২. ছায়া দেবনাথের গবেষণা, কেস নং ৯

ছায়া দেবনাথের গবেষণা, কেস নং ৯

বাস্তবের সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক সমস্যামূলক। উচ্চশিক্ষিত, দীর্ঘকাল উচ্চপদে চাকরি, অকৃতদার। শারীরিক অসুস্থতা ও কয়েকটা অস্ত্রোপচারের ইতিহাস আছে। বেশ কিছুদিন ক্লিনিকের বাসিন্দা। কোনও মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদানের আগ্রহ নেই। গত তিনমাসে বহুর কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করেছি। রোগী হয় নিরুত্তর নয়তো ক্রুদ্ধ। পরিবারের কেউ দেখতে এলে উত্তেজনা, বিরুদ্ধ মনোভাব বেড়ে যায়।

আমি আজকাল একটি বাংলাদেশি নার্স সেজে থাকি। এই ভূমিকাটি রোগীর কাছে যেন গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। তাছাড়া সম্পূর্ণ মিথ্যেও নয়। আমি বাংলাদেশের মেয়ে, আমার কাজ মানসিক রোগ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ। উদ্দেশ্য মানুষের যন্ত্রণার উপশম। গবেষণা শুধু তো ডিগ্রির জন্য নয়। এক অর্থে সেবা।

মনে হয় কথা বলতে রাজি করাতে পেরেছি। ছেলেবেলার স্মৃতি মানসিক রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমিও ভদ্রলোককে নিজের জীবনকাহিনী বলতে উৎসাহ দিই। শৈশব কৈশোরের দিনগুলির জন্য পরিণত বয়সে সাধারণত যে স্মৃতিমেদুরতা থাকে তার লক্ষণ রোগীর মধ্যে দেখি না। এদিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।

সময়চেতনার এমন মারাত্মক ঘাটতি বাস্তবের সঙ্গে যোগস্থাপনে অনীহাই প্রমাণ করে। তবে কথা বলতে ইচ্ছেটা উন্নতির প্রথম সোপান। আত্মপ্রকাশ থেকে আত্মসমীক্ষায় যাওয়া অসম্ভব নয়। হয়তো টুকরো টুকরো খাপছাড়া স্মৃতির একত্র সমাবেশে পরে একটা সামঞ্জস্য বা অর্থ পাওয়া যাবে। মানুষের মন চিররহস্যময়, বিজ্ঞানপ্রদত্ত কেমিক্যাল বা ওষুধ তাকে সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারে না।

অমলের মনের মধ্যে কতকগুলো প্রশ্ন বারেবারে আসে। উত্তর জোটে না। চার্চিল কোথায়। ভুবনেশ্বরে কলকাতার শুভ নাট্যগোষ্ঠীকে আনা গেল না কেন, রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা কী হল। প্রশ্নগুলো খালি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় ঘুরপাক খায়। চার্চিলশুভবি। রবিশুভচার্চিল। শুভচার্চিলরবি। যেন একটা ধাঁধা। তবে চার্চিল যে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল নয় সেটা ঠিক মনে আছে।

–চার্চিল নামে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিল বুঝি? ছায়ার সরল জিজ্ঞাসা।

—সে কি! চার্চিল কে জানো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইংল্যান্ডকে রক্ষা করেছিলেন। চার্চিল না থাকলে আজ পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হত।

—তা যুদ্ধ কি আমাগো সাথে হইছিল?

–উঃ! বাংলাদেশের স্কুলে কি কিছুই পড়ানো হয় না। আমাদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ হবে কী করে! আমরা তো তখন ইংরেজদের অধীন। একটা গরিব পিছিয়ে-পড়া উপনিবেশ। আমাদের অত মুরোদ হবে কোথা থেকে? সে সময়ে পৃথিবী জুড়ে বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। এশিয়া আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া সর্বত্র।

ছায়ার কথাবার্তা ভাবভঙ্গিতে মনে হয় পৃথিবীটা চিরকাল ঠিক এখনকার মতো ছিল। বাংলাদেশ, জগতের সবচেয়ে মার-খাওয়া ভুখণ্ড, ভারত পাকিস্তান ইংরেজ হিন্দু পঞ্জাবি সবাই তাকে শোষণ করেছে, সবাই তার দুশমন। পৃথিবীর শুরু ১৯৪৭ সালে। তার আগে সব শূন্যশূন্য। প্রথম প্রথম অমল চেষ্টা করত বোঝাতে বাংলাদেশ পাকিস্তান সব নিয়ে ছিল ভারতবর্ষ। শুনলেই ছায়ার হাসিহাসি মুখ আর হাসিহাসি থাকেনা। কথাগুলো যেন শুনতেই পায় না। অমল আর ছায়ার মধ্যে কেমন যেন একটা দেওয়াল গজিয়ে ওঠে। তাই এখন আর ইতিহাস-টিতিহাসের সূত্র অমল টানে না। এমনভাবে কথাবার্তা বলে যেন কোনও সময়ে বাংলাদেশ ভারতবর্ষের অংশ ছিল কি ছিল না তাতে কিছু যায় আসে না। নিজেকে মাঝে মাঝে বোঝায় কথাটাতো মিথ্যে নয়। ভারতবর্ষই তো নেই। সে যে দেশের নাগরিক তার নাম ইন্ডিয়া, ব্রিটিশের সৃষ্টি। তাছাড়া সে নিজে তো পাক্কা ঘটি, হান্ড্রেড পারসেন্ট। পশ্চিমবঙ্গে চোদ্দোপুরুষের ভিটে। খাস কলকাতায় তিন পুরুষ। বাবা জ্যাঠারা বর্ধমান বা হাট গোবিন্দপুরের নাম পারতপক্ষে মুখে আনতেন না। তাঁদের কাছে পরিবারের উৎপত্তি ঠাকুরদার কলকাতায় বাস অর্থাৎ ১৯১৩ সাল থেকে। তার আগে কিছু নেই। যেমন ছায়ার কাছে ১৯৪৭-এর আগে বাংলা নেই। অমলের নিজের জন্ম ১৯৪৭ সালের কাছাকাছি, আগের বছরেই, তবু প্রাক্-স্বাধীনতাযুগ শ্রুতি হয়ে তার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে আজও।

৪৭ সালের আগের বাস্তবতার কাছে দোতলার সবচেয়ে ভাল শোওয়ার ঘরটি। সেখানে মধ্যেখানে বিরাট পালঙ্ক। বাংলা সিরিয়ালে ঠিক যেমনটি দেখা যায়, চকচকে পালিশ কালো আবলুস কাঠের। প্যাঁচানো প্যাঁচানো খোদাই করা কাজের পায়াছত্রি। মাথার দিকটা কাঠের জালি, মুকুটের আকৃতি। শক্ত ছোবড়ার তোষক। পরিপাটি টানটান সাদা ধবধবে চাদর। মাঝখানে একটার ওপর একটা সাজানো দুটি শক্ত বালিশ। তাতে আঁট করে পরানো ফ্রিল দেওয়া ধবধবে ওয়াড়। মস্ত মোটা সাদা পাশ বালিশ। খাটের ধারে আটকোনা টেবিল। তার পাশে একটি বড় হেলান দেওয়া নিচু চেয়ার। সেই কালো আবলুস কাঠের। গোল গোল হাতল পায়া। বেতেবোনা পিঠে হেলান দিয়ে পা মেলে বসে ঠাকুরদা বিষ্ণুপদ দাস। পরনে লুঙ্গির মতো করে ধুতি, গায়ে ফতুয়া। দুই ধোপদুরস্ত। হাতে গড়গড়ার নল, মাঝে মাঝে টানছে। অমলের স্মৃতিতে ব্রিটিশ ভারতের রেশ।

তার তখন বয়স কত? বছর ছয়েক বোধহয়। আধ বোজা চোখ খুলে ঠাকুরদা অমলকে বলছেন,

—ওই দেখো, সামনের ছবিটা দেখেছো? সামনের দেওয়ালে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো মস্ত ছবি। ধূসর বাদামি রং বহু পুরনো। এক মেমসাহেব দাঁড়িয়ে। পা পর্যন্ত ঝোলা পোশাক, ভারী মুখ, মাথায় বিলিতি ডিজাইনের মণিমাণিক্যের মুকুট। ঠাকুরদা ভক্তিভরে বলতেন,

–বুঝলে দাদুভাই, ইনি ছিলেন আমাদের আসল মালিক, কুইন ভিক্টোরিয়া। সে সময় ছিল আলাদা। দেশে তখন আইনশৃঙ্খলা ছিল, সভ্যতা ছিল। একজন সাহেব পুলিশ অফিসার কী বলতেন জানো? কলকাতা শহরের রাস্তায় একটি অল্পবয়সি মেয়ে সর্বাঙ্গে গয়না পরে রাত বারোটার সময় একলা হেঁটে গেলেও কেউ তার মাথার চুলটি ছুঁতে পারে না। কারণ ব্রিটিশ এমপায়ার তাকে রক্ষা করছে। এই ছিল আমাদের রাজার জাত। ইস্কুল কলেজে পড়াশোনা হত। একটু পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি। আমরা বাঙালিরা কোথায় না চাকরি করেছি। সেই রেঙ্গুন থেকে কোয়েটা। ম্যাপ দেখেছো? কী বিরাট ক্ষেত্র ছিল আমাদের। ব্যবসাই বা কি কম করেছি? স্যার রাজেনের স্টিলপ্ল্যান্ট থেকে শুরু করে বেঙ্গল কেমিক্যালস, বেঙ্গল পটারিজ, ক্যালকাটা কেমিক্যালস, সেনর্যালে, ডাকব্যাক কত নাম করব? জাহাজের ব্যবসা মাইনিং কি না করেছি আমরা। এই কলকাতা শহরে প্রাসাদের মতো বাড়ি ছিল সব বাঙালিদের। শুধু কলকাতা কেন পশ্চিমেই বা কম কী? এলাহাবাদ-লখনউ, বেনারস, মজঃফরপুর, ভাগলপুর, রাঁচি, জামশেদপুর, মুঙ্গের, দেওঘর সর্বত্র। বৃহৎ বঙ্গ। সেই সময় ছিল আমাদের স্বর্ণযুগ। মেধা আর কর্মক্ষমতা এই দুটি জিনিস সম্বল করে আমরা ছড়িয়ে পড়েছিলাম, সসম্মানে বেঁচেছিলাম। আর এমন হতচ্ছাড়া জাত আমরা যে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। সব ভেঙেচুরে নষ্ট, দেশটা শ্মশান আর নেত্য করছে সব ভূত-প্রেতের দল।

এই সব ভূত-প্রেতের অন্যতম ছিলেন অমলের পূজ্যপাদ পিতৃদেব স্বৰ্গত হরিচরণ দাস বি এ বি এল। বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতির পুরুষানুক্রমিক স্থাপত্যকীর্তির ইতিহাসে তার নিজস্ব অবদান সদর দরজার কোলাপসিবল গেটটি। কারণ গেট দিয়ে ঢুকে প্রথম বাঁদিকের ঘরখানা তারই চেম্বার, কর্মস্থান অর্থাৎ জীবনের কেন্দ্র। ঘরের মাঝখানে একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও গদিআঁটা চেয়ার। সামনে ও পাশে মক্কেলদের জন্য নির্দিষ্ট গোটা কয়েক হাতলওয়ালা চেয়ার, গদিছাড়া। পিছনের দেওয়ালে আয়তক্ষেত্রটি মেঝে থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত আইনের বই ও পুরনো কেরেকর্ডে ঠাসা। পাশে চিলতে ঘরে জুনিয়র মোহন বিশ্বাস ও পি এ কালীবাবু। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা হাতে ও খটাখট টাইপমেশিনে চিঠিপত্র দলিল দস্তাবেজ মুসাবিদাবা চূড়ান্ত চলছে। ওকালতিতে মন্দ পসার ছিলনাহরিচরণ দাস, বি এ বি এল-এর। এমন সময় ধরল স্বদেশি ভূতে। চিত্তরঞ্জন দাশের দৃষ্টান্তেঅনুপ্রাণিত হয়ে ভিড়লেন কংগ্রেসে। অতঃপর পিছনের দেওয়ালে বইপত্রে জমতে লাগল ধুলো। সামনের দেওয়ালে দরজার দুদিকে শোভা পেল দুটি দুটি চারটি ছবি–চিত্তরঞ্জন,সুভাষচন্দ্র, গাঁধী, নেহরু। মাঝখানে অর্থাৎ দরজাব ওপরে টাঙানো হল ফ্রেমে বাঁধাই অমলের দিদির হাতে চটের ওপরে ক্রসস্টিচে লতানো হরফে গেরুয়া সাদা সবুজে ফোঁটানো মন্ত্র একজাতি এক প্রাণ একতা। অমলের সারা শৈশব ওই এক মন্ত্রজপ। কারণ ততদিনে স্বাধীন ইন্ডিয়ায় গদিতে আসীন কংগ্রেসের মাহাত্ম্য বুঝেছেন জ্যাঠা মামা পিসে মেসো সবাই এবং হরিচরণের দুরদৃষ্টি পরিবারের সর্বজনস্বীকৃত। এক জাতি এক প্রাণ একতার গৌরব তার সমস্ত পরিবেশে ব্যাপ্ত। স্কুলে নিজের ও সব-তুতো দাদাদের মার্চড্রিল পাড়ার নেতাজি ব্যায়ামাগারে তাসা পার্টির সঙ্গে সমবেত সঙ্গীত। একতার শিকড় গেড়ে বসে আছে অমলের চেতনার গভীরে। হয়তো বা তার জীবনেও।

সেই জন্যই কি বহু বছর বাদে অমল যখন ভুবনেশ্বরে পোস্টেড এবং আর পাঁচজন স্বল্প মেয়াদের বাঙালি বাসিন্দাদের নিয়ে ক্লাব গড়তে গেল, তার নামকরণের প্রশ্নে ৬ টা নামই মনে এল—একতা? আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল ক্লাবের কার্যনির্বাহী ছোট দলটির সব সদস্যই অমলের মতো পশ্চিমবঙ্গীয়, তিনজন এমনকি উত্তর কলকাতা থেকে। অর্থাৎ বাংলার জাতীয় কংগ্রেসের আদি অকৃত্রিম ভোটব্যাঙ্কের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ একতা ক্লাবের প্রাণ। হয়তো তাই তার জাতীয় চরিত্রটি ঢাক পিটিয়ে জারি। যদিও শহরে তামিল তেলুগু পঞ্জাবি সংগঠন তামিল তেলুগু পাঞ্জাবী নামে যদিও একতার শতকরা নব্ব। সদস্যই বাঙালি তবুও তাকে বাঙালি প্রতিষ্ঠান আখ্যা দেওয়া হল না। রিজিওনাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির সায়েন্টিস্টদিব্যেন্দুমুখার্জির আবার একটু বাংলা বাংলা ভাব আছে। স্ত্রী কাকলি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়টায় তো। ও একটু মিনমিন করে আপত্তি তুলেছিল।

—আমরা প্রবাসী বাঙালিরাই যখন চালাচ্ছি, তখন বাঙালি ক্লাব বলতে ক্ষতি কি।

–খুব ক্ষতি। বাঙালি বাঙালি আর করো কোন মুখে। ও পরিচয়টা আর দিও না, বুঝেছ। ওড়িশা তো প্র্যাকটিক্যালি রুল বাই আই এ এস এবং বেশ কটা বাঙালিও আছে ক্যাডারে। খোদ ভুবনেশ্বরে অন্তত আধডজন। কারও প্রেজে টের পাও? খবরের কাগজে যাদের নাম বেরোয়, টিভি-তে যাদের দেখানো হয় তাদের একজনও কি এই সব প্রেসিডেন্সি কলেজের বাঙালি ভাল ছেলে? না, না ও সব বাঙালি ওড়িয়া পার্শিয়ালিটি-ফিটির কথা বোলো না। অমল বেশ গুছিয়ে বলে যায়।

-এই তো গত বছর অ্যানুয়েল ফাংশানের সুভেনিরের জন্য বিজ্ঞাপন চাইতে গেলাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ওড়িয়া চেয়ারম্যান সুধাংশু মহাজ্ঞি কাছে। দু চারটে কথায় একতার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার। একটা ডেট দিলেন ম্যাটারটা দিয়ে যেতে। সুভেনিরের কপি অফিসে পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে-হাতে চেক। সবসুদ্ধ আধঘণ্টা সময় খরচ। আর ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশনের বাঙালি চেয়ারম্যান ১৫ বি চ্যাটার্জির কাছে যেই গেলাম আধঘণ্টা ধরে ঘ্যান ঘ্যান—অ্যানুয়েল বাজেট কত আছে, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে দেখা করুন, অমুককে বলুন তমুককে ডাকুন। হাজারটা ফাঁকড়া। এই তত তোমাদের প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া বাঙালিদের ছব্বা। এই পড়া আর পরীক্ষা দেওয়াতেই ভাল। কাজেই বেলা অষ্টরম্ভা। নইলে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আজ এই অবস্থা হয়। বাঙালি আই এ এস সব এক-একটি ট্যাড়স।

অতঃপর বিরাট ব্যানারে চিনে হাজার ফুল ফুটুক ছাঁচে একটি নকশা বা লোগো ওপরে একতা একটি সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা। একতার সর্বভারতীয় সদস্য হলেন জনা দুই ওড়িয়া আই এ এস, যাঁদের প্রশাসনের সর্বোচ্চ শিখরে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা, রাজ্যের সবেধন নীলমণি ওড়িয়া শিল্পপতি, একজন অবসরপ্রাপ্ত কেরলি খ্রিস্টান আই পি এস যিনি ওড়িয়া বিয়ে করে ভুবনেশ্বরে স্থিতু।

এঁরা সব একতার উপদেষ্টা। হ্যাঁ, এ দলে দুজন সিনিয়র বাঙালি আই এ এসের নামও আছে, তবে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। সাধারণ সদস্যদের মধ্যে জনা তিনেক স্থানীয় পঞ্জাবি ব্যবসায়ী, জনা দুয়েক অসম, উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত চাকুরে। বাদবাকি সবাই নির্ভেজাল বঙ্গসন্তান, বেশিরভাগই সেই শ্রেণীর যাদের সর্বভারতীয় ডাকনাম বোং বা বং। একতা ক্লাবের তথাকথিত সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের ছকটি দ্বিমুখী। বছরে একবার সর্বভারতীয়অনুষ্ঠান, অর্থাৎ মুম্বই থেকে মোটা দক্ষিণায় আনা গাইয়েদের মুখে জনপ্রিয় হিন্দি ফিল্মের গান, সঙ্গে তাঁদের সমান মোটা দক্ষিণার অর্কেস্ট্রা। অনুষ্ঠানে প্রথমে এক আধটা ক্লাসিকাল নাচ, দক্ষিণ ভারতের কোনও শিল্পীর। তার প্রস্তুতি কয়েক মাস ধরে। খবরের কাগজে নিউজ আইটেম। রাজমহল ছক-এ বিশাল বিশাল ব্যানার, দৈনিক সানটাইমস্, সংবাদ প্রভৃতির সঙ্গে বাড়ি বাড়ি হকারের হাতে হ্যান্ডবিল বিলি। বহুল প্রচারধন্য অনুষ্ঠানটির টিকিট বিক্রি আমজনতাকে। স্থান সাধারণত রবীন্দ্র মণ্ডপ। তেমন অতি বড় মাপের অনুষ্ঠান হলে কটক ইন্ডোর স্টেডিয়াম। এই সব সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকেন মুখ্যমন্ত্রী যার ত্রাণ তহবিলে টিকিট বিক্রি ও সুভেনির প্রকাশের অর্থপ্রদান করা হয়। মঞ্চে আরও দু-চারজন মন্ত্রী। অতিথির সারিতে সপরিবারে উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা। বেশ কিছু আসন পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য নির্দিষ্ট। নইলে ঝামেলার সময় কারও টিকিটি দেখা যাবেনা। ইউনিফর্ম-পরা মানুষ দেখলে তবেই আমাদের আমজনতা সভ্য হয়। এছাড়া পয়লা বৈশাখ, বিজয়া বা সরস্বতী পুজো উপলক্ষে ছোট ছোট অনুষ্ঠান। কলকাতার মাঝারি মাপের শিল্পীদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক। স্থান, স্টেশন স্কোয়ারে হোটেল স্বস্তির ব্যাংকোয়েট রুম বা শহিদনগরে হোটেল মেঘদূত এর কনফারেন্স হল। শুধু নিমন্ত্রিতদের জন্য। অর্থাৎ একতারসদস্য ও বন্ধুবান্ধব। একবার নববর্ষেকলকাতার একটি দল চিত্রাঙ্গদানৃত্যনাট্য করবে। স্টেজ চাই। রবীন্দ্র মণ্ডপ বাজেটে এল না, অতএব, সূচনা ভবন। প্রথমে স্থানীয় একজন সাহিত্যিক ও রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের বক্তৃতা। তারপর সাড়ে সাতটা নাগাদ নৃত্যনাট্য আরম্ভ। আটটা থেকে লোডশেডিং। এয়ারকন্ডিশন করা হলে সরকারি জেনারেটার চলে না। তবু অনুষ্ঠান হল। সেই এক অভিজ্ঞতা পরের বছর রবীন্দ্র মণ্ডপে সন্দীপ ঘোষালের নজরুল গীতি আর. ভি. কুলচারার অর্কেস্ট্রায়। কী ভাবে কত মাথা খেলিয়ে এ সব দুর্দৈব ম্যানেজ করা হয়েছে তা শুধু এই বান্দাই জানে। তবু অমলকুমার দাসের অপ্রতিরোধ্য উৎসাহে ভাটা পড়েনি। প্রত্যেকটি মেগাফাংশনের আগের দিন স্বস্তি বা নিউ কেনিলওয়ার্থ-এ প্রেস কনফারেন্স, চারিদিকে সাংবাদিক। টি ভি ক্যামেরার সামনে সবার মাঝখানে অনুষ্ঠানের আকর্ষণ মুখ্য শিল্পী আর তার পাশে অমল। যেন বিয়ের আসরে বর ও বরকর্তা। তার পরদিন মঞ্চেও তাই। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে চেক তুলে দিচ্ছে অমল, একতার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করছে অমল—হলই বা মুখস্থ করা বক্তৃতা এবং অজস্র ভুলে-ভরা। টিভি ক্যামেরায় ধরা মান্যগণ্যদের আগে পরে পাশে কে? না, অমলকুমার দাস, সভাপতি একতা। গোটা ভুবনেশ্বর দেখছে। দিন ছিল বটে।

একতা ক্লাবের এহেন সংস্কৃতিচর্চা ছাড়াও একটা অন্তরঙ্গ ভূমিকা ছিল—তার ইনার হুইল অর্থাৎকার্যনির্বাহী কমিটি এবং আসল কলকাঠিনাড়া সদস্যদের সামাজিক মেলামেশা। অমল একতার সভাপতি। যদিও সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ সব পদেই লোক বদলে যায় কিন্তু অমল গোজ অন ফর এভার। কারণ সে শুধু সভাপতি নয়, প্রতিষ্ঠাতা। সবচেয়ে বেশি চাঁদা তোলে। স্পনসর জোগাড়ের গুরুদায়িত্বটা তারই স্কন্ধে। এককথায় একতার প্রাণপুরুষ। অতএব, তার বাড়িটা যে একতা ক্লাবের এক্সটেনশন হবে তাতে আশ্চর্য কি। দু-একমাস পরপরই একটা গেট টুগেদার, একসঙ্গে হওয়া। নৈশভোজের বিভিন্ন পদ ও পানীয়ের দায়িত্ব বহন করে তার ঘনিষ্ঠ সদস্যরা সস্ত্রীক। দারুণ জমাটি পার্টি। আচ্ছা হাসি ঠাট্টা গান। মনপ্রাণ খুলে। সবশেষে তাদের একটা বিদঘুঁটে প্রথা পালন—সমস্বরে সঙ্গীত এক জাতি এক প্রাণ একতা।

আর সেই মুহূর্তে চার্চিল জানান দিত তার উপস্থিতি। অমলের জন্মদাতা স্বর্গত হরিচরণ দাস, বি-এ বি-এল-এর কংগ্রেসে যোগদান ছিল একইসঙ্গে ইংরেজ-ভক্ত পিতা ও ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারার সৎ সংকল্প সাধন। তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারীর পোষা কুকুরকে চার্চিল নামকরণ জাতীয়তাবাদী পিতার প্রতি আধুনিক যুগোচিত দ্বৰ্থক আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা। চৌকো থ্যাবড়ামুখো চার্চিল জাতে বুলডগ এবং স্বভাবে ল্যাপড়গ। ব্যাচেলার অমলের সংসারচালক, পার্শ্ববতী রাজ্যের সুদুর মজঃফরপুর জেলা থেকে আগত বীর সিং-এর সযত্ন তত্ত্বাবধানে চার্চিলের খাদ্যাভাস মোটামুটি তার প্রভুরই সম্পূর্ণ অনুগামী। তার সারাদিন শাওয়াবসা চলাফেরা সবই মানবজাতির অনুকরণে। সোফা ছাড়া বসে না। ঠাণ্ডা জল ছাড়া খায় না। মশলা ছাড়া রান্নায় প্রবল বিরাগ। প্রিয় খাদ্য চাঁদা মাছ, সন্দেশ ও পান। তার প্রভুর মতোই তার স্বভাব। অর্থাৎ অতি মিশুকে। ফলে প্রতিটি পার্টিতে সন্ধে থেকে লিভিংরুমের ঠিক মাঝখানটিতে বপুটি স্থাপন করে সামাজিকতায় অতি সক্রিয় চার্চিল। স্মিতমুখে অতিথিদের এর ওর মুখের দিকে তাকায় ল্যাজ নাড়ে এবং তাদের সঙ্গে একই তালে তার পানীয় না হোক খাদ্যের আস্বাদন চলে। প্রথমে তার আচরণ অতি সুসভ্য পরে অতি অসভ্য। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পর্যাপ্ত খাদ্যপানীয়ে আর পাঁচজনের মতো সেও যখন পরিতৃপ্ত, সকলে যখন একমত যে বাঙালির কি হবে না, কলকাতা মনুষ্যবাসের অযোগ্য অতএব, ছাড়ো বাংলা, মেরা ভারত মহান এবং সমবেত কণ্ঠে গান একজাতি একপ্রাণ এক, তখন কিনাহুমদোমুখো জাতে বুলডগ স্বভাবে ল্যাপড়গ চার্চিলের মুখচোখে ফুটে উঠত একটা অসম্ভব কষ্টের ভাব। এবং অচিরে পিছনের ঠ্যাং তুলে সশব্দে বায়ুত্যাগ। ব্যস একজাতি একপ্রাণ একতার ফুলে-ফেঁপে ওঠা বিশাল তেরঙা বেলুনটি ফুটো। পাংচারড। উত্তর কলকাতার কংগ্রেসের স্থায়ী ভোটব্যাঙ্কর প্রতিনিধি মুখুজ্যে বাঁড়ুয্যে ঘোষ বোস কুণ্ডু পাল সবার একযোগে অভিযোগ,

—অমলদা আপনার কুকুরকে সামলান।

–ওকে অত কাজু আর পাকোরা খেতে দিলে কেন?

—প্লেটে ঢেলে সেন আবার একটু বিয়ার দিয়েছিল না?

–কুকুরের পেটে এ সব সহ্য হয় না।

সৌমেন ইতিহাসের ভাল ছাত্র ছিল—এখন যদিও টায়ার বেচে—সে গম্ভীর মুখে বলে,

—একেই বলে ইম্পিরিয়ালিজম। রোয়াব দেখেছেন? মরেও মরে না। রক্তবীজের বংশ। দাদা আপনার চার্চিল কিন্তু ইংরেজদের স্পাই। নির্ঘাৎ। ঠাট্টাতেও পার্টির মেজাজ ফেরে না। সবাই কেমন অপ্রতিভ। মানবেতর একটা সামান্য প্রাণীর অকিঞ্চিৎকর নেহাত জান্তব ক্রিয়াতে ভদ্রসভ্য সমাজের বিশিষ্ট মানুষজন কুপোকাৎ। এ অবস্থায় পার্টির মুড ফেরাতে পারে একমাত্র একজন। কে আবার। বিপত্তারিণী মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী। তাকে ছাড়া অমলের বাড়িতে বা বাইরে কোথাও কোনও অনুষ্ঠান জমায়েত ভাবতেই পারা যেত না। সত্যি কথা বলতে কি তাকে ছাড়া অমলের জীবনেই বা কী ছিল? তার বাড়ির আসবাবপত্র পর্দা বাসনকোসন কেনা থেকে চাকরের ট্রেনিং খাবার মেনু লোক-লৌকিকতা সবেতেই মৈত্রেয়ীর উপস্থিতি। এমনকি তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিস পর্যন্ত মৈত্রেয়ীর হেফাজতে। সেই তো অমলের ঠিকঠিকানা। বাবা-মা দাদা-দিদি দূরে, নিকট রক্তের সম্পর্ক তো কবে শিথিল হয়ে গেছে।

দাঁড়ান দাঁড়ান, একটু খোলসা করেন। ছায়ার চোখেমুখে উৎসাহ উপচে পড়ছে। এতক্ষণে আপনার হিরোইনরে পাইলাম। তা ঠিকভাবে গোড়া থিক্যা বলেন, মৈত্রেয়ী কে, কেমন চেহারা, কোথায় প্রথম দেখা–

–আঃ, অমল বাধা দেয়। আমি কি তোমার জন্য ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি না কি। আমার দ্বারা ওসব হবে না। আরে বাবা আমি তো তোমাদের নামডাকওয়ালা সাহিত্যিক নই। ব্যাঙ্কে চাকরি করেছি সারা জীবন। কাটখোট্টা মানুষ। ওসব রসকষ আমার নেই।

—বারে! এই যে বললেন আপনি ছিলেন সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, আর এখন বলেন আপনার রসকষ নাই।

-ওহো তুমি তো দেখছি আমার কাহিনীর কিছুই বুঝতে পারনি। আমার কাজ ছিল সংগঠন। ছোট-বড়-মাঝারি আর্টিস্ট ভুবনেশ্বর-কটকে এনে ছোট-বড়-মাঝারি ফাংশান অর্গানাইজ করা। সারা ওড়িশাতে আমাদের মতো রেকর্ড কারও নেই জানো। এসবের জন্য টাকা জোগাড়, আর্টিস্টদের খাওয়া-থাকার বন্দোবস্ত, হল-এ সিকিউরিটি, সাউন্ড সিস্টেম দেখা এইসব ছিল আমার কাজ। এটাই তোমাদের ওই কালচারের প্রাণ, বুঝলে?

—আমি কি মানা করসি না কি? চটেন ক্যান। তা আপনার নায়িকাটি কেমন বলবেন তো?

.

আমার নায়িকাটি কেমন। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে শ্যামবর্ণ ভারী একটি মুখ। চোখের কোলে নাকের দু পাশে ঠোঁটের কোণে সামান্য ক্লান্তির ছাপ। শরীরে মাঝ বয়সের ভাঙন। কান ঘেঁষা সযত্নে বিন্যস্ত বিউটি-সেলুনের ছাঁটা চুল। পরনে দামি শাড়ি, বাহারি সেফটি পিনের ফোঁড়ে কাঁধে টানটান। হ্যাঁ, স্মার্ট সন্দেহ নেই। দাপটে চাকরি করে। ঘর-গেরস্থালি এক হাতে সামলায়। পোশকি রান্নায় সাক্ষাৎ দ্রৌপদী। শৌখিন নাটক অভিনয়ে মুখ্য চরিত্র। অর্থাৎ আধুনিক বঙ্গরমণী। দশপ্রহরণধারিণী স্বয়ং শক্তি। অপ্রতিরোধ্য।

আচ্ছা, মৈত্রেয়ীর এই মধ্য গগনের দিফাটা গনগনে রূপটাই আমার মনে সর্বদা ভাসে কেন। আমি তো তাকে দেখেছিলাম তরুণী অবস্থায়। তখন সদ্য অরুণোদয় নয় বটে কিন্তু তখনও ঊষাকাল। স্নিগ্ধ মধুর শান্ত। সে রূপটা কখনওই প্রায় মনে আসে না। অথচ বছর চারেক ধরে সে রূপই তো প্রায় প্রতিদিন চোখের সামনে থাকত। আলাপ-পরিচয়, অচেনা-অজানার দেওয়াল আস্তে আস্তে ভাঙা। দিনের পর দিন একটু দেখা একটু কথা।

কত পরে একটু ছোঁওয়া। কত মাস কত দিনে চার বছর। ভুবনেশ্বরে মৈত্রেয়ী আসত মাসে একবার, থাকত দু-চারদিন। গরমে স্কুলে ছুটিতে সেটা বেড়েবড় জোর সাত-দশদিন। সর্বদা একতার সদস্যরা ঘিরে থাকত। কতটুকু সময়ই বা আমরা একান্ত হতাম। অথচ ভুবনেশ্বরের চেহারাটি আমার আজকের স্মৃতিতে এত সজীব। সময় সত্যি বড় রহস্যময়। আজ আমি মৈত্রেয়ীকে যে চোখে দেখি ভুবনেশ্বরের কি ঠিক সেইভাবে সেই চোখে দেখতাম? মোটেই না। বরং তখন সর্বদা মৈত্রেয়ীর সেই ঊষাকালের রূপটি মনে ভাসত। অতীত কেন যে আমাকে সর্বদা ধাওয়া করে। বর্তমানকে নিয়ে থাকতে পারি না কেন। সময়ের তফাতে মানুষ যে পালটে যায় সেটা মেনে নেওয়া শক্ত বলে কি? হায় সময়, তোমার মতো একচ্ছত্র ক্ষমতা কার? তুমি একাধারে হিটলার-মুসোলিনী-স্ট্যালিন। হয়-কেনয়, সাদাকে কালো করতে তুমি ওস্তাদ। তোমার দৌলতে আজ মৈত্রেয়ী শুধু অতীতের।

না, মৈত্রেয়ী মৃত নয়। এটা বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতিগড়ার কেস হয়নি। শুধুবর্তমানের মৈত্রেয়ীকে আমি মনে করতে পারি না। হয়তো মনে করতে চাই না। স্মৃতিটুকু থাক। যা দূরে সরে গেছে, যা নাগালের বাইরে যা কোনদিন কোনও কিছুর বিনিময়েই আর ফিরে আসবে না সেই অতীতই কেবল সুখময়। যে স্বর্গ হারিয়ে গেছে তাই একমাত্র স্বর্গ।

-আপনি যখন হিরোইন সম্বন্ধে কিছুই মনে করতে পারেন না তাহলে সেই পার্টির কথাই চলুক। ছায়া দেবনাথ মেয়েটা অতি চালাক। যে জানে কতটুকু জেদ করতে হয়। অগত্যা অমল ফিরে আসে কাহিনীর বর্তমানে। নট থেকে কথকের ভূমিকায়।

একতা ক্লাবের পার্টি-টাটির এমন বেহাল অবস্থায় সামাল দিত মৈত্রেয়ী। খুব জমাটি মেয়ে তো। হয়তো ফট করে একটা ইংরিজি ছড়া ধরল। বাচ্চাদের ছড়া। ওতো বাচ্চাদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। ছড়া-টড়া প্রচুর জানত।

—কী ছড়া কী ছড়া? বলেন দেখি শিইখ্যা লই।

–আরে এমন আহামরি কোনও ছড়া নয়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সব বাচ্চাই জানে।

–বলেনই না।

–জ্যাক অ্যান্ড জিল/ওয়েন্ট আপ দ্য হিল/টু ফেচ আ পেইল অফ ওয়াটার/জ্যাক ফেল ডাউন/অ্যান্ড ব্রোক হিজ ক্রাউন/অ্যান্ড জিল কেম টাম্বলিং আফটার।

—তা এ ছড়াতে মজার কী আসে। দুইটা পোলাপান মানে ছেলেমেয়ে পাহাড়ে চড়ছিল এক বালতি জল আনতে, ছেলেটা পড়ে মাথা ফাটালো, মেয়েটাও পিছন পিছন গড়িয়ে গেল—এই তো? এই সব ছড়া শিখবার জন্য ক্যান যে মাইনসে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে কে জানে।

-তুমি একেবারে বাঙাল। ব্যাপারটাই বুঝছ না। আরে মানে-ফানে দিয়ে কী হবে। মজা হচ্ছে ছড়াটাকে নিয়ে যা করা হল। প্রথমে মৈত্রেয়ী হাতমুখ নেড়ে বাচ্চাদের মতো আধো-আধো উচ্চারণে আবৃত্তি করল। তারপরে বিভিন্ন প্রদেশের মার্কামারা সুরে ভঙ্গিতে ফেলে গাইল। যেমন বাংলা কীর্তন, জ্যাক রে..। তারপর ভোজপুরী, আরে হো জ্যাক হো। কাটকি, জ্যাকম জিলম। হাতে তালি মেরে পঞ্জাবি কাওয়ালি। সকলে ওর সঙ্গে সুর মেলালো। হারীন আর কেতকী যাদের আমরা হ্যারি আর কিটি বলতাম, ওরা স্বামী-স্ত্রী জ্যাক এ রে এ… বলে এমন টান দিত যে বাঘা বাঘা কীর্তনীয়াও হার মেনে যায়। তখন লোকে না হেসে পারে। পার্টি এত জমল যে মাঝরাত পার। পরদিন বাড়িওয়ালার মুখ ভার। ব্যাটা ক্যারা তো, মানে ওড়িশাতে স্থায়ী বাসিন্দা বাঙালি। একটি চিজ। ভূতভূতে, সবসময় ভয়ে সিঁটিয়ে আছে হাঁটতে ভয়, চলতে ভয়, খেতে ভয়। অসম্ভব কনজারভেটিভ, হচিকাসি-টিকটিকি মানে, পাঁজিনা দেখে সকালে বিছানা থেকে ওঠেনা। ভদ্রলোক আমাকে ধরে বললেন,

—আচ্ছা অমলবাবু আপনি গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়ার একটা প্রেস্টিজিয়াস ব্যাঙ্কে সিনিয়র পজিসনে আছেন। আবার একটা সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। আপনার বাড়িতে এরকম রাত কাবার করে হল্লা কি ভাল দেখায়? পাড়াপ্রতিবেশী কী ভাবে বলুন তো? এই বাঙালি কালচারের নমুনা?

-দেখুন নগেনবাবু, আমরা কটি বাঙালি পরিবার দেশের বাইরে থাকি। মাঝে মাঝে একসঙ্গে হয়ে একটু খাওয়াদাওয়া গানটান করি। তাতে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় বলুন তো? তাছাড়া আমরা তো বাঙালি জাতির প্রতিভূনই যে সবসময় মেপে চলতে হবে। বাঙালিয়ানা ঠিকমতো বাইরের লোকের চোখে দেখানো হচ্ছে কি না। আমরা নেহাত সাদামাঠা মানুষ। তবে কারও পাকা ধানে মই দিই না। দোষের মধ্যে একটু মদটদ খাই। জানেন তো মাতালরা দরাজ দিল? ভদ্রলোকের মুখ আরও কঠিন হয়।

– সেইটাই তো মুশকিল। আবার লেডিজও থাকেন। আমি বলছি না সেটা খারাপ কিছু। সবাই নিজের পরিবার নিয়েই আসেন। কিন্তু স্ত্রী-পুরুষ মিলে এমন হল্লা, মদ খাওয়া এগুলো ঠিক আমাদের কালচারে….

—আরে রাখুন মশায় আপনাদের কালচার।

–এটা কিন্তু অমলবাবু ঠিক সঙ্গত হল না। ব্যাজার মুখে নগেন পালিত দোতলায় উঠে গেল। ন্যাকা আর কি। তুমি কে সঙ্গত অসঙ্গত বিচার করবার? তোমার নিজের দাদা তো স্ত্রী ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতে ষাটের ওপর বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। সেটা খুব সঙ্গত না? শালা ক্যারা। ঠিকই করেছে ওড়িয়ারা তোমাদের ক্যারা নাম দিয়ে। বাড়িটা ভাড়া দিয়েছ তো বাজারের রেট থেকে বহু বেশিতে। তখন তো কত তেলানো রোজ অফিসে এসে বলতে স্যার, বাঙালিকে বাঙালি না দেখলে কে দেখবে। তারপরের পার্টিতে তিন রাউন্ড ড্রিংকের পর চেঁচিয়ে সবাই মিলে বলতে লাগল। ভারি অসঙ্গত হেলা,বুঝিলে ভারি অসঙ্গত হেলা। শেষে মৈত্রেয়ীর ধমকে চুপ। ওকে অত ইম্পর্টেন্স দিচ্ছ কেন। ব্যাপারটা কি ফাজলামি ফোককুড়ির পর্যায়ে রয়ে গেল নাকি শেষে বহুদূর বিস্তৃত হল তার ফলাফল? অমলের বরাবর সন্দেহ এই নগেন পালিত, রিটায়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অফ সেলস ট্যাক্স তার বিরুদ্ধে বম্বে হেড অফিসে অভিযোগের মূলে। ব্যাটা নিজে দুপয়সা করেছে। ঘাঁৎঘোঁত সব জানা। ভুবনেশ্বর অফিসে মাসে মাসে ভাড়ার চেক আনার ছুতোয় যাতায়াত ছিল। অফিসের স্টাফ তো সবই স্থানীয়, আর ক্যারাদের তো এদের সঙ্গেই ভাব-ভালবাসা। সবসময় ঘোঁট পাকানো অভ্যেস। না, প্রমাণ কিছু নেই নগেন পালিতের জন্যই তার চাকরি জীবনের এক সন্ধিক্ষণে এত বড় একটা ধাক্কা এসেছিল। তার বাদবাকি কেরিয়ার, পোমোশন

—আপনি কোথা থেকে কোথায় আইস্যা গ্যালেন। বাপ-ঠাকুরদার কথা শ্যাষ হইল। নায়িকাটা তো দরকচা মাইর্যা রইল। এদিকে আপনি চাকরি-বাকরির কথায় চইল্যা আসলেন। চাকরির কথা পরে হইব। আসল গল্পের কী হইল? প্র্যামের কথা না হইলে আর কাহিনী কী?

–উঃ ছায়া। ওই মাইরা চইল্যা এ্যাম কি চলে নাকি! একটু ভদ্র বাংলা বলল।

–খুব চলে। তবু তো বাংলা বলি। আপনাগো ভারতীয় বাংলা তো আই লাভিউ ইলু ইলু। তাই যদি সোনামুখ কইর‍্যা শোনেন তা হইলে এ্যাম কী দোষ করল? বলেন তারপর কী হইল।

—আবার তারপর কী হল। না, তোমার ওই ধারাবাহিকের জুলুম চলবে না। শুনতে হয় তো তার আগে কী হয়েছিল শোনো।

ঠাকুরদা বিষ্ণুপদ দাসের সংসারে প্রয়োজনবোধে জন্মতিথি মানা হত। কনিষ্ঠ পুত্র হরিচরণের কনিষ্ঠ পুত্র অমলের আবির্ভাবের পর থেকে জন্মদিন চালু। কারণ সে জন্মাল ১৮ই আগস্ট ১৯৪৬, দাঙ্গার মধ্যে। দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। যখন কলকাতা শহর জুড়ে বন্দেমাতরম্ আল্লাহহাআকবর বোমা আগুন আর্তনাদ। সেই ডামাডোলের মাঝখানে বেআক্কেলে মাঝবয়সী ছোট বউ সময়ের দুহপ্তা আগে প্রসববেদনা উঠিয়ে বসলেন। বৃদ্ধ কর্তা থেকে প্রায় প্রবীণ স্বামী, সব পুরুষবীরদের হাত-পা পেটের ভেতরে। ভাগ্যে অমলের মা সুধাময়ী আগের দিনের অভিজ্ঞতায় দুরস্ত ছিলেন এবং মাঝের দুটির বেলা ডাক্তার হাসপাতাল ইত্যাদি আধুনিক বিজ্ঞানলব্ধ সুব্যবস্থা এবং স্বাচ্ছন্দ্যে বিগড়ে যাননি। আরও ভাগ্য সে সময় বাড়িতে উপস্থিত অমলের ডাকসাইটে বহুপ্রসবিনী বড় পিসি। আঁতুড় সামলাতে তার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দুই-ই প্রচুর। পিত্রালয়ের ঠুটো পুরুষবীরদের প্রতি বাক্যবাণসহ কোমরে আঁচল জড়ালেন।

–বলিহারি বুদ্ধি-বিবেচনা তোমাদের। বলি তোমাদের সুবিধা-অসুবিধা মেনে কি পেটের ছেলে জন্ম নেবে। তোমাদের সকলের ওপরে যিনি, তার ইচ্ছেয় সে আসবে।

সকলের ওপরে যিনি তার ইচ্ছের বহর নিরাপদ নির্ঞ্ঝাট প্রসবের বেশি কিছু বলে মনে হল না। জন্মদিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সত্ত্বেও আমাদের নায়কটির নায়কোচিত কোনও গুণ দেখা যায়নি। হ্যাঁ, তার নামকরণটির একটা তাৎপর্য ছিল। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কালিমা যেন তার এই সন্তানটিকে কখনও মলিন না করে এই প্রার্থনায় একজাতি একপ্রাণ একতায় দৃঢ় বিশ্বাসী হরিচরণ দাস, বি এ বি এল নাম রাখলেন অমল। পিতার দেশভক্তি, ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে জন্ম নামকরণের মর্ম কোনও কিছুই অমলকে অসাধারণত্ব প্রদান করেনি। অমল সব দিক দিয়েই একেবারে সাধারণ। তার বাল্যকালে দুরন্তপনার কোনও মজাদার ঘটনা নেই। কৈশোরে দেখা যায়নি কোনও প্রতিভার পূর্বাভাস। অন্যান্য বাঙালি নায়কদের মতো তার রাজনীতিতে রুচি নেই, ইডিওলজি নিয়ে নেই মাথাব্যথা রোমান্টিকতার ধার ধারে না। সিনেমার হিরোদের মতো কোনদিন বেকার প্রেমিক হয়নি। তার শিক্ষাদীক্ষাও গতানুগতিক পথে। প্রথমে পাড়ার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বিদ্যালয়ে। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে দিশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের হুজুগে গজিয়ে-ওঠা একটি হাইস্কুল যার গভর্নিং বডিতে হরিচরণ দাস বি এ বি এল-এর সর্বদা উপস্থিতি। বাড়ির সব ছেলেদের হাতেখড়ি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রে। সারাটা স্কুলজীবন অমলের কেটেছে কোনও বিশেষ তাৎপর্য ছাড়া। পড়াশোনা খেলাধুলো ডাকটিকিট জমানো কোনও কিছুতেই অমলের তেমন বিশেষ উৎসাহ ছিল না। দাদারা এসব করেছে, তাই যেন সেও করতে বাধ্য। ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রশ্ন নিরর্থক।

কোনও বিশেষ বিষয়ে বা ক্ষেত্রে উৎসাহ না থাকলেও অমলের আতঙ্কের চেহারাটা ছিল সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইংরিজি। যেমন গম্ভীর তেমনি কড়া ইংরিজির ভূপেন স্যার। নেসফিল্ডের গ্রামার তার ভগবদ্গীতা। অজস্র এবং প্রায়শই অযৌক্তিক নিয়ম সুত্র মুখস্থ করা ও সেগুলির যথাযথ প্রয়োগ অমলের কাছে যেন এভারেস্টআরোহণ। চেষ্টা করাও অনর্থক কারণ ট্রানস্লেশনে সাবস্টেন্সে তার হাতে ক্লাসের ফার্স্টবয় সুবিনয়ও পাঁচ সাড়ে পাঁচের বেশি রাখতে পারে না। কতকাল পরে সেই সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা। বাই চান্স। ওকালতিতে ভাল পসারও করেছে। কোণার্ক সিমেন্টের রিটেইনার। কটকে কাজে এসেছিল। উঠেছিল ভুবনেশ্বরে আই টি ডি সির হোটেল কলিঙ্গ অশোকে। কফি শপে দেখা। অমলকে সেখানে এক পার্টি খাওয়াচ্ছিল।

—আরে অমল না?

–সুবিনয়! বেশি বদলাসনি।

–তুই কিন্তু বেশ ভুঁড়ি বাগিয়ে ফেলেছিস।

–বাগাবো না। ব্যাংকার বলে কথা। তা কেমন আছিস বল। এখানে কী করছিস? কথার ফাঁকে সুবিনয় বলে–

–মনে আছে ভূপেন স্যারের কথা? ট্রানস্লেশনের খাতাটা খুলে সেই আধখানা চাঁদ চশমার কাঁচের মধ্যে দিয়ে একদৃষ্টে তাকানো আর হাঁক—এই যে অমলা এদিকে আয়। এটা কী লিখেছিস? ইংরিজি না উড়ে? হা হা হা।

—চুপ চুপ। এখানে ও শব্দটি উচ্চারণ কোরো না। আমরা বাঙালিরা বড় অন্যায়ভাবে অন্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি। আমি কিন্তু এদের কাছ থেকে খুব কো-অপারেশন পাই। কলকাতার চেয়ে ঢের ভাল আছি এখানে।

—আরে ধৎ তুইও যেমন। ওরকম সেন্সে নিচ্ছিস কেন। ভূপেন স্যারেরা ছিলেন প্রি-প্যারোকিয়ালিজম যুগের মানুষ। তখন লোকে অত তোয়াক্কা করে কথাটথা বলত না। দে ডিন্ট মীন এনিথিং।

তা অবশ্য ঠিক। তারা কিছু ভেবে কথা বলতেন না। ছিলেন তো নেহাত সাধারণ বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্ত। তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোক অর্থাৎ পড়াশোনার বুনিয়াদ পাকা। তাই বোধহয় যাদের তেমন পড়াশোনা করতে দেখতেন না তাদের প্রতি অবজ্ঞা। হাজার বছরের ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিজীবীর অহঙ্কার বাঙালি উচ্চবর্ণের মজ্জায় মজ্জায়। বাংলার বুড়ো দুঃখহরণবাবু কম বিধিয়ে বিঁধিয়ে কথা শুনিয়েছেন অমলকে, ব্যাটার বাংলা শোনো। একটা যুক্তাক্ষর ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। প্রশান্তকে বলে পোসান্তো। প্রতিকার কে পোতিকার আর শস-ষ তো ছাড়। আরে বাপু দু-তিন পুরুষে আর কত ওঠা যায়। চাষার জিভে কি আর বাংলা হবে। তিনি জাতে ব্রাহ্মণ, সংস্কৃত শব্দগুলি তার অনায়াস আয়ত্ত, বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণ তার জিভ অনুযায়ী। অতএব জাত তুলে খোঁটা দিতে বাধত না। যদিও সে সময় অমলের বাবা হরিচরণ দাস বি এ বি এল স্কুলের গভর্নিং বডির মেম্বার কংগ্রেসের স্থানীয় চাই মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে লড়েন।

তাই তো অঙ্ক আর বিজ্ঞানে অমলের আদা জল খেয়ে লাগা যাতে ভবিষ্যতে ইংরিজি বাংলার বিশেষ ধার ধারতে না হয়। মেজো জ্যাঠার রাখা মাস্টার দাদাদের খবরদারি তার ওপরে সংরক্ষণের সুবিধা সব মিলে বহু চেষ্টায় একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নাম লেখানো। ব্যস আরেক পুরুষ বাঙালি ভদ্রলোক।

—আরে, ব্যস আপনি ইঞ্জিনিয়ার নাকি! এই না শুনছিলাম ব্যাংকে কাজ করতেন? ছায়া দেবনাথ কাহিনীর মাঝখানে ঢুকে পড়ে।

—হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ। তবে আমি তো সাধারণ ব্যাঙ্কে ছিলাম না। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে নতুন ইন্ডাস্ট্রি প্রোমোট করার জন্য টাকা জোগানো ছিল সে ব্যাঙ্কের কাজ। আর নতুন ইন্ডাস্ট্রি মানেই তোকলকারখানা বসানো। তাই সরকারের মনে হল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে ভাল। পাবলিক সেক্টর তো তাই একটু অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণা।

—আর হিসাবপত্র? ব্যাঙ্ক মানে তো টাকার হিসাব তাইনা? কাকে টাকা দেবেন, কাকে দেবেন না, দিলে কত দেবেন, এসব আপনার কাজ না?

–মেয়েটা বাঙাল হলে কী হবে বুদ্ধি আছে।

–সে তো বটেই। সরকারের সব গাইডলাইন দেওয়া থাকে কোন ইন্ডাস্ট্রি কতটা প্রায়রিটি পাবে। কোন রাজ্যে বেশি বিনিয়োগ করা উচিত। এছাড়া টাকা চাইলেই তো দেওয়া যায় না। প্রজেক্ট প্ল্যান চাই। সেটা আমার অফিস থেকে একজামিন করে তারপর রেকমেন্ড করা। হেড অফিসে পাঠাই। ডিসিশন সেখানে।

এসবে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যেটা কতটুকু লেগেছে। সত্যি ব্যাঙ্কে কাজ করার ফলে আমার ডিগ্রিটা শুধু কাগজেই রয়ে গেল। হাতে-কলমে কিছুই কাজে এল না।

আমাদের দেশে কজন পুরুষ যে বিদ্যাটা শেখে তা কর্মক্ষেত্রে বাস্তবে লাগায়। অথচ দোষ দিই মেয়েদের, বিএ-এমএ পাশ করে মা-ঠাকুমার মতো ঘরকন্না নিয়ে আছে। পড়াশোনা কোনও কাজে লাগে না। অদ্ভুত। বলি তাদের স্বামীদের পড়াশোনা কোন কাজে লেগেছে? আসলে প্রাচীন মেধা আধ্যাত্মিকতা ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে মুখে বড়াই করি এদিকে মনে মনে সমস্ত উদ্যমের সমস্ত শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থোপার্জন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *