1 of 2

১.১৫ সুবৰ্ণর লজ্জা নেই

সুবৰ্ণর লজ্জা নেই, কিন্তু সুবর্ণর বিধাতার বোধ করি কিছু পরিমাণ লজ্জা অবশিষ্ট ছিল, তাই হঠাৎ একটা নতুন ঢেউ আনিয়ে কটা দিনের জন্যে অন্তত ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন সুবৰ্ণরুক্ষণাৎ আবার ভাতের হাঁড়ির ধারে পাঠিয়ে দিলেন না তাকে।

হঠাৎই।

হঠাৎই প্ৰকাশচন্দ্র দেশের মহামারীর খবর নিয়ে এসে আছড়ে পড়ল।

প্লেগ।

আবার প্লেগ! যে প্লেগ ক-বছর যেন আগে শশান করতে বসেছিল দেশটাকে!

কলেরা, বসন্ত তবু ভালো। কিন্তু প্লেগ?

ওরে বাবা, সাক্ষাৎ যম!

পালাও পালাও।

যে যেখানে পারো পালাও! দক্ষিণের লোক উত্তরে এসো, পুবের লোক পশ্চিমে। চললো সেই

কলকাতার বাইরে যেখানে যত লোক আছে, তাদের বাড়ি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। আগত আগন্তুকে। যাবেই তো।

প্লেগ থেকে রক্ষা পেতে যে সব অসহায় আত্মীয় ছুটে এসে পড়েছে, তাদের তাড়িয়ে দেবে কী করে তারা?

সব বৌরাই বাপের বাড়ি কি মাসীর বাড়ি, নিদেনপক্ষে পিসির বাড়িও ছুটেছে।… শুধু সুবৰ্ণলতার ব্যাপার আলাদা।

সুবৰ্ণলতার বাপের বাড়ি নেই। বাপের গুষ্টির কেউ নেই ঠাঁই দেবার।

তবে?

সুবৰ্ণলতা কোথায় গিয়ে রক্ষা পাবে?

সুবৰ্ণলতার শাশুড়ী পর্যন্ত নবদ্বীপে গুরুপাটে গিয়ে উঠেছেন। চাপা তার সঙ্গে যাবে কিন্তু সুবৰ্ণলতা আর তার ন্যানজারি। কটা?

সুবৰ্ণলতা বলল, আমি মরব না, এ প্রমাণ তো হয়ে গেছে, প্লেগ আবার কী করবে। আমার?

কিন্তু সেটা তো কাজের কথা নয়।

পুরুষেরা যে কোনো মুহূর্তে পালাতে পারে, শহরের অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠলে পালাবেও। অফিস-কাছারিও তো খোলা থাকবে না। আর বেশিদিন, তালা পড়ল বলে। স্কুলগুলো তো বন্ধ হয়েই যাচ্ছে। ইঁদুর দেখলেই মারার বদলে, দেখামাত্রই মরে যাচ্ছে লোকে।

তা সেই অবস্থায় তুমি লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষ কোলে কাঁধে পাঁচটা আর জঠরের অভ্যন্তরে একটা আপোগণ্ড নিয়ে পুরুষদের পায়ে বেড়ি হয়ে বসে থাকবে? তুমি তো বলছি তোমার ছেলেদের অন্য কারো সঙ্গে পাঠিয়ে দাও! কে নেবে ভার?

বলে নিজের ভারেই অস্থির লোকে!

ওদের নিয়েই মরতে চাও?

বটে! ওরা তোমার খাস তালুকের প্রজা! তাই মারতে ইচ্ছে হলে মারবো! ওদের বাঁচাবার দুইড্রোমায় চলে যেতে হবে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে যেখানে এই রাক্ষসী মহামারীর থাবা C

কিন্তু কোথায় সেই জায়গা?

সহসা সুবর্ণর ভাসুর সুবোধচন্দ্ৰ বাতলে দিল সেই জায়গা।

চাঁপতা!

সুবালার বাড়ি।

সম্প্রতি দেখে এসেছে সুবোধ, দেখেছে দৈন্যের মধ্যেও সুখের সংসার সুবালার। গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ, বাগানে তরকারি, ক্ষেতে ধান।

তবে দৈন্যটা কোথায়?

দৈন্যটা নগদ টাকায়। তবু মনে দৈন্য নেই সুবালার আর তার বরের। এই তো মা-ভাই সাতজন্মে। খোঁজ নেয় না, একবার অসুখ শুনে ভাই একটু দেখতে গিয়েছিল বলে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে।

কী যত্ন! কী আদর!

সুবৰ্ণকে অনাদর পেতে হবে না।

যে মানিনী উনি, যেখানে সেখানে থাকতে পারবেন না তো।

তাই তো প্রকাশের বৌয়ের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়িতে যাবার কথা হয়েছিল একবার, সুবর্ণ হলো রাজী?

এই বেশ।

এই ঠিক জায়গা।

সুবোধচন্দ্র নিজেই হঠাৎ হাল ধরলো।

রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে নেপথ্যের উদ্দেশ্যে বলল, মেজবৌমা, আমার ইচ্ছে নয়। তুমি এই মড়কের সময় এখানে থাকো, সুবালার কাছে গিয়ে থাক দু-দশদিন।

একটা ছেলে ঘর থকে বলে ওঠে, জেঠাবাবু, মা বলছে, সবাই চলে গেলে আপনাদের রোধে দেবে কে?

সুবোধ হেসে উঠে বলে, ও হরি, এই কথা! সে যা হয় হবে। বামুনদের ছেলে দুটো ফুটিয়ে নিয়ে খেতে পারা যাবে না? তাছাড়া আমরাই বা আর কদিন? এ শহরে যা অবস্থা হয়ে উঠছে ক্ৰমশ…যাক, ওই কথাই থাকল।

ছেলেটা বলল, আচ্ছা জেঠাবাবু, তুমি যা বলছি তাই হবে।

তাই হবে!

সুবৰ্ণ বলছে তাই হবে!

অবাক কথা বৈকি!

তবু রীতিমত স্বস্তির কথা।

সবাইকে স্বস্তি দিয়ে সুবর্ণ তার প্রায় অপরিচিত ননদের বাড়ি যাত্রা করে মড়কের হাত থেকে বাঁচতে।

মরার জন্যেই যার আজীবন আকিঞ্চন।

 

কেউ বোধ হয় ছুটে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে, সুবালা ভিজে শাড়ি সপসপিয়ে জলভর্তি ঘড়াটা কাখে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এক মিনিটে এসে হাজির।

দুম করে ঘাড়াটা দাওয়ায় বসিয়ে সেই ভিজে কাপড়েই একটা পেন্নাম ঠুকে উল্লসিত স্বরে বলে ওঠে, মেজদা গো, তোমাদের কলকেতায় পেলেগ। এসেছিল, তাই না। এই কাঠকুড়ুনীর কুঁড়োয় মহারাণীর পদধূলি পড়লো!

সুবৰ্ণ তার বয়সে বড় মান্যে ছোট ননদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। দেখল ব্যঙ্গ নয়, কৌতুক। হুল নয়, মধু।

মনটা জুড়িয়ে গেল।

চোখ জুড়োচ্ছিল রেলগাড়িতে উঠে পর্যন্ত। এই গ্রামে নেমে পর্যন্ত। গরুর গাড়িতে আসতে হয়েছে খানিকটা, সেও তো পরম লাভ। সুবৰ্ণ তো যতক্ষণ তাদের গলি ছেড়েছে, ততক্ষণ ওই কথাই ভেবেছে।

ভাগ্যিস কলকাতায় প্লেগ এসেছিল!

কে বলতে পারে, সেই ভয়ঙ্কররূপী সুখদাতা না এলে সুবর্ণর জীবনে কখনো আর রেলগাড়ি চড়া হতো। কিনা।

হয়তো হতো না।

অতএব গ্রাম দেখাও হতো না। আর কখনো।

কিন্তু সুবর্ণ কি কখনো গ্রাম দেখে নি?

দেখেছে বৈকি।

সেই তার পিতৃভূমি বারুইপুর গ্রাম।

সেও এমনি ছায়া-সুশ্যামল নিভৃতে শীতল বাংলার পল্লীগ্রাম। কিন্তু সুবর্ণর স্মৃতিতে সে ছায়া কেবল অন্ধকার। সে শ্যামলিমায় দাবদাহ। হায়, সুবর্ণ যদি সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবার সঙ্গে ঠাকুমার কাছে যাব বলে না নাচতো!

সুবৰ্ণর দেখা গ্রামের স্মৃতিতে সুবর্ণর জীবনের অভিশাপ জড়িত, তবু এই মাঠ পুকুর ফল বাগান, ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়, সব কিছু তার সবুজের সমারোহ। আর শীতলতার স্পর্শ নিয়ে সুবৰ্ণকে যেন মায়ের মেহের স্বাদ যোগাচ্ছিল।

খাস কলকাতার বৌ না হয়ে সুবর্ণ যদি এরকম এক গ্রামের বৌ হতো!

গরুর গাড়িতে আসতে আসতে বলেও ফেলেছিল সুবৰ্ণ সে কথা।

আমার যদি এরকম একটা পাড়াগায়ে শ্বশুরবাড়ি হতো!

প্ৰবোধচন্দ্র অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে মোহভঙ্গ করিয়ে দিতে বিদ্রপহাস্যে বলেছিল, বল কি! তোমার মতন আলোকপ্ৰাপ্তার এই পচা পাড়াগা পোষাতো? এখানের মেয়েরা স্বপ্নেও কখনো দেখেছে বৌমানুষ বসে খবরের কাগজ পড়ে? বৌমানুষ রাতদিন মুখে মুখে তর্ক করে? বৌমানুষ দেশের কথা ভেবে মাথা গরম করে?

সুবৰ্ণ দৃপ্তকণ্ঠ বলেছিল, দেখে নি, দেখতো।

হুঁ! তা হলে আর ভাবনা ছিল না। সে বৌকে টেকিতে ফেলে কুটতো। শহরের দোতলায় পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকবার সুখ জুটলে সবাই অমন পাড়াগার শোভা দেখতে পায়। ক্ষারে কাপড় কাচতে কাচতে আর টেকিতে পাড় দিতে দিতে জান নিকলে যেত!

সুবৰ্ণ মৃদু তীক্ষ্ণ হাসির সঙ্গে বলেছিল, তেমন নিকলোলে একটা সুবিধে তো রয়েছেই। দীঘিপুকুর! ঝাঁপ দিলেই নিশ্চিন্দি!

প্ৰবোধচন্দ্ৰ সহসা স্ত্রীর একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠেছিল, তোমায় এখানে আনা দেখছি ঠিক হয় নি। সর্বনেশে মেয়েমানুষ তুমি, তোমায় বিশ্বাস নেই!

ছোট ছেলেমেয়েরা সকৌতুকে দেখছিল, বাবা মার হাত ধরেছে। দশ এগারো বছরের ভানু কানু দুই ভাই যেন লজ্জিতও। সুবৰ্ণ সেটা অনুভব করে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্ৰবোধ ছাড়ে না। ভয়ানক আতঙ্কিত গলায় বলে, তুমি এই আমায় গা ছয়ে দিব্যি কর, ওসব দুর্মতি করবে না!

সুবৰ্ণ মৃদু হেসে বলে, দুর্মতি যদি করি, এই পৃথিবীর সঙ্গে তো সব সম্পর্কই চুকে যাবে, গা ছুঁয়ে দিব্যির আর কি মূল্য থাকবে?

প্ৰবোধ আহত হয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, ওঃ! তাই বটে। তুমি তো আবার সম্পর্কটা যে জন-জন্মান্তরের সে কথা মানোই না!

তুমি মানো? সকৌতুকে প্রশ্ন করে সুবৰ্ণ।

প্ৰবোধ সতেজে বলে, হিঁদুর ছেলে হয়ে জনেছি, মানবো না! সবই মানি।

আচ্ছা তা হলে তো এ কথাও মানো, অপঘাতে মলে ভূতপেত্নী হয়?

আলবৎ মানি। না হলে আর শাস্ত্ৰে বলত না অপঘাতে অনন্ত নরক!

তবেই তো। সুবৰ্ণ হেসে ওঠে, আমি ধর অপঘাতে মরে অনন্ত নরকে পচছি, তুমি মহত্তর বলে স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্ৰত্ব করছ, তখন? তখন ওই জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্কটার গতি?

কুতার্কিক মেয়েমানুষের সঙ্গে কেউ কথায় পারবে না!

বলে রাগ করে মুখ হাঁড়ি করে বসেছিল প্ৰবোধ। কিন্তু সুবর্ণ তা নিয়ে বিচলিত হয় নি। সুবর্ণ দেখছিল গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট মাটির কুড়ে, তার সামনের উঠানে তুলসীমঞ্চ, পিছনে গোয়াল। উঠানগুলি মাটিল্যাপা, গোয়ালগুলি খড়ের চালের, ছবির মতই সুন্দর।

এই সৌন্দর্যকে লালন করছে তো গ্রাম তার হৃদয়ারস দিয়ে।

চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল।

তবু মনের মধ্যে ছিল একটা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। যেখানে যাদের কাছে যাচ্ছে, তারা নিকট-আত্মীয় হলেও দূরত্বের ব্যবধান অনেকখানি। সুবৰ্ণরা তো সাতজন্মেও ওদের নাম মুখে আনে না। সুখের সময় তাদের বিস্মৃত হয়ে থেকে অসুবিধের সময় গলায় এসে পড়া, এর চাইতে নির্লজ্জতা আর কী আছে?

মেজননদ যদি সেই নির্লজ্জতার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখায়! যদি বলে, কিগো, এখন বুঝি দায়ে পড়ে রায়মশাই? দরকারে পড়ে বোন? বলা তো অসম্ভব নয়!

যে কেউই এ অবস্থায় বলতে পারে এ কথা।

তার উপর আবার সুবালা মুক্তকেশীর মেয়ে।

কিন্তু মুক্তকেশীর মেয়ে মুক্তকেশীর মত মুখে মুখে উপর্যুক্ত জবাব দেবার জন্যে তৎপর হলো না। সে উল্লাসে পুলকে বলে উঠল, ভাগ্যিস পেলেগ। এসেছিল, তাই মহারাণীর পদধূলি পড়লো!

কান জুড়িয়ে গেল সুবর্ণর, জুড়িয়ে গেল প্ৰাণ।

সুবৰ্ণর আবির্ভাবে কেউ পুলকিত হচ্ছে, এ অনুভূতিটা নতুন।

সুবৰ্ণ এর স্বাদ জানে না।

সুবৰ্ণ জানে, সুবর্ণর আবির্ভাবও নেই, তিরোভাবও নেই। সে যেখানে বিরাজিত, সেটা তার নিত্যধাম। জানে তার সেই নিত্যধামের চারিপাশের বায়ূমণ্ডল সমালোচনার প্রখর তাপে তপ্ত থাকবে, আর তার মাথার উপরের আকাশ আর পায়ের নিচের মাটি সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেবে, তোমাকে আচ্ছাদন দিয়েছি। এই ঢের, তোমাকে দাঁড়াতে দিয়েছি। এই যথেষ্ট!

সুবৰ্ণ তুমি এলে? কী আনন্দ কী সুখ!

এ ভাষা সুবর্ণর জন্য নয়।

অথচ জগতের দীনীতিতম দীনের জন্যও আছে। এ ভাষা। ভিখারিণী মাও প্রার্থনা করে, নবমী নিশি গো, তুমি আর পোহায়ো না-

সুবৰ্ণর জন্যে এ প্রার্থনা নেই।

সুবৰ্ণ কি মূল্যহীন?

সুবৰ্ণ মূল্যবান হবার সৌভাগ্য থেকে চিরবঞ্চিত?

সুবৰ্ণর মূল্য ধার্য হয়েছে শুধু একটা অভ্যাস-মলিন শয্যায়। সেখানে সুবর্ণর জন্যে আগ্রহের আহবান অপেক্ষা করে।

কিন্তু সে আগ্রহ কি প্রেমের?

সে আহবান কি পুরুষের?

তা নয়।

সে শুধু অভ্যাসের নেশা।

তাই সে আহবান সুবর্ণর চেতনাকে বিদ্রোহী করে, স্নায়ূদের পীড়িত করে, আত্মাকে জীৰ্ণ করে।

তাই সুবর্ণর মূল্য কি জানে না সুবর্ণ।

তাই এক যৌবন-থাকতে-প্রৌঢ়া, খেটে খেটে শীর্ণ, শ্ৰীহীন মেয়ের এই খুশিটুকু সুবর্ণর প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।

প্ৰবোধ বলে, তা পড়লো পায়ের ধুলো! কিন্তু এই পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে থেকে চিনে তো ফেলেছিস ভাজটিকে? মহারাণীই বটে। এখন মহারাণীর মেজাজ বুঝে চলতে নাজেহাল হ!

আহা, এখনই নয় যাওয়া-আসা নেই তেমন, তা বলে কি দেখি নি। আমি ওকে! সুবালা পায়ের দিকের শাড়ীটা নিংড়ে নিংড়ে জলটা ফেলতে ফেলতে বলে, আমার মা জননীর হাতে পড়লে শিবও বাদর হয়ে ওঠে। গুরুজন নিন্দে করছি না, তবে বুঝি তো।

সুবৰ্ণ অবাক হয়ে তাকায়।

ওই হাতে-পায়ে শির ওঠা, শীর্ণ মুখ, পাতলা চুল, প্রায় বাসনামাজা ঝিয়ের মত চেহারার মানুষটার মধ্যে এমন স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিশক্তি! সুবৰ্ণকে বুঝতে পারে ও!

প্ৰবোধ অবশ্য অবাক হয় না। হেসে বলে ওঠে, শালুক চিনেছেন গোপাল ঠাকুর। তা যাক, বোনাইকে দেখছি না যে?

দেখবে কোথা থেকে? এখন যে মর্নিং ইস্কুল! ছেলে ঠেঙাতে গেছে সেই প্ৰাতঃকালে উঠে। বাড়িও তাই ঠাণ্ডা দেখছ, সবগুলো তো সেই গোয়ালে—

সুবৰ্ণ ফস করে বলে বসে, মেয়েরা?

মেয়েরা? সুবালা উঠোনের দড়ি থেকে গামছাখানা টেনে নিয়ে চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে ওঠে, বড়টা তো শ্বশুরবাড়ি, ছোট তিনটে ওই গোয়ালেই।

ইস্কুলে?

হুঁ। আমার দ্যাওর যে গায়ের লোকের পায়ে ধরে ধরে গাঁয়ে একটা মেয়ে-পাঠশালা বসিয়েছে গো! তা নিজেদের ঘরের মেয়েদের তো আগে পাঠাতে হবে! নচেৎ ফাঁসি!

তোমার দ্যাওর? আহ্লাদে উজ্জ্বল দেখায় সুবর্ণর মুখ, খুব ভাল, তাই না?

ভাল বল ভাল, বাউড়ুলে বল বাউড়ুলে, তবে— সুবালা গলা একটু নামিয়ে বলে, ইদানীং স্বদেশী বাতিকে বড়ভাইকে একটু ভাবনায় ফেলেছে—

ভিজে কাপড় ছাড়তে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় সুবালা। চেঁচিয়ে বলে, হাতমুখ ধুতে যেন ঘাটে যেওনা বাপু, আমি দিচ্ছি জল।

প্ৰবোধ চিন্তিতভাবে বলে, এই হল এক ঝামেলা। ভগ্নীপতির ভাই যদি আবার স্বদেশী-ফিদেশী হয় তাহলেই তো—

কী তা হলে? তোমার ফাঁসি হবে?

আমার কথা হচ্ছে না। তোমাদের রেখে যাব-পুলিসকে তো জানো না, পচা গণ্ডগ্রামের বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে, পুকুরের পাকের নিচে থেকে আসামীকে টেনে বার করে—

কলকাতার রাজরাস্তা থেকেও করছে।

করছে! আমরা তো আর কেউ ওই সব গোয়াতুর্মির মধ্যে মেতে যাই না! বলে গোলমালের টু শব্দটি উঠলে সে পথের দিক দিয়ে হাঁটি না।

সাবধানী প্ৰবোধ আপনি সাবধানতার মহিমায় স্ফীত হয়।

সুবৰ্ণ এখন আর তর্ক করতে বসে না, সুবৰ্ণর মনের মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে, একটা স্বদেশীবাতিক ছেলেকে দেখতে পাবে সে! কত বড় সেই দ্যাওর? বিয়ে হয়েছে? ঘর-সংসারী? মনে হয় না, সুবালা বলেছে বাউণ্ডুলে।

 

এরপরই সুবালা আতিথ্যের ধুম লাগায়। মাজা ঝকঝকে গাড়ুতে জল এনে দেয় হাত-মুখ ধুতে, বড় বড় ফুল কাঁসার রেকাবিতে করে ঢেলে দেয় মুড়ি, নারকেল কোরা, নাড়ু।

ভাইপো-ভাইঝিদের সযত্নে কাছে টেনে টেনে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। আর তারপরই বলে ওঠে, ওই যে আমার দ্যাওর আসছে।…এই খবরদার, কেউ পেন্নাম করতে যাবি না! পেন্নাম করা দেখতে পারে না। দুচক্ষে।

পেন্নাম করা দেখতে পারে না। দুচক্ষে। এও এক অভিনব ভাষা! যা সুবর্ণর কানকে আর একবার শীতল করে। হয়তো বা মুখটাকেও দীপ্ত করে।

কিন্তু প্ৰবোধের কাছে এই আগ্রহন্দীপ্ত মুখমণ্ডল অবশ্যই প্রীতিকর হয় না। হবার কথাও নয়। প্ৰবোধের মনে হয়-ছেলেদের কাটাকে তাদের পিসির কাছে রেখে সুবৰ্ণকে নিয়ে চলে যায়। কে জানতো যে সুবালার সংসারে আবার এরকম একটা সাংঘাতিক জীব আছে!

স্ত্রীকে এরকম একটা বাউণ্ডুলে পরপুরুষের কাছাকাছি রেখে চলে যাওয়ার থেকে তাকে যমের মুখে তুলে দেওয়াও ভাল।

একেই তো নিজের মনের কাছে নিজের দিকের বাটখারা তার হালকা, সুবর্ণর মন যে তার নাগালের অনেক উঁচু তে তা আর জানতে বাকী নেই প্ৰবোধের। কোনোমতে আগলে আগলে রেখে বয়েসকালটা পার করে দেওয়া এই পর্যন্ত!… কিন্তু সেই কালটার ঠিক নির্দিষ্ট সীমারেখাটা কি? বারো বছরের মেয়ে সুবর্ণর, আরও পাঁচটা ছেলে-মেয়ে তার নিচে, তবু তো দেখলে মনে হয় না। বয়েসকালটা চলে যাচ্ছে তার!

সেকালের নবাবরা যে বেগমদের হারেমে পুরে রাখতো, সেটাই ঠিক ছিল। হায়, কোথা থেকে এই প্লেগের হুড়ো এল! আশ্চর্য, প্ৰবোধের এমন বুদ্ধি হলো না যে রেখে যাবার আগে একবার দেখে যায়, জায়গাটা কেমন?

সুবালার সংসারই আছে শুধু, আর বুড়ী শাশুড়ী আছে, এইটাই তো জানা, ওই দ্যাওরটার কথা তো জানা ছিল না।

কক্ষনো যেন না। ওর সামনে বেরোয় সুবর্ণ।

প্ৰবোধ অতএব ভ্ৰভঙ্গী করে স্ত্রীকে ভিতরে যেতে নির্দেশ দেয়, কিন্তু বিফল হয়। সেই ইশারা। সুবৰ্ণও ভ্ৰাভঙ্গীতে জানায়, কেন, হয়েছে কি?

ইত্যবসরে সেই ভয়ঙ্কর জীবটি উঠোনের বেড়ার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে নতুন একটি সংসার দেখে ঈষৎ থমকে দাঁড়ায়।

কিন্তু মুহূর্তই।

সুবালা সহৰ্ষে বলে ওঠে, আমার মেজদা আর মেজবৌ গো! আর এরা ভাইপো-ভাইঝি! এর নাম ভানু, এর নাম কানু, এ চান্নন, এ পারুল, এ খোকা। ডাকনামই জানি বাপু, পোশাকী নাম জানি না। কই চাঁপাকে তো দেখছি না মেজবৌ? হারেকেষ্ট, এতক্ষণ খেয়ালেই আসে নি! সে?

প্ৰবোধ কিছু বলার আগেই ফন্ট করে সুবর্ণ ওই ছোঁড়ার সামনে বলে বসে, সে তার ঠাকুমার সঙ্গে গেছে।

শুনে মাত্র সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় প্ৰবোধের।

কেন?

তোমার তাড়াতাড়ি কণ্ঠসুধা বিতরণ করা কেন? কী দরকার ছিল? ছোঁড়া কি খোকা নাকি? শুটকো হাড়গিাল্লের মত দেখতে, তাই মনে হচ্ছে কম বয়স। সুবর্ণর থেকে ছোট হবে না। কক্ষনো। আর ছোট হলেই বা বিশ্বাস কি? দেখতে খারাপ? তাতেই বা কি? অবিশ্বাসিনী মেয়েমানুষের কাছে ওসব বাধা বাধাই নয়।

হায় হায়, কী কাজই করে বসলো প্ৰবোধ!

আবার কিনা আজই চলে যেতে হবে তাকে! জাহাজঘাটার অবস্থা টলমল, কুলি-কামিন সব পিটটান দিচ্ছে-প্লেগের ভয় যত না হোক, জোর করে টিকে দেওয়া হবে এই ভয়ে।

দু-চারদিন থাকতে পারলে লক্ষ্য করা যেত, আর তেমন বেচাল দেখলে টেনে নিয়ে যাওয়াও যেত। এ যে কিছুই হচ্ছে না।

হচ্ছে না।

অথচ ওদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

হতভাগা ছোঁড়া ফাট করে খোকাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, বাঃ, গ্র্যান্ড দেখতে তো! সকলকেই দেখছি খাসা! মেজবৌদির যত্নের গুণ আছে। হেলদি ছেলের বড় অভাব আমাদের দেশে।

নমস্কার মেজদা, কিছু মনে করবেন না, আমি একটু বেশি কথা বলি। এই যে এই বৌদিটি, আমার নামকরণ করেছেন বাক্যবাগীশ! ওঁকে রাতদিন গঞ্জনা দিই। আমি, ছেলেমেয়েগুলোর হাড়সার চেহারার জন্যে—

হঠাৎ আরো ভয়ানক আরো অসমসাহসিক এক কাণ্ড করে বসে সুবর্ণ।

শুধুই কি অসমসাহসিক?

কুশ্ৰীতা নয়? অসভ্যতা নয়? শাস্ত্রসমাজের বিরোধী নয়? কেন? কেন এই বদমাইশি?

ফট করে বলে বসলো। কিনা, আর আপনার নিজের কী?

আচ্ছা সুবালা তো গায়ের বৌ, সুবালাই বা ভাজকে এই নির্লজ্জতার জন্যে কিছু বলল না কেন? তার মানে বুদ্ধি-সুদ্ধির বালাই নেই। বালাই থাকলে কখনো এর পরও হাসে? হেসে উঠে বলে, ওর কথা বাদ দাও। ও যে দেশোদ্ধার করছে! ওর কি নাইবার-খাবার অবকাশ আছে? অযত্নে অযত্নে অমন পোড়াকাঠের মত দশা—

বৌদি, আমি আপত্তি করছি—, ইয়ারটা বলে ওঠে, একজন ভদ্রমহিলার সামনে কিনা পোড়াকাঁঠ বিশেষণ দেওয়া! মেজদা, দেখুন। আপনার বোনের কাণ্ড!

মেজদা তাঁর বোনের কোণ্ডর দিকে না তাকিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন, এই চন্নন, হচ্ছে কি? এত মুড়ি ছড়াচ্ছিস যে?

বাকি সবাই চমকে ওঠে, থমকে যায়।

তবু চলে যেতে হয়।

প্ৰাণপাখীকে পিঞ্জর ছাড়া করে বনে-জঙ্গলে উড়িয়ে দিয়ে।

উপায় কি?

সত্যি তো পাগল নয় যে বলবে, নিয়ে চলে যাই ওকে!

তবে একটা খবরে একটু ভরসা এসেছে, ছোঁড়া অমূল্যর নিজের ভাই নয়, জ্ঞাতিভাই। অন্য বাড়িতে থাকে। আবার বেশি ভরসাও নেই, —শূন্য একটা বাড়িতে থাকে বলে এ বাড়িতে খায়। সুবালাই ধরে-করে এই ব্যবস্থা করেছে, ওর একমাত্র দেখবার লোক পিসি মরে পর্যন্ত।

বাউণ্ডলে যাকে বলে!

কেউ কোথাও নেই, শূন্য একখানা বাড়িতে একা থাকা!

প্ৰবোধ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, তা বিয়ে করেন নি কেন দয়াময়?

সুবালা দাদার রাগে হেসেই খুন।

হিরোকেষ্ট। ও বিয়ে করবে তো দেশ স্বাধীন করবে। কে?

ফাজলামি। বলি আজ না হয় তুই ওর ভাত রাধছিস। চিরকাল পরের ঘাড় দিয়ে চলবে?

সুবালা আহত হয়।

সুবালা গম্ভীর হয়।

বলে, পর বললে পর, আপনি বললে আপনি, তবে কদিন ভাত রাঁধতে পাবো। ওর, তাই বা কে জানে! কোন দিন যে জেলের ভাত খেতে হয়, এই ভয়ে কাটা হয়ে আছি।

প্ৰবোধের নিজের বোনকেও আদিখ্যেতার জাহাজ মনে হয়। জ্ঞাতি দ্যাওরকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা! আরও বিরক্তস্বরে বলে, আর সেই লোককে বাড়িতে আসতে দিচ্ছিস?

সুবালা অবাক হয়।

আসতে দেব না? কাকে? অম্বিকা ঠাকুরপোকে; কী যে বল মেজদা!

তা তোর না হয় আদর কর্তব্য উথলে উঠল, বলি অমূল্যর হাতে দড়ি পড়লে?

সুবালা বিচলিত হয় না।

সুবালা বলে, নিয়তি ছাড়া পথ নেই মেজদা, সে নিয়তি থাকলে–

আগুনে হাত ড়ুবিয়ে যদি বলি, নিয়তি থাকলে পুড়বে, তবে আর বলবার কিছু নেই— প্ৰবোধ প্ৰায় খিঁচিয়ে ওঠে, তবে কাজটা ভাল হচ্ছে না। এ বাড়িতে ওর যাতায়াত কমাও! খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা অন্যত্র করতে বলতে হবে—

সুবালা হেসে ওঠে।

সুবালা ওর পূজনীয় মেজদার কথা অমৃতং বালভাষিতং হিসেবে গণ্য করে। তাই সুবালা আর তর্ক না করে বলে, পাগল হয়েছ? ওকে খাওয়াতে হয় ধরেবেধে, তিনবেলা না খেলেও ওর খেয়াল থাকে না।

তবে আর কি? কৃতাৰ্থ—, প্ৰবোধ বলে, তোমরা নিজের কপালেও তেঁতুল গুলিছো, ছেলেপুলেদেরও ক্ষতি করছে।… ওইরকম একটা ব্যাড় এগজাম্পল চোখের সামনে—

সুবৰ্ণ এতক্ষণ ভাইবোনের ওই তর্ক-বিতর্ক, স্নেহ-আলাপের মাঝখানে কথা বলে নি। এইবার বলে উঠল, বলল, চোখের সামনে এটা কুদৃষ্টান্ত নয়, বরং মহৎ আদর্শ! মেজঠাকুরঝির ছেলেদের ভাগ্য ভাল যে এমন একটা আদর্শ চোখের সামনে পাচ্ছে।

চমৎকার! যখন পুলিস এসে ঠেঙাতে ঠেঙাতে ধরে নিয়ে যাবে, তখন মহৎ আদৰ্শর লীলা বুঝবে। এমন জানলে আনতাম না তোমাদের!

সুবৰ্ণ তীব্ৰকণ্ঠে বলে, তোমাদের সহোদর বোন যেখানে রয়েছে, সেখানে তোমার বৌ-ছেলে থাকতে পারবে না?

থাকতে পারবে না কেন? বিপদের আশঙ্কা, সেই কথাই হচ্ছে।

সে আশঙ্কা তোমার বোন-ভগ্নীপতিরও আছে–

চুলোয় যাক ওরা—, প্ৰবোধ বলে ওঠে, মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে আমার!

 

তা সেই মাথার মধ্যে জ্বলন্ত আগুন নিয়েই বিদায় নিতে হলো প্ৰবোধকে। উপায় কি? আর সমস্ত রাগটাই শেষ পর্যন্ত সুবর্ণর ওপর পড়ল। সুবৰ্ণই বা আসতে রাজী হল কেন?

এদিকে তো এত জেদ, পাহাড় নড়ে তো জেদ নড়ে না, অথচ ভাসুর একবার অনুরোধ করলেন তো গলে গেলেন! চিরকাল দেখছি, এই আমি হতভাগ্য কেউ নয়, ভাসুরের কথা শিরোধার্য! বদ মেয়েমানুষদের স্বধৰ্মই এই। কেদারবাবুকে নিয়ে কত আদিখ্যেতা। সে বুড়ো আর আসে না। তাই বাঁচা গেছে।

গুরুজন বলে যদি ছেদ্দা করতো তো মাকে আগে করতো। তার বেলায় নয়। তার বেলায় রাতদিন শাশুড়ীর মুখে মুখে চোপা! আসল কথা বেটা ছেলে! সেটা হলেই হলো! যা বুঝছি, সুবালাটা মুখ্যুর ধাড়ি, ওই ঘোড়েল অম্বিকাটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে খাচ্ছে—দাচ্ছে। অতএব সুবালার ওপর ভরসা নেই। ওর চোখের সামনেই অনেক কিছু ঘটে যাবে, টেরও পাবে না।

সুবালার শাশুড়ীটি যে কোথায় থাকেন দেখতেও পাওয়া গেল না। তবু একটা বুড়ো মানুষ ছিল

নাঃ, ওসব বুড়ো-ফুড়োর কর্ম নয়, অমূল্যকেই বলে এলে হতো, তোমার শালাজের বাপু একটু পুরুষ-ঘেষা স্বভাব আছে, চোখে চোখে রেখো।

বলে এলে হতো।

বলা হয় নি।

এ কথা যত ভাবতে থাকে প্ৰবোধ, ততই তার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে।

কী উপায়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় সুবৰ্ণকে?

ভগবান! প্লেগকে যদি আবার তোমার ভাণ্ডারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না পার তো তোমার এই ভক্তপ্ৰজা প্ৰবোধকে প্লেগ দাও! অত বড় একটা কারণ ঘটলে অবশ্যই আনা যাবে সুবৰ্ণকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *