২৩. সত্যর বেহায়াপনার কথা

সত্যর বেহায়াপনার কথা জানতে আর বাকী থাকে না কারো এ তল্লাটে। বাপ নিতে এসেছিল, শ্বশুর-শাশুড়ী এক কথায় মত দিয়েছিল, অথচ সত্য যায় নি, নিজে ফিরিয়ে দিয়েছে বাপকে, এ অভাবনীয় সংবাদটা যেন খড়ের চালে আগুন লাগার মত ছড়িয়ে পড়ল এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া। পাড়ার অন্য বৌরা ভাবল, বাঁড়ুয্যে-বাড়ির বৌটার নানা নিন্দেবাদ শুনেছি, এতদিনে তার মানে পাওয়া গেল, বৌটা পাগল!

আহা বেচারা নবুকমার!

বেহাইয়ের বিষয়ের লোভে বাপ কিনা একটা পাগল বৌ গলায় চাপিয়েছে ছেলের!

তা সত্য সম্পর্কে এ ধরনের আলোচনা আরও একবার হয়ে গেছে ইতিপূর্বে। সত্যর বাপের বাড়ির দেশেই হয়েছে। যখন চাউর হয়ে গেল, রামকালী কবরেজ মেয়ে পাঠাতে চান নি, মেয়ে নিজে বলেছে, পাঠিয়ে দাও বাবা, তখন এর থেকে বেশী বৈ কম ছিছিক্কার পড়ে নি।

ভুবনেশ্বরী অবিরল কেঁদে মাটি ভিজিয়েছে, সত্যর বন্ধুরা গাল থেকে আর হাত নামাতে পারে নি, সত্য নিশ্চল থেকেছে। শুধু যখন সারদা বলেছে, নিজের পায়ে নিজে কুড়ল মারলে, ঠাকুরঝি? তখন বলেছে, কুড়ল তো বাবা সেই আট বছর বয়সে গলায় বসিয়ে রেখেছেন বৌ, নতুন আর কি হল?।

তবু আরও একটা বছর থাকতে পেতে।

এতখানি জীবনে একটা বছর কম-বেশীতে আর কি বা হবে বৌ! রাগের মাথায় তারা ওই বিয়ে না কি বলেছে, তাই করলে তো সারাজীবন সতীনের জ্বালায় জ্বলতে হবে!

সারদা একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করেছে।

আর যখন ভুবনেশ্বরী কেঁদে-কেটে মেয়ের হাত ধরে বলেছে, আমাদের জন্যে তোর মন কেমন করছে না সত্য? তখন সত্য অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে উদাস গলায় বলেছে, করছে কি করছে না সে কথা কি ঢাক পিটিয়ে বলতে হবে?

তবে স্বেচ্ছায় যেতে চাইলি কেন?

কেন কথার মানে নেই। নিজেরাই তো বল, মা বড় নির্বোধ, কেঁদে কেঁদে মর, আপনি ভাবিয়া দেখ কার ঘর কর! তবে?

ভুবনেশ্বরী এতেও চৈতন্যলাভ করে নি, বলেছিল, আমার তো তবু এপাড়া ওপাড়া–তোর মতন দশ-বিশ ক্রোশ দূরে নয়–

কথা শেষ হয় নি।

এই সময় আর বাঁধ রাখতে পারে নি সত্য, হাপুসনয়নে কেঁদে ফেলে বলেছে, তা সে কথাটা সময়কালে ভাবো নি কেন? একটা মাত্তর মেয়ে আমি তোমাদের, চোখছাড়া দেশছাড়া করে এক অ-গঙ্গার দেশে বিদেয় করে দিয়েছ, মায়া-মমতা থাকলে পারতে তা? এই তো পুণ্যি মোটে একটা বছরের ছোট আমার চেয়ে, দিব্যি ড্যাংডেঙিয়ে বেড়াচ্ছে, আর আমায় সেই কোন কালে পরগোওর করে দিয়ে– গলাটা ঝেড়ে নিয়ে কথাটা শেষ করেছে সে, তা না দিলে, পারতো কেউ আমার গলায় গামছা দিয়ে টেনে নে যেতে? বাবা মেয়ে বলে মায়া করেন নি, গৌরীদান করে পুণ্যি করেছেন, আমারও নেই মায়া-মমতা। নির্মায়িক বাপের নির্মায়িক মেয়ে বলেই হঠাৎ মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে দীর্ঘ সময় ধরে।

তবু শ্বশুরবাড়ি যাওয়া কি হয় নি?

রামকালী আর রামকালীর মেয়ে দুজনেই সমান। দুজনের মতই কথা যখন দেওয়া হয়ে গেছে, তখন আর নতুন বিবেচনা চলে না।

বাপের আড়ালে আর মেয়ের সামনে আলোচনার ঝড় বয়েছিল।

.

এবারের পালা এই।

এবারে মোটামুটি সত্যর আড়ালেই। শুধু সদু বলেছিল, ধন্যবাদ তোমাকে বৌ, নমস্কার! ছিছিক্কার দেব, না পায়ের ধুলো নেব ভেবে পাচ্ছি না!

সত্য এর উত্তরে নিজেই হেঁট হয়ে সদুর পায়ের ধুলো নিয়ে হেসে বলেছিল, দুগগা দুগগা গুরুজন তুমি, ছিছিক্কারই দাও বরং! জন্মাবধি যা পেয়ে আসছি!

সত্যর মধ্যে যে বিরাট সমুদ্রের আলোড়ন চলছে তা কি সত্য লোকের সামনে মেলে ধরবে? হ্যাঁ, সমুদ্রের আলোড়নই। তবু বাপ চলে যাবার পর ভেঙে পড়ে নি সে। যথারীতি তারপরই তেল সলতে নিয়ে বসেছে পিদিম সাজাতে, তার পর ঘাটে গেছে, গা ধুয়ে কাপড় কেচে মস্ত ঘড়াটা ভরে এনে দাওয়ায় বসিয়ে ভিজে কাপড়েই ঠাকুরঘরে সন্ধ্যে দেখিয়ে শাঁখ বাজিয়ে তুলসীমঞ্চে জল দিয়ে, শুকনো কাপড় পরে রাত্তিরের রান্নার ব্যবস্থা করতে বসেছে।

রাত্তিরের রান্নাটা সত্যই করে আজকাল। সদুকে বলে বলে এ অধিকার অর্জন করেছে সে।

শুধু রান্না করতে করতে যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল তার, ফাগুনের শেষ থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি আসতে কদিন লাগে, কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারে নি তার কোন সাক্ষী নেই।

.

কিন্তু সত্যর জীবন কি সেই বৈশাখের মাঝামাঝিটা দেখা দিয়েছিল আনন্দের মূর্তি নিয়ে? আলো-ঝলমলে উজ্জ্বল মূর্তি নিয়ে?

নাঃ। সে দেখা পায় নি সত্য।

পুণ্যির বিয়েতে যাওয়া হয়নি তার। ঠিক সেই সময় এলোকেশী রক্ত-আমাশয় পড়ে মরতে বসেছিলেন। আর কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকা মানুষটাই খিঁচিয়ে উঠে বলেছিল, কি বললি সদু, বাপের বাড়ির লোকের সঙ্গে যাবো বলে নাচছে হারামজাদী? বাপ যখন সোহাগ করে নিতে এসেছিল তখন যাওয়া হল না, এখন আমি মরতে বসেছি। বলে দিগে যা, যাওয়া হবে না, যে নিতে এসেছে। ধুলোপায়ে বিদেয় হোক।

মামী মরতে বসেছে বলে যে সদু ছেড়ে কথা কইবে তা কিন্তু করে নি। ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল সে, তারা তোমার লোককে টাটের শালগেরামের মতন পাদ্যঅর্ঘ্য দিয়ে বসিয়ে খাইয়ে মাখিয়ে আর এক পোঁটলা জিনিস দিয়ে বুক ভরিয়ে বিদেয় দিলে, আর তাদের লোককে ধুলোপায়ে বিদেয় দেবে? তা ভালো, মুখটা খুব উজ্জ্বল হবে। কিন্তু আমি বলি কি, দু-দশ দিনের জন্যে পাঠিয়েই দাও! ছেলেমানুষ–তাছাড়া শুনেছি ওই পিসিই চিরকালের খেলুড়ি।

এলোকেশী চিচি করে বলেছিলেন, তবে বল যেতে। তুমিই বা থাকবে কেন? তুমিও বিদেয় হও। শুধু যাবার আগে একখানা ছুরি এনে আমার গলায় বসিয়ে দিয়ে যাও।

সদু ছুরি দেয় নি, নিজেও বিদেয় হয় নি, শুধু সত্যর যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু মস্ত বাদ সাধল নবকুমার।

হঠাৎ পুরুষকর্তার ভূমিকা নিয়ে বেশ সোচ্চার ঘোষণা করে বসল, যাওয়া-টাওয়া হবে না কারুর। আমার মা মরছে, আর লোকে এখন খুড়তুতো পিসির বিয়ের ভোজ খেতে ছুটবে! বলে দাও সদুদি, সে গুড়ে বালি। যাওয়া বন্ধ থাক।

নবকুমারের ঘোষণায় কর্তা-গিন্নী পরম পুলকে নির্লিপ্ত সেজে বললেন, আমরা আর কি বলব? নবা যখন–

তবু সদু চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, সব সময় বুঝি নবার কথাতেই ওঠো বসো তোমরা?

কিন্তু কাজ হয়নি। এলোকেশী শাপমন্যি দিয়ে ভূত ভাগিয়েছিল।

সত্যবতী বলেছিল, আমি বাবাকে কথা দিয়েছিলাম বিয়েতে যাবো

নবকুমার সদু মারফৎ সে কথা শুনে জবাব দিয়েছিল, সমাজে আমাদের মুখটা হেঁট হয়, এই যদি কেউ চায় তো যাক।

সদু ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ হেসে ফেলে বলেছিল, খুব তো বিজ্ঞের মত কথা বলছিস, আসল ব্যাপারটা কি বল্ দেখি? বৌকে তো এখনও ঘরে পাস নি, তবু এত মন-কেমন?

সদুর এই কথায় হঠাৎ নবকুমারের কর্তাত্ত্বি ঘুচে গিয়েছিল। য্যাঃ বলে ঝপ করে সরে গিয়েছিল। বোধ করি এ কথাও ভেবেছিল, সদুদি কি অন্তর্যামী?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যবতীই বেঁকে বসল। সদু যখন বহু চেষ্টায় রফা করেছিল, নেমন্তন্ন রক্ষা করতে নবকুমার যাবে, সেই সঙ্গে বৌ যাবে তিনটি দিনের কড়ারে, বরকনে বিদেয় হবে ওরাও চলে আসবে, তখন সত্যবতী হঠাৎ বলে বসল, দরকার নেই আমার এই একমুঠো ভিক্ষেয়। তিন দিনের মধ্যে তো পাড়া ভেসে যাক– বাড়ির সব লোকগুলোর মুখও দেখে ওঠা হবে না, সে যাওয়ায় লাভ! লোকে শুনবে সত্য এসেছিল, সত্য চলে গেছে, ছিঃ!

দেখ কথা! ভাত পায় না– গয়না চায়! মুষ্টিভিক্ষেই যে জুটছিল না, তবু বিয়েটাও তো দেখতে পাবি?

থাক, নাই দেখলাম। যার নেমন্তন্ন রক্ষের কথা সে যাক।

সে আর গিয়েছে!

সদু মন্তব্য করে। এবং ঠিকই করে। নবকুমার জোড়হাতে বলে, রক্ষে কর বাবা!

অতএব শেষ রক্ষা করেন নীলাম্বর।

তিনি রামকালীর প্রেরিত লোকের হাতে পত্র দিয়ে দেন, নবকুমার বাবা-জীবনের গর্ভধারিণী মৃত্যুশয্যায়, সে কারণে কাহারও যাওয়া সম্ভবপর হইল না, পত্রবাহকের হাতে লৌকিকতা বাবদ দুই টাকা পাঠালাম।

.

রামকালী সেই পত্র পেয়ে দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে আস্তে বলেছিলেন, ও টাকা দুটো তুই জলপানি খাস রাখু… আর শোন, বাড়ির মধ্যে বলে দিগে যা, সত্যর শাশুড়ী মরমর, তাই আসা সম্ভব হল না।

তারপর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেছে, বৈশাখ কেটেছে, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় সব কেটে গেছে, রামকালী তার জামাতা বাবাজীবনের গর্ভধারিণীর মৃত্যুসংবাদ পান নি।

এই না পাওয়াটা কি একটা মরুভূমির রুক্ষ বাতাসের মত? যে বাতাস সমস্ত কোমলতা আর সরসতা মুছে নিতে পারে? নইলে রামকালী আস্তে আস্তে এমন নীরস কঠিন হয়ে গিয়েছেন কেন? কেন বেহাইয়ের সঙ্গে দ্রতারক্ষা হিসেবে বেহানের কুশল সংবাদ প্রার্থনা করেন নি? কেনই বা ভেবেছেন, মেয়ে আনার জন্যে হ্যাংলামি করার মধ্যে অগৌরব আছে?

অন্তঃপুরের মধ্যে একখানি বিচ্ছেদ-ব্যাকুল মাতৃহৃদয় যে রামকালীর এই কাঠিন্যের সামনে মূক বেদনায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে, সেটা বোঝবার ইচ্ছে হয় নি কেন রামকালীর?

রামকালী কি ভেবেছিলেন, এবারও সেই একফোঁটা মেয়েটাই বাপের কাছে অহঙ্কারের পরিমাপ দেখিয়েছে! দৃঢ়তার অহঙ্কার, কাঠিন্যের অহঙ্কার! বলতে চেয়েছে, দেখ, আমিও কম যাই না! এই অভিমানহত পিতৃহৃদয়টি এই অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে চুপ করে থেকেছে আর ভেবেছে, দেখা যাক!

কিন্তু কতদিন দেখবেন রামকালী?

অসমবয়সী এই দুটো মানুষের দাবা খেলার চালের অবসরে কত ব্যাপারই ঘটে গেল। যে ব্যাপারের একটা ঘটলেও মেয়ে বাপের বাড়ি ছুটে আসতে পারে। কিন্তু বলা তো চাই? মেয়ের বাপ গলায় বস্তর দিয়ে আবার আর্জি পেশ করবে তবে তো?

তা করছেন না রামকালী।

অতএব আরও একবার বর্ষা শরৎ শীত বসন্ত পার হয়ে গেল নিজস্ব নিয়মে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *