১. ম্যারি অ্যাসলে

দ্য উইন্ডমিল অফ গড (ঈশ্বরের অভিশাপ)
সিডনি সেলডন

গল্প শুরুর আগে

ম্যারি অ্যাসলে, এক উজ্জ্বল তরুণী অধ্যাপিকা, দুই সন্তানের জননী, তাকে কোনো এক লৌহযবনিকার অন্তরালে অবস্থিত দেশে পাঠানো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত করে। কিন্তু দায়িত্ব নেবার আগে দুজন শক্তিশালী শত্রু এসে দাঁড়াল তার যাত্রাপথে। তাদের মধ্যে একজন অ্যাঞ্জেল, ভয়ংকর শয়তান।

হোয়াইট হাউস থেকে প্যারিসের রূপসী রাস্তা, রোম থেকে বুদাপেস্ট শহরের উপকণ্ঠ– এইভাবেই তীব্রগতিতে এগিয়ে গেছে দুরন্ত দুর্বার ঘটনার পক্ষীরাজ।

দুজন পুরুষ ম্যারিকে সাহায্য করেছিলেন, একজন মাইক শ্লেট শক্ত মনের ডেপুটি চিফ, অন্যজন ফরাসি ডাক্তার লুইস ডেসফরগেস। কিছুদিন বাদে ম্যারি অ্যাসলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন, এই দুই সহকারীর কেউ একজন তাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন…

এইভাবেই শুরু হয়েছে সিডনি শেলডনের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দ্য উইন্ড মিল অফ গড’ অর্থাৎ ঈশ্বরের অভিশাপ!

.

পূর্বাভাস : পারজো ফিনল্যান্ড মিটিংটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটা আরামদায়ক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে, হেলসিঙ্কি থেকে দুশো মাইল দূরে পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে। কমিটির ওয়েস্টার্ন ব্রাঞ্চের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে এই মিটিং-এ এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা আটটি বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। ফিনিশ কাউন্সিল অব স্টেটসের এক প্রবীণ মন্ত্রী সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন। তাদের পাসপোর্টে কোনো সংকেত চিহ্ন রাখা হয়নি। বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরীরা তাদের কাছে চলে গেছে। সাবধানে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে কেবিনে। যখন শেষ অতিথি এলেন, কেবিনের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে রক্ষীরা যে যার পজিশনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো আগন্তুককে আজ এখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

অতিথিরা বসেছিলেন বিরাট আয়তক্ষেত্রাকার এক টেবিলের চারপাশে। তারা সকলেই রাজনৈতিক দিক থেকে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। দেশের কাছে এক মহান সত্তা। এর আগেও তারা একাধিকবার বিভিন্ন জায়গাতে মিলিত হয়েছেন, নানা পরিস্থিতির মধ্যে। এখন সাংকেতিক নামে তাদের ডাকা হবে, এভাবেই নিরাপত্তার বেষ্টনিকে আরও শক্ত করা হবে।

পাঁচ ঘণ্টা ধরে আলোচনা চলেছিল, কোনো কোনো সময়ে তা উত্তপ্ত তর্কে পরিণত হয়।

শেষ অবধি চেয়ারম্যান কোর্টের কথা ঘোষণা করলেন।

শুরু হল সমর্থনের লড়াই। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটাকে মেনে নেওয়া হল। কন্ট্রোলার সেটিকে নথিভুক্ত করলেন। স্থির হল পরবর্তী মিটিং-এ তারা এ বিষয় নিয়ে আবার আলোচনা করবেন।

দু’ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে, টেবিল এখন একেবারে ফাঁকা। একদল মানুষ কেরোসিনের বোতল হাতে সেখানে চলে এলেন। টেবিলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। এলোমেলো বাতাস লকলকে জিভ দিয়ে আগুনকে পরিব্যাপ্ত করল।

পারাহা থেকে ফায়ারব্রিগেড এল, দেখল, কোনো কিছুই সেখানে অবশিষ্ট নেই, শুধু জেগে আছে তুষারের আর্তনাদ।

অ্যাসিস্ট্যান্ট ফায়ার চিফ সেই ছাইয়ের গাদার কাছে গেলেন, বললেন, কেরোসিন, আরসন।

ফায়ার চিফ ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে আছেন, অদ্ভুত একটা মনোভঙ্গি জেগেছে তার, তিনি বললেন–এটা একটা অবাক করা কাণ্ড!

–কোনটা?

–গত সপ্তাহে আমি এখানে এসেছিলাম, এই অরণ্যে শিকার করতে, এখানে কোনো কেবিন ছিল না!

.

প্রথম পর্ব

০১. ওয়াশিংটন ডিসি

স্টানটন রজার্সকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বরণ করা হতে পারে। উনি এক আশাপ্রদ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। একাধিক শক্তিশালী বন্ধু আছে তার। কিন্তু তিনি কি এই পদটা শেষ পর্যন্ত পাবেন?

স্টানটন রজার্স নিজেকে একজন ক্যাসানোভা বলে থাকেন। তিনি সুপুরুষ, অর্থবান, পৃথিবীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু এছাড়াও তার চরিত্রের কতকগুলো গুণ আছে। স্ত্রীকে প্রতারণা করার অনেক সুযোগ ছিল, তবু কখনও কোনো মহিলাকে তিনি স্বপ্নের মধ্যেও স্থান দেননি।

স্টানটন রজার্সের স্ত্রী, এলিজাবেথ। সামাজিক, সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। তারা সর্বত্র একসঙ্গে চলাফেরা করতে ভালোবাসেন। যে মেয়েটির প্রতি রজার্সের সামান্য আসক্তি আছে, তিনি হলেন বারবারা। ডিভোর্স হবার পর, আবার বিয়ে করেছেন, বয়সে স্টানটনের থেকে পাঁচ বছরের বড়। মুখটা খুব একটা খারাপ নয়, কিন্তু তাকে সুন্দরী বলা যায় না।

স্টানটন একজন অ্যাথলিট, বারবারা যে-কোনো ব্যায়ামকেই ঘৃণা করেন। স্টানটন বহির্মুখী জীবনকে ভালোবাসেন, বারবারা একলা থাকার প্রত্যাশী। স্টানটনের রাজনৈতিক সত্তা উদারনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। বারবারা রক্ষণশীল সমাজের প্রতিভু।

স্টানটনের সবথেকে কাছের বন্ধু পল এলিসন একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন বন্ধু, মেয়েটিকে মন থেকে তাড়িয়ে দাও। তুমি আর লিজ হলে এক সুখী দম্পতি। গিনিস্ বুকে তোমাদের নাম উঠবে।

স্টানটন বলেছিলেন– পল, বারবারাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। ডিভোর্স পেলেই আমি ওকে বিয়ে করব।

–একবার ভাবতে পারছ, এই ঘটনা তোমার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ওপর কী প্রভাব ফেলবে?

–এই দেশে অর্ধেক বিয়ে ডিভোর্সে শেষ হয়। নতুন করে আর কী হবে?

স্টানটন রজার্সের ভবিষ্যদ্বাণী কিন্তু সফল হয়নি। সকলেই তার সম্পর্কে জানতে বেশ উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। হলুদ সাংবাদিকরা চনমন করতে থাকে। স্টানটন রজার্সের ভালোবাসার নীড়ের ছবি তোলা হল। মধ্যরাতের ঘটনাবলির রগরগে বর্ণনা প্রকাশিত হল। অনেক দিন ধরে সংবাদপত্র এইসব গল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। যাঁরা স্টানটন রজার্সকে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন করবেন বলে ভেবেছিলেন, অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এক নতুন চ্যাম্পিয়ানের জন্ম হল, পল এলিসন।

.

পল এলিসন এক ভদ্র স্বভাবের মানুষ। তার মধ্যে অবশ্য পৌরুষের অহমিকা ছিল না। স্টানটন রজার্সের মতো বিরাট পটভূমিকাও নেই তার। তবে তিনি বুদ্ধিমান, মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। আর তার বাতাবরণ খুব একটা খারাপ নয়। খর্বাকৃতি, নীল চোখ, দশ বছর ধরে বিবাহিত জীবন যাপন করছেন। ইস্পাত ম্যাগনেটের কন্যা অ্যালিসকে নিয়ে তার সুখের সংসার।

স্টানটন রজার্সের মতো পল এলিসন ইয়েলে পড়াশোনা করেছেন। হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এই দুই পুরুষ একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। সাউদার্ন টানে তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস আছে। ছেলেবেলায় সেখানে একসঙ্গে সাঁতার কেটেছিলেন। বেসবল টিমে যোগ দিয়েছিলেন। হার্ভার্ডে তারা একই শ্রেণিতে পাশাপাশি পড়তেন। পল এলিসনের রেজাল্টটা ভালোই হয়েছিল। কিন্তু স্টানটন রজার্স স্টার পেয়েছিলেন।

হার্ভার্ড ল রিভিউ-এর সম্পাদক হিসেবে ইনি পলকে সহকারি সম্পাদক করেছিলেন। স্টানটন রজার্সের বাবা ছিলেন ওয়ার্লফিল ল ফার্মের এক অত্যন্ত সম্মানীয় অংশীদার। স্টানটন সেখানে গরমকালে কাজ করতেন। পলকেও তিনি সেখানে ঢুকিয়ে নিলেন। এখান থেকেই স্টানটন রজার্সের রাজনৈতিক ভাগ্য ধীরে ধীরে উঠতে থাকে। আর পল এলিসন ধূমকেতুর লেজ হয়ে বেঁচে থাকেন।

ডির্ভোস সব ঘটনা পালটে দিল। এখন স্টানটন রজার্স লড়াইতে পেছনে পড়ে গেলেন। বোঝা গেল, পল বোধহয় অচিরেই সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠে যাবেন।

সেনেটের নির্বাচনে পল হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তিনি ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন তার নাম ছড়িয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই দারুণ ভাষণ দিচ্ছেন। চারবছর ধরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন। প্রিয় বন্ধু স্টানটন রজার্সকে বৈদেশিক দপ্তরে উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করলেন।

.

মার্শাল ম্যাকলুহান বলেছিলেন, একদিন টেলিভিশন পৃথিবীকে একটা ছোট্ট গ্রামে পরিণত করবে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে তাই ঘটল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিয়াল্লিশতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অনুষ্ঠান উপগ্রহের মাধ্যমে ১৯০টি দেশের মানুষ সাগ্রহে দেখলেন।

.

ওয়াশিংটন ডিসি। ব্ল্যাক রুস্টার, সাংবাদিক বেন কোহনের কাছে আদর্শ জায়গা। তার স্ত্রী ওয়াশিংটন পোস্টে চাকরি করেন। তিনি চারজন সহকর্মীকে নিয়ে একটা টেবিলের চারপাশে বসে আছেন, সামনে বিরাট টেলিভিশন পর্দায় ওই শুভ মুহূর্তের প্রতিফলন।

কুকুরের বাচ্চাটা এই পদে বসার যোগ্য নয়।

একজন রিপোর্টার মন্তব্য করেছিলেন।

–একথা বোলো না। এলিসনের মধ্যে একটা ম্যাজিক আছে, তুমি তা বিশ্বাস করো তো?

বেন কোহনের মন্তব্য।

পেনসিলভেনিয়া এভিনিউতে হাজার মানুষের ভিড়। জানুয়ারির শীতার্ত বাতাসকে উপেক্ষা করে মানুষ ছুটে এসেছে। চারিদিকে লাউডস্পিকার বসানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান জ্যাসন মারলিন শপথ বাক্য পড়ালেন। নতুন প্রেসিডেন্ট মাথা নাড়লেন, মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

বেন কোহন মন্তব্য করলেন–দেখ, এবার উনি কী বলেন। উনি কিন্তু ইতিমধ্যেই ইতিহাস তৈরি করেছেন। কিছুদিন বাদে আমরা আমাদের ছেলে এবং নাতিদের বলব, পল এলিসনের শপথ গ্রহণের দিনে আমরা উপস্থিত ছিলাম।

বেন কোহন এক তুষোড় সাংবাদিক। শুরু থেকেই তিনি পল এলিসনের জীবনকথা প্রকাশ করেছেন। প্রথম দিকে তিনি খুব একটা প্রভাবিত হননি, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি পল এলিসন সম্পর্কে তার মন্তব্য পালটাতে বাধ্য হলেন। দেখলেন, এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কারোর তাঁবেদারি করেননি। উইলো গাছের অরণ্যে তিনি এক একক মহীরুহ।

ঝিরি ঝিরি তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। বেন কোহন ভাবলেন, রাতটা খুব একটা খারাপ হবে না। তিনি আবার টেলিভিশন সেটের দিকে নজর দিলেন।

–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ হল এক উজ্জ্বল আলোকশিখা। চারবছর অন্তর তা এক হাত থেকে অন্য হাতে চলে যায়। শেষ অবধি আমার হাতে এই অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্রটি এসেছে। এটির মধ্যে শক্তি আছে, কারণ এই অস্ত্র সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে। আবার ঠিকমতো ব্যবহার করলে এই আলোকশিখা সারা পৃথিবীকে উজ্জ্বল করতে পারে। এখন আমাদের ওপর বেছে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু আমার বন্ধুদের কথাই বলছি না, যারা সোভিয়েত মনোভাবাপন্ন, তাদেরও ডাক দিচ্ছি। কিছুদিন বাদেই আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করতে চলেছি। এখন লড়াইয়ের কোনো জায়গা নেই। এখন এক বিশেষ স্বপ্নকে সফল করতে হবে।

ভাষণ শেষ হল, বেন কোহন ভাবলেন, না, পল খুব একটা খারাপ বলেননি, মনে হচ্ছে মানুষটা বোধহয় টিকেই যাবেন।

কানসাসে জাংশন সিটি। দিনটা মোটেই ভালো নয়, হাইওয়ের দিকে তাকানো যাচ্ছে না এই কুয়াশাচ্ছন্ন। ম্যারি অ্যাসলে তার পুরোনো স্টেশন ওয়াগানটা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। ঝড় শুরু হল। ক্লাসে যেতে দেরি হবে কী? ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছেন। গাড়িটা যেন কোনো কারণে পিছলে না যায়, সেদিকে নজর আছে তার।

গাড়িতে যে রেডিয়ো আছে, সেখানে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।

…আমি নতুন এক আমেরিকার জন্ম দেব। ভবিষ্যতে যেন আর কখনও আণবিক যুদ্ধ না হয়, সেজন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ম্যারি অ্যাসলে ভাবলেন, আমি ওঁনাকেই ভোট দিয়েছি। আমার স্থির বিশ্বাস, উনি এক মহান রাষ্ট্রপতিতে পরিণত হবেন।

ম্যারি হাতের বাঁধন শক্ত করলেন। না, তুষার ঝড়টা এবার বোধহয় তেড়েই এল।

.

সেন্ট ক্ৰোইক্স।

আকাশের কোথাও বৃষ্টিপাতের চিহ্ন নেই। হ্যারি লানজ আজ আর বাইরে যাবেন না। বাড়ির মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। তিনি বিছানাতে শুয়ে আছেন, একেবারে উলঙ্গ। তাঁর দুপাশে দুই রঙ্গিনী, ওলিজের দুই বোনেরা। লানজ জানেন, এরা সহোদরা নন।

অ্যানেটে লম্বা, মাথার চুল বাদামি। শ্যালিও লম্বা, চুলের রং সোনালি।

বাইরের নিকুচি করেছে, দুজনেই একসঙ্গে আমাকে আনন্দ দিচ্ছে। এমন আনন্দ যা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।

মোটেল ঘরের একপাশে টেলিভিশনের পর্দায় প্রেসিডেন্টের হাসি মুখ।

…আমি মনে করি, আলোচনার টেবিলে বসলে যে-কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। শ্যালি কাজকর্ম বন্ধ করল। জিজ্ঞাসা করল, এবার কি আমি শুরু করব সোনামণি?

হ, তোমারটা আরও ভালো লাগে।

অ্যানেটে জানতে চাইল, তুমি কি ওই ভদ্রলোককে ভোট দিয়েছ?

হ্যারি লানজ মন্তব্য করলেন কাজের সময় আমি বকবক পছন্দ করি না।

.

…আপনারা জানেন, তিনবছর আগে রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোল্যাকের মৃত্যু হয়েছিল। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রোমানিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আমি জানাতে চাইছি, রোমানিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলেকজানড্রোস আমাদের সঙ্গে আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছেন।

পেনসিলভেনিয়া এভিনিউর জনগণ আনন্দে হাততালি দিল।

হ্যারি লানজ তাকিয়ে আছেন, অ্যানেটের দাঁতগুলো তাঁর পুংদণ্ডকে চোষণ করছে। লানজের মুখ থেকে আরামদায়ক শব্দ বেরিয়ে আসছে। আঃ, সুখ বোধহয় একেই বলে।

–জিনিসটা নড়াচড়া করছে, অ্যানেটে বলল।

 লানজ তাকালেন টেলিভিশনের দিকে।

প্রেসিডেন্ট বলছেন– আমরা অবিলম্বে রোমানিয়াতে একজন অ্যাম্বাসাডরকে পাঠাব। এভাবেই কাজটা শুরু হবে।

.

বুখারেস্ট। সন্ধে হয়েছে। শীতের আবহাওয়া হঠাৎ নরম হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে মানুষজনের ভিড়। চারপাশে খুশি খুশি ভাব।

.

রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজানড্রোস তার অফিসে বসে আছেন পুরোনো প্রাসাদের মধ্যে। চারপাশে অনেক সহকারি। তারা শট-ওয়েভ রেডিয়ো মারফত ভাষণ শুনছেন।

মার্কিন প্রধানমন্ত্রকের প্রেসিডেন্ট বলছেন–এখানেই আমি থামব না, ১৯৪৬ সালে আলবানিয়া আমাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। আমি সেই ছেঁড়া সম্পর্ক জোড়া লাগাব। বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং পূর্ব জার্মানির সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখব।

রেডিয়োতেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, জনগণ এক একটি শপথকে কীভাবে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

.. রোমানিয়াতে আমাদের অ্যাম্বাসাডর পাঠাতে হবে। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে, আমরা সবাই একই উৎস থেকে পৃথিবীতে এসেছি। আমাদের সকলেরই একই সমস্যা আছে। আমাদের সকলের অন্তিম একইভাবে ঘটবে।

পাঁচ মিনিট ধরে হাততালি।

 মারিন গ্রোজা চিন্তার সঙ্গে বললেন– লেফ, কথাগুলো কিন্তু সত্যি।

সিকিউরিটি চিফ লেফ পাসটেরনাফ মন্তব্য করলেন- হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে।

.

পেট কোনরস, অনেকটা স্কচ খেয়ে ফেলেছেন। পাশে শুয়ে আছেন তার উপপত্নী ন্যানসি, প্রিয়তমা সেক্রেটারি। ভদ্রমহিলা বললেন- পেট, আর খেও না।

পেট হেসে পেছনে একটা থাপ্পড় মারলেন প্রেসিডেন্ট কথা বলছেন, কিছুটা শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। কমিউনিস্ট, কুকুরির সন্তান, রাগ করলেন তিনি। এটা হল আমার দেশ, সিআইএ এখানকার সর্বময় কর্তা। নাও, তোমার কারুকাজ শেষ করো।

.

০২.

পল এলিসন বললেন- বন্ধু, সব ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই।

স্টানটন রজার্স জবাব দিয়েছিলেন সাহায্য আমি নিশ্চয়ই করব।

তারা বসে আছেন, ওভাল অফিসে, প্রেসিডেন্ট তার নির্দিষ্ট আসনে, পটভূমিতে মার্কিন দেশের পতাকা। এটাই হল অফিসের প্রথম আলোচনা। প্রেসিডেন্ট এলিসনকে কেমন অসন্তুষ্ট মনে হল।

সামান্য একটা ভুল না হলে, আজ এই আসনে আমার বন্ধু বসে থাকত।

 স্টানটন রজার্সের মনে অন্য একটা চিন্তা একটা কথা বলি, যেদিন তোমাকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হল, পল, আমি ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। এটা আমার স্বপ্ন, কিন্তু তুমি সেই স্বপ্নটাকে কেড়ে নিয়েছ। শেষ অবধি বুঝতে পারলাম, আমি এই চেয়ারে বসলেও তা রক্ষা করতে পারতাম না। তুমি বসাতে আমি তাই খুশি হয়েছি।

পল এলিসন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হেসে বললেন– স্টান, তুমি একটা সত্যি কথা বলেছ। এখানে বসাটা খুব একটা সহজ নয়, সবসময় ওয়াশিংটন লিংকন আর জেফারসনের ভূত তোমাকে তাড়া করবে।

উনি ডেস্কে বোতাম টিপলেন, সাদা জ্যাকেট পরা স্টুয়ার্ট এসে গেল।

কফি, দুকাপ। তার সঙ্গে আর কিছু লাগবে না।

.

হঠাৎ বারবারার কথা মনে পড়ে গেল। অনেকে ভেবেছিল, এই বিয়েটা বোধহয় একবছরের বেশি টিকবে না। শেষ পর্যন্ত টিকে আছে। আজ স্টানটন রজার্স এক বিখ্যাত আইনজীবী, বারবারা অভিজাত মহিলা হিসেবে সম্মানিয়া।

পল এলিসন বলতে শুরু করলেন এই সময় অনেকে বিরুদ্ধাচরণ করবে। তুমি সব কটা খবরের কাগজ পড়ছ তো?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রজার্স বললেন–, কাগজে নানা কথা লেখা হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক।

–আমিও ওদের খুব একটা দোষ দিতে পারছি না।

 দুজনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন, কফির কাপে চুমুক দেওয়া হল, এবার আসল কাজ শুরু হবে।

কী কাজ? রোমানিয়াতে একজন যোগ্য অ্যাম্বাসাডর পাঠাতে হবে। এই দায়িত্বটা স্টানটন রজার্সের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হল।

.

নিউলি, একটা ছোট্ট উপ-শহর। রাত দুটো। মারিন গ্রোজার চেরা। চারপাশে অন্ধকার। চাঁদের মুখে ঝোড়ো মেঘের ওড়না। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। একজনের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কালো পোশাক পরা কেউ একজন। কে সে? সাইলেন্সর লাগানো বন্দুক তার হাতে, সে দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করল। নাইলনের দড়ি খুলল। হুক সঙ্গে ছিল, দরজার প্রান্তভাগে হুকটা লেগে গেল। এবার সে উঠতে শুরু করেছে। অনেক দূর উঠে সারা গায়ে কম্বলের ঢাকনা দিল। তার হাতে ধাতুর তৈরি কৃত্রিম নখর। চুপচাপ উঠতে থাকল। এবার দড়িটাকে অন্যদিকে ঠেলে দিল। দেখল সব ঠিক আছে কিনা।

কুকুরগুলো চিৎকার করবে কি? যে-কোনো সময়ে এই ঘটনাটা ঘটতে পারে, ডেরাটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, বোমা মেরেও এর ক্ষতি করা যাবে না।

লোকটি কে?

ওদিকে কুকুররা চিৎকার করতে শুরু করেছে। অন্ধকারে তাদের চোখ জ্বলছে। তারা লোকটিকে আক্রমণ করেছে। লোকটি বন্দুক বাগিয়ে ধরল। গুলি করার চেষ্টা করল।

এবার কী হবে? একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল–প্লিজ, বন্দুকটা ফেলে দাও, হাত তুলে দাঁড়াও।

কালো পোশাক পরা লোকটা বন্দুক ফেলে দিল। তাকিয়ে দেখল। অন্তত ছজন, দরজার মাথায়, ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে, হাতে নানা ধরনের অস্ত্র।

লোকটা আর্তনাদের শব্দ করল তোমরা এখানে কী করছ?

একজন প্রহরী বলল- আমরা জানতাম, তোমাকে আসতেই হবে।

 লেফ পাসটেরনাফ–আমাকে তখনই থামালে না কেন? আমি তো সুইসাইড অভিযানের জন্য আসিনি। কাল সকাল আটটায় সবাইকে একটা মিটিং-এ বসতে হবে।

লেফ পাসটেরনাফ এই বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রহরী। ইস্টারের যুদ্ধে অভিজ্ঞতা আছে তার। মোসাদ অর্থাৎ ইজরায়েলের গোপন সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। দুবছর আগের একটি সকালের কথা আজও তিনি ভুলতে পারেন না।

কর্নেল তাকে ডেকে বলেছিলেন লেফ, তোমাকে কেউ একজন কয়েক সপ্তাহ ভাড়া করতে চাইছে।

-কে?

–মারিন গ্রোজা।

 রোমানিয়া সম্পর্কে মোসাদের হাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আছে। গ্রোজা হলেন রোমানিয়ান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শ্রেণির নেতা। সেখানে একটা অভ্যুত্থান হয়েছিল, সরকার পালটে যাবার মতো পরিস্থিতি। মারিন গ্রোজাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করা হয়। একটি আঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

পাসটেরনাফ জানতে চেয়েছিলেন– উনি আমার কাছ থেকে, কী চাইছেন? সরকারই ওঁকে সবরকম নিরাপত্তা দেবে।

-সেটাই যথেষ্ট নয়, উনি তোমার সহযোগিতা চাইছেন।

–আমাকে ফ্রান্সে যেতে হবে?

–মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য।

–আমি পারব না।

-লেফ, কেন এমন করছ? আমাদের কাছে খবর আছে, ওই দেশে গোলমাল শুরু হতে পারে, ততদিন পর্যন্ত এই মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

লেফ পাসটেরনাফ বললেন- আপনি ঠিক বলছেন তো, মাত্র কয়েকটি সপ্তাহ?

-হ্যাঁ, আমি আবার বলছি।

.

সময় সম্পর্কে তিনি ঠিক কথা বলেননি। কিন্তু মারিন গ্রোজা সম্পর্কে ঠিক তথ্য দিয়েছিলেন। পাতলা চেহারার এক ভদ্রলোক, মুখটা কেমন দুঃখী দুঃখী, নাকটা লম্বা, চিবুকটা ধারালো, কপালটা চওড়া। একগুচ্ছ সাদা চুল। তীক্ষ্ণ কালো চোখ। যখন কথা বলেন, মনে হয় উত্তেজনায় কাঁপছেন।

প্রথম সাক্ষাৎকারে লেফকে বলেছিলেন–আমার বাঁচা-মরাটা ওদের ওপর নির্ভর করছে।

-কেন বলুন তো?

–রোমানিয়াকে আমরা স্বাধীন করব। এখানকার জনগণ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বেছে নিতে পারবেন।

লেফ পাসটেরনাফ তার বিদ্যাবুদ্ধি জাহির করলেন। তিনি নিউলিতে রক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করলেন। কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে নিয়ে এলেন। কিছু মানুষকে ভাড়া করলেন।

পাসটেরনাফ জানতেন, রোমানিয়ার বিভিন্ন বিদ্রোহী নেতা এখানে আসা-যাওয়া করেন। তিনি তাদের সাথে আরও বেশি করে সময় কাটালেন। মারিন গ্রোজা সম্পর্কে পাসটেরনাফ অনেক খবর জানতে পেরেছিলেন।

মাঝেমধ্যে পাসটেরনাফ ডেরার ওপর আক্রমণ করতেন ইচ্ছে করেই। দেখতেন সেটা কতখানি সুরক্ষিত। এখন বুঝতে পারলেন, কোনো কোনো প্রহরী একেবারে বাজে। অবিলম্বে তাদের স্থানান্তরিত করতে হবে।

তিনি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। হিট সেন্টার ঠিক আছে কিনা দেখলেন। ইলেকট্রনিক যন্ত্র? অতি বেগুনি রশ্মি? শেষ অবধি মারিন গ্রোজার শোবার ঘরে পৌঁছে গেলেন। গ্রোজা আর্তনাদ করছেন।

লেফ পাসটেরনাফ গ্রোজার ঘর পার হলেন। তখনও তিনি হাঁটছেন।

.

০৩.

সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সির হেড কোয়ার্টার। ভার্জিনিয়ার ল্যাংলেতে অবস্থিত, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সাত মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।

একটির পর একটি প্রহরীর অবস্থান। গেট হাউসের চারপাশে চব্বিশ ঘণ্টা প্রহরা দেওয়া হয়। ছাড়পত্র আছে এমন আগন্তুকদেরই ভেতরে ঢোকার অনুমতি মেলে। এই ধূসর রঙের সাততলা বাড়িটাই হল নিরাপত্তার শেষ কথা। ভেতরে একতলাতে আছে কাঁচের তৈরি করিডর। মধ্যে ম্যাগনোলিয়া গাছের সমাহার। রিসেপশন ডেস্কের ওপর মার্বেলের কবিতা খোদাই করা–তুমি কি সত্যিটা জানো?

সত্য অবশ্যই মুক্ত এবং স্বাধীন হবে।

এখনও পর্যন্ত কোনো জনগণ এই বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। এখানে কাউকে আসতে দেওয়া হয় না।

.

সাততলাতে আছে কনফারেন্স রুম। প্রহরীরা সবসময় পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র অস্ত্রের মাধ্যমে। পয়েন্ট আটত্রিশ রিভলবার, তাদের সুটের মধ্যে ভরা আছে।

সোমবার সকালবেলা।

বিশিষ্ট আধিকারিকদের বৈঠক চলেছে। ওক টেবিলের চারপাশে নানা পদাধিকারীরা উপস্থিত হয়েছেন। আছেন সিআইএ-র ডিরেক্টার নেড টিলিনগাস্ট, জেনারেল অলিভার ব্রুদস, সেক্রেটারী অব স্টেট ফ্লাইওড বেকার, পেট কোনরস এবং স্টানটন রজার্স।

নেড হলেন সিআইএ-র ডিরেক্টর, ষাট বছর বয়স হয়েছে, শান্ত স্বভাবের মানুষ। গুপ্ত কথা চেপে রাখতে ভালোবাসেন। গত সাত বছর ধরে তিনি এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।

জেনারেল অলিভার ব্রুদস ছিলেন এক বিশিষ্ট সৈন্য, তিনি নিয়মনীতি মেনে চলতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন।

সেক্রেটারি অব স্টেট ফ্রাইওড, জীবন সম্পর্কে নিরাশা পোষণ করেন। তার চেহারাটা খুবই ভালো, মাথায় রুপোলি চুলের ঝিলিক। মুখের মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ আছে। মনটা খুবই শক্ত। দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের আসল মালিক, যথেষ্ট পয়সা আছে তার।

পেট কোনরস হলেন এক কালো আইরিস। সূর্যের আলোয় চেহারাটা ঝলসে গেছে। মাঝেমধ্যে বেশি পান করতে ভালোবাসেন। ভয় শব্দের সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। সিআইএ-তে এটাই তার শেষ বছর। আগামী জুন মাসে তাকে অবসর নিতে হবে। পেট কয়েক বছর ধরে এই সংস্থাটিকে চালিয়ে এসেছেন। তিনি বিভিন্ন ইনটেলিজেন্স ডিভিশনে কাজ করেছেন। সেই পুরোনো দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়, যখন সিআইএ তার ষড়যন্ত্রের জাল সারা পৃথিবীতে বিস্তার করেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে পেটকে আমরা সোনালি ছেলে বলতে পারি। ইরানের ময়ূর সিংহাসনকে কেন্দ্র করে যে অভুত্থান হয়, পেট সেখানে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে অস্ট্রিয় সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য তাপারেশন মংগুঁজের আয়োজন করা হয়েছিল, পেট ছিলেন এই ষড়যন্ত্রের অন্তরালে।

কিন্তু এখন সব কিছুই পালটে গেছে। পেট মাঝে মধ্যে শোক প্রকাশ করেন। পৃথিবী জুড়ে এখন শান্তির বাতাবরণ। সিআইএ-র কাজ এখন ক্রমশ কমে আসছে। তাই বোধহয় এখন সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়াই ভালো।

আলোচনা এগিয়ে চলেছে, পেটের মুখখানা রাগে থমথম করছে।

–প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তিনি কি চাইছেন দেশটাকে অন্যের কাছে বেচে দিতে?

বেকার বাধা দিয়ে বললেন- এক সপ্তাহ হল নতুন প্রেসিডেন্ট অফিসে বসেছেন। আগে দেখা যাক তিনি কী করতে চাইছেন, তারপর তো?

না, মিঃ, আমি এটা কখনোই বরদাস্ত করব না। কেন প্রেসিডেন্ট তার পরিকল্পনার কথা খুলে বলছেন না?

–হয়তো উনি কিছু একটা চিন্তা করছেন, বেকার বললেন।

পেট বললেন আপনি কি প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করেন?

বেকার বললেন– উনি এদেশের সর্বোচ্চ কর্তা।

নেড স্টানটন রজার্সের দিকে তাকালেন– কোনরসের কথাটা ফেলে দেবার নয়। প্রেসিডেন্ট রোমানিয়া, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে চলেছেন। আপনি কি জানেন এইসব কমিউনিস্ট দেশের গুপ্তচররা এখানে কত সক্রিয়? আমরা কেন জেনেশুনে আবার একটা খারাপ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাব?

জেনারেল ব্রুদস মাথা নাড়লেন– আমাদের সাথে আলোচনা করা হয় না। আমার মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্টের এইসব পরিকল্পনা দেশটাকে একেবারে উচ্ছন্নের পথে নিয়ে যাবে।

স্টানটন রজার্স বললেন– ভদ্রমহাশয়রা, আপনাদের উদ্বেগ এবং আকুলতা অনুভব করতে পারছি। একটা কথা মনে রাখবেন, জনগণ কিন্তু পল এলিসনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আমরা প্রেসিডেন্টের দলভুক্ত সাধারণ সদস্য মাত্র। তার প্রত্যেকটি কাজকে আমরা সমর্থন করব।

কিছুক্ষণের নীরবতা–ঠিক আছে, তাহলে তাই হোক, কে একজন বলে উঠলেন।

ব্যাপারটা পেটের মোটেই ভালো লাগেনি। বারবার তিনি তার অসন্তোষ প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। নেডও তার দলভুক্ত। হয়তো কোথাও বিপ্লবের কালো মেঘের সঞ্চারন। দেখা যাক কী হয়!

এইভাবেই আলোচনা তার পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল। বোঝা গেল, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলেই চিন্তা করছেন। বিশেষ করে মস্কোর কেজিবি, সিআইএ-র প্রতিদ্বন্দ্বী। ওদের হাতে অনেক ক্ষমতা। ওরা যদি একবার এই দেশের বুকে আস্তানা তৈরি করে তাহলে কী হবে?

স্টানটন রজার্স তার অফিসে ফিরে এলেন। কাকে রোমানিয়ার রাষ্ট্রদূত পদে বসানো যায়? সম্ভাব্য কয়েকটা নাম মুখ বন্ধ খামের মধ্যে পড়ে আছে। অসাধারণ তালিকা। সেক্রেটারি অফট্রেট তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছেন। প্রত্যেকেই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেছেন। কেউ কেউ আবার আফ্রিকা কিংবা দূর প্রাচ্যে গেছেন। স্টানটন ভাবলেন, এই তালিকাটি দেখলে রাষ্ট্রপতি নিশ্চয়ই খুশি হবেন।

পল এলিসন বললেন- এঁরা সব ডাইনোসোর, আমি এঁদের সকলকে চিনি।

স্টানটন বাধা দেবার চেষ্টা করলেন–পল, ভেবে দেখ, এঁরা সকলেই কিন্তু প্রশিক্ষিত রাষ্ট্রদূত।

–এটাই হল আমাদের একটা অদ্ভুত ঐতিহ্য! তিন বছর আগে রোমানিয়াতে কী হয়েছিল মনে আছে তো? আমাদের রাষ্ট্রদূত কী করেছিলেন? না, এভাবে হবে না, নতুন কাউকে। খুঁজে বের করতে হবে।

কিন্তু, ওখানে একেবারে অ্যামেচার কাউকে পাঠানো উচিত হবে কী? ব্যাপারটা ভয়ংকর হয়ে যাবে না কি?

–এমন একজনকে, যার সামান্য অভিজ্ঞতা আছে স্টান, রোমানিয়া তার কাছে একটা নতুন বিচরণক্ষেত্র হতে পারে। দেখা যাক, কী করা যায়। ভেবে দেখ, দেশটা কিন্তু স্পর্শকাতর। বুলগেরিয়া, আলবানিয়া, চেকোশ্লোভোকিয়া সম্পর্কেও নতুন করে ভাবতে হবে। এখনও পর্যন্ত যে দেশগুলো লৌহযবনিকার আড়ালে থেকে গেছে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

–তাহলে কি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তালিকাটা একবার দেখব?

প্রেসিডেন্ট এলিসন মাথা নাড়লেননা, সেখানেও সমস্যা আছে। এমন একজন চাই, যিনি তরতাজা মার্কিন প্রজন্মের প্রতিনিধি।

স্টানটন রজার্স প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন, একটু অবাক হয়েছেন পল, তুমি কি কারোর কথা মনে করেছ?

পল এলিসন সিগার ধরালেন। বললেন–হ্যাঁ, একজনের নাম আমার মনে পড়ছে।

.

-সে কে?

–একজন মহিলা। তুমি ফরেন অ্যাফেয়ার্সের সাম্প্রতিক সংখ্যা পড়েছ?

–হ্যাঁ।

–কী মনে হচ্ছে তোমার?

ব্যাপারটা সত্যিই ভালো। লেখিকা বিশ্বাস করেন যে, কমিউনিস্ট দেশগুলির সাথে । সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাহলেই আমরা অর্থনীতির দিক থেকে স্থিতিশীল হয়ে উঠব। অনেকটা তোমার উদ্বোধনী ভাষণের মতো।

–জানো, এটা কিন্তু ছমাস আগে লেখা হয়েছে। ওই ভদ্রমহিলা কমেন্টরি এবং পাবলিক অ্যাফেয়ার্স পত্রিকাতেও নিয়মিত প্রবন্ধ লেখেন। গত বছর আমি পূর্ব ইউরোপের রাজনীতির সমস্যা সম্পর্কে তার লেখা একটি বই পড়েছিলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ওই বইটা পড়ে আমি আমার মতবাদ খানিকটা পালটাতে পেরেছি।

–হ্যাঁ, প্রবন্ধলেখিকার সঙ্গে তোমার মতের মিল হতে পারে, কিন্তু তা বলে ওই ভদ্রমহিলাকে এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে

-স্টান, এখানেই ব্যাপারটাকে আটকে রেখো না। ভদ্রমহিলার স্বপ্ন আছে, তিনি চারটে সন্ধিচুক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করেছেন।

কীভাবে?

–ভেবে দেখো, ১৯৪৯ সালে কী হয়েছিল? প্রাচ্য দেশগুলি একটা সুন্দর সংগঠন স্থাপন করে। নাম দেওয়া হয়েছিল comeeon, ১৯৫৮ সালে ইউরোপের দেশগুলো মিলে স্থাপন করে একটি কমন মার্কেট, তাই তো?

–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

–আমাদের হাতে একটা সংস্থা আছে, অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট, এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে, আছে কয়েকটা পশ্চিমি দেশ এবং যুগোশ্লোভিয়া। আমরা কেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে ভুলে যাব? ভেবে দেখ তো, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম সারিতে এসে গেছে।

প্রেসিডেন্টের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা জেগেছে– সম্ভাবনার কথা চিন্তা কর! যদি আমরা এই সমস্ত সংগঠনগুলিকে একীভূত করতে পারি তাহলে কী হবে? তাহলে বিশ্বের বাজারটাতে আমরা কর্তৃত্ব করতে পারব। আর বিশ্বের বুকে চিরস্থায়ী শান্তি স্থাপিত হবে।

স্টানটন রজার্স সাবধানে বললেন– কল্পনার মধ্যে বাস্তবতা কতখানি আছে, আমি জানি না, কিন্তু এটা তো অনেক দিনের ব্যাপার।

তুমি কি একটা পুরোনো চাইনিজ কোয়ার মনে রেখেছ- একটা পা ফেলেই আমরা হাজার মাইলের পদযাত্রা শুরু করি।

–কিন্তু ভদ্রমহিলা একেবারে অ্যামেচার।

–আমাদের অনেক বিশিষ্ট রাষ্ট্রদূত তো অ্যামেচার হিসেবেই জীবন শুরু করেছিলেন। ভেবে দেখতো, গ্রেট ব্রিটেনের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত অ্যামে আর্মস্টং-এর কথা। তার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ।

ডেনমার্কে পার্লে মেস্টাকে বসানো হয়েছিল, ইতালিতে আমাদের অ্যাম্বাসাডর ছিলেন ক্লারে বুথে বুস। জন গভিন, একজন অভিনেতা, তাকে মেক্সিকোতে পাঠানো হয়। তাহলে? তোমার চোখে এঁরা সকলেই অ্যামেচার।

–কিন্তু তুমি এই ভদ্রমহিলা সম্পর্কে কী জানো?

উনি বুদ্ধিমতী, ওঁর মাথাটা পরিষ্কার, নতুন জিনিসের সঙ্গে সহজেই মানাতে পারেন। ওঁর নাম হল ম্যারি অ্যাসলে।

.

দুদিন কেটে গেছে, প্রেসিডেন্ট এলিসন এবং স্টানটন রজার্স একসঙ্গে বসে প্রাতরাশ সারছেন।

তোমাকে একটা খবর দেওয়ার আছে, স্টানটন রজার্স, তার পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে বললেন ম্যারি এলিজাবেথ অ্যাসলে, সাতাশ নম্বর ওল্ড মিল ফোর্ড রোড, জাংশন সিটি, কানসাস। বয়েস পঁয়ত্রিশ, ডঃ এডওয়ার্ড অ্যাসলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, দুটি সন্তানের জননী। বেথের বয়স বারো আর টিমের বয়স দশ। ওই ভদ্রমহিলা জাংশন সিটি চ্যাপ্টারের ওম্যান ভোটার্সের চেয়ারম্যান। ইস্ট ইউরোপীয়ান পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার, কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ওঁর ঠাকুরদাদার জন্ম হয়েছিল রোমানিয়াতে।

-হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, রোমানিয়া সম্পর্কে ওঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে।

–তাহলে?

এবার ভদ্রমহিলাকে নজরে রাখো। ওঁর অতীত ইতিহাসটা পুরো জানতে হবে।

.

০৪.

ম্যারি অ্যাসলে, আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না।

ব্যারি ডাইলান, সবথেকে উজ্জ্বল এবং কমবয়সি ছাত্র, অ্যাসলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে, আলেকজানড্রোসের মতো খারাপ মানুষ আমি কখনও দেখিনি।

–ওই ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে? ম্যারি জানতে চাইলেন।

এই সেমিনারে বারোজন গ্রাজুয়েট ছাত্র যোগ দিয়েছে। কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি হলে এই সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ছাত্ররা সকলে ম্যারির সামনে বসে আছে, অর্ধবৃত্তাকারে। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়া অধ্যাপিকা। অসাধারণ বাগ্মী। কথার মধ্যে কৌতুক কণার বৃষ্টিপাত। এমনভাবে আলোচনা করেন, মনে হয় আন্তরিক। মাঝেমধ্যে তার ডিম্বাকৃতি মুখটি পরিবর্তিত হয়। কখন কোন আবেগ তাকে আল্লুত করছে, তার ওপর নির্ভর করে এই রূপান্তর। দেখতে ভারি সুন্দর! চোখের তারায় দৃষ্টিগ্রাহ্য ধূসরতা। মাথার চুল ঘন এবং সংবদ্ধ। তার স্বাস্থ্যসুষমা দেখে মেয়েরা অবাক হয়ে যান, ছাত্রদের মনে স্বপ্ন জগতের হাতছানি। ম্যারি জানেন না, কত সুন্দরী তিনি!

ব্যারি ভাবছিলেন, উনি কি স্বামীকে নিয়ে তৃপ্তা? এখন আবার সমস্যাটা এসে দাঁড়াল।

–হ্যাঁ, যখন ওই ভদ্রলোক রোমানিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন, তিনি বিরুদ্ধপক্ষদের বিলুপ্ত করার চেষ্টা করেন। সোভিয়েতপন্থী হয়ে ওঠেন।

আরেকজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট এলিসন তাই তার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছেন।

–আমরা তাকে পাশ্চাত্য জগতের মধ্যে আনতে চাইছি।

–মনে রেখো, ম্যারি বললেন, নিকোলাই কিন্তু দু তরফের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে চান। কখন এই ঘটনাটা শুরু হয়েছিল মনে আছে কী?

ব্যারি বললেন- হ্যাঁ, ১৯৬০ সালে, রাশিয়া এবং চিনের মধ্যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

–রোমানিয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কী জানো? ওয়ারশ চুক্তির মধ্যে যে দেশগুলি আছে, তাদের সাথে এবং রাশিয়ার সাথে কেমন সম্পর্ক ম্যারি জানতে চাইলেন।

এখন সম্পর্ক আরও ভালো হয়েছে।

আরেকটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আমি তা মনে করি না। রোমানিয়া রাশিয়াকে আক্রমণ করেছে, রাশিয়া কেন আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে নাক গলাচ্ছে, প্রফেসর অ্যাসলে?

ঘন্টা পড়ে গেল, সময় হয়েছে।

ম্যারি বললেন সোমবার আমি এ ব্যাপারে আরও কথা বলব। আমি বোঝাব, রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করছে। প্রসিডেন্ট এলিসন কেন এই ব্লকের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে চলেছেন সেটাও বলব। সপ্তাহের শেষটা তোমাদের ভালো কাটুক, কেমন।

ম্যারি দেখলেন, ছাত্রছাত্রীরা উঠে দাঁড়িয়েছে, তারা সার বেঁধে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে।

–আপনিও ভালো থাকবেন প্রফেসার।

 ম্যারি অ্যাসলে এইসব সেমিনারে ভাষণ দিতে খুবই ভালোবাসেন। ইতিহাসের পাশাপাশি ভূগোলও জীবন্ত হয়ে ওঠে। বুঝতে পারা যায়, এই সব ছাত্রছাত্রীরাই একদিন দেশের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে।

কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তিনি পাঁচ বছর ধরে পড়াচ্ছেন, এখনও প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনা অনুভব করেন। সারা বছরে পাঁচটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাশ তাকে নিতে হয়। এছাড়া গ্রাজুয়েট সেমিনারে যোগ দিতে হয়। প্রত্যেকটি সেমিনারে সোভিয়েত দেশ এবং তার আশ্রিত দেশগুলি সম্পর্কে কথা বলতে হয়। মাঝেমধ্যে নিজেকে কেমন যেন প্রতারক বলে মনে হয় অধ্যাপিকার। হায়, যেসব দেশের কথা আমি বলি, সেসব দেশে আমি কখনও পদার্পণ করিনি। শুধুই পুঁথিপড়া বিদ্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যাবার সৌভাগ্য অথবা সুযোগ কিছুই হল না আমার।

.

ম্যারি অ্যাসলের জন্ম হয়েছিল জাংশন সিটিতে। তাঁর পরিবারের একমাত্র যিনি ইউরোপ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তিনি হলেন ঠাকুরদাদা। তিনি এসেছিলেন রোমানিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম ওডনের থেকে।

.

 মাস্টার ডিগ্রি লাভ করার পর ম্যারি ভেবেছিলেন বিশ্ব ভ্রমণে বেরোবেন। কিন্তু সেই বছর গরমকালে এডওয়ার্ড অ্যাসলের সঙ্গে তার দেখা হল। ইউরোপীয় পরিভ্রমণ পরিণত হল জাংশন সিটি থেকে পঞ্চান্ন মাইল দূরবর্তী ওয়াটারভিলার মধুচন্দ্রিমাতে। এখানে এডওয়ার্ড গিয়েছিলেন এক হার্ট পেশেন্টকে শুশ্রূষা করতে।

ম্যারি বলেছিলেন– পরবর্তী বছর আমরা নিশ্চয়ই যাব। রোম, প্যারিস আর রোমানিয়াতে।

দেখা যাক আসছে বছর গরমকালে।

.

পরবর্তী গরমে বেথের জন্ম হল। এডওয়ার্ড গ্রেগরি কম্যুনিটি হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দুবছর পর টিমের জন্ম হল। ম্যারি পি এইচ ডি ডিগ্রি নিলেন। কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে শুরু করলেন। বছরগুলো কোথা দিয়ে কেটে গেল। শিকাগো, আটালান্টা এবং ডেনভা ছাড়া তিনি আর কোথাও যাননি। অর্থাৎ কানসাস রাজ্যের বাইরে যাবার সুযোগ তার হয়নি।

একদিন… ম্যারি ভাবলেন।

.

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। তুষার অদ্ভুত কারুকাজ আঁকছে, ধূসর পৃথিবী। আবার তুষার পড়তে শুরু হল। ম্যারি চামড়ার কোটটা পরলেন, লাল উলের স্কার্ফ, এবার এগিয়ে গেলেন যেখানে তার গাড়ি পার্ক করা আছে সেইদিকে।

ক্যাম্পাসটা বিশাল, তিনশো পনেরো একর, সাতাশিটা বাড়ি আছে, ল্যাবোরেটরি, থিয়েটার চ্যাপেল, চারপাশে গাছের সমারোহ। দূর থেকে মনে হয় এটা বোধহয় প্রাচীন দুর্গপ্রসাদ।

ম্যারি টেনিসন হলকে পাশে রেখে এগিয়ে গেলেন। এক অজানা ভদ্রলোক নিকন ক্যামেরা নিয়ে তাকে অনুসরণ করছেন। তিনি একটির পর একটি ছবি তুলছেন ম্যারিকে সামনে রেখে।

কিন্তু কেন? বোঝা গেল না। এক ঘণ্টা বাদে এই ফটোগ্রাফের নেগেটিভ পাঠানো হল ওয়াশিংটন ডিসিতে।

প্রত্যেক শহরের একটা নিজস্ব ছন্দ থাকে, থাকে নিজস্ব জীবন যন্ত্রণা এবং উন্মাদনা। জাংশন সিটি, কানকাস সিটির একশো ত্রিশ মাইল দূরবর্তী একটা ছোট্ট শহর। এখানে ‘ডেইলি ইউনিয়ন’ নামে একটি পত্রিকা আছে। একটি রেডিয়ো এবং টেলিভিশন স্টেশন আছে। আর অসংখ্য দোকান আছে শহরের কেন্দ্রস্থলে। দুনম্বর স্ট্রিট সবথেকে জনপ্রিয়। ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক আছে, ডোমিনো পিজা, সাভার জুয়েলারি, আরও কত কী। ফাস্টফুডের চেন আছে, বাস স্টেশন, ছেলেদের পোশাকের দোকান, মদের দোকান। জাংশন সিটিতে যাঁরা বাস করেন তারা শান্তি এবং নৈঃশব্দ্যকে ভালোবাসেন। সপ্তাহের শেষের দিকে জাংশন সিটির পার্শ্ববর্তী ফোর্টরিলের সৈন্যদের দাপাদাপিতে ভরে ওঠে। শুরু হয় তাদের অবসর এবং আনন্দের প্রহর।

.

ম্যারি অ্যাসলে ডিরন্স মার্কেটে থামলেন। কিছু খেতে হবে। তারপর, বাড়ি অর্থাৎ ওল্ড মিল ফোর্ড রোডের দিকে এগিয়ে যাবেন। লেকের ধারে তাদের ছোট্ট বাসস্থান। ওক আর এলম গাছের সমাহার।

অ্যাসলের বাড়িটি দোতলা, পাথর দিয়ে তৈরি। একটু উঁচু টিলার ওপর। ডঃ এডওয়ার্ড অ্যাসলে এই বাড়িটি কিনেছিলেন তেরো বছর আগে। মস্ত বড়ো একটা লিভিংরুম আছে। ডাইনিং রুম, লাইব্রেরি, ব্রেকফাস্ট রুম, কিচেন। দোতলায় আছে মাস্টারস সুইট আর দুটো অতিরিক্ত বেডরুম।

ম্যারি মাঝে মধ্যেই অনুযোগ করতেন- দুজনের পক্ষে বাড়িটা বিরাট।

এডওয়ার্ড প্রিয়তমা স্ত্রীকে আদর করতে করতে বলতেন- কেন ভাবছ, আমরা চিরদিন দুই থাকব নাকি?

.

ম্যারি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এলেন। টিম এবং বেথ তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে।

টিম আনন্দের সঙ্গে বলল– মা-মা, তুমি কি জানো খবরের কাগজে আমাদের ছবি ছাপা হবে?

ম্যারি বললেন- আঃ, ব্যাগটা রাখতে দে। কোন্ কাগজ?

–লোকটা বলেননি, উনি আমাদের ছবি নিচ্ছিলেন।

 ম্যারি ছেলের মুখের দিকে তাকালেন- উনি বলেননি কেন?

না, টিম জবাব দিল। কিন্তু ওঁনার হাতে একটা নিপটি নিকন ক্যামেরা ছিল।

.

রোববার, ম্যারি তার পঁয়ত্রিশতম জন্মদিন পালন করলেন। এডওয়ার্ড তার জন্য কাউন্টি ক্লাবে একটা সারপ্রাইজ পাটির ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রতিবেশী ফ্লোরেন্স আর ডগলাসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আরও চার জোড়া দম্পতি। এডওয়ার্ডকে মনে হল, তিনি বুঝি হারোনো শিশুদিনে পৌঁছে গেছেন। ম্যারির মুখে কৌতূহল এবং উজ্জ্বলতা। তারা ক্লাবের দিকে এগিয়ে গেলেন। গেটে রয়েছে হ্যাপি বার্থডে ব্যানার। আঃ কী দুষ্ট, আমাকে কিছুটি বলেনি। গত দু সপ্তাহ ধরে নীরবে এই আয়োজন চলছিল।

এখনও আমাকে কত ভালোবাসে! এডওয়ার্ডের দিকে চোরা চোখে তাকাতে তাকাতে ম্যারির মনে হয়েছিল। এঁরা সকলেই ডাক্তারের পরিবার। তাই বোধহয় এমন পরিশীলিত মনের অধিকারী। জাংশন সিটির সব সেরা সার্জেন। বাবা হিসেবেও অতুলনীয়। স্বামী হিসেবে অনন্য।

ম্যারি মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন। জন্মদিনের কেক কাটলেন। তাকালেন এডওয়ার্ডের দিকে, ভাবলেন, এই পৃথিবীতে আমি সুখীতমা রমণী।

.

সোমবার সকালবেলা, হ্যাং ওভার কেটে গেছে, ম্যারি উঠেছেন। কাল খুব হৈহৈ হয়েছে। যথেষ্ট শ্যাম্পেন পেটে পড়েছে। ম্যারি খুব একটা মদ খেতে অভ্যস্ত নন। তাই বোধহয় এখনও ঘুম-ঘুম পাচ্ছে।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেন। ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে।

ম্যারি কিছু বলার চেষ্টা করলেন।

বেথ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতে অনেকগুলো বই- মা, কার সঙ্গে কথা বলছ? মনে মনে!

বেথ কিচেন টেবিলে পৌঁছে গেছে–না মা, আমি এটা খেতে পারব না। তুমি কি আমায় মেরে ফেলবে নাকি?

মা বললেন আজকের মতো খেয়ে নে। কাল অন্য কিছু দেব।

দশ বছরের টিম রান্নাঘরে ছুটে গেছে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলছে, আমি বেকন আর ডিম খাব।

দিন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে, অসহ্য মাথার যন্ত্রণা।

বাচ্চাদের স্কুলের যাবার সময় হল। ওরা চলে গেলেই বাড়িটা শান্ত হবে।

এডওয়ার্ড সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছেন। এতদিন বাদেও এডওয়ার্ডকে দেখে খুবই আকর্ষণীয় পুরুষ বলে মনে হয়।

সুপ্রভাত ডার্লিং, এডওয়ার্ড চুমু দিলেন। তারা দুজনে কিচেনে চলে গেলেন।

–সুইট হার্ট, তুমি একটা কাজ করবে?

কী কাজ বলো।

আমি দুটো ছেলেকেই বেচে দেব।

 কাদের কাছে?

যাকে পাব তার কাছে।

–কে ওদের কিনবে?

–অপরিচিত কেউ। ওরা এত দুষ্টুমি করে। আর ভালো লাগছে না।

 এডওয়ার্ড হাসলেন, বুঝতে পারলেন, এটা মায়ের আদর।

এত সুন্দর সুখী দাম্পত্য জীবন। আনন্দ যেন উপচে পড়ছে।

 আরও একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ম্যারি ভাবলেন, আমি কত সুখী।

শেষ পর্যন্ত ম্যারি বললেন- ঠিক আছে, ছেলে দুটিকে আমি আমার কাছেই রাখব। কারণ তাদের বাবাকে আমি খুবই ভালোবাসি।

–সত্যি কথা বলব? আমিও ওই বাচ্চা দুটির মাকে ভালোবাসি। ম্যারিকে আলিঙ্গনে নিস্পেশিত করতে করতে এডওয়ার্ড বললেন– শুভ জন্মদিন।

–তুমি এখনও আমাকে ভালোবাসো, আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি!

আমি বুড়িদেরই ভালোবাসি।

ধন্যবাদ।

 কিছু একটা মনে পড়ে গেল ম্যারির, আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। ডিনার বানাতে হবে।

.

ম্যারি আর এডওয়ার্ড একসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাতাসে তাদের চুল উড়ছে। এডওয়ার্ড ফোর্ড গ্রানাডেতে উঠে পড়লেন। ম্যারি তার স্টেশন ওয়াগনে ঢুকে পড়েছেন।

এডওয়ার্ড বললেন- হাইওয়েতে বরফ জমেছে। সাবধানে চালিও, কেমন?

-তুমিও সাবধানে যেও।

বাতাসের ভেতর ম্যারি চুমু ছুঁড়ে দিলেন। দুজনে দুদিকে চলে গেলেন। এডওয়ার্ড যাবেন হাসপাতালের দিকে। ম্যারির গন্তব্য ম্যানহার্টন। ষোলো মাইল দূরে, যেখানে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের অবস্থান।

বাড়ির সামনেই একটা গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। দুজন মানুষ নেমে এলেন। তারা দেখলেন, স্বামী-স্ত্রী চলে যাচ্ছেন।

একজন বললেন– এবার আমরা যাব।

ড্রাইভার বসেছিলেন। এবার যাত্রা শুরু হল।

ম্যারিদের পাশের বাড়িতে তারা পৌঁছে গেছেন। মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা।

আপনি কি মিসেস ডগলাস সিফার?

হ্যাঁ।

ভদ্রলোক পকেট থেকে কার্ড বের করলেন। তিনি বললেন, আমার নাম রোনাল্ড জ্যামলক। আমি স্টেট গভর্নর্মেন্টের সিকিউরিটি এজেন্সিতে কাজ করছি।

কী হয়েছে? একথা বলবেন না যে, আমার স্বামী ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছে।

এজেন্ট হাসলেন না ম্যাডাম, আমি আপনার প্রতিবেশী মিসেস অ্যাসলে সম্পর্কে দু-চার কথা জানতে চাইছি।

– কেন? ম্যারি? কী হয়েছে?

 –আমি কি ভেতরে আসব?

–অবশ্যই আসুন। বসুন। কফি নেবেন?

না, ধন্যবাদ। আমি কয়েকটা মিনিট সময় নেব।

–ম্যারি সম্বন্ধে কেন জানতে চাইছেন?

–এটা একটা রুটিন চেক। উনি কোনো খারাপ কাজ করতেই পারেন না। সেটা আমরাও জানি।

— আমারও তাই মনে হয়। ম্যারি অ্যাসলেকে আমি এক অনবদ্য চরিত্রের মেয়ে বলতে পারি।…ওঁনার সাথে আপনার দেখা হয়েছে?

না ম্যাডাম, ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়। আপনিও গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। কতদিন ধরে আপনি মিসেস অ্যাসলেকে চেনেন?

–তেরো বছর ধরে। সে তো আমার পাশের বাড়িতেই থাকে।

 –অ্যাসলের সঙ্গে আপনার ভালো বন্ধুত্ব?

–হ্যাঁ, ম্যারি আমার খুব কাছের বন্ধু।

–তার স্বামী সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

–ডগলাস এবং আমি ছাড়া ওঁরা হলেন পৃথিবীর সবথেকে সুখী দম্পতি।

 শ্ৰীমতী অ্যাসলের দুটি সন্তান আছে, বারো বছরের একটি ছেলে আর দশ বছরের একটি মেয়ে। কী তাই তো?

–হ্যাঁ, বেথ আর টিম।

–মা হিসেবে তিনি কেমন?

 –অসাধারণ! কোনো অভিযোগ নেই।

 –তাহলে আপনি বলছেন, মিসেস অ্যাসলে এক আবেগসঞ্জাত মহিলা?

অবশ্যই।

–তার জীবনের কোনো সমস্যা?

–না-না।

–উনি কি মদ খান?

-না, উনি অ্যালকোহল পছন্দ করেন না।

ড্রাগসের বিষয়?

–মিস্টার, আপনি ভুল শহরে এসেছেন। জাংশন সিটিতে এই ধরনের কোনো সমস্যা নেই।

মিসেস অ্যাসলে এক ডাক্তারকে বিয়ে করেছেন…?

–তাতে কী হয়েছে?

–যদি তিনি ড্রাগস চান?

–আবার কেন এক কথা বলছেন? উনি সেই ধরনের মহিলা নন।

এইভাবে কথাবার্তা এগিয়ে চলল। অনেক খবর পাওয়া গেল।

.

দুজন এজেন্ট চলেছেন ওয়াশিংটন স্ট্রিটের দিকে। তারা উত্তরদিকে যাবেন। তারা একটা বিলবোর্ড পার হলেন। লেখা আছে– আপনি স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করছেন। আনন্দ উপভোগ করুন।

রেকস বললেন– ঠিকই বলেছে।

চেম্বার অফ কমার্সের বাড়ি, রয়্যাল অর্ডার, একটি বার, কমার্সিয়াল বাড়িগুলি, পথ এগিয়ে গেছে।

রোনাল্ড বললেন– যিশু, প্রধান রাস্তাটা দুটো ব্লক পরে! মস্ত বড় একটা শহর?

রেক বললেন- হ্যাঁ, এ পথেই আমাদের এগোতে হবে।

.

ডগলাস এক সহজ সরল স্বভাবের মানুষ। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মুখে বিষাদঘন অভিব্যক্তি। কেন? সিফার এখন ব্রিজ খেলাতে হারতে বসেছেন। দশ হাজার পয়েন্ট পেছনে আছেন তিনি। আজ সন্ধ্যায় এই ঘটনা চারবার ঘটল। ফ্লোরেন্সের স্থির বিশ্বাস, অবস্থাটা কাটিয়ে ওঠা যাবে।

ডগলাস কার্ড ফেলেছিলেন– ফ্লোরেন্স! কী খেলছ তুমি? তুমি কি খেলতে জানো না?

–আমি দুঃখিত, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।

–ঠিক আছে, ভালো করে খেলার চেষ্টা করো।

এডওয়ার্ড ফ্লোরেন্সকে জিজ্ঞসা করলেন ম্যাডাম, কিছু অসুবিধা হচ্ছে কী?

ম্যারি, এবার তোমার খেলা।

আমি খেলব?

–কোনো সমস্যা?

ম্যারি বললেন– সমস্যা কেন?

–আমি বলব না, আমি বলতে পারি না।

কাকে আপনি কথা দিয়েছেন? এডওয়ার্ড জানতে চাইলেন।

–ওয়াশিংটন থেকে এক ফেডারেল এজেন্ট এসেছিলেন। তিনি আজ সকালে ম্যারি সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করলেন। তার কথা শুনে মনে হল, ম্যারি বোধহয় এক ইন্টারন্যাশনাল স্পাই।

এডওয়ার্ড জানতে চাইলেন– কী ধরনের প্রশ্ন?

–আপনাদের সম্পর্কে, বিশেষ করে ম্যারি সম্পর্কে। ম্যারি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সৎ নাগরিক কিনা? মা এবং স্ত্রী হিসেবে তিনি কি কর্তব্য পালন করছেন? ড্রাগস গ্রহণ করেন কিনা?

কী আশ্চর্য! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

 ম্যারি বললেন– না-না, মনে হচ্ছে, এটা বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে। আমার কার্যকাল বাড়ানো হবে কিনা, তা নিয়ে।

ফ্লোরেন্স জানতে চাইলেন– কী ব্যাপার?

মাঝে মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরনের লোক পাঠায়। যাঁরা সেখানে অধ্যাপনা করেন, তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সবকিছু নিয়ে আলোচনা করা হয়।

–তা হতে পারে, ফ্লোরেন্স স্যিার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি ভেবেছিলাম ওঁরা বোধহয় আপনাকে বন্দি করবেন।

ম্যারি হাসলেন- না-না, তা কী করে সম্ভব!

ডগলাস সিফার বললেন- খেলাটা চালিয়ে যাবে কী? আমার পায়ে ব্যথা হচ্ছে।

না, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আর বাজে তাস ফেলব না।

.

০৫. অ্যাবিউড, ইংল্যান্ড

চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম অনুসারেই আমরা এই মিটিং-এ এসেছি। মনে রাখবেন এই মিটিং-এর কোনো রেকর্ড রাখা হবে না। আমরা এখন থেকে একে অন্যকে কোড নামে ডাকব।

ফ্লেমোর ক্যাসল, পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি দুর্গ। তার লাইব্রেরি ঘরে আটজন এসেছেন। দুজন সশস্ত্র ব্যক্তি, সাদা পোশাকে। তাদের পরনে হেভি ওভারকোট। তারা সবদিকে সতর্ক নজর রেখেছেন। তৃতীয় জনও সশস্ত্র। আমন্ত্রিত অতিথিরা বিভিন্ন জায়গাতে বসলেন।

 চেয়ারম্যান বলতে শুরু করলেন কয়েকটা বাজে খবর এসেছে। মারিন গ্রোজা আলেকজানড্রোসের বিরুদ্ধে একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে চলেছেন। রোমানিয়ার একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারি তাকে এব্যাপারে সমর্থন করবেন। এবার মনে হয় তিনি সফল হবেন।

ওডিন বললেন- আমরা এখন কী করব?

–আমাদের আরও সাবধান হতে হবে। পশ্চিম অভিমুখে অনেকগুলো জানালা খুলতে হবে।

লেয়ার মন্তব্য করলেন যাতে এই অভ্যুত্থান না হয় সেদিকে আমরা নজর দেব কী?

বালডার জানতে চাইলেন কীভাবে?

–গ্রোজাকে মেরে ফেলতে হবে। চেয়ারম্যান বললেন।

–এটা অসম্ভব! তার অনেক বন্ধু আছে। তার ভিলাটি যেখানে অবস্থিত, সেখানে ঢোকা খুব একটা সহজ নয়। কেউ এই কাজে যোগ দেবে কী?

না, আমরা সরাসরি করব না। ষড়যন্ত্র করতে হবে। চেয়ারম্যান আবার বললেন।

–সেটা হবে কীভাবে?

কনট্রোলার এব্যাপারে একটি গোপন আলোচনা করতে চাইছেন। আমরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের ভাড়া করতে পারি।

–আবুল আব্বাস?

–না, এখন নতুন কেউ এসেছেন। তার নাম অ্যাঞ্জেল।

–আমি তো কখনও তার নাম শুনিনি। সিগমন্ড বললেন।

–ঠিকই বলেছেন। অ্যাঞ্জেলের ইতিহাসটা খুব ভালোভাবে জানতে পারা যায়নি। কনট্রোলার অফিসে যে ফাইল আছে, তাতে দেখতে পাচ্ছি, অ্যাঞ্জেল ভারতের শিখ খলিস্তান আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। সে পুওরতিরিকোর সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ রেখে চলেছে। কম্বোডিয়াতে যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তার অন্তরালেও ওই লোকটির ভূমিকা স্বীকার করা হয়েছে। ইজরায়েলে অন্তত ছজনকে সে গুপ্ত হত্যা করেছে। ইজরায়েল তার জন্য দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

বাঃ, ব্যাপারটা উৎসাহব্যঞ্জক! থর বললেন, আমরা কীভাবে তার দেখা পাব?

তার দাম খুবই বেশি। যদি সে শর্তে রাজি থাকে। খরচা পড়বে ২০ লক্ষ ডলার।

ফেয়ার বললেন- সেটা না হয় হবে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটবে তো?

সিগমন্ড আবার জানতে চাইলেন– অ্যাঞ্জেলের সাথে কথা বলা কী করে সম্ভব?

ভদ্রলোকের এক রক্ষিতা আছে, নেউসা মুনেজ।

–কোথায় গেলে মেয়েটিকে পাওয়া যাবে?

–সে আর্জেন্টিনায় থাকে। অ্যাঞ্জেল তাকে বোয়েন্সআয়ার্সে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছে।

থর বলল– তাহলে আমরা কি ওই মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করব?

চেয়ারম্যান জবাব দিলেন- কনট্রোলার হ্যারি লানজের নাম করেছে।

-নামটা শোনা বলে মনে হচ্ছে।

চেয়ারম্যান বলতে থাকেন– হ্যাঁ, হ্যারি নামটা পরিচিত। তিনি সিআইএ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। ভিয়েতনামে নিজস্ব ড্রাগ ব্যবসা আছে। একবার দক্ষিণ আমেরিকাতে গিয়েছেন। এই অঞ্চলটা তার নখদর্পণে। এজেন্ট হিসেবে চমৎকার।

চেয়ারম্যান বললেন- আমরা কি ভোট নেব? যাঁরা অ্যাঞ্জেলকে পেতে চাইছেন, তারা দয়া করে হাত তুলুন।

আটজনের হাতই আকাশের দিকে উঠে গেল।

চেয়ারম্যান বললেন- সভা এখানেই শেষ হল। আপনারা সতর্কতা অবলম্বন করবেন।

.

সোমবার কনস্টেবল হ্যানসন গ্রিনহাউসে পিকনিকে ব্যস্ত। তিনি একা আসেননি। সঙ্গে আছেন অ্যানি নামে এক অসাধারণ সুন্দরী।

অ্যানি হাসতে হাসতে বললেন– তুমি খাবার তৈরি করো, আমি ডিজার্টটা দেখছি।

এই ডিজার্ট মানে কী? ছ ইঞ্চি লম্বা অসাধারণ কিছু একটা?

কিন্তু কনস্টেবল হ্যাঁনসনের ভাগ্যটা খারাপ। একটা লিমুজিন গাড়ির শব্দ শোনা গেল।

উনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন- মনে হচ্ছে শয়তানরা এখানেও ধাওয়া করেছে।

অ্যানি জবাব দিলেন রাগ কোরো না।

না, এখনও রাগ করিনি।

 কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। আর একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। জানালায় গিয়ে তিনি দেখলেন, মনে হচ্ছে, এটা বোধহয় সরকারি লিমুজিন। মদরঙা কাঁচ, বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না। প্যাসেঞ্জারদের লুকিয়ে রাখে।

–লেসলি, এখন কী হবে?

–দেখা যাক, এবার কী ঘটতে চলেছে।

আঃ, বুঝতে পারছি না।

কুড়ি মিনিট বাদে কনস্টেবল হ্যানসন বুঝতে পারলেন, তিন নম্বর গাড়িটিও চলে গেল। এবার পুলিশম্যানের সত্তা জেগে উঠছে। আরও পাঁচটা গাড়ি আছে। সবকটি লিমুজিন, এক এক করে সবকটি গাড়ি চলে যাবে।

কনস্টেবল হ্যানসন লাইসেন্স প্লেটের নাম্বারগুলো টুকতে শুরু করলেন।

অ্যানি অভিযোগ করলেন– আজও তুমি পুলিশের কাজ করবে? আরাম ফুর্তি করবে না?

কনস্টেবল বললেন-ব্যাপারটা ভবিষ্যতে কাজে দেবে হয়তো।

.

সার্জেন জানতে চাইলেন– ফ্লেমোর ক্যাসলে আপনি কী করছিলেন?

বেড়াতে গিয়েছিলাম স্যার।

ক্যাসলটা বন্ধ ছিল।

–কিন্তু গ্রিনহাউস খোলা ছিল।

–আপনি গ্রিনহাউসে গিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, স্যার।

–একা, না কাউকে নিয়ে?

স্যার, সত্যিটা বলব?

–হ্যাঁ, সবকিছু। আপনি কেন গাড়িগুলো সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন?

–ওদের ব্যবহারে।

–গাড়িরা আচরণ করতে পারে কি হ্যানসন? ড্রইভারদের কথা বলছেন?

–অবশ্যই স্যার। ড্রাইভারদের খুবই সতর্ক বলে মনে হয়েছে। কুড়ি মিনিট অন্তর গাড়িগুলো পার্কিং লট ছেড়ে চলে যায়।

বাঃ, এটা ভালো পর্যবেক্ষণ! তবে এর অন্তরালে অনেক যুক্তি খাড়া করা যেতে পারে। হ্যানসন আপনার কী মনে হচ্ছে?

–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

–দেখি, কী কী লাইসেন্স নাম্বার আপনি পেয়েছেন?

–এই দেখুন স্যার।

ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।

.

লাইসেন্স প্লেটের রিপোর্টটা হাতে এল। সার্জেন টুইল ভাবলেন, হ্যানসন বোধহয় কোথাও একটা ভুল করেছেন। তিনি ইন্সপেক্টর পাগোলার কাছে পৌঁছে গেলেন।

-ইন্সপেক্টর, লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার।

–হ্যাঁ, দেখি।

অনেক ধন্যবাদ।

.

এসআইএ-র হেডকোয়ার্টার। ইন্সপেক্টর পাগোলা তার সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। এখানে ব্রিটিশ সিক্রেট ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের কর্তাব্যক্তিরাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। দেখা গেল এক ভদ্রলোককে। স্যার আলেক্স হাইডভাইড।

–আমার সাথে কথা বলে আপনার কেমন লাগছে স্যার? অ্যালেক্স জানতে চাইলেন।

স্যার, আপনাকে এ ব্যাপারে জড়িয়েছি বলে আমি দুঃখিত। ইন্সপেক্টর পাগোলা বললেন।

না ইন্সপেক্টর, বুঝতে পারছি আপনার ব্রাঞ্চ কাজ করছে। ওই কনস্টেবলের নাম কী?

-হ্যানসন, লেসলি হ্যানসন।

.

ইন্সপেক্টর পাগোলার পেছন দিকের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। স্যার আলেক্স হাইডভাইড লাল টেলিফোনে হাত রাখলেন।

বললেন- বালডার, তোমার জন্য একটা খবর আছে। একটা ছোট্ট সমস্যা হচ্ছে। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তিন জনকে সরাতে হবে। পুলিশ সার্জেন টুইল, ইন্সপেক্টর পাগোলা, কনস্টেবল লেসলি হ্যানসন। খুব তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতে হবে। তাদের বিভিন্ন পোস্টে পাঠিয়ে দাও। লন্ডন থেকে যত দূরে সম্ভব। কনট্রোলারকে এখুনি খবরটা দিতে হবে।

.

 নিউইয়র্কের হোটেল ঘর। হ্যারি লানজের ঘুম ভেঙে গেছে। মাঝরাত, টেলিফোনের আর্তনাদ।

এখন কে ফোন করল? ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে গেল। রাত চারটে বাজে।

—কে?

মিষ্টি কণ্ঠস্বর, লাইনটা কথা বলতে শুরু করেছে। হ্যারি আমতা আমতা করতে থাকেন।

-হ্যাঁ, স্যার, ইয়েস স্যার। আমি এখুনি যাচ্ছি। প্রথম যে ট্রেনটা পাব, সেটা ধরেই সোজা বুয়েন্স আয়ার্স। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

লানজ রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। সিগারেট ধরালেন। হাত কাঁপছে। যে ভদ্রলোকের সঙ্গে উনি কথা বললেন, তিনি এই পৃথিবীর সব থেকে খতরনক আদমি। হ্যারিকে এখন কী করতে হবে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হ্যারি নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, বিরাট কোনো কাজ কী? একটা খবর দেবার জন্য এই মানুষটি পঞ্চাশ হাজার ডলার অনায়াসে দিয়ে দেন। আর্জেন্টিনাতে গেলে কত পাওয়া যেতে পারে? হ্যারি দক্ষিণ আমেরিকার মেয়েদের ভালোবাসেন। অন্তত জনা বারো সুন্দরীর খবর তিনি রাখেন, যাদের শরীরের সব জায়গা চিবিয়ে খেতে হয়।

–তার মানে দিনটা শুভ সংকেত দিয়ে শুরু হবে।

.

সকাল নটা। লানজ টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। অ্যারোলাইন্স আর্জেন্টিনার নাম্বারে ফোন করলেন।

বুয়েন্স আয়ার্সের দিকে আপনাদের প্রথম বিমান কখন উড়বে?

.

৭৪৭ বুয়েন্স আয়ার্সের এয়ারপোর্টে এসে থামল। বিকেল পাঁচটা। দীর্ঘ যাত্রা। হ্যারি লানজ এতে কিছুই মনে করেননি। একটা খবর দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার! মাথার ভেতর উত্তেজনা। পাঁচ বছর আগে তিনি আর্জেন্টিনায় শেষবারের মতো এসেছিলেন। সবকিছু কেমন নতুন বলে মনে হচ্ছে।

হ্যারি লানজ প্লেন থেকে বাইরে এলেন। গরম বাতাস তাকে অভ্যর্থনা জানাল। হ্যাঁ, এখানে বড্ড গরম।

ট্যাক্সি এগিয়ে চলেছে। লানজ তাকিয়ে আছেন আকাশ পথের দিকে। অনেক কিছু পালটে গেছে। আহা, কত সুখই না ছিল এখানে।

ফিয়েস্টা শেষ হয়েছে। মানুষজন আবার বেরিয়ে এসেছে। ট্যাক্সি হোটেলে এসে থামল। হোটেলটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, ফ্যাশান দুরস্ত এলাকায়। লানজ ড্রাইভারকে টাকা দিলেন। বললেন, বাকিটুকু তোমার কাছে রেখে দাও।

ডেস্কে নাম লেখা হল। পরিচয় লিখলেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তাঁর দিকে তাকালেন। বেডরুমের ভাড়া দৈনিক ষাট ডলার। বাথরুম, লিভিংরুম সব পাওয়া যাবে। টেলিভিশন এবং শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বসার ঘর। ওয়াশিংটনের সঙ্গে এর তুলনা করতে ইচ্ছে হল।

এখানে আমি বেশ কয়েকদিন থাকব। নেউসাকে কাল ডেকে পাঠাব।

দু-সপ্তাহ লেগেছিল নেউসারের সাথে যোগযোগ করতে। কিন্তু কেন?

.

অনুসন্ধান শুরু হল। হ্যারি টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতায় চোখ রাখলেন। অনেকগুলো নাম পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আসল নামটা কোথায়? সেই ভদ্রমহিলা, যার জন্য হন্যে হয়ে আমি এখানে ছুটে এসেছি? লানজ অবাক হলেন! এখান থেকে সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। কিন্তু কারোর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।

লা বেলা নামে একটি বারে গিয়ে ঢুকলেন। বারটেন্ডার তাকে দেখে অবাক আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় বেঁচেই নেই! ভারি ভালো লাগছে আপনি আবার এলেন, তাহলে? এবার কেন এসেছেন?

লানজ বললেন– আমি এক পুরোনো বান্ধবীর সন্ধানে এসেছি। একসময় ভেবেছিলাম আমরা বিয়ে করব। কিন্তু সেই বান্ধবীর পরিবার হঠাৎ এখান থেকে চলে যায়। সম্পর্কটা কেঁচে গেছে। তার নাম নেউসা মুনেজ।

বার-টেনডার বললেন– এই নাম তো কখনও শুনিনি!

–যদি এই নামটা শোনেন, তাহলে অ্যান্টনি, আমাকে জানাতে ভুলবেন না।

.

লানজ এলেন তার এক বন্ধুকে দেখতে, পুলিশ হেড কোয়ার্টারে।

লানজ, আমি হ্যারি লানজ!

 –হ্যালো জর্জ, তোমার সাথে অনেকদিন পর দেখা হল।

–শুনেছি সিএ নাকি তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে?

হ্যারি হাসলেন- ঠিক সেভাবে নয়, ওরা আমাকে থাকতে বলেছিল। কিন্তু আমার নিজস্ব কাজ আছে।

কী কাজ?

–আমি একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছি। এই কাজে আমি বুয়েন্স আয়ার্সে এসেছি। আমার এক ক্লায়েন্টের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ সপ্তাহ আগে। তিনি এক মেয়েকে রেখে গেছেন। অনেক টাকা দেবেন তাকে, আমি সেই মেয়েটাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি। আমি শুনেছি ওই মেয়েটি নাকি বুয়েন্স আয়ার্সে থাকে।

তার নাম কী?

নেউসা মুনেজ।

–এক মিনিট দাঁড়াও তো। না, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। আমাদের কম্পিউটার বা ফাইলে এই নাম লেখা নেই।

–ঠিক আছে, আমি দেখছি, অন্য কোথাও খবর পাওয়া যায় কিনা।

.

এবার বারগুলোতে অনুসন্ধান করতে হবে। পুরোনো চেনা বার, তারপর নতুন বার। কিন্তু সব জায়গায় একই খবর। এই মেয়েটির কোনো চিহ্ন নেই।

হারি লানজ ভাবলেন, কোথায় যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে লা বোকাতে এলেন। শহরের কেন্দ্রস্থলে অসাধারণ বিনোদন কেন্দ্র। চারপাশে ঝকঝকে দোকান। এখানেও নেউসা মুনেজের সন্ধান পাওয়া গেল না। এই প্রথম মনে হল, আমি বোধহয় অরণ্যের মধ্যে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি। নিষ্ক্রমণের পথ জানি না।

.

পিলার। ছোট্ট একটা বার এবং ভাগ্য পরিবর্তিত।

শুক্রবার রাত্রি। বারে শ্রমজীবী মানুষের ভিড়। দশ মিনিট পর লানজ বার অ্যাটেনডারের কাছে পৌঁছোতে পারলেন।

বার অ্যাটেনডার বললেন- নেউসা মুনেজ? হ্যাঁ, আমি ভদ্রমহিলাকে চিনি। আপনি মধ্যরাতে আসুন, তাহলে দেখা পাবেন।

পরের দিন সন্ধেবেলা হ্যারি লানজ পিলারে এসে পৌঁছেছেন এগারোটার সময়। দেখছেন, বারে জনসমাগম ক্রমশ বাড়ছে।

মধ্যরাত। তিনি আরও নার্ভাস হয়ে উঠলেন, কীভাবে কথা হতে পারে? সত্যি সত্যি উনি কি নেউসা মুনেজ?

হো-হো করে হাসতে হাসতে একদল তরুণী বারে ঢুকে পড়েছে। তারা একজন পুরুষের চারপাশ ঘিরে বসল। লানজ ভাবলেন, না, এদের মধ্যে বোধহয় নেউসা নেই।

কিন্তু এই মেয়েটি কি নেউসা হতে পারেন? বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছেন। অ্যাঞ্জেল একজনকে হত্যা করার জন্য কুড়ি লক্ষ ডলার পাবে। অ্যাঞ্জেল কি এই ভদ্রমহিলার তুরুপের তাস? ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

তারপর? দরজা খুলে গেল। লানজ তাকালেন, মধ্য বয়সিনী, দেখতে খুব একটা ভালো নয়, পেটে মেদ জমেছে, বড়ো বড়ো দুটো স্তন হাঁটার তালে তালে দুলছে, মুখে পাউডারের ছাপ, মাথার সোনালি চুল রং করেছেন। চামড়ার রং কালো। বুঝতে পারা যাচ্ছে, হয়তো আগে ভারতীয় বংশের ছাপ ছিল। স্পেনদেশীয় কারও সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। যে স্কার্টটা পরেছেন, ঢলঢল করছে। সোয়েটার অনেক রোগা কারও জন্য তৈরি।

এই ভদ্রমহিলা চারপাশে তাকালেন, চোখের তারায় উজ্জ্বলতা নেই। কয়েকজনের দিকে উদাসীন দৃষ্টিক্ষেপ করলেন। এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

স্পেনীয় ভাষায় বললেন- আমাকে কিছু মদ দেবে?

আরও–আরও, অনাকর্ষণীয় দেখাচ্ছে তাকে।

লানজ ভাবলেন, মদ খেয়ে তুমি পাগল হয়ে যাও, মাতাল হয়ে যাও, তারপর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।

এবার কথা শুরু হল। হ্যারি লানজ বললেন– আমি নেউসা মুনেজের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলাম। আমার ভাগ্য কি খুলে গেছে?

–আমিই নেউসা মুনেজ।

 হ্যারি লানজ ভাবলেন, না, এবার জিজ্ঞাসা করব, আপনি কি অ্যাঞ্জেলের বন্ধু?

-হ্যাঁ।

 হ্যারি লানজ বললেন ঠিক আছে, আমি কি আপনার সাথে হলের এককোণে বসতে পারি?

–ঠিক আছে।

তারা এককোণে চলে গেলেন। বসা হল।

হ্যারি লানজ বললেন আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব।

–আমাকে এক বোতল রাম কিনে দেবেন?

 হ্যারি বললেন- ঠিক আছে, এখুনি দিচ্ছি।

একজন ওয়েটারকে দেখা গেল। লানজ বললেন–একবোতল রাম, স্কচ আর সোডা।

 মুনেজ বললেন- না-না, অনুপাতটা দ্বিগুণ করে দিন।

ওয়েটার চলে গেল।

 লানজ বললেন আমি অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইছি।

ভদ্রমহিলা তাকালেন, সন্দেহের চোখে কী বলছেন?

তার জন্য একটা ছোট্ট উপহার আছে।

–কী ধরনের উপহার?

কুড়ি লক্ষ ডলার।

মদ এসে গেছে। হ্যারি লানজ গ্লাস তুললেন। বললেন–চিয়ারস।

ভদ্রমহিলা একচুমুকে চো-চো করে সবটা মেরে দিয়েছেন। তারপর বললেন- কী জন্য অ্যাঞ্জেলকে কুড়ি লক্ষ ডলার দেওয়া হবে?

তার সাথেই কথা বলতে হবে।

–এটা সম্ভব নয়। অ্যাঞ্জেল সকলের সঙ্গে দেখা করে না।

–দেখুন, কুড়ি লক্ষ ডলারের জন্যও নয়!

 বেশ বুঝতে পারা গেল, মদ এবার নেউসাকে আক্রমণ করেছে। নেউসার কথা জড়িয়ে আসছে। কোনোমতে বললেন ভালো করে বলুন তো আপনি কী চাইছেন?

হ্যারি লানজ বললেন– আপনি এখনই যাবেন না। আপনার সাথে দরকারি কথা আছে।

 উঠে দাঁড়িয়ে নেউসা আবার বসে পড়লেন। বললেন- কী কথা?

লানজ বললেন আমি সত্যি কথাটা বলব কী?

আর এক বোতল রাম?

হ্যারি ভাবলেন, কাজটা ঠিক হবে কি না।

–অ্যাঞ্জেল কী ধরনের মানুষ? উপপত্নী রাখতে পেরেছেন অথচ টাকা দিতে পারছেন না!

লানজ আবার মদের অর্ডার দিলেন। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য, কিন্তু এটা করতেই হবে। না হলে পঞ্চাশ হাজার ডলার কমিশন মারা যাবে। তিনি মুনেজকে লক্ষ্য করলেন। মুনেজ ভিখিরির মতো মদ পান করছেন।

লানজ হেসে বললেন– নেউসা, অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু কী করে?

–আমি ব্যবস্থা করতে পারি, কিন্তু আমার কী থাকবে?

–সব কথা বলছি, তার আগে বলুন আপনি মারিন গ্রোজার নাম শুনেছেন কী?

–না।

–শোনা সম্ভবও নয়।

আরও কিছু মদ দেবেন?

 এবার লানজ হাতে হাত রাখলেন– অবশ্যই।

ডাবল রামের অর্ডার দেওয়া হল।

–অ্যাঞ্জেল জানে গ্রোজাকে। আপনি শুধু মারিন গ্রোজার নাম বলবেন।

 তাহলে কী হবে? বোকা

–একেবারে বোকা। অ্যাঞ্জেল কী করে এই মেয়েটার সাথে সময় কাটায়?

 হ্যারি বললেন- ওই লোকটাকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে।

–কেন? ও কী করেছে?

নেউসা উদাসীনভাবে মাথা নাড়লেন।

মনে হচ্ছে, উনি বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখছেন।

.

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা। হ্যারি লানজ আবার সেই বারে পৌঁছে গেছেন। মুনেজের এখনও দেখা নেই। লানজ বারটেন্ডারকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কোথায় থাকেন জানেন কী?

বারটেন্ডার বললেন– না, আমার ঠিক জানা নেই।

নেউসা বোধহয় সকলকে বোকা বানিয়েছে। লানজের মনে হল, আমিও কেটে পড়ি। সময় এগিয়ে চলেছে। অ্যাঞ্জেলের সাথে কী করে দেখা হবে? একমাত্র রাস্তাটাও তো কেটে গেল।

সব কথা বলতে হবে, পরাজয়ের খবর।

না, হ্যারি লানজ ভাবলেন– মনে হচ্ছে নেউসা এখানে আবার ফিরে আসবেন। কারণ মদ খাওয়া দরকার। তিনি জানেন, আমি তাকে এখন মদ জোগাতে পারব।