1 of 2

১.১৪ পাত্রের মনের সংবেদনা

চতুর্দশ পাঠ
পাত্রের মনের সংবেদনা (Susceptibility of mind of the subject)

পাত্রকে মোহিত করিতে চেষ্টা পাইবার পূর্বে, কোন্ শ্রেণীর লোক সহজ বশ্য, অর্থাৎ কিরূপ প্রকৃতির লোক সহজে সম্মোহিত হয়, শিক্ষার্থীর তাহা জানা একান্ত প্রয়োজন। যেহেতু সে উহা জানিতে পারিলে অল্প চেষ্টাতেই শিক্ষায় শীঘ্র সাফল্য লাভে সমর্থ হইবে।

মোহিতাবস্থা সম্পূর্ণরূপে পাত্রের মনের সংবেদনা বা গ্রহণ-শক্যতার (mental susceptibility) উপর নির্ভর করে। এই সংবেদনা বা গ্রহণ-শক্যতার একটু বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আমরা দেখিতে পাই, এক এক ব্যক্তির এক এক বিষয়ের প্রতি একটা স্বাভাবিক ভাব প্রবণতা থাকে। যেমন—এক জনের সঙ্গীতে, আর একজনের কাব্যে বা চিত্রাঙ্কণে, আর এক ব্যক্তির হয়ত স্নেহ, দয়া, মায়া, প্রেম ইত্যাদিতে। অপরের দুঃখে রাম যেমন অভিভূত হয়, শ্যাম তেমন হয় না, সে হয়ত অন্ধকার রাত্রিতে পথ চলিতে ভূতের ভয়ে বিহ্বল হইয়া থাকে। মনের উক্ত ভাব গুলিকেই সংবেদনা বলা যায়।

স্ত্রী-পুরুষ মাত্রেরই সম্মোহন শক্তির প্রতি এই সংবেদনা আছে। কিন্তু সকলের উহা সমান পরিমাণে নাই। কাহারও উহা বেশী আর কাহারও অল্প। অধিক সংবেদ্য (susceptible) লোকদিগকে সহজেই সম্মোহন শক্তির বশীভূত করা যায়। আর যাহাদের উহা অল্প, হয় তাহাদিগকে মোহিত করা কঠিন, আর না হয় তাহারা মোটেই সম্মোহিত হয় না। যে সকল স্ত্রী-পুরুষ স্বভাবতঃ সরল বিশ্বাসী অর্থাৎ যাহারা বেশী যুক্তি-তর্কের ধার না ধারিয়া অপরের কোন কথা বা উক্তি সরল ভাবে বিশ্বাস করে, সম্মোহন শক্তির প্রতি তাহাদেরই মনের গ্রহণ শক্যতা বেশী। এবং তাহারাই অক্সাধিক পরিমাণে অপরের সম্মোহন-শক্তির আয়ত্তাধীন হইয়া থাকে। কোন লোককে সম্মোহন করিবার জন্য তাহার মনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সংবেদনা থাকা আবশ্যক। ইহার পরিমাণের অল্পতা বশতঃই সকল লোক বশীভূত হয় না।

মানুষের শৈশবাবস্থায় এই গ্রহণ-শক্যতা অত্যন্ত প্রখর থাকে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ দ্বারা তাহার বিচার-শক্তি বিশিষ্ট বহির্মন পরিস্ফুট ও উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইহা হ্রাস পাইয়া থাকে। এই নিমিত্ত বাল্য, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়াবস্থা ও বার্ধক্যে উহা উত্তরোত্তর হ্রাস পায়—অর্থাৎ শিশু অপেক্ষা কিশোর, কিশোর অপেক্ষা যুবক ইত্যাদি ক্ৰমে অপেক্ষাকৃত অল্প সংবেদ্য। অতএব এই হিসাবে বৃদ্ধগণই সর্বাপেক্ষা কম গ্রহণ-শক্তি বিশিষ্ট; কিন্তু স্বভাবতঃ যাহাদেয় ইহা অধিক, বৃদ্ধ বয়সেও তাহাদের যথেষ্ট সংবেদনা থাকে। শিশু ও অল্প বয়স্ক বালক বালিকাদিগের (যে পর্যন্ত শিক্ষা দ্বারা তাহাদের বিচারবুদ্ধি বিশিষ্ট বহিমন বিকশিত না হইয়াছে) উহা সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে থাকিলেও, মানসিক কিম্বা নৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্য ব্যতীত তাহাদিগকে সম্মোহিত করার কোন প্রয়োজন হয় না; কারণ তাহার অত্যন্ত সহজ বশ্য। অতএব যুবক,প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ, যাহাদের শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ দ্বারা বহির্মন সমধিক পরিমাণে উন্নত হইয়াছে এবং যাহারা আমাদের বৈষয়িক ও সামাজিক জীবন-সংগ্রামের প্রতিদ্বন্দ্বী, কেবল তাহাদিগকেই বশীভূত করিয়া আমাদের উদ্দেশ্য সফল করিতে হইবে। এই সকল ব্যক্তিদিগের মধ্যে আনুমানিক ১০ হইতে ৩০ বৎসর বয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষগণই বেশ সংবেদ্য; সুতরাং শিক্ষার প্রারম্ভে কেবল তাহাদের উপরই চেষ্টা করা উচিত। শিক্ষার্থিগণ উপরোক্ত ব্যক্তিদিগের ২৪ জনকে সম্মোহিত করার পর প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদিগকে লইয়াও চেষ্টা করিতে পারে; কিন্তু তাহারা স্বভাবতঃ অল্প সংবেদ্য বলিয়া প্রথম প্রথম তাহাদের উপর চেষ্টা করিবে না। পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোক স্বভাবতঃ অধিক গ্রহণ-শক্তি বিশিষ্ট নহে; সুতরাং তাহারা উভয়েই তুল্যরূপে বশ্য।

যে সকল স্ত্রী বা পুরুষের চোখ কোটর গত (অর্থাৎ গর্তের মধ্যে অবস্থিত) এবং ঘন সন্নিবিষ্ট বা নাসা-মূলের খুব নিকটে স্থিত, সম্মোহন শক্তির প্রতি তাহাদের সংবেদনা অপরাপর লোক অপেক্ষা অধিক। গোলাকার অপেক্ষা দীর্ঘাকার মুখমণ্ডল বেশী সংবেদনার পরিচায়ক।

সাধারণ লোকের ধারণা যে দুৰ্বল লোকেরাই মোহিত হয়, সবল লোকদিগকে সম্মোহিত করা যায়না। এই দুৰ্বলতা যদি মানসিক হয়, তবে উহা সম্মোহনের পরিপন্থী। কারণ দুর্বল চিত্ত লোকেরা আদিষ্ট বিষয়ে মনঃ-সংযোগ করিতে পারে না বলিয়া তাহাদিগকে মোহিত করা যায় না। যাহাদের শরীর দুর্বল কিন্তু মন সবল, তাহাদিগকে সহজেই মোহিত করা যায়। আর যাহাদের শরীর সবল তাহাদের মন সবল

হইলে, তাহারাও উক্ত কারণে সম্মোহনের অযোগ্য। অতএব সম্মোহনের সহিত শরীরিক সবলতা বা দুর্বলতার বিশেষ কোন সম্বন্ধ নাই। উহার সম্পর্ক কেবল মন লইয়া। যাহার মন সবল সে শারীরিক হিসাবে সবল বা দুর্বল হউক, সম্মোহন শক্তির প্রতি তাহার সংবেদনা থাকিলে সে অবশ্য মোহিত হইয়া থাকে।

যাহারা উপযুক্ত পরিমাণে সংবেদ্য ও মোহিত হইতে আন্তরিক ইচ্ছুক এবং সম্মোহনবিদের আদিষ্ট বিষয় মনাযোগের সহিত চিন্তা করিতে সমর্থ ও তাহার অন্যান্য উপদেশগুলিও যথাযথরূপে পালন করিতে যত্নবান থাকে, তাহারাই উত্তম শ্রেণীর পাত্র। আর যাহার মোহিত হইতে অনিচ্ছুক, কিম্বা কাৰ্যকারকের উপদেশ পালন করেন, বা করিতে পারেন, অথবা যাহারা তাহার চেষ্টা বিফল করিয়া স্বীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করিতে আগ্রহান্বিত তাহাদিগকে সম্মোহিত করা কঠিন। এই সম্বন্ধে বিস্তৃত উপদেশ দ্বাদশ পাঠে লিপিবদ্ধ হইয়াছে; সুতরাং এস্থলে উহার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *