২. কী যে হবে দেশের

কী যে হবে দেশের কিছু জানি না। বিদেশের চর এসে ভরে গেছে পুরো দেশটা।

স্ত্রীর সঙ্গে বহুদিন পরে আজ কথা বলতে বসলেন মকবুল আহমদ।

বাংলা বাংলা করে চিৎকার করছে ওরা। বাংলা কি মুসলমানের ভাষা নাকি? ওটাতো হিন্দুদের ভাষা। হিন্দুরা এ দেশটাকে জাহান্নামে নেবে।

কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন বিলকিস বানু।

কোথায় উর্দু আর কোথায় বাংলা! উর্দু হচ্ছে খানদানি ভাষা। আমাদের ফ্যামেলিতে বাবা মা সবাই উর্দুতে কথা বলেন।

 

উর্দু-বাংলা আমি কিছু বুঝি না। আমার সোজা কথা তোমার ছেলেকে সাবধান করে দাও। ও যদি আবার সভা-সমিতি আর আন্দোলন করে তাহলে এদ্দিন প্রমোশন বন্ধ হয়ে ছিলো, এবার আমার চাকরিটাই যাবে। তসলিমের পুলিশ-বাবা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।

মা-ও শিউরে উঠলেন।

অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে পানি এসে গেলো তার।

তুই কেমন নিষ্ঠুর ছেলেরে!

তসলিমকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন তিনি।

তোর বাবা-মা ভাই-বোনগুলোর কথা ভেবেও কি তুই ওসব ক্ষান্ত দিতে পারিস না?

চাকরিটা চলে গেলে আমরা খাবো কী?

তসলিম নিচুপ।

সালমা বললো—

খালুজান কদিন ধরে আপনার চিন্তায় খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। এসব কাজ না করলেই–তে পারেন। কী হবে এসব করে?

সালমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো তসলিম। এর মধ্যে সালমাকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো তার। কিন্তু কিছুই বললো না। শুধু বললো–তুমি ওসব বুঝবে না।

 

সদরঘাটে যেখানে অনেকগুলো খেয়ানৌকা ভিড় করে থাকে তার কাছাকাছি একটা ইট টেনে নিয়ে বসে পড়লো গফুর।

খিদে পেয়েছে। খাবে।

পুঁটলিটা ধীরেধীরে খুললো সে।

শহরের লোকজনদের সে বলতে শুনেছে-কাল নাকি হরতাল।

শহরের সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ থাকবে।

গাড়িঘোড়া চলবে না।

হরতাল কী গফুর বোঝে না।

পিঠা খেতে-খেতে সে নানাভাবে হরতালের একটা অবয়ব চিন্তা করতে লাগলো। কিন্তু হরতালের কোনো সঠিক চেহারা নির্ণয় করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।

সে ভাবলো, এটা হয়তো শহরেরই বিশেষ একটা রীতি কিম্বা নীতি। মাঝে মাঝে শহরের। মানুষেরা এ-রকম হরতাল পালন করে থাকে।

উঠে গিয়ে দু-হাতে বুড়িগঙ্গার পানি তুলে নিয়ে পান করলো গফুর। গামছায় মুখ হাত মুছলো। তারপর ট্র্যাক থেকে রুমালটা বের করে টাকাগুলো গুণে গুণে বারকয়েক দেখলো সে।

কাল দোকান-পাট বন্ধ থাকবে।

কেনাকাটা আজকেই শেষ করতে হবে।

মুহূর্তে আমেনীর মুখ মনে পড়লো তার।

কী করছে আমেনা এখন।

হয়তো পুকুরঘাটে পানি নিতে এসেছে।

কি ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে।

অথবা কচুবনে ঘুরে কচুশাক তুলছে।

সাতদিন পর বিয়ে।

ভাবতে বড় ভালো লাগলো গফুরের।

সহসা বিকট একটা আওয়াজ শুনে চমকে তাকালো গফুর।

দেখলো কয়েকটি ছেলে মুখে চোঙা লাগিয়ে চিৎকার করে বলছে—

কাল হরতাল।

আমাদের মুখের ভাষাকে ওরা জোর করে কেড়ে নিতে চায়।

আমাদের প্রাণের ভাষাকে ওরা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমরা মাথা নোয়াবো না।

আমরা আমাদের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবো না।

আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

আর সে দাবিতে কাল হরতাল।

সবাই হরতাল পালন করুন।

গফুর অবাক হয়ে শুনলো।

সে ভালো কাউকে জিজ্ঞেস করবে ব্যাপারটা কী! কিন্তু সাহস পেলো না।

অদূরে একটা লোক তাসের খেলা দেখাচ্ছিলো।

নানারকম খেলা।

আজগুবি খেলা।

গফুর ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে খেলা দেখতে লাগলো।

 

কিসের হরতাল?

আমি হরতাল মানি না।

রিকশার ব্রেকটা খারাপ হয়ে গেছে। সেটা ঠিক করতেকরতে আপনমনে গজগজ করে উঠলো সেলিম।

রিকশা না চালালে আমি রোজগার করবো কোত্থেকে?

আমি খাব কী?

আমার বউ খাবে কী?

আমার ছেলে খাবে কী?

ওসব হরতালের মধ্যে আমি নেই।

ব্রেকটা ঠিক করে সবে রিকশাটা নিয়ে সামনে এগুতে যাবে সে—এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকলো—

ভাড়া যাবে?

সেলিম দেখলো একটা ছেলে।

বোধহয় ছাত্র।

হাতে বই।

বগলে একগাদা কাগজ।

কোথায় যাবেন স্যার?

ইউনিভার্সিটি।

ওঠেন।

তসলিম রিকশায় উঠে বসতেই সেলিম প্রশ্ন করলো—

আপনারা কালকে হরতাল করছেন কেন? রিকশা না চালালে আমরা রুজি-রোজগার করবো কেমন করে? হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবো নাকি?

মুহূর্তে-কয়েক সময় নিলো তসলিম। তারপর ধীরেধীরে বললো—

আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আর ওরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তাহলে বাংলাভাষা এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। তোমাকে আমাকে আমাদের সবাইকে উর্দুতে কথা বলতে হবে।

উর্দু আমি কিছুকিছু জানি।

সেলিম বিজ্ঞের মতো বললো—

কিন্তু আমার বউ উর্দু একেবারে বোঝে না। ও মুন্সিগঞ্জের মেয়ে কিনা তাই। তবে ছেলেকে আমি উর্দু-বাংলা দুটোই শেখাচ্ছি।

তসলিম বললো—

উর্দুর সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা উর্দু-বাংলা দুটোকেই সমানভাবে চাই।

কিন্তু হরতাল করছেন কেন?

হরতালের মাধ্যমে আমরা বিক্ষোভ জানাতে চাই। আমাদের প্রতিবাদ জানাতে চাই।

অ।

কিছু না বুঝলেও বারকয়েক ঘাড় দোলালো সেলিম।

 

সরকারের চাকুরি করি বলে কি আমরা আমাদের মতামতটাও বন্ধক দিয়ে দিয়েছি নাকি?

আমরা কি ওদের ক্রীতদাস যে, কথামতো আমাদের চলতে হবে?

চেয়ারে বসে ছটফট করতে লাগলেন কবি আনোয়ার হোসেন।

বড়কর্তার হুকুম এসেছে। কাল সবাইকে সময়মতো অফিসে হাজির হতে হবে। হরতাল করা চলবে না। যে হাজির হবে না তাকে সাসপেন্ড করা হবে। কেন? আমাদের ও ভাষাটাকে তোমরা জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে? আর আমরা চুপ করে বসে থাকবো? কুকুর-বেড়ালেরও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। দেখি ওদের মুখ বন্ধ করে দাও তো! ২ তোমাদের ছেড়ে দেবে? কামড়ে-আঁচড়ে গায়ের রক্ত বের করে দেবে না? ওসব হুকুম। আমি মানিনা। যদি চাকরি যায় যাবে। মুটেগিরি করবো। দরকার হলে রাস্তায় খবরের কাগজ বিক্রি করবো। কিন্তু আমাকে তোমরা ক্রীতদাস বানিয়ে দেবে সেটা চলবে না। রাগে গজগজ করতে লাগলেন কবি আনোয়ার হোসেন।

ব্যস কাল হরতাল। আমি অফিসে যাবো মা যা হয় হোক।

হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের এককোণে রেখে দিলেন তিনি।

 

ওসব হরতালের হুমকিতে মাথা নোয়ালে দেশ চলবে না। হরতাল বন্ধ করতে হবে।

সভা-সমিতি ভেঙে দিতে হবে। রাস্তায় মিছিল করা বেআইনি ঘোষণা করতে হবে।

তবে ঠাণ্ডা হবে ওরা।

আমলাদের সামনে লম্বা ভাষণ দিলেন মকবুল আহমদ।

মন্ত্রীরা ছুটোছুটি করছে।

একমুহূর্তের বিশ্রাম নেই।

নেতারা তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠেছেন।

আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলছেন।

যে করেই হোক হরতাল বন্ধ করতে হবে।

রাস্তায় মিছিল বের করা বে-আইনি করতে হবে।

পাড়ার মাতব্বরদের ডাকা হয়েছে।

তাদের সঙ্গে পরামর্শ চলছে।

যত লোক লাগে আমরা দেবো।

যত টাকা লাগে আমরা যোগাবো।

পুলিশের প্রয়োজন হলে পুলিশ দেবো

সব কিছুই পাবেন আপনারা।

হরতলি বন্ধ করতে হবে।

মিছিল বন্ধ করতে হবে।

মাতব্বররা ঘাড় নোয়ালেন।

নামাজের সেজদা দেবার মতো।

 

কতগুলো উদ্ধত মুখ।

ঋজু।

কঠিন।

একসঙ্গে চিঙ্কার করে উঠলো।

না।

আমরা মানি না।

সরকার একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে আমাদের মুখ বন্ধ করে দেবে। প্রতিবাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে আমাদের। সে অন্যায় আমরা মাথা পেতে নেবো না।

আইন দিয়ে ওরা আমাদের শৃঙ্খলিত করতে চায়। সে শৃংখলি আমরা ভেঙে চুরমার করে দেবো।

আমরা গরু ছাগল ভেড়া নই যে, প্রয়োজনবোধে খোয়াড়ের মধ্যে বন্ধ করে রাখবে।

তর্ক-বিতর্ক চললো অনেক অনেকক্ষণ ধরে।

আলোচনার ঝড় উঠলো।

কেউ বললো–

এ আইন অমান্য করা ঠিক হবে না।

কেউ বললো—

এ আইন শোষণের আইন। এ আইন আমরা মানি না।

বুড়োরাত বাড়তে লাগলো ধীরেধীরে।

কাল কী হবে কেউ জানে না।

রাস্তায় পুলিশ নেমেছে। পুলিশের গাড়ি ইতস্তত ছুটোছুটি করেছে।

পথ-ঘাটগুলো জনশূন্য।

 

একটা খালি রক পেয়ে তার উপরে গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো গফুর।

দুটো শাড়ি কিনেছে সে।

একশিশি আলতা।

কিছু চুড়ি।

একটা নাকফুল।

সেগুলো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নানা কথা ভাবতে লাগলো সে।

আমেনার কথা।

বিয়ের পর কেমন করে সংসার করবে সে কথা।

আর কোনোদিন যদি ছেলেপুলে হয় তার কথা।

ইচ্ছে করলে সে আজ গ্রামে ফিরে যেতে পারতো। কিন্তু যায়নি। কারণ, সে হরতাল দেখবে।

হয়তো কোনোদিন আর শহরে আসা নাও হতে পারে। তাই হরতাল সে দেখে যাবে।

দু-একটা কেনাকাটাও বাকি রয়ে গেছে।

একটা লাল লুঙি কিনবে ভেবেছিলো সে।

কয়েক দোকানে ঘোরাঘুরিও করেছিলো।

কিন্তু ওরা বড় চড়া দাম চায়।

তাই গফুর ভাবলো, যদি কম দামে পাওয়া যায়। আর যদি দু-একটা দোকান-পাট খোলা থাকে তাহলে সে কিনবে সেটা।

লাল লুঙি আমেনা ভীষণ পছন্দ করে।

শুয়ে শুয়ে গফুর দেখলো দুটো পুলিশের গাড়ি ছুটে চলে গেলো রাস্তা দিয়ে।

গফুর চোখ বন্ধ করলো।

 

কবি আনোয়ার হোসেন উত্তেজিতভাবে ঘরের ভেতরে পায়চারি করলেন অনেকক্ষণ ধরে।

সালেহা ডাকলো—

কই, শোবে না?

না।

শান্ত গলায় জবাব দিলেন কবি—

জানো সালেহা, আজ বহুদিন পর আমার কী মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে, আমার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেলো। আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। কবিতা লিখতাম। কবিতা ছিল আমার স্বপ্ন। আমার সাধনা। ভেবেছিলাম সারাটা জীবন আমি কবিতা লিখেই কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমি—সেই আমি–দেখ আজ লেজার লিখতে লিখতে ক্লান্ত।

সালেহা সহানুভূতির সঙ্গে তাকালো তার দিকে।

লেখো না কেন? মাঝে মাঝে লিখলেই তো পারো। তুমি তো কবিতা লিখেই আমাকে পাগল করেছিলে, মনে নেই!

কথা শুনে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলেন কবি আনোয়ার হোসেন।

মনে আছে সালেহা। মনে থাকবে না কেন? শুধু কী জানো! আমার সেই মনটা নেই, যে মন নিয়ে একদিন আমি কবিতা লিখতাম। আমার সেই মনটা না, লেজারের চাপে দুমড়ে গেছে। মরে গেছে।

এসো এখন শুয়ে পড়ো।

সালেহা ডাকলো।

না।

আবার বললেন আনোয়ার হোসেন।

তার সারা মুখে কী এক অস্থিরতা।

স্ত্রীর কাছে এসে বসলেন তিনি—

সালেহা, আমি ঠিক করেছি, আমি আর ও চাকরি করবো না। এসব সরকারি চাকরি মানুষকে ক্রীতদাস করে ফেলে। আমি ছেড়ে দেবো। যেখানে আমার সামান্য স্বাধীনতা নেই, সেখানে কেন আমি কলুর বলদের মতো ঘানি টেনে যাবো? আমি আবার কবিতা লিখবো সালেহা। যে কবিতা পড়ে তোমার একদিন আমাকে ভালো লেগেছিলো—তেমনি কবিতা লিখবো আমি।

সালেহার পুরো চেহারায় কে যেন আলকাতরা লেপে দিলো।

না, না! চাকরি ছাড়া ঠিক হবে না। তাহলে সংসার চলবে কী করে? কবিতা লিখে তো আর টাকা পাবে না তুমি!

টাকা! টাকাটাই কি জীবনের সব কিছু সালেহা? মানুষের মন বলে কি কিছুই নেই?

শোনো। ওসব চিন্তা এখন রাখো।

সালেহা স্বামীর হাত ধরলো।

এসো এখন শুয়ে পড়া যাক। কাল আবার ভোরে-ভোরে উঠতে হবে না!

আমি কিন্তু কাল অফিসে যাবো না।

কেন?

আমি হরতাল করবা। ওরা নিষেধ করেছে। বলেছে চাকরি যাবে, যাক। সেটা পরোয়া করি না। আমার ভাষার চেয়ে কি চাকরি বড়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *