২. বন্দি

০৬.  বন্দি

 দাসত্বের শেকল পড়েছে প্রসপেরোর গলায়। কোমর পর্যন্ত অনাবৃত অবস্থায় সে বসে আছে দার্স-মাল্লাদের সঙ্গে। হেঁটে ছোট করে ফেলা হয়েছে ওর লালচে বাদামি চুল। বেঞ্চের সঙ্গে শেকল। দিয়ে পা বাঁধা হয়েছে ওর। মধ্য গ্রীষ্মের প্রখর রোদে উদোম শরীরে দাসদের বেঞ্চে বসে আছে ও। সঙ্গের মাল্লাদের সঙ্গে সমান তালে ওকেও বৈঠা বেয়ে যেতে হচ্ছে। নয়তো বাকি সবার মত ওর পিঠেও আছড়ে পড়বে ওয়ার্ডেনের নির্মম চাবুক।

প্রসপেরোর শোবার জায়গাটা ওর শরীরের চেয়েও কম চওড়া। একটা কাঠের তক্তার উপর বিছানো একটা চামড়া মাত্র। সেটাও আবার অসংখ্য ছারপোকার ঘরবাড়ি। খাবার হিসেবে ওর জন্য প্রতিদিনের বরাদ্দ ত্রিশ আউন্সের মত বিস্কিট আর এক পাত্র পানি। এই দিয়েই ওকে ক্ষুৎপিপাসা মেটাতে হয়।

এই অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া একজন ন্যূনতম রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষের পক্ষেও ভয়াবহ কঠিন কাজ। কিন্তু তারপরও মানিয়ে নিতেই হয়। তখন নিজের চারদিকে গড়ে ওঠে নির্লিপ্ততার অদৃশ্য এক প্রাচীর।

প্রসপেরোকেও তা-ই করতে হয়েছে। এখন প্রসপেরোর পরিচয়, ও স্রেফ একজন দাস। আর দাসদের দুনিয়ায় মানবিকতা শব্দটার কোন স্থান নেই। ওটা স্রেফ বিলাসিতা। কথাটা মেনে নিতে হয়েছে প্রসপেরোকেও।

প্রসপেরোকে বসানো হয়েছে নিকোলো লোমেলিনোর ছাপ্পান্ন দাঁড়ের গ্যালি মোরা-তে। আত্মসমর্পণ করার পর বন্দি করে দাস হিসেবে দাড়ির আসনে বসানো হয় ওকে। যার পাশে ওকে স্থান দেয়া হয়েছে সে বাদামি গাত্রবর্ণের চমৎকার শরীর-স্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মানুষ। প্রথম যখন ওকে ওই লোকটার পাশে বসানো হয়, লোকটার কালো চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। তারপর তার চোখে খেলে যায় কৌতুক। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। তার দিকে তাকায় প্রসপেরো। লোকটার কালো চোখ, বাদামি শরীর, মুখ ভরা দাড়ি আর চওড়া হাসি চোখে পড়ে ওর। তখন তাকে চিনতে পারে সে। সে আর কেউ নয়, খায়ের-আদ দীনের প্রথম সারির কমাণ্ডারদের একজন, মহান কোর্সেয়ার নৌ কমাণ্ডার দ্রাগুত।

এই দ্রাগুতকেই গোইয়ালার যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করেছিল খোদ প্রসপেরো। আর আজ শেকলে বাঁধা অবস্থায় তারই পাশে দাঁড় টানা দাস হিসেবে বসতে হয়েছে প্রসপেরোকে। দুজনেরই মনে হচ্ছে এ স্রেফ কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। বরং তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। দুজনেরই মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং ঈশ্বরের অঙ্গুলি-হেলনে ঘটনাগুলো ঘটেছে।

বিহ্বলতা কাটিয়ে দ্রাগুত বলল, সকল প্রশংসা কেবল এক আল্লাহর। নিশ্চয়ই তাঁর যা ইচ্ছা তিনি করেন এবং তিনি কী করবেন তা কেবল তিনি ছাড়া আর কেউই জানে না, বলেই হা হা করে হেসে উঠল সে। তারপর স্প্যানিশ আর ইটালিয়ানের মিশ্র টানে বলল, যুদ্ধভাগ্য, কী বলেন, ডন প্রসপেরো?

বিস্মিত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল লোমেলিনো। তবে প্রসপেরে নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত হলেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল না। ও-ও হেসে ফেলল। কাষ্ঠ হাসি যদিও। হাসি মুখেই বলল, যুদ্ধভাগ্য, সেইসঙ্গে আমাদের ভাগ্যের লিখন, সিনর দ্রাগুত।

ওদের কথোপকথন লোমেলিনোর কানেও যাচ্ছে। কথাগুলো তার কপালের ভাজ আরেকটু গভীর করে তুলল।

দ্রাগুত বলছে, বাহ! গাছের ডাল থেকে কুঠারের হাতল তৈরি হলো, এখন কুঠার তোলা হয়েছে সেই গাছকেই কাটতে। বেশ, বেশ! আমার বেঞ্চের রাজত্বে স্বাগতম, মেসার প্রসপেরো। একজন অবিশ্বাসীকে (বোঝাতে চাইছে, অমুসলিম) যদি আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাটতে হয়, তাহলে সেই লোক আপনি হওয়াই ভাল। কিন্তু বলতেই হচ্ছে, আল্লাহর মহিমা বোঝা বড় দায়।

ওদিকে প্রসপেরোকে টুলের সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা দেখে বিমলানন্দ পাচ্ছে ফিলিপ্পিনো ডোরিয়া। তাকে ওভাবে খুশি হতে দেখে দ্রাগুতকে উদ্দেশ্য করে প্রসপেরো মন্তব্য করল, আপাতত আমাদেরকে মানুষের কুটিল চিন্তার ধাক্কা সামলাতে হবে। খোদারটা পরে ভাবলেও সমস্যা নেই।

.

একটু পিছনে ফিরে যাই।

আমালফির যুদ্ধে প্রায় দুই হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। আর জেনোয়িস কমাণ্ডারের হাতে বন্দি হয়েছে অনেক ফ্রেঞ্চ অফিসার। বন্দিদের এনে কাতাঁরবদ্ধ করে দাঁড় করানো হয়েছে জাহাজের ডেকে। টিবারনাকলের ধনুকাকৃতির খিলানের নিচে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছে ফিলিপ্পিনো। বন্দিদের সারিতে প্রসপেরোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মন। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে দাঁড়াল প্রসপেরোর সামনে।

চোখে-মুখে কুটিল একটা হাসি ফুটিয়ে প্রসপেরোকে বলল, স্বাগতম, আমার যতটুকু মনে পড়ে শেষবার যখন আমরা একত্রিত হয়েছিলাম তখন বড় বড় কথা বলেছিলে তুমি। দেখব এবার, মুদে কত তোমার, বলে লোমেলিনোকে ডাক দিল সে। হুকুম করল, লোমেলিনোর জাহাজে দাঁড় বাইবার দাস হিসেবে প্রসপেরোকে বন্দি করে রাখতে।

সঙ্গে সঙ্গেই প্রসপেরোর সহবন্দিদের ভিতর থেকে উঠল ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধান্বিত প্রতিবাদ। সবাই দুয়ো দিতে থাকল ফিলিপ্পিনোকে। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ছিল অ্যাভালস এর আলফোন্সে ডেল ভাস্টোর কষ্ঠ। সে বলল, স্যর, আপনি প্রসপেরোকে অপমান করতে চাইলেও প্রকৃতপক্ষে অপমানিত হচ্ছেন আপনি নিজে।

জবাবে বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল ফিলিপ্পিনো।

প্রসপেরোর অপমানকে নিজের অপমান ভেবে নিয়ে প্রসপেরোর সঙ্গে দাঁড় বাইবার বেঞ্চে যেতে চাইল মারকুইস ডেল ভাস্টো। তবে ফিলিপ্পিনোর মনে আছে যে এই মারকুইস স্পেন সম্রাট পঞ্চম চার্লসের খুবই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। তাকে অবশ্যই সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। কাজেই নিজের উগ্র মানসিকতাকে লাগাম পড়াতে বাধ্য হলো ফিলিপ্পিনো। এবং প্রসপেরোর ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা দিতে চাইল। বলল, মাই লর্ড মারকুইস, যদি ভেবে থাকেন আমি আমার ব্যক্তিগত ঘৃণা চরিতার্থ করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাহলে ভুল করবেন। এই লোকটা সাধারণ কোন যুদ্ধবন্দি নয়। পোপের মিত্রবাহিনীতে খুব বড় ও দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত ছিল ওই প্রসপেরো। সে ছিল ন্যাভাল ফ্লিটের কমাণ্ডার। কিন্তু জাহাজ ও জাহাজের দায়িত্ব ফেলে পালিয়ে তার পদের অমর্যাদা করেছে সে। এ কারণেই তাকে এই শাস্তি দিয়েছি। প্রসপেরোকে অবশ্যই ফ্রেঞ্চ আদালতে বিচারের মুখে দাঁড়াতে হবে। ফ্রান্সের রাজার প্রতি তার দায়িত্ব ছিল। এবং রাজা যেহেতু পোপের সঙ্গে মৈত্রী করেছে তাই পোপের হুকুমের প্রতিও তার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পিঠটান দিয়েছে ও। কাজেই ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত ওকে পলাতক আসামি হিসেবে বিবেচনা করা ও বন্দি করে রাখা আমার দায়িত্ব। বুঝতেই পাচ্ছেন, লর্ড মারকুইস, আমার আসলে কিছু করার নেই। দায়িত্বের শেকলে আমার হাত পা বাঁধা।

বয়সে তরুণ হলেও অভিজ্ঞ লোক মারকুইস। ফিলিপ্পিনোর মিষ্টি কথায় ভুলবার লোক সে নয়। সে-ই উল্টো ফিলিপ্পিনোকে অপমান করে বলল, বেশ বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, মিথ্যার উপর রঙ চড়িয়ে প্রায় সত্য হিসেবে উপস্থাপনে আপনি অসম্ভব দক্ষ। অথবা দায়িত্ব সম্বন্ধে আপনার ধারণা সঠিক নয়। ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে কাউকে অপমান করা বা শাস্তি দেয়া মোটেও ভদ্রোচিত নয়, মেসার ডোরিয়া।

মারকুইসের কথা শুনে প্রচণ্ড রাগে কেঁপে উঠল ফিলিপ্পিনো। বলল, আমার হাতে যেহেতু বন্দি আছেন সেহেতু কেবল নিজের ভালমন্দ নিয়েই ভাবুন। বলার মত এতটুকু কথাই খুঁজে পেল সে। তারপর ঘুরে ডাক দিল লোমেলিনোকে। বলল বন্দিকে (প্রসপেরোকে) যেন তার জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরেকবার প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইল লোমেলিনো। কারণ তার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে প্রসপেরো। আর প্রচলিত রীতি হচ্ছে, কাউকে যুদ্ধবন্দি করা হলে যার কাছে সে আত্মসমর্পণ করবে বন্দির মুক্তিপণের দাবিদার সে-ই। এবং বন্দিকে সাধারণত তার হেফাজতে রাখা হয় না। তাই প্রসপেরোর দায়িত্ব অন্য কারো হাতে সমর্পণের পূর্ণ অধিকার আছে তার। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্য ফিলিপ্পিনোকে আবার প্রশ্ন করতেই সে খেঁকিয়ে উঠে বলল, শোনোনি, আমি কী বলেছি? বলেছি প্রসপেরো কোন সাধারণ যুদ্ধবন্দি নয়। ও একজন পলাতক সামরিক কয়েদি। ওকে আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা আমার দায়িত্ব। কয়েকটা দুৰ্বত্তের কথায় আমাকে দায়িত্ব থেকে পিছু হঠতে বলছ না নিশ্চয়ই?

ফিলিপ্পিনোর কূটচাল আর হঠকারিতা স্পষ্ট বুঝতে পারছে লোমেলিনো। কিন্তু আর কিছু বলার সাহস ওর নেই। কারণ একচোখা ফ্রেঞ্চ দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রসপেরোকে দোষী না বলে তার উপায় নেই। নয়তো নিজের গর্দান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

ওদিকে বন্ধুর স্বপক্ষে যা-যা বলা সম্ভব তার সবই মারকুইস ডেল ভাস্টো ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছে। অন্যান্য বন্দি অফিসারদেরকে তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ীই রাখা হলো। তবে মারকুইসকে নিয়ে যাওয়া হলো ফিলিপ্পিনোর গ্যালিতে। বলা চলে তার একরকম প্যারোল মঞ্জুর করা হয়েছে। সেখানে বসেই মার্শাল ডি লট্রেসকে কড়া ভাষায় লেখা লম্বা একটা চিঠি পাঠাল মারকুইস, যার মূল বক্তব্য, ফ্রেঞ্চ নৌবাহিনীর কমাণ্ডার এই এলাকায় মূল ফ্রেঞ্চ প্রতিনিধি হিসেবে এই যুদ্ধের বন্দিদেরকে উদ্ধারে যেন দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। মারকুইসকে খুশি করতে মার্শাল ডি লট্রেস যুদ্ধবন্দিদেরকে তার হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানাল।

কিন্তু ধূর্ত ফিলিপ্পিনো তাতে রাজি নয়। ডোরিয়া পরিবারের বাকি সবার মত সে-ও নিজের লাভটা খুব ভাল দেখতে পায়। কাজেই মার্শালের দাবির জবাবে সে জানাল আমালফির যুদ্ধে আটককৃত যুদ্ধবন্দিরা লর্ড ডোরিয়ার বন্দি। এবং তার হয়েই লড়াইয়ে নেমেছে ফিলিনিনা।

মার্শাল তখন ফিলিপ্পিনোকে আরো চাপ দিল। চিঠিতে বলল, ডোরিয়া ফ্রান্সের রাজার প্রতিনিধি। এবং এখানে ফ্রান্সের রাজার প্রধান প্রতিনিধি হচ্ছে মার্শাল লট্রেস নিজে। সেই ক্ষমতাবলে সে জোর দাবি জানাল যেন বন্দিদেরকে তার হাতে তুলে দেয়া হয়।

এই চিঠি পেয়ে ফিলিপ্পিনোর আত্মা কেঁপে গেলেও মার্শালের দাবি সে মেনে নেয়নি। বরং সে পাল্টা চিঠি দিয়ে জানায়, ডোরিয়ার হুকুম অনুযায়ী এই যুদ্ধের বন্দিরা সবাই ভোরিয়ার বন্দি। এবং তাদের মুক্তির বিনিময়ে প্রাপ্য মুক্তিপণেরও বৈধ হকদার ডোরিয়া নিজে। তবে মার্শাল যেহেতু বন্দিদেরকে নিজের দায়িত্বে নিতে চাইছে তাই ডোরিয়ার কাছে স্পষ্ট নির্দেশ ও নির্দেশনা চেয়ে চিঠি লিখবে ফিলিপ্পিনো। এবং চিঠির জবাব পেলে সেই অনুযায়ীই পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

সুতরাং ওভাবেই ঝুলে রইল ব্যাপারটা। পুরো ঘটনাটায় রেগে গিয়ে থাকলেও অস্বস্তির সঙ্গে ব্যাপারটা চেপে থাকতে বাধ্য হলো ফিলিপ্পিনো। আসলে বন্দিদেরকে ধরে রাখা বা মুক্তিপণ আদায় করা ফিলিপ্পিনোর কাছে কোন বড় বিষয় না। লট্রেসকে খেপানোর বদলে বন্দিদেরকে খুশি মনে তার হাতে তুলে দিতেও আপত্তি ছিল না ওর। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। বন্দিদেরকে তুলে দিলে ওদের সঙ্গে প্রসপেরোকেও যে দিয়ে দিতে হয়! এখানেই ওর যত আপত্তি। ও প্রসপেরোকে কেবল ঘৃণাই করে না, ভয়ও পায়। কারণ সুযোগ পেলেই প্রসপেরো যে ওদের অপকর্মের প্রতিশোধ নেবে তাতে ওর মনে কোন সন্দেহ নেই। এবং প্রতিশোধের সঙ্গে লিগুরিয়াদের শাসন ক্ষমতা ডোরিয়া পরিবারের হাত থেকে অ্যাডর্নো পরিবারের হাতে চলে যাবে, এটাও ছিল ফিলিপ্পিনোর গাত্রদাহের আরেকটা বড় কারণ।

আবার বর্তমানে ফিরে আসছি।

লোমেলিনো আর একজন ওয়ার্ডেনকে সঙ্গে নিয়ে গ্যাং ডেকে নেমে এল ফিলিপ্পিনো। এই ডেকেই দ্রাগুতের সঙ্গে এক টুলে শেকলে বাঁধা হয়েছে প্রসপেরোকে। দ্রাগুতকে উদ্দেশ্য করে অর্থপূর্ণভাবে শীতল কণ্ঠে ফিলিপ্পিনো বলল, সঙ্গীকে নিশ্চয়ই পছন্দ হয়েছে, মেসার দ্রাগুত? যে আপনাকে বন্দি করেছিল আজ সে-ই আপনার পাশে বন্দি হিসেবে বসে দাঁড় টানছে। আপনার প্রতিশোধের ইচ্ছা নিশ্চয়ই একটু হলেও পূর্ণ হয়েছে, কি বলেন, মেসার দ্রাগুত?

মুখ তুলে ফিলিপ্লিনোর দিকে নির্ভীক দৃষ্টিতে চাইল সে। বলল, মধু মাখা কথাগুলো দিয়ে কাকে পরিহাস করছেন?

ফিলিপ্পিনোর চোখের পাতা কুঁচকে গেল। আলাদা আলাদাভাবে আপনাদের দুজনকেই আমার বিরক্ত লাগে। তবে দুজন একত্রে দাঁড় বাইতে বসলে সেটা দেখার মত দৃশ্য বটে। আপনাদেরকে এভাবে দেখে লর্ড ডোরিয়া ভীষণ মজা পাবে।

প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, মজা তো পাবেই। সে আর তার মত বাকি সব নির্লজ্জই মজা পাবে।

কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিতে চাইল ফিলিপ্পিনো। বলল, হাহ্, আপনি লজ্জার কথা বলছেন?

জবাবে প্রসপেরো বলল, না, নির্লজ্জতার কথা বলেছি। এটা অবশ্য আমার চেয়ে তোমার ভাল বোঝার কথা। মেসার দ্রাগুত আর আমাকে একসঙ্গে দেখে তোমার শিক্ষা নেয়া উচিত যে, গোইয়ালাতার যুদ্ধে কীভাবে আমি ডোরিয়ার চামড়া বাঁচিয়েছিলাম। বিনিময়ে আজ আমি কী পেয়েছি? সেদিন তাকে বাঁচানোয় আজ তুমি আমাকে বলতে পারো বোকার হদ্দ। তবে তখন তরুণ ছিলাম, স্বার্থপর দুনিয়াটাকে তখনও চিনতে শিখিনি। অনেকবার অনেকের কাছে ঠকেছি। তারপরও বলছি, এখনও আমি বিশ্বাস করি মহত্ত্ব, দয়া, ক্ষমা এখনও হারিয়ে যায়নি। অবশ্য এসবের সঙ্গে তুমি পরিচিত কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাল ফিলিপ্পিনো। ঘুরেই ওয়ার্ডেনকে হুকুম করল, চাবুকটা দাও।

ক্যাপ্টেন লোমেলিনো আগে থেকেই যথেষ্ট বিব্রত। প্রসপেরোকে যখন তার জাহাজেই দাঁড়ে বসানো হয় তখন থেকেই সে ভীষণ অসন্তুষ্ট। কিন্তু এবার আর তার সহ্য হলো না। প্রতিবাদ করল সে। অথবা হয়তো তার ভিতরের ভদ্রলোকের সত্তাটি মাথা তুলল। বা হয়তো তার মনে পড়ে গিয়েছিল, জেনোয়ায় অ্যাডর্নো পরিবারের মর্যাদা কোথায়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে দৃশ্যত জেনোয়াতে ডোরিয়া পরিবারের শাসনের অন্তিম কাল চলে এসেছে প্রায়। কাজেই লোমেলিনোর ভয়, সত্যি সত্যি তেমন কিছু হয়ে গেলে ফ্রেগোসি পরিবারও রেহাই পাবে না। কারণ ডোরিয়াদেরকে সমর্থন দিয়েছিল তারা। ডোরিয়ারা সরতে বাধ্য হলে নিশ্চিতভাবে জেনোয়ার ক্ষমতায় আসবে অ্যাডর্নো পরিবার। তখন, যারা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে বা তাদের দুঃসময়ের ফায়দা লুটেছে, অ্যাডর্নোরা নিশ্চয়ই তাদের ছেড়ে কথা কইবে না। শেষ কথা হচ্ছে, সে যে চিন্তাই করে থাকুক, ফিলিপ্পিনোর কাজের প্রতিবাদ করল সে। বলল, চাবুক দিয়ে কী করবেন?

ফিলিপ্পিনো বলল, কী করব? চাবুকটা আমার হাতে আসুক, নিজেই দেখতে পাবে কী করি।

ওয়ার্ডেনকে পিছিয়ে যেতে ইশারা করল লোমেলিনো। আর ফিলিপ্পিনোকে বলল, প্রসপেরো আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু ওর মুক্তিপণ আপনি নেবেন সেটাই তো যথেষ্ট। এমনকী তাকে দাঁড়ে মাল্লাদের সঙ্গে বসাতেও আমার আপত্তি ছিল। কিন্তু আপনি তা-ই করতে আমাকে বাধ্য করেছেন। এটাই তো আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট লজ্জাজনক। আর এখন তার গায়ে হাত তুলতে চাইছেন?

শুনে রীতিমত খেঁকিয়ে উঠে ফিলিপ্পিনো বলল, নিকোলো, শুনেছ এই কুত্তাটা কী বলছে?

লোমেলিনোও বলল, ওকে যা বললেন, সেটাও আমি শুনেছি।

কয়েকটা লম্বা মুহূর্ত লোমেলিনোর দিকে তাকিয়ে রইল ফিলিপ্পিনো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলল, প্রসপেরোকে তোমার গ্যালিতে বন্দি করে রাখাটা তোমার পছন্দ না হলে ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্যই লর্ড ডোরিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারো। দুয়েকটা জরুরি ব্যাপার জেনে রাখো… বলে কনুই ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল পুপ কেবিনের আছে। ওখানে তার সঙ্গে নিচু গলায় কিছু কথা বলে চলে গেল ফিলিপ্পিনো।

অভিশাপ দিয়ে দ্রাগুত বলে উঠল, ওর আর ওর মালিক ডোরিয়ার কবর দুটোকে যেন বুনো কুকুর আঁচড়ে খায়। ওদের কারণে আজ আমি এই জাহান্নামে পচে মরছি, কে শুনল আর কে শুনল না তার পরোয়া না করে কথাগুলো বলে ফেলল দ্রাগুত। তারপর প্রসপেরোর দিকে ফিরে হেসে বলল, আন্দ্রের ভাতিজা চাইছে আমি যেন আপনার উপর প্রতিশোধ নিই। একটা ধূর্ত শয়তান ও।

মৃদু একটু হাসি খেলে গেল প্রসপেরোর ঠোঁটে। বলল, হ্যাঁ, জানি। কিন্তু আমার কাছে এখনও বেঁচে থাকাটা জরুরি। মারা যাওয়ার আগে আমাকে তিনটা কাজ করে যেতেই হবে।

দ্রাগুত তখন বলল, হ্যাঁ, বেঁচে থাকলে হয়তো করবেন। কিন্তু মারা গেলে কী করেছেন আর কী করেননি তাতে কী আসে যায়?

আমার কিছু আসে যায় না বটে, কিন্তু অন্যদের আসে যায়।

আপনার যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবেন না। বরং আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই করবেন। তার ইচ্ছাতেই চলে সবাই। অনেক আগেই আমাদের ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে।

জবাবে প্রসপেরো বলল, আমার মনে হয় আল্লাহতায়ালা আমার ভাগ্যে ইতিমধ্যে ওই তিনটা ব্যাপারে সফল হওয়া লিখে দিয়েছেন। নইলে আজ জীবিত অবস্থায় এই দাড়ে বসে থাকতে পারতাম।

এরপরের প্রায় মাসখানেক ধরে ওরা নিয়াপলিটান জলসীমায় ঘুরে বেড়াল। ওই সময় দাঁড়ে বসা সবাইকে গাধার মত খাটতে হলো। সেই দিনগুলোর অসম্ভব পরিশ্রম এমনকী প্রসপেরোর মত অত্যন্ত শক্তিশালী মানুষকেও তলানীতে নামিয়ে আনে। অন্য সময় লোমেলিনো নিজের ক্ষমতা খাঁটিয়ে ওকে চাবুক মারা থেকে রক্ষা করলেও কখনো কখনো তা সম্ভব হত না। কখনো অতিরিক্ত গতির দরকার হয়ে পড়লে বাকি সব দাঁড়ির মত ওর পিঠেও নেমে আসত ওয়ার্ডেনের নির্মম চাবুক।

এভাবে এক মাস বা তার কিছু বেশি চলার পর উপস্থিত হয় ল্যাণ্ডোর ভেনেশিয়ান গ্যালিগুলো। মূলত ওগুলো এসেছে জেনোয়িসদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। সেই দিনই ফিলিপ্পিনোর জন্য একটা জরুরি চিঠি নিয়ে আসে একটা দ্রুতগামী ফেলুকা। চিঠিতে বলা আছে ওকে তক্ষুণি ফিরে যেতে হবে। ফিলিপ্লিনোও খুশি মনে। রাজি হয়ে যায়। কারণ জেনোয়িসরা ভেনেশিয়ানদের পছন্দ করে না। আর ওদের ঘাড়ে ভেনেশিয়ানদের চাপিয়ে দেয়ার ফ্রান্স রাজের সিদ্ধান্তও ও পছন্দ বা সমর্থন করে না। ওই চিঠিটায় আরো একটা হুকুম আছে যে, মারকুইস ডেল স্টোকে তার ক্যাপিটানার টিবারনাকলে থাকতে দিতে হবে। এই হুকুমটা প্রবল অনিচ্ছার সঙ্গে পালন করল ফিলিপ্পিনো। কারণ মারকুইসের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুরুই হয়েছে অপমান দিয়ে। পরেও আর তাদের সম্পর্ক উষ্ণ হয়নি। কিন্তু ফিলিপ্পিনোর কিছু করার নেই কারণ চিঠিটা ডোরিয়ার স্পষ্ট নির্দেশ নিয়ে এসেছে।

ডাক পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই টিবারনাকলে চলে আসে ডেল ভাস্টো। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র দেখিয়ে ফিলিপ্পিনো তাকে বলল, এই মুহূর্তে আমাকে জেনোয়ায় ফিরে যাওয়ার হুকুম করা হয়েছে।

ডেল স্টোর প্রতিক্রিয়া, অবরোধের কী হবে?

ড্যাম কেয়ার গলায় ফিলিপ্পিনো বলল, ওটা ভেনেশিয়ানদের মাথাব্যথা। অবরোধ খুব বেশিদিন থাকবে বলে আমার মনে হয় না। দুর্ভিক্ষ আর মহামারী যদি আর কিছুদিন চলে তাহলে লট্রেসকেও পাততাড়ি গোটাতে হবে। শুনেছি, তার ক্যাম্পেও ঢুকে পড়েছে প্লেগের জীবাণু। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো ইটালিতেই ছড়িয়ে পড়বে এই প্লেগ। জেনোয়াতেও শুরু হয়ে গেছে বলে শুনেছি। লট্রেস যখন ক্যাম্প করে তখনই তাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম যে, কোন জলাধারের সঙ্গে যেন সংযোগ না রাখে। কিন্তু আমার কথা সে শোনেনি। নিজের কথাই সে ঠিক মনে করেছে। ফ্রেঞ্চম্যানদের যা বৈশিষ্ট্য হয় আরকী।

ফ্রেঞ্চদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য শুনে ডেল ভাস্টোর ভ্র দুটো একবার উঁচু হয়েছে কেবল। কিন্তু কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত রইল সে।

ফিলিপ্পিনো বলে চলেছে, হয়তো এখন সে বুঝতে পারছে, আমি মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলাম। পানির সঙ্গে মহামারীর জীবাণু চারিদিকে ছড়াচ্ছে। সেইসঙ্গে ওই পানি পচে দৃষিত আর বিষাক্ত করে তুলছে বাতাস। লট্রেসকে বলেছিলাম, নিয়াপলিটান এলাকায় গ্রীষ্মে ক্যাম্প না করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আসলে ফ্রেঞ্চদের আপনি কখনোই কিছু শেখাতে পারবেন না। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ, সময় থাকতেই আমার চাচাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।

ডেল ভাস্টো তখন বলে বসে, আহ, তাই? আমি বসতে পারি? বলে একটু সরে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। ডেল ভাস্টোর কাছে কোন অস্ত্র নেই। তার পরনের সিল্কের পোশাকটার রঙ হলুদাভ সাদা আর তার কোমরের বেল্টে শোভা পাচ্ছে ক্যাবোকন এমারেল্ড। নেপলস থেকে পোশাক-আশাক কেনার অনুমতি পেয়েছে সে। খরচ আসে তার জন্য আসা চিঠির দৌলতে। যা হোক, ফিলিপ্পিনোর কথার জবাবে সে বলল, মেসার আন্দ্রে তাহলে বুঝতে পেরেছে যে সে এতদিন ভুল প্রভুর আনুগত্য করে এসেছে?

সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে গেল ফিলিপ্পিনো। বলল, চিঠিতে অমন কিছু বলা নেই।

তাই? তবুও আশা করি ব্যাপারটা যেন সে বুঝতে পারে।

 বোঝাবুঝি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করছে।

তাই? তা সেই বিষয়গুলো কী?

আপনার জন্য একটা চিঠি এসেছে। সেটা দিয়েই বিষয়গুলো জানা শুরু করতে পারেন।

চিঠিটা নিয়ে সেটার সিল ভেঙে পড়তে শুরু করল মারকুইস। পড়া শেষে মুখ তুলে বলল, এখানে এমন কিছু নেই যেটা আমাদের সম্রাটের নামে আমি দিতে পারব না।

সম্রাটের নামে!? আরেকটু বুঝতে দিন। সম্রাটের নামে চাচার কাছে যে প্রস্তাব আপনি পাঠিয়েছেন, সেটা বাস্তবায়নের পূর্ণ ক্ষমতা আপনার আছে?

তখন শার্টের বুক পকেটের ভাঁজ থেকে একটা চিঠি বের করল মারকুইস। সেটা দেখিয়ে বলল, এটা হিজ ম্যাজেস্টির নিজের হাতে লেখা। এক সপ্তাহ আগে চিঠিটা আমার হাতে এসেছে। দেখতেই পাচ্ছেন, চিঠিটায় আমাকে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

চিঠিটা ফেরত দিতে দিতে ফিলিপ্পিনো:বলল, আপনি তাহলে সম্রাটের তরফ থেকে চুক্তি করার ক্ষমতা পেয়েছেন। জানেনই তো, আমার চাচার কিছু চাহিদা আছে। যেমন প্রথমেই আছে প্রস্তাবিত ভাতা ও অন্যান্য টাকার প্রসঙ্গ। চিঠিটা তো আপনি নিজেই পড়ে দেখেছেন।

জবাবে ডেল ভাস্টো বলল, হ্যাঁ, পড়েছি। অনেক দাবি দাওয়া। তবে আমাদের সম্রাটের হাত খাট নয়। ফ্রান্সের মহান রাজার মত তিনি তার ক্যাপ্টেনদের অকূল সাগরে ভাসিয়ে দেন না। চিন্তা করবেন না, দাবিগুলো পূরণযোগ্য।

ফিলিপ্পিনো বলল, তাহলে এবার মুক্তিপণ ও গণিমতের মালের প্রসঙ্গ তোলা যায়। ফ্রান্সের রাজা মুক্তিপণের অংশ আর গণিমতের পুরোটাই দাবি করেছেন।

আমাদের সম্রাট দুটোই পরিশোধ করতে রাজি আছেন।

মুখটা গম্ভীর করে ফিলিপ্পিনো বলল, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গ তুলতেই হচ্ছে। সেটা জেনোয়ার স্বাধীনতা নিয়ে।

ডেল ভাস্টো একগাল হেসে বলল, হ্যাঁ, আসলেই এটা গুরুত্বপূর্ণ। ভেবেছিলাম, প্রথমেই এই প্রসঙ্গটা তুলবেন।

ডেল ভাস্টোর সকৌতুক মন্তব্য ফিলিপ্পিনোর মোটেও পছন্দ হয়নি। প্রথমে গাম্ভীর্য, তারপর কৌতুক ফিলিপ্পিনোর সন্দেহ জাগিয়ে তুলছে। ও ভাবছে, আসলেই কতটা জানে এই ডেল ভাস্টো। যা-ই জানুক, এখনই কথাবার্তা শেষ হবে।

ডেল ভাস্টো বলে চলেছে, আমি ভাল করেই জানি, ফ্রান্সের রাজার তরফ থেকে আপনার চাচা যে কথা দিয়েছিলেন তা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফ্রেঞ্চ রাজের স্বভাব সম্বন্ধেও আমি ভালভাবেই অবগত। মহামান্য পোপের দেয়া কথাও রক্ষা হয়নি।

এমনকী জেনোয়ায় আপনার চাচার বর্তমান নড়বড়ে অবস্থান সম্বন্ধেও আমি জানি। আমার জানাশোনা দেখে অবাক হচ্ছেন? অবাক হবেন না। জানাই আমার কাজ। আর, এসব না জানলে নিশ্চয়ই মেসার ডোরিয়ার কাছে আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব পাঠাতাম না? জেনোয়াবাসীর প্রতি তার প্রতিজ্ঞাগুলো তো রাখতে হবে। সেটাই আমাকে বেশি আগ্রহী করে তুলেছিল। যতদিন মেসার ডোরিয়া ফ্রেঞ্চ রাজের আনুগত্য করছে ততদিন ওই প্রতিজ্ঞা পূরণ করার আশা দুরাশা হয়েই রইবে।

বেশ বিরক্ত গলায় ফিলিপ্পিনো বলল, অত বেশি অনুমান করতে যাবেন না। একটা ব্যাপার আপনাকে নিশ্চিত করছি, জেনোয়ার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা যে না দেবে, আমার চাচা তার সঙ্গে কখনোই হাত মেলাবে না।

অবশ্যই, অবশ্যই…

ডেল স্টোর গলায় এমন একটা সুর ফুটল যে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফিলিপ্পিনো। বুঝতে চাইল, লোকটা তাকে নিয়ে মস্করা করছে কিনা। তারপর জোর গলায় বলল, আপনারা নিশ্চয়ই এটা মানতে রাজি আছেন যে, লিগুরিয়ান রিপাবলিকের (জেনোয়ার আরেক নাম) শাসন ও পরিচালনায় কোন বিদেশি রাষ্ট্র কখনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না?

বুঝতে পেরেছি। তবে এই ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা এককভাবে সংরক্ষণ করেন কেবলমাত্র সম্রাট।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সম্রাট কি লিগুরিয়াদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? মনে রাখবেন, এই কথার উপরই নির্ভর করছে স্প্যানিশ সম্রাটের সঙ্গে লর্ড ডোরিয়ার চুক্তি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি, সম্রাট এই ঘোষণা না দিলে আমাদের মধ্যে কোন চুক্তিই হবে না।

জবাবে ডেল ভাস্টো বলল, আমাদের সম্রাটের কাছে। জেনোয়া একটা সেতুর অপর প্রান্ত। জেনোয়ার প্লোর্ট ব্যবহার করার সুবিধা দেয়া হলে, জেনোয়িসরা তাদের ইচ্ছামত শাসক বেছে নিতে পারবে। এ বিষয়ে সম্রাট কোন হস্তক্ষেপ করবেন না। আর বাইরের কেউ যেন হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেটাও তিনি দেখবেন।

ফিলিপ্পিনো তখন বলল, আমরা এমনকী ইটালির সামরিক সরকারকেও ট্যাক্স দিতে পারব না।

আমি তো আগেই বলেছি, জেনোয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবেন সম্রাট। কিন্তু, বিনিময়ে চান জেনোয়ার বন্দর ব্যবহারের অধিকার। আর কোন দাবি তার নেই।

মোটামুটি সন্তুষ্ট হলো ফিলিপ্পিনো। বলল, আপনি যেহেতু আপনার সম্রাটের পক্ষে এতকিছুর নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, তাই লর্ড ডোরিয়ার পক্ষ থেকে বলছি, ধরে নিতে পারেন আমাদের সমঝোতা হয়ে গেছে। শুধু আনুষ্ঠানিক সই-স্বাক্ষর বাকি রইল।

দারুণ। আমাদের কাজ মোটামুটি শেষ। এখন তাহলে বলা যায়, আমালফির যুদ্ধে আপনার বন্দি করা স্প্যানিশ সৈন্য ও অফিসারদের জন্য আর কোন মুক্তিপণের ব্যাপার থাকছে না।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ফিলিপ্পিনোর চেহারা থেকে সন্তুষ্টির ছাপ গায়েব হয়ে গেল। ও বলল, এই ব্যাপারটা লর্ড ডোরিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়াই ভাল। যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত সমস্ত সম্পদ তার প্রাপ্য।

ডেল ভাস্টোর মুখে ফুটে উঠল চতুর হাসি। সে বলল, স্যর ফিলিপ্পিনো, এই প্রশ্ন তুলবে মঁসিয়ে ডি লট্রেস। আপনি নন। কারণ ইতিমধ্যেই লর্ড ডোরিয়া আপনার মাধ্যমেই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি স্পেন সম্রাটের সেবক। কাজেই সম্রাটের এক সেবক আরেক সেবককে আটকে রেখে তার জন্য মুক্তিপণ চাইতে পারে না।

ডেল স্টোর চেহারায় এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার আভাসও নেই। তাই দেখে ফিলিপ্পিনো বলল, ঠিকই বলেছেন। কথা দিচ্ছি, চুক্তি স্বাক্ষর হলেই এরা সবাই মুক্তি পাবে।

আপনার বন্দিদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। বিশেষভাবে মেসার প্রসপেরেরার ব্যাপারে। তার মুক্তির জন্য আমি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। তার বর্তমান অপমানজনক অবস্থান থেকে এখনি মুক্তি চাইছি। এবং তার যা পদমর্যাদা, সেই অনুযায়ী তার সঙ্গে আচরণ দাবি করছি।

ফিলিপ্পিনোর চিকন মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। উত্তর দেবার আগে একমুহূর্ত থেমে কথা গুছিয়ে নিল সে। তারপর বলল, মাই লর্ড, কী বলছেন আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না। প্রসপেরো সাধারণ যুদ্ধবন্দি নয়। সে একজন সামরিক অপরাধী…

সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাধা দিয়ে ডেল ভাস্টো বলল, ওসব আগেও শুনেছি। আবার নতুন করে বলার দরকার নেই। বলে এক কদম এগিয়ে টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডেল ভাস্টো। তারপর ফিলিপ্পিনোর চোখে চোখ রেখে বলল, আপনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সম্রাটের মূল্যবান ও অনুগত একজন অফিসারকে মাল্লাদের দাঁড়ে পচতে দেয়া সম্ভব না।

ফিলিপ্পিনোর ভিতর ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনে ঘি ঢেলে দিল ডেল স্টোর কথাগুলো। ফুঁসে উঠল ফিলিপ্পিনো। সম্রাটের মুখ থেকে এমন কথা ও মানতে পারে। কিন্তু তার নিচের কারো কাছ থেকে অমন তিরস্কার কোনভাবেই মানতে রাজি না সে। বলল, আমরা ডোরিয়ারা কিন্তু সম্রাটের সেবায় এখনও যোগ দিইনি।

সমান তেজে জবাব দিল মারকুইস, যদি আমার এই দাবি উপেক্ষা করা হয় তাহলে সম্রাটের সেবায় আপনাদের যোগ দেয়া হবেও না। তার আগে বলুন, সম্রাট আপনাদেরকে তার আশ্রয়ে নিচ্ছেন, নাকি আপনারা সম্রাটকে আপনাদের আশ্রয়ে নিচ্ছেন? আপনার সব কথাই আমি শুনেছি। আপনাদের এই দাবি আছে, ওই দাবি আছে, সেই দাবি আছে। আমি শুনেছি, মেনেছিও। আমার দাবিও আপনি শুনেছেন। এবং আমাদের মাঝে চুক্তি হতে হলে এই দাবি বাস্তবায়ন হতেই হবে।

ফিলিপ্পিনো খুব ভাল করেই জানে জেনোয়ার শাসন-ক্ষমতা ডোরিয়া পরিবারের হাতে ধরে রাখতে হলে স্পেন রাজের সাহায্য তাকে পেতেই হবে। তাছাড়া আলোচনায় ব্যর্থ হলে ওর নিজের কোন কৃতিত্ব তো থাকবেই না, সঙ্গে চামড়াও যেতে পারে। কাজেই তার রাগে পানি ঢেলে দিল ডেল স্টোর কথাগুলো। তখন ফিলিপ্পিনো বলল, কিন্তু এটা তো বিবেচনা করবেন, যে এই লোকটা সাধারণ কোন বন্দি নয়। অন্য সবাই সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত বংশের লোক। আরও…।

ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ডেল ভাস্টো বলল, প্রসপেরো আমার বন্ধু।

একবার বাউ করে ফিলিপ্পিনো বলল, তারপরও, মাই লর্ড। আমার দায়িত্বের একটা প্রশ্ন তো রয়েই যায়। এক বছর আগে পোপের সেবায় কার্যরত থাকতে, ও নিজের দায়িত্ব ছেড়ে পালায়…

সেটা পোপের মাথাব্যথা, আপনার না।

আমাকে একটু বলতে দিন। আমরা ফ্রান্সের আনুগত্য করি। আর পোপের মৈত্রী ফ্রান্স রাজের সঙ্গে। কাজেই এটা আমারও দায়িত্ব।

শুনেছি, আর আমার বক্তব্যও বলেছি। কটু কথাগুলো আবার বলতে চাইছি না। একটু আগে না আপনিই বলেছেন আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেছে, এখন শুধু চুক্তিতে সই বাকি?”

কিন্তু ওই অপরাধটা হয়েছে যখন ও ছিল ফ্রান্সের সঙ্গে…

এখন আর সেই মৈত্রী নেই। ফিলিপ্পিনোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ডেল ভাস্টো বলল। যে কথা বলে আপনি ওকে অপমানিত করতে চাইছেন তাতে তো আপনার নিজেরই লজ্জিত হওয়া উচিত। কেন প্রসপেরো ওর দায়িত্ব ছেড়ে চলে এসেছিল তা আমি জানি না ভেবেছেন? আপনাদের অসততা ওকে তেমনটা করতে বাধ্য করেছিল।

আমাকে আপনি অপমান করছেন, মাই লর্ড।

আপনার কারণেই কথাটা বলতে বাধ্য হয়েছি, বলল ডেল ভাস্টো।

তাই বলে অসততা!

আপনার খুব বেশি খারাপ লাগলে আপনাদের অপকর্মের অন্য একটা নামও বের করতে পারি।

ভীষণ রেগে গিয়ে ডেল ভাস্টোর দিকে তাকিয়ে রইল ফিলিপ্পিনো। রাগে ওর নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। বেশ কতগুলো গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে খানিকটা সামলাতে পারল ও। তারপর বলল, আমাকে ভুল বুঝছেন, লর্ড। আমার কাছে এটা স্রেফ একটা দায়িত্ব। এর বেশি কিছু নয়।

তাহলে বলতে হচ্ছে, এখন সেগুলো মূল্যহীন, নিচু কণ্ঠে বলল ডেল ভাস্টো। সে খুব ভাল করেই জানে যে, হাতে চাবুক থাকলেই সেটা দিয়ে সবসময় পেটাতে হয় না। তাই কণ্ঠ নরম করে ফেলল সে। বিনীত কণ্ঠে বলল, আরেহ, এই তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে আমরা এত সময় নষ্ট করছি কেন! সত্য তো সত্যই। আর এটা ভুললেও চলবে না যে প্রসপেরোর বাবার দিকে আততায়ীর তলোয়ার উঠতে যাচ্ছিল স্পেন সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের কারণে। কাজেই তার না পালিয়ে উপায় ছিল না। আপনার কি ধারণা সম্রাট এ বিষয়ে অবগত নন? প্রসপেরোর ঘটনার দিকে নতুন করে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমাকে বাধ্য করবেন না, মেসার ফিলিপ্পিনো। সেটা কারো জন্যই ভাল হবে না। সেটা হয়তো ওই ঘটনার জন্য দায়ীদের প্রতি সম্রাটের রাগ জাগিয়ে তুলবে।

কথাগুলো ফিলিপ্পিনোর আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে। সম্রাটের প্রতিনিধির বক্তব্য ভালভাবে বিবেচনা করে দেখল সে। বাস্তবতা বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান থেকে পিছিয়ে গেল। তারপরও অপমানটা হজম করতে রীতিমত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে ওকে। বলল, নিজের কথা বলতে পারি, ব্যাপারটা ভুলে যাব আমি…

হ্যাঁ, ভুলে যাওয়াই ভাল, পরামর্শ দিল ডেল ভাস্টো।

 মাল্লাদের বেঞ্চ থেকে মুক্তি পেল প্রসপেরো।

.

০৭.

লেরিকি

 পিওমবিনোর খাল নামের সরু সাগর দিয়ে, এক সারিতে এগিয়ে চলছে নয়টা গ্যালি। এলবা দ্বীপ আর মূল ভূখণ্ডের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সাগরের ওই অংশটা বেশ সরু হওয়ায় একে খাল বলা হয়।

পূর্ব-দক্ষিণ থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাস পালে নিয়ে মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলছে জেনোয়িস গ্যালিগুলো। দাড়িরা তাদের দাঁড়গুলো তুলে গুটিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে এই পুব-দক্ষিণা বাতাস এমন দুরন্ত গতিতে বয় যে তখন সেটা ইটালিয়ান নাবিকদের কাছে রীতিমত আতঙ্কের অপর নাম হয়ে দাঁড়ায়। ওই বাতাস তাদের কাছে পরিচিত লিব্বেচিও নামে।

পশ্চিমে মণ্টে গ্রসো পাহাড়ের পিছনে ডুবতে বসেছে সূর্যটা। ডুবন্ত সূর্যের লালচে আলোয় দেখা যাচ্ছে অ্যাসনসেল্লো আর টাসকানের সবুজ পাহাড়।

জাহাজের সারিতে আট নাম্বার গ্যালি সিগনোরা। ওটাতেই বসে আছে ডেল ভাস্টো সহ আমালফি যুদ্ধের আরো তিন বন্দি। সারির সবশেষে আসছে লোমেলিনোর গ্যালি মোরা। মোরা থেকে সেদিন সকালেই প্রসপেরোকে প্যারোল দেয়া হয়েছে। মুক্তি দেয়া হয়েছে দাসত্বের শেকল থেকেও। ডেকের নিচে একটা ছোট্ট কেবিনও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ওর জন্য। ডেল ভাস্টোর ওয়ারড্রোবে নিজের মাপের অনেক কাপড় পেয়েছে ও। কাজেই কাপড় বদলানো কোন সমস্যা হয়নি।

ফিলিপ্পিনোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর সেদিন বিকেলেই প্রসপেরোকে দাঁড়ির আসন থেকে উদ্ধার করতে আসে ডেল ভাস্টো। তখনই ডেল ভাস্টোর সঙ্গে ফিলিপ্পিনোর দর কষা ও নিজের আপাত মুক্তির ব্যাপারটা জানতে পারে প্রসপেরো। সব শুনে ডেল ভাস্টোকে ও বলল, সত্যিই আমাকে আপনি বন্ধু বলে মনে করেন, আমি কৃতজ্ঞ।

নাহ্। আমি শুধু আপনার ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ের চেষ্টা করেছি, ডেল ভাস্টোর বিনীত মন্তব্য।

দাসদের সারি থেকে প্রসপেরোকে নিয়ে ওপরে প্রথম ডেকে উঠে এসে ডেল ভাস্টো বলল, এখানে বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া যাবে। আসলে দাসদের ঘামের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে রীতিমত ছুটে ওপরে চলে এসেছে সে। রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে তাজা বাতাসে বুক ভরে নিল ডেল ভাস্টো। তারপর বলল, আসলে আমিই আপনার কাছে ঋণী। সময়মত আপনি যদি ডোরিয়ার দুরবস্থার খবর না আনতেন তাহলে কোন কিছুই হত না। আমি জানতাম, সম্রাটের ইচ্ছা ডোরিয়াকে তাঁর মুঠোয় রাখা। কারণ সম্রাট খুব ভালভাবেই জানেন যে ইটালির উপর কর্তৃত্ব করতে হলে আগে তাকে ভূমধ্যসাগরের কর্তৃত্ব পেতে হবে। ডোরিয়া ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, ওই এলাকায় তার ফ্লিটই সবচেয়ে শক্তিশালী। এবং সে যার অধীনে থাকে সে-ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রসপেরো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদা ফেনার মুকুট মাথায় নিয়ে ধেয়ে আসা ঢেউগুলোর দিকে। দেখছে, জাহাজের প্লাউয়ে একের পর এক আছড়ে পড়ছে ঢেউগুলো। ডেল স্টোর কথা শুনে হালকা একটু হাসল ও। বলল, এবার পৃথিবী দেখবে ডোরিয়ার আসল চরিত্র। লোভের বশে স্পেন রাজের কাছে আনুগত্য বিক্রি করেছে সে। ডোরিয়ার অপকর্মের দুর্গন্ধ পাবে সবাই।

কপাল কুঁচকে গেল ডেল ভাস্টোর। প্রশ্ন করল, আপনার কাছে এটাই কি আসল ব্যাপার?

আমি বরং এভাবে বলব, চুক্তিটা হওয়ায় আমি সন্তুষ্ট, জবাব দিল প্রসপেরো।

আমার মনে হয় টাকাপয়সার লোভের চেয়ে জেনোয়ার স্বাধীনতাই ডোরিয়ার কাছে মুখ্য ছিল। সে খুব ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, জেনোয়ার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া না হলে যা-ই আমরা প্রস্তাব করি না কেন সে তাতে আগ্রহী নয়, বলল ভাস্টো।

অবশ্যই, অন্য কিছুর তার কাছে আসলেও মূল্য নেই। কারণ স্বাধীনতা ছাড়া সে তো আর জেনোয়ার শাসন ক্ষমতায় থাকতে পারছে না। এমনকী ফ্রান্সের রাজার কাছেও একই শর্তে আনুগত্য বিক্রি করেছিল সে। এভাবেই সে নিজের কাজকর্ম জায়েজ করে নেয়।

কিন্তু সে তো কপটতা করার লোক না, কী বলেন? তাছাড়া, ফ্রান্সের রাজা তার সঙ্গে বেইমানি করেছে বলেই তো সে দল বদল করল, তাই না?

ডোরিয়া তেমনটাই দাবি করবে। কিন্তু বিশ্ব ওর বক্তব্যে বিভ্রান্ত হবে না। এখন থেকে ডোরিয়ার পরিবারের নতুন নীতি হবে টাকা যার আনুগত্য তার, প্রসপেরোর কণ্ঠে প্রকাশ পেল ডোরিয়ার প্রতি স্পষ্ট ঘৃণা।

দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল ডেল ভাস্টো। বলল, এ কি শুধু প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা থেকে বলছেন, নাকি এর পিছনে আরো কোন-বাস্তবতা আছে?

প্রসপেরে বলল, ডোরিয়ার এখন যে-কোন মূল্যে টাকা দরকার। কে টাকা দিল তাতে কিছুই আসে যায় না। সেজন্যই ফ্রেঞ্চ আনুগত্য ত্যাগ করেছে সে। আর, প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলছেন? পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে না চাইলে আমি মানুষ হওয়ারই যোগ্য না। ডোরিয়াই বাবার উপর তার শত্রুদের লেলিয়ে দিয়েছিল। সে-ই আমার বাবার খুনি।

কিন্তু শুধু ডোরিয়ার একার ক্ষমতা ছিল না অমন কিছু করার। ফ্রেগোসিরা প্রকাশ্যে ফ্রেঞ্চদের সমর্থন করেছিল তখন, বলল ভাস্টো।

হ্যাঁ, কারণ ফ্রেগোসিদেরকে সুতোয় বেঁধে পুতুল নাচ নাচানো খুব সহজ। তাই ওদের দিয়ে ফ্রেঞ্চদের সমর্থন দেয়ানো হয়েছে। কিন্তু আমরা অত সহজে ভুলবার পাত্র নই। তাই সবাই চেয়েছে আমাদেরকে সবার আগে সরাতে। সময় আর সুযোগ পেলে আমাদের সবাইকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলত ডোরিয়া।

এ নিছকই আপনার অনুমান, বলল ডেল ভাস্টো।

ফিলিপ্পিনো একটা ঘৃণ্য কয়েদির মত দাসদের সঙ্গে শেকলে বেঁধে রেখেছিল আমাকে। চেয়েছিল পোপের হাতে তুলে দিতে। এটাও কি অনুমান?

কিন্তু ফিলিপ্পিনো তো তার চাচা না। সে যা করেছে তার নিজের আগ্রহের আতিশয্যে করেছে।

ডোরিয়াকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন? প্রশ্ন করল প্রসপেরো।

জবাবে একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডেল ভাস্টো বলল, আমি ভাবতেও চাই না যে সম্রাটের জন্য এমন এক লোককে কাজে নিয়েছি, যে বেশি টাকার জন্য যে-কোন সময় দল বদল করবে।

চিন্তা করবেন না। সম্রাটের ধনভাণ্ডার ছোট নয়। অমন কিছু যাতে না হয় সেদিকে সম্রাট নিজেই দৃষ্টি রাখবে, বলল প্রসপেরো।

অন্য কোনভাবে এটা আমাকেই নিশ্চিত করতে হবে, বলল ডেল ভাস্টো।

প্রসপেরো বলল, আরেকটা ব্যাপারে ভাবছি। বিচারের নাম করে আমাকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ এখন আর ডোরিয়াদের নেই। এমনকী দাসদের সঙ্গে আমৃত্যু দাঁড়ে বেঁধে রাখার সুযোগও হারিয়েছে। কাজেই একটা মাত্র ব্যাপারই ঘটতে পারে। কোন এক অন্ধকার রাতে হঠাৎ আমার পিঠে বিধে যাবে ছুরির ফলা। কোন না কোনভাবে আমার চামড়া ওদের চাই-ই চাই।

শুনে ফুঁসে উঠে ডেল ভাস্টো বলল, তেমন কিছু ঘটলে ভয়ানকভাবে এর মূল্য চুকাতে হবে ওদের।

আহ, তখন প্রতিশোধের ফুল সুবাস ছড়াবে আমার কবরের উপর। আপনার কথা শুনে ভাল লাগল, মন্তব্য করল প্রসপেরো।

প্রসপেরোর কাঁধে আন্তরিকতার সঙ্গে হাত রেখে ডেল ভাস্টো বলল, আমার মনে হয় অত সাহস ওরা দেখাবে না। প্রতিশোধের শপথে আমার বিশ্বাস নেই। তবে এটা বলতে পারি, সম্রাটের হাত আপনার মাথার উপর সবসময়, ছায়া হয়ে থাকবে। আপনি সম্রাটের একজন সম্মানিত ক্যাপ্টেন। সময়মত ব্যাপারটা ডোরিয়াদেরও স্মরণ করিয়ে দেব।

প্রসপেরোর কাছে ডেল স্টোর কথা অবশ্যই মূল্যবান। কিন্তু তাই বলে নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে একটুও ঢিল দেয়ার বান্দা না ও। কারণ সত্যি বলতে এখনো ওঁরা ফিলিপ্পিনোর বন্দি। কাজেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রসপেরোর শঙ্কা থাকাটাই। স্বাভাবিক। ও ভাবছে, চাইলেই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু তা সম্ভবত সফল হবে না। কারণ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে যাবে। তবে পালানোর চিন্তা একেবারে বাদ দিল না প্রসপেরো। ভেবে রাখল, গ্যালিগুলো বন্দরে নোঙর করে রাখা অবস্থায় ঘোর অন্ধকার কোন এক রাতে পালিয়ে যাবে। লোমেলিনোর জন্য অবশ্য একটা নোট রেখে যাবে ও। তাতে বলা থাকবে, ওর বিনিময়ে প্রাপ্য মুক্তিপণ লোমেলিনো অবশ্যই পাবে।

বেশ চিন্তা-ভাবনার করে প্রসপেরো শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, ও পালাবেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এরপরই গ্যালিগুলো জেনোয়ার পরিবর্তে চলে গেল গালফ অভ স্পেজিয়ায়।

বিস্তৃত সবুজ সমভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে লেরিকি দুর্গ। বিকেলের মৃদু আলোয় সবুজের পটভূমিতে দুর্গের লালচে দেয়াল দারুণ এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের অবতারণা করেছে। ওই দুর্গেই অপেক্ষা করছে ভবিষ্যৎ পুনর্নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর ডোরিয়া।

সন্ধ্যা নাগাদ বন্দরে নোঙর করল গ্যালিগুলো। ক্যাপিটানা থেকে ক্যাপ্টেনদের কাছে নির্দেশ গেল যে, বন্দিদের সঙ্গে নিয়ে বন্দরে অপেক্ষা করবে তারা। বাকি সবার মত লোমেলিনোর কাছেও খবরটা পৌঁছুল। খবরটা প্রসপেরোকেও জানানো হলো। এই ঘটনা ওর পরিকল্পনায় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মোেড় এনে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল প্রসপেরো। ওদিকে ছয় দাঁড়ির একটা ছোট নৌকা প্রস্তুত করার হুকুম দিয়েছে লোমেলিনো।

সন্ধ্যা থেকেই ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। লোমেলিনোর ঠাণ্ডা বাতাস একদম সহ্য হয় না। তাই কাঁধে একটা ক্লোক চড়িয়েছে সে। টিবারনাকলে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বড় তিনটা লণ্ঠন। সোনালি আভায় উজ্জ্বল হয়ে আছে টিবারনাকলের ভিতরটা। তবে বাইরে সেই আলো পৌঁছয়নি। অন্ধকার লোয়ার ডেকের উপর দেখা গেল ততোধিক অন্ধকার দুটো মূর্তি। প্রসপেরো আর লোমেলিনোর মূর্তি।

খুবই নিচু স্বরে লোমেলিনোকে বলল প্রসপেরেরা, লেরিকিতে যেতে আমার বাধছে।

লোমেলিনো বলল, তা কেন? ওখানে তো গ্যালির চেয়ে অনেক আরামে ঘুমাতে পারবেন।

হ্যাঁ, তাহলেই হয়েছে। পিঠে ছুরি খাওয়ার জন্য ডোরিয়াদের বিছানায় ঘুমাবে একজন অ্যাডর্নো।

লোমেলিনো বিরক্ত হলো। তবে অন্ধকারে তার চেহারার বিরক্তিটা দেখা গেল না। সে বলল, ধারণাটা ঠিক না। তাছাড়া কথাটায় অহঙ্কার আর অতি কল্পনা প্রকাশ পাচ্ছে।

অহঙ্কার, হয়তো। কিন্তু অতি কল্পনা? না, মোটেও না। চরম লাঞ্ছনা করে দাসদের সঙ্গে আমাকে দাঁড়ে বেঁধে রাখার কথা কি ভুলে যাব?

মানি, আপনার রাগার অনেক কারণ আছে। কিন্তু তারপরও বলব ডোরিয়ারা আততায়ী নয়।

এখনও নয়। তবে আগামীকাল হয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? ওদের চেয়ে আমি বরং আপনাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করি। তাছাড়া আমি আপনার বন্দি, ফিলিপ্পিনোর না। তাহলে আমার জন্য মুক্তিপণ চাইতে আপনি ভয় করছেন কেন?

ভয়? রীতিমত গর্জে উঠল লোমেলিনো।

 ভয় যদি না-ই পান তাহলে বলুন আমার মুক্তিপণ হিসেবে কী প্রত্যাশা করেন? নাকি আমি বলব? আচ্ছা, দুই হাজার ডাকাট হলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন?

দুই হাজার ডাকাট! ঈশ্বর! বুঝলাম, আপনি দর কষেন না।

নিজের মুক্তি নিয়ে কে-ই বা দর কষে? প্রস্তাবটা গ্রহণ করছেন?

ধীরে, বন্ধু, ধীরে। টাকাটা কে দেবে?

ব্যাঙ্ক অভ সেইন্ট জর্জিয়া। আমার নিজ হাতে লেখা একটা হ্যাণ্ড নোট পাবেন আপনি।

লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কাষ্ঠ হাসি হাসল লোমেলিনো। বলল, বিশ্বাস করুন, আয়োজনটা করতে পারলে আমি সত্যিই খুব খুশি হতাম। কিন্তু কথা হচ্ছে, ডোরিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ানো আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

বলতে চাইছেন, আমার প্রস্তাবটা গ্রহণ করছেন না। আমাকে লেরিকিতে যেতেই হবে, তাই তো? বলল প্রসপেরো।

আর তো কোন উপায় দেখছি না।

বেশ। তা-ই হোক। এক মিনিট, আসছি… বলে কেবিনে ঢুকে গেল প্রসপেরো। যেন কিছু একটা ভুলে ফেলে এসেছে। পরমুহূর্তেই ভিতর থেকে ভেসে এল ওর ডাক। যেন কিছু একটা ওখানে ছিল, কিন্তু এখন পাচ্ছে না। জবাবে লোমেলিনো ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দাঁড়ান, আলো জ্বালছি।

প্রসপেরোর ফাঁদে পা দিল লোমেলিনো।

লোমেলিনো কেবিনে ঢুকতেই নিঃশব্দে তার পিছনে পৌঁছে গেছে প্রসপেরো। আচমকা লোমেলিনোর গলা নিজের কনুইয়ের ভঁজে আটকে ফেলল ও। ফলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। একই সময় লোমেলিনোর পিঠে হাঁটু তুলে তাকে পুরোপুরি অচল করে ফেলল ও। বলল, দুঃখিত, মেসার লোমেলিনো। কিন্তু এমনটা না করে আমার উপায় নেই। কোন কিছুর বিনিময়েই আমি লেরিকিতে যাচ্ছি না। মুক্তিপণের প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেই ভাল করতেন।

বলতে বলতেই লোমেলিনোর কোমর হাতড়ে তার ড্যাগারটা নিয়ে নিল প্রসপেরো। ওকে বাধা দিতে চাইলেও সেই উপায় লোমেলিনোর নেই। এরপর হাতের আরেকটা জোরালো চাপে লোমেলিনোকে অজ্ঞান করে ফেলল প্রসপেরো। টেনে নিয়ে গেল কেবিনের ভিতরের সিঁড়ির পাশে। তাকে বাঁধতে হলে অনেক সময়ের দরকার, তাই ওই ঝামেলায় প্রসপেরো গেল না। প্রতিটা মুহূর্ত এখন মহামূল্যবান। লোমেলিনোকে সিঁড়ির প্রথম ধাপে শুইয়ে দিল প্রসপেরো, বাকি কয়েক ধাপ পিছলে নৈমে গেল অচেতন লোমেলিনো। একমুহূর্ত থেমে দেখে নিল লোকটা জীবিত আছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে তুলে নিল লোমেলিনোর হ্যাট, স্কারলেট ক্লোক ও তার তলোয়ারের বেল্ট। ওসব নিজেই পরে নিল। কেবিন থেকে যখন প্রসপেরো বেরিয়ে এল দেখা গেল ক্লোক গায়ে হ্যাট মাথায় বেরিয়ে এসেছে একটা মূর্তি। কেউই সন্দেহ করল না যে লোকটা লোমেলিনো নয়।

মইয়ের পাশে অপেক্ষা করছে ওয়ার্ডেন। একবার কেবল সে প্রশ্ন করল, মেসার অ্যাডর্নো আসেনি?

জবাবে কণ্ঠ গম্ভীর করে ও বলল, না।

লোকটা তখন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই ও হুকুম করল, পথ ছাড়ো।

ওয়ার্ডেন খানিকটা অবাক হলেও আর কিছু বলল না। কারণ তার কাজ হুকুম পালন করা, ক্যাপ্টেনকে প্রশ্ন করা নয়। ওয়ার্ডেন লোকটা তখন নিচে নেমে বার্জের হাল ধরে দাঁড়াল। আর প্রসপেরো বসল তার পাশে।

তীরের দিকে মোটামুটি অর্ধেক পথ পার হয়ে গেছে ওদের বার্জ। ওখান থেকে গ্যালির টিবারনাকলে জ্বলতে থাকা আলোটাকে টিমটিমে কুপির মত দেখাচ্ছে। উঠে দাঁড়াল প্রসপেরো। ওয়ার্ডেনকে হুকুম করল, টিলার ছাড়ো।

নিশ্চিত হতে চাইল ওয়ার্ডেন। প্রশ্ন করল, জী?

টিলার ছাড়তে বলেছি, বলতে বলতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ক্লোকটা ফেলে দিল ও। প্রথমেই ওয়ার্ডেনের চোখে পড়ল দাড়িহীন মুখ। ভাল করে দেখতে টিলার থেকে হাত সরিয়ে আরেকটু এগিয়ে এল সে। ঘটনা বুঝতে গিয়ে অজান্তেই প্রসপেরেরার জন্য সুবিধা করে দিয়েছে। তার ভারসাম্য নষ্ট করা প্রসপেরোর জন্য এখন আরো সহজ। লণ্ঠনের অল্প আলোয় প্রসপেরোর চেহারাটা দেখাচ্ছে ধূসর, বিবর্ণ। কিন্তু তাতে ফুটে থাকা কাঠিন্য ওয়ার্ডেনের দৃষ্টি এড়াল না। আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল সে। কিন্তু তারপর আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। প্রসপেরোর ধাক্কা খেয়ে রেইলিং টপকে ঝপাৎ করে ঠাণ্ডা পানিতে পড়ল সে। বার্জের নিয়ন্ত্রণ এখন প্রসপেরোর হাতে।

ওদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় মাল্লারা হতভম্ব হয়ে দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে প্রসপেরো বলল, টানো সবাই, সর্বশক্তিতে দাঁড় টানো। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে স্বাধীনতার মধুর স্বাদ। মনে রেখো, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাদের ধাওয়া করা শুরু করবে। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই, জাহান্নাম দেখিয়ে ছাড়বে। সুতরাং এমনভাবে দাঁড় বাও যেন খোদ শয়তান তোমাদের ধাওয়া করেছে।

আর কিছু বলার দরকার নেই। স্বাধীনতার সুবাস পেতে শুরু করেছে ওরা। কাজেই শুরু করল সর্বশক্তিতে দাঁড় বাওয়া। ওদিকে হিমশীতল পানিতে পড়ে ঠাণ্ডায় কাতর ওয়ার্ডেন আশ্রয় চাইল। জবাবে তার হাতে অত্যাচারিত মাল্লারা ফিরিয়ে দিল। শাপশাপান্ত আর উপযুপরি গালাগাল। সঙ্গে মুফতে পরামর্শ দিল যেন কাপড় খুলে সাঁতার কাটে। মাত্র আধ মাইল গেলেই জাহাজে উঠতে পারবে সে।

পেছন ফিরে একবার তাকাল প্রসপেরো। দেখতে পেল, লোমেলিনোক গ্যালি মোরার ডেকে তখনও একই তালে দুলে চলেছে লণ্ঠনগুলো। তবে এখান থেকে ওগুলোকে এখন দেখাচ্ছে ছোট ছোট বিন্দুর মত।

.

০৮.

সিটি অভ ডেথ

 রাতভর দাঁড় বাইল দাড়িরা। বলা বাহুল্য, আর কখনো এভাবে ওরা দাঁড় বায়নি। এমনকী ওয়ার্ডেনের চাবুকের ভয়ও এভাবে ওদের দাঁড় বাইতে বাধ্য করতে পারেনি কখনো।

তীর থেকে আন্দাজ এক মাইল দূরে সরে বার্জের মুখ পশ্চিমে ঘুরিয়ে নিল প্রসপেরো। তীরের সমান্তরালে এগিয়ে চলেছে ওরা। উদ্দেশ্য জেনোয়ায় পৌঁছনো। জেনোয়ায় ওর কী বিপদ হতে পারে সে সম্বন্ধে প্রসপেরো অজ্ঞ নয়। কিন্তু আসলে ওখানে না গিয়ে ওর উপায়ও নেই। কারণ ধারে-কাছে রসদ জোগাড় করার মত জায়গা কেবল এক জেনোয়া ছাড়া আর কোথাও নেই। লোমেলিনোর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া তলোয়ার ঝোলানোর বেল্টটায় তলোয়ারের সঙ্গে একটা ড্যাগারও আছে। আর আছে ছোট একটা স্বর্ণের বাক্স, একটা নোট বুক, আর ছয় ডাকাট (ডাকাট: বিংশ শতকের আগ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত মুদ্রা বিশেষ)। ওগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল প্রসপেরো। ওর ইচ্ছা ফ্লোরেন্স হয়ে অরেঞ্জের প্রিন্সের সঙ্গে যোগ দেবে। তাহলে পথে মায়ের সঙ্গেও দেখা করে যেতে পারবে।

ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে পাহাড়ী এলাকা, লাভান্তোর কাছে পৌঁছে গেল ওরা। ওদিকে ধাওয়াকারীদের কোন চিহ্ন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পুব দিগন্তে ভেসে উঠতে শুরু করেছে উদীয়মান সূর্যের আলোক ছটা।

লাভান্তোর ঘাটে বার্জ ভেড়াল প্রসপেরো। পুরো গ্রাম এখনও ঘুমিয়ে আছে বা এক-দুজন করে জাগতে শুরু করেছে। প্রসপেরো সোজা চলে গেল সবচেয়ে কাছের সরাইখানায়। ওখান থেকে নিয়ে এল রাই-এর রুটি, ওয়াইন, ছয়টা শার্ট আর সবার জন্য হ্যাট। সঙ্গে অবশ্য কয়েকটী ফাইলও নিয়ে এসেছে ও। ওগুলো দিয়ে পায়ের শিকলগুলো ভাঙবে মাল্লারা।

আবার রওনা হলো প্রসপেরোর বার্জ। মেইনল্যাণ্ড দৃষ্টির আড়াল হওয়া মাত্রই প্রসপেরোকে ডাক দিল একজন। দিগন্তে একটা মাস্তুলের ডগা দেখতে পেয়েছে সে। পুব থেকে ধেয়ে আসা বাতাসে অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা পরিণত হলো অগ্রসরমাণ একটা গ্যালির ফুলে ওঠা পালে। কোন সন্দেহ নেই, ওটা ওদের ধাওয়াকারী গ্যালি।

জোরালো পশ্চিমমুখী বাতাস দেয়ায় মনে মনে স্রষ্টাকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে প্রসপেরো হুকুম দিল তিন কোনা পাল তুলে দিতে। পাল তোলায় ক্লান্ত লোকগুলো বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেল। খাওয়া-দাওয়া করে নিজেদেরকে শেকলমুক্ত করার প্রয়াস পেল ওরা। দ্রুতই পৌঁছে গেল বোনাসোলা গ্রামের পাশে। জলপাই গাছে ছাওয়া গ্রামে সবুজের পটভূমিতে সাদা বাড়িগুলো ছবির মত সুন্দর দেখাচ্ছে।

ওদিকে ধাওয়ারত গ্যালিটা ওদের থেকে তিন মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে। দ্রুত আরো কাছিয়ে আসছে। এই গতিতে চললে এক ঘন্টার ভিতরই ধরা পড়ে যাবে ওরা। আর ওই গ্যালিটা সত্যিই ধাওয়াকারী হলে ওখানেই খতম ওদের এই পলায়ন অভিযান। দাসদের সবাইকে চাবকেই মেরে ফেলা হবে। আর প্রসপেরোকে এমন কোথাও আটকে ফেলা হবে যে ডেল ভাস্টোর শত ক্ষমতা দিয়েও ওকে আর মুক্ত করা সম্ভব হবে না। এসব ভেবে প্রসপেরো সিদ্ধান্ত নিল ওরা মাটিতে নেমে পড়বে। কথাটা শুনে বিরাট স্বস্তি পেল মাল্লারা।

বোনাসোলার সোনালি বালুকাবেলায় নিজের সঙ্গে অতি সামান্য যা ছিল সেগুলোই সবার মধ্যে ভাগ করে দিল ও। প্রত্যেকের ভাগে পড়ল আধ ডাকাট করে। এটুকু পেয়েই খুব খুশি হলো সবাই। অন্তর থেকে ওকে আশীর্বাদ করল ওরা।তারপর হারিয়ে গেল যার-যার পথে। ওরা চলে যেতেই গ্রামে গিয়ে উঠল প্রসপেরো। আধ ডাকাট দিয়ে ভাড়া করল একটা গাধা। ওটায় করে উপকূলের পাশ দিয়ে বিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছল কিয়াভারি-তে। ওখান থেকে ডাক অফিসের একটা ঘোড়ার সঙ্গে নিজের গাধাটা বদলে নিল ও। তারপর প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে গেল জেনোয়ার দেয়ালের কাছে।

গির্জাগুলোয় ততক্ষণে সীমানা প্রাচীরের ফটক বন্ধ করার ঘণ্টা বাজানো শুরু হয়ে গেছে। ঘণ্টার আওয়াজ শুনে দ্রুত এগিয়ে গেল ও। প্রসপেরো ফটক পার হবার সঙ্গে সঙ্গে ফটক বন্ধ করা শুরু করল প্রহরীরা। তখন পেছন থেকে ভেসে এল আরেকটা ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ। গাধা-টানা একটা গাড়ি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে এক লোক। সে-ই একটু দূর থেকে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে আসছিল। ওই গাড়ির পিছনে আসছে আরো দুজন লোক। তাদের কাঁধে ঝুলছে লোহার গ্রাপলিং হুক। অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে আড়চোখে প্রসপেরোর দিকে চাইল তারা। একজন তো বলেই ফেলল, ঘণ্টা বাজাচ্ছিলাম শুনতে পাওনি? বলে ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল তারা। পাহারার ঘর থেকে সেন্ট্রি বেরিয়ে এসে ওর দিকে একবার তাকাল বটে। তবে তার দৃষ্টিতে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।

সারা ইটালিতে যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। তবে জেনোয়ায় এখনও এর আভাস আসেনি। ক্যাম্পেট্রোর ভিতর দিয়ে সান সিরোর দিকে চলেছে প্রসপেরো। ওখানেই স্কিপিওনি ডি ফিয়েসির বাড়ি। জেনোয়ায় স্কিপিওনিই এখন প্রসপেরোর একমাত্র ভরসা। পথে যেতে যেতে ওর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে। মনে হয় যেন পরিত্যক্ত শহরে ঢুকেছে। এমন না যে শহরের নীরব রাস্তা ও কখনো দেখেনি। কিন্তু নীরব রাস্তায় যে দুয়েকজন চোখে পড়ছে তারা শিকারির তাড়া খাওয়া বন্য জন্তুর মত ছুটে পালাচ্ছে। ভরা গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ সন্ধ্যা এখন। রাস্তায় এখন থাকার কথা গল্প-গুজবরত লোকের জটলা, দুলকি চালে ছুটে চলা ঘোড়সওয়ার ইত্যাদি। কিন্তু লোকজনের নাম-নিশানাও নেই কোথাও। পথের ধারের বাড়িগুলোর দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কেবল ওর ঘোড়ার খুরের শব্দ। অন্ধকার আরো ঘনিয়ে এলে একটা-দুটো বাড়িতেই কেবল আলো জ্বলে উঠল। সান ডমিনিকোর একটা ছাড়া বাকি সরাইগুলোকে মনে হচ্ছে মৃত! ওই একটা জায়গাতেই কেবল যা একটু লোকজনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। জায়গাটা ছাড়িয়ে আসতেই আবার জেঁকে বসল নীরবতা!

একটু এগুতেই ওর ঘোড়াটা, হঠাৎ হেষা করে থেমে গেল। সামনে ঝুঁকে প্রসপেরো দেখল রাস্তার উপর পড়ে আছে এক লোক। তাড়াতাড়ি নেমে লোকটাকে দেখতে এগিয়ে গেল ও। গায়ে হাত দিয়ে বুঝল অনেক আগেই মারা গেছে সে।

রাস্তার অপর পাশ দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছিল এক লোক। পথের একমাত্র জীবিত প্রাণী সে। তাকেই ডাক দিল প্রসপেরেরা। বলল, এই যে, ভাই, এখানে একজন লোক মরে পড়ে আছে।

গতি না কমিয়েই লোকটা বলল, সকাল হওয়া পর্যন্ত ওকে ওখানেই পড়ে থাকতে হবে। সবাই চলে গেছে, বলে চলে গেল সে।

 প্রসপেরোর মনে হলো, লোকটা কোন কারণে ভয় পাচ্ছে। তারপরও দ্বিধাগ্রস্তভাবে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। ভাবছে ফ্রেঞ্চ শাসনে কি রাতে কোন পাহারা রাখা হয় না? তখন মনে হলো ও নিজে মৃতদেহটা নিয়ে কিছু করতে গেলে নানা প্রশ্ন উঠবে। তাতে নিজের অসুবিধাই হবে কেবল। কাজেই লোকটাকে ছেড়ে নিজেও ঘোড়ায় চড়ে বসল প্রসপেরো।

শেষ পর্যন্ত সান সিরোতে ফিয়েসি প্রাসাদে পৌঁছে গেল ও। পৌঁছে অবাক হয়ে দেখল ঘোর অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো প্রাসাদ। সাধারণত প্রাসাদের ভারী সদর দরজার পাল্লাগুলো সবসময় খোলা থাকে। কিন্তু আজ সেগুলোও বন্ধ।

বিশেষ একটা জায়গার উপর পাথর ঠুকল ও। আঘাতটা প্রাসাদের ভিতর একটা ফাঁপা প্রতিধ্বনি তোলে। ফলে ওখান থেকেই লোকজন বুঝতে পারে মূল ফটকে কেউ আছে। বেশ কিছুক্ষণের নীরব অপেক্ষার পর আবার পাথর ঠুকল ও। তারও বেশ কিছু সময় পর পদশব্দ শোনা গেল। পিনপতন নীরবতার মাঝে পাল্লার বোল্ট সরানোর আওয়াজ গুলির মত শোনাল প্রসপেরো কানে। ফটকের বিরাট পাল্লার গায়ে ছোট্ট একটা জানালা খুলল, দেখা দিল লণ্ঠন হাতে একজন বৃদ্ধ লোক। বিরক্ত কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি? নক করেছেন কেন? কী চাই?

আমি মেসার স্কিপিওনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনি ভিতরে আছেন?

ভিতরে? মেসার স্কিপিওনি? সে কেন এখন এখানে থাকবে? তাছাড়া এ প্রশ্ন করছেন কেন?

তার খবরটা জানতে পারলে খুবই উপকৃত হব।

তখন বৃদ্ধ বলল, বাকি সবার মত মেসার স্কিপিওনিও গত সপ্তাহে জেনোয়া ছেড়ে চলে গেছে।

চলে গেছে! কোথায় গেছে বলতে পারেন?

জানি না, কোথায়। লাভাঙ্গায় যেতে পারে। অথবা আকুই-এ তার কান্ট্রি হাউসেও যেতে পারে। অথবা হয়তো আরো দূরে কোথাও। তাকে এখানে পাবেন ভেবেছেন কেন, স্যর?

খোদা! সবার হয়েছেটা কী? সবাইকে কি ভূতে পেল!

ভূত? বয়স্ক লোকটার মুখের কাষ্ঠ হাসিটা আসলেই ভূতের মত দেখাল তখন। ছোট্ট একটা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে। বলল, আপনি নির্ঘাত জেনোয়ার বাইরে থেকে এসেছেন। তা কখন নেমেছেন? বলতে বলতে রাস্তার অপর পাড়ে একদিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করে বলল, ওটা দেখেছেন?

প্রসপেরোর চোখে কিছুই পড়েনি। সে পাল্টা প্রশ্ন করল, কী দেখব?

আবার ভূতের মত হেসে লোকটা বলল, ক্রুশ, নোবেল স্যর, ক্রুশ।

এবার খুব ভালভাবে দেখার চেষ্টা করল প্রসপেরো। তখন আবছাভাবে দেখতে পেল রাস্তার ওপারে একটা বাড়ির দরজায় লাল রঙে ক্রুশ আঁকা আছে। বলল, দেখেছি, একটা ক্রুশ আঁকা। কিন্তু তাতে কী?

তাতে কী! ও, যিশু আর মেরি, ওটা প্লেগ আক্রান্ত বাড়ি। প্লেগের প্রকোপে ওই বাড়ির সবাই মারা গেছে।

এবার টনক নড়ল প্রসপেরোর। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, প্লেগ? এখানেও প্লেগ চলে এসেছে?

হ্যাঁ। মানুষের দুরাচার আর অনৈতিকতার শাস্তি হিসেবে খোদা প্লেগের অভিশাপ ফেলেছেন আমাদের উপর। সডোম আর গমরাহ-এর উপর যেভাবে আগুন এসে পড়েছিল পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নবী লুত (আঃ)-এর দুটি সম্প্রদায় সভোম ও গমরাহ। অহঙ্কার, ব্যাপক অন্যায়, অনাচার, জিনা, ব্যভিচারের কারণে মাটি উল্টে দিয়ে এদেরকে ধ্বংস করে দেন আল্লাহতায়ালা। সে স্থানে এখন ডেড সি বিদ্যমান। এ ঘটনার কথা বাইবেলেও উল্লেখ আছে।], আমাদের উপরও সেভাবে এসে পড়েছে প্লেগ। সবাই বলে অভিশাপ, প্রথমে পড়েছিল নেপলসের উপর। পোপ আর রোমের উপর লোভের থাবা ফেলতে চাওয়ার শাস্তি হিসেবে অভিশাপ প্রথমে পড়ে ওদের উপর। অন্য অনেকের মত মেসার স্কিপিওনিও পালিয়ে গেছে। হাহ, যেন খোদার অভিশাপ থেকে কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারে! মেসার ট্ৰিভুলজিয়ো আর তার ফ্রেঞ্চ সাঙ্গপাঙ্গরা ক্যাস্টেলেট্রোর ভিতর নিজেদেরকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। যেন দুর্গের দেয়াল ওদেরকে প্রভুর রোষ থেকে বাঁচাতে পারবে! খুব খারাপ একটা সময়ে জেনোয়ায় ঢুকেছেন, স্যর। এখানে এখন কেবল পাবেন রাস্তার পাশে বা বাড়িঘরে পড়ে থাকা মৃতদেহ আর পাবেন আমার মত গরীব লোকদের, যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, বলে হালকা একটু হাসতে হাসতে ফিরে গেল। তার হাসিটা শুনে প্রসপেরোর মনে হলো যেন নিজেকেই উপহাস করছে সে। যেতে যেতে বলে গেল, যান, এখান থেকে চলে যান, স্যর। খোদা আপনার সহায় হোন।

কিন্তু প্রসপেরো চলে গেল না। জায়গায় দাঁড়িয়েই শুনল বৃদ্ধ লোকটার চলে যাওয়ার শব্দ। তারপর আবার ঘোড়ায় চড়ল, ও। সরু খাড়া পথ বেয়ে চলল নিচের দিকে। জেনোয়ায় একটা পোস্ট অফিস আছে। ওখানেই ওর ঘোড়াটা ফেরত দিতে হবে।

ভাবছে, স্কিপিওনির মত লোকই যেহেতু চলে গেছে তাহলে ওর পরিচিত আর কাউকেই জেনোয়ায় পাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নিল মার্চেন্টর ওই সরাইখানাতেই রাত কাটাবে। সকাল হলে পরবর্তী করণীয় বের করা যাবে।

খুব ধীরে ও সাবধানে পথ চলছে প্রসপেরো। ভয় পাচ্ছে, পাছে আবার রাস্তায় পড়ে থাকা কাউকে মাড়িয়ে না দেয় বা শত্রুপক্ষের কারো সঙ্গে দেখা হয়ে না যায়। কিন্তু কারো সঙ্গেই দেখা হলো না ওর। একসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু পথ ছেড়ে তুলনামূলক আলোকিত এলাকায় পৌঁছল ও। পুব আকাশে উঠছে সরু এক ফালি চাঁদ। পানিতে সেই চাঁদ প্রতিফলিত হয়ে তৈরি হয়েছে একটা অসাধারণ দৃশ্য। এখানে এসে খানিকটা জনমানবের সাড়া পেল প্রসপেরো। এমনকী দুজন পথচারী ওকে স্বাগত জানাল। সামনের চত্বরে এসে পড়ছে সরাইখানা মার্চেণ্টি থেকে আসা আলোর আভা। শোনা যাচ্ছে সরাই থেকে ভেসে আসা হেঁড়ে গলার কথোপকথন, ধুমাধুম ড্রাম পেটানোর আওয়াজ, কোন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের সুর, সঙ্গে বেসুরো গলার গান। সব মিলিয়ে জায়গাটায় নরক গুলজার চলছে বলে মনে হলো প্রসপেরোর। যেন একদল মড়াখেকো পিশাচ এসে জড়ো হয়েছে এক জায়গায়, চলছে শয়তানকে খুশি করার উন্মাতাল আয়োজন।

অথচ প্রসপেরো জানে এই সরাইখানায় সাধারণত সম্ভ্রান্ত লোকেরাই ওঠে। বড় ব্যবসায়ী, জাহাজের মালিক, প্রথম শ্রেণীর ন্যাভাল অফিসার আর বাইরে থেকে আসা অভিজাত ঘরের সম্ভ্রান্ত অতিথিরাই এই সরাইয়ের গ্রাহক। কিছু সাধারণ লোকও এখানে আসে বটে, তবে সেটা নিখাদ বিনোদন পাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই সরাইয়ে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল না। বিশেষ করে সরাইয়ের আবাসিক সুবিধা সংবলিত এলাকায় মহিলাদের প্রকাশ্য উপস্থিতি তো কল্পনাই করা যেত না। অথচ প্রসপেরো দেখতে পাচ্ছে এখন ওখানে ওঠা বেশিরভাগ লোকই গ্যালি বা ব্যাগিনো থেকে আসা দাসের ওয়ার্ডেন, জাহাজের বেয়ারা, সাধারণ নাবিক আর ভবঘুরে। অন্য সময় হলে এরা এই সরাইয়ের চৌকাঠ মাড়ানোর সাহসও করত না।

লোকগুলো উচ্চকণ্ঠে হাসছে বটে কিন্তু ওদের ভিতরের আতঙ্ক তাতে লুকানো থাকছে না। ওদিকে মঞ্চে বসা দুজন মহিলা গলাগলি করে বেসুরো গলায় কী একটা গান গাইছে। গান শেষ হলে শুরু হলো হল্লা আর হাসাহাসি। তখনই একজন, দুজন করে ওর দিকে তাকাতে শুরু করল। ওই লোকগুলোর মধ্যে ওকে লাগছে ভিন গ্রহের কোন প্রাণীর মত। কারণ ওর পরনে তখনও ডেল ভাস্টোর কাছ থেকে ধার নেয়া চমৎকার পোশাক আর লোমেলিনোর কাছ থেকে নেয়া স্কারলেট ক্লোক।

কয়েক মুহূর্তের পিনপতন নীরবতার পর হঠাৎ আবার হৈ চৈ করে উঠল সরাইয়ে বসে থাকা প্রায় মাতাল লোকগুলো। এবার এমনকী আগের চেয়েও বেশি কানে লাগল ওদের হৈ হল্লা। সবাই একসঙ্গে এগিয়ে এল ওকে দেখতে, কপট স্বাগত জানাতে আর ওকে ওদের মধ্যে ভিড়িয়ে নিতে। ধমকে উঠল প্রসপেরো, পথ ছাড়ো। এ কোন্ নরকের মধ্যে এসে পড়লাম!

ওর মন্তব্য শুনে কেউ হাসল, কেউ গর্জে উঠল আর যাদের তখনো হুঁশ ছিল তারা জায়গায় বসে রইল তামাশা দেখার আশায়। ঠিক তখন তাদের তামাশা দেখার আশায় পানি ঢেলে দিয়ে বেরসিকের মত ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সরাইয়ের মালিক মার্কেন্টোনিয়ে। তার ভিতর তখনও ভদ্রতাবোধ আছে। প্রসপেরোকে স্বাগত জানাল সে, স্বাগত, লর্ড প্রসপেরো!

এ কী দেখছি, মার্কেন্টোনিয়ো! মার্চেণ্টিতে যে শয়তানের উপাসনা শুরু করেছ!

একটু নিচু কণ্ঠে জবাব দিল মার্কেন্টোনিয়ো, সময় এই হাল করেছে, লর্ড। খদ্দের বলতে এখন কেবল এরাই বাকি। খুব খারাপ একটা সময়ে এসেছেন, মাই লর্ড। আসুন, ওপরে পরিষ্কার কামরা আছে। তাছাড়া আপনার পদধূলি পড়লে সম্মানিত হবে আমার বাড়ি, সম্মানিত হব আমিও। আসুন।

মার্কেন্টোনিয়োর কনুইয়ের তো আর বকাবকির ঠেলায় সরে গিয়ে ওদেরকে পথ করে দিল বাকিরা। তবে কটু মন্তব্য, কৌতুক আর তির্যক বাক্য বর্ষণ করতে ছাড়ল না কেউ। প্রসপেরো ভাবছে প্লেগের কথা। কী এক জিনিস! ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে এই মহামারী।

যা হোক, মার্কেটোনিয়োর খদ্দেরদের কাছ থেকে সরে আসতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রসপেরো। একটা পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল ওরা। ওদের সামনে আলো হাতে পথ দেখাল পনেরো-ষোলো বছর বয়সের একটা মেয়ে। সুসজ্জিত একটা কক্ষে ঢুকল ওরা। সুসজ্জিত হলেও বাতাসে ভাসছে বদ্ধ ঘরের সোদা গন্ধ। ঘরটা খুব গরম হয়ে আছে। জানালাগুলো। কতদিন ধরে বন্ধ খোদা মালুম। মেয়েটা ততক্ষণে বাতিগুলোয় আলো দেয়া শুরু করেছে।

ঘর্মাক্ত মুখ মুছে দুঃখিত চেহারায় প্রসপেরোর দিকে তাকাল মার্কেন্টোনিয়ো। বলল, খোদা, রহম করো। মহামারীটা আমাদের একদম ধসিয়ে দিয়েছে, লর্ড। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

হ্যাঁ। মৃত্যুর পরশে বেরিয়ে এসেছে জেনোয়ার মানুষদের নীচ চেহারা। যৌক্তিক-ই বটে।

যৌক্তিকতার দিন বহু আগেই চলে গেছে, মাই লর্ড।

হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। শূকরের পালে নাম লিখিয়েছে সবাই।

ওদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখান, লর্ড। ভয়ে, আতঙ্কে ওদের পাগল হবার দশা। মাতাল হয়ে মহামারীর আতঙ্ক ভুলতে চাইছে সবাই। জেনোয়া শাসনের জন্য যখন থেকে মেসার ডোরিয়া ওই লোভী ফ্রেঞ্চদের এনেছে তখন থেকেই কঠিন সময় শুরু হয়ে গিয়েছিল। যারাই ফ্রেঞ্চদের সমর্থন দিয়েছে, সাহায্য করেছে, এখন আফসোস করছে তারা সবাই। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, কত বড় ভুল তারা করেছে। পারলে তারা আবার আপনার বাবার শাসনামলে ফিরে যেত। ঈশ্বর তার আত্মাকে শান্তি দিন। বলে নিজের বুকে ক্রুশ আঁকল মার্কেন্টোনিয়ো। আমাদের কথা আর কী বলব। নিশ্চয়ই আমাদের পাপের কারণেই এখানে মহামারীর অভিশাপ নেমে এসেছে। যাক, এখন বলুন, লর্ড, কীভাবে আপনার সেবা করতে পারি। কী আনব আপনার জন্য?

প্রসপেরোর কেবল দরকার খাবার আর ঘুম। পরের দিন কী করবে সেটা পরের দিনই ভাবা যাবে। জানালা খুলে দিল প্রসপেরেরা। যদিও প্রচলিত ধারণা বাতাসের সঙ্গে জীবাণু ছড়াচ্ছে। তাই জানালা খোলা মানে মহামারীর জীবাণুকে দাওয়াত দিয়ে ঘরে আনা। তবে ওসব প্রসপেরোকে বিচলিত করতে পারল না। খাবার পরিবেশন করা হলো। তবে খাবারের মানের জন্য বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করল সরাই মালিক। কারণ এই দুঃসময়ে এর চেয়ে ভাল কিছু পরিবেশন করা সম্ভব নয়।

আলো হাতে পর্থ দেখিয়ে এনেছিল যে মেয়েটি তার নাম ইউফেমিয়া। প্রসপেরোর কখন কী লাগে দেখার জন্য তাকে রেখে গেছে মার্কেন্টোনিয়ো। এক মাথা কালো চুল মেয়েটার। গরমের কারণে মৃদু ঘর্মাক্ত হয়ে আছে লালচে চেহারা। আর মুখে ফুটে আছে কেমন অদ্ভুত হাসি! সেটাকে প্রশ্রয়ের হাসি বললেও ভুল হবে না। তবে যত্নের সঙ্গে কাজ করছে মেয়েটি। প্রসপেরোর হাত-মুখ ধধায়ার জন্য বেসিনে পানি ঢেলে দিল। তাতে পর্যাপ্ত সিরকাও মেশাল। মেয়েটার মতে জীবাণুর বিরুদ্ধে সিরকা খুবই কার্যকর। আর ও যেহেতু বাইরে থেকে এসেছে তাই ওর উচিত সিরকা মেশানো পানিতে হাত-মুখ ভাল করে ধুয়ে যতটা সম্ভব পরিষ্কার হয়ে নেয়া। বলতে বলতে একটা তামার পাত্রে কিছুটা জ্বলন্ত কয়লা ঢেলে দিল সে। তারপর ঘরের দুর্গন্ধ তাড়ানোর জন্য কয়লার পাত্রে ঢেলে দিল কিছুটা সুগন্ধির গুঁড়ো। ইউফেমিয়া বলল, মহামারীকে সে মোটেও ভয় পায় না। কারণ সেইন্ট লরেন্স চার্চের সেইন্ট জনের কফিন থেকে আনা কাপড়ের টুকরো দিয়ে বানানো স্ক্যাপুলারি পড়ে আছে সে (স্ক্যাপুলারি: বুক-কাঁধ জড়িয়ে থাকা ব্যাণ্ডেজের মত আবরণ)। পৃথিবীর সমস্ত স্বর্ণের বিনিময়েও ওটা সে খুলবে না। তবে এটা ছাড়া যা-ই তাকে করতে বলা হোক, প্রসপেরোর সেবায় সে হাজির। মুখে নিমন্ত্রণের হাসি নিয়ে কথাগুলো বলল মেয়েটা।

ইঙ্গিতটা একদম স্পষ্ট। ওর কথার অন্য অর্থ করার কোন সুযোগই নেই। টেবিলে খাবার সাজিয়ে প্রসপেরোর জন্য অপেক্ষা করছে সে। এবং বারবার করে মার্কেন্টোনিয়োর হয়ে খাবারের ব্যাপারে বিনীত ক্ষমা প্রার্থনা করছে। বলছে যে প্রচুর ভিনেগার ব্যবহার করে খাবারের উপাদানগুলো জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। প্রসপেরোর খাওয়া শেষ হলে পরে তাকে বেশি করে ওয়াইন খেতে পরামর্শ দিল ইউফেমিয়া। বলল, ওয়াইন জিনিসটা অ্যাসিডিক হওয়ায় প্লেগের বিরুদ্ধে কার্যকর। বলতে বলতে নিজের জন্যও ওয়াইন ঢেলে নিল সে।

.

০৯.

 গার্ডেন অভ লাইফ

জেনোয়ায় আসার পরের দিনের কথা। পথঘাটে পলায়নরত দুয়েকজন ভীত লোক ছাড়া আর কেউ নেই। পথের দুপাশের দরজাগুলো সবই বন্ধ। আর বেশিরভাগ দরজার উপরই লাল রঙে আঁকা ক্রুশ ঘোষণা করছে এই বাড়ি সংক্রামিত। আর কোথাও থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা না থাকায় শেষ পর্যন্ত প্রসপেরো সিদ্ধান্ত নিল ব্যাঙ্ক অভ সেইন্ট জর্জেই যাবে।

পুরো ইউরোপে এর সমতুল্য আরেকটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তখন ছিল না।

ব্যাঙ্কে ঢুকে একজন গভর্নরকে পেয়ে গেল ও। তার নাম মেসার তাদ্দিও ডেল ক্যাম্পে। জেনোয়ায় মহামারী অমন মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ার পরও লোকটা নিজের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যায়নি। প্রসপেরোর নিজ হাতে লেখা হ্যাণ্ড নোটের বিপরীতে ওকে পঞ্চাশ ডাকাট ঋণ দিল ব্যাঙ্ক। তাৎক্ষণিক খরচ মেটানো ও অবিলম্বে নেপলসের পথে রওনা হয়ে যাওয়ার জন্য ওই টাকাই যথেষ্ট।

ওদিকে প্রসপেরো যখন ব্যাঙ্কে ব্যস্ত তখন একটা গাধা টানা গাড়ি নিয়ে মাৰ্চেণ্টিতে ঢুকল তিনজন লোক। তাদের গড়ন আর আচার-আচরণে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওরা সৈন্য না হয়েই যায় না। নেমেই ওরা রুক্ষ কণ্ঠে জানতে চাইল প্রসপেরো কোথায়। ওরা বোনাসোলা থেকে চিয়াভেরি হয়ে ডাকের ঘোড়ার ট্র্যাক অনুসরণ করে জেনোয়ায় এসে পৌঁছেছে। আর যেহেতু ডাকের অফিস মার্চেণ্টির পাশে তাই সহজেই অনুমান করে নিয়েছে, ওখানেই পাওয়া যাবে প্রসপেরোকে। কাজেই সরাসরি ওখানে চলে এসেছে তারা।

ওদের প্রশ্নের উত্তরে কোন চিন্তাভাবনা না করেই মার্কেন্টোনিয়ে স্বীকার করে নিল যে গতরাতে প্রসপেরো এখানেই উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল বড় একটা ভুল করে ফেলেছে সে। সৈন্যরা হাসতে হাসতে ঘোড়া থেকে নামল। জানতে চাইল এখন সে কোথায়। উত্তরে মার্কেন্টোনিয়ে বলল, এখন সে কোথায় তা আমি কেমন করে জানব?

বলতে চাইছ, প্রসপেরো চলে গেছে? প্রশ্ন করল একজন।

জবাবে মার্কেন্টোনিয়ে বলল, অনেকটা তেমনই।

ঠিক তখন ওর পেছন থেকে ইউফেমিয়া বলে বসল, হ্যাঁ, চলে গেছে। তবে ফিরে আসবে। সে আপাতত এখানেই থাকছে।

বেশ বেশ, এখানেই থাকছে তাহলে, বলতে বলতে দাঁত বের করে স্বস্তির হাসি দিল অনুসন্ধানকারীদের একজন। জ্বলন্ত চোখে ইউফেমিয়ার দিকে চাইল মার্কেন্টোনিয়ো। বুঝিয়ে দিল, আজ রাত ওর জীবনের সবচেয়ে খারাপ রাত হতে যাচ্ছে। কড়া পিটুনি আছে ওর কপালে।

ইউফেমিয়া তখন ওই সৈন্যদের ডেকে বলল, আপনারা নামবেন না? আমাদের ওয়াইন খুব সুস্বাদু।

সুরা আর নারীসঙ্গ ওদেরকে তখন এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে মার্কেন্টোনিয়ে কোথায় যাচ্ছে সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর রইল না। তবে ইউফেমিয়া সরাইওয়ালার দিকে একটা চোখ রেখেছিল। তাকে চুপিচুপি বেরোতে দেখে সে ধারণা করে নিল, প্রসপেরোকে সাবধান করে দিতে যাচ্ছে মার্কেন্টোনিয়য়া।

আসলেও তা-ই করতে যাচ্ছে সে। এবং তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতেও হলো না। মুহূর্তখানেক পরই ব্যাঙ্ক থেকে প্রসপেরোকে বের হতে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল মার্কেন্টোনিয়ো। ক্ষমা চেয়ে বলল, এর অর্থ নিশ্চয়ই তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। প্রসপেরোও স্পষ্ট বুঝতে পারল মার্কেন্টোনিয়োর ওই আচরণের অর্থ। তাকে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু সে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল যে শয়তান ইউফেমিয়া সৈন্যদেরকে প্রসপেরোর এখানে থাকার কথা বলে দিয়েছে। হাতে সময় নেই, প্রসপেরো যেন পালায়। শেষে বলল, খোদা আপনার সহায় হোন।

কিন্তু যেই প্রসপেরো বাইরে পা দিয়েছে ওর প্রায় গায়ের উপর উঠে গেল একটা গাধা টানা গাড়ি। ওটা অনুসন্ধানকারীদেরই গাড়ি। স্রেফ রিফ্লেক্সের বশে লাফিয়ে সরে গেল ও। তারপর বিল্ডিংটার দূরের কোণ দিয়ে গায়েব হয়ে গেল গলির ভিতর। কিন্তু ওই এক পলকেই ওরা প্রসপেরোকে চিনে ফেলল। শিকারের পিছনে ধাওয়ারত একপাল হাউণ্ডের মত প্রসপেরোর পিছু নিল ওরা।

দীর্ঘ সময় ঘোড়ার পিঠে বসে থেকে অনেকটা আড়ষ্ট হয়ে আছে ওরা। অন্যদিকে প্রসপেরো ঝাড়া হাত পা। এই গলি ওই গলি হয়ে দুপায়ে ছুটে চলল ও। খুঁজতে থাকল লড়াইয়ের উপযুক্ত একটা জায়গা। কারণ ধাওয়াকারীরা সংখ্যায় তিনজন। উপযুক্ত জায়গা না পেলে লড়াইয়ে ওর কোন সুযোগই নেই বলা চলে।

ধাওয়াকারীদের ধোঁকায় ফেলতে ও ছুটতে থাকে প্রায় গোলকধাঁধার মত গলি-খুঁচি সমৃদ্ধ ক্যারিগানো এলাকার পথ ধরে। ওখানে একটা চার রাস্তার সংযোগস্থলে এসে ক্যাথেড্রালের পথ ধরল প্রসপেরো। চার রাস্তার মুখে এসে ধাওয়াকারীরা দ্বিধায় পড়ে গেল যে কোন্ পথ ধরে ওরা যাবে। নষ্ট হলো মূল্যবান কয়েকটা মুহূর্ত। প্রসপেরো ততক্ষণে ছুটে চলে এসেছে চার্চের কাছে।

এটা সেই চার্চ যেখানে ঠিক এক বছর আগে লুটেরাদের হাত থেকে দুজন মহিলাকে উদ্ধার করেছিল ও।

ধাওয়াকারীরাও ওখানে পৌঁছে গেছে প্রায়। চার্চের সামনের স্কয়ার থেকে ভেসে আসা ওদের দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে প্রসপেরো। ধরা পড়ার কোন ইচ্ছা ওর নেই। তাই হাঁপাতে হাঁপাতে চার্চের পাশের দেয়াল থেকে ঝুলে থাকা আইভি লতা বেয়ে উঠতে শুরু করল ও। দেয়ালে উঠে একমুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে পিছনের প্রায় অন্ধকার গলিতে ফিরে তাকিয়ে দেখল ধাওয়াকারীরা তখনও ওখানে পৌঁছয়নি। তবে ওদের আগুয়ান পদশব্দ বলে দিচ্ছে এ পথেই আসছে ওরা। দেয়াল টপকে ওপাশে নেমে পড়ল প্রসপেরো।

কাপড় থেকে ধুলো-ময়লা ঝেড়ে তলোয়ারের বেল্ট আর ডাবলেট ঠিক করে নিয়ে তাকিয়ে দেখল আশপাশটা। খুব অস্পষ্ট কিছু স্মৃতি যেন ওর মনে পড়ছে। মনে হলো যেন দূর অতীতে কখনো এই বাগানের পথে হেঁটেছিল ও। সাদা ও কালো মার্বেল দিয়ে সাজানো বাড়িটায় পার্টিশান ছাপ স্পষ্ট। বাগানের সাজসজ্জা অত্যন্ত মনোরম। বাগান ঘিরে বানানো আছে পাথর বিছানো হাঁটাপথ। পথের দুপাশে সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে বক্সউড আর হেজের ঝাড়। কিছুদূর পরপর বিশাল বর্শার মত ঊর্ধ্বপানে মাথা তুলে আছে সাইপ্রেস গাছ। মাঝারি আকারের একটা পুল ঘিরে আছে লিলি আর গোলাপের ঝাড়। পাশেই আরেকটা বড় পুল। সেটার পাড় বাঁধানো হয়েছে আয়নার মত চকচকে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে। পুলের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সাদা মার্বেল পাথরে গড়া চকচকে মৎস্যকুমারীর মূর্তি। পাশেই সাদা মার্বেলে বানানো গম্বুজ সমৃদ্ধ ছোট্ট একটা গির্জা। গির্জাটার চারদিক ছেয়ে আছে। সবুজ ঝোঁপঝাড়, ডালিমগাছ আর ছোট ছোট কিছু গাছে। ঝোঁপগুলোয় ফুটে আছে নানান রঙের ফুল।

চারদিকে এত সৌন্দর্য, সবুজের সমারোহ, কিন্তু তবুও প্রসপেরোর মনে হচ্ছে জায়গাটা যেন নিষ্প্রাণ, পরিত্যক্ত। হেজের ঝাড়গুলো অনেক দিন ধরে ছাঁটা হয় না। হাঁটাপথের প্রায় সর্বত্র পড়ে আছে শুকনো মরা পাতা। ঠিক তখন পেছন থেকে আসা একটা শব্দ ওর ধ্যান ভঙ্গ করল। খানিকটা বিরক্ত হলো প্রসপেরো। কিন্তু পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল বাগানের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা।

ওর দিকে হেঁটে আসছে একটা মেয়ে। মেয়েটার চেহারাটা বেশ মলিন। তবে সেই মলিন চেহারার সৌন্দর্যও অতুলনীয়। তবে মেয়েটার চেহারায় কোন ধরনের আবেগের চিহ্ন মাত্রও নেই। ভয়, দ্বিধা, রাগ-কিছুই না। তার চেহারায় একমাত্র যে ভাবটা প্রকাশ পাচ্ছে তা হচ্ছে নিবিড় প্রশান্তির ছাপ। তবে গভীর চোখ দুটোর অভিব্যক্তিকে অনুবাদ করা যায় রাশ টেনে রাখা দুঃখ বলে।

এক বছর আগে এই মেয়েকেই উদ্ধার করেছিল কিনা, নিশ্চিত করে তা বলতে পারবে না প্রসপেরো। কারণ এই মেয়েটি মোটেও ভুলে যাবার পাত্রী নয়। কিন্তু যাকে ও উদ্ধার করেছিল তার কোন স্মৃতিই ওর মনে নেই। এই মেয়েটির পেছন পেছন একজন কালো মহিলাও এসেছে। তবে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন মেয়েটাকে পাহারা দিচ্ছে।

কাছাকাছি এসে মেয়েটি প্রসপেরোকে বলল, পথ ভুল করে ঢুকেছেন, নাকি বলব স্বর্গ থেকে নেমেছেন?

গভীর করে শ্বাস নিয়ে প্রসপেরো বলল, আপাতত স্বর্গে নেমেছি বলেই তো মনে হচ্ছে।

স্বর্গ না, তবে স্বর্গে যাওয়ার পথে নেমেছেন হয়তো। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে মৃদু একটু হাসির আভাস ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। সে বলে চলেছে, না দেখে ওভাবে লাফিয়ে পড়া ঠিক না। যা হোক, কী চান বলুন।

সরাসরি জবাব দিল প্রসপেরো। বলল, আশ্রয় চাই। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে এখানে ঢুকতে হয়েছে।

মেয়েটি বলল, হায় রে, মৃত্যুর এক হাত থেকে বাঁচতে সরাসরি মৃত্যুর আরেক হাতে এসে পড়েছেন। এই বাড়ি সংক্রামিত হয়েছে।

সংক্রামিত? আঁতকে উঠল ও। তবে পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই সংক্রামিত নন? না, তা হতেই পারে না।

আমাকেও রোগটা ধরেছিল। তবে এখন সেরে উঠেছি। তবে আমার ধারে-কাছে আসা এখনও নিরাপদ বলে মনে করি না। এখানকার সবকিছুই সংক্রামিত, বিষাক্ত। বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালেই ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবাণুরূপী মৃত্যুর ফেরেশতা।

ঘুরুক। এখানে ঢুকে পড়ায় আমি মোটেও দুঃখিত নই।

 আশ্রয় খুঁজতে এলে আপনার দুঃখিতই হওয়া উচিত।

কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে, এখানে জীবন খুঁজে পেয়েছি আমি।

একটু হেসে মেয়েটি বলল, সম্ভবত আগামীকাল মারা যাওয়ার জন্য পেয়েছেন।

সেটা ব্যাপার না। আমার ত্রিশ বছরের জীবনে অন্তত একদিন হলেও আমি প্রাণবন্ত হয়ে বাঁচলাম, সেটাই বা কম কী?

আমরা শব্দের পিঠে শব্দ বসিয়ে খেলছি, শান্ত কণ্ঠে বলল মেয়েটি। সম্ভবত আপনি ভাবছেন আপনার অনুপ্রবেশ নিয়ে কৌতুক করছি আমি। বা আপনাকে মিথ্যে বলছি।

না, তেমন কিছু আমি ভাবিনি।

যা হোক, এ জায়গাটা আসলেই কোন সুস্থ পরিবেশ নয়। এখান থেকে চলে যাওয়াই নিরাপদ, মেয়েটি মন্তব্য করল।

ওসব নিয়ে আমার চিন্তা নেই, তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল প্রসপেরো। কিন্তু মেয়েটি ওর কথায় কান না দিয়ে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। বুঝতে চাইছিল কথাটা কতটুকু সত্য। এবং তখনই ওর চেহারা থেকে নিরাবেগ শান্ত ভাবটা চলে গেল। বলল, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।

কথাটা প্রসপেরোকেও নাড়া দিল। ভাবল, তাহলে কি এই সেই মেয়ে যাকে ও উদ্ধার করেছিল?

মেয়েটি প্রশ্ন করল, আপনার নাম কী?

কোন ভণিতা না করে সরাসরি উত্তর দিল প্রসপেরো, প্রসপেরো।

আপনার সম্বন্ধে শুনেছি আমি।

খারাপ কিছু শোনেননি আশা করি।

খারাপই শুনেছি। পোপের ফ্লিটের দায়িত্ব ফেলে পালিয়েছেন আপনি।

জবাবে প্রসপেরো বলল, আমি বরং বলব, আততায়ীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছি।

আততায়ী?

আজ যারা আমার পিছনে লেগেছে তারাই। ডোরিয়াদের নিযুক্ত আততায়ী।

মেয়েটির বিস্মিত প্রশ্ন, ডোরিয়াদের পাঠানো আততায়ী? সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ, সত্যি। আমার বেঁচে থাকা ওদের পছন্দ না। আমাকে সরিয়ে দিতে পারলে ওদের ক্ষমতায় থাকার পথ নিষ্কণ্টক হয়।

কয়েক মুহূর্ত মেয়েটা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, এবার আপনাকে চিনেছি! এক বছর আগে ফ্রেঞ্চ দুবৃত্তদের হাত থেকে আপনিই আমাকে রক্ষা করেছিলেন। এখানে, এই বাগানেই।

আমারও একবার তেমনটা মনে হয়েছিল। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই তো বলি, বাগানটা এত পরিচিত মনে হচ্ছে কেন?

তেমনটাই মনে হয়েছে? কেন আপনার মনে নেই, যেদিন ফ্রেঞ্চরা প্রথম এদেশে পা রেখেছিল, সেদিন দুজন মহিলাকে আপনি অপমান আর লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন?

মনে পড়েছে। হ্যাঁ, তাই তো! এখানে এক লোক এক মহিলাকে ধাওয়া করেছিল, ওই যে, ওখানে বসে আরেকজন বয়স্ক আহত লোকের মাথার ক্ষতের পরিচর্যা করছিল আরেকজন। আর সম্ভবত আপনি… এই মেয়েটির চেহারা সে ভুলে গেছে সেটা স্বীকার করা তো আর সম্ভব না। কাজেই থেমে গেল ও।

ঠিক তখন দেয়ালের ওপাশে গির্জার দিক থেকে ভেসে এল অতি সন্তর্পণে দরজা খোলার মৃদু কাঁচকোচ শব্দ। সেইসঙ্গে এল ছুটোছুটি আর উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলার আওয়াজ।

সকৌতুকে প্রসপেরো তখন বলল, ওই শুনুন। স্বর্গীয় সাধু সন্ন্যাসীরা কীভাবে আমাকে পথ দেখায়। যে আইভি লতাটা বেয়ে আমি দেয়াল টপকে এসেছি, সেটা বেয়ে ওরাও আসবে ভাবছে। সেইন্ট লরেন্সের বেদিতে একটা সোনার লকেট দেব যদি ওই শয়তানটাকে তিনি ঘাড় মটকে মেরে ফেলেন।

ওদিকে মেয়েটার মুখ থেকে শান্তভাব ততক্ষণে পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেছে। আইভি লতায় ছাওয়া দেয়ালটার দিকে একবার তাকিয়ে আঁতকে উঠল সে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, যিশু, মেরি! জলদি আমার সঙ্গে আসুন। বাড়িতে আপনাকে নেয়া যাবে না। বাড়ি এখনও সংক্রামিত। তবে প্যাভিলিয়নটা মনে হয় নিরাপদ। আপনার দুর্ভাগ্য আপনাকে এখানে টেনে এনেছে। কাজেই এতটুকু ঝুঁকি মেনে নিতেই হবে। চলুন। খোদা আপনার সহায় হোন।

লেডি, ওসব ভাগ্য-টাগ্যে আমার মোটেও বিশ্বাস নেই।

আসুন তো, কথা বলার সময় নেই এখন।

তার পাশে ছুটে চলল প্রসপেরো। ইঙ্গিত পেয়ে ওই বয়স্ক মহিলা কাম প্রহরীও চলল ওদের পেছন পেছন। তবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। এক ছুটে মোটামুটি একশ গজ পার হয়ে গেল ওরা। ততক্ষণে একটা কাঠের দরজার উপর শিলাবৃষ্টির মত ধুমাধুম করাঘাত পড়তে শুরু করেছে। ভেসে এল, বাড়িতে কে আছ, দরজা খোলো, দরজা খোলো।

সুকৌতুকে একটা মন্তব্য করে প্রসপেরো জিজ্ঞেস করল, দরজাটা কি মজবুত?

বিষণ্ণ কণ্ঠে সে বলল, না, প্যাভিলিয়ন পর্যন্ত আপনি পৌঁছনোর আগেই ওই দরজা ভেঙে পড়বে। তারপর হেজের একটা ঝোঁপ দেখিয়ে প্রসপেরোকে বলল ওটায় লুকিয়ে পড়তে।

তখন প্রসপেরো জিজ্ঞেস করে, কতক্ষণ ওটা আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারবে? বাড়িতে আর কোন পুরুষ মানুষ নেই?

আপনি ছাড়া আরো দুজন আছে। কিন্তু তাদের একজন এত বয়স্ক যে তাকে গোনায় না ধরাই ভাল। আর আরেকজন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।

অর্থাৎ সাহায্যকারী কেউ নেই। ওদিকে ওরা তিনজন। বলতে বলতে এক হাতে খাপ থেকে বের করল তলোয়ারটা। কোমর থেকে বের করে আরেক হাতে নিল ড্যাগার। তারপর হাসতে হাসতে বলল, একটু আনন্দ দেয়া যাক আপনাদের।

প্রসপেরোর হাত ধরে ফেলল মেয়েটি। বলল, ধরা পড়ে গেলে লড়াই করার সময় পাবেন। তার আগ পর্যন্ত লুকিয়ে থাকুন। হেজের ঝাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল সে।

ঠিক তখন দরজার উপর করাঘাতের শব্দ থেমে গেল। ভেসে এল ওদের উত্তেজিত কথাবার্তার আওয়াজ। সঙ্গে কসম কাটা বা এই জাতীয় কিছু কথাবার্তা। ভীত কণ্ঠে আবার কথা বলে উঠল তারা। এবং দ্রুত ওদের পদশব্দ ও কণ্ঠ দূরে সরে গেল। ওদের চলে যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার জন্য চুপ রইল প্রসপেরোরা। মৃদু হাসি ভেসে উঠল মেয়েটির মুখে। ওদের ভয় পাওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছে সে। বলল, বুঝেছি। দরজায় গায়ে লাল কুশ দেখেছে ওরা। সংক্রামিত হওয়ার ভয়ে পালিয়েছে। এই চিহ্ন দেখে খুব কম লোকই স্থির থাকতে পারে। তারপর প্রসপেরোর চোখে যখন সে তাকাল, তার চোখে ফুটে উঠেছে বেদনার্ত দৃষ্টি। বলল, আমি আপনার কাছে ঋণী ছিলাম। হয়তো তার খানিকটা শোধ হলো। সুযোগটা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ওসব কিছু না। এ পথে পালাতে হচ্ছিল। ভাগ্য টেনে এনেছে এখানে, আপনার ঘাড়ে। তারপর হাসতে হাসতে বলল, আর এসে যখন পড়েছি, তো পাওনাটা নিয়েই গেলাম।

আরেকটু বেশি কিছু দিতে পারলে সত্যি খুব খুশি হতাম। কিন্তু এই বাড়িটা সংক্রামিত। এর বাতাসও মনে হয় বিষাক্ত। এখানে শ্বাস নেয়াও নিরাপদ না।

নিরাপত্তাটাই কি সবকিছু?

জবাবে মেয়েটি বলল, যখন এখানে এসেছিলেন আপনি কিন্তু নিরাপত্তার খোঁজেই এসেছিলেন?

 হ্যাঁ। কিন্তু তারপর পুনর্জন্ম হয়েছে আমার। পিছনের জীবনের কথা ভুলে গেছি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও এতটা অন্ধকার হয়নি যে মেয়েটার মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তি চাপা থাকবে। সে বলল, আমার বাড়িতে যাব। আমাকে যেন মোটেও নিরাপদ কেন? আপনাকে আতিথেয়তা দিতে পারছি না। তাই আপনাকে আর আটকেও রাখতে চাই না।

বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন বের হলেই আবার ওদের হাতে পড়ে যাব। আমাকে যে বাঁচালেন তার কোন মূল্যই আর থাকবে না। জেনোয়া আমার জন্য মোটেও নিরাপদ না।

তাহলে জেনোয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন না কেন?

ঠিক সেই সময় বাজতে শুরু করল জেনোয়ার সীমানা প্রাচীরের মূল ফটক বন্ধ হওয়ার ঘণ্টা। প্রসপেরো বলল, ওই শুনুন, আপনার প্রশ্নের জবাব। অন্তত আজ রাতের মত, জেনোয়ায় আটকে গেছি আমি।

ঘণ্টাধ্বনি শুনে ক্রুশ আঁকল সে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল প্রার্থনা বাক্য। প্রসপেরোও যোগ দিল তার সঙ্গে। তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিল সে। বলল যে, বাড়িতে প্রসপেরোকে আশ্রয় দেয়ার সাহস সে করতে পারছে না। কারণ জীবাণু ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর উপর। ইতিমধ্যেই তার এক ভৃত্য মৃতপ্রায়। বাড়ির ভিতর পড়ে আছে সে। থাকার মত একমাত্র জায়গা বাড়ির প্যাভিলিয়ন। সে নিজে সুস্থ হতে শুরু করার পর থেকে ওখানেই থাকছে। এবং লেডির ধারণা ওখানকার বাতাসও জীবাণুমুক্ত নয়। এসব জানার পরও যদি প্রসপেরো এখানে আশ্রয় চায় তাহলে সে আর ওকে মানা করবে না। তবে প্রসপেরোর জন্য ভাল হবে অন্য কোথাও আশ্রয় খোঁজ করা।

জবাবে প্রসপেরো বলল, ম্যাডাম, পুরো জেনোয়ার কোন জায়গাই জীবাণুর আক্রমণ থেকে মুক্ত বা নিরাপদ নয়। কাজেই আমি আসলে অন্য সব জায়গার চেয়ে বেশি ঝুঁকি নিচ্ছি না।

বেশ। আসুন তাহলে। বলে এগিয়ে নিয়ে চলল সে। বড় পুলটার পাশে পৌঁছুতেই ওখানকার কতগুলো কবুতর ঘিরে ধরল ওদের। স্নেহসিক্ত কণ্ঠে ওগুলোর সঙ্গে কথা বলতে লাগল মেয়েটি বলল, আহা রে, তোদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এই যে খাবার নিয়ে এসছি। বলতে বলতে একটা বাক্স খুলে তা থেকে মুঠো মুঠো গম ছড়িয়ে দিল কবুতরগুলোর খাওয়ার জন্য। তারপর প্রসপেরোকে বলল, কবুতরগুলো আপনার চেয়ে ভাগ্যবান। কারণ আপনাকে উপযুক্ত ডিনার দিতে পারছি না। ওয়াইন আর ডিম দিতে পারব শুধু। আপনার নিজের নিরাপত্তার জন্যই ডিম আপনার নিজ হাতে ভেঙে খেতে হবে। জানেনই তো এই বাড়ির সবকিছু সংক্রামিত।

বলতে বলতে তার অ্যাটেনডেন্ট মহিলাটিকে আগে গিয়ে ঘরে আলো জ্বালতে বলল। আলো জ্বালানো হলে পরে ভিতরে ঢুকল ওরা। ভিতরে পৌঁছে প্রসপেরো দেখল প্যাভিলিয়নটা বিশাল একটা গোলাকার কক্ষ। মেঝের কিনারা জুড়ে বসানো হয়েছে নানা রঙের মার্বেল পাথর। পারস্যের তুলোয় বোনা কার্পেট দিয়ে ঢাকা হয়েছে পুরো মেঝে। ঘরের মাঝখানে রাখা আছে ব্রোঞ্জ দিয়ে বানানো একটা টেবিল। প্রতিটা চেয়ারের গদি আর ব্যাক রেস্ট মহামূল্য রেশমে মোড়া। ফুলদানিতে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ফুল। এগুলো সহ আরো নানারকম বহুমূল্য দ্রব্য দিয়ে ঘরটা সাজানো। ঘরের এমন ধারা সাজসজ্জা দেখা যায় কেবল পুবের দেশগুলোয়।

প্রহরী মহিলাটির নাম বোনা। তার হাতের লণ্ঠনের মৃদু আলোয় এসব দেখতে পেল প্রসপেরো। ও ভাবল স্বর্গের হুর পরীর ঘরও মনে হয় এরকমই হবে। ওদিকে বোনাকে ডিম আর ওয়াইনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিল সে। বলল অ্যামব্রোজিয়ো যেন কিছু বুঝতে না পারে।

প্রসপেরোকে আরাম করে বসতে বলল সে। প্রসপেরো মন্তব্য করল, আশ্রয় পেয়েছি, এমনকী একটা মন্দিরও পেয়ে গেছি। আর কী চাই…

বাক্কুস (রোমান দেবতা)-এর মূর্তিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে হেসে মেয়েটি বলল, ওই মূর্তিটার জন্য মন্দিরের কথা বলছেন নিশ্চয়ই? ওটা এখানে এনেছি ঘর সাজানোর জন্য। আর আশ্রয়ের কথা বলছেন? আমি বলব এক শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্য এসে আরেক শয়তানের পাল্লায় পড়ে গেছেন। প্রসপেরোর মন্তব্যের অপেক্ষা না করে কথা বলে চলেছে সে। তার কথায় জানা গেল যে, সে ছাড়া এখানে আছে তার বিশ্বস্ত ভৃত্য বোনা। সেইসঙ্গে আরো দুজন পুরুষ ভৃত্য, যাদের কথা আগেই বলেছে সে। একজন মৃত্যুপথযাত্রী আর অপরজন অত্যন্ত বয়স্ক লোক। এই এলাকায় মহামারী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ভিতরও সেটা সংক্রামিত হয়েছে। কিন্তু বোনার রাতদিন পরিশ্রম আর অক্লান্ত সেবায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে। ছোট বেলায়ও একবার এই রোগে সে আক্রান্ত হয়েছিল। সম্ভবত তখনই কোনভাবে তার ভিতর রোগটার কোন প্রতিরোধক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেটাও খুব ভালভাবে কাজ করেছে।

এই বাড়ির মালিক মারকুইস অভ ফেনারো। মেয়েটি তার ভাতিজি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে এখানে চাচার কাছে আছে সে। মেয়েটি মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন আগে তার চাচা পাদুয়া-তে থাকাবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওই খবর শুনে ছুটে যায় তার চাচী। তার পরপরই জেনোয়ায় ছড়িয়ে পড়ে মহামারী। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সে আর জেনোয়ায় পা রাখার সাহস করেনি।

এসব বলতে বলতেই একটা ঝুড়ি হাতে নিয়ে উপস্থিত হয় বোনা। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল লেডি। উঠল প্রসপেরোও। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। মেয়েটি বলল, এখন আমাকে যেতে হচ্ছে। আপনার কিছু দরকার পড়লে বলবেন, যতটুকু ভাল আছে তা থেকে যা-যা পারা যায় পৌঁছে দেব। কাল আপনি চলে যাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার সঙ্গে দেখা করব।

তখনই চেষ্টা করব আপনাকে ধন্যবাদ দিতে, বলল প্রসপেরো।

না, ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই। ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমিও তো আপনার ঋণ শোধ করছি। শুভ রাত্রি।

চলে গেল সে। পেছন পেছন এগিয়ে গেল প্রসপেরোও। পেরিস্টাইলে গিয়ে বিদায় দিল তাকে (পেরিস্টাইল: সমান দূরত্বে দাঁড় করানো কলাম ঘেরা জায়গা)। ভিতরে এসে কথা বলল বোনা। ফল রাখার ঝুড়িতে করে একটা বাটি, একটা গ্লাস, ওয়াইন, কয়েকটা ডিম আর খানিকটা মধু নিয়ে এসেছে সে। বলল, আমি ছাড়া আর কেউ এগুলো স্পর্শ করেনি। তারপরও গ্লাস, বাটি ভিনেগার (সিরকা) দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে এনেছি। ডিমটা আপনাকে নিজ হাতেই ভেঙে খেতে হবে। আর এই অসুখটার বিরুদ্ধে মধু খুব কার্যকর। তাই এনেছি। নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। আর কিছু আপনার দরকার পড়বে কি?

একটু হেসে মাথা নেড়ে লাগবে না জানাল প্রসপেরো। তারপর তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিল ও। লণ্ঠন নিয়ে চলে গেল বোনা। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই দেখতে পেল বল্লমের ফলার মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাইপ্রেস গাছ। চোখে পড়ল বড় পুল, পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৎস্যকুমারীর মূর্তি আর সেটার পিছনেই দাঁড়িয়ে থাকা ক্যারেটো প্রাসাদ। প্যাভিলিয়নের ভিতর ফিরে এল ও। ক্লান্তি সত্ত্বেও দুচোখের পাতা এক হচ্ছে না। জ্বরে পড়তে যাওয়া রোগীর মত চকচক করছে প্রসপেরোর দুই চোখ। ঘরে একটা আবলুশ কাঠের ক্যাবিনেট আছে। কাগজ আর কলম পেয়ে গেল ওটার ভিতর। প্রসপেরোর কলমে ঝর্নাধারার মত স্বচ্ছন্দে চলে এল একটা কবিতা।

.

১০.

 লিথ সাগরে

রাতে গভীর ঘুম হলো প্রসপেরোর। ঘুম ভাঙার পর মনে পড়ল যে ভোরে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল ও। স্বপ্নে দেখেছিল, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। ব্যথার চোটে বালিশ থেকে মাথাই তুলতে পারছে না ও। মনে হচ্ছিল মাথাটার যেন অচিন্তনীয় ওজন হয়ে গেছে। সেই ওজন বালিশের সঙ্গে ঠেসে ধরে রেখেছে ওকে। আর বিছানায় ওর বালিশের পাশে আঁকা ছিল লাল একটা চিহ্ন। বুঝতে পারছিল যে মহামারীর বীজ ওর মধ্যেও ঢুকে গেছে। এর পরে আরো কিছু স্বপ্ন ও দেখেছিল, কিন্তু সেগুলোর স্মৃতি খুবই অস্পষ্ট।

ঘুম ভেঙে আশপাশের দৃশ্যগুলো প্রথমে অপরিচিত লাগল। তারপর স্ট্যাণ্ডের উপর বাক্কসের হাস্যময় মূর্তি দেখে মনে পড়ে গেল গতকালের কথা। বুঝতে পারল কোথায় আছে। কিন্তু বিছানার দিকে চোখ পড়তেই হতভম্ব হয়ে গেল ও। কোথায় সেই সিল্ক আর লিনিনের নিভঁজ বিছানা। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এমনকী চাদরের নিচে ওর নিজের গায়েও পোশাক নেই। রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ও। হুড়মুড় করে উঠে বসল। তখনই চোখে পড়ল ওর বিছানার পায়ের কাছে বসা এক লোকের দিকে। তার মাথা টাক, কিন্তু মুখে একগাল ধূসর দাড়ি। ছোটখাট গড়নের মানুষটার মুখে লেগে আছে শয়তানী মার্কা হাসি।

আঁতকে উঠে তাকে প্রশ্ন করল প্রসপেরো, ঈশ্বর! বাজে কয়টা? তুমি কে? নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই হতবাক হয়ে গেল ও। এত দুর্বল।

ঘুরে ওর মাথার কাছে চলে এল লোকটা। বলল, শশ, কথা বলবেন না। সেইন্টদের ধন্যবাদ, আপনি ফিরে এসেছেন। তবে এখনও আপনি দুর্বল। শুয়ে থাকুন, বলে মৃদু ধাক্কা দিয়ে প্রসপেরোকে আবার শুইয়ে দিল সে। ঠাণ্ডা হাতে ওর গায়ের উত্তাপ একবার পরখ করে বলল, জ্বর চলে গেছে। দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন, লর্ড। সাহস রাখুন।

তখন আবার প্রশ্ন করল প্রসপেরো, কী হয়েছে আমার? আর কয়টা বাজে?

লোকটা হেসে বলল, বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। আজ সেইন্ট লরেন্সের ভোজের দিন। আগস্টের দশ তারিখ।

খবরটা হজম করতে সময় লাগল ওর। তারপর কৌতুক করে বলল, কোন্ বছর সেটা বলতে মনে হয় ভুলে গেছ।

একগাল হেসে লোকটা বলল, বাহ, হাসতে পারছেন। খুবই ভাল লক্ষণ। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন।

কিন্তু কী থেকে সুস্থ হলাম সেটা তো বলবে!

বুঝতে পারছেন না? প্লেগ থেকে সুস্থ হয়েছেন। পুরো পনেরো দিন বিছানায় পড়ে ছিলেন আপনি। এই কদিন আপনি ভীষণ ঘামছিলেন। একসময় তো আমাদের ভয় হচ্ছিল যে ঘামের সঙ্গে আপনার প্রাণটাও না বেরিয়ে যায়। তবে আপনি বড় বেহায়া মানুষ। কথাটার জন্য ক্ষমা চাইছি, লর্ড। তবে সত্যি হচ্ছে, যমদূতকেও ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনি।

প্লেগ! পনেরো দিন ধরে এখানে পড়ে ছিলাম আমি? পনেরো দিন? কী ভীষণ অবিচার! চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর লোকটাকে আবার প্রশ্ন করল, তুমি কে?

সবাই আমাকে অ্যামব্রোজিয়ো বলে ডাকে। আমি ম্যাডোনার ভৃত্য।

ম্যাডোনা? কোন্ ম্যাডোনা?

দরজায় একটা ছায়া পড়তে দেখল প্রসপেরো। তারপর গাউনের খসখস ও সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে প্রবেশ করল সেই মেয়েটি।

আহ, জ্ঞান ফিরেছে তার, হাত কচলাতে কচলাতে হে-হে করে হেসে অ্যামব্রোজিয়ো বলে চলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম যে উনি সুস্থ হচ্ছেন। অ্যামব্রোজিয়োকে বিশ্বাস করুন, লেডি। খোদাকে ধন্যবাদ, সত্তর বছর ধরে বেঁচে আছি। এত লম্বা আয়ু পেলে কোন কিছু শেখার আর বাকি থাকে না, মাই লেডি।

ওদিকে তাকে দেখে প্রসপেরোও প্রথমে ভাষা হারিয়ে ফেলল। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বলল, আপনার আতিথেয়তার অসদ্ব্যবহার করেছি আমি। এক রাতের জন্য আশ্রয় নিয়ে পনেরো দিন কাটিয়ে দিয়েছি…

প্রসপেরোর দুর্বল কণ্ঠ শুনে মেয়েটা বলল, বিশ্রাম নিন। আপনি সুস্থ হলে ওসব নিয়ে কথা বলা যাবে।

বোনা আর অ্যামব্রোজিয়োর সেবায় দ্রুতই সুস্থ হতে থাকল প্রসপেরো। প্রতিদিন একবার করে এসে প্রসপেরোকে দেখে যায় মেয়েটি। কয়েকবার প্রসপেরো চেয়েছে তার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সবিনয় ভদ্রতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে সে। বলেছে ও সুস্থ হলে তারপর কথা বলা যাবে। তবে প্রসপেরোকে দেখতে আসতে ভুল হত না তার। প্রতিদিনই একবার এসে ঘরে তাজা ফুল রেখে ওকে দেখে যায় সে। মেয়েটি ঘরে এলেই দারুণ আনন্দ হয় প্রসপেরোর। নির্বাক কিন্তু আবেগময় দৃষ্টিতে প্রসপেরো তাকিয়ে দেখে তার প্রতিটা পদক্ষেপ। কিন্তু এই চেয়ে চেয়ে দেখাটা প্রসপেরোর আর সহ্য হচ্ছে না।

পরের দিনের কথা। প্রতিদিনের মত সেদিনও ফুল হাতে ঘরে প্রবেশ করল লেডি। এবং অবাক হয়ে দেখল, তার দিকে তাকিয়ে আছে পনেরো দিন আগে দেয়াল টপকে নামা সেই মানুষটি। অ্যামব্রোজিয়ো তার দাড়ির দঙ্গল পরিষ্কার করে দিয়েছে। পরিয়ে দিয়েছে কালো ব্রোকেডটাও। প্রসপেরোকে ম্লান দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে ওর মুখ। লেডিকে একবার বাউ করে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে রইল প্রসপেরো।

কুশন পেতে দিয়ে প্রসপেরোকে বসতে বলল লেডি। বলল, অনেক ঝড়-ঝাপ্টা গেছে আপনার উপর দিয়ে।

হ্যাঁ, তা গেছে। কিন্তু ঝড়ো বাতাস আমাকে সোজা এনে ফেলেছে স্বর্গের বাগানে।

স্বর্গে যেতে হলে আগে মৃত্যুর দরজা পার হতে হয়। অবশ্য মৃত্যুর খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন আপনি, বলল লেডি।

আরে নাহ। মৃত্যুনদীর পারাপারের মাঝি স্টিক্স যখন আমাকে ওপাশে যেতে বলল তখন দেখলাম এখানেই আমি সুস্থ হয়ে উঠতে পারব।

এই আপনার ধন্যবাদ জানানোর ভাষা?

আরো সুন্দর ভাষা যদি আপনি শেখাতে চান, বিনা আপত্তিতে আপনার অনুগত ছাত্র হব আমি।

লেডি একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আর কী বলব, আপনি নিজেই যথেষ্ট কথা জানেন। আর মজা করার জন্য সেগুলোকে ইচ্ছা মত সাজিয়ে কথার মালা গাঁথেন আপনি।

ম্যাডোনা… একমুহূর্ত থেমে প্রসপেরো বলল, …আমি অনেকদিক থেকে আপনার কাছে ঋণী। অথচ আপনার নামটাই এখনও জানি না।

আমার নাম? বন্ধুরা আমাকে ডাকে জিয়ান্না বলে।

অনুমতি দিলে আমিও আপনাকে জিয়ান্না নামেই ডাকব। আমার দৃষ্টিতে আপনি বন্ধুর চেয়েও বেশি। দুই বার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন আপনি।

সেদিন অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি থাকল জিয়ান্না। এবং পরের দিন প্রসপেরোকে বিরাট আনন্দের উপলক্ষ দিয়ে ওর সঙ্গে ডিনার করল লেডি। ওদেরকে খাবার সার্ভ করা ও অন্যান্য কাজে সহায়তার জন্য দাঁড়িয়ে রইল বোনা আর অ্যামব্রোজিয়য়া। তারপর বাগানে কিছুক্ষণ সময় কাটাল ওরা। দিন-দিন প্রসপেরো শক্তি ফিরে পাচ্ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে প্রসপেরোর জন্য লেডি জিয়ান্নার বরাদ্দ দেয়া সময়। এরমধ্যেই একদিন তাকে নিজের ঘটনা খুলে বলল প্রসপেরো।

প্রসপেরে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সাত দিন কেটে গেছে। প্রসপেরোর মনে হচ্ছে কোন রোগাক্রান্ত বাড়ি নয়, বরং এক স্বর্গসম মরূদ্যানে রয়েছে ও। বাড়িতে বাইরের খবরাখবর একটু কমই ঢুকছে। আর খবর যা আসছে, আসছে অ্যামব্রোজিয়োর হাত ধরে। ফলে সেগুলো পরিবেশিতও হচ্ছে ওর মনমত। সুতরাং জেনোয়ার প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে ওরা কমই শুনত। একবার অ্যামব্রোজিয়ো খবর নিয়ে আসে যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। ফ্রেঞ্চদের অবস্থা এখন নাজুক। ওদিকে ডোরিয়া ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে তার চুক্তি বাতিল করেছে। লেরিকিতে বসে তার গ্যালিগুলোর জন্য লোক নিচ্ছে সে, সেগুলোকে রণসাজে সজ্জিত করছে। আর ইতালি চুপচাপ ঘটনাপ্রবাহ দেখছে। বিবেচনা করছে। পানি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়ায়।

শুনে হেসে উঠল প্রসপেরো। বলল, অনুমান করতে পারছি ঘটনা কোনদিকে গড়াবে। টাকা হাতে নিয়ে ডোরিয়া প্রথমেই আসবে জেনোয়ায়। তারপর আমার বাবাকে যেভাবে বিদায় করেছিল সেভাবে তাড়াবে ফ্রেঞ্চদের।

জিয়ান্নার মন্তব্য, ডোরিয়াদের প্রতি তোমার ঘৃণা খুব বেশি।

জানি। কিন্তু আমার সঙ্গে যা ঘটেছে তা তো তুমিও জানো। তাহলে আমাকে কি আদৌ দোষ দিতে পারো?

না, দোষ দিচ্ছি না। বলছি ব্যাপারটা হয়তো তোমার বিবেচনাবোধকে প্রভাবিত করছে।

না, তা করছে না, বলল প্রসপেরো।

শুনে জিয়ান্না মন্তব্য করল, কিন্তু তারপরও লর্ড ডোরিয়ার পরিবর্তনের অন্যান্য কারণগুলো তুমি দেখতে পাচ্ছ না। জেনোয়াকে নিয়ে কিং ফ্রান্সিস তার দেয়া কথা রাখেননি।

এটা তো ডোরিয়ার বক্তব্য। তুমি তার কথা বিশ্বাস করো? প্রশ্ন করল প্রসপেরো।

আমি তো বিশ্বাস না করার কারণ দেখছি না, লেডি জিয়ান্নার জবাব। তারপর বলল, ফ্রেঞ্চদের এখান থেকে বের করে দিলে ডোরিয়ার অনেকগুলো ভুল শুধরে যাবে।

হ্যাঁ, ঠিক তা-ই করবে সে। এবং ফিরে পাবে নিজের সাম্রাজ্য। সেইসঙ্গে আবার একবার সে হয়ে উঠবে জেনোয়ার মহান উদ্ধারকর্তা।

একটা শ্বাস ফেলে লেডি বলল, ডোরিয়ার প্রতি তুমি খুবই বিরূপ।

তিক্ততার কোন কারণ কি নেই? ডোরিয়াকে এর চেয়ে ভাল আর কী ভাবব আমি? ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওর কূটচালের কারণে আমার বাবা ভেবেছে বেইমানি করে আমি তাকে অপসারণ করিয়েছি। এই বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছে সে, বলল প্রসপেরো।

কিন্তু এটা তো ফ্রেগোসিরা করেছে, বলল জিয়ান্না।

উত্তরে প্রসপেরো বলল, ডোরিয়াকে ছাড়া ফ্রেগোসিরা অচল। ওরা কিছু করতেও পারত না। আর আছে আমাদের ডজ অট্টাভিও। নিঃসন্দেহে দারুণ এক ডজ সে। জেনোয়ায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়তেই নিজের চামড়া বাঁচাতে লেজ তুলে পালিয়েছে। ভুলে গেছে ডজ হিসেবে জেনোয়াবাসীর প্রতি তার দায়িত্বের কথা।

প্রসপেরোর হাতে হাত রেখে মুহূর্তখানেক থমকে রইল লেডি জিয়ান্না। তারপর বলল, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু… একমুহূর্ত থেমে তারপর একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, কিন্তু তাই বলে তুমি প্রতিশোধ নেয়াকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে নেবে? কী পাবে এর থেকে? প্রতিশোধস্পৃহা স্রেফ আত্মার উপর জেঁকে বসা কঠিন এক রোগ ছাড়া কিছু নয়।

অনড় বসে রইল প্রসপেরো। ওর কাছে এই ভাবাবেগ প্রশ্রয়। দেয়ার সুযোগ কম। মন বেঁকে যেতে চাইলেও ওর মুখে তৎক্ষণাৎ কোন কথা এল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলল, এটা আমার কর্তব্য। ওদের কারণে অ্যাডর্নো পরিবার নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।

কিন্তু ওরাও তো এখন ফ্রেঞ্চদের বিপক্ষে। তাহলে কোন সমঝোতা কি হতে পারে না?

সমঝোতা? উত্তেজনায় প্রসপেরোর চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে নিল ও। বলল, সমঝোতা পরে। আগে ওদের শাস্তি পেতে হবে।

গম্ভীর আর ভীষণ দুঃখিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জিয়ান্না। দেখে প্রসপেরো বলল, আমার ঝামেলা নিয়ে ভেবে মন খারাপ কোরো না। এসব আমার কাছে তেমন কোন চিন্তার বিষয় নয়।

কিন্তু প্রসপেরো জানে কথাটা সত্যি নয়। তাছাড়া এই কথোপকথন ওকে মনে করিয়ে দিল ওর নিজের অতীত, ভবিষ্যৎ আর দায়িত্বের কথা। মনে পড়ে গেল, ইম্পিরিয়াল অফিসার হিসেবে ওর দায়িত্ব অনতিবিলম্বে অরেঞ্জ কাউন্টির প্রিন্সের সঙ্গে যোগ দেয়া। একইসঙ্গে মায়ের সঙ্গে দেখা করাও জরুরি। ব্যাপারগুলো পরদিন সকালে ম্যাডোনাকে বলল ও।

সঙ্গে সঙ্গেই প্রসপেরোকে কোন জবাব দিল না সে। কিছুক্ষণের নিশ্চুপ নীরবতার পর তুলে নিল পাশে রাখা ধনুকাকৃতির লিউট (এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র)। লিউটের তারের উপর খেলে বেড়াতে শুরু করল তার আঙুলগুলো। গেয়ে উঠল একটা গান।

গানের কথাগুলো শুনে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে প্রসপেরোর মন। কারণ গানটা ছিল এই বাড়িতে প্রবেশের প্রথম রাতে ওরই লেখা সেই কবিতা।

জিয়ান্না নিজেই বলল, শব্দের রত্বে গাঁথা অপূর্ব এক মণিহার।

মাথা নেড়ে প্রসপেরো বলল, না, ম্যাডোনা, রত্ন নয়, মুক্তো। কারণ মুক্তো আমাদের দুঃখের প্রতীক। এবং মুক্তো সৃষ্টিও হয় পরতে পরতে ঝিনুকের কান্না জমে। কিন্তু এই লেখাটা পেলে কোথায়?

যে সকালে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো, সেদিনই ওই টেবিলটার উপর কাগজটা পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিই। দেখি To My Lady in Silver শিরোনামে কবিতাটা লেখা। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার জন্য কোন নোট লিখে রেখেছিলে তুমি।

ধরো, তা-ই ছিল। তাহলে?

লেখাটা আমার জন্য ভেবে পড়েছি। আর আশা করেছি এটা যদি সত্যি আমার জন্য হত…।

আশা করেছ! সত্যিই আশা করেছ? মেয়েটার চোখের দিকে তাকাল প্রসপেরো। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। ওই দৃষ্টি দেখেই জিয়ান্না বুঝতে পারল প্রসপেরো কী প্রত্যাশা করছে। একটু যেন ভয় পেয়ে গেল সে।

মৃদু কণ্ঠে তার নাম ধরে ডেকে প্রসপেরো বলল, আমার প্রার্থনা সত্যি সত্যি পূরণ হলে কথামালা গাঁথতে শব্দের অভাব হবে না, এমনকী তার দরকারও হবে না। দেয়াল টপকে এখানে নামার দিন থেকেই প্রার্থনা করেছি এমনটা হোক।

প্রসপেরোর দিকে না তাকিয়েই জিয়ান্না বলল, আমার ভয় ছিল কবিতাটা হয়তো আমার জন্য নয়। এমনকী তুমি মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে আবার ধরা দিয়েছ খোদ মৃত্যুরই হাতে। তুমি সুস্থ হতে শুরু করার পর ভয় আরো বেড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল কবিতাটা হয়তো স্রেফ খেয়ালের বশে লিখেছ তুমি। তোমাকে কি চলে যেতেই হবে?

থাকার সুযোগ আমার নেই। আমার কিছু অবশ্য পালনীয় কর্তব্য আছে। ওই কাজগুলো করার আগে আমি এমনকী আমার নিজের উপরই অধিকার রাখি না। কাজগুলো শেষ হলেই আমি ফিরে আসব। আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে তুমি?

খুব ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল লেডি জিয়ান্না। বলল, অপেক্ষা? তখন লেডির চেহারায় একইসঙ্গে ফুটে উঠল গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য। সে বলল, আমি অপেক্ষায় থাকব আর তুমি ছুটে বেড়াবে প্রতিশোধ নামের মরীচিৎকার পিছনে। যখন তুমি ফিরে আসবে, তোমার হাতে লেগে থাকবে ওদের রক্ত। তখনও আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব, এই তো তুমি চাও, তাই না?

শীতল হয়ে গেল প্রসপেরোর রক্ত। বলল, ফিরে আসতে যদি পারি, হা, হয়তো এমনটাই হবে।

উত্তর দেয়ার আগে লম্বা একটা বিরতি নিল লেডি। অনড় বসে থেকে বলল, বললে, আমায় তুমি ভালবাসো, প্রসপেরো।

হা, অনেক ভালবাসি।

বুঝতে পারি। যে কেউই পারবে। তুমি আগেও বলেছ, তোমার উপর আমার কিছু দাবি আছে। কথাটা বলেছিলে কারণ, দুইবার তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি আমি।

হ্যাঁ, তাই এই জীবন তোমার হাতে। যা ইচ্ছা করতে পারো।

মুখ তুলে তাকাল লেডি। বলল, ঠিক তো? কথার কথা বলোনি তো? ঠিক আছে তাহলে, আমি চাই প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা বাদ দাও।

বাবার আত্মা যে সারা জীবন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।

ভুল। তার আত্মা আছে শান্তির দেশে। আমাদের করা ভুল বা বোকামি তাকে বিরক্ত করতে পারবে না।

কিন্তু অন্যরা তো আছে। আছে অ্যাডর্নো পরিবারের সদস্যরা। প্রতিশোধ না নিয়ে ফিরে গেলে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না, অস্পৃশ্য হয়ে পড়ব আমি। এমন একটা মানুষকে তুমি গ্রহণ করতে পারবে?

গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করব। কারণ সে হবে একজন সাহসী মানুষ। আর প্রতিশোধ তো এমনকী ঈশ্বরের দৃষ্টিতেও অপছন্দনীয়। তাহলে স্রষ্টার অপছন্দের একজনকে কীভাবে মেনে নেব?

জিয়ান্নার পাশ থেকে একটু সরে বসল প্রসপেরো। মাথা নিচু করে বলল, আমার মন ভেঙে যাচ্ছে, জিয়ান্না। ভেবেছিলাম আজীবন তোমার সঙ্গে তোমার পাশে থাকব। কিন্তু তোমার প্রথম অনুরোধটাই তো রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

উত্তরে জিয়ান্না বলল, অনেক কম মূল্যবান জিনিস চেয়েছি আমি।

না, অনেক বড় কিছু চেয়েছ। চেয়েছ আমার সম্মানের বলিদান, বলল প্রসপেরো।

ভুল ভাবছ তুমি। প্রতিশোধের ভিতর কী সম্মান আছে? চার্চ থেকে শেখোনি, প্রতিশোধের চিন্তাই তো পাপ।

হতে পারে। কিন্তু বাবার মৃতদেহ ছুঁয়ে আমি শপথ করেছি।

যিশু তোমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমি কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব কখনো, জিয়ান্না?

জিয়ান্নার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, এভাবে বোলো না। আর তুমি যদি প্রতিশোধের সিদ্ধান্তে অটল থাকো তাহলে বলব, আমরা কাছে এসেছিই দূরে সরে যাবার জন্য।

তা হতে পারে না। তুমি বলছ যে কাকতালীয়ভাবে আমাদের দেখা হয়েছে। না, এটা আমাদের ভাগ্যের লিখন।

ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না। আর ভাগ্য বদলায় যার-যার কর্মানুসারে, বলল জিয়ান্না।

কিন্তু প্রায় অসম্ভব একটা কাজ করতে বলছ তুমি, রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল প্রসপেরো।

প্রার্থনা করি, তুমি যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পার, বলে উঠে দাঁড়াল জিয়ান্না। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রসপেরোও। চাইল লেডিকে আলিঙ্গনে বাঁধতে। বিনীত ভদ্রতার সঙ্গে প্রসপেরোকে বাধা দিল সে। বলল, এখনই না, প্রিয়। প্রথমে তোমার মন থেকে প্রতিশোধের আগুন নিভিয়ে ফেলল। তারপর যখন ইচ্ছা আমার উপর তোমার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কষ্টমাখা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল প্রসপেরো। তারপর বলল, মহামারীতে আমাকে মরে যেতে দিলেই সবচেয়ে ভাল হত।

তাহলে বলব, ওই রোগে আমরা দুজনেই মারা গেলে বেশি ভাল হত। আমাকে এখন যেতে হবে। চলে যাওয়ার আগে যদি মনস্থির করতে পারো তো খবর পাঠিয়ো। আর যদি না পারো…প্রার্থনা করি ঈশ্বর যেন আমাদের ধৈর্য দেন। তাঁর সাহায্য এখন আমাদের খুব দরকার, বলে রওনা হয়ে গেল সে।

প্রসপেরো আবার এগিয়ে গেল। লেডিকে ডেকে সে বলল, রওনা হওয়ার আগে একবার অন্তত তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে চাই।

একমুহূর্ত ভাবল সে। লেডির চোখে টলটল করছে অশ্রু- সে বলল, আমার কথা যদি মানতে না পারো তাহলে দেখা করে আমার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়ার কী দরকার?

আর বাধা দিল না প্রসপেরো। ধীরে ধীরে অন্ধকারের ভিতর গায়েব হয়ে গেল লেডি জিয়ান্না। প্রথম দিন যখন প্যাভিলিয়নে ওকে, থাকতে দিয়েছিল, সেদিনও এভাবেই সে চলে গিয়েছিল। সেদিন ওর বুকের ভিতর নাচছিল আশার তুফান। আর আজ এক বুক কষ্ট নিয়ে তার চলে যাওয়া দেখল প্রসপেরো। ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে প্রসপেরোর সুখস্বপ্ন। কারণ অনেক উচ্চমূল্য দাবি করেছে লেডি জিয়ান্না। এই দাবি মেটানোর সামর্থ্য ওর নেই।

হতাশাভরে মনে মনে প্রশ্ন করল কেন লেডির সঙ্গে ওর দেখা করিয়ে দিল ঈশ্বর। তখন ওর ভিতর থেকেই উঠে এল ওর প্রশ্নের জবাব। প্রথমত, ডোরিয়াদের শাস্তি দিতে, যাতে হৃত সম্মান ফিরে, পায় অ্যাডর্নো পরিবার। দ্বিতীয়ত, দ্য লিগুরিয়াদ লেখা শেষ করতে, যাতে অমরত্বের কাছাকাছি চলে যায় ও। নিয়তির নিষ্ঠুর কৌতুক নিয়ে হা-হা করে হেসে উঠল ও। হাসতেই থাকল যতক্ষণ না ওর হাসি কান্নায় পরিণত হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *