২০. আবার অ্যানেকদিন বাদে বাপের বাড়ি

আবার অ্যানেকদিন বাদে বাপের বাড়ি

তা অ্যানেকদিন বাদেই বটে! আগের মতুন আর আনন্দ হয় না। বাপজি মারা গেয়েছে বছর চারেক হলো! অসুখের খবর লয়, আমি একেবারে মরার খবরই পেয়েছেলম। কষ্ট কিছু হয় নাই তার। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল। ই রোগের নাম লিকিনি সন্ন্যাস রোগ। ওষুধ-পানি আর করতে হয় নাই, ডাক্তারও ডাকতে হয় নাই। খানিকক্ষণের মধ্যেই সব শ্যাষ।

তা সোংসারের ইতর-বিশেষ আর কি হবে? বৈমাত্র ভাইটি বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে। তিন বুনের একটোরও অবশ্যি বিয়ে হয় নাই। জানি, উসব আবার কত্তাকেই করতে হবে। বাপজির তেমন বয়েস। হয় নাই, আরও অনেকদিন বাঁচার বয়েস ছিল। আত্মীয়-কুটুম সবাই এয়েছিল। খবর পেয়ে আমি তো অ্যালমই। এক দিন থেকে আবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গ্যালম। সোংসারে অসুবিধা তেমন কিছু নাই। বাপজি ভালোই রেখে-থুয়ে গেয়েছে। ভাই যেদি উড়িয়ে-পুড়িয়ে না দিয়ে এট্টু দেখেশুনে রাখে, তাইলে সোংসার ভালোই চলবে।

যাই হোক, চার বছর আমার বাপের বাড়ি আসা হয় নাই। অ্যাকনকার বড় খোঁকা আর আমার সাথে আসতে চায় না। বড় হয়ে গেয়েছে, নিজের পড়া নিয়ে বেস্ত। মেয়ে আর চার বছরের খোঁকাটি নিয়ে আমি ইবার বাপের বাড়ি যেচি। ইবার অন্য রকম ভালো লাগছে। আগে মোষের গাড়ি করে ধু ধু তেপান্তর মাঠের ভেতর দিয়ে যেতম। অ্যাকন লতুন সড়ক হয়েছে, সেই সড়ক ধরেই গাড়ি যেচে। সড়ক লতুন বটে, তবে কাচা তো, বর্ষাকালে একহাঁটু কাদা হয়েছিল। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভেঙে এমন এঁটেল কাদা হয়েছিল যি মোযই কাদায় ডুবে যেত। অ্যাকন এই চোত-বোশেখে সেই কাদা শুকিয়ে একহাঁটু করে ধুলো হয়েছে। কি ধুলোই না উড়ছে, নিশ্বেস নিতে পারছি না।

বাপের বাড়ি যেতে এক কোশ দ্যাড় কোশ যেয়ে এই সড়ক ছেড়ে আবার আগের মতুন মাঠে মাঠে যেতে হবে। বাদশাহি পাকা সড়ক দিয়ে যাওয়া যায় বটে তবে সি খুব ঘুরপথ। সিদিক দিয়ে কে যাবে, মাঠে মাঠে যাওয়াই ভালো। গাঁয়ে যেতে শেষ এক কোশ আবার পাওয়া যায় পুরনো একটো পাকা সড়ক। এই সড়ক ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। আমাদের গাঁয়ের ভেতর দিয়ে গেয়েছে, কতো দূর গেয়েছে জানি না। এই সড়কে গাড়ি উঠলেই আমার মনে হয়, এই তো চলে এলম বাড়ি! মনে ত্যাকন খুব আনন্দ হয়। বাড়ির বউ আর বাড়ির মেয়ে বলে কথা! তফাত কতো! পাকা সড়কে উঠে আনন্দ ইবারও হছিল, যেদিও আগের মতুন লয়। এট্টু বাদে সি খুশিটো-ও মাটি হয়ে গেল য্যান পেছনের গরুর গাড়িটো পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সোমায় গাড়োয়ান চেঁচিয়ে আমাদের গাড়োয়ানকে বললে, মেলিটারি গাড়ি হলে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে মাঠে নেমে যেও কিন্তুক, নাইলে তোমার গাড়ি ভেঙেচুরে মেলিটারি গাড়ি বেরিয়ে যাবে। মরলে, না বাঁচলে, ফিরে চেয়ে দেখবে না। এই বলে নিজের গাড়ি সে তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।

আমি গাড়োয়ান ছোঁড়াটোকে বললম, কি র্যা, কিছু বুঝলি? সে দাঁত বার করে হেসে বললে, শুনেছেলম বটে ইদিকে কোথা মেলিটারি ঘাঁটি করেছে। দিন নাই, রাত নাই, উয়াদের গাড়ি যেচে আসছে। বলতে বলতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে কি দেখে বললে, উই দ্যাখো, মেলিটারি গাড়ি আসছে।

এই রাস্তায় কুনোদিন তেমন গাড়ি-ঘোড়া দেখি নাই। বাস অবশ্যি চালু হয়েছে হালে। সকালে দোপরে সাঁঝবেলায় এই মাত্তর তিনটে বাস। রাস্তা সারাদিনই সুনসান থাকে। গাড়োয়ান ছোঁড়ার কথা শুনে আমি কি একটো বলতে গেলম, আর তখুনি সেই মেলিটারি গাড়িটো এসে পড়ল। ধুলোর মদ্যে ছিল বলে এতক্ষণ দেখতে পাই নাই, অ্যাকন দেখলম, একটো ছোেট গাড়ি। পরে নাম জেনেছেলম এই গাড়িগুলিনকে জিপগাড়ি বলে। খাকিরঙ একটু দূরে গেলেই আর দেখতে পাওয়া যায় না। দেখতে দেখতে গাড়িটো আমাদের গাড়ির কাছে এসেই বাঁশি দিলে। সি বাঁশির আওয়াজ যেন কেমন, গা-টো রি রি করে উঠল, হাঁড়ি চাচার আওয়াজ যেমন হয় তেমনি। বাঁশি একবার দিলে, দুবার দিলে–যেন তর সইছে না। ত্যাতোক্ষণে গাড়োয়ান ছোঁড়া ভয়ের চোটে মোষদুটোকে ডাকিয়ে হুড়মুড় করে গাড়ি নিয়ে মাঠের মদ্যে নেমে গেয়েছে। যেমন করে গেল আর একটু হলেই গাড়ি উল্টিয়ে যেত। উদিকে জিপগাড়ি রিরিরিরি করে বাঁশি দিতে দিতে আমাদের পেরিয়ে গেল। এক লহমার মদ্যে দেখলম, দুজনা না তিনজনা গোরা সোলজার বসে বসে হি হি করে হাসছে। মেয়েমানুষ দেখছে, তা আবার বেপদে পড়া মেয়েমানুষ, হাসবেই তো। বাঁদরের পোঁদের মতুন লাল মুখ, গোরো ধপধপে বসে আছে এক একটো যেন পৰ্বত!

গাঁ যেতে এই এক কোশ পথটো আর যেন ফুরুইতে চায় না। ঐ গাড়িগুনো একটার পর একটো আসছেই। সয়রান থেকে আমাদের মোষের গাড়ি মাঠে নামাইতে সোমায় পাওয়াও যেচে না। মোযদুটো ভয় পেয়ে ছুটে নামতে যেয়ে গাড়ি উল্টিয়ে যাওয়ায় মতুন হচে আর রিরি করে বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে জিপগাড়ি বেরিয়ে যেচে। একটো পেরুইচে তো আর একটো আসছে–কারাল নাই। পেত্যেক গাড়িতে। একজন দুজনা করে সেই হুমদোমুখো গোরা সায়েব বসে আছে। কেউ হাসছে, কেউ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে, কেউ আমাদের বেপদ দেখে ভারি মজা পেয়ে খারাপ অঙ্গভঙ্গি করছে। এইরকম করে কতো গাড়ি যি গেল, কতোবার যি মাঠে আমাদের গাড়ি নামাতে হলো তা আর হিশেব নাই। এই এক কোশ রাস্তা মনে হতে লাগল আর কুনোদিন শেষ হবে না। পেছু দিকে দূরে গাড়ি দেখলেই তরাস হতে লাগল–এই ছোঁড়া, গাড়ি নামা র্যা বলতে বলতে গাড়ি চলে আসছে বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে। কাছে এসেও যি জোরে আসছিল তা একটুও কমাইছে না। বোঝাই যেচে, আমাদের গাড়ি রাস্তা থেকে সরাইতে না পারলে সব ভেঙেচুরে ওপর দিয়েই চলে যাবে, ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা মরে থাকলেও ওরা একবার ফিরে তাকাবে না। পরের গাড়িটো হয়তো আমাদের লাশের ওপর দিয়েই চালিয়ে দেবে। অ্যাকন দেখছি, শুধু গাড়োয়ানটোই লয়, দূরে গাড়ি দেখলেই আমার ছেলেমেয়েদুটিও ভয়ে নীল হয়ে যেচে। একটো পার হচে, নিশ্বেস ফেলছি, আবার একটো আসছে। সি যি কি বিভীষিকা হয়েছিল, কুনোদিন ভুলব না।

শ্যাষ পয্যন্ত গাঁয়ে ঢোকার বাগদিপাড়ার ঢালটো এলে জানে যেন পানি এল। মনে করি নাই যি ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি পৌছুইতে পারব। ছোট ভাইটি বাড়িতেই ছিল, তাকে ইসব কথা বলতেই বললে, অ, তোমরা জানো না বটে। তোমাদের উদিকে এখনো তো ইয়ারা যায় নাই, জানবে কি করে? ইদিকে খুব উপদ্রব হচে। তিন কোশ দূরে সয়রানের পাশেই উােের বেরাট ড্যাঙায় মেলিটারিরা অ্যারোডম করেছে। ছারখার করে দিলে এলেকা। গরু-ছাগল-মুরগি এন্তার খেয়ে ছয়লাপ করে দিচে। এই হুজুগে কতো ব্যাবসাই করছে গাঁয়ের লোকে, তা করুক। কিন্তুক শালারা জানে বাঁচতে দেবে বলে তো মনে হচে না। আজ তোমাদের গাড়ি ভেঙেচুরে দেয় নাই ভাগ্য ভালো। পিতিদিন রাস্তায় কতো বেদম যি উয়ারা ঘটাইচে, কি বলব! গরু-মোষের গাড়ি একটো-দুটো তো পত্যেকদিন ভাঙছেই, কত শেয়াল-কুকুর-ছাগলগরু-মোষ পেত্যেকদিন চাপা পড়ছে। শালাদের জানে দুখ-দরদ বলে কিছু নাই—ছামনে রাস্তায় কিছু যি দেখলি, এট্টু আস্তে চালা–তা লয়, একটুও কমাবে না। গাড়ি নিয়ে মানুষ সরতে পারলে ভালো, নাইলে সোজা এসে মেরে দেবে। তাইলে বলি শোনো, সিদিন মারলে একটো গাড়িকে, গাড়ি যেয়ে পড়ল রাস্তার পাশে গাবায়। একটো চাকা খুলে গড়িয়ে কুনদিকে চলে গেল, যি মুনিষটো চালাইছিল সে-ও ছিটকে কোথা যেয়ে পড়ল। ইদিকে ডাইনের হেলে গরুটো, যেটো গাড়ি টানছিল, তার একটা পা ভেঙে সি ত্যাকন গাবায় পড়ে আছে, তার গলায় লেগেছে গলান্দির দড়ির টুসি। জোয়াল উঠেছে আসমানে, কিছুতেই গলান্দির দড়িটো আমি আলগা করতে পারলম না–গরুটোর চোখের দিষ্টি কি রক্ত বেরিয়ে এল গো চোখ দিয়ে! হাতে ছুরিকাটারি কিছু নাই, দড়িটো কেটে দিতে পারলম না। গরুটো ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে শ্যাষে মরে গেল। জ্ঞান হয়ে মুনিষটোর কি কঁদন!

কথা শুনে ছোট বুনটি বললে, খালি উ কথা লয়। উয়ারা লিকিনি অ্যাকন গাঁয়ে-ঘরে ঢুকছে, যা মনে হচে তা-ই টেনে নিয়ে চলে যেচে। সিদিন তোমাদের বললম না–গা ধোব বলে ঘাটে গেয়েছি, গা ধোয়া হয়ে গেয়েছে, গামছাটো নিংডুতে নিংডুতে উঠে আসছি—এমন সোমায় পেছু দিকে শিস দেবার আওয়াজ শুনে যেই ফিরে তাকিয়েছি, দেখি এই একজনা লালমুখো সায়েব পুকুরের ওপারে দাঁড়িয়ে একটো ছবি তোলার কালো বাসো আমার দিকে তাক করে আছে। তাই দেখে আমি ছুটেমুটে বাড়ি এসে মাকে সব বললম। শুনে ভাই বললে, কই আমি তো শুনি নাই, খবরদার আর ঘাটে যাবি না।

তাইলে ইবার কেরমে কেরমে যুদ্বু এসে বাড়ির মদ্যে ঢুকে যেচে। পেলেন তো অনেকদিন থেকেই দেখছি। পাখির মতুন ঝাকে ঝুঁকে আসছে, যেচে। পেথম পেথম হাঁ করে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখতম। ত্যাকন আসতও অনেক কম। একটো-দুটো। গুড়গুড় করে আওয়াজ হতো, ম্যাঘের আওয়াজের মতুনই কিন্তুক ম্যাঘ তো লয়, আকাশে ম্যাঘের বংশ নাই, মাঘ ডাকার আওয়াজ আসবে কোতা থেকে! তাপর দেখতম, আসমানের এক কোণ দিয়ে পাখির মতো উড়ে এল পেলেন। রোদে ঝকঝক করছে, তাকিয়ে দেখতে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যেচে। পাখির মতুনই ড্যানা আছে বটে কিন্তুক সি ড্যানা থির, পেথম পেথম দেখে ভারি অবাক লেগেছিল। য্যাতো এগিয়ে আসছে, গুড়গুড় আওয়াজ ত্যাতোই বাড়ছে। দেখতে দেখতে মাথার ওপর দিয়ে কোনাকুনি আকাশ পেরিয়ে মিলিয়ে গেল। কখনো একটো, কখনো দুটো। দেখতে ওইটুকুনি লাগছে বটে, শুনেছি, আসলে ছোটখাটো একটো বাড়ির মতুন। কান-ফাটানো আওয়াজ করতে করতে মাথার একদম ওপর দিয়ে যাবার সোমায় দেখেছি, সত্যি অত ছোট তো লয়, বেশ বড়।

তা এই পেলেনও দেখছি অ্যাকন অ্যানেক আসছে আর য্যাখনত্যাখন আসছে। আজকাল আর খেয়ালও হয় না। একসাথে আট-দশটোও আসছে, অত খেয়াল করবে কে? দিনের মধ্যে কতোবার যি আসছে যেচে, কতরকম করে আসছে, একটোর পেছনে দুটো, পাশাপাশি চারটো, ছামনে তিনটো, পেছনে তিনটো, ডিগবাজি মারছে–নিজের মনে কাজ করছি, একবার একবার তাকিয়ে দেখছি, কি দেখছি তা-ও খেয়াল হচে না। অ্যাকন মনে হচে, তাই তো, যুদ্বুর গাড়িঘোড়ায় দ্যাশ যি ভরে গেল। আজ রাস্তায় য্যাতো গাড়ি দেখেছি, মনে হচে, তাইলে সারা দ্যাশে না জানি কতো গাড়ি এয়েছে আর তাদের সাথে কতো সায়েব, কতো গোরা সেপাই ই দ্যাশে এয়েছে! যুদ্ধ এখন নাই কিন্তুক দ্যাশ ভরে গেয়েছে যুক্ষুর সরঞ্জামে। আমরা গাঁয়েগঞ্জে অত দেখতে পেচি না, শহর-নগর তাইলে নিচ্চয় ভত্তি হয়ে গেয়েছে। হঠাৎ ভয়ে আমার বুক হিম হয়ে গেল। এত সাজ-সরঞ্জাম, এত আয়োজন তবু যুন্ধুর তো কিছুই নাই অ্যাকন। তাইলে য্যাকন যুদ্ধ দ্যাশে আসবে ত্যাকন কি হবে?

আমার খোঁকা দেখছি উত্তর-দুয়োরি ঘরের উসারায় বসে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গুড়গুড় আওয়াজ হচে দখিন-পশ্চিম কোণে। দেখতে দেখতে আট-দশটা পেলেন এগিয়ে এল। কতো ভঙ্গি করছে, দুটো এগিয়ে আসছে, আবার পিছিয়ে যেচে আর খালি ডিগবাজি দিচে, ইসব কি খেলা? খোঁকা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি মনে হলো, ছেলেটোকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলম।

সব যেন কেমন কেমন লাগছে। কবছর আসি নাই ঠিক, তা বলে কিছুই তো বদলায় নাই। বুন তিনটো বড় হয়ে গেয়েছে, তিনজনাই সোন্দরী একজনা যেন রাজরানী হবার লেগেই জন্মাইচে, তার রূপ দেখে ভয় লাগে। আর একজনার মাজা মাজা রঙ, টানা টানা চোখ, কোমর পয্যন্ত লম্বা চুল আর ছোটটোর দিকে তাকাইলে চোখ বেঁধে যায়–পাড়াগাঁয়ে এত রূপ–কি করে যে কি হবে! আজকাল আবার মেলিটারিরা সব গাঁয়ে ঢুকতে শুরু করেছে।

রাতটো ক্যানে যি এতো অসোয়াস্তিতে কাটল জানি না। নতুন মায়ের সাথে পিতিবার কতো কথা হয়, ইবার কথা খালি কেটে কেটে যেচে। বড় হয়েছে বলে কি না জানি না, বুনরাও যেন কি কথা বলবে খুঁজে পেচে না। মনে হলো, অনেকদিন পরে আসা হয়েছে তো, তাই এরকম হচে, দু-একদিন বাদে আবার সব আগের মতুন হয়ে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি, সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, বেলা অনেকটাই হয়েছে। অন্য অন্য বার আমি বাড়ি এসে পৌঁছুলেই গাঁয়ের মেয়ে-পুরুষ অনেকেই বাড়িতে দেখা করতে আসে, কতো গপ্পো-গুজব করে। ইবার আর তেমন কেউ আসে নাই। তাই আমি ভাবলম, হাত-মুখ ধুয়ে আমি বরঞ্চ একবার পাড়াটো ঘুরে আসি। গাঁয়েরই মেয়ে তো আমি!

এইবার যাব, এইবার যাব করছি, এমন সোমায় খবর এল, মীরপাড়ার ওলি মামুর ভোরবেলা থেকে ভেদবমি অরম্ব হয়েছে। শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্বপনেও ভাবি নাই, ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি আসব আর এই মহামারী রোগ ই-গাঁয়ে অরম্ব হয়ে যাবে। দু-বছর তিন বছর বাদে বাদে ই রোগদুটি ভালো কথায় বলে কলেরা আর বসন্ত–লোকে এমনি বলে পেট-নামা নামুনে আর মা-শেতলার দয়া–এই রোগটি আসবেই, কেউ ঠেকাইতে পারবে না। আর যি বছর আসবে গাঁ-কে গা একদম উজাড় হয়ে যাবে। গেল দু-তিন বছর ক্যানে জানি না ভুলে ছিল আর অ্যাকন অরম্ব হবি তো হ আমার বাপের বাড়ির গাঁয়েই শুরু হয়ে গেল। এই সকালবেলাতেই ওলি মামুর খবর প্যালম। সোমায় তো বেশি নেবে না, হয়তো বৈকালবেলাতেই শুনব ওলি মামু আর নাই। শুনে অবদি নিজের কথা ভাবছি না কিন্তুক ছেলেমেয়ে কারুর যেদি কিছু হয়, তাইলে কত্তার কাছে কি জবাব দেব? এই জায়গায় কত্তার কাছে কুনো মাপ নাই। কেন তুমি সাথে সাথে ফিরে এলে না? যা হবে আমার চোখের সামনে হবে। আর কুনো কথা সি শুনবে না। মাকে বললম, ও মা, আমার যি খুব খিদিবিদি লাগছে। এই কথা শোনবার পর থেকে আমি যি কিছুতেই থির থাকতে পারছি না। মায়ের বুদ্ধি যি কি ঠান্ডা, আমার কথা শুনে বললে, মা, ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি কালই বাড়ি ফিরে যাও। যার ধন তার কাছে যাও। এই কথা আমিও ভাবছি। দিন ভালো হলে আবার আসবে। তোমার ভাইকে বলছি, কালই দিয়ে আসুক তোমাদের।

চলে যাব শুনে বুনরা কাঁদতে লাগল। সারাবছর তারা বসে থাকে। কখনো বছরের পর বছর এন্তেজার করে থাকে কবে তাদের বুনপো-বুঝি আসবে। তাদের নিয়ে কি কি করবে তারা খুঁজে পায় না। আর ইবারে আজ এসে কাল তাদের যেতে হবে!

বৈকালের মদ্যেই খবর পাওয়া গেল, মীরপাড়ায় আরও দু-তিনজনার পেট নেমেছে। রোগটি ওলাউটোই, আর কিছু নয়। মুন্সিপাড়াতেও একজনার শুরু হয়েছে। যে ইসব খবর আনতে গেয়েছিল সে আমার এক বুন। কথায় কথায় বলেছে, মাহামারীর খবর পেয়ে বড় বুবু ছেলেমেয়ে নিয়ে কালই আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবে। তাই শুনে সি পাড়ার এক বাঁজা-বউ বলেছে, অ, ওলাউটোর কথা শুনে পালাইচে তোর বুন! ছেলেপিলে যেন আর লোকের নাই! যোম যেদি একবার চেনে, যেখানেই যাও, পেচু পেচু যেয়ে ধরবে।

ছি ছি, এমন কথা কেউ বলে! কথাটো শুনে কি দুঃখ যি হলো! জান আর জানে থাকছে না! দুনিয়ার সব্বারই বুকের ধন ভালো থাকুক, ছি ছি, ই কি কথা! আমার ছোট বুনটো ভারি রাগী, ভারি তেজি। সে বললে, একুনি সে মুন্সিপাড়ায় যাবে ঝগড়া করতে। বহু কষ্টে তাকে সামলালম।

তিমি-সাঁঝবেলাতেই খবর পাওয়া গেল, ওলি মামু আর নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *