২. ইউটোপিয়া

ইউটোপিয়া

প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ রিপাবলিক ব্যাপক অর্থে তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। একটি আদর্শ রাষ্ট্র (Ideal Commonwealth) গঠনের বিষয় রয়েছে প্রথম অংশে (পঞ্চম পুস্তকের প্রায় শেষাংশের কাছাকাছি পর্যন্ত), এটি ইউটোপিয়াগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। যেসব উপসংহার এ অংশে টানা হয়েছে সেগুলোর একটি হলো, শাসকরা অবশ্যই হবেন দার্শনিক। দার্শনিক শব্দটাকে ষষ্ঠ ও সপ্তম পুস্তকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশ গঠিত হয়েছে এই আলোচনা নিয়ে। তৃতীয় অংশটিতে রয়েছে প্রধানত নানা রকম বাস্তব সংবিধান ও সেগুলোর দোষ-গুণ সম্পর্কিত বিষয়ের আলোচনা।

রিপাবলিক গ্রন্থের নমিন্যাল উদ্দেশ্য ন্যায্য কাজ বা ন্যায়পরায়ণতা শব্দটার সংজ্ঞার্থ ব্যাখ্যা করা। অবশ্য প্রাথমিক পর্বে ধরে নেয়া হয়, যেহেতু ছোটর চেয়ে বড়র মধেই সবকিছু দেখা সহজতর, তাই একজন ব্যক্তি কিসের মাধ্যমে ন্যায়পরায়ণ হয় তার চেয়ে একটি রাষ্ট্র কীভাবে ন্যায়ানুগ হয় তা খতিয়ে দেখা হবে শ্রেয়তর কাজ এবং যেহেতু কল্পনাযোগ্য সর্বোত্তম রাষ্ট্রটির স্বাভাবিক গুণাবলির মধ্যে ন্যায্য কাজ বা ন্যায়পরায়ণতা অবশ্যই থাকবে, তাই প্রথমে এ রকম একটি রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ওই রাষ্ট্রের কোন কোন উৎকর্ষকে ন্যায়পরায়ণতা বলে আখ্যায়িত করা যাবে। আমরা প্রথমে প্লেটোর ইউটোপিয়া পূর্ণভাবে বর্ণনা করব, তারপর আলোচনা প্রসঙ্গে যেসব পয়েন্ট উঠবে বিবেচনা করব সেগুলো।

প্লেটো এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে শুরু করেছেন; নাগরিকরা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত থাকবেন : জনসাধারণ, সৈন্যবাহিনী ও অভিভাবকরা। শেষোক্তদের হাতেই শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে। অন্য দুটি শ্রেণির চেয়ে এই শ্রেণির (অভিভাবক) লোকসংখা হবে বেশ কম। মনে হয়, প্রথমে তারা মনোনীত হবেন বিধায়কের পছন্দক্রমে, তারপর থেকে স্বাভাবিকভাবে বংশানুক্রমে অভিভাবকত্ব লাভ করবেন। অবশ্য ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কোনো অধঃস্তন শ্রেণির কোনো সম্ভাবনাময় শিশুকে ঊর্ধ্বতন শ্রেণিতে নেয়া যেতে পারে, আবার নিম্নতর শ্রেণিতে পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে অভিভাবকদের সন্তানদের মধ্যে অসন্তোষজনক কোনো শিশু বা তরুণকে। প্লেটো প্রধান সমস্যাটি যেমনটি উপলব্ধি করেন, তা হলো অভিভাবকরা যে বিধায়কের অভিপ্রায়গুলো পূরণ করবেন তা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যে প্লেটোর নানা রকম প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্ত বিগুলো শিক্ষা, অর্থনীতি, জীববিজ্ঞান এবং ধর্ম সংক্রান্ত। অভিভাবক ছাড়া অন্য শ্রেণিগুলোর বেলায় এ প্রস্তাবগুলো কতটা কার্যকর তা পরিষ্কার নয়। এ প্রস্তাবগুলোর কিছু কিছু সৈনিকদের বেলায় প্রযোজ্য তা অবশ্য পরিষ্কার, তবে প্লেটো মূলত শুধু অভিভাবকদের নিয়েই চিন্তিত। প্রাচীন প্যারাগুয়ের জেসুইটদের মতে, অভিভাবকরা এক বিচ্ছিন্ন শ্রেণি, যারা চার্চের রাষ্ট্রগুলোর পুরোহিত ছিল ১৮৭০ সাল পর্যন্ত, আর বর্তমানকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিনিস্ট পার্টির মতো।

প্রথম বিবেচ্য বিষয়টি হলো শিক্ষা। শিক্ষা দুই অংশে বিভক্ত-সঙ্গীত ও শরীরচর্চা। এই দুটি শব্দের বর্তমান অর্থের চেয়ে ব্যাপকতর অর্থ আছে। সঙ্গীত মানে মিউজদের আঙ্গিনায় যা কিছু আছে তা সবই, আর শরীরচর্চা বলতে যা কিছু শারীরিক প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য-সবলতার সাথে সংশ্লিষ্ট তাই। সঙ্গীত প্রায় ততটাই বিস্তৃত একটি ব্যাপার, যাকে আমরা সংস্কৃতি বলি এবং শরীরচর্চা অ্যাথলেটিকসের চেয়ে ব্যাপকতর। কালচার বা সংস্কৃতির সার্বিক লক্ষ্য হবে মানুষকে ভদ্রলোক বানানো, gentleman বলতে ইংরেজিতে যা পরিচিত, সেই অর্থে। প্লেটোর সময়কার এথেন্স এক বিবেচনায় উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের অনুরূপ ছিল : উভয় সমাজেই একটি করে অভিজাত সম্প্রদায় ছিল, যারা সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা ভোগ করত, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল না এবং এই দুই সমাজের প্রত্যেকটিতেই অভিজাত সম্প্রদায়কে ক্ষমতা-তারা যতটুকু পেয়েছে-অর্জন করতে হয়েছে চিত্তাকর্ষক আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে। যদিও প্লেটোর ইউটোপিয়ায় অবাধ শাসনক্ষমতা হবে অভিজাত সম্প্রদায়ের।

শিক্ষায় প্রধান যে গুণাবলির চর্চা হবে সেগুলো হলো গাম্ভীর্য, শিষ্টাচার ও সাহসিকতা। খুব অল্প বয়স থেকে একটি অনড় বিধিনিষেধ থাকবে সাহিত্য ও সঙ্গীতের ব্যাপারে। মা ও সেবিকারা কেবল অনুমোদিত গল্প কাহিনি শোনাতে পারবেন ছেলেমেয়েদের। কয়েকটা কারণে হোমার ও হেসিওডের রচনা নিষিদ্ধ হবে। প্রথমত, তাদের রচনায় কখনো কখনো দেবতাদের বাজে আচরণ করতে দেখা যায়, যা নৈতিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক নয়; ছেলেমেয়েদের এই শিক্ষা দিতে হবে যে, মন্দ জিনিসগুলো দেবতাদের কাছ থেকে আসে না, কারণ ঈশ্বর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা নন, তিনি শুধু ভালো জিনিসগুলোর স্রষ্টা। দ্বিতীয়ত, হোমার ও হেসিওডের রচনায় এমন কিছু আছে, যা হিসাব করলে দেখা যায়, পাঠকের মনে মৃত্যু সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করে, অথচ শিক্ষায় সবকিছুর উদ্দেশ্যেই হবে যুবকদের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুকে বরণ করে নেবার মানসিকতা গঠন করা। আমাদের ছেলেদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে যাতে তারা দাসত্বকে মৃত্যুর চেয়ে হীন জ্ঞান করে, আর সে কারণেই তাদের জীবনে এমন কোনো গল্প থাকবে না যেখানে ভালো মানুষেরা কাঁদে ও হাহাকার করে, এমনকি তাদের বন্ধুদের মৃত্যুতেও। তৃতীয়ত, শিষ্টাচার দাবি করে যে কখনো উচ্চস্বরে হাসা যাবে না, কিন্তু হোমার আশীর্বাদপুষ্ট দেবতাদের মধ্যে অনির্বাণীয় উচ্চহাস্যের কথা বলেছেন। ছেলেরা যদি এই অংশটুকুর উদ্ধৃতি দেয় তাহলে পণ্ডিতমশাই কীভাবে এই হাস্যকলরবকে দোষারোপ করবেন? চতুর্থত, হোমারের রচনায় কিছু অংশ আছে যাতে উপাদেয় ও দামি ভোজের প্রশংসা আছে এবং আরো কিছু অংশে দেবতাদের লালসার বর্ণনা আছে; এ রকম রচনাংশগুলো মিতাচারকে নিরুৎসাহিত করে। [খাঁটি প্লেটোবাদী Dean Inge এক সুপরিচিত স্তোত্রগীত (hymn)-এর একটি লাইন সম্পর্কে আপত্তি PGA; The shout of them that triumph, the song of them that feast. এই কথাগুলো স্বর্গের আনন্দ উল্লাসের বর্ণনায় ছিল। তারপর, এমন কোনো গল্প থাকবে না যেখানে দুষ্টুরা সুখী বা ভালোরা অসুখী, অপরিণত মনের ওপর এ রকম গল্পের নৈতিক প্রভাব দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে। এই সবকিছু হিসাব করে যা দাঁড়ায়, তা হলো কবিরা হবেন নিন্দিত।

এরপর নাটক সম্পর্কে এক কৌতূহলোদ্দীপক যুক্তি দিয়েছেন প্লেটো। তিনি বলেছেন, একজন ভালো মানুষের কোনো খারাপ লোককে অনুকরণ করা উচিত নয়, আর অধিকাংশ নাটকেই এখন ভিলেন চরিত্র আছে; সুতরাং নাট্যকার ও ভিলেনের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতাকে এমন সব লোকের অনুকরণ করতে হবে যারা বিভিন্ন রকম অপরাধে অপরাধী। শুধু অপরাধীদেরই নয়, নারী, দাস এবং সাধারণভাবে নিচু শ্রেণির কাউকেই অনুকরণ করা উঁচু শ্রেণির কোনো মানুষের উচিত নয় (এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডের মতো গ্রিসেও পুরুষদের দ্বারা নারী চরিত্রগুলো অভিনীত হতো)। সুতরাং নাটক, যদি আদৌ অনুমোদনযোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে তাতে সদ্বংশের পুরুষ বীর ছাড়া অন্য কোনো চরিত্র থাকতে পারবে না। এটা যে সম্ভব নয় তা থেকে এই প্রমাণই মেলে যে প্লেটো তার নগর থেকে সব নাট্যকারকে নির্বাসিত করতে চেয়েছেন। এই রূপকথার নাটকের ভদ্রলোকেরা এত চালাক যে তারা যেকোনো কিছু অনুকরণ করতে পারেন; তাদের কেউ যদি আমাদের কাছে এসে নিজেকে ও তার কাব্য উপস্থাপনের প্রস্তাব করেন তাহলে আমরা তার সামনে অবনত হবে, তাকে এক সুমধুর ও পবিত্র সত্তা হিসেবে পূজা করব, কিন্তু আমাদের এ কথাও তাকে অবশ্যই জানিয়ে দিতে হবে যে আমাদের রাষ্ট্রে তার মতো কারোর অস্তিত্বের অনুমতি নেই; আইন তাদের অনুমতি দেয় না। এবং আমরা যখন এভাবে তাকে গন্ধরস লেপন করব এবং তার শিরে পশমের একটি মালা পরিয়ে দেব, তারপর আমরা তাকে পাঠিয়ে দেব অন্য কোনো নগরীতে।

এরপর আসা যাক সঙ্গীতে (আধুনিক অর্থে) ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে। লিদিয়া ও আয়োনিয়ার সুরগুলো নিষিদ্ধ করা হবে। প্রথমটি নিষিদ্ধ হবে কারণ তা দুঃখ প্রকাশ করে; দ্বিতীয়টি নিষিদ্ধ হবে কারণ তা প্রশান্তিময়। শুধু ডরিয়ান (সাহসিকতার জন্য) এবং ফ্রিজিয়ান (মিতাচারের জন্য) সুর অনুমোদিত হবে। অনুমোদিত ছন্দগুলো হবে সরল এবং এমন, যেগুলোতে সাহসী ও সাজানা- গোছানো জীবন প্রকাশ পাবে। শারীরিক প্রশিক্ষণ হবে অত্যন্ত কঠোর ও অনাড়ম্বর। শুধু রোস্ট করা ছাড়া অন্যভাবে রাধা মাছ অথবা মাংস খাওয়া যাবে না এবং খাবারে কোনোরকম সস বা কনফেকশনারি থাকবে না। প্লেটো বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে বেড়ে ওঠা মানুষের কোনো চিকিৎসকের প্রয়োজন হবে না।

একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ছোটরা কোনো কদর্যতা বা পাপ দেখতে পাবে না। কিন্তু একটি উপযুক্ত মুহূর্তে তাদের সামনে সেই মোহিনীশক্তি উন্মোচন করতে হবে; একই সঙ্গে আতঙ্কের রূপে এবং মন্দ আনন্দের রূপে, যে আতঙ্ক তাদের সন্ত্রস্ত করবে না এবং যে মন্দ আনন্দ তাদের ইচ্ছাশক্তিকে বিপথগামী করবে না। কেবল এই পরীক্ষাগুলো উত্তীর্ণ হবার পরই তারা অভিভাবক বিবেচিত হবার যোগ্যতা লাভ করবে। সাবালক হবার আগে বালকেরা যুদ্ধ দেখবে, যদিও তারা নিজেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্লেটো অভিভাবক শ্রেণির জন্যে এক সর্বাত্মক সাম্যবাদের প্রস্তাব– করেছেন এবং (আমার মনে হয়) সৈনিকদের জন্যেও; যদিও এটা পরিষ্কার নয়। অভিভাবকদের ছোট ছোট বাড়ি থাকবে, তাদের খাদ্য হবে সাধারণ। তারা বাস করবেন যেন একটি শিবিরে; একত্রে খাবার খাবেন, একেবারে অত্যাবশ্যক কিছু জিনিস ছাড়া তাদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না। সোনা ও রুপা নিষিদ্ধ। ধনী না হলেও তাদের সুখী না হবার কোনো কারণ থাকবে না; কিন্তু নগরীর লক্ষ্য কোনো একটি শ্রেণির সুখ নয়, বরং সমগ্র নগরীর মঙ্গল। সম্পদ এবং দারিদ্র্য উভয়ই ক্ষতিকর, প্লেটোর নগরীতে এ দুটোর কোনোটাই থাকবে না। যুদ্ধ সম্পর্কে প্লেটোর এক অদ্ভুত যুক্তি আছে, তা হলো যেহেতু আমাদের নগরী বিজয়ের লোকসানের কোনো অংশীদার হতে চাইবে না সেহেতু মিত্রদের কিনতে পাওয়া যাবে সহজেই।

অনিচ্ছার ভান করলেও প্লেটোনিক সক্রেটিস পরিবারের ক্ষেত্রে সাম্যবাদ প্রয়োগ করতে চান। তিনি বলেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ বন্ধুরা সবাই সর্বজনীন জিনিসপত্রের মালিক হবে। তিনি স্বীকার করেন যে তাতে জটিলতা ও অসুবিধা আছে, কিন্তু তিনি এগুলোকে দুর্লঙ্ মনে করেন না। সর্বোপরি বালিকারা বালকদের মতো হুবহু একই শিক্ষার সুযোগ পাবে, ছেলেদের সঙ্গে তারাও সঙ্গীত, শরীরচর্চা আর সমরবিদ্যা শিখবে। সব ক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের মতো সমানাধিকার থাকবে। যে শিক্ষা পুরুষদের ভালো অভিভাবক হিসেবে তৈরি করবে সেই একই শিক্ষা নারীদেরও ভালো অভিভাবক হিসেবে গড়ে তুলবে, কারণ তাদের মৌলিক প্রকৃতি একই রকম। সন্দেহ নেই যে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু রাজনীতিতে তার কোনো প্রভাব নেই। কিছু নারী দার্শনিক স্বভাবের এবং তারা অভিভাবক হিসেবে মানানসই; কিছু নারীর স্বভাব যোদ্ধাসুলভ, তারা ভালো সৈনিক হতে পারে। কিছু নারী ও কিছু পুরুষ নিয়ে বিধায়ক অভিভাবকমণ্ডলী মনোনয়ন করবেন এবং ঘোষণা করবেন যে তারা সবাই সাধারণ বাসস্থানে বাস করবে ও সাধারণ খাবার খাবে। আমরা যেমনটি জানি, বিবাহপ্রথার মৌলিক পরিবর্তন করা হবে (কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই এই মহিলারা হবে এই পুরুষদের কমন স্ত্রী, কোনো পুরুষের নিজস্ব স্ত্রী থাকবে না।) জনসংখ্যা ঠিক রাখার জন্যে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বর-কনেকে কিছু বিশেষ উৎসবে দল বেঁধে হাজির করা হবে, এভাবে তাদেরকে অভ্যস্ত হতে শিক্ষা দেয়া হবে; মূলত শাসকরা এদের ব্যবহার করবেন সুপ্রজনন নীতির ভিত্তিতে। এমন আয়োজন করা হবে যাতে সর্বোত্তম সিরিজগুলো থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সন্তানের জন্ম হয়। জন্মের সময়ই সব শিশুকে তাদের পিতামাতার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে; কোনো পিতামাতা যেন জানতে না পারে তাদের ছেলেমেয়ে কারা, সেদিকে খুব নজর রাখা হবে, কোনো শিশুও জানতে পারবে না তার পিতামাতা কারা। বিকলাঙ্গ শিশু বা নিম্নমানের পিতামাতার সন্ত নিদের সরিয়ে নেয়া হবে একটি রহস্যময় অজানা স্থানে, যেমনটা হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া যৌন মিলনের ফলে জন্ম নেয়া শিশুদের অবৈধ বিবেচনা করা হবে। মায়েদের বয়স হবে ২০ থেকে ৪০-এর মধ্যে, বাবাদের বয়স হবে ২৫ থেকে ৫৫-এর মধ্যে। এই বয়সসীমার বাইরে যৌনসঙ্গমে স্বাধীনতা দেয়া হবে, কিন্তু তার ফলে গর্ভসঞ্চার হলে গর্ভপাত বা শিশু হত্যা হবে বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র যেসব বিবাহের ব্যবস্থা করবে তাতে বর-কনের কোনো বক্তব্য থাকতে পারবে না, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যবোধ। থেকে তা সম্পন্ন হবে; নির্বাসিত কবিরা যেসব সাধারণ আবেগের গুণগান করতেন সেগুলো থেকে নয়। যেহেতু কেউ তার বাবা-মাকে চিনবে না তাই বাবার বয়সী যেকোনো পুরুষকেই সে বাবা ডাকবে; একইভাবে বয়স অনুযায়ী মা, বোন বা ভাই ডাকবে ওই ওই বয়সের যেকোনো মানুষকে। (এ ধরনের ব্যাপার আদিম মানুষদের মধ্যে আছে, মিশনারিরা এ দেখে ধাঁধায় পড়তেন।) পিতা ও কন্যার মধ্যে বা মাতা ও পুত্রের মধ্যে সাধারণ বিয়ে হবে না, তবে এ নিয়ম চূড়ান্ত নয়। ভাই-বোনের বিয়েতে বাধা দেয়া হবে। (আমার মনে হয় প্লেটো যদি যত্নসহকারে চিন্তা করতেন তাহলে তিনি দেখতে পেতেন যে তিনি সব বিয়েই নিষিদ্ধ করছেন, শুধু ভাই-বোন বিয়ে ছাড়া; ভাই-বোন বিয়েকে তিনি বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে দেখেছেন।)।

ধরে নেয়া যায়, বাবা, মা, ভাই বোন-এই শব্দগুলোর সঙ্গে বর্তমানকালে যে অনুভূতিগুলো জড়িত, সেগুলো প্লেটোর নতুন ব্যবস্থায়ও থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো তরুণ কোনো বৃদ্ধ লোককে আঘাত করবে না, কারণ তিনি তার বাবা হয়ে থাকতে পারেন। এই ব্যবস্থার মধ্যে যে সুবিধা খোঁজা হয়েছে তা নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত অধিকারবোধকে কমিয়ে ফেলা এবং এইভাবে সামষ্টিক বোধের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথের বাধাগুলো দূর করা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতির প্রতি সম্মতি তৈরি করা। এর উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে যাজকদের কৌমার্যব্রত পালনের মতো দেখুন (Henry C. Lea, A History of Sacerdotal Celibay)।

শেষে আমি প্লেটোর ব্যবস্থার ধর্মতাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে আসছি। আমি স্বীকৃত গ্রিক দেবতাদের কথা ভাবছি না, বরং কিছু নির্দিষ্ট পুরাণের (myth) কথা বলছি, যেগুলোকে সরকার চিত্তনিষ্ঠ করবে। প্লেটো পরিষ্কার বলছেন, সরকারের জন্যে মিথ্যে বলা হবে একটি বিশেষ অধিকার। ঠিক যেমন একজন চিকিৎসকের অধিকার আছে ওষুধ দেয়ার। দলবদ্ধ বিবাহের ব্যবস্থার ভানের মধ্য দিয়ে সরকার জনগণকে ভুল বোঝাবে, কিন্তু এটা কোনো ধর্মীয় ব্যাপার নয়। একটি রাজকীয় মিথ্যা থাকতে হবে যা প্লেটো আশা করেন, শাসকদেরও বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু যেকোন মূল্যেই হোক নগরীর অবশিষ্ট লোকদের মনে ভুল বা মিথ্যা বিশ্বাসের জন্ম দেবে। এই মিথ্যার বিবরণ বেশ বিস্তারিতভাবে দেয়া হয়েছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো এই অন্ধবিশ্বাস যে, ঈশ্বর তিন প্রকারের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম তারা সোনার তৈরি; দ্বিতীয় সারির লোকেরা রুপার; আর সাধারণ জনতা পিতল ও লোহার তৈরি। যারা সোনার তৈরি তারা অভিভাবক হবার যোগ্য; রুপার তৈরি লোকেরা হবে সৈনিক, আর অবশিষ্টদের করতে হবে শারীরিক কার্যকর্ম। সাধারণত-তবে কোনক্রমেই সর্বদা নয়-শিশুদের মর্যাদা হবে তাদের পিতামাতার মতোই; যখন এর ব্যত্যয় ঘটবে তখন অবশ্যই শিশুদের দোষ-গুণ অনুযায়ী মর্যাদা কমানো-বাড়ানো হবে। বর্তমান প্রজন্মকে এই মিথ (myth) বিশ্বাস করানো আদৌ সম্ভব হবে বলে ভাবা হয়নি, তবে পরবর্তী এবং তার পরের সব প্রজন্মকে এমনভাবে শিক্ষিত করে তোলা হবে যে তারা এর প্রতি কোনো সন্দেহ পোষণ করবে না।

প্লেটোর এই চিন্তা সঠিক যে এই মিথের প্রতি বিশ্বাস গড়ে তোলা দুই প্রজন্ম কালের মধ্যে সম্ভব হবে। ১৮৬৮ সাল থেকে জাপানিদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, মিকাদোর (Mikado) আবির্ভাব ঘটেছে সূর্যদেবীর মধ্য থেকে এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশের চেয় আগে সৃষ্টি হয়েছে জাপান। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোনোভাবে, এমনকি যদি কোনো পণ্ডিতসুলভ রচনায়ও এই অন্ধবিশ্বাসের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন তাহলে তাকে অজাপানি কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বরখাস্ত হতে হবে। প্লেটো যা উপলব্ধি করতে পারেননি বলে মনে হয় তা হলো, এ ধরনের মিথের বাধ্যতামূলক স্বীকৃতি দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং তা এমন ধরনের শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট, যা বুদ্ধিবৃত্তিকে রুদ্ধ করে দেয়।

প্লেটোর পুরো আলোচনার নমিন্যাল যে উদ্দেশ্য, সেই ন্যায়পরায়ণতার সংজ্ঞা পাওয়া যায় চতুর্থ পুস্তকে। বলা হচ্ছে, ন্যায়পরায়ণতা বা ন্যায্য কাজ মানে প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজ করা, অন্যের কাজের নিন্দামন্দ না করা; নগর রাষ্ট্র তখনই একটি ন্যায়ানুগ নগর just city) হবে, যখন বণিক সৈন্য অভিভাবক প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্তব্য করে যাবে, অন্য শ্রেণির কারুর কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। প্রত্যেকের নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হওয়া উচিত-এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় অনুশাসন। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ স্বাভাবিক অর্থে ন্যায়পরায়ণতা বলতে যা বোঝে এটা দ্বারা তা বোঝায় না। এভাবে অনূদিত গ্রিক শব্দটি এমন একটি ধারণা ব্যক্ত করত যা গ্রিক চিন্ত Tয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল; কিন্তু সেটার কোনো সঠিক সমার্থক শব্দ আমাদের নেই। এ প্রসঙ্গে অ্যানাক্সিমেন্ডার যা বলেছিলেন তা স্মর্তব্য : যেমনটি স্থির করা আছে, বস্তুগুলো যে রূপ থেকে বেরিয়ে আসে তারা আবার সে রূপকে অতিক্রম করে যায়, কারণ নির্ধারিত সময় অনুযায়ী তারা তাদের অন্যায্যতার ক্ষতিপূরণ ও সন্তুষ্টি পরস্পরকে দিয়ে থাকে।

দর্শন শুরু হবার আগে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে গ্রিকদের একটি তত্ত্ব বা অনুভব ছিল, সেটাকে ধর্মীয় বা নৈতিক বলা যেতে পারে। এই তত্ত্ব অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তি বা প্রতিটি বস্তুর জন্যে স্থান ও কর্ম নির্ধারিত আছে। সেটা জিউসের আদেশের ওপরে নির্ভর করে না, কারণ জিউস নিজেও একই নিয়মের অধীন, যা অন্যদের পরিচালিত করে। এই তত্ত্ব ভাগ্য বা নিয়তির ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি স্বর্গীয় পদার্থগুলোর বেলায় এই তত্ত্ব বেশ জোরালোভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু যেখানে শারীরিক বা মানসিক তেজ রয়েছে সেখানে ন্যায্যতার সীমা অতিক্রম করার একটি প্রবণতা আছে, এখান থেকেই দ্বন্দ্ব-বিবাদের সৃষ্টি। একধরনের সুপার ওলিম্পিয়ান নৈর্ব্যক্তিক আইন হার্বিস (Hurbis)-কে শাস্তি দেয় এবং আগ্রাসী যে চিরন্তন ব্যবস্থাকে লংঘন করতে চেয়েছিল তা পুনঃপ্রতিষ্ঠত করে। এই পুরো দৃষ্টিভঙ্গিটি মৌলিকভাবে এবং সম্ভবত অসচেতনভাবে, দর্শনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এ রকম ব্যাপার দেখা যাবে দ্বন্দ্বমূলক বিশ্বতত্ত্বগুলোর মধ্যে, যেমন হেরাক্লিটাস ও এম্পিডকলসের তত্ত্বে এবং পারমিনাইডিসের অদ্বৈতবাদী মতবাদের মধ্যে। প্রাকৃতিক ও মানবিক-উভয় প্রকার আইনের প্রতি বিশ্বাসের উৎস এটাই এবং প্লেটোর ন্যায়পরায়ণতার ধারণার গভীরে তা স্পষ্টভাবে রয়ে গেছে।

রাজনৈতিক চিন্তায় জাস্টিস শব্দটা যে অর্থে ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে আইনশাস্ত্রে ব্যবহৃত অর্থটি শব্দটি এখনো প্লেটোর জাস্টিসের ধারণার সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ। গণতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রভাবে আমরা জাস্টিস শব্দটাকে ইকুয়ালিটি বা সমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করি। কিন্তু প্লেটোর কাছে এর কোনো ব্যঞ্জনার্থ নেই। যে অর্থে জাস্টিস আইনের প্রায় সমার্থক, (যেমন আমরা বলে থাকি courts of justice) তা প্রধানত সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সমতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। রিপাবলিক গ্রন্থের শুরুতে জাস্টিস শব্দটার প্রথম প্রস্তাবিত সংজ্ঞার্থ ছিল ঋণ পরিশোধ করা। অচিরেই এই সংজ্ঞা যথার্থ নয় বলে পরিত্যক্ত হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কিছু একটি রয়েই গেছে।

প্লেটোর সংজ্ঞা সম্পর্কে খেয়াল করার মতো কয়েকটি দিক আছে। প্রথমত এতে ন্যায়বিবেচনার অভাবে ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার অসমতা সম্ভব। অভিভাবকরা হবেন সব ক্ষমতার অধিকারী কারণ তারা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে জ্ঞানী সদস্য। শুধু তখনই অন্যায় ঘটবে যদি প্লেটোর সংজ্ঞা অনুসারে অন্য শ্রেণিগুলোর মধ্যে অভিভাবকদের কারো কারো চেয়ে অধিকতর জ্ঞানী ব্যক্তি থাকে। ঠিক এই কারণেই প্লেটো নাগরিকদর পদোন্নতি ও পদাবনতির ব্যবস্থা রেখেছেন; যদিও তিনি মনে করেন অভিভাবকদের ছেলেমেয়েরা জন্ম ও শিক্ষার যুগল সুবিধার কারণে অন্যান্য শ্রেণির ছেলেমেয়েদের চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উন্নত হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার আরো জুতসই কোনো বিজ্ঞান যদি থাকত এবং তার অনুশাসনে মানুষের আরো নিশ্চয়তা তৈরি হতো, তাহলে প্লেটোর ব্যবস্থার পক্ষে আরো অনেক কিছু বলার থাকত। একটি ফুটবল দলে সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়দের নেয়া কেউই অন্যায় মনে করে না, যদিও এর দ্বারা ওই খেলোয়াড়রা বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। এথেন্সের সরকারের মতো ফুটবল যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো, তাহলে যেসব ছাত্র তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলবে তাদের নির্বাচিত হতে হতো সবার ভোটে। কিন্তু সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বোঝা খুব কঠিন, কার দক্ষতা সবচেয়ে বেশি এবং এটা খুবই অনিশ্চিত যে, একজন রাজনীতিক তার দক্ষতা কাজে লাগাবেন জনগণের স্বার্থে। তিনি যে নিজের বা নিজ শ্রেণির বা দলের বা বিশ্বাসের স্বার্থে তার দক্ষতা ব্যবহার করবেন না তা মোটেই নিশ্চিত করে বলা যায় না।

প্লেটোর জাস্টিসের সংজ্ঞার পরবর্তী পয়েন্টটিতে এমন একটি রাষ্ট্রের পূর্বপরিকল্পনা আছে, যা হয় চিরাচরিত লাইনে গঠিত হবে, অথবা যেমনটি সামগ্রিক অর্থে বোঝা যায়-প্লেটোর নিজের মতো কতগুলো নৈতিক আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। বলা হচ্ছে, জাস্টিস বা ন্যায়পরায়ণতা মানে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ কাজ সম্পাদন করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন মানুষের কাজ কী? প্রাচীন মিসর বা ইনকাদের রাজ্যের মতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অপরিবর্তিত থাকে এমন একটি রাষ্ট্রে একজন মানুষের কাজ তা-ই, যা তার পিতার কাজ, তাই কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু প্লেটোর রাষ্ট্রে কোনো মানুষের আইনগত কোনো পিতা নেই। তাই তার কাজ হয় তার নিজের রুচি অনুসারে নির্ধারিত হবে, অথবা তার ঝোঁক ও দক্ষতা অনুসারে রাষ্ট্র তা নির্ধারণ করে দেবে। পরিষ্কার যে, প্লেটো পরবর্তী ব্যবস্থাটাই আকাক্ষা করতেন। কিন্তু কিছু কিছু কাজ বেশ ভালো রকম দক্ষতাপূর্ণ হলেও ক্ষতিকর মনে হতে পারে; প্লেটো এখানে। কাব্যের দৃষ্টিভঙ্গিটা গ্রহণ করেছেন, আর আমি নেব নেপোলিয়নের কাজের দৃষ্টিভঙ্গি। সুতরাং সরকারের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একজন মানুষের কাজ বা পেশা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। যদিও শাসকরা সবাই হবেন দার্শনিক, কিন্তু সেই রাষ্ট্রে নতুন কিছু সৃষ্টি হবে না। সব সময়ের জন্যে, একজন দার্শনিককে হতে হবে এমন একজন মানুষ, যিনি প্লেটোকে বুঝবেন ও তার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন।

আমরা যখন প্রশ্ন তুলি, প্লেটোর রিপাবলিকের অর্জনটা কী হবে, তখন উত্তরটা খুবই গতানুগতিক। এর অর্জন হবে যুদ্ধে সাফল্য, মোটামুটি সমতাপূর্ণ জনগোষ্ঠী এবং স্বল্পসংখ্যক একটি নির্দিষ্ট জনগণের জীবিকার নিশ্চয়তা। প্রায় নিশ্চিতভাবেই এই রাষ্ট্রে কোনো শিল্প বা বিজ্ঞান সৃষ্টি হবে না, হবে না সেটার অনমনীয়তার জন্যে। এই বিবেচনায়-যেমনটি অন্যান্য আরো অনেক বিবেচনায়-প্লেটোর রাষ্ট্রটি হবে স্পার্টার মতো। সব সুন্দর সুন্দর কথা সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রের অর্জন হবে যা, তা হলো যুদ্ধে দক্ষতা আর পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য। প্লেটো বাস করেছেন চরম খাদ্যাভাব ও এথেন্সের পরাজয়ের মধ্যে। হতে পারে, তিনি ভেবেছিলেন একটি দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার পূর্ণতা হলো সর্বোত্তমভাবে এই জিনিসগুলো পরিহার করার মধ্যে।

আকাঙ্খাপ্রসূত গুরুতর একটি ইউটোপিয়া সেটার স্রষ্টার আদর্শগুলোকে অবশ্যই মূর্ত করে তুলবে। এখন একটু বিবেচনা করা যাক, আদর্শগুলো বলতে আমরা কী বোঝাতে পারি। প্রথমত আদর্শগুলোর আকাক্ষা পোষণ করে তারাই যারা সেগুলোতে বিশ্বাস করে। কিন্তু একজন মানুষ খাদ্য বা আশ্রয়ের মতো ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ যেভাবে কামনা করে, আদর্শের প্রতি আকাক্ষা মোটেই সে রকম নয়। একটি আদর্শ ও একটি সাধারণ কাক্ষিত বস্তুর মধ্যে যে পার্থক্য তা হলো আদর্শ নৈর্ব্যক্তিক; এমন একটি কিছু যার সঙ্গে যে ব্যক্তি সেটির জন্যে আকাঙ্ক্ষা বোধ করেন তার অহমের কোনো সম্পর্ক নেই (অন্তত আপাতদৃষ্টিতে), সে কারণেই তত্ত্বগতভাবে আদর্শ সবারই কাক্ষিত বিষয়। এইভাবে, আদর্শকে আমরা এমন একটি ব্যাপার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি যা কাক্ষিত এবং আত্মকেন্দ্রিক নয়, যে ব্যক্তি তা আকাক্ষা করবেন তিনি। চাইবেন অন্য সবাইও তা আকাঙ্ক্ষা করুক। আমি এমন কামনা করতে পারি যে প্রত্যেক মানুষ যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে পায়, প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় ইত্যাদি। আমার কামনা যদি এই রকম হয় তাহলে আমি এও চাইব যে অন্য সবাইও এই রকম কামনা করুক। এইভাবে আমি এমন একটি জিনিস দাঁড় করাতে পারি, যা এক নৈর্ব্যক্তিক নৈতিকতার মতো দেখাবে, যদিও সেটার ভিত্তি হবে আসলে আমার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা, কারণ আকাক্ষাটা রয়ে যাচ্ছে আমারই, এমনকি যখন কাঙ্ক্ষিত বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে আমার নিজের কোনো সম্পর্ক থাকে না, তখনো আকাঙ্খাটা আমারই। দৃষ্টান্তস্বরূপ; একজন মানুষ চাইতে পারে যে সবাই বিজ্ঞান বুঝুক, আর অন্য একজন চায় প্রত্যেকেই শিল্পকলা বুঝুক; এই দুই মানুষের মধ্যে এটা একটি ব্যক্তিগত পার্থক্য, যার ফলে ওই দুজনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত উপাদান তখনই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন বিরোধ দেখা দেয়। ধরা যাক একজন মানুষ বললেন, তুমি যদি চাও প্রত্যেক মানুষই সুখী হোক, তাহলে সেটা তোমার ভুল; তোমার কামনা করা উচিত শুধু জার্মানরা সুখী হোক, বাকি সবাই অসুখী হোক। এখানে উচিত বলতে ধরে নেয়া যেতে পারে বক্তা চাইছেন আমার আকাঙ্ক্ষা কী হলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়। আমি যদি জার্মান না হই তাহলে আমি তার প্রতিবাদ করতে পারি, কারণ তাহলে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমার পক্ষে সব অজার্মান অসুখী হোক-এমন কামনা করা অসম্ভব, কিন্তু এই জবাব যথাযথ বলে মনে হয় না। আবার খাঁটি নৈর্ব্যক্তিক আদর্শগুলোর মধ্যেও বিরোধ থাকতে পারে। নিটশের নায়কের সঙ্গে একজন খ্রিস্টান সাধুর পার্থক্য আছে, তবু নৈব্যক্তিকভাবে উভয়েরই সমাদর আছে; একজনের সমাদর নিটশেবাদীদের কাছে, অন্যজনের সমাদর খ্রিস্টানদের কাছে। আমাদের নিজস্ব আকাক্ষা ছাড়া এ দুই-এর মধ্যে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি? তারপরেও যদি না হয়, তাহলে একটি নৈতিক বিতর্কের সমাধান হতে পারে শুধু আবেগী আবেদন অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে-চূড়ান্ত শরণ হিসেবে-যুদ্ধের মাধ্যমে। বাস্তব ঘটনার প্রশ্নে আমরা বিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শরণাপন্ন হতে পারি। কিন্তু চূড়ান্ত নৈতিক প্রশ্নের বেলায় সে রকম কিছু পাওয়া যায় না। তবুও ব্যাপার যদি আসলেই এই রকম হয়, তাহলে নৈতিক বিতর্কগুলোর মধ্যে একটি মীমাংসা তৈরি হয় ক্ষমতার প্রতিযোগিতার মধ্যে। ক্ষমতার প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে প্রোপাগাণ্ডা ক্ষমতাও অন্তর্ভুক্ত। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি একটি স্কুল আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে রিপাবলিক গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে, প্রেসিম্যাকাস-এর মুখে। প্লেটোর সংলাপগুলোর প্রায় সব চরিত্রের মতো গ্রেসিম্যাকাসও ছিলেন একজন বাস্তব মানুষ। তিনি ছিলেন চেলসেডনের এক সফিস্ট এবং রেটোরিকের একজন বিখ্যাত শিক্ষক। খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ সালে অ্যারিস্টোফেনস-এর প্রথম কমেডিতে তার আবির্ভাব। সেফালাস নামক এক বৃদ্ধ, প্লেটোর দুই বড় ভাই গ্লাউকন ও এডিমেন্টাস-এর সঙ্গে সক্রেটিস জাস্টিস বিষয়ে সদাশয় আলাপ করছিলেন, প্রেসিম্যাকাস ক্রমবর্ধমান অধৈর্য নিয়ে তা শুনছিলেন, কিছু সময় পর তিনি এ রকম শিশুসুলভ বাজে কথাবার্তার প্রবল প্রতিবাদ করে ওঠেন। তিনি জোর দিয়ে ঘোষণা করেন, জাস্টিস অধিকতর বলশালীর স্বার্থ ছাড়া কিছুই নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি সক্রেটিস খণ্ডন করেছেন যুক্তির প্রধান দিক বাদ দিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে; কখনোই ন্যায্যভাবে এর মোকাবিলা করা হয়নি। নীতিবিদ্যা ও রাজনীতিতে এটি মৌলিক যে প্রশ্নটি উত্থাপন করে, তা হলো ভালো ও মন্দ শব্দ দুটি যে ব্যক্তি ব্যবহার করেন তার আকাঙ্ক্ষাগুলো ছাড়া ভালো ও মন্দর কি কোনো মাপকাঠি আছে? যদি না থাকে তাহলে প্রেসিম্যাকাস-এর টানা পরিণতিগুলোর অনেকগুলোকেই এড়ানো অসম্ভব বলে মনে হয়। তাহল কী করে আমরা বলব যে ভালো ও মন্দর কোনো মাপকাঠি আছে?

প্রথম দেখায় এই প্রশ্নের একটি সরল উত্তর আছে। ধর্মের মধ্যে কী ভালো আর কী মন্দ তা নির্ধারণ করেন ঈশ্বর, ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে যে মানুষের ইচ্ছা মিলে যায়, সে একজন ভালো মানুষ। তবু এই উত্তরটি ঠিক অর্থোডক্স নয়। ধর্মতাত্ত্বিকরা বলেন, ঈশ্বর ভালো, আর এর মানে হলো ভালোত্বের একটি মাপকাঠি আছে, যা ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন নয়। এভাবে আমরা একটি প্রশ্নের মুখোমুখি এসে পড়ি : তুষার সাদা, যে অর্থে এই বক্তব্যটি করা হয় সেই একই অর্থে সুখ ভালো-এই রকম বক্তব্যের মধ্যে কি কোনো বস্তুনিষ্ঠ সত্য বা মিথ্যা আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে খুব দীর্ঘ এক আলোচনার দরকার হবে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, বাস্তব প্রয়োজনে আমরা মৌলিক ইস্যুটি এড়িয়ে গিয়ে বলতে পারি : আমি জানি না বস্তুনিষ্ঠু সত্য বলতে কী বোঝায়, কিন্তু আমি একটি বক্তব্যকে সত্য বলে বিবেচনা করব, যদি সেটি পরখ করে যারা দেখেছে তাদের সবাই বা প্রায় সবাই সেটাকে সমর্থন করতে সম্মত হয়। এই বিবেচনায়, তুষার সাদা, সিজারকে হত্যা করা হয়েছিল, পানি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত ইত্যাদি সত্য বিবৃতি। তারপর আমরা একটি বাস্তব প্রশ্নের মুখোমুখি হই : নৈতিক বিষয়ে কি এ রকম অভিন্ন মতামত আছে? যদি থাকে তাহলে সেগুলোকে ব্যক্তিগত আচরণ এবং একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব উভয়ের ভিত্তি হিসেবে নেয়া যায়। আর যদি না থাকে, তাহলে দার্শনিক সত্য যাই হোক না কেন, বাস্তবে আমরা শক্তি বা প্রপাগাণ্ডা অথবা উভয়ের দ্বারা একটি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই, যখন ক্ষমতাধর গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি মীমাংসাতীত নৈতিক বিরোধ বিরাজ করে।

প্লেটোর জন্যে এই প্রশ্নর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। নাটকীয় বোধের গুণে যদিও তিনি প্রেসিম্যাকাসের অবস্থানটা জোরপূর্বক বিবৃত করেছেন, তবু আসলে তিনি এর শক্তি সম্পর্কে বেশ অনবহিতই ছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে তর্ক করতে গিয়ে বিরাট রকমের অন্যায় করেছেন। প্লেটোর বিশ্বাস যে ভালো বা শুভ আছে এবং এর প্রকৃতি অনুধাবন করা সম্ভব। যখন লোকেদের মধ্যে এ নিয়ে ঐকমত্য হয় না, তখন অন্তত তাদের একজন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একটি ভুল করে; তা যেন ঠিক কিছু বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে একটি বৈজ্ঞানিক অনৈক্যের মতো।

প্লেটো ও প্রেসিম্যাকাস-এর মধ্যকার পার্থক্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দর্শনের ইতিহাসবিদদের জন্যে এটা শুধু খেয়াল করার জিনিস, তা নিরসনের দায়িত্ব দর্শনের ইতিহাসবিদদের নয়। প্লেটো মনে করেন তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে তার আদর্শ রিপাবলিকটি ভাল; একজন গণতন্ত্রী, যিনি নৈতিকতার বস্তুনিষ্ঠতা স্বীকার করেন, তিনি মনে করতে পারেন যে প্লেটোর রিপাবলিক মন্দ-এ কথা তিনি প্রমাণ করতে পারবেন। কিন্তু প্রেসিম্যাকাসের সঙ্গে একমত পোষণকারী যে কেউ বলবেন, এখানে প্রমাণ করা বা না করার কোনো প্রশ্ন নেই; একমাত্র প্রশ্নটি হলো প্লেটোর কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রটি আপনার পছন্দ হয় কি না। যদি পছন্দ হয় তাহলে সেটা আপনার কাছে ভালো, যদি পছন্দ না হয় তাহলে আপনার কাছে সেটা খারাপ। যদি পছন্দকারীদের ও অপছন্দকারীদের সংখ্যা উভয়ই প্রচুর হয় তাহলে যুক্তির সাহায্যে এর কোনো সুরাহা হবে না, তখন শুধু বল প্রয়োগের দ্বারাই, দৃশ্যমান বা গুপ্ত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই এর মীমাংসা করতে হবে। দর্শনে এটা এখনো উন্মুক্ত ইস্যুগুলোর অন্যতম; উভয় পক্ষেই। এমন সব মানুষ আছেন যারা শ্রদ্ধা দাবি করেন। কিন্তু একটি দীর্ঘ সময় ধরে প্লেটোর সমর্থিত মতটি প্রায়ই অবিতর্কিত ছিল। আরো খেয়াল করা প্রয়োজন, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে মতামতের ঐক্যের বিকল্প বলে মনে করা হয় একটি বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ডকে, তার কিছু নির্দিষ্ট ফলাফল থাকে, যা কম লোকেই মেনে নেয়। গ্যালিলিওর মতো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকদের ব্যাপারে আমরা কী বলব, যিনি এমন একটি মতের প্রবক্তা, যে মতের সঙ্গে খুব কম লোকই একমত পোষণ করত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকেই তার মতকে সমর্থন করেছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকরা এমনটি করেন যুক্তিতর্কের সাহায্যে-আবেগী আবেদন, রাষ্ট্রীয় প্রপাগাণ্ডা বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। এতে এমন একটি মানদণ্ড আছে যা সাধারণ মতামতের চেয়ে ভিন্ন। নৈতিক বিষয়গুলোতে মহান ধর্মীয় গুরুদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কিছু আছে। যিশু বলেন, স্যাবাথ-এর দিন শস্য তোলা অন্যায় নয়, কিন্তু শত্রুকে ঘৃণা করা পাপ। এই ধরনের নৈতিক আবিষ্কার পরিষ্কারভাবে এমন এক মানদণ্ড নির্দেশ করে যা অধিকাংশের মতামতের চেয়ে আলাদা। কিন্তু এই মানদণ্ডটি যাই হোক না কেন, একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্নে তা কোনো বস্তুনিষ্ঠ সত্য নয়। এটি একটি কঠিন প্রশ্ন, আমি দাবি করি না এটি সমাধানে আমি সক্ষম। আপাতত এটি খেয়ালে রেখেই তুষ্ট থাকা যাক।

প্লেটোর রিপাবলিক, যা আধুনিক ইউটোপিয়াগুলোর মতো নয়, সম্ভবত সত্যি সত্যি প্রতিষ্ঠার জন্যেই পরিকল্পিত হয়েছিল। আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবে যেমনটা মনে হতে পারে, রিপাবলিক আসলে ততটা কাল্পনিক বা অসম্ভব ছিল না। আমাদের কাছে একেবারেই প্রয়োগযোগ্য নয় বলে মনে হয় এ রকম অনেক রীতিনীতিসহ রিপাবলিকের অনেক রীতিই স্পার্টায় বাস্তবায়িত হয়েছে। পিথাগোরাস দার্শনিকদের শাসন কায়েমের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নিজের যুগে প্লেটো যখন সিসিলি ও দক্ষিণ ইতালি ভ্রমণ করেন তখন তারাস-এ (আধুনিক তারাতো) পিথাগোরাসবাদী আরকাইটাস রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন। নগরীগুলোতে একটি সাধারণ রীতি ছিল আইন প্রণয়নের কাজে একজন ঋষি নিয়োগ করা। এথেন্স-এর জন্য এই কাজ করেছিলেন সোলন আর থুরির জন্য করেছিলেন প্রোটাগোরাস। সে যুগে কলোনিগুলো মূল নগরীর নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল; একদল প্লেটোবাদীর পক্ষে স্পেন বা গল-এর উপকূলগুলোতে তাদের রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা সহজেই সম্ভব হতে পারত। দুর্ভাগ্যক্রমে প্লেটোকে চলে যেতে হয়েছিল সিরাকুজে; সিরাকুজ একটি বিশাল বাণিজ্যনগরী ছিল, কারাথেজ-এর সঙ্গে সিরাকুজকে দুর্ধর্ষ যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে; এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো দার্শনিকই বেশি কিছু অর্জনে সক্ষম হতেন না। পরবর্তী যুগে মেসিডোনিয়ার উত্থানের ফলে সব ছোট ছোট রাষ্ট্র সেকেলে হয়ে পড়ে এবং ক্ষুদ্র আকারের সব রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *