1 of 2

১.১৩ বাসনমাজ ঝি হরিদাসী

বাসনমাজ ঝি হরিদাসী পূজোয় পাওয়া কাপড়খানা বাসায় নিয়ে গিয়ে আবার ফেরত দিতে এল।

বলল, নাটুমার্কা কাপড় চলবে নি। ঠাকুমা, ও বিলিতি কাপড় আমাদের বস্তিতে বারণ হয়ে গেছে।

সন্ধ্যের দিকে ইদানীং যেন মুক্তকেশী চোখে একটু কম দেখছেন, তাই সহসা ঠাহর করতে পারলেন না ব্যাপারটা কি। চোখ কুঁচকে ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বললেন, কি বললি! কিসের কি হয়েছে?

বারণ হয়ে গেছে গো ঠাকুমা, বিলিতি কাপড় পরা বারণ হয়ে গেছে! ও পরলে নাকি দেশের শতুরতা করা হবে!

মুক্তকেশী চোখে-কনে যদিই বা কিঞ্চিৎ খাটো হয়ে থাকেন, গলায় খাটো হন নি। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, কাপড় ফেরত দিতে এসেছিস! এত বড় আস্‌পদ্দা! বাজারের সেরা কাপড় এনে দিয়েছে মেজবাবু, আর তুই… কই পেবো কোথা গেল? দেখে যাক ছোটনোককে নাই। দেওয়ার ফল! কাঁচা পয়সা হয়েছে তাই দু হাতে পয়সা ছড়াচ্ছে বাবু। ঝিয়ের কাপড় চোদ্দ আনা! ওই যে—পরিবার রাতদিন বলেন, ঝি বলে কি মানুষ নয়? গরীব বলে কি মানুষ নয়? তারই ফল! তখনই বলেছিলাম, এত বাড়াবাড়ি ভাল নয় পেবো, যা রয়-সয় তাই কর। ও-কাপড় বদলে আট-ন আনার একখানা কাপড় এনে দে। সে কথা শোনা হল না, এখন দেখে যাক আসপদ্দা! সেই কাপড় অপছন্দ করে ফেরত দেওয়া—

হরিদাসী বোজার মুখে বলে, অপছন্দ আমি করি নি। ঠাকুমা, বলেছি পরা চলবে নি।

ওলো থাম থাম, তুই আর কথার কায়দা শেখাতে আসিস নি! যার নাম ভাজাচাল তার নামই মুড়ি, বুঝলি? ছোটমুখে লম্বা লম্বা কথা!

হরিদাসী আরো বোজার গলায় বলে, ছোটনোকে কথা কইলেই তোমাদের কানে লম্বা। ঠেকে ঠাকুমা! বদলে না দাও কাপড় চাই না, গালাগাল কোর না।

গালাগাল! গালাগাল করি আমি? মুক্তকেশী ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, বলেন, বেরিয়ে যা! বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে! ভাত ছড়ালে কাকের অভাব?

তা কালটা তখনো তাই ছিল।

ভাত ছড়ালে কাকের অভাব ঘটত না। তবু কে জানে কোন দুঃসাহসে হরিদাসী চাকরি যাওয়ার ভয়ে কেঁদে পড়ে বলে উঠল না, কাল মা দুগৃগার পূজো, এই বছরকার দিনে তুমি আমার অন্নটা খেলে ঠাকুমা!

না, বলে উঠল না।

কে জানে কোন শক্তিতে শক্তিলাভ করে অপ্ৰসন্ন গলায় বলে উঠল, অন্যায় রাগ করলে নাচার ঠাকুমা! তোমার একখানা কাপড় পরে বাসায় আমি জাতে ঠেকা হয়ে থাকতে পারি না। দেখ গে যাও না, রাস্তায় কী কাণ্ডটাই হচ্ছে! পুলিসের হাতে মার খেয়ে মরছে, তবু মানুষ বন্দে মাতাং! বলছে! এতটুকুন-টুকুন ছেলেগুলো পর্যন্ত মার খাচ্ছে, গান গাইছে। দোকান থেকে কাপড় লুঠ করে বাবুরা সব বিলিতি কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বস্তর-যজ্ঞি করছে, এরপর সব নাকি স্বদেশী হবে, নেকচারবাবুরা সেই সেই নেকচারই দিয়ে বেড়াচ্ছে।… আমাদের বস্তিতে পর্যন্ত তোলপাড় কাণ্ড চলছে। খালি এ বাড়ির বাবুদেরই চোখে কানে ঠুলি আটা!

ছেলের বার্লির বাটি হাতে করে রান্নাঘর থেকে আসছিল সুবৰ্ণলতা, দাঁড়িয়ে পড়েছে কাঠ হয়ে। বাটিটা কাত হয়ে গিয়ে বার্লি পড়ে গড়াতে শুরু করেছে সে খেয়াল নেই।

এ বাড়ির বাবুদের চোখে-কনে ঠুলি আটা!

এ বাড়ির বাবুদের চোখে-কনে ঠুলি আটা!

এ বাডির বাবুদের!

চোখে-কানে ঠুলি!

সুবৰ্ণলতার মাথার মধ্যে লক্ষ করতাল বাজতে থাকে, এ বাড়ির বাবুদের—।

বাসনামাজা ঝিয়ের মুখে শুনতে হলো, এ বাড়ির বাবুদের চোখে কানে ঠুলি! যে কথা সুবৰ্ণলতা ভাবছে, সে কথা ওর চোখেও ধরা পড়ে গেছে তাহলে!

সুবৰ্ণলতা তো জানতো, শুধু এ বাড়ির বাবুদের চোখেই নয়, ঠুলি আটা এ বাড়িটারও। আষ্টেপৃষ্ঠে ঠুলি আঁটা। রাজরাস্তার মুখর হাওয়া এ গলির মধ্যে ঢুকে আসে না। বস্তিতে যায়, যায় গাছতলায়, শুধু এ গলির মধ্যে ঢুকতে চাইলে, গলির বাঁকে বাকে ভাঙা দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে বোবা হয়ে যায়।

কিন্তু আশ্চৰ্য, সুবৰ্ণলতার চোখ-কান এত খোলা থাকে কি করে! সুবৰ্ণলতা কেন বাইরের জগতের বাতাসে স্পন্দিত হয়, বাইরের ঝড়ে বিক্ষুব্ধ হয়, বাইরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাকে ঘৃণার চোখে দেখে!

সুবৰ্ণলতাকে এই চারখানা দেয়ালের ভিতরে বাইরে জগতের বার্তা এনে দেয় কে?

আর যে বার্তা অন্য সকলের কানের পাশ দিয়ে ভেসে যায়, গায়ের চামড়ার উপর দিয়ে ঝরে পড়ে, সে বার্তা সুবৰ্ণলতার গায়ের চামড়াকে জুলিয়ে ফোস্কা পড়িয়ে দেয় কেন? কেন ক্যানের মধ্যে গরম সীসে ঢেলে মনের মধ্যে তীব্র ক্ষতের সৃষ্টি করে?

হরিদাসীর চোখে যদি ধরাই পড়ে থাকে এ বাড়ির বাবুদের চোখে-কনে ঠুলি আটা, তাতে সুবৰ্ণলতার চোখ দিয়ে আগুন ঝরাটা বাড়াবাড়ি নয় কি? আর সুবৰ্ণলতা যদি সেই ঠুলি উন্মোচন করতে চায়, ধৃষ্টতা ছাড়া আর কি?

সারাজীবন কি শুধু ধৃষ্টতাই করবে সুবৰ্ণলতা?

 

সংসারের সমস্ত সদস্যের পূজোর কাপড় কেনা প্ৰবোধচন্দ্রের ডিউটি, কারণ তাঁর পয়সা কাঁচা পয়সা! আর তার পরিবারের বুদ্ধিটা কাঁচা বুদ্ধি!

সুবৰ্ণ বলেছিল, এবারে বিলিতি কাপড় আনা চলবে না। জেলা তাতির জেলে গামছা কাপড়ও তার চেয়ে ভাল।

প্ৰবোধ নাক তুলে বলেছিল, তোমার ভাল তো পাগলের ভাল! সে কাপড় কে ছোঁবে?

সে চৈতন্য এনে দিলে সবাই ছোঁবে, মাথায় করে নেবে!

চৈতন্যদায়িনী দিক তবে চৈতন্য, আসছে। বছর কাজে লাগবে। বলে সুবর্ণর কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে একবোঝা যথারীতি বিলিতি কাপড়ই এনে ফেলেছিল প্ৰবোধ। এনেছিল আলতা, চীনেসিঁদুর, মাথা ঘষার মশলা।

যার যার কাপড় তার তার ঘরে উঠে গেছে, ছোট ছোট ছেলেগুলো দিন গুনছে কখন পরবে: সেই পূজোর কাপড়, আর ছোট ছোট মেয়েগুলো হিসেব করছে। কার কাপড়ের পাড়টা ভাল!

সুবৰ্ণ ভেবে রেখেছিল যে যা করে করুক, সে পরবে না ও শাড়ি। সে আপনার সংকল্পে অটুট থাকবে।

ষষ্ঠীর দিনে যখন নতুন কাপড়ের কথা উঠবে, সুবর্ণ বলবে পূজোর পুণ্যদিনে অশুচি বস্ত্ৰ পরিবার প্রবৃত্তি নেই তার। কোনো দিনই নেই। সে ত্যাগ করবে। এবারের পূজোর কাপড়।

কিন্তু হরিদাসীর ধিক্কারে সে সঙ্কল্পের পরিবর্তন হল।

দাউ দাউ আগুন জ্বেলে জুলিয়ে পুড়িয়ে খসিয়ে দাও ওই ঠুলি। নয়তো মুক্তি দিক সুবৰ্ণলতাকে এই নাগপাশ থেকে। তাড়িয়ে দিক ওরা সুবৰ্ণলতাকে, দূর করে দিক তাকে তাঁর ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের জন্যে।

মীরাবাঈয়ের মত পথে বেরিয়ে পড়ে দেখবে সুবৰ্ণ পৃথিবীর পরিধিটা কোথায়?

কতদিন কল্পনা করেছে সুবৰ্ণলতা এরা সুবৰ্ণকে তাড়িয়ে দিল, সুবর্ণ সাহস করে চলে গেল।

বাইরের লোকের কৌতূহলী চোখকে এড়াবার জন্য ঢুকে পড়ল না তাড়াতাড়ি মুক্তকেশীর শক্ত বেড়ার মধ্যে।

তারপর সুবৰ্ণলতা পথে পথে ঘুরছে, ঘুরছে তীর্থে তীর্থে, ঘুরছে ওই সব মহাপুরুষদের দরজায় দরজায়, যাঁরা স্বদেশী করেন।

 

চোখ জ্বালা করানো ধুমকুণ্ডলী পাক খেতে খেতে নিচে নামছে…তার সঙ্গে নেমে আসছে। তীব্ৰ আর পরিচিত একটা গন্ধ।

এ বাড়ির ছাদের আকুলতা আকাশে ওঠবার পথ পায় না, তাই নিরুপায় ধোঁয়াগুলো ছাদের আলসে টপকে পাতালের দিকে নামতে চায়।

প্রথমটা কারো খেয়াল হয় নি, খেয়াল হল চোখ জুলায়। তারপর পোড়া গন্ধ। ন্যাকড়া পোড়ার গন্ধ তো আর চাপা থাকে না!

ছোটদের চেঁচামেচিটা নতুন নয় এ বাড়িতে, কাজেই সবশেষে অনুভবে এল সেটা।

কোথায় কি সর্বনাশ ঘটাচ্ছে পাজীগুলো!

সর্বনাশে উমাশশীর বড় ভয়, উমাশশী এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করল ঘটনাটা!

রান্নাঘরের ছাদে ধুমালোক, জড়ো-করা চারটি কাপড় পুড়ছে, তার ধারে কাছে কটা ছেলেমেয়ে চোখের জ্বালা নিবারণ করছে চোখ রগড়ে রগড়ে, আর তার সঙ্গে করছে হৈ চৈ।

কিন্তু শুধুই কি ছোটরা?

তার সঙ্গে নেই পালের গোদা মেজগিন্নী?

উমাশশী থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

উমাশশীর মুখ দিয়ে কথা বেরোল না।

ইচ্ছে করে এ কী পোড়াতে বসেছে মেজবো? কাপড় না। ভবিষ্যৎ? তা সে তো পোড়াচ্ছেই জীবনভোর! আ-জীবনই তো ধ্বংসকার্য চালাচ্ছে! তবু সে আগুনটা ছিল অদৃশ্য, এবার কি বাড়িটাতেই আগুন ধরাবে মেজবৌ?

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইল উমাশশী। তারপর আঁচল দিয়ে চোখটা মুছল। জল পড়ছে চোখ দিয়ে, জ্বালা করছে।

ধোঁয়ায়?

না সুবৰ্ণলতার অসমসাহসিক দুঃসাহসের স্পর্ধায়?

অবিরত এইরকম করে চলেছে সুবৰ্ণলতা, তবু তার ভাগ্য উথলে উঠছে দিন দিন। দু হাতে খরচ করছে, চাঁদির জুতোয় সবাইকে কিনছে, সোনার ঠলি দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখছে লোকের।

মেজকর্তা করেন?

সেটা তো বাইরের হাত!

ভিতরের ঘরের অধিকারটা কারি?

মেজঠাকুরপো যখন সকলের পূজোর কাপড় কিনে এনে মায়ের কাছে ধরে দেন, তখন কি মনে হয় না মেজবৌই দিল?

অনেক দুঃখে আর অনেক ধোয়ায় বাষ্পাচ্ছন্ন চোখ দুটো মুছে নিয়ে উমাশশী রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, এ কী হচ্ছে মেজবৌ!

মেজবৌ কিছু উত্তর দেবার আগেই একটা ছেলে বলে উঠল, বস্তর-যজ্ঞি হচ্ছে জেঠিমা। সাহেবদের তৈরি কাপড় আর পরা হবে না, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে সেই ছাইয়ের টিপ পরবো আমরা।

ছাইয়ের টিপ!

এসব কী কথা!

কোন ভাষা!

উমাশশী দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে দেখে মেজবৌয়ের দিকে। ধোঁয়া উঠছে বিলক্ষণ, তবুও আগুনে জ্বলছে দৰ্প দৰ্প করে, আর সেই আগুনের আভায় আনন্দের আভার মত জ্বলজ্বল করছে সুবৰ্ণলতার মুখ। মাথার কাপড় খোলা, গায়ের কাপড়ও অবিন্যস্ত, এ বাড়ির ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করে সেমিজ পরে এই যা!

ওকে যেন তাদের পরিচিত মেজবৌ মনে হচ্ছে না। ওকে ধিক্কার দেবে উমাশশী?

কম্পিত্যকণ্ঠে উচ্চারণ করলো, এ কী কথা মেজবৌ?

মেজবৌ সেই আহ্লাদে জুলজুল মুখে বলে, হোম হচ্ছে!

উমাশশীর আর কথা যোগাতো কি না কে জানে, তবে কথা থামাতে হল। মাথার ঘোমটাটা দীর্ঘতর করতে হল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সুবৰ্ণলতাও মাথায় আঁচলটা তুলে দিল!

ভাসুর নয়, দ্যাওর। তবু বয়সে বড় বিজ্ঞ পুরুষ দ্যাওর। ভাসুরের মতই সমীহ করা দরকার বৈকি। সেটাই বিধি।

প্রভাস চলে এসেছে। ছাতে, তার হাতে হাত জড়িয়ে চাপা। চাঁপার চোখ ক্ৰন্দনার্যক্ত। কাঁদতে কাঁদতে কাকাকে ডেকে এনেছে সে, মা তাদের পূজোর কাপড় আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে বলে।

বাড়ির বিচারকের পোস্টটা সেজকাকার, সেই জানা আছে বলেই পাকা মেয়ে চাপা তার কানেই তুলেছে খবরটা।

কি কচ্ছে মা?

ধমকে উঠেছিল। সেজকাকা।

পূজোর কাপড় পুড়িয়ে দিচ্ছে! সব কাপড়!

হু-হু করে কেঁদে উঠেছিল চাপা। কই কোথায়— বলে বীরদৰ্পে এগিয়ে এসেছে প্ৰভাস, তবু এ ধারণা করে নি।

এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে-ও।

পরীক্ষণেই ব্যাপারটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না তার। কারণ পথে-ঘাটে এ ব্যাপার ঘটতে দেখছে যে!

কিন্তু বাড়িতে?

বাড়িতে সেই থিয়েটার?

আর সেই থিয়েটারের অভিনেত্রী বাড়ির বৌ?

বড় ভাজ। কানে হাত দেওয়া চলবে না, অতএব তার ছেলেটাকেই কান ধরে টান মারে প্রভাস, যতটা জোর টানলে শুধু ছিঁড়ে পড়তে বাকি থাকে।

পলিটিক্সের চাষ হচ্ছে বাড়িতে? পলিটিক্সের চাষ? লীডার কে? মা জননী? তা বাড়িতে শাড়ি পড়ে বসে ঘোমটার মধ্যে খ্যামটা নাচ নেচে ছেলেগুলোর পরকাল ঝরঝরে করবার দরকার কি? কুছ কুছা এটি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেই হয়। ইংরেজরাজকে খবর পাঠাই, তোমাদের অন্ন এবার

ব্যঙ্গ মুখটা বিকৃত করে প্রভাস।

সুবৰ্ণলতা যে স্রেফ পাগল হয়ে গেছে তাতে আর সন্দেহ কি! নচেৎ অত বড় দ্যাওরের সামনে গলা খুলে কথা বলে? আর তাকেই বলে?

বলে কিনা, যার যেমন বুদ্ধি, তার তেমন কথা! এ বাড়ির পুরুষদের চেয়ে হরিদাসীর ভাইও অনেক উঁচুদরের মানুষ!

হঠাৎ উমাশী দ্রুত পায়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুড়-দুড় করে চলে যায়।

দ্যাওরের হাতে বড় ভাজের মার খাওয়া দেখতে পারবে না। সে।

আর ততক্ষণে তো আরো সবাই গিয়ে জুটেছে ছাতে! তার মানে সভাস্থলে লাঞ্ছনা!

কিন্তু আশ্চর্য! আশ্চর্য!

লাঞ্ছনা হলো না সেদিন সুবৰ্ণলতার।

বোধ করি মূক হয়ে গেল সবাই সুবৰ্ণলতার বুকের পাটায়। কিংবা ভোবল পাগল হয়ে গেছে! সুবৰ্ণর ব্যবহারে এরা যখন বাক্যাহত হয়ে যায়। তখন এরা বলে, পাগল হয়ে গেছে! মাথার চিকিৎসা করা দরকার!

আজও বলল।

প্রভাসই বলল।

হয়তো মান বাঁচাতেই বলল।

মারতে গেলে ফিরে উল্টে মার খাওয়া অসম্ভব নয়। আর সত্যিই কিছু আর একটা শিক্ষিত ভদ্রলোক বড় ভাইয়ের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারে না।

এক মারানো যেত মেজদাকে দিয়ে!

কিন্তু তাই বা হচ্ছে কই?

মেজদাকেও যে গুণন্তুক করেছে!

সংসারে যখন ভয়ঙ্কর কোনো ঢেউ তোলে সুবৰ্ণলতা, মনে হয় এবারে আর রক্ষা নেই তার। এবারে সত্যি সত্যিই মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গলির বার করে দেওয়া হবে তাকে।

কিন্তু নাঃ, সে আশঙ্কা গর্জন করতে করতে তেড়ে এসে হঠাৎ ভেঙে গিয়েই কেমন ছড়িয়ে পড়ে। যেন ফেনার। রাশির মত স্তিমিত হয়ে মিলিয়ে যায় বালির স্তরে।

প্ৰবোধচন্দ্র এসে সব শুনলো।

মুক্তকেশী কথাটা আর এক সুরে বললেন। বললেন, বছরকার দিনে লক্ষণ করে কেনা পূজোর  কাপড় চোপড়ে আগুন, সেই অবধি ভয়ে আমার বুকের কাঁপুনি থামছে না। বাবা! না জানি কী দুর্ঘটনা আসছে, কী অলক্ষণ ঘটবে সংসারে! কাপড়ের একটা সুতো উড়ে আগুনে পড়লে স্বস্তেন করতে হয়, আর এ কী! তোমার পরিবার যখন এমন দুর্দান্ত তখন তোমার উচিত হয় নি। ওর অমতে কাজ করা!

প্ৰবোধ মীরমে মরে যায়।

প্ৰবোধ ঘটা করে ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ করতে যায় বহরমপুরের পাগলাগারদে পাঠাতে হলে কি কি উপায় অবলম্বন করা দরকার।

তারপর প্রবোধ মার হাতে একশোখানি টাকা তুলে দেয়। বলে, মা, কাপড় কেনায় ঘেন্না দরে গেছে আমার, এ টাকা থেকে প্ৰকাশকে দিয়ে যা হয় করে কিছু কিনিয়ে নিও।

কিন্তু বহরমপুরের টিকিট কি কেনা হয়েছিল সুবর্ণর?

কোথায়?

টিকিট যা কেনা হল সে তো স্বদেশী মেলার!

বাড়িসুদ্ধ ছেলেমেয়েকে আর ননদ বিরাজকে নিয়ে মহোৎসাহে দুখানা গাড়ি ভাড়া করে স্বদেশী মেলা দেখতে গেল সুবৰ্ণ।

কিনে স্বদেশী দেশলাই, স্বদেশী চিরুনি, স্বদেশী সাবান। সবাইকে বিলালো। বললো, পূজোয় এবার কাপড় কেনা হবে। ঢাকাই আমাদের নিজস্ব বাংলাদেশের জিনিস।

হেরেও কোন উপায়ে জিতে যায় সুবর্ণ, মার খেতে গিয়েও মাথায় চড়ে বসে, এ এক অদ্ভুত রহস্য।

যে যতই তড়পাক, শেষ পর্যন্ত কোথায় যেন ভয় খায়।

আর বিজয়িনী সুবৰ্ণলতা খানিকটা করে এগিয়ে যায়। এ বাড়ির বৌরা মেলায় যাবে, এ কথা কেউ দশ দিন আগেও কল্পনা করতে পারতো?

অথচ সেই আকল্পিত ব্যাপার ঘটাল সুবর্ণ। আর আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে বলল, আসছেবারে আমিও মেলায় দোকান দেব!

আসছেবার আমিও মেলায় দোকান দেব! বলেছিল সুবৰ্ণলতা আহ্লাদে ছলছল করে। ভেবেছিল এইবার বুঝি বন্ধনমুক্তির মন্ত্ৰ পেল সে। ভেবেছিল আলোর রাস্তায় হাঁটবার অধিকার অর্জন করবে। সে রাজপথে।

চাঁপাকে সুবৰ্ণ ঘৃণা করে, চাঁপা যেন তার মে–। সেজমেয়ে চন্দনটা বোকাটে নিরীহ। ছেলেদের ওপর অনেক আশা। এ আশা ও পোষণ করছে এখন থেকেই, আর একটু বড় হোক ভানু, ওকে সঙ্গে নিয়ে কাশী চলে যাবে সে একদিন। গিয়ে দেখবে তার সেই কুল ভেঙে অকুলে ভাসা মাকে।

আজ পর্যন্ত নিয়ে গেল না প্ৰবোধ! খুব ভাল মানসিক অবস্থায় কখনো কি ইচ্ছে প্ৰকাশ করে নি সুবৰ্ণ? বলে নি কি, ন বছর বয়সে সেই শেষ মাকে দেখলাম! আর কি বাঁচবেন মা? জীবনে আর দেখা হবে না!

বলেছে।

প্ৰবোধও প্ৰবোধ দিয়েছে, কেন বাঁচবেন না? ধুৎ! কত বয়েস তোমার মার! আমার মায়ের থেকে তো আর বড় নয়? তোমার এই এণ্ডি-গেণ্ডি নিয়ে তো আর কাশী যাওয়া চলে না! ওগুলো একটু বড় হোক!

সুবৰ্ণ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলতো, ওগুলো বড় হলেই শখ মিটবে তোমার? রেহাই দেবে?

প্ৰবোধ অভিমানাহত গলায় বলতো, এই নিয়ে চিরদিন ঘেন্না দিলে। তবু ভেবে দেখলে না। কোনোদিন আমার সেজভাই ছোটভাইয়ের মতন স্বভাব খারাপ করতে যাই নি!

আশ্চর্য, ওই মোক্ষম কথাটা ভেবে দেখত না সুবর্ণ।

বরং বলতো, ওরাই জগতের আদর্শ পুরুষ নয়!

তারপর একদিন কোথা থেকে একটা কবিরাজি পান এনে হাজির করল প্ৰবোধ। চুপি চুপি বললো, ভোরবেলা খালি পেটে খেয়ে নেবে, ব্যস! তুমি যা চাও তাই হবে, আর ন্যানজারি হতে হবে না!

সুবৰ্ণ হেসে বলেছিল, বিষ দিচ্ছ না তো আপদের শান্তি করতে?

প্ৰবোধ সর্পাহতের মত মুখে বলেছিল, এই কথা বললে তুমি আমায়? এই সন্দেহ করলে? ভুলিয়ে তোমায় বিষ খাওয়াচ্ছি। আমি? বেশ তা যদি ভেবে থাকো, খেও না!

সুবৰ্ণলতা আরো হেসে উঠেছিল, নাঃ, ঠাট্টাও বোঝে না! মাথা না বুনো নারকেল! আর বিষ বলে ভয় পাবো কেন গো? বিষের জন্যেই তো হাহাকার করে বেড়াই। তারপর ঈষৎ আড়ষ্ট গলায় বলেছিল, খেলে পাপ হবে না?

তা বিষের কথাটায় কান দেয় নি। প্ৰবোধ, শেষের কথাটায় দিল, পরম আনন্দে মশগুল হয়ে বলল, পাপ কিসের? এগিয়ে দিয়েছিল সেই কবিরাজী পান।

সুবৰ্ণও বোধ করি আশায় কম্পিত হয়েছিল। রেহাই যদি নেই তো উপায় একটা ধরা হোক। সেজভাই ছোটভাইয়ের মত প্ৰবোধেরও যদি স্বভাব খারাপ হত, সুবর্ণ কি বাঁচিত না? বলেছেও তো কতবার বরকে! তাই হও তুমি। আমি বাঁচি।

কিন্তু খারাপ হতে যাবার জন্যে যে সাহসের দরকার তাই বা কোথায় প্ৰবোধের?

নেই।

তাই প্রবোধ সুবৰ্ণলতার কাছে পান নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, মহৌষধ।

মহৌষধ।

সুবৰ্ণ তাই তারপর থেকে নিশ্চিন্ত আছে। সুবর্ণ বিশ্বাস করেছে আর ন্যানজারি হবার ভয় নেই তার। তাই আহ্লাদে ছলছলিয়ে বলে উঠেছে, আসছেবারে আমিও স্বদেশী মেলায় দোকান দেব! মেয়েরা দিচ্ছে!

ভেবে দেখে নি, যে মেয়েরা স্বদেশী মেলা খুলে দোকান দিচ্ছে তারা কাদের ঘরের মেয়ে!

তারা কি সুবর্ণর ডাস্টবিন ওলটানো সরু সরু গলির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে?

নাঃ, তারা রাজরাস্তার, তারা প্রাসাদের।

তাদের জন্যে তাদের অকৃপণ বিধাতা রেখেছেন অনেক আলোর প্রসাদ। ভাগ্যের টীকা ললাটে পরেই পৃথিবীর মাটিতে অবতীর্ণ হয়েছে তারা।

সুবৰ্ণ যদি নিজের ওজন বুঝতে না শিখে তাদের রাস্তায় হাঁটতে চায়, তাদের আকাশে চোখ তুলতে চায়, সুবর্ণর কৃপণ বিধাতা ঘা মেরে সচেতন করিয়ে দেবেন বৈকি।

সুবৰ্ণর মাকেও তো দিয়েছিলেন।

সুবৰ্ণর মা যখন ভেবেছিল, আমি পাই নি, কিন্তু আমার মেয়ের জন্যে মুঠোয় ভরে আহরণ করে নেব সেই আলো, আর সেই আলোর সাজে সাজিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেব ওই রাজপথে, যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর এক পৃথিবীর মেয়েরা!

তখনও কি সুবর্ণর মায়ের বিধাতা বড় একটা হাতুড়ি বসিয়ে দেন নি তার ধৃষ্টতার উপর?

সুবৰ্ণর মা যদি বাকী জীবনটা শুধু এই কথাই ভেবে ভেবে দেহপাত করে—ইচ্ছায় অনিচ্ছয়, প্ৰতারকের প্রতারণায়, অহঙ্কারীর নির্লজ্জ শক্তির মত্ততায়, যে কোনও ঘটনায় ঘটিত বিয়েও চিরস্থায়িত্ব পাবে কেন, মানুষকে নিয়ে মানুষ পুতুল খেলা করবে কেন? —তবু সুবর্ণর তাতে কোন লাভটা হবে?

সুবৰ্ণর পরবর্তীকাল লাভবান হবে? সুবৰ্ণ দেখতে পাবে সে লাভ?

সুবৰ্ণ যদি ওর সরু গলির শিকলটা ভাঙবার দুরন্ত চেষ্টায় নিজেকে ভেঙে ভেঙে ক্ষয় করে, কোনো একদিন শিকল খসে পড়বে?

কে জানে কে কথা!

সুবৰ্ণ অন্তত জানে না।

সুবৰ্ণ পরবর্তী কালকে জানে না।

সুবৰ্ণ নিজে চায় শিকল ভেঙে বেরিয়ে পড়তে। চায় আলোর মন্দিরের টিকিট কিনতে।

কেনা হবে না!

তার বিধাতা তাকে আঘাত করবে, ব্যঙ্গ করবে!

 

সেই ব্যঙ্গ ধরা পড়ল সুবর্ণর কাছে।

ধরা পড়েছিল, তবু চোখ বুজে ছিল। খারাপ মনটাকে নিয়ে জোর করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ সেই অনেক দিন আগে পড়া ময়াল সাপের প্রবন্ধটা মনে পড়ে গেল।

ভাবতে ভাবতে নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল। তার, বিস্ফারিত হয়ে এল চোখ দুটো, আড়ষ্ট কঠিন হয়ে উঠিল শরীর। হাত দুটো আপনি মুঠো হয়ে গেল।

ঘরে কেউ থাকলে দেখে চমকে যেত, চেঁচিয়ে উঠত।

এর পর আর কি করতো সুবৰ্ণ কে জানে!

কে জানে চিৎকার করে কেঁদে উঠতো, না দেয়ালে মাথা ঠুকতো?

মোক্ষম সময়ে প্ৰবোধচন্দ্র এসে ঘরে ঢুকলো।

দেরাজ থেকে তোলা তাসজোড়াটা বার করে নিতে এসেছিল প্ৰবোধ।

আড্ডায় লোকসংখ্যা বেশি হয়ে গেছে, কাজেই একদল বেকার ব্যক্তি খেলোয়াড়দের পিছনে বসে উসখুসি করছে আর চাল বলে দিয়ে খেলার পিপাসা মেটাচ্ছে।

অবস্থাটা অস্বস্তিকর!

প্রভাস বলেছে, দূরছাই, আর একটা বাসর বসুক! তোমার ঘরে আরও তাস আছে না?

প্রভাস ইচ্ছে প্ৰকাশ করেছে, প্ৰভাস বলেছে! হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল প্ৰবোধ তোলা তাসটা নিতে! কিন্তু সুবর্ণর মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ালো।

মুঠোপাকানো হাত, আর সে হাতের স্ফীত শিরাগুলো দেখে ভয়ই হলো তার। সত্যি বলতে, এমনিতেই সুবৰ্ণকে ভয়-ভয় করে প্রবোধের। নিয়ে ঘর করে বটে, কিন্তু কোথায় যেন অনন্ত ব্যবধান!

সত্যি, বাড়ির সমস্ত স্ত্রীলোকগুলিকে বুঝতে পারা যায়, পারা যায় না। শুধু নিজের স্ত্রীকে! এ কি কম যন্ত্রণা!

অথচ ওই বুঝতে না পারাটা স্বীকার করতে রাজী নয় বলে না-বোঝার জায়গাগুলো চোখ বুজে এড়িয়ে যেতে চায়, ভয় করে বলেই শাসনের মাত্রায় সহসা মাত্রা ছাড়ায়।

আশ্চর্য!

মেয়েমানুষ পর্যচর্চা করবে, কোদল করবে, ছেলে ঠেঙাবে, ভাত রাধবে, আর হাঁটু মুড়ে বসে। এককাসি চচ্চড়ি দিয়ে একগামলা ভাত খাবে, এই তো জানা কথা। ভাত বাড়া দেখে ঘরের পুরুষেরা পাছে মুচকে হেসে প্রশ্ন করে, বেড়াল ডিঙোতে পারবে কিনা। তাই পুরুষের চোখের সামনে কখনো ভাত বাড়বে না নিজেদের। এই সবই তো চিরাচরিত।

প্ৰবোধের ভাগ্যে সবই উল্টো।

সৃষ্টিছাড়া ব্যতিক্রম!

ইচ্ছে হচ্ছিল, না দেখার ভান করে কেটে পড়ে, কিন্তু হলো না। চোখোচোখি হয়ে গেল। অগত্যাই একটু এগিয়ে এসে বলতে হলো, কী ব্যাপার? শরীর খারাপ হচ্ছে নাকি?

সুবৰ্ণ শুধু চোখ তুলে তাকালো, সুবর্ণর নিঃশ্বাসটা আরো দ্রুত হলো।

হলো কি? কামারের হাপরের মত আমন বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলাছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? বড়বৌকে ডেকে দেব?

এবারে আর নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে উঠল না, ফোঁস করে উঠল সুবর্ণ নিজেই, কেন, বড়বৌকে ডেকে দেবে কেন?

বাঃ, ডেকে দেব কেন! কী হলো না হলো বড়বৌ বুঝবেন।

সুবৰ্ণ শুধু ফোঁসই করে না, এবার তীব্র একটা ছোবল দেয়, বড়বৌ বুঝবেন! আর তুমি বুঝবে না? কবিরাজী পান এনে ভোলানো হয়েছিল, কেমন? মিথু্যক, জোচ্চোর!

প্ৰবোধ ওই আরক্ত মুখের দিকে তাকায়।

প্ৰবোধের ব্যাপার বুঝতে দেরি হয় না।

আর বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়টাও কাটে। ওঃ, শরীর খারাপ নয়, রাগ। বাবাঃ, স্বস্তি নেই!

ক্যাবলা-ক্যাবলা হাসি হেসে বলে, ও ফেঁসে গেছে বুঝি তুক? বাবা, কী ইয়ে—

বোধ করি বলতে যাচ্ছিল কোনো বেফাঁস কথা, সামলে নিল। ওই সামলে নিতে নিতে কথার ধরনই সভ্য হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র এই তাসের আড্ডাতেই যা ইচ্ছেমত মুখ খুলতে পাওয়া যায়। স্ত্রী তো নয়, যেন গুরুমশাই!

বলে মিথ্যেও নয়!

গুরুমশাইয়ের ভঙ্গীতেই ধমকে ওঠে তার স্ত্রী, খবরদার বলছি, দিদিকে ডাকবে না!

ডাকিবো না? বাঃ! শেষে একলা ঘরে দাঁতকপাটি লাগিয়ে বসে থাকবে? ওসব মেয়েলী কাণ্ড বড়বৌই ভাল বুঝবে!

মেয়েলী কাণ্ড!

মেয়েলী কাণ্ড!

আর সর্পিণী নয়, যেন বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় সুবর্ণ স্বামীর উপর। যেন নখে করে ছিঁড়ে ফেলতে চায় ওর ওই বোকামির মুখোশ।

আর মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা সেই কুৎসিত জীবটাকে কটুক্তির চাবুকে জর্জরিত করে ফেলতে পারলেই বুঝি সুবৰ্ণলতার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

কিন্তু সত্যিকার নখ দিয়ে তো আর সে মুখোশ ছেড়বার নয়, তাই কিছুই হয়ে ওঠে না। শুধু একটা আগুনঝরা প্রশ্ন ঠিকরে ওঠে, মেয়েলী কাণ্ড! কচি খোকা তুমি!

প্ৰবোধ এই আগুনের খাপরার কাছ থেকে সরে পড়তে পারলে বাঁচে, তাই একটা সাজানো হাসি হেসে বলে, হল কি রে বাবা! থেকে থেকে যেন ভূতে পায়। তাসজোড়াটা কোথায়? দেরাজে আছে?

প্রশ্নটা বাহুল্য।

ঘরে ওই দেরাজটা ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই।

না, আর একটা জিনিস আছে।

ইট দিয়ে উঁচু  করা একটা চৌকিও আছে। যার নীচে বাক্স-প্যাটরা চালান করবার জন্যে ওই উঁচু  করা। যে চৌকিটার উপর অনেকদিন পর্যন্ত দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়েও আড়াআড়ি শুয়ে এসেছে সুবর্ণ আর প্রবোধ। তিনটে হবার পর থেকেই সেটাকে ছেড়ে মাটিতে শয্যা বিছিয়েছে সুবর্ণ।

চৌকিটায় এখন সারাদিন গাদা করে বিছানা তোলা থাকে, আর রাত্ৰে প্ৰবোধ একা হাত পা ছড়িয়ে শোয়। কচি-কাঁচা নিয়ে শুতে পারে না। আর সে। বয়েস হয়েছে, শরীর ভারী হয়েছে, তাছাড়া-কাঁচা পয়সার গুমোরও হয়েছে কিছু।

মনে জানে, আরাম চাইবার দাবি জন্মেছে তার।

সুবৰ্ণ মাটিতে বিছানা বিছিয়ে শোয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে, দিনের বেলা মাদুরে। ঘরের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি বিছানা কাঁথার সমাবেশ, কে জানে অদূর ভবিষ্যতে আরও একটা জায়গা

তাসজোড়াটা থাকলে দেরাজেই থাকবে। কিন্তু সেই সহজ নির্দেশটা দিল না। সুবর্ণ, উঠে দাঁড়িয়ে কটুকণ্ঠে বলল, আবার তাস?

আস্তে! প্ৰবোধ বলে, গলা যে ভাসুরের কান ফাটিয়ে দিচ্ছে!

কিন্তু ভাসুরের নামোল্লেখেও দমে না। সুবৰ্ণ, সমান তেজে বলে, ওঃ, ভারি একেবারে সাতমহলা অট্টালিকা, তাই ভাদরবৌয়ের গলা ভাসুরের কানে পৌঁছবে না! সারা বাংলায় বোবা মেয়ে ছিল না? বোবা মেয়ে! তাই একটা খুঁজে নিয়ে বিয়ে করতে পারো নি.?

ঘাট হয়েছিল। তাই উচিত ছিল। প্ৰবোধ বলে ওঠে, জিভ তো নয়, ছুরি!

প্ৰবোধ বানাৎ করে দেরাজ টেনে তাসটা বার করে।

তাস নেবে না বলছি, ভাল হবে না! সেদিনের প্রতিজ্ঞার কথা মনে নেই? ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করেছিলে না? বেহায়া নির্লজ! জোচ্চোর!

একখানা ঘরের ব্যবধানে ভাইরা আর খেলার বন্ধুরা, এ সময়ে আর গোলমাল বাড়তে দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করা চলে না। নইলে প্ৰবোধের কি ইচ্ছে হচ্ছিল না, ফুটবলের মত লাথিয়ে লাথিয়ে ঘরের বাইরে বার করে দেয় ওই অবিশ্বাস্য ঔদ্ধত্যকে!

তাই কষ্টে মুখে হাসি টেনে এনে বলে, ফুঃ, সঙ্কটকালে আমন কত প্ৰতিজ্ঞা করতে হয়। তাই বলে যদি রাতের প্রতিজ্ঞা দিয়েও মানতে হয়, তাহলে তো বাঁচাই চলে না।

কী? কী বললে?

সুবৰ্ণ আবার বসে পড়ে।

প্রতি মুহূর্তে স্বামীর অপদার্থতার পরিচয় পায় সুবর্ণ তবু চমকে চমকে ওঠে।

অথচ অপদার্থতা সুবৰ্ণর মাপকাটিতেই। অন্য অনেক মেয়েমানুষই অমান বর পেলে ধন্য হয়ে যেত।

প্ৰবোধ পালায়।

স্রেফ পালায়। তাড়া-খাওয়া জানোয়ারের ভঙ্গীতে।

শুধু বলে যায়, ওঃ, কাকে কি বলছি হঁশ নেই, কেমন? নিজে নিত্যি ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসবেন, আর মেজাজ হবে যেন আগুন!

কাকে কি বলাই বটে!

কিন্তু ইশ কি সত্যিই নেই সুবর্ণর?

নাকি ও চায় অপমানের অন্ধুশে আহত হয়ে একবার অন্তত জ্বলে উঠুক প্ৰবোধ? পুরুষের মত জ্বলে উঠুক, বজের তেজ নিয়ে জ্বলে উঠুক? মা ভাইয়ের কাছে মুখ রাখতে শাসনের প্রহসন নয়, সত্যিকার শাসন করুক। সুবৰ্ণকে তাড়িয়ে দিক, মেরে ফেলুক। সেই মরণের সময়ও যেন জেনে মরে সুবৰ্ণ, যে প্রাণীটার সঙ্গে ঘর করছিল সেটা মানুষ!

কিন্তু ফলটা ফলে বিপরীত।

সুবৰ্ণলতা যত উগ্র হয়ে ওঠে, প্ৰবোধচন্দ্র ততো নিস্তেজ হয়ে যায়। পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

কিন্তু সুবর্ণই বা কি!

তার মধ্যেই কি পদার্থ থাকছে আর? যেটুকু ছিল, সেই আত্মঘাতী সংগ্রামে ক্ষয় হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে না? তার নিজের ভিতরকার যে সুরুচি, যে সৌন্দর্যবোধ এই কুশ্রী পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সর্বদা ছটফট করে মরতো, সে যে প্রতিনিয়ত এই নিস্ফল চেষ্টায় বিকৃত হয়ে উঠছে, সে বোধ কি আর আছে সুবৰ্ণলতার?

এই বাড়ি আর এই বাড়ির মানুষগুলোর অসৌন্দর্য ঘুচিয়ে ছাড়াবার জন্যে নিজে সে কত অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, এ কথা তাকে কে বুঝিয়ে দেবে!

 

কী হে প্ৰবোধবাবু, তাস আনতে যে বুড়ো হয়ে গেলে!

অভ্যস্ত কথা, অভ্যস্ত ঠাট।

বুঢ়ী আঁচল ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?

হুঁ, গিন্নী!

প্ৰবোধ গুছিয়ে বসে বলে, প্ৰবোধচন্দ্ৰ অমন গিন্নী-ফিনীর ধার ধারে না। দেরি হল তাসটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে।

বাড়ির অখ্যাতি বন্ধুমহলেও প্রচার হয়ে গেছে, তাই প্ৰবোধের সগর্ব উক্তিতে একজন হেসে ফেলে বলে, আরো রেখে দাও তোমার গুমোর! গিন্নী তো শুনি তোমার কান ধরে ওঠায়, কান ধরে বসায়া!

হাসি।

হাসিই একমাত্ৰ মুখরক্ষার ঘোমটা।

তাই হাসতে থাকে প্ৰবোধ তাস ভাজতে ভাঁজতে, নাঃ, তোমরা আর মান-মৰ্যাদা রাখলে না!

এই সময় সুবোধের ছেলে বুদো এক ডাবর সাজা পান এনে আড্ডার মাঝখানে বসিয়ে দেয়, প্ৰবোধের লজ্জায় ছেদ পড়ে। পর পর তিন মেয়ের পর ছেলে, তবু বেচারা যেন নিতান্তই বেচারী।

 

রবিবারটা বুদোর দুঃখের দিন।

খেলতে যেতে পারে না, সারাক্ষণ আসরের খিদমদগারী খাটতে হয়।

বিশেষ এক-একটা ভার যে কেমন করে বিশেষ এক-একজনের ঘাড়ে এসে চাপে, সেটাই বোঝা শক্ত। বাড়িতে আরো ছেলে আছে, কিন্তু বুন্দোরই সব রবিবার দুঃখের দিন।

অবশ্য ভানু কানুর এ আসরের মুখে হবার জো নেই। তাদের মা তাহলে তাদের ধরে ধোবার পাটে আছাড় দেবে। এবং যে তাদের ফরমাস করবে, তাকেও রেহাই দেবে না। এটাও জানা। তাই বাড়িতে ভানু কানু নামের দু-দুটো ছেলে থাকতে বুদের ঘাড়েই সব বোঝা।

প্ৰবোধ বলেছিল, ওরা কিছু করে না, একা দাদার ছেলেটাই খেটে মরে—এটা স্বার্থপরের মত দেখায় না!

দেখায়! সুবর্ণ বলেছিল, কি করা যাবে, দেখাবে!

তোমারই যত ইয়ে, কই ওরা মা তো এত রাগ করে না?

ওর মা মহৎ।

তা মহৎই!

নইলে ওই ডাবর ডাবর পানই বা সে একা সেজে মরে কেন?

জনৈক আড্ডাধারী পকেট থেকে জর্দার কোটো বার করে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, পান কে সেজেছে রে বুদো? তোর মা বুঝি?

মেয়েদের সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হলে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার সুর মেশাতে হয়, এটাই রীতি। ভদ্রলোক সে রীতিতে বিশ্বাসীও।

নির্বোধ বুদো এ প্রশ্নে কৃতাৰ্থমন্য হয়ে একগাল হেসে বলে, হ্যাঁ।

তোর মাকে শিখিয়ে দিগে যা বাপ, পান দিলে তার সঙ্গে একটু চুন দিতে হয়।

যেন একটি ক্ষুদে লাটের ভঙ্গীতে একটা পান তুলে নেন। ভদ্রলোক।

এই এঁদের অভ্যস্ত ভঙ্গী।

পৃথিবীটা এঁদের কাছে করতলগত আমলকীবৎ। সর্ববিধ ব্যাপারকে নস্যাৎ করে দেবার কৌশলটি এঁদের জানা। দেশ যখন স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে উদ্বেল, এরা তখন ঘরে বসে রাজা-উজির মারছেন, সেই আন্দোলনকে তুড়িতে ওড়াচ্ছেন।

পাড়ার প্রত্যেকটি বাড়ির বৌদের খবর এঁরা রাখেন এবং সমালোচনায় তৎপর হন। এ বাড়ির বড়বৌটিকে ওঁরা অগ্রাহ্য করেন,–মেজটিকে ব্যঙ্গ করেন, সেজটিকে স্বার্থপর বলে ছিছিক্কিার করেন এবং ছোটটিকে অবজ্ঞা করেন।

গুণানুসারেই করেন। অবশ্য, এবং মনোভাব চাপতেও চান না।

শুধু পাড়াপাড়শীই নয়, ওঁদের আড্ডায় কাটা পড়ে না। এমন মাথা নেই। এঁরা ব্ৰাহ্মকে বলেন বেম্ম, ব্ৰাহ্মণপুরুতকে বলেন, বামনা, বিদুষী মেয়ের নাম শুনলে বলেন, লীলাবতী!

এঁরা দেশনেতাদের পাগলা আখ্যা দিতে দ্বিধা করেন না, পরমহংসের বুজরুকীর ব্যাখ্যায় আমোদ পান, বিবেকানন্দের আমেরিকায় গিয়ে হিন্দুধর্ম প্রচারের বার্তা নিয়ে হাসাহাসি করেন এবং মেয়েদের লেখাপড়ার অগ্রগতি লক্ষ্য করে সকৌতুক ব্যঙ্গ যখন তখন ঈশ্বর গুপ্ত থেকে উদ্ধার করে বলেন, আরো কত দেখবে হে! দেখবার এখুনি হয়েছে কি? এরপর সব–

এ, বি, সি, শিখে বিবি সেজে
বিলিতি বোল কবেই কবে।
আর হুট বলে বুট পায়ে দিয়ে
চুরুট ফুকে স্বর্গে যাবে।

বাড়ি বাজার আর অফিস, এই ত্রিভুজ তাঁতে আনাগোনা করতে করতে মরচে পোড়ে গেছে ওঁদের জীবনের মাকুটা।

এঁরাই সুবৰ্ণলতার স্বামীর বন্ধু।

কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর এই অফিসবাবুর দল কি এ যুগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?

আজকের পৃথিবীর এই দুরন্ত কর্মচক্রের দুর্বর গতির তাড়নের মাঝখানেও, অলস গতি আর অসাড় আড্ডা নিয়ে আজও কি টিকে নেই তারা? আজও কি তাদের জানার জগতে শুধু এই কথাই নেই, মেয়েমানুষ জাতটাকে ব্যাঙের আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতে হয়, তারা পানের পাশে চুন রাখতে ভুলে গেলে তাদের সমঝে দিতে হয়? আছে। ওঁরা যে আধুনিক নন, এই ওঁদের অহমিকা, এই ওঁদের গৌরব।

নাঃ, একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি।

আজও আছে বৈকি কিছু কিছু।

আছে দর্জিপাড়া আর কিনুগোয়ালার গলি, ছিদাম মিস্ত্রী আর রাণী মুদিনীর লেনের অন্তরালে।

এখনো ঐরা জানেন পুরুষ জাতটা বিধাতার স্বজাতি বলেই শ্রেষ্ঠ।

এঁরা আছেন।

হয়তো চিরকাল থাকবেন।

পৃথিবীর দুরন্ত অগ্রগতির পথে বাঁধা দেবার প্রয়োজনে বিধাতাই এঁদের সৃষ্টি করে চলেছেন, কম-বেশি হারে।

অথচ আবার হয়তো ওঁদের অন্তঃপুরের রঙও বদলাচ্ছে, ওঁরাই আব্রুর কড়া শিকল শিথিল করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন, ওঁরাই ওঁদের মেয়েদের নিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসছেন বিয়ের বাজারে দাম বাড়াবার আশায় আর মেয়েদের বিয়ের বয়েসটা বারো থেকে ষোলোয় তুলছেন পারিপার্শ্বিকের চাপে।

এঁদের নাম মধ্যবিত্ত।

এঁরাই নাকি সমাজের কাঠামো।

এঁরা এদের মধ্যবিত্ততা এবং মধ্যচিত্ততা নিয়ে রক্ষা করে চলেছেন সেই কাঠামো। তার সঙ্গে চলেছে সময়ের স্রোত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *