২০. লখাই যখন ফিরে এল বাড়িতে

লখাই যখন ফিরে এল বাড়িতে তখন সেখানে কেউ নেই। কেবল শ্যাম একলা আপনমনে বসে বসে মাটিতে দাগ কাটছে। লখাইকে দেখে একবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় ছেলে কাল রাতে?

লখাই বলল, মুরলীদাদার আখড়ায়।

একমুহূর্ত লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ ফিরিয়ে অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, এমনি হয়েছে আজকাল শ্যাম। প্রকৃতপক্ষে সে কারও সঙ্গেই কথা বলে না। যেন সব সময়ই নেশার ঘোরে ভাম্ হয়ে বসে আছে। যেন জগতটাই তার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। মন্ত্রপূত জীন ভূতের মতো যথানিয়মে মাঠের কাজ করে। করতে গেলে তার শেষ নেই। বিশ্রাম নিতে গেলে কদণ্ড গেল ঠিক থাকে না। খেতে বসলে কালী ভাত দিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারে না। নিজের ভাতগুলো দিয়ে তারপর সে শ্যামকে উঠতে বলে। আশ্চর্য! খাওয়ার হিসাবও নেই শ্যামের!

কেবল কান্না বাড়ে কালীর।

লখাই গেল কানুর বাড়িতে। সেখানে তখন কানুদের কয়েকজন জাতভাই মরা মেয়ে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছে। লখাই দেখল শুষ্ক চোখ স্থির দৃষ্টি কাটুনিবউয়ের পাশে কালী বসে আছে। মধুর মড়া স্পর্শ করার অধিকার নেই, তাই মড়া বওয়ার মই বাঁধছে সে।

তারপর হরিবোল ধ্বনি দিয়ে যখন মড়া তোলা হল তখনও কানুর বউয়ের চোখে এক ফোঁটা জল দেখা গেল না। সে সকলের সঙ্গে গঙ্গাধারের পথ ধরল। জলভরা চোখ নিয়ে সে মুখের দিকে কালী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

দুপুরবেলা মড়া পুড়িয়ে সবাই গঙ্গায় স্নান করে ফিরে এল।

কালী বার বার কিছু মুখে তুলতে বলল কাটুনিবউকে। কাটুনিবউ বিচিত্র হেসে বলল, অনেক খেয়েছি, আর কত খাব! ভাল চাও তো এবার তোমরা পালাও।

কান্নাহীন বিচিত্র হাসির সে কথা শুনে সকলেই এক অদ্ভুত ভয় ও অশান্তি করা চোখে বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

পরদিন সকালে আকাশে মেঘ করা গুমোট। রাত্রির শেষে এসে দিন যেন আটকা পড়ে আছে। লখাই কানুর বাড়িতে এসে দেখল দাওয়ার উপর কালকের সেই জায়গাটিতেই তখনও কাটুনিবউ তেমনি বসে আছে। ফরসা রং পোড়া হয়েছে, কালী পড়েছে চোখের কোলে। কালো রং লাগানো পাটের মতো চুলগুলো রুক্ষধূসর। তবু সারা শরীরে তার যৌবনের ছাপ সুস্পষ্ট। ছাই-মাটি-লাগা ভরাকুম্ভের মতো সে রূপ অপরূপ হয়ে উঠবে না আর কোনওদিন। বিস্রস্ত বসন, ঢাকবার বালাইও নেই। কেবল চোখ জোড়ায় যেন চোখ ধাঁধানো ধকধকানি। লখাইয়ের নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একটু বা সঙ্কুচিত হল সে। পরমুহূর্তে সেই বিচিত্র হেসে বলল, লখাই, এবার?

লখাই চোখ নামাল, কিন্তু তার বড় অস্বস্তি লাগল কাটুনিবউয়ের হাসি দেখে। সে বলল, তুমি অমন করে হেসো না। কাটুনিদিদি।

হায়! সে কথা শুনে মিষ্টি বাজনার মতো শব্দ করে এবার হেসে উঠল কাটুনিবউ। সে হাসি এক মূর্তিমান সর্বনাশের মতো। আর চোখ পুড়ে গেল লখাইয়ের আচমকা হাসির দমকে আঁধার ফাটা আলোর মতো কাটুনিবউয়ের অপরূপ মুখ দেখে।

কথা ফুটল না লখাইয়ের গলায়। জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল, ধুকপুক করতে লাগল বুকের মধ্যে।

হাসি থামিয়ে কাটুনিবউয়ের আপাদমস্তক একবার দেখে বলল, কী নে থাকব, বলো লখাই। মহাজনের ট্যাঁকে ভিটে, জমি নেই এক ফোঁটা, মেয়েমানুষের সব সোয়ামি সন্তান, তাও খেয়েছি। এবার যাব কোম্পানির চটকলে।

চটকলে? কেমন বিভ্রান্ত হয়ে উঠল লখাই। এই হাসি এই কথা, তারপরে চটকলে যাওয়ার ইচ্ছা, এ-সবই যেন লখাইকে কেমন বিচলিত করে তুলল। বলল, চটকলে আর যে যাক, কাটুনিদিদি, তুমি যাবে কেমন করে? তোমার মতো মেয়েমানুষের জায়গা সে নয়।

আমার মতো মেয়েমানষের— বলতে বলতে আবার সেই দুয়ে হাসি ফুটল বউয়ের মুখে। বলল, লখাই, নিজের ইচ্ছেয় কিছুই করিনি, আজ নিজের মতলবে কাজ করব আমি। আমাকে আটকো না, আমি উঠি। আমার মতো মেয়েমানুষের কি আর জায়গা-অজায়গা আছে?

বলে সে উঠে পড়েল। সে ঘরে কানু গলায় ফাঁস দিয়েছিল সেই ঘরে গিয়ে সেই ফাঁসির বাঁশটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মুখ তুলে বলল, কে জানত কোম্পানির পরে গোঁসা করে তুমি পানঘাতী হবে? যদি হলে, আমাকে জানতেও দিলে না। তুমি আজও আছ, কিন্তু অন্য জগতে। তোমার মেয়ে মরেছে, তবু আমি আছি। কত সাধ ছেল—তোমার মেয়ে হয়েছে, এবার ছেলে হবে। এ পোড়ামুখে বলি, রাক্ষুসে,পেটে সেদিন ছেলে ধরতে তোমার চে বেশি সাধ ছেল আমার। তুমি যাওয়ার পরেতে, কেবলি ভেবেছি, বুঝিন মনের আশা পেটে রয়েছে। না, তা নেই। কিন্তু।

ঊর্ধ্ব দেহ নগ্ন করে দুহাত তুলে ফিসফিস করে বলল, দেখো, দেখো, আজও তেমনি আছি। তুমি বেঁচে থাকলে—

 সে চুপ করল। তবু চোখে একফোঁটা জল নেই। অসহ্য জ্বরের ঘোরে ও যন্ত্রণায় তার মুখ যেন আগুনের তাপে জ্বলছে। চোখ বুজে সে যেন কান পেতে শুনল তার জগৎ-দর্শনকামী অজাত শিশুরা গর্ভের মধ্যে ছটফট করে কোলাহল করছে। খানিকক্ষণ বাদে চোখ খুলে বলল, আজ সব রেখে থুয়ে পথ ধরেছি চটকলের, জানি না কী হবে…পরের গলার কাঁটা হয়ে তো থাকতে পারব না। তুমি গে পথের বার হলুম আজ…পথ দেখিয়ো।

বলে সে ফিরতেই দেখল লখাই দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।

মৃত স্বামীর কাছে যে এমন করে বিদায় নিয়ে পথে বেরোয় তাকে ঠেকাবার কথা লখাই আর ভাবতে পারল না। কেবল বলল, কাটুনিদিদি, যদি পর ভাবো, তোমাকে গলার কাঁটা হয়েই থাকতে নাগবে। তবু বলি, আমরা তোমার পর লই। আর…কানুদাদা যেদিন বলেছেন, এবার কোম্পানির কলে চট বুনতে যাব, আমি বলেছিলুম, তার চে তাঁতির মরণ ভাল।

আচমকা যেন কাটুনিবউকে পুড়িয়ে ছাই করে দিল। সে চোখ বড় বড় করে লখাইয়ের দিকে তাকাল ফিরে। কী সে চোখের চাউনি। বোধ করি লখাইয়ের বুকটা ফুড়ে দেখল। তারপর ঘোমটা তুলে দিয়ে বলল, এসবই তোমার কাছে রইল, দেখো। বলেই হেসে ফেলল। আবার কী ভেবে হাসি থামিয়ে ঘরে ঢুকে মাথার ছাউনির মাচা থেকে একটা মুখ ঢাকা কলসি পেড়ে তার ভেতর থেকে বার করল একখানি নয়নমোহন উজ্জ্বল শাড়ি। মেঘ-চাপা দিনেও সে শাড়ির কী বাহার। যেন তার একেক ভাঁজে একেক রং। কয়েকটা ভাঁজ খুলে সে একবার সেই শাড়ি বুকে এলিয়ে দিল, আবার দুলিয়ে দিল কোমরের পাশ দিয়ে, তারপর মাথায় দিয়ে ছড়িয়ে দিল কাঁধের উপর দিয়ে বুকের উপর। হেসে বলল, তোমার দাদার হাতে তায়েরি। আমার জন্যে। রোদ থাকলে মনে লাগত যেন আগুন লেগেছে গায়ে। হ্যাঁ গো, ঠিক আগুনের রকোম। বলে চোখের কোণে কটাক্ষ করে অপরূপ হাসিতে যেন নবীনা প্রেমবতী হয়ে উঠল। তারপর ঘরের শিকল তুলে শাড়িটা গুটিয়ে বুকে নিয়ে বেরুল।

হাতে তখনও কয়েকগোছ রূপোর চুড়ি। আঁচলে বাঁধা কয়েকগণ্ডা পয়সা।

লখাই যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে মায়ামুগ্ধ, নিবার্ক।

কাটুনিবউ বেরিয়ে গঙ্গার পথ ধরে আতপুরের ঘাটের দিকে এগিয়ে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *