১.৩ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ
প্রথম খণ্ড । ভাগ ১ – নিয়তি । পরিচ্ছেদ ৩

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বটি প্রকাশ করেছে কিছু অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সত্য। মানুষ কোনো পশুপ্রজাতি নয়, এটি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। মানব সমাজ এক অর্থে প্রকৃতির বিরোধী; এটা অক্রিয়ভাবে প্রকৃতির অধীনতা স্বীকার করে না, বরং নিজের পক্ষে হাতে তুলে নেয় প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ। এ-দখলকর্মটি অন্তর্গত, মন্ময় কাজ নয়; বাস্তব কাজের ভেতর দিয়ে বস্তুগতভাবে এটা সম্পন্ন করা হয়।

তাই নারীকে শুধু একটি লৈঙ্গিক প্রাণী হিশেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না, কেননা জৈবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সেগুলোরই রয়েছে গুরুত্ব, যেগুলো কর্মকাণ্ডে পরিগ্রহ করে বাস্তব মূল্য। নারীর আত্মচেতনাকে শুধুই তার কাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না : এটা প্রতিফলিত করে এমন এক পরিস্থিতি, যা নির্ভরশীল সমাজের আর্থনীতিক সংগঠনের ওপর, যেটা আবার নির্দেশ করে মানবমণ্ডলি অর্জন করেছে। প্রযুক্তিগত বিবর্তনের কোন পর্যায়। আমরা দেখেছি জৈবিকভাবে নারীর দুটি মূল। বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : বিশ্বে তার আয়ত্তি পুরুষের থেকে কম বিস্তৃত, এবং সে তার প্রজাতির কাছে অধিকতর দাসত্বে বন্দী।

কিন্তু আর্থনীতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে এসব সত্য ধারণ করে বেশ ভিন্ন মূল্য। মানুষের ইতিহাসে বিশ্বের ওপর অধিকার কখনোই নগ্ন শরীর দিয়ে সংজ্ঞায়িত হয় নি : হাত, তার বিরোধসমর্থ বৃদ্ধাঙ্গুলি নিয়ে, হয়ে ওঠে হাতিয়ারের পূর্বরূপ, যা বৃদ্ধি করে ক্ষমতা; প্রাক-ইতিহাসের অতিপ্রাচীন দলিলেও মানুষকে দেখা যায় সশস্ত্ররূপে। যখন ভারি লাঠি উঁচিয়ে ধরে দূরে রাখা হতো বন্যপশুদের, তখনও নারীর শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে সুস্পষ্ট নিকৃষ্টতারূপে : যদি হাতিয়ারটি ব্যবহারের জন্যে দরকার হতো একটু বেশি শক্তি, তাহলে এটাই দেখিয়ে দিতো সে শোচনীয়ভাবে শক্তিহীন। তবে কৌশল হয়তো লোপ করে দিতে পুরুষ ও নারীর পেশিগত অসাম্য : বিশেষ প্রয়োজনেই উদ্ধৃষ্টতার অভাব পূরণ করা হয় প্রাচুর্য দিয়ে, এবং খুব বেশি থাকা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকার থেকে ভালো নয়। তাই আধুনিক অনেক যন্ত্র চালানোর জন্যে দরকার পড়ে পেশিশক্তির অতিসামান্য অংশ; এবং যা ন্যূনতম দরকার, তা যদি নারীর সামর্থ্যের থেকে বেশি না হয়, তাহলে সে হয়ে ওঠে, একাজের ক্ষেত্রে, পুরুষের সমান। আজ অবশ্য একটি বোতাম টিপেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বিপুল শক্তি। বিভিন্ন দেশের প্রথানুসারে মাতৃত্বের ভার এখন ধারণ করে বিভিন্ন রকম গুরুত্ব : এটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার মতো হয় যদি নারীটি বাধ্য হয় ঘনঘন গর্ভধারণে ও কারো সাহায্য ছাড়াই সন্তান লালনপালনে; কিন্তু সে যদি স্বেচ্ছায় সন্তান ধারণ করে এবং গর্ভধারণের কালে যদি সমাজ এগিয়ে আসে তার সাহায্যে ও উদ্যোগী থাকে সন্তানের কল্যাণের ব্যাপারে, তাহলে মাতৃত্বের ভার হয় লঘু এবং কাজের অবস্থাগুলোর সুবিধামতো বিন্যাস করে পুষিয়ে নেয়া যায়।

এ-পরিপ্রেক্ষিতেই এঙ্গেলস নারীর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে, এবং দেখিয়েছেন যে এ-ইতিহাস প্রধানত নির্ভর করেছে কৌশলের ওপর। প্রস্তর যুগে, যখন যৌথভাবে জমির মালিক ছিলো গোত্রের সমস্ত সদস্য, আদিম কোদাল ও নিড়ানির অবিকশিত অবস্থার জন্যেই কৃষির সম্ভাবনা ছিলো সীমিত, তাই নারীর শক্তি ছিলো উদ্যানপালনের উপযুক্ত। আদিম এ-শ্রমবিভাজনে দুটি লিঙ্গ গড়ে তুলেছিলো দুটি শ্রেণী, এবং এ-দুটি শ্রেণীর মধ্যে ছিলো সাম্য। পুরুষ যখন শিকার করে ও মাছ ধরে, নারী তখন থাকে বাড়িতে; তবে গৃহস্থালির কাজের মধ্যেও থাকে উৎপাদনশীল শ্রম—হাঁড়িপাতিল তৈরি, তাঁত বোনা, বাগান করা এবং ফলত আর্থনীতিক জীবনে নারী পালন করে বৃহত্তর ভূমিকা। তামা, টিন, ব্রোঞ্জ, ও লোহা আবিষ্কার ও লাঙলের উদ্ভবের ফলে কৃষিকর্মের সীমা বৃদ্ধি পায়, এবং বনপরিষ্কার ও জমি চাষের জন্যে দরকার হয়ে পড়ে নিরবচ্ছিন্ন শ্রম। তখন পুরুষ আদায় করে নেয় অন্য পুরুষের শ্রম, যাদের সে পরিণত করে দাসে। দেখা দেয় ব্যক্তিগত মালিকানা : দাসের ও জমির প্রভু, পুরুষ হয়ে ওঠে নারীরও মালিক। এটা ছিলো নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। নতুন হাতিয়ার আবিষ্কারের ফলে পুরোনো শ্রমবিভাজন বিপর্যস্ত করে এটা ঘটে। সে-একই কারণ, যা নারীকে দেয় গৃহের কর্তৃত্ব–যেমন, গৃহস্থালিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া–সেই একই কারণ পুরুষকে দেয় আধিপত্য, কেননা এর পর নারীর গৃহস্থালির কাজ পুরুষের উৎপাদনশীল কাজের পাশে হয়ে ওঠে তুচ্ছ–পরেরটি হয় সব কিছু, আগেরটি হয়ে ওঠে তুচ্ছরূপে গৌণ তখন মাতৃ-কর্তৃত্ব নিজের অধিকার তুলে দেয় পিতৃ-কর্তৃত্বের কাছে, কেননা পিতার কাছে থেকে পুত্র পেতে থাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার; আগের মতো আর নারীর কাছে থেকে তার গোত্র পায় না সম্পত্তির উত্তরাধিকার। এখানেই আমরা দেখতে পাই সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তি করে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের উদ্ভব। এ-ধরনের পরিবারে নারী হয় পরাভূত। নিজের সার্বভৌমত্বের মধ্যে পুরুষ, আরো অনেক কিছুর সাথে, নিজেকে লিপ্ত করে কামলীলায়–সে সঙ্গম করতে থাকে দাসীর বা বারবনিতার সাথে বা করতে থাকে বহুবিবাহ। যেখানে সম্ভব হয়, স্ত্রীরা প্রতিশোধ নিতে থাকে অসতীত্বের মধ্য দিয়ে বিয়ে তার স্বাভাবিক সার্থকতা লাভ। করে ব্যভিচারে। যে-গার্হস্থ্য দাসীত্বে বন্দী নারী, তার বিরুদ্ধে এটাই তার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়; এবং এ-আর্থনীতিক পীড়ন থেকেই উদ্ভূত হয় সামাজিক পীড়ন, যা ভোগ করতে হয় তাকে। যে-পর্যন্ত না এই দু-লিঙ্গ আইনে সমান অধিকার পাবে, সেপর্যন্ত সাম্য পুনপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; কিন্তু এ-সমানাধিকারের জন্যে দরকার সাধারণ শ্রমে নারীর অংশগ্রহণ। তখনই শুধু নারীর মুক্তি ঘটতে পারে, যখন সে বৃহৎ সামাজিক মাত্রায় অংশ নিতে পারবে উৎপাদনে এবং গৃহস্থালির কাজে অংশ নেবে খুবই কম মাত্রায়। এবং এটা সম্ভব হয়েছে শুধু আধুনিক কালের বৃহৎ শিল্পে, যেটা শুধু ব্যাপক হারে নারীশ্রম কাজেই লাগায় না, বরং এটা আনুষ্ঠানিক ভাবে চায়…

তাই নারীর নিয়তি ও সমাজতন্ত্রের নিয়তি পরস্পরের সাথে গভীরভাবে বাধা, যা বেবেলের নারী সম্পর্কিত মহাগ্রন্থেও দেখানো হয়েছে। নারী ও সর্বহারা, তিনি বলেন, উভয়ই উৎপীড়িত। উভয়কেই মুক্ত করতে হবে আর্থনীতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে, যা ঘটবে শিল্পযন্ত্রপাতির মধ্য দিয়ে সংঘটিত সামাজিক অভ্যুত্থানের ফলে। নারীর সমস্যাকে পরিণত করা হয়েছে শ্রমে তার সামর্থ্যের সমস্যার পর্যায়ে। যখন কৌশল ছিলো তার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তখন প্রভাবশালী থেকে, যখন সে তা ব্যবহার করতে পারে নি তখন সিংহাসনচ্যুত হয়ে, আধুনিক কালে নারী পুনরুদ্ধার করে পুরুষের সাথে তার সাম্য। প্রাচীন পুঁজিবাদী পিতৃসুলভ শাসনের প্রতিরোধের ফলে অনেক দেশেই এ-সাম্য বাস্তবায়িত হতে পারছে না; যখন এ-প্রতিরোধ ভেঙে পড়বে, তখন এটা বাস্তবায়িত হবে, সোভিয়েত প্রচার অনুসারে যা ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এবং যখন সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তখন আর কেউ পুরুষ বা নারী থাকবে না, সবাই হবে সমান মর্যাদার শ্রমিক।

এঙ্গেলস যে-চিন্তাধারার রূপরেখা তৈরি করেছেন, তা যদিও আমাদের আলোচিত চিন্তাধারাগুলো থেকে নির্দেশ করে অগ্রগতি, তবু এ আমাদের হতাশ করে–সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোকেই এখানে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। সব ইতিহাসের বাঁক নেয়ার বিন্দু হচ্ছে গোষ্ঠিগত মালিকানা থেকে ব্যক্তিগত মালিকানায় উত্তরণের পথটুকু, এটা কীভাবে ঘটেছে তা এতে কোনোভাবেই নির্দেশ করা হয় নি। এঙ্গেলস নিজে পরিবারের উদ্ভব-এ ঘোষণা করেছেন যে বর্তমানে আমরা এ-সম্বন্ধে কিছুই জানি না; ঐতিহাসিক বিস্তৃত বিবরণ সম্বন্ধে তিনি শুধু অজ্ঞই নন, এমনকি তিনি কোনো ব্যাখ্যাও দেন নি। একইভাবে, এটাও স্পষ্ট নয় যে ব্যক্তিগত মালিকানাই অবধারিতভাবে নারীদের বন্দী করেছে দাসত্বে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এমন সব ঘটনাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিয়েছে যেগুলোর ব্যাখ্যা দরকার : এঙ্গেলস আলোচনা না করেই ধরে নিয়েছেন যে স্বার্থের বন্ধনই পুরুষকে গ্রথিত করে সম্পত্তির সাথে; কিন্তু এ-স্বার্থ, যা সামাজিক সংস্থাসমূহের উৎস, তার উৎস কোথায়? তাই এঙ্গেলসের বিবরণ অগভীর, এবং যে-সব সত্য তিনি প্রকাশ করেছেন, সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাচক্ৰজাত, আকস্মিক। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সীমা পেরিয়ে না গিয়ে আমরা ওগুলোর অর্থ নির্ণয় করতে পারি না। আমরা যেসব সমস্যা তুলেছি, এটা সেগুলোর সমাধান দিতে পারে না, কেননা এগুলোর বিষয় সম্পূর্ণ মানুষ, শুধু সে-বিমূর্তকরণ : হোমো ওএকোনোমিকাস নয়।

উদাহরণস্বরূপ, এটা স্পষ্ট যে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাটি বোধগম্য হতে পারে শুধু অস্তিত্বশীলের আদি অবস্থার প্রসঙ্গে। কেননা এটা বোঝা যায় যে প্রথমে এমন। একটা অবস্থা ঘটেছিলো, যখন অস্তিত্বশীল নিজের অস্তিত্বের স্বায়ত্তশাসন ও পার্থক্য ঘোষণার জন্যে নিজেকে মনে করেছিলো একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা। এ-ঘোষণা থেকে গিয়েছিলো মন্ময়, অন্তর্গত, বৈধতাহীন, যতো দিন তার এটা কাগতভাবে বাস্তবায়নের কৌশলগত উপায় ছিলো না। উপযুক্ত হাতিয়ার ছাড়া বিশ্বের ওপর সে নিজের কোনো ক্ষমতা বোধ করে নি, প্রকৃতিতে ও নিজের গোত্রে সুপ্ত অবস্থায় সে নিজেকে বোধ করেছে অক্রিয়, সন্ত্রস্ত, অবোধ্য শক্তিরাশির ক্রীড়নক। কঠিন ও উৎপাদনশীল শ্রমের অভিজ্ঞতার মধ্যে ব্রোঞ্জ আবিষ্কারই মানুষকে সমর্থ করে নিজেকে স্রষ্টা হিশেবে আবিষ্কার করতে; প্রকৃতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর সে আর তাকে ভয় পায় নি, এবং নানা বাধা পেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সে সাহস পায় নিজেকে স্বায়ত্তশাসিত সক্রিয় শক্তি হিশেবে দেখার এবং ব্যক্তি হিশেবে আত্মসিদ্ধি অর্জনের।

আবার, তার নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ঘোষণাই সম্পত্তি ব্যাখ্যার জন্যে যথেষ্ট নয় : প্রতিটি সচেতন ব্যক্তি কি, সংগ্রাম, এবং একক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রয়াস চালাতে পারে নিজেকে সার্বভৌমত্বে উন্নীত করার।

সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার ফলেই ঘটেছে নারী উৎপীড়ন, এ-সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোও অসম্ভব। এখানেও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। তিনি দেখেছেন যে নারীর পেশিগত দুর্বলতা প্রকৃত নিকৃষ্টতার ব্যাপার হয়ে ওঠে শুধু ব্রোঞ্জ ও লৌহ হাতিয়ারের সম্পর্কে এসে; কিন্তু তিনি দেখেন নি যে শ্রমের সীমিত সামর্থ্যই নারীর জন্যে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে ওঠে অসুবিধাজনক। নারীর অসামর্থ তার বিনাশ ডেকে আনে, কেননা পুরুষ নারীকে বিবেচনা করেছে তার সমৃদ্ধিলাভ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু কেননা নারী উৎপীড়িত হয়েছে, এ পরিকল্পনাও ব্যাখ্যা করার জন্যে যথেষ্ট নয়, কেননা দু-লিঙ্গের মধ্যে শ্রববিভাজন হয়ে উঠতে পারতো একটা প্রীতির সম্পর্ক। যদি মানুষের চেতনায় না থাকতো অপর নামে একটি আদি ধারণা এবং অপর-এর ওপর আধিপত্যের এক আদি আকাঙ্খা, তাহলে ব্রোঞ্জের হাতিয়ার উদ্ভাবনের ফলে নারীপীড়ন ঘটতো না।

এঙ্গেলস এ-পীড়নের বিশেষ ধরনটিও ব্যাখ্যা করেন নি। দু-লিঙ্গের বৈরিতাকে তিনি দিতে চেয়েছেন শ্রেণীসংগ্রামের রূপ, তবে এ-উদ্যোগে তিনি ছিলেন নিরুদ্যম; তাঁর তত্ত্ব একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা সত্য যে লিঙ্গানুসারে শ্রমবিভাজন ও পরিণামে পীড়ন মনে জাগিয়ে তোলে শ্রেণী অনুসারে সমাজবিভাজনের ধারণাটি, তবে এ-দুটিকে গুলিয়ে ফেলা অসম্ভব। এক দিকে, শ্রেণীবিভক্তির কোনো জৈবিক ভিত্তি নেই। আবার, শ্রমিক তার অতিপরিশ্রমের মধ্যেও প্রভুর বিপরীতে সচেতন থাকে নিজের সম্বন্ধে; এবং সর্বহারারা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সব সময়ই পরখ করে নিয়েছে তাদের অবস্থা, এবং শোষকদের জন্যে তৈরি করে রেখেছে একটি হুমকি। এবং তারা চেয়েছে একটি শ্রেণী হিশেবে নিজেদের অবলুপ্তি। ভূমিকায় আমি দেখিয়েছি নারীর পরিস্থিতি কতো ভিন্ন।

যা আরো গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সরল বিশ্বাসে নারীকে শুধু শ্রমিক হিশেবে গণ্য করা যায় না; কেননা তার প্রজননগত ভূমিকা তার উৎপাদন সামর্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তিগত জীবনে যতোটা সামাজিক অর্থনীতিতেও তার থেকে কম নয়। কোনো কোনো পর্বে, সত্যিই, ভূমিকৰ্ষণের থেকে সন্তান প্রসব অনেক বেশি উপকারী। এঙ্গেলস সমস্যাটিকে উপেক্ষা করেছেন শুধু এ-মন্তব্য করে যে সমাজতান্ত্রিক। জনগোষ্ঠি লোপ করবে পরিবার প্রথাকে–এটা নিশ্চিতভাবেই একটি বিমূর্ত সমাধান। আমরা জানি উৎপাদনের অব্যবহিত প্রয়োজন ও জনসংখ্যাবৃদ্ধির প্রয়োজনের মধ্যে সম্পর্কের অদলবদলের ফলে কতো ঘনঘন এবং কতো মৌলভাবে সোভিয়েত রাশিয়াকে বদলাতে হয়েছে পরিবার সম্বন্ধে তার নীতি। তবে পরিবার প্রথা লোপ করা মানেই নারীর মুক্তি নয়। স্পার্টা ও নাটশি শাসনের উদাহরণ প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হতে পারে নারী।

নারীর অবস্থা যে-সমস্যা তুলে ধরে, তাতে খুবই ব্ৰিত বোধ করবে একটি প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা, যা স্বাধীনতা খর্ব না করে সমর্থন করে ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র লুপ্ত না করে ব্যক্তির ওপর দেয় দায়িত্ব। গর্ভধারণকে কোনো দায়িত্ব, কোনো কাজ, বা সামরিক পেশার মতো কোনো পেশার সাথে সমীকরণ খুবই অসম্ভব নাগরিকদের চাকুরির বিধিমালার থেকে সন্তানের জন্যে দাবি নারীর জীবনকে বিপর্যস্ত করে অনেক তীব্রভাবে–কোনো রাষ্ট্রই কখনো বাধ্যতামূলক সঙ্গমের বিধান দেয় নি। সঙ্গমে ও মাতৃত্বে নারীর জন্যে জড়িত থাকে সময় ও শক্তির থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবোধ। যৌক্তিক বস্তুবাদ বৃথাই চেষ্টা করে কামের এ-নাটকীয় বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করতে; কেননা কামপ্রবৃত্তিকে কোনো বিধিমালার অধীনে আনা অসম্ভব। সত্যিই, যেমন ফ্রয়েড বলেছেন, এটা নিশ্চিত নয় যে এটা নিজের ভেতরেই বহন করে কি না নিজের সন্তুষ্টির অস্বীকৃতি। যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে এটা সমাজের সাথে সংহতির অনুমতি দেয় না, কেননা কামে আছে সময়ের বিরুদ্ধে এক বিশেষ মুহূর্তের দ্রোহ, আছে সর্বজনীনের বিরুদ্ধে ব্যক্তির দ্রোহ।

নারীকে প্রসবে সরাসরি বাধ্য করার কোনো উপায় নেই : যা সম্ভব, তা হচ্ছে তাকে ফেলতে হবে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে তার জন্যে মাতৃত্বই একমাত্র পরিণতি–আইন বা লোকাচার দিতে পারে বিয়ের আবশ্যিক বিধান, নিষিদ্ধ করতে পারে জন্মনিয়ন্ত্রণ, বিবাহবিচ্ছেদকে করতে পারে অবৈধ। এসব প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক বিধিনিষেধ আজ আবার ফিরিয়ে আনছে সোভিয়েত ইউনিয়ন; রাশিয়া পুনরুজ্জীবিত করছে বিয়ের পিতৃশাসনসুলভ ধারণাকে। এটা করতে গিয়ে সে নারীকে আবার নির্দেশ দিচ্ছে নিজেকে কামসামগ্রি করে তুলতে : সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় রাশিয়ার নারী নাগরিকদের অনুরোধ করা হয়েছে তাদের কাপড়চোপড়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে, প্রসাধন ব্যবহার করতে, স্বামীদের বশে রাখার জন্যে ছেনালিপনার আশ্রয় নিয়ে তাদের কামাগ্নি জাগিয়ে রাখতে। এ-ঘটনা স্পষ্ট নির্দেশ করে যে নারীকে শুধু একটি উৎপাদনের শক্তি হিশেবে গণ্য করা অসম্ভব : পুরুষের জন্যে সে কামের সঙ্গী, প্রসবকারিণী, কামসামগ্রি–এক অপর, যার ভেতর দিয়ে পুরুষ খোঁজে নিজেকে। নারীর অবস্থা বোঝার জন্যে আমাদের তাকাতে হবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পেরিয়ে, যা পুরুষ ও নারীকে আর্থ এককের বেশি কিছু বলে গণ্য করে না।

একই কারণে আমরা ফ্রয়েডের যৌন অদ্বৈতবাদ ও এঙ্গেলসের আর্থনীতিক অদ্বৈতবাদ উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করি। মনোবিশ্লেষক নারীর সমস্ত সামাজিক দাবিকে বিশ্লেষণ করেন পুরুষসুলভ প্রতিবাদ বলে; অন্য দিকে, মার্ক্সবাদীর কাছে নারীর কাম কম-বেশি জটিল, পরোক্ষভাবে, প্রকাশ করে তার আর্থনীতিক পরিস্থিতি। তবে ভগাঙ্কুরীয় ও যোনীয় ধারণাগুলো, বুর্জোয়া বা সর্বহারা ধারণাগুলোর মতোই বাস্তব নারীকে সার্বিকভাবে ব্যক্ত করতে সমান অসমর্থ। মানুষের আর্থনীতিক ইতিহাসের তলে যেমন থাকে, তেমনি সব ব্যক্তিগত নাটকের তলে আছে এক অস্তিত্ববাদী ভিত্তি, যা আমাদের পূর্ণরূপে বুঝতে সাহায্য করে সত্তার সে-বিশেষ রূপকে, যাকে আমরা বলি মানবজীবন। মানুষের সম্পূর্ণ বাস্তবতার সাথে জড়িত না করা হলে কাম ও প্রযুক্তি কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে না। এ-কারণেই ফ্রয়েডের সুপার-ইগোর নিষেধগুলো আর ইগোর উদ্যমগুলোকে ঘটনাচক্ৰজাত বলে মনে হয়, এবং এঙ্গেলসের নারীর ইতিহাসের বিবরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকাশগুলো রহস্যময় ভাগ্যের খেয়ালখুশিতে ঘটেছে বলে মনে হয়। আমাদের নারী আবিষ্কারের উদ্যোগে জীববিজ্ঞান, মনোবিশ্লেষণ, ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কিছু কিছু অবদানকে আমরা। প্রত্যাখ্যান করবো না; তবে আমরা ধারণা পোষণ করবো যে শরীর, কামজীবন, ও প্রযুক্তির সম্পদগুলো মানুষের জন্যে ততোটাই আছে, তাদের সে যতোটা উপলব্ধি করে নিজের অস্তিত্বের সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতে। পেশিশক্তির, শিশ্নের, হাতিয়ারের মূল্য সংজ্ঞায়িত হতে পারে শুধু এক মূল্যবোধের বিশ্বে; এটা নিয়ন্ত্রিত হয় সে-মৌল পরিকল্পনা দিয়ে, যার সাহায্যে মানুষ খোঁজে সীমাতিক্রমণতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *