২০. ম্যালেরিয়া এবার আসিয়াছে

ম্যালেরিয়া এবার আসিয়াছে যেন মড়ুকের চেহারা লইয়া। চারিদিকে ঘরে ঘরে লোকে জ্বরে পড়িয়াছে। কে কাহার মুখে জল দেয়—এমন অবস্থা। বয়স্ক মানুষের বিপদ কম—তাহারা ভুগিয়া কঙ্কালসার চেহারা লইয়া সারিয়া উঠিতেছে-পাঁচ দিন, সাত দিন, চৌদ্দ দিন পর্যন্ত জ্বরের ভোেগ। মড়কটা ছেলেদের মধ্যে। পাঁচ-সাত বৎসর বয়স পর্যন্ত ছেলেদের জ্বর হইলে–মা-বাপের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িতেছে। তিন দিন কি পাঁচ দিনের মধ্যেই একটা বিপদ আসিয়া উপস্থিত হয়। হঠাৎ জ্বরটা ময়ূরাক্ষীর ওই ঘোড়াবানের মতই হু-হু করিয়া বাড়িয়া ওঠে—ছেলেটার ক্রমাগত মাথা ঘুরায়—তারপর হয় তড়কার মত। ব্যস, ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে সব শেষ হইয়া যায়। দশটার মধ্যে বাঁচে দুইটা কি তিনটা, সাত-আটটাই মরে।

পরশু রাত্রে পাতু মুচির ছেলেটা মরিয়াছে। পাতুর স্ত্রীর অনেক বয়স পর্যন্ত সন্তানসন্ততি হয় নাই—দুই বৎসর আগে ওই সন্তানটিকে সে কোলে পাইয়াছিল। পাড়া-প্রতিবাসীরা বলে–ওটি এগ্রামের বাসিন্দা হরেন ঘোষালের সন্তান। শুধু পাড়া-প্রতিবাসীরাই নয়—পাতুর মা, দুর্গা, ইহারাও বলে। ঘোষালের সঙ্গে স্ত্রীর গোপন প্রণয়ের কথা পাতুও জানে। আগে যখন পাতুর চাকরান জমি ছিল—ঢাকের বাজনা বাজাইয়া সে দু-পয়সা রোজগার করি, তখন পাতু ছিল বেশ মাতব্বর মানুষ, তখন ইজ্জত-সম্ভ্রমের দিকে কঠিন দৃষ্টি ছিল। দুর্গার মন্দ স্বভাবের জন্য তখন সে গভীর লজ্জা বোধ করিত—দুর্গাকে সে কত তিরস্কার করিয়াছে; কখনও কখনও প্রহারও করিয়াছে। তখন তাহার স্ত্রীও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পাতুর প্রতি ছিল তাহার গভীর ভয়, আসক্তিও ছিল; দিবারাত্রি হৃষ্টপুষ্টাঙ্গী বিড়ালীর মত বউটা ঘরের কাজ করিয়া ঘুরঘুর করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত। সে সময় তাহার শাশুড়ি-পাতুর মা পুত্রবধূর যৌবন ভাঙাইয়া গোপনে রোজগার করিবার প্রত্যাশায় বউটিকে অনেক প্রলোভন দেখাইয়াছিল, কিন্তু তখন বউটি কিছুতেই রাজি হয় নাই। তাহার পর পাতুর জীবনে শ্রীহরি ঘোষের আক্ৰোশে আসিল একটা বিপর্যয়। জমি গেল, পাতু বাজনার ব্যবসা ত্যাগ করিল, শেষে দিনমজুরি অবলম্বন করিল। এই অবস্থার মধ্যে কেমন করিয়া যে পাতু বদলাইয়া গেল—সে পাতুও জানে না।

এখন ঘরে চাল না থাকিলে দুর্গার কাছে চাল লইয়া, পয়সা লইয়া—দুর্গাকে সে শাসন করা ছাড়িল। তারপর একদিন তাহার মা বলিল—দুগ্‌গা কঙ্কণায় যায় এতে (রাতে), তু যদি সঁতে যাস পাতু—তবে বক্‌শিশটা বাবুদের কাছে তুই-ই তো পাস্। আর মেয়েটা যায়, কোনোদিন আত (রাত) বিরেতে—যদি বেপদই ঘটে তবে কি হবে? মায়ের প্যাটের বুন তো বটে।

দুর্গাকে সঙ্গে করিয়া বাবুদের অভিনয়ের আসরে পৌঁছাইয়া দিতে গিয়া-পাতুর ওটাও বেশ অভ্যাস হইয়া গেল। এই অবসরে একদিন প্ৰকাশ পাইল, তাহার স্ত্রীও ওই ব্যবসায়ে রত হইয়াছে। ঘোষাল ঠাকুরকে সন্ধ্যার পর পাড়ার প্রান্তে নির্জন স্থানে ঘুরিতে দেখা যায় এবং পাড়া হইতে পাতুর বউকেও সেইদিকে যাইতে দেখা যায়। একদিন পিতুর মা ব্যাপারটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া হঠাৎ একটা কলরব তুলিয়া ফেলিল-দুর্গা বলিল—চুপ কর মা, চুপ কর, ঘরের বউ, ছিঃ!

পাতু মাকেও চুপ করিতে বলিল না বউটাকেও তিরস্কার করিল না—নিজেই নীরবে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। বউটা ভয়ে সেদিন বাপের বাড়ি পলাইয়া গিয়াছিল; কয়েকদিন পরে পাতুই নিজে গিয়া তাহাকে ফিরাইয়া আনিয়াছিল। কিছুদিন পর পাতুর স্ত্রী এই সন্তানটি প্রসব করিল।

পাড়ার লোকে বলাবলি করিল ছেলেটা ঘোষাল ঠাকুরের মত হইছে বটে। রংটা এতটুকু কালো দেখাইছে।…

পাতুও ছেলেটার দুষ্টবুদ্ধি দেখিয়া কতদিন বলিয়াছে—বামুনে বুদ্ধির ভেজাল আছে কিনা, বেটার ফিচুলেমি দেখ ক্যানে!—বলিয়া সে সন্দেহে হাসিত।

ছেলেটাকে ভালবাসিত সে। হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে ছেলেটা শেষ হইয়া গেল। দুর্গাও ছেলেটাকে বড় স্নেহ করিত; সে ডাক্তার দেখাইয়াছিল। জগনকে যতবার ডাকিয়াছে—নগদ টাকা দিয়াছে, নিয়মিত ঔষধ খাওয়াইয়াছে, তবু ছেলেটা বাঁচিল না।

আশ্চর্যের কথা—পাতুর স্ত্রী ততটা কাতর হইল না, যতটা কাতর হইল পাতু। পাতু তাহার মোটা গলায় হাউ-বাউ করিয়া কাঁদিয়া পাড়াটাকে পর্যন্ত অধীর করিয়া তুলিল।

বিপদের রাত্রে সতীশ আসিয়া তাহাকে ধরিয়া বসাইল—সান্ত্বনা দিল। বাউরি ও মুচিপাড়ার মধ্যে সতীশ মোড়ল মানুষ, ঘরে তাহার হাল আছে—দুই মুঠা খাইবার সংস্থান আছে। সেই মনসার ভাসানের দলের মাতব্বর, ঘেঁটুর দলের মূল গায়েন রকমারি গান বাধে; এজন্য হরিজনপল্লীর লোক তাহাকে মান্যও করে। সেই ছেলেটার সঙ্কারের ব্যবস্থা করিল। পরদিন সকালে সে পাতুকে ডাকিয়া নিজের ঘরে লইয়া গেল, তারপর দেবু পণ্ডিতের আসরে লইয়া গেল।

দেবুর আসর এখন সর্বদাই জমজমাট হইয়া আছে। নিজ গ্রামের এবং আশপাশ গ্রামের বার-তের হইতে আঠার-উনিশ বছরের ছেলের দল সর্বদা আসিতেছে যাইতেছে, কলরব করিতেছে। তিনকড়ির ছেলে গৌর তাহাদের সর্দার। পাতুও কয়েকদিন এখানকার কাজে খাঁটিতেছে। ছেলেদের সঙ্গে সে কস্তা ঘাড়ে করিয়া ফিরিত। গ্রাম-গ্রামান্তরে মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করিয়া বহিয়া আনিত। এই বিপদের দিনে সাহায্য-সমিতি হইতে পাতুর পরিবারের জন্য চালের বরাদ্দও হইয়া গেল। কথাটা তুলিল সতীশ।

দেবু কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া ছিল। সতীশ কথাটা তুলিতেই সে সচেতন হইয়া উঠিল, বলিলহা হ্যাঁ, নিশ্চয়, পাতুর ব্যবস্থা করতে হবে বৈকি। নিশ্চয়।

সাহায্য-সমিতি হইতে পাতুর খোরাকের চালের ব্যবস্থা দেবু করিয়া দিয়াছে। চালটা লইয়া আসে দুর্গা। সকালে উঠিয়াই জামাই-পণ্ডিতের বাড়ি যায়। বাহির হইতে ঘরকার যতখানি মার্জনা এবং কাজকর্ম করা সম্ভব দেবুর বাড়িতে সে সেইগুলি করে; সাহায্য-সমিতির চাল মাপে। সকালে গিয়া দুপুরে খাওয়ার সময় ফেরে, খাওয়াদাওয়া সারিয়া আবার যায়—ফেরে সন্ধ্যার পর। সে এখন সদাই ব্যস্ত। বেশভূষার পারিপাট্যের দিকে দৃষ্টি দিবার অবকাশ পর্যন্ত নাই।

সকালে উঠিয়াই সে দেবুর বাড়ি গিয়াছে। পাতুর মা দাওয়ায় বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া নাতির জন্য কাঁদিতেছে,পাতুর মায়ের অভিযোগ সকলের বিরুদ্ধেই। সে বিনাই বিনাইয়া কাঁদিতেছে, দুর্গার পাপে তাহার এই সর্বনাশ ঘটিয়া গেল। ওই পাপিনী বউটা—ব্রাহ্মণের দেহে পাপ সঞ্চার করিয়া সে মহাপাপ সঞ্চয় করিয়াছে, সেই পাপে এত বড় আঘাত তাহার বুকে বাজিল। গোয়ার-গোবিন্দ পাষণ্ড পাতু দেবস্থলে বাজনা বাজানো ছাড়িয়ছে, সেই দেব-রোষে তাহার নাতিটি মরিয়া গেল। সমস্ত গ্রামখানা পাপে ভরিয়া উঠিয়াছে—তাই ময়ূরাক্ষীর বাঁধ ভাঙিয়া আসিল কালবন্যা-তাই দেশ জুড়িয়া মড়কের মত আসিয়াছে এই সর্বনাশা জ্বর গ্রামের পাপে সেই জ্বরে তাহার বংশধর গেল—তাহার স্বামী-কুল, পুত্র-কুল আজ নির্বংশ হইতে বসিল।

পাড়ায় এখানে-ওখানে আরও কয়েকটা ঘরে কান্না উঠিতেছে। পাতু বাড়ির পিছনে একা বসিয়া কাঁদিতেছিল। আজ সতীশ আসে নাই, অন্য কেহও ডাকে নাই, সে-ও কোথাও যায় নাই।

পাতুর মা হঠাৎ কান্না বন্ধ করিয়া উঠিয়া আসিল। পাতুর মুখের সামনে বসিয়া হাত নাড়িয়া বলিল—আর সব্বনাশ করিস না বাবা, আর কাঁদিস না। পরের ছেলের লেগে আর আদিখ্যেতা করিস না। উঠ! উঠে খানকয়েক তালপাতা কেটে আন্—এনে দেওয়ালের ভাঙনে বেড়া দে। কাজকম্মে কর্।

বন্যায় পাতুর ঘরের একখানা দেওয়াল ধসিয়া পড়িয়া গিয়াছে। পাতু এখন বাস করিতেছে দুর্গার কোঠা-ঘরখানার নিচের তলার ঘরে। ওই ঘরখানা এতদিন নির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করিত পাতুর মা।

পাতু কোনো কথা বলিল না।

পাতুর মা বলিল–ওগে (রোগে) শোকে আমার বুকের জরাগুলা একেবারে ঝাজরা হয়ে গেল। এতে (রাতে) শোব—আর তোরা দুজনায় ফোঁসফোস করে কাদবি—আমার ঘুম হয় না। বাপু তোরা আপনার ঘর করে লে। কত লোকের ঘর পড়েছে—সবাই যার যেমন তার তেমন মেরামত করলে—তোর আর হল না। পাতুর মা মিথ্যা বলে নাই, ময়ূরাক্ষীর বানের ফলে এ-পাড়ায় একখানা ঘরও গোটা থাকে নাই, কাহারও বেশি কাহারও কম ক্ষতি হইয়াছে। কাহারও আধখানা-কাহারও একখানা—কাহারও বা দুইখানা দেওয়াল পড়িয়াছে, দুইচারজনের গোটা ঘরই পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু এই বিশ-পঁচিশ দিনের মধ্যেই সকলে যে যেমন আপনার ব্যবস্থা করিয়া লইয়াছে। কেহ বা তালপাতার বেড়া দিয়াছে। যাহাদের গোটা ঘর পড়িয়া গিয়াছে, তাহারা চাল তৈয়ার করিয়া তালপাতার চাটাই ঘিরিয়া মাথা পুঁজিবার ব্যবস্থা করিয়াছে, ঘোষ মহাশয়—শ্ৰীহরি ঘোষ অকাতরে লোককে সাহায্য করিয়াছে। বলিয়া দিয়াছে তালপাতা যাহার যত প্রয়োজন কাটিয়া লইতে পারে। দুইটা ও একটা হিসাবে বাঁশও সে অনেককে দিয়াছে। কিন্তু পাতু শ্রীহরি ঘোষের কাছে যায় নাই। গেলেও ঘোষ তাহাকে দিত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে; কারণ সতীশ বাউরিকেও ঘোষ কোনো সাহায্য করে নাই। বলিয়াছে–তুমি তো বাবা গরিব নও।

সতীশ অবাক হইয়া গেল। সে বড়লোক হইল কেমন করিয়া?

শ্ৰীহরি বলিয়াছিল—তুমি আগে ছিলে পাড়ার মাতব্বর, এখন হয়েছ গায়ের মাতব্বর। শুধু এ গায়ের কেন—পঞ্চগ্রামের তুমি একজন মাতব্বর। সাহায্য-সমিতি তোমার হাতে। লোককে তুমি সাহায্য করছ, তোমাকে সাহায্য কি আমি করতে পারি?

সতীশ ব্যাপারটা বুঝিয়া উঠিয়া আসিয়াছিল।

ব্যাপারটা শুনিয়া পাতু কিন্তু হাসিয়াছিল, বলিয়াছিল—সতীশ-ভাই, উ বেটার আমি মুখ পর্যন্ত দেখি না। বেটার মুখ দেখলে পাপ হয়। মরে গেলেও আমি কখনও যাব না উয়ার দোরে।

পাতু যায় নাই, এদিকে দুর্গার ঘরে শুকনো মেঝেয় রান্নাবান্নার জায়গা পাইয়া, নিজের ঘর মেরামতের জন্য এতদিন সে কোনো চেষ্টাও করে নাই। রাত্রিতে শুইবার স্থান তাহাদের নির্দিষ্ট হইয়া আছে, দেবুর স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতেই দুৰ্গা পাতুর জন্য ওই চাকরিটা স্থির করিয়া দিয়াছিল। সন্ধ্যার পর খাওয়াদাওয়া সারিয়া ছেলেটা ও স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া গিয়া দেবুর বাড়ি শুইত। ছেলেটার মৃত্যুর পর কয়দিন তাহারা দুর্গার নিচের ঘরেই শুইতেছে। সুতরাং নিজের ঘর। মেরামতের বাস্তব প্রয়োজনের কোনো তাগিদই আপাতত তাহার ছিল না। তাহার মনের যে তাগিদ সে তাগিদও পাতুর ফুরাইয়া গিয়াছে বহুদিন। রান্নাবান্নার স্থান ও শুইবার আশ্রয় ছাড়া মানুষের যে কারণে ঘরের প্রয়োজন হয় তা পাতুর নাই। কি রাখিবে সে ঘরে? রাখিবার মত বস্তুই যে তাহার কিছু নাই। চাকরান জমি লইয়া ঘোষের সঙ্গে মামলায় তাহার সমস্ত পিতলকাসা গিয়াছে। সে বাদ্যকর আগে তাহার ঢাক ছিল দুইখানা, ঢোলও একখানা ছিল; তাহাও গিয়াছে বাদ্যকরের লাভহীন বৃত্তি পরিত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে। পূর্বে চামড়াও একটা সম্পদ ছিল সেও আর নাই। জমিদার টাকা লইয়া ভাগাড় বন্দোবস্ত করিবার ফলে চামড়ার কারবারও গিয়াছে। কারবার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা-পয়সা আনা বন্ধ হইয়াছে। সুতরাং ঘরে সে। রাখিবেই বা কি আর ঘরখানাকে সাজাইবেই বা কি দিয়া? পৈতৃক শাল-দোশালা বিক্রয় করিবার পর পুরনো সিন্দুক-তোরঙ্গের মতই ঘরখানা সেই হইতে যেন অকারণে তাহার জীবনের সবখানি জায়গা জুড়িয়া পড়িয়া ছিল। বানে ঘরখানার একদিকের দেওয়াল ভাঙিয়াছে,যেন শূন্য তোরঙ্গের একটা দিক উই-পোকায় খাইয়া শেষ করিয়াছে। পাতু সেটাকে আর নাড়িতে বা ঝাড়িতে চায় না—বাকি কয়টা দিকও কোনো রকমে উইয়ে শেষ করিয়া দিলে সে বোধহয় বাঁচিয়া যায়। মধ্যে মধ্যে ভাবিয়াছে—ঘরখানা পড়িয়া গেলে, ওই বাস্তুভিটার উপর একদফা লাউ-কুমড়া-ভঁটাশাক লাগাইবে—তাহাতে প্রচুর ফসল পাওয়া যাইবে; কিছু খাইবে, কিছু বিক্রয় করিবে।

মায়ের কথা শুনিয়া পাতুর শোকাতুর মন-দুঃখেরাগে যেন বিষাইয়া উঠিল। কাটা ঘা যেমন তেল লাগিয়া বিষাইয়া ওঠে, তেমনি যন্ত্রণাদায়কভাবে বিষাইয়া উঠিল। মাকে সে কোনো কথা বলিল না, সেখানে হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল।

যাইবেই বা কোথায়? এক সতীশের বাড়ি। কিন্তু সতীশ আজ আসে নাই বলিয়া অভিমান করিয়া সে সেখানে গেল না; আর এক দেবু পণ্ডিতের মজলিস! কিন্তু সেও পাতুর ভাল লাগিল না। দেশের কথা ছাড়া সেখানে অন্য কথা নাই। আজ সে একান্তভাবে তাহার নিজের কথা বলিতে, অপরের কাছে শুনিতে চায় তাহার দুঃখটা কত বড় মর্মান্তিক সেই কথা, তাহারা পাতুর দুঃখে কতখানি দুঃখ পাইয়াছে সেই তত্ত্ব সে জানিতে চায়। দশজনের কথা বিশখানা গাঁয়ের কথা শুনিতে তাহার এখন ভাল লাগে না।

পাতু মাঠের পথ ধরিল।

মাঠেই বা কি আছে? গোটা মাঠখানাকে বানে ছারখার করিয়া দিয়া গিয়াছে। এখানে বালি। ধু-ধু করিতেছে-ওখানে খানায় জল জমিয়া আছে; যে জমিগুলার ওসব ক্ষতি হয় নাই; সেইসব। জমিগুলা শুকাইয়া ফাটিয়া যেন হাড়-পাঁজরা বাহির করিয়া পড়িয়া আছে। চারিপাশ অসমান উঁচু-নিচু, কতক জমিতে অবশ্য আবার ধান পোঁতা হইয়াছে। বনানীত পলির উর্বরতায় সদ্যপোঁতা ধানের চারাগুলি আশ্চর্য রকমের জোরালো হইয়া উঠিয়াছে। আরও অনেক জমি চাষ হইতে পারি, কিন্তু লোকের বীজ নাই। বীজও হয়ত মিলিত—পণ্ডিত বীজের যোগাড় করিয়াছিল, ঘোষও দিতে প্রস্তুত ছিল; কিন্তু ম্যালেরিয়া আসিয়া চাষীর হাড়গুলা যেন ভাঙিয়া দিল।

হঠাৎ কাহার উচ্চ কণ্ঠের গান তাহার কানে আসিল। স্বরটা পরিচিত। সতীশের গলা বলিয়া মনে হইতেছে।… হ্যাঁ, সতীশই বটে। ময়ূরাক্ষীর বাঁধের উপর দিয়া আসিতেছে। কোথায় গিয়াছিল সতীশ? পরক্ষণেই সে হাসিল। সতীশের অবস্থা মোটামুটি ভাল-জমি হাল আছে, কত কাজ তাহার। কোনো কাজে গিয়াছিল, কাজ উদ্ধার করিয়া মনের আনন্দে গান ধরিয়া ফিরিতেছে। তাহার তো পাতুর অবস্থা নয়। জমিও যায় নাই-সর্বস্বান্তও হয় নাই—ছেলেও মরে নাই। সে গান করিবে বৈকি। পাতু একটা দীর্ঘনিশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না।

—গরুর সেবা কর রে মন গরু পরম ধন

ওঃ, সতীশ গোধন-মাহাত্ম্য গান করিতেছে–

দরিদ্যের লক্ষ্মী মাগো শিবের বাহন।
তুমি মাগো হলে রুষ্ট, জগতেরো অশেষ কষ্ট,
তুষ্ট হও মা ভগবতী বাঁচাও জীবন।
গরু পরম ধন–মন রে–গোমাতা গোধন।

পাতুকে দেখিয়া সতীশ গান বন্ধ করিলগভীর বেদনার্ত স্বরে বলিল রহম শ্যাখের জোড়া-বলদ-আহা, জোড়াকে জোড়াই মরে গেল রে!

পাতু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

সতীশ বলিল—ভোর রেতে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। কিছু করতে পারলাম না। শ্যাখ বুক চাপড়িয়ে কাঁদছে। আঃ কি বাহারের বলদ জোড়া!—বলিতে বলিতে সতীশের চোখেও জল আসিল। সে চোখ মুছিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।

এতক্ষণে পাতু প্রশ্ন করিল–কি হয়েছিল?

ঘাড় নাড়িয়া সতীশ শঙ্কিতভাবে বলিলবুঝতে পারলাম না। তবে মহামারণ কাণ্ড বটে। জ্বরে যেমন ছেলের বনেদ মেরে দিছে—এ রোগে গরুও বোধহয় তেমনি ঝেড়েপুছে দিয়ে যাবে। কাও খুব খারাপ!

সতীশ বাউরি এ অঞ্চলের মধ্যে বিচক্ষণ গো-চিকিৎসকও বটে। রহমের গরুর ব্যারাম হইতে সে তাহাকেই ডাকিয়াছিল।

রহম সত্যই বুক চাপড়াইয়া কাঁদিতেছিল।

চাষী রহমের অনেক শখের গরু। তাহার অবস্থার অতিরিক্ত দাম দিয়া গরু জোড়াটাকে সে প্রায় শৈশব অবস্থায় কিনিয়াছিল। সযত্নে লালনপালন করিয়া, তাহাদিগকে আবড় অর্থাৎ হালবহন অনভ্যস্ত হইতে—পেঁয়াইয়া অর্থাৎ অভ্যস্ত করিয়াছিল। শক্ত-সমর্থ সুগঠিত গরু জোড়াটি এ অঞ্চলের চাষীদের ঈর্ষার বস্তু ছিল। রহম গরু দুইটার নাম দিয়াছিল—একটার নাম পেল্লাদ অপরটার নাম—আকাই। প্রহ্লাদ এবং আকাই এ অঞ্চলের এককালের বিখ্যাত শক্তিশালী জোয়ান ছিল। গরু দুইটির গৌরবে রহমের অহঙ্কার ছিল কত! ভাল সড়কের উপর দিয়া সে যখন গাড়ি লইয়া যাইত, তখন লোকজন দেখিলেই গরু দুইটার তলপেটে পায়ের বুড়া আঙুলের ঠোকর এবং পিঠে হাতের আঙুলের টিপ দিয়া নাকে একটা ঘড়াত শব্দ তুলিয়া গরু দুইটাকে ছটাইয়া দিত। বলিত—শেরকে বাচ্ছা রে বেটা-আরবি ঘোড়া!

কখনও পথিকদের হুঁশিয়ার করিয়া হাঁকিত–এ-ই সরে যাও ভাই, এই সরে যাও!

বর্ষার সময় কাদায় কাহারও গাড়ি পড়িলে শীতে কাহারও ধান-বোঝাই গাড়ি খানা-খন্দে পড়িলে, রহম তাহার প্রদ ও আকাইকে লইয়া গিয়া হাজির হইত। তাহাদের গরু খুলিয়া দিয়া সে জুড়িয়া দিত প্রদ ও আকাইকে। প্রহ্লাদ-আকাই অবলীলাক্রমে গাড়ি টানিয়া তুলিয়া ফেলিত। পরমগৌরবে নিঃশব্দে বড় বড় দাতগুলি আপনা হইতেই বাহির হইয়া পড়িত। এ অঞ্চলে শ্রীহরি ঘোষ ছাড়া এমন ভাল হেলে বলদ আর কাহারও ছিল না। শ্ৰীহরি নিজের বলদ জোড়াটার দাম দিয়াছে—সাড়ে তিনশো টাকা।

রহম বুক চাপড়াইয়া কাঁদিতেছে।

কাঁদবে না? গরু যে রহমের কাছে উপযুক্ত ছেলের চেয়েও বেশি। বড় আদরের বড়। যত্বের ধন; তাহার কর্মজীবনের দুইখানা হাত। কাঁধে করিয়া সার বয়, বুক দিয়া ঠেলিয়া মাটি চষে, বুড়া বাপ-মাকে উপযুক্ত ছেলে যেমনভাবে কোলে-কঁধে করিয়া পাথরচাপড়ির পীরতলা ঘুরাইয়া আনে, তেমনিভাবে সপরিবার রহমকে গ্রাম-গ্রামান্তরে গাড়িতে বহিয়া লইয়া যাইত, ক্ষেতের ফসল বোঝাই করিয়া ঘরে আনিয়া তুলিয়া দিত, যোগ্য শক্তিশালী বেটার মত। এই সর্বনাশা বানে জমির ফসল পচিয়া গেল, তবু রহম প্রহ্লাদ ও আকাইয়ের সাহায্যে অর্ধেকের উপর জমিতে হাল দিয়া বীজ পুঁতিয়া ফেলিয়াছে। বাকি জমিটা আশ্বিনের শেষেই বরখন্দের চাষ। করিবে ঠিক করিয়াছে। এখন সে চাষ তাহার কি করিয়া হইবে? যে জমিটার ধান পোঁতা হইয়াছে তাহার ফসলই বা কেমন করিয়া ঘরে আনিবে?

একবার ইদুজ্জোহার সময় সে ইরসাদের কাছে একটা গল্প শুনিয়াছিল।–

তাহাদের এক মহাধার্মিক মুসলমান চাষী কোরবানি করিবার জন্য দুনিয়ার মধ্যে তাহার প্রিয়তম বস্তু কি ভাবিয়া দেখিয়া তাহার চাষের সবচেয়ে ভাল বলদটিকে কোরবানি করিয়াছিল। গল্পটি শুনিয়া তাহার বুক টনটন করিয়া উঠিতেছিল। বারবার মনে পড়িয়ছিল তাহার প্রদ ও আকাইকে। দুই-তিন দিন সে ভাল করিয়া ঘুমাইতে পারে নাই।

রহম গোয়ার লোক, বুদ্ধি তাহার তীক্ষ্ণ নয়, কিন্তু হৃদয়াবেগ তাহার অত্যন্ত প্রবল; একেবারে ছেলেমানুষের মত সে কাঁদিতেছিল। অন্যান্য মুসলমান চাষীরাও আসিয়াছিল। তাহারাও সত্য সত্যই দুঃখিত হইয়াছিল, আহা-হা এমন চমৎকার জানোয়ার দুইটা মরিয়া গেল। তাহারাও যে অন্য গ্রামের চাষীদের কাছে তাহাদের গ্রামের গরু বলিয়া অহঙ্কার করিত।

হিন্দুদের দুর্গাপূজার পর দশমীর দিন—গরু লইয়া একটা প্রতিযোগিতা হয়। ঘৌড়দৌড়ের মত গরুর দৌড়। ময়ূরাক্ষীর চরমভূমিতে আপন আপন গরু লইয়া গিয়া একটা জায়গা হইতে ছাড়িয়া দেয়, পিছনে প্রচণ্ড শব্দে ঢাকা বাজেচকিত হইয়া গরুগুলি ছুটিতে আরম্ভ করে। একটা নির্দিষ্ট সীমানা যে গরু সর্বাগ্রে পার হয়, সেই গরুই এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকৃত হয়, শ্ৰীহরির নূতন গরু জোড়াটা সেবার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করিয়াছিল। পরবৎসর তিনকড়ি আসিয়া রহমের প্রসাদ ও আকাইকে লইয়া গিয়াছিল। বলিয়াছিল—দে ভাই, আমাকে ধার দে। বেটা ছিরের দোকটা আমি একবার ভেঙে দি!

রহম আপত্তি করে নাই। সে মুসলমান, কিন্তু তাহার গরু দুইটা তো গরুই; হিন্দুও নয়–মুসলমানও নয়। তা ছাড়া শ্রীহরির দেমাক ভাঙিয়া তাহার আনন্দ তিনকড়ির চেয়ে কম হইবে না। সেবার রহমের প্রহাদ সকলকে হারাইয়া দিয়াছিল। প্রজাদের পর শ্ৰীহরির জোড়াটা পৌঁছিয়ছিল। তাহার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই রহমের আকাই।

ইসরাদ আসিয়া হাতে ধরিয়া রহমকে বলিল—উঠ! চাচা উঠ! কি করবে বল? মানুষের তো হাত নাই। নাও, এইবার আবার দেখেশুনে কিনবে এক জোড়া ভাল বলদ-বাছুরই আবার হবে! এ জোড়ার চেয়ে জিন্দা হবে—তুমি দেখিয়ো

রহম বলিলনা, না, বাপ! তা হবে না। আমার পেল্লাদ-আকাইয়ের মতনটি আর হবে না রে বাপ! যেটি যায় তেমনটি আর হয় না। ইরসাদ বাপ, আর আমার হবে না। আর বাপ ইরসাদ… জলভরা উগ্র চোখ দুটি তুলিয়া রহম বলিল-ই হাড়ে আর আমার সে হবে না বাপ, আমার আর কি আছে, কিসে হবে?

ইরসাদ বলিল–আমি তুমার টাকার যোগাড় করে দিব চাচা। তুমাকে আমি বাত দিচ্ছি। উঠ, তুমি উঠ।

ঠিক এই সময়েই আসিয়া হাজির হইল তিনকড়ি। প্রহ্লাদ ও আকাইয়ের মৃত্যুর খবর পাইয়া সে ছুটিয়া আসিয়াছে। রহম তাহাকে দেখিয়া কেঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল—তিনু-ভাই! দেখ ভাই দেখ, আমার কি সৰ্বনাশ হইছে দেখ।

তিনকড়ি নীরবে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতেছিল মরা বলদ দুইটাকে। নীরবেই। প্রদের দেহটার পাশে আসিয়া বসিল—কয়েকবার দেহটার উপর হাত বুলাইল; তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলওঃ, দুটো ঐরাবত রে! আঃ, ইন্দ্ৰপাত হয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গে তাহার চোখ দিয়া টপটপ করিয়া কয়েক ফোঁটা জল ঝরিয়া পড়িল।

চোখ মুছিয়া সে বলিল—মহাগেরামেও কটা গরুর ব্যামো হয়েছে শুনলাম। চাষীরা সকলে চকিত হইয়া উঠিল—মহাগেরাম?

হ্যাঁ। তিনকড়ি চিন্তিতভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল—ছেলে-মড়কের মত গোমড়কও লাগল দেখছি। সতীশ বাউরি আমাকে বললে—কি ব্যামো বুঝতেই পারে নাই।

ইরসাদ এবং অন্য চাষীরা মহাচিন্তিত হইয়া উঠিল।

তিনকড়ি বলিল—দেবু তার করেছে জেলাতে গরুর ডাক্তারের জন্য। হঁহ্যাঁ, ইরসাদ চাচা, তোমাকে দেবু যেতে বলেছে বিশেষ করে। কাল রেতে কলকাতা থেকে বিশুবাবু আরও সব কে কে এসেছে। বারবার করে তোমাকে যেতে বলে দিয়েছে।

হঠাৎ খানিকটা বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া আবার বলিল—মহাগেরামে দেখলাম, রমেন চাটুয্যে আর দৌলতের লোক ঘুরছে মুচি পাড়ায়। গিয়েছে বুঝলাম—পেল্লাদ-আকাইয়ের খাল (চামড়া) ছাড়াবার লেগে তাগিদ দিতে। একেই বলে—কারু সর্বনাশ, আর কারু পোমাস!

রহম একেবারে ক্ষেপিয়া উঠিল। আমি ভাগাড়ে দিব না। গেড়ে দিব আমি মাটিতে গেড়ে দিব। তারপর হঠাৎ ইরসাদের হাত ধরিয়া বলিল-ইরসাদ, ই তা হলি উদেরই কাম।

—কি? ইরসাদ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল।

–মুচিদিকে দিয়ে উরাই বিষ দিছে।

তিনকড়ি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলনা ভাই, বিষ-কাঁড় নয়, এ ব্যামোই বটে। মড়ক গো-মড়ক! তবে ওরা ভাগাড় জমা নিয়েছে—লাভ তো ওদের হবেই।

ইরসাদ বলিল—তা হলে আমি এখন একবার যাই চাচা। ঘরে ভাত চাপিয়ে এসেছি পুড়ে যাবে হয়ত। উ-বেলা একবার দেবু-ভাইয়ের কাছে থেকে ঘুরে আসতে হবে। বিশুবাবু এসেছে। বললে তিনু-কাকা। দেখে আসি একবার কি বলে।…।

ছমির শেখ নিতান্ত দরিদ্র; দিনমজুরি করিয়া খায়; দেহ তার দুর্বল; রোগপ্রবণ বলিয়া মজুরিও বড় মেলে না। ছমিরের দুঃসহ দুরবস্থা আজন্মের-ওটা তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে; মধ্যে মধ্যে ভিক্ষাও সে করে। বন্যার পর সাহায্য-সমিতি হওয়াতে বেচারা ইরসাদের অত্যন্ত অনুগত হইয়া পড়িয়াছে। ইরসাদের পিছনে খানিকটা আসিয়া সে ডাকিল—মিয়া-ভাই! ইরসাদ ফিরিয়া দেখিল ছমির।

—কি ছমির-ভাই?

–দেবু পণ্ডিতের কাছে যাবা? আমার লাগি, আর কবিলাটার লাগি—দুখানা কাপড় যদি বুলে দাও পুরানো হলিও চলবে মিয়া-ভাই।

ইরসাদ বলিল—আচ্ছা।

 

ইরসাদ বিশুকে বহুবার দেখিয়াছে। কিন্তু তেমন আলাপ কখনও হয় নাই। কঙ্কণার স্কুলে বিশু যখন ফার্স্ট ক্লাসে পড়িত সেই সময় ইরসাদ তাহার মামার বাড়ির মাইনর স্কুলের পড়া শেষ করিয়া আসিয়া ভর্তি হইয়াছিল। বয়সে তফাত ছিল না, ইরসাদই বয়সে বৎসর খানেকের বড়, কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস ও ফোর্থ ক্লাসের পার্থক্যটা স্কুলজীবনে এত বেশি যে কোনোদিন ভাল করিয়া আলাপ জানাবার সুযোগ হয় নাই। তারপর মক্তবের মৌলবীত্ব গ্রহণ করিয়া, নিজের ধর্ম লইয়া। সে বেশ একটু মাতিয়া উঠিয়াছিল; ফলে ইরসাদ ইদানীং বিশুর উপর বিরূপ হইয়া ওঠে। কারণ বিশু হিন্দুদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঘরের সন্তান। কিন্তু সম্প্রতি দেবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পরে সে বিরূপতা তাহার মুছিয়া যাইতেছে। দেবুর কাছে বিশ্বনাথের গল্প শুনিয়া সে আশ্চর্য হইয়া গিয়াছে। বিশুবাবুর এতটুকু গোঁড়ামি নাই। মুসলমান, খ্রিস্টান, এমনকি হিন্দুদের অস্পৃশ্য জাতির কাহাকেও ছুঁইয়া সে স্নান করে না।

দেবু বলিয়াছিল—তোমাকে দেখবামাত্র দুহাতে জড়িয়ে ধরবে, তুমি দেখো ইরসাদ-ভাই!

বিশুর চিঠিগুলা পড়িয়া তাহার খুব ভাল লাগিয়াছে। বন্যার পর অকস্মাৎ সাহায্য-সমিতির খবর দিয়া যেদিন সে টাকা পাঠাইল, সেদিন সে বিস্মিত হইয়া গেল। বিশ্বনাথের সঙ্গে তাহার প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকিলেও মনে হইল—এ এক নূতন ধরনের মানুষ। এমন ধরনের মানুষ কঙ্কণার বাবুদের ছেলেদের মধ্যে নাই, তাহার পরিচিত মিয়া-মোকাদিমদের ঘরেও সে দেখে নাই, তাহাদের নিজেদের মধ্যে তো থাকিবার কথাই নয়। মনে হইল বিশ্বনাথের সঙ্গে তাহাদের। অমিল হইবার কিছু নাই। দেবুকে লেখা চিঠির মধ্যে বিশ্বনাথের কথাবার্তার জন্য সে আগ্রহভরেই চলিয়াছিল। ভাবিতেছিল বিশ্বনাথ তাহাকে জড়াইয়া ধরিলে, সে তখন কি বলিবে?—বিশুবাবু? না ভাই সাহেব? না বিশু-ভাই? দেবু বলে বিশু-ভাই। কিন্তু প্রথমেই কি তাহার বিশু-ভাই বলা ঠিক হইবে?

দেবুর বাড়ির খানিকটা আগেই জগন ডাক্তারের ডাক্তারখানা। ডাক্তার একখানা চেয়ারে বসিয়া গম্ভীরভাবে বিড়ি টানিতেছিল। ইরসাদ একটু বিস্মিত হইল। ডাক্তারও সাহায্য-সমিতির একজন পাণ্ডা। বিশেষ করিয়া এই সর্বনাশা ম্যালেরিয়ার সময়ে সাহায্য-সমিতির নামে যেভাবে চিকিৎসা করিতেছে—তাহাতে তাহার সাহায্য একটা মোটা অঙ্কের টাকার চেয়ে কম নয়। আজ বিশু আসিয়াছে, অথচ সে এখানে বসিয়া রহিয়াছে। ইরসাদ বলিল-সেলাম গো ডাক্তার।

ডাক্তার বলিল–সেলাম।

হাসিয়া ইরসাদ বলিল—কি রকম, বসে রয়েছেন যে?

–কি করব? নাচ্‌ব?

ইরসাদ একটু আহত হইল। ব্যথিত বিস্ময়ে সে জগনের মুখের দিকে চাহিল। জগন, বলিল—কোথায় যাবে? দেবুর ওখানে বুঝি?

ইরসাদ নীরসকণ্ঠে বলিলহা। বিশ্বনাথ এসেছে শুনলাম। তাই যাব একবার মহাগেরামে।

—মহাগেরামে সে আসে নাই। জংশনের ডাকবাংলোয় আছে। দেবুও সেইখানে।

–জংশনে?

–হ্যাঁ—বলিয়া ডাক্তার আপন মনে বিড়ি টানিতে আরম্ভ করিল। আর কথা বলিল না।

আরও খানিকটা আগে—হরেন ঘোষালের বাড়ি। ঘোষাল উত্তেজিতভাবে বাড়ির সামনে ঘুরিতেছিল, আপন মনেই সংস্কৃত আওড়াইতেছিল—স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।

ইরসাদ আরও খানিকটা আশ্চর্য হইয়া গেল। ঘোষালও যায় নাই। সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল—ঘোষাল, কাণ্ডটা কি?

ঘোষাল লাফ দিয়া নিজের দাওয়ায় উঠিয়া বলিল—যাও, যাও, বিশুবাবু খানা সাজিয়ে রেখেছে—খেয়ে এস গিয়ে যাও! বলিয়াই সে ঘরে ঢুকিয়া দরজাটা দড়াম করিয়া বন্ধ করিয়া দিল।

আরও খানিকটা আগে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ, শ্ৰীহরি ঘোষের ঠাকুরবাড়ি। সেই ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দিরে বেশ একটি জনতা জমিয়া গিয়াছে। শ্ৰীহরি গম্ভীরভাবে পদচারণা করিতেছে। প্রাচীন। বয়সীরা উদাসভাবে বসিয়া আছে। কথা বলিতেছে শুধু ঘোষের কর্মচারী দাসজীকঙ্কণার বড়বাবু তো অজগরের মত ফুসছে—বুঝলেন কিনা? বলছে—আমি ছাড়ব না! মহামহোপাধ্যায়ই হোক আর পীরই হোক, এর বিহিত আমি করবই।-ইরসাদের আর সন্দেহ রহিল না। কোনো একটা গোলমাল হইয়াছে নিশ্চয়ই। সে ভাবিতেছিল—কোথায় যাইবে? ডাক্তার বলিল বিশ্বনাথ জংশনের ডাকবাংলোয় আছে। দেবু সেখানে আছে। জংশনে যাওয়াই বোধহয় ভাল, কিন্তু তার আগে সঠিক সংবাদ কাহার কাছে পাওয়া যায়?

হঠাৎ তাহার নজরে পড়িল দেবুর দাওয়ায় দাঁড়াইয়া আছে দুর্গা। ইরসাদ দ্রুতপদে আসিয়া দুর্গাকে জিজ্ঞাসা করিল-দুগা, দেবু-ভাই কোথায় বল দেখি?

দুর্গা ম্লানমুখে বলিল—মহাগেরামে–ঠাকুর মশায়ের বাড়ি গিয়েছে।

—মহাগেরামে? তবে যে ডাক্তার বললেজংশনে!

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দুর্গা বলিল—সেখান থেকে মহাগেরামে গিয়াছেঠাকুর মশায়ের সঙ্গে।

—কি ব্যাপার বল দেখি? সবাই দেখি হইচই করছে!

দুর্গার চোখে জল আসিয়া গেল। কাপড়ের অ্যাঁচলে চোখ মুছিয়া গলাটা পরিষ্কার করিয়া লইয়া দুর্গা বলিল—সে এক সর্বনেশে কাণ্ড শেখ মশায়! ঠাকুর মশায়ের নাতি নাকি পৈতে ফেলে দিয়েছে কাদের সঙ্গে একসঙ্গে খেয়েছে। ঠাকুর মশায় নাকি নিজের চোখে সব দেখেছেন। ঠাকুর মশায় নাকি থরথর করে কেঁপে মৌরাক্ষীর বালির উপর পড়ে গিয়েছিলেন। এ চাকলায় সবাই এই নিয়ে কলকল করছে জামাই-পণ্ডিত ঠাকুর মশায়কে ধরে তুলে তার বাড়ি নিয়ে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *