২৩. দেবু অনিরুদ্ধকে বলিল

দেবু অনিরুদ্ধকে বলিল—এতদিন কোথায় ছিলে অনি-ভাই?

উত্তরে অনিরুদ্ধ দেবুকে বলিল—কেয়া, পদ্ম ঘর ছোড়কে চলা গেয়া দেবু-ভাই?

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মাথা হেঁট করিল। কোনো কথা সে বলিতে পারি না, পদ্মকে সে রক্ষা করিতে পারে নাই। গৃহত্যাগিনী কন্যার পিতা, পত্নীর স্বামী, ভগ্নীর ভাই সেই গৃহত্যাগের প্রসঙ্গ উঠিলে যে ভাবে মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া থাকে, তেমনিভাবেই সে চুপ করিয়া রহিল।

অনিরুদ্ধ হাসিল; বলিল—সরম কাহে? তুমারা কেয়া কসুর ভাই?

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, ঘাড় নাড়িয়া যেন মনে মনে অনেক বিবেচনা করিয়া বলিল—উকা ভি কুছ কসুর নেহি! কুছ না! যানে দেও।

শেষে আপনার বুকে হাত দিয়া নিজেকে দেখাইয়া বলিল—কসুর হামারা; হ্যাঁ, হামারা কসুর।

দেবু এতক্ষণে বলিল—একখানা চিঠিও যদি দিতে অনি-ভাই!

অনিরুদ্ধ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল—আর কোনো কথা বলিল না।

দুর্গা দেবুকে তাগিদ দিল-জামাই, বেলা দুপুর যে গড়িয়ে গেল। রান্না কর! … তারপর অনিরুদ্ধের দিকে চাহিয়া বলিল-মিতেও তো এইখানে খাবে? না কি হে?

দেবু ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল—হ্যাঁ, এইখানে খাবে বৈকি। তুই কথাবার্তা বলতে শিখলি না দুগ্‌গা!

দুর্গা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; বলিল–ও যে আমার মিতে! ওকে আবার কুটুম্বিতে কিসের? কি হে মিতে, বল না?

অনিরুদ্ধ অট্টহাসি হাসিয়া উঠিল—সছ বোলা হ্যায় মিতেনী।

তাহার এই হাসিতে দেবু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিল। বলিল তুমি মুখ-হাত ধোও অনি-ভাই। তেল-গামছা নাও, চান কর। আমি রান্না করে ফেলি।

বাড়ির ভিতর আসিয়া সে রান্নার উদ্যোগ আরম্ভ করিল! … অনিরুদ্ধ! হতভাগ্য অনিরুদ্ধ! দীর্ঘকাল পরে ফিরিলকিন্তু পদ্ম আজ নাই। থাকিলে কি সুখের কথাই না হইত। আজ অনিরুদ্ধের হাতে তাহাকে সে সমৰ্পণ করিত মেয়ের বাপের মত—বোনের বড় ভাইয়ের মত। হতভাগিনী পদ্ম! সংসারের চোরাবালিতে কোথায় যে তলাইয়া গেল কে জানে? তাহার কঙ্কালের একখানা টুকরাও আর মিলিবে না তাহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য।

অনিরুদ্ধ বাহিরে বকবক করিতেছে। অনর্গল অশুদ্ধ হিন্দিতে কথা বলিয়া চলিয়াছে। বাংলা যেন জানেই না। যেন আর-এক দেশের মানুষ হইয়া গিয়াছে সে।

খাইতে বসিয়া অনিরুদ্ধ তাহার নিজের কথা বলিল—এতক্ষণে সে বাংলায় কথা বলিল।… জেলখানাতেই মনে মনে বড় আক্ষেপ হয়েছিল দেবু-ভাই! নিজের ওপর ঘেন্না হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে ভাবতাম, গাঁয়ে মুখ দেখাব কি করে? আর গায়ে গিয়ে খাবই বা কি? কিছুদিন থাকতে থাকতে আলাপ হল একজন হিন্দুস্থানি মিস্ত্রির সঙ্গে। লোকটার জেল হয়েছিল মারামারি করে। কারখানার আর একজন মিস্ত্রির সঙ্গে মারামারি করেছিল একজন মেয়েলোকের জন্যে। সেই আমাকে বললে। আমার খালাসের একদিন আগে তার খালাসের দিন। কলকাতায় তার জেল হয়েছিল খালাস হবে সে সেইখানে। কদিন আগেই এ জেল থেকে চলে গেল। আমাকে ঠিকানা দিয়ে বলে গেল—তুমি চলে এস আমার কাছে। আমি তোমার কাজ ঠিক করে দোব। জেল থেকে খালাস পেয়ে বের হলাম। ভাবলাম বাড়ি যাব না, জংশন থেকে খবর দিয়ে পদ্মকে আনিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলে যাব। তা–অনিরুদ্ধ হাসিল; কপালে হাত দিয়া বলিল, হামারা নসীব দেবুভাই! আমাদের সেই বলে না—গোপাল যাচ্ছ কোথা? ভূপাল! কপাল? কপাল সঙ্গে। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল জংশনের কলের একটা মেয়ের সঙ্গে। দুগ্‌গা জানে, সাবি-সাবিত্রী মেয়েটার নাম। মেয়েটা দেখতে-শুনতে খাসা; আমার সঙ্গে–অনিরুদ্ধ আবার হাসিল। অনিরুদ্ধের সঙ্গে মেয়েটির আগে হতেই জানাশুনা; জানাশুনার চেয়েও গাঢ়তর পরিচয় ছিল। মেয়েটি ছিল কলের বৃদ্ধ খাজাঞ্চীর অনুগৃহীতা। বৃদ্ধের কাছে টাকা-পয়সা সে যথেষ্ট আদায় করিত, কিন্তু তাহার প্রতি অনুরক্তি বা প্রীতি এতটুকু ছিল না। সে সময় য় বুড়ার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া মেয়েটি সদর শহরে আসিয়া দেহব্যবসায়ের আসরে নামিয়াছিল।

অনিরুদ্ধ বলিল-মেয়েটা কিছুতেই ছাড়লে না আমাকে নিয়ে গেল তার বাসায়। মদটদ খাওয়ালে। আর সেই দিনই এললা সেই বুড়ো খাজাঞ্চী ত কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। মেয়েটা জ্বলে গেল। রাত্রেই আমাকে বললে—চল, আমরা পাই। দেবু-ভাই, মাতন কাকে বলে, তুমি জান না। মাতনে মেতে তাই চলে গেলাম। গিয়ে উঠলাম কলকাতায় মিস্ত্রির ঠিকানায়। তারপর

তারপর অনিরুদ্ধ বলিয়া গেল এতদিনের দীর্ঘ কাহিনী-কলে কাজ ঠিক করিয়া দিল মিস্ত্রি। কামারশালায় মজুরের কাজ। কামারের ছেলে—তাহার উপর বুকে দারিদ্র্যের জ্বালা, কাজ শিখিতে তাহার বিলম্ব হইল না। মজুর হইতে কামারের কাজ, কামারের কাজ হইতে ফিটারমিস্ত্রির কাজ শিখিয়া সে আজ পুরাদস্তুর একজন ফিটার। বার আনা হইতে দেড় টাকা—দেড় টাকা হইতে দুই টাকা—দুই হইতে আড়াই—আজ তাহার দৈনিক মজুরি তিন টাকা। তাহার উপর ওভারটাইম। ওভারটাইম ছাড়াও মধ্যে তাহার বাহিরে দুই-চারিটা ঠিকার কাজ থাকে।

অনিরুদ্ধ বলিল—দেবু-ভাই, পেট ভরে খেয়েছি—পরেছি–আবার মদ খেয়েছি, ফুর্তি করেছিকরেও আমি ছশো পঁচাত্তর টাকা সঙ্গে এনেছি। ভেবেছিলামঘরদোর মেরামত করব জমি কিনব; পদ্মকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তা অনিরুদ্ধ দুটি হাত-ই উল্টাইয়া দিয়া বুলিল–ফুড়ুৎ ধা হয়ে গেল! অনিরুদ্ধ চুপ করিল। দেবুও কোনো উত্তর দিল না। এ সবের কি উত্তর সে দিবে?

দুর্গা অদূরে বসিয়া সব শুনিতেছিল। সেও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলতারপর, সাবি কেমন আছে?

–ছিল ভালই। তবে—। হাসিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—কদিন হল সাবি কোথা পালিয়েছে।

–পালিয়েছে?

–হ্যাঁ।

–তাতেই বুঝি পরিবারকে মনে পড়ল?

অনিরুদ্ধ দুর্গার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—কাজে-কাজেই, তাই হল বৈকি। দোষ আমার, সে তো আমি স্বীকার করছি। তবে–

দুর্গা বলিল—তবে কি?

—তবে যদি ছিরের ঘরে না যেত, তবে আমার কোনো দুঃখুই হত না। কিছুক্ষণ চুপ। করিয়া থাকিয়া বলিলতাও যে সে ছিরের ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে–এতেও আমি সুখী।

দেবু বলিল—তাহার একমাত্র অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করিল—তুমি যদি একখানা চিঠিও দিতে, অনি-ভাই!

অনিরুদ্ধ বলিলবলেছি তো, মাতন কাকে বলে, তুমি জান না দেবু-ভাই! আমি মেতে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া মনে মনে কি ছিল জান? মনে মনে ছিল যে, রোজকার করে হাজার টাকা না নিয়ে আমি ফিরব না। ফিরে তোমাদিগকে সব তাক লাগিয়ে দোব।

দুর্গা হাসিয়া বলিলতা এখন এসে তোমারই তাক লেগে গেল!

–না। অনিরুদ্ধ অস্বীকার করিয়া বলিল না। এ রকম একটা মনে মনে ভেবেই এসেছিলাম। খাবার নাই, পরবার নাই-স্বামী দেশ-ছাড়া, ছেলেপুলে নাই, জোয়ান বয়েস পদ্মর; এ আমি হাজারবার ভেবেছি দুগ্‌গা। তবে সবচেয়ে বেশি দুঃখ–।

–কি?

–না। সে আর বলব না।

–ক্যানে? তোমার আবার লজ্জা হচ্ছে নাকি?

–লজ্জা দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—দেবু-ভাইয়ের ছেলে-পরিবার ছিল না, ও-ই তাকে খেতে-পরতে দিলে। হারামজাদী এসে ওর পায়ে গড়িয়ে পড়ল না কেন? আজ আমি দেবু-ভাইয়ের কাছে চেয়ে নিয়ে যেতাম। সে যদি না যেতে চাইত, কি দেবু-ভাই যদি দুঃখু পেত, আমি হাসিমুখে চলে যেতাম।

দেবু বলিয়া উঠিল—আঃ আঃ, অনি-ভাই।

সে খাবার ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল।

সমস্ত বাকি দ্বিপ্রহরটাই দেবুর মনে পড়িল—সেদিনকার রাতের কথা। বাহিরের তক্তপোশের উপর বসিয়া সে স্থিরদৃষ্টিতে সেই শিউলি গাছটার দিকে চাহিয়া রহিল।

তাহার একাগ্র চিন্তায় বাধা দিয়া দুর্গা তাহাকে ডাকিল—জামাই!

–এ্যাঁ! আমাকে বলছিস।

দুর্গা হাসিল; বলিল—বেশ যা হোক। জামাই আর কাকে বলব?

—কি বলছিস?

—উ বেলায় গৌর এসেছিল। আমাকে বলে গিয়েছে, দেবু-দাদাকে একবার মনে করে। যেতে বলো আমাদের বাড়ি। কি দরখাস্ত না কি লিখতে হবে। বার বার করে বলে গিয়েছে। তোমাকে বলে নাই?

দেবুর মনে পড়িয়া গেল। স্বৰ্ণ মাইনর পরীক্ষা দিবে। তাহার দরখাস্ত লিখিয়া দিতে হইবে। স্বর্ণকে একটু পড়াশুনা দেখাইয়া দিতে হইবে। স্বর্ণকেও যদি জীবনের পথ ধরাইয়া দিতে পারে, তবে সে-ও তাহার পক্ষে একটা মহাধৰ্ম হইবে। বড় চমৎকার মেয়ে। গৌরের বোন তো। দেলু আশ্চর্য হইয়া যায়—কোথা হইতে কেমন করিয়া তাহারা এমনটি হইল!

 

তিনকড়ির বাড়িতে বেশ একটা জটলা বসিয়া গিয়াছে। তিনকড়ি জুড়ে হইয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছে। ভল্লাবান্দীর রামচরণ, তারিণী, বৃন্দাবন, গোবিন্দ প্রভৃতি কয়েকজন বসিয়া তামাক খাইতেছে। সকলেই চুপ করিয়া আছে। ইহাদের নিস্তব্ধতার একটা বিশেষ অর্থ আছে। আস্ফালন, উচ্চহাসি ইহাদের স্বাভাবিক প্রকাশ। তিনকড়ির চারিত্রিক গঠনও অনেকটা ইহাদেরই মত। তিনকড়িকে কেন্দ্ৰ করিয়া ইহাদের মজলিস বসিলে, অন্তত সিকি মাইল দূর হইতে সমবেত অট্টহাসির শব্দ শোনা যায়। অথবা শোনা যায় বসার উচ্চকণ্ঠের আস্ফালন। অথবা শোনা যায় ঈষৎ জড়িত কণ্ঠের সমবেত গান।

নিস্তব্ধ আসর দেখিয়া দেবু শঙ্কিত হইল। কি ব্যাপার তিনু-কাকা?

তিনকড়ি এতক্ষণে মুখ তুলিয়া দেবুকে লক্ষ্য করিল; বলিল—এস বাবা!

দেবু বলিল—এমন করে চুপচাপ কেন আজ?

রামভল্লা বলিল—মোড়ল-দাদার ভাল গাইটি আজ মরে গেল পণ্ডিত মাশায়।

তিনকড়ি একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—শুধু তাই নয় বাবা! হারামজাদা ছিদমে ঘোষপাড়াতে কাল রেতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পঞ্চাশবার আমি বলেছিলাম ওরে হারামজাদা ছিদমে, তোর বয়েস এখন কাঁচা, হাজার হলেও ছেলেমানুষ, যাস নি। তা শুনলে না।

—ঘোষপাড়ায় ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে? কই, ঘোষপাড়ায় ডাকাতি হয়েছে বলে কিছু শুনি নাই তো?

—এ ঘোষপাড়া নয়। মৌলিক ঘোষপাড়া-মুরশিদাবাদের পাহাটির ধারে। কেউ কেউ পাঁচহাটি-ঘোষপাড়াও বলে।

দেবুর বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না! পাঁচহাটি সে নিজেই গিয়াছে। সপ্তাহে পাঁচদিন হাট বসে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত হাট। তরিতরকারি হইতে আরম্ভ করিয়া চাল-ডাল, মসলাপ, এমনকি গরু-মহিষ পর্যন্ত কেনা-বেচা হয়। মৌলিক-ঘোষপাড়াও সে একবার দেখিয়াছে, বনিয়াদী মৌলিক উপাধিধারী কায়স্থ জমিদারের বাস। প্রকাণ্ড বাড়ি। কায়দা-করণ কত! কিন্তু পাঁচটি যে এখান হইতে অন্তত বার ক্ৰোশ পথ চব্বিশ মাইল! এখান হইতে সেখানে ডাকাতি করিতে গিয়াছে। ছিদাম ভল্লা! ঊনিশ-কুড়ি বছরের লিকলিকে সেই লম্বা ঘোড়াটা!

সবিস্ময়ে দেবু বলিল—সে যে এখান থেকে বার-চোদ্দ ক্ৰোশ পথ।

অত্যন্ত সহজভাবে রাম বলিল–হ্যাঁ, তা হবে বৈকি!

–এত দূর ডাকাতি করতে গিয়েছে? ছিদমে? সেই ছোঁড়াটা? কাল বিকেল বেলাতেও যে আমি তাকে দেখেছি! আমার সঙ্গে পথে দেখা হল।

–হ্যাঁ। সন্ধের সময় বেরিয়েছে।

তিনকড়ি বলিল-হারামজাদা ধরা পড়ল,—এরপর গোটা গা নিয়ে টানাটানি করবে। আমাকেও বাদ দেবে না, বাবা-দেবু। সে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।

দেবু চমকাইয়া উঠিল। তিনকড়ির মত লোকের মাথায় হাত দিয়া বসিয়া থাকার অর্থ এতক্ষণে তাহার কাছে স্পষ্ট হইয়া উঠিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই সে সংযত হইয়া বলিল—করে, তার উপায় নাই! সে অবশ্যই সহ্য করতে হবে। কিন্তু তাতেই বা ভয় কি? আদালত তো আছে। মিথ্যাকে সত্যি বলে চালাতে গেলে সে চলে না।

তিনকড়ি একটু হাসিল।

রাম হাসিয়া বলিলপণ্ডিত বাজে কথা বলে নাই তিনু-দাদা। তুমি ভেবো না কিছু। পুলিশ হুজ্জোৎ করবে—মেজেস্টারও হয়ত দায়রায় ঠেলবে। কিন্তু দায়রাতে তোমার সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি দেখে।

হঠাৎ রাত্রির অন্ধকার যেন শিহরিয়া উঠিল; নিকটেই কোথায় ধ্বনিত হইয়া উঠিল কাহার মর্মান্তিক দুঃখে বুকফাটা কান্না! সকলেই চমকিয়া উঠিল।

তিনকড়ি বলিল—কে রে রাম? কে কাঁদছে?

রামের চাঞ্চল্য ইহারই মধ্যে প্রশমিত হইয়া গিয়াছে; সে বলিলরতনের বেটাটা গেল বোধহয়।

তারিণী বলিল হ্যাঁ! তাই লাগছে।

হঠাৎ তিনকড়ি উঠিয়া পাড়াইল, ক্ষুব্ধ আক্ৰোশে বলিয়া উঠিল-মানুষে মানুষ খুন করলে কঁসি হয়, কিন্তু রোগকে ধরে ফাঁসি দিক্ দেখি! আয় রাম, দেখি। যা হবার সে তো হবেই–তার লেগে ভেবে কি করব?

সে হনহন করিয়া সকলের আগেই চলিয়া গেল। দেবু একটু বিস্মিত হইল। তিনু-কাকার এমন বিচলিত অবস্থা সে কখন দেখে নাই। সকলে চলিয়া গেল সে দাঁড়াইয়া রহিল। ভাবিতেছিল, রতনের বাড়ি যাইবে কি না? গেলে, যে কাজের জন্য সে আসিয়াছে—সে কাজ আজ আর হইবে না। এদিকে স্বর্ণের পরীক্ষার জন্য অনুমতির আবেদন পাঠাইবার দিনও আর। বেশি নাই। রতনের বাড়ি গিয়াই বা কি হইবে? কি করিবে সে? শুধু পুত্ৰশোকাতুর মা-বাপের বুকফাটা আর্তনাদ শোনা, তাহাদের মর্মান্তিক আক্ষেপ চোখে দেখা ছাড়া আর কিছুই করিতে পারে না। নাঃ, আর সে দুঃখ দেখিতে পারিবে না। দুঃখ দেখিয়া দেখিয়া তাহার প্রাণ হাঁপাইয়া। উঠিয়াছে। সে এখানে আসিবার পথে আনন্দ-আহ্মদনের প্রত্যাশা লইয়াই আসিয়াছিল। পরে সে অনেক কল্পনা করিয়াছে। বুদ্ধিদীপ্তিমতী স্বর্ণকে সে কঠিন প্রশ্ন করিবে, স্বর্ণ প্রথম শূন্যদৃষ্টিতে ভাবিতে থাকিবে; হঠাৎ তাহার চোখ দুটি চেতনার চাঞ্চল্যে দীপশিখার মত জ্বলিয়া উঠিবে, মুখে স্মিত হাসি ফুটিবে, ব্যর্থ হইয়া বলিয়া দিবে সে প্রশ্নের উত্তর। আরও কঠিনতর প্রশ্ন করিবে সে; স্বর্ণ সে প্রশ্নের উত্তর ভাবিয়া পাইবে না। তখন তাহার স্তিমিত চোখের প্রদীপে জানার আলোক শিখা সে জ্বালাইয়া দিবে। বলিবেশোন, উত্তর শোন। সে উত্তর বলিয়া যাইবে, স্বর্ণের চোখে দীপ্তি ফুটিবে, আর বুদ্ধিমতী মেয়েটির মুখে ফুটিয়া উঠিবে পরিতৃপ্ত কৌতূহলের তৃপ্তি ও শ্রদ্ধান্বিত বিস্ময়। গৌরও হয়ত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া শুনিবে। গৌরের বুদ্ধি ধারালো নয়, কিন্তু অফুরন্ত তাহার প্রাণশক্তি। মধ্যে মধ্যে তাহার প্রাণশক্তির স্ফুরণের স্পর্শ সে পাইবে। সাহায্য-সমিতির জন্য হয়ত ইহারই মধ্যে সে কোনো নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়া বসিয়া আছে। পড়াশুনার অবসরের মধ্যে মৃদু কণ্ঠে বলিবে-দেবুদা, একটা কথা বলছিলাম কি–।

কল্পনার মধ্যে সে যেন মুক্তির আস্বাদ পাইয়াছিল। দুঃখ হইতে মুক্তি, হতাশা হইতে মুক্তি—দুর্যোগময়ী অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রির অবসানক্ষণে পূর্বাকাশের ললাটরেখার প্রান্তে এ যেন শুকতারার উদয়-আশ্বাস! দুঃখ আর সে সহ্য করিতে পারিতেছে না। মধ্যে মধ্যে তাহার মনে হয়, সে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যায়। তাহার ঘর। ঘরের কথা মনে করিলে তাহার হাসি পায়। বিলু-খোকনের সঙ্গেই তাহার ঘর পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। যেটা আছে, সেইটাতে এবং গাছতলাতে কোনো প্ৰভেদ নাই। পৃথিবীর পথের ধারে গাছতলার অভাব নাই, এটা ছাড়িয়া আর। একটার আশ্রয়ে যাইতেই বা ক্ষতি কি? কিন্তু এই কাজগুলা যেন তাহাকে নেশার মত পাইয়া বসিয়াছে। নেশাখোর যেমন প্রতিজ্ঞা করিয়াও নেশা ছাড়িতে পারে না—নেশার সময় আসিলেই যেমন নেশা করিয়া বসে, সেও তেমনি মনে করে—এই কাজটা শেষ করিয়া আর সে এসবের মধ্যে থাকিবে না; এই শেষ। কিন্তু কাজটা শেষ হইতে না হইতে আবার একটা নূতন কাজের মধ্যে আসিয়া মাথা গলাইয়া বসে।

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন রাত্রিতে ভাগ্যবানের চোখের সম্মুখে বিদ্যুৎ ঝলসিয়া ওঠে বর্ষার দিগন্তের বিদ্যুৎ; আলোর আভাস আসে, গর্জনের শব্দ আসিয়া পৌঁছায় না ভাগ্যবান অন্ধকারের মধ্যেও নিশ্চিন্তে পথ দেখিয়া চলে। কিন্তু ভাগ্যহীনের হাতের আলো নিভিয়া যায়; তাহার ভাগ্যফলের দিগন্তের বিদ্যুতাভার পরিবর্তে আসে ঝড়ো হাওয়া। দেবু যে আনন্দের প্রদীপখানি মনে মনে জ্বালিয়াছিল-সে আলো তিনকড়িদের দুশ্চিন্তার দীর্ঘনিশ্বাস এবং সন্তান-বিয়োগে রতন বান্দীর বুকফাটা আৰ্তনাদের ঝড়ো হাওয়ায় নিমেষে নিভিয়া গেল।

 

দাওয়ায় উঠিয়া সে দেখিল—সামনের ঘরে যেখানে গৌর ও স্বর্ণ বসিয়া পড়ে, সেখানে। কেহই নাই। শুধু একখানা মাদুর পাতা রহিয়াছে, পিলসুজে একটা প্রদীপ জ্বলিতেছে। সে। ডাকিলগৌর।

কেহ সাড়া দিল না।

আবার সে ডাকিলগৌর রয়েছ? গৌর?

এবার ধীরে ধীরে আসিয়া দাঁড়াইল স্বর্ণ।

দেবু বলিল–স্বৰ্ণ!

স্বর্ণ কোনো উত্তর দিল না।

দেবু বলিল–গৌর কই? তোমার পরীক্ষার দরখাস্ত লেখবার কথা বলে এসেছিল সে, তোমার কি কি পড়া দেখিয়ে নেবার আছে বলেছিল!

স্বর্ণ এবারও কোনো কথা বলিল না। প্রদীপটা স্বর্ণের পিছনে জ্বলিতেছে, তাহার সম্মুখ অবয়বে ঘনায়িত ছায়া পড়িয়াছে; তবুও দেবুর মনে হইল—স্বর্ণের চোখ দিয়া জলের ধারা গড়াইয়া পড়িতেছে। সে সবিস্ময়ে একটু আগাইয়া গেল, বলিল—স্বৰ্ণ!

চাপা কান্নার মধ্যে মৃদুস্বরে স্বর্ণ এবার বলিল—কি হবে দেবু-দা?

–কিসের স্বর্ণ? কি হয়েছে?

–বাবা–

—কি? স্বর্ণ? বাবার কি? বলিতে বলিতেই তাহার মনে পড়িল তিনকড়ির কথা। তিনকড়ি তাহাকে বলিতেছিল—ঘোষগায়ে ডাকাতি করতে গিয়ে ছিদাম ধরা পড়েছে। হারামজাদা ধরা পড়ল, এর পর গোটা গা নিয়ে টানাটানি করবে। আমাকেও বাদ দেবে না বাবা। দেবু বুঝিল, আলোচনাটা বাড়ির ভিতর পর্যন্ত পৌঁছিয়া মেয়েদের মনেও একটা আতঙ্কের সঞ্চার করিয়াছে।

অভয়ের সহিত সান্ত্বনা দিয়া সে বলিল—ছিদামের কথা বলছ তো? তা তার জন্যে ভয় কি? মিছিমিছি তিনু-কাকাকে জড়ালেই তো জড়ানো যাবে না! ভগবান আছেন। এখনও দিন-রাত্রি হচ্ছে। সত্য-মিথ্যা কখনও ঢাকা থাকবে না। এ চাকলার লোক সাক্ষি দেবেতিনু-কাকা সে রকম লোক নয়। এর আগেও তো পুলিশ দু-দুবার বি-এল কেস করেছিল কিন্তু কিছুই তো করতে পারে নি। চাকলার লোকের সাক্ষ্য জজ সাহেব কখনও অমান্য করতে পারেন না।

স্বর্ণের কান্না বাড়িয়া গেল, বলিল—কিন্তু এবার যে বাবা সত্যি সত্যি ওদের দলে মিশেছে।

—অ্যাঁ, বল কি? দেবু বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল।

স্বর্ণ বলিল—কেউ আমরা জানতাম না, দেবুদা। আজ সন্ধের সময় রাম-কাকারা এসে চুপিচুপি বাবাকে বললে—সর্বনাশ হয়েছে মোড়ল-দাদা, ছিদ্মে ধরা পড়েছে। আমরা মনে। করলাম, তাড়া খেয়ে ছোঁড়া কোনো দিকে ছটুকে পড়েছে, কিন্তু না-হারামজাদা ধরাই পড়েছে। বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে বললে রামা, তোরাই আমাকে মজালি! তোরাই আমাকে এবার এ পাপ করালি!

দেবু যেন পাথর হইয়া গিয়াছে, সে নির্বাক নিস্পন্দ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

স্বর্ণ মৃদুস্বরে বলিল—কাল বিকেলবেলা বাবা বললে—আমি কাজে যাচ্ছি—ফিরব কাল সকালে; তার আগে যদি ফিরি তো অনেক শেষত্তির হবে। পুলিশে যদি ডাকে তো বলে দিস অসুখ করেছে, ঘুমিয়ে আছে। পুলিশে ডাকে নাই, কিন্তু বাবা ফিরল শেষরাত্রে। হাঁপাচ্ছিল। মদ খেয়েছিল। তা বাবা তোমদ খায়। আমরা কিছু বুঝতে পারি নি। আজ সন্ধেবেলায় রাম–কাকারা যখন এল—

স্বর্ণের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া গেল।

দেবু একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। শেষ—সব শেষ! চৌধুরী ঠাকুর বিক্রয় করিয়াছে, তিনু-কাকা শেষে ডাকাতের দলে ভিড়িয়াছে!

কাপড়ের অ্যাঁচলে চোখ মুছিয়া স্বৰ্ণ বলিল—এরা সব যখন ডাকাতির কথা বলছিল, দাদা তখন ঘরে বসে ছিল—বাবা জানত না। আমি ঘরে এলাম দাদা ইশারা করে আমাকে চুপ করে থাকতে বললে। আমিও চুপ করে দাঁড়িয়ে সব শুনলাম।

আবার একটা আবেগের উচ্ছাস স্বর্ণের কণ্ঠে প্রবল হইয়া উঠিল; বলিল—দাদা বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে দেবুদা।

দেবু চমকিয়া উঠিল। বলিল–চলে গিয়েছে। কেন?

–হ্যাঁ। রাগে, দুঃখে, অভিমানে। যাবার সময় বললে—স্বৰ্ণ, বাবা ফোঁজ করে তো বলিস, আমি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি! এ বাড়িতে আমি আর থাকব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *