১. মুশকিল আসানের তিন তলব

ইন সার্চ অভ দ্য কাস্টঅ্যাওয়েজ – জুল ভের্ন। অনুবাদ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

প্ৰথম – মুশকিল আসানের তিন তলব

১. হাঙরের পেটে এ-কোন লেখা

হাওয়া আসছিলো দক্ষিণপশ্চিম থেকে। সেই হাওয়া ঠেলে ভেসে চলেছিলো মস্ত-একটা প্রমোদতরী, উত্তর প্রণালী দিয়ে। মাস্তুলের ডগায় পৎ পৎ ক’রে উড়ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঝাণ্ডা, তার নিচে নীল বলয়ের ওপর সোনালি জরিতে লেখা E.G., আর তাকে ঘিরে আছে বংশপ্রতীক, ছোটো-একটি মুকুট, কোনো আর্ল-এর পারিবারিক আভিজাত্যের চিহ্ন নিশ্চয়ই। বাষ্পেচলা এই প্রমোদতরীটির নাম ‘ডানকান’।’ডানকান’-এর মালিক লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভন হাউস অভ লর্ডস-এ যান বটে, দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান নিয়ে সেখানে কথাও বলেন, তবে তাঁর রক্তের মধ্যে আছে নীল সমুদ্রের নেশা : লালরক্ত যতটা-না নীল, তার চাইতেও বেশি-নীল বোধহয় এই সমুদ্রের টানই। রয়্যাল টেমস ইয়ট ক্লাবের তিনি নামজাদা সদস্য—কতবার যে তাঁর বিলাসবহুল ইয়ট নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন, বাজি লড়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এবার কিন্তু নিছক দৌড়ের বাজি বা অ্যাডভেনচারের নেশায় তিনি তাঁর এই মস্ত প্রমোদতরীটি নিয়ে এই প্রণালীর জলে বেরিয়ে পড়েননি, এবার তিনি বেরিয়েছেন তাঁর নবপরিণীতা পত্নী তরুণী লেডি হেলেনাকে নিয়ে, নিছকই শখের বেড়ানো। সঙ্গে আছেন তাঁর তুতোভাই মেজর ম্যাকন্যাব্‌স। গোড়ায় যাবেন গ্লাসগো, তারপর বারদরিয়ায় প্রমোদভ্রমণে।

জুলাই মাস শেষ হ’তে চলেছে, আজ ২৬ তারিখ, বছরটা ১৮৬৪, ভরা গ্রীষ্ম। কিন্তু গ্রেটব্রিটনে গ্রীষ্মকাল সবসময়ে তো ঠিক গ্রীষ্মকাল নয়, আবহাওয়ার মর্জি কারু বোঝাই দায়; হয়তো দিনের পর দিন সূর্যের দেখাই পাওয়া গেলো না, আকাশ ভরা রইলো নিচু, ভারি মেঘে, কালো বা ধূসর; বৃষ্টি পড়লো টিপটিপ বা ঝমঝম; হাওয়া গর্জালো তারই সাথে পাল্লা দিয়ে, উত্তুরে হাওয়া, কনকনে-ঠাণ্ডা। অতএব গ্রীষ্মকালেও ঠাণ্ডা এড়াবার জন্যে প’রে থাকো জবড়জং ভারি পশমি পোশাক; শুধু-যে কনকনে ঠাণ্ডা তা-ই নয়, তারই সঙ্গে অসহ্য হ’য়ে ওঠে দিনরাত্তির এই ভেজা-ভেজা ভাবটা। মনে হয় হাড়গোড়ও এই বর্ষার হাওয়ায় শ্যাওলা গজিয়ে জ’মে যাচ্ছে। এবার কিন্তু গ্রীষ্মের চালটা একটু অন্যরকম। বেশ ঝকঝকে রোদ্দুর ছিলো গত কয়েক সপ্তাহ, আকাশ ছিলো নীল, আর আবহাওয়া ছিলো মোলায়েম। সেইজন্যেই হঠাৎ মাথায় এসেছিলো নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে নিয়ে সমুদ্রে কোথাও বেরিয়ে পড়লে কেমন হয়। এরপর আবহাওয়া যদি দুম ক’রে ঝোড়ো হ’য়ে ওঠে, তাহ’লেও অবশ্যি ভাবনা নেই—ডানকান চলে বাষ্পের জোরে, মাস্তুলের পাল হাওয়ার কৃপা পাবে বলে হা-পিত্যেশ ক’রে ব’সে থাকে না; বিলাসের সমস্ত আধুনিক উপকরণ আছে জাহাজে, বাড়ির আরামের চাইতে কোনোদিক থেকেই কম নয়। আর বাড়িতে থেকে বা করতেন কী? ক্লাব, পার্টি, নাচের মজলিশ, সাম্রাজ্যের কোথায় কী অঘটন ঘটছে সে নিয়ে আলোচনা আর তর্কাতর্কি, আর নয়তো কখনও-কখনও কোথাও পিকনিকে বেরিয়ে-পড়া; একঘেয়ে কাটছিলো জীবন, উত্তেজনাহীন, অলস, নিস্তরঙ্গ। বরং সমুদ্র সবসময়েই চঞ্চল– সবসময়েই বিষম তাড়া ক’রে কোথাও চলেছে, আর ঢেউয়েরা রহস্যময় কোন-এক ভাষায় অস্ফুট স্বরে সারাক্ষণই কী কথা শুনিয়ে চলেছে। জাহাজ মানে হ’লো ‘চলন্তের মধ্যে আরেক চলন্ত’–কোথায় যেন এ-রকম একটা কথা একবার শুনেছিলেন লর্ড এডওয়ার্ড। চলো কোথাও’—সমুদ্রেও তো এটাই সুর। কাজেই চলো, বেরিয়ে-পড়া যাক।

তাছাড়াও আরো-একটা উদ্দেশ্য ছিলো বৈকি লর্ড এডওয়ার্ডের। তাঁরই নির্দেশমাফিক, তাঁরই নকশা অনুযায়ী, সদ্য কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে ডানকান, তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রীকে এটাই তাঁর বিশেষ উপহার। কিন্তু এই ঝকঝকে জাহাজটি নিয়ে যদি বারদরিয়ায় পাড়ি জমিয়ে পরখ করেই দেখা না-গেলো তবে বুঝবেন কী ক’রে ডানকান কেমন জাহাজ—কেমন মজবুত আর কাজের। অন্তত মহড়া দেবার জন্যও একবার বেরুতে হয় বৈ কি। আর এইজন্যেই তরতর করে ডানকান এখন চলেছে প্রণালীর জলে—আগে হ’লে বলা যেতো মস্ত-এক রাজহাঁস যেন অনায়াসে সাবলীলভাবে চলেছে; এখন অবশ্য এই কলের জাহাজ, যার চোঙ থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, তাকে ঠিক পুরোনো কবিতার মতো রাজহাঁসের সঙ্গে তুলনা দেয়া ঠিক হবে না, সেজন্যে আরো একটা নতুন-কোনো প্রাণীর কথা ভেবে নিতে হয়, কিন্তু মোদ্দা কথাটা মানতেই হয়; ডানকানের চলবার ভঙ্গি ছন্দোময়, সাবলীল, অনায়াস—এমন সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পুরোনো পালের জাহাজ সচরাচর যেতে পারতো না। লর্ড এডওয়ার্ড ভারি খুশি ডানকান জাহাজের চলবার ভঙ্গি দেখে। কাপ্তেন জন ম্যাঙ্গল্‌সও এই জাহাজের ভার পেয়ে খুব খুশি। সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত তিনি চ’ষে বেরিয়েছেন জাহাজে-জাহাজে, অনেক ভালো জাহাজেও কাজ করেছেন আগে, তবে এই ডানকান জাহাজের সঙ্গে সেগুলোর কোনো তুলনাই হয় না।

লর্ড এডওয়ার্ড রক্তের মধ্যে চাঞ্চল্য বোধ করেছিলেন ব’লে নিজেই স্ত্রীকে নিয়ে জাহাজে এসে উঠেছেন। তখনও তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি তাঁর এই ছটফটে অস্বস্তিটায় আসলে আরো-কোনো বড়ো অভিযানেরই পূর্ববোধ ছিলো—সত্যি—বলতে কোনো অভিযানের কথাই তিনি ভাবেননি, শুধু একটু বেড়ানো সমুদ্রে, আর নতুন জাহাজটার কেরামতি হাতে-কলমে বা জলে ভাসিয়ে পরখ করে দেখা—এই ও ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য।

বেশ-খানিকটা পথ অনায়াসেই চলে এসেছে ডানকান—কোনো অস্বস্তি বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোঝা যায়নি, একটুক্ষণের মধ্যেই গতি দ্রুত ক’রে ফেলতে পারে এই কলের জাহাজ, আর ইচ্ছে করলে তাকে মন্থরও ক’রে আনতে পারে;–তাকে বাতাসের গতি বা জলের উচ্ছ্বাস – কোনোকিছুর ওপরই নির্ভর করতে হয় না। মাঝি-মাল্লারাও এই নতুন জাহাজটা হাতে পেয়ে উৎসাহভরে কাজে লেগেছে। সত্যি-বলতে, কেউ যদি একবার নাবিক হয়, রক্তে যদি একবার সমুদ্রের নেশা ঢুকে যায়, তাহ’লে ডাঙায় আর কিছুতে তার মন ওঠে না—এই মাঝিমাল্লারাও ডাঙায় ব’সে কবে ডানকান জলে ভাসবে তারই প্রতীক্ষায় ছটফট করছিলো। এখন তারা এই আনকোরা মজবুত জাহাজটা হাতে পেয়ে ভারি খুশি।

আজকের দিনটা ভারি চমৎকার। ঝকঝকে মুচমুচে রোদ্দুর, আকাশ ঘন-নীল, শুধু অনেক ওপরে ধূসর ও শাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, সমুদ্রের সবুজ জলে ও বাড়তি কোনো ঢেউ বা ছটফটানি নেই; ডানকান জাহাজ তার এই ট্রায়াল রানে চমৎকার চলেছে।

সেইজন্যই একটু বাদে যখন দূরে জলের ওপর একটা ক্ষুব্ধ আলোড়ন দেখা গেলো তখন লর্ড এডওয়ার্ড বেশ অবাক হ’য়ে গেলেন—মনে হ’লো সমুদ্রের জল তোলপাড় করে কী-একটা যেন ওদিকটায় এক ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স নিশ্চয়ই বলতে পারবেন ব্যাপারটা কী—ঐ আজব, অতিকায় জলস্তম্ভেরই বা কী কারণ। দুরবিনে চোখ লাগিয়ে মনে হচ্ছে কোনো মাছ—কিন্তু হঠাৎ এই সময়ে স্কটল্যান্ডের সমুদ্রে এ কোথাকার অতিকায় মাছ।

লর্ড এডওয়ার্ডের প্রশ্নের উত্তর কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স দুরবিনে চোখ এঁটেই ব’লে উঠলেন : ‘এ তো হাঙরের এক জাতভাই!’

‘হাঙর!’ লর্ড এডওয়ার্ড বিস্মিত।’

‘এখনকার সমুদ্রে হাঙর আছে নাকি?’

‘প্রায়ই আসে। এ অবশ্য কোনো সাধারণ জাতের খুদে হাঙর নয়—বরং সাধারণ হাঙরের চাইতে একে আলাদাই দেখায়। যদি অনুমতি করেন তো লেডি হেলেনাকে আমরা হাঙর কী ক’রে ধরে তারই একটা নমুনা দেখিয়ে দিই। মাছটা সত্যি বড়ো, তছাড়া স্বভাবটাও বেয়াড়া। জেলেদের ছোটো নৌকোগুলোর ওপর উৎপাত করতে পারে—ফলে একে নির্মূল করাই ভালো।

‘তাহ’লে তা-ই করো। এ-বিষয়ে তুমি যা বলবে তা-ই হবে।’

লর্ড এডওয়ার্ড গিয়ে লেডি হেলেনাকে ডেকের ওপর ডেকে নিয়ে এলেন।

ঝকঝকে রোদ্দুর আর সমুদ্রও প্রধানত শান্তই—তাই এই অতিকায় হাঙরটার দাপাদাপি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

কাপ্তেন ম্যাঙ্গলসের হুকুমে মাল্লারা সাজো-সাজো ভঙ্গিতে লড়াইয়ের প্রাথমিক প্রস্তুতিটা সেরে ফেললে। মস্ত-একটা আংটায়—তাকে বঁড়শি বলাই ভালো, যেমন অতিকায় মাছ তেমনি অতিকায় বঁড়শি—মাংসের টুকরো গেঁথে মাল্লারা জলে ফেলে দিলে। আংটাটা শক্ত কাছিতে বাঁধা, অনেকটাই বড়ো, দরকার হ’লে দড়ি ছেড়ে দিয়ে জলের মধ্যে হাঙরটাকে খেলানো যাবে। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স অবিশ্যি নিছক মাছধরা দেখাবেন ব’লেই এটাকে ধরবার উদ্যোগ নেননি। এত-বড়ো মাছটা ধরতে পারলে অনেকটা তেল পাওয়া যাবে। হাঙরের তেল তো সবসময়েই কাজে লাগে। ওষুধ হিশেবে তো বটেই, তবে দরকার হ’লে এই চর্বিতে অন্য কাজও করা যাবে।

অনেকটা দূর থেকেই মাংসের গন্ধটা পেয়েছিলো মাছটা, কিংবা তার দৃষ্টিও ঘ্রাণশক্তির মতোই প্রখর ছিলো। তীরের মতো ছুটে এলো সে, যেন ছোঁ মেরে পড়বে। জলের ওপর দেখা যাচ্ছে প্রচণ্ড গতিতে তার কালো পাখনাটা ছুটে আসছে, ডগাটা ছাইয়ের মতো ধূসর। কাছে এলে চোখে পড়লো তার মস্ত দুটি ভাঁটার মতো চোখ, রাক্ষুসে খিদেয় মুখটা হা-করা, সারি-সারি দাঁত দেখা যাচ্ছে। প্রকাণ্ড মাথাটাকে দেখাচ্ছে অতিকায় কোনো হাতুড়ির মতো। এর পাখনার ঝাপট, জোয়ালের জাঁতিকল কিংবা মুগুরের মতো মাথাটার ঘা—কোনোটাই সাধারণ ছোটো জেলেডিঙির পক্ষে মনোরম হতো না। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সই ঠিক বলেছেন। এ-জীবকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই।

কাছে এসেই মাছটা একটা গোঁত্তা খেয়ে ছোঁ মেরে পড়লো মাংসের টোপটার ওপর, আর সে মাংসের টুকরোটা গিলতেই মাল্লারা হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান দিলে আর অমনি আংটাটা তার গলায় আটকে গেলো। তারপর শুরু হ’লো দড়ি টানাটানির খেলা। অতজন মাল্লা মিলে কাছিটাকে ধরে টান দিচ্ছে, হাঙরটা গলায় বঁড়শি বিঁধে যাওয়াতে ছটফটও করছে, কিন্তু তাই ব’লে মোটেই জল ছেড়ে ওঠবার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। ও-রকম অস্থিরভাবে দাপাচ্ছে দেখে তার ঝটপটি কমাবার জন্যে পাখনার ওপর দিয়ে একটা দড়ির ফাঁসও পরিয়ে দেয়া হ’লো তাকে। তারপর আধঘন্টা ধুন্ধুমার কাণ্ডর পর তাকে তোলা হ’লো ডেকে, মাল্লাদের একজন তক্ষুনি একটা কুঠারের কোপে তার পুচ্ছটাকে আলগা ক’রে দিলে। কিন্তু তার আগেই দেখা হ’য়ে গেছে দুই পাখনা, লম্বা পুচ্ছ, ফোলা পেট, লম্বা শরীর, মুগুরের মতো মাথা—সব মিলিয়ে প্রকৃতিঠাকরুন কী-একটা অদ্ভুত কারখানা সৃষ্টি করেছেন। সে যখন ছোটে জলের মধ্যে তখন তার ঐ পাখনা আর পুচ্ছই তাকে গতি বা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হতে দেয় না। হাঙরটার ল্যাজে যে-কোপ দেয়া হয়েছিলো তার কারণ অতর্কিতে সে যাতে ল্যাজটা দিয়ে একটা মরণঝাপট দিতে না-পারে। লেডি হেলেনা কিন্তু এই ভয়ানক রক্তক্ষয়ী দৃশ্যটা দেখে কেমন আঁৎকে উঠেছিলেন, তিনি চটপট তাঁর ক্যাবিনে ফিরে গেলেন। এই রক্তারক্তি কাণ্ডটার জন্যে তিনি তাঁর মনোরম প্রমোদভ্রমণের অভিজ্ঞতাটে মাটি ক’রে দিতে চান না।

অনেক প্রাণী আছে, মাংসাশী বটে, তবে খিদে না-থাকলে অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করে না। হাঙররা মোটেই তা নয়, তারা ঝাঁক বেঁধে থাকে, সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর, মুহূর্তে সব সাবাড় ক’রে দেয়। কুকুরমাছের জাতের এই মাছটা দলছাড়া হ’য়ে পড়েছিলো—সে কি একাই তার রাক্ষুসে খিদেটাকে নিবৃত্ত করবার জন্যে? সে অবশ্য একাই একশো।

মাল্লারা সাধারণত হাঙর ধরলেই পেট চিরে দেখে নেয় কী-কী সে গলাধঃকরণ করেছে ম’রে যাবার আগে। পুচ্ছহীন হ’লেও তার দাপাপাপি তখনও আদৌ তুচ্ছ নয়। সে তখনও ফোঁস ফোঁস ক’রে নিশ্বেস নিচ্ছে আর ছটফট করছে। লম্বায় সে দশফুটের ওপর, ওজনটাও কোন-না ছশো-সাড়ে ছশো পাউন্ড। মাল্লারা কয়েকজন মিলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, কিন্তু প্রথমেই পেট চিরে দেখা গেলো পেট খালি, পেটের মধ্যে কিচ্ছু নেই। মাংসের টুকরোটার গন্ধ পেয়েই সে-যে অমনভাবে ধেয়ে এসেছিলো তা সম্ভবত খিদেয় এমন হন্যে হ’য়ে ছিলো ব’লেই। কেটে সেটাকে টুকরো-টুকরো ক’রে ফেললে মাল্লারা, চর্বিটা সরিয়ে রেখে এই জলরাক্ষসের দেহাবশেষ জলে ফেলতে গিয়েও মাল্লারা থমকে গেলো কেননা তাদের মধ্যে একজন তখন চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘আরে! ওটা কি আটকে আছে পাকস্থলিতে?’

‘হবে কোনো নুড়িপাথর! যা রাক্ষুসে খাই-খাই, খিদের জ্বালায় হয়তো তা-ই খেয়ে ফেলেছে।’ বললে অরেকজন।

টম অস্টিন—সে এই ডানকান জাহাজের ফার্স্টমেট–বললে, ‘ধুর আহাম্মক! দেখছিস না এ ছিলো পাঁড়মাতাল। ওটা নুড়িপাথর নয় মোটেই। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা বোতল।’

এই শোরগোল শুনে লর্ড এডওয়ার্ড এগিয়ে এসেছিলেন কাছে। অবাক হ’য়ে বললেন : ‘বোতল! হাঙরের পেটে বোতল! এমন কথা তো কস্মিনকালেও শুনিনি যে হাঙর বোতলশুদ্ধু মদ খেয়ে ফ্যালে! বোতলটা বার করো পেট থেকে! অনেক সময় লোকে দরকারি কাগজপত্র পুরে ছিপি এঁটে সমুদ্রে বোতল ভাসিয়ে দেয়। এটা হয়তো সে-রকমই কিছু। কই, নিয়ে এসো ওটা।’

হাঙরের পেট থেকে বোতলটা বার ক’রে নিয়ে আসা হ’লো। তাকে ধুয়েটুয়ে সাফসুতরো ক’রে বোতলটা রাখা হ’লো টেবিলে। লর্ড এডওয়ার্ড, মেজর ম্যাকন্যাব্‌স, কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স—এঁদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে লেডি হেলেনাও কৌতূহলী হ’য়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন।

লর্ড এডওয়ার্ড বোতলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আগাপাশতলা সেটা নিরীক্ষণ করলেন।

পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখে মেজর ম্যাকন্যাব্‌স বললেন, ‘হুম! শ্যাম্পেনের বোতল।’ তিনি সেটা জানতে পারেন, সামরিক ব্যারাকে অস্ত্রশস্ত্র, কুচকাওয়াজের সঙ্গে, সঙ্গে নানাবিধ পানীয়রও চর্চা হ’য়ে থাকে।

‘কীসের বোতল জেনে আর কী হবে,’ লেডি হেলেনা উদ্‌গ্রীব হ’য়ে বললেন, হঠাৎ হাঙরের পেটে কোত্থেকে এলো, সেটাই জানতে চাই।’

‘অনেকদিন নিশ্চয়ই জলে ভেসেছিল। কী-রকম শ্যাওলা পড়েছে ওপরটায় দেখেছো?’ লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘হাঙরটার পেটে হয়তো খুব বেশিদিন যায়নি।’ ছিপিটা খুলতে গিয়ে দেখো গেলো এতদিন জলে থাকার ফল ফলেছে—ভেতরটায় জল ঢুকে গিয়েছে।

বিচ্ছিরি কাণ্ড হলো তো! ভেতরে জল ঢুকেছে দেখছি। তাহলে কি আর ভেতরে যা ছিলো তা আর অটুট থাকবে।

বোতলের ছিপিটা খোলবার পর একটা বিশ্রী আঁশটে গন্ধে আশপাশ ঝিমিঝিম করে উঠলো।

ভেতরে কিন্তু সত্যি-কিছু আছে। কাগজ? সে-রকম তো দেখাচ্ছে। কিন্তু ভেতরে সেটা আটকে গিয়েছে—সম্ভবত জলে ভিজে গিয়েই।

‘বোতলটা ভেঙে ফেললেই তো হয়?’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স অমনি সমাধানটা বাৎলে দিলেন।

‘তার চাইতে বরং বোতলের মাথাটাই ভাঙা যাক,’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গলসের সুপরামর্শ। ‘তাহ’লে হয়তো ভেতরের জিনিশটা নষ্ট হবে না।’

হাতুড়ি ঠুকে বোতলের মাথাটা ভাঙা হ’লো। ঝনঝন ক’রে চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো ভাঙা কাচ। সন্তর্পণে কাচের টুকরো ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতর থেকে তিন-তিনটে পার্চমেন্ট বার ক’রে এনে বিছিয়ে রাখা হলো টান-টান ক’রে। দেখা গেলো, তিনটে পার্চমেন্টই জল লেগে লেখা প্রায় ঝাপসা হ’য়ে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে আলোর সামনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন লর্ড এডওয়ার্ড। কী লেখা আছে এগুলোয়?

২. একে তিন তিনে এক

ভালো ক’রে দেখে নিয়ে লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘এ-যে দেখছি তিন-তিনটে আলাদা দলিল। একেকটা একেক ভাষায় লেখা। এটা আলেমান, এটা ইংরেজি—আর এইটে ফরাশিতে লেখা।’

‘কী লেখা আছে? পাঠোদ্ধার করা যায়?’ লেডি হেলেনা কৌতূহলী হ’য়ে জিগেস করলেন।

‘উঁহু। সব কথা পড়া যাচ্ছে না যে। কিছু-কিছু লেখা জলে মুছে গিয়েছে যে।’

‘তিনটে দলিলে যদি একই কথা তিন ভাষায় লেখা হয়ে থাকে, তাহ’লে হয়তো তিনটে একসঙ্গে মিলিয়ে প’ড়ে দেখলে একটা মর্মোদ্ধার করা যাবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। আচ্ছা, প্রথমে ইংরেজিটা দেখা যাক।’

ইংরেজিতে লেখা দলিলটা টান ক’রে টেবিলে বিছিয়ে রাখার পর দেখা গেলো, তা থেকে শুধু এটুকুই পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছে :

বেশ-খানিকক্ষণ লেখাটা প’ড়ে মর্মোদ্ধার করার ব্যর্থচেষ্টা ক’রে হতাশ হ’য়ে মেজর ম্যাকন্যাব্‌স মন্তব্য করলেন, ‘উঁহু, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। একটা বাক্যও আস্ত নেই—কিছু বোঝা যাবে কী করে?’

‘কোনো গোটা বাক্য না-থাকলেও কতকগুলো শব্দ তো আস্ত আছে। এই-যে, দ্যাখো-না, Sink, aland, This, and lost এই শব্দগুলো কিন্তু ঠিকই আছে। আর ঐ Skipp নিশ্চয়ই Skipper কথাটারই গোড়ার দিক। Gr-এটার G বড়োহাতের হরফ ব’লে মনে হয়, কোনোকিছুর নাম। Skipper যদি আমরা ঠিকঠাক ভেবে থাকি, তবে এই Gr হয়তো জাহাজটারই নাম— আর ssistance কথাটা থেকে মনে হয় সাহায্য চাচ্ছে। সম্ভবত Gr জাহাজটা ডুবে গেছে, বা এমনভাবে ভেঙে গিয়েছে যে আর নাব্যতার উপযোগী নেই। সেই জন্যেই এই assistance চাইবার প্ৰাৰ্থনা।’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বললেন, ‘ssistanceটা যে assistance-এরই শেষাংশ সেটা আপনি ঠিকই ধরেছেন। docum কথাটা সেভাবেই নিশ্চয়ই document কথাটার গোড়ার দিক—শেষটা মুছে গিয়েছে।’

‘হয়তো এই অনুমানগুলো ঠিক, তবে যেহেতু অনেকগুলো লাইন নেই, কোনো বাক্যই নেই পুরোপুরি, তাতে আসল ব্যাপারটাই জানা যাচ্ছে না। যদি জাহাজডুবির পর কেউ সাহায্য চেয়ে এই দলিলটা বোতলে পুরে জলে ভাসিয়ে দিয়ে থাকে, ধরে নিলুম তা-ই হয়েছে, কিন্তু এই তথ্যগুলো নেই জাহাজটার নাম কী, কোথায় যাচ্ছিলো; কোন দেশের জাহাজ (কারণ বাকিগুলো তো ইংরেজিতে লেখা নয়—আলেমন আর ফরাশিতে) তাও বোঝা যাচ্ছে না। কবে কোথায় গিয়ে জাহাজটা বিপাকে পড়েছে তারও কোনো হদিশ নেই। আমরা যা জানতে পাচ্ছি, তার অনেকটাই অনুমানের ওপর নির্ভর ক’রে—’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স জানালেন। দু-নম্বর পার্চমেন্টটার গায়ের লেখা প্রথমটার চাইতে আরও অবোধ্য—প্রায় পুরোটাই নষ্ট হ’য়ে গেছে। পার্চমেন্টে যা পড়া গেলো, তা এই :

‘সৎভাই, আট্রোসেন, ব্রিংগট ইরেন—’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স কথাগুলো জোরে-জোরে উচ্চারণ করলেন। ‘আলেমান ভাষা,’ বললেন তিনি, ‘তাছাড়া হরফগুলো গথিক। সিবেন ইউনি অর্থাৎ সাত জুন। ইংরেজি কাগজটার 62 যদি তারিখেরই অংশ হয় তাহ’লে এই দুটো জুড়ে পাওয়া যাচ্ছে সাত জুন, ১৮৬২। আলেমান দলিলে আছে Glass, ইংরেজিতে আছে Gow—জুড়ে দিলে হবে Glassgow, অর্থাৎ জাহাজটা ছিলো গ্লাসগোর। পরের একটা লাইন কিছুই পড়া যাচ্ছে না—শুধু ঝাপসা কালির দাগ। কিন্তু তারপরেই রয়েছে সৎভাই—zwei—মানে দুই, মাঝে ফাঁক দেখে মনে হয় attrosen-এর আগে অন্তত একটা হরফ ছিলো—যদি mattrosen হয় তবে বোঝাবে নাবিক, মাঝিমাল্লা। ঐ graus কথাটার মানে ঠিক ধরতে পারছি না। কিন্তু অন্য দুটো কথা তো আসতই আছে bringt ihren—মানে bring them-ওদের নিয়ে এসো; এখন ssistance বা assistance-এর সঙ্গে যদি জোড়া যায় তাহ’লে দাঁড়াবে being them assistance—মানে ওদের কাছে সাহায্য নিয়ে এসো। ওদের সাহায্য করো।

লর্ড এডওয়ার্ড বললেন : ‘সাহায্য চাইছে? কারা?’

মেজর ম্যাকন্যাব্‌স বললেন : ‘তাছাড়া এরা কোন্ ধরনের সাহায্য চাইছে তাও তো আমরা জানি না।’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স তৃতীয় পার্চমেন্টটা নেড়ে-চেড়ে বললেন : ‘কী ধরনের সহায়তা পাঠাতে হবে, তা সম্ভবত পরের লেখাটায় চোখ বুলিয়ে নিলেই বোঝা যাবে। যেহেতু ফরাশিতে লেখা, কারুপক্ষেই বুঝতে অসুবিধে হবে না। ‘

‘ত্রোয়া—trois—মানে তো তিন, আর mais—সেটা সম্ভবত মাস্তুলই বোঝাচ্ছে—তিন মাস্তুলের জাহাজ।’ লর্ড এডওয়ার্ড হঠাৎ উত্তেজিত হ’য়ে উঠলেন ‘ইংরেজি আর ফরাশি লেখা মিলিয়ে তো জাহাজটার নামও পাওয়া যাচ্ছে—ব্রিটানিয়া— Britannia! অর্থাৎ গ্রেটব্রিটেনের জাহাজ! আর Austral ইংরেজিতেও যা বোঝাচ্ছে ফরাশিতেও তাই—অর্থাৎ দক্ষিণ গোলার্ধের কথা—’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বললেন : ‘তার মানে, দক্ষিণ গোলার্ধে জাহাজডুবি হয়েছে!’

কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতে লর্ড এডওয়ার্ড আরো-কতকগুলো ব্যাপার আন্দাজ ক’রে নিলেন। শব্দের ভাঙাচোরা টুকরো থেকেই অনুমান ক’রে নিতে হবে গোটা শব্দটা—এবং কোনো নৌযাত্রার সঙ্গেই যেন সে-সব শব্দের একটা সংগতি থাকে। আর এই সূত্রটা ধরেই সশব্দে অনুমান দাঁড় করালেন লর্ড এডওয়ার্ড : ‘abor ধ’রে নিলুম aborder এর প্রথম অংশ মানে জমিতে নামা। যাত্রীরা ডাঙায় নেমেছে। কিন্তু কোথায়? Contin – তা নিশ্চয় Continentই বোঝাচ্ছে–কোনো একটা মহাদেশ –

‘দক্ষিণ গোলার্ধের মহাদেশ?’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স তাঁর অনুমানের ঢিল ছুঁড়লেন।

‘এটা খেয়াল করেছেন?’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স ব’লে উঠলেন, ‘cruel শব্দটা থেকে আলেমান শব্দ graus-এরও একটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে-grausam—অর্থাৎ gruesome—ভয়ংকর-নিষ্ঠুর।’

‘Indi তাহ’লে কি India—ভারতবর্ষ? আর ongit ই বা কী—আরে! সেটা নিশ্চয়ই longitude-এরই ধ্বংসাবশেষ-দ্রাঘিমা। তাহ’লে lat হ’লো অক্ষরেখা, latitude—৩৭ ডিগ্রি ১১। তাতে তো ঠিকানাটাই পেয়ে-যাওয়া গেলো, অন্তত তার একটা মোটামুটি আন্দাজ।’

‘দ্রাঘিমা কত না-জানলে আর মোটামুটি ঠিকানা তুমি পেলে কোথায়?’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স ফ্যাকড়া তুললেন।

‘আগে তো তিনটের বয়ান মিলিয়ে সবটা লিখে ফেলা যাক—একসঙ্গে চোখের সামনে যদি থাকে তাহ’লে হয়তো হেঁয়ালিটার একটা নিষ্পত্তি হবে—’ বললেন লর্ড এডওয়ার্ড।

‘যারা এই পার্চমেন্টগুলো বোতলে পুরেছিলো, তারা কিন্তু কোনে ধাঁধা বা হেঁয়ালি তৈরি করতে চায়নি—তারা ঠিকঠাক জানাতে চেয়েছিলো কোথায় কী হয়েছে। শুধু প্রকৃতির কৃপাতেই খানিকটা লেখা মুছে গিয়ে জট পাকিয়ে গেছে।’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বললেন।

‘সেইজন্যেই একসঙ্গে সাজিয়ে নিলে সুবিধে হবে। তাছাড়া লেখাগুলো সব পশ্চিম ইওরোপের নানা ভাষায়—আর আমরা যদি জাহাজের নামটা সঠিক অনুমান ক’রে থাকতে পারি, ব্রিটানিয়া, তাহ’লে সেটা মোটেই অস্বাভাবিক হয়েছে ব’লেও মনে হয় না। এবার সবগুলো লেখা একসঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক তা থেকে জটটা খোলবার কোনো হদিশ মেলে কি না।’

তিনটে পার্চমেন্টের লেখাকেই সাজিয়ে নিয়ে ইংরেজিতে লিখে ফেললেন লর্ড এডওয়ার্ড।

June 7th 1862
went down

frigate Britannia
-gonie

Glasgow
austral-

by land

Captain Gr-
Contin-

two sailors land

pr-
thrown this paper

cruel

indi—

and latitude 37°11’
lost

in longitude
Take them help

লেখাটা যখন তাঁরা খতিয়ে দেখছেন, তখন মাল্লাদের একজন এসে জানতে চাইলে এবার ডানকান জাহাজ কোনদিকে যাবে। পুরোটাই তো এই আনকোরা জাহাজটার মহড়া চলেছে, এমনিতে তার বিশেষ-কোনো নিদিষ্ট গন্তব্যই নেই। এবার অবশ্য ঠিক করে নেয়া দরকার ডানকান ফিরে যাবে কি না।

প্রশ্ন শুনে লর্ড এডওয়ার্ড বললেন : ‘ডামবার্টন চলো। লেডি হেলেনা ম্যালকম কাল-এ ফিরে যাবেন। আমি তারপর যাবো লন্ডনে—নৌবাহিনীর দফতরে গিয়ে এটা দেখাতে হবে। তাছাড়া ব্রিটানিয়া সম্বন্ধেও খোঁজ-খবর নিতে হবে আমাদের।’

মাল্লাটি নির্দেশ নিয়ে চ’লে গেলে লর্ড এডওয়ার্ড লেখাটা তুলে নিয়ে বললেন : ‘আমরা তাহ’লে ধরে নিতে পারি যে ১৮৬২ সালের ৭ই জুন একটা ত্রিমাস্তুল যুদ্ধজাহাজ – ব্রিটানিয়া—গ্লাসগো থেকে বেরিয়েছিলো—সেটা কোনো অজ্ঞাত কারণে ডুবে গিয়েছে। কাপ্তেন আর তার সঙ্গে দুজন মাল্লা ৩৭°১১ অক্ষাংশ থেকে তিনটি ভাষায় খবরটা জানিয়ে সাহায্যের প্রার্থনা ক’রে একটা বোতলে লেখাগুলো পুরে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে যদি তারা উদ্ধার না-পেয়ে থাকে, তাহ’লে দু-বছরেরও বেশি হ’লো কোথাও প’ড়ে আছে—’

‘যদি-না এর মধ্যে ম’রে গিয়ে থাকে,’ বললেন, মেজর ম্যাকন্যাব্‌স। ‘আর যদি বেঁচেও থাকে, তাদের দশা এখন কী হয়েছে, সেটা খানিকটা কল্পনা ক’রে নেয়া যায়,’ এতক্ষণে লেডি হেলেনা মুখ খুললেন।

‘খুব-একটা ভালো অবস্থায় নেই সম্ভবত,’ লর্ড এডওয়ার্ডকে একটু উদ্বিগ্নই দেখালো। ‘কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে, তার সমাধান কী, আমার মাথায় আসছে না। জাহাজটা ডুবেছে সম্ভবত দক্ষিণ গোলার্ধের কোথাও। কিন্তু ঐ gonie শব্দটার মানে কী হ’তে পারে?’

‘ওটা তো ফরাশি লেখাটার টুকরো—ফরাশি ভাষায় যাকে Patagonie বলে, ইংরেজিতে তাকেই বলে Patagonia। এটা সেই পাতাগোনিয়া কথাটারই ভগ্নাংশ নয় তো?’

‘পাতাগোনিয়া কি ৩৭° অক্ষরেখায় পড়ে?’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স জিগেস করলেন। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স তক্ষুনি আমেরিকার দক্ষিণভাগের মানচিত্র খুলে দেখিয়ে দিলেন সত্যি তা-ই।

‘দক্ষিণ আমেরিকা যদি হয় তাহ’লে ধাঁধার জট আরো-খানিকটা খোলা যায়। Contin—তাহ’লে Continent, pr—হতে পরে prisoners, আর cruel indi- সেক্ষেত্রে হ’তে পারে cruel Indians। আর এই অনুমান যদি ঠিক হয় তাহ’লে তারা হয়তো নিষ্ঠুর ইন্ডিয়ানদের হাতে বন্দী হয়েছে। এবং সেক্ষেত্রে তারা এখনও বেঁচে আছে কি না, সে-সম্বন্ধে সংশয়ও জাগতে পারে।’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বললেন : ‘পাতাগোনিয়া দক্ষিণ আরহেনতিনা আর দক্ষিণ চিলের মধ্যে অবস্থিত—তার একদিকে আন্দেয়াস গিরিমালা অন্যদিকে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর। তিয়েরা দেল ফুয়েগো এই পাতাগোনিয়ারই অংশ।’

‘যদি আর্হেনতিনা বা চিলের দক্ষিণভাগেই তা হ’য়ে থাকে, তবে এটা আশ্চর্য যে অন্যান্য ইওরোপীয় ভাষার সঙ্গে এস্পানিওলে কিছু লেখা নেই। তাছাড়া আর্হেনতিনার পাম্পায় বা চিলেয় যে-ইন্ডিয়ানরা থাকে, তারাই বা কতটা নিষ্ঠুর? অকারণে কাউকে বন্দী করে রেখে তারা কি অত্যাচার করবে?’ লেডি হেলেনা প্রশ্ন তুললেন।

‘এ-সব তো আমাদের অনুমান মাত্র,’ লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘গ্লাসগো গিয়ে না-হয় খোঁজ ক’রে দেখা যাবে ব্রিটানিয়া সত্যি-সত্যি কোথায় যাচ্ছিলো। সেখানে নিশ্চয়ই কোনো নথিপত্রে কিছু লেখা থাকবে।

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বললেন তাঁর কাছে নৌদফতরের গেজেট আছে—সেখানে হয়তো এক্ষুনি কোনো হদিশ পাওয়া যেতে পারে। দু-বছর আগেকার গেজেট বার ক’রেই একটা জরুরি তথ্য বার ক’রে নেয়া গেলো।

‘এখানে গেজেটে একটা জ্ঞাপনী আছে। ১৮৬২ সালের ৩০শে মে কাপ্তেন গ্রান্ট কাইয়াও থেকে ব্রিটানিয়া জাহাজ নিয়ে গ্লাসগোর উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন।’

‘কাইয়াও? সে আবার কোথায়?’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স জিগেস করলেন।

‘কাইয়াও,’ গেজেট থেকে মুখ তুলে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স জানালেন, ‘পশ্চিম পেরুর একটা নগর-বন্দর—লিমার পশ্চিমে, কাইয়াও উপসগারের তীরে অবস্থিত। তেমন ছোটো শহরও নয়-দেড় লাখের ওপর লোক আছে—’

লর্ড এডওয়ার্ড কিন্তু কাইয়াওয়ের খবর শুনছিলেন না। তিনি বরং ব্রিটানিয়া জাহাজের কাপ্তেনের নাম শুনে চমকে উঠেছেন। ‘কাপ্তেন গ্রান্ট? সেই যিনি প্রশান্ত মহাসাগরে নোভাস্কোশিয়ার পত্তন করতে চেয়েছিলেন—নয়াস্কটল্যান্ড?’

‘হ্যাঁ। তিনিই। কিন্তু ১৮৬২ সালে ব্রিটানিয়া জাহাজ নিয়ে তিনি কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন তা আজও কেউ জানতে পারেনি।’

‘তাহ’লে তো আমরা অনেকটাই জেনে যেতে পেরেছি। ৩০শে মে তিনি কাইয়াও থেকে বেরিয়েছিলেন—৭ই জুন অর্থাৎ ঠিক আটদিন পরে পাতাগোনিয়ার কাছে কোথাও–হয়তো উপকূলেই –জাহাজ ডুবি হয়। এবার তাহ’লে দ্রাঘিমাটা জেনে যেতে পারলেই আমরা বুঝে যাবো সত্যি কোথায় তাঁর জাহাজডুবি হয়েছিলো।’

‘দ্রাঘিমা যদি নাও জানা যায়?’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স জানালেন, ‘পাতাগোনিয়া বা তিয়েরা দেল ফুয়েগো আমার জানা। আমরা সেখানটায় অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারবো।’

‘এবার তাহ’লে গোটা সন্দেশটা লিখে ফেলা যাক,’ লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘অন্তত যে-কথাগুলো সম্বন্ধে আমাদের আর-কোনো সন্দেহই নেই, সেগুলো পর-পর সাজিয়ে দেখা যাক কী দাঁড়ায়।’

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসের সাত তারিখে গ্লাসগোর ত্রিমাস্তুল যুদ্ধজাহাজ ব্রিটানিয়া দক্ষিণ গোলার্ধে পাতাগোনিয়ার কাছে কোথাও ডুবে গিয়েছে। দুজন মাল্লা আর কাপ্তেন গ্রান্ট দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের কোথাও গিয়ে নেমেছিলেন, বা নামবার চেষ্টা করেছিলেন–এবং সম্ভবত নামবামাত্র সেখানকার ইন্ডিয়ানদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন—তাদের বলা হয়েছে ভয়ংকর অথবা নিষ্ঠুর–নামবার সময় ৩৭°১১ অক্ষরেখায় তাঁরা সাহায্য চেয়ে একটা বোতলে নানা ভাষায় খুঁটিনাটি জানিয়ে তিনটে চিরকুট ভাসিয়ে দিয়েছিলেন—অন্তত আর-কোনো বোতলে এই বার্তা জানিয়েছিলেন কি না জানা নেই–তবে এটায় তাঁরা তিনটি ভাষায় আবেদন জানিয়েছিলেন—যাতে যারই হাতে পড়ুক সে-ই মূল আবেদনটা পড়তে পেরে সাহায্য পাঠাতে পারে।

এই মর্মার্থটা জানবার পর সকলেরই মত হ’লো যে, ব্যাপারটা বাস্তবিকই নিশ্চয়ই তা-ই হয়েছিলো।

লেডি হেলেনা কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সকে জিগেস করলেন : ‘তারপর থেকে আজ অব্দি কি আদৌ কোনো খোঁজ মেলেনি তাঁদের?’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স মাথা নেড়ে জানালেন, ‘না।’

‘কিন্তু এই চিরকুটগুলো দেখালে কি সরকার থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না? ব্রিটানিয়া তো একটা যুদ্ধজাহাজ, ফ্রিগেট—তাতে কামানও তো আছে!’

লেডি হেলেনা বললেন, ‘আর কাপ্তেন গ্রান্টের পরিবার? তাঁর স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে–’

লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘এ নিয়ে তুমি মিথ্যে আর ভেবো না। আমিই তাঁদের খবর দেবো। দরকার হ’লে তাঁদের দায়িত্ব নেবো।’

একটু পরে ডানকান যখন ডামবারটনের বন্দরে ভিড়লো, লেডি হেলেনাকে নিয়ে মেজর ম্যাকন্যাব্‌স গেলেন ম্যালকম কাল-এর উদ্দেশে, আর লর্ড এডওয়ার্ড লন্ডনের ট্রেন ধরবার আগে টাইম্স আর মর্নিং ক্রনিক্‌ল কাগজ দুটোয় একটা বিজ্ঞাপনের খাড়া পাঠিয়ে দিলেন ছাপবার জন্যে :

কেউ যদি ত্রিমাস্তুল মানোয়ারি জাহাজ ব্রিটানিয়ার কোনো খোঁজ নিতে চান তাহলে নিচের ঠিকানায় লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।—ম্যালকম কাল, ডামবারটন, স্কটল্যান্ড।

৩. কাপ্তেন গ্রান্টের ছেলেমেয়ে

পশ্চিম স্কটল্যান্ডের লখ ফাইন-এর কাছে, যেখানে সমুদ্র থেকে একটা লম্বা ল্যাজ যেন দু-দিকে ডাঙা রেখে ভেতরে ঢুকে পড়েছে, তারই কাছে একটা টিলার ওপর তৈরি হয়েছে ম্যালকম কাল, মস্ত-একটা দুর্গ, পুরোনো সমস্ত কিংবদন্তি কুয়াশা আর আলোছায়ায় ছাওয়া পরিখাঘেরা কেল্লা, তাকে জড়িয়ে কত-যে গল্প আছে তার ঠিক নেই। সেই কবে থেকেই গ্লেনারভনরা এই কেল্লার মালিক, কত যুদ্ধ-বিগ্রহ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র কল্পকথা কিংবা প্রেমকাহিনীর সে সাক্ষী—ফার্গাস ম্যাকন্‌গ্রেগর বা তাঁরই মতো কেউ-কেউ সে-সব কাহিনীর নায়ক। স্কটল্যান্ডে যখন তুলকালাম কাণ্ড চলছিলো, বিদ্রোহ বিক্ষোভে স্বাধীনতার লড়াই, তখন অ্যাংলো-স্যাকসনদের অত্যাচারের কত-যে স্কট দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো, তার ইয়াত্তা নেই, যদিও গ্লেনারভনরা নানাভাবে টিকে থাকতে চেয়েছেন এখানে এবং টিকেও গিয়েছেন, আর তাঁদেরই সঙ্গে থেকে গিয়েছে—টিকেই গিয়েছে বলা যায়—তাঁদের কিছু অনুচর সহচর—বংশানুক্রমিকভাবে তাদের পরিবারও সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে গ্রেনারভনদের সঙ্গে ছিলো। ইংরেজদের অধীনতা মেনে নিতে হয়েছে ব’লে তাদের দুঃখের শেষ নেই। কিন্তু তারই মধ্যে তারা জিইয়ে রাখতে চেয়েছে তাদের স্বাতন্ত্র্য, তাদের সংস্কৃতি—কিল্ট পরে তারা, খাটো হাঁটু অব্দি নামা ছোটো স্কার্ট, কিংবা বলে গেলিকভাষা, কিংবা বাজায় ব্যাগপাইপ, ফ্রুট, হাইল্যান্ডের সংগীত। তারা না-থাকলে একা-একা গ্লেনারভনদের এই কেল্লায় থাকা মুশকিলের হ’তো, যতই কেননা ম্যালকম কাল মজবুত হোক, কিংবা কাস্ল হোক সশস্ত্র, থাকুক জালিকাটা উপরদেয়াল, যেখান থেকে গোলন্দাজদের বন্দুকের নল বেরিয়ে থাকতে পারে হানাদারদের উদ্দেশ্যে। এরা সবাই নির্ভীক, দুঃসাহসী, বেপরোয়া—আর বিশ্বস্ত ও অনুগত। সত্যি-বলতে, তারাই আছে ডানকান জাহাজে, ওস্তাদ মাল্লা একেকজন, দুর্ধর্ষ, সমুদ্র যখন রাগে ফোঁসে, গর্জায় একটুও না-টসকে, একটুও বিচলিত না-হ’য়ে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে তারা জাহাজ সামলাতে পারে। স্কটল্যান্ডের উপকূলে সমুদ্র প্রায়ই অশান্ত হয়ে ওঠে, বিশেষত দীর্ঘস্থায়ী বর্ষায়, আর ছেলেবেলা থেকেই সেই জলে বেরোয় ব’লে তারা জানে কেমন ক’রে শামাল দিতে হয় সে-সময়। তারা শুধু নির্ভরযোগ্য বা নিছক বেপরোয়াই নয়, তাদের দুর্দান্ত দুঃসাহস এসেছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে, দক্ষতা থেকে, একেকজন তারা ওস্তাদ মাঝি-মাল্লা, চৌকশ, দুর্ধর্ষ।

লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভন অজস্র বিত্তসম্পদের মালিক—কিন্তু এই বিপুল অর্থ তিনি কোনো মক্ষিচুষ কঞ্জুসের মতো শুধু সিন্দুকেই তুলে রাখেন না, অকাতরে সে-অর্থ তিনি সে-অঞ্চলের মানুষদের অবস্থা ফেরাবার জন্যে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় করেন, দরকার হ’লে হাউস অভ লর্ডস-এ তাদের জন্যে বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, লড়াই করেন, তাদের উন্নতির জন্যে নিপুণভাবে যুক্তি সাজিয়ে ও শানিয়ে ভাষণ দেন—সেইসব ভাষণে কেবল যে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ থাকে, কুটজাল থাকে যুক্তির, তা-ই নয়—কখনও-কখনও সেইসব কথার সঙ্গে মিশে যায় তীব্র আবেগ—অর্থাৎ নীরক্ত, শীতল, হৃদয়হীন বুদ্ধির প্যাচই খেলেন না লর্ড এডওয়ার্ড—এ-দেশের মানুষের জন্য সত্যি ভাবেন তিনি, তাদের কথা ভাবেন সবসময়, আর এই দেশপ্রেম বা দেশবাসীর জন্যে প্রেম আছে ব’লেই অকুতোভয়ে এমন-সব পরিকল্পনা ফাঁদতে পারেন, যে-সব কাজে নামতে গিয়ে অনেক ডাকাবুকো লোকও দু-একবার ইতস্তত করবে। বিপদের সম্ভাবনা দেখে তিনি তাঁর প্রস্তাবিত পরিকল্পনা থেকে পেছিয়ে আসেন না। তিনি রয়্যাল টেমস ইয়ট ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন, তা নিছক খেয়ালি বিত্তবান ব’লেই নন। এটা ঠিক যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নামতে তাঁর ভালোই লাগে, উত্তেজনা জাগে মনে, রক্তে জাগে চাঞ্চল্য, শিহরন। কিন্তু আরো একটা উদ্দেশ্য থাকে আড়ালে—প্রতিযোগিতায় তিনি কেবল ব্যক্তি হিশেবেই জেতেন না, জেতেন স্কটল্যান্ডের প্রতিনিধি হিশেবে, স্বদেশের নাম উজ্জ্বল করবার জন্যে। কিন্তু তাঁর এই দেশপ্রেম তাই ব’লে তাঁকে সংকীর্ণ মানুষ ক’রে তোলেনি তাঁর চিত্তের ঔদার্যও তাঁকে অন্যদের চাইতে ভিন্ন ক’রে দিয়েছিলো—বিশেষত হাউস অভ লর্ডসে অন্য যে-সব ধনীর দুলাল আভিজাত্যের বড়াই করেন, নাকউঁচু হাম্বড়া দেমাক দেখান, সবসময়েই ভোগেন অহংম্মন্যতায় বা আত্মকেন্দ্রিকতায় তিনি ঠিক তাঁদের মতো নন। এজন্য তাঁর বিস্তর সুনাম হয়েছিলো। আর তা যে কারু-কারু মধ্যে ঈর্ষার জ্বলুনি জাগিয়ে দিতো না, তাও নয়। কিন্তু বত্রিশবছর বয়সী এই সুপুরুষ কখনো নিজে থেকে কাউকে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবার সুযোগ দেননি—প্রতিযোগিতা হয় জলে, ইয়টের বাজিতে, আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের থাকে ততক্ষণই যতক্ষণ জলের মধ্যে চলে এই রেষারেষি। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর দরদ এতই সহজে তাঁর স্বভাবটার সঙ্গেই মানিয়ে যেতো যে তাতে কখনও কোনো আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পেতো না। আর তাঁর দরাজ দিলের সঙ্গে সংগতি রেখেই ছিলো তাঁর প্রচণ্ড দুঃসাহস। এটা এমন ধরনের কোনো দুঃসাহস নয় যার মধ্যে দেখানোপনা আছে, শুধু দুঃসাহসী কীর্তি করেই যা তুষ্ট হ’তো, অর্থাৎ নিছক বেপরোয়াভাব প্রকাশ করার জন্যেই তিনি বেপরোয়া কাজেকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তেন না, তার পেছনে তাগিদ থাকতো পরের উপকার করবার। আর এই পরোপকার-প্রবৃত্তি কারু কৃতজ্ঞতার প্রত্যাশী ছিলো না, বরং কারু জন্যে কোনো কাজ ক’রে দেবার পর সে যদি গদ্‌গদ হ’য়ে তাঁকে সম্ভাষণ করতো তবে তিনি যেন লজ্জাই পেয়ে যেতেন, একটু সংকুচিত বোধ করতেন, আড়ষ্ট। তিনি যদি অকাতরে দেশের মানুষের জন্যে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেন, অন্তত বিলিয়ে দেবার প্রয়োজন এলে তিনি যে তাতে পেছ-পা হতেন না এটা সুনিশ্চিতই ছিলো, তবু তিনি ঠিক চাইতেন না লোকে সেটা জানুক, জেনে তাঁকে বাহবা দিক, শাবাশি জানাক—পারলে নিজেই তিনি প্রসঙ্গটা হয়তো ভুলেই যেতেন।

এহেন লর্ড এডওয়ার্ড বিয়ে করেছেন হেলেনাকে, সাধারণ ঘরের মেয়ে। সুশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, সংবেদনশীল, কিন্তু তাঁর ধমনীতে নীল রক্ত ব’য়ে যেতো না। অন্যান্য অনেক রূপসী তরুণী-অভিজাতঘরের মেয়ে সবাই—তাঁর প্রেমে পড়বার জন্যে যেন তৈরি হ’য়েই ছিলো। তাদের সঙ্গে লর্ড এডওয়ার্ডের নানা উপলক্ষে মেলামেশাও হ’তো, নাচের মজলিশে, গানের আসরে, পালায়-পরবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তিনি বিয়ে করলেন উইলিয়ম টাফনেলের এই মেয়েকে—সেই অকুতোভয় টাফলেন, যিনি ছিলেন বিখ্যাত ভ্রমনবিদ, কত যে দেশবিদেশ ঘুরে বেরিয়ে এসেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। হেলেনার সঙ্গে যখন লর্ড এডওয়ার্ডের পরিচয় হ’লো টাফনেল পরিবার তখন বিষম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলো। হেলেনার বয়েস তখন সদ্য বাইশ ছুঁয়েছে। বিত্ত, কিংবা নীল রক্ত, কিংবা তথাকথিত জাগতিক খ্যাতি কিছু না-ই থাক, হেলেনার রূপগুণ ছাড়া আরো-একটা জিনিশ ছিলো, যা লর্ড এডওয়ার্ডের প্রণয়প্রার্থী অন্য মেয়েদের ছিলো না—আর তাতেই যেন সবাইকে টেক্কা দিয়ে গিয়েছিলেন লেডি হেলেনা, আর সেটা এই : তিনি স্কটল্যান্ডের দুহিতা। হেলেনা যে স্কটিশ, এটাই ছিলো লর্ড এডওয়ার্ডের কাছে একটা বাড়তি আকর্ষণ। অবশ্য স্কটিশ না-হ’লেও হেলেনাকে তিনি বিয়ে করতেন, ব’লেই মনে হয়—কেননা প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই দুজনে দুজনের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু হেলেনা যে স্কটল্যান্ডের দুহিতা—এই তথ্যটা কাটান দিয়েছিলো এই সামাজিক রীতিকে— যে, অভিজাতরাই অভিজাতকে বিয়ে করবেন। লর্ড এডওয়ার্ডের কাছে স্কটল্যান্ডের মানুষ মাত্রেই অভিজাত। আর হেলেনা টাফনেল তো বিশেষ ক’রে তা-ই, যেহেতু দুজনের মনের মিল এতটাই হয়েছিলো যে সত্যি-বলতে কোনো সামাজিক রীতিনীতির অযৌক্তিক বিধানকেই নির্বিচারে বিনাতর্কে মানতে দেয়নি।

বিয়ের পর হেলেনাকে তাক লাগিয়ে দেবেন ব’লে লর্ড এডওয়ার্ড একটা বাষ্পেচলা জাহাজ তৈরি করাচ্ছিলেন। লোকে মধুচন্দ্রিকা যাপন করতে যায় নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব কোনো ভূস্বর্গে; লর্ড এডওয়ার্ডের ধারণা ছিলো অন্যরকম। তাঁরা বেরিয়ে পড়বেন সমুদ্রে, মধুচন্দ্রিকার সঙ্গে মিশবে প্রমোদভ্রমণ, অর্থাৎ কোথাও গিয়ে আস্তানা গেড়ে বসা নয়—সারাক্ষণই চলতে থাকবেন দুজনে, রোজ নতুন জলে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখবেন—অথচ জাহাজটি এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্য থাকে, আরামবিরামের অবকাশ থাকে। সত্যি-বলতে, কোনো ইয়ট ক্লাবের সদস্য মিথ্যে কেন মধুচন্দ্রিকা যাপন করবে ডাঙায়?

আর এই কারণেই তৈরি করা হয়েছিলো ডানকান। জাহাজের নীল-খশড়া—অর্থাৎ নকশাটা—অনেক ভাবনাচিন্তার পর লর্ড এডওয়ার্ডের মাথা থেকেই বেরিয়েছিলো। একই সঙ্গে মজবুত হবে, সর্বাধুনিক এনজিন থাকবে তার, তরতর ক’রে জল কেটে এগিয়ে যাবে, কিন্তু তাতে থাকবে আরামেরও সব উপকরণ, যাতে কিছুতেই এ-কথা কখনও মনে না-হয় যে এর চাইতে কোনো ভালো হোটেলে গিয়ে উঠলেই হ’তো।

আর তারপরে নতুন-তৈরি জাহাজ ডানকানকে নিয়ে মহড়ায় বেরুবামাত্র আকস্মিকভাবে পাওয়া গেলো মুশকিল আসানের তিন তলব—তিন-তিনটে ভাষায় লেখা সাহায্যের প্রার্থনা।

লর্ড এডওয়ার্ড টাইমস আর মর্নিং ক্রনিকলে বিজ্ঞাপন দুটো পাঠিয়ে দিয়েই রওনা হ’য়ে গেলেন লণ্ডনের উদ্দেশে, নৌদফতরে গিয়ে তিনি বিশদ জানাবেন কী হয়েছে, সেইসঙ্গে খোঁজ-খবরও নেবেন কাপ্তেন গ্রান্টের ব্রিটানিয়া সম্বন্ধে। আর লেডি হেলেনা চ’লে এলেন ম্যালকম কাল-এ।

পরদিনই লণ্ডন থেকে এক তার এসে হাজির। যত-শিগগির-সম্ভব লর্ড এডওয়ার্ড ডামবারটন ফিরে আসবেন; কিন্তু তারের পেছন-পেছন সেদিনই রাত্তিরে এলো এক চিঠি। তার সংক্ষিপ্ত বয়ানের ততোধিক সংক্ষিপ্ত সারমর্ম–লন্ডন থেকে ফিরতে দেরি হবে। নববিবাহিত বর তার কনেকে খুবই সোজাসুজি জানিয়েছে তাড়াতাড়ি ফেরা সম্ভব হবে না। চিঠির বয়ানের ধরন দেখে লেডি হেলেনার একটু ভাবনাই হ’লো। যেন তাড়াহুড়ো ক’রে হঠাৎ লর্ড এডওয়ার্ড কোনো কারণে মতি পরিবর্তন ক’রে জানাচ্ছেন লণ্ডনে তাঁর সময় লাগবে। কেন? হঠাৎ আবার কী হলো?

এ-চিঠি পাবার পর লেডি হেলেনা যখন সাত-সতেরো অনেক কিছুই ভাবছেন অথচ কোনো হদিশই পাচ্ছে না লর্ড এডওয়ার্ডের আকস্মিক সূচিবদল করার কারণের, এমন সময়ে তাঁর খাশ পরিচারক এসে জানালে অনেক দূর থেকে ট্রেনে ক’রে দুই কিশোর-কিশোরী এসেছে, গ্লেনারভনের সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করতে চায়, জরুরি দরকার। তাদের নাকি বিষম বিচলিত দেখাচ্ছে।

কারা এরা—লেডি হেলেনা ঠিক বুঝতে পারলেন না। লর্ড এডওয়ার্ডের তাড়াতাড়ি না-ফেরার সঙ্গে এদের কোনো যোগ আছে? থাকুক বা না-থাকুক, তাদের খুব বিচলিত দেখাচ্ছে এ-কথা শুনেই লেডি হেলেনা তাদের ডেকে পাঠালেন।

ঘরে যারা ঢুকলো, সত্যি তাদের বয়েস বেশি নয়। মেয়েটির বয়েস ষোলো-সতেরো হবে, সে-ই দুজনের মধ্যে বড়ো, পোশাক-আশাক দেখে বোঝা যায় এককালে যদি-বা অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষ হ’য়েও থাকে,এখন নিশ্চয়ই অবস্থাবিপাকে পড়েছে, কেননা পোশাক তার দামি, তাতে রুচির ছাপ আছে, পরিচ্ছন্নও, কিন্তু দেখে বোঝা যায় এই পোশাক পুরোনো, বহু ব্যবহারে তার রঙ একটু মিইয়ে এসেছে। ছিপছিপে সুশ্রী কিশোরী, ডাগর দুটি চোখ—লাল, ফোলা-ফোলা, দেখে মনে হয় এতক্ষণ কাঁদছিলো। ছেলেটির বয়েস বারো-তেরো, তারও পরনে দামি কিন্তু পুরোনো পোশাক—দুজনেরই মুখের আদলে মিল আছে, সম্ভবত এরা ভাই-বোন। একটু উদ্‌ভ্রান্তই দেখাচ্ছে দুজনকে, উত্তেজিতও। তারা লর্ড এডওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করতে চায়, খবরকাগজে বিজ্ঞাপন প’ড়ে ছুটে এসেছে, কাপ্তেন গ্রান্টের খোঁজ নিতে চায় তারা।

‘কাপ্তেন গ্রান্টের খোঁজ?’ তাদের উত্তেজিত অধীর চোখমুখ দেখে জিগেস করলেন লেডি হেলেনা : ‘কেন, বলো তো? কে তোমরা?

‘কাপ্তেন গ্রান্টের ছেলেমেয়ে।’

‘কাপ্তেন গ্রান্টের ছেলেমেয়ে!’

‘হ্যাঁ।’ মেয়েটি প্রায় যেন ফিশফিশ ক’রে কথাটা বললে, ‘আমার নাম মেরি, আর এ আমার ভাই, রবার্ট।’

রবার্ট বললে, ‘আমরা টাইমস-এ একটা বিজ্ঞাপন দেখেছি—কেউ যদি ত্রিমাস্তুল মানোয়ারি জাহাজ ব্রিটানিয়ার কোনো খোঁজ নিতে চায় তাহলে যেন এখানে এসে হিজ লর্ডশিপের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু এসে শুনি তিনি এখানে নেই, লণ্ডন গেছেন। অথচ বিজ্ঞাপনে ব্রিটানিয়া জাহাজের নাম দেখে আমাদের আর তর সয়নি—

‘আমরা আগে থেকে চিঠি লিখে দেখা করবার জন্যে কোনো সময় ঠিক ক’রে আসিনি, হিজ লর্ডশিপ তো আর জানতেন না আমরা আসবো—’ মেরি বললে, ‘কিন্তু বাবার জাহাজের নাম দেখেই আমাদের এমন অস্থির লাগলো যে আমরা কোনো নিয়মকানুনের ধার না ধরেই ছুটে এসেছি—’

লেডি হেলেনা তাদের আশ্বস্ত করলেন। না-না, সেজন্যে ভেবো না। আসলে লর্ড গ্লেনারভন ব্রিটানিয়া সম্বন্ধে কথা বলতেই লন্ডনে নৌবাহিনীর সদর দফতরে গেছেন।’ তারপর লেডি হেলেনা তাদের এক-এক করে খুলে বললেন কেমন ক’রে হাঙরের পেটে বোতলটা পাওয়া গেছে, আর বোতলের ভেতরে তিনটে ছোট্ট পার্চমেন্ট—তাতেই ব্রিটানিয়ার খবর ছিলো। ‘লর্ড গ্লেনারভন কালকেই ফিরে আসবেন। তোমরা বরং এখানেই থেকে যাও—কোনো ফর্মালিটি নেই—কাল লর্ড এডওয়ার্ড ফিরে এলেই তোমাদের সঙ্গে কথা হবে—লন্ডনে তিনি কী জানতে পারবেন, তা আমিও জানি না, তাই আমিও তাঁর ফেরার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছি।’

লর্ড এডওয়ার্ডকে ম্যালকম কাল-এ না-পেয়ে ভাইবোনে যেন একটু চুপসেই গিয়েছিলো। লেডি হেলেনার সদয় ব্যবহারে তারা রীতিমতো মুগ্ধ হ’য়ে গেলো। তারা রাতটা কেল্লাতেই কাটাতে রাজি হলো। বিশেষ ক’রে লেডি হেলেনা যখন বললেন যে তিনি কাপ্তেন গ্রান্ট সম্বন্ধে বিশেষ-কিছুই জানেন না, ভালোই হ’লো, এই ফাঁকে তাদের কাছ থেকে তাঁর সম্বন্ধে সব জরুরি কথা জেনে নিতে পারবেন। তিনি অবশ্য সব কথা খুলে বলেননি তাদের কাছে, ব্রিটানিয়া যে জলে ডুবে গিয়েছে, কাপ্তেন গ্রান্ট যে বিদেশ-বিভুঁয়ে ইন্ডিয়ানদের হাতে বন্দী হয়েছেন—এ-সব কথা ব’লে তিনি ভাইবোনকে ঘাবড়ে দিতে চাননি।

সত্যি-বলতে রবার্ট আর মেরি বাবার কথা বলবার জন্যে যেন উদ্‌গ্রীব হয়েই ছিলো। যেন তাদের দুঃখের কাহিনী শুনিয়ে তারা মনের বোঝা হালকা ক’রে নেবার সুযোগ পেয়েই ব’র্তে গিয়েছে। একটু বিশ্রামের পর, খাবার-টেবিলে বসে ভাইবোনে তাঁকে কাপ্তেন গ্রান্ট কথা শোনালে।

বেচারারা! বাবার কথা বলতে-বলতে তাদের যেন চোখ ফেটে জল বেরুচ্ছিলো। ছেলেবেলাতেই তারা মাকে হারিয়েছিলো। তারপর তাদের হারাতে হ’লো বাবাকেও।

কাপ্তেন গ্রান্ট ডাকাবুকো বেপরোয়া মানুষ। কিন্তু নিছক দুর্দান্ত অ্যাডভেনচারে বেরুনোই নয়, তাঁর চোখে ছিলো স্বাধীন স্কটল্যান্ডের স্বপ্ন। স্কটল্যান্ড যদি স্বাধীন না-ই হয়, অন্তত সে যদি কোথাও উপনিবেশ স্থাপন করতে পারে, তাহ’লেও হয়। সেই স্বপ্ন ছিলো ব’লেই একদিন তিনি নিজের সব সম্বল দিয়ে মানোয়ারি জাহাজ ব্রিটানিয়া নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে বেরিয়ে পড়েছিলেন—কোনো নতুন দ্বীপ খুঁজে বার ক’রে সেখানে একটা উপনিবেশ স্থাপন করবার জন্যে। ছেলেমেয়েকে রেখে গিয়েছিলেন এক আত্মীয়ার কাছে—ইচ্ছে ছিলো, নতুন দ্বীপে বসবাসের ব্যবস্থা ক’রে ফিরে এসে একদিন তাদের সঙ্গে নিয়ে আবার পাড়ি জমাবেন। কিন্তু একদিন খবর এলো, ব্রিটানিয়া জাহাজের কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না।–হয় সে-জাহাজ ডুবে গিয়েছে, নয়তো এমন-কোনো দুর্বিপাকে পড়েছে যা মৃত্যুরই শামিল – কিংবা হয়তো পড়েছেন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর কোনো পরিস্থিতিতে। মেরির বয়েস তখন মাত্র চৌদ্দ, রবার্ট আরো ছোটো। এমন সময় সেই বৃদ্ধা আত্মীয়ও মারা গেলেন। তারপর থেকে ছোটোভাইটিকে সে সমস্ত দুঃখকষ্টের মধ্যেও আগলে রেখেছে, তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, তাকে মানুষ ক’রে তুলতে চেয়েছে। দু-বছর ধ’রে কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খোঁজ না-পেয়ে সে ধরেই নিয়েছিলো যে বাবা মারা গেছেন। এখন, কাগজে বিজ্ঞাপনটা প’ড়েই তার মধ্যে এক নতুন আশা জেগে উঠেছে। এক মুহূর্তও দেরি না-করে ছুটে এসেছে লর্ড গ্লেনারভনের কাছে। বাবা তাহ’লে মারা যাননি—নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন।

লেডি হেলেনা অবিশ্যি তাদের কাছে নিজের আশঙ্কার কথা খুলে বললেন না। প্রথমত, দু-বছর আগে সাহায্য চেয়ে এই বোতল জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কাপ্তেন গ্রান্ট যদি তখন দক্ষিণ আমেরিকার কোথাও ইন্ডিয়ানদের হাতে বন্দী হ’য়ে থাকেন, তাহ’লে এখনও বেঁচে আছেন কি না কে জানে। তাছাড়া তাঁরা তো এটা ঠিক ক’রে জানেন না কাপ্তেন গ্রান্ট সত্যি-বলতে কোথায় বন্দী হ’য়ে আছেন। অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার মধ্যে একটা তাঁরা জানেন, দ্রাঘিমারেখা যে কী, সেটার জন্যে তাঁদেরও তো অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হবে। তাছাড়া লর্ড এডওয়ার্ডের ফিরে আসতে দেরি দেখে এটাই ভয় হয় যে নৌদফতর ব্যাপারটাকে কোনো পাত্তাই দেয়নি। তারা হয়তো কোনো সাহায্য করতে চাইবে না।

ভাইবোনকে শুতে পাঠিয়ে দিয়ে লেডি হেলেনা মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় বলেছিলেন। মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের মনে হচ্ছিলো লেডি হেলেনার আশঙ্কা হয়তো অমূলক নয়—নৌদফতর হয়তো ঐ হারানো জাহাজের সন্ধানে কাউকেই পাঠাতে রাজি হবে না। কিন্তু মেরির দৃঢ়তায় তিনি প্রায় মুগ্ধই হ’য়ে গেলেন। এইটুকু মেয়ে একটুও ভেঙে পড়েনি—সব দুর্বিপাকের মধ্যেও ছোটোভাইটির দেখাশুনো ক’রে এসেছে। এটা মানতেই হয় যে মনের জোর আছে মেয়েটির। তবে সবসময়ে তো আর শুধু মনের জোরে হয় না, পরিস্থিতি যদি প্রতিকূল হয় তাহ’লে মনের জোর তখন হয়তো ভেঙে পড়তে দেয় না—শুধু প্রতীক্ষা করতে বলে কখন পরিস্থিতি অনুকূল হবে। এতদিন মেরি ধ’রে নিয়েছিলো যে তার বাবা বেঁচে নেই, সে নিজেই এক মনের জোরে সব দুর্বিপাকের মধ্যে ছোটোভাইটির দেখাশুনো করার দায়িত্ব পালন করছিলো। এখন সে বিজ্ঞাপন দেখে আশা ক’রে ছুটে এসেছিলো, এমনকী আজ লর্ড এডওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা না-হ’লেও এই আশা আছে যে কাল দেখা হবেই, কাল বাবার সব খবর জানতে পাবে—অথচ লর্ড এডওয়ার্ড সম্ভবত লণ্ডন থেকে কোনো আশার খবর নিয়েই ফিরবেন না। মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের সঙ্গে এই নিয়েই কথা বলছিলেন লেডি হেলেনা, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না এই অবস্থায় কী তাঁর করণীয়। তবে এটা অনুমান করতে দেরি হয় না যে যতদিন রবার্ট আর মেরি মেনে নিয়েছিলো যে কাপ্তেন গ্রান্টের ফিরে আসার কোনো আশাই নেই ততদিন অন্তত দুঃখকষ্ট মেনে নিয়েই একরকম চলছিলো, অভ্যস্ত হ’য়ে গিয়েছিলো তাতে, কিন্তু এখন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো একবার আশা জেগে উঠেই যদি মিলিয়ে যায় তখন হয়তো তাদের কচি মনে আশাভঙ্গের আঘাত আরো তীব্র হ’য়ে পড়বে।

যতটা আশা করে এসেছিলো, ততটা সম্ভবত আর ছিলো না ব’লেই মেরি নিশ্চয়ই সকালবেলায় একটু আড়ষ্ট ও সংকুচিত বোধ করছিলো; আর সেই অস্বস্তির জন্যেই, লেডি হেলেনা আর মেজর ম্যাকন্যাব্‌স তাদের যতই আপ্যায়ন করার চেষ্টা করুন না কেন, তারা একটু দূরে-দূরেই সরে থাকছিলো। সেইজন্যেই লর্ড এডওয়ার্ড যখন জুড়ি-গাড়ি চ’ড়ে স্টেশন থেকে চৌদুনে ঘোড়া হাঁকিয়ে ফিরে এলেন, মেরি আর রবার্ট তখন ছিলো বাগানে।

লর্ড এডওয়ার্ড কোনোদিকে না-তাকিয়ে হনহন ক’রে সটান চ’লে গেলেন লেডি হেলেনার কাছে। ইংরেজ সরকারের বানিয়া মনোভঙ্গিতে তিনি বিচলিত; আরো বিচলিত এই কথা ভেবে যে মুখে ‘গ্রেটব্রিটেন’

‘গ্রেটব্রিটেন’ ক’রে চ্যাঁচালেও ইংরেজরা সত্যি-সত্যি স্কটিশ, আইরিশ বা ওয়েল্সবাসীদের মানুষ ব’লেই যে মনে করে না, আরো-একবার হাতে-নাতে তার প্রমাণ পেয়ে গিয়েছেন তিনি লণ্ডনে। বিস্তর যুক্তি সাজিয়েও নৌদফতরের কর্তাদের তিনি এ-বিষয়ে আদৌ বোঝাতেই পারেননি, যে হারানো মানোয়ারি জাহাজ ব্রিটানিয়ার সন্ধানে বেরিয়ে-পড়া তাঁদের আশু কর্তব্য

তাঁর মুখচোখের ভাব দেখেই লেডি হেলেনার বুঝতে মোটেই দেরি হয়নি যে লর্ড এডওয়ার্ডের লণ্ডনসফর সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে—শুধু তা-ই নয়, কি-রকম যেন অপমানিতও বোধ করেছেন লর্ড এডওয়ার্ড। গ্লেনারভন যখন উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘খামকাই গিয়েছিলুম নৌ-দফতরে—কোনো কাজই হয়নি,’ লেডি হেলেনা তখন আদৌ বিস্মিত হননি। বরং এই আশঙ্কা নিয়েই যে কাল রাতে মেজর ম্যাকন্যাব্‌স আর তিনি বলাবলি করেছিলেন, এ-কথা তাঁর মনে প’ড়ে গেলো।

তাদের মতে ব্রিটানিয়ার সন্ধানে বেরুনোটা হবে বুনোহাঁসের পেছনে ছোটা,’ আগের কথার জের ধরেই বললে লর্ড এডওয়ার্ড।

এদিকে জুড়িগাড়ি এসে থেমেছে, গটগট ক’রে একজন সে-গাড়ি থেকে নেমে লিভিংরুমের দিকে চ’লে গেছেন, তাঁকে দেখেই অনুচর-পরিচরেরা সেলাম ঠুকেছে—এইসব লক্ষ ক’রে মেরি আর রবার্ট বুঝতে পেরেছিলো যে ইনিই লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভন। তারাও, তাই, তাঁর পেছন পেছন লিভিংরুমে চ’লে এসেছিলো। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে তারা শুনতে পেলে লর্ড এডওয়ার্ড বলছেন : ‘হাজারটা ফ্যাকড়া, হাজারটা ওজর, হাজারটা আপত্তি সরকারের। দু-বছর আগে যে-জাহাজ ডুবেছে —

‘ডুবেছে ব’লে আমরা এখনও সঠিক জানি না,’ লেডি হেলেনা বললেন, ‘বরং বলতে পারি দু-বছর আগে সে নিরুদ্দেশ হ’য়ে গেছে—’

‘হ্যাঁ, আমিও তা-ই বলতে চেষ্টা করেছিলুম। কিন্তু তাদের বক্তব্য : ডুবুক বা হারিয়ে যাক—দু-বছর আগে যা ঘটেছে, এতদিন পরে কেউ খামকা এত টাকা খরচ করে তার সন্ধানে যায়! তাছাড়া তাদের মতে ঐ তিনটে পার্চমেন্টই অসম্পূর্ণ—পুরো হদিশ কোনো পার্চমেন্টেই দেয়া নেই। কিন্তু, আসল কথা কি জানো, মাত্র তিনজনের জন্যে—সে তিনজনও তো পুরোমানুষ নয়, নেহাৎই স্কট—একটা আস্ত গোটা জাহাজ তারা কিছুতেই পাঠাবে না। এরা যে শুধু বানিয়া, শুধু মুনাফাই দ্যাখে—তা নয়—এরা নিজেদের ছাড়া আর-কাউকেই ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না।’

লর্ড এডওয়ার্ড রাগের স্বরে তেড়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সরকারের ফয়সালা শুনে তক্ষুনি মেরি আর রবার্ট নিজেদের আর সামলে রাখতে না-পেরে অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ ক’রে উঠেছে : ‘বাবা! বাবা!’ যেন দ্বিতীয়বার মৃত্যু হয়েছে কাপ্তেন গ্রান্টের।

লর্ড এডওয়ার্ড এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে খেয়ালই করেননি কখন এই দুটি অচেনা কিশোর-কিশোরী এসে তাঁর কথা শুনতে লেগেছে। হঠাৎ এই অস্ফুট আর্তনাদ শুনে অবাক হয়ে তিনি জিগেস করলেন, ‘এরা কে?’ তারপর সরাসরি তাদেরই তিনি জিগেস করলেন : ‘বাবা! কে তোমাদের বাবা?’

এবার লেডি হেলেনা সব কথা বুঝিয়ে দিলেন তাঁর স্বামীকে। যেমন ক’রে কাপ্তেন গ্রান্টের এই ছেলেমেয়ে দুটি খবরকাগজে বিজ্ঞাপন প’ড়ে তক্ষুনি, তড়িঘড়ি, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চ’লে এসেছে, বিজ্ঞাপনের বয়ান থেকে কতটা আশা তাদের মধ্যে জেগে উঠেছিলো নতুন ক’রে, ভেবেছিলো অবশেষে বুঝি সত্যি হদিশ মিলেছে কাপ্তেন গ্রান্টের—আর এখন তারা তাঁর প্রতিবেদন শুনে কতটাই মর্মাহত হ’য়ে পড়েছে! ‘এড, এরা তোমার বিজ্ঞাপন প’ড়েই কাল এখানে চ’লে এসেছে। বলো, এখন এদের কী বলবে?’

কিছুই বলার নেই, হেলেনা। এতক্ষণ তো সে-কথাই বলছিলুম। নৌদফতর কিছুতেই একজন হারিয়ে-যাওয়া স্কটের উদ্দেশে কোনো জাহাজ পাঠাবে না—’

মেরির আত্মাভিমান প্রখর। এই কচি বয়সেই নানা দুর্বিপাকের মধ্যে পড়েও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়েছে তাকে, দেখাশুনো করতে হয়েছে ছোটোভাইটির, অভিভাবকহীন অবস্থাতেও সে কোনোদিন দোরে দোরে সাহায্য করে বেড়ায়নি। এখন পুরো ব্যাপারটা শুনে ইংরেজ সরকারের হৃদয়হীনতা সম্বন্ধে সে যতটাই রেগে যাক, মুখে সে-কথা প্রকাশ না-করে শুধু বললে : ‘তাহ’লে আমরা চলি। বাবার খবর যতটুকু পাওয়া গেছে, সেটাই অনেক। অ্যাদ্দিন বাদে অন্তত নতুন ক’রে একটা সম্ভবনা জেগেছে যে তিনি বেঁচে আছেন। হয়তো একদিন নিজেই কোনো উপায় ক’রে ফিরে আসবেন।’ এই ব’লে রবার্টের হাত ধরে সে চ’লে যাবার জন্য পা বাড়ালে, বললে, ‘চল, রবার্ট, মিথ্যে মনখারাপ করিসনে। উপায় একটা বার করবোই।’

লেডি হেলেনা কাল রাত থেকেই এই অনাথ ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন। এবার একটু শঙ্কিতই হলেন তিনি, বিচলিত হ’য়ে এরা যদি ভয়ংকর-কিছু ক’রে বসে! তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা আবার এক্ষুনি কোথায় যাবে?’

দাঁতে দাঁত চেপে মেরি বললে : ‘শেষ ভরসা একজনই। যে-ক’রেই হোক মহারানীর কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলবো। যদি কোনোভাবে তাঁর মনে দয়া জাগাতে পারি তাহ’লে হয়তো তিনি কোনো-একটা ব্যবস্থা ক’রে দেবেন।’

অন্যরা যা জানতো, তা মেরিও জানতো। এত সহজে রানীর দেখা পাওয়া যায় না। এতগুলো বাধা আসবে আমলা বা অনুচরদের কাছ থেকে যে কোনোদিনই হয়তো রানীর কাছে গিয়ে পৌঁছুনোই যাবে না। কোনো উটকো যে-সে লোককে রানীর সঙ্গে দেখা করতে দেয়াই হয় না।

‘মেরি, শোনো, যেয়ো না,’ লেডি হেলেনার গলার স্বর পালটে গিয়েছে। ‘এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার কিছু হয়নি। রানীর বদলে আমরা নিজেরাই হয়তো কোনো-একটা ব্যবস্থা করতে পারবো।’ তারপর লর্ড এডওয়ার্ডের দিকে ফিরে বললেন : ‘এডওয়ার্ড, ইংরেজরা যদি আমাদের মানুষ ব’লেই মনে না-করে, আমরা তবে খামকা তাদের কৃপার জন্যে অপেক্ষা করবো কেন। তুমি তো ডানকান জাহাজ বানিয়েছো আমাদের প্রমোদভ্রমণের জন্যে। মজবুত, আধুনিক জাহাজ, বাষ্পে চলে। কিন্তু প্রমোদভ্রমণ তো আর অকারণে যেখানে-সেখানে ভেসে-যাওয়া নয়, জাহাজ যদি জলে ভাসানো হয় তাহ’লে তার একটা গন্তব্য থাকে। পৃথিবীর সেরা দৌড়বীরের চাইতেও সেই লোকটাই দৌড়ের বাজিতে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়েছিলো যে ম্যারাথনে দৌড়েছিলো—কেননা তার দৌড়টা নিছক দৌড় ছিলো না, ছিলো তার দেশকে বাঁচাবার উপায়। আমাদের প্রমোদভ্রমণও সার্থক হবে যদি তার সামনে একটা লক্ষ্য থাকে, একটা উদ্দেশ্য থাকে।’

তুমি কি বলতে চাচ্ছো, হেলেনা? আমি যা মনে-মনে ভেবেছি তা-ই কি তোমারও মনের কথা?’ লর্ড এডওয়ার্ড প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ, এডওয়ার্ড। আমি সত্যিকার সুখী হবো, সত্যিকার আনন্দ পাবো যদি আমাদের প্রমোদভ্রমণ শেষপর্যন্ত আর নিছক-প্রমোদভ্রমণ না-থাকে। আমরা তো এই উপলক্ষে ডানকান নিয়ে কাপ্তেন গ্রান্টের খোঁজেই বেরিয়ে পড়তে পারি—সাগরপাড়ি যদি দিতেই হয়, তবে সামনে এই লক্ষ্যটা রাখলেই হয়। দরকার হ’লে সাতসমুদ্র তেরোনদী পাড়ি দিয়েই না-হয় আমরা কাপ্তেন গ্রান্টকে খুঁজে বার ক’রে নিয়ে আসবো।’

লর্ড এডওয়ার্ড আনন্দে যেন ফেটেই পড়বেন। ‘জানো, হেলেনা, লণ্ডনে ব’সে ব’সে আমিও ঠিক এই কথাই ভেবেছিলুম। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারিনি তোমাকে একা ফেলে রেখে এত দূর পথ পাড়ি দেয়া ঠিক হবে কি না। তুমিও যে আমার সঙ্গে যেতে চাইবে, সেটা মোটেই ভাবিনি। জাহাজ যত আধুনিক‍ই হোক বা মজবুতই হোক, দিনের পর দিন অজানা সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মধ্যে ধকলও আছে, আবার একঘেয়েমিও আছে। দিনের পর দিন চারপাশে জল দেখতে সকলের সমান ভালো লাগে না কি না!’

মেরি আর রবার্ট গিয়ে ততক্ষণে লেডি হেলেনাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমরাও সঙ্গে যাবো,’ একসঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠেছে তারা, ‘আপনারা যদি বাবার খোঁজে জাহাজ নিয়ে দূর সাগরে পাড়ি জমান, তাহ’লে আমরাও সঙ্গে যাবো—’

‘নিশ্চয়ই যাবে,’ লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘ডানকানে বিস্তর জায়গা আছে। তাছাড়া হেলেনারও ভালো লাগবে তোমাদের সঙ্গী পেলে—অন্তত একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচবে।’

লেডি হেলেনাও সায় দিলেন : ‘তাছাড়া তাড়াটা তো তোমাদেরই বেশি। তোমরা সারাক্ষণ ব’সে-ব’সে অদ্ভুত সব কথা ভাববে, ভাববে ডানকান জাহাজের কী হ’লো, বাবার দেখা পেলো কিনা—তার চাইতে সঙ্গেই চলো, একই সঙ্গে আমরা খুঁজে দেখবো কাপ্তেন গ্রান্ট এখন কোথায় আছেন।’

‘তোমাদের কোনো অসুবিধেই হবে না। ডানকান নেহাৎ ছোটো জাহাজ নয়—দুশো দশ টনের জাহাজ। এর চাইতেও ছোটো ছোটো শাবেক আমলের জাহাজ নিয়ে ক্রিস্তোবাল কোলোন সম্পূর্ণ অজানা সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন—কোথায় যাবেন, জানতেনই না। আমাদের তো তবু খানিকটা আন্দাজ আছে—অন্তত এটা তো জানি কত অক্ষরেখায় যেতে হবে।’

৪. পাড়ি

একবার যখন ঠিক হ’য়ে গেছে যে ডানকান জাহাজই ব্রিটানিয়া আর কাপ্তেন গ্রান্টের সন্ধানে দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্রে পাড়ি দেবে, তখন আর একমুহূর্তও তর সইছিলো না কারু। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সকে ডেকে অভিযানের কথা বলতেই তিনি তো একপায়ে খাড়া; সমুদ্র যারা ভালোবাসে, ডাঙায় থাকতে তাদের যে আদপেই ভালো লাগে না, সারাক্ষণ যে তারা উশখুশ করে কবে আবার জলে ভাসতে পারবে, কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সই তার সশরীর প্রমাণ। এখানে অবশ্য আরো-একটা কথা আছে। ইংরেজদের নৌদফতরকে হাতে-নাতে দেখিয়ে দিতে হবে তাদের সাহায্য ছাড়াই কেউ দূর সমুদ্রে পাড়ি জমাতে পারে—শুধু তা-ই নয়, কোনো দায়িত্ব নিয়ে বেরুলে স্কটরা ছিনেজোঁকের মতো লেগে থেকে সে-দায়িত্ব পালনও করতে পারে। অন্তত লর্ড গ্লেনারভনের জেদও যে কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিলো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর তাছাড়া আছে মেরি আর রবার্ট—আর-কিছুর জন্যেও যদি না-হয় অন্তত তাদের কথা ভেবেও চট করে অভিযানে বেরিয়ে-পড়া উচিত।

কিন্তু এত-বড়ো একটা অভিযানে বেরুতে গেলে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তো আর হুট করে রওনা হওয়া যায় না। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সের ওপরেই ভার পড়লো ডানকানকে গ্লাসগোর বন্দরে নিয়ে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে অভিযানের জন্যে যা-যা করা দরকার সবকিছুই নিজে তদারক করে করবার।

এটা ঠিক যে ডানকান বাষ্পে চলে। কিন্তু ফোরকালের সামনে বড়ো মাস্তুলটার ডগায় পাল খাটাবারও ব্যবস্থা আছে—সে কিন্তু নিছকই বিকল্প ব্যবস্থা হিশেবে নয়; হাওয়া যদি তোড়ে বয়, অনুকূল থাকে, তাহ’লে ডানকান পালতোলা জাহাজ হিশেবেই চলবে, আর অন্য সময় তো আছেই তার ১৬০ অশ্বশক্তির এনজিন। পুরোনোদিনের পালের জাহাজের সঙ্গে তার এখানেই তফাৎ—তাকে সবসময় অনুকূল হাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে না। অন্য সময় সে বাষ্পের জোরেই ঘন্টায় সতেরো সামুদ্রিক মাইল হিশেবে চলতে পারবে। কিন্তু সেই বাষ্প তৈরি করবার জন্য চাই কয়লা, বিস্তর কয়লা–আর এই দূরপাল্লার পাড়িতে সঙ্গে যতটা সম্ভব কয়লা নিয়ে-যাওয়াই ভালো, না হ’লে মাঝপথে হঠাৎ কয়লার দরকার হ’লে সব জায়গায় তো তা নাও মিলতে পারে। অপর্যাপ্ত রসদও চাই সঙ্গে, যাতে পথে খাবারের অভাবে ভুগতে না হয়। তারপর জাহাজের সামনে আত্মরক্ষার খাতিরে একটা কামানও বসাতে হবে—পথে জলদস্যুদের পাল্লায় পড়লে যাতে সামলানো যায়।

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স প্রায় যেন জলে-জলেই মানুষ, কিন্তু সে তো সাধারণ খালাশিও। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে জানেন, উদ্ভাবনীশক্তি আছে, আছে অফুরন্ত আর অদম্য প্রাণশক্তি আর সাহস, উপস্থিতবুদ্ধির জোরে কোনো মুশকিলে পড়লে সেটা কাটান দেবার ক্ষমতা রাখেন। ম্যালকম কালেই তিনি মানুষ হয়েছেন, গ্লেনারভনদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই নৌবিদ্যায় তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিলো, এখন তিনি অভিজ্ঞতার জোরে বলীয়ান হ’য়ে উঠেছেন। আর তাঁরই সুযোগ্য সহযোগী টম অস্টিন—দক্ষ ও কুশলী নাবিক, কালে তিনিও কোনো জাহাজের পরিচালনভার নিজের হাতে পাবেন। আর তাঁরা দুজনে মিলেই গ্লাসগোর ডকইয়ার্ড থেকে বাছাই ক’রে ক’রে আরো পঁচিশজন মাল্লাকে ডানকান জাহাজে কাজ দিয়েছেন। দক্ষতা আর পরিশ্রমের ক্ষমতা ছাড়া তাদের সকলেরই আরো একটা পরিচয় আছে—তারা সবাই ডামবারটনের মানুষ, গ্লেনারভনদের প্রতি তাদের আনুগত্য অসীম।

প্রমোদভ্রমণের উপযোগী ক’রে আগেই ভালো ক’রে সবচেয়ে-বড়ো ক্যাবিনটা সাজানো হয়েছিলো, কিন্তু তখন তো আর জানা ছিলো না তাঁদের এত দীর্ঘ কোনো অভিযানে বেরুতে হবে। তাই এখন তাঁদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজরে রেখে দীর্ঘদিনের উপযোগী ক’রেই সাজানো হলো মাস্টার-ক্যাবিন—সত্যি-বলতে বিয়ের পর এই-প্রথম লর্ড এডওয়ার্ড তাঁর নবপরিণীতা পত্নী লেডি হেলেনাকে নিয়ে দূর সমুদ্রে পাড়ি জমাবেন—এ তো আর ডানকান জাহাজের নিছক কোনো মহড়া নয় কাছেপিঠের সমুদ্রে। তাছাড়া রবার্ট যে কতটা চৌকশ ছেলে সে তো আর গোড়ায় বোঝা যায়নি, কিন্তু পাড়ি জমাবার আগেই দেখা গেলো কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের সঙ্গে তার ভারি খাতির হয়ে গিয়েছে, ছায়ার মতো সে কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের পেছন-পেছন থাকে; সে-যে কাপ্তেন গ্রান্টের ছেলে, গোড়ায় এটাই ছিলো তার প্রতি কানে ম্যাঙ্গসের অতিরিক্ত একটা আকর্ষণের কারণ, কিন্তু পরে দেখা গেলো এই অভিযানে শেষপর্যন্ত রবার্টেরও সমুদ্রে হাতেখড়ি হবে, তারও রক্তে তার বাবার মতোই অ্যাডভেনচারের নেশা আছে যেন।

এরা ছাড়া সঙ্গে যাবেন মেজর ম্যাক মাসও। বছর পঞ্চাশ বয়স, এমনিতে স্বল্পবাক্ কিন্তু কৌতুকবোধ প্রখর, অনেক অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া মানুষ মেজর, জানেন, যে বিপদের সময় অহেতুক উত্তেজনা বরং ক্ষতিই করে—তখনই বরং মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। লর্ড এডওয়ার্ডের সঙ্গে রক্তের সম্বন্ধ আছে, কিন্তু শুধু সেইজন্যেই নয়, অ্যাডভেনচারের সম্ভাবনা দেখেই তিনি ডানকান জাহাজে এসে উঠেছেন—তাছাড়া মেরি আর রবার্টের প্রতি তাঁর কেমন একটা মায়াও জ’ন্মে গিয়েছিলো। এই দুর্ধর্ষ অকুতোভয় মানুষটার মধ্যে ভেতরে কোথাও যে স্নেহের একটা অফুরন্ত প্রস্রবণ ছিলো, এটা তারও একটা প্রমাণ—যদিও তিনি নিজে সে-কথা ঠিক জানেন না—তিনি ভেবেছেন ডানকানের লম্বা পাড়িতে তিনি যোগ দেবেন নিছক একঘেয়েমির হাত থেকে রেহাই পেতে।

এমনিতে হয়তো কোন জাহাজ এলো, কোন জাহাজ গেলো—তাতে লোকের কিছুই এসে-যেতো না। কিন্তু ডানকান যে-উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে চাচ্ছে লোকের মুখে-মুখেই সে-কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। আর তাই যখন ২৫শে আগস্ট ০ ঘন্টায়, অর্থাৎ ২৪ আর ২৫-এর মাঝরাত্রে, ঠিক বারোটার সময়, জাহাজ ছাড়লো, গ্লাসগোর লোক ঝেঁটিয়ে এসেছিলো জাহাজ দেখতে। চোঙ দিয়ে ভলকে ভলকে ধোঁয়া উঠলো, ঝগঝগ আওয়াজ উঠলো এনজিনে, চাকাগুলো পাক খেলো, আর ডানকান বন্দর থেকে নোঙর তুললো। সকাল ছটার মধ্যেই জাহাজ গিয়ে পড়লো বারদরিয়ায়। ডানকানের লম্বা পাড়ি শুরু হ’য়ে গেলো, কতদিনের জন্যে কে জানে।

৫. ভ্রান্তিবিলাস ও অন্যমনস্ক অধ্যাপক

ডানকান যখন ছেড়েছিলো, সবাই ভেবেছিলো এখানে স্কটল্যান্ডের কাছে সমুদ্র নিন্তরঙ্গ থাকবে, আচমকা এখন ঝড়বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। ঝড়তুফান হয়তো সত্যিই ওঠেনি, কিন্তু হাওয়া ছিলো প্রখর, সমুদ্র ছিলো ক্ষুব্ধ ও চঞ্চল, আর সমুদ্রযাত্রায় ততটা অভ্যস্ত নন ব’লেই প্রথম দিনে মেরি বা লেডি হেলেনা কেউই নিজেদের ক্যাবিন থেকে বেরোননি। দ্বিতীয় দিনে যখন হাওয়ার তোড় কমলো, সমুদ্র শান্ত হ’য়ে এলো, ঢেউয়ের দোলাও ক’মে এলো। সমুদ্র শান্ত হ’য়ে যেতেই যাত্রীরা ডেকে এসে জড়ো হলেন; ঠিক যেন পুব দিগন্তে সমুদ্রের মধ্য থেকেই উঠে এলো সূর্য, আকাশের গায়ে একটা লালের ছোপ, আর সেখান থেকে রৌদ্রের ছটা বেরিয়ে আসছে, ডানকানের শাদা পালে এসে পড়েছে রোদ্দুর। স্নিগ্ধ একটা হাওয়া দিচ্ছে।

কারুই যেন আর তর সইছিলো না। চট ক’রে যদি গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যেতো, তাহ’লেই যেন খুশি হ’তো সবাই। কিন্তু ইওরোপ থেকে তাঁদের যেতে হবে দক্ষিণ আমেরিকায়, নতুন মহাদেশের তটে–১৪৯২ সালে ক্রিস্তোবাল কোলোন (বা ক্রিস্তোফোরো কোলোম্বো বা ক্রিস্টফার কলম্বাস) খুব-তো আর চট ক’রে যেতে পারেননি নতুন মহাদেশে। তাঁদের হয়তো অত সময় লাগবে না, কিন্তু এ তো আর ইওরোপের এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে যাওয়া নয়।

লেডি হেলেনা যেন স্পষ্ট ক’রে মেরির জিজ্ঞাসাটাকেই উচ্চারণ করলেন : ‘আমাদের গিয়ে পৌঁছুতে কত সময় লাগবে, এড?’

‘ম্যাঙ্গল্‌স, আমরা কত জোরে যাচ্ছি বলো তো?’

‘ঘন্টায় সতেরো সামুদ্রিক মাইল। যদি চলার এই গতি বজায় থাকে, তাহ’লে আমরা পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই কেপ হর্ন পৌঁছে যাব।’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স জানালেন।

‘কেপ হর্ন? ভারি অদ্ভুত নাম তো?’

‘কেপ হর্ন আসলে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম বিন্দু। ৫৫°৫৯ দক্ষিণ। তিয়েরা দেল ফুয়েগো হর্ন আইল্যান্ডেরই অংশ, মূল ডাঙা হচ্ছে দক্ষিণ চিলে,’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স জানালেন, ‘শিঙের মতো দেখতে ব’লেই অন্তরীপটার নাম কেপ হর্ন। সেখানে পৌঁছুবার পরই খোঁজখবর নিয়ে আমাদের পরবর্তী সূচি তৈরি করতে হবে।

পাতাগোনিয়া যেতে হ’লে ঐ দক্ষিণতম বিন্দু পেরুতেই হবে ডানকানকে।

‘পাঁচ সপ্তাহ অবশ্য খুব বেশি নয়—দেখতে-না-দেখতেই এই দিনগুলো কেটে যাবে।’ লর্ড এডওয়ার্ড ঘুরে মেরির দিকে তাকিয়ে জিগেস করলেন, ‘মিস গ্রান্ট, ডানকান জাহাজকে কেমন লাগছে?’

ডানকান যদি তাকে আর রবার্টকে না-নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়তো, তাহ’লে মেরির তা মোটেই ভালো লাগতো না। এখন তার মনে হচ্ছে কাপ্তেন গ্রান্টের সন্ধানে যে-অভিযান রওনা হয়েছে, তাতে তারও মস্ত একটা ভূমিকা আছে। সে উদ্ভাসিত মুখে বললে ‘দারুণ! চমৎকার!’

‘রবার্টের কী খবর?’ জিগেস করলেন লর্ড এডওয়ার্ড। ‘কই? তাকে তো দেখছি না?’

মেরি কিছু বলবার আগেই কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স হেসে বললেন, ‘রবার্ট তো আমার প্রধান সহকারী হ’য়ে উঠেছে। এই হয়তো সে আছে এনজিনের সামনে, পরক্ষণেই ফোরকল-এ বা মাস্তুলের ডগায়। ঐ তো, তাকিয়ে দেখুন না বড়ো মাস্তুলটার দিকে।’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের কথা শুনে সবাই মাস্তুলটার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, মাস্তুলের ওপরে উঠে রবার্ট দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখেই, মেরির বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। কী ডাকাবুকো ছেলেই না হয়েছে সে, প্রাণে একটুও ভয়ডর নেই। জাহাজে উঠতে পেরে সে যেন ফুর্তিতে ডগমগ করছে। কিন্তু মেরি আঁৎকে উঠে বললেন, ‘কী সর্বনাশ! প’ড়ে যাবে যে!’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স কিন্তু তখনও হাসছেন। বললেন, ‘মিথ্যে ভয় পাবেন না, মিস গ্রান্ট। দু-দিনেই আপনার ভাইকে ওস্তাদ নাবিক বানিয়ে দেবো–দেখে এমনকী কাপ্তেন গ্রান্টেরও তাক লেগে যাবে।’

‘কিন্তু ওভাবে অকারণে–’

‘সে-ই তো ভালো। জাহাজ যখন দুলছে না তখনই তো তরতর ক’রে ওপরে ওঠা-নামা অভ্যাস করতে হবে, যাতে পরে দরকারের সময় আচমকা এ-কাজ করতে গিয়ে ভয় না-পায় বা গুবলেট ক’রে না-ফ্যালে। দেখবেন মিস গ্রান্ট, আপনার বাবা বরং তার এইসব ওস্তাদি দেখে তারিফই করবেন।’

‘আপনি যদি বলেন,’ মেরির গলা থেকে শঙ্কার ভাব তখনও দূর হয়নি। আপনার ওপরই কিন্তু ওর ভার রইলো!’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স আবার আশ্বস্ত করবার চেষ্ট করলেন মেরিকে। ‘কিচ্ছু ভাববেন না, মিস গ্রান্ট। আমি সবসময় ওর ওপর কড়া নজর রাখবো।’

লর্ড এডওয়ার্ড প্রসঙ্গটা পালটাবার জন্যে বললেন, ‘ম্যাঙ্গল্‌স, আমি বরং এই ফাঁকে এঁদের জাহাজটা ভালো ক’রে দেখিয়ে আনি। তুমি ততক্ষণে স্টুয়ার্ডকে বলো আমাদের ছোটোহাজরির ব্যবস্থা করতে।’

মেজর ম্যাকন্যাব্‌স ডেকের একপাশে রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে সিগার টানছিলেন। একদিন নতুন মহাদেশ থেকেই তামাক এসেছিলো, আর এখন ইওরোপের অজস্র লোকই এই চুরুট খাবার নেশায় আটকে গিয়েছে। তাঁর মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই নেই। সম্ভবত মেজর ম্যাকন্যাব্‌স সকালবেলায় ছোটোহাজরির আগে কোনো বিষয় নিয়েই অস্থির হন না। কোনো লড়াইয়ের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি কী করেন, এ নিয়ে লর্ড এডওয়ার্ড অনেক সময়েই ভাবতেন। মেজর ম্যাকন্যাব্‌স এর আগেই সারা জাহাজ ঘুরে দেখেছেন, ফলে ডানকান জাহাজ ঘুরে দেখবার জন্যে তাঁর কোনো কৌতূহল ছিলো না। লর্ড গ্লেনারভন অন্যদের নিয়ে জাহাজের অন্যদিকে চ’লে গেলেন। মেজর ম্যাকন্যাব্‌স একা-একা দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে-ভাবতে আনমনে দিগন্তের দিকে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ কাছেই কার পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দ্যাখেন অচেনা এক ভদ্রলোক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স, তাঁর সহকারীরা, জাহাজে কাজ করতে এসেছে যে-সব মাঝিমাল্লা, তাদের প্রায় সবাইকেই মেজর ম্যাকন্যাব্‌স চেনেন। এটা ঠিক যে নতুন অনেককেই অভিযানের আগে ডানকান জাহাজে নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এই অচেনা ভদ্রলোক যে তাদের কেউ নয়, সে তাঁর চেহারা বা পোশাক-আশাক দেখেই বোঝা যায়। খালাশির পোশাক পরা নেই তাঁর, তাছাড়া খুব হট্টাকট্টা গাট্টাগোট্টা পোড়খাওয়া লোকও নন তিনি। বরং ঢ্যাঙা রোগামতো এই ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় একটা সরু লম্বা পেরেকের ডগায় কেউ মস্ত-একটা মাথা গেঁথে দিয়েছে। মাথার সামনের দিকে চুল পাতলা হ’য়ে এসেছে, ছুঁচলো চিবুক, চোখে পুরু পরকলার চশমা। ভদ্রলোক এখনও যেন ঘুমের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি, ঝকঝকে দিনের আলোয় চোখ কুঁচকে আলোটা যেন চোখে সইয়ে নেবার চেষ্টা করছেন। চোখমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। আর কেমন-একটা কৌতুকের ছোপ। মাথায় কানঢাকা টুপি, হলদে রঙের বুটজুতো পায়ে, কোমরে সেই রঙের চামড়ারই বেল্ট, গায়ে খয়েরি রঙের মখমলের জ্যাকেট, ট্রাউজার জোড়ার রঙও তা-ই—পকেটগুলোয় রাশি-রাশি কাগজপত্তর, যেন একটা আস্ত টেবিলের সব জিনিশপত্র কোট-প্যান্টের পকেটে এসে আশ্রয় নিয়েছে। গলা থেকে ঝুলছে একটা টেলিস্কোপ। ভদ্রলোক মেজরকে ঘিরে ধুপধাপ আওয়াজ করে একবার পাক খেয়ে নিলেন; এঁরই এই ধুপধাপ শব্দে মেজরের তন্ময়তা ভেঙেছিলো।

মেজর ম্যাকন্যাব্‌স একটু অবাক হ’লেও কোনো কথাই বললেন না–বা তাঁর চোখমুখে বিস্ময়ের কোনো ছাপ দেখা দিলো না। অথচ এমনিতে তাঁর বিস্মিত হবারই কথা ছিলো। তিনি যতদূর জানতেন তাতে তাঁরা কয়েকজন ও মাঝিমাল্লারা ছাড়া ডানকান জাহাজে আর-কোনো যাত্রীরই যাবার কথা নয়। তবু মেজর ম্যাকন্যাব্‌স মুখ ফুটে এই অচেনা যাত্রীটির কোনো পরিচয়ই জানতে চাইলেন না। এই ঢ্যাঙা ভদ্রলোকটি কিন্তু জিজ্ঞাসু চোখে হাজারো কৌতূহল নিয়েই মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

মেজর ম্যাকন্যাব্‌স তাঁকে নিজে থেকে কোনো সম্ভাষণ করলেন না দেখে এই অচেনা আগন্তুকটি টেলিস্কোপ্ টেনে লম্বা ক’রে দিগন্তের দিকে তাকালেন। তারপর টেলিস্কোপটা একটা ছড়ির মতো রেখে তাতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে ভদ্রলোক টাল সামলাতে না-পেরে প’ড়ে গেলেন। কারণ টেলিস্কোপ তাঁর ভারে ততক্ষণে খোপের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। তাঁর কাণ্ড দেখে কেউ হয়তো এতক্ষণে হেসে ফেলতো, কিন্তু মেজর ম্যাকন্যাব্‌স তবু গায়ে প’ড়ে ভদ্রলোক সম্বন্ধে কোনো কৌতূহলই প্রকাশ করলেন না।

ঢ্যাঙা ভদ্রলোক উঠে প’ড়ে জ্যাকেটটা থেকে ধুলো ঝেড়ে টেলিস্কোপটা ফের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে নবাবিচালে হাঁক পাড়লেন। ‘স্টুয়ার্ড! স্টুয়ার্ড!’

ঠিক সেই সময়েই কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের নির্দেশ অনুযায়ী স্টুয়ার্ড অলবিনেট সকলের ছোটোহাজরির ব্যবস্থা করতে ডাইনিংরুমে যাচ্ছিলো। হঠাৎ এমন হাঁক শুনে একটু থতমত খেয়ে ভদ্রলোকের সামনে এসে বললে : ‘আপনি কি আমায় কিছু বলছেন?’

‘আপনিই কি স্টুয়ার্ড?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি?’

আমি ছ-নম্বর ক্যাবিনের যাত্রী।’

‘ছ-নম্বর ক্যাবিন!’ স্টুয়ার্ড অলবিনেট এবার সত্যি হতভম্ব হ’য়ে পড়লো। ডানকান তো কোনো যাত্রীবাহী জাহাজ নয়, তাতে আবার ছ-নম্বর ক্যাবিন ব’লে কী আছে?

‘হ্যাঁ। তা মঁসিয় স্টুয়ার্ড, আপনার নামটা আমি জানতে পারি? আমার আবার সারাক্ষণ ‘স্টুয়ার্ড-স্টুয়ার্ড’ ক’রে চ্যাঁচাতে ভালো লাগে না।’

‘অলবিনেট।’ অলবিনেট তখন সত্যি বুঝে উঠতে পারছিলো না কী বলবে। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স তাকে কখনও এই যাত্রীটির কথা বলেননি।

‘তা মঁসিয় অলবিনেট, প্রায় দু-দিন আমার পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। পারী থেকে গ্লাসগো অব্দি প্রায় ছুটেই এসেছি একটানা। চ্যানেল পেরুতে হ’লো—ক্যালে থেকে ডোভার, তারপর এখানে গ্লাসগোতে। তা ছোটোহাজরি হবে কখন?’

অলবিনেট ততক্ষণে তার হতচকিত দশা থেকে বেরুবার চেষ্টা করছে। বললে, ‘নটার সময়, ডাইনিংরুমে।’

ভদ্রলোক তাঁর অগুনতি পকেট হাতড়াতে-হাৎড়াতে শেষে কোন-এক পকেট থেকে একটা ঘড়ি বার করে এনে অতীব মনোযোগ সহকারে সময়টা দেখলেন। ‘সবে তো দেখছি আটটা বাজে! আরো-একটি ঘন্টা! তাহ’লে আমার ক্যাবিনে কিছু পানীয় আর খুচরো কিছু বিস্কুট পাঠিয়ে দেবেন। খিদেয় আমার জঠর এখন চিঁ-চিঁ করছে। হ্যাঁ, আর, ভালো কথা—কাপ্তেন কোথায় এখন? কিংবা ফার্স্টমেট? জাহাজ তো দেখছি চমৎকার চলেছে, পালে খোলা হাওয়া লাগিয়ে তোফা পাড়ি জমিয়েছে।’

স্টুয়ার্ড ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না এই অচেনা অভ্যাগতটিকে নিয়ে সে কী করবে। আর তখনই কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সকে এদিকটায় আসতে দেখে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলে। তার জানা নেই এই যাত্রীমহোদয় সত্যি কে কাপ্তেন নিশ্চয়ই জানেন। তাই সে পরিচয় করিয়ে দিলে ‘ইনিই কাপ্তেন – ‘

‘কাপ্তেন? কাপ্তেন বার্টন, শেষ অব্দি তাহলে সাক্ষাৎ হ’লো আপনার সঙ্গে? চমৎকার। আপনার সঙ্গে আলাপ ক’রে ভারি খুশি হয়েছি—’ ব’লে হাতঝাঁকুনির জন্যে অচেনা যাত্রীটি হাত বাড়িয়ে দিলেন।

বার্টন? নিজের পিতৃদত্ত দীক্ষান্ত নামটিকে এভাবে আদ্যন্ত বদলে যেতে দেখে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বেশ হকচকিয়েই গেলেন। অচেনা যাত্রীটি ততক্ষণে তাঁর হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছেন, ‘নানান গোলেমালে পরশু তো দেখাই হ’লো না। অবশেষে আজ সকালেই একেবারে মুখোমুখি দেখা হ’য়ে গেলো। খুব ভালো লাগছে আমার। তা, কেমন লাগছে এই. এস. এস. স্কটিয়া জাহাজটাকে?’

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স আরো ভড়কে গিয়ে, যেন বিষম খেয়েই স্টুয়ার্ডের দিকে একবার তাকালেন। তারপর এই প্রথম তিনি সম্ভাষণ করলেন যাত্রীটিকে, ‘এস. এস. স্কটিয়া মানে?

‘যে-জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন, তারই নাম। কী-রকম ছিমছাম ঝকঝকে জাহাজ, দেখেছেন? খাশা! ঠিক রাজহাঁসের মতো ভেসে চলেছে। আচ্ছা, বলুন তো, আপনি কি সেই বিখ্যাত বার্টনের কেউ হন, যিনি আফ্রিকার নানা দুর্গম অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে অমন চমৎকার একখানা বই লিখেছেন আফ্রিকা সম্বন্ধে?’

‘কিন্তু সার, আমি বার্টনের কেউ নই–বার্টন আমার নামই নয়।’

‘তবে কি আপনি ফার্স্টমেট মঁসিয় বার্ডনেস?’

কাপ্তেনের পেছন-পেছনই গল্প করতে-করতে আসছিলেন লর্ড এডওয়ার্ডরা। তাঁদের দেখেই সাময়িকভাবে কাপ্তেনকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁদের দিকে প্রায় ছুটেই চ’লে গেলেন এই অদ্ভুত নবাগত যাত্রী। ‘এঁরাও তবে এই জাহাজেরই যাত্রী? বেশ ভালো হ’লো। জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে—একঘেয়ে নিরেস লাগবে না যাত্রাটা। আসুন, আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে নিই।’ লেডি হেলেনাকে সম্ভাষণ করলেন মাদমোয়াজেল, মেরিকে বললেন মাদাম, লর্ড এডওয়ার্ডকে বললেন মঁসিয়—আর খুব ক’রে সবাইকার হাত নেড়ে দিলেন।

প্রহসনটা হুড়মুড় ক’রে ঘাড়মুখ গুঁজড়ে এগুচ্ছে দেখে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর এই হতভম্ব ভড়কে-যাওয়া দশা এখনও কাটেনি বটে, তবে তাঁর মনে হয়েছে এবারে সমস্ত ব্যাপারটা মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভালো ক’রে অনুধাবন করা যাক, কিন্তু সেটা তাঁর সাধ্যে কুলোলে তো? যেই তিনি বলতে গেছেন, ইনি হলেন লেডি হেলেনা, আর উনি লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভন,’ আগন্তুক অমনি ব’লে উঠেছেন, ‘তাই নাকি? তা জাহাজে প্রথম আলাপেই অত নিখুঁতভাবে সহবৎ মেনে চলা যায় না। তবে স্কটিয়ার ওপর দু-দিনেই প্রথম আলাপের এই আড়ষ্টতা কেটে গিয়ে ঘনিষ্ঠতা গজিয়ে উঠবে। তখন কি আর এ-সব তুচ্ছ আদবকায়দার কথা কেউ মনে রাখবে?’

রকমসকম দেখে সকলেই তাজ্জব। শুধু যে-কথাটা প্রথমেই জিগ্যেস করা উচিত ছিলো, সেই কথাটাই এবার জিগেস করলেন লর্ড এডওয়ার্ড—’কার সঙ্গে আলাপ হ’লো জানতে পারি কি!’

‘ও-হো, দুঃখিত। নিজের পরিচয়টাই তো এখনও দেয়া হয়নি। এই অধম পারী ভৌগোলিক সমিতির প্রধান সচিব, এবং বার্লিন, বম্বাই, লাইপজিক, লন্ডন, সেন্ট পিটার্সবুর্গ, জ্বীন, নিউ-ইয়র্ক ভৌগোলিক সমিতির সদস্য জাক-য়েলিয়াস ফ্রাঁসোয়া মারি পাঞয়ল। আমি কিন্তু ইস্ট-ইনডিয়া ইনস্টিটিউটের রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল অ্যান্ড এথনোগ্রাফিক্যাল সোসাইটিরও সদস্য। দুই দশক ধরে শুধু আরামকেদারায় ব’সেই ভূগোলের চর্চা করেছি—এবারে সশরীরে যাচ্ছি ভারতবর্ষে, পদব্রজে ঘুরে-ঘুরে ভারতের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সরেজমিন তদন্ত ক’রে দেখতে।’

জাক পাঞ্চয়লের নামটা শোনামাত্র লর্ড এডওয়ার্ডের মধ্যে একটা সম্ভ্রমের ভাব জেগে উঠলো। তিনিও অবসর সময়ে এক-আধটু ভূগোলচর্চা ক’রে থাকেন—আর তাইতেই বিভিন্ন জার্নালে নানা সময়ে জাক পাঞ্চয়লের নানাবিধ তত্ত্ব ও আবিষ্কারের খবর বেরিয়েছে, আর যে-রকম সম্মান দিয়ে সে-সব প্রতিবেদন বেরিয়েছে তাতে বোঝা যায় পণ্ডিতেরা জাক পাঞ্চয়লের বিদ্যাবত্তাকে যথেষ্টই সম্মান ক’রে থাকেন। ডানকান জাহাজে যে এভাবে আচমকা তারই সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। পুরোটাই রীতিমতো চমকপ্রদ এক ভ্রান্তিবিলাস বলেই মনে হচ্ছে, আরামকেদারা থেকে পা বাড়াবামাত্র ভুগোলবিদ কোথাও একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে ব’সে আছেন—কিন্তু বিভ্রম যা-ই কিংবা যেভাবে ঘটে থাকুক না কেন, লর্ড এডওয়ার্ড ভাবলেন এই ছিটগ্রস্ত অধ্যাপকটিকে সমাদর করা কর্তব্য, এবার তিনি নিজেই তাঁর হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিগেস করলেন, আচ্ছা, একটা কথা যদি জানতে চাই—’

‘একটা কেন? অনেক কথাই জানতে চাইতে পারেন। কী জানতে চান, বলুন— ‘ ‘আপনার কথা থেকে মনে হ’লো আপনি বোধকরি পরশু রাতের বেলা জাহাজে এসে উঠেছেন—’

‘হ্যা, রাত আটটায়। তিরিশ ঘন্টা রেলের ঝাঁকুনি খেয়েছি সমানে, তারপর ঘোড়ার গাড়িতে ক’রে স্টেশন থেকে জাহাজঘাটা—যা ধকল গেছে, কী আর বলবো। আমার তো আর ভ্রমণ করে অভ্যাস নেই। তাই এস. এস. স্কটিয়ায় উঠেই সোজা ছ-নম্বর ক্যাবিনে গিয়ে চিৎপাত হ’য়ে শুয়ে পড়েছি—একটানা ছত্রিশ ঘন্টা ঘুমিয়েছি, নইলে আবার অসুখবিশুখ বাধিয়ে মুশকিলে প’ড়ে যেতে হতো।’

এতক্ষণে এই বিভ্রমের রহস্য বোঝা গেল। ডানকান ছাড়বার আগে সবাই যখন গির্জেয় গেছে, জাহাজে যে কোনো পাহারার দরকার আছে সেটাও কারু তখন খেয়াল হয়নি, আর রাতের অন্ধকারে বিধ্বস্ত পাঞয়ল ডানকানকেই এস. এস. স্কটিয়া মনে ক’রে সোজা গিয়ে ঢুকে পড়েছেন তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট-করা ছ-নম্বর ক্যাবিনে।

‘কথা ছিলো সোজা কলকাতার বন্দরে পৌঁছে, সেখান থেকেই স্থলপথে আমাদের ভৌগোলিক অভিযান শুরু হবে। ভৌগোলিক সমিতির পক্ষ থেকে বড়োলাটবাহাদুরকে সেই মর্মেই বিশদ বিবরণ জানানো হয়েছিলো। আমাদের ভৌগোলিক সমিতি জানতে চাচ্ছিলো, তিব্বতের ইয়ারো-জাঙবো-চট্ট নদীটা হিমালয়ের দক্ষিণদেশ থেকে বেরিয়ে শেষটায় আসামের ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে পড়েছে কি না। সেটাই সরেজমিনে দেখে-আসা আমার উদ্দেশ্য ছিলো। ঐ রাস্তায় বেরিয়ে, নদীর গতিপথ আবিষ্কার করতে গিয়ে, এই ‘৪৬ সালে ক্রিক ব্যর্থ হয়েছিলেন—আমার ধারণা, আমি নিশ্চয়ই সফল হবো।’

জাক পাঞ্চয়ল যেন দ্বৈতালাপে বিশ্বাসই করেন না, ক্লাসে পড়িয়ে তাঁর অভ্যাসটা এমনই বিগড়ে গেছে যে সারাক্ষণ, অনর্গল, মুখ থেকে তুবড়ির মতো বাক্যের ফুলঝুরি ছিটিয়ে চলেন। রেলভ্রমণের ধকলে তিনি কতটা কাহিল হয়েছিলেন এখন আর সেটা বোঝবার কোনো জো নেই—সম্ভবত ঐ ছত্রিশ ঘন্টা একটানা ঘুমিয়ে নেবার পর শরীরটা তাঁর এতই ঝরঝরে লাগছে, এতই চাঙ্গা লাগছে যে তোড়ে বাক্যবর্ষণ ক’রে যাচ্ছেন। একটু খারাপই লাগলো তাঁর ভুলটা ভাঙিয়ে দিতে, কিন্তু গোড়াতেই ভুলটা ভাঙিয়ে না-দেয়াটাও অন্যায় হবে। ‘মঁসিয় পাঞয়েল, লর্ড গ্লেনারভন খুব স্পষ্ট ক’রে বললেন, ‘আপনি কিন্তু মোটেই কলকাতা যাচ্ছেন না।’ তড়াক ক’রে কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন জাক পাঞ্চয়ল, ‘অথচ কাপ্তেন বার্টন—’

‘আপনি ভুল করেছেন, মসিয় পাঞয়ল’, ম্যাঙ্গল্‌স বললেন, ‘আমি কিন্তু কাপ্তেন বাৰ্টন নই—’

‘তাহ’লে স্কটিয়া—’

‘এবং এটা এস. এস. স্কটিয়াও নয়।’

জাক পাঞয়ল শুধু হতচকিত নন, স্তম্ভিত। জীবনে এই-প্রথম সম্ভবত তাঁর কোনো বাক্‌স্ফুৰ্তি হ’তে চাচ্ছিলো না। এক-এক করে সকলের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে গেলেন তিনি; না, মোটেই কোনো রসিকতা নয়, এটা, সকলেরই মুখ গম্ভীর। শুধু কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের ওষ্ঠাধর মুচকি এক হাসিতে ফুসকায়িত হ’য়ে আছে। আর তারপরেই তাঁর চোখ পড়লো হালের চাকায়, সেখানে বড়ো-বড়ো হরফে স্পষ্ট করে লেখা :

ডানকান
গ্লাসগো

‘অ্যা! ডানকান!’

প্রায় অর্ধস্ফুট একটা আর্তনাদের মতোই কথাটা পাঞয়লের মুখ থেকে নিঃসৃত হ’লো। কী-রকম হতাশভাবে ছুটে গিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন তাঁর ঐ ছ-নম্বর ক্যাবিনে।

এই ভ্রান্তিবিলাসে সকলেরই হাসি পাচ্ছিলো, শুধু মেজর ম্যাকন্যাব্‌সই সারাক্ষণ চুপচাপ গম্ভীর হ’য়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

লর্ড গ্লেনারভন বললেন, ‘বেচারা! এটা অবিশ্যি সব্বাই জানে যে জাক পাঞয়ল প্রায় গল্পের বইয়েরই চরিত্রের মতো, অন্যমনস্ক অধ্যাপক বলতে যা বোঝায়, উনি তারই সশরীর জলজ্যান্ত প্রমাণ—’

‘বেচারি বললে কী হবে,’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের গলা শোনা গেলো এতক্ষণে, ‘ওঁকে এখন কলকাতার বদলে আমাদের সঙ্গে পাতাগোনিয়াতেই যেতে হবে—কিছুতেই আর ফেরা হবে না।’

‘তবে প্রথম যে-বন্দরে ডানকান নোঙর ফেলবে,’ লর্ড গ্লেনারভন সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘সেখানেই বেচারিকে নামিয়ে দেওয়া যাবে না-হয়।’

জাক পাঞ্চয়লের এই গোড়ায় গলদের শেষরক্ষা কী ক’রে করা যায়, এ নিয়ে যখন পরামর্শ করতে সবাই ব্যস্ত, ঠিক তখনই তাঁর বিখ্যাত ছ-নম্বর ক্যাবিন থেকে কাঁচুমাচু মুখ ক’রে বেরিয়ে এলেন জাক পাঞ্চয়ল, তাঁকে কেমন-একটু সংকুচিত দেখালো। কোনো কথা না-ব’লে তিনি নিরীক্ষণ করলেন বড়ো মাস্তুলটা, তাকিয়ে দেখলেন সমুদ্রের ফেনোচ্ছল জল, আর দূরের ঝাপসা দিগন্তরেখা। তারপর আস্তে হেঁটে লর্ড গ্লেনারভনের কাছেও এসে দাঁড়ালেন।

‘আপনাদের জাহাজ কোথায় যাচ্ছে?’

‘চিলেয়—দক্ষিণ আমেরিকায়।’

‘সর্বনাশ! সে-যে একেবারে উলটো দিকে—’

‘আপনি না-হয় আমাদের সঙ্গে চলুন—’

‘উঁহু, তা হয় না আমাদের একটা আন্তর্জাতিক অধিবেশন রয়েছে যে সামনেই—’

‘তাহ’লে মাদেইরাতে নেমে পড়বেন—তারপর সেখান থেকে ফিরতি কোনো জাহাজ ধ’রে ইওরোপেই ফিরে যাবেন না-হয়।’

‘ডানকান তো আর মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে না, নৌসেনারও জাহাজ নয়—এ তো নিছকই একটা প্রমোদতরণী। আপনারা নিশ্চয় নৌবিহারেই বেরিয়েছেন। তাহ’লে আর কলকাতা বেড়াতে গেলেই বা ক্ষতি কী? তাছাড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী কলকাতা, লন্ডনের পরেই; সেখানে বা তার আশপাশে ঘুরে বেড়িয়ে কতকিছু দেখতেও তো পাবেন। সম্পূর্ণ অন্যরকম এক জীবনযাত্রা, একেবারেই আলাদা এক সংস্কৃতি।’

আপনি কলকাতা নিয়ে ওকালতি না-করলেও আমার নিজে থেকেই তো কতকাল ধরে কলকাতা—শুধু কলকাতা কেন, আস্ত ভারতভূমিই ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে ডানকানকে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে বেড়াতে যাবার লোভ আমাকে সংবরণ করতেই হবে। এখন দক্ষিণ আমেরিকা না-গিয়ে আমার কোনোই উপায় নেই।’

লর্ড গ্লেনারভন তখন বিস্তারিতভাবে খুলে বললেন কী উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি পাতাগোনিয়া যাচ্ছেন। একটুও সবুর করার উপায় নেই, এমনিতেই বড্ড দেরি হ’য়ে গেছে, একটা দিনও অন্যকোথাও গিয়ে নষ্ট করা চলবে না। তাছাড়া মেরি আর রবার্টও খুব ব্যাকুল হ’য়ে আছে। এই বেচারিদের কথা ভাবলে মনে হয় জলযানের বদলে কোনো উড়োযানে ক’রে উড়াল দিতে পারলেই ভালো হ’তো—চট ক’রে পেরিয়ে যাওয়া যেতো এই বিপুল জলধি। এককালে হয়তো লোকে কোনো উড়োজাহাজ আবিষ্কার করবে—তখন হয়তো দূর-দূরান্তেও আরো-অল্প সময়ে চ’লে-যাওয়া যাবে।

সব কথা খুলে ব’লে লর্ড গ্লেনারভন পাঞয়লকেও তাঁদের সঙ্গে যেতে আমন্ত্ৰণ জানালেন। ‘তার চেয়ে আপনিই বরং চলুন না আমাদের সঙ্গে। কলকাতা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না—সেখানে পরেও যাওয়া যাবে। তাছাড়া আপনি তো আর দক্ষিণ আমেরিকা চক্ষেও দ্যাখেননি—চর্মচক্ষুতে সব দেখে আপনি নতুন মহাদেশ সম্বন্ধে অজস্র নতুন তথ্য জানতে পারবেন।’

জাক পাঞ্চয়ল প্রস্তাবটায় মোটেই রাজি হলেন না—তবে লেডি হেলেনার দয়ামায়াসহানুভূতির প্রশংসা করলেন সাতকাহন ক’রে, বোতল থেকে উদ্ধার করা সাহায্যের জন্যে তিন তলবও দেখলেন, সে-সম্বন্ধে অবশ্য নতুন-কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। কিন্তু যখন জানলেন যে লেডি হেলেনা বিখ্যাত ভূপর্যটক উইলিয়াম টাফনেলের দুহিতা, তখন হৈ-হৈ ক’রে উঠলেন : ‘তাই নাকি! বিল টাফনেল তো আমার বন্ধুমানুষ। ইনি তাঁরই মেয়ে! কী আশ্চর্য, দৈব যে কখন কী করে, তা কেউ বুঝতেও পারে না। কে জানতো যে একদিন বিল টাফনেলের মেয়ের সঙ্গে একই জাহাজে ক’রে আমি সাগরপাড়ি দেবো!

৬. জাক পাঞ্চয়লের মতিবদল

আগস্টের তিরিশ তারিখে দেখা গেলো মাদেইরা, উত্তর আটলান্টিকের ক্যানারি আইল্যান্ডসের উত্তরে, এলোমেলো ছড়িয়ে আছে ছোটো-ছোটো কতগুলো দ্বীপ, পোর্তুগালের অধীন এই দ্বীপগুলোর রাজধানী ফুনশাল, ‘তিনশো-দুই বর্গমাইল তার বেড়,’ আর কী দারুণ আঙুর হয়, ‘ওহ, মাদেইরা ওয়াইন দারুণ খেতে,’ তবে, ‘মূল মাদেইরা দ্বীপ, যার বেড় দুশো পঁচাশি বর্গমাইল, সেখানে খামকা নোঙর ফেলতে চাচ্ছেন কেন? এখানে তো দেখার কিছুই নেই, আগেকার যত ভূগোলবিশারদেরাই তো যা দেখার সবকিছু দেখে গিয়েছেন। হ’তো যদি ব্রাজিল, যেখানে পশ্চিমে আমাজোন থেকে বেরিয়েছে মাদেইরা নদী—পোর্তুগিসরা আশ্চর্য, নতুন-কিছু দেখলেও পুরোনো নামেরই স্মরণ নেয়—এই মাদেইরা নদী মামোরে আর বেনির মোহনায় প’ড়ে বোলিভিয়ার সীমান্তটাকে চিনিয়ে দিচ্ছে, তাহ’লে না-হয় একবার নামা যেতো,–এত-সমস্ত কথা ভূগোলবিশারদ জাক পাঞ্চয়লের, জাহাজ থেকে না-নামবার অনেকগুলো ছুতোর মধ্যে একটি।’ এখান থেকে নিশ্চয়ই আপনারা ক্যানারি আইল্যান্ডে যাবেন, ঐ যে-দ্বীপগুলো আছে আটলান্টিকে, আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমে, রৌদ্রোজ্জ্বল, চমৎকার, সবশুদ্ধু ২৮০৭ বর্গমাইল, এখনও এস্পানিয়ারই অধীন, তার রাজধানী লাস্ পালমাস্ সান্তা ক্রুস দে তেনেরিফে, সেখানে পাহাড়ের চুড়োয় উঠলে হয়তো অনেককিছু দেখা যাবে। পূর্ব ক্যানারির এই লাস্ পাল্‌মাস খুব-একটা ছোটো দ্বীপ নয়, সবশুদ্ধ ১২৭৯ বর্গমাইল বেড়, সেখানে অবশ্য ঘুরে-ঘুরে কিছু দেখা যেতে পারে।

এই মর্মে ছোটোখাটো বক্তৃতা শুনে, এবং মাদেইরায় নামতে এই ভৌগোলিকের অনিচ্ছা দেখে, লর্ড গ্লেনারভন মৃদু একটু হাসলেনই শুধু কিছু বললেন না। না-হ’লে বলতে পারতেন, মাদেইরার যত খবর আপনি জানেন ততটাই তো আপনি জানেন লাস্ পামাস্-এর, আর জানেন ব’লেই যদি খামকা নামতে না-চান, মাদেইরায়, তবে সেই একই যুক্তিতে লাস্ পাল্মাস্-এই বা নামবেন কেন? একটা দ্বীপ পোর্তুগালের, আর অন্যটা এস্পানিয়ার–তফাৎ তো শুধু এটাই। এ-ধরনের কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন ক’রে যে কোনো লাভ নেই, এটা বুঝতে পেরেই লর্ড গ্লেনারভন মাথা নেড়ে সস্মিত মুখে জাক পাঞ্চয়লের প্রস্তাবটাই মেনে নিলেন।

মাদেইরা থেকে ক্যানারি আইল্যান্ডসের দূরত্ব আড়াইশো মাইলের মতো। পরের দিন অপরাহ্ন দুটো নাগাদ ডেক থেকে দূরে দিগন্তের কাছে, লাস পালমাস সান্তা ক্রুজ দে তেনেরিফের পাহাড়চুড়ো দেখা গেলো, ঘন-সবুজ ছায়ার মতো। জাক পাঞ্চয়লও তখন দাঁড়িয়েছিলেন ডেকে। তাঁকে ডেকে নিয়ে চোখে দূরবিন গুঁজে দিয়ে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স জিগেস করলেন, ‘চিনতে পারছেন—ঐ যে আপনার লাস্ পামাস্-এর পাহাড়-তেনেরিফে। পাঞয়ল যেন দেখেও দেখতে পেলেন না। তিনি আরামকেদারার ভূগোলবিশারদ, জানা পৃথিবীটা তাঁর নখের ডগায়, কিন্তু সেটা স্বচক্ষে দেখে বাড়তি কী আর উৎসাহ দেখাবেন তিনি। তাঁর চোখমুখে কেমন-একটা ঔদাসীন্যের ভাবই লেপটে রইলো। তবে গোল হ’লো তখন যখন কয়েকঘন্টা পরে খালি চোখেই দেখা গেলো পাহাড়, ডানকান এখন তার অনেকটাই কাছে গিয়ে পৌঁছেছে—এমন জলজ্যান্ত দ্বীপটা চাক্ষুষ দেখে ফেলবার পরে আর না-দেখবার ভান করা যায় কী করে? কিন্তু এবার তাঁর মুখচোখ তাচ্ছিল্যের ভাবে ভ’রে গেলো। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সকে তিনি জানালেন, ‘ধুর! ঐ পাহাড়ে উঠে আর কী হবে? ও-পাহাড়ে তো হুমবোল্টও উঠেছে, বঁপাও উঠেছে। এ-পাহাড় আর তবে নতুন বা অজানা হলো কী ক’রে? হুমবোল্ট তো ঘুরে-ঘুরে পাহাড়ের পাঁচ-পাঁচটা আলাদা-আলাদা জায়গায় গিয়েছিলো, পাহাড়ের উঁচু চুড়োটায় উঠে দেখেছে এস্পনিয়ার সিকিভাগ, তারপর এমনকী আগ্নেয়গিরির ভেতরে গিয়ে পর্যন্ত জমাট লাভার স্তর দেখে এসেছে। ওখানে আর নতুন-কী দেখবো আমি। তার চেয়ে বরং কেপ ভের্দ গিয়ে ঘুরে দেখা যেতে পারে : পশ্চিম আফ্রিকার এই এই দ্বীপগুলো পোর্তুগালের অধীন, রাজধানী প্রাইয়া সাঁউ তিয়াগুর ওপর ঠিক যেন ছবির মতো বসিয়ে রেখেছে কেউ—তাছাড়া সেনেগলের অংশ এটা, আফ্রিকার একেবারে পশ্চিমতম বিন্দু—অন্তরীপটা যেভাবে অ্যাটলান্টিকে ঢুকে এসেছে ১৭°৩০ তে তাতে মনে হয় গোটা আফ্রিকাই যেন পশ্চিমদিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনারা কেপ ভেদ-এ থামবেন তো?’

‘তা তো থামতেই হব,’ কথার তোড়ে ভেসে যেতে-যেতে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স জানালেন, ‘কয়লা নিতে হবে যে।’

‘আমি তাহ’লে সেখানেই নেমে যাবো,’পাঞয়ল অমনি ঘোষণা ক’রে বসলেন, ‘ফ্রাসের কিছু লোকজন তো থাকবেই ওখানে, ব্যবসা করতে যারা ওখানে গেছে। অবশ্য লোকে বলে ওখানেও কিছু দেখার নেই, সেনেগল তো ফরাশিদেরই অধীন—আরেকটা ফ্রান্স বানিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে আর-কি ওখানে। তবে চোখ থাকলে, খুঁটিয়ে দেখতে জানলে, অনেককিছুই চোখে প’ড়ে যেতে পারে। অন্তরীপটা সেনেগলের ব’লে ফরাশিদের, দ্বীপগুলো সব পোর্তুগিসদের—পাশাপাশি দেখতে গেলে দুটো দেশের তফাৎ ভালো ক’রে মালুম হ’য়ে যাবে।’

কেপ ভের্দ বা কাপ ভার্দ, যখন এলো, সেদিন আকাশ ফেটে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স পরিকল্পনা মতোই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এসে পৌঁছেছেন, দিনটা সেপ্টেম্বরের তিন তারিখ। কিন্তু কেউ যেন আকাশ উপুড় করে ঘড়া-ঘড়া জল ঢেলে যাচ্ছে। ডানকান ঠিক সেনেগলের অন্তরীপে এসে ভেড়েনি, ভিড়েছে দ্বীপের রাজধানী পোর্তু প্রাইয়াতে। কর্কটক্রান্তি পেরিয়ে আসার পর থেকেই আকাশ ছিলো মেঘলা, কালো-কালো মেঘে ঢাকা প’ড়ে গিয়েছিলো সূর্য, তারই মধ্যে মরা মিয়োনো আলোতে দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিলো আগ্নেয়গিরির চূড়াটা—সম্ভবত শ-তিনেক ফুট উঁচু হবে।

পোর্তু প্রাইয়াতে ডানকান নোঙর ফেলবামাত্র দেখা গেলো ভূগোলবিশারদ জাক পাঞ্চয়ল তাঁর তল্পিতল্পা জিনিশপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে নামবার জন্যে প্রায় একপায়ে খাড়া, কিন্তু তারই মধ্যে বেশ গজর-গজর ক’রে চলেছেন। তাঁর অন্তহীন বিড়বিড় থেকে অচিরেই অবশ্য মর্মার্থ উদ্ধার করা গেলো। তাঁর সঙ্গে রয়েছে আনকোরা সব দামি-দামি যন্ত্রপাতি, যে-রকম বৃষ্টির ঢল নেমেছে তাতে সব ভিজে-টিজে একেবারে বিকল হ’য়ে যাবে যে।

কেবল এইই নয়—তাঁর ভ্যাজর ভ্যাজর এমনকী পোর্ত প্রাইয়ার আদ্যশ্রাদ্ধ করে ছাড়লো—অবশ্যই কোনো ভৌগোলিকের দিক থেকে। এ-দেশটার নাকি উল্লেখ করার মতো নদী নেই—’ভেবে দেখুন, পাহাড় আছে, খাতও আছে, জমি ঢাল থেকে গড়িয়ে গিয়ে পড়েছে সমুদ্রে, অথচ কোনো নদী নেই! তাজ্জব!’—তাছাড়া গাছপালা যা আছে তা নেহাৎই নাকি নামকাওয়াস্তে, বনজঙ্গল নেই—’অথচ এর নাম কি না কেপ ভেদ—সবুজ অন্তরীপ। এ-রকম বেমানান নাম কখনও শুনেছেন?’—পাহাড় যা আছে তাও তো নিছক বালির ঢিবি—সাঁউ তিয়াগুর আগ্নেয়গিরিটাকে সরেজমিন দেখে গিয়েছেন মঁসিয় দ্য ভিল—তাঁর বর্ণনা থেকেও মনোরম কোনো তথ্য জানা যায়নি। এ-রকম একটা জনবিবর্জিত দ্বীপে দু-দুটো মাস মানুষ থাকে কী ক’রে—দু-মাসের মধ্যে তো আর দেশে ফেরার জাহাজ মিলবে না!

বিড়বিড় ক’রে এমনি সাতকাহন পেড়ে বসলেন পাঞয়ল আর ক্রমশ কেমন যেন মনমরা হ’য়ে পড়তে লাগলেন।

গোড়ায় বেচারি পাঞয়লকে তাতাচ্ছিলেন সবাই, এমনকী মেজর ম্যাকন্যা শুদ্ধু; নেমে গেলে ক্ষতিই বা কী। ভৌগোলিকদের তো আর পৃথিবীর আশ্চর্য-সব ভূদৃশ্য নিয়ে মাথা ঘামালেই চলে না—তাঁদের তো অতিসাধারণ দেশ-গাঁ দ্বীপ-মহাদ্বীপের বর্ণনা তৈরি করতে হয়। কিন্তু এ-সব কথায় চাঙ্গা হ’য়ে ওঠার বদলে পাঞয়ল ক্রমেই যেন মিইয়ে পড়তে লাগলেন। শেষটায় তাঁর বেচারা-বেচারা মুখটা দেখে লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভনের একটু মায়া হ’লো, বললেন, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, এখানে আপনার হাত-পা গুটিয়ে মিথ্যোমিথ্যি দু-মাস ব’সে-থাকা ছাড়া আর-কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু মঁসিয় পাঞয়ল, এরপর তো ডানকান গিয়ে সটান চিলেতে থামবে—একেবারে নতুন-এক মহাদেশে—অন্য-একটা গোলার্ধে। তা চলুন, আমাদের সঙ্গে না-হয় পাতাগোনিয়াতেই চলুন, সেখানকার ইন্ডিয়ানদের চাক্ষুষ দেখে আসবেন, চলুন। তাদের নিয়ে তো কতরকম গালগল্প ফেঁদেছে লোকে—কিন্তু সত্যি তারা কী-রকম সেটা একটু নিজের চোখে দেখে নেয়া কি ঠিক হবে না?’

‘কিন্তু আমার যে তিব্বতে যাবার কথা? আমায় তো ইয়ারো-জাংবো-চৌতে গিয়ে যেখানে কেউ যায়নি সেখানকার সব হালহদিশ জেনে আসতে হবে!’

আপনার মনে হচ্ছে নদী নিয়েই কারবার। তিব্বতী নদী না-পান আমেরিকার নদী পেয়ে যাবেন। ইয়ারো-জাংবো-চৌ-এর বদলে না-হয় রিও কলোরাদোর উৎস আর মোহানাই দেখবেন না-হয়।’

‘তাহ’লে তো গোড়া থেকেই ভারতবর্ষের বদলে পাতাগোনিয়া যাবার পরিকল্পনা করলেই হ’তো। ভৌগোলিক সমিতিকে আগে থেকে ব’লে-ক’য়ে- জানিয়ে এলে অভিযানটা একটা সরকারি রূপ পেতো।’ তা-না-না-না ক’রে নিমরাজি হবার ভঙ্গিতে বললেন ফরাশি ভৌগোলিক।

লর্ড গ্লেনারভন একটা নামকাওয়াস্তে কৈফিয়ৎ জুগিয়ে দিলেন। নিশ্চয়ই অনেকরকম পরিকল্পনাই ছিলো আপনাদের সমিতির। সে-সব নিয়ে উদ্বাস্তু ছিলেন ব’লেই হয়তো তখন ঠিক খেয়াল হয়নি। তাছাড়া খুব কি আর ঝামেলা হবে? ভারতবর্ষে গেলেও দেখতে পেতেন ইন্ডিয়ান—এই পাতাগোনিয়াতেও দেখতে পাবেন ইণ্ডিয়ান—শুধু এরা যে আমেরিন্ডিয়ান সেটা মনে রাখলেই হ’লো।’

‘মঁসিয় পাঞয়ল,’ এবার লেডি হেলেনা তাঁকে উসকে দিলেন, ‘আর মিথ্যে ভাবছেন কেন? এই বর্ষায় এখানে কোথাও যাবেনই বা কী করে? তার চেয়ে আমাদের সঙ্গেই চ’লে আসুন। আমরাও না-হয় আপনার ভৌগোলিক অভিযানের সঙ্গী হ’তে পেরে কৃতার্থ হবো। আর এ নিয়ে দ্বিরুক্তি করবেন না।’

‘না-না, দ্বিরুক্তি নয়,’ পাঞয়লের মুখ উদ্ভাসিত, চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং, ঠিক ওপর-পড়া হ’য়ে বলতে পারছিলুম না ব’লেই আপনাদের না ব’লেই আপনাদের দিক থেকে আমন্ত্রণ আসার অপেক্ষা করছিলুম।’ আর-কোনো ওজর-আপত্তির কথা না-তুলে সরাসরি মনের কথাটাই খুলে বললেন ভৌগোলিক : ‘আপনাদের জাহাজ, আপনারা যদি না-ডাকেন তো সেই জাহাজে ক’রে যাই কী ক’রে?’

মেরি হাততালি দিয়ে বলে উঠলো : ‘বাঃ, এই-তো বেশ হ’লো। আমাদের অভিযানে আরো-একজন সঙ্গী বাড়লো।’

আর রবার্ট তো সোজা গিয়ে তাঁকে একেবারে জড়িয়ে ধরলো।

অমনি খুশি হ’য়ে পাঞয়ল ব’লে উঠলেন, রবার্টকে তিনি একেবারে দিগ্‌গজ ভৌগোলিক বানিয়ে তুলবেন। রবার্ট বেচারা নিজে কী হ’তে চায় সেটা জানবার চেষ্টা না-করেই একেকজন তাকে একেরকম মহদাশয় বানিয়ে দেবার ঘোষণা ক’রে ব’সে আছেন। পাঞয়ল তাকে ভূগোলবিশারদ বানিয়ে দেবার কথা বলার আগে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স বলেছেন, ‘রবার্ট গ্রান্ট হবে কাপ্তেন গ্রান্টেরই সুযোগ্য সন্তান—তাকে তিনি বানিয়ে দেবেন ওস্তাদ নাবিক।’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স কোন-এক দুর্লভ মুহূর্তে মুখ ফুটে বলেছেন তাকে তিনি বানিয়ে দেবেন দুর্দান্ত ও দুঃসাহসী, অকুতোভয় যোদ্ধা। লর্ড গ্লেনারভন বলেছেন তাকে আদবকায়দা শিখিয়ে একেবারে পাক্কা ‘জেন্টলম্যান’ বানিয়ে দেবেন। লেডি হেলেনা বলেছেন প্রাণে দয়া-মায়া না-থাকলে অমন মস্ত সর্ববিদ্যাবিশারদ হ’য়েও কোনো লাভ নেই, তিনি দেখবেন সে যাতে দয়াধর্ম শেখে। কেবল মেরি-যে অ্যাদ্দিন রবার্টের দেখাশুনো ক’রে এসেছে—সে-ই কিছু বলেনি, উলটে সবাই তাকে ছাত্রী হিশেবে পাকড়াবার চেষ্টা করেছিলো—ঠিক রবার্টের মতোই আরেকজন, যাকে যেমন-খুশি সবাই গ’ড়ে নিতে পারবে।

কিন্তু রবার্টকে ভূগোলপণ্ডিত তৈরি করার জন্যে পাঞয়ল যে ডানকান ছেড়ে না, গিয়ে তাদের সঙ্গেই অভিযানে বেরুবেন ব’লে মনস্থির করেছেন, এতে জাহাজশুদ্ধু সব্বাই ভারি খুশি হ’য়ে উঠলো। পাঞয়ল ভারি মজার মানুষ—একে তাঁর অমন ভুলোমন, তায় ভীষণ আরামকাতুরে, তায় নানা বিষয়ে অদ্ভুত-অদ্ভুত ফোড়ন কাটেন। তিনি সঙ্গে থাকলে আর যা-ই হোক এ-অভিযান কখনোই একঘেয়ে বা বিরক্তিকর হ’য়ে উঠবে না—সবসময়েই একটা-না-একটা রসালো প্রহসন সৃষ্টি হবে, কতরকম মজা হবে।

চারদিন ধ’রে জাহাজে কয়লা বোঝাই হ’লো, রসদ তোলা হ’লো, শূন্য ভাঁড়ার ভরাট করা হ’লো। বৃষ্টি মাঝে-মাঝে ধ’রে আসে বটে, টিপটিপ, টিপটিপ, কিন্তু কখনোই পুরো থেমে থাকে না। এরই মধ্যে মেজর ম্যাকন্যাব্‌স একাই একদিন বর্ষাতি চাপিয়ে পোর্তু প্রাইয়ায় নেমে সরেজমিন তদন্ত ক’রে এসেছিলেন সব। জাক পাঞ্চয়ল কিন্তু একবারও জাহাজ থেকে নামবারই চেষ্টা করেননি। তিনি বরং ডেকের ওপর পায়চারি করতে-করতে কিংবা ডেকচেয়ারে বসে আড্ডা দিতে-দিতেই তাঁর ভূগোলবিদ্যার জ্ঞানের বহর জাহির করতেন। আর বৃষ্টির সময় তো কথাই নেই—তাঁর ঐ বিখ্যাত ছ-নম্বর ক্যাবিন থেকে তিনি একপাও বেরুতেন না।

ডানকান যখন তার কয়লা আর রসদ নিয়ে ফের তার অভিযানে রওনা হ’য়ে পড়লো, আর সেপ্টেম্বরের সাত তারিখে পেরিয়ে এলো বিষুবরেখা, সেদিন থেকে জাক পাঞ্চয়ল তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিধি প্রকাশ করবার জন্যে আরো একটি নতুন বিষয় পেলেন। যখন-তখন খাবারটেবিলেই তিনি মস্ত-একটা মানচিত্ৰ বিছিয়ে দিয়ে কাকে বলে নিরক্ষরেখা, কাকে বলে অমুক ডিগ্রি দেশান্তর আর তমুক ডিগ্রি অক্ষরেখা, কখন কার কত ডিগ্রি পেরুলে সময়ের তফাৎ হ’য়ে যায় চার মিনিট—এ-সব বিষয় সোৎসাহে হাত-পা নেড়ে বোঝাতে লাগলেন। স্টুয়ার্ড অলবিনেট বেচারির হ’লো বিষম ঝামেলা- সে বাটি-রেকাবি-কাঁটা-চামচে ন্যাপকিন-গেলাশ যে কোথায় সাজাবে তা বুঝতে না-পেরে, তার খাবারটেবিলটা এভাবে জবরদখল হ’য়ে যেতে দেখে, পণ্ডিতপ্রবরের সঙ্গে বেজায় খিটিমিটি লাগিয়ে দিতো। অন্যদের কাছে কিন্তু জাক পাঞ্চয়লের ভূগোলের ক্লাস মজাই লাগতো। আর কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌সও খুশি ছিলেন যে এইসব প্রহসনের মধ্যে যদি মেরি মজা খুঁজে পায়, তাহ’লে অন্তত সেই সময়টুকু সে কাপ্তেন গ্রান্টের কথা ভুলে থাকবে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো কাপ্তেন গ্রান্টকে শিগগিরই খুঁজে পাওয়া যাবে, তাঁদের এই অভিযান সফল হবে। শুধু মেজর ম্যাকন্যা এই আরামকেদারার বাহাদুরি আর অবিশ্রাম বকর-বকর শুনতে চাইতেন না।—তিনি নিজে বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে পোর্তু প্রাইয়া ঘুরে এসেছেন, কোনো পণ্ডিতি বক্তৃতা দেননি, আর ভূগোলবিশারদ কিনা সর্বক্ষণ মুখে খৈ ফুটিয়ে চলেছেন, অথচ কোনোকিছু গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসবার বেলায় তাঁর যত-সব ওজর-আপত্তি শুরু হয়ে যায়।

একটু বোধকরি বিরক্তই হ’য়ে উঠছিলেন মেজর ম্যাকন্যাব্‌স, বিশেষত খাবার সময়ে ভূগোলের ক্লাসে তাঁর প্রবল, অনীহাই ছিলো, কিন্তু হঠাৎ একদিন অবস্থাটা বেশখানিকটা বদলেই গেলো। জাহাজের লাইব্রেরিঘরে জাক পাঞ্চয়ল আবিষ্কার ক’রে বসলেন একবাক্স বই, এস্পানিওলে লেখা—নতুন মহাদেশে যাচ্ছেন, দক্ষিণ গোলার্ধে, সেখানে ব্রাজিল বা ওলন্দাজ ইণ্ডিস বা ব্রিটিশ গিয়ানার মতো দু-চারটে জায়গা ছাড়া সর্বত্রই তো এস্পানিওলের চল—বিভিন্ন ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীর অবশ্য যার-যার নিজের ভাষা আছে। ভাষাটা জানলে চিলেতে নেমে ভারি কাজে লেগে যাবে। আদানুন খেয়ে পাঞয়ল ভাষাটাকে কব্জা করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। বই ঘেঁটে-ঘেঁটে নানারকম শব্দ বার করেন, ধাতুরূপ মুখস্থ করেন, ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে হাওয়ার উদ্দেশে ছড়িয়ে দেন এস্পানিওল বাণী। এমনকী, অন্যদের সঙ্গে কথা বলবার সময় যখন-তখন ব্যবহার করেন এস্পানিওল, আর পরক্ষণেই বলেন, থুড়ি, ভুল হ’য়ে গেছে, তোমরা তো কথাটার মানে জানো না, কথাটা ফরাশিতে হ’লো এই, আর ইংরেজিতে হ’লো ঐ। আর এটা সবচেয়ে বেশি হ’তো যখন তিনি রবার্টকে পাকড়ে তাকে আমেরিকার কাহিনী শোনাতে লাগলেন।

ক্রিস্তোফোরো কোলোম্বো, ক্রিস্তোবাল কোলোন বা ক্রিস্টফার কলম্বাস- যে-নামেই ডাকো না কেন, ক্রিস্তোবাল কোলোন মরবার আগে জেনেই যেতে পারলেন না ইওরোপ থেকে নতুন-একটা মহাদেশে যাবার রাস্তা তিনি আবিষ্কার করেছেন, ভারতবর্ষের ধারে-কাছেও ঘেঁসেননি। সেই প্রথম অভিযানে ১৪৯২তে গিয়েছিলেন কুবায়, আর শেষ অর্থাৎ চতুর্থ অভিযানে ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে গিয়েছিলেন বারবেডোসে – প্রত্যেকবারই বেচারি ভেবেছিলেন ভারতবর্ষে এসে পা দিয়েছেন, ফলে এখানকার লোকেরা হ’য়ে গেলো ইন্ডিয়ান, বারবেডোস হ’য়ে গেলো পশ্চিম-ইনডিস—ইন্ডিয়া কথাটার চল ষোড়শ শতাব্দীর আগে হয়নি—আর তাও ভা ডা গামা ১৪৯৮-তে কোড়িকোডে পা দেবার পর সেই রাস্তায় যখন পোর্তুগিস আর ওলন্দাজ বোম্বেটেদের লুঠতরাজ দারুণ বেড়ে গেলো, তারই পর—পোর্তুগিস বোম্বেটেরা আবার আমাদা থেকে বদলে গেলো হার্মাদ-এ, নৌসেনা থেকে জলদস্যুতে। ক্রিস্তোবাল কোলোন যে-গণ্ডগোলটা পাকিয়ে গিয়েছিলেন সে শুধু ভূগোলটা ঠিকঠাক জানতেন না ব’লেই—’

‘আমেরিকা মহাদেশের কথা ইওরোপের কেউই জানতো না—তারা জানতো ভূমধ্যসাগর, তারপর আফ্রিকা—তাও মরোক্কো-টরোক্কো-ভারতবর্ষের রাস্তাও জানা ছিলো না তাদের, যদিও আরবদের মারফৎ পেতো মশলিন, মশলা, চিনি আর আরো নানারকম শৌখিন জিনিশ। তো ক্রিস্টফার কলম্বাসই বা কী ক’রে বুঝবেন জলের মধ্যে আস্ত একটা অজ্ঞাত মহাদেশই প’ড়ে আছে, উত্তর-দক্ষিণ দুই গোলার্ধ জুড়ে?’ রবার্ট একবার কলম্বাসের ভূগোলবিদ্যায় অজ্ঞতার কারণটা বাৎলাবার চেষ্টা করেছিলো।

‘সে-কথাই তো বলছি,’ এই কথোপকথনের মধ্যে অন্য শ্রোতারাও যথারীতি জুটে গিয়েছিলেন, তাঁরা শুনতে পেলেন পাঞয়লের সারগর্ভ বয়ান : ‘ক্রিস্তোবাল কোলোন তো না-জেনেই মরলেন যে তিনি একটা নতুন মহাদেশে যাবার রাস্তা বার ক’রে ফেলেছেন। বেরিয়ে ছিলেন এশিয়া—বিশেষ করে ভারতে যাবার সোজা রাস্তাটা খুঁজে বার করতে। ফলে মধ্য আমেরিকায় এসে ভেবেছিলেন এসে পৌঁছেছেন ক্যাথে অর্থাৎ চিনদেশে, কিংবা নিপ্পন দেশে, জাপানে। শুধু ভূগোল না-জানবার ফল—কারণ ভূগোল তো আর কতগুলো নদীপাহাড় নয়, দেশ-বিদেশের মানুষজনেরও কাহিনী। চির আপান সম্বন্ধে একফোঁটা জ্ঞান থাকলে এ-গণ্ডগোল তাঁর হ’তো না। তাঁর চেয়ে ঢের সড়গড় ছিলেন আমেরিগো ভেসপুচ্চি-ফলে তাঁর নাম থেকেই নতুন মহাদেশের নাম হ’য়ে গেলো আমেরিকা। যেমন মাগেলানের নাম থেকে হলো মাগেলান প্রণালী, মাগেলান অন্তরীপ—ইত্যাদি।’

ডানকান তখন মাগেলান প্রণালীতে ঢুকেছিলো ব’লেই এ-নামটা করেছিলেন পাঞয়ল। এবং সদলবলে ডেকে দাঁড়িয়ে অন্তরীপের কাছে এসে তিনি চর্মচক্ষে পাতাগোনিয়ার ইণ্ডিয়ানদের দেখবার চেষ্টা করলেন—কিন্তু, উঁহু, কাউকেই দেখা গেলো না। তাঁর কৌতূহলের কারণ ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করলেন তিনি। ‘একেকজন অভিযাত্রী একেকরকম বর্ণনা দিয়েছেন ইন্ডিয়ানদের। কেউ বলেছেন এরা সব এগারো ফুট লম্বা দৈত্য, কেউ-বা বলেছেন, উঁহু-উঁহু—এরা সব তিন ফুট লম্বা হয়, সবাই বামন, কেউ-কেউ আবার বলেছেন, তা পাঁচ-ছ ফুট হবে ব’লেই মনে হ’লো। জনাথান সুইফ্‌ট যে লিলিপুট বা ব্রবডিঙনাঙদের কথা বলেছেন, এরা তার কেউই নয়। তবে ডীন সুইফ্‌ট বোধহয় এ-সব অভিযাত্রীদের গুলগল্প কিংবদন্তি শুনেই একটা দ্বীপে ফেলেছেন খুদে মানুষ লিলিপুশনদের আর অন্য দ্বীপে ফেঁদেছেন ব্রবডিঙনাঙি দৈত্যদের আস্তানা।’

‘হ্যাঁ, তা তো বুঝলুম,’ সরাসরি মোক্ষম জায়গাতেই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলেন লর্ড গ্লেনারভন, ‘কিন্তু আসল উচ্চতাটা তবে কী?’

‘ব’সে থাকলে উচ্চতা একরকম, দাঁড়ালে আরেকরকম,’ অমনি চ্যাটাং ক’রে এলো জবাব—ফোড়ন কাটার মতো—রবার্টের কাছ থেকে।

‘তা ঠিকই বলেছে, রবার্ট,’ পাঞয়ল বললেন, ‘ওদের ধড়টা লম্বা, পা জোড়া খাটো। তবে যাঁরা এদের নিয়ে পণ্ডিতি কেতাব লিখেছেন তাঁরা কিন্তু বলেননি মাপজোক নেবার সময় এরা ব’সে ছিলো, না দাঁড়িয়েছিলো।’

৭. ডানকান-এর যাত্রীরা পদব্রজে

ক্লাইড ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ঠিক বিয়াল্লিশ দিন যখন কেটে গিয়েছে ডানকান গিয়ে ঢুকলো তালকাউয়ানো উপসাগরে; ঐ নামেই নগর-বন্দর, চিলের দক্ষিণমধ্যে তার অবস্থান, কনসেপসিওনের উত্তর-পশ্চিমে। তালকা নামে যেহেতু চিলের ঠিক মাঝখানে সান্তিয়াগোর দক্ষিণে আরো একটা নগর আছে। তাই এই তালকাকে আলাদা ক’রে বোঝাবার জন্যে নাম দেয়া হয়েছে তালকাউয়ানো। বলাই বাহুল্য, জাক পাঞ্চয়লের একটা ছোটোখাটো উচ্ছ্বসিত বক্তৃতার পরই এই সম্যক জ্ঞান লাভ হ’লো অন্যদের। আর তাঁর বাগ্মিতা এমনই চুলবুল-করানো ছিলো যে তক্ষুনি লর্ড গ্লেনারভনও জাক পাঞ্চয়লের সঙ্গে সরাসরি ডাঙায় এসে নামলেন। বন্দরের রমরমার জন্যেই শহরটায় গিশগিশে ভিড়। পাঞয়ল ভেবেছিলেন, সদ্য-রপ্ত-করা এস্পানিওল ভাষার প্রয়োগনৈপুণ্যে তিনি চট ক’রেই লর্ড গ্লেনারভনকে তাজ্জ্বব ক’রে দেবেন, তাঁর প্রতিভা দেখে সবাই নিশ্চয়ই দারুণ চমৎকৃত হ’য়ে যাবেন। কিন্তু ফরাশি টানে এস্পানিওল বলার ফল অবশ্য তাঁর ঠিক মনঃপূত হ’লো না—কোনো হতভাগা চিলেনো তাঁর কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারলে না। একের পর এক লোককে ডেকে তড়বড় ক’রে কথা বলছেন পাঞয়ল, তোড়ে ছুটিয়ে দিয়েছেন এস্পানিওল ভাষার তুবড়ি, আর তারা গোড়ায় ধন্দে প’ড়ে গিয়েছে, পরে হতভম্ব, এবং কারু-কারু কাছ থেকে জুটেছে কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটিও। শেষটায় নিজেই পাঞয়ল ব্যাখ্যা করলেন তাঁর কথা অন্যদের কাছে এমন দুর্বোধ্য–না, না, অবোধ্য—ঠেকার কারণ। ‘আসলে আমার জিভেরই আড় ভাঙেনি–নিশ্চয়ই উচ্চারণে গোল পাকিয়ে গিয়েছে।’

তাঁর ভাষাশিক্ষার এহেন পরিণতি দেখে গ্লেনারভন একটু মুচকি হাসলেন শুধু। বললেন : ‘চলুন। শুল্ক দফতরের আপিশটায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক।’

শুল্ক দফতরের আপিশে গিয়ে অবশ্য তেমন লাভ হ’লো না, শুধু এ-তথ্যটা জানা গেলো যে ইংরেজ কনসাল থাকেন কনসেপসিওনে—অর্থাৎ চিলের দক্ষিণমধ্যের সেই তুলনায়-বড়ো শহরটায়।

‘এখান থেকে কদ্দূর? ‘

তো, তেজি ঘোড়া পেলে ঘন্টাখানেকে পৌঁছে যাবেন।’

ঘোড়া জোগাড় করা হ’লো প্রায় তক্ষুনি–কড়ি ফেললে কীই-বা না-মেলে, আর দুজনে ঘোড়ায় চেপে তক্ষুনি জোরকদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।

কিন্তু যতই প্রত্যাশা বা উত্তেজনা থাক, ইংরেজ কনসাল সব শুনে-টুনে তাদের সব প্রত্যাশায় ঠাণ্ডাজল ঢেলে দিলেন। কাপ্তেন গ্রান্টের ব্রিটানিয়া জাহাজ, তার হালহদিশ, তার সলিলসমাধি—কিছুই তাঁর জানা নেই। লর্ড গ্লেনারভনদের কাজে লাগতে পারলে তিনি ধন্য হতেন, কৃতার্থ হতেন, কিন্তু…

অতএব, পুনরায়, তালক।উয়ানায় প্রত্যাবর্তন দুজনের। অথচ এখানে হাত গুটিয়ে ব’সে-থাকাও তো চলে না। সুতরাং চর পাঠানো হ’লো উপকূল ধরে দূরে-দূরে, রাহাখরচ বাদেও প্রলোভন রইলো কেউ কোনো খবর আনতে পারলেই ইনাম মিলবে, কিন্তু কোনো খবরই মিললো না।

এ-সব করতে-করতেই প্রায় হপ্তা কাবার। ছ-দিন বাদেও কোনো খবর নেই। এতদিন মেরি আর রবার্ট আশায় আশায় বুক বেঁধে ছিলো, এবার তারা হাল ছেড়ে দিয়ে একবোরে ভেঙে পড়লো।

অতএব ঐ রহস্যময় চিরকুটগুলো নিয়ে আবারও খুঁটিয়ে দেখতে ব’সে গেলেন মঁসিয় পাঞয়ল। শব্দগুলোর মর্মোদ্ধার করতে কোনো ভুল হয়নি তো? এবং তন্নতন্ন ক’রে সবগুলো চিরকুট খতিয়ে দেখে তড়াক ক’রে প্রায় লাফ দিয়েই উঠলেন জাক পাঞ্চয়ল।

‘হুম! যা ভেবেছি তা-ই! গোড়াতেই গলদ, তো শেষরক্ষা হবে কী করে?’

তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে সবাই কাছে ঘেঁসে এলেন।

‘কী ব্যাপার? গোড়ায় আবার গলদ কোথায়?

‘কয়েকটা শব্দের ভুল মানে করা হয়েছে দেখছি!’ জাক পাঞ্চয়লের চোখ জ্বলজ্বল করছে, উদ্ভাসিত বদন বিগলিত। ‘বন্দী হবো—এমন-কোনো কথা তো লেখেননি কাপ্তেন গ্রান্ট—সম্ভবত লিখতে চেয়েছিলেন বন্দী হয়েছি। সাহায্য চেয়ে এই চিরকুট যখন লিখেছিলেন, তার আগেই নিশ্চয়ই ইণ্ডিয়ানদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছেন।

‘তা কী ক’রে হয়?’ লর্ড গ্লেনারভন তাঁর যুক্তি উপস্থাপিত করলেন। ‘বোতলটা তো জলে ফেলা হয়েছিলো—আর সে নিশ্চয়ই ঐ জাহাজডুবির সময়তেই। না-হ’লে বন্দীশিবির থেকে দিব্বি সকলের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসে সমুদ্রের জলে ফেলবেন কী ক’রে বোতলটা?’

‘হয়তো পথে কোনো নদী পড়েছিলো, তার জলেই ফেলেছেন। পরে ভেসে এসেছে সমুদ্রে।’

‘তা অবশ্য হ’তে পারে। এ-সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তা, না-হয় ধ’রেই নিলুম, ক্রিয়াপদের ভূত-ভবিষ্যৎ সমস্ত আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তাতে কী দাঁড়ালো? আমাদের আপনি কী করতে বলেন? ‘

‘সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তরাল রেখা যেখানে আমেরিকার উপকূল ছুঁয়েছে, সেখান থেকে রওনা হ’য়ে ঐ রেখা বরাবর সোজা অ্যাটলান্টিক অব্দি যাই, চলুন। আমরা যদি আস্ত সমান্তরাল রেখাটার বুড়ি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাই, তাহ’লে কোথাও-না-কোথাও জাহাজডুবির লোকজনদের কারু-না-কারু হদিশ মিলে যাবে।’

মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের এ-সব বুনো-হাঁসের-পেছন-ছোটায় কোনো আস্থা নেই। তিনি শুধু ফোড়ন কাটলেন : ‘অতীব-ক্ষীণ সম্ভাবনা—এবং অমূলক।’

‘এটা ভুলে যাবেন না, মেজর, যে এটাই একমাত্র সম্ভাবনা। আপনি নিশ্চয়ই চান না এক্ষুনি সবাই মিলে হাল ছেড়ে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই শুড়শুড় ক’রে। রিও কলোরাদো কিংবা রিও নেগ্রো নদীর অগুনতি শাখা বেরিয়ে গেছে মহাদেশের ভেতরে—তার কোনোটার ধারে কোনো আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের দল তাঁদের বন্দী করেছে। হদিশ পেলে, সুযোগ-সুবিধে ক’রে নিয়ে, আমরাই উদ্ধার করতে পারবো তাঁদের। তা যদি সম্ভব না-হয়, তবে পূর্ব-উপকূলে ডানকান জাহাজের কাছে পৌঁছে ফৌজের লোকজন ডাকবো—আর তখন আপনি স্বয়ং মেজর ম্যাকন্যাব্‌স, আপনিই অভিযানের নেতৃত্ব দিতে পারবেন।’

প্রস্তাবটা মোটেই হাস্যকর নয়। আর অভিযানের নেতৃত্ব পাবার সম্ভাবনাটা দেখে মেজর ম্যাকন্যাব্‌সও তাঁর সামরিক গোঁফে একবার তা দিয়ে নিলেন।

কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স তক্ষুনি টেবিলে মানচিত্র বিছিয়ে নিলেন। ডানকানকে কোথায় অপেক্ষা করতে বলা হবে, সেটাও ঠিক ক’রে নেয়া জরুরি। সব খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে তিনি প্রস্তাব করলেন : ‘আমাদের জাহাজ তাহ’লে কোরিয়েন্তেস অন্তরীপ আর সান আন্তোনিওর মাঝে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করুক।’

‘তা-ই ভালো।’

এই নূতন মহাদেশের মাঝখান দিয়ে কে-কে যাবে কাপ্তেন গ্রান্টের খোঁজে, অজ্ঞাতের সন্ধানে, অজানার উজানে, তা আলোচনা ক’রে ঠিক করা হ’লো। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্‌স-এর তো ডাঙার অভিযানে যাবার প্রশ্নই ওঠে না—তিনি যদি জাহাজে না-থাকেন, তবে ডানকান জাহাজকে সাগরপাড়ি দেবার সময় সামলাবে কে? আর লেডি হেলেনা বা মেরিরও গিয়ে কাজ নেই, পথে মেয়েদের নিয়ে বেরুলে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনেক ঝামেলাঝক্কি দেখা দিতে পারে। ইচ্ছে ছিলো, রবার্টকেও বাচ্চা ব’লে অজুহাত দিয়ে ডাঙার অভিযান থেকে নিবৃত্ত করা হয়, কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, কারু কোনো ওজর-আপত্তি শুনলে তো? শেষটায় ঠিক হ’লো জাহাজের তিনজন খালাশিকে নিয়ে স্থলপথে যাবেন লর্ড গ্লেনারভন, সঙ্গে থাকবেন মেজর ম্যাকন্যাব্‌স, জাক পাঞ্চয়ল আর রবার্ট তো আগেভাগেই ডাঙায় গিয়ে নেমে একপায়ে খাড়া।

অক্টোবরের চোদ্দ তারিখে এই সাতজনে বেরিয়ে পড়লো অভিযানে—সঙ্গে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে তিনজন ডাকাবুকো হট্টাকট্টা শক্তপোক্ত লোক, আর তাদের সঙ্গেও আছে আরেকটি ছোটোছেলে। গাইডদের সর্দার কিন্তু সত্যি বলতে স্থানীয় লোক নয়, সে একজন ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ, কবে কোনকালে—সে প্রায় বিশ বছর হ’লো—কোর্তেসদের মতো লাতিন আমেরিকায় পা দিয়েছিলো সোনারূপো হিরেজহরতের লোভে, কিন্তু লুঠতরাজ যা-যা করার আগেই তা সাঙ্গ ক’রে নিয়েছিলো কোনকিস্তাদোরেরা, ফলে আখেরে তার তেমন সুবিধে হয়নি। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে এতগুলো বছর একটানা কাটিয়ে-দেবার পর সে ইংরেজি ভাষা প্রায় ভুলতেই বসেছে, এমনকী তার নামটা শুদ্ধু এখন এস্পানিওল হ’য়ে গিয়েছে, লোকে তাকে ডাকে কাতাপাস ব’লে। যে-শৈলশিরাকে এখানকার লোকে বলে কোর্দিইয়েরা, সেই গিরিসংকট পেরিয়ে আরহেনিনার সীমান্তে গিয়ে পাম্পার কোনো গাইডের হাতে পৌঁছে দেয়াই এখন তার জীবিকা। কতকগুলো খচ্চরের পিঠে মালপত্রের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে রওনা হ’লো সবাই। এই পাহাড়ি খচ্চরগুলো—গাধা আর ঘোড়ার মিশেল—দারুণ শক্ত, পাহাড়ি চড়াই-উত্রাই ভাঙতে তাদের মতো জীব আর দ্বিতীয় যেন নেই। বাহন হিশেবে তারা চমৎকার, দিনে জল মোটে একবার খেলেই চলে, আটঘন্টায় পেরিয়ে আসে মাইল তিরিশ এবড়োখেবড়ো উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ।

এক সমুদ্রতীর থেকে আরেক সমুদ্রতীর যেতে হবে—এই বিস্তীর্ণ দুস্তর পথে কাতাপাস-এর অভিজ্ঞতা জানিয়েছে সরাই-টরাই পথে খুব-একটা পড়বে না। খেতে হচ্ছে জারানো শুখামাংস, মকাই, অথবা ভাত। ক্লান্ত শরীরকে চাঙ্গা ক’রে নেবার জন্যে জলের সঙ্গে সবাই মিশিয়ে নিচ্ছে একটু ক’রে রাম—এখানকার আখের রস নিংড়ে তৈরি করা।

পাঞয়ল পণ ক’রে বলেছেন তিনি এস্পানিওল ছাড়া আর কোনো ভাষাতেই কথা বলবেন না—ফরাশিও না, ইংরেজিও না। কিন্তু তাঁর চমকপ্রদ উচ্চারণে এস্পানিওল ভাষার যে-সংস্করণ ফুটে বেরোয়, অন্য-কেউ তা খুব-একটা বোঝে না বলেই, প্রায় বাধ্য হ’য়েই, নিজের সঙ্গেই সারাক্ষণ একটা দ্বৈতালাপ চালিয়ে যেতে হচ্ছে; অর্থাৎ, নিজেই প্রশ্ন করছেন, এবং নিজেই মুখ থেকে খসিয়ে ফেলছেন উত্তর। তার ওপর কাতাপাস মানুষটা কথা কম বলে, কাজ করে বেশি। পাঞয়লের তুবড়ির মতো প্রশ্নগুলোর উত্তরে সে হাঁ-হাঁ ছাড়া কিছুই বলে না। খচ্চরগুলোর তদারকি করছে তার দুই অনুচর : বাহনদের তাড়া লাগাবার জন্যে কখনও তারা দুর্বোধ্য কিছু আওয়াজ করে, গলা ছেড়ে চ্যাঁচায়, কখনও হাতের পাচন দিয়ে খোঁচায়, কখনও-বা ঢিল ছোঁড়ে।

তিনদিন একটানা চলার পর দূরে নীলপাহাড় দেখা গেলো। রাস্তা ক্রমেই দুর্গম ও বন্ধুর হ’য়ে উঠছে, মাঝ-মাঝেই পথে পড়ছে পাহাড়ি জলধারা, নদী না-বলেই অনেকগুলোকে পাহাড়ি সোঁতা বলাই ভালো। এদের বেশির ভাগেরই নাম এ-যাবৎ কোনো মানচিত্রে ওঠেনি, ফলে জাক পাঞ্চয়ল নতুন-নতুন নদী আবিষ্কার করার নেশায় মেতে উঠেছেন, টুকে নিচ্ছেন তাঁর খাতায়, মানচিত্রের খশড়া তৈরি করছেন, লিখে রাখছেন পাশে মানচিত্রের এক ইঞ্চি সমান অত মাইল। যে-নদীগুলোর কথা তিনি আগেই বইতে পড়েছেন, সেগুলো দেখে আর-কেউ বলার আগে, সোৎসাহে নিজেই চেঁচিয়ে ব’লে দিচ্ছেন নামগুলো। তাঁদের যাবার পথ কাটাকুটি করে আড়াআড়ি গেছে মস্ত একটা পথ, রীতিমতো রাস্তাই বানানো হয়েছে যেন, দেখেই তিনি উৎফুল্ল কণ্ঠে ব’লে উঠলেন : ‘আরে, এ-যে দেখছি লস আনহেলেসে যাবার রাস্তাটা।’

‘সত্যি নাকি?’ কাতাপাসকে জিগেস করে যাচাই ক’রে নিতে চেয়েছিলেন লর্ড গ্লেনারভন।

‘হ্যাঁ,’ তার অভ্যাসমাফিক ছোট্ট উত্তরটা দিয়েই কাতাপাস কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেনি, বরং উলটে জাক পাঞ্চয়লের দিকে ঘুরে জানতে চেয়েছে : ‘এদিকটায় এর আগে কখনও এসেছিলেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ’ ভারিক্কিচালে জবাব দিয়েছেন পাঞয়ল।

‘দলবল নিয়ে, খচ্চরের পিঠে চ’ড়ে?’

‘না। একাই। চেয়ারে ব’সে থেকেই।’

কাতাপাস এমন উত্তর শুনে একটু তাজ্জব হ’য়েই পাঞয়লের মুখের পানে তাকিয়েছে, ফ্যালফ্যাল ক’রেই তাকিয়েছে। কথাটার মানে তার মাথায় ঢোকেনি। সে-বেচারি কী ক’রে বুঝবে যে কোনো পড়ার ঘরে ব’সে-বসে বইয়ের পাতা উলটে যাওয়াও যে কারু-কারু পক্ষে সত্যির চেয়েও বেশি, আরো সত্যি, ভৌগোলিক অভিযান।

অবশ্য কথাটা তলিয়ে বোঝবার জন্যে কাতাপাস্ খুব-একটা চেষ্টাও করেনি তখন। কেননা সত্যিকার দুর্গম পথের যাত্রা তো শুরু হলো এই এখন। চলাটা আর আগের মতো সহজ নেই, বেশ কষ্টকর। এ-সব পথে যাদের চলাফেরা ক’রে অভ্যাস নেই তাদের কাছে রীতিমতো কঠিনই ঠেকবে। আর তার নীট ফল হবে এই যে চলার গতি ক’মে যাবে অনেকটাই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চড়াই ভেঙে-ওটা আদপেই সহজ কাজ নয়। প্রথম-প্রথম আবার পা ফসকে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে—আর কত-যে হোঁচট খেতে হয় তার তো কোনো লেখাজোখা নেই। আন্দেয়াস-এর গিরিপথ পেরুবার জন্যে শেষ অব্দি অনেক ভেবে কাতাপাস্ ঠিক করেছে আন্তুকো গিরিসংকট দিয়েই যাবে—তার কারণ সেটা পড়েছে নাকবরাবর, আর কে না জানে যে কোনো সিধে সরলরেখাই হ’লো হ্রস্বতম পথ, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একটাই—এবং সেটা বেশ বড়োগোছেরই মুশকিল। এই বিষম পথ ধরে খচ্চররা যায় না, আর এতটাই দুর্গম যে সিধে পথে গিয়ে সময় বাঁচাবার ফন্দিটাও হয়তো ভেস্তে যাবে। সেইজন্যেই গোড়ায় কাতাপাস্ এ-পথ দিয়ে যেতে চায়নি। কিন্তু পাঞয়লের ভৌগোলিক জ্ঞানেই সবাই নেচে উঠেছে। এটাই যদি শর্টকার্ট হয়, যদি কম পথ পেরুতে হয়, তবে এই পথেই যেতে হবে। সকলের একগুঁয়েমি দেখে কাতাপাকে শেষটায় এ-পথ দিয়ে যাবার প্রস্তাবেই রাজি হ’তে হয়েছে। ভেবেছে, নিজেরা খচ্চরের পিঠের বোঝা ভাগাভাগি ক’রে নিয়ে একটু হালকা ক’রে নিলে বুঝি এই সরু পথটা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে চ’লে যেতে পারবে; অনেকটা সেভাবে চলেছেও তারা, কিন্তু শেষটায় এমন-একটা জায়গায় এসে পড়েছে যে খচ্চররা সে-রাস্তা পেরিয়ে যেতেই পারবে না, আর জীবজন্তুরা সহজেই টের পেয়ে যায়, কী ক’রে যেন তারা বুঝে ফেলেছে এ-পথ দিয়ে যেতে গেলেই তারা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে। তারাও জেদ ধ’রে দাঁড়িয়ে পড়েছে, একপাও যাবে না আর। একটা কারণও অবশ্য আছে : দক্ষিণ গোলার্ধে সবই তো উত্তর গোলার্ধের চাইতে একেবারেই উলটো। এখনই এখানে বসন্ত—পাহাড়ের গায়ের জমানো তুষার এখনই মাঝে-মাঝে গ’লে যেতে থাকে—আর পাহাড় থেকে ধস নামে। মাটি নরম হ’য়ে যায়, আলগা হ’য়ে যায়, খ’সে পড়ে। সেইজন্যেই কাতাপাস্ এতটা অনিচ্ছুক। এবার আর কাতাপাস্ কোনো অনুরোধ উপরোধ শোনেনি। তার খচ্চরগুলো আর সাঙাৎদের নিয়ে সেখান থেকেই সেলাম ঠুকে বিদায় নিয়েছে। যাবার আগে সে বলেছে, সবাই যদি তিনদিনের পথ পেছিয়ে যায়, তবে একটা ঘোরাপথ দিয়ে সে তাদের নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু লর্ড গ্লেনারভনরা রাজি হননি : এতটা এসে আর পেছিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। অগত্যা কাতাপাস্ তার সাগরেদদের নিয়ে বিদায় নিয়েছে, আর এঁরা নিজেরাই মালপত্র ভাগাভাগি ক’রে নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠেছেন—ভাগ্যিস, সঙ্গে ডানকান জাহাজের বিশ্বস্ত খালাশি তিনজন ছিলো।

পথে অনেক জন্তুজানোয়ার তাঁদের চোখে পড়েছে। এ-সব জন্তুজানোয়ারের অনেকগুলোই তাঁদের অচেনা। তবে এমন-কোনো শুওর তাঁরা চোখে দ্যাখেননি যাদের নাভিকুণ্ডলী ছিলো তাদের পিঠে, কিংবা এমন পাখিও দ্যাখেননি যাদের পা নেই, অথবা মেয়ে-পাখিগুলো ডিম পেড়ে তা দিচ্ছে পুরুষপাখিগুলোর পিঠে, কিংবা এমন প্রাণীও দ্যাখেননি যাদের বৃদ্ধি আচমকা থেমে গিয়েছে আর তারা সব এর-ওর-তার কাছ থেকে শরীরের সব জিনিশ নিয়েছে—যেমন তাদের মুণ্ডু আর কানগুলো খচ্চরের মতো, শরীরগুলো উটের, পাগুলো হরিণীর, আর চিঁহি-চিঁহি ডাকটা ঘোড়ার। সারা রাস্তা বকবক করতে-করতে এসেছেন পাঞয়ল। বলেছেন ক্রিস্তোবাল কোলোনরা—পিগাফেত্তারা—কেবল গুল ঝেড়েছেন, আর নয়তো মেস্কাল খেয়ে নেশার ঝোঁকে আজব-সব জীবজন্তু দেখেছেন। এই দুর্গম পথে জীবজন্তুর দেখা পাওয়াই তো বিস্ময়কর—তার ওপর আবার এ-সব কিস্তৃত জীব, যা মানুষ শুধু চোখে দ্যাখে কল্পনায়-কল্পনার লাগামছেঁড়া উড়ালে। ‘জানেন,’ পাঞয়লের মুখে ছিলো একটাই বুলি, ‘এইসব আজগুবি জিনিশ লিখে এঁরা সবাই আমাদের—আধুনিক ভৌগোলিকদের—জীবনটাই দুর্বিষহ ক’রে তুলেছেন। এঁদের বিশ্বাস করলে তো নিজের ওপর থেকেই বিশ্বাস হাপিশ হয়ে যাবে।’

যত ওপরে ওঠা যাচ্ছে হাওয়া লঘু হ’য়ে আসছে, হালকা, আর নিশ্বাস নিতে গিয়ে অস্থি-অস্থির লাগছে, বুকের খাঁচাটাই যেন ফেটে যাবে, মাঢ়ি ফেটে বেরিয়ে এসেছে রক্ত, ঠোঁট ফেটে গিয়েছে। রবার্ট এমনি কাহিল হ’য়ে পড়েছে যে শেষটায় ডানকান এর একজন খালাসিকে তাকে কাঁধে ক’রে ব’য়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। অবশেষে—ঠিক কখন, খেয়াল করার মতো অবস্থা তখন কারু নেই—তখন কেউ খাড়া হ’য়ে হাঁটতেও পারছে না আর, প্রায় হামাগুড়ি দিয়েই এগুতে হচ্ছে, এমনি অবস্থায়, অবশেষে—দূরে ছোট্ট একটা ফুটকির মতো দেখা গেলো কার একটা পোড়ামাটির বাড়ি, আদোবা বাড়ি বলে তাকে এখানকার স্থানীয় লোকেরা।

আন্দেয়াসের চিরতুষারের মধ্যে প্রায় যেন চাপা প’ড়ে গিয়েছিলো এই আদোবা। কিন্তু ফৌজের লোকেদের নজরদারি খুব তীক্ষ্ণ হয় ব’লেই বোধহয় মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের চোখেই পড়েছিলো কুঁড়েবাড়িটা।

কোনোরকমে তুষার সাফ ক’রে চাঁই-চাঁই জমাট তুষার সরিয়ে সেখানেই রাতটা কাটাবার ব্যবস্থা করা হ’লো। ইন্ডিয়ানরা ভালোই জানে পোড়ামাটি দিয়ে কেমন ক’রে দেয়াল বানালে শীত ঠেকানো যায়, তাই তুষারের মধ্যে আদোবা বাড়িগুলো মোটামুটি স্বচ্ছন্দ একটা আস্তানা দেয়।

তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিলো চূড়ার আড়ালে। এদিকে এখনও সুপ্ত-জাগ্রত কত আগ্নেয়গিরি আছে। দক্ষিণের আগ্নেয়গিরির মুখটার ওপর আগুনের হলকা, লেলিহান লোল রক্তজিহ্বা, আর তারই প্রতিফলন ঝিকিয়ে উঠেছে বরফের স্তূপের ওপর, আর সেই সঙ্গে ঝলসাচ্ছে ডুবে-যেতে-থাকা সূর্যের শেষরশ্মিগুলো। ভয়ংকরের সম্ভাষণ যে এমন নয়নাভিরাম রূপ নিতে পারে, তা চোখে না-দেখলে হয়তো কেউই বিশ্বাস করতো না। কোনো আশঙ্কারও যে এমন সৌন্দর্য হয়, তা কে জানতো?

ভীষণ শ্রান্ত লাগছিলো সকলের। ঠিক হয়েছিলো, তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে পূর্ণ বিশ্রাম নেবে সবাই। কিন্তু খেতে ব’সেই সবাই কি-রকম আঁৎকে উঠলেন। বাইরে ঐ ধুপধাপ আওয়াজ কিসের? এমন প্রচণ্ড আওয়াজ? তুষার ধ’সে পড়ছে নাকি চূড়া থেকে? খাওয়া মাথায় উঠলো, সবাই ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

না, তুষারধস নয়—জন্তুর দল। তীব্রগতিতে ছুটে আসছে, পালে-পালে। দৃকপাতহীন তাদের ধাবমান পায়ের তলায় পড়লে আর দেখতে হবে না—সেখানেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে। দেখেই সবাই মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। মেজর ম্যাকন্যাব্‌স ঘর থেকে ছুটে বেরুবার সময় তাঁর শয়ন-স্বপনের সঙ্গী বন্দুকটা সঙ্গে আনতে ভোলেননি। তিনি তাঁর বন্দুকের ঘোড়া টিপলেন, জন্তুদের পালের মধ্য থেকে একটি জন্তু মাটিতে আছড়ে পড়লো, বাকি সবাই দৃকপাতহীন ধুপধাপ ক’রে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেলো।

তাদের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসেছিলেন পাঞয়ল। জন্তুগুলোকে ছুটে আসতে দেখে তিনিই সর্বাগ্রে ছিটকে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, চশমা খুলে প’ড়ে গিয়েছিলো পাশে। হাড়ে চশমাটা খুঁজে নিয়ে নাকের ডগায় বসিয়ে দিয়ে মৃত জন্তুটাকে নিরীক্ষণ ক’রেই তিনি উৎফুল্ল কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘আরে! গুয়ানাকো! বাঃ! তোফা!’

‘গুয়ানাকো?’ সে আবার কী?’ ততক্ষণে রবার্টও উঠে বসেছে।

‘গুয়ানাকো দক্ষিণ আমেরিকার লামাগোছের জীব। ওপরে ঐ নরম হালকা পাটকিলে লোমগুলো দেখেছো? খুব ভালোজাতের পশম হয় ওতে। গুয়ানাকোরা উটের বংশেরই কেউ হবে—তাদেরই জ্ঞাতিগুষ্টির কেউ, তবে কুঁজ নেই। কিন্তু এর মাংস খেতে ভারি ভালো—খুবই সুস্বাদু।’

আপনি জানলেন কী করে? আগে চেখে দেখেছেন বুঝি?’

‘না, চেখে দেখিনি, তবে বইয়ে পড়েছি। চকৎকার হ’লো, জারানো শুখামাংসের বদলে গুয়ানাকোর মাংসই খাওয়া যাবে। আমিই রসুই পাকাবো কিন্তু।’

সঙ্গে-সঙ্গে মাংস কাটাকুটি ক’রে রান্নার তোড়জোড় শুরু হ’য়ে গেলো। একটু আগেই ক্লান্তি লাগছিলো সকলের, এখন এই উত্তেজনার পর টাটকা মাংস খাবার লোভে সবাই যেন হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

রান্না তো হ’লো, কিন্তু মুখে দিয়েই–থুঃ থুঃ! শক্ত আঁশের তৈরি ছিবড়ে যেন, রসকষহীন, একেবারেই বিস্বাদ।

পাঞয়ল তাঁর কেতাবি বিদ্যার এমন সমূহ উৎখাত দেখে একটু যেন ভাবনাতেই পড়লেন। কিন্তু একটা কৈফিয়ৎ খাড়া ক’রে দিতে তাঁর আবার বেশিক্ষণ লাগে না কি? লাফিয়ে উঠে বললেন : ‘ওহো, বুঝেছি! অ্যাদ্দুর থেকে ছুটে এসেছিলো ব’লে মাংসটা এমন খারাপ লাগছে—শুধু শুকনো পেশী ব’লেই মনে হচ্ছে—গুয়ানাকোর মাংস খেতে তখনই ভালো লাগে যখন সে স্থির থাকে—’

‘কিন্তু এতগুলো গুয়ানাকো দল বেঁধে এমনভাবে ছুটে আসছিলো কেন?’ রবার্ট জিগেস করলে : ‘তারা কি এমনি প্রাণের ভয়ে পড়িমরি ক’রে সবসময় ছোটে নাকি? ‘ নিশ্চয়ই ছোটে না সবসময়। তবে এখন কেন দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে আসছিলো,সেটা কেমন-একটা ধাঁধার মতোই ঠেকলো, কী-একটা অজানা রহস্য আছে যেন এর ভেতর।

তখনই অবশ্য ধাঁধাটার কোনো সমাধান হলো না। রহস্যটা ভেদ করা গেলো অনেক রাত্রে। গুম গুম গুম…প্রচণ্ড গড়িয়ে-যেতে-থাকা গুম গুম শব্দে সকলের ঘুম ভেঙে গেলো।

ভূমিকম্প না কি? আদোবা বাড়িটা অমন দুলছে কেন?

ঘুম ভেঙে আঁৎকে জেগে উঠে আতঙ্ক আর হতভম্ব দশার এক মিশ্র অনুভূতি তখন সকলের। দেখা গেলো দরজার পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অন্ধকার! তার মানে?

তার মানে ধস নেমেছে।

আদোবা বাড়িটা সমেত পাহাড়ের একটা মস্ত অংশ প্রচণ্ড বেগে নেমে চলেছে নিচে।

কতক্ষণ যে সবাই ভয়ে চোখ বন্ধ ক’রে ছিলো কেউ জানে না—মাঝে-মাঝে একটা থমথমে মুহূর্তকেও মনে হয় অনেকটা সময়। কিন্তু যতক্ষণই কেটে থাকুক না কেন, সংবিৎ ফিরলো আকাশবাতাসফাটানো একটা ভয়াবহ আওয়াজে। ঘরের মধ্যে কে কোনদিকে ছিটকে পড়লো ঠিক নেই। কারু মাথা ঠুকে গেলো দেয়ালে, কারু-বা হাত-পা পড়লো বেকায়দায়। আর…কী-যে হচ্ছে সেটা বোঝবার মতো সজাগ মনও কারু যেন ছিলো না।

সকলের আগে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মেজর ম্যাকন্যাব্‌স–সামরিক বাহিনীতে নবীশী করার পর কেউ হয়তো অন্যদের চাইতে সহজেই সমস্ত ধকল, সমস্ত ঝড়ঝাপটা সইতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখলেন মাটিতে-প’ড়ে-থাকা অন্যদের চিৎ-উপুড় শরীরগুলো।

কে যেন নেই—?

ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখলেন ম্যাক্‌ন্যাস। না, সকলেই আছে, কিন্তু শুধু রবার্টকেই কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না।

কোথায় গেলো তবে রবার্ট? ঘরশুদ্ধ সবাই ছিটকে, ঢাল বেয়ে, ধসের সঙ্গে নিচে নেমে এসেছে। রবার্ট কি তখন ঘরে ছিলো না? কোথায় গিয়েছিলো ঘর ছেড়ে—রাত-বিরেতে? রবার্টকে সঙ্গে না-নিয়ে কাপ্তেন গ্রান্টের কাছে গিয়ে তাঁরা মুখ দেখাবেন কী ক’রে? কে-একজন বললে, ‘ধস নামার একটু আগেই রবার্টকে দেখা গিয়েছিলো ঘাসের চাপড়া সজোরে জাপটে থাকতে! অর্থাৎ : বাঁ দিকে অন্তত দু-তিন মাইল জমি খুঁজে দেখা দরকার। কিন্তু তারও আগে প্রশ্ন : এখন তাঁরা এ-কোথায় ছিটকে এসে পড়েছেন?

আন্দেয়াসের পুবদিকের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে লর্ড গ্লেনারভনের দল চিলে থেকে সরাসরি চলে এসেছেন আরহেন্তিনায়—আন্দেয়াসের শিখরে চিরতুষার থেকে একেবারে বিস্তীর্ণ সবুজে। তাজ্জব কাণ্ড! এমনই আশ্চর্য যে কয়েকদিনের পথ কেউ যেন আরব্য উপন্যাসের জাদুগালচেয় ক’রে উড়ে নিয়ে এসে পার ক’রে দিয়েছে। অবশ্য জাদুগালচেয় ক’রে শূন্যে পাড়ি দেবার মতো মসৃণ-নিরাপদ ছিলো না ব্যাপারটা, তবে ভূমিকম্পে যখন ধস নেমেছিলো তখন একটা মস্ত ধসই তাঁদের আদোবা বাড়িশুদ্ধু অমনভাবে অতটা পথ-পার ক’রে নিচে নামিয়ে এনেছে—প্রায় আলগোছেই বলা যায়। ফটফটে শাদা বরফের বিস্তারের পর এখানে চারদিকে যেন সবুজের উৎসবের একটা ঢল নেমেছে—চোখ না-ধাঁধিয়ে দিয়ে চোখ যেন জুড়িয়েই দিচ্ছে সেই সবুজ।

কিন্তু প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে-করতে প্রকৃতির এই আশ্চর্য কীর্তি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তাঁদের নেই এখন। প্রথম কাজ—এবং এইমুহূর্তে একমাত্র কাজ—যে-করেই হোক রবার্টকে খুঁজে বার-করা। অথচ চারপাশে তন্নতন্ন ক’রে খুঁজেও রবার্টের কোনো সন্ধানই পাওয়া গেলো না। আস্ত, গোটা দিনটা কেটে গেলো-—কিন্তু কোথাও তার কোনো হদিশ নেই, এমনকী এমন-কোনো সূত্র অব্দি কোত্থাও নেই যার সাহায্যে অন্তত একটা আন্দাজ করা যায় যে রবার্ট কোথায় আছে। বিষম বিমর্ষ হ’য়ে পড়লেন লর্ড গ্লেনারভন : দায়িত্বটা তাঁরই, কী বলবেন গিয়ে তিনি মেরিকে? নিরুদ্দিষ্ট বাবাকে খুঁজতে এসে ছেলেও না-পাত্তা। তাছাড়া অপঘাত মৃত্যুরও একটা সম্ভাবনা আছে—কিন্তু ধস নেমে রবার্ট যদি ম’রেও গিয়ে থাকে, তবে তার মৃতদেহটা কোথাও নিশ্চয়ই থাকবে। লর্ড গ্লেনারভন কিন্তু সারারাত ধরে খুঁজে চললেন, পাহাড়ের ঢালে, সমতলে কখনও নাম ধ’রে চেঁচিয়ে ডাকেন, কখনও হতাশায় গুম হয়ে যান—কিন্তু তাঁর ডাকাডাকিতে কারুই কোনো সাড়া আসে না।

পরদিন সকাল কেটে গিয়ে এলো দুপুর—কিন্তু লর্ড গ্লেনারভন কিছুতেই এ-জায়গাটা ছেড়ে নড়তে চান না। যদি রবার্ট নিজে খোঁজ নিতে এদিকে আসে? বেঁচে আছে তো বেচারা?

কিন্তু এই জনশূন্য নিঃঝুম জায়গায় কতক্ষণই বা কাটাবেন তাঁরা? খাবারও ফুরিয়ে এসেছে—শুকনো জারানো মাংস যা ছিলো তা কোথায় ছিটকে পড়েছে। বিস্বাদ ব’লে গুয়ানাকোর মাংসও তাঁরা তখন রাখেননি। এই অবস্থায় অন্তত খাবারের খোঁজেও এখানকার পাট উঠিয়ে যেতে হয়—না-হলে সবাই যে অনাহারে মরবে!

মেজর ম্যাকন্যাব্‌সও বিষম মুষড়ে পড়েছিলেন, কিন্তু রবার্ট ছাড়া এখানে তো অন্য আরো অনেকে আছে। অভিযানের নেতা হিশেবে গ্লেনারভনের তো তাদের কথাও ভাবা উচিত। ম্যাকন্যাবস নিজের মনের ভাব চেপে একটু কড়া সুরেই বললেন : ‘আর না—এবার এখান থেকে চলো।’

‘হ্যাঁ, যাবো তো বটেই, তবে আর একটু——’

এমন সময়ে আকাশে ঐ কার বিশাল ছায়া? দ্রুত ধাবমান—এই দিকেই? ভালো ক’রে তাকিয়ে বোঝা গেলো : কণ্ডর : লাতিন আমেরিকার আকাশের রাজা, বিশাল পাখি কণ্ডর!

পাঞয়ল তাকিয়েই ব’লে উঠলেন : ‘এ তো দক্ষিণ আমেরিকার গৃধিনী—কণ্ডর — বিশাল এই পাখির একটা পোশাকি কেতাবি নাম আছে অবশ্য—ভুলতুর গ্রাইফাস-এ তো থাকে আন্দেয়াসের ওপর, মাথা আর ঘাড়ে কোনো লোম বা পালক নেই। আর সারা গায়ের পালক কেমন নিরেস কালো, শুধু গলাটা শাদামতো, ডানায় মাঝে-মাঝে শাদা ছোপ থাকে। ইনকারা তো কণ্ডরের পুজো করে প্রায়—তাদের পুরাণে-উপকথার এর কথা কত আছে! এমন শিকারি পাখি আইরির ঈগলও নয়—হাজার-হাজার ফুট ওপর থেকেও দেখতে পায় নিচে কোথায় ছোট্ট শিকার ঘুরছে। ছোঁ মেরে নিচে নেমেই আস্ত-সব ভেড়া, ছাগল, গুয়ানাকো উড়িয়ে নিয়ে যায় পাহাড়চূড়ায় নিজের আস্তানায়।’—

পাঞয়ল হয়তো তাঁর পুঁথিপড়া বিদ্যে জাহির করেই চলতেন, কিন্তু অন্যরা তখন চোখ ছানাবড়া ক’রে দেখছেন কেমন ক’রে সেই বিশাল কণ্ডর বৃত্তের মতো গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে নামছে নিচে, বাঁ দিকে। তবে কি শিকারের জন্যেই তার এই বিদ্যুৎক্ষিপ্র ছোঁ? কে এই শিকার? রবার্ট?

ম্যাকন্যাবস তাঁর বন্দুক বাগিয়ে টিপ করছিলেন, কিন্তু ঘোড়া টেপবার আগেই পাহাড়ের আড়ালে সেই কণ্ডর উধাও হয়ে গিয়েছে। সবাই ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রইলো সে যেদিকে গেছে, সেদিকে। একটু পরেই তাকে দেখা গেলো আবার, সোঁ ক’রে ওপরে উঠেছে, তার থাবায় ঝুলছে কে-একজন, ছটফট করছে। প্রায় চোখের পলকেই সে দুশো আড়াইশো ফুট ওঠে গেছে ওপরে।

লর্ড গ্লেনারভনও বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছিলেন, গুলি ছুঁড়তে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপছে তখন, যদি ঐ দেহটা রবার্ট হয়, যদি তার গায়ে গিয়ে গুলি লাগে! ম্যাক্‌ন্যাবস ততক্ষণে ঘোড়ায় চাপ দিতে যাচ্ছেন, কিন্তু ঘোড়া টেপবার আগেই দূর থেকে বন্দুকের আওয়াজ ভেসে এলো। সোজা গিয়ে গুলি লেগেছে কণ্ডরের গায়ে। জখম, গুলি-বেঁধা কণ্ডর থাবার বোঝা নিয়েই ঘুরে-ঘুরে আস্তে এসে নেমে পড়েছে নদীর ধারে।

পড়িমরি ক’রে ছুটে গেলেন সবাই। কণ্ডরের ঠিক মাথায় গিয়ে গুলি লেগেছে। বন্দুক যেই ছুঁড়ে থাকুক, তার লক্ষ্য ছিলো অব্যর্থ! আর কণ্ডরের ডানার পালকের মধ্যে নিঃঝুম অচেতন প’ড়ে আছে রবার্টের মাথা। কাঁপা হাতে রবার্টকে টেনে বার ক’রে নিয়ে এলেন লর্ড গ্লেনারভন। বুকে কান পেতে শুনতে পেলেন অস্ফুট ক্ষীণ ধুকধুক আওয়াজ। অমনি আবেগে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বেঁচে আছে—প্রাণের সাড়া আছে এখনও বেঁচে আছে!’

ম্যাকন্যাব্‌স গিয়ে চট করে পাহাড়ি নদী থেকে জল এনে রবার্টের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলেন।

আস্তে-আস্তে চোখ মেলে তাকালে রবার্ট, কেমন ঘোর-লাগা দৃষ্টি, যেন কিছু‍ই সে এখনও বুঝতে পারছে না। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফ্যালেন বুঝি গ্লেনারভন। তিনি জ্ঞান হারাননি বটে, কিন্তু তাঁরও মাথার মধ্যেটা কেমন করছে, কিছুই বুঝতে পারছেন না যেন তিনি।

গুলিটা তো তাঁরা করেননি—তবে গুলিটা করলে কে? কার এমন অচঞ্চল হাত, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা?

তার উত্তর অবশ্য পাওয়া গেলো তক্ষুনি। হাত-পঁচিশ দূরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো তাকে। যেন পাথরে-খোদাই-করা, পাহাড়ের গায়ে-বসানো কোনো কিংবদন্তির রাজা।

ছ-ফিটের ওপর লম্বা ঋজু সটান দেহ, কেশরের মতো চুলের ঢাল ফিতে দিয়ে বাঁধা, কপালে শাদা রং লেপা, মুখে লাল রং, দু-চোখের পাশে কালো-রঙের ছোপ। গায়ে পশুলোমের কুর্তা, পায়ে মোটা চামড়ার বুটজুতো, হাঁটু অব্দি ফিতে দিয়ে বাঁধা।

তার পায়ের কাছে প’ড়ে আছে বন্দুক।

তাকাবামাত্র বোঝা যায় কী-প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব তার। চোখমুখ থেকে বুদ্ধির দীপ্তি ফুটে বেরুচ্ছে।

চমকটা ভাঙতেই লর্ড গ্লেনারভন এগিয়ে গিয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন—তাঁর বিহ্বল দৃষ্টি, আর মুখের ভাবই কৃতজ্ঞতা এমনভাবে ফুটিয়ে রেখেছে কারুই সেটা বুঝতে দেরি হয় না। গিরি আন্দেয়াসের এই রাজারও তা বুঝতে দেরি হয়নি।

পাঞয়লও তখন এগিয়ে এসে তড়বড় করে এস্পানিওলে কত-কী ব’লে ফেলেছেন। কিন্তু সে-সব কথার কিছু যে এই রাজা বুঝতে পেরেছে এমন-কোনো ইঙ্গিত অবশ্য পাওয়া গেলো না। মেজর ম্যাকন্যাব্‌স তাঁর ভাঙা-ভাঙা এস্পানিওলে একটা কথা ব’লেই বুঝতে পেরেছিলেন এই বিশাল মানুষটা এস্পানিওল জানে। আর তাই পাঞয়ল যখন কথার তুবড়ি ছুটিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন সংলাপ হবে—কথার জবাবে কথা, কিন্তু পাঞয়ল অনেক চেষ্টা করেও তাকে তাঁর কোনো কথা বোঝাতে পারলেন না।

‘কিছুই বুঝছে না কেন আপনার কথা?’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের গলার সুরে এবার একটু ব্যাঙ্গের সুর!’ এখনও এস্পানিওল উচ্চারণ আপনার রপ্ত হয়নি? আপনি কি এখনও ফরাশিতে এস্পানিওল ব’লে যাচ্ছেন?’

পাঞয়ল এতক্ষণ কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছিলেন, মেজরের কথা শুনে একটা বাক্যের মাঝখানেই থেমে পড়লেন। পকেট থেকে একটা দোমড়ানো বই বার ক’রে বললেন, ‘কেন-যে এত গণ্ডগোল হচ্ছে বুঝতে পরেছি না তো? বই প’ড়ে কি আর উচ্চারণ শেখা যায় না? এত ভালো একখানা বই, ধ্রুপদী—মহাকাব্যই—এই-যে এই দেখুন, উশ লিসিয়াদাস্—’

এবার একটু আঁৎকেই উঠলেন লর্ড গ্লেনারভন। ‘এ আপনি করেছেন কী, মঁসিয় পাঞয়ল? এ-যে পোর্তুগিজ মহাকাব্য—ভাশকু ডা গামার ভারতবর্ষের পথে বেরিয়ে পড়ার কাহিনী আছে যে এতে—লুইস ভাজ্‌ তে কামোয়েন্স-এর লেখা—উনি তো ষোড়শ শতাব্দীর পোর্তুগিজ কবি—’

‘অ্যা?’ আঁৎকে উঠলেন স্বয়ং পাঞয়লও, সম্ভবত জীবনে এই প্রথমবার। ‘সে কী? আমি কি তাহ’লে এস্পানিওল মনে ক’রে এতদিন শুধু পুর্তুগিশই ব’লে গেছি? তাই তো বলি, আমি এত কথা ব’লে যাচ্ছি অথচ কেউ কিছু বুঝছে না কেন? যাক, তাতে আর কী হ’লো—এবার ব্রাজিলে গেলেই আমার এই ভাষা শেখা কাজে দেবে—’ ব’লেই পাঞয়ল হেসেই কুটিপাটি। বইয়ের ভেতরটা টীকার সাহায্যে তন্নতন্ন করে পড়েছেন—অথচ কখনো খেয়াল করেও দ্যাখেননি ভাশকু ডা গামা কোন দেশের লোক—অথবা বহু-ব্যবহারে-মলিন ও হলুদ-হ’য়ে যাওয়া বইটা কোন ভাষায় লেখা

শেষটায় অবশ্য নির্ভর হ’লো মূকাভিনয়-আকারে-ইঙ্গিতে, কিঞ্চিৎ কণ্ঠনিঃসৃত আওয়াজ ইত্যাদি মারফৎ এই পাহাড়ি মানুষটার নাম জানা গেলো—ইনি না-থাকলে আজই রবার্টের ভবলীলা সাঙ্গ হ’তো। তার নাম নাকি ত্রোনিদো, অর্থাৎ বজ্রশব্দ, সম্ভবত ইন্ডিয়ানদের ভাষা থেকে তর্জমা করেই এই ত্রোনিদো নাম দেয়া হয়েছে তাকে। পেশায় সে গাইড। আরহেনতিনার বিশাল প্রেয়ারি, যার নাম তাদের ভাষায় পাম্পা, ক্রোনিদো সানন্দেই তাদের সঙ্গে গিয়ে পার ক’রে দিয়ে আসতে রাজি হলো। মার্কিন মুলুকে যাদের নাম কাউবয়, আর্হেনতিনার ভাষায় তারাই গাউচো; ত্রোনিদো গাউচোই ছিলো, বিশাল একটা র‍্যানচের ভার ছিলো তার ওপর। কিন্তু তার পায়ে বোধহয় কুট ক’রে কামড়েছিলো কোনো ঘুরঘুরে পোকা, একজায়গায়—তা সে যত বিশালই হোক—আটকে না-থেকে সারা পাম্পাস-এ ঘুরে-ঘুরে বেড়াবার জন্যেই সে গাইডের কাজ নিয়েছে। এখানকার বুনো ঝোপঝাড়ের পাতা ছেঁচে রবার্টের জখমে তার রস লেপে দিয়ে সে রবার্টকে কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঙ্গা করে তুললো। তারপর সবাই এত উত্তেজনার পর একটু বিশ্রাম ক’রে যখন সুস্থ হ’য়ে উঠেছে, তখন সে তাদের সবাইকে নিয়ে গেলো মাইল-চারেক দূরের এক পুয়েবলোতে—ছোট্ট জনপদ, গ্রামই বলা যায়, ছোটোছোটে। আদোবা বাড়ি, তাতে বাস চাষীদের, প্রধানত ভুট্টাই ফলায় তারা—আর ঘোড়ায় চ’ড়ে পাম্পায় টহল দিয়ে বেড়ায়। তাদের সঙ্গে দরাদরি করে অভিযাত্রীদের সে কিনিয়ে দিলে সাতটা টগবগে ঘোড়া। নিজে সে অবশ্য কোনো ঘোড়া কিনলো না—তার দরকার নেই, নিজের ডেরায় তার আস্তাবল আছে, তবে বনে যখন শিকারে বেরোয় তখন সে কোনো ঘোড়া সঙ্গে নেয় না।

সেদিন সন্ধেবেলায় দেখা গেলো পুর্তুগিশ ভাষার চর্চা আপাতত মুলতুবি রেখে জাক পাঞ্চয়ল ত্রোনিদোর কাছে এস্পানিওল ভাষা শিখতে লেগে গিয়েছেন—কাস্তিইয়ের রাজা-রাজড়ার আভিজাত্যে ভরা আধো-আধো থ-থ ভরা এস্পানিওল নয়-লাতিন আমেরিকার কোন্‌কিস্থাদোরেরা এস্পানিওলকে সংস্কার ক’রে অনেকটাই নিজেদের মতো ক’রে নিয়েছে—পাঞয়ল এখন শিখতে শুরু করেছেন তাদেরই ভাষা।

৮. পাম্পার বিশালে

পরদিনই ত্রোনিদোর নির্দেশমতো অভিযাত্রীরা আরো-পুবের দিকে রওনা হ’য়ে পড়লেন।

পথে বেরিয়েই বোঝা গেলো ত্রোনিদো তার জন্যে কোনো ঘোড়া এখন চায়নি কেন। জঙ্গলের কাছে এসে মুখ থেকে বার করলে লম্বা একটানা এক অদ্ভুত আওয়াজ,লম্বা একটানা শিস যেন—আর অমনি জঙ্গলের মধ্যে থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো আরহেনতিনার এক আশ্চর্যসুন্দর ঘোড়া, পেশল-মসৃণ দেহ, যেন গতিকেই কেউ একটা চামড়ার খাপে পুরে দিয়েছে, সে যখন কদম-কদম হাঁটে, তখনই তাঁর বলিষ্ঠ পেশীগুলো রোদ্দুরে হালকা ঢেউয়ের মতো নেচে-নেচে ওঠে।

ঘোড়া ছিলো বলেই যতক্ষণ সূর্য মাথার ওপর রইলো, ততক্ষণ ঘোড়া ছুটিয়ে—জোরে নয়, মোটামুটি দুলকিচালে চ’লেই—পেরিয়ে-আসা গেলো আটত্রিশ মাইল পথ। রাতের বেলায় এক নদীর ধারে ছাউনি ফেলে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করা হ’লো, ঠিক হ’লো পরদিন ভোরেই ফের রওনা হওয়া হবে।

পরদিন দুপুর অব্দি আগের দিনের মতোই তারা এগিয়েছে, কিন্তু হঠাৎ দেখা গেলো দূর থেকে ধোঁয়ার মতো কী-একটা তীব্র ঘূর্ণি তুলে এগিয়ে আসছে। শুকনো হাওয়ার ঝড়। তোড়ে ব’য়ে যায় এই হাওয়া পাম্পার ওপর দিয়ে। প্রায় লু-র মতোই তপ্ত। অন্তত ব্যারোমিটারে পারদের চড়চড় করে ওপরে-ওঠা দেখে পাঞয়লের ‘তা-ই মনে হ’লো।

পাঞয়লের মুখে তাই ব’লে কোনো শঙ্কার ছাপ নেই, বরং অন্যদেরও তিনি আশ্বাস দিলেন, বললেন, ‘ভয় নেই। পারা যদি নিচের দিকে নামতো তবে বোঝা যেতো যে হারিকেন শুরু হ’য়ে গেছে—সেই ঘূর্ণিঝড় তিনদিনের আগে থামতো কি না সন্দেহ। পথে যা-ই পেতো তাকেই উড়িয়ে দিয়ে দূরে আছড়ে ফেলতো। কিন্তু এ নেহাৎই শুকনো হাওয়ার খেলা, একটুক্ষণ সব তোলপাড় করবে, তারপর যেমন আচমকা এসেছিলো তেমনি আচমকা চ’লে যাবে। ব্যারোমিটারে যখন পারা উঠছে, তখন বোঝা যাবে এই ঝড় থেমে যাবে শিগগিরই–কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।’

‘আপনি জানলেন কী ক’রে?’

‘হুঁ-হুঁ, তার জন্যে কেতাব পড়তে হয়। অভিযাত্রীদের রোমাঞ্চকর কাহিনী।‘

‘যা পড়েন সব মনে থাকে নাকি আপনার? আপনি কি নিজেই জ্যাম্ভ-একটা বই হ’য়ে উঠেছেন?’

পাঞয়লের মনে হ’লো এ-কথাটা আসলে তাঁর মস্ত প্রশংসা বই আর-কিছু নয়। খুশি হ’য়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘বেশ, যা বললুম তা মিলিয়ে নেবেন।

পুর্তুগিশ ভাষাকে খেয়াল না-করে এস্পানিওল ভেবে চর্চা ক’রে আসছিলেন অ্যাদ্দিন; গল্পের বইতে ঠিক যেমন কোনো অন্যমনস্ক অধ্যাপকের কথা পড়া যার—ঐ সেই যিনি নাকের ডগায় চশমা থাকা সত্ত্বেও নিজের চশমা খুঁজে বেড়ান—তেমনি একটি ভূমিকায় আবারও অনিচ্ছুক ভূমিকা গ্রহণ ক’রে একটু হয়তো-বা মুষড়েই পড়েছিলেন জাক পাঞ্চয়ল। পরে অবশ্য ত্রোনিদোর কাছে এস্পানিওল শিখতে-শিখতে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এই ব’লে যে, ‘যাক, এই সুযোগে প্রায় মুফতেই পুর্তুগি ভাষাটাও শেখা হ’য়ে গেলো।’ কিন্তু তবু যৎকিঞ্চিৎ মনমরাই ছিলেন বইকি পাঞয়ল। এখন এই শুকনো ধুলোর তুফান সম্বন্ধে তাঁর পুথিপড়া জ্ঞান ফলিয়ে মনে-মনে তিনি আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলেন খানিকটা—তবে একটা ভয় কি মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো না? যদি তাঁর কেতাবি বিদ্যেটা না-ফলে? কিন্তু ঐ-যে বলেছিলেন জাঁক দেখিয়ে, ‘বেশ, যা বললুম, মিলিয়ে দেখে নেবেন,’ সেটা কিন্তু শেষ অব্দি সত্যিই হ’য়ে গেলো। ঝড়টা অভিযাত্রীদের কাছে এলো সন্ধেবেলায়, আর মিলিয়ে গেলো কয়েক ঘন্টা পরে, রাত একটায়, সবকিছুর ওপর পুরু সরের মতো ধুলোর একটা আস্তর বিছিয়ে রেখে। আর তারপর থেকে তাঁকে আর পায় কে? তাঁর উৎসাহ তারপর থেকে টগবগ ক’রে ফুটে উঠেছে। এই অজানা বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাড়ি দিতে-দিতে প্রায়-একটা জ্যান্ত বইয়ের মতোই তিনি গাছপালা পাহাড়-পর্বতের নাম শুনিয়ে গেছেন। আর তা শুনে সবচেয়ে অবাক হয়েছে ক্রোনিদো, প্রায় বোমকেই গেছে সে, মুখে অবশ্য কিছু বলেনি—এদিক থেকে সে পাঞয়লের ঠিক উলটো, প্রায় সবসময়েই মুখে কুলুপ এঁটে থাকে, নেহাৎ দরকার না-হ’লে টু শব্দটিও করে না আর তাও যখন পাঞয়লকে ভাষা শেখাতে হয়, শুধু তখনই। কিন্তু পরে একটা সময় এসেছে, যখন তাকেও বেশ স্পষ্ট ভাষায় মত দিয়ে একটা-কিছু বলতে হয়েছে।

ব্যাপারটা ঘটেছে এইভাবে : সড়ক কারমেনের কাছে এসে যখন শুনেছে যে এ-রাস্তা পেরিয়ে আরো-পুবদিকে যেতে হবে তাদের, সে গম্ভীরভাবে ব’লে উঠেছে, ‘কিন্তু সেদিকে তো কিছু নেই।’

কিছু না-থাকলেও যে তাঁদের যেতে হবে, এ-কথা বুঝিয়ে বলবার ভার পড়েছে তখন পাঞয়লের ওপর। গোড়ায় কিঞ্চিৎ বাণীবিনিময় হয়েছে বটে, তবে তাতে তেমন সুবিধে হয়নি, পাঞয়লের ভৌগোলিক জ্ঞান যতই থাকুক এস্পানিওল ভাষার জ্ঞান ভাসা-ভাসা, তাই শেষ অব্দি তাঁকে বালির ওপর ছবি এঁকে বোঝাতে হয়েছে তাঁদের ইচ্ছেটা কী। এঁকে দেখাতে হয়েছে রাস্তার এদিকটায় সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আর ওদিকটায় সূর্য উঠছে, সেই সঙ্গে সচিত্র বক্তব্যকে পরিস্ফুট করবার জন্যে তাঁকে অঙ্গভঙ্গির সাহায্য নিতে হয়েছে, মুখ দিয়ে দু-চারটে আওয়াজও করতে হয়েছে। গোড়ায় কিছু না-বুঝে ফ্যালফ্যাল ক’রে ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকেছে ত্রোনিদো, তারপর গম্ভীরভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেও ছবির ভাষার পাঠোদ্ধার করতে না-পেরে মাথা চুলকেছে কেবল। তখন পাঞয়ল যেদিকটায় সূর্য উঠছে এঁকেছিলেন সেদিকটাতেই পাশে এঁকে দেখিয়েছেন একটা গাছের গায়ে একজন লোক দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এবার আর ত্রোনিদোর নিশ্চয়ই ছবির কথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। মুখ তুলে বলেছে : ‘বুঝেছি। পুবদিকে কেউ-একজন বন্দী হ’য়ে আছে। সে কি আপনাদের লোক? আপনারা তাকে খুঁজে বার করতে চাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ,’ রবার্টকে দেখিয়ে বলেছেন পাঞয়ল, ‘যাকে খুঁজতে যাচ্ছি তিনি এর বাবা।’

ত্রোনিদোর বজ্রকঠোর মুখটা তখন সহানুভূতিতে কোমল হ’য়ে এসেছে। তবে মুখে সে কিছুই বলেনি।

পাঞয়ল তখন জিগেস করেছেন : ‘এখানে কি ইন্ডিয়ানরা কাউকে কয়েদ ক’রে রেখেছে ব’লে শুনেছো?’

‘হ্যাঁ,’ আর অমনি সবাই চমকে উঠেছে ত্রোনিদোর কথা শুনে, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, সিংহের মতো অকুতোভয় আর বিশালহৃদয় এক শ্বেতাঙ্গকে বন্দী ক’রে রেখেছে এখানকার ইন্ডিয়ানদের একটা দল—না, না, তারা কেচুয়াও নয়, আইমারাও নয়—অন্য-একটা ছোটো উপজাতি। কিন্তু সে তো বছর দুই আগেকার ব্যাপার।’ সে যদিও বলেছে এর বেশি আর-কিছু তার জানা নেই, তবু তার মুখের ভাব দেখে সবাই আন্দাজ করেছে যে যে—কথাটা সে বলতে চায়নি, তা এই : অ্যাদ্দিন পরেও সে-বন্দী কি আর বেঁচে আছেন?

তাঁদের সব আশা এই অনুক্ত আশঙ্কায় বেশ খানিকটা ধাক্কা খেয়েছে বটে, তবু অভিযাত্রীরা কেউ হাল ছেড়ে দেননি। বরং, সে যে জানে একজন-কেউ এখানে বন্দী হয়েছিলো, এই তথ্যটাই তাঁদের উৎসাহ আরো চাগিয়ে দিয়েছে। এতদিনে তাঁরা একটিবারও তো এমন-কোনো কথাও শোনেননি—এখন তো জানা গেছে যে অন্তত আশপাশে কোথাও ইণ্ডিয়ানদের একটি উপজাতি একজন শ্বেতাঙ্গকে বন্দী ক’রে রেখেছে, আর তিনিই নিশ্চয়ই কাপ্তেন গ্রান্ট! ফলে প্রচণ্ড তোড়জোড় ক’রে নবোদ্যমে এগিয়ে গেছেন তাঁরা, পরের দিন পেরিয়েছেন, কলোরাডো নদী, ইন্ডিয়ানদের তৈরি চামড়ার তৈরি ঝুলন্ত সেতুটা পেরিয়ে।

যে-কোনো যাত্রাতেই কখনও-কখনও এমন সময় এসে পড়ে, যখন তেমন-কিছুই ঘটে না। শুধু নিয়মমাফিক এগিয়ে যেতে হয়, কখনও পথের একঘেয়েমিতে নিরুৎসাহিত হ’তে হয় না। কয়েকদিন একটানা চলে তাঁরা গিয়ে পৌঁছেছেন মস্ত একটা হ্রদের ধারে, বহুরকম খনিজ পদার্থ মেশানো তার জলে, ফলে সে-জল মোটেই মিষ্টি নয়, বরং কেমন একটা কটু অম্লষায় স্বাদ তার জলের, সেইজন্যেই না কি এ-দেশের ভাষায় এই হ্রদের নাম : যে-জলাশয়ের জল তেতো।

যদি ভাবা গিয়ে থাকে যে রবার্টের ফাঁড়া কেটে যাবার পর আর ত্রোনিদোর সঙ্গে ভাব হ’য়ে যাবার পর, অভিযানকারীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তবে বিষম ভুল করা হবে। জাক পাঞ্চয়লের ফোড়ন সত্ত্বেও পরের কয়েকদিন কিন্তু অভিযানকারীদের আর দুর্ভোগের সীমা ছিলো না। পাম্পা, অর্থাৎ লাতিন আমেরিকার – বিশেষত আর্হেনতিনার—প্রেয়ারি, সব জায়গায় কিন্তু একরকম নয়। কোথাও সে সবুজে সবুজ, তৃণভূমির বিশাল বিস্তার, কোথাও-বা গেরিধূসর, সবুজের একফোঁটাও কোনো চিহ্ন নেই, যেন কোনো মরুভূমিই আচমকা পথ ভুল করে এই তৃণভূমিতে ঢুকে প’ড়ে আর বেরুতে চাইছে না। শুধু তা-ই নয়, সমভূমি যেমন আছে, মাইলের পর মাইল একইরকম, তেমনি আছে বন্ধুর রুক্ষ জমি, উবড়ো-খাবড়ো, অসমতল রূঢ়-কর্কশ মাটি। যদি-বা ইওরোপ থেকে আসার পর এমন সবুজ দেখে গোড়ায় সকলের চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিলো, মুখে আর লাতিন আমেরিকার ভূদৃশ্যের প্রশংসা ধরছিলো না, দু-দিন পরেই যখন রুক্ষধূসর গিরিভূমি নিস্তারহীন ছড়িয়ে গেলো, আর পানীয় জলের অভাবে শুধু কণ্ঠনালীই নয়, ধুলোমাখা শরীরগুলোও একুট ঠাণ্ডাজলের জন্যে ব্যাকুল হ’য়ে উঠলো, তখন পাম্পা সম্বন্ধে গোড়ার ধারণাটা বদলাতে বাধ্য হ’লো সবাই। গাউচো অর্থাৎ এখানকার কাউবয়রা যখন পনচোয় শরীর ঢেকে ঘোড়ায় চড়ে মাইলের পর মাইল টহল দিয়ে বেড়ায়, তখন তারা তাদের চলার পথে গভীর-সব কূপ খুঁড়ে জল বার করে নেয় : তাঁরা জমির ধরন দেখেই টের পেয়ে যায় কোনখানে মাটি খুঁড়লে জল মিলবে। আর গাউচোরা এই ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ব’লেই প্রস্তুত ও সুসজ্জিত হ’য়ে আসে—কাপ্তেন গ্রান্টের সন্ধানে বেরিয়ে-পড়া লর্ড গ্লেনারভনের দল কিন্তু পাম্পা সম্বন্ধে কিছুই না-জেনে, কোনোভাবেই তৈরি না-হ’য়ে, এখানে ঢুকে পড়েছেন। পরের জলাশয় অনেক দূরে, এখানে আশপাশে এমনকী তেতো জলেরও কোনো কূপ নেই।

শেষটায় প্রায় যেন ধুঁকতে ধুঁকতেই চলছিলো ক্লান্ত, অবসন্ন, অভিযাত্রীর দল। ঘোড়াগুলো অব্দি তৃষ্ণায় কাতর হ’য়ে আছে। যাত্রার শুরুতে তাদের যে দুর্জয় গতি ছিলো, সেটা এখন প্রায় স্মৃতি মাত্র—অর্থাৎ এই দুর্গম অঞ্চলটা যে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাবেন, তারও কোনো জো নেই। শুধু ত্রোনিদো আর তার তেজিয়ান ঘোড়াটাই সুখেদুঃখেনির্বিকার ভঙ্গিতে পথ দেখিয়ে-দেখিয়ে চলেছে।

এরই মধ্যে একদিন হাওয়ায় ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়া গেলো। আচমকা হা-হা ক’রে হেসে ওঠা লেলিহান দাবানল নয়, মানুষের জ্বালানো অগ্নিকুণ্ড। অন্তত সেটাই ছিলো তাদের পথপ্রদর্শকের অভিমত : ‘বেঁটে ঝোপগুলোয়, আগাছার বনে, প্রচুর পোকামাকড় থাকে—এ আগুন জ্বালিয়েছে গাউচোরা, পোকা মারবে ব’লে—তবে তা প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর মাইল দূরে হবে। এখানে সমতল প্রান্তর বলে অনেক দূর থেকেই গন্ধ আসছে।’ শুধু পোকামাকড় নেই ঝোপে-ঝোপে, জায়গায় জায়গায় আছে মশার ঝাঁক। পোকামাকড়ের কথা শুনে পাঞয়ল তাঁর বিদ্যে জাহির করতে গিয়েছিলেন, পুথিপড়া জ্ঞান ফলিয়ে ফিরিস্তি দিতে বসেছিলেন কত অসংখ্য ধরনের পোকামাকড় পাওয়া যায় এখানে। কিন্তু মশার কামড়ে তাঁর বিদ্যেবাগিশ শরীরখানা যখন চাক-চাক হ’য়ে ফুলে গেলো, মেজর ম্যাকন্যাব্‌স ফোড়ন কেটেছিলেন : ‘সে কী! হাজার ধরনের পোকামাকড় তো নয়, নিছক একজাতের তুচ্ছ মশা, তার কামড়েই আপনি অমন নাজেহাল হ’য়ে পড়লেন!’ পাঞয়ল শুধু চিঁচিঁ ক’রে বলেছিলেন : ‘মশার কামড়ে ঘাবড়ে যাচ্ছি কি সাধে। এখানকার মশারা পড়েছি ম্যালেরিয়া রোগ ব’য়ে নিয়ে বেড়ায়।’ আরেকদিন গাউচোদের একটা ছোটোদলের মুখোমুখি পড়েছিলেন তাঁরা, বেশিরভাগই মেস্তিসো, দো-আঁশলা, শ্বেতাঙ্গ আর ইন্ডিয়ানদের মিশেল। তারা দূর থেকে এই দলটাকে দেখে অন্যধার দিয়ে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে পিঠটান দিলে; পাঞয়লের অনুমান, তারা নির্ঘাৎ এঁদের দস্যুদল ব’লে ভেবেছে। মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের মন অবিশ্যি এ-কথায় আদপেই সায় দিতে চায়নি। তিনি বরং খুনশুটি ক’রে নানারকম ফোড়ন কেটে পাঞয়লকে চটিয়ে দিতে চাইলেন। তাতে অন্তত পথের কষ্ট একটু লাঘব হবে। এ-সব কথাকাটাকাটিতেই সকলে অন্তত সারাক্ষণই ক্লান্তির কথা ভাববে না। পাঞয়ল প্রায় ফেটেই পড়েছিলেন তাঁর ফক্কুড়িতে, মেজাজ হ’য়ে উঠেছিলো তিরিক্ষি—যেটা একটু আশ্চর্যই, কেননা মানুষটি এমনিতে ভারি দিলখোলা, সদাশয়, একটু মজারও আছেন (যদিও নিজে টের পান না তিনি কতটা মজার মানুষ)।

আর হা-হা ক’রে ব’য়ে যায় রোদ্দুরে-তাতা উদ্দাম হাওয়া, ধুলোর ঝড় তোলে। তবু আশায় বুক বেঁধে সবাই চলেছে কখন পৌঁছুবে পরবর্তী জলাশয়ে—লেক সালিনার তীরে।

কিন্তু পথশ্রমে আর তৃষ্ণায় জেরবার হ’য়ে লেক সালিনায় এসে দেখা গেলো, শুকনো মরা খাত, একফোঁটা জল নেই, গরমে সব জল শুষে নিয়েছে কেউ যেন এক গণ্ডূষে, খাতটায় মাটি প’ড়ে আছে ফুটিফাটা! এবার তাহলে খরা কী রকম ভয়াল হয়েছিলো? এককালে তো বড়োলোক কোনকিস্তাদোরেরা বুয়েনোস আইরেস থেকে এই জলাশয়ের জল নিয়ে যেতো, যেহেতু এই জলে খনিজ পদার্থ আছে, চিকিৎসকদের মতে তা নাকি প্রায় মৃতসঞ্জীবনী—এত স্বাস্থ্যদায়ক, বলকারক। রোদ্দুরের আঁচে এখন কি না সেই জলাশয়ের জল শুষে গিয়েছে। শুধু কোথাও-কোথাও কাদামাখানো এক-আধফোঁটা জল চিকচিক করছে, শুধু যেন আয়নার মতো কতগুলো হতাশ মুখকে ফিরিয়ে দেখাবে বলেই, শুধু ব্যঙ্গ করার জন্যেই যেন এই ক-ফোঁটা জল বয়ে গেছে—তলানি।

জল পাবে প্রত্যাশা ক’রে এসেছিলেন ব’লেই জলাশয়ের তলদেশটাকে তাঁদের কাছে ঠেকলো খরামাটির অট্টহাসির মতো। আর সেই সময়ে তাঁদের কাছে একটা নতুন উপায় বাৎলালে তাদের পথপ্রদর্শক। সে বললে দলটাকে দু-ভাগে ভাগ হ’য়ে দু-দিকে যেতে হবে। একদল যাবে ৩৭° ডিগ্রি সমান্তর ধরে নাকবরাবর, সোজা সামনে— তিরিশ-বত্রিশ মাইল দূরে একটা ছোট্ট নদী আছে, গুয়ামিনি, তাকে লক্ষ্য ক’রে। সে-দলটায় লর্ড গ্লেনারভন আর রবার্টের সঙ্গে রইলো পাম্পারই বজ্রনিনাদ–ত্রোনিদো। অন্যদলটা যাবে ঘোরাপথে, মাইল-পঁচাত্তর যেতে হবে তাদের, ঘোরাপথ হ’লেও দক্ষিণগামী এই পথটা সহজতর। অতটা পথ ঘুরে যাবে ব’লেই পথ বেঁকে গিয়ে দল দুটিকে মিলিয়ে দেবে একসময়।

পরের দিন ভোরবেলায়, রোদ তেতে ওঠবার আগেই, বেরিয়ে পড়লো সবাই। ঘোড়ারা টের পায় কোথায় কোন দিকে জল আছে। হাওয়ায় যেন জলের সোঁদা গন্ধ পায় তারা। ত্রোনিদোর ঘোড়াই শুঁকে শুঁকে শেষটায় বেলা তিনটে নাগাদ তাদের নিয়ে এলো গুয়ামিনি নদীর ধারে-প্রায় মরীয়ার মতো চেষ্টা ক’রেই ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন তাঁরা, তাই বেলা প’ড়ে যাবার আগেই এসে পৌঁছেছেন নদীর ধারে। অবশেষে, তৃষ্ণার শান্তি : জলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে জল খেয়ে বাঁচলো সবাই—ঘোড়া আর মানুষের মধ্যে জলপানের ধরনে কোনো তফাৎই রইলো না। পাম্পা বোধহয় একসময় এইভাবেই আধুনিক মানুষকে আদিম মানুষে বদলে দেয়—উবু হ’য়ে ব’সে, বা শুয়েই বলা যায়, সেই দূর-অতীতের মানুষের মতোই জলপান করলেন লর্ড গ্লেনারভনরা।

জল যেই অবসন্ন মানুষগুলোর সাড় ফিরিয়ে আনলে, অমনি মনে হ’লো এ-কদিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও হয়নি—তৃষ্ণার জল ছিলো না ব’লে তখন কারু নজরই ছিলো না ভোজ কী জুটলো। এবার মনে হ’লো অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করতে-করতে যদি কোনো শিকার জোটে—তবে নিছক অপেক্ষা ক’রেই সময় কাটাতে হবে না তাদের, বরং অন্যদের জন্যে যদি কোনো ভরিভোজের ব্যবস্থা করা যায় তবে সকলকেই তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে—বিশেষত ত্রোনিদো যখন জানালে এখানে জল আছে ব’লেই আশপাশে জীবজন্তুর দেখা মিলবে—এর আগে তো কেবল গেছে ধু-ধু শুকনো খরায়-ফাটা জমি।

শিকারের নামে রবার্ট নেচে উঠেছিলো। তারই উৎসাহে শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন লর্ড গ্লেনারভন। কিছুদূর যাবার পরই দেখা গেলো পিপীলিকাভুকদের—আর্মাদিলো—বর্মের মতো কঠিন আঁশেভরা ছোটো ছোটো জীব—ছোটো ছোটো কীটপতঙ্গ খেয়েই তারা বাঁচে, প্রধান খাদ্য অবশ্য পিঁপড়েই, যেজন্যে নাম পিপীলিকাভুক; তবে এদের শিকার করা ভারি কঠিন, একটু ভয় পেলেই তারা গুটিয়ে যায় একটা উলের বলের মতো, আর বর্মের মতো কঠিন আঁশ চারপাশে একটা ঢাকা তৈরি ক’রে তোলে। ত্রোনিদো বলেছিলো, এই কঠিন আঁশের তলায় আছে সুস্বাদু নরম মাংস-লাতিন আমেরিকার এই জীব ভয় পেলেই তার বর্মের বলের মধ্যে ঢুকে পড়ে গড়িয়ে গিয়ে গর্তে ঢোকে, বিদ্যুৎবেগে, অতএব দেখামাত্র গুলি করতে হবে। অনেকবার চেষ্টার পর রবার্ট শেষকালে একটি আর্মাদিলো শিকার করতে পেরেছিলো। সেই মাংসে তাদের দিব্যি ভোজ হয়ে গেলো, কিন্তু তবু অন্যদের কোনো দেখা নেই। এদিকে রাত হ’য়ে আসছে।

ত্রোনিদো বলেছিলো জল যেহেতু আছে, অতএব থাকার কোনো আস্তানাও যা-হোক মিলে যাবে। আর মিলেও গেলো অবশ্যি : একটা ভাঙাচোরা র‍্যাচের কোরালে—সেই-যেখানে র‍্যাচের জীবজন্তু রাখা হয়, খোঁয়াড়ই আর-কি একধরনের। গাছের গুঁড়ি, ডাল, কাঠের ফালি—সব দিয়ে তৈরি করা, ওপরে একটা ছাউনি আছে, তিনদিক বন্ধ, আরেকদিকে আড়কাঠ দিয়ে আটকানো দরজা, আড়কাঠগুলো গেছে সমান্তরভাবে, সেগুলো তুলে নেয়া যায়, অমনি সামনেটা পুরো হাট ক’রে খোলা যায়। দক্ষিণ আমেরিকায় তারা একে বলে রামাদা। অর্থাৎ, একদিক দিয়ে, এখানে শোয়া মানে খোলা জায়গাতেই শোয়া, তবে একদিক থেকে নিশ্চিন্ত। পরিত্যক্ত, ভাঙা র‍্যানচ্, কেউ কোথাও নেই; তাছাড়া রামাদার মাথার ওপর তো ছাউনি আছে একখানা। শুতে যাবার আগে কিছু কাঠ জোগাড় ক’রে জড়ো করে রাখলে তারা—কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে, পরে রান্নাবান্নার কাজে সুবিধে হবে। কিছু খড় অব্দি জুটে গেলো তাদের, খড়ের বিছানায় আয়েস ক’রে শোবামাত্র গাঢ় ঘুম, এই ক-দিনের অবিরাম পরিশ্রমের পর শরীর ভেঙে অবসাদ নেমেছিলো, তাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে মোটেই কোনো সময় লাগেনি।

কিন্তু নিশুত রাতে, তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে বোধহয়, কেমন-একটা অস্বস্তিতে ত্রোনিদোর ঘুমটা ভেঙে গেলো। অন্যরা ঘুমিয়ে প্রায় কাদা, চারপাশে অন্ধকার; ত্রোনিদো ঠিক বুঝতে পারলে না অমনভাবে হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেছে কেন। তার জীবনটা শিকারির, রাত-বিরেতে অজানা-অচেনা বনে-বাদাড়ে তাকে শুতে হয় দরকার হলে, ঘুমটা তার স্বভাবতই পালা—যেন ঘুমের মধ্যেও তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় সারাক্ষণ সজাগ থাকে। অনেকক্ষণ ধ’রে চুপটি ক’রে সে কোরালের খুঁটিগুলোর ফাঁক দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো। উঁহু, না, কিছুরই কোনো সাড়া নেই। কিন্তু তবু তার ঘুম এলো না। তার ইন্দ্রিয়বোধ প্রখর, সজাগ—তারাই তাকে আগে থেকে হুঁশিয়ার ক’রে দেয়। তার অবচেতন মন ঘুমের মধ্যেও যেন কোনো বিপদের গন্ধ পেয়েছে।

ঘোড়াগুলোর মধ্যে তারই ঘোড়াটি শুধু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘুমুচ্ছে—যেন ইশারা পেলেই ছুটবে ক্ষিপ্রগতিতে—তার চটকা ভেঙে যাবে। অন্য ঘোড়া দুটো মাটিতে নেতিয়ে শুয়ে আছে–তাদের সম্ভবত এতটা ধকল সহ্য করা অভ্যেস নেই।

ত্রোনিদো উৎকৰ্ণ হ’য়ে শুয়ে রইলো, অনেকক্ষণ—বোধহয় একঘন্টা হবে—শুয়ে রইলো মানে, রইলো ঠিক আধশোয়া অবস্থায়, যে-কোনো মুহূর্তে সে তড়াক ক’রে লাফিয়ে উঠবে, প্রয়োজন বোধ করলে। এই ঘুম আর জাগরণের মধ্যে অস্পষ্টতার মাঝখানে হাজার ক্লান্ত থাকলেও সে কিন্তু সুপ্রস্তুত।

হঠাৎ, দূরে, আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ছোটো-ছোটো কতকগুলো আলোর ফোঁটা। এমন সময় ত্রোনিদোর ঘোড়াটাও কেমন অদ্ভুত ছটফট করে উঠলো। বিপদের গন্ধ সেও পেয়েছে।

অন্ধকারে, ঘাসের মধ্যে অস্ফুট সর-সর আওয়াজ—কারা যেন স’রে-সরে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন তারই মধ্যে একসঙ্গে গর্গর্ ক’রে উঠলো বুনো খ্যাপা কুকুর আর নেকড়ে। এই অদ্ভুত গর্জন শুনেই ত্রোনিদো তার বন্দুক তুলে অন্ধকার লক্ষ্য ক’রে একটা গুলি ছুঁড়লো—আর বন্দুকের শব্দ মিলিয়ে যাবার পরেই আবার সব আগের মতো নিঃঝুম হ’য়ে এলো। কিন্তু ততক্ষণে, বন্দুকের আওয়াজ শুনে, ধড়মড় ক’রে উঠে বসেছেন লর্ড গ্লেনারভন, আর রবার্টও তথৈবচ।

ত্রোনিদো শুধু অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘জাগুয়ার!’

অর্থাৎ ট্রপিক্যাল আমেরিকার সেই বৃহৎ বন্যবিড়াল, যে লেপার্ডের চাইতেই যে আকারে বড়ো ও পৃথুল তা-ই নয়, তার চাইতেও ধূর্ত ও শক্তিশালী, খয়রির সঙ্গে হলদে মেশানো পেশল গায়ে কালো-কালো ফুটফুট ছোপ

ত্রোনিদোর কথাটাকে যেন প্রমাণ ক’রে দিতেই আবার শুরু হ’য়ে গেছে রাগী গরগর আওয়াজ। যেন দল বেঁধে এসেছে কত জাগুয়ার, আর খিদেয় হন্যে হয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুঝেই যে পারে সামনে এগিয়ে আসতে চাচ্ছে।

একটু আশ্চর্যই। এরা এমনিতে আসে নিঃশব্দে, চুপি-চুপি ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর, অব্যর্থ কৌশলী লাফে, ছিঁড়ে খায় শিকারকে, তারপর, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি নিঃশব্দে মিলিয়ে যায়।

এই রেষারেষি ক’রে গরগর করে নিজেদের জানান দিয়ে কখন এসে চড়াও হয়েছে তখন বোঝাই যায় কতটা ক্ষুধিত এরা, কতটা বুভুক্ষু, আর তাই, কতটা হিংস্ৰ হ’য়ে উঠেছে এখন।

কিন্তু এখন এ নিয়ে ভাবার কোনো ফুরসৎ নেই। এই নিশুত রাতের আতঙ্ককে যে-ক’রেই হোক ঠেকাতে হবে। প্রথমে যত কাঠকুটো ছিলো, সব জড়ো ক’রে র‍্যানচের মুখে জ্বালিয়ে দেয়া হলো—এই আগুনের গণ্ডি পেরিয়ে আসতে এরা ভয় পাবে, তাছাড়া অন্ধকার দূর হ’য়ে যাবে বলে এই মরণদূতগুলোকে চর্মচক্ষে দেখাও যাবে। আর একটু বেশামাল দেখলেই, বেগতিক দেখলেই, অগত্যা চালাতে হ’লো বন্দুক। অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কেননা গুলি বেশি নেই, ভয় পেয়ে সব একসঙ্গে মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়ে খরচ করা চলবে না, গুনে-গুনে হিশেব করে খরচ করতে হবে গুলি, সাবধানে—যাতে একটা গুলিও না-ফসকায়, যাকে তাগ ক’রে গুলি-করা হবে সরাসরি তার গায়ে যেন তা বেঁধে।

কিন্তু গুলি এত কম ছিলো যে তাও একসময় শেষ হ’য়ে গেলো। আহত, ক্রুদ্ধ, হন্যে, ক্ষুধিত নেকড়েরা তখনও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, গুলিগোলার কোনো পরোয়া না-ক’রেই। ফলে গুলি ফুরিয়ে যেতে শুরু হয়ে গেলো বন্দুকের বাঁট আর ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা। আর আগুনের কুণ্ডও ক্রমে, জ্বালানির অভাবে, নিভু-নিভু হ’য়ে আসছে। জাগুয়ারের দল কিন্তু এবার র‍্যাচের পেছন দিয়ে ঢোকবার চেষ্টা করছে। পারলে বুঝি খুঁটিগুলো উপড়েই ফ্যালে।

এবার সটান উঠে দাঁড়ালে ত্রোনিদো, তার ঘোড়াটাও এতক্ষণ বেদম অস্থির হ’য়ে ছটফট করছিলো, নাক দিয়ে নিশ্বাসে ছড়াচ্ছিলো গরম হলকা, চোখ দুটোয় যেন আগুন জ্বলছিলো। লাগাম হাতে নিয়ে তার ঘোড়ার পিঠে যেই সে চাপতে যাবে, অমনি লর্ড গ্লেনারভন তার হাত চেপে ধরলেন।

অস্থির-একটা মূকাভিনয় মারফৎ ত্রোনিদো বোঝাবার চেষ্টা করলে তাঁদের বিপদের মধ্যে ফেলে রেখেই নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে সে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে না, বরং সে বেরিয়ে গেলে জাগুয়ারেরা ভাববে যে এতক্ষণে বাগে পাওয়া গেছে শিকারকে, তার পেছন পেছন ছুট লাগাবে—কিন্তু ত্রোনিদোর ঘোড়া হাওয়ার চাইতেও বুঝি জোরে ছোটে, তাই জাগুয়ারগুলো তার পেছনে প্রাণপণে ছুটে এলেও তার নাগাল ধরতে পারবে না, সে জাগুয়ারগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে টেনে নিয়ে যাবে দূরে, আর তাতে লর্ড গ্লেনারভন আর রবার্ট আপাতত বেঁচে যাবেন।

র‍্যাচের মুখটার কাছে তখন জাগুয়ারেরা নেই। কিন্তু ত্রোনিদো আর লর্ড গ্লেনারভন সন্তর্পণে গিয়ে যখন আস্তানার মুখটা দেখছেন, জাগুয়ারেরা কোথায়, সেই সময়ে দুরন্ত ঝড়ের গতিতে ত্রোনিদোর ঘোড়ায় চেপে তাদের পাশ দিয়ে অন্ধকারে ছুটে চ’লে গেলো রবার্ট, আর পেছন-পেছন অমনি ধেয়ে গেলো হন্যে ও ক্ষুধিত জাগুয়ারেরা।

ত্রোনিদো আর লর্ড গ্লেনারভন শুধু হতভম্ব নন, আঁৎকেও উঠেছেন। এ কী করলে রবার্ট?

এদিকে ভোর হ’তে তখনও ঘন্টা দু-এক বাকি। কী-যে করবেন, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না লর্ড গ্লেনারভন। শুধু ছটফট করা ছাড়া, অধীর হ’য়ে আলো ফোটবার অপেক্ষা করা ছাড়া, আর কোনোকিছু করণীয় নেই। আলো ফুটতেই আর কালক্ষেপ নয়—দুজনে ঘোড়ায় চেপে পশ্চিমদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।

খানিকটা দূর গেছেন, হঠাৎ শুনতে পেলেন পর-পর কতগুলো বন্দুকের আওয়াজ। তাকিয়ে দ্যাখেন, পাঞয়লরা ছুটে আসছেন, আর তাদের সকলের পুরোভাগে স্বয়ং রবার্ট, তাকে দেখে অক্ষতই মনে হয়, গায়ে আঁচড়টুকুও লাগে নি।

লর্ড গ্লেনারভন স্বস্তির শ্বাস ফেলে রবার্টকে জড়িয়ে ধরলেন। জিগেস করলেন, ‘তুমি অমনভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়েছিলে কেন, রবার্ট?’

অমনি, চটপট, সোজা জবাব এলো : ‘বা-রে, ত্রোনিদো এর আগে একবার আমায় বাঁচায়নি? আমায় তো তার একটা প্রতিদান দিতে হয়। তাছাড়া আপনাকেও নিরাপদ রাখা কর্তব্য আমার : কারণ আপনিই তো চলেছেন আমার বাবাকে উদ্ধার করতে?’

এহেন যুক্তির কাছে আর কোনো কথাই চলে না, তবে লর্ড গ্লেনারভনের দায়িত্ববোধের মধ্যে রবার্টের এই দুর্দান্ত কাণ্ডটা কাঁটার মতো খচখচ ক’রে বিঁধছিলো। এই কিশোরের যদি কিছু হয়, তবে তার দায় তো তাঁকেই সামলাতে হবে। পরে কখনও রবার্টকে আলাদা ক’রে ডেকে নিয়ে আচ্ছা ক’রে ধমকে দেবেন ভেবে তখন আর এ নিয়ে তিনি কোনো উচ্চবাচ্যই করলেন না, কেননা এই সমূহ বিপদ থেকে এভাবে উদ্ধার পেয়ে সবাই তখন উচ্ছ্বাসে প্রায় যেন ভেসে যাচ্ছে—বলাই বাহুল্য, পাঞয়লের উচ্ছ্বাসটাই অন্যসকলের চাইতে যৎকিঞ্চিৎ বেশি।

উচ্ছ্বাসের মধ্যে একটু রাশ টেনে ধরবার পরেই সবাই দল বেঁধে ফিরে এলেন র‍্যাচে। গত রাতের হুলুস্থুলু যুদ্ধে বেশ-কিছু জাগুয়ার অক্কা পেয়েছে—কিন্তু র‍্যাচের খুঁটিগুলোকে তারা খুব-একটা অক্ষত রাখেনি। হামলাটা যেমন প্রচণ্ড আর ভয়ংকর হয়েছিলো, তেমনি তাদের ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টাটাও হয়েছিলো প্রচণ্ড আর জীবনপণ। কত-যে জাগুয়ার এসেছিলো কে জানে, আর তাদের সঙ্গে লড়েছিলো কি না মাত্র তিনজনে—যতই মরীয়া হ’য়ে লড়াই করুক, সংখ্যায় যে তারা নগণ্যই ছিলো, সে-কথাটা অস্বীকার করবে কে।

অন্যদের জন্যে যৎকিঞ্চিৎ মাংস তুলে রেখেছিলো ত্রোনিদো। তাই দিয়েই হ’লো প্রাতরাশ, বেশ আয়েশ ক’রেই খাওয়া গেলো, তারিয়ে-তারিয়ে, কিন্তু তাতে কি আর সকলের খিদে মেটে! অর্থাৎ উত্তেজনার ধকলটা একটু কমলে ফের তাদের খাদ্যসংগ্রহের কাজটায় মনোযোগ দিতে হবে।

সেই-কবে অক্টোবরের চোদ্দ অরিখে, তাঁরা বেরিয়ে পড়েছিলেন তালকাউয়ানো থেকে। তারপর দিনের পর দিন কেটেছে, কিন্তু আরহেনতিনার এই বিশাল তৃণভূমি যেন আর ফুরোয়ই না। প্রায় একটানাই পথ চলেছেন তাঁরা। বন্য জন্তুর অতর্কিত উপদ্রবে আর হামলায় দু-একবার তাঁদের থমকে পড়তে হয়েছে বটে, কিন্তু সে নেহাৎই সাময়িকভাবে। তাছাড়া আর কারু সঙ্গেই তাঁদের দেখা হয়নি। অথচ সেটাই বরং একটা প্রহেলিকা। পথের মাঝে-মাঝে ইন্ডিয়ানদের বসতি চোখে না-পড়ুক, দলছুট কোনো ইন্ডিয়ানের সঙ্গেও তাঁদের দেখা হয়নি। অথচ এ-সব অঞ্চলে নাকি আরহেন্তিনার ইন্ডিয়ানদের দেখা পাওয়া যায় প্রায়ই। শুধু একবার তিন জন সশস্ত্র ঘোড়সোয়ারকে দেখা গিয়েছিলো দূর থেকে, আর তারা ছিলো ইন্ডিয়ান—কিন্তু ঐ দূর থেকেই যা দেখা–কেননা তাঁদের দেখেই অন্যদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে তারা ঝড়ের বেগে চোখের আড়ালে চ’লে গিয়েছিলো। এরা কি তবে ইন্ডিয়ান ছিলো না? ছিলো দো-আঁশলা, ক্রেয়োল বা মেস্তিসো, আর গাউচো বা কাউবয় হিশেবেই যারা খেতখামার সামলায়? পাঞয়লের মতে অবশ্য এরা মোটেই গাউচো নয়, বরং বান্দিতো, দস্যু—তাঁর চোখে সবাইকেই বোধহয় ডাকাতের মতো দেখায়।

তেসরা নভেম্বর পাম্পার অন্য প্রান্তে এসে পৌঁছুবার পর ত্রোনিদো পরামর্শ দিলে, আরো ষাট মাইল পথ পেরিয়ে ফোর্ট ইনডিপেনডেন্‌সে গিয়ে খোঁজ করা যাক, কাপ্তেন গ্রান্টকে যারা পাকড়ে কয়েদ ক’রে রেখেছে সেই ইণ্ডিয়ানদের কোনো খোঁজ মেলে কি না। প্রস্তাবটা সকলেরই মনে ধরলো। এখানে র‍্যাচের মধ্যে খবরদারির চিহ্ন বেশ চোখে পড়লো। এই বিশাল তৃণভূমিতে পালে-পালে গোরুমোষভেড়া চরে বেড়াচ্ছে, প্রত্যেকটা জন্তুর গায়ে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে মালিকের নাম মোহর ক’রে দাগানো, আর তাদের আগলে আর সামলে নিয়ে বেড়াচ্ছে কুকুর। শিক্ষিত কুকুর এ-সব, ভারি ওস্তাদ, নিজের কাজ ভালোই জানে। কখনও-কখনও এমনও হয় যে দু-চারজন মাত্র গাউচো থাকে কোনো র‍্যাচে, তবে তাদের সঙ্গী থাকে দুর্দান্ত সব ঘোড়া আর অনেকগুলো ক’রে পোষমানানো শেখানোপড়ানো কুকুর।

ফোর্ট ইনডিপেনডেন্‌স বা আজাদগড় সমুদ্র থেকে হাজারফিট উঁচুতে। দেয়াল দিয়ে ঘেরা, যাতে শত্রুর আক্রমণ ঠেকানো যায়। এককালে যখন এটা তৈরি হয়েছিলো তখন লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ভূগোল অনবরত ভোল পালটাচ্ছে—তখন মুহুর্মুহু চলেছে যুদ্ধবিগ্রহ, আর যতবারই হাত পালটাক সবসময়েই ছিলো একটা সাজো-সাজো রব।

অভিযাত্রীরা অবশ্য এখন আজাদগড়ে পৌঁছে একবারেই হতভম্ব হ’য়ে গেলেন

কেল্লার ভেতরে বেশ উৎসাহভরে এখন যারা কুচকাওয়াজ করছে তারা প্রায় সবাই ছেলেমানুষ। উনিশ-কুড়ি বছরের চাইতে বড়ো-কেউ নেই—কিন্তু দলে-দলে আছে ছোটো ছেলে, তাদের বয়স সাত-আট থেকে শুরু। ছোটোদের পরনে পনচো, কোমরে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। মস্ত লম্বা তলোয়ারগুলো কোনো-কোনো ছেলের নিজের দৈর্ঘ্যের চাইতেও দীর্ঘ হবে, তাছাড়া আছে বন্দুক, আর সে-সব সমেতই তারা ফরাশি কেতায় কুচকাওয়াজ ক’রে চলেছে। বয়েস যার যে-রকমই হোক না কেন, সকলেরই গড়ন আর মুখচোখ একই রকম, সম্ভবত একই বাড়ির ছেলে। আর এরা যদি সবাই ভাই-ভাই হয়, তবে তাদের কুচকাওয়াজ করাচ্ছে সবচেয়ে বড়োভাই—সেই-ই স্বভাবতই এই ইউনিটের সর্দার। এ-রকম ‘ইউনিট’ নাকি অনেক আছে এখানে—পাঞয়লের পণ্ডিতি বয়ান—কেননা এখানে একেকটা পরিবারে অনেক সন্তান জন্মায়, তবে পাঞয়লের পড়া বিদ্যের বুলি কি না, তাতে একচিলতে নুন ছিটিয়ে নিতে হয় সবসময়।

ফোট ইনডিপেনডেন্‌স বা আজাদগড়ের তত্ত্বাবধানের দায় সার্জেন্ট মানুয়েলের ওপর। জন্মেছিলেন ফ্রানসে, কিন্তু এখন এখানকার মেয়ে বিয়ে ক’রে তিনি এখানকারই একজন হ’য়ে গেছেন—কস্মিনকালেও আর ইওরোপে ফেরবার মলব নেই তাঁর।

সার্জেন্ট মানুয়েল মানুষটা খোলামেলা, দিলদরিয়া, হাসিখুশি।

উঁহু, না কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খোঁজ তিনি রাখেন না। তাঁর নামই তিনি নাকি বাপের জন্মে শোনেনি। তবে বেশ-কয়েক বছর আগে একজন ইতালীয় আর একজন ফরাশিকে ধ’রে আনে ইন্ডিয়ানরা। ইতালীয়টির হম্বিতম্বি আর বদমায়েশি দেখে তাকে সাজা দেয়া হয় : প্রাণদণ্ড। তবে ফরাশি ভাগ্যান্বেষী বা ফরচুনহানটার বা সম্পদশিকারি পালিয়ে যান। না-না, এঁদের কেউই ইংরেজ ছিলেন না—গ্রেটব্রিটেনের এঁরা কেউ নন!

এদিকটায় যে ইণ্ডিয়ানদের কেন দেখা যাচ্ছে না, সেই ধাঁধাটারও একটা সমাধান বাৎলে দিলেন সার্জেন্ট মানুয়েল। পারাগুয়াইয়ের সঙ্গে বুয়েনোস আইরেসের একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলেছে—ইন্ডিয়ানরা সবাই গেছে সেখানেই—কেউ লড়াই করতে, কেউ-বা লুঠপাট করার সুযোগ খুঁজতে।

সার্জেন্ট মানুয়েলের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা ব’লে একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। কাপ্তেন গ্রান্ট এখানকার ইন্ডিয়ানদের হাতে বন্দী হননি—অর্থাৎ এখান থেকে অ্যাটলান্টিকের তীর অব্দি পুরো তল্লাটটাতেই তাঁর দেখা আর পাওয়া যাবে না। এই মুলুকেই নেই তিনি।

পাঞয়ল বললেন : ‘ঐ চিরকুটটা আরেকবার ভালো ক’রে দেখা দরকার। কাপ্তেন গ্রান্ট আদপেই কোনোদিন এই নতুন মহাদেশের মাটিতে তাঁর পা রেখেছেন কি না সন্দেহ। এই বিশাল পাম্পায় যখন নেই, তখন গোটা লাতিন আমেরিকাতেই নেই। অথচ কোথায় আছেন, তার হদিশ দেয়া আছে এই চিরকুটটাতেই। ধাঁধার মতো ঠেকছে বটে, তবে সব ধাঁধারই তো সমাধান হয়। এর সমাধান যদি করতে না-পারি, তাহ’লে আমার নাম আর জাক পাঞ্চয়লই নয়!’

তাঁর এমন লম্বাইচওড়াই আশ্বাস সত্ত্বেও অবশ্য রবার্ট কী-রকম যেন মিইয়ে গেলো। এত-দূরে নূতন জগতে এসেও বাবার কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না।

৯. খ্যাপাজল আর পাখির বাসা

আজাদগড় থেকে টানা দেড়শো মাইল গেলেই—অ্যাটলান্টিক।

এতটা পথ যখন পেরিয়ে আসা গেছে, তখন ঐ বাকি দেড়শো মাইল পেরুতেও তেমন কী আর ঝামেলা হ’তে পারে? বিশেষত এখন যখন ধরেই নেয়া গেছে যে কাপ্তেন গ্রান্ট আর যেখানেই থাকুন এই নূতন জগতে যখন নেই, তখন নানা স্থানে-অস্থানে থেমে গিয়ে তাঁর খোঁজ না-করলেও হয়তো চলবে! ফলে এই দেড়শো মাইল নিশ্চয়ই অনায়াসেই পেরিয়ে যাওয়া যাবে।

তবে লোকে ভাবে এক, আর তাতে বাদ সাধেন প্রকৃতিঠাকরুন। এই দেড়শো মাইলের মধ্যেই যে এমন বিপদ তাদের জন্যে ওৎ পেতে বসেছিলো, তা কে জানতো। পথের মাঝখানে ছোটে-ছোটো সব খরগোশকে হুড়মুড় ক’রে লাফিয়ে-লাফিয়ে পালিয়ে যেতে দেখে কারু-কারু অবশ্য সন্দেহ হয়েছিলো যে কিছু-একটা ঘটতে চলেছে। এরা টের পায়, এই ছোটো জীবগুলো—কেমন ক’রে, কে জানে। তাছাড়া বিশাল পাম্পা যেন কেমন ভেজা-ভেজা স্যাঁৎসেঁতে ঠেকছিলো গোড়া থেকেই। মাঝে-মাঝে জল জ’মে আছে—জলাশয় নয়, অথচ মাটি একটু ঢালু হ’লেই কেমন যেন জল আটকে গেছে। আস্ত জায়গাটাই যেন একটা প্রকাণ্ড জলাভূমিতে পরিণত হ’য়ে গেছে। আর এ-সব হঠাৎ-গজানো জলাভূমি যে বেশ-বিপজ্জনক তার প্রমাণও পাওয়া গেলো এক জায়গায় : মাটির মধ্য থেকে গাছের গুঁড়ির মতো উঠে আছে রাশি-রাশি শিং : অর্থাৎ এই জলাভূমির আবার কোথাও-কোথাও চোরাবালিতেও ভর্তি : নিশ্চয়ই একদঙ্গল ষাঁড় এখান দিয়ে যাবার সময় চোরাবালিতে ডুবে গিয়েছে : শুধু তাদের শিংগুলোই জানান দিচ্ছে কীভাবে এই অনিচ্ছুক বুনো ষাঁড়গুলোকে জীবন্ত সমাধি মেনে নিতে হয়েছে। না কি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?

এই শিংগুলো দেখবার পর থেকেই সবাই কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছে। এমনকী ত্রোনিদো অব্দি গুম হ’য়ে আছে, যেন ভারি উদ্বিগ্ন। মাঝে-মাঝে এদিক-ওদিক ডানদিকে বামদিকে ছুটে-ছুটে যাচ্ছে, ঘাড় উঁচিয়ে কী-সব লক্ষ করবার চেষ্টা করছে, কপালে ভাঁজ আর ভ্রূকুটি। শেষটায় সে একসময় পাঞয়লকেই খুলে বললে তার দুশ্চিন্তার কারণ। এ-তল্লাটে এ-সময়টায় সাধারণত অত ডোবা, পুকুর বা জলা থাকে না। এখন পর-পর শুধু এ-সব ছোটোখাটো জলাই বা চোখে পড়ছে কেন?

রাত কাটাবার জন্যে সবাই মিলে আশ্রয় নিয়েছিলো একটা ফাঁকা, পরিত্যক্ত র‍্যাচে! সারাদিন পথচলার ধকল গেছে। তার ওপর মাথার মধ্যে যদি সারাক্ষণ কোনো অজানা বিপদের আশঙ্কা হানা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাহ’লেও খুব কাহিল লাগে। খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙলো তুমুল বৃষ্টির জন্যে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, যেন মহাপ্লাবনের আগের রাত। ঘোড়াগুলো কেমন যেন দাপাচ্ছিলো, অনবরত পা ঠুকছিলো। অর্থাৎ কোনো কারণে তারা ভারি অস্থির হ’য়ে পড়েছে, এই ভোররাত্তিরে বৃষ্টি মাথায় ক’রেই বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। এরাও নিশ্চয়ই আগে থেকেই বিপদের গন্ধ পায়—নইলে হঠাৎ এমনভাবে পা ঠুকবে কেন অস্থির আর দামাল!

ত্রোনিদো সব্বাইকে জানালে, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে—লক্ষণ খুব-একটা সুবিধের ঠেকছে না।

ঐ ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই দলটা বেরিয়ে পড়লো। পথে এর মধ্যেই জল জ’মে যেতে শুরু করেছে, ঘোড়ার খুর ডুবে যাচ্ছে জলে, কিন্তু তবু তারা নিজে থেকেই, কেউ চেতিয়ে না-দিলেও, তীব্রবেগে ছুটে চলেছে উত্তরে।

আর তাদের এই তাড়ার কারণটা—চোখে না-পড়লেও—কানে শোনা গেলো পরক্ষণেই। পেছন থেকে কানে ভেসে এলো গভীর গম্ভীর গুমগুম শব্দ, যেন কোথাও বাজ গড়িয়ে যাচ্ছে। আর তারই সঙ্গে-সঙ্গে দলে-দলে ছুটে এলো কতরকম জীবজন্তু, জলে ছপছপ ক’রে ছুটে চলেছে তারা, খাদ্য-খাদকেও এখন কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই যেন কোনো-এক বিষম ভয়ে একসঙ্গে এখন ছুটে পালাচ্ছে নিরাপত্তার সন্ধানে। শুধু যে ডাঙার জীবজন্তু তা-ই নয়, মাথার ওপর দিয়ে আর্ত সুরে ডাকতে-ডাকতে উড়ে চলেছে কত-রকম পাখি।

ঘোড়াগুলো তীব্রগতিতে ছুটেছে উত্তরদিকে—ঐ জন্তুদের মতোই। এখন একটু ভাববারও ফুরসৎ নেই। যে-হারে পথে জল বাড়ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এ-নিছকই বাদলার জল নয়, আরো বেশিকিছু আছে সেইসঙ্গে। নিশ্চয়ই কূল ছাপিয়ে ছুটে আসছে নদী—বান ডেকেছে, ঝলকবান, চমকবান, হয়তো বাঁধও ভেঙেছে। হু-হু ক’রে জল বেড়ে যাচ্ছে। ঘোড়াগুলো এবার যেন সাঁৎরে পেরুচ্ছে, কদম-কদম ছুটতে পারছে না আর।

প্রায় শ-খানেক গজ দূরে ছিলো মস্ত-একটা আখরোটগাছ, আর তার ওপর এসে যখন আছড়ে পড়লো বানের জল, প্রায় তার আদ্ধেকটা ডুবিয়ে দিয়েই, তখনই বোঝা গেলো এই অতর্কিত ও অপ্রত্যাশিত বিপদ কতটা ভয়াবহ। ঘোড়াগুলো ভেসেই গেলো, ছিটকে পড়লো আরোহীরা জলে; শুধু ত্রোনিদোর ওস্তাদ ঘোড়াটাই জলের সঙ্গে অনবরত যুঝে চলেছে, আর তার কেশর ধরে ভেসে চলেছে রবার্ট, আর পাঞয়লের জামার কলার ধরে সাঁরে চলেছেন লর্ড গ্লেনারভন। পাঞয়ল কিছু-একটা বলবার জন্যে মুখ খুলেছিলেন, সম্ভবত বলতে চাচ্ছিলেন, ‘ভয় কী—ঘাবড়াবেন না—আমি তো আছি সঙ্গে’, কিন্তু মুখে একরাশ খ্যাপাজল ঢুকে যাওয়ায় আশ্বাস দেবার বদলে শুধু খাবিই খেলেন, আরেকটু হলেই হয়তো বেকায়দায় জল ঢুকে যেতো গলায়।

আখরোট গাছটার কাছে এসে ত্রোনিদো এক-এক ক’রে সবাইকে গাছের ডালে তুলে দিলে। নিচে, ফেনিয়ে, চর্কি দিয়ে জল ছুটছে, আর ত্রোনিদোর ঘোড়া এইবার সেই জলের তোড়ে কাবু হয়ে ভেসে গেলো উত্তরে। তা-ই দেখে আর একমুহূর্তও সবুর করেনি ত্রোনিদো, সোজা ফের গাছের ডাল ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঐ খ্যাপাজলে, প্রাণপণে সাঁতার কেটে গিয়ে নাগাল ধরেছে তার ঘোড়ার, আঁকড়ে ধরেছে তার গলা, আর পরক্ষণেই ঘূর্ণিতোলা খ্যাপাজল ঘোড়া আর মানুষ দুজনকেই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দূরে, উত্তরে।

সেই মেঘলা ভোরবেলায় সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে-তাকিয়ে শুধু দেখলেন ত্রোনিদোর ভেসে-যাওয়া। এখন তাঁদের কোনো বাহন নেই, পথপ্রদর্শক নেই, তল্পিতল্পা নেই, ঠাণ্ডাও লাগছে একটু, এই অচেনা বিদেশ-বিজনে এসেই কি তবে শেষকালে এমনভাবে তাঁদের অভিযান শেষ হ’য়ে গেলো? কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো সন্ধান তো পাওয়াই গেলো না, এখন উলটে তাঁরা নিজেরা এসে পড়েছেন বিষম বিপদের মাঝখানে, এই তালঢ্যাঙা গাছটার মগডালের কাছে, আর নিচে খ্যাপজল থৈ-থৈ করছে, ফেনিয়ে চর্কি দিয়ে ছুটছে

ভাগ্যিশ গাছটা প্রায় একশোফিট উঁচু, আর তার গুড়িটাও প্রকাণ্ড—আর ডালপালাগুলো প্রায় ছাতার মতো ছড়িয়ে আছে—অনেকখানি জায়গা জুড়ে, শূন্যে। তার জটিল ঝুরি আর শেকড় মাটির তলায় অনেকটা ছড়িয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে বলেই বাঁচোয়া, নইলে এ-গাছটাও কখন বানের ধাক্কায় ভেঙে পড়তো! এখনও যে উপড়ে পড়েনি, তা হয়তো এইজন্যেই যে গাছটা অনেককালের পুরোনো আর প্রকাণ্ড–হয়তো এককালে কোনাকিস্তাদোররা এখানে যে-তাণ্ডব তালিয়েছিলো তারও সে সাক্ষী।

নিচে খ্যাপাজল যেভাবে থৈ-থৈ করছে, তাতে মনে হতে পারত, এ বুঝি বানের জল নয়, সমুদ্রেরই কোনো খাঁড়ি। এত-বড়ো গাছটা পর্যন্ত জলের ধাক্কায় থরথর করে কাঁপছে। নিচে, জলে ভেসে যাচ্ছে র‍্যাচের ছাদ, ওপড়ানো গাছপালা, মরা জীবজন্তু। ভেলার মতো ভেসে যাচ্ছিলো একটা গাছ—তার ওপর আশ্রয় নিয়েছে কত-যে জাগুয়ার, এখন আর তাদের গরগর আওয়াজে হিংস্র আক্রোশ নেই, বরং সে-আওয়াজ এখন কেমন যেন কাহিল, ক্ষীণ, আর্ত।

লর্ড গ্লেনারভন বেশ-কিছুক্ষণ লক্ষ ক’রে এই সিদ্ধান্তে এলেন, জল এখানে বেশ গভীর বটে, আর তোড়ও ভয়ংকর, তবে জল আর বাড়ছে না—অর্থাৎ বন্যার প্রথম ধাক্কায় যা হবার হ’য়ে গিয়েছে, এরপর আর যদি বৃষ্টি না-পড়ে তবে এ-জল বাড়বার আর সম্ভবনা নেই। কিন্তু এ-জায়গাটা একটা ডেকচির মতো ঢালু—দু-পাশে উঁচু জমি, মাঝখানে এই ঢাল, সেইজন্যেই জল এখানে অত গভীর, তাছাড়া জল যদি আর নাও বাড়ে, এই জল সরতে অনেক সময় লেগে যাবে। অর্থাৎ এই গাছকে আশ্রয় করে তাঁদের যে কতটা সময় কাটাতে হবে কে জানে!

হিশেব ক’রে লর্ড গ্লেনারভন যতটা বুঝতে পেরেছেন, তাতে মনে হচ্ছে অ্যাটলান্টিক এখান থেকে আর মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে। মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে ডানকান তাঁদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। কিন্তু শুধু-যে এই চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করা এখন একেবারেই অসম্ভব তা-ই নয়, ডানকানেও কোনো খবর পাঠাবার কোনো উপায় নেই।

তার ওপর এখন, এক্ষুনি, আরো-একটা সমস্যার সমাধান করা জরুরি। সেটা হচ্ছে খাবার।

মেজর ম্যাকন্যাব্‌স জলে জবজবে-ভেজা ব্যাগ তুলে দেখালেন। তাতে যা খাবার আছে, তাতে হয়তো দিন-দুই চ’লে যাবে। কিন্তু তারপর? এ-জল যে কবে নামবে, কে জানে। দু-দিন পরে তাঁদের খাদ্যের সমস্যা মিটবে কী করে?

লর্ড গ্লেনারভন বললেন, ‘গাছে তো বেশ ক-টা পাখির বাসা আছে দেখছি। বড়ো পাখিগুলো পালিয়েছে বটে, তবে তাদের ছানাপোনাগুলো আছে, ডিমও আছে। তাতেও নিশ্চয়ই কয়েকটা দিন চলে যাবে।’

‘তাহলেও গোড়া থেকেই আমাদের সাবধান হ’য়ে খাবার খরচ করতে হবে—র‍্যাশন ক’রে দেয়া ছাড়া উপায় নেই,’ মেজর ম্যাকন্যাব্‌স বললেন। তবে ত্রোনিদো জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একটা মস্ত উপকার ক’রে গেছে। তাতে হয়তো একটু সুরাহা হবে—’

‘কী?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন লর্ড গ্লেনারভন।

‘এই-যে, গুলিভর্তি এই ম্যাগাজিনটা সে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে গেছে—আর এটা জলে ভেজেনি।’

‘চমৎকার। তাছাড়া আমাদের দুজনের কাছেই তো রিভলভার আছে?’

‘হ্যাঁ। এবার জলটা নামলেই হয়।’

পাঞয়ল একবার নাক সিটকোলেন। ‘খাবার যা আছে, তা তো কাঁচা। রান্না না-ক’রে খেলেই তো দফরাফা হবে—অসুখবিশুখ বাঁধিয়ে বসবো সবাই।’

‘কাঁচা খাবার খাবেন কেন? ঝলসে নিলেই হবে?’

‘ঝলসে যে নেবেন, আগুন জ্বালবেন কী করে?’

‘ধৈর্য ধ’রে একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি নিজের চোখেই রন্ধনপ্রক্রিয়া দেখতে পাবেন।’

মগডাল থেকে বেছে-বেছে অপেক্ষাকৃত শুকনো পাতা জড়ো করা হ’লো নিচের ডালে। বৃষ্টিধোয়া ফটফটে আকাশে ততক্ষণে সূর্য উঠেছে—বৃষ্টি ধরতেই মেঘও স’রে গেছে। এখন দেখে কে বলবে যে কাল রাতে এই আকাশই অমন-একটা দুর্যোগ তৈরি করেছিলো। দূরবিনের পরকলার মধ্যে ধরা হলো রোদ্দুর, সূর্যের রশ্মি, পরক্ষণেই নিচের ডালের শুকনো পাতায় আগুন ধরে গেলো।

প্রথম কাজ তো কোনোরকমে এই আগুনের আঁচে ভেজা জামাকাপড় শুকিয়ে নেয়া। তারপর খাবারগুলো ঝলসে নিয়ে বেশ হিশেব ক’রেই খেয়ে নিলে সবাই। আর জঠরানল প্রশমিত হ’তেই পাঞয়ল দূরবিনটা হাতে ক’রে উঠে পড়লেন মগডালে, সেটা নাকি তাঁর অবজারভেটরি, মানমন্দির, সেখান থেকে তিনি এখন দিগন্ত পর্যবেক্ষণ করবেন।

কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো হদিশই তো এই নূতন জগতে পাওয়া গেলো না—এখন তাহলে তাঁরা তাঁর খোঁজে আর-কোথায় যাবেন?

নিচের ডালে বসে এই নিয়েই বলাবলি করছিলেন তাঁরা।

মেজর ম্যাকন্যাব্‌সের সুচিন্তিত অভিমত : ‘সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তর ধ’রেই না-হয় বরাবর যাওয়া যাক—তবে পথে কী পড়বে সেটাও জানা দরকার—’

‘তাহ’লে মঁসিয় পাঞয়লকে জিগেস করা যাক—’

মঁসিয় পাঞয়ল তখন মগডালে ব’সে দূরবিনে চোখ এঁটে আছেন। সেখান থেকেই তিনি হেঁকে বললেন—’সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তরে কী আছে? সেটা বলবার জন্যে নিচে নামবার কোনোই দরকার নেই। সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তর আমেরিকা থেকে বেরিয়ে অ্যাটলান্টিকের ওপর দিয়ে ত্রিস্তান ডা কুনিয়া দ্বীপটা পেরিয়ে উত্তমাশা অন্তরীপের দু-ডিগ্রি দক্ষিণ দিয়ে ভারত মহাসাগরে আমস্টারডাম দ্বীপ আর সেন্ট পল্স দ্বীপের পাশ পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টরিয়া রাজ্যের মাথার ওপর দিয়ে—’

আস্ত ভূগোলবই আওড়াতে গিয়ে মাঝপথেই থেমে গেলেন পাঞয়ল।

অ্যা? কী ব্যাপার? ভৌগোলিক কি তবে জ্ঞান হারিয়ে বাক্যহারা?

না তো। কেননা পরক্ষণেই শোনা গেছে বিষম-একটা বিদঘুটে চিৎকার। তারপরেই দুমদাম আওয়াজ ক’রে কী যেন আছাড় খেয়ে পড়তে লাগলো ঐ মগডাল থেকে।

সাড়ে-সর্বনাশ। এ আবার কী? হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছেন নাকি জাক পাঞ্চয়ল? মেজর ম্যাকন্যাব্‌স যদি হাত বাড়িয়ে ধরে না-ফেলতেন তবে সত্যিই জলে প’ড়ে যেতেন পাঞয়ল : তিনি তখন ডিগবাজি খেতে-খেতে মগডাল থেকে নিচে আছড়ে পড়ছিলেন।

‘কী ব্যাপার, বলুন তো? ফের বুঝি ভুলে গিয়েছিলেন কোথায় আছেন? ‘ঠিক তাই। ভুলবো না? নিজের আহাম্মুকিতে আমি যে নিজেই জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলেছিলুম!’

পাঞয়ল সত্যি আহাম্মক কি না, সে নিয়ে একটা তর্ক তোলাই যায়। তবে অকস্মাৎ তাঁর এই আত্মজ্ঞান লাভের কারণ কী?

‘ভাবুন একবার! কাপ্তেন গ্রান্টকে আমরা কি না এমন জায়গায় ছুঁড়ে বেড়াচ্ছি যেখানে তিনি নেই—আদপেই তিনি এ-তল্লাটে আসেননি। কস্মিনকালেও না!’

পাঞয়ল কি তবে এত বিপদ-আপদে সত্যি সব জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলেছেন? মাথাটাই বিলকুল গেছে নাকি? এ আবার কেমনতরো কথা?

কিন্তু পাঞয়লের মাথার পোকা নতুন ক’রে আর তাঁকে কামড়ায়নি—তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন। সোজাসুজি স্পষ্ট গলায় তিনি ঘোষণা করলেন : ‘মুশকিল আসানের ঐ তিন তলবটা আমরা সবাই তিন-তিনবার ভুল পড়েছি। Austral একটা গোটা শব্দ নয়—Australia শব্দটার ভগ্নাংশ—জলে ঐ i আর a মুছে গিয়েছে—’

গ্লেনারভন আপত্তি তুললেন। ‘ভুল পড়বো কেন? অস্ট্রেলিয়া তো আসলে একটা দ্বীপই—’

‘আপনারা কী বলেন, তাতে কিছু এসে-যায় না। ভৌগোলিক মাত্রেই বলবে অস্ট্রেলিয়া আস্ত একটা মহাদেশ?

‘তাই বুঝি?’ পাঞয়লের বক্তৃতাটা সবে শুরু হ’তে যাচ্ছিলো, গ্লেনারভন সেটা চট ক’রে থামিয়ে দিলেন। ‘বেশ, তাহ’লে এবার অস্ট্রেলিয়াতেই যাওয়া যাক।’

ব্বাস, একটি মোক্ষম কথাতেই সব আলোচনা খতম।

আলোচনা খতম বটে, কিন্তু বলবামাত্রই কি আর যাওয়া যায়? ডানকান এখন কোথায়? আরো চল্লিশ মাইল পথ যেতে হবে যে—আর তাও যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ এখানে জল থৈ-থৈ করবে।

তখন বেলা প’ড়ে এসেছে। চারটে বাজে।

রবার্ট এতক্ষণ মনমরা হয়ে বসেছিলো, কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো হদিশ না-পেয়ে বেচারার মুখ দিয়ে একটাও কথা সরছিলো না। এবার সেই পাঞয়লের মুখ থেকে অস্ট্রেলিয়ার কথা বেরুলো, অমনি আবার নতুন উৎসাহের সঞ্চারে সে একেবারে ডগমগ হ’য়ে উঠলো। সব আশা তাহ’লে এখনও শেষ হ’য়ে যায়নি। চাঙ্গা হ’য়ে সে লাফিয়ে উঠে পড়লো—এই একটা-গাছ-দিয়েই-তৈরি জঙ্গলটায় এবার সে শিকারে গেলো—মেরে নিয়ে এলো গোটা-কয় ছোটো পাখি। সেইসঙ্গে পাখির বাসা থেকে হাতসাফাই ক’রে আনলে বেশ-কিছু ডিম। ছুঁচ আর সুতো দিয়ে বঁড়শি বানিয়ে কিছু মাছও ধরা হ’লো জল থেকে।

রসুইখানার ভার এবার জাক পাঞ্চয়ল নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন। কে না জানে ফরাশিরা রান্নায় ওস্তাদ। আর তিনি তো আপাদমস্তক ফরাশি একজন—না, কি? রান্নার বাসনকোসন নানাবিধ ফোড়নের মশলা এ-সব বিনাই সেদিন সন্ধেয় তিনি যা-একখানা উপাদেয় ভোজ রাঁধলেন—অথবা, বলা যায়, পাতায় মুড়ে ঝলসালেন—আর তার এমনই তার যে তা যেন সকলেরই মুখে লেগে রইলো।

জল না-কমা অব্দি এই গাছের মধ্যেই কাটাতে হবে তাঁদের। ভ্যাপসা গরম পড়েছে, দারুণ গুমোট, আকাশে ঝুলে আছে থমথমে ভারি মেঘ, এত নিচু যেন এই কাছের ডগাটাই ছোঁয়। হাঁসফাস করতে-করতে তারই মধ্যে চলেছে আড্ডা, গুল্পগুজব, পাঞয়লের দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা। যে-কোনো বিষয় পেলেই হ’লো : প্রায় সবজান্তার ভঙ্গিতেই পাঞয়ল সেই বিষয় নিয়ে সাতকাহন শুনিয়ে দিতে পারেন।

সন্ধ্যের সময় কিন্তু ঐ নিচু ভারি মেঘ সরে গেলো, আর আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ফুটফুটে আকাশ, যেখানে অগুনতি তারা ঝকমক করছে। সেইসঙ্গে গুমোটের ভাবটা কেটে গিয়ে ফুরফুরে একটু হাওয়াও দিচ্ছে। গাছের ডালের বাসায় জাঁকিয়ে ব’সে রবার্টকে এবার পাঞয়ল তারাদের নিয়েই মস্ত-একটা বক্তৃতা ফেঁদে শোনালেন। পাতাগোনিয়ার কবিদের কল্পনায় অরিয়ন নক্ষত্র রূপ নিয়েছে তিনটে বোলাস আর একটা ল্যাসোর। কেউ যেন তাদের মহাশূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছে গোটা-কয় তারাকে পাকড়াবার জন্যে। অর্থাৎ মাটির শিকার সরাসরি কবিকল্পনায় উঠে গিয়েছে আকাশে।

পাঞয়লের বক্তৃতা যখন জ’মে উঠেছে—রসিকতা, টীকা-টিপ্পনীসমেত – এমন সময় হঠাৎ পুবদিকে দিগন্তের কাছে কালো একটা ফুটকির মতো কী দেখা গেলো, সেটা একটু বাদেই বড়ো হ’য়ে যেন মাটির একটা ঢেলা হ’য়ে উঠেছে। একটু-একটু ক’রে এগিয়ে এসে সে ঝিকমিক-ঝিকমিক তারাদের ঢেকে দিতে গেলো। আর তারই সঙ্গে তাল রেখেই যেন ঐ ফুরফুরে হাওয়াটাও মরে গেলো। আবার কী-রকম থমথমে গুমোটে সবকিছু হাঁসফাস করতে লাগলো। নিচে বানের জল থম মেরে আছে। যেন একটা গেরিমাটির আয়নার উপরিতল।

কেউ কোনো মন্তব্য করার আগেই, নক্ষত্রতত্ত্বের প্রসঙ্গ পালটে ফেলে, পাঞয়ল ব’লে উঠলেন : ‘লক্ষণ মোটেই ভালো না। সাংঘাতিক একটা বজ্রবিদ্যুতে ভরা ঝড় আসছে। প্রচণ্ড-সব বাজ পড়বে পর-পর। আর আমাদের দশাও তাতে সঙিন হ’য়ে উঠবে—কেননা এদিকটায় তো গাছ বলতে আমাদের এটাই—আর সব গাছকেই তো বন্যার জল উপড়ে ফেলেছে। এ-গাছটার ওপর বাজ না-পড়লেই হয়।’

পাঞয়ল যেন কোনো গানের আসরের কনডাকটার। তাঁর কথাই যেন ছিলো ইঙ্গিত। তাঁর কথা শেষ হ’তে-না-হ’তেই শুরু হয়ে গেলো গুমগুম আওয়াজ, আর সেইসঙ্গে জলের ওপর হঠাৎ দেখা দিলে অগুনতি আলোর ফোঁটা। ফসফর নাকি?

পাঞয়ল ঝুঁকে ফস ক’রে হাত বাড়িয়ে জল থেকে টপ ক’রে একটা আলোর ফোঁটা ধ’রে ফেললেন। ‘এ-যে দেখছি তুকো-তুকো!’

‘তুকো-তুকো মানে? জোনাকি?

‘হ্যাঁ, জোনাকিও বলতে পারো—তবে এদের ভাষায় এই ফসফর-পোকা হ’লো জ্যান্তহিরে। এই দ্যাখো, লম্বায় প্রায় ইঞ্চিটাক। এখানকার মেয়েরা এদের ধ’রে-ধীরে মালা গাঁথে, গলায় পরে, খোঁপায় গোঁজে।’

ফসফরের আলোয় পাঞয়লের হাতের ঘড়িতে দেখা গেলো রাত বাজে দশটা। যেন দিনক্ষণ দেখেই তক্ষুনি ঝড়টা ফেটে পড়লো। আকাশ চিরে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ, ঘন-ঘন, যেন আগুনের ল্যাসো ছুঁড়ে-ছুঁড়ে কেউ আস্ত আকাশটাকেই পাকড়াবার চেষ্টা করছে। আর তারই সঙ্গে তাল রেখেই গুমগুমগুম ক’রে গড়িয়ে যাচ্ছে বাজ। আর সেইসঙ্গে নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি—কী বড়ো-বড়ো ফোঁটা, যেন গায়ে এসে বেঁধে। কুঁকড়িমুকড়ি হ’য়ে পাতার আড়ালে গা ঢাকা দেবার চেষ্টা করলেন সবাই, কিন্তু তাতেও কি আর এই মুষলধারে বর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়?

সবে সবাই পাতার ঘন বুনোনের আড়ালে গুটিশুটি হ’য়ে বসেছে, এমন সময় আকাশের আগুন নেমে এলো গাছটাতেই। প্রথমে যেন বিদ্যুতের একটা গোলা ছোটাছুটি করলে ডাল থেকে ডালে, আর ভেজা পাতায় আগুন লেগে উঠলো কালোধোঁয়ার কুণ্ডলী। তারপর বার-কয়েক চর্বিপাক খেয়ে সেই বিদ্যুতের গোলাটা প্রচণ্ড আওয়াজ করে ফেটে গেলো—আওয়াজটা এত-জোরে আর এত-কাছে হ’লো যে মনে হ’লো গোলাটা ঠিক যেন মাথার মধ্যে ফেটেছে। বোঁ ক’রে ঘুরে-ওঠা মাথার হকচকানো দশা কমে যাবার আগেই দেখা গেলো, পাঞয়ল যে-ভয় করেছিলেন, তা-ই হয়েছে; গাছে আগুন ধরে গিয়েছে। আগুন যেন লাফিয়ে-লাফিয়ে নামছে ডাল থেকে ডালে, পুড়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা, ডালপালা, পাখির বাসা – সবকিছু।

ভয় পেয়ে সবাই স’রে এলেন আগুনের কাছ থেকে, পুবদিকে।

এবার আর কারু রেহাই নেই।

নিচে বানের জলে ঘূর্ণি লেগেছে, ওপরে আগুন জ্বলছে লেলিহান

উইলিয়ামের গায়ে আগুনের হলকা ছ্যাঁকা দিতেই সে লাফিয়ে নেমে পড়েছিলো জলে। কিন্তু পরক্ষণেই সবকিছু ছাপিয়ে ভেসে এলো তার কানফাটানো চিৎকার : ‘অ্যালিগেটর! অ্যালিগেটর!’

কুমিরের ভয়াল দোসর এই অ্যালিগেটরদের এ-দেশে কে না ভয় পায়? গাছের তলায় বেশ কয়েকটা—দশ-বারোটা হবে বোধহয়—অ্যালিগেটর জলের মধ্যে গা ভাসিয়ে আছে—ওৎ পেতেই আছে—কখন তাদের খাদ্য টুপ করে খ’সে পড়ে গাছ থেকে, সেই, অপেক্ষাতেই আছে।

হঠাৎ দক্ষিণদিক থেকে এলো পাহাড়প্রমাণ একটা মস্ত ঢেউ, আর এত ধকল সামলাবার পর, এতক্ষণে এই-এতবড়ো গাছটা মড়মড় করে উপড়ে গেলো। জলে পড়তেই আগুন নিভে গেলো, অ্যালিগেটরগুলোও ছিটকে গেলো একপাশে, শুধু একটা একটু তেড়িবেড়ি ক’রে ধেয়ে এসেছিলো, শেষে জ্বলন্ত ডালটা তুলে একজন নাবিক তার গায়ে গায়ের জোরে হাঁকাতেই অ্যালিগেটরটা ছিটকে পড়লো জলে, আর তার ল্যাজের আছড়ানিতে যেন জলে হুলুস্থুল বেধে গেলো—যদি অবশ্য হুলুস্থুলের তখনও কিছু বাকি থেকে থাকে।

এই এতবড়ো গাছটাই এখন তাঁদের ভেলা। হাওয়ার দাপটে এই মস্ত বিশাল বেনোজলের ওপর দিয়ে ভেসে চললো গাছটা—কতক্ষণ কে জানে—অন্তত ঝলসে মরার ভয় নেই—এখন কোনোক্রমে শুকনো ডাঙায় গিয়ে পৌঁছুতে পারলে হয়

তারপর একসময় বৃষ্টিও ধ’রে এলো, সেই মুষলধারের বদলে এখন মিহি ফিনফিনে বৃষ্টির একটা পর্দা ঝাপসা ক’রে রেখেছে সব। আখরোট গাছের ভেলা ভেসেই চলেছে।

শেষরাতের দিকে, তখন সম্ভবত তিনটে বাজে, ভেলাটা যেন মাটির গায়ে ধাক্কা খেলে। তারপরেই ঘষটে ঘষটে চললো কিছুক্ষণ, প্রায় কুড়িপঁচিশ মিনিট বাদে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো এই অদ্ভুত ভেলাটা।

ফুর্তিটা সবচেয়ে বেশি পাঞয়লেরই। ‘মাটি! মাটি!’

দুড়দাড় ক’রে সবাই লাফিয়ে নামলে মাটিতে। আর নেমেই–এ কী তাজ্জব দৃশ্য।

সামনেই দাঁড়িয়ে ত্রোনিদো, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে তার ঘোড়া খুর ঠুকছে।

ত্রোনিদো পাঞয়লের ঠিক উলটো—সাত চড়েও রা কাড়তে চায় না। তবু দু-চার কথায় সে যা বললে তার সারাংশ হ’লো, বেনোজলের তোড়ে সবাই একসময়–না, একসময় যে এদিকটাতেই ভেসে আসবে, তা সে আন্দাজ করেছিলো। তাই একটা পরিত্যক্ত র‍্যাচে সে সকলের জন্যে খাবার ব্যবস্থা ক’রে রেখে এসেছে।

সেখানেই বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলে সবাই। সকাল হ’লেই ফের রওনা হ’তে হবে অ্যাটলান্টিকের পানে।

অ্যাটলান্টিকের তীরে এসে পরদিন যখন পৌঁছনো গেলো, তখন রাত ক’রে এসেছে, জোর হাওয়া দিচ্ছে, হয়তো আরো-একখানা পূর্বাভাস। তীরে ডানকান নেই। সে ভাসছে ডাঙা থেকে দূরে, জলের ওপর। তীরে যে নেই, তার কারণ ঝড়ের প্রকোপে ডাঙায় ঘা খেয়ে ডানকান বেদম জখম হ’য়ে যেতে পারে, তাই সাবধানের মার নেই ভেবে তাকে বারদরিয়ার কাছে নিয়ে-যাওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ আজ রাতটা তীরেই তাঁদের কাটিয়ে দিতে হবে, ঐ চড়ায়। অ্যাটলান্টিকে পৌঁছে গেছে, ঐ-যে দূরে ছায়ার মতো ডানকানকে দেখা যাচ্ছে, এ-কথা ভেবে অন্যদের মনে যতই স্বস্তির ভাব দেখা দিক, লর্ড গ্লেনারভনের মনে কিন্তু একফোঁটাও স্বস্তি নেই—তিনি সারারাত ছটফট করেই কাটালেন। দক্ষিণ আমেরিকায় পা দেবার পর থেকেই পর-পর যত অপ্রত্যাশিত ঘটনার আবর্তে তাঁরা পাক খেয়েছেন, তাতে ডানকানে পা না-দেয়া অব্দি তিনি মোটেই স্বস্তি পাবেন না। আবার অতর্কিতে কোনদিক থেকে কী বিপদ আসে কে জানে!

ভোরের আলো ফুটতেই কিন্তু স্পষ্ট দেখা গেলো ডানকানকে। আর দেখেই আকাশ লক্ষ্য ক’রে পর-পর তিনবার বন্দুক ছুঁড়লো ত্রোনিদো—সংকেত। আর তারপরেই ডানকানের ডেক থেকে তোপের আওয়াজ এলো—কামান দেগে সংকেতের উত্তর দিচ্ছে। পরক্ষণেই ডানকান থেকে ভাসিয়ে দেয়া হ’লো একটা নৌকো।

ত্রোনিদো কিছুতেই তার স্বদেশ ছেড়ে যাবে না—সে এই আহেনতিনাতেই থাকবে। ত্রোনিদো ছাড়া আর-সবাই উঠে পড়লেন ডানকানের নৌকোয়। শুধু রবার্ট নৌকোয় গিয়ে ওঠবার আগে ত্রোনিদো একবার তার হাত চেপে ধরলো। অস্ফুট স্বরে বললে, ‘আর তুমি কিশোর নও এখন, বড়ো হয়ে গেছো!’

নৌকো যতক্ষণ-না অভিযাত্রীদের নিয়ে গিয়ে ডানকানে ভিড়লো, ত্রোনিদো পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিলো তীরে। সবাই একে-একে ডানকানে উঠে যেতেই, সে তার তেজি ঘোড়াটার পিঠে লাফিয়ে উঠলো, তারপর ডানকানের দিক থেকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সবেগে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে হয়তো পাম্পারই উদ্দেশে।