজনীন সমার্ঘ রূপটি একটি বিশেষ পণ্যের দৈহিক রূপের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে এবং এইভাবে অর্থ-রূপে স্ফটিকায়িত (কেলাসায়িত) হয়। যা ঘটে বলে দেখা যায়, তা এই নয় যে সোনা পরিণত হয় অর্থে এবং তার ফলে বাকি সমস্ত পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয় সোনার মাধ্যমে, বরং উলটো যে, বাকি সমস্ত পণ্য সর্বজনীনভাবে তাদের মূল্য প্রকাশ করে সোনার মাধ্যমে কেননা সোনা হচ্ছে “অৰ্থ। আদ্যন্ত প্রক্রিয়াটির মধ্যবর্তী পৰ্যায়গুলি ফলতঃ অদৃশ্য হয়ে যায়; পেছনে কোনো চিহ্নই রেখে যায় না। পণ্যরা দেখতে পায় যে তাদের নিজেদের কোনো উদ্যোগ ছাড়াই তাদের মূল্য তাদেরই সঙ্গের আরেকটি পণ্যের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্ৰকাশিত হয়ে গিয়েছে। সোনা ও রূপো-এই সামগ্ৰীগুলি যেই মুহূর্তে পৃথিবীর জঠর থেকে বেরিয়ে আসে, সেই মুহুর্তেই তারা হয়ে ওঠে সমস্ত মনুষ্য-শ্রমের প্রত্যক্ষ মূর্তরূপ। এখান থেকেই অর্থের যাদু। উপস্থিত যে-সমাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সে সমাজে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় মানুষের আচরণ নিছক আণবিক (অণুর মতো)। এই কারণে উৎপাদন-প্ৰণালীতে তাদের সম্পর্কগুলি ধারণ করে এমন একটি বস্তুগত চরিত্র যা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও সচেতন ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্ম থেকে নিরপেক্ষ। এই ঘটনাগুলি প্ৰথমে আত্মপ্ৰকাশ করে সাধারণ ভাবে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের পণ্যের রূপ পরিগ্রহ করার মধ্যে। আমরা দেখেছি কেমন করে পণ্য-উৎপাদনকারীদের এক সমাজের ক্ৰমিক অগ্রগতির ফলে একটি বিশেষ পণ্য অর্থ-রূপের মোহরাঙ্কিত হয়ে বিশেষ মৰ্যাদায় অধিষ্ঠিত হল। সুতরাং অর্থ যে কুহেলি সৃষ্টি করে তা আসলে পণ্যেরই সৃষ্ট কুহেলি; বৈশিষ্ট্য শুধু এইটুকু যে অর্থের কুহেলি তার সবচাইতে চোখ ধাঁধানে রূপ দিয়ে আমাদের ধাঁধিয়ে দেয়।

——————
১. ধর্মনিষ্ঠার জন্য যে শতাব্দীটি এত বিশিষ্ট, সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে পণ্যসম্ভারের মধ্যে অনেক সুক্ষ্ম জিনিসকেও ধরা হত। ঐ শতাব্দীর একজন ফরাসী কবি লাঁদিত-এর বাজারে প্রাপ্তব্য দ্রব্যাদির বিবরণ দিতে গিয়ে কেবল কাপড়, জুতো, চামড়া, চাষের যন্ত্রপাতির কথাই বলেন নি, সেই সঙ্গে তিনি “femmes folles de leur corps”-এর কথাও বলেছেন।

২. পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইনগত সম্পৰ্কসমূহ থেকেই প্রুধো তাঁর ‘ন্যায়’ সংক্রান্ত ‘শাশ্বত ন্যায়’ (‘justice eternelle’) সংক্রান্ত ধারণাটি গ্রহণ করেন।। এই ভাবে সমস্ত সৎ নাগরিকদের প্রবোধ দিয়ে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন পণ্যোৎপাদন-ব্যবস্থা উৎপাদনের ব্যবস্থা হিসেবে ‘ন্যায়’-এর মতোই শাশ্বত। তারপরে তিনি নজর দেন। বাস্তবে প্ৰচলিত পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার এবং সেই সঙ্গে তৎসংশ্লিষ্ট আইন-প্ৰণালীর সংস্কাঞ্চ সাধনের দিকে । সে রসায়নবিদ বস্তুব সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিধানগুলি অনুধাবন না করে ‘শাশ্বত ধ্যানধারণা’র ( ‘eternal ideas’ ) সাহায্যে বস্তুর সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণকে নিয়ন্ত্রিত করার দাবি করেন, তার সম্বন্ধে আমরা কী মনোভাব পোষণ করব ? ‘কুসীদবৃত্তি’ ‘শাশ্বত ন্যায়’-এর বিরোধীএ কথা বললেই কি কুসীদ বৃত্তি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি পায় ? গীর্জার পাদ্রীরাও তো বলেন কুসীদবৃত্তি “grace eternelle”, “foi eternelle” এবং “ia volonte eternelle de Dieu”-এর বিরোধী, কিন্তু তাতে আমাদের জ্ঞান কতটা বাড়ল?

(৩) “প্ৰত্যেকটি জিনিসেরই ব্যবহার দ্বিবিধ । — একটি ব্যবহার সেই জিনিস হিসেবেই, দ্বিতীয়টি তা নয়। যেমন, জুতো পরাও যায়, আবার অন্য কিছুর সঙ্গে বিনিময়ও করা যায়। দুটিই কিন্তু জুতোর ব্যবহার। যে ব্যক্তি অর্থ বা খাদ্যের বিনিময়ে জুতো দিয়ে দেয়, সে-ও জুতোকে জুতো হিসেবেই ব্যবহার করে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে নয়। কেননা, বিনিময়ের জন্য তা তৈরি হয়নি।”-(অ্যারিস্ততল, “De Rep.” l.i.c.9)

(৪) এ থেকে আমরা পেট-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের ধূর্ততার একটা ধারণা করে নিতে পারি। এই সমাজতন্ত্র পণ্যোৎপাদন বহাল রেখেই অর্থ এবং পণ্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব অপসারিত করতে চায়, এবং কাজে কাজেই, যেহেতু এই দ্বন্দ্বের দৌলতেই অর্থের অস্তিত্ব সেই হেতু অর্থকে নির্বাসিত করতে চায়, এ যেন পোপকে বাদ দিয়ে ক্যাথলিক ধর্মকে বহাল রাখার মত। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য “Zur Kritik der Pol. Oekon. p. 61, 5 q.

(৫) যে পৰ্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন ব্যবহার-মূল্য বিনিমিত না হয়ে, একটি মাত্র দ্রব্যের সমার্ঘ হিসেবে এলোমেলোভাবে একগাদা দ্রব্য হাজির করা হয়-বন্য যুগের : মানুষ যা করত-, ততদিন পর্যন্ত প্ৰত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থা থাকে। তার শৈশবেই।

(৬) “Zur Kritik. . . …,” p. 135. “Imetalli. . naturalmente moneta.“ (Galiani, “Della moneta in Custodios Collection : Parte Moderna t. iii.)

(৭) এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য আলোচনার জন্য আমার “Zur Kritik…” “-এর “মহার্ঘ ধাতু” শীৰ্ষক পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

(৮) Il danaro e la merce universale.” (Verri 1.c. পৃঃ ১৬)

(৯) “সোনা ও রূপা (যাদের এক কথায় বলা হয় ‘বুলিয়ান’) নিজেরাই পণ্যদ্রব্য যাদের মূল্যও বাড়ে ও কমে। সুতরাং কম-পরিমাণ বুলিয়ান যখন বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয় করে, তখন বুলিয়ান-এর মূল্য বেশি। (“A Discourse on The General Notions of Money, Trde and Exchange” as They stand in Relation each to other by a Merchant, 1695 Lond p. 7). সোনা এবং রূপা মুদ্রা-আকারে অথবা অমুদ্রা-আকারে, সবরকম দ্রব্যের পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হলেও মদ, তেল, তামাক, কাপড় অথবা অন্যান্য সামগ্রীর তুলনায় কম পণ্য নয়। (A Discouse concerning Trade and that in particular of the East Indies”, London 1689, P. 2). রাজ্যের মজুদ পণ্যদ্রব্য ও ধনসম্পদকে অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়না আবার সোনা ও রূপাকে পণ্যদ্রব্য থেকে বিয়োজিত করাও যায়না। (“The East India Trade and Most Profitable Trade”, London 1677, P. 4).

(১০) “L’oro e l’argento hanno valore come metalli anteriore all esser moneta” (Galiani l.c.). লক বলেন, “অর্থের উপযোগী গুণাবলীর অধিকারী হবার দরুণ রৌপ্য মানবজাতির সর্বজনীন সম্মতির ভিত্তিতে অর্জন করুল একটি কাল্পনিক মূল্য।” পক্ষান্তরে জা ল’ (Jean Law) বলেন, “কোন একটি বিশেষ দ্রব্যকে বিভিন্ন জাতি একটি কাল্পনিক মূল্যে ভূষিত করবে কিভাবে, , , অথবা কিভাবে এই কাল্পনিক মূল্য নিজেকে বজায় রাখবে? কিন্তু নিচের কথা থেকে বোঝা যায়, আসলে তীর ধারণা ছিল অকিঞ্চিৎকার। রূপা ব্যবহার-মূল্যের অনুপাতে বিনির্মিত “হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত মূল্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। অর্থের উপযোগী গুণাবলীর অধিকারী হবার দরুণ এটি অতিরিক্ত মূল্য পেয়েছে। (Jean Law: “Considerations sur le numeraire et le commerce’ in E. Daire’s Edit, of *Economistes Financiers du XVIII. Siecle”-(P.470).

(১১) ‘L Argent en (des denrees) est le signe’ (V. de Forbeonnais : ‘Elements du Commerce. Nouv. Edit. Leyde, 1766, t. II., p. 143) ‘Comme signe il est attire par les denrees. (l.c.p. 155.) ‘L’argent est un signre d’une chose et la represente.’’ (Montesquieu. “Esprit des Lois,” (OEuvres, London, 1767, t. II, p. 2) ‘L’argent n’est pas simple signe, car il est lui meme richesse; il ne represente pas les valeurs, il les equivaut.’’ (Le Trosne, lcp. 910).” ‘মূল্যের ধারণা অনুযায়ী একটি মূল্যবান দ্রব্য কেবল একটি প্রতীকমাত্র; দ্রব্যটি কি তা গণনীয় নয়, দ্রব্যটির মূল্য কি তাই গণনীয়’-হেগেল (I. c. p. 100)। অর্থনীতিবিদদের অনেক আগেই আইনজীবীরা এই ধারণাটি চালু করেছেন যে, অর্থ হচ্ছে একটি প্রতীক মাত্র, এবং মহার্ঘ ধাতুগুলির মূল্য নিছক কল্পনাজাত। এটা তারা করেন মুকুটধারী মাথাগুলির প্রতি চাটুকারসুলভ সেবায়, মুদ্রাকে হীনমূল্য করার ব্যাপারে এই মুকুটধারীদের অধিকারের সমর্থনে, গোটা মধ্য যুগ ধরে, রোমক সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এবং pandects থেকে লব্ধ অর্থরে ধারণা অনুযায়ী। তাঁদের একজন যোগ্য পণ্ডিত, ভ্যালয়-এর ফিলিপ, ১৩৪৬ সালে এক বিধাল বলেন, “Quaucun puisse ni doive faire doute Says an apt scholar of theirs, philips of valoi in a deorce of 1346. que a nous et a notre majeste royal n’appartiennent seulement … le mestier, le fait, l’etat, la provision et toute l’ordonnance des monnaies, de donner tel cours, et pour tel prix comme il nous plait et bon nous semble”, রোমক আইনের বিধি ছিল যে অর্থের মূল্য সম্রাটের বিধান দ্বারা ধাৰ্য। অর্থকে একটি পণ্য হিসাবে গণ্য করা ছিল স্পষ্ট ভাবে নিষিদ্ধ। “Pecunnias viro nulli emer fas erit, nam in usu publico constitutas oportet non esse mercem.” এই প্রশ্নে কিছু ভাল কাজ করেছেন জি এফ পাগনিনি। “Saggio sopra il giusto pregio delle cose, 1751” Custodi “Parte Moderna, t, II, তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে পাগনিনি তঁর আক্রমণ পরিচালনা করেন। বিশেষ করে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে।

(১২) পেরুর মৃত্তিকাগাের্ভ থেকে লণ্ডনে এক আউন্স রূপা নিয়ে আসতে যে-সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে যদি এক বুশেল শস্য উৎপন্ন করা যায়, তা হলে দুয়ের স্বাভাবিক দাম হবে সমান। এখন যদি নতুন কোনো কৌশলের ফলে ঐ সময়ের মধ্যে দুই বুশেল শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়, তা হলে এক আউন্স রূপা হবে দুই বুশেলের সমান -William Petty: “A Treatise of Taxes and Contributions, 1667, p. 32.

(১৩) বিদগ্ধ অধ্যাপক রশ্চিগর আমাদের প্রথম জানালেন, “অর্থ সংক্রান্ত ভ্ৰান্ত সংজ্ঞাগুলি প্ৰধানতঃ দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়; কতকগুলি সংজ্ঞায় অর্থকে পণ্যের চেয়ে বড় করে দেখানো হয়েছে, আবার কতকগুলিতে দেখানো হয়েছে ছোট করে; তার পরে অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে বিবিধ রচনার একটা লম্বা ও খিচুড়ি তালিকা দিলেন, যা থেকে বোঝা যায় যে, তত্ত্বটির আসল ইতিহাস সম্বন্ধে তঁর দূরতম ধারণাও নেই; এবং তার পরে তিনি এই নীতিনিষ্ঠ বক্তব্য রাখলেন, “বাকিদের ব্যাপারে, এটা অস্বীকার করা যায় না যে, পরবর্তী অৰ্থনীতিবিদদের অধিকাংশই অন্যান্য পণ্য থেকে অর্থের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না” (যাক, তা হলে এটা একটি পণ্যের চেয়ে হয় বেশি, নয় কম!) “এ পর্যন্ত গ্যানিল-এর আধা বণিকবাদী প্রতিক্রিয়া একেবারে ভিত্তিহীন নয়।” (Wilhelm Roscher, Die Grundlagen der Nationaloekonomie, 3rd Edn., 1858 pp, 207-210), বড়! ছোট! যথেষ্ট! একেবারে নয়! এ পর্যন্ত! ধারণা ও ভাষা সম্পর্কে কী স্পষ্টতা ও যথাযথতা! আর এই পেশাদারি বোলচালকেই রশ্চার সবিনয় অভিহিত করেছেন, রাষ্ট্ৰীয় অৰ্থনীতির “অঙ্গ সংস্থানগত শারীরবৃত্ত ভিত্তিক পদ্ধতি বলে! একটি আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব অবশ্য তারই প্ৰাপ্য, যথা অৰ্থ হচ্ছে “একটি মনোরম পণ্য।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *