২৬-৩০. ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল

২৬.

ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল ইউরোপের প্রমোদ বিলাসীদের অন্যতম গন্তব্য স্থান। এখানে জুয়া খেলার জন্য অনেকে আসেন, একদা বিখ্যাত বেলভিউ ক্যাসিনো মেরামতির জন্য দীর্ঘকাল ধরে বন্ধ। এখন নতুন ক্যাসিনো চালু হয়েছে। বেশির ভাগ ধন কুবেরের নিজস্ব বাড়ি আছে এই অঞ্চলে। যাদের নেই তারা ওঠেন হোটেল দ্যু-প্যালেতে, এটি ছিল তৃতীয় নেপোলিয়ানের প্রাসাদ।

একদিন ওই হোটেলে ঢুকলেন মার্গারিয়েট দ্য স্যান্তিনি। যেমন দামী পোশাক তার তেমনই সুন্দর তার রূপ যৌবনের বাহার। সকলে হাঁ করে তাকে গিলতে থাকলো। কাউন্টারে গিয়ে নিজের সুইটের চাবি চাইলেন ব্যারনেস, সুইটের কাছে পৌঁছেছেন এমন সময় চশমা পরা এক বিধস্ত চেহারার ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ভ্যানিটি ব্যাগ। বার বার ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেন ওই ভদ্রলোক।

ব্যারনেসের সুইটের নম্বর ৩১২, এটাই ওই হোটেলের সেরা সুইট। বেডরুমে ঢুকে ব্যারনেস তার পরচুল আর পোশাক খুলে ফেললেন। এবার বেরিয়ে এল ট্রেসির আসল রূপ।

যার সঙ্গে ধাক্কা খেলাম লোকটা কে? ট্রেসি কিছুক্ষণ চিন্তা করল।

সন্ধ্যে আটটার সময় হোটেলের বারে বসে ব্যারনেস শ্যাম্পেন খাচ্ছিলেন, এমন সময় সেই ধাক্কা খাওয়া পুরুষটি এগিয়ে এলেন। সকালের ঘটনাটার জন্য ভীষণভাবে লজ্জিত ঠিক আছে।

–আপনি খুব ক্ষমাশীল দেখছি, যদি কিছু মনে না করেন আমি কিছু খাওয়াই আপনাকে।

–ঠিক আছে।

ভদ্রলোক বসলেন ট্রেসির সামনে। আমি অধ্যাপক অ্যাডিলফ জুফারম্যান।

–আমি মার্গারিয়েট দ্য স্যান্তিনি।

–কি খাবেন? না না খুব দামী কিছু খাওয়াবার মতো অবস্থায় আসতে পারিনি।

–তার মানে?

–কিছুই না, একজন দরিদ্র অধ্যাপক ছিলাম আমি, ইতিহাস পড়াতাম, স্প্যানিশ আর্মাডা নিয়ে গবেষণা করতে করতে জানতে পারলাম ১৫৮৮ সালে প্রিন্স ফিলিপের সোনা ভর্তি একটা জাহাজ ডুবে যায়। আমি তার ম্যাপটা খুঁজে পেয়েছি, অর্থাৎ জাহাজটা কোথায় ডুবেছে।

জুফারম্যান শেষের কথাগুলো বললেন একটু গলা নামিয়ে।

–কী অসাধারণ আবিষ্কার আপনার, ট্রেসির গলায় প্রশংসার সুর।

–ওখানে যা সোনা আছে তার বাজার দর পাঁচকোটি ডলার। জুফারম্যান বলছিলেন–আমার কাজ শুধু সেগুলো উদ্ধার করা।

–বাধাটা কোথায়?

–টাকা পয়সা। অভিযানে যেতে গেলে অনেক খরচ হবে।

–কত টাকা দরকার?

–এক লাখ ডলার। আমি আমার শেষ পুঁজি কুড়ি হাজার ডলার নিয়ে এখানে এসেছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম জুয়ায় জিতে এক লাখ ডলার নেবো। কিন্তু…

–কিন্তু সব হেরে বসে আছেন?

শ্যাম্পনে চুমুক দিতে দিতে ট্রেসি বলল–কিন্তু ওখানে যে সোনা আছে এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত?

–একশো পার্সেন্ট, পুরনো ম্যাপটি আমি পেয়েছি।

–এক লাখ ডলারে কার্যোদ্ধার হবে? ট্রেসি জানতে চাইলো।

–নিশ্চয়ই।

–পার্টনার নিলে হয় না?

–না না, অধ্যাপক মাথা নাড়লেন। এটা আমার সারজীবনের সাধনার ধন, আমি কাউকে বখরা দেব না।

–আপনার সব সঞ্চয় তো শেষ হয়ে গেছে। ধরুন আমি যদি একলাখ ডলার দিই।

–না, ব্যারনেস তা হয় না, আপনার মতো এক মহিলাকে এর মধ্যে জড়াতে পারবো না।

অনেক সাধ্য সাধনার পর ট্রেসি প্রফেসরকে রাজী করলো, যা সোনা উদ্ধার হবে তা আধাআধি বখরা। দুজনে মদের গ্লাস ঠেকিয়ে ব্যবসা পাকা করলেন। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ ট্রেসি দেখল দারুণ গয়না পরা এক সুন্দরী মহিলার সাথে এক কোণে টেবিলে বসে আছে জেফ। তার দিকে তাকিয়ে সে হাসছে।

অধ্যাপক খুশি হয়ে চলে গেলেন বন্দোবস্ত করতে। ট্রেসি দুদিন বাদে টাকাটা দেবে। কয়েক মিনিটের জন্য জেফ চলে এল ট্রেসির টেবিলে।

-কী চমৎকার লাগছে তোমাকে, প্রফেসরের চেয়ারটায় বসতে বসতে জেফ বলল–মাতিগনির বাড়ির কাজটা নিখুঁত হয়েছে একথা বলতেই হবে।

–তোমার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া সৌভাগ্যের কথা-ট্রেসি হাসতে হাসতে বলল।

–তা প্রফেসার জুফারম্যান কি বলছিলেন?

–তুমি চেনো ওকে, ট্রেসি অবাক হয়েছে।

–হ্যাঁ, ডুবো জাহাজের সোনার কথা নিশ্চয়ই বলেছেন তোমাকে।

–তুমি কী করে জানলে?

–আরে এই ধরনের জোচ্চুরির খেলা বহুদিন ধরে চলে আসছে।

–এটা কিন্তু মিথ্যে নয়।

–বলো কি ট্রেসি? তুমি জুফারম্যানের কথা বিশ্বাস করেছে? এরপর হয়তো বলবে মোটা টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছো?

–আমার ব্যাপারে তুমি নাক গলাবে না জেফ। টাকাটা আমার তাই আমি যা খুশি তাই করতে পারি।

–নিশ্চয়ই, কিন্তু পরে বোলো না জেফ তোমাকে সাবধান করে দেয়নি।

–ওই সোনার ব্যাপারে তোমার কোনো আগ্রহ নেই?

–আচ্ছা ট্রেসি তুমি সব ব্যাপারে সন্দেহ করো কেন বলোত?

–সোজা কথা আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তোমার সঙ্গে ওই মেয়েমানুষটা কে?

–সুসান।

–ধনী নিশ্চয়ই…

–তা বলতে পারো। বাদ দাও ওসব কথা। এখানকার বিখ্যাত গেলোটা খেলা দেখতে যাবে?

–যাবো, ট্রেসি না বলতে পারলো না।

সিমেন্ট কংক্রিটের দেওয়ালে বল ছুঁড়ে মারতে হয়, বলটা যখন ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে তখন হাতের সঙ্গে বাঁধা লম্বা সরু ঝুড়িতে সেটাকে ধরে দিতে হবে। খুবই উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এক সময় দুদল সমর্থকদের মারামারি লেগে গেল। ভীড়ের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ট্রেসিকে বুকের মধ্যে আড়াল করার চেষ্টা করতে গিয়ে দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল। ভীড় কমলো, ট্রেসিকে টেনে তুলল জেফ। ট্রেসি তাড়াতাড়ি নিজেকে জেফের বাহু বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিল, কিন্তু তার মনের মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ জেগেছে।–তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরলো ট্রেসি। যাবার আগে জেফ শেষবারের মতো বলে গেল ডোরা জাহাজের সোনা সম্বন্ধে যেন আরেকবার চিন্তা করে।

ঘরে আসতেই দেখে প্রফেসর জুফারম্যানের চিঠি।

প্রফেসর জুফারম্যান বিরাট সংকটের মুখে পড়েছেন। আমান্দ গ্র্যাঞ্জিয়ারের দপ্তরে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমান্দ-এর একটা ব্যক্তিগত ক্যাসিনো আছে। সেখানে নির্দিষ্ট অংকের জুয়া চলে। তুমুল উত্তেজনার মধ্যে আমার ক্যাসিনোয় লক্ষ লক্ষ ডলারের খেলা হয়। জুয়ার যন্ত্রগুলোর মধ্যে কারচুপি থাকে।

এই বিয়ারিজে সামান্য অবস্থায় এসেছিল আর্মা। ধীরে ধীরে অসৎ পথে প্রচুর পয়সার মালিক হয়েছে। পুলিশ মহল থেকে সকলেকে হাত করেছে। বেঁটে-খাটো চেহারার মধ্যে বুদ্ধির ছাপ, আর ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকে রমণী-মোহন হাসি।

–এই ব্যারনেস সম্বন্ধে তুমি কী জানো? আমার কণ্ঠস্বরে এমন একটা হিংস্রতা ফুটে উঠেছিল যে প্রফেসর কাঁপতে শুরু করে দিলেন।

–বলছিল সে ধনী বিধবা, অনেক টাকা আছে… প্রফেসরের কথা শেষ হবার আগেই আমান্দ বলল–মিথ্যা কথা বলেছে, একটু আগে আমাদের প্যারিসের এজেন্ট খবর দিয়েছে। ব্যারনেসের পাশপোর্টটা তারই জাল করা। ওর আসল নাম ট্রেসি হুইটনি।

–কিন্তু সর্দার, ব্যারনেস সত্যিই টাকাটা দিতে চায়।

–ঠিক আছে। দেখছি ও কত বড়ো জোচ্চোর। তুমি এখুনি মেয়েটাকে ফোন করে জানাও অন্য একজন অর্ধেক টাকা দিতে রাজী হয়েছে। সে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে সমুদ্রের তীরে। ওকে নিয়ে এসো ওখানে, তারপর দেখাচ্ছি মজা।

আর্মান্দ গ্র্যাঞ্জিয়ার বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। মাঝেমধ্যে যারা সোনার, ফাঁদে পা দেয় তারা বোকা কিন্তু এই মেয়েটা একজন সেরা জোচ্চোর, তবে কেন ওই ফাঁদে পা দিচ্ছে?

কী ভেবে আমান্দ চলে এল ট্রেসির হোটেলে। ডেস্ক ক্লার্ক তার অনুগত লোক। ব্যারনেসের সব খবর এবং সুইটে ঢোকার চাবি নিয়ে চুপি চুপি চলে এল ট্রেসির ঘরে। দরজার সামনে পৌঁছে দেখলো সেটা আধ ভেজানো।

–হ্যালো কে এলেন; আমি বাথরুমে আছি, এখুনি আসছি, ট্রেসির গলা শোনা গেল।

ধীর পায়ে আমান্দ চলে এল শোবার ঘরে। খাটের ওপর পোশাক আর দামী গয়না, ছড়ানো। বাথরুম থেকে আবার ট্রেসির গলা শোনা গেল। প্রফেসর একটু বসুন। এক মিনিটে আসছি। ফ্রিজে মদ আছে নিয়ে ততক্ষণ খান।

–তাড়াতাড়ি করার দরকার নেই ব্যারনেস।

ব্যারনেস? তোমার শয়তানি আমি শিগগীরই ঘোচাবো।

তালা দেওয়া পাশের ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল আর্মা। চাবি দিয়ে খুলতেই দেখলো যে ঘরটা প্রায় ফাঁকা। এমন ঘর কেউ কি টাকা দিয়ে ভাড়া নেয়? হঠাৎ তার নজরে পড়ল প্লাগ থেকে একটা মোটা তার পাশের কাঠের আলমারির মধ্যে ঢুকে গেছে।

খুলতেই দেখা গেল আলমারির মধ্যে সুতোতে ক্লিপ দিয়ে ঝোলানো আছে কয়েকটা একশো ডলারের ভিজে নোট। টাইপ রাইটারের মতো ছোট্ট একটা মেসিন কাপড়ে ঢাকা।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন গর্জন করলো, এখানে আপনি কি করছেন? আর্মাল চমকে ফিরে তাকালো, ট্রেসি হুইটনি তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমান্দ খুব আস্তে আস্তে বলল–জাল নোট? এই জাল তুমি আমাদের দিতে চেয়েছিলে?

ট্রেসির মুখে অস্বীকৃতি, অপমান এবং প্রতিবাদের ছাপ।

–তাই যদি হয়, ট্রেসি বলল, তাহলে অন্যায়ের কিছু নেই। এগুলোর সঙ্গে আসল নোটের কোনো পার্থক্য নেই।

আমান্দ একটা নোট আলোতে তুলে পরীক্ষা করে দেখলো হ্যাঁ, প্রায় নিখুঁত।

–আগামী শুক্রবারের মধ্যে আমার একলাখ ডলার দরকার, তাই ছাপছি। আমান্দ হেসে ফেলল, সেই সঙ্গে চমকেও উঠলো, মাই গড, তুমি কি সত্যিই ডোবা জাহাজের সোনার কথা বিশ্বাস করেছো?

–কেন? প্রফেসর জুফারম্যানের মতো পন্ডিত লোক?

–নির্বোধ, ওটা ভাওতা, শোনো ব্যারনেস, আমি হুকুম না দেওয়া পর্যন্ত হোটেল ছাড়া যাবে না।

 আমান্দ গ্রাঞ্জিয়ার ট্রেসিকে ব্রুনোর হাতে তুলে দেয়ার আগে নোটগুলোকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলো। জুফারম্যানকে একটা নোট দিয়ে পাঠালো ব্যাঙ্কে। যদি নোটটা জাল হয় তাহলে জুফারম্যান জেলে যাবে। তাই যাক বোকা হাঁদাটা।

কিন্তু কি আশ্চর্য নোট ভাঙানো হয়ে গেল। এবার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হবার জন্য ট্রেসির ছাপা আরও দুটো নোট দিয়ে জুফারম্যানকে পাঠালো ব্যাঙ্কে।

–দেখুন ম্যানেজার, কাল জুয়াখেলায় বেশ কিছু মার্কিন ডলার আমি জিতেছি। আমার সন্দেহ হচ্ছে আমাকে জাল নোট গছিয়েছে। দেখুন তো দয়া করে, প্রফেসর জুফারম্যান নিরীহভাবে কথাটা পাড়লেন ব্যাঙ্কে, মেশিন পরীক্ষা করে জানালো দুটো নোটই খাঁটি।

খবরটা পেয়ে আমান্দ তখন দ্রুত চিন্তা করে নিল। এবার ট্রেসিকে অন্য ব্যাপারে দরকার।

আর্মান্দ বলল–আমার দুজনে পার্টনার হয়ে কাজ করবো।

ট্রেসি বলল, না, এসব কাজে পার্টনারশিপ আমি পছন্দ করি না।

–এই শহরটা আমার। ওই নোটটা চালাবার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি বিপদে পড়বে। তুমি নিশ্চয়ই জানো জেলখানায় তোমার মতো সুন্দরী মেয়েদের কি হাল হয়? প্রাণের মায়া থাকে তো আমার কথা মেনে চল।

ট্রেসি বুঝতে পেরে চুপ করে রইল।

আর্মা জানতে চাইলো, এবার বলল, ছাপাখানাটা কোথা থেকে পেয়েছো?

ট্রেসি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল–এক মার্কিন ভদ্রলোক আমেরিকার টাকশালে খোদাইয়ের কাজ করতেন, পঁচিশ বছর চাকরি করার পর অবসর নিয়েছিলেন। সামান্য কারণ দেখিয়ে তার পেনশন আটকে দেওয়া হয়। প্রতিশোধ নেবার জন্য কয়েকটা ছাঁচ চুরি করে নিয়ে চলে আসেন। উনি সুইজারল্যান্ডে থাকেন। ওঁর কাছ থেকে আমি কিনেছি ওগুলো। ট্রেজারী ডিপার্টমেন্টের লোক জানাশোনা আছে, সেখান থেকে নোটের কাগজ জোগাড় করি।

আর্মান্দ এবার নিশ্চিন্ত হল, তাই নোটগুলো একেবারে আসলের মতো।

–একদিনে কটা নোট ছাপা যায় ওই মেশিনে?

–ঘন্টায় একটা।

–আরও বড়ো মেশিন আছে?

–আছে, আট ঘন্টায় পঞ্চাশটা ছাপা যায়। কিন্তু সেটার দাম চেয়েছিলেন পাঁচ লক্ষ ডলার।

–ওটা কিনে ফেলল।

–আমার অত টাকা নেই।

–আমার আছে, এই বলে আর্মান্দ চোখ তুলে কাকে যেন ডাকলো। ওক্যাসিনোর ব্যাঙ্ক-এর ভল্ট থেকে এখুনি পাঁচ লক্ষ ডলারের সমান ট্র্য নিয়ে এসো।

–মানে আপনি কি এখুনি।

–হ্যাঁ, এখুনি চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

তারপর মনে মনে ভাবলো মেশিনটা পেয়ে নোট ছেপে ক্যাসিনোর ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেবে আর প্রয়োজন হলে পার্টনারদের জানাবে। আর মেশিনটা হাতে আসার পর ব্রুনো এই মেয়েটার ভার নেবে।

দুঘন্টার মধ্যে বড়ো ব্যাগে ভর্তি টাকা এসে গেল।

–নাও ফোন করো সুইজারল্যান্ডে।

–ফোন নম্বরটা হোটেলে আছে।

–চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। টাকা নিয়ে যাও।

মেশিন এয়ারপোর্টে নামলেই আমরা ডেলিভারী নিয়ে নেবো। সঙ্গে জুফারম্যান যাচ্ছে সে নজরে রাখবে। রাত আটটার সময় দেখা হবে, তার মধ্যে সব কাজ শেষ করতেই হবে।

আমান্দ গ্র্যাঞ্জিয়ার সারা দিন সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলো। আধ ঘন্টায় ৫০টা সারাদিনে দেড়শো, মানে পনেরো হাজার ডলার, সপ্তাহে এক লাখ। দশ সপ্তাহে দশ লাখ–আর্মান্দ আর ভাবতে পারছে না।

ঠিক রাত আটটার সময় সে পৌঁছলো হোটেল দ্যু পালেতে। লবিতে একভাবে বসে আছে জুফারম্যান। ওপর থেকে নামার দরজাতে কড়া নজর তার।

আহা বেচারী, মনে মনে ভাবলো আর্মান্দ।

ডেস্কের কাছে গিয়ে ব্যারনেসের খবর নিলো, শুনলো উনি চলে গেছেন। তবে জিনিসপত্র নিয়ে যাননি শুনে আমান্দ নিশ্চিন্ত হল। তার মানে মেয়েটা বোধহয় সুইজারল্যান্ডে গেছে মেশিনটা আনতে।

ট্রেসির সুইট যেমন ছিল তেমনই আছে। পাশের ঘরটা খুলে দেখলো মেশিনটা এখনও আছে। তার মানে পাঁচ লাখ ডলার নিয়ে পালালেও আসল মালটা নিতে পারেনি। এরপর ওকে জেলের ঘানি টানতেই হবে।

অনেক ভেবে চিন্তে আমান্দ পুলিশে ফোন করলো, মিনিট পনেরো বাদে ইন্সপেক্টর দুমোন্ত উপস্থিত হলেন। সঙ্গে একজন কুৎসিত দর্শন মানুষ। এই ইন্সপেক্টর আমান্দর বিশেষ পরিচিত।

–ইনি হলেন মিঃ ড্যানিয়েল কুপার, ইনিও ওই ট্রেসি মেয়েটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কুপার বলল–আপনি জানিয়েছেন ওই মেয়েটা নোট জাল করে?

–হ্যাঁ প্রমাণ আছে, বলে কাঠের আলমারিটা খুলে মেশিনটা দেখিয়ে আমান্দ জানালো এই মেশিনে নোট ছাপানো হয়। এই দেখুন ছাপানো নোট।

কুপার নোটটা আর মেশিনটাকে ভালো করে পরীক্ষা করে বলল–নোটটা আসল আর এটা চিঠির কাগজ ছাপার মেশিন।

চিঠির কাগজ ছাপার মেশিন, আর্তনাদ করে উঠল আর্মা–তার মানে? মনে মনে। ভাবলো, মেয়েটা ডোবাজাহাজের সোনার ফাঁদে পা দেয়নি, উল্টে তাদের বুদ্ধ বানিয়ে পাঁচলাখ ডলার নিয়ে চলে গেছে।

–মেয়েটার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যায় কি?

ইন্সপেক্টর দুমোন্তের প্রশ্ন শুনে আমান্দ রেগে গিয়ে বলল, না, সেসব কিছুই করা চলবে না। মনে মনে ভাবতে লাগলো সে পার্টনারদের কি বলবে। তার থেকে আফ্রিকায় পালিয়ে যাওয়া ভালো।

ড্যানিয়েল কুপার ভাবছিলো আরও একবার ফসকে চলে গেছে, কিন্তু পরের বার ওকে ধরতেই হবে।

.

২৭.

হারটগকে বলা ছিল সে যেন মাজোবকায় এসে দেখা করে। ছবির মতো সুন্দর এই মাজোবকা দ্বীপ। একসময় এটি ছিল জলদস্যুদের প্রিয় আস্তানা। হারটগ লন্ডন থেকে ফোন করে একটা নতুন কাজের কথা জানিয়েছিল, তাই দেখা করা দরকার।

বিয়ারিৎজ ছাড়ার পর ইন্টারপোল ট্রেসিকে অনুসরণ করে মাজোবকায় হাজির হয়েছে। সমভিদা হোটেলে ট্রেসির সুইটের ওপর চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখছে পুলিশ।

ড্যানিয়েল কুপার চলে এসেছে স্থানীয় কমান্ডান্ট এরনেস্টো মায়জেকে সাহায্য করার জন্য।

ট্রেসির চলাফেরা দেখে তাকে নিছক ট্যুরিস্ট বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ড্যানিয়েল কুপার বিশ্বাস করেন এখানে ট্রেসি কারোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

মাজোবকায় প্রচুর গুহা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুহাটির নাম ড্রাগনের গুহা। গুহার ভেতরটা গোলক ধাঁধার মতো, সেখানে নানা রঙের পাথর ছড়ানো আছে, মাঝে মাঝে আছে বিচিত্র জলধারা। ড্যানিয়েল কুপার দুজন গোয়েন্দাকে নিয়ে ট্রেসিকে অনুসরণ করছে। এক সময়ে প্রচণ্ড ভীড়ের চাপে ট্রেসি হারিয়ে গেল।

গুহার শেষ প্রান্তে একটা হ্রদের মতো জায়গা, সেখানে এক কালে রোমান থিয়েটার ছিল। তার একপাশে ট্রেসি হারটগের সঙ্গে দেখা করল। চারপাশে তাকিয়ে হারটগ বলল–আমার এক ধনী মক্কেল মাদ্রিদ শহরের প্রাদো মিউজিয়ামে সুরক্ষিতভাবে রাখা গোইয়ার আঁকা বিখ্যাত পুয়ের্তো ছবিটা কিনতে চাইছে। যদি তুমি ওটা আনতে পারো তাহলে তোমাকে পাঁচ লাখ ডলার দেওয়া হবে।

একটু ভেবে ট্রেসি বলল–আর কেউ ওটা চুরি করার চেষ্টা করেনি?

–নিশ্চয়ই করেছে। তবে ওদের কারো মাথায় তোমার মতো হলদে ঘিলু নেই। ট্যুরিস্টরা আসতে শুরু করেছে, ট্রেসি বেরিয়ে গেল। গুহার মুখে ড্যানিয়েল কুপার দাঁড়িয়েছিল, অবাক হয়ে সে দেখলো ট্রেসি একাই বেরিয়ে যাচ্ছে।

.

২৮.

স্পেনে যতো হোটেল আছে তার মধ্যে মাদ্রিদের রিজ হোটেল সব থেকে বিখ্যাত। ট্রেসি এরই একটা দামী সুইটে উঠেছে। তার ঘরের জানলা দিয়ে মিউজিয়ামটা পরিষ্কার দেখা যায়। আর এই কারণেই ঘরটা ভাড়া নিয়েছে সে।

মাদ্রিদের পুলিশ প্রধানের কাছে খবর এসেছে ট্রেসি ইতিমধ্যেই মাদ্রিদে পৌঁছেছে। প্যারিসের ইন্টারপোল ইন্সপেকটর ট্রিগনান্টের কাছে ওই খবর পৌঁছে গেছে।

ড্যানিয়েল কুপার পুলিশের প্রধানের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে মেয়েটার ব্যাপারে কড়া নজর রাখতে হবে। ও কিন্তু ভীষণ চালাক, দিনের পর দিন ধরে গোটা পুলিশবাহিনীকে ঠকাচ্ছে।

ট্রেসির ঘুম ভাঙলো বেশ দেরীতে। জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকালো, মিউজিয়ামে লাইন পড়ে গেছে বোধহয়। হঠাৎ ট্রেসিকে চমকে দিয়ে টেলিফোন বেজে উঠলো।

কণ্ঠস্বর ট্রেসির পরিচিত–আমি মাদ্রিদ চেম্বার অফ কমার্স থেকে বলছি, আপনাকে দেখা শোনা করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে।

ওই কথা শুনে ট্রেসি খুবই অবাক হয়ে গেল, সে জানতে চাইলো–আমি যে এখানে এসেছি তুমি তা কি করে জানলে জেফ?

–সব জানতে হয় চেম্বার অব কমার্সকে। ভালো কথা, প্রথম এসেছো যখন সব ঘুরে ফিরে দেখো, আমি না হয় তোমার গাইড হব। আমার সঙ্গে তুমি ডিনার খাবে?

ট্রেসি জেফকে অপছন্দ করলেও মুখের ওপর না বলতে পারলো না। লিফট থেকে নেমে লবিতে পা রেখে ট্রেসি দেখলো জেফ দাঁড়িয়ে আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রেসির ভালো লাগল। হাজার হোক মাদ্রিদ দেশে এর আগে কখনও আসেনি সে। ড্যানিয়েল কুপার দেখলো দুজন হাত ধরাধরি করে চলেছে।

ড্যানিয়েল জানে একমাত্র সে ছাড়া ট্রেসিকে আর কেউ ধরতে পারবে না।

ওরা দুজন ঢুকলো একটা রেস্টুরেন্টে, জেফ বলল–শুনেছো, গোয়েন্দা ড্যানিয়েল কুপার এখানে এসেছে। দারুণ বুদ্ধিমান গোয়েন্দা। সাবধানে থেকে একটু।

–আমার ব্যাপারে তুমি কেন এত চিন্তা করো বলো তো?

–আমার কাছে তুমি বিশেষ কিছু একটা, তুমি কাছে থাকলে আমার প্রত্যেকটা মুহূর্ত আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

জেফ ট্রেসির হাতের ওপর হাত রাখলো। ট্রেসি ওর আন্তরিকতায় হয়তো বিশ্বাস করতো, কিন্তু ইতিমধ্যেই সে জেফের অতীত সম্পর্কে অনেক কথাই জেনে ফেলেছে। এই ধরনের মানুষকে সবসময় দূরে দূরে রাখতে হয়।

বেশ কয়েকটা দিন ট্রেসি আর জেফ নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালো, ড্যানিয়েল কুপার আর দুজন স্থানীয় গোয়েন্দা আঠার মতো লেগে রইল তাদের সঙ্গে।

জেফের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল তার অতীতটা খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু ড্যানিয়েল কুপারের মন কিছুতেই মানছে না ট্রেসি এখানে শুধু বেড়াতে এসেছে।

ট্রেসি একদিন নিজেকেই প্রশ্ন করলো-জেফ সম্পর্কে আমার কি ধারণা?

চার্লসের সঙ্গে ওই ঘটনা ঘটে যাবার পর এই প্রথম একজন পুরুষ তার হৃদয়কে দোলা দিয়েছে এটা অস্বীকার করতে পারছে না সে। কিন্তু এটা কি তার বুদ্ধিহীনতার পরিচয়?

একদিন জেফ ট্রেসিকে নিয়ে মাদ্রিলেনোতে গেল, এখানে দারুণ খাওয়া দাওয়া পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে দেখতে পাওয়া যায় জিপসী সুন্দরীদের নাচ, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ফ্লাখেঙ্গে। বাজনা এবং নারী-পুরুষের উদ্ধত অঙ্গ-ভঙ্গীগুলি খুবই উত্তেজক, হঠাৎ ট্রেসি দেখলো তার সমস্ত অঙ্গ বাজনার তালে তালে নেচে উঠেছে।

.

২৯.

পরদিন সকাল ১০টায় ট্রেসি প্রাদো মিউজিয়ামের গেটে লাইন দিয়েছে।

এই মিউজিয়ামে সারা পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবির এবং বিরলতম সংগ্রহ আছে। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ড্যানিয়েল তার সঙ্গে ঘুরছে।

একটা ঘরে বই আর ছবি, ট্রেসির হৃৎস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে, ওই তো সেই ছবি পুয়ের্তো, হঠাৎ ট্রেসির নজর পড়লো জেফের ওপর। সেও দূর থেকে ছবিটাকে এক দৃষ্টিতে দেখছে। তাহলে? আবার একটা লড়াই শুরু হয়ে গেল? ট্রেসির চোয়াল শক্ত হয়েছে, যে করেই হোক এই লড়াইতে জেফকে সে হারাবেই।

ড্যানিয়েল কুপার বলল–প্রাদো থেকে ও ছবি চুরি করতে এসেছে।

এই কথা শুনে গোয়েন্দা প্রধান রামিরো বললেন–আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি তা।

ড্যানিয়েল কুপার জানে যে করেই হোক ট্রেসি ছবিটা চুরি করবেই, পুলিশ ওর কিছু করতে পারবে না।

.

২৯.

হারটগের কথাটা মনে পড়ে গেল ট্রেসির সাফল্য লাভ করার চান্স কম তবুও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি। ছবিটা চুরি করলেও বাইরে আনা যাবে না। রাতের বেলায় ছাদ দিয়ে ঢুকেও ফল হবে না, অ্যালার্ম ঘণ্টার তার চারপাশে ছড়ানো আছে। আছে অদৃশ্য–ইনফা রেড আলোক রশ্মি। বাইরে অনবরত ফ্লাড লাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পরদিন আবার ট্রেসি গিয়ে পুয়ের্তোর সামনে দাঁড়াল। আগের মতোই প্রহরার ব্যবস্থা। শখের শিল্পীরা ক্যানভ্যাস আর তুলি নিয়ে বসে বসে ছবি আঁকছে। ট্রেসির হঠাৎ মনে হল সে এই কাজটা করতে পারবে।

সে পাবলিক বুথে ঢুকলো। ফোন করল। ড্যানিয়েল কুপার সামনের কফি বারে বসে লক্ষ্য রাখলো তার ওপর। কাকে ফোন করছে জানবার জন্য সে সর্বস্ব পণ করতে পারে।

ফোন নামিয়ে রাখার আগে শেষবারের মতো ট্রেসি মনে করিয়ে দিচ্ছিলো গান্থার হারটগকে–এটা নিশ্চয় মনে রাখবে যে লোকটার হাত যেন খুব দ্রুত চলে। মাত্র দুমিনিট সময় পাবে সে, ইতিমধ্যে কাজটা সারতে হবে, আশা করি তুমি বুঝতে পারছো গতির ওপরেই কাজটার সাফল্য নির্ভর করছে।

ড্যানিয়েল কুপার রেনল্ডসকে চিঠি লিখে জানলো ট্রেসি প্রাদো মিউজিয়ামে কিছু একটা চুরি করার জন্য ঢুকেছে, ট্রেসির ওপর আমি কড়া নজর রেখে চলেছি।

দুদিন পর সকাল নটার সময় দেখা গেল মাদ্রিদ শহরের মাঝখানে রেটিনো পার্কে ছোট পুকুরের পাড়ে বসে ট্রেসি অলস ভঙ্গিতে হাঁসেদের পাউরুটির টুকরো খাওয়াচ্ছে।

একটু বাদে পাকাচুলের একজন বয়স্ক লোক সেখানে এসে হাজির হলেন, তার পিঠ সামান্য কুঁজো, তিনি বেঞ্চির অন্য ধারে বসে বসে কাগজ পড়তে লাগলেন। তার নাম সীজার পোরেটা।

তিনি বললেন–গুডমর্নিং ম্যাডাম।

–গুডমর্নিং, কোনো অসুবিধা আছে?

–না না, তারিখ আর সময়টা জানিয়ে দিন।

–এখনও ঠিক হয়নি।

–পুলিশ কিন্তু ক্ষেপে যাবে, আজ অবধি কেউ এ কাজ করতে পারেনি।

–তার জন্য সুবিধা অনেক, চলি পরে দেখা হবে। ট্রেসি যখন পার্কে তখন ড্যানিয়েল কুপার তার হোটেল ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। ট্রেসিকে খাবার না খেয়ে বেরোতে দেখে ও ধরে নিল ফিরতে অন্তত আধ ঘণ্টা লাগবে। ওর ঘরে কোনো ছবির নকল খুঁজছিল ড্যানিয়েল। কিন্তু ছবির কোনো চিহ্ন নেই।

পরেরদিন সকালে ট্রেসি হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা বড়ো দোকানে ঢুকলো। ড্যানিয়েল

তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। ট্রেসি বাথরুমে ঢুকে পড়ল, মেয়েদের বাথরুম, বাইরে। দাঁড়িয়ে কুপার ছটফট করছিল। ভেতরে গেলে ও দেখতে পেতো একটা মাঝবয়সী মোটাসোটা মহিলার সঙ্গে ট্রেসি কথা বলছে।

ট্রেসি বলল–কাল সকাল এগারোটার সময়।

–না, কাল হবে না। কাল সকালে লুক্সেমবার্গের রাজা আসছেন ওই মিউজিয়াম দেখতে দারুণ পাহারা থাকবে।

–যত বেশি পাহারা ততই ভালো, কাল সকাল এগারোটা।

পরদিন সকাল এগারোটায় রাজা আসবেন। প্রাদোতে সাজোসাজো রব পড়ে গেছে। প্রাদোর ডিরেক্টর প্রিস্টিয়াম মাচাদা প্রধান দরজায় দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাবেন। একটু ভয়ও আছে, সাধারণ দর্শকদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। রাজার নিজস্ব দেহরক্ষীর পাশাপাশি মিউজিয়ামের স্পেশাল গার্ডরাও থাকবে।

ট্রেসি মনে মনে খুবই উত্তেজিত। পুয়ের্তো টাঙানো আছে যে ঘরে সে ঘরে এসে পৌঁছলো সে, আগে থেকেই সব ঠিক করা আছে। পুয়ের্তো ছবির পাশে টাঙানো পোশাক পরা মাজা নামের বিখ্যাত ছবিটার সামনে ইজেল রঙ তুলি নিয়ে কে যেন বসে ছবি আঁকছে। সে হল সীজার। ওটা দেখে নিয়ে ট্রেসি পাশের ঘরে ঢুকলো।

ড্যানিয়েল কুপার নজর রাখছে, তাহলে ট্রেসি এই ঘরেই কিছু একটা করবে, রাজা দোতলার গ্যালারি শেষ করে নীচে ফিরে আসছেন, তিনি বই আর ছবি দেখবেন। ট্রেসি যে ঘরে ছবি দেখছিল সেখানেও সেই বাথরুমে দেখা মহিলাটি রং তুলি নিয়ে বসে ছবি আঁকছিলেন। ঠিক সেই সময় একদল জাপানী কিচির মিচির করতে করতে ঢুকে পড়ল। ট্রেসিও কায়দা করে পিছু হটতে গিয়ে জাপানীদের কনুই-এর গুতোয় ধাক্কা খেয়ে ওই মহিলা শিল্পীর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। সব এদিক ওদিক ছিটকে গেল। ট্রেসি তাড়াতাড়ি মহিলাটিকে সাহায্য করতে গেল। জুতো দিয়ে রঙের টিউবগুলোকে মাড়িয়ে মেঝেটি নষ্ট করে দিল। ড্যানিয়েল কুপার বুঝতে পারলো এটা ট্রেসির প্রথম চাল, আসলে সে কাজ করতে শুরু করেছে।

পাহারাদার ছুটে এল কুয়ে পাশ বলতে বলতে। দর্শনার্থীরা ট্রেসিকে ঘিরে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে। এখনি রাজা এখানে আসবেন। এর মধ্যে মেঝে নোংরা হয়েছে। পাহারাদার ঘাবড়ে গিয়ে পাশের ঘরের পাহারাদারকে ডেকে আনলো।

ট্রেসির একটা চোখ লক্ষ্য করল, পাশের ঘরের পাহারাদার ছুটে এসেছে। সীজার ও পুয়ের্তোর ছবিটা এখন ও ঘরে সম্পূর্ণ একা।

দুজন পাহারাদার দর্শনার্থীদের সরাবার চেষ্টা করছে। একজন বলল ডিরেক্টরকে ডাকতে।

মিনিট তিনেক বাদে ডিরেক্টর মাচাদা হন্তদন্ত হয়ে বললেন শীগগিরি ঘর মোছর লোক। ডাকো।

–যাচ্ছি স্যার বলে একজন ছুটে গেল।

ট্রেসি দেখল পাহারাদার পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তখনও ভেতরে সীজার পোরেটা একমনে ছবি এঁকে চলেছেন।

ড্যানিয়েল কুপার কিন্তু ট্রেসির ওপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরায়নি। দ্বিতীয় চালটা ধরতেই হবে। কিন্তু ট্রেসি কোনো ছবির কাছে গেল না, কারোর সঙ্গে কথা বলল না, শুধু কেন ধাক্কা খেল? একটা ছবিও হারিয়ে যায়নি? কিন্তু কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই বিষয়ে নিঃসন্দেহ ড্যানিয়েল কুপার। ও ছুটলো ডিরেক্টরের কাছে স্যার, আমার মনে হয় এখান থেকে একটা ছবি চুরি গেছে।

–অসম্ভব যেতেই পারে না, মাচাদা ড্যানিয়েলকে বললেন।

–আমি বলছি আসল ছবির বদলে নকল ছবি বসানো হয়েছে।

–শুনুন মিঃ কুপার, প্রত্যেকটা ছবির পেছনে, যন্ত্র লাগানো থাকে। নামলেই ঘণ্টা বেজে উঠবে।

মাচাদা নিজেই সব পরীক্ষা করলেন। ড্যানিয়েল কুপার বুঝলো–এবারও শিকার ফস্কেছে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা হোটেলে খেতে খেতে ট্রেসি জেফকে জানালো কয়েকদিনের মধ্যে সে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। জেফ বলল, তোমার জন্য আমার কষ্ট হবে।

.

ডিরেক্টর মাচাদা সকালে বেশ আরাম করে কফি খাচ্ছিলেন। একটা বেয়ারা একটা চিঠি আনল। জুরিখের কুনসুখ হাউস মিউজিয়ামের ডিরেক্টর লিখেছেন যে তিনি তার দপ্তরের সব থেকে প্রবীণ শিল্পবিশেষজ্ঞকে পাঠাচ্ছেন। তিনি সারা পৃথিবীর সেরা ছবিগুলো দেখে একটি রিপোর্ট তৈরি করবেন।

ওঁর নাম হেনরী রেন্ডেল। তিনি এলেন। ওঁর কথায় সুইশ টান। হ্যান্ডশেক করার সময় মাচাদা লক্ষ্য করলেন হেনরীর ডান হাতের তর্জনীটা নেই।

লুক্সেমবার্গের রাজার দর্শন লাভ করার পর একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ–মাচাদা নিজেই সব কিছু দেখাতে শুরু করলেন।

একের পর এক গ্যালারীতে যাচ্ছেন রেস্তেল, মুগ্ধ হয়ে তারিফ করছেন সব কিছুর।

শেষে একতলায় বই আর ছবির ঘরে ঢুকেও সেই ভাব রেন্ডেলের মুখে, সব ছবিগুলির প্রশংসা করতে করতে হঠাৎ পুয়ের্তোর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন–অসাধারণ নকল।

–কি বললেন মিঃ রেভেল?

–সুন্দর নকল!

–হতেই পারে না, একেবারে আসল ছবি এটি।

হেনরী রেভেল আরেক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন–নাঃ, যা বলেছি তাই, এটা গোইয়ার শিষ্য ইউজেনিও লুকাস পডিলার আঁকা।

মাচাদা বললেন–না না হতেই পারে না। আমরা অনেক খোঁজ খবর করে এটা কিনেছি।

–কেন হবে না, লুকাস আর গোইয়া তো সমসাময়িক। তাই প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে ঝঞ্ঝাট থাকবে না। আমি বলছি লুকাস যে সব ছবি নকল করতো তাতে নিজের নাম লিখতো। তারপর অন্য রঙের কোটিং লিখে গোইয়ার নামটা লিখে বাজারে ছেড়ে দিতো। এইভাবে সে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেছে।

সব দেখে নিজের হোটেলের ঠিকানা জানিয়ে ধন্যবাদের বন্যা বইয়ে দিলেন। তারপর রেন্ডেল চলে গেলেন। মাচাদার মনে খটকা লাগল। তিনি ছবিটাকে ল্যাবরেটরিতে আনতে বললেন।

মাচাদার নির্দেশে অ্যাসিড দিয়ে, গোইয়ার সইয়ের অক্ষরগুলো মোছা হল। ধীরে ধীরে লুকাসের এল ভেসে উঠল। রেন্ডেলের কথাই ঠিক। গোইয়ার তলায় লুকাসের সই।

মাচাদার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। এখন বোধহয় তার চাকরী চলে যাবে। মাচাদা সঙ্গে সঙ্গে রেন্ডেলের হোটেলে ফোন করলেন।

মাচাদা বললেন–আপনি ঠিকই বলেছিলেন, ওটা লুকাসেরই।

–লুকাস অনেককে বোকা বানিয়েছিল, আপনিও ঠকে গেছেন।

মাচাদা ঘাড় নেড়ে বললেন–আমরা যে বিধবার কাছ থেকে কিনেছিলাম উনি বলেছিলেন এই ছবিটি ওঁর পরিবারে তিন পুরুষ ধরে ছিল। মামলা করলে আমারই বোকামি প্রকাশ পাবে।

রেন্ডেল বললেন–তা ঠিক, এক কাজ করুন, ডিরেক্টরদের সঙ্গে কথা বলে ওটা নীলাম দারদের কাছে পাঠিয়ে দিন।

–তাতে জানাজানি হবে।

–তবে একটা কথা বলি, আপনার ভাগ্য ভালো হলে একজন খদ্দের পেতে পারেন। আমারই একজন পরিচিত পঞ্চাশ হাজার ডলারে ছবিটা কিনতে পারে।

মাচাদা বললেন–তাহলে সেই ব্যবস্থা করুন।

তাড়াতাড়ি মিটিং বসলো, ছবিটা সাধারণ কাগজে মুড়ে তুলে দেওয়া হল রেভেলের হাতে। তার আগে টাকা অবশ্য হাতে চলে এসেছে।

ছবিটা নিয়ে রেভেল ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে এলেন মাদ্রিদের উত্তর প্রান্তে। চারতলার ফ্ল্যাটে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ট্রেসি, পিছনে সীজার পোরেটা।

–অসুবিধে হয়নি তো?

রেন্ডেল ছবিটা টেবিলে রেখে বললেন–না।

ট্রেসির নির্দেশে সীজার আবার অ্যাসিড নিয়ে বসলো, লুকাসের সইটা তুলে নিতেই বেরিয়ে পড়লো গোইয়ার আসল সই।

রেন্ডেল অবাক হয়ে বললেন–চমৎকার, অপূর্ব।

সীজার পোরেটা বলল–সবটাই মিস হুইটনির পরিকল্পনা। উনি আমাকে বলেছিলেন দুমিনিট সময়ের মধ্যে আসল সইয়ের ওপর রঙের আস্তরন দিয়ে তার ওপর লুকাসের সই করে আবার আস্তরণ দিয়ে গোইয়ার সহ্য করতে পারবো কিনা। আমি যে পেরেছি

এটা তারই প্রমাণ। ওরা যদি লুকাসের সইটা তুলতো তবে আসল, সইটা পেতো। কিন্তু–প্রথমে ভয় পেয়ে যাওয়াতে অতদূর এগোতে পারেনি।

ট্রেসি দুজনকে পাওনা মিটিয়ে দিল।

সীজার প্রশ্ন করল–কীভাবে এটাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবেন?

–অন্য একজনকে পাঠাবো, সেইই কাজ করবে।

ট্রেসি হোটেলে ফিরলো, আহা বেচারা জেফ।

নির্ধারিত মানুষটি এল, ট্রেসি সীজার পোরেটাকে ফোন করল–লোক পাঠাচ্ছি ছবিটা দিয়ে দেবেন।

–কী বললেন? একটু আগেই তো আপনার লোক ছবিটা নিয়ে চলে গেছে।

এই কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না ট্রেসি!