২২. উপসংহার

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
উপসংহার

ঝিন্দ্‌ রাজপ্রাসাদের সদর ও অন্দরের মধ্যবর্তী বিশাল কক্ষটির কেন্দ্রস্থলে আবলুশের টেবিলের সম্মুখে বসিয়া ঝিন্দের রাজা শঙ্কর সিং পত্র লিখিতেছেন।

চারিদিকের ভোলা জানালার বাহিরে রৌদ্র-প্রফুল্ল প্রভাত; কয়েক দিন আগে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হইয়া। গিয়া আকাশ পালিশ করা ইস্পাতের মত ঝকঝক করিতেছে; কোথাও এতটুকু মলিনতার চিহ্ন নাই।

শঙ্কর সিং পত্র লিখিতেছেন বটে, কিন্তু নিবিষ্টমনে পত্র শেষ করিবার অবকাশ পাইতেছেন না। ঘরের দ্বারে রুদ্ররূপ পাহারায় আছে এবং প্রাসাদের সদরে স্বয়ং ধনঞ্জয় বাঘের মত থাবা পাতিয়া বসিয়া আছেন; তবুও রাজদর্শনপ্রার্থী সম্রান্ত জনগণের স্রোত ঠেকাইয়া রাখা যাইতেছে না। ডাক্তার। গঙ্গানাথের দোহাই পর্যন্ত কেহ মানিতেছে না। শক্তিগড় দুর্গে রাজার প্রতি হিংসুক উদিতের আক্রমণ ও রাজার অসাধারণ বাহুবলে উদিত, ময়ূরবাহন প্রভৃতির মৃত্যুর কথা রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে। উদিত যে রাজাকে দুর্গে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া গিয়া বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক তাঁহাকে হত্যা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, একথা কাহারও অবিদিত নাই। মন্ত্রী বজ্ৰপাণি ভার্গব ও সর্দার ধনঞ্জয় এই শোচনীয় ভ্রাতৃবিরোধের কাহিনী গোপন করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। সত্য কথা চাপিয়া রাখা যায় না, প্রকাশ হইয়া পড়িবেই। তাই গত কয়েকদিন ধরিয়া দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ ক্রমাগত রাজাকে অভিনন্দন জানাইয়া যাইতেছেন।

তাঁহাদের শুভাগমনের ফাঁকে ফাঁকে পত্ৰ-লিখন চলিতেছে–

—যার হাতে চিঠি পাঠালাম, তার নাম প্রহ্লাদচন্দ্র দত্ত। সে বাঙালী, যদিও তার ভাষা শুনলে সে বিষয়ে সন্দেহ জন্মাতে পারে। কিন্তু ভাষা যাই হোক, প্রহ্লাদ খাঁটি বাঙালী। গত কয়েক দিন ধরে আমি কেবলই ভাবছি, প্রহ্লাদ যদি বাঙালী না হত? অনেককে বলতে শুনেছি, বাঙালীর ভায়ে ভায়ে মিল নেই, যেখানে দুটি বাঙালী সেখানেই ঝগড়া। মিথ্যে কথা। বিদেশে বাঙালীর মত বাঙালীর বন্ধু আর নেই। যদি সন্দেহ হয়, প্রহ্লাদকে স্মরণ কোরো।

.

রুদ্ররূপ দ্বারের পর্দা ফাঁক করিয়া জানাইল, ঝড়োয়ার বিজয়লালকে সঙ্গে লইয়া ধনঞ্জয় আসিতেছেন। শঙ্কর সিং অসমাপ্ত পত্র সরাইয়া রাখিলেন।

বিজয়লাল মিলিটারি স্যালুট করিয়া একখানি পত্র রাজার হাতে দিল। ঝড়োয়ার মন্ত্রিমণ্ডলের পক্ষ হইতে রাজকীয় লেফাফাদুরস্ত পত্র—দেওয়ান লিখিয়াছেন। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হইয়াছে।

পত্রে চোখ বুলাইয়া শঙ্কর সিং বিজয়লালের দিকে দৃষ্টি তুলিলেন; গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন—রানী কস্তুরীবাঈ ভাল আছেন?

আছেন মহারাজ!

মহারাজের গম্ভীর মুখের এক কোণে একটু হাসি দেখা দিল—আর–কৃষ্ণাবাঈ? তিনি ভাল আছেন?

বিজয়লাল অবিচলিত মুখে কেবল একবার মাথা ঝুঁকাইল।

রাজা ধনঞ্জয়ের দিকে ফিরিয়া বলিলেন—সর্দার, সুবাদার বিজয়লালকে আমি আমার খাস পার্শ্বচর নিযুক্ত করতে চাই। এ বিষয়ে ঝড়োয়ার দরবারের সঙ্গে যে লেখাপড়া করা দরকার, তা আজই যেন করা হয়।

যো হুকুম মহারাজ!

রাজা মস্তকের একটি সঙ্কেতে উভয়কে বিদায় দিলেন।

.

-তোমার পায়ে পড়ি অচলবৌদি, দেরি কোরো না। যত শিগগির পারো দাদাকে নিয়ে চলে এস। তোমাদের জন্য যে কি ভয়ঙ্কর মন কেমন করছে তা বলতে পারি না। যদি সম্ভব হত, আমি ছুটে গিয়ে তোমাদের কাছে পড়তাম। কিন্তু এ রাজ্য ছেড়ে বার হবার উপায় নেই, হয়তো ইহজীবনে ছাড়া পাব না। আমি তো ঝিন্দের রাজা নই, ঝিন্দের বন্দী—

.

রুদ্ররূপের ফ্যাকাসে মুখ ক্ষণকালের জন্য পদার ফাঁকে দেখা গেল—ত্রিবিক্রম সিং আসছেন।

কিছুক্ষণ ত্রিবিক্রমের সঙ্গে অভিনন্দনের অভিনয় চলিল। তারপর শঙ্কর সিং সহসা গম্ভীর হইয়া বলিলেন—ত্রিবিক্রম সিং, আমি আপনার মেয়ে চম্পাদের জন্য পাত্র স্থির করেছি।

ত্রিবিক্রম ঈষৎ চমকিত হইয়া মামুলি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিলেন; তারপর দুইবার কাশিয়া পাত্রের নামধাম জানিতে চাহিলেন।

শঙ্কর সিং কহিলেন—ভারি সৎ পাত্র—আমার দেহরক্ষী রুদ্ররূপ। চম্পাও তাকে পছন্দ করে।

ত্রিবিক্রম মনে মনে অতিশয় বিব্রত হইয়া উঠিয়াছেন, তাঁহার মুখ দেখিয়াই বুঝা গেল। তিনি গলার মধ্যে নানাপ্রকার শব্দ করিতে লাগিলেন।

শঙ্কর সিং যেন লক্ষ্য করেন নাই এমনিভাবে বলিলেন—ময়ূরবাহন মরেছে-তার কেউ ওয়ারিস নেই। আমি স্থির করেছি ময়ূরবাহনের জায়গীর রুদ্ররূপকে বকশিশ দেব।

ত্রিবিক্রমের মুখের মেঘ কাটিয়া গেল। তিনি সবিনয়ে রাজার স্তুতিবাচন করিয়া জানাইলেন যে, রাজার অভিরুচির বিরুদ্ধে তাঁহার কোনো কথাই বলিবার ছিল না এবং কোনো কালেই থাকিতে পারে না।

আরো কিছুক্ষণ সদালাপের পর তিনি বিদায় লইলেন।

.

–রাজকার্যে ভয়ানক ব্যস্ত আছি। ঘটকালি করছি। এইমাত্র একটি মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। পাত্র ও পাত্রী পরস্পরকে গভীরভাবে ভালবাসে, কিন্তু মেয়ের বাপ বেঁকে বসেছিল। যাহোক, অনেক কষ্টে তাকে রাজী করেছি। প্রণয়ী-যুগলের মিলনে বাধা আর নেই।

বৌদি, বাড়ি ছেড়ে আসবার সময় তোমাকে বলেছিলাম মনে আছে?—যে, তুমি যা চাও—অর্থাৎ বৌ-তাই এবার একটা ধরে নিয়ে আসব? একটি বৌ জোগাড় হয়েছে। আমাদের বংশে বেমানান হবে না; তোমারও বোধ হয় পছন্দ হবে। কিন্তু তুমি তাকে বরণ করে ঘরে না তুললে যে কিছুই হবে না বৌদি! তুমি এস এস এস। তোমরা না এলে কিছু ভাল লাগছে না। তার নাম কস্তুরী। নামটি ভাল, নয়? মানুষটিকে বোধ হয় আরো ভালো লাগবে। সে একটা দেশের রাজকন্যা; কিন্তু আগে থাকতে কিছু বলব না। যদি চিঠিতেই কৌতূহল মিটে যায়, তাহলে হয়তো তুমি আসবে না।

.

এত্তালা না দিয়াই চম্পা প্রবেশ করিল।

রাজা মুখ তুলিয়া চাহিলেন—কি চম্পাদেই?

চম্পা রাজার পাশে দাঁড়াইয়া অনুযোগের স্বরে বলিল—আজকাল কিছু না খেয়েই দরবার করতে চলে আসছেন? আপনাকে নিয়ে আমি কি করি বলুন তো?

খাওয়া হয়নি। তাই তো, ভুলে গিয়েছিলাম।

আপনি ভুলে যান, কিন্তু আমাকে যে ছটফট করে বেড়াতে হয়। রুদ্ররূপেরও কি একটু আক্কেল নেই, মনে করিয়ে দিতে পারে না?

হাঁ, ভাল কথা। চম্পা, তোমার বাবা এসেছিলেন; রুদ্ররূপকে তুমি বিয়ে করতে চাও শুনে তিনি খুব খুশি হয়ে মত দিয়ে গেছেন।

চম্পার মুখ রাঙা হইয়া উঠিল, সে ঘাড় বাঁকাইয়া কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, থামিয়া গিয়া হাত নাড়িয়া যেন কথাটাকে দূরে সরাইয়া দিয়া বলিল—ওসব বাজে কথা শোনবার, আমার সময় নেই। আপনার জন্য কি নিয়ে আসব বলুন। দুটো আনারসের মোরব্বা আর একপাত্র গরম সরবৎ–

রাজা চিঠিতে মনোনিবেশ করিয়া বলিলেন—দরকার নেই।

চম্পা বলিল–তাহলে এক বাটি গরম দুধ—

বিরক্ত কোরো না চম্পা, আমি এখন ভারি জরুরী চিঠি লিখছি।

কিন্তু কিছু তো খাওয়া দরকার। একেবারে—

রাজা হাঁকিলেন—রুদ্ররূপ!

রুদ্ররূপ শঙ্কিত মুখে প্রবেশ করিল।

চম্পার প্রতি কঠোর দৃষ্টিপাত করিয়া রাজা হুকুম করিলেন—তুমি চম্পাদেঈর হাত ধর।

রুদ্ররূপ কিছুক্ষণ হতভম্ব হইয়া রহিল, তারপর ফাঁসির আসামীর মত মুখের ভাব করিয়া চম্পার একটি হাত ধরিল।

রাজা বলিলেন—বেশ শক্ত করে ধরেছ? আচ্ছা, এবার ওকে নিয়ে যাও।

ক্ষীণকণ্ঠে রুদ্ররূপ বলিল—কোথায় নিয়ে যাব?

তোমার বাড়িতে। না না, এখন থাক, সেটা বিয়ের পরে হবে। আপাতত তুমি ওকে ওর মহালে নিয়ে যাও। সেখানে ওকে আটক রাখবে, যতক্ষণ তোমার কথা না শোনে ওর হাত ছাড়বে না—যাও।

কড়া হুকুম দিয়া রাজা পুনরায় চিঠিতে মন দিলেন। চম্পা ও রুদ্ররূপ আরক্তমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর আড়চোখে পরস্পরের পানে চাহিল। দুইজনেরই ঠোঁটের কুলে কুলে হাসি ভরিয়া উঠিল। রাজা তখন চিঠিতে নিমগ্ন হইয়া গিয়াছেন; পা টিপিয়া টিপিয়া উভয়ে দ্বারের দিকে চলিল।

পদার ওপারে গিয়াই চম্পা সজোরে হাত ছাড়াইয়া লইল, তারপর রুদ্ররূপের বুকে একটা আচমকা কিল মারিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া পলাইল।

.

—ঝিন্দের মহারাজ শঙ্কর সিং বিদেশীদের খুব খাতির করেন। তোমরা এলে রাজপ্রাসাদেই অতিথি সঙ্কারের ব্যবস্থা হবে। তাছাড়া রাজকীয় প্রকাণ্ড যাদুঘরের ভার নেবার জন্য একজন পণ্ডিত লোকের দরকার; দাদা ছাড়া আর তো যোগ্য লোক দেখি না।

এত কথা লেখবার আছে যে কিছুই লেখা হচ্ছে না। তোমরা কবে আসবে?

দাদাকে বোলো, তাঁর দেওয়া ছোরাটা কিস্তার জলে ভেসে গেছে; ছোরার ন্যায্য অধিকারী সেটা বুকে করে নিয়ে গেছে। দুঃখ করবার কিছু নেই।

ভাল কথা, গৌরীশঙ্কর রায় নামক একজন বাঙালী যুবক ঝিন্দে বেড়াতে এসেছিল, সম্প্রতি তার মৃত্যু হয়েছে।

কবে আসবে? প্রণাম নিও। ইতি—

দেবপাদ শ্ৰীমন্মহারাজ
শঙ্কর সিং

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *