২২. মানুষ বন্যায় বিপর্যস্ত

কয়েক দিন পর।

মানুষ বন্যায় বিপর্যস্ত, রোগে জীর্ণ ও শোকে কাতর, অনাহার এবং অচিকিৎসার মধ্যে দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছে। গোমড়কে তাহাদের সম্পদের একটা বিশিষ্ট অংশ শেষ হইয়া যাইতেছে। তাহাদের জীবনের সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া দাঁড়াইয়াছে করাল মূর্তিতে। তবু সে কথা ভুলিয়া তাহারা এ সংঘাতে চঞ্চল হইয়া উঠিল।… ন্যায়রত্ন মহাশয়ের পৌত্র ধর্ম মানে না, জাতি মানে না, ঈশ্বর মানে না—সে উপবীত ত্যাগ করিয়াছে! ন্যায়রত্ন পৌত্রবধূ এবং প্রপৌত্রকে লইয়া দুঃখে লজ্জায় দেশত্যাগ করিয়াছেন। সে দুঃখসে লজ্জার অংশ যেন তাহাদের। শুধু তাই নয়,। ইহাকে তাহারা মনে করিল-পঞ্চগ্রামের পক্ষে মহা অমঙ্গলের সূচনা। তাহারা ঘরে ঘরে হায় হায় করিয়া সারা হইল, আশঙ্কায় শিহরিয়া উঠিল। অনেকে চোখের জলও ফেলিল। বলিল–একপো ধর্ম হয়ত এইবার শেষ, চারপোকলি পরিপূর্ণ। সমস্ত কিছু সর্বনাশের কারণ যেন এই অনাচারের মধ্যে নিহিত আছে।

এই আক্ষেপ—এই আশঙ্কায় তাহারা মৃত্যু কামনা করিল কিনা, তাহারাও জানে না; তবু তাহারা কিছু একটার প্রেরণায় সাহায্য-সমিতির প্রতি বিমুখ হইল—যাহার ফলে মৃত্যু হয়ত অনিবার্য। এই নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অভাব এবং রোগের নির্যাতনের মধ্যে প্রত্যক্ষ মৃত্যু বিভীষিকা সম্মুখে দেখিয়াও আহার এবং ঔষধ প্রত্যাখ্যান অনিবার্য মৃত্যু নয় তো কি?

ন্যায়রত্ন চলিয়া যাওয়ার পরদিন সকালবেলায় বিশ্বনাথ আসিয়াছিল। সেদিন দেবু তাহাকে হিসাবপত্র বুঝিয়া লইতে অনুরোধ করিয়াছিল। বিশ্বনাথ বলিয়াছিল—তুমি একটু বাড়াবাড়ি করছ, দেবু-ভাই! আমাদের সঙ্গে সংস্রব রাখতে না চাও রেখো না। কিন্তু এখানকার সাহায্যের নাম করে দশজনের কাছে টাকা তুলে যে সাহায্য-সমিতি হয়েছে, তার অপরাধটা কি হল?

দেবু হাত জোড় করিয়া বলিয়াছিল—আমাকে মাফ কর, বিশু-ভাই।

আজ আবার বিশ্বনাথ আসিয়াছে। কয়দিন ধরিয়া সে নিজেই সাহায্য-সমিতি চালাইবার চেষ্টা করিতেছিল।

আজও দেবু তাহাকে বলিল-আমাকে মাফ কর, বিশু-ভাই। তারপর হাসিয়া বলিলদেখলে তো নিজেই এ কদিন চেষ্টা করে, একজনও কেউ চাল নিতে এল না!

সত্যই কেহ আসে নাই। গ্রামে গ্রামে জানানো হইয়াছে সাহায্য-সমিতিতে শুধু চাল নয়, ওষুধও পাওয়া যাইবে। কলিকাতা হইতে একজন ডাক্তারও আসিয়াছে। কিন্তু তবুও কেহ। ওষুধ লইতে আসে নাই।

বিশ্বনাথ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।…

এ কয়দিন ধরিয়া বিশ্বনাথ অনেক চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু মানুষগুলি অদ্ভুত। কাছিম যেমনভাবে খোলার মধ্যে তাহার মুখ-সমেত গ্রীবাখানি গুটাইয়া বসিলে তাহাকে আর কোনোমতেই টানিয়া বাহির করা যায় না, তেমনিভাবেই ইহারা আপনাদিগকে গুটাইয়া লইয়াছে। ইহাকে জড়ত্ব বলিয়া বিশ্বনাথ উপহাস করিতে পারে নাই ইহার মধ্যে সহনশক্তির যে এক অদ্ভুত পরিচয় রহিয়াছে তাহাকে সে সসম্মানে শ্ৰদ্ধা করিয়াছে। এই সহনশক্তি। যাহারা আয়ত্ত করিয়াছে রক্তের ধারায় বংশানুক্রমে যাদের মধ্যে এই শক্তি প্রবহমান তাহারা যদি জাগে, তবে সে এক বিরাট শক্তির দুর্জয় জাগরণ হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। যে ডাকে—যাহার ডাকে সে জাগিবে, কুর্মাবতারের মত সমস্ত ধরিত্রীর ভার বহনের জন্য সে জাগিয়া উঠিবে; তেমন ডাক সে দিতে পারি না। তাই বোধহয়, তাহার ডাকে তাহারা সাড়া দিল না।

সে ওই বীরবংশী—অর্থাৎ শিক্ষিত ডোম বন্ধুটিকে লইয়া গ্রামে গ্রামে হরিজনপল্লীতে মিটিং করিবার বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিল। মিটিং করিতে পারিলে কি হইত বলা যায় না, কিন্তু মিটিং হয় নাই। মিটিং করিতে দেয় নাই ভূমির স্বামী ভূস্বামীবর্গ; যাহারা বিশ্বনাথের অনাচারের জন্য ন্যায়রত্নকে সামাজিক শাস্তি দিবার সংকল্প করিয়াছিল—তাহারাই; কঙ্কণার বাবুরা, শ্ৰীহরি ঘোষ। হাঁটতলা জমিদারের, গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ জমিদারের, ধর্মরাজতলার বকুলগাছের তলদেশের মাটিও জমিদারের; সেখানে যত পতিত ভূমি, এমনকি ময়ূরাক্ষীর বালুময় গর্ভও তাহাদের। বিশ্বনাথ এই দেশেরই মানুষ-বাল্যকাল হইতে এই দেশের ধুলা-কাদা মাখিয়া মানুষ হইয়াছে; সে-ও ভাবিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল—এত পথে ধূলা সে মাখিয়াছে, পঞ্চগ্রামের মানুষ বাঁচিয়া আছে—পথ চলিতেছে—পরের মাটিতে। নিজেদের বলিতে তাহাদের ঘরের অঙ্গনটুকু ছাড়া আর কিছুই নাই। ব্যবহারের অধিকার বলিয়া একটা অধিকারের কথা বরাবর শুনিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু সে অধিকারও জমিদার নাকচ করিয়া দিল আদালতের সীলমোহর-যুক্ত পরোয়ানার সাহায্যে। আদালতে দরখাস্ত করিয়া জমিদারেরা পরোয়ানা বাহির করিয়া আনিল–এই এই স্থানে মিটিঙের উদ্দেশ্যে তোমাদের প্রবেশ করিতে নিষেধ করা যাইতেছে। অন্যথা করিলে অনধিকার-প্রবেশের দায়ে অভিযুক্ত হইবে।

এ আদেশ অমান্য করিবার কল্পনাও বিশ্বনাথের দল করিয়াছিল। কিন্তু কি ভাবিয়া সে কল্পনা ত্যাগ করিয়াছে। দলের অন্য সকলে কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়াছে। বিশ্বনাথ দেবুর কাছে আসিয়াছে সাহায্য-সমিতির ভার দিতে।…

দেবু বলিল—বিশু-ভাই, তুমি আমাকে রেহাই দাও। তুমি ঠাকুর মশায়ের পৌত্র-তুমি যা-ই কর, তোমার বংশের পুণ্যফল তোমাকে রক্ষা করবে। কিন্তু আমি ফেটে মরে যাব।

বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিল—এটা তোমার ভুল বিশ্বাস, দেবু-ভাই! কিন্তু সে যাক্ গে। এখন আমিই সাহায্য-সমিতির সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ ছেড়ে দিচ্ছি। অন্য সকলে তো চলেই গেছেন, আমিও চলে যাব। আমার সঙ্গে সংস্রব না থাকলে তো কারও আপত্তি হবে না।

দেবু কোনো উত্তর দিল না। মাথা নিচু করিয়া চুপ করিয়া রহিল।

–দেবু?

ম্লান হাসি হাসিয়া দেবু বলিল—বিশু-ভাই!

বিশ্বনাথ বলিল—এতে আর তুমি অমত কোরো না।

—লোকে হয়ত তবু আর সাহায্য-সমিতিতে আসবে না, বিশু-ভাই!

—আসবে। বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিলনা আসে তোমাকে বুঝিয়ে আনতে হবে। তুমি পারবে। টাকা-পয়সা তো জাত মেনে হাত ঘোরে না, ভাই! চণ্ডালের ঘরের টাকা বামুনের হাতে এলেই শুদ্ধ হয়ে যায়।

কাটার খোঁচার মত একটু তীক্ষ্ণ আঘাত দেবু অনুভব করিল; সে বিশ্বনাথের মুখের দিকে চাহিল। অদ্ভুত বিশু-ভাইয়ের মুখখানিকোনোখানে এক বিন্দু এমন কিছু নাই—যাহা দেখিয়া অপ্রীতি জন্মে, রাগ করা যায়। বিশ্বনাথের হাত ধরিয়া সে বলিল—কেন তুমি এমন কাজ করলে, বিশু-ভাই?

বিশ্বনাথ কথার উত্তর দিল না, অভ্যাসমত নীরবে হাসিল।

দেবু বলিল কঙ্কণার বাবুরা ব্রাহ্মণ হলেও সায়েবদের সঙ্গে এক-টেবিলে বসে খানা খায়-অখাদ্য খায়, মদ খায়, অজাত-কুজাতের মেয়েদের নিয়ে ব্যভিচার করে তাদের আমরা ঘেন্না করি। হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, পথের ভিখিরিরা পর্যন্ত ঘেন্না করে। ভয়ে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ঘেন্না করে। ওরা বামুনও নয়, ধর্মও ওদের নাই। কিন্তু রোগে, শোকে দুঃখে, বিশু-ভাই, মরণে পর্যন্ত আমাদের ভরসা ছিলে—তোমরা। ঠাকুর মশায়ের পায়ের ধুলো নিলে মনে হত সব পাপ আমাদের ধুয়ে গেল, সব দুঃখু আমাদের মুছে গেল। মনে মনে যখন ভাবতাম, একদিন ভগবান আসবেন, পৃথিবীর পাপীকে বিনাশ করে আবার সত্যযুগ প্রতিষ্ঠা করবেন—তখন মনে পড়ত ঠাকুর মশায়ের মুখ। আজ আমরা কি করে বাঁচব বলতে পার? কার ভরসায় আমরা বুক বাঁধব?

বিশ্বনাথ বলিল—নিজের ভরসায় বুক বাঁধ, দেবু-ভাই! যেসব কথা তুমি বললে, সেসব নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। সে তোমার ভাল লাগবে না। শুধু একটা কথা বলে যাই। যে-কালে দাদুর মত ব্রাহ্মণেরা রাজার অন্যায়ের বিচার করতে পারত, চোখ রাঙালে বড়লোকে। ভয়ে মাটিতে বসে যেত সে-কাল চলে গেছে। এ-কালে অভাব হলে—হয় নিজেরাই দল বেঁধে অভাব ঘুচোবার চেষ্টা কর, নয় যারা আজ দেশরক্ষার ভার নিয়ে বসে আছে—তাদের কাছে দাবি জানাও। রোগ হলে ওষুধের জন্যে চিকিৎসার জন্যে তাদেরই চেপে ধর। অকালমৃত্যুতে তাদেরই চোখ রাঙিয়ে গিয়ে বলকেন তোমাদের বন্দোবস্তের মধ্যে এমন অকালমৃত্যু? গভীর দুঃখে শোকে অভিভূত যখন হবে তখন ভগবানকে যদি ডাকতে ইচ্ছে হয়—নিজেরা ডেকো। ঠাকুর মশায়দের কাজ আজ ফুরিয়ে গিয়েছে; তাই সেই বংশের ছেলে হয়েও আমি অন্য রকম হয়ে গিয়েছি। দাদু আমার মন্ত্র-বিসর্জনের পর মাটির প্রতিমার মত বসে ছিলেন, তাই তিনি চলে গেলেন।

দেবু একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—বিশু-ভাই, তুমি অনেক লেখাপড়া করেছ, তুমি আমাদের ঠাকুর মশায়ের বংশধর—তুমি আমাদের বাঁচাবে—এইটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল। কিন্তু

হাসিয়া বিশ্বনাথ বলিলবলেছি তো, অন্যে তোমাদের আশীর্বাদের জোরে বাঁচাবে, এ ভরসা ভুল ভরসা, দেবু-ভাই! সে ভুল যদি আমা থেকে তোমাদের ভেঙে গিয়েই থাকে, তবে সে ভালই হয়েছে। আমি ভালই করেছি। আচ্ছা, আমি এখন চলি দেবু!

–কিন্তু বিশু-ভাই।

–যেদিন সত্যি ডাকবে, সেইদিন আবার আসব, দেবু-ভাই। হয়ত বা নিজেই আসব। বিশ্বনাথ দ্রুতপদে পথ অতিক্ৰম করিয়া, খানিকটা আগে পথের বাঁকে মোড় ফিরিয়া মিলাইয়া গেল।

পথে যাইতে যাইতে হঠাৎ বিশ্বনাথ দাঁড়াইয়া গেল। কেহ যেন তাহার পথরোধ করিল। তাহার চোখে পড়িল—অদূরবর্তী মহাগ্রাম। ওই যে তাহাদের বাড়ির কোঠাঘরের মাথা দেখা যাইতেছে। ওই যে ঘনশ্যাম কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছটি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে দেখিয়া সে আবার মাথা নিচু করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল। কোন আকর্ষণে সে যে দাদু-জয়া-অজয়কে ছাড়িয়া, ঘরদুয়ার ফেলিয়া, এমনভাবে জীবনের পথে চলিয়াছে—সে কথা ভাবিয়া মধ্যে মধ্যে সে নিজেই বিস্মিত হইয়া যায়। অদ্ভুত অপরিমেয় উত্তেজনা এই পথ চলায়।

–ছোট-ঠাকুর মশায়!

–কে? চকিত হইয়া বিশ্বনাথ চারিপাশে চাহিয়া দেখিল।

পথের বাঁ দিকে মাঠের মধ্যে একটা পুকুরের পাড়ের আমবাগানের মধ্যে দাঁড়াইয়া একটি মেয়ে।

বিশ্বনাথ আবার প্রশ্ন করিলকে? বহুকালের প্রাচীন গাছগুলি বাগানটার নিচের দিকটা ঘন ছায়ায় প্রায় অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে। তাহার উপর একটা নিচু গাছের ডালের আড়ালে মেয়েটির মুখের আধখানা আড়াল পড়িয়া গিয়াছে, চেনা যাইতেছে না।

বাগানের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল দুর্গা।

বিশ্বনাথ বলিল-দুৰ্গা!

–আজ্ঞে।

–এখানে?

–এসেছিলাম মাঠের পানে। দেখলাম আপনি যাচ্ছেন।

–হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি।

—একবারে দেশ-ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আপুনি?

বিশ্বনাথ দুর্গার মুখের দিকে চাহিল। দুর্গার মুখে বিষণ্ণতার ছায়া পড়িয়াছে। বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিল–দরকার হলেই আসব আবার।

দুর্গা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হাসিল। বলিল এব টা পেনাম করে নিই আপনাকে। আপনি তো এখানকার বিপদ-আপদ ছাড়া আসবেন না। তার আগে যদি মরেই যাই আমি! সে আজ অনেকদিন পর খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

সে প্রণাম করিল খানিকটা সমপূর্ণ দূরত্ব রাখিয়া। বিশ্বনাথ হাসিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া আশীৰ্বাদ জানাইয়া বলিল-আমি জাতটাত মানি না রে! আমার পায়ে হাত দিতে তোর

এত ভয় কেন?

দুর্গা এবার বিশ্বনাথের পায়ে হাত দিল। প্রণাম সারিয়া উঠিয়া হাসিয়া বলিলজাত ক্যানে মানেন না ঠাকুর মশায়? এখানে এক নজরবন্দি বাবু ছিলেন তিনিও মানতেন না। বলতেন আমার খাবার জলটা না-হয় তুমিই এনে দিয়ো দুগ্‌গা।

বিশ্বনাথও হাসিল, বলিল—আমার তো এখন পায় নি দুর্গা। নাহলে তোকেই বলতাম আমি এইখানে দাঁড়াই তুই এক গেলাস জল এনে দে আমায়!

দুর্গা আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল—তবে না-হয় আমাকে নিয়ে চলেন। আপনার সঙ্গে। আপনার ঝিয়ের কাজ করব। ঘরদোর পরিষ্কার করব, আপনার সেবা করব।

বিশ্বনাথ বলিল-আমার যে ঘরদোর নেই। এখানকার ঘরই পড়ে থাকল। তার চেয়ে এখানেই থাক্ তুই। আবার যখন আসবতোর কাছে জল চেয়ে খেয়ে যাব।

বিশ্বনাথ চলিয়া গেল; দুর্গা একটু বিষণ্ণ হাসি মুখে মাখিয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল।

 

দেবু চুপ করিয়া বসিয়া আছে।

বিশ্বনাথ চলিয়া যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ সে পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেই যে বসিয়াছিল—এখনও সেই চুপ করিয়া বসিয়া আছে।

ঠাকুর মহাশয় চলিয়া গিয়াছেন। বিশ্বনাথ চলিয়া গেল। তাহার মনে হইতেছে—সে একা। এ বিশ্বসংসারে সে একা! তাহার বিলু, তাহার খোকা যেদিন গিয়াছিল—সেদিন যখন তাহার বিশ্বসংসার শূন্য মনে হইয়াছিল, সেদিন গভীর রাত্রে আসিয়াছিলেন ঠাকুর মহাশয়। যতীনবাবু রাজবন্দি ছিল, অনেকদিন আগেই চলিয়া গিয়াছে। তাহার অভাবেও সে বেদনা অনুভব করিয়াছিল; কিন্তু তখন নিজেকে অসহায় বলিয়া মনে হয় নাই। বিশ্বনাথ কয়েকদিন পরই আসিয়াছিল। কিন্তু আজ সে সত্যই একা। আজ সে একান্তভাবে সহায়হীন—আপনার জন কেহ। পাশে দাঁড়াইতে নাই, বিপদে ভরসা দিতে কেহ নাই, সান্ত্বনার কথা বলে, এমন কেহ নাই। অথচ এ কি বোঝা তাহার ঘাড়ে আজ চাপিয়াছে! এ বোঝা যে নামিতে চায় না। চোখে তাহার জল আসিল। চারিদিক নির্জন,দের চোখের জল সংবরণ করিবার কোনো প্রয়োজন বোধ করিল না। তাহার গাল বাহিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।

এ বোঝা যেন নামিবার নয়। শুধু তাই নয়—বোঝ যেন দিন দিন বাড়িতেছে! বোঝা আজ পাহাড়ের মত ভারী হইয়া উঠিয়াছে। একখানা গ্রাম হইতে পাঁচখানা গ্রামের দুঃখের বোঝা তাহার ঘাড়ে চাপিয়াছে। খাজনা বৃদ্ধির ধর্মঘট হইতে শেখপাড়া কুসুমপুরের সঙ্গে বিরোধ, তারপর এই সর্বনাশা বন্যা, বন্যার পর কাল ম্যালেরিয়া-গোমড়ক। পঞ্চগ্রামের অভাব-অনটন-রোগ-শোক আজ পাহাড়ের সমান হইয়া উঠিয়াছে। সে একা কি করিবে? কি করিতে পারে?

—জামাই-পণ্ডিত! তুমি কাঁদছ?

দেবু মুখ ফিরাইয়া দেখিল—দুর্গা কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

–ছোট-ঠাকুর মাশায় চলে গেলেন—তাতেই কাঁদছ! দুৰ্গা অ্যাঁচলের খুঁটে আপনার চোখ মুছিল। তারপর আবার বলিলতা তুমি যদি যেতে না বলতে—তবে তো তিনি যেতেন না।

চাদরের খুঁটে চোখ-মুখ মুছিয়া দেবু বলিল—আমি তাকে যেতে বলেছি?

দুর্গা বলিল-আমি ঘরের ভেতরে ছিলাম–তোমরা যখন কথা বলছিলে, সব শুনেছি আমি। লোকে আজ চাল নিতে আসে নাই। কাল আসত। কাল না আসত, পরশু আসত। জামাই, পেটের লেগে মানুষ কি না করে বল! … ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলজান তো, আমার দাদা ঘোষালের টাকা দিব্যি হাত পেতে নেয়।

দেবু নীরবে দুর্গার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

দুর্গা আবার বলিল—ছোট-ঠাকুর মশায় পৈতে ফেলে দিয়েছে, জাত মানে না, ধৰ্ম্ম মানে না বলছ, কিন্তু দ্বারিকা চৌধুরী মাশায়ের খবর শুনেছ?

–কি? চৌধুরী মশায়ের কি হল? দেবু চমকিয়া উঠিল। দ্বারিক চৌধুরী কিছুদিন হইতে অসুখে পড়িয়া আছে। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বিদায়ের দিন পর্যন্ত সে আসিতে পারে নাই। বুদ্ধের অবশ্য বয়স হইয়াছে। তবুও তাহার মৃত্যুসংবাদ দেবুর পক্ষে একটা বড় আঘাত হইবে। বৃদ্ধ মানুষ বড় ভাল! দেবুকে অত্যন্ত স্নেহ করে।

দুর্গা বলিল—চৌধুরী মাশায় ঠাকুর বিক্রি করছে।

–ঠাকুর বিক্রি করছে।

–হ্যাঁ। ঠাকুরের সেবা আর চালাতে পারছে না। তার ওপরে বানে আর কিছু রাখে নাই। চৌধুরী মাশায়কে পাল বলেছে—ঠাকুর আমাকে দাও, আমি তোমাকে পাঁচশো টাকা দোব। পাল নিজের বাড়িতে সেই ঠাকুর পিতিষ্ঠে করবে।

—শ্ৰীহরি?

দুর্গা ঘাড় নাড়িয়া একটু হাসিল।

দেবু আবার বলিল চৌধুরী ঠাকুর বিক্রি করছেন?

হ্যাঁ, বিক্রি করছেন। কথাটা এখন চাপা আছে। এখন হাজার হোক মানী লোক বটে তো। চৌধুরী মাশায়। পালের হাতে ধরে বলেছে এ কথা যেন কেউ না জানে পাল-অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন বোলো, অন্য কোনো ঠাঁই থেকে এনেছ। পাল কাউকে বলে নাই।

–বলতে যদি বারণই করেছে—শ্ৰীহরিও যদি বলে নাই কাউকে, তবে তুই জানলি কি করে? দেবু কথাটা কোনোমতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। তর্কের কূটযুক্তিতে সে দুর্গার কথাটা উড়াইয়া দিতে চাহিল। কথার শেষে সেই কথাই সে বলিল–ও তুই কার কাছে বাজে কথা শুনেছিস।

হাসিয়া দুর্গা বলিল—কি আর তোমাকে বলব জামাই-পণ্ডিত, বল!

–কেন?

–আমি বাজে কথা শুনি না। দুর্গা হাসিল–আমার খবর পাকা খবর। মনে নাই?

–কি?

–নজরবন্দির বাড়িতে রেতে জমাদার এসেছিল—তোমাদের মিটিঙের খবর পেয়ে, সে খবর আমি আগে পেয়েছিলাম।

দেবুর মনে পড়িল। সেদিন দুর্গা খবরটা সময়মত না দিলে সত্যই অনিষ্ট হইত। অন্তত ডেটি যতীনবাবুর জেল হইয়া যাইত।

দুর্গা হাসিয়া বলিল—বিলু-দিদির বুন হয়েও আমি তোমার মন পেলাম না, আর লোকে সাধ্যি-সাধনা করে আমার মন পেল না।

দেবুর মুখে-চোখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল; দুর্গার রসিকতা—বিশেষ করিয়া আজ মনের এই অবস্থায় তাঁহার একেবারেই ভাল লাগিল না; সে বলিলথাম দুর্গা। ঠাট্টাতামাশার কথাও নয় এটা সময়ও নয়। বল তুই কার কাছে শুলি?

কয়েক মুহূর্তের জন্য দুর্গা মুখ ফিরাইয়া লইল। তার পরই সে আবার তাহার স্বাভাবিক হাসিমুখে বলিল—নিজের লজ্জার কথা আর কি করে বলি বল? চৌধুরী মাশায়ের বড় বেটা আমাকে বলেছে। সে কিছুদিন থেকে আমার বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরছে। আমি প্রশু ঠাট্টা করেই বলেছিলাম চৌধুরী মশায়, মালাবদল করতে আমি সোনার হার পোব। বললে—তাই দোব আমি। বাবা ছিরু পালকে ঠাকুর বেচেছে পাঁচশো টাকা দেবে। তোকে আমি হারই গড়িয়ে দোব।

দেবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিয়া সহসা উঠিয়া পড়িল। বলিল-আমি এসে রান্না করব দুর্গা।

—কোথায়? প্রশ্নটা করিতে গিয়া দুর্গা চুপ করিয়া গেল। কোথায় যাইতেছে জামাই পণ্ডিত সে বিষয়ে অস্পষ্টতার তো অবকাশ নাই। বারণ করিলেও সে শুনিবে না।

–আসছি। বেশি দেরি করব না।

দেবু হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

 

শিবপুর ও কালীপুরের মধ্যে ব্যবধান একটি দিঘি।

প্রকাণ্ড বড় দিঘি। এক সময়ে ওই চৌধুরীরাই কাটাইয়াছিল। দিঘিটা মজিয়া গিয়াছে। দিঘিটার পাড়েই চৌধুরীদের বাড়ি। এক সময়ে চৌধুরীদের বাঁধানো ঘাট ছিল, ওই ঘাটে চৌধুরীদের গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার স্নানযাত্রা পর্ব অনুষ্ঠিত হইত। ঘাটটির নামই জনার্দনের ঘাট। ঘাটটি এখন ভাঙিয়া গিয়াছে, দিঘিটা মজিয়া আসিয়াছে, পানায় সারা বৎসর ভরিয়া থাকে, তবুও ওইখানেই স্নানযাত্রা পর্বের অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান ঠিক বলা চলে কি না, দেবু জানে না। দেবুর বাল্যকালে চৌধুরীদের ভাঙা হাঁটে ফাটল-ধরা বাঁধাঘাটে স্নানযাত্রার যে অনুষ্ঠান সে দেখিয়াছে, তাহার তুলনায় এখন যাহা হয়—তাহাকে বলিতে হয় অনুষ্ঠানের অভিনয়, কোনোমতে নিয়মরক্ষা।

মজা দিঘিটাতে যে জল থাকিত, তাহাতেও কার্তিক মাসের অনাবৃষ্টিতে অনেক উপকার করিত। অনেকটা জমিতে সেচ পাইত। এবার আবার ময়ূরাক্ষীর বন্যায় দিঘিটার একটা মোহনা ছাড়িয়া গিয়াছে, তাই এই আশ্বিন মাসেই দিঘিটা জলহীন হইয়া পড়িয়া আছে। দিঘির ভাঙা ঘাটে দাঁড়াইয়া দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।

দিঘিটার পরই চৌধুরীদের আম-কঁঠালের বাগান-ঘেরা খিড়কি। খিড়কির ছোট পুকুরটার ওপারেই ছিল চৌধুরীদের সেকালের পাকাবাড়ি। এখনও ছোট পাতলা ইটের স্থূপ পড়িয়া আছে। পাকা বাড়িঘরের আর এখন কিছুই অবশিষ্ট নাই, বহু কষ্টে কেবল চৌধুরী রথের ঘরের ফাটধরা পাকা দেওয়াল করখানি খাড়া রাখিয়াছিল; ছাদ গেলে খড়ের চাল করিয়াছিল; এবার বন্যায় সেখানাও পড়িয়া গিয়াছে। কাঠের রথখানাও ভাঙিয়াছে। সর্বাঙ্গে কাদামাখা রথখানা কাত হইয়া পড়িয়া আছে একটা গাছের গুঁড়ির উপর।

ভগ্নস্তূপ পার হইয়া দেবু চৌধুরীর বর্তমান মাটির বাড়ির সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। বাহিরের ঘরখানার সামনের বারান্দাটার চাল পচিয়া খসিয়া গিয়াছে। বারান্দার উপরে পাতা তক্তপোশটা জলে ভিজিয়া, রৌদ্রে শুকাইয়া, ফুলিয়া-কাঁপিয়া-ফাটিয়া পড়িয়া আছে—জরাজীর্ণ শোথরোগগ্রস্ত বৃদ্ধের মত।

বাড়ির ভিতর-মহলে বাহিরের পাঁচিল ভাঙিয়া গিয়াছে—সেখানে তালপাতার বেড়া দেওয়া হইয়াছে। বেড়ার ফাঁক দিয়াই দেখা যাইতেছে, একদিকে একখানা ঘর ভাঙিয়া একটা মাটির। স্থূপ হইয়া রহিয়াছে; চালের কাঠগুলা এখনও ভাঙিয়া পড়িয়া আছে অতিকায় জানোয়ারের কঙ্কালের মত।

অবস্থা দেখিয়া কিছুক্ষণ দেবুর কণ্ঠনালী দিয়া আওয়াজ বাহির হইল না, তাহার পা উঠিল না; নির্বাক হইয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। চৌধুরীর বাড়ির এ দুরবস্থা সে কল্পনা করিতে পারে না। চৌধুরীর বাড়ি অনেক দিন ভাঙিয়াছে; পাকা ইমারত ইটের পাঁজায় পরিণত হইয়াছে, জমিদারি গিয়াছে, পুকুর গিয়াছে, যে পুকুর আছে, তাও মজিয়া আসিয়াছে। কিন্তু তবুও চৌধুরীর মাটির কোঠা মাটির বাড়িখানার শ্রী ও পারিপাট্য ছিল। চৌধুরীর জমিও কিছু আছে; বন্যার পরে যখ সাহায্য-সমিতির পত্তন হয়, তখনও চৌধুরী নগদ একটি টাকা দিয়াছে। দেবু অনেকদিনই এদিকে আসে নাই; সুতরাং অবস্থার এমন বিপর্যয় দেখিয়া সে প্রায় স্তম্ভিত হইয়া গেল। ইহার উপর চৌধুরীর অসুখ। সে ক্ষুব্ধচিত্তে কঠোর কথা বলিতে আসিয়াছিল, কিন্তু দেখিয়া শুনিয়া সব গোলমাল হইয়া গেল। দেবু একবার ভাবিল—ফিরিয়া যাই! চৌধুরী লজ্জা পাইবে, মর্মান্তিক বেদনা পাইবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ডাকিল—চৌধুরী মশায়? হরেকেষ্ট?

কেহ উত্তর দিল না, কিন্তু বাড়ির ভিতর সাড়া জাগিয়াছে বোঝা গেল। মেয়েরা ফিসফিস করিয়া কাহাকেও কিছু বলিতেছে। চৌধুরী-বাড়ি আজ সাধারণ চাষী গৃহস্থের বাড়ি ছাড়া কিছু নয়—তবুও পর্দার আভিজাত্য এখনও পুরা বজায় আছে।

দেবু আবার ডাকিলহরেকেষ্ট বাড়ি আছ?

হরেকেষ্ট চৌধুরীর বড় ছেলে। সে এবার বাহির হইয়া আসিল; সেই মুহূর্তেই চৌধুরীর ক্ষীণ কণ্ঠস্বরের রেশ ভাসিয়া আসিল আঃ! কে ডাকছেন দেখ না হে!

দেবু বলিল চৌধুরী মশায়কে দেখতে এসেছি।

হরেকেষ্ট নিৰ্বোধ, গাঁজাখোর, সে তাহার বড় বড় দাঁতগুলি বাহির করিয়া আপ্যায়িতের হাসি হাসিয়া বলিল—দেখবেন আর কি? বাবার আমার শেষ অবস্থা, কবরেজ বলেছে—বড়জোর পাঁচ-সাত দিন।

দেবু বলিল—চল, একবার দেখব।

হরেকেষ্ট ব্যস্ত হইয়া উঠিল—এস! এস!—সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরের দিকে উদ্দেশ্য করিয়া হাঁকিয়া—সরে যাও সব একবার। পণ্ডিত যাচ্ছে। দেবু পণ্ডিত।

 

কুড়ি-পঁচিশ দিন পূর্বে চৌধুরী অসুস্থ অবস্থাতেও গাড়ি করিয়া সাহায্য-সমিতির আসরে গিয়াছিল; এই কুড়ি-পঁচিশ দিনের মধ্যেই চৌধুরী যেন আর এক মানুষে পরিণত হইয়াছে মানুষ বলিয়া আর চেনাই যায় না। চামড়ায় ঢাকা হাড়ের মালা একখানি পড়িয়া আছে যেন বিছানার উপর। চোখ কোটরগত, নাকটা খড়ার মত প্রকট, হনু দুইটা উঁচু হইয়া উঠিয়া চৌধুরীর মূর্তিকে ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছে।

চৌধুরী এই অবস্থাতেও হাসিয়া বলিল—এস, বস। শীর্ণ হাতখানি দিয়া চৌধুরী অনতিদূরে পাতা একখানি মাদুর দেখাইয়া দিল। ইহারই মধ্যে চৌধুরী এই ব্যবস্থাটুকু করাইয়া রাখিয়াছে।

দেবু বসিল তাহার বিছানায়। বলিল—এমন কঠিন অসুখ করেছে আপনার? কই, কিছুই তো শুনি নি চৌধুরী মশায়?

চৌধুরী ম্লান হাসি হাসিল। বলিল—ফকিরে যায় আসে, লোকের নজরে পড়বার কথা নয় পণ্ডিত। রাজা-উজির যায়—লোক-লস্কর হক-ডাক, লোকে পথে দাঁড়িয়ে দেখে। বুড়োর যাওয়াও ফকিরের যাওয়া!

দেবু চুপ করিয়া রহিল; তাহার অনুশোচনা হইল—লজ্জা হইল যে, সে এতদিনের মধ্যে কোনো খোঁজখবর করে নাই।

চৌধুরী বলিলবাবা, তুমি ওই মাদুরটায় বস। আমার গায়ে বিছানায় বড় গন্ধ হয়েছে।

চৌধুরীর শীর্ণ হাতখানি আপনার কোলের উপর তুলিয়া দেবু বলিলনা, বেশ আছি।

চৌধুরী বলিল—তোমাকে আশীর্বাদ করি—তোমার মঙ্গল হোক; তোমার থেকে দেশের উপকার হোক মঙ্গল হোক।

দেবু প্রশ্ন করিল–কে চিকিৎসা করছে?

–চিকিৎসা চৌধুরী হাসিল। চিকিৎসা করাই নি। নিজেই বুঝতে পারছি নাড়ি তো একটু-আধটু দেখতে জানি, আর খুব বেশি দিন নয়। একদিন মেয়েরা জিদ করে কবরেজ ডেকেছিল। ওষুধও দিয়ে গিয়েছে, তবে ওষুধ আমি খাই না। আর দিন নাই। কি হবে মিছামিছি পয়সা খরচ করে? একটু জল দাও তো বাবা। ওই যে। হ্যাঁ।

সযত্নে জল খাওয়াইয়া মুখ মুছাইয়া দেবু বলিলনা, না। ওষুধ না খাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।–পয়সা নাই পণ্ডিত।

দেবু স্তম্ভিত হইয়া গেল।

চৌধুরী বলিল—অনেক দিন থেকেই ভেতর শূন্য হয়েছিল। এবার বন্যাতে সব শেষ করে দিলে। ধান যে কটা ছিল ভেসে গিয়েছে। কদিন আগে দুটো বলদের একটা মরেছে, একটা বেঁচেছে; কিন্তু সেও মরারই শামিল। বড় ছেলেটাকে তো জানগাঁজাখোর—নষ্টচরিত্র। ছোটগুলো খেতে পায় না। কি করব?

দেবু বলিল—কাল ডাক্তার নিয়ে আসব।

–না।

–না নয়। ডাক্তারকে না চান, কবরেজ নিয়ে আসব আমি।

–না। চৌধুরী এবার বারবার ঘাড় নাড়িয়া বলিলনা, পণ্ডিত না। বাঁচতে আমি আর চাই না। একটুখানি স্তব্ধ থাকিয়া আবার বলিল—ঠাকুর মশায় কাশী গেলেন বিছানায় শুয়েই বৃত্তান্ত শুনলাম। ড়ুলি করে একবার শেষ দর্শন করতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু লজ্জাতে তাও পারলাম না। পণ্ডিত, আমি কি করেছি জান?

দেবু চৌধুরীর মুখের দিকে চাহিল।

চৌধুরীর মুখে তিক্ত হাসি ফুটিয়া উঠিল; বলিল—আমি আমাদের লক্ষ্মীজনার্দন ঠাকুরকে বিক্রি করেছি। শ্ৰীহরি ঘোষ কিনলেন।

ঘরখানা অস্বাভাবিকরূপে স্তব্ধ হইয়া গেল। কথাটি বলিয়া চৌধুরী বহুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। দেবুও কোনো কথা বলিতে পারিল না।

বহুক্ষণ পরে চৌধুরী বলিল-লক্ষ্মী না থাকলে নারায়ণও থাকেন না, পণ্ডিত! ঠাকুরও দেখলাম সম্পদের ঠাকুর। গরিবের ঘরে উনি থাকেন না। আমি স্বপ্ন দেখলাম পণ্ডিত। ঠাকুর আমাকে স্বপ্নে তাই বললেন।

সবিস্ময়ে দেবু প্রশ্নের আকারে কথাটার শুধু পুনরুক্তি করিল—স্বপ্নে বললেন?

–হ্যাঁ। বহুক্ষণ ধরিয়া বারবার থামিয়া—মধ্যে মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চৌধুরী বলিয়া গেল—একদিন ঘরে কিছুই ছিল না। আতপ চালও একমুঠো ছিল না যে নৈবেদ্য হয়। ভোগ তো দূরের কথা। নিরুপায় হয়ে বড় ছেলেটাকে পাঠালাম-মহাগ্রামে ঠাকুর মশায়ের কাছে। ওটা গাঁজা খায়—মধ্যে মধ্যে ঘোষের দরবারে আজকাল যায় তামাক খেতে, হয়ত ঘোষের ওখানে নেশাও পায়। ও ঠাকুর মশায়ের বাড়ি না গিয়ে ঘোষের বাড়ি গিয়েছিল। ঘোষ আতপ চাল দিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল—তোমার বাবাকে বোলো ঠাকুরটি আমাকে দেন। আমার ইচ্ছে ঠাকুর প্রতিষ্ঠে করি। না-হয় পাঁচশো টাকা দক্ষিণে আমি দোব।… হতভাগা আমাকে এসে সেই কথা বললে। বলব কি দেবু, মনে মনে বারবার ঠাকুরকে অন্তর ফাটিয়ে বললাম,-ঠাকুর, তুমি আমাকে সম্পদ দাও, তোমার সেবা করি সাধ মিটিয়ে; এ অপমান থেকে আমাকে বাঁচাও। নইলে বল আমি কি করব? রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম–শ্ৰীহরির ঘরে ঠাকুর প্রতিষ্ঠে হচ্ছে। আমি টাকা নিচ্ছি। শ্ৰীহরির কাছে। প্রথম দিন মনে হল—চিন্তার জন্যে এমন স্বপ্ন দেখেছি; বলব কি পণ্ডিত, দ্বিতীয় দিন দেখলাম আমাদের পুরুত মশায় বলছেন—আপনি শ্রীহরির ঘরেই ঠাকুরকে দিয়ে আসুন। ঠাকুর রেখে আপনি কি করবেন? পরের দিন আবার দেখলাম আমার মৃত্যুর পর ছেলেরা হয়ত নিত্যপূজাই তুলে দেবে। চৌধুরী হাসিয়া বলিল, আর রাখবেই বা কি করে? নিজেদেরই যে অন্ন। জুটবে না। যে জমিটুক আছে, তাও বন্ধক ছিল ফেলারাম চৌধুরীর কাছে। একশো টাকা—সুদে আসলে আড়াইশো হয়েছে। শ্ৰীহরিকে ডেকে পাঁচশো টাকা নিলাম পণ্ডিত। জমিটা ছাড়িয়ে নিলাম। কি করব, বল!

দেবু স্তম্ভিত, নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল-আচ্ছা, আজ আমি উঠি।

–উঠবে?

–হ্যাঁ। আজ যাই, আবার আসব।

–এস।

দীর্ঘক্ষণ কথা বলিয়া চৌধুরী শ্ৰান্ত হইয়া পড়িয়াছিল; একটা গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া নিথর হইয়া সে-ও চোখ বুজিল।

 

দেবু আসিয়াছিল চৌধুরীর উপর ক্ষোভ লইয়া। অর্থের জন্য দেবতা—বংশের ঠাকুরকে বিক্রয় করিয়াছে শুনিয়া তাহার যে ক্ষোভ হইয়াছিল, সে ক্ষোভ সে দুঃখ ন্যায়রত্নের দেশত্যাগের জন্য ক্ষোভ-দুঃখের চেয়ে বড় কম নয়। তাহার প্রিয়তম বন্ধু, জীবনের একমাত্র ভরসার স্থল বিশু-ভাইকে সে যেমন ত্যাগ করিয়াছে, তেমনিভাবে চৌধুরীকে পরিত্যাগের বার্তাই সে শুনাইতে আসিয়াছিল। দূর হইতে মনে মনে সংকল্প করিয়া তাহার ক্ষোভ মেটে নাই, তাই সে আসিয়াছিল চৌধুরীকে সে কথা রূঢ়ভাবে শুনাইয়া দিবার জন্য; কিন্তু সে ফিরিল নির্বাক বেদনার ভার লইয়া। চৌধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ তাহার আর নাই। মনে মনে বার বার সে দোষ দিল—অভিযুক্ত করিল দেবতাকে। এক্ষেত্রে চৌধুরী আর কি করিতে পারি? স্বপ্নগুলি যদি তাহার মনের ভ্রমও হয়—তবুও সব দিক বিচার করিয়া দেখিয়া মনে হইল, চৌধুরী ঠিকই করিয়াছে। তাহার কর্তব্য সে করিয়াছে। চিরদিন সংসারের শ্রেষ্ঠ বস্তু দিয়া ষোড়শোপচারে পূজা করিয়াছে-ভোগ দিয়াছে, আজ নিঃস্ব অবস্থায় সেই দেবতার সেবাভোগ দিতে পারিবে না বলিয়া সে যদি সম্পদশালীর হাতেই দেবতাকে দিয়া থাকে তবে সে অন্যায় করে নাই, তাহার কর্তব্যই করিয়াছে; কিন্তু দেবতা তাহার কি করিল? হঠাৎ তাহার মনে পড়িল ঠাকুর মহাশয়ের গল্প। দুঃখ তাহার পরীক্ষা।

না–না। সে আপন মনেই বলিলনা। এই বিশ্বজোড়া দুঃখ তাহার পরীক্ষা বলিয়া আজ আর কিছুতেই সে মানিয়া লইতে পারিতেছে না। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক দিয়া গোটা দেশটাকে ছন্নছাড়া করিয়া পরীক্ষা!

পথ দিয়া আসিতে আসিতে শুনিল—পাশেই শিবপুরের বাউরিপাড়ায় কয়েকটি নারীকন্ঠের বিনাই বিনাইয়া কান্নার সুর উঠিতেছে।

বাঁ দিকে আউশের মাঠ খাঁখাঁ করিতেছে। ধান নাই। সামনে আসিতেছে কার্তিক মাস, রবিফসল চাষের সময়, লোকের শক্তি-সামৰ্থ নাই, গরু নাই, সে চাষও হয়ত অসম্ভব হইয়া উঠিবে। তাহারও আগে পূজা-দুর্গাপূজা। পূজাও বোধহয় এবার হইবে না। ঠাকুর মহাশয়ের বাড়ির পূজা করিবে তাঁহারই টোলের এক ছাত্র। তিনি তাহাকেই ভার দিয়া গিয়াছেন। কিন্তু ঠাকুর মশায় না থাকিলে—সে কি পূজা হইবে? মহাগ্রামের দত্তদের পূজা গতবারেও তাহারা ভিক্ষা করিয়া করিয়াছিল। এবার আর হইবেই না। লোকের ঘরে নূতন কাপড়চোপড়, ছেলেদের জামা-পোশাক–হইবে না।

সব শেষ হইয়া গেল। সব শেষ।

ঠাকুর মহাশয় চলিয়া গিয়াছেন, চৌধুরী মৃত্যুশয্যায়; মাতব্বর বলিতে পঞ্চগ্রামে আর কেহ রহিল না। ছেলেবেলায় প্রাচীনকালের লোকেদের কাছে শুনিয়াছিল—তেমুণ্ডের পরামর্শ লইতে হয়; তেমুণ্ড অর্থাৎ তিনটা মুণ্ড যাহার, তাহার কাছে। প্রথমে তাহার বিস্ময়ের আর সীমা ছিল না। তার পরই শুনিয়াছিল—তেমুণ্ড হইল অতি প্রাচীন বৃদ্ধ। উবু হইয়া বসিয়া থাকে, দুই পাশে থাকে হাঁটু দুইটা; মাঝখানে টাকপড়া চকচকে মাথাটি দূর হইতে দেখিয়া মনে হয় তিনমুণ্ডবিশিষ্ট মানুষ। তেমুণ্ড দূরে থাক, আজ পরামর্শ দিবার কোনো প্রবীণ লোকই রহিল না।

অন্নহীন দেশ, শক্তিহীন রোগজর্জর মানুষ, উপদেষ্টা-অভিভাবকহীন সমাজ। দেবতারা পর্যন্ত নির্দয় হইয়া সেবা-ভোগের জন্য ধনীদের ঘরে চলিয়াছেন। এদেশের আর কি রক্ষা আছে।

কোনো আশা নাই, সব শেষ।

গভীর হতাশায় দুঃখে দেবু একেবারে ভাঙিয়া পড়িল। ভিক্ষা করিলেও এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোককে বাঁচানো কি তাহার সাধ্য! পরক্ষণেই মনে হইল—একজন পারিত, বিশু-ভাই হয়ত পারিত! সে-ই তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছে।…

 

তাহার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইয়া গেল।

কিসের ঢোল পড়িতেছে? ও কিসের ঢোল? ঢোল পড়ে সাধারণত জমি নিলামের ঘোষণায়—আজকাল অবশ্য ইউনিয়ন বোর্ডের হাকিমদের হুকুমজারি ঢেল সহযোগে হইয়া থাকে। ট্যাক্সের জন্য অস্থাবর ক্রোক, ট্যাক্স আদায়ের শেষ তারিখ, ট্যাক্স বৃদ্ধি প্রভৃতির ঘোষণা—হরেক রকমের হুকুম। এ ঢোল কিসের? দেবু দ্রুতপদে অগ্রসর হইল।

চিরপরিচিত ভূপাল একজন মুচিকে লইয়া ঢোল সহরত করিয়া চলিয়াছে!

–কিসের ঢোল, ভূপাল?

–আজ্ঞে, ট্যাক্স।

–ট্যাক্স? এই সময় ট্যাক্স?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আর খাজনাও বটে।

দেবুর সমস্ত শরীর যেন কেমন করিয়া উঠিল। এই দুঃসময়—তবু ট্যাক্স চাই, খাজনা চাই। কিন্তু সে কথা ভূপালকে বলিয়া লাভ নাই। সে দীর্ঘ দ্রুত পদক্ষেপে ভূপালদের পিছনে ফেলিয়া অগ্রসর হইয়া গেল।

দুঃখে নয়—এবার ক্ষোভে ক্রোধে তাহার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করিয়া উঠিল।

কোনো উপায় কি নাই? বাঁচিবার কি কোনো উপায়ই নাই?

চণ্ডীমণ্ডপে শ্ৰীহরির সেরেস্তা পড়িয়াছে। গোমস্তা দাসজী বসিয়া আছে। কালু শেখ কাঠের ধুনি হইতে একটা বিড়ি ধরাইতেছে। ভবেশ ও হরিশ বসিয়া আছে, তাহাদের হাতে হুঁকা। মহাজন ফেলারাম ও শ্রীহরি বকুলগাছের তলায় দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছে—কোনো গোপন কথা, কাহারও সর্বনাশের পরামর্শ চলিতেছে বোধহয়।

গতিবেগ আরও দ্রুততর করিল দেবু।

বাড়ির দাওয়ার উপর গৌর চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ওই একটি ছেলে। বড় ভাল ছেলে। একেবারে বাড়ির সম্মুখে আসিয়া সে বিস্মিত হইয়া গেল। একটা লোক তাহার তক্তপোশের উপর শুইয়া ঘুমাইতেছে। লোকটার পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে সস্তাদরের কামিজ ও কোট; পায়ে হেঁড়া মোজা; জুতাজোড়াটা নূতন হইলেও দেখিলে বুঝা যায় কমদামি। হ্যাটও আছে, হ্যাটটা মুখের উপর চাপা দিয়া দিব্য আরামে ঘুমাইতেছে, মুখ দেখা যায় না। পাশে টিনের একটা সুটকেস।

দেবু গৌরকে প্রশ্ন করিল–কে গৌর?

গৌর বলিলতা তো জানি না। আমি এখুনি এলাম; দেখলাম, এমনিভাবেই শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দেবু সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে আবার লোকটার দিকে চাহিল।

গৌর ডাকিল দেবু-দা!

–কি?

–ভিক্ষের বাক্সগুলো নিয়ে এসেছি। চাবি খুলে পয়সাগুলো নেন। আরও পাঁচ-ছটা বাক্স দিতে হবে। আমাদের আরও পাঁচ-ছজন ছেলে কাজ করবে।

দেবু মনে অদ্ভুত একটা সান্ত্বনা অনুভব করিল। তালাবদ্ধ ছোট ছোট টিনের বাক্স লইয়া গৌরের দল জংশন-স্টেশনে যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা করে। সেই বাক্সগুলি পূর্ণ করিয়া সে পয়সা লইয়া আসিয়াছে। সংবাদ আনিয়াছে—তাহার দলে আরও ছেলে বাড়িয়াছে; আরও ভিক্ষার বাক্স চাই। পাত্রে ভিক্ষা ধরিতেছে না। আরও পাত্র চাই।

সে সস্নেহে গৌরের মাথায় হাত বুলাইয়া দিল।

গৌর বলিল-আজ একবার আমাদের বাড়ি যাবেন? সন্ধের সময়?

–কেন? দরকার আছে কিছুঃ কাকা ডেকেছেন নাকি?

—না, স্বন্ন এবার পরীক্ষা দেবে কিনা। তাই দরখাস্ত লিখে দেবেন। আর স্বন্ন তার পড়ার কতকগুলো জায়গা জেনে নেবে।

–আচ্ছা, যাব। গভীর স্নেহের সঙ্গে দেবু সম্মতি জানাইল। গৌর আর স্বর্ণ-ছেলেটি আর মেয়েটির কথা ভাবিয়া পরম সান্ত্বনা অনুভব করিল দেবু। আর ইহারা বড় হইলে এ অঞ্চলের। অবস্থা আর এক রকম হইয়া যাইবে।

বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল দুর্গা, সে ঝঙ্কার দিয়া বুলিল—যাক, ফিরতে পারলে? খাবেদাবে কখন?

তাহার শাসনে দেবু না হাসিয়া পারিল না; বলিল—এই যে! চল।

দুর্গা একটু হাসিয়া বলিল-লাও, আবার কুটুম এসেছে!

–কুটুম?

–ওই যে! দুৰ্গা ঘুমন্ত লোকটিকে দেখাইয়া দিল।

দেবুর কথাটা নূতন করিয়া মনে হইল। সবিস্ময়ে সে বলিল—তাই বটে! ও কে রে?

–কর্মকার!

–কর্মকার?

–অনিরুদ্ধ গো! চাকরি করে সায়েব সেজে ফিরে এসেছে। মরণ আর কি!

–অনিরুদ্ধ? অনি-ভাই?

–হ্যাঁ।

কথাবার্তার সাড়াতেই, বিশেষ করিয়া বার বার অনিরুদ্ধ শব্দটার উচ্চারণে অনিরুদ্ধ জাগিয়া উঠিল। প্রথমে মুখের টুপিটা সরাইয়া দেবুর দিকে চাহিল, তার পর উঠিয়া বসিয়া বলিল—দেবু–ভাই! রামরাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *