১.৩ পঞ্চায়েত কাণ্ড

পঞ্চায়েত কাণ্ড

দুখিয়ার মায়ের খেদ

অনেকে দুখিয়ার মা না বলে, বলে বালালকা-আদমী [১২৭]। কথাটা খুবই ভাল লাগে দুখিয়ার মার, বিশেষ করে যখনই আপিসের উর্দিপাগড়ি পরা বাবুলালের চেহারা তার মনে আসে। এমন মানায় এ পোশাকে বাবুলালকে। বুধনী ভাবে পাড়ার সকলে হিংসেয় ফেটে পড়ছে। দুখিয়ার মাকে রোজগার করতে হয় না বলে সত্যিই পাড়ার মেয়েরা তাকে হিংসে করে। এত লোকের বিষের নজর এড়িয়ে দুখিয়াটা বাঁচলে হয়। বড় হলে সেও আবার উর্দিপাগড়ি পরে, বাবার জায়গায় কাজ করবে। ও কাজ কি সোজা ইজ্জৎ! দুখিয়ার মা বাবুলালর কাছে শুনেছে যে চেরমেনসাহেবের ঘরে,– না না চেরমেনসাহেব বললে আবার আজকাল বাবুলাল চটে, আজকাল বলতে হবে রায়বাহাদুরের ঘণ্টায় ঘণ্টায় নাম বদলালে আর মনে না থাকার দোষ কী?- যে রায়বাহাদুরের ঘরে ঠিকেদার সাহেবরা, গুরুজীরা পর্যন্ত ঢুকতে পায় না, সেখানে বাবুলালের অবারিত দ্বার। গর্বে দুখিয়ার মার বুক ফুলে ওঠে। আজ সে আপিস ফেরত বাবুলালকে ভাল করে খাওয়াবে। তাই সে তাল গুলতে বসে। তার ভিতর গুড় আর নুনের জল দিয়ে সে বরফি করবে। রায়বাহাদুরের ডেরাইভারই কত বড় লোক, না হলে কি আর তার বৌয়ের ছেলে হাওয়ার সময়, বাবুলাল চাপরাসী রাত দুপুরে চামারনী ডাকতে ছোটে। ডেরাইভারসাহেবই তো ধনুয়া মহতোর সমান অকতিয়ারের [১২৮] লোক। সেই ডেরাইভারসাহেবকেও চাকর রাখে রায়বাহুদুর। এত বড় লোকটিকে বড় দেখতে ইচ্ছা করে একবার দুখিয়ার মার। কত কথা সে শুনেছে তাঁর সম্বন্ধে বাবুলালের কাছ থেকে। যেই ঘণ্টিতে হাত দেবে অমনি বাবুলাল চাপরাসীকে সঙ্গে সঙ্গে বলতে হবে হজৌর। আজব দুনিয়াটা। বড়র উপরও বড় আছে। রায়বাহাদুরের উপরেও আছে দারোগা, কলস্টর…ঢোঁড়াইয়ের বাপের কথা হঠাৎ বুধনীর মনে পড়ে- সেই ঢোঁড়াই যেবার হয়-হয় সেইবার কলস্টর দেখে এসেছিল। বাবুলালের মতো এ ইজ্জৎদার আদমী [১২৯] ছিল না বটে, কিন্তু ছিল বড় ভালমানুষ।…এক রত্তি ঢোঁড়াইকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে সুর করে গাইত বকড়াহাট্টা; বরদ বাট্টা সো যা পাঠঠা…। সে আর আজ কদিনের কথা। তবু সে সব ঝাপসা মনে পড়ার দাগগুলো পর্যন্ত এর কম মুছে গিয়াছে। অনুতাপ নয়, তবুও কোথায় যেন একটু কী খচ খচ করে বেঁধে।…।

খাবারের লোভে দু-একজন করে দুখিয়ার বন্ধুরা এসে জড়ো হয়। সকলেই এক একটা তালের আঁটি চুষছে। কার তালের দাড়ি কত বড় তাই নিয়ে ঝগড়া জমে উঠেছে, কিন্তু নজর সকলেরই রয়েছে দুখিয়ার মার দিকে।

নে দুখিয়া। নে নে তোরা সকলে আয়; একটু একটু নে। যা, এখন ভাগ জলদি!

এক দণ্ড নিশ্চিন্দি নেই এদের জ্বালায়। পাড়াসুদ্ধ শুয়ারের পালের মতো ছেলেপিলেকে দুখিয়ার মা তালের মিঠাই খাওয়াল। কিন্তু ঢোঁড়াই! ঢোঁড়াইয়ের কথা তার আজ বড্ড বেশি করে মনে পড়ছে অনেক দিনের পর। বহুদিন তার খোঁজখবরও করা হয়নি। পথে ঘাটে মধ্যে মধ্যে দেখা হয়, ছেঁড়া পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। যাক ছোঁড়া ভাল থাকলেই হল গোঁসাইথানের মাটির কল্যাণে আর বাওয়ার আশীর্বাদে ছেলেটা বেঁচে বর্তে থাকলেই হল। সে আর ও ছেলের কাছ থেকে কী চায়।

অনেকদিন ছেলেটাকে কিছু খাওয়ানো হয়নি। বাড়িতে ডেকে পাঠালেও আসবে কি না কে জানে। দুখিয়ার মা একখানা কচুপাতায় করে খানকয়েক তালের বরফি নিয়ে গোসাইথানে যাবে বলে বেরোয়।…সে ছোঁড়া কি আর এখানে গোঁসাইথানে আছে। হয়তো মুখপোড়া ধাঙড় ছেলেগুলোর সঙ্গে পাক্কীতে, বিসরিয়া থেকে যে নতুন লৌরী [১৩০] খুলছে, তাই দেখতে গিয়েছে। লৌরী আসবার সময় ওরা রাস্তার ধুলো উড়িয়ে, হয় রাস্তার উপর গাছের ডাল ফেলে পালিয়ে আসে। একদিন ধরবে তালে মহলদার রোড সরকার তো মজা টের পাইয়ে দেবে।…ঢোঁড়াই এখন কত বড় হয়ে উঠেছে। কেমন সুন্দর স্বাস্থ্য।…ওই তাল মহলদার, ডিস্টিবোডের রোড সরকার, যার নাম করে বাবুলাল পাক্করী পাকা অংশটির উপর দিয়ে গরুর গাড়ি যেতে দেখলে, গাড়োয়ানের কাছ থেকে পয়সা আদায় করে; তারপর দুজনে আধাআধি ভাগ করে নেয়,-সেই তালে মহলদার একদিন ঢোঁড়াইকে দেখে ধাঙড়দের ছেলে বলে ভেবেছিল, ভুল ধরিয়ে দিলে বলেছিল যে, এমন পাঠঠা যোয়ান তো তাৎমার ছেলে হয় না। লোকটা অন্ধ না-কি! ঢোঁড়াইয়ের রঙ ধাঙড়দের মতো কালো নাকি? সামুয়রের মতো ফর্সা না হলেও আকার মতো কালোও তো না। মকসুদনবাবুর রঙ্গের সঙ্গে ওর রঙ্গের মিল থাকতেও পারে; বলা যায় না…ঐ তো বাগভেরেণ্ডা গাছের ফাঁক দিয়ে বৌকা বাওয়ার কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে গোঁসইথানে।…আ মর, মহতোর ছাগল কিনা, তাই সাধারণ লোক দেখে আর পথ থেকে সরবার নাম নেই! হট! হট!..

আরে কোথায় চললি দুখিয়ার মা?

এই একটু ঐদিক কাজ আছে।…এতদিনের অনভ্যাসের পর ঢোঁড়াইয়ের কাছে যাচ্ছি বলতে সংকোচ লাগে লোকের কাছে। …আজ আর কেউ তাকে ঢোঁড়াইয়ের মা বলে ডাকে না। অথচ ঢোঁড়াই হচ্ছে প্রথম ছেলে;-তার দাবিই সবার উপর। সেই প্রথম ছেলে হওয়ার আগের ভয়, আনন্দ, বুড়ো নুনুলাল মহতোর বৌয়ের আদর যত্ন বকুনি, কত নতুন অনুভূতি আকাঙ্খা মেশানো- ঢোঁড়াইয়ের পৃথিবীতে আসার সঙ্গে। সব সেই পুরনো অস্পষ্ট স্মৃতিগুলোর হালকা ছোঁয়াচ লাগছে মনে।…না ঐ তো দেখা যাচ্ছে ঢোঁড়াইকে, বাওয়ার লোটা মাজছে। আজ ভাগ্যি ভাল। বাওয়া আজ তাকে দুপুরে বেরুতে দেয়নি দেখছি।…

 কিন্তু এ ভিক্ষে করে কতকাল চলবে?…

এই বাওয়ার দর্শন করতে এলাম- বলে দুখিয়ার মা গোঁসাইথানের মাটির বেদীটিকে প্রণাম করে। তারপর বাওয়াকে বলে, পরণাম। বাওয়া আগেই আড় চোখে তার হাতের কচুপাতার মোড়কটা দেখে নিয়েছে। দুখিয়ার মা যে ঢোঁড়াইয়ের কাছে এসেছে সে কথা প্রকাশ করতে চায় না। ঢোঁড়াইও তার দিকে না তাকিয়ে এক-মনে নিজের কাজ করে যায়। লোটা মাজে, বাওয়ার ত্রিশূল, চিমটে ছাই দিয়ে ঘসে ঝকঝকে পরিষ্কার করে রাখে। তার কাজের আর শেষ নেই। একবার যখন ধরা পড়েছে, এখন গাছতলাটা ঝাঁট দেওয়ার আগে আর বাওয়ার হাত থেকে নিস্তার নেই। তারপর আবার কোন কাজ বাওয়ার মনে পড়বে ঠিক নেই। দুখিয়ার মা-টা আবার এই অসময়ে কোথা থেকে এসে জমিয়ে বসল! কী গল্পই করতে পারে এই মেয়ে জাতটা। ধনুয়া মহতোর একদিনের কথা ঢোঁড়াইয়ের বেশ মনে আছে। ধনুয়া তার স্ত্রীকে বকছিল, কাজের মধ্যে তো ঘাস ছেলা আর উনুনের পাশে বসে লবড় লবড় বকা [১৩১]। চাবুকের উপর রাখতে পারলে তবে তোদের জাতের চাল বেগড়োয় না। মহতোগিন্নি গিয়েছিল মহতোর দিকে এগিয়ে-রামজী মোচটা দিয়েছেন বলে যা ইচ্ছে তাই বলে যাবে নাকি? চাবুক! মরদ চাবুক দেখাতে এসেছ!…এসো না দেখি।…ধনুয়া মহতোর সেইদিনের কথা ঢোঁড়াইয়ের খুব মনে ধরেছিল। মেয়েজাতটাই এইরকম! কী রকম তা সে এখনও ঠিক বুঝতে পারে না, তবে খারাপ নিশ্চয়ই। আর বাবুলালের পরিবারের উপর সব তাৎমারাই বিরক্ত। দুখিয়ার মার নাকি দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না-চাপরাসীর বৌ বলে। সে ঘাস বিক্রি করে না, কোনো রোজগার করে না, পারতপক্ষে বাবুলাল তাকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেয় না; বাবুভাইয়াদের বাড়ির মেয়েদের মতো সে তার নিজের স্ত্রীকে রাখতে চায়। যখন তখন দুখিয়ার মাকে চটে মারতে যায়- তোর তাৎমানী থাকাই ভাল- তোর আবার চাপরাসীর স্ত্রী হওয়ার শখ কেন। মাথা কাটা যায় নাকি তার, দুখিয়ার মার বেহায়াপনায়…

ঢোঁড়াই  গাছতলা ঝাঁট দেওয়া আরম্ভ করে। রোজ ঝাঁট দেওয়া হয় তবু এত ময়লা কোথা থেকে যে আসে সে ভেবে পায় না। পাড়ার যত ছাগলের আড্ডা, বর্ষাকালে এই গাছতলায়!

চেরমেন সাহেবের ডেরাইভারের সামনে বাবুলাল চাপরাসী চুপচাপ চোরের মতো থাকে, আর বাবুলালের স্ত্রী, গোঁসাইথানে প্রণাম করতে এসেও চুপ করে থাকতে পারে না। গোঁসাই উপর থেকে সব দেখছেন।…হঠাৎ দুখিয়ার মার গলা কানে আসে…

..আপনারা সাধুসন্ন্যাসী মানুষ; আপনারা ভিক্ষে করেন সে এক কথা; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাও কি সারা জীবন ভিক্ষে করে জীবন কাটাবে? ও ছেলে কি কোনোদিন আপনার চেলা হতে পারবে? কিরিস্তান ধাঙড়দের সঙ্গে আলাপ, না আছে কথার ঢং [১৩২], না আছে মনের ঠিকানা, উনি আবার হবেন সাধুবাবা। অন্য ঘরের ছেলে হলে এতদিন একটা রোজগারের ধান্ধা দেখে নিত। বয়স তো কম হল না। ওর বয়সী ঘোতাই, গুদর তো ঘরামির কাজে বেরুনো আরম্ভ করেছে। আপনি বাওয়া ছেলেটার মাথা খেলেন…

ঢোঁড়াইয়ের কান খাড়া হয়ে উঠেছে। বাওয়ার মুখের উপর এতবড় কথা!…

বলেন তো চাপরাসী সাহেবকে বলে ঢোঁড়াইকে ডিস্টিবোডের পাংখা টানার কাজে বহাল করিয়ে দিতে পারি! বছরে চারমাস কাজ। আট টাকা করে পাবে। তার মধ্যে থেকে দু-টাকা করে বহালীর [১৩৩] জন্য চাপরাসী সাহেবকে দিতে হবে; বাকি টাকা তোমার হাতে এনে দেবে। বছরের মধ্যে বাকি আট মাস, কেরানীবাবুর বাড়ির কাজ করবে। তাঁর ছেলেমেয়ে রাখবে। ওজর না থেকে তো বাওয়া বলুন! কত লোক এ নিয়ে চাপরাসী সাহেবের কাছে ঘোরাঘুরি করচে।…

ঢোঁড়াই লক্ষ্য করে যে বাওয়ার মুখচোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। ঢোঁড়াই আর বাওয়ার চোখচোখি হয়ে যায়। দুজনেরই স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে। প্রস্তাবটি কারও মনঃপূত নয়। বাওয়া ভাবে ঢোঁড়াই করতে যাবে চাকরি! পরের ছেলেকে আপন করে নিলাম কিসের জন্য? ওর জন্য এত কষ্ট সইলাম কেন?

আর ঢোঁড়াই ভাবে শেষকালে বাবুলালের খোসামোদ করে দিন কাটাতে হবে; তার দয়ার রোজগার! এও রামজী কপালে লিখেছেন? বাওয়ার সেবা করে, বেশ তো তার দিন কেটে যাচ্ছে! দুখিয়ার মাটা বুকের উপর মুগের দানা রগড়াচ্চে১৩৪ এর জন্যে। সকলেই তাকে ভিক্ষের কথা নিয়ে খোঁচা দেয়। বাবুলালের পরিবারেরও এই কথা নিয়ে দুর্ভাবনার শেষ নেই। অন্তরের থেকে সকলেই তাদের ভিখিরি ছাড়া আর অন্য কিছু মনে করে না।

বাওয়া ভাবে, দরদ! এতদিনে মায়ের দরদ উছলে উঠল!

সে আংটা লাগানো ত্রিশূলটা দুখিয়ার মার সম্মুখে মাটিতে তিনবার ঠোকে; তারপর তিনবার মাথা নাড়ে-না, না, না।

অপমানে দুখিয়ার মার চোখে জল এসে যায়। সে কচুপাতায় মোড়া বরফি ফেলে উঠে পড়ে। কার জন্যে এত ভেবে মরি!

কার জন্য তালের বরফিগুলো এনেছিল, সে কথা আর বলা হয় না।

সে চলে গেলে বাওয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে ঢোঁড়াইয়ের দিকে তাকায়। ঢোঁড়াই হঠাৎ কচুপাতার ঠোঙাটি তুলে নিয়ে দূরে ঝোঁপের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঝোঁপের নিচের ভাদ্রের ভরা নালায়, একটা ব্যাং লাফিয়ে পড়ে।

ভিখ দিতে এসেছেন, ভিখ! তোর দেওয়া ভিখ যে খায়, তার বাপের ঠিক নেই। ডিস্টিবোডের পয়সা দেখাতে এসেছেন। অমন খাবারে আমি…

তারপর ঢোঁড়াই আর বাওয়া চুপ করে মুখোমুখি হয়ে বসে থাকে! একই বেদনায় দুটো মন মিলে এক হয়ে যায়।

[১২৭. সস্থানীয় ভাষায় আদমী মানে স্ত্রী। মানুষ অর্থেও প্রচলিত। ১২৮. অধিকার। ১২৯- সম্মানিত লোক। ১৩০- লরী- মোটরবাস। ১৩১. বাজে বকা। ১৩২ শ্ৰী; আদবকায়দা। ১৩৩- নিযুক্তি। ১৩৪. পাকা ধানে মই দেওয়া অর্থে ব্যবহৃত।]

.

ঢোঁড়াইয়ের যুদ্ধ-ঘোষণা

পরের দিন ভোরে উঠেই ঢোঁড়াই যায় ধাঙড়টুলিতে শনিচরার কাছে। এত ভোরে তাকে দেখে শনিচরা অবাক হয়ে যায়।

কী রে? সব ভাল তো?

ভালও, আবার মন্দও। আমি পাক্কী মেরামতির দলে কাজ করতে চাই। আমাকে ভর্তি করে নেবে?

শনিচরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না। তারপর হো হো করে হেসে ওঠে।

এতদিনে তাহলে তাৎমাদের বুদ্ধি খুলেছে। গয়লার ষাট বছরে, আর তাৎমার সত্তর বছরে বুদ্ধি খোলে। আরে এতোয়ারী, শুক্রা, আকলু, বিরসা, বড়কাবুন্ধু, শোন শোন, শুনে যা খুশখবরী [১৩৫]। মজার খবর। ময়নার বাচ্চার চোখ ফুটেছে।

সকলে এসে জড়ো হয়। হাসি মস্করার মধ্যে মেয়েরাও এসে যোগ দেয়।

এতদিনে তাৎমারা বেলদার [১৩৬] হয়ে গেল।

আরে বাবা করবি তো মজুরি। যেখানে পয়সা পাবি সেখানে কাজ করবি। তার মধ্যে আবার বাছ বিচার।

শুক্রা বাধা দিয়ে বলে, তাই বলে নিজের মান ইজ্জৎ নেই। পয়সা পেলেই মেথর ডোমের কাজও করতে হবে নাকি?

এতোয়ারী শুক্রাকে ঠাণ্ডা করে কোথায় মেথরের কাজ, কোথায় মাটি কাটার কাজ। কালে কালে কিন্তু সকলের ফুটানি ভাঙবে। দেখ অতবড় গেরস্থ জৈশ্রী চৌধুরী, বনেদী ব্রাহ্মণ পরিবার, পাড়াসুদ্ধ লোকের সম্মুখে হাল চালিয়েছে। জাতের মাথা দ্বারভাঙ্গারাজ পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে টু শব্দ করেননি। একে শখের হাল চালানো ভাবিস না। দিন আসছে চনরচুড় ঝা, একতাল ফুটানি ছাঁটত [১৩৭] যে সে গরুর গাড়িতে চড়ে না। সেদিন দেখি কামিখ্যাথানের মেলায় গরুর গাড়ি থেকে নামছে। লোটাতে করে জমানো পয়সা ঘরের মেঝেতে পোঁতা থাকলে তবেই বিবিকে কাজ করতে বারণ করা যায়।

এসব তো অনেক হল। এখন বেটা [১৩৮] তুই বল, তুই যে রাস্তা মেরামতির কাজ করবি, পাড়ার মহতো নায়েবদের জিজ্ঞাসা করেছিস?

তারা কি আমায় খেতে দেয়? জিজ্ঞাসা করতে যাব কেন? আর জিজ্ঞাসা করলে জানাই আছে যে, তারা মাটি কাটার কাজ করতে দেবে না।

 দেখিস না পঞ্চায়েত তোর কি করে। নোখে বেলদার কবে পচ্ছিম থেকে এসে এককুড়ি বছরের উপর এই এলাকায় আছে। তাকে কি তোর জাতভাইয়া মানুষ বলে ভাবে? সে বেচারা রোজ কাজ করার সময় এই নিয়ে দুঃখু করে।

সেই দিন থেকেই ঢোঁড়াই কোশী-শিলিগুড়ি রোডের একুশ থেকে পঁচিশ মাইলের গ্যাং-এ বহাল হয়।

 সব ধাঙড়বা তাকে ঠাট্টা করে বলে যে তোকে এবার থেকে বাচ্চা বেলদার বলব। শুক্রা ধাঙড় তার বাড়ির মাইজীর কাছ থেকে, মাইনের থেকে এক টাকা আগাম নেয়; তার সনবেটার কোদাল কিনবার জন্য। বড়ো এতোয়ারী ধাঙড়ের দল নিয়ে বোরোয় বকরহাটার মাঠের থেকে ময়নার ডাল বাছতে, বাচ্চা বেলদারের কোদালের বাটের জন্য।

বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ফিরবার সময় ঢোঁড়াইয়ের দেখা হয় ধাঙড়টুলির ডাইনীবুড়ি আকলুর মার সঙ্গে। সে মাটি খুঁড়ে একটা কী বার করছিল, মাটির ভিতর থেকে। ঢোঁড়াই কে দেখে হেসেই আটখান। ছালটা পোকায় খাওয়া খাওয়া গোছের, একটা প্রকাণ্ড শাক আলু ঢোঁড়াইয়ের হাতে দেয়। নে নাতি, অসময়ের জিনিস। সবাই একে ডাইনী বলে ভয় করে। কিন্তু এর চোখে একটা অনুভূত কোমলতার আভাস দেখে, ঢোঁড়াই ভয় করবার অবকাশও পায় না সেদিন।

[১৩৫. সুখবর। ১৩৬. বেলদার আর নুনিয়া, এই দুটো জাতই কেবল এই অঞ্চলে মাটিকাটার কাজ করে। ১৩৭. বড়াই করত। ১৩৮. ঢোঁড়াই শুক্রার সনবে। অর্থাৎ ধছেলে; সেইজন্যই অন্য ধাঙড়রাও তাকে ছেলে বলে।]

.

মহতো নায়েব আদির মন্ত্রণা

সেই রাতেই ধনুয়া মহতোর বাড়িতে পঞ্চায়েত বসে। অন্য সময় হত তার বাড়ির সম্মুখের মাদার গাছটার নিচে, বাঁশের মাচার পাশে;-দুই একজন বিশিষ্ট দর্শক বসত মাচার উপর। এখন ভাদ্রমাসের টিপটিপুনি বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বসা যায় না। তাই সবাই বসেছে একচালাটির ভিতর। ছড়িদার আর নায়েবরা বাঁশের চাটাইয়ের উপর, আর ধনুয়া মহতো বসেছে ঘরের জিয়লের খুঁটিতে হেলান দিয়ে। খুঁটিটা থেকে এক গোছা পাতা বের হয়েছে; বুড়ো তাৎমাদের মত জিয়লের ডালও মরতে জানে না। মহতোর সম্মুখে একখান খুঁটে থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে- বাবুলালের তামাকের খরচ আজ বাঁচবে। তেতর কাশছে, বোধ হয় এইবার কথা বলবে। ঠিকই সে কথা বলে চাটাইটার দেখছি আর কিছু নেই।

জবাব দেয় রতিয়া ছড়িদার, বাবুদের বাড়ি থেকে যে বাঁশের টুকরোগুলো নিয়ে আসে, সেগুলো তো পঞ্চায়েতের পাওয়ার কথা। চিরকাল তাই হয়ে এসেছে, নুনুলাল মহতোর সময়ে। সেখান থেকে আনা ঔজার [১৩৯] আর ঘাস দড়ি হবে যে আনবে তার; আর বাঁশ আনলে অদ্ধেক হবে পঞ্চায়েতের, এই ছিল চিরকালের নিয়ম। কেউ দিয়েছে দুবছরের মধ্যে, যে চাটাই নতুন থাকবে?

সকলেই দোষী; কেউ আর কথাটা বাড়তে চায় না। লালু বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আরম্ভ করে, কেবল টিপটিপুনি বৃষ্টি এ বছর। আরে হবি তো জোরে হ। এ জলে আর কে চালের খাপড়া বদলাবে। অথচ ব্যাঙের ডাকের কামই নেই।

বাসুরা বলে হয় একদিন তিসুর সালের [১৪০] মতো জল। এক বৃষ্টিতে সেবা, মরণাধারের কাঠের পুল ডুবে গিয়েছিল।

 বাবুভাইয়াদের সে কী দৌড়োদৌড়ি তাৎমাটুলিতে সেদিন। অমন আর কখনও দেখিনি। মহতো সেবার খুব হিম্মৎ দেখিয়েছিল বাবুভাইয়াদের কাছে।

মহতো এই প্রশংসায় খুব খুশি হয়ে সলজ্জ হাসির সঙ্গে বলে-বৃষ্টিতে যে কতদিন বাড়িতে বসে থাকি, সেটা দেখবে না, এক আনা বেশি চাইলেই চালার মাপের হিসেব দেখাবে। মৌকা পেলে বাবুভাইয়াদের কাছে থেকে চুটিয়ে নেব; ছাড়াছাড়ি নেই আমার কাছে। খাইতো গেঁহু, নহিতো এহু [১৪১]।

মহতো হুঁকোটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসে। স্ত্রীকে বলে, গুদরমাই (গুদরের মা) বাইরের শুকনো ঘাসগুলো তুলিস নি তো? কী যে তোদের আক্কেল তা বুঝি না, যেমন মা তার তেমনি ছেলে। আবার খাটাসের মতো তাকাচ্ছিস কি? ওগুলো যে পচে গলে যাবে। হরনন্দন মোক্তারের বাড়িতে কাজ করার দিন এনেছিলাম, আজও সেই পড়ে রয়েছে। কত ধানে কত চাল তা তো আর বুঝিস না। আমাদের কাজ শেষ হওয়ার সময় তারা লোক রেখে দেয় পাহারায়। সেইগুলোকে ভিজাচ্ছিস। ও ঘাসে উই লাগতে কদিন। গতবার ঠিকেদার বাবুর বাড়িতে কাজ করবার সময় এনেছিলাম উপর করে১৪২ এই এত বড় দা, তিনপোয় ওজন হবে, সেটাকেও হারিয়েছে ওই মায়ে বেটায় মিলে। করে নে ফুটানি যে কটা দিন এই মহতো বেঁচে আছে। পারমাত্মা কী পদার্থ দিয়ে যে আজকালকার ছেলেদের গড়েছে। এই দ্যাখো না ঐ ঢোঁড়াইটার কাণ্ড!

পয়স পলি অহি অতি অনুরাগ।
 হোহি নিরামিষ কবহুঁ কি কাগা। [১৪৩]

উনি আবার গলায় তুলসীর মালা নিয়ে সাধুবাবাজী হবেন।

সকলে এই বিষয়টারই প্রতীক্ষা করছিল এতক্ষণ থেকে। আজ আর ছাড়াছাড়ি নেই।

বাওয়ার ছেলে হয়েছেন তো মাথা কিনেছেন।

পঞ্চ-এর কথার খেলাপ গিয়েছে অতটুকুনি ছোঁড়া! হারাজাদা!

আজকের পঞ্চায়তি থেকে মহতো নায়েব ছড়িদার কারও এক পয়সা রোজগার নেই [১৪৪]। কেবল জাতের ভালোর জন্য, আর দেশের মঙ্গলের জন্য, আজকের পঞ্চায়েতের বৈঠক করা হচ্ছে। ঢোঁড়াইকে ডাকা হয়েছিল পঞ্চায়তিতে। ঢোঁড়াই আসেনি এখনও।

তাৎমাটুলিতে পঞ্চায়তি নিত্যি লেগেই আছে। এর বৌ ওকে দেওয়া, কোন পক্ষের কোন ছেলেটা মড়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখাগ্নি করে নিয়েছে, মৃতের বাড়ির বেড়া আর বাশগুলো পাবে বলে; কে জোর করে স্বামীর সাক্ষাতে তার স্ত্রীর কপালে সিঁদুর লাগিয়ে তাকে স্ত্রী বলে দাবি করছে। আরও কত রকমের দৈনন্দিন জীবনের খুচরো মামলা। কিন্তু এতটা বয়স হল, পঞ্চারা কখনও দেখেনি যে জাতের পঞ্চায়তিতে কাউকে ডেকে পাঠিয়েছে আর আসেনি। কথায় বলে পঞ্চ যদি সাপকে ডাকে তো সাপ আসবে, বাঘকে ডাকে বাঘ আসবে, মানুষ তো কোন ছার। এত বুকের পাটা ঐ একরত্তি ছেলেটার। এ অপমান পঞ্চদের পক্ষে অসহ্য।

সব আসামীই তাৎমাটুলির পঞ্চায়তিতে [১৪৫] আসতে ভয় পায়। শাস্তির প্রথম দফা পঞ্চায়তের বৈঠকের মধ্যেই হয়ে যায়। মোটামুটি ফয়সালা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসামীর উপর চড়চাপড় পড়তে আরম্ভ করে। এগুলো ছিল আসল শাস্তির ফাউ। এই উপরি পাওনার পর অন্তিম রায় বেরোয়; জরিমানা, গাধার পিঠে চড়ানো, ভোজ খেলা নয় ভাতকা ভোজ [১৪৬] আরও কত কী। ছোটবেলা থেকে ঢোঁড়াই এ সব কত দেখেছে। পূরণ তাৎমাকে সেবার অর্ধেক গোঁফ কামিয়ে একটা বড় রামছাগলের পিঠে বসানো হয়। ঢোঁড়াইয়ের বেশ মনে আছে, সে গুদর, আরও সব ছেলেরা কালকাসুন্দি আর ভট গাছের ছড়ি নিয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে। এক! দু! তিন! সকলে রামছাগলটির উপর ছড়ি চালাচ্ছে সপাসপ। বাবুলাল বলল, থাম তোরা একটু। চেরমেন সাহেবের হাওয়া গাড়ির পিট্রোল [১৪৭] সে একটা শিশিতে ভরে রাখে, ব্যথায় মালিশ করার জন্য। সেই শিশি থেকে একটু পেট্রোল দেয় রামছাগলটার পিঠের কাছে। ব্যা ব্যা করে পরিত্রাহি চিৎকার করছে রামছাগলটা। সেটা অনবরত ঘুরপাক খাওয়ার চেষ্টা করে। এমন অদ্ভুত কাণ্ড! রামছাগলটা শেষকালে ছটফট করতে করতে শুয়ে পড়ে। সকলে মিলে জোর করে পূরণ তাৎমাকে সেটার উপর চেপে ধরে রাখবে; নে নে পূরণা, শখ মিটিয়ে, শুঁকে নে। কেওড়ার গন্ধ। সে কথা ঢোঁড়াই কোনোদিন ভুলতে পারবে না। মহতো নায়েব ছড়িদার সকলেরই হাত নিশপিশ করছে- ঢোঁড়াই টাকে একবার হাতের কাছে পেলে হয়।

ধনুয়া মহতো হুঁকোটায় কয়েকটা টান মেরে, তার উপরের নালটা মুছে নালুর হাতে দেয়; তার মনের মতো ধোয়া এখনও বের হচ্ছে না।

নে নাল্লু তামাকটা টেনে ভালো করে ধরিয়ে দে! এখনও তোরা জেয়ান মরদ আছিস, বুকের জোর আছে; আমাদের মতো বুড়ো হয়ে যাসনি। তোদের মতো বয়সে আমাদের এককোশের মধ্যে দিয়ে কোনো মেয়েছেলে যেতে সাহস করত না।

মহতোর রসিকতায় সকলে হাসে। মহতোর বয়সকালে অনেক কাণ্ড সকলের মনে আছে। মহতোগিন্নী আর তার পঙ্গু মেয়ে ফুলঝুরিয়া বাইরে আড়ি পেতে ছিল। মা গর্বপ্রসন্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,-এমন এমন কথা বলবে যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে।

ধনুয়া মহতোর উচ্চহাসি ব্যাঙের একঘেয়ে ডাকের মধ্যেও কানে বাজে। হঠাৎ সে উদগত হাসিটা ঢক করে গিলে ফেলে গম্ভীর আর সোজা হয়ে বসে। মহতোর পদের একটা মর্যাদা আছে তো। সকলেই বোঝে যে এইবার আসল কাজের কথা আরম্ভ হবে। বৈঠকের আবহাওয়া থমথমে হয়ে ওঠে।

 ছেলে বাপের হয় না; ছেলে হয় জাতের। তারপর ছেলের উপর দাবি হয় টোলার। এই জিয়লের ডালের খুঁটি লেগে গিয়েছে তো; এ এখন সমস্ত চালাটাকে সুদ্ধ ঠেলে নিয়ে উঁচুতে উঠবে। সেই রকমই দ্যাখো, এই বাবুলাল তাৎমা জাতটার ইজ্জত কত বাড়িয়েছে। হৈজার ডাক্তার [১৪৮] যখন তাৎমাটুলির ফৌজী কুয়োতে লাল রঙ [১৪৯] দিতে আসে, তখন আমার বুক, সত্যি কথা বলতে কী, ভয়ে দুরদুর করে। বাবুলাল দেখি মোচে তা দিতে দিতে তার সঙ্গে কথা বলে;তবে না ও তাৎমা জাতটাকে একা এতটা এগিয়ে দিতে পেরেছে।

বাবুলাল, আত্মপ্রশংসা নিজের কানে শোনেনি এমন একটা ভাব দেখায়।

 আর একদিক দ্যাখো, সালা বদমাইসির জর [১৫০] এই ঢোঁড়াই।

সকলে ঢোঁড়াইয়ের নামে সোজা হয়ে বসে। নান্টু শব্দ করে থুথু ফেলে; বাসুয়া চিক করে একটা শব্দ করে। বাবুলাল বলে, ছি ছি ছি! তারপর গোঁফের একটা অবাধ্য চুলকে দাঁত দিয়ে কাটার চেষ্টা করে।

সেই কুত্তার বাচ্চাটা কি না মাটি কাটার কাজ করবে, যা আমাদের সাত পুরুষে কেউ কোনোদিন করেনি! তাৎমা জাতের মুখে কালি দিল! এর থেকে মুসলমানের এটো খাওয়া ভাল ছিল। আর লোকসমাজে মুখে দেখানোর তো কিছু রাখল না তাদের। এখানে এল না পর্যন্ত সে নবাবপুর। কী ছেলেই মানুষ করেছে বৌকাবাওয়া! বাওয়ার নাই দিয়ে মাথায় চড়ানোর জন্যেই তো ওর এত বাড় বেড়েছে। দ্যাখো দেখি কাণ্ড! নোখে বেলদার, আর শনিচরা ধাঙড় তাৎমার সঙ্গে সমান হয়ে গেল। আরে, মাটি কেটেই যদি পয়সা রোজগার করতে হয়, তাহলে আমরা এতদিনে ফুলে ভাতি (হাপর) হয়ে যেতাম। আজ এই তিনকুড়ি বছর থেকে দেখছি এই পাক্কী মেরামতের জন্য মাটি কাটার লোক, কত দূর দূরান্ত থেকে আসে। ধনুয়া মহতো আঙুল উঠোলে এখনই তিনশ তাৎমা রাস্তা মেরামতির কাজে দিতে পারে। বাপ ঠাকুরদার নাম হাসালি। এই চোখের পর্দাটুকুর জন্যই তো ধাঙড়দের পোয়া-বারো। রাতদিন পচই খেয়েও দুবেলা ভাত ডালের উপর আবার তরকারি খায়; আর আমাদের বরাতে মকাই মারুয়ার দানাও জোটে না। একখান দা কিনতে হলে অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছ থেকে দু টাকা ধার করতে হয়, দু-আনা করে রবিবারে তাকে সুদ দেব এই কড়ারে। এই দ্যাখো না আমার দা খানা। এই আঙুলের মতো পাতলা হয়ে গিয়েছে, ধার দেওয়ার জায়গা নেই। নরকেলের দড়িটা কাটা যায় না এ দিয়ে। পয়সা না থাক একা ইজ্জত প্রতিষ্ঠা আছে। একটা ছোঁড়ার বদ খেয়ালের জন্য আমাদের সেটাও খোয়াতে হবে?

পঞ্চরা সকলে বেশ তেতে উঠেছে, এতক্ষণে।

বন্ধ কর শালার হুক্কা পানি [১৫১]।

তাড়াও ওটাকে গোঁসাইথান থেকে।

বাওয়াটাই যত নষ্টের গোড়া।

জাকে নখ অরুজটা বিশালা।

সেই তাপস প্রসিদ্ধ কলিকালা। [১৫২]

লুটিশ দাও, বাওয়াকে।

চল, সকলে। থানে। ছোঁড়ার ছাল ছিঁড়ে আজ হাড়মাস আলাদা করব।

চল, চল।

বাইরে তখন বেশ জোরে বৃষ্টি এসেছে।

পড়তে দে জল,-বলে হেঁপো রুগী ভেতর বের হয়ে পড়ে ঘর থেকে। আর কারও বৃষ্টির কথা খেয়াল নেই।

লাঠি নিয়েছিস তো?

[১৩৯. যন্ত্র, হাতিয়ার। ১৪০. গত বছরের আগের বছর। ১৪১. খাই তো গম, না হলে কিছুই খাই না! মারি তো গণ্ডর লুটি তো ভাণ্ডার এই অর্থে। ১৪২. যোগাড় করে। ১৪৩. হত অপরের সঙ্গে পাস খাইয়ে পালন করলেও কাক কী কখনও নিরামি আহারী হয়। ১৪৪. সাধারণত কেউ পঞ্চায়তের কাছে নালিশ করলে তাকে দু টাকা ছ আনা জমা দিতে হয়। এর ছয় আনা ছড়িদারদের প্রাপ্য, এক টাকা মহতোর, আর এক টাকা বারোয়ার ফাণ্ডের। এই ছিল। নিয়ম। কিন্তু আজকাল এ নিয়ম চলে না। নায়েব মহতো ছড়িদার এরা মিলে সব টাকাই নিজেরা আত্মসাৎ করে। এর জন্য নিত্য নতুন মিথ্যা মোকদ্দমাও তারা করে। ১৪৫. স্থানীয় ভাষায় কোনো বিষয় পঞ্চায়েতে দেওয়া হয় না, পঞ্চায়তিতে দেওয়া হয়। ১৪৬. ভাতের ভোজ: অন্য শুকনো জিনিসের ভোজে খরচ কম পড়ে। ১৪৭. পেট্রল। ১৪৮. হৈজার ডাক্তার, দাহ কলের ভাতার, আসলে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। ১৪৯. পারমঙ্গনে অব পাশ। ১৫০. যত নষ্টের গান। ১৫১. একঘরে কর। ১৫২. যার নখ আর জটা বড়, সেই কলিকালে প্রসিদ্ধ তপস্বী (তুলসীদাস)।]

.

দুখিয়ার মার বিলাপ ও প্রার্থনা

আগে আগে চলেছে বড়রা- মহতো নায়েব চারজন, আর ছড়িদার। এর পিছনে আছে ছেলে বুড়ো সকলে। এরা সব এতক্ষণ ছিল কোথায়। বোধ হয় মহতোর বাড়ির আশেপাশে সবাই জড়ো হয়েছিল সেই জলবৃষ্টির মধ্যেও আজকের পঞ্চায়তির জমজমাট তামাসা দেখবার জন্য। জল কাদা ব্যাঙ কাঁটা মাড়িয়ে, অধোলঙ্গ বীরের দল নৈশ অভিযানে বেরিয়েছে। তাদের জাত্যাভিমানে আঘাত লেগেছে। অন্ধকারের সরু পথের উপর আন্দাজে পা ফেলে চলেছে সকলে; পায়ের নিচের চটকানো কেঁচোগুলো থেকে আলোর আভাস ফুটে বেরুচ্ছে; গুগলি শামুক গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। খড়মড় করে। ক্ষ্যাপা শেয়ালের মতো তারা হন্যে হয়ে ছুটেছে; কোন কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নেই তাদের এখন,- যেমন করে হোক তাদের জাতের এ অপমানের একটা প্রতিকার তারা করবে।

 পাড়ায় মেয়েরাও একে একে ধনুয়া মহতের সদ্য খালি করা একচালাটিতে এসে জড়ো হয়। বাইরে অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তবু সকলে ভিজে কাপড় নিঙড়োতে নিঙড়োতে বাইরে কী যেন দেখতে চেষ্টা করে। সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়। মুখে কারও ভয় ডর মায়ামমতার ছায়াও নেই; আছে কেবল অভিযানের নিশ্চিত সাফল্যের জন্য উল্লাস, আর কয়েকটা অনিশ্চিত মজার খবরের জন্য কৌতূহল। ঐ একরত্তি ছোঁড়ার এই কাণ্ড! অসীম উৎসাহের সঙ্গে গুদরর মা আজকের পঞ্চায়তের সম্পূর্ণ কার্যবিররণী, অন্য সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করে। কুপীর আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কে তার কথা শুনছে? তাদের মধ্যে এত উত্তেজনা বোধ হয় এক কেবল ধাঙড়টুলিতে আগুন লাগার সময় ছাড়া আর কখনও হয়নি। বাসুয়া, নালু, তেতর এই তিন নায়েবের স্ত্রীরাও মহতোগিন্নীর চেয়ে গৌরবের অংশীদার হিসাবে কম বলে মনে করে না নিজেদের। তারাও সমস্বরে চিৎকার করছে। পাষণ্ডদলনে বীরেরা বেরিয়েছেন, বীরজায়ারা যাত্রার আগে কপালে জয়তিলক কেটে দিতে পারেননি; সেইটা পুষিয়ে নিচ্ছেন চেঁচামেচি গালাগালির মধ্যে দিয়ে। কেবল দুখিয়ার মা এদের মধ্যে নেই। সে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। দুখিয়াটা চাটাইয়ের উপর একটা কচি বাতাবি লেবু নিয়ে খেলতে খেলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ রান্নাবাড়ি করার মতো মনের অবস্থা দুখিয়ার মার নেই। সন্ধ্যায় বাবুলাল বাড়ি থেকে বেরুবার পর থেকেই, তার মাথার আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে কান পেতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল–যদি কোনো চেঁচামেচি শোনা যায়; পঞ্চায়েতি কখনও বিনা হট্টগোলে শেষ হয় না। কেন মরতে গিয়েছিল সে কাল তালের বরফি নিয়ে ছোঁড়াটার জন্য। সেই থেকেই তো এত কাণ্ড! কাল গোঁসাইথানে না গেলে আজ হয়তো ছেলেটা এ কাণ্ড করত না। চিরকাল বদরাগী ঢোঁড়াইটা- সেই যখন কোলে তখন থেকেই; কিন্তু রাগেরও তো একটা সীমা আছে! বলতে গেলাম ভাল কথা, বাওয়া আর ঢোঁড়াই দুজনেই মানে কর নিল উল্টো। মহতো নায়েবরা, বিশেষ করে চাপরাসী সাহেব, আজ আর ঐ একরত্তি ছেলেটাকে আস্ত রাখবে না। দেবে হাড়গোড় ভেঙে। চাপরাশী সাহেব কোনোদিন ছেলেটাকে দেখতে পারে না- পঞ্চাতির চেঁচামেচি মহতোর বাড়ি থেকে এতদূর পৌঁছোয় না, কেবল বৃষ্টির একটানা রিমঝিম শব্দ শোনা যায়।

টপ টপ করে চালের ছাঁচতলা থেকে পড়ছে তার সম্মুখে। জলের ফোঁটা পড়েই একটা একটা টুপির মতো হয়ে যাচ্ছে। একটা নেপালী ফৌজ চাপরাসী সাহেবকে একটা টুপি দিয়েছিল। সে তার পেন্সনের টাকা তুলতে পারছিল না সরকারী অফিস থেকে। বাবুলাল টাকায় চার আনা করে নিয়ে টাকাটা তুলে দিতে সাহায্য করে। তাই সে বাবুলালকে দিয়েছিল পুরনো টুপিটা। দুখিয়ার মা আবার একদিন সেই টুপির মধ্যে বাবুলালের জন্যে কাঁঠাল ছাড়িয়ে রেখেছিল। কী মারই না মেরেছিল সেদিন বাবুলাল দুখিয়ার মাকে। আবার চাপরাসীর বৌ হতে শখ যায়; তাক তুই তাৎমানী।

বাবুলালের উপর বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে ওঠে। ঢোঁড়াইয়ের কথা মনে করে, তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নিচে জলের ফোঁটা পড়ে টুপি হচ্ছে কি না, সেদিকে আর খেয়াল থাকে না। খেয়াল থাকলেও ঝাপসা চোখে তখন দেখতে পেত না।

ঐ! এইবার একটা হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। তারা বোধ হয় পঞ্চায়েতিতে ঢোঁড়াইকে মারছে! রামজী! গোঁসাইজী, তোমার থানের ধুলোবালি মেখে ছেলেটা এত বড় হয়েছে। দোষ করে ফেলেছে বলে তাকে পায়ে ঠেলো না…ছোঁড়াটা হয়তো এখন চিৎকার করে কাঁদছে।…না কাঁদবে কেন? ঢোঁড়াইকে তো কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেনি। …হট্টগোল শোনা যেন দূরে সরে যাচ্ছে, বোধ হয় গোঁসাইথানের দিকে। এ আবার পঞ্চরা কি ফয়সালা করল? বাওয়াকে আবার কিছু করবে না তো? হয়তো ঢোঁড়াই কে এত মেরেছে যে তার চলবার ফিরবার ক্ষমতা নেই, নাকমুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বেহুশ হয়ে গিয়েছে; তাই বোধ হয় সকলে মিলে ধরাধরি করে তাকে বৌকাবাওয়ার কাছে পৌঁছুতে যাচ্ছে।

চেঁচামেচির আওয়াজ বাড়তে থাকে। বৃষ্টিরও বিরাম নেই- না হলে হয়তো কথাবার্তা কিছুটা শোনা যেত। ঝাপের সম্মুখে কুপির আলো পড়ে বৃষ্টির ধারা সাদাটে রঙের দেখাচ্ছিল, চোখের জলে তাও ঝাপসা হয়ে গেল।…মাইয়া গো, তোর চুলে বাওয়ার জটার মতো গন্ধ নেই কেন?…দূরে থেকে আপিস ফেরত বাবুলালকে দেখে, ধুলোকাদা মাখা ছেলেটা রাংচিতের বেড়ার মধ্যে দিয়ে পালাচ্ছে চোরের মতো।…

হঠাৎ পায়ের শব্দ হয়। ছপ ছপ কাদার মধ্যে দিয়ে কে যেন এদিকে আসছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বাবুলাল এসে ঘরে ঢোকে। সে যেন ধাক্কা দিয়ে দুখিয়ার মাকে দোরগোড়া থেকে সরিয়ে দেয়। তার সর্বাঙ্গ দিয়ে জলের স্রোত বইছে। উনুনের পাড় থেকে কুপিটা উঠিয়ে, সে ঘরের কোণের দিকে এগিয়ে যায়। আর একটু হলে ঘুমন্ত দুখিয়াকে মাড়িয়ে ফেলেছিল আর কী! সবুজ আর গোলাপী রঙে রাঙানো বেনা ঘাসের কাঠাটির ভিতর থেকে বাবুলাল টেনে বের করে পেট্রোলের শিশিটা। যত্ন করে তুলে রাখা কাজললতাটা কাঠা থেকে দূরে ছিটকে পড়ে। বাইরের দমকা হাওয়ার মতো বাবুলাল আবার বেরিয়ে পড়ে জলের মধ্যে। দুখিয়ার মা সশঙ্ক জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে একবার শিশিটির দিকে একবার বাবুলালের মুখের দিকে তাকায়। দোর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বাবুলাল বলে যায় শালা থানে নেই…

দুখিয়ার মার মনে হয় যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার পায়ের ধুলোর ইজ্জৎ রেখো, গোঁসাই। ঢোঁড়াইকে তার, এই চামারগুলোর হাত থেকে আজ বঁচিও। বাওয়ার মতো ভকত যাকে আগলে থাকে চব্বিশ ঘণ্টা, তাকে এই বাবুলাল, তেতর, নালু, বাসুয়া, কী করতে পারে? বিশ্বাস নেই বাবুলাল চাপরাসীকে। ও আগের জন্মের সুকৃতের [১৫৩[ ফলে সব কাটিয়ে উঠতে পারে, এ বিশ্বাস দুখিয়ার মার আছে। তার উপর পঞ্চ-এর রায়, দশের ফয়সলা। তার তাৎ গোঁসাই আর রামজীর তাকতের সমান। পীপর [১৫৪[ গাছের আওতায় মানুষ হয়ে, ছেলেটা কী করে পঞ্চ- এর কথার খেলাপ যেতে পারল। ওর ঘাড়ে এখন শয়তান সওয়ার হয়েছে। নিশ্চয়ই ধাঙড়টুলির আকলুর মা, কিংবা লম্বী গোয়ারিনের মতো কোনো ডাইন [১৫৫] জানা মেয়েমানুষ ওর উপর চক্কর [১৫৬] দিয়েছে। তা নাহলে কি কখনও কেউ এমন করতে পারে। কত পাপই না আমি করেছি, গোঁসাই তোমার কাছে! পিট্রোল-এর শিশি নিয়ে বাবুলাল আবার এখন কী করতে গেল?…

দুখিয়ার মা কিছু ভেবে ঠিক করে উঠতে পারে না।…কী একটা পোড়া গন্ধ না? ঠিকই তো!…ধোঁয়ার গন্ধ; বর্ষার ধোঁয়া উঁচুতে ওঠে না; মেঝেতে পড়া কেরোসিন তেলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়ায় চারিদিক ভরে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতেও ভয় হয়, কী জানি আবার কী দেখব। বৃষ্টি ধরে এসেছে। ঘন আঁধার ভেদ করে, থানের দিকে আকাশে উগ্র লাল আলোর ঝলক লেগেছে।

[১৫৩. পূণ্য। ১৫৪. অশ্বথগাছ। ১৫৫. ডাকিনীবিদ্যা। ১৫৬. যাদুমন্ত্রের প্রক্রিয়াবিশেষ।]

.

বাওয়া ও ঢোঁড়াইয়ের অগ্নিপরীক্ষা

ঢোঁড়াইকে গোঁসাইথান না পাওয়ার তাৎমা ফৌজের দল প্রথমটা কী করবে ভেবে পায় না।

 শালা, এত রাতেও বাড়ি ফেরেনি। এই ঝড় বৃষ্টির দিনেও। শয়তানী করে নিশ্চয়ই ধাঙড়টুলিতে বসে আছে, তাৎমাদের বেইজ্জৎ করার জন্য। ঐ ধাঙড়, আর মুসলমানদের বাড়ির ভাত খাওয়াটুকুই বাকি ছিল। তা সে শখটুক মিটিয়ে নে। খেয়ে নিস তার সঙ্গে মুরগীর আণ্ডা। ওটাকে হাতের কাছে এখন পেলে,–যেমন ধাঙড়রা শুয়োর মারে, এই তেমনি করে…

 কয়েকজন বাওয়াকে ঘরের ভিতর থেকে টেনে বার করে। সে কোনো বাধা দেয় না। বাওয়ার সত্ত্বেও দোষী মন, এই রকমই একটা কিছুর আশা করছিল। কিন্তু এত উত্তেজিত হওয়া সত্ত্বে, বাওয়াকে মারপিট করতে তাদের সাহস হয় না। তাকে কাদার মধ্যে টেনে এনে ফেলা হয়। তারপর চলে জেরা- কোথায় আছে ঢোঁড়াই, বল। কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছিস? শুক্রা ধাঙড়দের বাড়ি? নোখে বেলদারের বাড়ি? কোথায় লুকিয়ে আছে বল? পাক্কীর গাছতলায়?

বাওয়ার ঘাড় নেড়ে জবাব দেবার কথা। কিন্তু সে নির্বিকারভাবে পিট পিট করে তাকায় কিংবা কী ইশারা করে বলে, অন্ধকারের মধ্যে বোঝা যায় না।–আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে না, কোন দিকে গিয়েছে? সে ঐ জটাটায় আগুন লাগিয়ে। হ্যাঁ বলেছিল ঠিক; মাথার চাঁদিতে একটু গরম লাগলেই পেটের কথা বেরুবে।–

এই যে বাবুলাল পিট্রোলের শিশি আর দেশলাই নিয়ে এসেছে।

বাওয়ার ভিজে চালাটিকে জ্বালবার পর এই পাগলের দলের আক্রোশ একটু কমে আসে। মহতো নায়েবরা বুদ্ধিমান। তারা বুঝতে পারে যে যতটা করা উচিত ছিল; তার চাইতে একটু বেশি করা হয়ে গিয়েছে। বাবুলালের ভয় হয় যে সে-ই পেট্রোলের শিশি এনেছিল। এক এক করে তারা সরে পড়ে। বাকি সকলে গোঁসাই-থানে নানারকম গালগল্প আরম্ভ করে।

আলবৎ বটে পিট্রৌলের ধক। তা না হলে কি আর এ দিয়ে হাওয়া-গাড়ি চলে।

 মাদারঘাটের বুড়ি মদিয়াইন সেবার শীতকালে গেঁটে বাতের ব্যথায় মর মর হয়েছিল। ডেরাইভার সাহেব তাকে দিয়েছিল একটু পিট্রোল। শীতে জুবুস্থবু হয়ে, পায়ে পেট্রোল ঢেলে যেই ঘুর-এর আগুনের উপর পা তুলে ধরেছে, অমনি গিয়েছে পায়ে আগুন লেগে। চামড়া টামড়া ঝলছে একাক্কার :

তুই যে আবার সেই শাখড়েল-এর [১৫৭] গল্প আরম্ভ করলি।

 খবরদার, মুখ সামলে কথা বলবি। আমি বলছি মিছে কথা। বাসুয়া নায়েবকে জিজ্ঞেস কর, মুদিয়াইন-এর কথা সত্যি কিনা।

এই বাসুয়া!

বাসুয়াকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সকলে তাকিয়ে দেখে যে মহতো নায়েবেরা নাই। বহুদূর থেকে হেঁপো তেতরের কাশির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়- রতিয়া ছড়িদার [১৫৮]।

বাওয়া তার সম্মুখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ছাই আর আগুনের স্কুপের মধ্যে থেকে তখন কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বার হচ্ছে। রতিয়া বাওয়ার কাছে ঘেঁসে বসে। হাতের লাঠিটা দিয়ে খানিকটা পোড়া খড় আর ছাই সরিয়ে দেয়। নিচে থেকে আধপোড়া হাড়িকাঠটা বেরিয়ে আসে। এ কী! হাড়িকাঠ পুড়ে গিয়েছে। কত পাপের ভার তার বুকের উপর চেপে বসে। সকলে চলে গেলেও সে থেকে গিয়েছিল, বাওয়ার কাছে একটা প্রস্তাব আনবার জন্য; ভিক্ষের জমানো পয়সা যদি কিছু থাকে তাই দিয়ে পঞ্চ-দের ঠাণ্ডা করার চেষ্ট করা উচিত, এই সোজা কথাটা বাওয়ার মাথায় ঢুকানোর জন্য সে কাছে ঘেঁসে বসেছিল। কিন্তু হাঁড়িকাঠ পুড়ে গিয়েছে। পাপের গ্লানিতে আর রেণগুনীর ভয়ে তার বুক দুরদুর করে। এই হাড়িকাঠের পাশেই সর্বাঙ্গে রক্তমাখা রেবণগীর উপর প্রতি বছর গোঁসাই ভর করেন। ভয়ে ছড়িদার ঘেমে ওঠে। বাওয়ার পা জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়তো কিছুটা পাপের বোঝা কমত। ঝোঁকের মাথায় এ কী কাণ্ড করে বসেছে সকলে। রেবণগুণী তো সবই জানতে পারে। এই হাড়িকাঠ জ্বালানোর কথা সে নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছে। এখন তার সব রাগ করে উপর পড়বে সেইটাই হল কথা…

আগুন আর ধোয়ায় উদভ্রান্ত পাখিগুলো অশ্বখগাছের উপর এখনও শান্ত হতে পারেনি। অশ্বথগাছের ঝলসানো পাতাগুলো ধোঁয়ায় কাঁপছে। এমন সময় দূরে চেঁচামেচি শোনা যায়। সাপের ভয়ে হাততালি দিতে দিতে কারা যেন আসছে।

কী হয়েছে রে? আগুন কিসের? বাওয়া কোথায়? ধাঙড়ের দল আগুন দেখে এসে পড়েছে।

 ঢোঁড়াই দৌড়ে গিয়ে বাওয়ার পাশে বসে। সে সমস্ত ঘটনাটা আন্দাজ করে নিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। বাওয়ার কাদামাখা হাতখানা নিজেদের মুঠোর মধ্যে নেয়। কেউ কোনো কথা লে না। বাংওয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ঢোঁড়াই জীবনে কাঁদেনি বলেই নিজেকে সামলে নিতে পারে। সব ধাঙড়রা তাদের গোল হয়ে ঘিরে বসে। রতিয়া ছড়িদার পালাবার পথ পায় না।

 শনিচরা উঠে তার দুহাত চেপে ধরেছে।

বল কে কে ছিল? রগচটা বেড়াল রাগের জ্বালায় খুঁটি আঁচড়ায়। এ হয়েছে তাই। মুনিয়া পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করছিস কেন? বেশি নড়াচড়া করেছিস কি দেব ফেলে ঐ আগুনের ভিতর।

বিরসা বলে- পঞ্চায়তির ভোজের ফয়সালা করতে এসেছিলে নাকি বাওয়ার কাছে। দেড় টাকা পেলেই তো ভাতের ভোজ মাপ করে দেবে এখুনি।

এতোয়ারী বলে-বাজে কথা যেতে দে। বল কে কে ছিল? আগুন লাগিয়েছে কে? বাওয়াকে মেরেছিস নাকি? বাওয়া তুমিই বল না।

 বাওয়া মাথা নেড়ে বলে যে, না, কেউ তাকে মারেনি।

 ঢোঁড়াই বাওয়ার গায়ে হাত দিয়ে দেখে কোনো মারের দাগ আছে কি না। সারা গা একেবারে ছড়ে গিয়েছে। চামার চণ্ডালের দল। ঢোঁড়াইয়ের চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। তারই জন্য বাওয়াকে এই জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। শনিচরা রতিয়া ছড়িদারের চুলের গোছা ধরে বলে- সব সত্যি কথা বল। তা না হলে তোকে আজকে এইখানে আধপোড়া হাড়িকাঠে বলি দেব। এখনও বললি না। দাঁড়া তোর ছড়িদার গিরি ঘোচাচ্ছে।

 ছড়িদার ভয়ে ভয়ে সম্পূর্ণ ঘটনাটি বলে। শনিচরা আর বিরসার রক্ত গরম হয়ে ওঠে সব শুনে। দাঁড়া, ধনুয়ার মহতোগিরি, আর বাবুলালের চাপরাসীগিরি বের করছি। চললাম থানায়।

এতোয়ারী, আর শুক্রা তাদের থানায় যেতে বারণ করে। জানিস না দারোগা পুলিসের ব্যাপার। মাথা গরম করিস না, গর্ত খুঁড়ে সজারু বের করতে গিয়ে শেষকালে গোখরো সাপ বেরিয়ে যাবে। পালানোর পথ পাবি না তখন। বুড়ো হাতির কথা শোন। আমার বাবা আমাকে বলে গিয়েছিল কোনোদিন বুড়ো আঙুলের ছাপ দিস না। তার কথা মনে না রেখে সেবার কী বিপদেই পড়েছিলাম, সেই অনিরুদ্ধ মোক্তারের ব্যাপারটা মনে আছে না শুক্রা ভাই।

বিরসা বলে, বুড়োদের কোনো কথা চলবে না এখানে। সে সব শুনব নিজের টোলায়। চলরে শনিচরা।

কথা যখন রাখবি না, তখন যা ভাল বুঝিস তাই কর। বড়োর কথা আর গুণীর কথা না রাখলে ফল ভাল হবে না, ঠোকর খাবে।

 শুক্রা সায় দেয়- যত আক্কেল ঘরের বেড়ার মধ্যে। পুল পার হলেই সব বুদ্ধি বের হয়ে যাবে। ঘর বৈঠে বুদ্ধ পঁয়াতস; রাহ চলতে বুদ্ধ পাঁচ; কচহরী গয়ে তো একো ন সুঝে; যে হাকিম কহে সো সচ। [১৫৯]

সকলে হেসে ওঠে।

সত্যি হলও তাই।

বিরসা আর শনিচরা যখন পাঁচ মাইল দূরের সদর থানায় পৌঁছুল তখন বেশ রাত। দারোগা সাহেব দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। বহু ডাকাডাকির পর ছোট দারোগাসাহেবের ঘুম ভাঙা চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে তিনি কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করেন। কেমন শ্বশুর আবার এত রাতে জ্বালাতন করতে এসেছেন। কেয়া হ্যাঁয় কুলদীপ সিং? আবার এখন এই রাতে আউয়াল ইতলায় [১৬০] লিখতে হবে? কুলদীপ সিং বেশ করে সসুরা টাকে [১৬১] একটু পেটাতো। বেটা মিছে কথা বলতে এসেছে নিশ্চয়।

শনিচরা উৰ্দ্ধশাসে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। বিরসা থানার কম্পাউন্ডে ঢোকেইনি। থানা পর্যন্ত আসবার পর দারোগার নামে তার ভয় করে। শনিচরার হাজার টানাটানি সত্ত্বেও তার সাহসে কুলোয়নি। সে কম্পাউন্ডের বাইরে বসেছিল। হঠাৎ শনিচরাকে পালাতে দেখে সেও প্রাণপণে দৌড়ায়-কী জানি আবার কী হল! শহরের কাঁকর ভরা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে প্রায় সেখানে গিয়ে তারা থামে। যে ঘিয়ে ভাজা খেকি কুকুর দুটো ডাকতে ডাকতে তাদের তাড়া করছিল, সে দুটো আগেই থেমে গিয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সারা ঘটনার হিসাব নিকাশ করে। তারপর গাঁয়ে ফেরে।

শুক্রা আর এতোয়ারী সারা বৃত্তান্ত শুনে বিশেষ কিছু বলে না। এই রকম যে একটা কিছু হবে, তা তারা আশাই করছিল। ধাঙড়ানীরা বলে যে, যাক দারোগার হাত থেকে যে বেঁচে এসেছিল সেই ঢের।

[১৫৭. এক শ্রেণীর পেত্নীর নাম। ১৫৮. তার কাজ পঞ্চায়েতের নোটিশ, বাদী, বিবাদী সাক্ষী, নায়েব সকলকে জানানো, জরিমানার টাকা আদায় করা ইত্যাদি। আসলে কিন্তু সে মাতদের ঘুষের দালালী করে। ১৫৯. বাড়িতে থাকলে বুদ্ধি থাকে পঁয়ত্রিশ; পথে বেরুলে বুদ্ধি হয়ে যায় পাঁচ; কাছারী পৌঁছে একও দেখতে পায় না, যা হাকিম বলে তাই সত্যি মনে হয়। ১৬০. First Information Report. ১৬১. সাধারণ গালি।]

.

পুলিশের নামে ঢোঁড়াইয়ের পাপক্ষয়

এতোয়ারী পরের দিনও প্রত্যহের মতো জয়সোয়ালদের সোডা-লেমনেডের কারখানায় কাজ করতে যায়। সেখানে ম্যানেজার সাধুবাবুকে সব কথা বলে। পুলিশ সাহেবের গাড়ি, সোলা আর তার আনুষঙ্গিক পানীয়ের বোতলের জন্য জয়সোয়াল কোম্পানীর দোকানে থামলে সাধুবাবু ইংরেজি মিশানো হিন্দীতে গত রাত্রের তাৎমাটুলির ঘটনাটির কথা তাঁকে বলেন। সাহেবের মাথা তখনও ঠিক ছিল; দিনের বেলা কোনো কোনো দিন থাকত।

তাই নাকি। আমার চোখের উপর এই ব্যাপার! চ্যাপ্যাসি, কোটি পর বড়া ডারোগাকো সলাত ডেও। আগাগোড়া পচ ধর গিয়েছে সার্ভিসের নিচের অঙ্গগুলিতে। সব ঠিক করতে হচ্ছে।

 সাহেবের রাগ দেখে কারখানার ঘরে এতোয়ারী ঘামতে থাকে। সাধুবাবু এসে বলেন, এবার খাওয়াও এতোয়ারী, তোমার কাজ করে দিয়েছি।

আমার নাম বলেননি তো বাবু?

আরে না, না, সে আর আমায় বলতে হবে না। ও কী! বুরুশ না নিয়ে, এমনিই বোতল পরিষ্কার করছিস কেন? বুড়ো হয়ে এতোয়ারী তোর কাজে ফাঁকি দেওয়া আরম্ভ হয়েছে।

এতোয়ারী অপ্রস্তুত হয়ে যায়।

সেই রাত্রেই বড় দারোগাসাহেব দুজন কনস্টেবল নিয়ে গোঁসাইথানে পৌঁছান। আলো দেখে বাওয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। চাটাইখানা বের করে পেতে দেয়। এত বড় হাকিমকে সে কী করে খাতির দেখাবে। চাটাইটার উপর দুই চাপড় মেরে ধুলো ঝাড়বার অছিলায় দারোগাসাহেবকে বসবার জায়গা দেখিয়ে দেয়।

কনস্টেবল ঢোঁড়াইকে বলে- কী রে দারোগা সাহেবের জন্য একখানা খাটিয়াও যোগাড় করতে পারিস না?

হ্যাঁ, কপিল রাজার জামায়ের কাছ থেকে একখান আনতে পারি।

 দারোগাসাহেব বারণ করেন- না না অত খাতিরদারির [১৬২] দরকার নেই।

গাঁয়ের চৌকিদার লম্বা সেলাম করে এসে দাঁড়ায়। পুলিশ সাহেবের গালাগালির কথা দারোগাবাবুর তখনও বেশ স্পষ্ট মনে আছে- সার্ভিসবুকে কালো দাগ পড়বার ভয়, সব এই নচ্ছার চৌকিদারটা খবর দেয়নি বলে। খবর না দেওয়ার জন্য চৌকিদারকে দুটি চড় মেরে দারোগাবাবু কাজ আরম্ভ করেন। আরম্ভ দেখেই সবাই বুঝতে পারে যে, আজ আর কারও রক্ষে নেই : চৌকিদারের মতো অফসর- এরই যদি এই হালৎ হয়, তাহলে সাধারণ লোকের পেলে কী-যে আছে, তা গোঁসাই-ই জানেন।

চৌকিদার যায় ধাঙড়টুলি থেকে সকলকে ভাবতে, আর কনস্টেবলরা যায় তাৎমাটুলি থেকে আসামীদের ধরে আনতে। ঢোঁড়াই এত কাছ থেকে দারোগা পুলিশকে কখনও দেখেনি। তার ভয় ভয় করে। তাই চৌকিদারের সঙ্গে সঙ্গে ধাঙড়টুলির পথ ধরে।

ধাঙড়টুলিতে হুলস্থুল পড়ে যায়। আজ আর কারও নিস্তার নেই। কাল রাতের ছোট দারোগার মারের হুমকির কথা শুনিচরা আর বিরসার মনে আছে। ছোট দারোগাতেই ওই কাণ্ড। এতো আবার বড়ো দারোগা। বাপরে বাপ! পালা, পালা; চল সব গাঁ ছেড়ে পালাই। গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো উধ্বশ্বাসে অন্ধকারে পালাতে আরম্ভ করে; কলেরে জঙ্গলে, পুলের নিচে, বাঁশঝাড়ে। কেবল এতোয়ারী থেকে যায়, একজনও না গেলে দারোগাসাহেব চটবে। শুক্রা পালায় সবার শেষে! সনবেটাকে ফেলে পালাতে শুক্রার মন সরে না- আসবি নাকি ঢোঁড়াই ? ঢোঁড়াইয়েরও ধাঙড়দের সঙ্গে পালাতে ইচ্ছে করে। আবার ভাবে যে, না, বড় দারোগা আবার বাওয়াকে কী-না-কী করবে; বাড়িতে দারোগা। এই বিপদের সময় বাওয়াকে দারোগার হাতে একলা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আর তার জন্যই তো এত কাণ্ড। না হলে এতে বাওয়ার আর কী দোষ ছিল।

যাওয়ার সময় শুক্রা চৌকিদারের হাতে চার আনা পয়সা গুঁজে দিয়ে যায়। এতোয়ারী আর চৌকিদারের সঙ্গে ঢোঁড়াই  ফিরে আসে। পথে এতোয়ারীর সঙ্গে চৌকিদারের ঠিক হয় যে, সে যেন দারোগা সাহেবকে বলে যে ধাঙড়েরা সকলে আজ ভোজ খেতে নীলগঞ্জ গিয়েছে। কেবল এতোয়ারী ছিল পাড়া পাহারা দেবার জন্য। সিকিটা ট্র্যাকে খুঁজতে খুঁজতে চৌকিদার ঢোঁড়াইকে বলে, তুই আবার যেন অন্য কিছু বলে টলে দিস না ছোঁড়া, বুঝলি।

ধাঙড়দের উপর চৌকিদারের এই অভাবনীয় করুণায় ঢোঁড়াইয়ের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে।

সমবেত তাৎমার দল সদলে একবাক্যে বলে যে, তারা কেউ কিছু জানে না। বাবুলাল পিট্রোল এনেছিল। সে তেতর নায়েব আর ধনুয়া মহতোর ঘরে আগুন লাগিয়েছে।

কনস্টেবলরা বাবুলাল, তেতর আর ধনুয়াকে গালাগালি দিতে দিতে সম্মুখে টেনে নিয়ে আসে। কোথায় গিয়েছে তেতর নায়েবের কাল রাতের প্রতাপ, কোথায় গিয়েছে ধনুয়া মহতোর জিয়লাগাছে হেলান দিয়ে বসা ন্যায়াধীশের গুরুগাম্ভীর্য, কোথায় গিয়েছে চাপরাসী সাহেবের পদগৌরব। দারোগা-পুলিশের হাতে বেইজ্জৎ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। প্রশ্ন আপন আপন প্রাণ বাঁচাবার, হাকিমের হাত থেকে রক্ষা পাবার। বাবুলাল করুণ দৃষ্টিতে ঢোঁড়াই য়ের দিকে তাকায়, মহতো দেখে বাওয়ার দিকে ত্রস্ত চাউনির ভিতর থেকে মিনতি আর কৃপাভিক্ষা ফুটে বেরুচ্ছে। তেতর উদগত শ্লেষ্ম গিলে দারোগা সাহেবের সম্মুখে কাশি চাপবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আর কাশি চাপবার উকট প্রয়াসে তার চোখে জল এসে গিয়েছে।

ঢোঁড়াইয়ের মনের ভিতর আগুন জ্বলছে; এইবার ঠেলা বোঝো! দেখে যা দুখিয়ার মা, যে চাপরাসী সাহেবের জন্য তুই নিজেকে বাবুভাইয়াদের বাড়ির মাইজী মনে করিস, দেখে যা তার দশা। দেখিয়ে যা তালের বরফি দারোগা সাহেবকে, পিট্রোলের শিশির মালকাইন।

হঠাৎ ঢোঁড়াইয়ের বাওয়ার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়; বাওয়ার মনের ভিতরটা সে পরিষ্কার দেখতে পায়। সে ঢোঁড়াই কে অনুরোধ করছে- আসামীর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলো না- যা হবার হয়ে গিয়েছে, জাতের লোকের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি জীইয়ে রাখা ঠিক নয়।…

দারোগাসাহেবের জেরা আর গালাগালির বিরাম নেই। সব কটাকে জেলে পাঠাব, সব কটার উপর চারশ ছত্তিশ দফা [১৬৩] চালাব। সমস্ত গাঁটাকে পিষে একেবারে ছাতু ছাতু করে দেব, মুনেসোওয়ার সিং দারোগাকে চেনো না তাই। হিন্দু হয়ে থানের ইজ্জত রাখো না। মুসলমান হলেও না হয় কথা ছিল। তারা সব করতে পারে…

সব আসামীই বলে যে, তারা হুজুরের কাছে মিথ্যা বলবে না, হুজুর মা-বাপ। আকাশের চাঁদ আছেন, গোঁসাই আছেন। রামচন্দ্রজীর রাজ্য চলছে। হাতের পাঁচ আঙুল সমান নয়- তাদের মধ্যে যে খারাপ লোক কেউ নেই, তা বলছে না; তবে সরকারের নিমক খেয়ে সরকারের কাছে মিথ্যা বললে তাদের গায়ে যেন কুষ্ঠ হয়। তারা আগুন লাগিয়েছিল ঠিক।…

কেন? শয়তানের বাচ্চা কোথাকার!

বাবুলাল সামলে নেয়। হুজুর বাওয়ার ঐ চালটার উপর একটা শকুন বসেছিল। শকুন বসা ঘর রাখতে নেই, তাতে পাড়ার অমঙ্গল, থানের অমঙ্গল আর যে ঐ ঘরে থাকবে, তার তো কথাই নেই। এখানে একটা চামড়ার গুদাম আছে হুজুর, সেইটাই আমাদের জেরবার করল, শকুন-উকুন পাড়ায় এনে।

সকলে প্রথমটায় অবাক হয়ে যায়। আসামী আর অন্য তাদের ধরে প্রাণ আসে। এখন সব নির্ভর করছে বাওয়া আর ঢোঁড়াইয়ের উপর- এই বুঝি তারা মিথ্যে ফাঁস করে দেয়।

দারোগা সাহেব বাওয়াকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এরা যা বলছে তা সত্যি কি না। বাওয়া উত্তর দেয় না। সে প্রথম থেকে দারোগা সাহেবের সুমুখে এই রকম ভাবে বসে আছে। কোন কথায় সাড়া দেয়নি।

দারোগা ভাবেন লোকটা কেবল বোবা নয়, কালাও। আর সাধারণত তাই হয়। একবার যেন মনে হয়েছিল যে, সে শুনতে পাচ্ছে তাই না খটকা লেগেছিল দারোগা সাহেবের মনে।

তুই বল হোকরা। ঢোঁড়াইয়ের সব ঘুলিয়ে যায়। মুখ থেকে কথা বেরুতে চায় না। জিব যেন জড়িয়ে আসছে। এত বিপদেও কি লোকে পড়ে। প্রাণপণ শক্তিতে সে কথা বলতে চেষ্টা করে।

জোরা বল। ভয় করিস না। তুই এখানেই থাকিস নাকি? বাপকা নাম?- এক নিশ্বাসে দারোগা সাহেব বলে যান। ঢোঁড়াই মাথা নেড়ে জানায় যে হা সে এখানেই থাকে। এরা যা বলছে তা কি সত্যি?

এতগুলো লোকের ভবিষ্যত এখন তার হাতে। একবার মাথা নাড়লে সে এখনই তার জাতের সেরা লোকটির পঞ্চগিরি ঘুচিয়ে দিতে পারে, জেলের হাওয়া খাইয়ে আনতে পারে, পুলিশকে দিয়ে মার খাইয়ে বেইজ্জৎ তো করাতেই পারে। তার মনও তাই চায়। এই পঞ্চায়েতের অত্যাচারের মাথাগুলোকে নিচু করাতে, এমন নিচু করাতে যাতে তারা আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে বাওয়ার সঙ্গে কথা বলতে না পারে- যাতে তারা ঢোঁড়াইকে আর তাচ্ছিল্যের চোখে না দেখতে পারে।

 কিন্তু বাওয়ার চাহনির আদেশ সে অমান্য করতে পারে না।…বাওয়া নীরবে তাকে বলছে যে, জেলে ধরে নিয়ে গেলে এদের এখন ছত্রিশ জাতের ছোঁয়া ভাত খেতে হবে, কোথায় থাকবে তাৎমা জাতের গৌরব, কোথায় থাকবে কনৌজি তন্ত্রিমা। ছত্রিদের সুযশের সৌরভ…

 এতোয়ারী উসখুস করে বয়সের অভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পারে যে বাওয়া আর ঢোঁড়াই কেউই সত্যি কথা বলবে না। এতক্ষণ সে মনে মনে ভাবছিল যে গোঁফমোটা জেলরবাবু রবিবারে আসেন জয়সোয়াল কোম্পানিতে, সওদা করতে, সাধুবাবুকে দিয়ে তাঁকে বলিয়ে বাবুলাল আর মহতোর হাতে বোনা একখানা সতরঞ্চি সে জেলখানা থেকে আনাবে; এনে একবার তার উপর বাওয়াকে বসাবে; তার জন্য যত খরচ হয় হোক। অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছ থেকে কর্জও যদি নিতে হয়, তাও স্বীকার… কিন্তু সব চৌপট [১৬৪] করে দিল ঐ ঢোঁড়াইটা।

সে বলে যে, হাঁ বাবুলের কথা সত্যি।

কবে বসেছিল শকুন?

 কাল সকালে।

মদ্দা না মাদী।

ঢোঁড়াই ঢোঁক গেলে।

 দুদিন পরে মোচ উঠবে এখনও শকুনের মদ্দা মাদী চেনো না- বদমাস ছোকরা অশ্বথ গাছে না বসে চালার উপর বসল কেন শকুনটা মিথ্যাবাদীর ঝাড় সব!

ঢোঁড়াই এ প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারে না; সে মনে মনে ভাবে, এইবার বোধ হয় দারোগাসাহেব তাকে মারবার জন্য উঠবেন।

আর কেউ কিছু জানিস এ সম্বন্ধে। এই বুডঢা!

এতোয়ারীর সাদা ভুরুর নিচের ঝাপসা চোখ জোড়া আর নির্বিকার মুখ দেখে, তার মনের কিছু বুঝবার উপায় নেই। সে ভেবেছিল তাৎমাদের বিরুদ্ধে কিছু বলবে; কিন্তু থানা পুলিশের ভয়ে সব কথা চেপে যায়। ঢোঁড়াইয়ের সাক্ষ্যেই যদি এই চোট্টা গুলিকে সায়েস্তা করা যেত, তাহলে, মাছও উঠত, ছিপও ভাঙত না। কিন্তু এমন সুযোগ পেয়েও এই নোংরা কুড়ের বাদশা, বিলকুল চোট্টা পঞ্চগুলোকে ছেড়ে দিল ঢোঁড়াই। ঐ জাতটাকেই বিশ্বাস নেই। ও ছোঁড়ার শরীরেও তো এদেরই রক্ত। কাল সাধুবাবুর কাছে মুখ দেখানো শক্ত হবে তার।

 না হুজুর, আমি থাকি ধাঙড়টুলিতে।

দারোগাবাবু সাক্ষী না পেয়ে বকেঝকে চিৎকার করে উঠে পড়েন। চৌকিদারকে বলেন- শালাদের উপর ভালো করে নজর রাখবে। না হলে তোমার চাকরি থাকবে না।

চৌকিদার ঝুঁকে কুর্নিস করে। দারোগাসাহেব কপিল রাজার জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করে, তারপর শহরে ফেরেন।

একজন কনস্টেবল কেবল থেকে যায়। সে ছড়িদারকে দূরে ডেকে নিয়ে সব কথাবার্তা বলে। ছড়িদার এসে মহতো নায়েবদের বলে যে সিপাহীজী জানে যে ঢোঁড়াই  বাবুলালের স্ত্রীর ছেলে। সব খবর পুলিশ রাখে। সে এখনি গিয়ে দরোগা সাহেবকে বলে দেবে যে এই জন্যই ঢোঁড়াই বাবুলালের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। তারপরই সবকটাকে জেলে পুড়বে।

পঞ্চরা চাঁদা করে কিছু কিছু দিয়ে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করে ফেলে, সিপাহীজীর সঙ্গে।

[১৬২. সম্মান দেখানোর। ১৬৩. ফৌজদারী আইনের চারশ ছত্রিশ ধারা মোকদ্দমা। ১৬৪. মাটি করে দিল।]

.

ঢোঁড়াই ভকতের মর্যাদা বৃদ্ধি

এই ঘটনার পর ঢোঁড়াই কে মহতো নায়েবরা আর কিছু বলতে পারে না। মনে মনে নিশ্চয়ই সেই আগেকার মতই বিরূপ তার উপর, কিন্তু চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে। আর রাগ না চাপলে উপায় কী, মোকদ্দমা আবার খুলে যেতে কতক্ষণ। পুলিশকে খবর দিয়েছিল কে তা তাৎমারা বুঝতে পারে না। সে লোকটাকেও খুশি করে রাখতে হবে।

বাওয়ার চালাঘর তাৎমারাই আবার তুলে দেয়। বাওয়া কিন্তু তার মধ্যে আর কখনও শোয় না। কেবল বর্ষার সময় ঢোঁড়াই বাওয়াকে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়।

পাড়ার সকলে ঢোঁড়াইয়ের প্রশংসা করে। এতবড় বিপদের থেকে, এতবড় বেইজ্জতি থেকে, সে জাতটাকে বাঁচিয়েছে। তাকে আর কিছু হোক, তাচ্ছিল্য করা চলে না। পাড়ার ছেলেরা ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে কথা বলে ধন্য হয়, মেয়েরা ডেকে কথা বলে। তার বয়সী অন্য ছেলেদের গাঁয়ের বয়স্ক বয়স্করা ওরে ছোঁড়া বলে ডাকে, কিন্তু তাকে এখন ঢোঁড়াই ছাড়া আর অন্য কিছু বলে ডাকতে বাধে- দুখিয়ার মার পর্যন্ত। এতটা সম্মান বাওয়া আর ঢোঁড়াই নিজের পাড়ায় কখনও পায়নি।

কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের মাটি কাটার কথাটা যেমন এই সূত্রে চাপা পড়ে যায়, তেমনি আবার একটা চার বছরের পুরানো কথা হঠাৎ বেরিয়ে আসে- ঐ চামড়াগুদামবালা কপিলরাজার জামাইয়ের কথাটা। ওটা চাপা পড়ে গিয়েছিল সেবার গানহী বাওয়ার সুরাজ এর [১৬৫] তামাসার হিড়িকে।

বাবুলাল যে সেদিন দারোগাসাহেবের কাছে চামড়াগুদামের কথাটা তুলেছিল সেটার মধ্যে নিজের প্রাণ বাঁচানো ছাড়াও অন্য কথা ছিল। এমনিই তো সবাই ছিল চামড়াবালা মুসলমানটার উপর চটা। তার উপর কিছুদিন থেকে সে জিরানিয়ার একজন মেথরানীকে বাড়িতে এনে রেখেছে। এখন আবার শোনা যাচ্ছে যে, তাকে মুসলমান করে বিয়ে করবে।

কী যে পছন্দ ও জাতটার বুঝি না। একটা বৌ থাকতে আবার ঐ মেথরানীকে বিয়ে করতে ইচ্ছেও হয়। বলিহারি প্রবৃত্তির! গা দিয়ে সেটার ভক ভক ভক করে নিশ্চয় দুর্গন্ধ বেরোয়। এনে রেখেছিলি তাও না হয় বুঝেছিলাম; কিন্তু তাকে মুসলমান করে নিয়ে বিয়ে? কভভী নহী!– হেঁপো রুগী তেতর পর্যন্ত তাল ঠুকে বলে।

সেদিন দারোগাসাহেব রাতে ওর এখানে গিয়ে কী বলেছেন, কী করছেন জানতে পারা যায় নি! নিশ্চয়ই তাড়াটাড়া দিয়ে থাকবেন,-যা চটেছিলেন থানের থেকে যাওয়ার সময়।

এই মেথরানীর ব্যাপার নিয়ে গ্রামে বেশ সোরগোল পড়ে যায়। এমনি সময়ে থানা পুলিশের ভয় ছিলই, তার উপর আবার গোসাইথানে হয়ে গেল ঢোঁড়াইকে নিয়ে কাণ্ড; তাই কেউ আর কিছু করতে সাহস পায় না।

মেথরানীটাকে মুসলমান করে বিয়ে করা জিনিসটা, ধাঙড়রাও পছন্দ করে না। তারা নিজেরা হিন্দু কিনা, এ নিয়ে কখনও মাথা ঘামানো দরকার মনে করেনি; তবে তারা যে মুসলমান নয় এ কথা তারা জানত। এই মেথরানীর বিয়ের ব্যাপারটাতে তাদের হিন্দু জাতের উপর জুলুম করা হচ্ছে। মেথরানীকে তারা ছোঁয় না ঠিক; তা হলেও সে তাদের মেয়ে। সেই মেয়েকে নিয়ে যাবে গরুখোরে? ছেলে হলেও না হয় অন্য কথা ছিল; এ মেয়ের ব্যাপার; বিলকুল বেইজ্জতির কথা। আর যখন লার ব্যবসা ছিল, শিমুলগাছ কাটার কাজ ছিল, তখন না হয় কপিল রাজার সঙ্গে রোজগারের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এই জামাইটা পরদেশী শুগা [১৬৬]। আজ নিমফল খেতে বসেছে এখানকার নিমগাছে কাল থাকবে না। করে চামড়ার ব্যবস্যা, যার সঙ্গে ধাঙড়দের রোজগারের কোনো সম্পর্ক নেই। এটার সঙ্গে কিসের খাতির?

কিন্তু কী তাৎমাটুলির, কী ধাঙরটুলির বড়রা কেউ থানা পুলিশের ভয়ে এ বিষয়ে এগুতে রাজি নয়। ঢোঁড়াই এখন ছেলেদের মধ্যে একটু কেস্ট বিষ্ণু গোছের হয়ে উঠেছে। ধাঙড়টুলি তাৎমাটুলির দুই জায়গার ছেলেরাই তার কথা শোনে। পঞ্চরা ঢোঁড়াইকে বলে চুপি চুপি- রাতে মধ্যে মধ্যে ঢিল ফেলিস চামড়াগুদামে। খুব সাবধানে, এসব ছেলেপিলের কাজ। তোদের বয়সে আমরাও অনেক করেছি।

পঞ্চরা মনে মনে ভেবে রেখেছে যে, এ নিয়ে বিপদ তপন কিছু হলে ঢোঁড়াইটার উপর দিয়েই যাবে।

ঢোঁড়াইরা মুসলমানটাকে একটু জব্দ করুক বাওয়াও তাই চায়। শোনা যাচ্ছে যে, মিলট্রি ঠাকুরবাড়ির মোহন্তজীরও এতে সমর্থন আছে। টোলার মহতো নায়েবদের কাছ থেকে, এত বড় দায়িত্ব আর বিশ্বাসের পদ পেয়ে ঢোঁড়াই বর্তে যায়। কিন্তু এ কাজ তাদের বেশিদিন করতে হয় না। হঠাৎ শোনা যায় গানহী বাওয়া জিরানিয়ায় আসছেন, সাভা [১৬৭] করতে। তাঁকে কি কেউ জেলে ভরে রাখতে পারে। এক মন্তরে তালা পাঁচিল ভেঙে বাইরে চলে আসেন। গানহী বাওয়া মেথর মেথরানীদের খুব ভালবাসেন। তিনি এখানে এলে তাকেই বলা যাবে- এই জুলুম আর বেইজ্জতির একটা কিছু বিহিত করতে।

 বন্ধ করে দে এখন ঢিল ফেলার কাজ, ঢোঁড়াই। কদিন দেখই না।

ঝিকটিহার মাঠে গানহী বাওয়ার সাভার পৌঁছে তারা দেখে কী ভীড়? কী ভীড়। বকড়হাট্টার মাঠে যত ঘাস, তত লোক; ই-ই-ই এখানে থেকে মরণাধারের চাইতেও দূর পর্যন্ত লোক হবে। গানহীবাওয়ার রস সি ভর-এর [১৬৮] মধ্যেই তারা যেতে পারেনি, তার আবার তার সঙ্গে কথা বলা। গানহীবাওয়ার কাছে বসেছিলেন মাস্টার সাব, আরও কত বড় বড় লোক সব। কপিলরাজার জামাইয়ের কথাটা বলতে না পারায়, তাৎমাদের দুঃখ হয় খুব। একবার বলতে পারলেই কাজ হয়ে যেত। কিন্তু এই বেশুমার লোকের সকলেরই হয়তো নিজের নিজের কিছু কাজের কথা বলার আছে। যার ধর্ম তিনি নিজেই যদি রক্ষা না করেন তাহলে আমরা কী করতে পারি। যাক গানহী বাওয়ার দর্শনটা তো হল। ঢোঁড়াই দেখে যে, তার চাইতেও বোধহয় বেঁটে- কি লরম, ঠাণ্ডাহা [১৬৯] চেহারা-ঠিক মিসিরজীর মতো। ঢোঁড়াই শুনেছে যে ঘি খেলে নাকি অমন চেহারা হয়। কিন্তু এ কিরকম সন্ত আদমী [১৭০], দাড়ি নেই। ঢোঁড়াইদের সব চাইতে খারাপ লাগে, শৌখিন বাবুভাইদের মতো এই সন্ত আদমীর আবার চশমা পরার শখ। গানহী বাওয়ার চেলারা সকলকে বসতে বলে। দর্শন হয়ে গিয়েছে, আর তারা বসে। কেবল বৌকাবাওয়া বসে থাকে দূর থেকে সে দেখে কম, তাই সাভা শেষ হলে একবার ভাল করে দর্শন করবে বলে।

কিন্তু আজব ব্যাপার! ঢোঁড়াইয়ের কাজ হাসিল হয়ে গেল এর দিন কয়েকের মধ্যে। চামড়া গুদামটা উঠে গেল ইস্টিশানের কাছে। আসল কথা ইস্টিশানের কাছে না গেলে চামড়া চালান দেবার সুবিধে হচ্ছিল না, কিন্তু তাৎমাটুলিতে ধাঙড়টুলিতে এর ব্যাখ্যা হল অন্য রকম! ঢোঁড়াইয়ের দলের ঢিলের জোর গানহী বাওয়ার অদৃশ্য প্রভাব আর সেদিনের দারোগা সাহেবের হুমকি, তিনটে মিলে যে কপিলরাজার জামাইকে এখান থেকে ভাগিয়েছে, এ সম্বন্ধে আর কারো কোনো সন্দেহ নেই। এই ঘটনার পর গায়ে ঢোঁড়াইয়ের প্রতিষ্ঠা যেমন বাড়ে, তার আত্মপ্রত্যয় বাড়ে তার চাইতে অনেক বেশি। সে মনে মনে অনুভব করে যে রামজী আর গোঁসাই তার দিকে,–ঐ এমনি বোঝা যায় না, মনে হয় তারা ঘুমচ্ছেন, কিন্তু দেখছেন সব উপর থেকে; যিনি অন্যায় করেছেন তাকে ঘা খেতেই হবে। রামজী ঢোঁড়াইয়ের তরফে। আর এখন সে কারো পরোয়া করে না দুনিয়ায়?

[১৬৫. স্বরাজ শব্দের বিকত উচ্চারণ। ১৬৬. বিদেশী টিয়াপাখি। ১৬৭. সভা, মিটিং। ১৬৮. এক রশি অর্থাৎ সিকি মাইল। ১৬৯. নরম, ঠাণ্ডা। ১৭০. সন্ন্যাসী মানুষ।]

.

তন্ত্রিমাছত্রিদের যজ্ঞোপবীত গ্রহণ

ভাগলপুর জেলার সোনবর্গা থেকে মরগামায় এসেছিল মহগুদাস। তা বলে মরগামার মুখোরিয়া তাৎমাদের ওখানে নয়। মুখোরিয়া তাৎমারা রাজমিস্ত্রীর কাজ করে, তাদের ঝোটাহারা মইয়ে চড়ে। তাদের ওখানে হেঁজিপেঁজি কনৌজি তাৎমাও জলস্পর্শ করে না; তাঁর আবার মহগুদাসের মতো লোক উঠবে সেখানে। তার বলে কত হাল বলদ জমি জিরেৎ তিনটে সাদী, [১৭১] ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আঙিনা, জনানীরা [১৭২] বাড়ির বাইরে যায় না, ছেলেপিলে নাতিপুতি, বাড়বাড়ন্ত সংসার।

সিরিদাস বাওয়ার কুৰ্মী চেলারা মরগামায় একটা সাভা করেছিল। সেই কুৰ্মী গুরুভাইদের নিমন্ত্রণ করতে মহগুদাস এসেছিল;-আর সঙ্গে সঙ্গে গুরুদেবের দর্শনটাও হয়ে যাবে, এটাই ছিল ইচ্ছা।

সেই সময় মহগুদাস কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলেন তাৎমাটুলিতে। অত বড় একটা লোককে এরা খাতিরদারী কী করে করবে, তাই তাকে এরা থাকতেও বলেনি। কেবল ডিস্টিবোড অপিস থেকে ডেকে আনিয়েছিল বাবুলালকে। গাঁয়ের মধ্যে ভালা আদমির সঙ্গে কথা বলা লোক, বাবুলাল ছাড়া আর কে আছে। সেই সময় মহগুদাসই কথা পাড়ে, জাতের সম্বন্ধে-তাৎমারা যে সে জাত নয়। রামচরিতমানসে তুলসী দাসজী বলে গিয়েছেন যে, তারা তন্ত্রিমাছত্রি, একেবারে ব্রাহ্মণ না হলেও ঠিক ব্রাহ্মণের পরেই।

পশ্চিমে সব জায়গায় কনৌজী তাৎমারা এই নাম নিয়েছে, আর নিয়েছে জনৌ [১৭৩]। এই দেখো, বলে মহগুদাস তুলোর কুর্তার ফিতে খুলে বের করে দেখায় তার গলার পৈতেটা-আঙুলের মতো মোটা, সোনার মতো হলুদ রঙের।

মহগুদাস তো গেলেন চলে, কিন্তু জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন আগুন তাৎমাটুলিতে। ঢোঁড়াই , রারিয়া, আরও অনেকে তখনই পৈতা নিতে চায় কিন্তু মহতো নায়েবেরা রাজী না। এসব জিনিস হট করে পরে ফেলা কিছু নয়। বুড়োরা ভয় পায়- ধরম নিয়ে ছেলেখেলা ঠিক নয়। পচ্ছিমে করছে, পচ্ছিমের লোক তোকে হাতের আঙুল কেটে দিতে বলে দিবি? পচ্ছিমে এক সের আটার রুটি হজম হয়, এখানে হয়? গোসাইকে ঘাটাস না খবরদার!- যেমন আছেন তেমনি তাঁকে থাকতে দে। খুশি না হন, অন্তত তোর উপর চটবেন না।

তাৎমাদের পুরুত মিসিরজী, গত দুবছর থেকে প্রতি রবিবারে গোঁসাইথানে রামায়ণ পড়ে শুনিয়ে যান, আর এর জন্য এক আনা করে পয়সা দক্ষিণা পান পঞ্চায়েতের কাছে থেকে। তারই কাছে পঞ্চরা জিজ্ঞাসা করে পৈতা নেওয়ার কথা। তিনি বলেন যে, মহগুদাস বাজে কথা বলেছে- রামায়ণের তন্ত্রিমাত্রির কথা লেখা নেই। কেউ তার কথা বিশ্বাস করে না। ঢোঁড়াই পরিষ্কার তার মুখের উপর বলে দেয় যে, তিনি অন্য জাতের নতুন করে পৈতা নেওয়া পছন্দ করেন না, সত্যি কথাটা চেপে যাচ্ছেন। তুমি খামকা ভয় পাচ্ছ মিসিরহী; তুমি এলে গায়ের কম্বল চারাপাট করে মুড়ে, ইয়া: গদ্দাদার [১৭৪] আসন পেতে দেব বসতে- যেমন এখন পেয়েছ। চির-অ-কা-আল…

বাওয়া ঢোঁড়াইকে থামিয়ে দেয়।

শুভ আচরণ কত নেহি হোই
দেব বিপ্র গুরু মানই ন কোঈ। [১৭৫]

বলে, মিসিরজী চটে শালুর খোলে রামায়ণটি বাঁধতে আরম্ভ করেন।

তারপর ঢোঁড়াইরা মরগামায় সিরিদার বাওয়ার কুৰ্মী চেলাদের সঙ্গে, এই পৈতে নেওয়া নিয়ে অনেকবার দেখাশুনা করেছে। তারাও পৈতে নিতে বারণ করে তাৎমাদের। ঢোঁড়াই চটে আগুন হয়ে যায়;-কুর্মী কুর্মছত্রি হতে পারে, কিন্তু আমরা পৈতা নিলেই পৃথিবী ফেটে জল বেরিয়ে যাবে; না?

আমাদের কথা পছন্দ না, তা জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলি কেন?

তাৎমাটুলির যখন এই ব্যাপার নিয়ে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তখন ধনুয়া মহতোর বাড়িতে এল তার শালা মুঙ্গীলাল, কুটমৈতি [১৭৬] করতে। তাৎমাটুলির তাৎমাদের মধ্যে মহতোই প্রথম বিয়ে করেছিল নিজের গাঁয়ের বাইরে ডগরাহাতে, জিরানিয়া থেকে ন মাইল দূরে। আজকাল কুটমৈতিতে কেউ এলেই বাড়ির লোক বিরক্ত হয়। কুটুম এসেই বলবেন, ভেটমুলাকাত [১৭৭] করতে এলাম। কিন্তু বাড়ির লোক সবাই জানে যে, ভেমুলাকাতের তখনই দরকার হয়, যখন নিজের বাড়িতে খাওয়া জোটা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। কুটুম এলেই দিতে হবে পা ধোয়ার জল, খড়ম থাকলে খড়ম, বসতে বলতে হবে বাইরের মাচাতে, নিজেরা খাও না খাও তাকে দুবেলা ভাত খাওয়াতেই হবে, পার আঁচানোর জল তার হাতে ঢেলে দিতেই হবে; কিন্তু এবার মুঙ্গীলালের খাতি বেশি, সে পৈতা নিয়েছে। পৈতেটা কানে জড়িয়েই, সে দিদির বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। পা ধুয়েই সে পৈতার কথা পাড়ে। মহতোর ছেলে গুদর ডেকে নিয়ে আসে ঢোঁড়াইকে। পাড়াসুদ্ধ সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে কুটুমের মাচার উপর। খাসা মানিয়েছে পৈতেটা কানে জড়িয়ে! আরে হবে না, এ যে আমাদের নিজেদের জাতের জিনিস। সেকালে আমাদের বাপঠাকুরদারা যখন কাপড় বুনত, তখন মাড় দিয়ে সুতো মাজবার সময় সবাই কানে জড়িয়ে রাখত এক এক গাছা সুতো। মাজতে গিয়ে সুতো ছিঁড়েছে কি কানের থেকে একগাছা খুলে নিয়ে ছেঁড়াটা জুড়ে দাও। পৈতা কি আর আমাদের নতুন জিনিস।

সেকালের তন্ত্ৰিমাছত্রিদের পূত-গৌরবের উত্তরাধিকারীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পচ্ছিমের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এ জেলায় চার কোশ দূরের তাৎমারা পৈতে নিয়েও যখন মাথায় বজর [১৭৮] পড়েনি, তখন আমরা নেব না কেন? মুঙ্গীলালও এতে সায় দেয়। মহতো শালাকে কিছু বলতে পারে না। মনে মনে ভাবে যে, তাৎমা টুলির লোকেদের দলে ভিড়াতে না পারলে, ডগরাহার তাৎমাদের বিয়াসাদী কিরিয়া করম এর অসুবিধা হবে, তাই মুঙ্গীলালটা এই সব ছোকরাদের নাচাচ্ছে।

খালি ছোকরাদের মধ্যে জিনিসটা সীমাবদ্ধ থাকলে না হয় মহতো তাড়াতাড়ি দিয়ে ব্যাপারটা সামলে নিতে পারত। নান্টু নায়েবও ছেলেদের দিকে হয়ে গেল, বাবুলালেরও নিমরাজি নিমরাজি ভাব, এই পৈতে নেওয়ার সম্বন্ধে। হেঁপো তেতর হাঁ না কিছুই বলে না ঠিক হয় পৈতা নেওয়া হবে। তবে এটা কানফুকনেবাল গুরু গোঁসাই [১৭৯]-এর অনুমতিসাপেক্ষ।

তিনি থাকেন অযোধ্যাজীতে। সেই একবার এসেছিলেন তাৎমাটুলিতে, যেবার জিরানিয়ায় টুরমন এর তামাসা [১৮০] হয়। সকলের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছিল, তাঁকে দেবার জন্য। অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছ থেকে কিছু কর্জও করতে হয়েছিল, তাঁর গদ্দীবালা কিলাসের টিকস [১৮১] কাটিয়ে দেবার জন্য; এগারো টাকা সাড়ে তিন আনা ভাড়া; না না মহতোর বোধহয় ভুল হচ্ছে, নটাকা সাড়ে তিন আনা, সে কি আজকের কথা, সাড়ে তিন আনাটা ঠিক মনে আছে। তবে টাকাটা এগার কিনা…বাবুলাল তুমিই বল না, অফসর আদমী- তোমরা…হিসেব টিসেব জানো…

বাবুলাল বলে, দশ টাকা সাড়ে তিন আনা। সকলেই জানত যে বাবুলাল দশ টাকাই বলবে পরিমাণ, মাপ, সংখ্যা প্রভৃতি নিয়ে ঝগড়া উঠলে মাঝামাঝি একটা নির্ণয় দেওয়াই ভালো পঞ্চদের।…

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম- হতো কেশে গলা পরিষ্কার করে নেয়-গুরু- গোঁসাইকে একখানা পোসকাট [১৮২] লেখা যাক।

গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। অযোধীয়াজীতে পোসকাট লেখা হবে। গাঁয়ে এর আগে কখনও চিঠি লেখা হয়নি। তবে মহতো নায়েবরা খবর রাখে যে, ডাকঘরের মুন্সীজি চিঠি লিখতে নেয় এক পয়সা। মিসিরজী লেখে ভাল। কিন্তু সে কি দুপয়সার কমে কাজ করবে। যেমন জায়গায় পূজো দিতে যাবে, তেমনি খরচ হবে। থানে এক পয়সার গুড়ে পূজো হতে পারে, কিন্তু অযোধিয়াজীতে পূজো তো দূরের কথা, পৌঁছুতেই দশ টাকা খরচ হয়ে যাবে।

মহতো পোসকাটের দাম দিতে চায় না; বলে পঞ্চায়েতের তবিলে খড়মহরাও [১৮৩] নেই। ঢোঁড়াইয়ের দল জ্বলে ওঠে- কী করেছ জরিমানার সব পয়সা?

ছড়িদার পঞ্চদের বাঁচিয়ে দেয়-পঞ্চরা তার হিসেব দেবে কি তোমাদের কাছে?

একটা বড় রকমের ঝগড়া আসন্ন হয়ে ওঠে।

 ঢোঁড়াই নিজের বাটুয়া থেকে একটা পয়সা বার করে দেয় এই আমি দিলাম পোসকাটের দাম। সকলে অবাক হয়ে যায়- ঢোঁড়াইটা পাগল হল নাকি! দশের কাজ, একজন দিয়ে দিচ্ছে কি? আর একটু অপেক্ষা করলে মহতো নিজেই দিত। বোকা কোথাকার!

বাবুলাল ঢোঁড়াইকে বলে আর এক পয়সা লাগবে পোসকাটে। ডিস্টিবোডের অফিসার-পৃথিবীর সব খবর তার নখদর্পণে। ঢোঁড়াই আরও একটা পয়সা ফেলে দেয় সকলের মধ্যে।

মহতো বলে, বাবুলাল তুমিই তাহলে কিনো পোসকাট দেখেশুনে। ঢোঁড়াই তুই মিসিরজীকে রবিবারে দোয়াত কলম আনতে বলে দিস।

রবিবারে মিসিরজী রামায়ণ পাঠের বদলে চিঠি লিখে দেন; আর মেয়েরা পর্যন্ত রামায়ণ শুনতে এসেছে। কী জোর দিয়ে দিয়ে লেখে। এখানে পর্যন্ত খস খস করে শব্দ শোনা যাচ্ছে, দেখতে দেখতে কালি ফুরিয়ে যাচ্ছে কলমে। পৈতে নেওয়াটা মিসিরজীর মনঃপূত নয়, কে জানে আবার ভুলটুল না লিখে দেয় পোসকাটে…

ঠিক হয় বাবুলাল চিঠি ডাকে দেবে। সকলে ডাকঘর পর্যন্ত তার সঙ্গে যায়। তারপর চলে কত জল্পনা-কল্পনা, ডাকপিয়নের জন্য প্রত্যহ প্রতীক্ষা। কী চিঠি মিসিরজী লিখে দিয়েছিল কে জানে। একমাস অপেক্ষা করেও চিঠির জবাব আসে না গুরু গোঁসাইয়ের কাছ থেকে।

ঢোঁড়াইয়ের আর ধৈর্য থাকে না। আবার গাঁয়ে চেঁচামেচি আরম্ভ হয়ে যায় এ নিয়ে। ঢোঁড়াই বলে- আর কেউ না নিক, আমি একাই পৈতা নেব। কালই যাব সোনবর্গা। অন্তরের থেকে সকলে এই জিনিসটাই চাইছিল। কেবল মনে মনে একটু ভয় ছিল কী জানি কী হয়; ডগরাহার তাৎমারা পৈতা নেওয়ার পর সেখানে অনেকগুলো গরুমোষ, দুতিন দিনের অসুখে মারা গিয়েছে–গরুগুলো খায়ও না দায়ও না, দুতিন দিন গোবরের সঙ্গে রক্ত পড়ে, তারপর মরে যায়।

 যাক, তাৎমাটুলির লোকদের চাষবাষ গরুমোষের বালাই নেই। গুরুগোঁসাইয়ের নাম নিয়ে তারা পৈতা দেওয়ানোর জন্য বামুন ডেকে পাঠায় সোনবর্গা থেকে।

তারপর একদিন গাসুদু ছেলেবুড়ো একসঙ্গে মাথা নেড়া করে আগুনের ধারে বসে, গলায় কাছির মতো পৈতে নেয়। দুদিন গাঁয়ের মেয়ে পুরুষরা আলাদা থাকে; তারপর একসঙ্গে ভাতের ভোজ খেয়ে নিজের নিজের বাড়ি ফেরে। সেদিন থেকে তাৎমারা হয় দাস- ঢোঁড়াই ভকত হয়ে যায় ঢোঁড়াইদাস।

মহতো নায়েবদের বিরুদ্ধে পৈতা দেওয়ার দলের নেতৃত্ব কী করে এসে পড়েছিল ঢোঁড়াইয়ের উপর, তা সে নিজেই বুঝতে পারেনি। লোকে বোধহয় বুঝেছিল যে মাটিকাটা নিয়ে তার দেওয়া আঘাত সমাজ সহ্য করে নিয়েছে। হিম্মত আছে ছোকরার। আর পৈতার ব্যাপারে ওটা বলেছে ঠিক সবার মনের কথাটা। তার একটা জিনিস সবাই লক্ষ্য করেছে যে যতই ঢোঁড়াই পঞ্চদের বিরুদ্ধে কথা বলুক, মহতো সে রকম কড়া হতে পারে না আর ঢোঁড়াইয়ের উপর। কেন যে, তা বোঝে কেবল মহতোগিন্নী আর মহতো- আর অল্প অল্প আন্দাজ করে ঢোঁড়াই।

[১৭১. বিয়ে। ১৭২. ছেলেমেয়েরা। ১৭৩. পৈতা। ১৭৪. গদিযুক্ত। ১৭৫. ভাল আচরণ আর কোথাও রইল না। দেবতা, ব্রাহ্মণ ও গরুকে কেউ আর মানে না। (তুলসীদাস)। ১৭৬. কুটুম্বিতা। ১৭৭. দেখা সাক্ষাত। ১৭৮. বজ্র ১৭৯. দীক্ষাগুরু। ১৮০. ডিস্ট্রীক্ট টুর্নামেন্ট (১৯১৭), যুদ্ধে সাহায্যই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। ১৮১. ইন্টার ক্লাস টিকিট। ১৮২. পোস্টকার্ড। ১৮৩. কানাকড়ি।]

.

ঢোঁড়াইদাসের নতুন জীবিকা

ঢোঁড়াই পাক্কীতে [১৮৪] কাজ করে। তার পাথরে কোঁদা হাতের পেশীগুলি গত দেড় দু বছরে আরও সবল হয়ে উঠেছে। গলার স্বর ভারি ভারি ঠেকে। রাস্তা মেরামতের কাজের সব রহস্য এখন সে জেনে গিয়েছে। বর্ষার আগে ডিরেসিং এ কী করে ফাঁকি দিতে হয়, কী করে কেবল উপরের ঘাস চেঁচে নিয়ে রাস্তার গতাঁর উপর চাপা দিতে হয়, সড়কের ধারের চৌকোণা মাটিকাটা গর্তগুলির মাটি উপর উপর কেটে কী করে অফিসার ঠকাতে হয়, ডাঙা পাথরের স্তূপ মাপবার সময় কেমন করে কাঠি ধরলে মাপে বাড়ে, সব তার জানা হয়ে গিয়েছে। শেষের কাজটাতেই লাভ সবচেয়ে বেশী। এইসব কাজে ওরসিয়র বাবু আর ঠিকেদার সাহেব তাদের বকশিশ করেন; কেবল শর্ত হচ্ছে যে এনজিনিয়র সাহেব কি চেরমেন সাহেব হঠাৎ এসে জেরা করতে আরম্ভ করলে, তাদের গুছিয়ে জবাব দিতে হবে। জেরায় মচকে কি গিয়েছে। তাহলেই জিলা খারিজ [১৮৫]  আর জেরায় উৎরে গেলেই পেট ভরে দহিচুড়ার ভোজ;- চুড়াদহির নয় দহিচুড়ার,-দই বেশি, চিড়ে কম। নুন দিয়ে খাও, কাঁচা লঙ্কা পাবে; মিঠা দিয়ে খেতে চাও গুড় পাবে- ইয়া: দানাদার গুড়, একেবারে লসলস লসলস।

রাস্তায় পাকা অংশটির উপর দিয়ে গরুর গাড়ি থেকে শনিচরারা গাড়োয়ানদের ভয় দেখিয়ে পয়সা আদায় করে। ঢোঁড়াই এ কাজ করতে পারে না, তার ভয়-ভয় করে, গোঁসাই আর রামজী সব দেখতে পাচ্ছেন উপর থেকে। বরঞ্চ একলা থাকলে গাড়োয়ানকে সাবধান করে দেয়। ঢোঁড়াই জানে যে গাড়োয়ানদের কাছ থেকে পয়সা নেওয়া পাপ ঠকাতে হয় সরকারকে ঠকাও, চেরমেন সাহেবকে ঠকিয়ে পয়সা রোজগার করো।

এই সেদিনও দুটো ছেলে গাড়ির রেস দিচ্ছিল। একজনের ছিল বলদের শ্যাম্পনি [১৮৬] আর একজনের খোলা গরুর গাড়ি। তুমুল উৎসাহের সঙ্গে তারা দুজনে পাল্লা দিচ্ছে, আর শ্যাম্পনির গাড়োয়ানটা হাসতে হাসতে বলছে, এইও! যে গাড়ির স্প্রিং নেই সে গাড়ি মাটির উপর দিয়ে চালাও, পাকা রাস্তা থেকে নামো শীগগির।

ওরে আমার হাওয়া-গাড়ি ওয়ালারে!

জলদি নিচে ভাগে, কাচ্চীতে [১৮৭]!

–দুটো চাকাতেই যে ফুলে কুপো [১৮৮]। চারটে চাকা থাকলে না জানি কী করতিস। একখানা হাওয়া-গাড়ি আসুক না পিছন থেকে; অমনি সটকদম হয়ে যাবে। শুড় শুড় করে নেমে আসতে হবে নালায়েক এর [১৮৯] পাশে।

ঢোঁড়াই তাদের দুজনকেই রাস্তার কাঁচা অংশটিতে নেমে আসতে বলে।

–তুই কোন ডিস্টিবোডের নাতি যে আমাদের মানা করতে এসেছিস? প্রত্যেক বছর আমরা বলে জিরানিয়া বাজারে ফসল নিয়ে আসি বেচতে। তোদের সর্দারকে পয়সা দিয়ে এই আসছি, এখানে থেকে কোশভরও হবে না; আর তুই কোন ক্ষেতের মূলো [১৯০] লাল চোখ দেখাতে এসেছিস আমাদের উপর।

ঢোঁড়াই তাদের বুঝোয়–আরে কথাটাই শোন আমার। খানিক আগেই রোড সরকার আছে; তালে মহলদারের নাম শুনেছিস। রোডসরকার আর সর্দারের মধ্যে সাট আছে। একজন পয়সা দিয়ে যেতে বলে দেয় পাক্কীর উপর দিয়ে; আর একজন খানিক আগেই আবার ধরে পয়সা নেওয়ার জন্যে। তাই নাকি!

 দু-জোড়া সশঙ্ক চোখ আরও বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, সত্যি?

তোমার নাম কী ভাই? আর তোমাদের! ধূসর? সোলৈী থানায়? গল্প জমে ওঠে। খয়নি বেরোয়। সেখানে রাজদ্বার ভাঙ্গার তহশীল কাছারি আছে, প্রকাণ্ড গাঁ-…গুরুজীর ইস্কুল আছে।

ওদের গাড়ি চলে যায়। আবার অন্য গাড়ি এসে পড়ে কাঁচর কাঁচর শব্দ করতে করতে, বলদের গলার ঘন্টা বাজিয়ে, উড়ন্ত ধুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে।

ঢোঁড়াই গান বন্ধ করে আবার তাদের সঙ্গে কথা বলে। কত গাঁয়ের কত আজব আজব খবর শোনে। কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়েছে রাস্তা। এ রাস্তা আরম্ভ কোথায় আর শেষ কোথায় সে জানে না। কেউ জানে না বোধহয়। কোনো গাড়ি আসছে ভুট্টা নিয়ে, কেউ গাড়িতে আসছে কাছারীতে মোকদ্দমা করতে, কেউ আসছে রুগী দেখাতে। দেশের বিরাটত্বের একটা আবছা ছায়া পড়ে তার মনের উপর; তার রাস্তা তোয়ের করার সঙ্গে সঙ্গে এত লোকের এত গাড়ি আসা যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে মোটামুটিভাবে এ জিনিসটা সে বোঝে। পাক্কীতে কাজ না করলে এ জিনিস বোঝা যায় না।

কিন্তু এসব কথা মনে হতে পারে নমাসে ছমাসে, এক আধ মুহূর্তের জন্য। এসবের সময় কোথায়? তার গ্যাং–এর কেউ কেউ গাড়িতে মেয়েছেলে দেখে হয়তো ততক্ষণ রাজকন্যা সুরঙ্গা আর রাজপুত্র সদাবৃচের প্রেমের গান আরম্ভ করেছে। কেউবা হেসে ঢলে পড়ে, এ ওর গায়ে; খোয়ার টুকরো ছুঁড়ে মারবার ভান করে। ঢোঁড়াই সব বোঝে, দেখে মুচকে মুচকে হাসে। একটা রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা এই মেয়ে জাতটা, তার জানতে ইচ্ছা করে, বুঝতে ইচ্ছা করে। সে মুখে একটা নির্লিপ্ত ভাব দেখিয়ে তার কৌতূহল চাপা দিতে চায়। আর মেয়েদের কথা ভাবতে গেলেই কোথা থেকে কখন যে এসে পড়ে যত নষ্টের গোড়া ঐ দুখিয়ার মাটার কথা, বুঝতেই পারে না। দুখিয়ার মা তার কোনো অনিষ্ট করেনি একথা ঠিক। কিন্তু তার উপর যে কোথাও অবিচার করা হয়েছে একথা বুঝবার মতো বুদ্ধি তার হয়েছে। আর মহতোগিন্নী, কিছুদিন থেকে ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে খুব আলাপ জমাবার চেষ্টা করছেন; তিনি ঢোঁড়াই য়ের ছোটবেলার গল্প, বেশ রং চং দিয়ে তাকে শুনিয়েছেন, কয়েকদিন। বাপ মরা ছেলেটাকে গোঁসাইথানে ফেলে দিয়ে, মা গিয়েছিল গটগটিয়ে সাগাই করতে। তাই এতদিন পরে মহতোগিন্নীর মায়ের প্রাণ কেঁদে উঠেছে ঢোঁড়াইয়ের জন্য। পাকা কাঁঠালের ভিতরের বোঁটা দিয়ে তরকারী বেঁধে তিনি ঢোঁড়াই কে আদর করে খাওয়ান, আর ঐ সব পুরনো গল্প করেন। তাঁর হাতে-খড়ম-পরা পঙ্গু মেয়ে ফুলঝরিয়া দূরে বসে বসে শোনে।

দুখিয়ার মা না হয় বদ সে না হয় ঢোঁড়াইকে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু মহতো নায়েবরা সে সময় কী করছিল? তাৎমা জাতটা কী করছিল? বাওয়া ছাড়া আর কেউ তার কথা ভাবেনি কেন? সকলের বিরুদ্ধেই তার অনেক কিছু বলার আছে। আর রামজী বজরংবলী মহাবীজী [১৯১] তারা কি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন? এদের উপরও অভিমান ঘনিয়ে ওঠে তার মনে।

[১৮৪. কোশী শিলিগুড়ি বোর্ডে। ১৮৫. বরখাস্ত। ১৮৬. দুই চাকার একরকম গাড়ি। এই গাড়িগুলোতে সাধারণত লোহার স্প্রিং লাগানো থাকে। ওরে আমার হাওয়া-গাড়িওয়ালারে! ১৮৭. কাঁচা রাস্তায়। ১৮৮. আঙুল ফুলে কলাগাছ-এর স্থানীয় ভাষার ইডিয়ম। ১৮৯. অযোগ্য। ১৯০. সামান্য লোক। মশা বলে কত জল এই অর্থে ব্যবহৃত হয়।]

.

সামুয়র সন্দর্শনে

রাস্তার কাজ করার সময়, ঢোঁড়াইয়ের রাজ্যের কথা মনে আসে। শনিচরার মধ্যে মধ্যে বলে, কী রে ঢোঁড়াই স্বপ্ন দেখছিস নাকি? তোর গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে; এবার একটা সাদী করে ফেল।

 ধেৎ!

ধেৎ আবার কি। তবে মেয়ের বাপকে দেবার টাকার যোগাড় করাই শক্ত। কিরিস্তান হতিস, তো সামুয়রের মতো সাহেবের টাকা পেতিস।

পাদরি সায়েব সামুয়রকে মর্লি সাহেবের বাগানের মালীর কাজে বহাল করিয়ে দিয়েছিলেন। পুরনো নীলকর পরিবারের পর সব সাহেবই চলে যাচ্ছে একে একে জিরানিয়া থেকে। মর্লি সাহেবও কয়েক বছর থেকে যাব যাব করছে। জমি জিরেৎ বেচতে আর করে দিয়েছে অনেকদিন থেকেই। জমির দাম নাকি শীগগিরই কমতে পারে এইজন্য এই বছরটায় সম্পত্তি বিক্রির হিড়িক পড়ে গিয়েছে সাহেবদের মধ্যে। মর্লি সাহেব, তার চাকর-বাকর, ডাক্তার, উকিল, আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেককেই যাওয়ার আগে কিছু কিছু টাকা দিয়ে যাবেন, এ খবর এই অঞ্চলের সকলেই জানে। অনেকের টাকা শোনা যায় পাদরি সাহেবের কাছে জমাও করে রেখে দিয়েছেন। এখন বিসারিয়া কুঠির সম্পত্তিটা সুবিধা মতো দামে বিক্রি করে দিতে পারলেই মর্লি সাহেব চলে যেতে পারেন জিরানিয়া ছেড়ে। শনিচরা এই মর্লি সাহেবের টাকার কথাই বলছিল।

সামুয়রও এখন জোয়ান হয়ে উঠেছে। খাদা খদা মুখটা, কিন্তু সাহেবের মতো টকটকে চেহারা হয়েছে তার। কুঠির সাইকেলে চড়ে ঢোঁড়াইয়ের সম্মুখ দিয়ে, ডাকঘর থেকে সাহেবের ডাক নিয়ে আসে প্রত্যহ। আর শিস দিতে দিতে রোজ সন্ধ্যার সময় তাড়ি খেতে যায়।

ঐ দ্যাখ সামুয়র আসছে। ওর গোঁফ উঠছে দেখেছিস, ভুটার চুলের মতো।

ঢোঁড়াই হেসে ফেলে। সত্যিই সাইকেলে সামুয়র আসছে। মাথায় একখানা রুমাল বাধা।

 রুমাল বেঁধেছে দ্যাখ না-ঠিক ছুরিতালাবেচা ইরানী মেয়েদের মতো। নিশ্চয়ই ডাকঘর থেকে আসছে।

মোচের রেখাটা কামিয়ে নে সাময়র সকলে হেসে ওঠে। সামুয়র সাইকেল থেকে নেমে পড়ে। এরা এক ডাকে সামুয়রকে আসমান থেকে জমিতে এনে ফেলেছে; কত কথা সে সাইকেলে ভাবতে ভারতে আসছিল।…

নূতন আয়াটি দেখতে শুনতে বেশ। আলিজান বাবুর্চির সঙ্গেও তার আশনাই আছে, আবার সামুয়রের সঙ্গেও। গত বছর সাল শেষ হওয়ার রাতে গির্জার হলঘরের পাশের ছোট ঘরে- যে ঘরটায় মতির মার্বেলে মেমসাহেবরা নিজের নিজের তকদীর দেখছিল [১৯২]- সেই ঘরটায় অর্ধেক রাত হবে তখন-বাইরে পোষের শীত, বরফের মতো ঠাণ্ডা কিন্তু ঘরটার ভিতর কী গরম!- আয়ার গাউনটায় কী সুন্দর গন্ধ, মেমসাহেবের শিশি থেকে চুরি করা খোশবায়; অটো দিলবাহারের চাইতেও ভাল গন্ধ, তার সঙ্গে মিশেছে সিগারেট আর পিয়াজের গন্ধভরা আয়াটার নিঃশ্বাস, সেদিনের নেশার ঘোরে সবই মধুর লেগেছিল। বাবুর্চি এক নম্বরের ঘুঘু- বাড়িতে তার দু-দুটো বিবি।…

এদের ডাকে সামুয়র বিরক্ত হয়েই সাইকেল থেকে নামল। ভাল লাগে না এগুলোর সঙ্গে কথা বলতে। সবে সে সিগারেটটা ধরিয়েছে। ভাগ্যে সে কিরিস্তান, না হলে এ লোকগুলো তার মুখ থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়েই টান মারত। রাজার জাত হয়ে লাভ আছে। সেই জন্যেই না আলিজান বাবুর্চি মাংসটা খাওয়ায়; সাহেব তাকে টাকা দিয়ে যাবে বলে; আয়াটার সঙ্গে আলাপ জামাবার সুবিধে হয়।

 ঢোঁড়াই ঠাট্টা করে বলে সামুয়র, তোর সায়েব শুনছি যাবে না?

সামুয়র বলে, ও না গেলেও আমার ভাল, আবার গেলেও ভাল। না গেলে এ আরামের কাজটা তো থাকবে। আর গেলে তো কথাই নেই- টাকা পাওয়া যাবে। সে চিঠি আর খবরের কাগজের তাড়া হাতে নিয়ে আবার সাইকেলে চড়ে।

দেরি হলে সাহেব চটবে। কিছুদিন থেকে দেখছি সাহেবের মেজাজটা যেন ভাদ্রের কুকুরের মতো হয়ে রয়েছে।

 তোরই তো মনিব আবার কেমন হবে?

সামুয়র সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলের উপর ঝুঁকে পড়ে জোরে জোরে পা চালায়, এই গেঁয়োগুলোকে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য।

আরো জোরে চালা। আগের গরুর গাড়িতে লাল শাড়ি দেখেছে, ওকি আর আস্তে চালাতে পারে।

বিরষা বলে- বিলকুল লাখেড়া হয়ে গিয়েছে। আমি দেখছি কিরিস্তান হলেই এমনি হয়। সব বুদ্ধি ছেলেবেলাতেই খরচ হয়ে যায়।

[১৯১. বীর হনুমানের একটি নাম। বজ্রের মতো শক্তি যার।]

.

ফুলঝরিয়ার খেদ ও পাপমুক্তির জন্য প্রার্থনা

ঢোঁড়াই কে নেমন্তন্ন করে খাওয়াচ্ছে মহতোগিন্নী। তার আজকাল খাতির কত। বাবুলাল নাকি মহতোগিন্নীর কাছে বলেছে যে, চেরমেন সাহেব সফরে যাওয়ার সময় হাওয়া-গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় ঢোঁড়াইকে জেরা করেছেন। ঢোঁড়াই জেরার খুব ভাল জবাব দিয়েছে। বাবুলাল সঙ্গে ছিল সেই হাওয়া-গাড়িতে। সেই কথাই মহতোগিন্নী শোনাচ্ছিলেন ঢোঁড়াইকে। ঢোঁড়াই য়েরও এ প্রসঙ্গে উৎসাহ কম নয়। মহতোগিন্নীর সমুখে তার ছিল একটা সংকোচ ভাব। কিছুক্ষণের জন্য ঢোঁড়াই এ ভাব ভুলে যায়। তাকে ধাঙড় পাওনি যে চেরনে সাহেব জেরায় হারিয়ে দেবে! এতদিন তাহলে জাতের বুজুর্গ [১৯৩] দর কাছে থেকে সে কি কেবল পাটকাঠি ভাঙতে শিখেছে। দলের মধ্যে বয়স কম দেখে, তাকেই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল। এমন মুহতোড় [১৯৫] জবাব দিয়েছে যে বাছাধনের চিরকাল মনে থাকবে।… আনন্দে গুদরের মার কাতলা মাছের মতো মুখ থেকে কালো দাঁত দুপাটি প্রায় বেরিয়ে আসে। হঠাৎ তার ঢোঁড়াইকে নুন দেওয়ার কথা মনে পড়ে। ঢোঁড়াইয়ের পাতার পাশেই মাটির খুরিতে নুন রাখা হয়েছে।

ওরে ফুলঝুরিয়া ঢোঁড়াইকে একটু নুন দিয়ে যা। ফুলঝুরিয়া তার মেয়ে। তার পায়ের দিকটা খুব সরু। হাতে খড়ম পরে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সে চলাফেরা করে।

 থাক, থাক, আমি নিজেই নিচ্ছি- বলে ঢোঁড়াই খুরিটা থেকে নুন নেয়।

নিজে নেবে কেন। কী যে বলে আমার বাচ্চা তার ঠিক নেই! ফুলঝুরিয়া কি আর এখন সেই ছোট আছে। এই কথা বলে মহতোগিন্নী নিজের মেয়ের বয়স সম্বন্ধে মেয়ের সম্মুখেই এমন একটি নির্লজ্জ ইঙ্গিত করে যে ফুলঝরিয়ো ও ঢোঁড়াই দুজনই লজ্জা পায়। খট খট করে উঠোনে খড়মের শব্দ হয়। দূরে চলে যাচ্ছে শব্দটা ফুলঝরিয়া বোধহয় বাইরে গেল। তার শরীরের উপরের দিকটা অস্বাভাবিক রকমের পুষ্ট।

ওরে ফুলঝরিয়া! কোথায় গেলি আবার। লজ্জা হয়েছে বুঝি। কোথা দিয়ে যে পরমাত্মা কী করেন, কী রকম যোগাযোগ ঘটান, বোঝা শক্ত। কাকে চালের খাপরা উল্টে দেয়, আর তার থেকে চলে ঘরামির রোজগার। তবে সে জিনিসের সময় আছে। তার খেলাপ হওয়ার জো নেই। জিয়লের ডাল বর্ষাকালে লাগাও, পচে যাবে; আর চোৎবোশেখে পোতো শুখনো ধুলোর মধ্যে তাও লেগে যাবে। এ একটা কথার মত কথা বলেছ গুদরীমাই। হঠাৎ মহতোর গলা শুনে ঢোঁড়াই চমকে ওঠে,- ও তাহলে উঠোনেই আছে। এতক্ষণ সাড়া দেয়নি। মহতোই নিশ্চয়ই তাহলে গুদরের মাকে দিয়ে এই সব করাচ্ছে। গুদরীমাই ডাকসাইটে মেয়েমানুষ ঠিক, কিন্তু এত খাওয়ানো-দাওয়ানো, এত সব, এ মহতোর মতো মাথাওয়ালা লোক পিছনে না থাকলে, একা গুদরীমায়ের দ্বারা সম্ভব হতো না। বাবুলালও হয়তো আছে এর ভিতরে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই। সেই জন্যই না চেরমেন সাহেবের জেরা করার গল্প করেছে। দুখিয়ার মা-টাও থাকতে পারে এর মধ্যে। তিনিও থাকেন সর্বঘটে। এ শিউজীর মাথায় খানিক জল ঢালা, ও শিউজর মাথায় খানিক জল ঢালা, দুনিয়ার শিউজীর মাথায় জল ঢালা তার চাই-ই চাই [১৯৫]।

 ঢোঁড়াই অনেকদিন আগেই মহতোগিন্নীর এত আদর যত্নের উদ্দেশ্য বুঝেছে। সে ধরাছোঁয়া দিতে চায় না।

আর চারটি ভাত নেবে না? ওকি ছাই খাওয়া হল? এই জোয়ান বয়সে ঐ চারটি, ভাতে কী হবে; এই ফুলঝরিয়া আমলকির আচার দিয়ে যা! ও মেয়ের আবার বুঝি লজ্জা হয়েছে। সর্ষে দিয়ে নিজে হাতে আচার করেছে আমার মেয়ে। কোথায় গিয়ে সে মেয়ে বসে থাকল এখন কে জানে। নিজে আচার তৈরি করে, নিজেই দিতে ভুলে গেল। কী যে আমার কপালে ভগবান লিখেছেন কে জানে। গুদরের বাপ আবার সেদিন বলেছিল যে সরকার নতুন কানুন করছে। মেয়ের বিয়ে, তিন ছেলের মা হওয়ার বয়স না হওয়া পর্যন্ত, হতে দেবে না। দিলেই কালাপানির সাজা। ঘোর কলি! এও চোখে দেখতে হলো, কানে শুনতে হল। রতিয়া, রবিয়া, বাসুয়া সবাই কোলের মেয়ের পর্যন্ত বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ভগরাহা থেকে আমার ভাই সেদিন এসেছিল; সে বলল যে সেখানে একজন মুসলমানের বাড়ি একটা বিয়ে হয়েছে, বরকনে দুজনেই এখনও পেটে।

মহতো উঠোন থেকেই ঠাট্টা করে, তোমার ভাইয়ের তো কথা।

আমার ভাই কি মিছে কথা বলেছে। সকলকে নিজেদের মতো মনে করো না। আচ্ছা, আচ্ছা, তোমার ভাই এত সত্যবাদী যে মুখ দিয়ে যে কথা বার করে, তা ফলে যায়। এখন ঐ পেটের দুটোই যদি মেয়ে হয়, কি দুটোই যদি ছেলে হয় তাহলে? তোমাদের গাঁয়ে ও রকম বিয়েও চলে নাকি?

মহতোগিন্নী ভাইয়ের কথা সরল মনে বিশ্বাস করেছিল। সে অপ্রস্তুত হয়ে বলে, আচ্ছা ও কথা যেতে দাও, রবিয়া আর বাসুয়া কোলের মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে কিনা? এখন আমার বরাতে কী আছে জানি না। আমরা তো ধাঙড় না যে সোমত্ত মেয়ে ঘরে রাখব; আর যেসব গরীবগুলোর টাকার অভাবে কনে জোটে না, সেগুলো বদ নজর দেবে তার উপর।…

ঢোঁড়াই উঠে পড়ে। মহতো নিজে তার হাতে জল ঢেলে দেয়। [১৯৬]

ফুলঝরিয়া! ও ফুলঝরিয়া সকড়ি কি তুলতে হবে না?

ফুলঝরিয়া তখন বাড়ির পিছনের কলার ঝাড়ের পাশে বসে আকাশ পাতাল ভাবছে।…কী পাপই না সে আগের জন্মে করেছিল। তারই উপর গোঁসাইয়ের যত আক্রোশ। কোন পাপ সে করেছিল জানে না। তবে কেন সে হাতে খড়ম পরে থাকবে? কেন অন্য দশজনের মতো সে চলতে ফিরতে পারে না? তাৎমাটুলির অন্য। মেয়েরা বলে যে সে রুপের গরবে গত জনে শিউজী-কে [১৯৭] লাথি মেরেছিল, তার বাবা বলে যে সে মদকে দিয়ে নিশ্চয়ই পা টিপিয়েছিল আগের জনে। ছি ছি ছি ছি ছি! কেন তার দুর্মতি হয়েছিল। মরদে টিপবে ঝোটাহার পা! শিউজির মাথায় সে মারতে গিয়েছিল লাথি! শাস্তিই তার হয়েছে। রেবণগুণী কিন্তু বলে অন্য কথা। সে বলে যে ঠিক যেখানটায় সে জন্মায় সেই জায়গাটায় মাটির নিচে নিশ্চয়ই কালো বিড়ালের হাড় আছে। জন্মানোর ছদিনের মধ্যে কাঁকড়াবিছে ভাজা সরষের তেল, ঐ পায়ে মালিশ করতে পারলে; তবে ঐ বিড়ালের হাড়ের দোষ কাটাতে পারত। তা সে সময় তো আর মা বাবা রেবণগুণীকে দেখায়নি। দেখায় ছমাস পরে। তখন আর দেখিয়ে কী হবে। তার বাবাকে ভাগপরবাহার বৈদজী [১৯৮] বলেছিল যে এখনও যদি সদ্য মরা বুড়ো শিয়ালের পেট চিড়ে, তার গরম গরম নাড়িভুঁড়ির মধ্যে পা ঢুকিয়ে বসতে পারা যায়, তাহলে অনেকটা উপকার পাওয়া যেতে পারে। তা ফুলঝড়িয়ার বাবা আজ পর্যন্ত একটাও শিয়াল ধরার ব্যবস্থা করতে পারল না। এতদিন ফুলঝরিয়ার মনে আশা ছিল যে পঙ্গু হলেও তার বিয়ে হয়েই যাবে। কেননা কে না জানে যে তাৎমাদের বিয়েতে মেয়ের বাপ টাকা পায়; আর এই টাকার জন্য কত গরীব তাৎমা বিয়ে করতে পারে না, বহুদিন পর্যন্ত। তার বাবা টাকা যদি না চায়, তাহলেই দুটো রাধা ভাত পাওয়ার লোভে, কত মরদ তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে। কিন্তু এ কি সরাধ-এর কানুনের [১৯৯] কথা শোনা যাচ্ছে কিছুদিন থেকে। মেয়ের বাপ হয়েও খোসামোদ করতে হবে ছেলের বাপকে? ছোট ছোট মেয়ের বাপরা তাৎমা হয়েও বরের বাপের দুয়ারে ধন্না দিচ্ছে। ঘেন্নার কথা, টাকা পর্যন্ত দিতে তৈরী মেয়ের বাপ; টাকা! বুচকুনিয়ার বাপ তো তিন বছরের বুচকুনিয়াটার বিয়ের জন্য অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছ থেকে কর্জই করে ফেলল! তাকে দোষই বা দেওয়া যায় কী করে? সে বেচারা কালাপানি থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছেলের বাপকে টাকা দিয়েছে। এখন এই হাওয়ায়-কে আর ফুলঝরিয়াকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। এই সরাধ-এর কানুন সত্যিই তারই সরাধ-এর (শ্রাদ্ধর) জন্য হয়েছে। আজ যে রোগা, কাল সে মোটা হতে পারে; আজকের ছোট, কাল বড় হতে পারে; কিন্তু হাতে খড়ম পরা মেয়ে কোনোদিনই পায়ে চলতে পারবে না- হাজার শিয়ালের পেটে পা ঢুকিয়ে বসে থাকো। এখনও কি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়নি? না হলে সরকার আবার তাকে শাস্তি দেবার জন্য এ সরাধ-এর কানুন করছে কেন? সরকার তুমিও তো ভাগবান। তোমারই দয়ায় রেলগাড়ি, হাওয়া-গাড়ি চলে। মহাবীরজীর মতো তোমার তাকৎ; চেরমেন সাহেব তোমার খাব্বাস; [২০০]। অত ক্ষমতা যার, তার ফুলঝরিয়ার মতো সামান্য লোকের উপর রাগ কেন?

তার চোখে জল আসে…

এ গে ফুলঝরিয়া! চেঁচিয়ে যে আমার গলা ফাটল, কথা কি কানেই যায় না। বিয়ের কথাতেই মাচার উপর পা উঠল নাকি?

পা তুলবার ক্ষমতাও যদি থাকত-ফুলঝরিয়ার দুচোখ ফেটে জল এসে গিয়েছে। মাকে দেখে সে চোখ মুছে নেয়। দেখে ফেলল নাকি মা?

এত মাকড়সার জাল এই কলা গাছের দিকে; দেখা যায় না অথচ চোখে মুখে লেগে যায়। আজ সকালেও ছিল না। মাকড়সার জাল নাকে লাগলে বড় চুলকোয়; না মা?

[১৯৫. স্থানীয় ভাষায় এর অর্থ-সর্বঘটে বিরাজমান থাকা। আবশ্যক অনাবশ্যক সব কাজেই হাত দেওয়া এবং কোনো কাজই ঠিক করে না করা। ১৯৬. আঁচানোর জল ঘটি থেকে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি নিজে ঢেলে নেওয়া, বাড়ির লোককে অপমান করা বলে গণ্য হয়। ১৯৭. মহাদেব: শিবলিঙ্গ। ১৯৮. হাতুড়ে ডাক্তার। ১৯৯. সর্দা আইনের বিকৃত উচ্চারণ। সরাধ কথাটির শব্দগত অর্থ শ্রাদ্ধ। ২০০. চাকর।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *