1 of 2

২১. ধান যে তমিজের আরেকটু প্রাপ্য

ধান যে তমিজের আরেকটু প্রাপ্য, অন্তত বিলের পানি ও কামলা বাবদ তার কাছ থেকে বেশিই নেওয়া হয়েছে, আবদুল কাদের এটা মানে।–তোর কথা ন্যায্য। কিন্তু ভাইজান বাগড়া দিবি।

সপ্তাহের ছয়টা দিনই তো ভাইজান বাড়ি থাকে না, কিন্তু কাদের কিছু করতে পারলো না। ভাইজান নাই, আছে ভাবি। আবদুল কাদেরের সমস্যাটা তমিজ বোঝে। আবদুল আজিজের শ্বশুরবাড়ি তো টাউনের কাছে, টাউনবন্দরের মানুষকে তমিজের। চেনা আছে। ভাবিজানের হাতটা একটু খাটো। আবার বড়ো বেটা না থাকলে বর্গাদার কি কামলাপাটকে দেওয়া থোওয়ার ব্যাপারে বেটার বৌয়ের কথা মণ্ডল খুব শোনে। বড়োবিবি তার হাজারটা ব্যাপার নিয়ে রাতদিন যতোই ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করুক, শরাফত শেষপর্যন্ত সায় দেয় বেটার বৌয়ের কথায়। এমন কি ছোটোবিবির মিহি গলার তেরছা কথায় মণ্ডল দিনমান যতোই ভিজুক আর নিজে রাত্রিবেলা তকে যতোই ভিজিয়ে দিক, ধানের হিসাবে নিকাশে তার কথার দাম নাই। ছোটোবিবিকে বলেও তমিজের তাই সুবিধা হলো না।

তো কী আর করে, তমিজ নিজেই একদিন আল্লা ভরসা করে মণ্ডলবাড়ি গিয়ে কাদেরের সামনে শরাফতের কাছে কারুবারু শুরু করে। শরাফত সরাসরি না করে দেয়, কাদের তো লিত্যি তোর কথা কচ্ছে। জাহেল মাঝি, হিসাব বুঝিস না। হিসাব করা দেখলে ধান তোক বেশি দেওয়া হছে। আর কাদের, তুমি একজন শিক্ষিত ছেলে হয়া এই সোজা হিসাবটা বোবঝা না?

তমিজের হয়ে কাদের বাপের সঙ্গে কথা বলেছে মোটে একবার। শরাফত বাড়িয়ে বললো, কাদেরের সম্মানটা এতে বাড়লো তমিজের কাছে, এই অতিরিক্ত সম্মানপ্রাপ্তির জোরে বুক ফুলিয়ে সে বাপকে বলে, বাপজান, পানি বাবদ খরচটা ধরেন কীভাবে? আর কামলার খরচ যা ধরিছেন।

মাগনা কোনো কিছু পাওয়া ভালো লয় বাপু। তুমি পানি সেচবা, পানিটা কার সেটা হিসাব করবা না? বিল কি আমি পয়সা দিয়া ইজারা লেই নাই?

কাদের জবাব না দিলে পানির ব্যাপারটা ফয়সালা হয়ে গেছে ধরে নিয়ে মণ্ডল আসে কামলার প্রসঙ্গে, তোমরাই না মিটিং করা কামলা কিষাণের কথা কও? কোরান হাদিসের কথা, মজুরের গায়ের ঘাম শুকাবার আগে তার পাওনা মিটায়া দাও। এখন। তুমি কামলাক পয়সা দিবার মানা করো কোন বুদ্ধিতে?

না না, বাপজান, কথা তো সেটা নয়। কিন্তু কথাটা যে কী তা বলতেও তার একটু দেরিই হয়। শেষপর্যন্ত অবশ্য বলতে পারে, ধান কাটার সময় তমিজের বাপ যখন আছিলো তখন আর কামলা নেওয়ার দরকার কী? তারপর ধরেন তমিজের বাড়িত যদি ধান ক্যাটা লিয়া আসা যায় তো ওর বাপ আছে, ওর সত্য আছে।

ওই জমির ধান ওরা বাপবেটা কাটলে এক সপ্তাহের কমে পারে না। ধান যেমন পাকিছিলো, অতোদিনে মেলা ধান নষ্ট হতো। বেশি কামলা দেওয়া লাগলো তাই। এ ব্যাপারটিরও ফয়সালা হলো, সুতরাং শরাফত তোলে পরের প্রশ্নটি, আর তমিজের বাড়িত ধান লিয়া গেলে সব ধানই নষ্ট হয়। তমিজের বাপ তো একটা আবোর মানুষ, আবার শয়তানের একশেষ, আর বৌটা ফকিরের বেটি; ধানের অরা বোঝে কী? হুরমতুল্লার বেটি কও, বৌ কও, হুরমতুল্লার লিজের কথাও কওয়া লাগে, সোগলি ফসলের কামই করে। ওই বাড়িত না লিলে এতো ধান বার হয়? কাদেরকে কিছুক্ষণ। কথা বলার সুযোগ দিতে শরাফত চুপ করে, তা সুযোগের সদ্ব্যবহার সে না করলে শরাফত ধীরেসুস্থে জানায়, হাজার হলেও তমিজ হলো মাঝির বেটা। আর কয়েকটা বছর চাষবাসের কাম করুক, তখন লিজেই সব বুঝবি। তা তুমি এই চ্যাংড়াটাক বুঝবার দাও, অর সাথে তোমার লাফ পাড়লে চলে?

লাফ পাড়ার সময়ও কাদেরের নাই। পোড়াদহ মাঠে সন্ন্যাসী মেলার আয়োজন শুরু হয়েছে, সেখানে মানুষ আসছে নানা জায়গা থেকে। ইসমাইল সাহেব আজ টমটমে। শিমুলতলা যাবে, যাবার পথে পোড়দহ মাঠে ঘণ্টাখানেক বসে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে। গোলাবাড়ি থেকে তার সঙ্গে আসবে কাদের। ইসমাইল যাবে শ্বশুরবাড়ি, কিন্তু তার আসল কাজ হলো ওই বাড়ির প্রজা পার্টির সাপোর্টারদের লীগে ভেড়াবার চেষ্টা করা। শিমুলতলার মিয়াবাড়ি হাত করতে না পারলে ওদিকে ছোটোবড়ো কোন ঘর থেকে একটা ভোটও পাওয়া যাবে না।।

আবদুল কাদের চলে গেলে তমিজ একেবারে চুপ মেরে গেলো। শরাফত চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে দেখে তমিজের হঠাৎ ভয় হয়, মণ্ডলের সঙ্গে তার জীবনে আর কথা। বলার সুযোগ হবে না। মণ্ডলের পায়ের কাছে বসে সে হঠাৎ বলে, ওই জমিত হামি পিয়াজ করবার হাউস করছিলাম।

এই খন্দটা হুরমতুল্লা করুক। শরাফত সোজাসুজি বলে, তুই বাপু আগে হালগোরু কর। তার কাজের প্রশংসাও করে শরাফত, সে মেহনত করতে জানে, আল্লা তার পুরস্কারও দেয়। কিন্তু নিজের হালগোরু ছাড়া জমি বর্গা নিলে নানারকম ক্যাচাল হয়, দুই পক্ষেই সন্দেহ করে, তার প্রাপ্য ঠিক পাওয়া গেলো না।–মণ্ডল রাগ করে না, ধমক দেয় না, গালাগালি করে না, মুখও খারাপ করে না। নাতির মৃত্যুর পর সে বরং আরো নরম হয়েছে, নাতির চেহলামের পর কথাবার্তায় সবার সঙ্গে সে খুব বিনীত। কিন্তু তার স্বভাব ও ব্যবহারের বদল হয় আর তমিজের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে, তমিজ–এখন তার দিকে ভালো করে তাকাতেও পারে না।

তবে তমিজের একটা ব্যবস্থা সে করে দেয়, তুই না হয় ওই জমিত বছরকামলা খাট। বিলের ওইপারে তো হুরমতুল্লা হামার মেলা জমি করিচ্ছে, কাম তোর একটা না। একটা হবিই। পিয়াজ রসুনের আবাদ করবার চাস, তো কর। মানা করিচ্ছে কেটা? হুরমতুল্লার সাথে থাকলে কামও শিখবার পারবু।

শরাফত মণ্ডলের এই নতুন বন্দোবস্তের কথা শুনে তমিজ একেবারে বসেই পড়ে, ধ্বসেও পড়ে বলা যায়। শরাফত সেটা আঁচ করে গলার আওয়াজ কমিয়ে গোপন কথা বলার ভঙ্গি করে, তুই থাকিস তো খন্দ উঠলে হুরমতুল্লা টাল্টিবাল্টি করবার পারবি না। আর বেটিটা তো শুনি জমিতই পড়া থাকে, ধামা ধামা পিয়াজ রসুন সরালে ধরবি কেটা?

প্রায় টলতে টলতে বাড়ি ফিরলো তমিজ। বাপের ওপর, কুলসুমের ওপর ঝাল ঝাড়তে পারলে তার টলোমলোটা কমে। কিন্তু কুলসুম তখন ধানভরা মাটির হাঁড়ি তুলে দিয়েছে উনানের ওপর, ধোঁয়ার আড়ালে দেখা যায়, তার চোখমুখে গালে চিবুকে ধানের সুখ সাঁটা রয়েছে মেচেতার দাগের মতো। এক পলক সেই দাগ দেখে নিয়ে তমিজ ঢুকলো বাপের ঘরে। বাপটা তখন বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলো একটা বেড় জাল হাতে। তার চোখে ও দাড়িতে খুশির ছটা, উঠানে যেতে যেতে বলে, কালাম দিলো। অর বাপের আমলের জাল। কয়েক জায়গাত সুতা নাই, জোড়া দিলেই এই জালে আরেক জেবন চলবি।।

তমিজের সব ক্ষোভ আর কষ্ট চাপা পড়ে তীব্র উৎকণ্ঠায়, তুমি কি আবার কাৎলাহার বিলত যাচ্ছো মাছ ধরবার? মণ্ডল তোমার ঠ্যাং দুইটাই ভ্যাঙা দিবি না?

বাপের জোড়া ঠ্যাং ভাঙার সম্ভাবনাতেই তমিজের অবসাদ কাটে, মণ্ডলের লাঠিতে বাপটা তার যদি সত্যি সত্যি পড়ে যায় তো সেই এক বাড়িতেই সে নিজেও ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে শরাফতের কবজা থেকে। আবার ওদিকে বেড় জালের ভেতর দিয়ে বাঘাড় মাছের তেজ যেন ঢুকে পড়েছে তমিজের বাপের গতরে, সেই তেজে ছোটে তার মুখ, কাৎলাহার বিল ছাড়া দুনিয়াত আর পানি নাই? দুনিয়ার ব্যামাক পানি কি মণ্ডলের বেটা একলাই দখল করিছে? বাঙালি নাই? যমুনা নাই? পশ্চিমমুখে করতোয়া নাই?

একনাগাড়ে এতো কথা বলে তমিজের বাপের চোখে ঢুলুনি নামে, সেই দুলুনিতেও তেজ তার কমে না, ধান যা লিয়া আসিছু, বেচলে কয়টা মাসের খোরাক হয় রে? তার গর্জন ক্রমে ক্রমে নেমে আসে বিড়বিড় ধ্বনিতে, পোড়াদহ মেলাত যদি একটা বাঘাড় তুলবার পারি তো। বাক্য অসমাপ্ত রেখেই একটু উঁচু গলায় জিগ্যেস করে, মণ্ডল তোক এবার বর্গা তো দিচ্ছে না। কামলাই খাটবু?

মণ্ডলের পেটের খবর বাপ পায় কী করে? বুড়া গত রাত্রে কি বিলের সিথানে গিয়েছিলো? পাকুড়তলা থেকেই কি সে এতো তেজ নিয়ে এসেছে গতর ভরে? তা বুড়ার সাথে মুনসির এতো খায়খাতির তো মুনসিকে দিয়ে সে মণ্ডলের মনটা একটু ফেরাতে পারে না? রাতভর বিলের ধারে ধারে এতো হাঁটাহাঁটি করে তমিজের বাপের ফায়দাটা। হলো কী? বর্গা জমিটা তার বেহাত হয়ে গেলো, বুড়া কি মুনসিকে খবরটা জানাতে পারে না?-শূন্য জমি যে দিনরাত তমিজের জন্যে আহাজারি করছে, মুনসি কি তার কিছুই শুনতে পারে না? জমির নিশ্বাসে কি মুনসি এতোটুকু সাড়া দিতে পারে না? তো সে কিসের মুনসি?

দুপুরবেলা নিজগিরিরডাঙায় মোষের দিঘির পাশের সেই ধান-কাটা জমি গা এলিয়ে দিব্যি উদাম গা পোহায়। পাশে হুরমতুল্লার মরিচখেতের সবুজ ও লাল আভায় এই জমির গা কি একটুও কঁপে? ছটফট করে বরং তমিজ। হুরমতুল্লাকে হাতে পায়ে ধরে মণ্ডলকে বলিয়ে তমিজ কি এবারের মতো, শুধু এবারের মতো হালগোরু ছাড়া জমিটা বর্গা পেতে পারে না?

কিন্তু হুরমতুল্লার বাড়িতে লোকজন কোথায়? শুকনা কলাপাতার পর্দার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তমিজ অনেকক্ষণ পর শুনতে পায় শিশুকণ্ঠের কোঁকানি। গলা খাঁকারি দিয়ে সে ভেতরে ঢুকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ফুলজান। ছেলেটির গলা থেকে ক্ষীণ কোঁকানি বেরিয়ে বাড়িটিতে আরোপ করেছে ধূ ধূ করা মাঠের ছন্দ। হুরমতুল্লাকে তমিজের খুব দরকার,-এই ব্যাপারটি আড়ালে পড়ে যায়। তমিজের বুক ধুক ধুক করে, বাড়িতে আর কেউ নাই?

মাঝির বেটা, ছোল হামার বুঝি আর বাঁচে না গো?

তার এই উৎকণ্ঠায় সাড়া না দিয়ে কিংবা ভালো করে সাড়া দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে তমিজ জিগ্যেস করে, তোমার বাপ কোটে? নবিতন কোটে? মাও?

বাজান গেলো মণ্ডলবাড়িত। বাজান মনে হয় বিল পার হয়ই নাই, ছেলের হামার বমি আরম্ভ হলো। বমি এখন থামিছে, সখন থ্যাকা খালি ক্যামা কোকাচ্ছে। লাকোত বিশ্বাস মনে হয় নাই।

নিশ্বাসবিহীন প্রাণীর পক্ষে কোনো সম্ভব নয়, শিশুটির জীবন সম্বন্ধে তমিজ নিশ্চিন্ত। শূন্য রান্নাঘর ও শূন্য উঠানের দিকে দেখে তমিজ শিশুটিকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে দেখে, কপালে হাত দেয়, গালে হাত বুলায় এবং প্রায় ডাক্তারেদের মতো করে বলে, না। ভালো হয়া যাবি। চ্যাংড়াপ্যাংড়ার বমি ওংকা হয়ই। তোমার মাও কোটে? নবিতন বাড়িত নাই?

হামার বড়োমামু আসিছিলো, মায়েক লিয়া গেলো, সাথে গেলো নবিতন আর ফালানি। তার ছেলে সম্বন্ধে তমিজের বিজ্ঞ বিজ্ঞ কথায় ফুলজান হয়তো আশ্বস্ত হয়েছে, নাইওর লিয়া গেলো। দুইদিন বাদে পোড়াদহের মেলা লয়? মামু কয়, তোমার জামাই তো আর আসবি না। ফুলজানের বাপ হামাগোরে বুড়া জামাই, তাই লিবার আসিছি।

পোড়াদহের মেলা উপলক্ষে একজন প্রবীণ জামাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে আমন্ত্রিত হবার খবরে তমিজ কিন্তু হাসে না। কিন্তু অস্পষ্ট খুশির ঝিলিক ওঠে ফুলজানের ঠোঁটে, এই আবছা হাসির হালকা টোকায় বিমারি বেটার জন্যে জমে-ওঠা অশ্রু ফুটে ওঠে। গোল বিন্দুতে এবং তমিজ একটু লাই পায়, পোড়াদহের মেলা পাড়ি দিয়া আসবি? তুমি যাও নাই যে?

এই রুগ্ন ছেলেকে নিয়ে ফুলজান যেতে পারে নি, তাকে একা রেখে বাপজানই বা যায় কী করে? এইসব জানাতে জানাতে ফুলজানের অশ্রু বিন্দুটি গড়িয়ে পড়ে গালে, কিন্তু শুকিয়ে যায় না। বাড়িতে ফুলজান আর তার ছেলে ছাড়া আর কেউ নাই, এটা। জানার পর বাড়ির নির্জনতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হলে শুরু হয় তমিজের নতুন উদ্বেগ : এই . নির্জনতা কি তাকে কোনো সুযোগ নেওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলো?-এই বাড়িতে তার আবার দায়িত্ব কী? এখন কী করবে তমিজ? হুরমতুল্লা তার জমি হাতিয়ে নিচ্ছে, ফুলজানকে বলে লাভ কী? তা হলে? ফুলজানকে কিছু একটা বলতে তো হবে। কী বলবে?—এই দমবন্ধ দশা থেকে তাকে বাঁচায় ফুলজানের বেটা, হঠাৎ সে বমি করে ফেলে মায়ের কোলেই। তার বমি নিঃশব্দ, যেন তরল কিছু জিনিস মুখ থেকে ফেলে দিলো আলগোছে। তারপর মাথাটা এলিয়ে দিলো মায়ের কোলে, যেন বাঁচার জন্যে। চেষ্টা করার শক্তিই তার নাই।

বেহুঁশ হয়া গেলো? দেখি দেখি! বলতে বলতে ছেলেটিকে নিজের কোলে তুলে .. নেয় তমিজ। ফুলজানের বেটার বেঢপ পেট আরো ফুলে উঠেছে, চোখজোড়া খুঁজে গেলেও দুই চোখের পাতায় একটু ফাঁক রয়েই গেছে, চোখ বন্ধ করার ক্ষমতাও তার লোপ পেয়েছে। তার গালের কালচে হলুদ রঙ আরো গাঢ় হয়েছে, পাটের আঁশের মতো। চুল সব মাথার খুলির সঙ্গে লেপটানো। তমিজ ওই বমির লালা লাগা গালে গাঢ় একটি চুমু খায়। গাল বেশ গরম, তমিজের ঠোঁটে যেন ছ্যাকা লাগে। তার গরম নিশ্বাসে তমিজের মাথার জট কাটে, ফুলজানের বিলাপের জবাবে সে ধকম দিয়ে বলে, ছোলের জ্বর উঠিচ্ছে, মাথাত পানি ঢালা লাগবি, ভাণ্ড দে। বদনা লিয়া আয়।

ফুলজান বড়ো মালসা আর কলসিভরা পানি আর বদনা নিয়ে এলে ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তমিজ বসে মাটিতে। ফুলজান কিছুক্ষণ তার মাথায় পানির ধারা দেওয়ার। পর ছেলেটি চোখ মেলে কাঁদতে শুরু করলে তমিজের ইশারায় ফুলজান তার মাথায় পানি ঢালতেই থাকে। কলসির পানি শেষ হলে তমিজের ইশারাতেই পানি ঢালা সে বন্ধ করে এবং তার মাথা মুছে দেয় আঁচল দিয়ে। তমিজ নিজেই তাকে মাচার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেশ ভারী গলায় বলে, জ্বর কমিছে। কালই ডাক্তারের কাছ লিয়া যামু। ব্যায়না মেলা করা লাগবি।

ফুলজানের বেটা বোধহয় এখন একটু আরাম পাচ্ছে, কিংবা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। বলেও হতে পারে, কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে ঘুমিয়ে পড়ে। তমিজ হুকুম ছড়ে, ছেলের জাড় করিচ্ছে, বুঝিস না? তোক একখান এ্যাপার দিছিনু, সেটা কোটে? র‍্যাপার কথাটির শুদ্ধ বা অশুদ্ধ কোনো রূপের সঙ্গেই পরিচিত না থাকায় কিংবা সেটা হয়তো নবিতন নিয়ে গেছে মামাবাড়িতে সে জন্যেও হতে পারে, বেটার গায়ে সে বিছিয়ে দেয় নবিতনের ফুল-তোলা একটা কাঁথা। কথা জুড়ে ছড়ানো ছোটো ছোটো ফুল তমিজ দেখছে, এমন সময় ড়ুকরে কেঁদে ওঠে ফুলজান, একটা ওষুদ লয়, পানি-পড়া লয়, ছোল হামার এমনি এমনি মরে? কেউ দেখলো না!

কান্দিস কিসক? তমিজ হঠাৎ তাকে ধমক দিয়ে ওঠে, কান্দনের কী হলো? বাপের বাড়িত বান্দি হয়া আছু, বেটার চিকিচ্ছা করবু ক্যাংকা কর‍্যা? তমিজের এই। সান্ত্বনা-কাম-ধমকে ফুলজান ফোঁপানো ছেড়ে ড়ুকরে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, হামার কপাল মন্দ। হামার নসিব মন্দ। ছেলের বাপ থ্যাকাও নাই। একটা দিন খবর লেয় না মরলো কি বাচলো!

তোর সোয়ামির কথা কোস? সোয়ামি তোর আছেই? আরে তাই তো গান করা বেড়ায়, তুই খপর আখিস না? আজ এই হাট কাল ওই হাট করিচ্চে, এটি আসে নাই?

ফের ফোঁপানিতে ফিরে এসে ফুলজান এবার কান্না থামায়। কেটা কলো? মিছা কথা কও কিসক? ফুলজান কেরামতের খবর জানে এটা অনুমান করতে তমিজের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে ফুলজানের এই ছোট্টো ভাণটুকু ভারী মিষ্টি। বেশ আত্মবিশ্বাসী কিসিমের একটা খুচরা হাসি ছেড়ে তমিজ বলে, মিছা কথা কয়া হামার লাভ? আরে কালই তো গোলাবাড়ি হাটোত দেখা, তোমার কথা কয়, ওই বিয়া তো হামার তালাক হয়া গেছে। হামি কনু, বেটাক তো আর তালাক দিবার পারো না। বেটার তোমার কঠিন ব্যারাম, দেখবার যাবা না? তো চুপ করা থাকে। হাটের মধ্যে সোগলির সামানেই কথা হলো!

তমিজের দিকে চোখ বড়ো করে তাকিয়েফুলজান মাথা নিচু করলে ওই চোখ দিয়ে তার পানি পড়ে টপটপ করে। তমিজ তৎপর হয়ে দুই হাতে ফুলজানের চোখের পানি মোছে, মুছেই চলে। চোখের পানি এরকম পড়তেই থাকলে সে আর হাত সরায়। কী করে? হাত ওভাবে রেখেই বলে, সারাটা জেবন তুই বান্দিগিরিই করবু? তোের বিয়া বসা লাগবি না? ফুলজান দ্বিগুণ বেগে কাঁদতে শুরু করলে তমিজ তার গোটা। মাথাটাকেই চেপে ধরে নিজের বুকে, তারপর চুমু খেতে থাকে তার মোনতা গালে ও নোনতা চোখে, এমন কি তার ঘ্যাগ হয়ে বুক পর্যন্ত। চুমুর এমন প্রবল বর্ষণে ফুলজানের শরীর এলিয়ে পড়ে মাচার ওপর তার ছেলের গা ঘেঁষে। তোর বেটা তো হামারও বেটাই হবি, তখন তার দ্যাখশোন হামিই করমু। কাঁপতে কাঁপতে তমিজ বলে এবং নিজের কথায় তার নিজের শরীরের কাঁপুনি আরো বাড়ে। কাঁপুনি ঠেকাতেই তাকে শুয়ে পড়তে হয় ফুলজানকে জড়িয়ে ধরে।

ফুলজান তাকে ঠেকাতে একটু চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পারে না, সে নিজেও খুব কাঁপছিলো। তার বেটার ঘুম ভেঙে যায়, সে কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদে। ফুলজানের সারা শরীর জুড়ে তখন মাঝির বেটার গতরের দাপাদাপি; তার নাক তো বটেই, তার চোখ, কান, মুখ, গলা, ঘ্যাগ, বুক, পেট, উরু, পা ও পায়ের পাতা, পিঠ, পাছা প্রভৃতি অঙ্গে মাঝির বেটার গতরের আঁশটে গন্ধ।

তমিজ উঠে দাঁড়ালেও ফুলজান শুয়ে শুয়েই ছেলেকে টেনে নেয় বুকের ভেতর। তমিজ বলে, তোর বাপোক কই? আজই কই? তমিজ জানে কাজটা একটু কঠিন। অথচ বুড়া পরামাণিক বোঝে না, তাকে জামাই করলে হুরমতুল্লার সব জমিতে সে যে খন্দটা তুলবে বুড়া জীবনে তা স্বপ্নেও দেখে নি।

বাইরে শোনা যায় হুরমতুল্লার কাশির আওয়াজ। কাশতে কাশতেই সে গোরুর পেট এতো বেলা পর্যন্ত খালি কেন তার কৈফিয়ৎ তলব করছিলো মেয়ের কাছে। তমিজ তাড়াতাড়ি উঠানে নামে এবং হুরমতুল্লাকে প্রায় অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে যায় শুকনা কলাপাতার পর্দা পর্যন্ত।

ক্যা গো, তুমি আসিছো? হামি বলে কতোক্ষণ ধরা তোমার জন্যে দেরি করিচ্ছি। তমিজের গলা শুকনা, কিন্তু খামাখা উঁচু গলায় কথা বলায় সেখানে খরার দুপুরবেলার গরম হাওয়া বয়।

মণ্ডল ছাড়বার চায় না, দেরি হয়া গেলো। হুরমতুল্লা বলতেই তমিজ জিগ্যেস করে, জমির বন্দোবস্ত লিবার জন্যে মণ্ডলের পাও ধরবার গেছিলা, না?

হামি যামু কিসক? মণ্ডলই হামাক ডাকিছে। মণ্ডল ধরিছে, ওই জমি এবার বর্গা করাই লাগবি। এখন জোতদারে একটা কথা কলে তো আর ফালাবার পারি না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে ভেতরের দিকে তাকিয়ে অতিরিক্ত জোরে বলে ওঠে, ক্যা রে ফুলজান মরিছু? এঁড়াটার প্যাট ওঠে নাই কিসক?

বেটা কোলে ফুলজান বেরিয়ে এসে বলে, ছোল হামার মরবার ধরিছিলো। আর কোনো ব্যাখ্যা কি গোরুর প্রতি অবহেলার জন্যে কৈফিয়ৎ দেওয়ার কোনো চেষ্টাই সে করে না।

তমিজ ফুলজানকে অকারণে উঁচু গলায় হুকুম দেয়, কাল ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবি কলাম। ব্যায়না ব্যায়না মেলা না করলে ডাক্তারের সাথে দেখা হবি না।

নিজের মেয়ে ও তমিজের এরকম ঠাস ঠাস কথায় হুরমতুল্লা একটু ধান্দায় পড়ে। উঠানে হাঁটু ভেঙে বসে সে তমিজকে বলে, তুই না হয় তোর ভিটার সাথেকার জমিটার কথা ক। মণ্ডলের হাতেপায়ে ধরলে ওই জমিটা তোক বর্গা দিবার পারে।

মণ্ডলের পায়েত পড়ার হামার দরকার নাই। মণ্ডল হামাক বস্যা খাওয়াবি?

হুরমতুল্লা নরম হয়ে পড়ে, তা বাপু হালগোরু না থাকলে জমি বর্গা করার ক্যাচাল কম লয়। মণ্ডল কলো, তোক বলে হামার সাথে কামলা খাবার দিবি। আমার তো মানুষ লাগে না। আমার বেটিগুলাই-

এবারে দপ করে জ্বলে ওঠে তমিজ, উগলান ফন্দি ছাড়ো বুড়ার বেটা। গিরস্থের ঘরের বৌ বেটি জমির মধ্যে গতর খাটায় এটা খুব ভালো কথা হলো? বেটিক তুমি আর জমিত খাটাবার পারবা না কয়া দিলাম।

হনহন করে হেঁটে বিলের কাছাকাছি এসে তমিজ ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় উত্তরের দিকে। বিলের সিথান এখান থেকে দূরে নয়, মোষের দিঘি ঘুরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগোলে কাছেই পড়ে। ওইখানে পাকুড়গাছ থেকে মুনসি গোটা বিল নিয়ে আসে তার হাতের বেড় জালের ভেতর। বিলের গজার মাছগুলোকে ভেড়ার আদল দিলে তামাম রাত ধরে হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটে তারা, ভোর হওয়ার আগে আগে। তাদের নিজেদের সুরত ফিরিয়ে দিলে দিনমান তারা পাহারা দেয় পানির অনেক নিচে। তাদের চোখে চোখে বড়ো হয় রুই কালা, শোল, শিঙিমাগুর, ট্যাংরা পাবদা, খলসে পুঁটি। মুনসি তখন কী করে গো? বিলের শিওরে পাকুড়গছের মগডালে শকুনের চোখের মণি হয়ে ছুঁচলো চোখে সে সুরুজের আকাশ পাড়ি দেওয়া দেখবে, দেখতে দেখতে রোদের মধ্যে রোদ হয়ে বিলের পানিতে শুয়ে ওম দেবে বিলের গজার আর রুই কাৎলা। আর শোল আর শিঙিমাগুর আর কৈ আর পাবদা ট্যাংরা আর খলসে পুঁটির হিম শরীরে। আর? আর কী করবে? হয়রান হয়ে পড়লে পাকুড়গাছের ডালে ঘন পাতার আড়ালে হরিয়াল পাখির ডানার নিচে লোমের ভেতর ছোটো লোম হয়ে পাখির নরম মাংসের ওমে টানা ঘুম দেবে একেবারে সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত।

তা মুনসির কি এখন দিনের পর দিন ধরে ঘুমের আসর চলছে? মণ্ডলের বছর কামলার মতো সে কি মাসকাবারি ঘুমের চুক্তি নিলো নাকি গো? তমিজের একবার জেদ হয়, হেঁটে হেঁটে এখনি সে চলে যায় পাকুড়তলার দিকে। পাকুড়গাছে জোরেসোরে ঝাকুনি দিয়ে মুনসির মরণের ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয়। মোষের দিঘি পেরিয়ে সত্যি সত্যি ঝোপঝাড় জঙ্গল পেরিয়ে সে পাকুড়গাছ খুঁজতে লাগলো। এতো গাছ, বড়ো ছোটো এতো গাছ, গাছের ওপারে, জঙ্গলের ওপারে কাশবন। কাশবন পর্যন্ত এসেও সে পাকুড়গাছ আর সনাক্ত করতে পারে না। তখন তার গা শিরশির করে। গা ছমছম করে। নাঃ। সে বেশ হাপসে যায়। কিন্তু তমিজ পাকুড়গাছ চিনতে পারবে না, তা কী করে হয়? সে ফের এদিক ওদিক তাকায়। পাকুড়গাছ তা হলে কোনদিকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *