২. বড় বৌদি জমিদার বাড়ীর মেয়ে

বড় বৌদি জমিদার বাড়ীর মেয়ে সুন্দরী সুলক্ষণা এবং সদগুণশালিনী আর এই বধুটি আসার পর থেকে উমেশবাবুর উন্নতি আশাতীত হয়ে উঠেছিল, বড় বধুর সম্মান ও বাড়ীতে বেশী। একমাত্র পুত্রসন্তান সাড়ে তিন বছরের। মেঝ ছেলে উচ্চশিক্ষিত কলকাতায় এক বিখ্যাত ব্যারিষ্টারের কন্যাকে বিয়ে করেছে সন্তানাদি এখনো হয়নি। শীঘ্রই সস্ত্রীক বিলাতে আমেরিকা যাবে বেড়াতে, কিছু বিদ্যা শিক্ষারও ইচ্ছা আছে। খেলাধুলায় ঝোঁক বেশী, ভাল ক্রিকেট খেলতে পারে। ব্যারিষ্টার কন্যাটি বিলেতী ঢঙে মানুষ হয়েছে, বাড়ীর চালচলন তার খুব পছন্দ নয় তবে যতদুর সম্ভব মানিয়ে চলতে চায়। ছোট ছেলে রতীন এম এ পাশ করে সঙ্গীত চর্চা করছে। ওদিকে খুব ঝোঁক ওর। লক্ষ্ণৌ এর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ীর কন্যার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে। আগামী অগ্রহায়ণেই হতে পারে। ছোট মাধুরী, উইমেন্স কলেজে আই, এ পড়ে। গাড়ীতে আসে যায়। এখন পূজার ছুটি তাই অখন্ড অবসর ওর। গিন্নীমা পূজা পার্বন নিয়েই থাকেন। বড় বধুই সাহায্য করেন। আর মাধুরীও করে সাহায্য। বাড়ীতে নিত্য পূজা তো আছেই তাছাড়া ওর নিজের তপজপও যথেষ্ট আছে তাই বাড়ীর মধ্যে আলাদা একটা ঘরই আছে ওঁর জন্যে। অত্যন্ত ভক্তিমতি নিষ্ঠামতী মহিলা। কেউ যদি বলে আপনাকে ভাল কীর্তন শোনাবো, তা তৎক্ষণাৎ তাকে লুচি মিষ্টি খাইয়ে দেবেন আর কীর্তন শোনালে তো কথাই নাই। পোলাও কালিয়া খাওয়ান! নিত্য গঙ্গা স্নান করে আসেন তাই কালীগঞ্জে ওর বাড়ি করা হলো না, গঙ্গা দূর হয়ে যাবে। দক্ষিণেশ্বর প্রতি শনিবার যান শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের সাধানপীঠ দর্শন করতে কথামত ওর প্রায় মুখস্থ। কিন্তু নিজে তিনি মোটে লেখাপড়া জানেন না সব পড়িয়ে শোনেন। কেউ যদি গিয়ে বলে আপনাকে কথামৃত পড়ে শোনাবো, তার তখুনি ওখানে নিমন্ত্রন হয়ে গেল খাবার। পাড়ার কত চালাক ছেলে–মেয়ে ওঁর এই দুর্বলতার সুযোগ যে নেয়, তার ইয়ত্তা নাই। এইবার পূজোর আগে পাড়ার ছেলেমেয়ে এসে বললো, জেঠাইমা বা কাকিমা মাসিমা যাহোক সম্বোধন করে মহিষমর্দিনী অভিনয় হবে, মায়ের মহিষাসুর বধ লীলা আপনাকে না শোনালে আমাদের পূজোই মিথ্যে হয়।

মহা খুশী হয়ে তিনি একশো চাঁদা দিলেন এবং নবমীর দিন রাত্রি জাগরণ করে শুনে এলেন গিয়ে যাত্রা। বললেন–

নিজের ছেলেরা করেছে তাই ভালো খুব ভালো হয়েছে!

অবশ্য এ জন্য পাড়াতে ওঁর অত্যন্ত সুনাম আপদে বিপদে ওর কাছেই লোকে ছুটে আসে, সাহায্য তিনি করেন যথেষ্ট। কলকাতার শহরে এরকম গিন্নী আধুনিক যুগে দুর্লভ এ জন্য সকলেই বলে মা বলে ভগবতী।

সংসারটা সুন্দর কোথাও কোনো কলঙ্ক চোখে পড়ে না। বাইরে থেকে শুধু মেজবৌটার চাল চলন ও বাড়ীর পক্ষে একটু বেমানান। কিন্তু সে খবর বাইরের লোকের জানাবার কথা নয়। তার বিস্তর বন্ধু নারী এবং পুরুষ টেনিস একটু না খেললে রাত্রে তার ঘুম হয় না। রাত্রে মোটরে চড়ে ক্লাবে তাকে যেতে হয়, তিনখানা খবরের কাগজ সে সকাল থেকে পড়ে। রান্না বান্নার প্রায় কিছু জানে না। চায়ের লিগার ঠিক করে দিলে কোন রকমে কাপে ঢেলে দুধ চিনি। মিশিয়ে দেয়, এছাড়া মাঝে মাঝে সৌখিন রান্না করে। বন্ধুদের দেওয়া পার্টি পিকনিকে যায় আর ইংরেজী গান শিখে রেকর্ড বাজায়। বিদ্যায় এম, এ। ইংরেজী কথা মুখ ফরফর করে বলতে পারে। বই যা পড়ে সব ইংরেজী, বাংলার কোনো লেখকের নাম বোধ হয় ওর জানা নেই এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। রবীন্দ্রনাথকে জানে কারণ ছোটবেলায় দিনকতক শান্তি নিকেতনে পড়তে গিয়েছিল। তার পর ওর বাবা ওকে দার্জিলিং–এর মেম স্কুলে পড়ায়। কিন্তু একেবারে বিদেশী করে তোলা কেন? দেশী কর্তব্য কে জানে।

যতীনের সঙ্গে ক্রিকেটের মাঠে ওর আলাপ হয়। পরে বন্ধুত্ব তারপর লাভ ম্যারেজ। নইলে উমেশবাবু ও বাড়ীতে ছেলে বিয়ে দিতেন না। এই বধুটিকে নিয়ে সংসারে যা একটা ভাবনা। ঘর না ভাঙে। নইলে ভাইরা স্নেহ পরায়ণ বড়দার ওপর সবাই নির্ভর, আর বড়দাও অতিশয় ভালোবাসেন ভাই বোনদের। বড় বধূর তো কথাই নাই সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। মাধুরীকে নিয়ে একটু গন্ডগোল আছে। সবার ছোট এবং সকলের অদূরে তাই ওর মন মেজাজ বোঝা কঠিন। কিন্তু ছেলেমানুষ দাদারা ওর বক্তব্যের মধ্যেই আনেনা বলে ও আমাদের আরেকটা ভাই। ওর যা খুশী করবে কেউ কিছু বলে না ওকে।

ওর বিয়ের চিন্তা কেউ কখনো করেনি। বয়স প্রায় আঠারো। বিয়ে হলে কিন্তু মন্দ হয়। মেজবৌদির বন্ধু কুমার সাহেবের বেশ একটা লোভ আছে ওর দিকে, কিন্তু মাধুরী গ্রাহ্য করে না তাকে। এমন কি কুমার যেদিন আসে মাধুরী সেদিন এ তল্লাটে থাকে না। ছোটদার এক বন্ধু আছে সুশীল বড় লোকের ছেলে গানবাজনার সখ। না মাধুরী তার দিকে ফিরেও চায়না। আর একজন আছে বড়বৌদির ভাই, নাম বরুণ, সুন্দর চেহারা বলিষ্ঠ, শিক্ষিত, সদালাপী সবাই ভাবে হলে বেশ হতো কিন্তু যার জন্যে এসব চিন্তা তার কোন সাড়া পাওয়া যায় না। ছোট থেকে মানুষ করেছে বড়বৌ ওকে মেয়ের মত স্নেহ করে; মাধুরী সুখী হলেই বড়বৌ সুখী হবে। শোনরে ছোটদি আজ মার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর যেতে পারবি?

আমি তো যাবই তুইও চল না–-ওখানে তোর জন্যে ভাল বরের প্রার্থনা করবো।

আমার জন্যে বর চাই না, অভিশাপ পাও তো কুড়িয়ে এনো, আমি আজ রতনদাকে নিয়ে ঈষা খার গান শুনতে যাবো বলে মাধুরী চলে গেল।

দক্ষিণেশ্বর পৌঁছে ঠাকুর দর্শন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের মন্দির ইত্যাদি দেখে জপ সমাপন করে ফিরলো, রাত তখন দশটার উপর। কিন্তু মাধুরী মহেন্দ্র তখনও ফেরেনি। বড়বৌদি বললো–

এখনো ফেরেনি মাধু, বাবা। মেয়ে যা হোক–

তোমার তাতে কি? বড়দা বললো কথাটা শুনে। আমার কিছু না কিন্তু বোনটি বড় হয়েছে, বুঝলে? মেয়েরা অত রাত অব্দি বাইরে থাকবে!

মাধুরী তোমার মতন ছিচকাঁদুনে মেয়ে নয়। যার কাজ তাকেই সাজে।

স্বামী মাধুরীর দোষ দেখবে না, জানা বড়বৌদির। হেসে বললো বিয়েটিয়ে দিতে হবে না বোনের?

না বিয়ে ওর খুশী হয় করবে টিয়ে একটা পেলে দেখতাম।

টিয়ে নিজেই জোগাড় করে নিয়েছে ওই মহেন্দ্রকে। বলে হাসলো বড়বৌদি বেশ তো। কিন্তু খারাপ নয়, বলে বড়দা চলে গেল খাওয়া শেষ করে।

আর সব খেয়েছে, বাকী মাধুরী, মহেন্দ্র আর বড়বৌদি স্বয়ং। কিন্তু শাশুড়ী ওপর থেকে বললেন তুই খেয়ে নে মা, ওরা যখন আসবে খাবে, তুই কচি ছেলের মা রাত জাগলে অসুখ করবে–

নিরুপায় হয়ে বড়বৌ খেয়ে শুতে গেল তখনো মাধুরীর ফেরেনি, আশ্চর্য তো। এমন কি শুনছে ওরা বারোটা বাজে বড়বৌ ঘুমিয়ে গেল।

কে জানে মাধুরী আর মহেন্দ্র কখন ফিরছে?

পাঁচ সাত বিঘে ধানজমি মাত্র দেবেন্দ্রর বছরের ভাতের চালটা কোন রকম হয়, কিন্তু পরনের কাপড় আর নুন, তেল, মসলার জন্য নগদ কিছু দরকার কাজেই নিত্য অভাব লেগেই থাকে। খিড়কীর ডোবাটায় আগে কিছু মাত্র মাছ হতো ধারে কিচু শাক বেগুনও, কিন্তু দীর্ঘকাল সংস্কার না হওয়ার এখন আর বারো মাস জল থাকে না আর শাক বেগুনের চাষ করবার লোকাভাব। অন্ধ দেবেন্দ্ৰ পেরে উঠেন না অতএব তবুও এ বছর কিছু মাছ ছাড়া রয়েছে, আর পুকুরের জলে কলমীলতা বপন করেছে খোকনের মা। লতাটা বেশ বড় হয়ে উঠলো। ওরই শাক প্রায় প্রতিদিন রান্না হয়! ওদিকে পাড়ে একটা আমরা গাছ আছে তার অম্বল হয় রোজই। এই উপাদান দিয়ে কোনরকমে অন্ন উদরস্থ করতে হয় ওদের কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেছে।

পুরনো বাড়ী পেছনের অংশটা অব্যবহার্য–ইঁদুর চামচিকের বাসভুমি। সামনের দিকটাই একটু ভাল আছে তারই কয়েকখানা ঘর আর উঠোনটুকু নিয়ে এই পরিবারটি। বাইরের ঘরটায় দেবেন্দ্র প্রায় সারাদিন বসে থাকেন চৌকিতে যে কেউ আসে এই ঘরেই বসে। মাঝে মাঝে সেতার তানপুরা মৃদঙ্গ বাজাতেন দেবেন্দ্র কিন্তু তানপুরাটাই ভেঙ্গে গেছে। সেতারটা প্রায় অব্যবহাৰ্য্য কাজেই তার সেই অবলম্বনটুকু নাই আর এখন খালি গলায় দু’একটা গান মাঝে মাঝে ধরেন।

খোকনের গান বাজনার বড় ঝোঁক। ওইটুকু ছেলে তবলার চাটি শুনলেই দৌড়াবে সেখানে। রাত জেগে গান শুনতে চায় ভাঙা কেনেস্তার বাজিয়ে বোল শেখে। গলাটা অত্যন্ত মিষ্টি এরই মধ্যে দু’একটা শ্যামাবিষয়ক গান শিখে ফেলেছে। কিন্তু ওকে শিক্ষা দিতে যন্ত্রপাতির দরকার তার অভাবে কিছু করা যাচ্ছে না। দেবেন্দ্র অনেক ভেবে চিন্তে আজ সকাল থেকে খোলাটা নিয়ে পড়েছেন, কীর্তন শেখাবেন খোকন বসে বসে দেখছে এবং সাহায্য করছে–অন্ধ বাপের ঐ এখন বন্ধু।

গ্রামের দু’জন লোক এসে দাঁড়ালো–স্বাগতম জানিয়ে দেবেন্দ্র বললেন কি খবর চাকলাদার মশাই?

: পাড়ায় মাহমায়া লতায় আজা একটু গান বাজনা হবে, তাই তোমাকে যেতে হবে, ভাই দেবেন। আমার ছেলে এসে নিয়ে যাবে আর দিয়ে যাবে।

 : সে তো আনন্দের কথা তা বাইরের কেউ আসবে নাকি?

 : হ্যাঁ ভুরশুশরী ওস্তাদ কালীচরণ আসবে, আমাদের বিপিন আছে আর তুমি রয়েছ। তাহলে এই কথাই রইল কেমন।

: না, তেমন কিছু নয়। ভাল কথা, মহেন্দ্র কোথায়?

: সে কলকাতায় গেছে কিছু একটা চেস্টা চিঠি পাইনি এখনো, ভাবছি।

: ভাবনা কি? চিঠি পাবে। আচ্ছা আসি এখন, বাবুদের বাড়ীর দু’এজনকে বলতে হবে বলে চলে গেলেন ওঁরা।

দেবেন্দ্র খোলটা সারবার চেষ্টা করতে করতে ভাবতে লাগলেন, একদিন এই বাড়িতেই গানের কত আসর বসতো। আর আজ তাকে যেতে হবে ও পাড়ায়। কিন্তু দুঃখের কি আছে। ওরা সব মনে করে ওকে ডেকেছেন, এইতো যথেষ্ট। গরীবকে কে আর মনে রাখে? বহুদিন ভালো গান বাজনা শোনেন নি আজ শুনতে পাবেন ভেবে আনন্দিত হয়ে উঠলেন মনে মনে।

এ গ্রামে সঙ্গীত চর্চা একদিন খুব ছিল এমন প্রায় নাই বললেই হয়। এখন পরচর্চা এবং পরের অনিচিন্ত ছাড়া আড্ডা প্রায়ই জমে না। যাকগে, তানপুরাটা কোনোরকমে সারিয়ে খোকনকে গান শিখাতে হবে। পড়া শুনায় ছেলেটায় বুদ্ধি খুব কিন্তু গান শেখানো দরকার। গ্রামের ফ্রি প্রাইমারী স্কুল পড়ে সে, মাইনে লাগে না ও বিষয়ে কিছু ভাবনার নাই। পড়ার। বইও যোগাড় করা হয়েছে, তা ছাড়া ওর মা, ঘরে পড়ায়, তাই খোকনের খেলায় ধুম খুব বেশী। গান বাজনা হবে শুনেই বললো–

: আমি যাব বাবা।

 হ্যাঁ, যাবি, মা যাবে না তো? না।

আয় তোকে স্বর–মাত্রা শেখাবো বলে আরম্ভ করে দিলেন মুখে মুখে। খোকনের আগ্রহ অত্যন্ত বেশী। আর এত সহজে বুঝতে পারে যেন মনে হয় পূর্বজন্মের সংস্কার সা–রে–গা–মা সমানে চালিয়ে যাচ্ছে বাপের সঙ্গে ওর মা ভেতরে থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখলো। ও একনিষ্ঠ সুরসাধকের এখন ঐ শিশুটি সম্বল। অথচ কত ভালো গান উনি গাইতে পারেন। চোখে জল আসছে, সামনে এগিয়ে এসে বললো–

: স্নান করো, বেলা হয়ে গেছে।

: হ্যাঁ, যাই গা মা পা ধা তাল দিয়ে চলেছেন দেবেন্দ্র আর খোকন ঠিক মত অভ্যাস করছে। অপূর্ব কণ্ঠস্বর ভগবদদও। কি মিষ্টি যে লাগছে কচিমুখে। সাধারণ বদরী বেদীতে যেন ওই পিতাপুত্র, ওই গুরু শিষ্য। খোকন গাইছে–

শ্মশান ভালবাসিস বলে, ওরা শ্মশান করেছি হৃদি।
শ্মশান সিনী শ্যামা, নাচবি বলে নিরবধি।
শ্মশান ভালবাসিস বলে–

ঝরঝর জল পড়ছে দেবেন্দ্রের দৃষ্টিহীন চোখ থেকে। জানালাপথে চেপে আছে যেন আকাশ উজ্জ্বল করা জ্যোতির্ময় শ্যামামূর্তি দেখছেন। গাইছেন—

আর কিছু ধন নাই মা চিতে,
চিতার আগুন জ্বলছে চিরে,
চিতাভষ্ম চারিভিতে, রেখেছি মা আসিস যদি,

: থামো। এটুকু ছেলেকে গান কেন শেখাচ্ছে? বললো খোকনের মা। মরণকালে গাইবে গো–আমার আর কদিন। ওর মুখে গান শুনতে শুনতে–

থামো। তোমার পায়ে পড়ি। থামো বলে ছুটে এসে মুখে হাত চাপা দিল। খোকন অবাক হয়ে বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে দেখছে বাবা মার এরকম ব্যাপার ও আর দেখেনি। কী এমন হলো যে বাবা কাঁদছে আর মা চুপ করাচ্ছে। সে ভাবলো আজ সকালে জলখাবার জন্য মা কৈ কিছু দিতে পারেনি, তাই কাদাছ বাবা। বলে বসলো–

: আমার খিদে পাইনি মা, দু’টো ডাসা পেয়ারা খেয়েছি রাজুদের বাড়ীতে।

: চুরি করে? দেবেন্দ্র প্রশ্ন করলেন।

: না বাবা, রাজু দিয়েছিল। আর একটা আতা–আতাটা পাকা নয় তাই রেখে দিয়েছি পাকলে খাব। কাল পেকে যাবে।

: সকালে কারও বাড়ী যাসনে খোকন, মা বললো, ওদের ছেলেপেলেরা সব ভাল খাবার খায় তুই কেন ভিখারির মত গিয়ে দাঁড়াস বাবা? যাসনে।

না মা রা জ্বর দুধমুড়ি খাওয়ার পর আমি গিয়েছিলাম। আর যাব না গান শিখতে হবে। ভোরবেলা, বাবা বললো।

 হ্যাঁ, ভোরবেলা গলা সাধবে। এসো স্নান করে ভাত খাবে এবার মা ওকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। ওইটুকু ছেলে সকাল থেকে বারোটা পর্যন্ত কিছুই খায়নি দু’টো ভাত বেঁধে দিতে পারতো, কিন্তু কাঠ–কয়লা কিছু ছিল না শেষে পিছনের দালানের একটা পুরানো কড়িকাঠ ছড়িয়ে উনুন জ্বালতে হোল, বেলা তখন অনেক হয়ে গেছে। নগদ পয়সা হাতে থাকলে কিছু কিনে দেয়া যেত। কিন্তু যা ছিল, মহেন্দ্রকে দেয়া হয়েছে ট্রেনভাড়া বাবদ। দেবেন্দ্র সবই জানেন, কিছু বলেন না। বলে লাভ তো নেই।

পূজা সেরে খেতে বসলেন মাসকলা–এর ডাল, ভাত আর আমড়ার অম্বল। বাড়ীর শাক অবশ্য পাতের এক কোণে ছিল একটু, ওতেই হোল। কিন্তু খোকনের বড় কষ্ট হয়, কোনো রকমে খায়, যাকে বলে পেটের জ্বালা। দৈন্য মানুষের আসে কিন্তু এদের যেন অতিরিক্ত মাত্রায় এসেছে কিন্তু যেদিন মহেন্দ্র রোজগার করবে সেদিনই তো সংসার সচ্ছল হয়ে উঠবে। দুঃখের দিন শেষ হয়ে আসছে।

আহারের পর একটু বিশ্রাম করার অভ্যাস, দেবেন্দ্র চৌকিতে শুয়ে চোখ বুজছেন, খোকন বাইরে রোয়াকে বসে সা রে গা মা সাধছে। হঠাৎ পিওন তাকে কি যেন বলল, খোকন তিন লাফে ভিতরে এসে বললঃ

বাবা, ও বাবা টেলিগ্রাম নাকি, কাঁপছেন দেবেন্দ্র উদ্বেগে।

আজ্ঞে  হ্যাঁ বাবু, টেলিগ্রাম মানি অর্ডার, পঞ্চাশ টাকা, বলতে বলতে গ্রামের পোষ্টম্যান সাগরময় এসে ঢুকলো ভেতরে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছুটলে যেন। মানি অর্ডার। টেলিগ্রাম নয়, আহঃ। আনন্দে চোখে জল এসে পড়লো দেবেন্দ্রের। মহীন টাকা পাঠিয়েছে, কোথায় টাকা পেল, কি করে পাঠালো কে জানে। কোন খবর নয় এই যথেষ্ট।

  : ফর্ম খানা হাতে দিয়ে দেবেন্দ্র বললেন আমারই নামে আছে তো সগর, কোথায় সই করতে হবে, দেখিয়ে দাও।

: আজ্ঞে, চিঠিও আছে একখানা, বলে সাগর একটা পোষ্টকার্ড দিল।

চিঠিখানা আগে পড়লো খোকনের মা। মহীন ভালো আছে। উমেশবাবু তাকে পুত্রবৎ গ্রহণ করেছেন, এই টাকা তিনি পাঠাচ্ছেন খোকনের জন্যে। চাকরিও তিনি একটা করে দেবেন শীঘ্রই।

পঞ্চাশ টাকা একসঙ্গে অনেকদিন দেখেনি দেবেন্দ্ৰ হাত পেতে নোটখানা নিলেন কিন্তু এটা একজনের দান সাহায্য। মহীনের রোজগারের টাকা নয়। যতটা আনন্দ ওর হওয়া উচিত ছিল, তা হোল না। তবু মহীন ভালো আছে সেখানে। আর উমেশবাবু ধনী হয়েও তাদের ভুলে যায়নি এই সান্ত্বনা, খুশীই হলেন তিনি। মহীন লিখেছে খোকনের যেন রোজ আধাসের দুধের ব্যবস্থা করা হয়, ছেলেটা ঠিকমত বাড়িত পারছে না খাদ্যভাবে? হাসলেন দেবেন্দ্র। দুধ স্বপ্নের ব্যাপার তার বাড়িতে। কিন্তু স্বপ্ন কেন? মহীন রোজগার করবে, দুধ অমন অসম্ভব কথা কি?

টাকাগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে আবার শুলেন তিনি খাটে, মাথাটা এখনো ধরে রয়েছে। ডাক পিওন বিদায় হয়ে গেছে, মনি অর্ডার আর কুপন আর চিঠিখানা রয়েছে বিছানার একপাশে। খোকন মার সঙ্গে ভেতর বাড়িতে গেছে। একা দেবেন্দ্র শুয়ে। কিন্তু আর ঘুম। আসে না কত চিন্তা কত অতীতের স্মৃতি কত ভবিষ্যতের স্বপ্ন যে ওর মনের আনাচে কানাচে ঘুরতে লাগলো তার সংখ্যা নেই। নিশ্ৰুপ কিছুক্ষণ পড়ে থাকলেন, তারপর উঠে ভেতরে গেলেন দেয়ালে ধরে ধরে। স্ত্রীকে গিয়ে বললেন একটা টাকা সত্য নারায়ণের পূজার জন্য রাখে, বাকীটা খরচ করো। তোমার একখানা কাপড় বড় দরকার, দয়ালকে ডেকে আনতে পাঠিয়ে দাও।

আচ্ছা, তুমি উঠে এলে কেন?

: কিছু না, এমনি মনটা অস্বস্তি লাগছে।  

: কে জানে?

  : কেন তা জানে অর্পণা। টাকাগুলো নিতে হলো দারিদ্রের তাড়নায়, নিরুপায় হয়ে, নইলে ক্ষেত্রনাথের পুত্র দেবেন্দ্র কারো অর্থ সাহায্য জীবনে গ্রহণ করেনি। আর এই জন্যই তিনি উমেশবাবুকে কোনো খবর পর্যন্ত দেননি, তার দুঃখ দুর্দশার। মহেন্দ্র জেদ করে গেল, নইলে তাকে ওখানে তিনি পাঠাতেই চাননি। অর্পণা বললো, উনি আমাদের লোকই তো টাকা দিয়েছেন তো ক্ষতি কি? মহীন চাকরী পেলেই আর কারও সাহায্য নিচ্ছি না আমরা, নিজের মনে করে তিনি দিয়েছেন, মনে অশান্তি কেন আনছো তুমি?

অশান্তি নয় অপর্ণা অসহায় বোধ করছি। মহীনের রোজগারের পাঁচটা টাকা এলে আমি হয়তো আনন্দে নাচতাম।

–আসবে? পাঁচ টাকা কেন, পাঁচশো আসবে মহীনের। কত কষ্টে মানুষ করা ছেলে আমার মহীন, সে তো বসে থাকার ছেলে নয় কুড়েও নয়।

: হু, যাক কাপড়টা আনিয়ে নাও, বলে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। অপর্ণ বললো। তোমার তানপুরার তারও আনতে দেব কি রকম তার চাই বলে দাও

–না, অকস্মাৎ ফিরে দাঁড়ালেন দেবেন্দ্র। না অপর্ণা ওটা মহীনের রোজগারের টাকা এলে কিনবে। এই বংশের গৌরববাহী যন্ত্রে আমি পরের দানের স্পর্শ ঘটাব না। চলে গেলেন।

জানে অপর্ণা স্বামী স্বভাব। ভাঙ্গবে তো নুইবে না কঠোর কঠিন সংযমী পুরুষ, নির্লোভ নিরহঙ্কার কিন্তু কোথাও তার বংশগৌরব ক্ষুণ্ণ হতে তিনি দিতে চান না, একান্ত অসহায়। আজ তিনি অন্ধ, অন্ন বস্ত্রহীন, নইলে হয়তো এ টাকা তিনি ফেরত দিতেন।

দয়ালকে ডাকতে হলো না এমনি সে আসে। পাড়ার পরোপকারী যুবক অকাতরে। অপরের জন্য শরীর ব্যয় করতে প্রস্তুত। এসে বললো–

: কাকীমা, কিছু দরকার আছে?  

: হ্যাঁ বাবা একখানা শাড়ী এনে দিতে পারবি?  

: হ্যাঁ টাকা দাও, আর রেশন কার্ডটা।

অপর্ণা টাকা দিয়ে বললো খুব মিহি কিনিস না বাবা, মাঝামাঝি দেখে আনিস যেন টেকে। খোকনের জন্য প্যান্ট।

আর কি? দয়াল প্রশ্ন করলো!

–না আর কি? একটা রবারের বল পাস তো আনবি খোকনের জন্য দয়াল হয়তো সন্ধ্যা নাগাদ ফিরবে। কিন্তু তানপুরার তারটা কেনা হলো না। হলে উনি বাজাতে পারতেন সকাল সন্ধ্যায় একটা কাজ পেতেন খোকনের শেখা হতো, উপায় নাই। অপর্ণা নিঃশ্বাস ফেলে গৃহকর্মে মন দিল।

খোকন খিড়কী পুকুরের পাড়ে বাগান করেছে। চাপা দোপাটি আর সন্ধ্যামণি ফুলের গাছ লাগিয়ে। কবরী শুলঙ্ক আর গাদা আগে থেকেই ছিল ওখানে। বাগানের মাঝে গোটাকয়েক ভাঙ্গা ইট জড়ো করে বেদী বেঁধেই তার উপর শাহাজাদা বাদশার মতো বসে গান ধরেছে–

কেষ্টঠাকুর কালো হলো, গোরা হলো, গোরা হলো রাধা।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, হঠাৎ শুনতে পেল বাবাকে ডাকতে এসেছে মহামায়া মন্দিরে গান বাজনার আসর থেকে। একছুটে ভিতরে এসে দাঁড়ালো, ও যাবে ওখানে। অপর্ণা ওর ছেঁড়া প্যান্ট খুলে নতুন প্যান্ট পরিয়ে দিল। আনন্দে খোকন চলে গেল বাপের সঙ্গে গান শুনতে।

আসরটা মন্দ হয়নি ওখানে। অনেক লোক এসেছে। দেবেন্দ্র ওস্তাদ সবাই খাতির করে বসালেন, গান আরম্ভ হলো, খোকন তালে তালে ঘাড় দোলাচ্ছে অবশেষে বাবার গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে আরম্ভ করে দিল। সবাই অবাক সঙ্গীতে অসাধারণ প্রতিভা তার, আশ্চর্য তো।

: খুব বড় গায়ক হবে বললো একজন।

: কি করে হবে শেখবার অবস্থা নেই দেবেন্দ্র বললেন।

 : আপনি শুধু সা রে গা মা শিখিয়ে দিন, তারপর ও নিজেই শিখে যাবে।

: সঙ্গীত বড় শক্তি বিদ্যা, বললেন দেবেন্দ্র কিন্তু আশায় আনন্দে ওর চোখ জলে ভরে উঠলো। খোকা বড় গায়ক হবে ঈশ্বরের আর্শীবাদ হয়ে দাঁড়াবে তার জীবনে।

জুতো জামা কাপড়ে মহেন্দ্র প্রায় অভিজাত হয়ে উঠেছে, চেহারাটা তো ঈশ্বরদত্ত! কিন্তু আচার ব্যবহার নিতান্ত দীনহীনের মত না হলেও ধনী সন্তানের মত মদগর্ব আসছে না। বহু ব্যাপার আছে এই সমাজে, যা যত্ন করে শিখতে হয়। জন্মবধি যাদের অভ্যাস তারাই এই সব ভাল পারে। মহেন্দ্র নিতান্তই পল্লীবাসী, তাকে কাঁটা চামচেতে খাওয়া শেখাতেই যথেষ্ট সময় লাগবার কথা, কিন্তু মাধুরী অসাধারণ ভাল মাষ্টার। তার পাল্লায় পড়ে মহেন্দ্রকে শিখতে হচ্ছে।

সেদিন গান শুনে বহু রাত্রে ফিরলো মহেন্দ্র মাধুরী। খেয়েই এসেছিল, তাই বাড়ীর খাবারের আর খোঁজ করলো না। মহেন্দ্র তার নির্দিষ্ট ঘরে কম্বল পেতে শুলো, কিন্তু অতি ভোরে মাধুরী নয় বড়বৌদি এসে বললো, তোমার যোগাভ্যাস আপাততঃ তুলে রাখো ঠাকুরপো, ওর দেরী আছে। এজন্মে হবার আশা কম।

: যোগভ্যাস নয় বৌদি। মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ করতে করতে বললো, বদভ্যাস করতে চাই না।

 : ভালো, বিছানায় শোওয়া বুঝি বদ অভ্যাস?

: হ্যাঁ, বৌদি, পুরুষ যেখানে হউক শোবে, যা পাবে তাই খাবে, যে ভাবে হোক থাকবে পৃথিবীতে তাকে কর্মের জন্য পাঠানো হয়েছে।

  : ওরে বাপরে! একেবারে পতঞ্জলী ঠাকুর। কিন্তু তোমার শরীর খুব ভালো নয়। ঠাকুরপো। কাল তোমার বড়দা বলেছিলেন তোমার শরীরটা আগে সারা দরকার।

 : আমি খুব সুস্থ মানুষ, বৌদি, আপনি ভুল করছেন। বড়দাকে বলবেন দেখতে লম্বা আর রোগা হলেও আমি অসম্ভব খাটতে পারি। উঠলো মহেন্দ্র নিজের হাতে কম্বল–বালিশ গুটিয়ে তুলে রাখলো। মুখে চোখে জল দিল এবার।

: কাল কেমন গান বাজনা হলো, বড়ো বৌদি শুধোল।

: ভালো। তবে দেখলাম খাঁটি রাগ রাগিণীর দিকে প্রায় কেউ এগোল না।

 : আজ কালকার মানুষ খাঁটি কিছুই চায় না ঠাকুরপো। নাও উঠে মুখ ধুয়ে এসো, মা বাবা বসে আছেন চা নিয়ে।

: মাধুরী কোথায়? ঘুমুচ্ছে? কথাটা অকস্মাৎ অতর্কিত বেরিয়ে গেল মহীনের মুখ থেকে।

: না। হেসে উঠলো। বড়বৌদি, মাধুরী ভালোই আছে। ভোরে স্নান ওর অভ্যাস, তারপর ঠাকুর ঘরে যায়, এখনো সেখানেই আছে। নাও, মুখ ধোও। মহেন্দ্র আর কিছু না বলে বাথরুমে ঢুকলো। কিন্তু বৌদি কেন হাসলেন? অমন ব্যাকুলভাবে মাধুরীর কথাটা না শুধুলেই ভালো হতো। কে জানে কি ভাববেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমতি এই বৌদি। এতবড় সংসার ওর নখাগ্রে রয়েছে, অথচ কিই বা বয়স? বড়বৌদির চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতিশয় কঠিন। ফাঁকি দেবার মতো কি এমন দুষ্কর্ম করেছে মহেন্দ্র? না কিছু না। আশ্বস্ত হয়ে মুখ দিয়ে এল। চা খেতে গেল তারপর।

গিন্নী আর উমেশবাবু বসে আছেন। মহেন্দ্রকে দেখেই গিন্নী বললেন, ভালো ঘুম হয়েছিল বাবাচোখ লাল কেন দেখাচ্ছে?

: না ঘুমিয়েছি তো। বলে মহেন্দ্র বসলো। মাধুরী এখানে আনে নি ঠাকুর ঘর থেকে, ওখানে ও কি করে, কে জানে? ওর এখন ঠাকুর ঘরে অত সময় দেবার বয়স নয়, কিন্তু ওদের। মহেন্দ্র ভাবলো জিজ্ঞাসা করবে মাধুরীকে। ইতিমধ্যে ছোটদা রতীন্দ্র এসে বললো, আমাদের অলকা ক্লাবে কাল তুমি গেলে না মহীন? মাধুটাকে এত করে বললাম তোমায় নিয়ে যেতে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?

 : চলো সঙ্গীতালয়ে। বহুবাজার।  

: আমাদের ওখানে গেলে না কেন? কাল ভাল গাইয়ে ছিল একজন।

 : তোমাদের দত্ত সাহেব তো। ওর গান আমাদের শোনা আছে। গলা তো নয় যেন ফাটা হাড়ি। লোকটার গান গাইতে লজ্জা করে না। কথাগুলো বললো মাধুরী।

স্নান করে ঠাকুর ঘর থেকে ফিরছে, অঙ্গে ওর ধুপ সুরভি, হাতের মুঠোয় এক মুষ্টি শেফালী ফুল। টেবিলের উপর সেগুলো নামিয়ে বসলো। রতীন্দ্র বললো, ভাঙ্গা গলা পুরুষের লক্ষণ জানিস। রাগিনী যেন রূপ ধরে উঠে ওর গানে। ওরে বাপ। সে তাহলে রাগিনী নয় বাঘিনি। বলে মাধুরী চা ঢালতে লাগলো। রতীন জানে কথায় ওর সাথে পারা যাবে না, তাই। মহীনকে বললো তুমি একবার দপ্ত গান শুনবে মহীন, বুঝলে? আমার সঙ্গে যেয়ো আজ বিকালে।

না, আজ আমাদের হাওড়া যাবার প্রোগ্রাম আছে, বেলুড় মঠ দেখতে, বলে মাধুরী কথাটা কাটিয়ে দিল। মহেন্দ্র কিছুই বলেনি ধীরে ধীরে চা খাচ্ছে।

 : দাদার চিঠি পেয়েছে? শুধালেন উমেশবাবু। ও আজ্ঞে না, দাদা আমার চিঠি হয়তো পেয়েছেন, আজ জবাব দিলে আমি কাল পাব।  

: খোকার জন্য মন খারাপ করছ বাবা। শুধোলেন গিন্নী মা।  

: না হ্যাঁ ওটার কথাই মনে হয়; মহীন সলজ্জ হেসে জবাব দিল।  

: বেলুড়ে কি কাজ তোমাদের? রতীন প্রশ্ন করলো আবার।

 : কাজ এমন কিছু না। দেখতে যাব আজ গেলেও হয়, কাল গেলেও হয়, বললো মহেন্দ্র।

  : আজ যেতে হবে, আমার প্রোগ্রাম বদলায় না। মাধুরীর গলার স্বর দৃঢ় এবং উত্তেজনাপূর্ণ।

আচ্ছা বাপু যা। বেলুড়ই যা রামকৃষ্ণ, মিশনে যোগ দিলেই তো পারিস, বলে রতীন বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। যেতে যেতে আবার বলে গেল, মনে করেছিলাম ক্লাবে টেলাবে নিয়ে একটু দ্র করে দেব, পাঁচজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব তা তো তুমি হতে দেবে না। থাক অমনি জংলী ভূত হয়ে।

শহরে মামদো থেকে জংলী ভূতেরা অনেক ভালো। জবাব দিল মাধুরী।

ওরা পিঠোপিঠি ভাই–বোন, ঝগড়া প্রায়ই লেগে আছে ওদের। কিন্তু সে ঝগড়ায়। স্নেহের অভাব নাই। ছোটদা খুবই ভালোবাসে মাধুরীকে। যেখানে যায় নতুন কিছু ওর জন্য কিনে আনে। সেই লক্ষ্ণৌ থেকে একটা পুতুল কিনে আনলো।

: ও নিয়ে খেলবার বয়স পার হলাম ছোটদা, তোমার খুকীর জন্য রেখে দাও।

 : তুই এখনো যথেষ্ট খুকী আছিস, নে, নে বলছি, ছোটদা ওর ঘরে দিয়ে গেল ওটা। খুশি হলো মাধুরী খুবই। কিন্তু মুখে কথা বলতে ছাড়লো না বললো, আমাকে ওরা খুকী বানিয়ে রাখবার চক্রান্ত করেছে, ছোটা সেই চক্রান্ত সভার প্রেসিডেন্ট।

 : আমি না, বড়দা বললো ছোড়দা।

: আজ্ঞে তোমার ইচ্ছাই নয় যে আমি বড় হই। শাড়ি তো তুমি কিনে দিতে চাইতে। এখনো তুমি স্বীকার করছো না আমি বড় হয়েছি।

 : হোসনি বলে ছোড়দা চলে গেল। ভাই বোনের এই ঝগড়া বেশ লাগে অন্য সকলের ওরা সবার ছোট, সকলের স্নেহভাজন, তাই সবাই উপভোগ করে কথা কাটাকাটি। কিন্তু মহেন্দ্র ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখলো। মাধুরীর মত বয়সের মেয়ে তার চোখে ছোট তো। নয়ই বরং যথেষ্ট বড়। ওর বিয়ে এখনো হয়নি মহীনের কাছে প্রথম প্রথম এটা অত্যন্ত বিসদৃশ লেগেছিল। এই কয়দিনে অবশ্য সয়ে গেছে এবং সে বুঝেছে সে আধুনিক যুগে এটাই চলছে কিন্তু রতীন যেভাবে মাধুরীর সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে যতখানি সহজে তার বেশি ধরে টান দিয়ে চড়টা–চাপড়টা লাগিয়ে দেয় মহেন্দ্রর পক্ষে তা সম্ভব নয় কিন্তু কেন? রতীন ওর সহোদর আর মহেন্দ্র নিতান্ত অনাত্মীয় না হলেও বন্ধুপুত্র। মাধুরীর পক্ষে সহজ ভ্রাতা–ভগ্নী ভাব কেন মহেন্দ্র আনতে পারছে না। নিজেকে কঠোর প্রশ্ন করেছে মহেন্দ্র দু’তিনদিন থেকে এটা অপরাধ হচ্ছে তার অন্তরাত্মার কাছে। নিজেকে এভাবে নীচু করা মহেন্দ্রের। মাধুরীর তরফটা সে ভেবে দেখলো, সে ঠিক সহোদরার মতো ব্যবহার করে, সহজ সরল সুন্দর। মাধুরী উঠে বললো। চলো, তোমার সেই গল্পটা শুনতে হবে।

 : কিসের গল্প রে মা? উমেশবাবু শুধালেন।

খুব ভালো গল্প বাবা, ধানগাছ আর ক্ষেত্রে কাঁকর ধরার গল্প, পানকৌড়ির ডুব সাঁতার, কাঠ ঠোকরার কঠকঠ তার সঙ্গে দোয়েল, পাপিয়া, বৌ কথা কও পাখীর গল্প, ও এতো সুন্দর করে বলে বাবা, যে শুনলে তুমিও শুনতে চাইবে।

 : ও, যা, শোনগে।

মহেন্দ্রকে নিয়ে মাধুরী চলে গেল। বড় বউ হেসে বললো, পাড়াগাঁ সম্বন্ধে মাধুরীর একটা স্বপ্ন আছে বাবা, ও কখনো দেখেনি কিনা।

 হ্যাঁ, মা কলকাতার বাইরে ও যদি গেছে তো, দার্জিলিং কিংবা দিল্লী। পাড়াগাঁ দেখেনি।

 : আমি একবার ওঁকে বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে কুন্তী নদী বয়ে যায়। তা শুনে বললো সে নদী আমি দেখবোই বৌ, কুন্তী, মহাবারতের কুন্তী দেখতেই হবে। বললাম, সেইটা একটা খাল বিশেষ। শুনে ওর চোখ ছলছল করে উঠলো, বললো, কুন্তীর মত গরবিনী মাকে তুমি খাল বলছো? ছি। সেই থেকে আমি খুব সাবধানে ওর সঙ্গে কথা বলি বাবা।

মা বাবা দু’জনেই হাসলেন। মা বললেন ওকে নিয়ে ভারী মুশকিল রে মা। কোথায়। গিয়ে পড়বে, শ্বশুর বাড়ি কেমন হবে, বড় ভাবনা হয় আমার।

: তোমার ছেলেরা তো বলেন ওর বিয়েই দেব না। তুমি ভাবছো কেন মা ওঁরা বলে, মাধুকে নিয়ে আমরা চার ভাই, মাধু আমাদের বাড়িতেই থাকবে বিয়ে ওর দেব না।

তা কি হয় মা? মেয়ে হয়ে জন্মেছে, বিয়ে তো দিতেই হবে। তবে যতটা সম্ভব দেখে শুনে দিতে হবে, তারপর অদৃষ্ট। আর কেউ কিছু বললো না কেমন যেন গুরু গম্ভীর হয়ে উঠলো আসরটা। তারপর উমেশবাবু বললেন, অতীন কি বেরিয়ে গেছে বৌমা?

: হ্যাঁ বাবা, কিসের যেন কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন, ভোরেই বেরিয়েছেন। মেজ ঠাকুরপো যাবেন। বোম্বাই ওদের খেলা আছে।

 : মেজবৌমা যাবেন নাকি, গিন্নি প্রশ্ন করলেন।  হ্যাঁ যাবার যোগাড়ই তো করতে দেখলাম, এয়ারে যাবে শুনেছি।

: এয়ারে। বড্ড আমার ভয় করে মা, এয়ারে কেন? ট্রেনে গেলেই পারতো।

: ভয় করে আর লাভ নাই মা, সবাই এ যুগে এয়ারে চলে, বাকী রইলাম আমি তুমি আর বাবা, বলে হাসলো বড়বৌ। বাবা চলুন আমরা একবার এয়ারে ঘুরে আসি, আমার ভারী ইচ্ছে হয় বাবা।

: তুই যা অতীনের সঙ্গে। আমাদের আর এ বয়সে এয়ারে পোয় না মা, বলেন। উমেশবাবু। তারপরই বললেন, মাধু শুনলেই বায়না নেবে আর আমাকে উড়িয়ে ছাড়বে। ওকে কিছু বলিস না, বুঝলি?

: ওকেই বলতে হবে বাবা তাহলে আপনারা যাবেন আপনাকে একবার এয়ারে নিয়ে যাবার বড় সাধ, হাসলো বড়বৌ।

: কেন মা হেসে শুধালেন উমেশবাবু। আমাকে উড়াবি কেন?   

: বাবা, আপনি আমাদের জন্যে এতসব করেছেন, সারাজীবন খেটেছেন অথচ যুগের যে সুখ সুবিধে, তা কিছু আপনি ভোগ করছেন না। সেই ভাতে ভাত খাবেন ফরাসে বসে, গুড়গুটি টানবেন, আর সেই হাত কাটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে শীত কাটাবেন আর আমরা সব নবাবী করে বেড়াবো, এ আমার ভালো লাগে না বাবা। বড়বৌ মাথায় হাত দিয়ে বুলাতে বুলাতে বললো।

  : অনেকদিন সে এসেছে এ বাড়িতে। কন্যার মত বড় হয়েছে উমেশবাবুর ক্রোড়ে। শুধু বধু নয়। আত্মজা দুহিতার মতো ওর আবদার বড় মিষ্টি লাগে উমেশবাবুর। আর বড়বৌ সত্যি বড় ভালো মেয়ে, এযুগে এরকম বধু দুর্লভ।

  : ছেলেমেয়েদের জন্যই মা বাপ যা কিছু করে মা, আমার কি নবাবী করার বয়স আছে। এখন হরিনামের মালা ঘোরাব, শেষ কাজ মাধুরীর বিয়ে, তাপর আর কি, তোরা ভাল থাকলেই আনন্দ রে। আমায় এককাপ কফি দে রে, বলে বৃদ্ধ সস্নেহে বড় বধূর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।

বড়বৌ কফি তৈরি করছে শ্বশুরের জন্য, ওদিকে মাধুরীর কল হাসি শোনা গেল। ওদের গল্পে বলছে নিশ্চয় এবং সে গল্প হাসির উপাদান আছে। কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বড়বৌ একবার ভিতরে গেল দেখতে, মহেন্দ্র আর মাধুরী কিসের গল্প করছে–

: শীত বুড়ি এ গ্রাম উ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরলো, ওম্ মা তাকে কে চায়, বেরো–। শীত বুড়ীকে কেহ আশ্রয় দিল না, ঘুরে ঘুরে বুড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়লো। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেছে শীতে তো গলা শুকায় জানো

 : হু, তারপর? মাধুরী হাসিমুখে বললো।

ও জল খাবার জন্যে বুড়ি গেল নদীতে। নদী ওকে দেখে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল যা বেরো কে তাকে জল দেবে? শীত বুড়ি নিরাশ হয়ে পুকুরের কাছে গেলো। পুকুরও তাকে তাড়িয়ে দিল দূর দূর করে। কেউ জল দিতে চায় না। শীত বুড়ির চোখ ফেটে জল আসছে, পিপাসায়…..

: তারপর?

ঐখানে ছিল একটা পুরানো পাতকুয়া, সে এসে বললো, বুড়ি, কেউতো তোকে জল দিল না, আমি দেব আয়। আমার জল খা। বুড়ি যেন হাতে স্বর্গ পেল। আকণ্ঠ জল পান করে আশীর্বাদ করলো পাতকুয়াকে, শীত কালে আমার রাজত্বে সব জল ঠান্ডা হয়ে যাবে কিন্তু বাছা পাতকুয়ো, তোর জল থাকবে উষ্ণ, সুখসেব্য।  হ্যাঁ, সত্যি? পাতকুয়োর জল গরম থাকে শীতকালে? মাধুরী শুধলো, গরম নয়, উষ্ণ থাকে। তাপর শীত বুড়ি বসলো। গাছতলায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, শীত পড়েছে দারুণ, শীতে বুড়ি কাঁপছে। রাস্তা দিয়ে যে যায়, শীত বুড়ি বলে, বড় জড়ি একটি কম্বল দাও না গো কেউ। কিন্তু কে দেবে? সবাই ভয়ে পালাল। শীত বুড়িকে কম্বল দিয়ে কে আর তোয়াজ করবে বলো?

: হু, তারপর?

 : শেষে একটি গাঁয়ের বউ ঘাট থেকে জল নিয়ে ফিরছিল, শীত বুড়ি তাকে বললো জারে বড় কষ্ট পাচ্ছি মা, কিছু দিতে পারো। বউটির দেবার কিছু নাই, বললো, আমি তো আঁচল গায়ে দিয়ে আছি মা, এরই একখানি নাও। বলে সে তার আঁচলের খানিকটা  ছিঁড়ে দিল। বুড়ি গায়ে দিয়ে বাচলো, বললো, বৌমা, আমার রাজত্বে যে যতই দামী জামাকাপড় পরুক আমি তাকে শীতে কষ্ট দেবই, কিন্তু খালি গায়ে আঁচল গায়ে দিয়ে কেউ শীত পাবে না, বৌরা আঁচল ঢেকে তাদের খোকাখুকীকে শীত থেকে রক্ষা করতে পারবে। সেই থেকে পাতকুয়োর জল আর শাড়ির আঁচল বাংলার বধূদের সম্বল। এই দারুণ শীতে দামী জামাকাপড় বৌদের দরকার হয় না মাধুরী।

 : শুধু আঁচল গায়ে? এতো শীতে? বিস্ময়ে–চোখ কপালে উঠলো।

  : হ্যাঁ শুধু আঁচলে, তাও ছেঁড়া, উঠতে হয় ভোর পাঁচটায়, ঘর নিকানো কত কি কাজ ঐ ভোরেই বাংলা পল্লীবধুর এই স্বরূপ, আজও।

: পাতকুয়োর জলে হাত কনকন করে না।

: না, মাধুরী পাতকুয়োর বর রয়েছে জল উষ্ণ, আমার লাগে হাত দিতে।

: ওখানকার সব বাড়িতেই এই রকম?

: হ্যাঁ কারণ সবাই গৃহস্থ প্রায়, কলের জলতো নেই, জামা–কাপড়ও কম।

: এই তোমাদের গল্প, বলে বড়বৌ হেসে ঢুকলো ভেতরে। মাধুরী বলল গল্প খুব সুন্দর বৌদি, গাঁয়ের মেয়েদের সত্যি রূপটি ফুটে উঠেছে গল্পে।

উমেশবাবু একটি বাগান বাড়ি খরিদ করলেন দমদমে। বিরাট বিস্তীর্ণ উদ্যান কৃত্রিম ঝর্ণা। পুকুর এবং তার সঙ্গে একখানি বাড়ি। কে জানে কবে কোন এক সৌখিন ধনী। এই সুন্দর উদ্যান তৈরি করেছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছরের প্রাচীন এর জীবনে। ইতিহাস, হয়তো সেসময় বাঈজী বিশাল এই সুরম্যকানন অপবিত্র হোত কিন্তু আজ তার কোন চিহ্ন নাই বরং বাড়ির বহু ভগ্ন, বাগান যে মেরামতে কদর্য মূল্যবান প্রস্তর মূর্তির অনেকগুলো স্থান ভ্রষ্ট তথাপি বাগানটা এখনও সুন্দর।

বর্তমানকালে কেউ আর বাগানবাড়ি কিনে না। উমেশবাবুও কিনতেন না, কিন্তু বাগানটার মালিক আর্থিক দূর্দাশায় পড়েছেন, তাই উমেশবাবুকে তিনি ধরে পড়লেন। অন্তঃপর বাগানটা নিয়ে কি করা যায় উমেশবাবু ভাবছিলেন। অকস্মাৎ মেজ ছেলে যতীন বললে, আমরা ঐ বাগানটায় পিকনিক করতে যাবে একদিন।

বেশ তো, যেয়ো। উমেশবাবু আনন্দিত হয়ে উঠলেন। এতগুলো তার ছেলে মেয়ে, বাগান বাড়ি তো দরকারই বাগানটা কিনে ভালো করেছেন। তারপর কলকাতা শহর যেমন বাড়তে আরম্ভ করেছে কে জানে কবে ঐ বাগানে ঠেকবে আর তখন ঐ জমি হাজার টাকায় বিক্রী হবে। একটা সম্পত্তি হয়ে রইল।

মনে মনে এসব হিসাব করছিলেন উমেশবাবু হিসাব করা তার অভ্যাস, হিসেবী না হলে এতবড় সম্পদের মালিক তিনি হতে পারতেন না। বড় ছেলে এসে ঢুকলো। উমেশবাবু তার পানে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালেন।

 : মহেন্দ্রকে টাইপ করার কাজটা শিখতে বললাম বাবা।

: বেশ তো, আর শর্ট হ্যাঁন্ডও। উমেশবাবু সানন্দে বললেন।

: না বাবা, ইংরাজী খুব কম জানে, শর্ট হ্যাঁন্ড পড়বে না।

 : কে? সেই ছোঁকরাটার কথা বলছেন? বলতে বলতে কুমার এসে দাঁড়ালে। হাতে টেনিস   র‍্যাকেট, পরণে খেলোয়াড়ের সাজ, মুখে উপেক্ষার হাসি। বললো, শর্ট হ্যাঁন্ড না শিখলে টাইপ শেখার কোনো মানেই হয় না, ওতে কি হবে। ত্রিশ টাকা।

: হবে ওতেই হয়ে যাবে। টেনিস ক্রিকেট না দেখলে, বিলেতী ঢঙে না চললে ওতেই দুবেলা দুমুঠো হতে পারে। বলে মাধুরী এসে দাঁড়ালো বাপের পিছনে। বাবাকে বললো, আজ আমি একটা ঘরোয়া সাহিত্য আসর বসাব বাবা, তোমাকেও থাকতে হবে।

সাহিত্য আসর! উমেশবাবু বুদ্ধিহারা হয়ে উঠলেন, কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করেছিস?

বাংলার খ্যাতনামা কয়েকজন সাহিত্যিক আসবেন, বর্তমান সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হবে।

ব্যাপারটা এতই অভিনব আর এ বাড়িতে এমনই আকস্মিক যে উমেশবাবু এবং অতীন ও কুমার বিস্মিত হয়ে গেলো বিশেষ রকম। কিন্তু কুমার কোনো ব্যাপারে নিজেকে ছোট মনে করে না, আধ মিনিট ভেবে বললো, সুন্দর প্রস্তাব। আমাদের খেলাটা আজ না হয় মূলতবী থাক……।

আপনারা নিশ্চিন্তে খেলা করুনগে, ওখানে আপনাদের কোনো কাজ নেই।

তোমাকে তাহলে নিমন্ত্রণ করা হলো বাবা, বলে মৃদু হেসে চলে গেল মাধুরী।

নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেশ ক্ষুণ্ণ হলো বোঝা গেল, কিন্তু উপায় নেই। মাধুরীর কথাই ঐ ধরনের। তথাপি ঐ তরুণীর প্রতি আকর্ষণ দুর্বার, দুঃসহ অজয়কে জয় করবার সাধনাই। করেছে সে। মাধুরীর অন্তর তাকে লাভ করতেই হবে কিন্তু আপাততঃ কিছু করবার নেই। ওদিকে লন–এ খেলোয়াড়গণ এসে জুটল। কুমার   র‍্যাকেটখানা ঘুরাতে ঘুরাতে বাইরে গেল–অতীন বললো–

: মাধু কুমারকে মোটেই সইতে পারবে না বাবা

: তার আর কি করা যাবে? যাকে সইতে পারবে তাকেই আনবি।

 : সে তো নিশ্চয়ই। যতদিন ওর মত না হবে, তত দিন বিয়ের কথা থাক বাবা। ও এখন সাহিত্য, সঙ্গীত এই নিয়ে বেশ আছে।

: থাক, তবে বড় হয়ে উঠলো অতীন।

  : না বাবা, এমন কিছু বড় হয়নি, বলে চলে গেল। বৃদ্ধ তারপর কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবতে লাগলেন, ছেলে। মাধুরীকে অত্যন্ত স্নেহ করে। তার মৃত্যুর পরেও মাধুরী কোন। অসুবিধা হবার নয়, তথাপি কিছু নগদ টাকা আর দমদমের ঐ বাগানখানা তিনি মাধুরীকে দিয়ে যাবেন। মাধুরীর বিয়ে যদি এর মধ্যে হয় ভাল না হলেও খুব বেশি আটকাবে না। তবে কি হবে, না হবার কারণ কিছু নাই, কুমারকে না চায়, অনেক কুমার মাধুরীর জন্য পাওয়া যেতে পারে।

ওদিকে বড় ঘরটায় সাহিত্য আসর পাতা হচ্ছে। তিন চারটি মেয়ে ওরা সকলেই মাধুরীর বান্ধবী, কলেজে পড়ে পাড়ারও আছে। আর রয়েছে মহীন। গান হবে, তারও আয়োজন করা হচ্ছে। এ ঘর থেকে দেখতে পেলেন উমেশবাবু ব্যাপারটা বেশ ঘোরাল করে। তুলেছে মাধুরী। ওদের আলোচ্য বিষয় বর্তমান সাহিত্য কিন্তু সাহিত্য সম্বন্ধে উমেশবাবু কোন খোঁজ খবর রাখেন না। বাড়িতে একটা ছোট লাইব্রেরী আছে, মাসিক পত্রও আসে কয়েকখানা, কিন্তু সে সব মাধুরীর সম্পত্তি। বড় জোর ছোট ছেলে রতীন মধ্যে মধ্যে যায় সেখানে। বড় বৌমাও বই নিয়ে যায়, কিন্তু মাধুরীদের ওতে নজর খুবই কম। প্রায় সব সময়। ঘরটা তালাবন্ধ থাকে।

চার পাঁচজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে মাধুরী ঢুকলো এ ঘরটায়, এঁরাও তাহলে সাহিত্যিক হবেন। আর বসে থাকা চলে না, উমেশবাবুকে উঠতে হোল অভ্যর্থনার জন্যে। গিয়ে স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন তাদের। গান হোল, মাল্যদান ও হোল, এবার আলোচনাও হবে। উমেশবাবু এক সময় সরে পড়লেন, কিন্তু টেনিস খেলোয়াড়ের দলকে দল এসে ঢুকলো। ওখানে। পাঁচ সাত জন লোক, কুমার নৃপেন্দ্র নারায়ণও।

আসনে বসলেন তারা। জনৈক সাহিত্যিক বক্তা বলতে লাগলেন, বর্তমান বাংলা। সাহিত্যে যে ধারা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্য একটা বলিস্ট গতি লাভ করেছে। এই যুগের জন সাহিত্য, মানুষের মনের সঙ্গে এর সংযোগ। নিবিড় মানুষের আবেষ্টনীর সঙ্গে অনুরঞ্জন গভীর এবং গাঢ়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন–

যে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি,
যে আছে মাটির কাছাকাছি—

মাটির কাছাকাছি থাকা সেই কবিদের আবির্ভাব আজ ঘটছে–

ব্যাপারটা অমনি জটিল অবোধ্য আর অনালোচিত যে কুমারদের দলে বিশেষ সুবিধে পাচ্ছিল না। প্রায় শেষ হয়ে আসছে, আর কেউ কিছু বলবেন কিনা প্রশ্ন করলেন সভাপতি মশাই। অকস্মাৎ কুমার বলে উঠলো, সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা মহীন বাবুর কাছ থেকে কিছু শুনবার আশা করি।

মহেন্দ্র একধারে চুপচাপ বসেছিল। তার প্রতি এমন একটা আদেশ আসবে, সে মোটেই আশা করেনি, সভাটা ঘরোয়া, কাজেই রুচি বিরুদ্ধতার কথা উঠে না কিন্তু সভাপতি মশাই মহেন্দ্রর পানে তাকালেন। মহেন্দ্র উঠলো–

অকস্মাৎ আমার উপর এই আদেশ আমি আশা করিনি। বিদ্যা আমার অত্যন্ত কম। সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান তার থেকেও কম, তথাপি আমার মত, আমি যথাসাধ্য বলবার চেষ্টা করছিঃ বর্তমান জগযুদ্ধের বিপর্যয়ে ব্যাধিগ্রস্ত জগৎ শুধু বলিষ্ঠ আর বিচিত্র সাহিত্যই চাইছে না, বহির্মুখী চিন্তাকে আজ আবার কেন অন্তমুখী করবার জন্যে একটা অনুপ্রেরণা জেগেছে মানুষের। নির্জন গৃহকোণের শুদ্ধ ধ্যান মোহনতার যে শান্তি, যে সুরভি, যে সুখাবেশ তাকে মানুষ উপেক্ষা করছে বলিষ্ঠ আর বর্যিমুখি বৈচিত্র্য দিয়ে কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবী আজ যেন আবার অন্তরের আত্মচেতনাকে জাগিয়ে তুলতে চায়। মানুষের মনের এই দাবীকে মিটাতে হলে শুধু বলিষ্ঠ আর বিচিত্র সৃষ্টি হলে হবে না। সে সৃষ্টিকে করতে হবে শান্ত এবং সম্মানিত, সে হবে লোক সাহিত্য শুধু নয়, লোকাত্তর সাহিত্যও, তার আবেদন আজকের শুধু নয়, আগামী শতাব্দীরও। তার আনন্দ আধুনিক নয়, অনন্তকালের। আমার মনে হয়, মাটির কাছাকাছি আছেন যে কবিগণ তারা অন্তরকে উদঘাটিত করে অন্তরকে নন্দিত করবেন, আনন্দিত করবেন রস পিপাসুদের।

সুন্দর! হাততালি দিল কয়েকজন। বসে পড়ল মহেন্দ্র, কিন্তু মাধুরীর তীক্ষ্ণ চক্ষু কুমারের এই প্রস্তাব, মাধুরীর বুঝতে মুহূর্ত সময় লাগেনি, কিন্তু ঐ ছোট লোকটা জব্দ হয়ে গেল! শান্ত সুন্দর হাসি ফুটলো মাধুরীর মুখে, অতঃপর সভাপতির অভিভাষণের পর জলযোগার ভুরি পরিমাণ আয়োজন। মহেন্দ্র সঙ্গে আলাপ করলেন তারা এবং বললেন, মহেন্দ্রর সংক্ষিপ্ত ভাষণ সুন্দর হয়েছে। মাধুরী তাকালো কুমারের দিকে কিন্তু কুমার তখন কাটলেটখানা কাটতে ব্যস্ত! পাশে বসা ডেইজীকে অনুচ্চস্বরে কি যেন বলছে। ডেইজী ওর বান্ধবী। টেনিস খেলার সঙ্গিনী এবং ওদের পাড়াতেই বাস করে বছর চব্বিশ বয়স এখনও বিয়ে হয়নি। সাহিত্যিকরা আহারাদি করে চলে গেলেন মহেন্দ্র মাধুরী ওদের এগিয়ে দিল।

তারপর মহেন্দ্র গেল নিজের ঘরে, মাধুরী গেল মার পূজার ঘরে? ওখানে টেনিস খেলোয়াড়দের আলোচনা সভায় ওরা আর ফিরে এলো না। কুমারদের দল আশা করেছিলো ওদের ফেরাবার কিন্তু কৈ, অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। অতএব ওরাও উঠলো।

কুমারের অন্তরটা কেমন যেন বিষাদিত হয়ে উঠেছে। ঐ নগন্য একটা যুবক, বিদ্যাহীন, স্বাস্থ্য, সামাজিকতাহীন একটা তুচ্ছ ব্যক্তি কুমার নৃপেন্দ্রনারায়ণ কি তার কাছে হেরে যাবে? কিন্তু হারালো কোথায় নিজেকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করতে করতে কুমার গিয়ে গাড়িতে উঠলো, পাশে ডেইজী, গাড়ি চলে যাচ্ছে।

ডেইজী বলল, ছোঁকরাটা কে? ঐ শেষে বক্তৃতা দিল?

ওদের বাড়ির একটা পরগাছা। চাকরির জন্য বসে আছে?

ছেলেটা বেশ বলতে পারে তো।

 হ্যাঁ এবার কংগ্রেস নির্বাচনে ওকে কাজে লাগাব—

আপনি দাঁড়াচ্ছেন নাকি?

দাঁড়াব, ওকে প্রোপাগাণ্ডার জন্য নিযুক্ত করতে হবে।

ভালো হবে, ওর বুদ্ধি আর বলবার ক্ষমতা দুটোই আছে।

তৃতীয়টা নেই, বলে মোড় ফেরালেন গাড়িটাকে কুমার।

সেটা কি?

বল। শারীরিক শক্তি, বলে আপনাদের সবার সুপুষ্ট হাত দিয়ে ষ্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন কুমার সাহেব, গাড়িটাকে অনাবশ্যক জোরে চাপিয়ে দিলেন।

সাহিত্য বাসর শেষ হওয়ার পর মহেন্দ্র নিজের ঘরে এসে বসল, ভাবতে লাগলো সে তো বেশ বলতে পারে। অল্পক্ষণের জন্য হলেও কথাগুলো সে খুব মন্দ বলেনি? নিজেকে এতোখানি অসহায় ভাববার কোনো কারণ নেই, তার ভেতর এমন একটা শক্তি রয়েছে যে তাকে সকল সাহায্য করছে। নিজের এই শক্তিটা সম্বন্ধে সে কোন দিন সচেতন ছিল না, এ যেন তার কাছে একটা আবিষ্কার। কিন্তু উৎফুল্ল হতে পারলো না মহেন্দ্র। তার বক্তৃতা মাধুরী ওকে আক্রমণ করবে, অথবা একান্তভাবে এগিয়ে যাবে ও বিশেষ কোন কথাই তুলবে না। মাধুরীর মনের গঠনটা এতটা অদ্ভুত কেন হোল, বুঝতে পারে না মহেন্দ্র। এ বাড়িতে আরো তো অনেক আছেন, কিন্তু মাধুরী এদের মধ্যে থেকেও যেন স্বতন্ত্র, ওর সঙ্গে এদের কারো মেলে না।

মাধুরীর মনে মহেন্দ্রর বক্তৃতা কি কাজ করেছে, ভেবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয় মহেন্দ্রের। পক্ষে। তার সঙ্গে দেখা হলে তখন বোঝা যাবে, তাই মহেন্দ্র কাব্য পাঠ আরম্ভ করে দিল। এখানে আসার পর থেকে ওর পড়াশোনার সুবিধা হয়েছে প্রচুর, সঙ্গীত চর্চার ও সুযোগ মিলেছে, কিন্তু ওর যেটা সারা মনপ্রাণ দিয়ে চাইছে, সেই চাকরি এখনো পায়নি। টাইপ রাইটিংটা শিখছে মহেন্দ্র, তার সঙ্গে বুক কিপিংও। হয়তো চাকরি তার একটা শিঘ্রী হয়ে যাবে, কিন্তু এ বাড়ির কেউই তার চাকরির জন্য বেশি মাথা ঘামায় না, শুধু মাধুরীই বলে মাঝে মাঝে চটপট কাজ শিখে ফেল চাকরি করতে হবে তোমার–

মহেন্দ্র রবীন্দ্রকাব্য পড়ে প্রতিটি পংক্তির ব্যঞ্জনা রসাপুত করে বিস্মিত বিমুগ্ধ করে তোলে, গড় গড় করে তাই সে পড়ে না ধীরে ধীরে রস আস্বাদন করে পড়ে, এটা ওর বরাবরের স্বভাব, কিন্তু অত ধীরে পড়ায় অপর কাউকে শোনানো যায় না তাই মাধুরী বলে–

আবৃত্তি তোমার দ্বারা হবে না মহিনদা

না হোক, আবৃত্তির জন্য কাব্য হয়নি, বলে মহেন্দ্র পড়ে চলে।

কি জন্য তবে লেখা হয়েছে? প্রশ্ন করে মাধুরী।

রসপিপাসুর অন্তরকে পরিতৃপ্তি করতে, কাব্য সকলের জন্য নয় মাধুরীর, বিমুগ্ধ জনই কাব্য সম্ভোগ করতে পারে, দেবীর করুণা, কাব্য ব্যতীত অনুভব হয় না।

যথা? মাধুরী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধোয়। যথা, অন্তর হচ্ছে আহরি বচন, আনন্দ লোক কবি বিচরণ কবির এই যে কথাটায় একটি আনন্দলোক রচিত হয়েছে, পৃথিবীর কটা মানুষ সেখানে পৌঁছাতে পারে বল তো?

আমি তো কোন লোকই খুঁজে পাচ্ছি না, না আনন্দ, না নিরানন্দ, তবে ভাষার তুবড়িবাজী দেখা যাচ্ছে, মাধুরী তর্ক করতে চায় মহেন্দ্রকে রাগিয়ে। ঐ জন্যেই তা। অরসিকেষু রহস্য নিবেদন, করতে মানা বলে মহেন্দ্র পাশ কেটে একেবারে চুপ মেরে যায়, কিন্তু মাধুরী তখনো গুঞ্জন করতে থাকে আপন মনে।

অরসিকের মধ্যে রস না আনতে পারলে কবিতা হোলো না, হোলো কচুপোড়া বেগুন ভোজন করার লোক, আর বেলফুল উপভোগ করার মধ্যে তফাৎ আছে মাধুরী।

অর্থাৎ আমি বেগুন বিলাসী আর তুমি বেলফুল বিলাসী, দুটোরই কিন্তু জন্ম এক জায়গায়, মাটিতে, অতএব এখানে আমরা আত্মীয়, কেমন?

 হ্যাঁ, যেন অন্নের সঙ্গে সম্পর্ক কদলী পত্রের, সৌন্দয্যের চপট ভরে না, তার উপর ভাতের কাড়ি দরকার। বেলফুলে পেট ভরে না বেগুনও চাই, চাই–ই।

চাকরির চেষ্টা কর, রোজগার কর, তারপর কথা হবে।

এরকম তর্ক হয় ওদের মধ্যে।

আজও সভাভঙ্গের পর মহেন্দ্র নিজের ঘরে এসে পড়তে বসেছে। রবীন্দ্রকাব্য মনটা রক্তাপুত হয়ে উঠেছে, সুতরাং অন্য চিন্তা ভুলে গেছে মহেন্দ্র, বিশ্ব যেন ওর কাছে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, জেগে আছে, এক কবি অন্তরের।

অনাস্বাদিত অনুভূতি আনন্দের জ্যোতিময় রূপায়ন, মহেন্দ্র পড়ছে।

নিঃশব্দ চরণে উষা নিখিলের সুপ্তির দুয়ারে দাঁড়িয়ে একাকী, রক্ত অবগুণ্ঠনের অন্তরালে।

উষা নয় আমি বড়বৌদি, উষার আসতে দেরী আছে। এই রাত মাত্র দশটা।

ওঃ মহেন্দ্র হাসলো এই বিঘ্ন ওর ভাল লাগেনি, কিন্তু কিছু বলার নেই। এ ওদের আশ্রিত, কিন্তু বড়বৌ বুঝলো, হেসে বললো–

খেতে ডাকতে এলাম ঠাকুরপো, চল, কি এমন মশগুল হয়ে পড়ছিলে? বই ওটা? উষা অনিরুদ্ধ?

না বৌদি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন থেমে গেল মহেন্দ্র।

কি বলেছেন? প্রশ্ন করলো বড়বৌদি হেসে।

কি অপরূপ কথার ব্যঞ্জন। বৌদি বলেছেন রাত শেষ হয়েছে ভোর হল পূবাকাশে লাল হলে উঠছে আলো এতগুলো বলেছেন তিনি

বেশ তো বলেছেন, তোমার বৌদি এসে ঐ রকম বলবে, খাবে এসো।

শুনুন বৌদি, কি অপরূপ কথার ব্যঞ্জন ওভাবে কথাগুলো তিনি বলেন নি, বলেছেন–

নিঃশব্দ চরণে উষা নিখিলের তৃপ্তির দুয়ারে দাঁড়ায় একাকী। রক্ত অগুণ্ঠনের অন্তরালে।

না, বৌদি অবগুণ্ঠন মানে ঘোমটা, ভোরের আকাশকে তিনি অবগুণ্ঠনের সঙ্গে–কিন্তু মহেন্দ্র দেখতে পেল, দরজার প্রান্তে মাধুরী প্রদীপ্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি বললো থাক বৌদি, চলুন খেতে দেবেন বলে বইটা রেখে উঠে পড়ল।

মাধুরী নিঃশব্দ পদসঞ্চার কখন চলে গেছে, দেখতে পেল না আর। খেয়ে এসে মহেন্দ্র শোবে। দেখলো বিছানার চাদরখানা ঝেড়ে পেতে দিচ্ছে মাধুরী। নিশূপে দাঁড়িয়ে থাকলো মহেন্দ্র। মাধুরী কাজ শেষ করে বলল।

শোও, যেখানে সেখানে যা তা কথা বলা বন্ধ করো তুমি।

কেন? কি বললাম। ভয়ে ভয়ে মহেন্দ্র তাকালো ওর পানে।

অত ভয় পাবার কিছু নেই, উলুবনে মুক্তো ছড়িও না। বুঝলে তোমার এই কাব্য ব্যঞ্জনা বড়বৌদি কি বুঝবেন? তিনি মা জাতীয় জীব। তাঁর সমস্ত শরীর মন ইন্দ্রিয় আচ্ছন্ন করে জেগে আছে শুধু মাতৃত্ব ওখানে উষার অভিসারের কথা একেবারেই অবান্তর! নিঃশব্দে চরণে উষা আসছে তোমার কাব্য মণিকোঠার দরজা ঠেকতে এ ব্যাপারে ওকে কোনদিন বোঝন যাবে না তোমার পেটের দরজা উনি খুলতে পারে। শোও।

চলে গেল মাধুরী মহেন্দ্র তার পেছনটা দেখলে ওকে তো এখন আর ডাকা যাবে না। ও পতিভক্তিতে সেটা প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু মহেন্দ্র কে জিজ্ঞেস করতে তীব্র ইচ্ছা জাগিছিল। উষার এই অভিসারের কথা মাধুরী কতখানি বুঝেছে। কাব্য লিখে আনন্দ পূর্ণ হয় না পড়েও হয় না যদি কোন অনুভূতিশীল শ্রোতার সঙ্গে সে রস বন্টন করে ভোগ করা যায়। মাধুরী কি অপূর্ব রস উপলদ্ধি করতে পারে?

পারে তার কথাতেই সেটা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু মাধুরীর মনে গভীর জটিলতা অতল বারিধির তলদেশের মতই স্তব্ধ নিথর।

কি ভাবলো নিজের চিন্তাটা নিজেই যেন বুঝতে পারছে না মহেন্দ্র ওর মতে অন্য কেউ যেন চিন্তা করছে ওর সম্বন্ধে সে সর্বশেষ জানে, এবং অনেক বেশি জানে কে সে। মহেন্দ্রর অন্তরাত্মা হয়তো।

ধীরে ধীরে বিছানায় এসে শুলো মহেন্দ্র। ঘুম আসতে হয়তো দেরী হবে, কিন্তু না, অতি অল্প সময়েই মহেন্দ্র ঘুমের মধ্যে কত কি স্বপ্ন দেখে। সে আজ কিন্তু কিছুই দেখলো না কেমন একটা নীবিড় সুশীতল ঘুম, উঠেই দেখল সকাল। সকালেই টাইপ যন্ত্রণা কিছুক্ষণ অভ্যাস করে মহেন্দ্র, তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিল তারপর অফিস ঘরে এসে টাইপ করতে বসল। কতক্ষণ কেটেছে কে জানে? অকস্মাৎ মহেন্দ্রের মনে পড়ল, আজ সকাল থেকে এত বেলা অবধি মাধুরীকে একবারও দেখা যায়নি। এমনটি তো হয় না।

প্রতিদিন যার সঙ্গে দেখা হয়, কোনো একদিন তার সঙ্গে দেখা না হলে মনের কোণায় যেমন কাটার মত ব্যাথা বোধ হয়, মহেন্দ্রের তেমনি হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় অফিসের মেমসাবটি একবার মহেন্দ্রকে দেখে প্রশ্ন করলো–তুমি কতটা শিখলে বাবু, চোখ বুজে টাইপ করতে পার? ভাষাটা ইংরেজি? না বলে মহেন্দ্র আবার বললো চোখ বুজে টাইপ করতে অনেক দিন লাগবে। নাও, তোমার কাজ কর, বলে মহেন্দ্র যন্ত্রটা ছেড়ে উঠলো। মনের মধ্যে এমন একটা উদাস ভাব জেগে রয়েছে, যেন কিছুই আর করবার নেই। এখানেই খবরের কাগজ রয়েছে, মহেন্দ্রের চোখ দিতেও ইচ্ছা করল না, বুককিপিং শিখবার জন্য কিছু পড়া দরকার, সেদিকেও মন গেল না, করবে কি সে এখন? কেন মনটার অবস্থা এতো করুণ হয়ে উঠলো ভাবতে গিয়ে মহেন্দ্র বুঝতে পারল আজ দুইদিন দাদা বৌদির চিঠি পায়নি, খোকনের কোন খবর পাওয়া যায়নি। এতোগুলো দিন পার হয়ে গেল খোকনের কথা ভাবেনি মহেন্দ্র এর থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার ওর জীবনে কিছু হতে পারে না। নিজেই সে আশ্চর্য হয়ে গেল, কি এমন রাজকার্যে ব্যস্ত ছিল যে তার একান্ত স্নেহ–পুত্তলীর কথা সে ভুলে গেছে? আর চিঠিই বা আসলো না কেন!

ভেবে দেখলো এই ক’দিন সকাল বিকাল টাইপ করার অভ্যাস করছে আর সন্ধ্যায় থিয়েটারে, সিনেমা, নাচ, গান শুনে কাটিয়েছে। রাত্রে ফিরে পড়েছে কাব্য না হয় উপন্যাস। গভীর রাত্রে সঙ্গীত সাধনাটাও ক’দিন হয়নি, কারণ ঘুমিয়ে গেছে। এভাবে জীবন কাটলে তো তার চলবে না তাকে খাটতে হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বড় লোকের বাড়িতে আগাছা পরগাছা হয়ে পরমানন্দে দিনযাপন করতে মহেন্দ্র কলকাতায় আসেনি। নিজের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মহেন্দ্র উঠে এসে খবরের কাগজের ওয়ানটেড কলাম দেখতে লাগলো। খুঁজে খুঁজে কয়েকটা চাকরীর জিজ্ঞাপন বের করলো, তারপর গোটা পাঁচেক দরখাস্ত বিভিন্ন জায়গায় পার করে দিল ডাকে, অবশ্য ওই সঙ্গে দাদাকেও একটা চিঠি লিখলো থোকার খবরের জন্য। সব শেষ করে সে যখন স্নান করে এলো, তখন বেলা দেড়টা। বড় বৌদি বলল–ব্যাপার কি ঠাকুরপো, আজ কি এমন দরকার ছিল?

এমন দরকার ছিল–ছিল বৌদি, দরখাস্ত লিখলাম চাকরীর জন্য।

চাকরী–বলে বৌদি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, খানিক পর বললো তা বেশ তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *