২৪. দীনেশ সান্যালের গলা খাঁকারি

পরদিন ভোরবেলা দীনেশ সান্যালের গলা খাঁকারিতে মহিমের ঘুম ভেঙে গেল। কইরে মণ্ডলের পো, আছি টাছিস, না, ভাগলি?

নিশ্চিত ঘুমে মহিমের মুখ আজ বেশ প্রফুল্ল। এক রাত্রে যেন তার অনেকদিনের সমস্ত ক্লেদ কেটে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, নমস্কার সানেল মশাই।

সান্যাল বলল, কী রে, আদালতে কিছু জমাটমা তো দিলিনে। ভেবে দেখলি কিছু?

মহিম বলল, ভাবার তো কোনও উপায় নাই সানেল মশাই।

হুঁ! সান্যাল একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, উপায় আছে বই কী। কত্তার কথাটা ভেবে দ্যাখ। তাতে সবই বজায় থাকবে।

মহিম বলল, জমিদারের ঘরে চাকরি মুই নিব না। নিজের মন ছাড়া মুই গড়তে পারব না কিছু। সান্যাল হেসে বলল, তুই ব্যাটাদের মনও তো সেরকম। অখলে চাষার মোষ, ভাগচাষার মরা মুখ। এ ছাড়া কি দুনিয়ায় কিছু নাই?

সকালবেলাই মহিম আর বাকবিতণ্ডা বাড়াতে চাইল না। বলল, সে আপনি বোঝবেন না সানেল মশাই। আপনি এখন যান, মোর কাজ আছে।

সান্যাল বক্র ঠোঁটে চোখ কুঁচকে বলল, এখনও কাজ? জেদ এখনও? ভাল, ভাল। কতা পাঠিয়েছিল তাই বললাম। তবে এক কাজ কর! আমের আঁটির ভেঁপু কিছু তুলে রাখ। বলে হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। অহল্যা গোবর জলের বালতি হাতে সবই শুনল। বাপ ভাইয়ের কথাই মনে পড়ল তার। এর মধ্যে কয়েকদিন তার বাবা পীতাম্বর আর দাদা ভজন এসে ঘুরে গেছে। জিজ্ঞেস করেছে কোনও গতি আছে কি না কিছু বিক্রি বাটা করে ভিটে বজায় রাখবার। অহল্যা তাদের সবই বলেছে যে, কিছুই নেই। পীতাম্বর মেয়েকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, অহল্যা কিছু বলতে পারেনি। বাপ জিজ্ঞেস করেছে, তোর দেওরের জন্য ভাবছিস? সে কথার জবাবও অহল্যা দিতে পারেনি। পীতাম্বর দেখেছে মেয়ে তার বড় রাশভারী। তবু একটু চুপ করে থেকে বললে, চাষ করে খাই সত্য, মোরা কাউকে দয়া ধমো দেখাতে পারি না। কিন্তু তোর দেওরের মতো কীর্তিমান ছেলে যদি মোর ঘরে দু-দিন থাকে তবে বর্তে যাই। ভিটে তো আর আটকে থাকবে না। ভজন বলেছে, ওর ভিটা নাই কিন্তুক নয়নপুরের অনেক ভিটার দোর ওর জন্য খোলা রইছে। আর শুধু নয়নপুরই বা বলি কেন। এ তল্লাটে কোথায় নাই? ব্যাপারটা এমনই যেন, অহল্যাকে রাজি করানোটাই বাপ-ভাইয়ের কাছে সবচেয়ে বড়। তাই পীতাম্বর বলেছে, মোরা গতর খাটাই, মহিম গতরও খাটায়, চিন্তাও করে। এ দুটো ছাড়া মানুষের আর কী কাজ থাকতে পারে মুই জানি না।

অহল্যা অরাজি হয়নি কিন্তু কিছু বলতেও পারেনি। বুকে তখন তার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলেছে। সান্যালের ঘুরে যাওয়ার পর ভবিষ্যৎ চিন্তাতে ড়ুবে গেল সে।

মহিম তখন নতুন উদ্যমে শুরু করেছে আধ শেষ কুঁজো কানাইয়ের মুরতি।

দুপুরে এল রান। পরান আজকাল খুবই বিমর্ষ, নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। এসে ডাকল মহিমকে।

মহিম বেরিয়ে এসে বলল, পরানদা বউঠাকুরানীরে বলল, নয়নপুর ছেড়ে মুই যাব না।

সেদিনের ক্রুদ্ধ বাঘিনী অহল্যা আজ শান্তভাবে এসে বলল, বউঠাকুরানীরে বললা পরানদা, তাড়া হলেন রাজরাজড়া লোক, দরিদ্দ মহিমের পরানটুকু নিয়ে তাঁর পরান কতটুকু ভরবে? ওর পথ ও-ই দেখে নেবে।

পরানের বিস্মিত মুখে মিটমিট করে উঠল হাসি। দু পা এগিয়ে এসে অহল্যাকে বলল, তাই তো ভাবছিলাম যে, তেলজলে এমন মিশ খায় কেমন করে। আচ্ছা, তাই বলব।

বলে পরান বেরিয়ে গেল। কিন্তু যেমন বিমর্ষভাবে এসেছিল তার চেয়ে অনেকটা খুশি নিয়ে যেন ফিরল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *