২৭. বকুলের প্রকৃতিতে পারুলের মত

বকুলের প্রকৃতিতে পারুলের মত নিজের মধ্যে ডুবে, গভীরে তলিয়ে যাওয়ার সুখ নেই। বকুলের সে সময়ও নেই। বকুল বর্তমানের স্রোতের ধাক্কায় ছুটেই মলো জীবনভোর।

পারুলের কথা আলাদা।

পারুল চিরদিনই আত্মমগ্ন। এখন তো আরো বেশী হয়েছে। পারুলের চোখের সামনে গঙ্গার অফুরন্ত তরঙ্গ। পারুলের জীবনটা নিস্তরঙ্গ। সেই নিস্তব জীবনের মাঝখানে আচমকা একটা বড় ঢিল পড়ার মত তরঙ্গ তুলেছিল শম্পা নামের মেয়েটা, পারুলেরও যে এখনো কারো জন্যে কিছু করবার আছে, পারুল এখনো কারো প্রয়োজনে লাগতে পারে এ স্বাদ এনে দিয়েছিল, কিন্তু সেও তো মিলিয়ে গেল ক্ষণিক বুদবুদের মত।

আমাকে আর কারো কোনো দরকার নেই। এই এক শ্মশানের শান্তি নিয়ে আবার থিতিয়ে বসেছিল পারুল, আবার এক তরঙ্গ এলো তার জীবনে।

পারুলের ছেলে তার ছেলেকে রেখে গেল মায়ের কাছে। তার সমারোহময় জীবনে মার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল, রসুনচৌকি থেমে যাওয়া বিধ্বস্ত জীবনে আবার এলো সেই প্রয়োজন।

পারুল বলেছিল, ও কি একা এই বুড়ীর কাছে থাকতে পারবে?

ছেলে বলেছিল, পারা অভ্যাস করতে হবে। তা নইলেই তো বোর্ডিঙের জীবন? সেটা আমি চাইছি না–

হ্যাঁ, পারুলের ছেলে এখন আর চাইছে না ছেলেকে কনভেন্টে রেখে ‘সভ্যভাবে’ মানুষ করতে। অথচ কিছুদিন আগেও সে চাহিদা ছিল তার। আর একটু বড় হলেই কোথাও পাঠিয়ে দেবার বাসনা এবং চেষ্টা ছিল। হঠাৎ মন ঘুরে গেছে তার, সে ‘প্রাচীন কালে’র আদর্শে আর সনাতনী পদ্ধতিতে ছেলেকে মানুষ করতে চায়। অতএব মার কাছেই শ্রেয়। প্রথম দিন এর জন্যে ছেলেকে বকেছিল পারুল, বলেছিল, ছেলে-মেয়ে কি তোদের হাতের বল যে নিজেদের যখন যেমন মতিগতি হবে, তখন ওদের গতিও তাই হবে? এই কদিন আগেও তুই ওকে বলেছিলি, তুই সাহেব হ! আজ বলছিস, তুই সনাতনী হ! ছেলেমানুষ এ ধাক্কা সামলাতে পারবে কেন?

ছেলে বলেছিল, জীবনে আরও অনেক বড় ধাক্কা আসতে পারে মা, এটা ধরো সেটা সইবার ক্ষমতা-অর্জনের প্রস্তুতি।

তা আমার কাছে যে দিচ্ছিস, আমাকে কি তোর খুব সনাতনী মনে হয়? আমি তো একটা সর্বসংস্কারবর্জিত কালাপাহাড়।

ছেলে মার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেছিল, তবু তো খাঁটি! নির্ভেজাল কালাপাহাড়! ভেজাল দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি মা!

তবে দিয়ে যা ছেলেকে। তবে গ্যারান্টি দিতে পারব না বাপু, তোমার ছেলেকে তোমার মনের মত গড়ে তুলতে পারব কিনা। তুই আমাকে যা ভাবছিস, আমি সত্যি তাই কিনা, তাতে আমার নিজেরই ঘোরতর সন্দেহ আছে।

তোমার থাকে থাক, আমার নেই। বলে চলে গিয়েছিল ছেলে।

পারুলের বড় একটা যা হয় না তাই হয়েছিল। পারুলের চোখে জল এসে গিয়েছিল। আমায় কেউ বুঝতে পারল, আমায় সেই বোঝার মধ্য দিয়ে সে বিশ্বাস করল, এর থেকে আহ্লাদের কি আছে? আর সে স্বীকৃতি যদি আপন সন্তানের কাছ থেকে আসে, তার থেকে মূল্যবান বুঝি কিছু নেই।

তা স্বয়ং ভগবানই নাকি ওই স্বীকৃতির কাঙাল, তিনিও তার গঠিত সন্তানদের কাছে ভিক্ষাপাত্র পেতে ধরে বলেছেন, তুই আমায় বোঝ, আমায় জান্। আমি যে কী তা একবার উপলব্ধি কর। তবে? মানুষ কোন্ ছার!

.

কিন্তু ছেলের এই ছেলেটাকে নিয়ে মুশকিলেই আছে পারুল। এত গম্ভীর হয়ে গেছে সে, যেন পাথর কী কাঠ! ওর কোনখানটা দিয়ে যে একটু ঢুকে পড়ে মনটা ছুঁতে পারবে, বুঝতে পারে না।

গল্প বলে, ছড়া শিখোবার চেষ্টা করে নিজেদের ছেলেবেলার কাহিনী শুনিয়ে, ওরই বাবার ছোটবেলার দুষ্টুমির আর বায়না আবদারের বিশদ বর্ণনা করে ওই গাম্ভীর্যের পাষাণপ্রাচীরে এতটুকু ফাটল ধরাতে পারছে না পারুল।

একেবারে যে হাসে না তা নয়, হাসির গল্প শুনে একটু হাসে। সদ্য শোকগ্রস্ত মলিনচিত্ত মানুষ শিশুর হাসিখেলা দেখলে যেমন একটু প্রাণহীন হাসি হাসে তেমন হাসি। যেন পারুল যে ওর জন্যে এতটা চেষ্টা করছে, সেটা বুঝে একবিন্দু কৃতজ্ঞতার কুণ্ঠিত হাসি।

পারুল বলে, তুই একটা বুড়ো! পুরো বুড়ো! তোর যত ভাল আর শৌখিন নামই থাকুক, আমি তোকে “বুড়ো” বলে ডাকবো, এই আমার সঙ্কল্প।

বুড়ো একটু বুড়োটে হাসি হেসে বলে, তা ডাক না। ভালই তো।

পারুল রাগ দেখিয়ে বলে, আচ্ছা, তুই এমন নিক্তিমাপা হাসি হাসতে শিখলি কোথা থেকে বল তো? আমাদের ছেলেবেলায় আমাদের জোরে জোরে হাসিটা ছিল মহা দোষের, হেসে উঠলেই ধমক। তবু আমরা হেসে উঠতাম। আর তুই বাবা কেমন মেপে মেপে হাসি অভ্যেস করেছিস!

বুড়ো তার উত্তরে আরো শীর্ণ হাসি হেসে বলে, আমি তো খুব হাসি।

এর মধ্যে কোন্ ফাটল দিয়ে ঢুকবে পারুল? আশ্চর্য সংযম ওইটুকু ছেলের!

এমন সাবধানে কথা বলে, যেন ওর ‘অতীত’ বলে কিছু নেই, কিছু ছিল না। ও যেন কেবলমাত্রই এই চন্দননগরের পারুলের ‘বুড়ো’।

মা বাপ বোন, কি নিজের হারিয়ে ফেলা জীবনের কোন কথার ছন্দাংশও অসতর্কে কোনো সময় বেরিয়ে পড়ে না বুড়োর মুখ দিয়ে।

বুড়ো যেন ভূঁইফোড়।

পারল হয়তো অন্যমনস্কের বশে কোনোদিন বলে বসে, এ সময় তুই কী খেতিস? ছুটির দুপুরে তুই কি করতিস?

বুড়ো অবলীলায় বলে, মনে নেই।

পারুল বলে, বুড়ো, তোর বাবার চিঠি এসেছে। তোর আর আমার একটা খামের মধ্যে, আয় আমরা দুজনে দুটো চিঠি লিখে খামে পুরে পাঠাই। আমারটা লিখছি–তোরটা লেখ।

এইভাবে ছড়িয়ে গুছিয়ে বলে। তবু বুড়ো অম্লানমুখে বলে, তুমি তো সব খবরই লিখেছ-

ওমা! আমি লিখছি আমার ছেলেকে, আর তুই লিখবি তোর বাবাকে, দুটো বুঝি এক হল? আয় আয়, তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলে উত্তরটা লিখে ফেল, ডাকের সময় চলে যাবে।

বুড়ো আসেও না, চিঠি লেখা তো দূরের কথা, পড়েও না। হাতেই নেয় না, বলে, এখন লিখতে ইচ্ছে করছে না, তুমি পাঠিয়ে দাও।

বলে, এখন অঙ্ক কষছি, পরে পড়ব।

পারুল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

পারুলের ওর আগের চেহারাটা মনে পড়ে যায়।

আগে আগে দু-একদিনের জন্যে বাপ-মার সঙ্গে বেড়াতে আসত, ‘বাপী বাপী’ করে কী বায়নাই করত!

বাপী, আমায় এক্ষুনি বেড়াতে নিয়ে চল। বাপী, আমি এক্ষুনি নৌকো চেপে গঙ্গায় ভাসবো। বাপী, তুমি যে বলেছিলে–একটা তিনকোণা এরোপ্লেন কিনে দেবে, এক্ষুনি দাও।

বাপী বাপী বাপী!

বাপীর জীবন মহানিশা করে তুলত, গলা ধরে ঝুলে পড়ে, পিঠের ওপর লাফিয়ে চড়ে বসে।

বাপী যদি বলত, এখন গঙ্গায় জোয়ার, এখন নৌকোয় চড়ে না।

অবলীলায় বলত, মেরে হাড় ভেঙে দেব তোমার!

‘মা-মণি’ সম্পর্কে অবশ্য একটু সমীহ ভাব ছিল। এমন কথা মাকে বলতে সাহস করত না। মা বলত, নিজের মান নিজে রাখতে জানে না, তাই ছেলের অতো সাহস!

তবু মা-মণি-অন্ত প্রাণও তো ছিল।

আর ছোট্ট সেই বোনটার ওপর? আহা, একেবারে সাতখানা প্রাণ বোনের গুণপনায়, বোনের বোকামিতে আহ্লাদে বিগলিত।

পারুলকে ডেকে ডেকে উচ্ছ্বসিত সেই মন্তব্য মনে পড়ে যায় পারুলের।

দিদি দিদি, শোন! লিলিফুলটা এমন না বোকা! টফিটা ফেলে দিয়ে কাগজটাই খেতে লেগে গেছে।

দিদি দিদি, লিলিফুলটার বড় হবার কী দারুণ শখ দেখ, নিজের জুতো ফেলে রেখে বাপীর জুতো পরে বেড়াচ্ছে–

উচ্ছ্বসিত কলকণ্ঠ।

যে দু-তিনটে দিন থাকত, মুখর করে রাখত গঙ্গাতীরের এই নিস্তরঙ্গ বাড়িখানা।

সেই ছেলেটাই!

সেই ছেলেটাই এ বাড়ির মৌন দেয়ালগুলোকে যেন ডবল ভারী করে তুলেছে। কেউ নেই, কেউ কথা বলার নেই, সে একরকমের শান্ত স্তব্ধতা, কিন্তু একজন আছে, যাব হঠাৎ হঠাৎ বাঁশীর মত বেজে ওঠার কথা, ঝর্ণার মত কলকলিয়ে ওঠবার কথা, সে যদি নিথর হয়ে থাকে, সে স্তব্ধতায় দম আটকে আসে।

পৃথিবীর তিক্ত অভিজ্ঞতায় বুড়িয়ে যাওয়া একটা শিশুর ভার যে কত গুরুভার, সেটা অহরহ অনুভব করছে পারুল। অনুভব করতে পারছে ওই স্তব্ধতার অন্তরালে কী যন্ত্রণার ঝড় বইছে।

এই তো ছিল গৌরবের উচ্চ রাজাসনে, হঠাৎ নেমে আসতে হল রিক্ত নিঃস্ব এক অগেীরবের রুক্ষ ভূমিতে। সেখানে কোথাও কোনোখানে স্নেহ নেই, মমতা নেই, ত্যাগ নেই।

না, ওদের জন্যে কেউ ত্যাগস্বীকারে রাজী নয়। ওরা গুঁড়ো হয়ে যাক, ওদের ওপরওয়ালা অটল থাকবে আপন হৃদয়সমস্যা নিয়ে।

পারুল মনে মনে বলে, সব যুগেরই বলি আছে, তোরাই এ যুগের বলি। আমাদের অন্ধকার যুগে আমরা ছিলাম অন্ধ কুসংস্কারের বলি, আর এই আলোর যুগে তোরা হচ্ছিস সভ্যতার বলি।

তবু চেষ্টা করে পারুল।

ডাক দেয়, বুড়ো আয়, বুড়ীর মাথার পাকা চুল তুলে দে

বুড়ো বই হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায়। অহরহ হাতে বই। গল্পের বই নয়, পড়ার বই।

ওই বই-খাতাই যেন তার আত্মরক্ষার অস্ত্র।

যেন তলোয়ারের মুখে ঢাল। ডাকলে সব সময় বই নিয়ে এসে দাঁড়ায়।

এসে বলে, তোমার তো পাকা চুল নেই

আছে রে আছে। ভেতরে আছে, খুঁজে দেয়।

বুড়ো নির্লিপ্তভাবে বলে, ও তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না। বলে চলে যায়।

পারুল ডাকে, বুড়ো আয়, একটা ফার্স্ট ক্লাস খাবার করছি, চটপট চলে আয়—

বুড়ো এঘর থেকে বলে, আমার এখন খিদে পায়নি।

আরে বাবা, তুই আয়ই না, দেখলেই খিদে পেয়ে যাবে! এমন জিনিস, তুই নামই শুনিসনি

নিতান্ত অনিচ্ছুক মূর্তিতে এসে দাঁড়ায় ছেলেটা।

পারুল অতিরিক্ত উৎসাহ দেখিয়ে বলে, বল তো এগুলো কী?

নাতি ভাববার চেষ্টামাত্র না করে মাথা নেড়ে বলে, জানি না।

জানবি কোথা থেকে? এসব হল সেকেলে জিনিস। আমার শাশুড়ী বানাতেন। তোর বাবা বলত, ঠাকুমা, রোজ রোজ কেন বকুল-পিঠে কর না? আসলে এর নাম হচ্ছে গোকুল পিঠে, বুঝলি? তোর বাবা বুঝতে না পেরে বলত “বকুল-পিঠে”। এদিকে ওর মাসির নাম, মানে আমার বোনের নাম তো বকুল, তাই তোদের যিনি দাদু ছিলেন, তিনি বলতেন, তার চেয়ে বল না কেন মাসি-পিঠে?

হি হি করে হাসতে হাসতে রস থেকে প্লেটে তুলে এগিয়ে ধরে পারুল।

কিন্তু ছেলেটা পারুলের মত চেষ্টাকৃত কৌতুকের আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়ে নিস্তেজ গলায় বলে, পরে খাবো।

আর কী করবে পারুল? আর কী করতে পারে?

স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়েই তো চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা জীবনে-পোড়-খাওয়া শিশুর নিরুত্তাপ নির্লিপ্ততার স্পর্শে চেষ্টাটা হাস্যকরভাবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে নিজের কাছে।

তখন পারুলের ওই ছোট ছেলেটার কাছে নিজের বাচালতার জন্যে লজ্জা করছে, লজ্জা করছে কৃত্রিমতার জন্যে। মনে হচ্ছে, পারুল বুঝি এতক্ষণ ভাড়ামি করল!…কিন্তু ওই ছেলেটা কি তার গভীর বেদনার ঘরের বন্ধ দরজাটা একটু খুলে ধরবে, যেখান দিয়ে পারুল পারবে। আস্তে আস্তে ঢুকে যেতে! সে ঘরে চুপ করে বসে থেকে ওর মনের বেদনার ভার নিতে পারবে পারুল!

তা দেবে না।

আশ্চর্য রকমের কঠিন হয়ে গেছে ছেলেটা।

অথবা নিজের ভিতরের সেই গভীর ক্ষতটাকে জগতের কাউকেই দেখাতে চায় না ও।

মনে মনে নিজের ছেলেকে উদ্দেশ করে বলে পারুল, তুই ভেবে সন্তোষ পাচ্ছিস, অন্ততঃ ছেলেটাকে তুই পেয়েছিস, কিন্তু পরে বুঝবি ওটাকেই তুই একেবারে হারিয়েছিস!

এখন আর নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে শুধু একটা শান্ত উপলব্ধির জগতের স্বাদ গ্রহণের সময় নেই, এখন সারাক্ষণ শুধু এই। এখন পারুল মৃদু হাসির সঙ্গে ভাবে জগতে কিছুই অমনি পাওয়া যায় না, সব কিছুর জন্যেই মূল্য দিতে হয়। আমাকে ওদের প্রয়োজন হচ্ছে এই পাওয়াটার জন্যে মূল্য ধরে দিতে হচ্ছে আমাকে, আমার সেই অনাহত অবকাশের গভীর স্বাদটিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *