১.২ সে এক বিচিত্ৰ উপাখ্যান

বলে—সে এক বিচিত্ৰ উপাখ্যান।
জয় বিষহরি গ! জয় বিষহরি!
চাঁদো বেনে দণ্ড দিল।
তোমার কৃপায় তরি গ!
অ–গ!
চম্পাই নগরের ধারে
সাঁতালী পাহাড় গ!
অ–গ!

ধন্বন্তরি মন্তে বাধা
সীমেনা তাহার গ!
অ–গ!

বিরিখ্যে ময়ূর বৈসে
গত্তে গত্তে নেউল গ!
অ–গ!

বিষবৈদ্য বৈসে সেথায়
বাণ্ডুলা বাউল গ!
অ–গ!

ধন্বন্তরি সাঁতালী পাহাড়ের সীমেনায় সীমেনায় গণ্ডি কেটে দিয়েছিলেন মন্ত্ৰ পড়ে। ভূত পেরেত পিশাচ রাক্ষস ডাইন ডাকিনী বিষধর সেখানে ঢুকতে পারত না। বিশেষ করে পারত না। বিষধর নাগ-নাগিনী, বিচ্ছ-বিছা, পোকা-মাকড়, ভিমরুল-বোলতা, এরা ঢুকলে কি সীমানার মধ্যে পা দিলে, নিশ্চিন্ত মরণ ছিল—ময়ূরে নেউলে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলত। ধন্বন্তরি পৃথিবীর গাছপালা লতাপাতা ফুল-মূল খুঁজে সাত সমুদুরের তলা থেকে, স্বৰ্গলোকের ধন্বন্তরির বাগান থেকে পেয়েছিলেন যত বিষঘনী অর্থাৎ বিষম্ন গাছগাছড়া—সব এনে তার বীজ ছড়িয়েছিলেন এই সাঁতালী পাহাড়ের মাটি-পাথরের গায়ে। ঈশের মূল থেকে বিশল্যকরণী পর্যন্ত। তার গন্ধে সাঁতালী পাহাড়ের নুড়ি-পাথরের মধ্যে বিষ-পাথর থাকত ছড়িয়ে, সমুদুরের ধারের বালির উপর ছড়ানো ঝিনুক শামুক শাঁখের মত। বিষ-পাথর বিষ শুষে নেয় মাটির জল শুষে নেওয়ার মত। সেই বিষঘনী জড়িবুটি লতাপাতার গন্ধে বিষধরেরা চেতনা হারিয়ে। নেতিয়ে পড়ত শিকড়-কাটা লতার মত, বিষ-পাথরের আকর্ষণে তাদের কষ বেয়ে মুখের থলির বিষ গলে বেরিয়ে আসত।

ধন্বন্তরি শিষ্যদের ওপর ভার দিয়েছিলেন সাঁতালী পাহাড়ের। ঊদসদাগর ধন্বন্তরির মিতা–বিষহরির বিবাদী সে—দিয়েছিল সাঁতালী পাহাড়ের নিষ্কর বসবাসের ছাড়পত্র। ধন্বন্তরির শিষ্য বিষবৈদ্যরা সমাজে আসন পেত, সম্মান পেত অঙ্গুৎ ছিল না, বিষঘ্ন লতা পৈতের মত পরতে পেত গলায়। তবু তারা ছিল বিবাগী বাউল; বিষ-চিকিৎসার মূল্য নাই—অমূল্য এ বিদ্যা, ধনলোভীর এ বিদ্যা নিষ্ফল, তারা দক্ষিণা নিত না, মূল্য নিত না–নিত যৎসামান্য দান।

তুরা খাস গো সুধার মধু মোরা খাইব বিষ গ!
অ–গ!
তুদের ঘরের কালসপ্য মোদের গলায় দিস গ!
অ–গ!
আর দিস গো ঘেঁড়া বস্তর মুষ্টি মেপ্যা চাউল গ!
অ–গ!
গুরুর আজ্ঞায় বিষবৈদ্য বাঞ্জুলা বাউল গ!
অ-গ!

মর্ত্যধামের অধিকারী সাতডিঙা মধুকরের মালিক চাঁদো বেনে শিবভক্ত; তবু বাদ করলে শিবকন্যে বিষহরির সঙ্গে। চ্যাঙমুড়ি কাণি, চ্যাঙমাছের মত মাথা, এক চোখ কানা, সাপের দেবতা বিষহরি-মনসাকে কিছুতেই দেবে না পুজো। আরম্ভ হল যুদ্ধ দেবতার সঙ্গে মর্তের অধিকারী সমাজের মাথার মণির বাদ। মহাজ্ঞান গেল, ধন্বন্তরি গেলেন, বিষবৈদ্যেরা হায় হায় করে উঠল, গুরু গেল—অন্ধকার হয়ে গেল তাদের জীবন, মন্ত্রের পাপড়ি ভেঙে গেল। চাঁদো বেনের ছয় ছয় বেটা গেল। বিষবৈদ্যদের শিরবৈদ্য—তারও গেল একমাত্র কন্যা। অপরাজিতা। ফুলের কুঁড়ির মত কালো বরণের কচি মেয়ে, নূপুর পায়ে দিয়ে বাপের বাঁশির তালে তালে নাচছিল, হঠাৎ টলতে লাগল, তারপর পড়ে গেল—মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙল, আর উঠল না। মন্ত্রতন্ত্র জড়িবুটি সব হয়ে গেল মিছে। আকাশ থেকে মা-মনসা হাঁক দিয়ে বললেন যে বিষ তোরা বিষহরির অনুচর নাগ-নাগিনীর বিষ নষ্ট করতে, তাদের জীবন নিতে সাঁতালী পাহাড়ের চারিদিক ছেয়ে রেখেছি—সেই বিষেই গেল তোর কন্যের জীবন।

সাপের বিষের ওষুধ ওই সব লতাপাতা, সেও যে বিষ। যে বিষে বিষক্ষয় করে, সে বিষও যে সাক্ষাৎ মৃত্যু! কোনো লতাতে ধরেছিল রাঙা ফল–কচি মেয়ে সেই টুকটুকে ফল তুলে খেয়ে। তারই বিষে প্রাণ হারালে।

তুমি পুঁতলে বিষ-বিরিক্ষি ফল খাইবে কে?

শিরবৈদ্য বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল। হায় হায় করে উঠল বৈদ্যপাড়া। বললে—

মরুক মরুক চাঁদো বেনে মুণ্ডে পড়ুক বাজ গ!
অ–গ!
এত দেবতা থাকতে হৈল মনসার সঙ্গে বাদ গ!
অ–গ!

ছয় পুত্র গিয়েছে, ধন্বন্তরি গিয়েছে, মহাজ্ঞান গিয়েছে, সাতডিঙা মধুকর গিয়েছে; তবু যার জ্ঞান হয় নাই, তাকে এসব কথা বলা মিছে। আবার ঘরে জন্মেছে চাঁদের মত লখিন্দর—গণকে বলেছে, বাসরে হবে সর্পাঘাত। তবু না। তবু চাঁদো বেনে ভেঙে দিলে সনকার পাতা মনসার ঘট তার হিন্তাল কাঠের লাঠির ঘায়ে। তবু সে লখিন্দরের বিয়ের আয়োজন করলে সায় বেনের কন্যে বেহুলার সঙ্গে। সাঁতালী পাহাড়ে কামিলা দিয়ে তৈরি করালে লোহার গড় তার মধ্যে লোহার বাসরঘর। সেই রাত্রে পালটে গেল বিষবৈদ্যদের ভাগ্য। সে কি রাত্রি! আকাশে মেঘ জমেছে, সেই মেঘের পুরীতে মা-বিষহরির দরবার বসেছে। অন্ধকার থমথম করছে। সেই থমথমে অন্ধকারের মধ্যে বিষবৈদ্যদের লাল চোখ আঙরার টুকরোর মত জ্বলছিল। মধ্যে মধ্যে শিরবৈদ্য তার গম্ভীর গলায় হাঁকছিল-কে? কে যায়? সাঁতালী পাহাড়ের গাছপালার ডালপালা সে হাঁকে দুলে উঠছিল, গাছের ডালে ডালে ময়ূরেরা উঠছিল পাখসাট মেরে, গর্তে গর্তে নেউলেরা মুখ বার করে রোঁয়া ফুলিয়ে নরুনের মত ধারালো সাদা দাঁত বের করে গর্জে উঠছিল সেই হাঁকের সঙ্গে।

মনসার নগেরা এসে দূর থেকে দেখে থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাথা হেঁট করে ফিরে যাচ্ছিল। আকাশে মেঘ ঘন থেকে ঘন হয়ে উঠেছিল—বিষহরির ভ্রুকুটির ছায়া পড়ছিল। বিদ্যুৎ চমকালি ঘন ঘন, মায়ের চোখে ঝিলিক মেরে উঠছিল ক্রোধের ছটা।

এমন সময় সাঁতালীর সীমানার ধারে করুণস্বরে কে কেঁদে উঠল! মেয়েকণ্ঠের কান্না! শুধু মেয়েকণ্ঠই নয় কচি মেয়ের কণ্ঠস্বর; দুরন্ত ভয়ে সে যেন পৃথিবী আকুল করে কেঁদে উঠেছে।

—বাঁচাও গো! ওগো, বাঁচাও গো! আমাকে বাঁচাও গো!

সর্দার বসে ঝিমোচ্ছিল। সে চমকে উঠল। কে? কে এমন করে কাদে! কচি মেয়ে? কে রে?

—মরে গেলাম! মেরে ফেললে! ওগো! শেষের দিকে মনে হল, সে চিৎকারে আকাশে ঘন মেঘও যেন চিড় খেয়ে গেল, পৃথিবী কেঁদে উঠল।

সর্দার হেঁকে উঠল ভয় নাইভয় নাই।

হাতের চিমটে নিয়ে সে ছুটে এগিয়ে গেল। বিষবৈদ্যদের তখন অস্ত্র ছিল বড় বড় লোহার চিমটে, ডগায় ছিল শূলের মত ধার, সে চিমটে দিয়ে নাগরাজকে ধরলেও তার নিস্তার ছিল না। মাথার দিকে থাকত কড়াচলার সঙ্গে সঙ্গে সে কড়াটা চিমটের গায়ে আছড়ে পড়ে বাদ্যযন্ত্রের মত বাজত—ঝনাৎ ঝঝনাৎ ঝন্—ঝনাৎ!

সাঁতালী পাহাড়ের সীমানার ধারে ঠিক ওপারে আট-দশ বছরের ছোট একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। শীতের শেষে উত্তর-বাতাসে অশ্বত্থপাতা যেমন থরথর করে কাঁপে, তেমনি ভাবে কাঁপছে। আর চোখে মুখে তার সে কি ভয়!

ভয় কি সাধে! হিজল বিলের ধারের ভাগীরথীর চরের উপর ঘাসবনের ভিতর বেদের গা–সাঁতালী গাঁয়ের শিরবেদে সেকালের উপাখ্যান বলতে বলতে নড়েচড়ে বসে। তার দুই কাঁধের মোটা মোটা হাড়গুলো নড়ে নড়ে ওঠে বুকের ভিতরের আবেগে; চোখ ওদের ছোট–নরুন–দিয়ে-চেরা লম্বা সরু চোখও বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। বলে—সাঁতালীর সীমানা বরাবর তখন উপরে নিচে যেন গৰ্জনের তুফান উঠেছে। গাছের উপরে ডালে ডালে ঝটপট ঝটপট শব্দ উঠছে, ময়ুরগুলোর পাখসাটের যেন ঝড় উঠছে, ক্যাঁওক্যাঁও শব্দে সব চমকে উঠছে, নিচে মাটিতে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে রোয়া ফুলিয়ে নেউলেরা, ফ্যাসাস শব্দে রব তুলছে, উপরে ময়ূরের মধ্যে মধ্যে দু পায়ের নখ মেলে ঠোঁট লম্বা করে পাক দিয়ে উড়ে এ-ডাল থেকে ও-ডালে গিয়ে বসছে, নেউলগুলোর দাঁতের সারি বেরিয়ে পড়েছে—তাতে ক্ষুরের ধার, অন্ধকারের মধ্যেও আবছা দেখা যাচ্ছে সাদা দাঁতের সারি। আক্রোশ যেন ওই কচি মেয়েটার উপর। ঝাঁপিয়ে পড়লে টুকরো টুকরো করে ফেলবে লহমায়। শুধু অপেক্ষা মেয়েটার পা বাড়াবার।

শিরবেদে এসে দাঁড়াল থমকে। এ কি আশ্চর্য রূপের কন্যে! এ কি রূপ! ন-দশ বছরের মেয়ে; কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, অ্যাঁধার রাত্রেও জলের তলার মানিকের মত ঝিকমিক করছে; হিলহিলে লম্বা; ঝকমকে সাদা দুটি চোখ! তেমনি কি নরম ওর গড়ন, যেন কচি লতা, যেন। কালো রঙের রেশমি উড়ানি, ওকে যদি কাঁধে ফেলে কেউ, কি গলায় জড়ায়, তবে লেপটে জড়িয়ে যাবে।

মেয়েটা কাঁপছিল; সঙ্গে সঙ্গে যেন নেতিয়েও পড়ছিল, সাঁতালী পাহাড়ের শিরবৈদ্যের মনে হল, শিকড়-কাটা একটি কচি শ্যামলতা যেন নেতিয়ে পড়ছে। মেয়েটা শিরবৈদ্যের দিকে আশ্চর্য চাউনিতে চেয়ে বললেও বাবা, আমাকে বাঁচাও, বাবা গো–

শিরবৈদ্য কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল মরা মেয়েকে। সেও এমনি করে শিকড়-কাটা লতার মত নেতিয়ে পড়েছিল। চোখের উপরে দেখতে দেখতে আলে মানে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তার কণ্ঠের স্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর কণ্ঠে সে ডাকলে—বাবা গো!

আর থাকতে পারলে না শিরবৈদ্য। মা! মা গো! বলে দু হাত মেলে পা বাড়ালে। সঙ্গে সঙ্গে ময়ূরগুলো মাথার উপর চিৎকার করে উঠল, নেউলেরা চিৎকার করে শিরবৈদ্যের পথ। আগলে দাঁড়াল। গোটা সাঁতালী পাহাড় যেন শিউরে উঠল। চাঁদো বেনে হিন্তাল কাঠের লাঠি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে চিৎকার করে উঠল—কে?

শিরবৈদ্য থমকে দাঁড়াল। তার উঁশ ফিরে এল।

কে? কে এ অপরূপ কালো মেয়ে! ময়ূরেরা কেন হায় হায় বলে চিৎকার করে উঠল, নেউলেরা কেন না না বলে পথ আগলে দাঁড়াল! কেন শিউরে উঠল সাঁতালী পাহাড়ের মন্ত্ৰপূত মাটি!

গাঙের কূলের ঘাসবনের সাঁতালী গাঁয়ের শিরবেদে এ কাহিনী বলতে বলতে বলে–বিষবৈদ্যেরা তখন বিষবেদে হয় নাই ধন্বন্তরি বাবা। তখন তারা ছিল সিদ্ধবিদ্যের অধিকারী, মন্তরের ছিল মহিমা, সেই মন্তরের বলে, বিদ্যের বলে বুঝতে পারত জীবজন্তু পশুপাখির বাক্; তখন তাদের মন্তরের বলে গাছ উড়ত আকাশে, গাছে চড়ে মন্তর পড়ে বলত-চল্‌ উড়ে; মাটিপাথর চড়চড় করে ফাটিয়ে শিকড়বাকড় নিয়ে গাছ হুহু করে আকাশে উঠত। মন্তর পড়ে গণ্ডি এঁকে দিলে সে গণ্ডি পার হয়ে কারুর যাবার হুকুম ছিল না, হোক না কেন দেবতা, হোক না। কেন দত্যি, যক্ষ বল, রক্ষ বল কারুর না। শিরবৈদ্য বুঝতে পারত ময়ূর-নেউলের বাক, সাঁতালীর মাটির শিউরে ওঠা। হুঁশ ফিরল তার, থমকে দাঁড়াল, ভুরু কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, শুধালে কে তু? অ্যাঁ?

মেয়েটা তখন ভুঁইয়ের উপর বসে পড়েছে—নেতিয়ে পড়েছে। টলছে, বিসর্জনের প্রতিমার মত টলছে। তবু সে কন্যে কোনোমতে বললে তিন ভুবনে আমার ঠাঁই নাই, তিন ভুবনে আপন নাই; ছিল শুধু মা; সেও আমাকে দিলে তাড়িয়ে। মায়ের কাজ করতে নারলাম তাই দিলে তাড়িয়ে। তোমার নাম শুনেছি, তোমার কাছে এসেছি ঠাঁইয়ের জন্যে। তুমি যদি ঠাঁই দাও তো বঁচি, নইলে আমাকে—

হাঁপাতে লাগল সে। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললে—এই নেউলে আর ওই ময়ূরেরা আমাকে। ছিঁড়ে ফেলবে গো! তা ছাড়া এখানকার বাতাসে কি রয়েছে—আমার দম বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে।

শিরবৈদ্য এবার চিনলে। বুকে তার কন্যের শোক, চোখে তার ওই কালো মেয়েটার রূপের ছটায় ধাধা—তবু সে চিনতে পারলে। কালো মেয়ের দাঁত কি মিহি, কি ঝকঝকে, আর মুখ। থেকে কি কটু বাস বেরিয়ে আসছে! বিষবৈদ্যের কাছে কতক্ষণ লুকানো থাকবে কালকূটের গন্ধ?

দু পা পিছিয়ে এল শিরবৈদ্য।

–সর্বনাশী-কালনাগিনী! পালা, পালা, তুই পালা, নইলে তোর পরান যাবে আমার হাতে। ওই মোহিনী কন্যেমূর্তি না ধরে এলে এতক্ষণে তা যেত।

তখন মেয়েটা এলিয়ে পড়ে গিয়েছে ধুলোর উপর। অন্ধকার রাত্রে একছড়া কালে মানিকের হারের মত পড়ে আছে, আকাশের বিদ্যুৎচমকের মধ্যে ঝিকমিক করে উঠছে।

শিরবেদে মহাদেব কাহিনী বলতে বলতে থেমে যায় এইখানে। একটুখানি হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে। মাথা নেড়ে অসহায়তা জানিয়ে আবার বলে—দেবতার সহায় নেয়ত, নেয়তের হাতে মানুষ হল পুতুলনাচের পুতুল বাবা। যেমন নাচায় তেমিন নাচি।

চাঁদো বেনের সঙ্গে বিষহরির লড়াইয়ে নিয়তি বিষহরির সহায়। শিবের ভক্ত চাঁদ, মহাজ্ঞানের অধিকারী চাঁদ নাচলে পুতুলের মত। লখিন্দর জন্মল বাবা, নিয়তি তার কপালে নেখন নিখলে। তাকে এড়িয়ে যাবে শিরবৈদ্য—সে সাধ্যি তার কোথায়? হয়ত সাধ্যি হত যদি থাকত গুরুবল––ধন্বন্তরি থাকতেন বেঁচে। এই ছলনায় ছলবার তরে নিয়তি আগে থেকে ছক সাজিয়ে রেখেছে। কন্যে দিয়েছিল, সেই কন্যেকে কচিকালে কেড়ে নিয়েছে, বুকের মধ্যে তেষ্টা জাগিয়ে রেখেছে, তারপরেতে কালনাগিনীকে ছোট মেয়েটি সাজিয়ে এই কাল রজনীতে তার ছামুনে দাঁড় করিয়েছে। তবু শিরবৈদ্য আপন গুরুবলে বিদ্যেবলে তাকে চিনতে পেরে দু পা এল পিছায়ে। তখন, বাবা মোক্ষম ছলনা এল।

শিরবৈদ্য দেখতে পেলে আরও একটি মূর্তি। ছায়ার মতন। ওই নেতিয়ে-পড়া কালনাগিনীর শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা, সে হল সাক্ষাৎ নিয়তি, মহামায়ার মায়া! একেবারে শিরবৈদ্যের সেই মরা কন্যে। এবারে শুধু শিরবৈদ্যই ভুললে না বাবা, সাক্ষাৎ নিয়তির ছল, তাতে ভুলল সবাই, ময়ূরেরা ভুলল, নেউলেরা ভুলল, সাঁতালী পাহাড়ের মন্তরপড়া মাটি, সেও ভুলল। সবাই স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ছায়ার মত মূর্তিটির দিকে। সেই কন্যে, শিরবৈদ্যের দুলালী, যে ময়ূরদের সঙ্গে নাচত, নেউলেরা যার পায়ে মাথা ঘষত, যার পায়ের মলের ঝমঝমানিতে সাঁতালী পাহাড়ের মন্তরপড়া মাটি তালে তালে দুলে উঠত,–সেই কন্যে।

অবিকল! তিল থুতে তফাত নাই। সেই—সেই!

সে মেয়ে এবার ডাকলে—বাবা!

শিরবৈদ্য এবার হা-হা করে কেঁদে উঠে দুহাত মেলে দিয়ে বললে—আয়, আয় ওরে আমার হারানিধি, ওরে আমার কন্যে, আয় মা, আমার বুকে আয়।

কন্যেমূর্তি ধরে নিয়তি বললে—কি করে যার বাবা! এ যে আমার ছায় মূর্তি! নূতন মূর্তিতে তোমার বুক জুড়াব বলে এলাম কিন্তু তুমি যে আমাকে নিলে না বাবা।

শিরবৈদ্যের চোখ দিয়ে জল গড়াল, ময়ূরেরা বিলাপ করে ঠল, নেউলেরা ফেঁসানি ছেড়ে কুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, গাছের পাতাপল্লব থেকে টপটপ করে ঝর,ত লাগল শিশিরের ফোটা।

কন্যে বললে—নতুন জন্মে আমি নাগকুলে জন্ম নিয়েছি বাবা। এই তো আমার নতুন কায়া, ওই তো পড়ে রয়েছে সে কায়া, সাঁতালীর সীমানায় কালো রত্নহারের মত। তুমি যদি বুকে নাও তবেই এই কায়ায় থাকতে পাব, নইলে আবার মরতে হবে।

বলতে বলতে ছায়ামূর্তি যেন এলিয়ে গলে মিলিয়ে গেল—ওই কালো মেয়ের অচেতন দেহের মধ্যে। মানুষের ছলা, মানুষের মায়া—এ হেঁড়া যায়, কাটা যায়; দেবমায়াও বুঝা যায় বাবা। নিয়তির মায়া—সে বুঝবার সাধ্যি এক আছে শিবের, আর কারুর নাই।

শিরবৈদ্য ভুলল; সে পাগলের মত ছুটে গিয়ে তুলে নিলে কালনাগিনীর কন্যেমূর্তি-ধরা দেহখানি। মনে হল, বুক যেন জুড়িয়ে গেল। নাগিনীর অঙ্গের পরশ বড় শীতল যে! বিষবৈদ্যের দেহে তেমনি জ্বালা। বিষ খেয়ে সে ঝিমোয়, সারা অঙ্গে মাখে বিষহরা ওষুধের রস, গলায় হাতে তার জড়িবুটি; তেল মাখা বারণ; দেহ তার আগুনের মত তপ্ত। নাগিনীর শীতল পরশে দেহ জুড়াল, মনে হল বুকও যেন জুড়িয়ে গেল। শিরবৈদ্য আরও জোরে বুকে জড়িয়ে ধরল কন্যের দেহখানি। কথায় আছে—মরে মানুষ জ্বালা জুড়ায়। তা বাবা নাগিনীর দেহ অঙ্গে জড়ালে ভাবতে হয়—মরণ ঠাণ্ডা বেশি, না, নাগিনী শীতল বেশি?

–তারপর?

প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে হাসে গঙ্গার চরের সাঁতালীর শিরবেদে, ঘাড় নাড়ে গৃঢ় রহস্যোপলব্ধির আনন্দে নিবাসক্তের মত। বলে-তারপর, যা হবার তাই হল, কন্যের মুখে চোখে দিলে মন্ত্রপড়া জল, ওষুধের গন্ধ সহ্য করবার মত ওষুধও দিলে দুধের সঙ্গে। ময়ূরদের বললে—যা যা, চলে যা। হুস—ধা! নেউলদের বললে—যা, তোরাও যা বলে শিস মেরে দিলে ইশারা।

মেয়ে চোখ মেললে। বললে—তুমি আমার বাপ!

শিরবৈদ্য বললে–হ্যাঁ মা, হ্যাঁ। তারপর বললে কিন্তু আমাকে কথা দে মা, আমাকে কখনও ছেড়ে যাবি না।

না না না। তিন সত্যি করলে কালোকন্যে। বললে—তোমার ঘরে আমি চিরকাল থাকব থাকব থাকব। তোমার ঘরে ঝাপিতে থাকব নাগিনী হয়ে, তোমাদের বংশে জন্মাব আমি কন্যে হয়ে। তুমি বাঁশি বাজিয়ে আমাকে নাচাবে আমি নাচব।

শিরবৈদ্য বললে—আকাশে সাক্ষী রইল দেবতারা, মর্তে সাক্ষী রইল নেউলরা ময়ূরেরা আর সাঁতালীর গাছপালা। যদি চলে যাস তবে আমার বাণে হবে তোর মরণ।

–হ্যাঁ, তাই।

এইবার শিরবৈদ্য তাকে পরিয়ে দিলে তার সেই মরা-মেয়ের অলঙ্কারগুলি। পায়ে দিলে মল, গলায় দিলে লাল পলার মালা, হাতে দিলে শঙ্খের কঙ্কণ, তারপর তুলে নিলে তার বশি। বাঁশের বাঁশি নয়, অন্য বাঁশি নয়, এই তুমড়ি-বাঁশি। তার সেই মেয়ে নাচলে নাচন—দুলে দুলে পাক দিয়ে, সে নাচন বিষবৈদ্যের মেয়ে আর নাগকন্যে ছাড়া আর কেউ জানে না। নাচতে নাচতে এসে শিরবৈদ্যের গলা জড়িয়ে ধরে দুলতে লাগল। তার নিশ্বাস পড়তে লাগল শিরবৈদ্যের নাকের কাছে। নাগিনীর নিশ্বাস অন্যের কাছে বিষ, কিন্তু বিষবৈদ্যের কাছে দুঃখহরা চিন্তাহরা আসব। আমরা, বাবা, সাপের বিষ খেয়ে নেশা করে যে সুখ পাই হোক না কেন হাজার কড়া মদ, সে সুখ পাই না। শিরবৈদ্য বুক ভরে নিশ্বাস টানতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতের তুড়ি-বাঁশির সুর এলিয়ে পড়তে লাগল, চোখ দুটি তুলতে লাগল, সারা গা টলতে লাগল, পায়ের তলার মাটি দুলতে লাগল, শেষ খসে পড়ল হাতের বাঁশি।

এবার নাগিনী গান ধরলে গুনগুনিয়ে ঘুমপাড়ানি গানের মত বিষছড়ানি গান।

বাসুকী দোলায় মাথা দোলে চরাচর রে—
তুই ঢল্‌ ঢলে পড়া রে!
সমুদ্রমন্থনে দোলে ও সাত সাগর রে–
তুই ঢল্ ঢলে পড়া রে!
অনন্ত উগারেন সুধা তাই হলাহল রে–
ও তুই ঢল্ ঢলে পড়া রে!
সে সুধা ধরেন কণ্ঠে ভোলা মহেশ্বর রে–
তুই ঢল্‌ ঢলে পড়া রে!
ভোলার চক্ষু ঢুলুঢুলু অঙ্গ টলমল রে–
তুই ঢল্‌ ঢলে পড়া রে!
অনন্ত শয্যায় শুয়ে ঘুমান ঈশ্বর রে—
তুই ঢ ঢলে পড়া রে!

বাবা, অমন ঘুমের ওষুধ আর নাই। ভোলানাথ মহেশ্বর হলেন মিত্যুঞ্জয়, মিত্যুকে জয় করলে কি ঘুম তার কাছে আসে? আসে না। মিত্যুর হেঁয়া হল ঘুম। তোমার আমার অঙ্গের যেমন হেঁয়াতে তোমার আমারই আকার পেকার মিত্যুর হেঁয়াতেও তাই তারই ছোঁয়াচ। নিথর করে দেবে, সব ভুলিয়ে দেবে। তা মিত্যুর হেঁয়া ঘুম মিত্যুঞ্জয়ের চোখে কি পেকারে আসবে বল? আসে না। মিত্যুও নাই, ঘুমও নাই। সদাই জেগে আছেন শিব। কিন্তু ওই নিশ্বাসের নেশায়। সদাই আধঘুমে ঢুলুঢুলু করছেন-মনে কিছুই নাই, সব আছেন ভুলে। আবার দেখ বাবা, ঈশ্বর—তিনি পাতেন অনন্ত-শয্যা ক্ষীরোদসাগরে। অনন্ত নাগের শয্যা ভিন ঘুম আসে না। ঈশ্বরকে ঘুম পাড়ায়, বাবা, ঐ নিশ্বাস। সেই নিশ্বাসে ঢলে ঘুমিয়ে পড়ল শিঃবৈদ্য। শুধু সে কেন? গোটা সাঁতালী পাহাড়। ময়ূরের পাখা হল নিথর, নেউলের দেহ পড়ল নেতিয়ে, সাঁতালীর লতাপাতা ঝিম হয়ে রইল। তখন বের হল সেই ছোট কালো মেয়ে। খুলে ফেললে শিরবৈদ্যের দেওয়া গয়নাগুলি। নিঃশব্দে চলল এগিয়ে। নিঃশব্দে, কিন্তু তীরের মত বেগে। বাসরঘরের লোহার দেওয়ালে কামিলে রেখেছিল ছিদ্ৰ—সেখানে গিয়ে ধরলে নিজের মূর্তি। দাঁড়াল ফণা ধরে, কলক করে খেলতে লাগল জিভ, নিশ্বাসে ছিদ্র বড় হতে লাগল—কয়লার গুড়ো খসে। পড়ল। ছিদ্র বন্ধ ছিল কয়লার গুঁড়ো দিয়ে।

–তারপর?

—তারপর তো তোমরা সব জান গো। জানতে না শুধু বিষবৈদ্যের এই কথা কটি। কি করে জানবে বল? ঘটল রাত্তিরের অ্যাঁধারে। সাক্ষী তো কেউ ছিল না। আর বিশ্বাসই বা কে করবে বল? সকালে বেহুলার কান্না শুনে চাদসদাগর ছুটে এল ডাঙশ-খাওয়া হাতির মত, এসে দেখলে–সোনার লখিন্দর নাই। কাঁদছে বেহুলা, পড়ে আছে নাগিনীর লেজের একটা টুকরো। তখন সর্বাগ্রে সে ছুটে এসেছিল বিষবৈদ্যদের পাড়ায় শিরবৈদ্যের আঙনেতে। তখনও সে ঘুমে অচেতন।

লাথি মারলে চাঁদ। হিন্তালের লাঠি দিয়ে দিলে ফেঁচা। শিরবৈদ্য জাগতেই তাকে বললে–তুই নেমকহারাম। তুই বিশ্বাসঘাতী। তুই পাপী। তুই সাহায্য না করলে, তুই পথ না দিলে পথ। পায় কি করে নাগিনী?

শিরবৈদ্য স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল বণিক মহাশয়ের মুখের দিকে। শুধু একবার দেখে নিলে। চারিপাশ। কোথায় কালো মেয়ে? কেউ কোথাও নাই, শুধু কখানা অলঙ্কার পড়ে রয়েছে চারিদিকে ছড়িয়ে।

মায়া! ছলনা! নিয়তি!

মাথা হেঁট করলে সে দণ্ড নেবার জন্যে।

চাঁদো বেনে শাপান্ত করলে।

–বাক্য দিয়ে বা লঙ্ন করেছিস, বিশ্বাস করেছিলাম সে বিশ্বাসকে হনন করেছিল। তুই, তোর জাত, বাক্যহন্তা, বিশ্বাসহন্তা। যে বাক্ দিয়ে বা রাখে না, তার জাত থাকে না। বিশ্বাস করলে যে বিশ্বাসকে হনন করে তার দণ্ড নির্বাসন। সাঁতালী পাহাড়ে যে নিষ্কর সনদ দিয়েছিলাম সে হল বাতিল; এই পাহাড় থেকে এই সমাজ থেকে এই দেশ থেকে তাদের ঠাঁই আমি কেড়ে নিলাম। শিবের আজ্ঞায় রাজা নিলেন কেড়ে। তোদের বাস গেল, জাত গেল, মান গেল, লক্ষ্মী গেল। শিবের আজ্ঞা, আমার শাপান্ত। তোদের কেউ ছোবে না, ছোওয়া জিনিস নেবে না, বসতির মধ্যে ঠাঁই দেবে না।

চলে গেল সদাগর। সাত পুত্রের শোক বুকে নিয়ে সে তখন পাথর; তার সে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে শিরবৈদ্যের সাহস হল না যে বলে সদাগর, তোমার সাতটি গিয়ে বুক যেমন খালি হয়েছে, আমার একটি গিয়েই তেমনি বুক খালি হয়েছে। বিশ্বাস যদি না কর তো তোমার বুকে হাত দিয়ে আমার বুকে হাত দাও,তাপ সমান কি না দেখ। কিন্তু সে বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ওদিকে তখন চম্পাই নগরে, হায়-হায় উঠেছে। দুয়ারে দুয়ারে লোক জমেছে, নদীর ঘাটে কলার মাঞ্জাস বাধা হচ্ছে; লখিন্দরের দেহ নিয়ে বেহুলা জলে ভাসবেন; মরা লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পেলে তবেই ফিরবেন, নইলে এই ভাসা মরণলোকে ভাসা।

জলে ভেসে যায় রে সোনার কমলা।
হায় গ! হায় গ!
কঠিন নাগিনী তোর দয়া হল না!
হায় গ! হায় গ!

বিষবৈদ্যের জাতি ছিল, কুল ছিল, মান ছিল, খাতির ছিল; কিন্তু লক্ষ্মী ছিল না। চিরটা দিন বাঞ্জুলা বাউল, ওষুধের মূল্য নাই, মন্ত্রগুণের দক্ষিণা নাই। ভগবানের ছিষ্টি আর গুরুর দান–এ বিক্রি করে কি মূল্য নিতে আছে? না, এ দুয়ের মূল্য সোনায় রুপায় হতে পারে?-নিয়ম হল—বিষে জীবন যায় এ সংবাদ যদি কাকের মুখে পাও তো কাককে শুধাবে কোথায়, কার? তারপরে ঘরের চিড়ামুড়ি খুঁটে বেঁধে তৎক্ষণাৎ যাত্রা করবে সেই দিকে। পরান ফিরায়ে দিয়ে ফিরে আসবে ঘর। খালি হাতে যাত্রা, খালি হাতে ফেরা। তাদের ঘরে লক্ষ্মী হবে কোথা থেকে বল? চিরদিনই তারা গরিব। শুধু ছিল জাতি, কুল, মান—তাও গেল সমাজের শিরোমণি লক্ষ্মীশ্বর চাঁদোবেনের শাপে। ব্রহ্মার সৃষ্টির প্রথম থেকে সাঁতালী পাহাড়ে বসতের শাসন-পত্র, তাও হয়ে গেল দেবচক্রে নিয়তির ছলনায় বাতিল। বিষবৈদ্যদের রূপ ছিল সাধুসন্ন্যাসীর মত, তাদের অঙ্গের জড়িবুটি ওষুধের গন্ধ বিষধরের কাছে অসহ্য, কিন্তু মানুষের কাছে সে গন্ধ দিব্যগন্ধ বলে মনে হত। তাদের সে রূপে পড়ল কালি, দিব্যগন্ধ হয়ে উঠল দুৰ্গন্ধ চাঁদোরাজার শাপে। লজ্জায় মাথা হেঁট করে সাঁতালী ছেড়ে, জড়িবুটির বোঝা সাপের ঝাঁপি আর মাটির ভাঁড় সম্বল করে বেরিয়ে পড়ল তারা। সাঁতালীর সীমানা পার হয়ে যেখানে শিরবৈদ্য প্রথম দেখেছিল। সেই মায়াবিনী কালো-কন্যে মূর্তি-ধরা কালনাগিনীকে, সেইখানে এসে থমকে দাঁড়াল শিরবৈদ্য; মনে পড়ল সব। সে আক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠল—আঃ, মায়াবিনী রে! তোর ছলাতে সব হারালাম, তোকেও হারালাম? বাক্ দিয়ে বাভঙ্গ করলি সর্বনাশী।

কাঁধের বকে ঝুলানো ঝাঁপি থেকে শিস দিয়ে কে যেন বলে উঠল–বাবা, না। আমি আছি—তোমার সঙ্গেই আছি।

ঝাঁপি খুলতেই মাথা তুলে দুলে উঠল কালোমানিকের হাড়ের মত ঝলমলানো ছটা নিয়ে। কালনাগিনী কালো কন্যে। ছপাৎ করে ছোবল দেওয়ার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল শিরবৈদ্যের বুকের দিকে। শিরবৈদ্য তাকে জড়িয়ে নিল গলায়। নাগিনী মাথা তুলে দুলতে লাগল শিরবৈদ্যের কানের পাশে। ফোঁসফুসিয়ে কানে কানে বললে–নাগের বাক্যে দেববাক্যে তফাত নাই। বাক্ দিলে। সে বা ফেরে না। চাঁদের আজ্ঞায় তোমাদের বাসভূমি গিয়েছে, মা-বিষহরির আজ্ঞায় তোমরা পাবে নতুন বাসের ঠাঁই। গঙ্গার বুকে ভাসাও নৌকা; মা-গঙ্গা স্বর্গের কন্যে, পৃথিবীর বুকে বেয়ে গেলেও পৃথিবীর বাইরে। গঙ্গার জল যত দূর পর্যন্ত মাটি ঢেকে দেয়, তত দূর মা-গঙ্গার সীমানা। গঙ্গার ধারে পবিত্র পলি-পড়া চরের উপর যেখানে তোমার পছন্দ সেইখানেই ঘর বাঁধ। চাঁদের আজ্ঞা সেখানে খাটবে না। তোমাদের জাতি নিলে, কুল নিলে চাঁদ, মা-বিষহরি তোমাদের দিলেন নতুন জাত, নতুন কুল। তোমরা কারুর ভাত খাবে না; তোমাদের জল, তোমাদের ফুল মা-বিষহরি নেবেন মাথায়। এ জাত তোমার যাবে না। চাঁদের শাপে তোমাদের বর্ণ হয়ে গিয়েছে কালিবর্ণ, মায়ের ইচ্ছায় ওই কালিবর্ণে ফুটে উঠবে আমার বর্ণের ছটা। আমার মা দিয়েছেন ধন্বন্তরির বিদ্যার উপরে নতুন মন্ত্র, যে মন্ত্রে পৃথিবীর জন্তু-জানোয়ার সব বশ মানবে। নাগের দংশন সে যেমন হোক, যদি বিধির লেখা মৃত্যুদণ্ডের দংশন না হয়, তবে সে মন্ত্রে নাগের বিষ উড়ে যাবে কপূরের মত। আর মা দিলেন তোমাকে নতুন অধিকার, তুমি নিতে পাবে গৃহস্থের কাছে পেটের অন্নের জন্যে চাল, অঙ্গ ঢাকবার জন্য বস্ত্ৰ। আর দিয়েছেন অধিকার আমার বিষের উপর এই গেলে নিয়ে তুমি বিক্রি করবে বৈদ্যদের কাছে, তোমার হাতের গেলে নেওয়া বিষ তারা শোধন করে নিলে হবে অমৃত। সে অমৃত সূচ-পরিমাণ দিলে মরতে মরতে মানুষ বেঁচে উঠবে। বান্ধের বা ফুটবে, পঙ্গুর দেহে সাড় আসবে। আর বাবা, আমি যে হয়েছিলাম কাল তোমার কন্যে, চিরকাল তাই থাকব। ঝাপিতে থাকব নাগিনী মূর্তিতে, তুমি আমাকে নাচাবে আমি নাচব; তোমাদের ঘরে সত্যিকারের কন্যে হয়েও জন্মাব। তুমি শিরবেদে, তুমি আমাকে চিনতে পারবে আমার লক্ষণ দেখে। প্রথম লক্ষণ বাবা, পাঁচ বছরের আগে সে কন্যা বিধবা হবে, স্বামী মরবে নাগের বিষে। তারপর ষোল বছর পর্যন্ত সে কন্যের আর বিয়ে দেবে না, ষোল বছরের আগে ফুটবে নাগিনী-লক্ষণ। কাল রাত্রে আমার যেমন রূপ দেখেছ বাবা, ঠিক তেমনি রূপ। তার কপালে তুমি দেখতে পাবে চক্ৰচিহ্ন। সেই কন্যে নেবে তোমাদের বিষহরির পুজোর ভার। তোমাদের কল্যাণ করবে সে, তোমার আজ্ঞাধীন হবে, তোমাকে জানাবে মা-বিষহরির অভিপ্ৰায়ের কথা। চল বাবা, ভাসাও নৌকা; আমি দেখাই তোমাকে পথ।

গাঙ্গুড়ের জলে রাত্রির অন্ধকারে নৌকা ভাসল।
দিনে সকালে বেহুলার মাঞ্জাস ভেসে গিয়েছে।

 

সমস্ত দিন অরণ্যে মুখ ঢেকে থেকে রাত্রে বিষবেদেরা নৌকা ভাসাল—চলল চম্পাই নগর সাঁতালী পাহাড় দেশভূঁই ছেড়ে। গলুইয়ের উপর ফণা তুলে কালনাগিনী বলতে লাগল, এইবার বায়ে ভাঙ বাবা। এইবার ডাইনে। আকাশে মেঘ ওঠে, নাগিনী ফণা তুলে ধরে ছত্র। ওঠে ঝড়, নাগিনী বিষনিশ্বাসে দেয় উড়িয়ে। প্রভাত হয়, শিরবৈদ্য দেখে, সারিবন্দি নৌকার অর্ধেক নাই। নাগিনী বলে, ওরা তোমাকে ছাড়লে বাবা। পতিত হয়ে ওরা থেকে গেল, মাটিতে ঠাঁই রইল না, এখানকার নদীতেই নৌকায় নৌকায় ফিরবে ওরা।

পরের দিন সকালে যখন নৌকা পদ্মাবতীর মাঝামাঝি এল, তখন দেখলে, আরও অর্ধেক নৌকা নাই, রাত্রের অন্ধকারে অকূলে ভাসবার দুশ্চিন্তা সইতে না পেরে চুপিচুপি সঙ্গ ছেড়ে নৌকা বেঁধেছে কোনো ঘাটে। তারাও থাকল সেখানে।

শেষ তিনখানা নৌকা এসে পৌঁছল এই হিজল বিলের ধারে।

নাগিনী বললে—এইখানে আছে মা-বিষহরির আটন। এরই তলায় মা লুকিয়ে রেখেছিলেন। চাঁদোর সাতডিঙা মধুকর।

শিরবেদে বললে—তবে এইখানে ভুঁইয়ে ঘর বাঁধি?

মা-গঙ্গার চরের উপর যেখানে খুশি সেইখানেই বাঁধতে পার। বাঁধ, এইখানেই বাঁধ। হিজল বিলের বুক থেকে নালা-খালার অন্ত নাই। এইখানের মুখে হাঙরের বাস-এর নাম। হাঙরমুখী, ওর পাশে ওইটে হল কুমিরখানা, তার ওদিকে হাঁসখালি।

এ বিলের নালা-খালার অন্ত নাই; কৰ্কটির খাল, চিতির নালা, কাদুনে গড়ানি। হিজলের যে দিকটা লোকে চেনে, এটা সেদিক নয়, সেদিকে আছে আরও কত নালা-খালা।

আমরা এইখানেই ঢুকলাম নৌকা নিয়ে।

তিনখানি নৌকা ঘাটে বাঁধা রইল। ঘাসবনের ভিতর মাচান বেঁধে তুললাম। তিনখানি ঘরে নতুন সাঁতালী গাঁয়ের পত্তন হয়েছিল।

* * *

তিন ঘর থেকে তিরিশ ঘরের উপর বিষবেদের বসতি এখন সাঁতালীতে।

শরতের প্রথমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। মেঘের গায়ে পেঁজাতুলোর বর্ণ ও লাবণ্য দেখা দিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী। দশ দণ্ড রাত্রি পার হয়ে গিয়ে আকাশে কৃষ্ণাপঞ্চমীর চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত; বড় বড় সাদা মেঘের খানা ভেসে যাচ্ছে। নিচে হিজল বিলে পদ্মশালুক পানাড়ীর ফুল ঝলমল করছে। হিজলের ঘন সবুজ ঘাসবনে কাশফুল ফুটতে শুরু করেছে, এখনও ফুলে ফেঁপে দুধবরণ সাদা। হয়ে ওঠে নি। তারও উপর পড়েছে জ্যোৎস্না।

হাঙরমুখীর বাঁকে বাঁকে ঘুরে সাঁতালীর ঘাটে যদি কেউ এখন যেতে পারে, তবে দেখতে পাবে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশখানা নৌকা বাঁধা। নৌকায় নৌকায় আলো জ্বলছে—পিদিমের আলো, কিন্তু লোক নাই। দূরে শুনতে পাবে কোথাও বাজনা। ঘাটে পৌঁছবার আগে থেকেই শুনতে পাবে।

তুমড়ি-বাঁশির একঘেয়ে শব্দের সঙ্গে–বিষম-ঢাকি বাজছে। তার সঙ্গে উঠছে–ঝনাৎ–ঝন–ঝনাৎ-ঝন-বিচিত্র ধাতব ঝঙ্কার। শরীর মন কেমন করে উঠবে সে বাজনা শুনে। তারই সঙ্গে মধ্যে মধ্যে ঠিক তালে তালে সমবেত কণ্ঠের ধুয়া-গান শুনতে পাবে-অ-গ! অ-গ!

আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে শুনতে পাবে মোটা ভরাট গলার গান–

লাচোলাচো আমার কালনাগিনী কন্যে গ!
অগ!
দুঙ্কু আমার সোনা হইল তু মানিকের জন্যে গ!
অ-গ!
কদমতলায় বাজে বাঁশি রাধার মন উদাসী গ!
অ-গ!
কালীদহে কালনাগিনী উঠল জলে ভাসি গ!
অগ!
মোহন বংশীধারীর আমার লয়ন মন ভোলে গ!
অ-গ!
ঝাঁপ দিল কালো কানাই রাধা রাধা বলে গ!
অ-গ!
কালোবরণ কালনাগিনী কালো চাঁদের পাশে গ!
অগ!
কালীদহের জলে যুগল নীলকমল ভাসে গ!
অ-গ!

ঘাটে এসে বাঁধ নৌকা। সাবধানে নেম। অনেক বিপদ। সামনে পাবে এক-ফালি সরু পথ। দুপাশে ঘাস বন; এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তাটি। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তা। আজই চেঁচেছুলে পরিষ্কার করেছে। রাস্তায় দাঁড়ালেই পাবে ধূপের মিষ্ট গন্ধ। ধূপের সঙ্গে ওরা দেবদারুর আঠা আর মুথা ঘাসের গোড়া শুকিয়ে গুঁড়ো করে মেশায়। বাজনা এবার উচ্চ হয়ে উঠেছে, একঘেয়ে সুরে বেজেই চলেছে।

ঝনাৎ-ঝন ঝনাৎ-ঝন ঝনাৎ-ঝন।
চিমটের মাথায় কড়া বাজাচ্ছে। বাজছে মন্দিরার মত তালে তালে—ঝনাৎ-ঝন।
ধুম-ধুম, ধুম-ধুম, ধুম-ধুম।
বিষম-ঢাকি বাজছে।
বিচিত্ৰ তুড়ি-বাঁশি বাজছে—পুঁ-উ-উ-পুঁ-উ-উ-পুঁ-উ-উ।

আজ ভদ্রের শেষ নাগপঞ্চমী। বিষহরির আরাধনা করছে বিষবেদেরা। আজ ওদের শ্রেষ্ঠ উৎসব। উৎসব হচ্ছে বিষহরির আঙনেতে। পূজা হয়ে গিয়েছে দিনে, এখন হচ্ছে গান। গোটা পাড়া গানের আসরে এসে বসেছে, সবাই গাইছে গান। মেয়ে পুরুষ সবাই। শ্রোতা নাই। এগিয়ে চল, এবার শুনতে পাবে নারীকণ্ঠ। একা একটি মেয়ে গান গাইছে—

ও আমার সাত জন্মের বাপ গ—তোরে দিচ্ছি বাক্‌ গ!

সমবেত নারীকন্ঠে এবার সেই ধুয়া ধ্বনিত হয়ে উঠবে—অ-গ!

তোরে ছেড়্যা যাইলে আমার মুণ্ডে পড়বে বাজ গ!
অগ!
এ ঘোর সঙ্কটে তুমি রাখলে আমার মান্যে গ!
অ-গ!
জন্ম জন্ম তোমার ঘরে হইব আমি কন্যে গ!
অ-গ!
তোমার বাঁশির তালে তালে নাচব হেল্যা-দুল্যা গ!
অগ!
আমার গরল হইবে সুধা তুমি বাবা ছুল্যে গ!
অ-গ!

এ গান গাইছে ওদের নাগিনী কন্যা।

কালনাগিনী ওদের ঝাঁপির মধ্যে থাকে, আবার ওদের ঘরে কন্যা হয়েও জন্মায়। বা দিয়েছিল কালনাগিনী:

তোমার বংশ তোমার অ্যাঁপি হইল আমার ঘর গ!
অ-গ!
তুমি না করিলে পর হইব না মুই পর গ!
—অ-মরি-মরি-মরি গ; অ-মরি-মরি গ!

আজও সে বাক্যের অন্যথা হয় নাই। পাঁচ বৎসর বয়সের আগে সর্পাঘাতে বিধবা হয় যে কন্যে, তার দিকে সকল বেদের চোখ গিয়ে পড়ে। বেদের ঘরে মেয়ের বিয়ের কাল হয় অন্নপ্রাশনের পরই। ছমাস থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। বেদের ছেলে সাপ নিয়ে খেলা করে; বেদেদের সাপ নিয়ে কারবার। মনসার কথায় আছে–নরে নাগে বাসা হয় না। সাঁতালী গাঁয়ে সেই নরে-নাগে বাস। সেবার মধ্যে অপরাধ হয়, নাগ দংশন করে; বিষহরির বরে—সে বিষ মন্ত্রবলে ওষুধের গুণে নেমে যায়। কিন্তু নিয়তির লেখায় যে দংশন হয় তার উপায় নাই। মৃত্যু এসে নাগের দন্তে আসন পেতে বসে; নাগের বিষের মধ্যে মিশিয়ে দেয় নিজের শক্তিকে। নৌকার মাঝি মরে জলে, কাঠুরে মরে গাছ থেকে ডাল ভেঙে পড়ে, যুদ্ধ যার পেশা সে মরে অস্ত্রাঘাতে।

শিরবেদে বলে—মৃত্যু বহুরূপী বাবা। মানুষের ছেষ্ট কামনার দব্য অন্নজল, তার মধ্যে দিয়েও সে আসে। বেদের মিত্যু সাপের মুখের মধ্যে দিয়ে আসবে, তাতে আর আশ্চর্যি কি! তাই যারা মরে সাপের দংশনে, তাদের বউয়েরা সবাই কিছু নাগিনী কন্যে হয় না। যে হয় ধীরে ধীরে তার অঙ্গে লক্ষণ ফুটে ওঠে। বেদের জাতে বিধবার বিয়ে হয়, আবার ছাড়-বিচারও আছে। কিন্তু এই সব কন্যের সাঙা ষোল বছরের আগে হয় না। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত চোখ থাকে এই কন্যেদের ওপর।

নতুন নাগিনী কন্যে দেখা দিলেই পুরনো নাগিনী কন্যেকে সরতে হয়। গাঁয়ের ধারের ছোট একখানি ঘরে গিয়ে আর-জন্মের ভাগ্যের জন্যে মা-বিষহরিকে ধেয়ায়।

একজন শিরবেদের আমলে দু-তিন জন নাগিনী কন্যার আসন পার হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *