1 of 2

১.০৫ সম্মোহন আদেশ

পঞ্চম পাঠ
সম্মোহন আদেশ

যখন আমরা কোন বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে কোন কিছু বিশেষভাবে বা দৃঢ়রূপে কাহারও হৃদয়ে অঙ্কিত করিবার ইচ্ছায় বাক্য প্রয়োগ করি, তখন ঐ সম্পূর্ণ বাক্যটিকে “সম্মোহন ইঙ্গিত” বা “সম্মোহন আদেশ” (hypnotic suggestion) বলে। এই আদেশ যে কেবল বাক্য দ্বারা দিতে হয়, তাহা নহে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশেষ ভাব-ভঙ্গী দ্বারা বা মানসিক চিন্তা দ্বারাও কোন বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে আমরা ভাল-মন্দ যাহা কিছু বলিতে ইচ্ছা করি, তাহাও অল্পাধিক পরিমাণে লোকের মনে অঙ্কিত করিয়া দিতে সমর্থ হই। মানসিক চিন্তা দ্বারা বা মনে মনে যে আদেশ প্রদান করা যায়, উহাকে “মানসিক আদেশ” (mental suggestion) বলে। সুতরাং যখনই আমরা এই তিন প্রকারের কোন রকমে অর্থাৎ বাক্য, চিন্তা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভাব-ভঙ্গী দ্বারা কাহাকেও কোন বস্তু বা বিষয়ের বিশেষ কোন দোষ-গুণ স্বীকার বা বিশ্বাস করাইতে কিম্বা কোন কাৰ্য্য করাইবার জন্য প্রবৃত্তি জন্মাইতে চেষ্টা পাই, তখনই উহাকে “ইঙ্গিত” বা “আদেশ” বলিয়া অভিহিত করিতে পারা যায়।

এই আদেশ সম্মোহন বিজ্ঞানের মেরুদণ্ড। কারণ বিচার শক্তিবিশিষ্ট মানুষকে বশীভূত করিবার জন্য তাহার উপর যে সকল প্রক্রিয়া প্রয়োগ করিতে হয়, তন্মধ্যে এই আদেশই সৰ্ব্ব প্রধান। মানুষকে জাগ্রত (স্বাভাবিক। বা নিদ্রিত অবস্থায় হউক, বশীভূত করিতে তাহাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আদেশ দিতে হয়। আদেশের ভাষা সাধারণ কথাবার্তার মত হইলেও উহা একটি নির্দিষ্ট নিয়মে প্রযুক্ত হয় বলিয়া উহার কাৰ্য্যকরী শক্তি অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী। কেহ এক ব্যক্তিকে কোন একটি কার্য করিতে অনুরোধ করিলে, সে উহা করিতে পারে, কিম্বা নাও করিতে পারে; কিন্তু তাহাকে সম্মোহিত করোন্তর আদেশ প্রদান করিলে, সে অবশ্য উহা করিতে বাধ্য হইয়া থাকে। কাহাকেও কোন একটি বস্তু বা বিষষের দোষ-গুণ স্বীকার বা বিশ্বাস করাইতে হউক, অথবা কঠিন বা সহজ কোন কাৰ্য্য করাইবার জন্য প্রবৃত্তি জন্মাইতে হউক, যযোপযুক্ত রূপে আদেশ প্রদান করিতে পারিলে উহা তাহার জাগ্ৰদবস্থায়ও, কাৰ্যকর হইয়া থাকে। প্রখর আদেশের শক্তি অনিবার্য; আজ বা কাল হউক, অথবা দুই মাস পরেই হউক, উহা নিশ্চিতরূপে আশানুরূপ ফল প্রসব করিয়া থাকে। অতীতকালে যে সকল প্রতিভাশালী ব্যক্তি কৰ্ম্ম জগতের কোন বিভাগে বিশেষ প্রাধান্য লাভ করিয়াছিলেন, তাহাদের ব্যক্তিগত গুণ ও ক্ষমতার মধ্যে প্রখর আদেশ দ্বারা মানুষকে বশীভূত করিবার শক্তি অত্যধিক পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। বর্তমান যুগেও এইরূপ শক্তিশালী স্ত্রী-পুরুষের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে, যাহাদের প্রবল ইঙ্গিত বা আদেশে শত শত লোক ক্রীড়া-পুত্তলীর ন্যায় প্রতিনিয়ত পরিচালিত হইতেছে।

ইতঃপূৰ্ব্বে বলা হইয়াছে যে, আমরা তিনটি বিভিন্ন প্রণালীতে আদেশ প্রদান করিতে পারি। যথা—বাক্য, চিন্তা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির বিশেষ ভাবভঙ্গী দ্বারা। যাহার সহিত স্বাধীনভাবে আলাপ করিবার সুবিধা হয়, তাহাকে মৌখিক আদেশ, আর যাহার সহিত কথা-বার্তার কোন সুবিধা নাই, তাহাকে মানসিক আদেশ প্রদান করিতে হয়। মৌখিক আদেশের সহিত মানসিক আদেশ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভাবভঙ্গী পূর্ণ ইঙ্গিত প্রদান করিলে, সেই আদেশের শক্তি প্রখরতর হয়। এই নিমিত্ত মৌখিক আদেশের সঙ্গে উক্ত দুই প্রকার আদেশও প্রয়োগ করা উচিত। এই তিনটি বিভিন্ন প্রকার আদেশ একযোগে প্রদান করার অর্থ এই যে, কাৰ্যকারক মুখে যাহা বলিবে মনেও তাহাই ভাবিবে এবং তাহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশেষ ভাব-ভঙ্গী-দ্বারাও সেরূপ ভাবই প্রকাশ করিবে। মৌখিক আদেশের ন্যায় মানসিক আদেশও স্বাধীনভাবে কাৰ্য্য করিতে পারে; কিন্তু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভাব ভঙ্গীপূর্ণ ইঙ্গিত তাহা করিতে পারে না। সে লোকের সহিত বিষয় কৰ্ম্মের আলাপে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে, উক্ত কার্যে সিদ্ধি লাভের নিমিত্ত তাহাকে যাহা বলা আবশ্যক, সেই কথাগুলি পূর্বেই মনোনীত করিয়া লইবে। ঐ কথাগুলি সরল, সংক্ষপ্তি অথচ তাহার সম্পূর্ণ অভিপ্রায় প্রকাশক হইবে; এবং বলিবার সময় উদ্দেশ্য সিদ্ধির সহায়ক শব্দগুলির উপর বিশেষ জোর দিয়া প্রকাশ করিবে। যদি কেহ দোকানদার রূপে কাহারও নিকট একখানা সাবান বা পুস্তক বিক্রি করিতে ইচ্ছা করে, তবে তাহাকে এই মত কিছু বলা উচিত হইবে; যথা-“এইখানা খুব উৎকৃষ্ট সাবান,” বা সাবানের মধ্যে “এইখানাই সর্বোৎকৃষ্ট; অথবা “এইখানা খুব ভাল বই” বা “এই বিষয়ে যতগুলি পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এইখানাই সর্বশ্রেষ্ঠ”, অথবা “এরূপ উৎকৃষ্ট পুস্তকই আপনি চান” ইত্যাদি। অন্য কোন জিনিষ বিক্রি করিবার সময়ও সেই জিনিষের উৎকর্ষ বাচক ও তাহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির সহায়ক শব্দগুলির উপর উক্তরূপে বিশেষ জোর দিয়া, বাক্যটি ধীর, গম্ভীর ও সুস্পষ্ট স্বরে বলিবে। সে ক্রেতা, দশটি জিনিষ দেখিয়া হয়ত উহাদের মধ্য হইতে একটি পছন্দ করিবে। কিন্তু তাহার দোকানে যে জিনিষগুলি আছে, ঐগুলিকেই তাহাকে পছন্দ করাইতে হইবে। সুতরাং যতক্ষণ সে তাহার জিনিষ গুলিকে উৎকৃষ্ট বলিয়া তাহাকে বুঝাইতে এবং বিশ্বাস করাইতে না পারিবে, ততক্ষণ সে তাহার নিকট উহাদিগকে বিক্রয়ের আশা করিতে পারেনা। তাহাকে ঐ জিনিষগুলি পছন্দ করাইবার জন্য উহাদের প্রশংসা করিতে হইবে, কিন্তু তাহা করিতে কেবল কতক গুলি বাজে কথা না বলিয়া, সরল, সুস্পষ্ট, গম্ভীর ও বিশ্বাসোদ্দীপক স্বরে, উহাদের গুণ বাচক ও তাহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির, অনুকূল শব্দগুলির উপর জোর দিয়া এমন ভাবে কথাগুলিকে ব্যক্ত করিবে, যেন উহাদের উৎকর্ষ সম্বন্ধে তাহার কিছুমাত্র সংশয় না থাকে। যদি সে তাহাকে উক্তরূপ আদেশ প্রদান করতঃ তাহার মন আকৃষ্ট করিতে সমর্থ হয়, তবে সে নিশ্চয় তাহার আদিষ্ট দ্রব্যগুলি ক্রয় করিতে বাধ্য হইবে। আর যদি সে কোন কারণে আজ চলিয়া যায়, তথাপি তাহার এই আদেশের অনিবার্য শক্তি প্রভাবে, তাহাকে পুনরায় আর এক দিন আসিয়া উহ। ক্রয় করিতে হইবে। এইরূপে আইন ব্যবসায়ী বিচারককে, বক্তা শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে, চিকিৎসক রোগীকে ও নিম্নতন কর্মচারী উৰ্দ্ধতন কর্মচারীকে বশীভূত বা প্রভাবিত করিয়া তাহার দ্বারা স্বীয় অভীষ্ট সিদ্ধি করিয়া লইতে পারে। ফলতঃ আদেশ যযোপযুক্ত রূপে প্রদত্ত হইলে উহা কখনও নিস্ফল হয় না। যে সকল ব্যবসায়ী আদেশের এই গুপ্ত রহস্য অনবগত, তাহাদের ব্যবসায়-স্থল বিফলতার লীলাভূমি।

শিক্ষার্থী যে কথাগুলি আদেশ রূপে ব্যবহার করিবে, সেইগুলিকে পূৰ্বেই দুই চার বার মনে মনে আওড়াইয়া লইবে, যেন বলিবার সময় মুখে না-আটকায়। আদেশগুলিকে খুব একাগ্রচিত্তে প্রদান করিবে এবং বলিবার সময় মনে এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস রাখিবে যে, সে যাহা বলিতেছে তাহা সম্পূর্ণ সত্য। কারণ যদি সে নিজেই তাহার কথার প্রতি আস্থাশূন্য হয়, কিম্বা মুহূর্তের জন্যও তাহার এরূপ ধারণা হয় যে, “বুঝি সে তাহার কথা বিশ্বাস করিল না”, বা “বুঝি সে তাহার মন আকৃষ্ট করিতে পারিল না,তাহা হইলে তাহার সেই আদেশের অন্তনিহিত কার্যকরী শক্তি নষ্ট হইয়া যাইবে। সুতরাং তাহাকে যাহা বলিতে হইবে, তাহা সে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে, আন্তরিক উৎসাহের সহিত বলিবে এবং দৃঢ়তার সহিত মনে এরূপ বিশ্বাস রাখিবে যে, সে তাহার কথাগুলি কখনও অবিশ্বাস করিতে পারিবে না। একাগ্রতার সহিত মৌখিক আদেশের পুনরাবৃত্তি করিলে উহার শক্তি বৃদ্ধি পায়; এজন্য একটি আদেশ পুনঃ পুনঃ প্রদান করিলে উহা অধিক নিশ্চয়তার সহিত কাৰ্য করিয়া থাকে। যাহাকে আদেশ প্রদান করিবে, সে যেরূপ ভাষা সহজে বুঝে সর্বদা সেইরূপ শব্দ ব্যবহার করিবে এবং সে যে ভাষা জানেনা, তাহাতে কখনও তাহাকে আদেশ করিবে না।

আমার বিশ্বাস, আমার মনের ভাবগুলি আমি পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত করিতে পারিয়াছি এবং শিক্ষার্থী ও উহাদিগকে সম্যক্‌রূপে উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইয়াছে। মানুষকে বশীভূত করিতে যে যে শক্তি আবশ্যক, তন্মধ্যে ইহা একটি প্রধান শক্তি; এই নিমিত্ত আমি এই বিষয়টি বিশদরূপে বুঝাইবার প্রয়াস পাইয়াছি। সে বৈষয়িক জীবনে উন্নতি লাভের প্রয়াসী হইলে, প্রতিপদক্ষেপে যে সকল লোকের সংশ্রবে আসিবে, তাহাদিগকে আবশ্যকানুযায়ী আদেশ প্রদান করিয়া স্বীয় অভীষ্ট সিদ্ধির চেষ্টা পাইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *