২১-২৫. গত রাত্রে নীচের তলায়

গত রাত্রে নীচের তলায় যে ঘরে বসে সকলের কথাবার্তা হয়েছিল ইন্সপেক্টার বসাক সেই ঘরেই এসে প্রতুল বোস ও রজতকে নিয়ে প্রবেশ করলেন।

রেবতীর মুখেই ইতিমধ্যে সংবাদটা ড্রাইভার করালী, পাচক লছমন ও দারোয়ান ধনবাহাদুর জানতে পেরেছিল।

তারাও এসে দরজার বাইরে ভিড় করে দাঁড়ায় ইতিমধ্যে। ঐ সঙ্গে প্রহরারত একজন বাঙালী কনেস্টবল মহেশও দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়।

সর্বাগ্রে মহেশকে ডেকে মিঃ বসাক থানায় রামানন্দ সেনকে তখুনি একটা সংবাদ দিতে বললেন, সংবাদ পাওয়া মাত্রই নীলকুঠীতে চলে আসবার জন্য। মৃতদেহটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

রেবতীকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করবার করা হয়ে গিয়েছিল বলে ইন্সপেক্টর বসাক প্রথমে ডাকলেন লছমনকে। লছমন সাধারণত একটু ভীতু প্রকৃতির লোক। তার উপরে রেবতীর মুখে রামচরণেরখুন হবার সংবাদ পাওয়া অবধি সে যেন আর তার মধ্যেই ছিল না। ইন্সপেক্টারের আহ্বানে সে যখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল তার গলা দিয়ে স্বর বেরুবার মত অবস্থাও তখন আর তার নেই।

নাম কি তোর?

গোটা দুই ঢোঁক গিলে কোনমতে লছমন নামটা তার উচ্চারণ করে।

কাল রাত্রে কখন শুতে গিয়েছিলি?

লছমণের যদিও মুঙ্গের জিলায় বাড়ি, দশ বছর বাংলাদেশে থেকে বেশ ভালই বাংলা ভাষাতে কথাবার্তা বলতে পারে।

সে আবার কোনমতে একটা ঢোঁক গিলে বললে, রাত এগারোটার পরই হবে সাহেব।

শুনলাম, কাল রাত্রে নাকি রামচরণ কিছু খায়নি, সত্যি?

হ্যাঁ সাহেব। রামচরণ কাল রাত্রে কিছুই খায়নি।

কেন খায়নি জানিস কিছু?

না। বলতে পারি না সাহেব।

রামচরণ বোজ আফিং খেত, জানিস?

আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখেছি তাকে খেতে।

তুই দেখেছিস?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

হুঁ, কাল রাত্রে তুই একটানাই ঘুমিয়েছিলি না এক-আধবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল?

একবার মাঝখানে উঠেছিলাম বাইরে যাবার জন্য।

সেই সময় কিছু শব্দ বা কিছু শুনেছিস?

আজ্ঞে–

লছমন যেন কেমন একটু ইতস্তত করতে থাকে।

এবারে একটু চড়া সুরে মিঃ বসাক বললেন, চুপ করে রইলি কেন? যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দে।

আজ্ঞে আমি যখন বাইরে থেকে ঘুরে আবার ঘরে ঢুকতে যাব—

কী? আবার থামল দেখ। বল্‌–

তখন যেন মনে হল কে একজন সাদা চাদরে গা ঢেকে রামচরণের ঘর থেকে বের হয়ে রান্না-ঘরের সামনে যে সরু ফালি বারান্দাটা সেই দিকে চট্ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভয়ে বাবু তখন আমার গলা শুকিয়ে এসেছে, অড়াতাড়ি উঠি কি পড়ি কোনমতে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে খিল তুলে দিই।

কেন, ভেবেছিলি বুঝি ভূত?

আজ্ঞে সাহেব। গত মাসখানেক ধরে রামচরণের মুখে শুনেছি—

কি শুনেছিস?

বুড়োকতাবাবু নাকি ভূত হয়ে এ বাড়িতে রাত্রে ঘুরে বেড়ায় মধ্যে মধ্যে।

কি বললি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের বাবুও নাকি তাকে–ঐ বুড়োকতাবাবুর ভূতকে অনেক রাত্রে উপরের বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন।

রামচরণ তোকে ঐ কথা বলেছিল?

হ্যাঁ।

শুধু তোদের কর্তাবাবুই বুড়োকতার ভূত দেখেছিলেন না তোরাও কেউ কেউ এর আগে দেখেছিস?

আমি বা রামচরণ কখনও দেখিনি তবে করালী নাকি বার দু-তিন দেখেছিল।

ভূত তুই বিশ্বাস করিস?

কি যে বলেন বাবু! সিয়ারাম! সিয়ারাম। ভূত প্রেত তেনারা আছে বৈকি!

রেবতী, করালী ওদের তোর কেমন লোক বলে মনে হয়?

রেবতীও আমারই মত ভীতু বাবু, তবে করালীর খুব সাহস।

মৃদু হেসে ইন্সপেক্টার এবারে বললেন, আচ্ছা হ্যাঁ। করালীকে এ ঘরে পাঠিয়ে দে।

নমস্কার জানিয়ে লছমন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

তার মুখ দেখে মনে হল সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

ইন্সপেক্টার বসাক লছমনকে প্রশ্ন করতে করতে তাঁর ডাইরীতে মধ্যে মধ্যে নোট করে নিচ্ছিলেন।

রজত স্তব্ধ হয়ে পাশেই একটা চেয়ারে বসেছিল।

এমন সময় আবার ঘরের বাইরে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বলতে গেলে স্থানীয় থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।

.

২২.

আবার কি হল স্যার? রামানন্দ সেন প্রশ্ন করলেন।

এই যে মিঃ সেন, আসুন। বসুন—

মুখ তুলে আহ্বান জানালেন ইন্সপেক্টার রামানন্দ সেনকে।

রামানন্দ সেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

This time poor রামচরণ।

বলেন কি, মানে সেই বৃদ্ধ পুরাতন ভৃত্য–সত্যি—

হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, কিছুটা এখন অবশ্য বুঝতে পারছি আমারই অসাবধানতার জন্যে বেচারীকে প্রাণ দিতে হল।

কি বলছেন স্যার।

ঠিকই বলছি মিঃ সেন। রামচরণের কথাবার্তা শুনেই কলি মনে হয়েছিল স্বেচ্ছায় আমার প্রশ্নের জেরায় পড়ে যতটুকু সে স্বীকার করেছে, সেটাই সব নয়। যে কোন কারণেই হোক অনেক কথাই সে গোপন করে গিয়েছে। তাই কাল মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম একদিনেই আর বেশি চাপ দেব না। আজ রইয়ে সইয়ে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করব। এবং আমার অনুমান যে এক্কেরে মিথ্যা নয়, তার মৃত্যুই সেটা প্রমাণ করে দিয়ে গেল। তাই বলছিলাম কাল যদি একটু রামচরণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতাম এবং তার উপরে আরো একটু নজর রাখতাম, তবে হয়তো এমনি করে তাকে নিহত হতে হত না।

আপনি কি বলতে চান স্যার বিনয়েন্দ্রবাবুর হত্যাকারীই তবে রামচরণকেও হত্যা করেছে!

নিশ্চয়ই। একই কালো হাতের কাজ। এবং এ বিষয়ও আমি স্থির নিশ্চয়ই যে বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারে অনেক কিছু জানত বলেই সে বেচারীকে হত্যাকারীর হাতে এইভাবে এত তাড়াতাড়ি প্রাণ দিতে হল। অনেক কথাই বিনয়েন্দ্রবাবু সম্পর্কে আমাকে সেগতকাল বলেছিল, আরও বেশী কিছু না প্রকাশ করে বসে যাতে করে হত্যাকারীর বিপদ ঘটতে পারে, সেই আশঙ্কাতেই হয়তো হত্যাকারী এত তাড়াতাড়ি তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলল। এবং—

কথাটা ইন্সপেক্টার শেষ করতে পারলেন না হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। বললেন, কে?

একটা মুখ দরজাপথে উঁকি দিয়েছিল।

ইন্সপেক্টরের প্রশ্নে ঘরের অন্যান্য সকলেরই দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষিত হয়।

একটা ভাঙা কর্কশ গলায় প্রশ্নোত্তর এল, আজ্ঞে, আমি করালী।

এস, ভেতরে এস।

করালী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

লোকটা দেখতে রোগা লম্বা। কালো পালিশ করা গায়ের রং। মুখভর্তি বসন্তের বিশ্রী ক্ষতচিহ্ন। নাকটা একটু চাপা। পুরু ঠোঁট অত্যাধিক ধূমপানে একেবারে কালচে হয়ে গেছে। মাথার চুল পর্যাপ্ত, তেল চকচক করছে। এলবার্ট তেড়ি। পরিধানে সাধারণ একটা ধোপ-দুরন্ত ধুতি ও গায়ে একটা সাদা অনুরূপ সিবু টুইলের হাফসার্ট।

আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?

হ্যাঁ। কিন্তু ঘরে না ঢুকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারছিলে কেন?

আজ্ঞে উঁকি তত মারিনি, ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম আপনারা কথা বলছেন, তাই ঢুকতে একটু ইতস্তত করছিলাম।

হুঁ, তুমি তো এই নীচের তলাতেই লছমনের ঘরের পাশের ঘরটাতেই থাক?

আজ্ঞে।

কাল রাত্রে কখন ঘুমিয়েছিলে?

আজ্ঞে, শরীরটা আমার কয়দিন থেকেই ভাল যাচ্ছিল না বলে কাল রাতে আর কিছু খাইনি, সাড়ে নটার মধ্যেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।

শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

আজ্ঞে একরকম তাই, আমার তো বিছানায় শোওয়া আর ঘুমোনো।

রাত্রে আর ঘুম ভাঙেনি?

না।

কিন্তু ওই একটি মাত্র উচ্চারিত শব্দও যেন ইন্সপেক্টারের মনে হল, করালী একটু ইতস্তত করেই উচ্চারণ করল।

কাল রাত্রে তাহলে কোন রকম শব্দ বা চিৎকার শোননি?

শব্দ? চিৎকার? কই না।

হুঁ। ইন্সপেক্টার কি যেন ভাবতে লাগলেন।

তারপর হঠাৎ আবার প্রশ্ন শুরু করলেন, করালী, তুমি তো বছরখানেক মাত্র এখানে চাকরি নিয়েছ, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এর আগে কোথায় কাজ করতে?

কোথাও দুচার দিনের বেশি একটা ঠিকে কাজ ছাড়া করিনি, একমাত্র এই বাড়িতেই এই একবর একটানা কাজ করছি।

তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স কত দিনের?

চার বছরের।

চার বছর লাইসেন্স পেয়েছ, অথচ কোথাও এর আগে বড় একটা কাজ করোনি। কি করে তাহলে দিন চালাতে?

তা আর চলত কই স্যার। আজকাল ভাল সুপারিশপত্র না হলে প্রাইভেট গাড়ি চালাবার কাজ কি বিশ্বাস করে কেউ দিতে চায় স্যার? কাজের সন্ধান নিয়ে কারও কাছে গেলেই। অমনি সকলে প্রশ্ন করবেন, আগে কোথায় কাজ করেছ, কেমন কাজ করতে তার সাটিফিকেট দেখাও।

হুঁ। তা বিনয়েন্দ্রবাবু সে রকম কিছু দেখতে চাননি তোমার কাছে?

আজ্ঞে না। আজ্ঞে তিনি ছিলেন সত্যিকারের গুণী। বললেন, ড্রাইভ কর দেখি, কাজ দেখে তবে কাজে বহাল করব। বললাম, এই তো বাবু কথার মত কথা। নিয়ে গেলাম গাড়িতে চাপিয়ে। আপনাদের আশীবাদে স্যার যে কোন মে বা মডেলের গাড়ি দিন না, জলের মত চালিয়ে নিয়ে যাব। আমার গাড়ি চালানো দেখে বাবুও খুশী হয়ে গেলেন। তিনি সেই দিনই কাজে বহাল করে নিলেন আমাকে।

ইন্সপেক্টার বুঝতে পারেন, লোকটা একটু বেশীই কথা বলে।

বাবু তাহলে গাড়ি চালানোয় খুশি ছিলেন বল?

আজ্ঞে, নিজমুখে আমি কি বলব স্যার, বলবেন অহঙ্কার, দেমাক। তবে হ্যাঁ, বাবু বেঁচে থাকলে তাঁরই মুখে শুনতে পারতেন। তবে তিনি বলতেন, করালী, তোমার হাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমানো যায়।

হুঁ। ভাল কথা। দেখ করালী, কাল তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

বলুন স্যার।

তোমার আপনার জন আর কে কে আছে?

আজ্ঞে স্যার, সে কথা আর বলবেন না। ভাল করে জ্ঞান হবার আগেই মা বাপকে হারিয়েছি; তারপর লালন-পালন করলে এক পিসি; তা সেও বছর দশেক আগে মারা গেছে। সব ধুয়ে মুছে গেছে। একা স্যার—একেবারে একা।

বিয়ে করনি?

বিয়ে-থা আর কে দেবে বলুন স্যার। এতদিন তো ক্যাঁ কাঁ করে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়িয়েছি—এই তো সবে যাহোক একটা কাজ জুটেছিল। দেখুন না, তাও বরাতে সইল না। এবারে আবার সেই রাস্তা আর কলের জল।

কেন হে, এখানে তো শুনলাম দেড়শো টাকা মাইনে পেতে, থাকা খাওয়া লাগত না, এ ক বছরে কিছুই জমাতে পারনি?:

আজ্ঞে না স্যার। জমল আর কোথায়! আগের কিছু ধার-দেনা ছিল, তাই শোধ দিতে দিতেই সব বেরিয়ে যেত মাসে মাসে-জমাব কি করে আর।

আচ্ছা করালী, তুমি যেতে পার। হ্যাঁ, ভাল কথা, না বলে কোথাও বেরিও না যেন।

আজ্ঞে না স্যার, কোথাও বড় একটা আমি বের হই না।

করালী ঘর ছেড়ে চলে গেল।

.

২৩.

ইন্সপেক্টার বসাক থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বুঝতে পারলেন সেন?

একেবারেই যে কিছু বুঝিনি তা নয় স্যার। বেশ গভীর জলের মাছ বলেই মনে হল।

হঠাৎ রজত কথা বললে, ঠিকই বলেছেন মিঃ সেন। লোকটার চোখ দুটো যেন ঠিক সাপের চোখের মত। একেবারে পলক পড়ে না। তা ছাড়া লোকটার মুখের দিকে তাকালেই যেন কেমন গা ঘিনঘিন করে। আশ্চর্য! লোকটাকে ছোেটা যে কি করে টলারেট করতেন তাই ভাবছি।

ইন্সপেক্টার রজতের কথায় মৃদু হাসলেন মাত্র, কোন জবাব দিলেন না।

হাসিটা রজতের দৃষ্টি এড়ায় না। সে বলে, হাসছেন আপনি ইন্সপেক্টার, কিন্তু লোকটার মুখের দিকে তাকালেই কি মনে হয় না—ঠিক যেন একটা snake!

ইন্সপেক্টার রজতের প্রশ্নের এবারেও কোন জবাব দিলেন না, কেবল রামানন্দ সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মৃতদেহটা একবার দেখবেন নাকি?

হ্যাঁ। একবার যাই, দেখে আসি। একটা ডাইরী আবার পাঠাতে হবে তো!

যান।

রামানন্দ সেন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

ইন্সপেক্টার এবারে রজতের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আপনারা যখন এসে গেছেন রজতবাবু, মৃতদেহের মানে আপনাদের কাকার সৎকার করবেন তো?

তা করতে হবে বৈকি।

তাহলে আর দেরি করবেন না। রামানন্দরাবুর কাছ থেকে একটা Order নিয়ে কলকাতায় চলে যান।

.

রামচরণের মৃতদেহটা মর্গে পাঠাবার একটা ব্যবস্থা করে রামানন্দ সেন থানায় ফিরে গেলেন। চা পান করে রজতও বিনয়েন্দ্রবাবুর মৃতদেহ কলকাতার মর্গ থেকে নিয়ে সৎকারের একটা ব্যবস্থা করবার জন্য বের হয়ে গেল।

একজন কনস্টেবলকে নিচের তলায় প্রহরায় রেখে ইন্সপেক্টার বসাক উপরে চললেন।

প্রথমেই পুরন্দর চৌধুরীর সংবাদ দেবার জন্য তাঁর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। পুরন্দর চৌধুরী শয্যার উপরে শুয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখনও।

ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এলেন ইন্সপেক্টার।

হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। সুজাতাদেবীর একটা সংবাদ নেওয়া প্রয়োজন।

এগিয়ে চললেন ইন্সপেক্টার সুজাতার ঘরের দিকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ইতস্তত করলেন, তারপর আঙুল দিয়ে টুকটুক করে ভেজানো দরজার গায়ে মৃদু ‘নক’ করলেন।

কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। প্রথমে ভাবলেন সুজাতা ঘুমচ্ছে হয়তো তারপরেই আবার কি ভেবে মৃদু একটু ঠেলা দিয়ে ভেজালে দরজাটা ঈষৎ একটু ফাঁক করে ঘরের ভিতরে দৃষ্টিপাত করলেন।

দেখতে পেলেন, সুজাতা নিঃশব্দে খোলা জানলার সামনে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

বিস্রস্ত চুলের রাশ সারা পিঠ ব্যেপে ছড়িয়ে আছে। হাওয়ায় চুর্ণ কুন্তল উড়ছে। বেশেও কেমন একটা শিথিল এলোমেলো ভাব।

আবার দরজার গায়ে নক করলেন টুকটুক করে।

কে? ভিতর থেকে সুজাতার গলার প্রশ্ন ভেসে এল।

ভিতরে আসতে পারি কি?

আসুন।

দরজা ঠেলে ইন্সপেক্টার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

সুজাতা ঘুরে দাঁড়াল: আসুন।

এখন একটু সুস্থ বোধ করছেন তো মিস রয়?

হ্যাঁ।

একটু চা বা গরম দুধ এক গ্লাস খেলে পারতেন। বলি না দিতে রেবতীকে ডেকে?

বলতে হবে না। রেবতী কিছুক্ষণ আগে নিজেই এসে আমাকে চা দিয়ে গিয়েছে। চা খেয়েছি। কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন নে মিঃ বসাক? বসুন না ঐ চেয়ারটার ওপরে।

হ্যাঁ, বসি। পাশেই একটা চেয়ার ছিল, টেনে নিয়ে ইন্সপেক্টার উপবেশন করলেন: আপনিও বসুন মিস রয়।

সুজাতা খাটের উপরেই শয্যায় উপবেশন করে।

কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলে না স্তব্ধতার মধ্যেই কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। এবং স্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমেই কথা বললেন ইন্সপেক্টার, আপনি কি তাহলে কলকাতায়ই ফিরে যাবেন ঠিক করলেন, মিস রয়?

সুজাতা নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল ইন্সপেক্টারের মুখের দিকে।

রজতদা কোথায়? সুজাতা প্রশ্ন করে।

রজতবাবু তো এই কিছুক্ষণ আগে কলকাতায় গেলেন।

কলকাতায় কেন?

বিনয়েন্দ্রবাবুর মৃতদেহের সৎকারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাই।

সুজাতা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, আমি যদি লক্ষ্ণৌয়ে ফিরে যাই আপনার কোন আপত্তি আছে কি?

না। আপত্তি আর কি, তবে আপনার কাকার সলিসিটারকে একটা সংবাদ পাঠাতে বলেছি প্রতুলবাবুকে, আজই সন্ধ্যার সময় এখানে এসে একবার দেখা করবার জন্য।

সলিসিটারকে কেন?

আপনার কাকার উইল-টুইল যদি কিছু থাকে, তা সেটা তো আপনাদের জানা প্রয়োজন।

থাকলেও আমার সে বিষয়ে কোন interestই নেই জানবেন, মিঃ বসাক। সুজাতা যেন মৃদু ও নিরাসক্ত কণ্ঠে কথাটা বললে।

বিস্মিত ইন্সপেক্টার সুজাতার মুখের দিকেতাকালেন।

হ্যাঁ। তাঁর সম্পত্তি যার ইচ্ছা সে নিক। আমার তাতে কোন প্রয়োজনই নেই। চাই না আমি সেই অর্থের এক কপর্দকও, এবং নেবও না। পূর্ববৎ নিরাসক্ত কণ্ঠেই কথাগুলো বলে গেল সুজাতা।

সে তো পরের কথা পরে। আগে দেখুন তাঁর কোন উইল আছে কিনা। উইলে যদি আপনাদেরই সব দিয়ে গিয়ে থাকেন তো ভালই, নচেৎ উইল না থাকলেও তাঁর সব কিছুর একমাত্র ওয়ারিশন তো আপনারাই, আর কিছু যদি আপনি না নেনইযাকে খুশি সব দানও করতে পারবেন।

না। তাঁর হোপার্জিত অর্থ তো নয়, সবই তো সেই বাবার দাদামশাইয়ের অর্থ। যে লোক মরবার সময় পর্যন্ত তাঁর নাতি-নাতিনীদের মুখ দেখেননি, তাঁর সম্পত্তি লাখ টাকা হলেও আর যেই নিক আমি একটি কপর্দকও স্পর্শ করব না তা জানবেন।

কি বলছেন আপনি মিস রয়?

ঠিক বলছি। আপনি তো জানেন না আমার পিতামহকে। অনাদি চক্রবর্তী তাঁর একমাত্র জামাই হওয়া সত্ত্বেও সব কিছু থেকে তাঁকে তিনি বঞ্চিত করে গিয়েছিলেন। আর শুধু কি তিনিই, শুনেছি আমার পিতামহীরও এমন অহমিকা ছিল ধনী-কন্যা বলে যে, আমার পিতামহকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করতেও একদিন দ্বিধাবোেধ করেননি। বাবা বলেছিলেন একদিন, সুজাতা, যদি কখনও ভিক্ষা করেও খেতে হয় তবু যেন অনাদি চক্রবর্তীর এক কপর্দকও গ্রহণ কোরো না। এমন কি তিনি যেচে দিতে এলেও জেনো যে অর্থ বিবাহিতা স্ত্রীকে পর্যন্ত স্বামীর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, সে অর্থ মানুষের জীবনে আর যাই দিক মঙ্গল আনতে পারে না। আমি এখানে এসেছিলাম শুধু তাকে একটিবার দেখব বলে, অন্যথায় আসতামই না।

.

২৪.

একটানা সুজাতা কথাগুলো বলে গেল।

মিঃ বসাকের বুঝতে কষ্ট হয় না, সুজাতাদেবী সত্যি সত্যিই তার মৃত ছোটাকে গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহ করত। এবং তাই ছোটকার মৃত্যু-সংবাদটা তার বুকে শেলের মতই আঘাত হেনেছে।

একটু থেমে সুজাতা আবার বলতে লাগল, আমার ও ছোট্‌কার মধ্যে ঠিক যে কি সম্পর্ক ছিল, আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মিঃ বসাক। তাছাড়া আপনি হয়তো বুঝবেনও না। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। মানুষ হয়েছি রজতদার মা-জেঠাইমার স্নেহ ও ভালবাসাতেই। কিন্তু সেদিনকার আমার বালিকা মনের খুব নিকটে যাকে আপনার করে পেয়েছিলাম, সে হচ্ছে আমার ছোটুকাই।

বলতে বলতে সুজাতার গলাটা যেন কেমন জড়িয়ে আসে।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ছোট্‌কা ছিল আমাদের, বিশেষ করে আমার, জীবনে একাধারে বন্ধু ও সর্ব ব্যাপারে একমাত্র সাথী। তাই যেদিন তিনি তাঁর দাদামশাইয়ের জরুরী একটা চিঠি পেয়ে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়েই এ বাড়িতে চলে এলেন, এবং তারপর যে কারণেই হক আর তিনি আমাদের কাছে ফিরে গেলেন না, তার পর থেকে রজতদা ও জেঠাইমা তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেও আমি তা পারিনি। তাঁদের সঙ্গে একমত না হতে পারলেও অবিশ্যি তাঁদের বিরুদ্ধেও যেতে পারিনি। তাই মনে মনে ছোট্রকার সঙ্গে দেখা করবার খুব বেশী একটা ইচ্ছা থাকলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি সেদিন।

একটু থেমে সুজাতা আবার বলতে লাগল, তারপর হঠাৎ এমন কতকগুলো কথা ছোটকার নামে আমার কানে গেল যে, পরে আর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে ইচ্ছাও হয়নি।

কিছু যদি না মনে করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করি সুজাতাদেবী। কী এমন কথা আপনার ছোট্রকার সম্পর্কে, কার মুখে আপনি শুনেছিলেন বলতে আপনার যদি অপত্তি না থাকে–

না। আপত্তি কি। কথাটা শুনেছিলাম রজতদার মুখেই। তার সঙ্গে নাকি হঠাৎ একদিন ছোট্‌কার রাস্তায় দেখা হয়েছিল, তখন ছোট্‌কা নাকি রজতদা কথা বলে সত্ত্বেও তাকে চিনতে পারেনি। তাই ভয় হয়েছিল রজতদার মত আমাকেও যদি ছট্‌কা আর না চিনতে পারেন!

সুজাতার মুখে কথাটা শুনে মিঃ বসাক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। একটা কথা সুজাতাকে ঐ সম্পর্কে খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল বলবার কিন্তু ইচ্ছা করেই শেষ পর্যন্ত বললেন না। এমন সময় রেবতী এসে ঘরে ঢুকল।

কি খবর রেবতী?

বাবু, ঠাকুর বলল খাবার তৈরী।

ঠিক আছে, ঠাকুরকে টেবিলে খাবার দিতে বল। আর অমনি দেখ পুরন্দরবাবু উঠেছেন কিনা।

রেবতী চলে গেল।

উঠুন সুজাতাদেবী। স্নান করবেন তো করে নিন।

হ্যাঁ, আমি স্নান করব।

খাবার টেবিলে বসে সুজাতা কিন্তু এক গ্লাস সরবৎ ছাড়া কিছুই খেতে চাইল না। না খেলেও খাবার টেবিলেই বসে রইল।

মিঃ বসাক ও পুরন্দর চৌধুরী খেতে লাগলেন।

এক সময় মিঃ বসাক বললেন, আপনি কি তাহলে আজই চলে যেতে চান, মিস রয়?

রজতদা ফিরে আসুক। কাল সকালেই যাব।

কালই তাহলে লক্ষ্ণৌ রওনা হচ্ছেন?

না। দু-একদিন পরে রওনা হব।

আহারাদির পর সুজাতা ও পুরন্দর চৌধুরী যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। মিঃ বসাক নীচে এলেন।

যে ঘরে রামচরণ নিহত হয়েছিল সেই ঘরে এসে ঢুকলেন।

ঘণ্টাখানেক আগে মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘরটা খালি।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। ঘরের জানলাগুলো ভেজানো ছিল, এগিয়ে গিয়ে ঘরের পশ্চাতে বাগানের দিককার দুটো জানলাই খুলে দিলেন। দ্বিপ্রহরের পর্যাপ্ত আলোয় স্বল্পান্ধকার ঘরটা আলোকিত ও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

ঘরের দেওয়ালে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টাঙিয়ে তার উপরে খান দুই পরিষ্কার পাট করা ধুতি ঝুলছে। একপাশে একটা ভোয়ালে। একটা শার্ট ও গোটা দুই গেঞ্জিও দড়িতে বোলানো রয়েছে।

এক কোণে একটা কালো মাঝারি আকারের রঙ ওঠা স্টীল ট্রাঙ্ক। দেওয়ালে একটা আরশি ও তার পিছনে গোঁজা একটা চিরুনি। আরশিটার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটো। ফটোটার সামনে এগিয়ে গেলেন মিঃ বসাক।

পাঁচ-ছ বছরের একটি শিশুর হোট ফটো। অনেক দিন আগেকার ভোলা ফটো হবে। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

ফটোটা দেখতে দেখতে হঠাৎ তার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো আরশিটার পিছনে গোঁজা চিরুনিটার দিকে নজর পড়তেই একটা জিনিস তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।

চিরুনিটার সরু দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকগাছি কেশ তখনও আটকে আছে।

বিশেষ করে কয়েকগাছি কেশই তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।

.

২৫.

হাত বাড়িয়ে চিরুনিটা হাতে নিলেন মিঃ বসাক।

চার-পাঁচগাছি কেশ আটকে রয়েছে চিরুনির সরু দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে। এবং কেশগুলি লম্বায় হাতখানেকের চাইতে একটু বেশীই হবে। আর সেগুলো সামান্য একটু কোঁকড়ানো এবং রংও তার ঠিক কালো নয়, কেমন একটু কটা কটা।

ধীরে ধীরে কেশগুলি চিরুনির দাঁত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন মিঃ বসাক।

রামচরণের নিত্যব্যবহৃত এই চিরুনি তাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। এখনও মিঃ বসাকের, রামচরণের কেশের রং কুচকুচে কালোই ছিল; যদিচ অনেক কেশেই তার পাক ধরেছিল। বিশেষ করে, তার কেশ দৈর্ঘ্যে এতখানি হওয়াও অসম্ভব। মোট কথা, চিরুনির এই কেশ আদপেই রামচরণের মাথার নয়। এবং কেশের দৈর্ঘ্য দেখে মনে হয়, এ কোন রমণীর মাথার কেশ হবে। কোন পুরুষের মাথার কেশ এ নয়। এবং কোন নারীরই মাথার কেশ যদি হবে, তবে এই চিরুনিতে এ কে এল কোথা থেকে?

এ বাড়িতে তো কোন নারীর অস্তিত্বই নেই এবং ছিল না বলেই তো তিনি শুনেছেন। একমাত্র লতা, তাও সেদিন যার আগেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। সে ক্ষেত্রে চিরুণির দাঁতে নারীর কে দেখে মনে হচ্ছে, গতকাল দিনে বা রাত্রে, নিশ্চয়ই কেউ এক সময়ে এই চিরুনির সাহায্যে তাঁর কেশ প্রসাধন করেছিলেন যিনি কোন পুরুষই নন, নারীই। এ বাড়িতে একমাত্র বর্তমানে উপস্থিত নারী সুজাতাদেবীই। সুজাতাদেবী নিশ্চয়ই রামচরণের ঘরে এসে তাঁর চিরুনি দিয়ে কেশ প্রসাধন করেননি। আর করলেও সুজাতাদেবীর কেশ এ ধরনের নয়। তাঁর কেশ দের্ঘ্যে আরও বড় ও কালো কুচকুচে। আদপেই কোঁকড়ানো নয়।

তবে কে সেই নারী যার কেশ প্রসাধনের চিহ্ন এখনও এই চিরুনির দাঁতে রয়ে গিয়েছে।

আরও মনে হয়, যেই কেশ প্রসাধন করে থাকুক রামচরণের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা পড়েনি, নচেৎ রামচরণের মত ছিমছাম প্রকৃতির লোকের চিরুনিতে এগুলো আটকে থাকা সম্ভব হত না, একবার তার দৃষ্টি চিরুনিতে আকৃষ্ট হলে।

তবে কি রামচরণের অজ্ঞাতেই কেউ তার চিরুনির সাহায্যে কেশ প্রসাধন করেছিল! সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে হয় মিঃ বসাকের, গত রাত্রে রামচরণ যখন তাঁদের আহার্য পরিবেশন করছিল তখনও তো তিনি লক্ষ্য করেছেন, তার মাথার কেশপরিপাটি করে আঁচড়ানো ছিল। যাতে করে তাঁর মনে হয়েছিল, বিকালের পরে কোন এক সময় সে তার কেশ প্রসাধন করেছিল। অতএব কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে?

সন্ধ্যার পর রাত্রে কোন এক সময়ে কোন না কোন নারীই এই ঘরে এসে রামচরণের এই চিরুনির সাহায্যে তার কেশ প্রসাধন নিশ্চয়ই করেছিল। যার সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত প্রমাণ এখনো এই চিরুনির দাঁতে কয়েকগাছি কেশে বর্তমান। এবং এ থেকে সহজেই অনুমান হয় কোন নারী তাহলে গতরাত্রে এ কক্ষে এসেছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, রামচরণের জ্ঞাতে না অজ্ঞাতে।

আরও একটা কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, যে নারী গত রাত্রে এই ঘরে এসেছিল সে রামচরণের পরিচিতও হতে পারে, অপরিচিতও হতে পারে। এবং শুধু তাই নয় রামচরণের হত্যার ব্যাপারে সেই নারীর প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ ছিল কিনা তাই বা কে জানে!

মোট কথা, কোন এক নারীর এই কক্ষমধ্যে গত রাত্রে পদার্পণ ঘটেছিল। এবং সে বিষয়ে যখন কোন সন্দেহই থাকছে না তখন সেই নারীর এই কক্ষমধ্যে আবির্ভাবের ব্যাপারটাই রামচরণের হত্যার মতই বিস্ময়কর মনে হয়।

বাড়ির চারদিকে কাল সতর্ক পুলিস প্রহরী ছিল, তার মধ্যেই অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে কী করে এক নারীর এ বাড়িতে প্রবেশ সম্ভবপর হয়।

তবে কি সেই নারীই রামচরণের হত্যাকারী!

কথাটা ভাবতে গিয়েও যেন মিঃ বসাকের লজ্জার অবধি থাকে না। তাঁদের এতগুলো পুরুষের জাগ্রত ও সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা সামান্য এক নারী নিঃশব্দে এসে রামচরণকে হত্যা করে চলে গেল। এতগুলো লোক কেউ কিছু জানতেও পারল না।

কিন্তু এলই বা সে এ বাড়িতে কোন্ পথে, আবার ফিরে গেলই বা কোন্ পথে?

অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে পর্যন্ত কেন যেন মিঃ বসাকের ধারণা হয়েছিল, গত রাত্রে রামচরণের হত্যাকারী এ বাড়ির মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল গত রাত্রে তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে তা নাও হয়তো হতে পারে।

ভাবতে ভাবতে চকিতে মিঃ বসাকের মনে আর একটা সম্ভাবনার উদয় হয়। এই কেশ যার সেই নারী ও বিনয়েন্দ্রর জীবনে তার ল্যাবরেটরী অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে যে রহস্যময়ী নারীর অকস্মাৎ আবির্ভাব ঘটেছিল—উভয়েই এক নয় তো!

কিন্তু কথাটার মধ্যে যেন বেশ কোন যুক্তি খুঁজে পান না মিঃ বসাক।

সে না হলেও কোন এক নারী কাল রাত্রে এ ঘরে এসেছিল ঠিকই এবং যে প্রমাণ একমাত্র যার পক্ষে আজ দেওয়া সম্ভব ছিল সে রামচরণ, কিন্তু সে আজ মৃত।

যে রহস্যের উপর আলোকপাত সম্ভব হত আজ আর তার কাছ থেকে পাওয়ার কোন উপায়ই নেই, তার মুখ আজ চিরদিনের জন্যই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর সে কথা বলবে না।

আবার মনে হয়, তবে কি বিনয়েন্দ্রবাবুর হত্যাকারীও সে-ই! তাই সে এত তাড়াতাড়ি রামচরণের কণ্ঠও চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গেল, পাছে রামচরণ তার সমস্ত রহস্য ফাঁস করে দেয়!

আবার সেই রহস্যময়ীর কথাই মনের মধ্যে নতুন করে এসে উদয় হয়।

সমস্ত ব্যাপারটাই ক্রমে যেন আরো জটিল হয়ে উঠেছে। সব যেন কেমন বিশ্রীভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে যাই হোক, এই কয়েকগাছি কেশের মধ্যে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।

যত্নসহকারে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করেন মিঃ বসাক। এবং কাগজের মধ্যে কেশ কগাছি রেখে ভাঁজ করে সযত্নে পকেটের মধ্যে রেখে দিলেন।

তারপর রামচরণের স্টীল ট্রাঙ্কটা খুলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তালা দেওয়া। খোলা গেল। চাবিটা কিন্তু বিশেষ খুঁজতে হল না। রামচরণের শয্যার নীচে তোশকের তলাতেই পাওয়া গেল। চাবির সাহায্যে মিঃ বসাক তালা খুলে ফেললেন।

বাক্সটা খুলে ডালাটা তুললেন। ট্রাকের মধ্যে বিশেষ কিছুএমন পাওয়া গেল না। খানকয়েক ধুতি পাট করা, গোটা দুই জামা। একটা ব্যাগের মধ্যে গোটা ত্রিশেক টাকা ও কিছু খুচরো পয়সা। একটা ছোট কৌটোর মধ্যে খানিকটা আফিং এবং খানকয়েক চিঠি ও মনিঅর্ডারের রসিদ।

রসিদগুলো ফেরত আসছে কোন এক শ্যামসুন্দর ঘোষের কাছ থেকে।

চিঠিগুলোও সেই শ্যামসুন্দরেরই লেখা। চিঠি পড়ে বোঝা গেল, সম্পর্কে সেই শ্যামসুন্দর রামচরণেরভাইপোহয়। থাকে মেদিনীপুর। আর পাওয়া গেল একটাপোষ্ট-অফিসের পাস-বই।

পাস-বইটা উলটে-পালটে দেখা গেল, তার মধ্যে প্রায় শ-চারেক টাকা আজ পর্যন্ত জমা দেওয়া আছে। মধ্যে মধ্যে অবিশ্যি পাঁচ-দশ করে তোলার নিদর্শনও আছে। লোকটা দেখা যাহেতাহলে কিছুটা সঞ্চয়ীও ছিল।

বাক্সটা বন্ধ করে পুনব্ৰায় তালায় চাবি দিয়ে মিঃ বসাক রামচরণের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।

দ্বিপ্রহরের রৌদ্রতাপ তখন অনেকটা ঝিমিয়ে এসেছে। প্রশান্ত বসাক নীচের তলায় যে ঘরটায় গত দুদিন ধরে অফিস করেছিলেন সেই ঘরেই এসে প্রবেশ করলেন।