১. বিশ্ববিখ্যাত মানুষদের জীবন

দ্য স্যান্ড অফ টাইম (সময়ের বালুকাবেলায়)
সিডনি সেলডন

বিশ্ববিখ্যাত মানুষদের জীবন আমাদের কানে কানে সেই কথা বলে, আমরাও তাদের মতো হতে পারি। তারা চলে যান, কিন্তু সময়ের বালুকাবেলায় তাদের পদচিহ্ন থেকে যায়।

–হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলো।

.

না, যারা মারা গেছেন তাদের ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করো না।

তারা এই পৃথিবীর অংশ হয়ে গেছেন। এই পৃথিবীর মধ্যে তাদের সব কিছু মিশে আছে। তারা সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেপনের গৃহযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন, তারা ইতিমধ্যেই অমরত্ব লাভ করেছেন।

—আরনেস্ট হেমিংওয়ে।

.

গল্প শুরুর আগে আপনারা এটাকে একটা বানানো উপন্যাস বলতে পারেন, কিন্তু…

আমরা প্রবেশ করতে চলেছি ডন কুইকসোট এবং ফ্লেমিংকোর সেই রোমান্টিক ভূমিখণ্ডে, যা বরাবর ট্যুরিস্টদের হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। একে আমরা স্পেনীয় অভিযাত্রীদের মহান দেশ বলতে পারি। টরকোয়েমাডার দেশ হিসেবেও একে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখব, এই দেশের বুকে একদা সবথেকে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ হয়ে গেছে। পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একদিকে প্রজাতন্ত্রী, অন্যদিকে বিদ্রোহী জাতীয়তাবাদীরা। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ২৬৯টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। জাতীয়তাবাদীরা হত্যা করতে থাকে প্রজাতন্ত্রীদের। প্রতি মাসে অন্তত এক হাজার করে। নিহতদের জন্য শোক প্রকাশের ওপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। ১০৭টি গির্জা ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়। কনভেন্ট থেকে বিতাড়িত করা হয় উপাসিকাদের। ডার্ক ডি সেন্ট সিমন লিখেছেন– এটা হল স্পেনীয় সরকার এবং চার্চের কর্তৃত্বের মধ্যে লড়াই। শেষ পর্যন্ত তা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। সংবাদপত্রের আধিকারিকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খবরের টুটি চেপে ধরা হয়েছে। এই গৃহযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়। জাতীয়তাবাদীরা ফ্রাঙ্কের নেতৃত্বে স্পেনের ওপর তাদের দখলদারি কায়েম করে। ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর পর স্পেনে রাজতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।

১৯৩৬-১৯৩৯ সরকারীভাবে গৃহযুদ্ধের সময়সীমা। তারপরেও যুদ্ধের আগুনের আঁচ ধিকিধিকি জ্বলেছে। স্পেনের দুটি অংশ পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কখনও সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত করা সম্ভব হয়নি। আজ স্পেনের বুকে আর একটি গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে। গেরিলারা বাসকোর নেতৃত্বে কর্তৃত্বের জন্য লড়াই করছে। এই লড়াইয়ের প্রথম পর্যায়ে তারা গণতন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়েছিল। কিন্তু ফ্রাঙ্কের শাসনকালে এই যুদ্ধে তারা পরাস্ত হয়। এই যুদ্ধে যথেষ্ট বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। একের পর এক ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেছে গুপ্ত হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

ই টি এ অর্থাৎ একটি গেরিলা সংবাহিনীর নেতা মাদ্রিদ হাসপাতালে মারা গেছেন। তাকে ভীষণভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল। এই মৃত্যু দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা করেছে। এর ফলে স্পেনের পুলিশ বিভাগের মহা আধিকারিককে পদ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। পাঁচজন নিরাপত্তা প্রধানকেও অপসারিত করা হয়েছে। চলে গেছেন ২০০ জন বলিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক।

১৯৮৬ সালে বার্সিলোনাতে বাসকোয়েটরা জনসমক্ষে স্পেনের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছেন। বাসকোর অধীনস্থ মানুষদের অত্যাচারে পাম্পালোনাতে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পুলিশ দীর্ঘদিন যোবা ভূমিকা পালন করেছে। তারপর শুরু হয়েছে আধা সামরিক বাহিনীর শাসন। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছে। দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। বাসকোর বাড়িতে গুলি চলেছে। জনগণ অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ চোখে পড়ছে।

১৯৭৬ সালের ঘটনাবহুল দুটি সপ্তাহকে পাথেয় করে লেখা হল এই উপন্যাসটি। তাই . বলছি পাঠক-পাঠিকা, একে বানানো উপন্যাস বলার আগে এক মুহূর্ত চিন্তা করবেন…

.

০১. পাম্পালোনা, স্পেন-১৯৭৬

যদি পরিকল্পনাটা কোনো কারণে ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে আমাদের সকলকে মরতে হবে।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন এই প্রকল্পনার মধ্যে কোনো লুকোনো ত্রুটি বা অসঙ্গতি আছে কিনা। উনি একজন বুদ্ধিমান মানুষ। শেষ পর্যন্ত দেখলেন, না, কোনো ছিদ্র চোখে পড়ছে না। পরিকল্পনাটার মধ্যে দুঃসাহসের ছাপ আছে। একে আমরা এক নির্ভীক প্রকল্প বলতে পারি। সেকেন্ডের ক্ষণভগ্নাংশের মধ্যে কাজ করতে হবে। জয়যুক্ত হলে অসামান্য সফলতা অর্জিত হবে। কিন্তু যদি আমরা হেরে যাই…

এখন চিন্তা করার কোনো মানে হয় না। জাইমে মিরো দার্শনিকভাবে চিন্তা করলেন এখন কাজে লেগে পড়তে হবে।

জাইমে মিরোকে আমরা কিংবদন্তীর এক মহানায়ক বলতে পারি। বাসকের অধীনে এক মহান নেতা। ইতিমধ্যে তিনি স্পেনীয় সরকারের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছেন। ছফুট লম্বা, মুখমণ্ডলে বুদ্ধির দ্যুতি, পুরুষালি চেহারা, দুটি চোখের তারায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অবয়বের থেকে তাকে আরও বেশি উচ্চ বলে মনে হয়। দেহের যা রং, তার থেকে বেশি বাদামী বলে মনে হয়। তিনি এক জটিল চরিত্রের মানুষ। বাস্তববাদী, যে কোনো ঘটনার ভবিষ্যৎ ব্যাপার কী হতে পারে, তা অনায়াসে বুঝতে পারেন। আবার রোমান্টিক মনোভাবাপন্ন। স্বপ্নের জন্য জীবন দিতে কুণ্ঠিত হন না।

পাম্পালোনা শহরটির সকলে এখন উন্মাদ হয়ে গেছে, কারণ কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হবে সেই রক্ত নাচানো খেলা। ফিয়েস্টা দে সান ফেরমিন, উন্মত্ত ষাঁড়ের লড়াই, জুলাই-এর ৭ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত এই হাড় হিম করা খেলার আসর বসে। সমস্ত পৃথিবী থেকে তিরিশ হাজার পর্যটক ইতিমধ্যেই এই শহরে ভিড় করেছে। কেউ কেউ এসেছে এই শ্বাসরোধকারী খেলাতে অংশ নিতে ওই ভয়ংকর জন্তুর সাথে লড়াইতে অবতীর্ণ হতে। কোনো হোটেলে একটুকরো জায়গা ফাঁকা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাভারা থেকে বিছানা নিয়ে দরজার সামনে শুয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্কে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে না। পার্কিং করা গাড়িগুলোতেও তারা জোর করে বসে পড়েছে। মাঠে ময়দানে তাদের তাবু চোখে পড়ছে। এমন কি ফুটপাথেও দেখা যাচ্ছে তাদের সারিবদ্ধ মিছিল।

কাফে এবং হোটেলে নানা ভাষার মানুষের ভিড়। সকলেই ওই শব্দচঞ্চল বর্ণরঞ্জিত মিছিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আহা, কৌতূহলোদ্দীপক বাজনা বেজে উঠেছে। প্যারেড এগিয়ে চলেছে। বাদামী রঙের ক্লোক পরা। কেউ বা সবুজ পোশাকে আচ্ছাদিত। মাথায় উষ্ণীষ, হাতে উন্মুক্ত তরবারি। সোনার আলো ঝিকঝিক করছে। রাস্তার মধ্যে দিয়ে তারা বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে এ বুঝি সাতরঙা নদী, মাঝে মধ্যে আতস বাজির বিস্ফোরণ, এখানে সেখানে আলোর ছটা। উৎসব শুরু হল বলে।

মানুষজন এসেছে সান্ধ্যলড়াইতে যোগ দেবে বলে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য অংশ হল এনসিরো– ভোরবেলার লড়াই। এর জন্য অনেকে উদগ্রীব চিত্তে অপেক্ষা করে।

মধ্যরাত শুরু হবার দশ মিনিট আগে, রাস্তাঘাট অন্ধকার হয়ে গেছে। পাগল ষাঁড়গুলোকে তাদের আস্তানা থেকে বের করা হচ্ছে। এবার তারা সেতুর ওপর দিয়ে দৌড়োতে শুরু করবে। তাদের গন্তব্য ক্যালে সানটো ডোমিংগো। সেখানে সারারাত তাদের আটকে রাখা হবে। ভোর হবার আগে দড়ি খুলে দেওয়া হবে। তারা এগিয়ে যাবে সরু ক্যালে সানটো ডোমিংগোর মধ্যে দিয়ে। হাজার মানুষের দৃষ্টি তাদের ওপর পড়বে। পৌঁছোবে প্লাজা দে হেমিংওয়েতে। সেখানে তাদের আটকে রাখা হবে বিকেল পর্যন্ত।

মধ্যরাত থেকে সকাল ছটা, আগন্তুকদের চোখের তারায় ঘুম উধাও, তারা আনন্দে মদ্যপান করছে, যৌবনের গান গাইছে, একে অন্যকে অনভিপ্রেত ভালোবাসা নিবেদন করছে। এত বেশি উত্তেজিত যে ঘুমোতে পারছে না। যারা এই মরণ খেলায় অংশ নেবে, তারা ইতিমধ্যেই জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে।

ছটা বাজতে আর বেশি দেরী নেই। মিনিট পনেরো বাকি আছে, ব্যান্ডের শব্দ পাওয়া গেল। অসাধারণ সংগীত, নাভারে বৃন্দবাদন। সকাল সাতটা, মনে হল বাতাসের মধ্যে দিয়ে রকেট ছুটে গেছে। মানুষ পাগল হয়ে গেছে। তারা আনন্দে চিৎকার করছে। এক-একটা মুহূর্তকে এক-একটা যুগ বলে মনে হচ্ছে। সময় এগিয়ে এসেছে, এবার–সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত।

এমন কিছু ঘটনা চোখে পড়ছে যা কোনোদিন ভোলা সম্ভব হবে না–একটির পর একটি। বাতাসের বুকে আলোড়ন। জলের বুকে বুদবুদ, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। শব্দরা হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন একটি শব্দ আসছে। দেখা গেল, ছটি কালো কুচকুচে গোক আর ছটি বিরাট আকারের ষাঁড়কে। এক-একটির ওজন ১৫০০ পাউন্ডের কম হবে না। তারা। সকলেই প্রশিক্ষিত। চাবুকের আঘাত মাত্রই গর্জন করে উঠছে। কাঠের আচ্ছাদনের ভেতর সকলের চোখ। লড়াই এবার শুরু হবে। ষাঁড়গুলোকে কোনোরকমে শেষ অব্দি বেঁধে রাখা হচ্ছে। তারাও লড়াই করতে উদগ্রীব। কিছু কিছু মানুষ চিৎকার করছে–ভয় এবং আতঙ্কে। কেউ আবার ওই উন্মত্ত বন্য জন্তুর সাথে লড়াই করার প্রহর গুণছে।

রাস্তার শেষ প্রান্তে অনেক মানুষের ভিড়, ক্যালে লাফটফেটা এবং ক্যালে জাভিয়ারের পাশে। দোকানগুলো চোখে পড়ছে। জামাকাপড়ের দোকান, ফলের দোকান। আমরা এগিয়ে চলেছি প্লাজা দে হেমিংওয়ের দিকে। এবার একটা চিৎকার শোনা যাবে। উন্মাদ মানুষের মুখ থেকে। ওই দেখা যাচ্ছে, ওই দেখা যাচ্ছে ষাঁড়ের মিছিল। শুরু হয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল আর্তনাদ। তাদের চকচকে তীক্ষ্ণ শিং, তাদের খুর দিয়ে আগুন ছুটছে। আমরা বাস্তবে ফিরে এসেছি। মৃত্যু, আরও আরও কাছে এসে গেছে। আমরা কি এখন পালাব? ঢুকে পড়ব ঘরের মধ্যে। দেখা গেল, একদল ভীতু মানুষকে। তারা এখানে থাকতে পারছে না। এই উত্তেজনার আগুনের আঁচ তাদের পুড়িয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে ষাঁড়ের পায়ের তলায় তারা চাপা পড়বে। এখুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

একটি ছোট্ট ছেলে তার দাদুর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল ব্যারিকেডের আড়ালে। দুজনেরই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে দুটি শরীর।

ওদের দিকে তাকাও, বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, অসাধারণ তাই নয় কি?

 ছোটো ছেলেটি ভয় পেয়েছে আমি ভয় পাচ্ছি দাদু, আর এখানে থাকব না।

দাদু এগিয়ে এলেন, ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, ভয় পাবার কী আছে? হ্যাঁ, ভয়-ভয় করছে বটে, কিন্তু দেখো, এই অভিজ্ঞতা তুমি সারা জীবন মনে রাখবে। আমি একবার ষাঁড়ের সঙ্গে লড়েছিলাম। প্রথমে খুব ভয় লেগেছিল। তারপর দেখলাম, না, ব্যাপারটার ভেতর এত আতঙ্কের কিছু নেই। এভাবেই তুমি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে পারবে। জিতলে মনে হবে তুমি সত্যিকারের পুরুষ।

এখানে একটা নিয়মের কথা বলা যাক। ওই জন্তুগুলো ক্যালে সানটো ডোমিংগো ধরে প্রতি দুমিনিটে ৯০০ গজ ছুটে নিরাপদ জায়গায় চলে আসবে। বাতাসের মধ্যে সংকেত ভেসে আসবে। শুরু হবে লড়াই। কিন্তু? চারশো বছর ধরে আমরা একই নিয়ম পালন করে আসছি, তাই তো?

সরু পথ দিয়ে যাঁড়ের দৌড় শুরু হয়ে গেছে। অন্তত ছজন বীর পুরুষকে দেখা গেল, বর্ণরঞ্জিত পোশাক তাদের পরনে, তারা সবকিছু সামলাচ্ছে। তারা ওই ষাঁড়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছে। দেখছে, এখানে যেন কোনো অশুভ ঘটনা না ঘটে। একটু বাদেই সবকিছু পালটে যাবে। অনেকের শুভ সন্ধ্যা দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। অনেকের জীবন মৃত্যুর হাহাকারে হারিয়ে যাবে। বোঝা যাচ্ছে, উন্মাদনা আরও বাড়ছে। আঘাত করা হচ্ছে ওই ষাঁড়গুলোকে। তাদের গায়ে চাবুক। তারা ক্ষেপে উঠেছে।

আমরা আবার দৃষ্টি ফেরাচ্ছি ওই ছোট্ট ছেলে এবং তার দাদুর ওপর। কী হল? এক মুহূর্তের অসর্তকতা। ষাঁড়ের পায়ের তলায় দুজনেই প্রাণ হারিয়েছে কি? আর্তনাদ? হ্যাঁ, ঘাতক ষাঁড়ের শিং ঢুকে গেছে ওই ছোটো ছেলেটির পেটের মধ্যে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে তার। একটু বাদে তার মার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হল। বাতাসে মৃত্যুর ইশারা। শুরু হয়ে গেছে বিশৃঙ্খলা। কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। যাঁড়েরা খেপে গেছে। বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুদের অবস্থা শোচনীয়। তারা শিং বাগিয়ে ধরেছে। ঢুকে পড়েছে বাড়ির মধ্যে। ভেঙে দিচ্ছে খাবারের স্টলগুলি। কোনো কিছুকেই তারা রেয়াদ করছে না। কেন এমন হল? মানুষজন পালাচ্ছে, কীভাবে এখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া যেতে পারে, তাই নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেছে।

হঠাৎ দেখা গেল একটা উজ্জ্বল লাল ট্রাককে। কে এসেছে? পুলিশ কি? এবার কী হবে? এই রাস্তা কোথায় গেছে? পাম্পালোনার কারাগারের দিকে।

.

এবার আমরা, দোতলা পাথরের তৈরি বাড়ির দিকে দৃষ্টি ফেরাব। এই বাড়ির সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল এর ছোটো ছোটো জানলাগুলি। চারটি দিকে চারটি জানালা আছে। মাথার ওপর লাল-হলুদ স্পেনদেশীয় পতাকা উড়ছে। পাথরের তৈরি গেট। ছোট্ট বাগান। তিনতলায় আছে বেশ কয়েকটা সেল, যেখানে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তদের আটকে রাখা হয়।

জেলখানার মধ্যে একদল গার্ড ইউনিফর্ম পরে পায়চারি করছে। কঠিন কঠোর তাদের দৃষ্টি। পুলিশের হাতে মেশিন গান।

এখানে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। প্রশ্ন করাটা অপরাধ। কেউ একজন জানতে চাইল ফাদার, আমরা কি আরও সতর্ক হব? মনে হচ্ছে, একটা অঘটন ঘটতে চলেছে।

সেই প্রহরী তাকিয়ে থাকল ফাদারের দিকে। মেটাল ডিটেক্টর তার হাতে ধরা আছে। এগুলো সাধারণত এয়ারপোর্টে ব্যবহার করা হয়।

–আমি দুঃখিত ফাদার, কিন্তু এটাই হল এখানকার নিয়ম।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে এত কিন্তু কিন্তু করতে হবে না।

পাদরি সাহেব সিকিউরিটি পেট্রলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন, পরিস্থিতি এখন অনুকূল নয়। দেখা গেল রথী তার হাতে ধরা অস্ত্রের ওপর আঙুলের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।

যাজক তাকালেন। প্রশ্রয়ের হাসি।

–এটা আমারই ভুল। তিনি মেটাল ডিটেক্টরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেন। তার গলায় একটা রুপোর চেন ছিল। সেটি তুলে দিলেন প্রহরীর হাতে। না, এবার কোনো শব্দ নেই। মেশিন নীরব হয়ে গেছে। প্রহরী ওই ক্ৰশটা আবার তার হাতে দিয়ে দিল। এবার তিনি কোথায় যাবেন? তিনি বোধহয় কারাগার কক্ষে প্রবেশ করবেন।

করিডরে কিছু মানুষের ভিড়। প্রহরী দার্শনিক সুরে বলে উঠল– আপনি যাবেন, সত্যি ফাদার? কিন্তু কেন? এই ষাঁড়ের আত্মার শান্তি কামনায়?

হ্যাঁ, আমাকে তো চেষ্টা করতে হবে।

প্রহরী মাথা নাড়ল- আমি তো বলেছি, এখানে নরকের অন্ধকার। এখানে আপনার কোনো কাজ নেই।

পাদরি সাহেব অবাক হয়ে প্রহরীর দিকে তাকালেন। তিনি বললেন- হ্যাঁ, আমি কেন এসেছি জানো? আমি স্বীকারোক্তি গ্রহণ করব। অন্তত কিছু মানুষের কাছ থেকে।

প্রহরী ঘাড় ঝাঁকাল– কোনো কোনো সময় আমরা আপনাকে বাঁচিয়েছি। জামবোরা মারা গেছে ইনফারমিতে, হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তার।

প্রহরী এগিয়ে গেছে দূরবর্তী সেলের দিকে।

–এখানে এসে গিয়েছি আমরা, ফাদার।

এক প্রহরী দরজাটা খুলে দিল। তারপর সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করল। তাকে অনুসরণ করে পাদরি সাহেব ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। প্রহরী দরজাটা বন্ধ করে দিল। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকল। তার মুখে বিরক্তি এবং ভয়ের চিহ্ন।

পায়ে পায়ে যাজক এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। নোংরা কারাকক্ষে শুয়ে আছেন এক বন্দী।

তিনি বললেন- তোমার নাম কী?

–রিকার্ডো মেলাডো।

 পাদরি অবাক হয়ে তাকালেন। এই মানুষটিকে কেমন দেখতে তা ভাষায় বর্ণনা করা সহজ নয়। মুখটা ফুলে গেছে। চোখ প্রায় বন্ধ। মোটা দুটি ঠোঁট। সে কোনোরকমে বলল ফাদার শেষ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে দেখা হবে, আমি স্বপ্নেও তা ভাবতে পারিনি।

ফাদার হাসলেন– এটা আমার কর্তব্য। এই জন্যই তো আমাকে এই পদে নির্বাচিত করা হয়েছে।

আজ সকালে আমার ফাঁসি হবে। তাই তো।

 ফাদার বললেন- হ্যাঁ, তোমার ওপর মৃত্যু দণ্ডাদেশ জারি করা হয়েছে।

 রিকার্ডো মেলাডো ফাদারের দিকে তাকাল। কিছু বলার চেষ্টা করল।

 ফাদার বললেন আমি দুঃখিত, দেশের প্রধানমন্ত্রী এই আদেশ জারি করেছেন।

ফাদার ওই বন্দীর মাথায় হাত দিলেন। বললেন- তুমি কিছু বলবে কি?

রিকার্ডো মেলাডো বলে উঠল– আমি আর কী বলব? হ্যাঁ, যে পাপ আমি করেছি, তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আন্তরিকভাবে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

প্রহরী কিছু শোনার চেষ্টা করছিল। ভাবছিল, এসব পাগলামির কী লাভ?

পাদরি সাহেব বললেন- তোমার আত্মা শান্তি লাভ করুক। এখন আমি আর কী বলতে পারি।

পদরি সাহেব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন কারাকক্ষের দরজার দিকে। প্রহরী দরজা খুলে দিল। সে এক মুহূর্তের জন্য পেছন ফিরে তাকাল। ওই বন্দীর দিকে তার বন্দুকটা তাক করল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

পাদরি সাহেব, কাজ শেষ হল?

যাজক এবার দ্বিতীয় কারাকক্ষে প্রবেশ করবেন। এখানে যে মানুষটি পড়ে আছে, তাকেও ভীষণভাবে আঘাত করা হয়েছে। অনেকক্ষণ তার রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকালেন যাজক। বললেন- তোমার নাম কী?

ফেলিক্স কারপিও। গলাটা খাসখসে। বেশ দাড়ি গোঁফ আছে। চোখের তারায় উজ্জ্বলতা। মনে হয় সে কিছু লুকোতে চাইছে। সে বলল, আমি মরতে ভয় পাই না ফাদার।

বাঃ, এই সাহসই তো আমি চাইছি। এই পৃথিবীতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তাকে ভয় করব কেন?

এবার পাদরি তার স্বীকারোক্তি শুনলেন। দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। প্রথমে জড়ানো, তারপর পরিষ্কার। অনেক ঘটনা ঘটে গেছে তার জীবনে। বিদ্যুৎ চমক। একটির পর একটি মুহূর্ত কেটে গেছে। প্রহরী শুনছিল, অবাক হয়ে শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।

ফাদার, তাড়াতাড়ি করুন, বাইরে কিছু একটা হচ্ছে বলে মনে হয়।

 –আমার হয়ে গেছে।

প্রহরী আবার ওই কারাকক্ষের দরজাটা খুলে দিল। যাজক বেরিয়ে এলেন বাইরে, করিডরে দাঁড়ালেন। প্রহরী দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে সংঘর্ষের শব্দ। কী হচ্ছে? ছোট্ট জানলা দিয়ে প্রহরী দেখার চেষ্টা করল।

বুঝতে পারছি না। এত গোলমালের উৎস কোথায়?

যাজক বললেন- মনে হচ্ছে, কেউ বোধহয় আমাদের সঙ্গে লড়াই করতে চাইছে। আমি কি একবার দেখব?

–কিন্তু এভাবে?

না, তোমার অস্ত্রটা একবার ধার দেবে ভাই?

 যাজক কথা বললেন, তিনি প্রহরীর কাছে এগিয়ে গেলেন, তারপর? একটা স্টিলেট্রে হাত বদল হল। মুহূর্তের মধ্যে একটা চকচকে ছুরি ঢুকে গেল প্রহরীর বুকের ভেতর।

–আমার কিছু করার নেই, জাইমে মিরো বললেন। সাব মেশিনগানটা নিয়ে নেওয়া হয়েছে মৃতার্ত ওই প্রহরীর হাত থেকে। হে ঈশ্বর, আমি জানি, এই অস্ত্রটা আর তোমার কোনো কাজে লাগবে না।

রক্তাক্ত দেহ, পড়ে গেল সিমেন্টের মেঝের ওপর। জাইমে মিরো চাবি নিলেন, মৃতদেহের কাছ থেকে। অতি দ্রুত দুখানা কারাকক্ষ খুলে দিলেন। বাইরে শব্দ আরও-আরও উত্তেজিত।

এবার আমাদের যেতে হবে। জাইমে আদেশের সুরে বললেন।

রিকার্ডো মেলাডো, ওই মেশিনগানটা তুলে নিয়েছে। দেখছি কাজটা আপনি ভালোই করেছেন। আপনি তো আমাকে প্রায় ঘাবড়ে দিয়েছিলেন।

সে হাসার চেষ্টা করছে, কিন্তু আহত মুখে হাসি ফুটছে না।

–আর একটু দেরী হলে কী হত বলুন তো? যাক আমি কিন্তু ভয় পাইনি।

জাইমে মিরো অস্ত্র হাতে রাখলেন। আর এগিয়ে চললেন করিডর দিয়ে।

–জামবোরার কী হয়েছে?

–প্রহরীরা তাকে মেরে ফেলেছে, আঘাত করতে করতে। আমরা তার আর্তনাদ শুনতে পেয়েছি। তাকে ইনফারমারিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মিথ্যে করে বলা হয়েছে, হার্ট অ্যাটাকে সে মারা গেছে।

সামনে তালা বন্ধ একটা লোহার দরজা।

এখানে একটু দাঁড়াও। জাইমে মিরো বললেন।

তিনি দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। ওদিকে যে প্রহরী ছিল তাকে বললেন- আমার কাজ হয়ে গেছে।

প্রহরী বলল- আপনি তাড়াতাড়ি করুন ফাদার। বাইরে পোলমাল শুরু হয়ে গেছে।

 বাকিটুকু সে শেষ করতে পারল না। জাইমের ছুরি অতি দ্রুত তার পেটে ঢুকে গেল। রক্ত ছিটকে এল, ওই হতভাগ্য প্রহরীর মুখ থেকে।

জাইমে বললেন– আরও তাড়াতাড়ি।

ফেলিক্স করপিও ওই প্রহরীর বন্দুকটা তুলে নিল। তারা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে। বাইরে কী হয়েছে? পুলিশ ছুটোছুটি করছে। উন্মত্ত মানুষের চিৎকার। কেন? আর্তনাদ? কেউ বোধহয় এই ষাঁড়দের ছেড়ে দিয়েছে। একটা পাগল ষাঁড় এই বাড়িটার সামনে চলে এসেছে। পাথরের প্রবেশ পথটা ভেঙেচুরে দিয়েছে। আর একটা ষাঁড় ইউনিফর্ম পরা গার্ডের শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সামনে একটা লাল ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে সেটা সচল হবে। প্রচণ্ড গোলমাল। তিনজন মানুষ কোথায় চলে গেল, কেউ নজর করল না। কেউ দেখল না, কী ঘটেছে এখানে, তারা তখন ওই ঝঞ্ঝাট সামলাতে ব্যস্ত।

কোনো কথা না বলে জাইমে এবং দুই অপরাধী ট্রাকের ওপর লাফিয়ে পড়ল। তারপর জনাকীর্ণ রাস্তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আর এভাবেই! এভাবেই প্যারামিলিটারী পুলিশকে বোকা বানানো হল। সবুজ ইউনিফর্ম পরে তারা বৃথাই খোঁজাখুঁজি করেছে। তাদের মাথায় কালো চামড়ার টুপি। তারা উন্মত্ত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। কী হবে? সকলকেই অসহায় বলে মনে হচ্ছে। এখানে সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকায়। মানুষজন বিভিন্ন দিকে ছুটোছুটি করছে। উন্মাদ ষাঁড়দের হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করছে। সমস্যা আরও বাড়ছে। আরও–আরও বেশি মানুষ পদপৃষ্ট হচ্ছে। রক্ত ঝরছে। মৃত্যুর ঘটনা। এক বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখা গেল। তারা চাপা পড়েছে মানুষের পায়ের তলায়।

জাইমে ওই বিশৃঙ্খলতার দিকে তাকালেন? বললেন– আহা, এমন ঘটনা কেন ঘটল? তিনি শব্দ করলেন। তিনি এক মনে তাকিয়ে থাকলেন। এখানে কিছুই করার নেই। তিনি চোখ বন্ধ করলেন। শোকবিহ্বল এই দৃশ্যগুলোকে না দেখাই ভালো।

ট্রাক পাম্পালোনা শহরের বাইরে চলে গেছে। দক্ষিণদিকে এগিয়ে চলেছে। শব্দ ক্রমশ কমে আসছে। দাঙ্গার চিহ্ন এখানে নেই।

–জাইমে আমরা কোথায় চলেছি। রিকার্ডো মেলাডো জানতে চেয়েছিল। টর্চের বাইরে একটা ভালো জায়গা আছে, নিরাপদ। আমরা সেখানে থাকব, সন্ধ্যে পর্যন্ত।

ফেলিক্স কারপিও মাঝে মধ্যে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল।

জাইমে মিরো তার দিকে তাকালেন। তার মুখে করুণার আভাস। তিনি বললেন– বন্ধু, আমরা অতি শীঘ্র যেখানে পৌঁছে যাব।

মন থেকে পাম্পালোনার এই দুঃখজনক স্মৃতি কিছুতেই মুছছে না।

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। তারা টরের ছোট্ট গ্রামে চলে এসেছেন। একটা ফাঁকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গ্রামের একেবারে মধ্যে জাইমে মিরো দুজনকে নিয়ে এলেন।

মধ্যরাতে আপনাদের নিতে আসব? তাই তো? ড্রাইভার জানতে চাইল।

–হ্যাঁ, একটা ভালো ডাক্তার পাওয়া যাবে? জাইমে প্রশ্ন করলেন।

তিনজনে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। এটা একটা ফার্ম হাউস। ছোট্ট ছিমছাম অথচ আরামপ্রদ। এক কোণে ফায়ার চুল্লি আছে, লিভিং রুমের মধ্যে। টেবিলের ওপর এক টুকরো কাগজ দেখা গেল। জাইমে মিরো কাগজটা পড়লেন। আহা সম্ভাষণী শব্দবন্ধ বারে কয়েক বোতল মদ দেখা গেল। জাইমে মিরো মুখে মদ ঢালতে শুরু করলেন।

রিকার্ডো মেলাডো মন্তব্য করল– আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব। আপনি না থাকলে এতক্ষণে…

জাইমে গ্লাস তুললেন আসুন, আমরা স্বাধীনতার সপক্ষে জয়গান গাই।

হঠাৎ একটা শব্দ শোনা গেল। জাইমে মিরো এগিয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন, একটা পাখি খাঁচার ভেতর ছটফট করছে। তিনি খাঁচাটা খুললেন। পাখিটাকে ভোলা জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিলেন।

শান্তভাবে বললেন– যে কোনো জীবন্ত মানুষের স্বাধীনতা থাকা উচিত।

.

০২. মাদ্রিদ

প্রধানমন্ত্রী লিও পোলডো মার্টিনেজ ভীষণ রেগে গেছেন। মোটামুটি মাঝারি উচ্চতার মানুষ। চোখে চশমা আছে। সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। জাইমে মিরোকে থামাতেই হবে। তিনি চিৎকার করলেন। তার কণ্ঠস্বর, তীক্ষ্ণ এবং উচ্চ।

আপনারা কি আমার কথার মানে বুঝতে পারছেন?

তিনি ওই ঘরে উপস্থিত ছ-জন মানুষকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমরা একজন উগ্রপন্থীর সন্ধান করব। কিন্তু গোটা পুলিশ এবং মিলিটারী তার খোঁজ পাবে না। আমরা কি মুখের স্বর্গে বাস করছি?

মোনক্লোয়া প্যালেসে এই গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী থাকেন এবং কাজ করেন। এটি হল মাদ্রিদ শহরের কেন্দ্র থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। কারটেরা দে গ্যালিসিয়া অঞ্চলে। এটা এমন একটি হাইওয়ে যার কোনো সংকেত চিহ্ন নেই। সবুজ ইট দিয়ে বাড়িটা তৈরি হয়েছে। লোহার ব্যালকনি আছে, আছে সবুজ জানালা ঢাকনা এবং প্রত্যেক কোণে প্রহরীদের থাকার জায়গা।

এটা এক গরম শুকনো দিন। বাতাস হলকা বহন করছে। যতদূর চোখ পড়ছে, শুধুই নিদাঘের তপ্ত নিঃশ্বাস। আর কিছু নেই। আর দেখা যাচ্ছে, একদল ভৌতিক সেনা বুঝি এগিয়ে চলেছে, ব্যাটেলিয়নের মতো।

–গতকাল মিরো পাম্পালোনাকে একটা রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন। মার্টিনেজ অবাক হয়ে একথা বললেন। ঘুষি মারলেন ডেস্কের ওপর, তিনি দুজন কারারক্ষীকে হত্যা করেছেন। জেলখানা থেকে দুই সন্ত্রাসবাদীকে বের করে নিয়েছেন। ইচ্ছে করে উন্মত্ত ষাঁড়গুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

এক মুহূর্ত সকলেই চুপচাপ, কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না।

যখন এই প্রধানমন্ত্রী অফিসে বসেছিলেন, তিনি বলেছিলেন আমার প্রথম কাজ হল এই সব উগ্রবাদী সংগঠনগুলিকে ভেঙে দেওয়া। ইতিমধ্যে মাদ্রিদ অনেক রক্ত সহ্য করেছে, আমি দেশে এতগুলো উপদল থাকতে দেব না।

তিনি আশাবাদী। তবে স্বাধীনচেতা বাসকোস অন্য কথা চিন্তা করেছিলেন। তাই শুরু হয়েছিল ব্যাপক বোমাবর্ষণ। একটির পর একটি ব্যাঙ্ক লুণ্ঠনের ঘটনা চোখে পড়েছে। ই টি এ সংস্থার সন্ত্রাসবাদীরা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। শুরু হয় তাদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ।

মাটিনেজের ডানপাশে বসে থাকা মানুষটি শান্তভাবে বললেন আমি ওনাকে সনাক্ত করবই, আজ অথবা আগামীকাল, আমাকে একটু সময় দিন।

তিনি হলেন কর্নেল র‍্যামন আকোকা, জিওই-র প্রধান। এই সংস্থাটি স্থাপন করা হয়েছে। বাসকো উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি করার জন্য। আকোকাকে সংক্ষেপে এক দস্য বলা যেতে পারে। বয়স ষাটের কোঠা পেরিয়ে গেছেন। মুখে শীতল শান্ত আভা। চোখ দুটি কুতকুতে। এক সময় তিনি ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর অধীনে এক তরুণ অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলেন, গৃহযুদ্ধের সময়। ফ্রাঙ্কো দর্শনে বিশ্বাস করতেন। এই দর্শন বলছে আমরা কেবল মাত্র ঈশ্বর এবং ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থাকব।

আকোকাকে এক প্রশিক্ষিত আধিকারিক বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন ফ্রাঙ্কোর ডানহাত। এই কর্নেলের মধ্যে একটা লৌহকঠিন নিয়মশৃঙ্খলা আছে। যারা আইন মেনে চলতে ভালোবাসে না, সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর শাস্তি জারি করেন। গৃহযুদ্ধের ভয়ংকর দিনগুলির সাক্ষী তিনি। তিনি দেখেছেন, জাতীয়তাবাদী সন্ধি দলগুলি কীভাবে রাজতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করছে। কোনো কোনো জেনারেল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ভূমির মালিকেরা নিজস্ব সংগঠন তৈরি করেছেন। চার্চের আধিপত্যের অবসান ঘটে গেছে। ফ্যাসিবাদী দলগুলি জেগে উঠেছে। তিনি দেখেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের উত্থান। একদিকে গণতন্ত্রপ্রেমীরা, অন্যদিকে সমাজবাদীরা। সাম্যবাদী অথবা উদারনৈতিকতা। বাসকো এবং ক্যাটালন, একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছেন। বলা যেতে পারে, সেটা ছিল ভয়ংকর প্রহর, মৃত্যু নিয়ে মানুষ ছেলেখেলা খেলেছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। দিনের পর দিন ধরে মৃত্যুর সংজ্ঞা শুধু বেড়েছে। এখন বাসকো আবার নতুন একটি রণক্ষেত্র খুলেছেন। হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

কর্নেল আকোকার অধীনে একটি অত্যন্ত প্রশিক্ষিত নির্মম সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশবাহিনী আছে। তার অনুগামীরা মাটির তলায় কাজ করে। তারা ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। জনসমক্ষে নিজের মুখ দেখায় না। তাদের মনে অনুশোচনা নেই। ভয় শব্দটাকে তারা অভিধান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু, কে এই কাজটা করবে?

 প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন। কর্নেলের ওপরেই এই কাজের দায়িত্ব দিলে বোধহয় ভালো হবে। প্রাইভেট লাইনে ফোন বেজে উঠেছে। বোঝা গেল, এটি কার কণ্ঠস্বর।

–জাইমে মিরোকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উনি একটা ভীষণ সন্ত্রাসবাদী দলের সর্বাধিনায়ক। আমরা কর্নেল র‍্যামন আকোকাকে এই দায়িত্ব দেব। তাকেই আমরা এই বাহিনীর প্রধান করব। ব্যাপারটা বোঝা গেল?

-ঠিক আছে স্যার। আপনার আদেশ শিরোধার্য।

লাইনটা মরে গেল।

এই কণ্ঠস্বর হল ও পি ইউ এস-এর এক সদস্যের। এই সংস্থাটিকে আমরা এক গোপন সংগঠন বলতে পারি। এই সংস্থার মধ্যে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিরা আছেন। আছেন ব্যাঙ্কের অধিকর্তারা, আইনজীবীরা, শক্তিশালী করপোরশেনের প্রধানরা, সরকারী মন্ত্রীরা। এই সংস্থাটি স্থাপন করা হয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলার জন্য। এই সংস্থাটির কোষাগারে অনেক অর্থ আছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থের ধারাবাহিক স্রোত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে এত টাকা আসছে, তা একটা রহস্য। কেউ কেউ বলে থাকেন, এখানে দুর্নীতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। তবে এই সংস্থার কাজকর্ম সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করার সাহস করেন না।

শেষ অব্দি প্রধানমন্ত্রী কর্নেল আকোকাকেই প্রধান আধিকারিক নিযুক্ত করলেন। তাঁকে নানা ধরনের উপদেশ দেওয়া হল। বলা হল, যে করেই হোক ওই অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। ইতিমধ্যেই ব্যবস্থাটা হাতের বাইরে চলে গেছে। এবার কর্নেল আকোকা রণক্ষেত্রে নামলেন। ব্যাপক ধর-পাকড় শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন, বাসকো এবার ঠান্ডা হয়ে যাবেন। যেভাবে প্রতি আক্রমণ শুরু হয়েছে। শেষ অব্দি বাসকোর কোনো কোননা অনুগামীকে পালোনার কাছে কারারুদ্ধ করা সম্ভব হল। তাদের ফাঁসি দেওয়া হল। কর্নেল আকোকা প্রথম রাউন্ডে জিতে গেলেন। তিনি চেয়েছিলেন ওই ফাঁসির ঘটনা যেন সকলে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। নৃশংসভাবে ওদের হত্যা করা হবে। জনমানসে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া পড়বে। কেটে দেওয়া হবে ওই অপরাধীদের মেরুদণ্ড, রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

জাইমে মিরা এখনও পর্যন্ত অধরা থেকে গেছেন। কর্নেল আকোকা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন।

কর্নেল আকোকা চিৎকার করে বলেন- আমি ওঁর মাথা চাই। ওনার মাথাটা কেটে ফেলো। তাহলে বাসকোর আন্দোলন থেমে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী মাঝে মধ্যেই বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করছেন, তিনি একটা সরল সত্য স্বীকার করেছেন। তা হল জাইমে মিয়োর অনেক অনুগামী আছে। অনেকের চোখে তিনি দেবদূত। কিংবদন্তীর মহানায়ক। তাই অত্যন্ত বিপজ্জনক।

প্রধানমন্ত্রী ভাবলেন- কর্নেল আকোকাকে আরও তৎপর হতে হবে।

প্রাইমো কাসাভো, পুলিশ বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল কথা বলছেন– মাননীয় মহাশয়, পাম্পলোনাতে যা ঘটে গেছে তা একটা দুঃস্বপ্ন। জাইমে মিরো…

-হ্যাঁ, আমি জানি। প্রধানমন্ত্রী বাধা দিয়ে বললেন, আমি জানতে চাইছি কোথায় উনি আছেন?

উনি কর্নেল আকোকার দিকে তাকালেন।

উনি কোথাও লুকিয়ে আছেন। কর্নেল বললেন, তার কণ্ঠস্বরে অভিজ্ঞতার সুর– আমি আপনাকে আরও একবার মনে করাতে চাইছি যে, আমরা শুধু একজন মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিনি। আমরা বাসকোর অনুগামীদের সাথে লড়াই করছি। তারাই জাইমে মিরোকে সাহস জুগিয়ে চলেছে। তারাই ওই সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। দিচ্ছে খাদ্য এবং অস্ত্র। হ্যাঁ, ওই মানুষটি সকলের চোখে হিরো। কিন্তু ভয় পাবেন না, কিছুদিনের মধ্যেই তাকে আমরা ফাঁসির মঞ্চে ঝোলাব। অবশ্য তার আগে বিচারের প্রহসন করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী এখনও বুঝতে পারছেন না, কীভাবে নির্দেশনামা জারি করা যেতে পারে। তিনি কি স্নায়ুরোগে ভুগছেন? কর্নেল সম্পর্কে কিছু সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বললেন– ভদ্রমহোদয়রা, আরও–আরও তৎপর হতে হবে আমাদের।

এবার সকলে চলে যাবেন। কিন্তু কর্নেল আকোকা এখন যাবেন না। তাকে থাকতে হবে। লিও পোলডো মার্টিনেজ যাবার জন্য উঠলেন। তিনি বললেন–আমরা স্প্যানিয়ানদের সাহায্য নিতে পারি, তাদের দলভুক্ত করলে কেমন হয়?

আকোকা বললেন না, তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য তৎপর। তারা দেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে, আছে নিজস্ব পতাকা।

-না, যতদিন ধরে আমি এই অফিসে বসে থাকব, আমি স্পেনকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেব না। সরকারের প্রধান হিসেবে এটা আমার একমাত্র কর্তব্য। তাই ওদের আমরা একধরনের বিপ্লবী ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না।

নৈঃশব্দ্য ভেসে এল, আমায় ক্ষমা করবেন, মাননীয় মহাশয়। বিশপ আইবানেজ এসেছেন।

–ওনাকে আমার কাছে পাঠান।

কর্নেলের চোখ ছোটো হয়ে এল। আপনি সুনিশ্চিত থাকলে পাদরিরা এই ঘটনার অন্তরালে আছেন। এবার ওঁদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখব, চার্চের ভূমিকা সত্যিই বিতর্কিত। কর্নেল আকোকা এই ব্যাপারে চিন্তা করলেন। গৃহযুদ্ধের শুরুতে ক্যাথোলিক চার্চ জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলিকে সাহায্য করেছে। পোপ নিজে ফ্রাঙ্কোর সমর্থক ছিলেন। তিনি ঈশ্বরের নামে এই কাজ করেছেন। যখন বাসকো বিভিন্ন গির্জা এবং মনেস্ট্রিগুলিকে আক্রমণ করতে থাকলেন, চার্চ তার সমর্থন তুলে নিল।

-বাসকো এবং ক্যাটালানসকে আরও বেশি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। পাদরিরা এই আবেদন করেছিলেন। বলা হয়েছিল, বাসকো যাতে পারিদের হত্যা করতে না পারেন, সেদিকে নজর দিতে হবে।

ফ্রাঙ্কো এই কথা শোনেননি, তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন–চার্চ এসে আমার সরকার পরিচালনা করবে? আমি এক নীরব দর্শক হয়ে অপেক্ষা করব?

শুরু হল ব্যক্তিত্বের সংঘাত। আরও–আরও বেশি গির্জা এবং মনেস্ট্রি ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হল। উপাসিকা এবং যাজকদের হত্যা করা হল। বিশপদের গৃহে অন্তরীণ করা হল। সমস্ত স্পেন জুড়ে শুরু হল অরাজকতা। যাজকদের ওপর কর ধার্য করা হল, বলা হল, মিথ্যে উপদেশ দেবার জন্য সরকারী তহবিলে অর্থ জমা রাখতে হবে। এবার চার্চ আবার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করে, তারা ফ্রাঙ্কোকে ভয় দেখাতে থাকে। শেষ অব্দি ফ্রাঙ্কোর আক্রমণের তীব্রতা কমে আসে।

আকোকা ভাবছিলেন, চার্চের ভূমিকা সত্যিই সন্দেহজনক। ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর চার্চের প্রভাব প্রতিপত্তি আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।

উনি প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকালেন এবার বিশপের কাছে পরিষ্কার করে জানতে চান, স্পেনের আসল শাসক কে?

বিশপ কালগো প্রবেশ করলেন– রোগা পাতলা চেহারা, মুখের ওপর দুশ্চিন্তার ছাপ। মাথায় একগাদা সাদা চুল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি তার চশমার আড়াল থেকে এই দুটি মানুষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বললেন– শুভ সন্ধ্যা।

 কর্নেল আকোকা ভাবলেন, এখনই কথা বললে কেমন হয়? ওই ভদ্রলোককে দেখা মাত্র তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে সামনে বোধহয় কসাই মাংস ঝুলিয়ে রেখেছে। মুখটা তার বিকৃত হয়ে গেল।

বিশপ এসে দাঁড়ালেন। বসার জন্য এখনও আমন্ত্রণ পাননি তিনি। আমন্ত্রণ এলো না। তাকে কর্নেলের সাথে পরিচিত করানো হল না, ব্যাপারটা সত্যি ভাবতে খারাপ লাগছে।

প্রধানমন্ত্রী আকোকার দিকে তাকালেন। কিছু বলার কথা ভাবতে থাকলেন।

আকোকা কাটা কাটা কণ্ঠস্বরে বলতে থাকেন আমাদের কাছে কিছু খারাপ সংবাদ এসেছে। বাসকো বিপ্লবীরা ক্যাথোলিক মনেস্ট্রিতে গোপন অধিবেশন ডেকেছে। আমরা আরও জানতে পেরেছি যে, বিভিন্ন চার্চে ওই সন্ত্রাসবাদীরা আশ্রয় পেয়েছে।

কণ্ঠস্বরে ইস্পাতের কাঠিন্য।

–আপনারা স্পেনের শত্রুদের সাহায্য করছেন, কাজেই আপনাদের আমরা স্পেন জনগণের শত্রু বলতে পারি।

বিশপ ইবানে অবাক চোখে তাকালেন। লিও পোলডো মার্টিনেজের দিকে তাকিয়ে বললেন– মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা রেখে আমি বলছি, আমরা সকলে স্পেনের সন্তান। বাসকো কিন্তু আপনার শত্রু নয়। তারা একধরনের স্বাধীনতা চাইছে।

আকোকা গর্জন করে উঠলেন– চাইছেন, না, জোর করে কেড়ে নিতে চেষ্টা করছেন। দেশের এখানে সেখানে অরাজকতার আবরণ। একটির পর একটি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। পুলিশদের হত্যা করা হচ্ছে। আর আপনি বলছেন, তারা দেশের শত্রু নয়? এ আপনার কী বিচার?

-হ্যাঁ, আমি বলছি, এই কাজ করতে গিয়ে তারা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু কেন? ভেবে দেখুন তো, কী তাদের উদ্দেশ্য?

তাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই, তারা নিজেদের উদরপুর্তি করতে চাইছে। স্পেনের ব্যাপারে তারা বিন্দুমাত্র চিন্তা করে না। এই জন্যই আমাদের এক মহান লেখক বলেছেন স্পেনের কেউই সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না। প্রত্যেকটা দল নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য উদগ্রীব। একদিকে পাদরি, অন্যদিকে বাসকো, এপাশে ক্যাটালোন। একে অন্যকে আঘাত করার চেষ্টা করছে।

বিশপ বুঝতে পারলেন, কর্নেল আকোকার কথার মধ্যে ভুল আছে। উনি অরটেগা গাসেটের উক্তি মিথ্যেভাবে বলেছেন। সম্পূর্ণ উক্তিটা বললে আমরা বুঝতে পারতাম, ওই লেখক সশস্ত্র বাহিনী এবং সরকারকে সাবধান করেছেন। তবে তিনি স্পষ্টভাবে কিছু বলেন নি। ভদ্রলোক প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে তাত্ত্বিক শব্দ বেরিয়ে আসবে।

মাননীয় মহাশয়, ক্যাথোলিক চার্চ…

 প্রধানমন্ত্রীর মনে হল, আকোকা জবাব দিতে পারবেন।

–বিশপ, আমাকে ভুল বুঝবেন না। তাত্ত্বিক দিক থেকে সরকার ক্যাথোলিক চার্চকে সাহায্য করবে, একশো শতাংশ সাহায্য।

কর্নেল আকোকা আবার বলতে থাকেন। কিন্তু আমরা আপনাদের দ্বারা কোন ধ্বংসাত্মক কাজ হতে দেব না। অনুগ্রহ করে চার্চকে বলুন এসব ব্যাপারে মাথা না ঘামাতে। কেন চার্চ মনেস্ট্রি আর কনভেন্ট আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে? যতদিন পর্যন্ত আপনারা বাসকোর সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেবেন, তাদের গোপন অধিবেশনের ব্যবস্থা করবেন, ততদিন ভয়ংকর ঘটনার জন্য আপনাদের তৈরি থাকতেই হবে।

–আমার মনে হচ্ছে এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত খবর এসেছে, বিশপ বললেন, ঠিক আছে, আমি এই ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখব।

প্রধানমন্ত্রী বললেন– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, বিশপ। তা হলেই হবে।

 প্রধানমন্ত্রী মার্টিনেজ এবং কর্নেল আকোকা তাকিয়ে থাকলেন, বিশপ চলে যাচ্ছেন।

–আপনার কী মনে হল?

মার্টিনেজ জিজ্ঞাসা করলেন।

উনি সব জানেন কিন্তু বললেন না।

 প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তিনি বুঝতে পারছেন, চার্চকে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সমস্যা হবে। একেই চারিদিকে নানা সমস্যা, তার ওপর একটা নতুন ঝামেলা এসে গেল।

যদি চার্চ বাসকোকে সাহায্য করে, তাহলে আমরা চার্চের বিরুদ্ধাচরণ করব। কর্নেল আকোকার কণ্ঠস্বর আরও কঠিন। আমি আপনাকে বলছি, আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আমি ওই বিশপকে সাংঘাতিক শিক্ষা দেব।

প্রধানমন্ত্রী তাকিয়ে থাকলেন। বোঝা গেল, ওই মানুষটির চোখে মুখে এক ধরনের উগ্র প্রতিশোধ ধিকধিক করে জ্বলে উঠেছে। উনি সাবধানে বললেন– সত্যি-সত্যি আপনি এই সংবাদ পেয়েছেন? উপাসনালয়গুলি কি সন্ত্রাসবাদীদের হয়ে কাজ করছে?

হ্যাঁ, মাননীয় মহাশয়।

কে সত্যি বলছে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী জানেন, আকোকা চার্চকে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। তবে চার্চ যদি এইভাবে বিরুদ্ধাচরণ করে, তাহলে তাকে সহবত শেখাতেই হবে। কিন্তু দেখতে হবে কর্নেল আকোকা যেন তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের অপব্যবহার না করেন। প্রধানমন্ত্রী মার্টিনেজ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

আকোকা নৈঃশব্দ ভেঙে বললেন– যদি চার্চ ওই উগ্রবাদীদের আশ্রয় দেয়, তাহলে শাস্তি দিতেই হবে।

প্রধানমন্ত্রী উদাসীনভাবে মাথা নাড়লেন– আপনি কীভাবে শুরু করতে চাইছেন?

–জাইমে মিরো এবং তার অনুগামীদের গতকাল আভিলাতে দেখা গেছে। তারা কোনো একটি কনভেন্টে লুকিয়ে আছেন বলে আমার স্থির বিশ্বাস।

প্রধানমন্ত্রী এবার মনস্থির করে বললেন- তাহলে অনুসন্ধান শুরু করুন।

এই ছোট্ট উক্তি যে ঘটনা পরাম্পরার জন্ম দিয়েছিল, তা সমস্ত স্পেনের বুকে একটি আতঙ্ক স্বরূপ বিরাজ করে। শুধু স্পেন নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ শিহরিত হয়ে ওঠে।

.

০৩. আভিলা

নীরবতার সাথে আমরা শান্ত তুষারের পতনের তুলনা করতে পারি, কোমল এবং শব্দহীন। আহা, বুঝি নিদাঘ তপ্তদিনে বাতাসের ফিসফিসানি, আকাশের বুকে খসে পড়া। তারপর নীরবতা।

সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট, এটি প্রাচীর আচ্ছাদিত আভিলা শহরের অন্যতম সম্পদ। এটি হল স্পেনের সবথেকে উঁচু শহর। মাদ্রিদ থেকে ১১২ কিমি উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। কনভেন্টের সর্বত্র নীরবতা বিরাজ করছে। ১৬০১ সালে যে অনুশাসন চালু করা হয়েছিল, এখনও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। কত শতাব্দী কেটে গেছে, তবুও এখানে আধ্যাত্মিক অনুশীলন করা হয়। এখানে আছে কঠিন নিয়মনীতি। আছে নীরবতা, নীরবতার মধ্যেই এখানকার বাসিন্দারা আত্মার সন্ধানে মগ্ন থাকেন।

এই কনভেন্টকে আমরা পাথরের নির্মিত শান্ত শীতল বাড়ির সমাহার বলতে পারি, বিশাল এক ভূমিখণ্ডের মধ্যে তাদের অবস্থিতি। মাঝে আছে বেশ কয়েক বিঘা খোলা জমি, সূর্যের আলো পড়ে। আর আছে উপাসিকাদের বসবাসের জন্য কয়েকটি বাড়ি। সকাল থেকে সন্ধ্যে তারা জীবনের নিয়মনীতি পালন করেন। এই কনভেন্টে চল্লিশজন ধর্ম্যাজিকা আছেন। তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন। সৎ সুন্দর জীবন যাপন করেন। আভিলার এই কনভেন্টটি সাতটি কনভেন্টের অন্যতম। আগে এখানে কয়েকশো কনভেষ্ট ছিল। কিন্তু সিভিল ওয়ার তার সবকটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মাত্র এই কটি কনভেন্ট এখনও তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে।

সিস্টারসিয়ান কনভেন্টের ভেতর শুধু প্রার্থনার শব্দ শোনা যায়। এটি হল এমন একটা জায়গা যেখানে অন্যায় অত্যাচার নেই। এখানে মানুষে মানুষে হিংসা নেই। মনে হয় মানুষের মন থেকে হিংসাকে চিরদিনের জন্য দূরীভূত করা হয়েছে। সিস্টারসিয়ানের জীবন অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মানুষ এখানে সন্তুষ্ট। সামান্য উপাদানে জীবন কাটাতে ভালোবাসেন, আহা, এ বুঝি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্বর্গীয় দ্বীপ।

সব সিস্টাররা একই ধরনের পোশাক পরে থাকেন। পোশাকের মধ্যে কোনো বাহুল্য নেই। কয়েক শতাব্দী ধরে একই ফ্যাশান তারা পালন করছেন। একধরনের আলখাল্লা, ক্লোক এবং মাথায় টুপি। সরলতা ও পবিত্রতার প্রতীক। আছে লিনেন টিউনিক, যা দেখলে বুঝতে পারা যায়, এখানে অস্থিরতার প্রবেশ নিষেধ। শীতের দিনে তারা গায়ে শাল জড়িয়ে রাখেন। সকাল থেকে পরিশ্রম করেন। পরিশ্রমের চিহ্ন মুখে আঁকা থাকে।

.

 এই কনভেন্টের ভেতর আছে অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি। চারপাশে বিরাজ করছে নিয়মশৃঙ্খলা। বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো ঘর, প্যাসেজ ওয়ে, সিঁড়ি, ডাইনিং রুম, কমিউনিটি রুম, ছোটো ছোটো কক্ষ এবং চ্যাপেল। সব জায়গাতে শীতলতার ছোঁয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। দরজা-জানালায় পর্দা ঝুলছে। বাইরে উঁচু পাঁচিলওয়ালা বাগান। প্রত্যেকটা দরজার ওপর আছে লোহার দণ্ড, কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যাবে না ভেতরে কী হচ্ছে। ডাইনিং হলটি বেশ লম্বা। এর জানালায় খড়খড়ি আছে, জানলায় পর্দা ঝুলছে। মোমদানিতে মোম রয়েছে। পুরোনো মোমদানি। সিলিং-এ এবং দেওয়ালে ভৌতিক ছায়া কাঁপছে।

মনে হয়, চারশো বছর এই প্রাচীরের ওপর দাগ কাটতে পারেনি। কনভেন্ট একইরকম আছে, শুধু বাসিন্দাদের মুখগুলো পালটে গেছে। সিস্টারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু নেই। তারা দরিদ্রতা ভালোবাসেন। দরিদ্রতাকে মহান যিশুখ্রিস্টের অবদান হিসেবে গণ্য করেন।

চার্চের সর্বত্র ছিমছাম পরিস্থিতি। মনে হয়, এখানে বিরাজ করছে নিদারুণ শান্তি। কিন্তু এখানে এক অমূল্য সম্পদ আছে, নিরেট সোনার তৈরি ক্রশ, অনেক দিন আগে এক ধনী ভক্ত উপহার দিয়েছিলেন। এটিকে রিফ্যাক্টরি ক্যাবিনেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা আছে। আর বেদীতে ঝুলছে একটি সাধারণ কাঠের তৈরি ক্রুশ চিহ্ন।

মহান ঈশ্বরের সাথে যারা জীবন ভাগ করে নিয়েছেন, তারা একত্রে দিন কাটান। একসঙ্গে কাজ করেন, একসঙ্গে খাদ্য গ্রহণ করেন, একসঙ্গে ঈশ্বরের উপাসনা করেন। কোনো ঘটনা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না। তারা খুব কম কথা বলেন। কিন্তু যখন পরম শ্রদ্ধেয় মাদার প্রাওরেস বেটিনা আসেন, তখন এইসব বাসিন্দাদের মধ্যে চিত্ত চাঞ্চল্য দেখা যায়। তখন তারা একে অন্যের সাথে অতিরিক্ত কথা বলেন। তবুও তারা প্রাচীন সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করেন। এই শব্দের ওপর বেশি জোর দেন।

মহান মাদারকে আমরা এক প্রবীণ নেত্রী বলতে পারি, সত্তর বছর বয়স হয়ে গেছে। মুখে এখনও যৌবনের উজ্জ্বলতা, সব সময় হাসিমুখে থাকতে ভালোবাসেন। অসীম শক্তির অধিকারিনী। জীবনে কত আনন্দ আছে, তা তিনি উপলব্ধি করেছেন। তার সমস্ত জীবন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তিনি এই সব উপাসিকাদের পরম রক্ষাকত্রী। তিনি মনে করেন, আরও বেশি শৃঙ্খলাবোধের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারব।

উপাসিকারা করিডর দিয়ে হেঁটে যান। মাটির দিকে আবদ্ধ তাদের চোখ। হাত দুটি জড়ো করা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকের কাছে ধরা আছে। এদিক-ওদিক আসা-যাওয়া করেন। কথা বলেন না। কেউ কাউকে চিনতে পারেন না, এমন ভঙ্গিমা। কনভেন্টে যে শব্দ শোনা যায়, সেটি হল ঘণ্টাধ্বনি। ভিক্টর হুগোে যাকে বলেছেন- স্টেপেলসের অপেরা।

এই সিস্টাররা এসেছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের আগমন। তবে সকলেই যে ওই পরিবারভুক্ত এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। অনেকে ছিলেন অভিজাত পরিবারের কন্যা, কেউবা কৃষক তনয়া, কেউবা কোনো সেনাপতির মেয়ে। তারা এই কনভেন্টে এসে সবকিছু ভুলে গেছেন। ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ এখানে নেই, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের বিভাজন রেখা মুছে গেছে। দুঃখিত অথবা উল্লসিত কোনো ভেদাভেদ এখানে মানা হয় না। ঈশ্বরের চোখে তারা সকলেই সমান। যিশুর সঙ্গে তারা সকলে এক আধ্যাত্মিক বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ।

এখানকার দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা তাদের আকর্ষণ করে। শীতকালের বাতাস তীক্ষ্ণ ছুরি হয়ে আক্রমণ করে। দিনের আলো ক্রমশ নিভে আসে। জানালার মধ্যে দিয়ে অন্ধকার ঘনীভূত হয়। ধর্ম যাজিকারা পোশাক পরে খড়ের বিছানায় শুয়ে পড়েন। গায়ের ওপর কুটকুটে কম্বল চাপা দেওয়া হয়। প্রত্যেকের জন্য একটি ছোট্ট কক্ষ নির্দিষ্ট করা আছে। সেখানে একটা ঠকঠকে চেয়ার ছাড়া আর কিছু নেই। নেই আর কোনো উপকরণ। দৈনন্দিন জীবনের ওপর দারিদ্রতার ছাপ। বেসিন আছে, মেঝের এককোণে, মাটির তৈরি মগ আছে। কোনো উপাসিকা অন্য উপাসিকার ঘরে প্রবেশ করতে পারেন না। একমাত্র মহান মাদার বেটিনা সব জায়গায় যেতে পারেন। বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু কাজ আর প্রার্থনা। কাজের মধ্যে কী আছে? সেলাই বোনা, বই বাঁধাই । করা, মেশিনে উল বোনা, রুটি তৈরি করা, প্রত্যেককে নিয়মমতো দিনে আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এই কাজগুলোকে আবার নানা নামকরণে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের দৈনন্দিন প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে হয়।

এবার আমরা চার্চের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি সম্পর্কে আলোচনা করব। প্রথমেই ম্যাশনের কথা বলতে হবে। এই কাজ শুরু হয় একেবারে ভোরবেলা। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ। তখন ঘুমিয়ে থাকেন। আবার কিছু মানুষ তখন পাপ কাজে লিপ্ত হয়।

লাউডস নামে পরবর্তী পর্বটি শুরু হয় দিন সূচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এরপর মার্টিন্স। নামে আর একটি কাজ। তখন সূর্য মাথার ওপর দেখা যাচ্ছে, আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

প্রাইমকে বলা হয় ওই চার্চের সকালবেলার প্রার্থনা। ঈশ্বরের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়- হে মহান দেবতা, আজকের দিনটি যেন আমরা ভালোভাবে কাটাতে পারি। সকাল নটায় টেরসের আসর বসে। সেন্ট অগাস্টাইন মহান আত্মাকে ডেকে পাঠান।

সেকটের আসর বসে এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিটে। মন থেকে কামনা-বাসনা দূর করার জন্যই এই প্রার্থনা সভা।

বিকেল তিনটের সময় যে প্রার্থনা তাকে বলে নান। এই মুহূর্তটিকে আলাদাভাবে মনে রাখা হয়। কারণ এই মুহূর্তেই মহান খ্রিস্টের মৃত্যু হয়েছিল। চার্চের বিকেলের অধিবেশনকে ভেসপারস বলা হয়। দিন শেষ হয়ে গেল। রাত্রি আসছে। তার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হবে।

কমপ্লাইন হল দিনের শেষ অধিবেশন। রাত্রির জন্য আমরা তৈরি হচ্ছি। মৃত্যুর জন্য অন্তহীন প্রতীক্ষা। এভারেই তো সবকিছু শেষ হয়ে যায়।

কোন কোন ক্ষেত্রে আবার কিছু নিত্যনতুন নিয়মের ব্যবস্থাপনা করা হয়। কিন্তু সিস্টারসিয়ান কনভেন্টে সেই পুরোনো নিয়মটাকেই মেনে চলা হচ্ছে। সপ্তাহে একদিন বিশেষ অধিবেশন বসে। সেদিন আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেতে হয়। সেদিন এই সন্ন্যাসিনীরা শরীরে যন্ত্রণা দেন। তারা আঙুলের ভেতর উঁচ ফুটিয়ে দেন। তারা বারো ইঞ্চি লম্বা ব্লেড দিয়ে নিজেদের আঘাত করতে থাকেন। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠেন। এইভাবেই তারা যন্ত্রণা দগ্ধা হতে ভালোবাসেন। তখন শোনা যায় সিস্টারসিয়ান চার্চের মঠাধ্যক্ষের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

তিনি বলতে থাকেন চোখ বন্ধ করে একবার ভেবে দেখো তো, মহান যিশুখ্রিস্টকে কীভাবে আহত করা হয়েছিল। সেই আঘাত অনুভব করার জন্যই আমরা আমাদের দেহকে এইভাবে ক্ষত-বিক্ষত করছি।

আমরা এই জীবনটাকে বন্দীজীবন বলতে পারি কি? কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের মুখের দিকে তাকালে, আপনি প্রত্যক্ষ করবেন, সেখানে অলৌকিক আভার প্রজ্জ্বলন। বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। তারা শারীরিক প্রেমকে দূরে বিসর্জন দিয়েছেন। নিজস্ব বলতে কোনো কিছু নেই। নির্বাচনের স্বাধীনতা নেই, তবে লোভ এবং প্রতিযোগিতার আসর থেকে তারা কি সত্যি সত্যি দূরে চলে গেছেন? ঘৃণা এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ? আমরা জানি না বাইরের পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে লড়াই চলেছে, সেই লড়াই থেকে এরা কি সত্যি সত্যি দূরে? এই কনভেন্টের মধ্যে এলে মনে হয়, এখানে : বুঝি শুধুই আনন্দের ঝরনা ধারা, ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হবার এক ঐকান্তিক প্রয়াস। এখানে বিরাজ করছে শান্ততা, এবং নীরবতা। চার দেওয়ালের মধ্যে অন্য এক পৃথিবী। এখানে হৃদয় আরও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি কেউ এই কনভেন্টকে একটি জেলখানার সঙ্গে তুলনা করতে চেষ্টা করেন, তাহলে এটিকে আমরা মহান ঈশ্বরের নিজস্ব কারাগার বলব। অথবা বলব, এটি হল স্বর্গের ইডেন উদ্যান। এখানে চিরন্তনতা বিরাজ করছে। যারা এখানে এসেছেন, তারা ইচ্ছে করেই এই অবস্থাকে মেনে নিয়েছেন। সুতরাং তাদের মনের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই।

.

কনভেন্টের বেলের শব্দে সিস্টার লুসিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চোখ দুটি খুললেন। তাকালেন দুরের দিকে। এক মুহূর্তে তার মনের মধ্যে কোন্ ভাবনার অনুরণন। যে ছোট্ট কক্ষে তিনি শুয়েছিলেন, সেটি এখনও অন্ধকারে ঢাকা। সকাল তিনটে, বেল বাজছে, এবার বোধহয় কাজ শুরু হবে। এখনও সারা পৃথিবী অন্ধকারের ওড়না ঢেকে শুয়ে আছে।

শিট, এই রুটিনটা আমাকে মেরে ফেলবে, সিস্টার লুসিয়া ভাবলেন।

তিনি তার ছোট্ট আরামবিহীন খাটে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেন। একটি সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। উদাসীনভাবে নিজেকে শয্যা থেকে তুলে আনলেন। ভালো লাগছে না এইভাবে শুয়ে শুয়ে দিন কাটাতে। আহা, একসময় রোমে থাকার সময় কত সুন্দর সুন্দর পোশাক পরতেন। গেস্টাডের সেই দিনগুলি মনে পড়ছে। ভ্যালেন্টিনসের কথা মনে পড়ছে, আর্মানিস এবং জিয়ানিস।

সিস্টার লুসিয়া একটা শান্ত পদধ্বনি শুনতে পেলেন। উপাসিকাদের চলাচল শুরু হয়েছে। তারা এবার প্যাসেজে গিয়ে দাঁড়াবেন। উদাসীনভাবে তিনি বিছানা গুটিয়ে রাখলেন। লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেন। ইতিমধ্যে সেখানে ধর্মযাজিকাদের ভিড় লেগেছে। সকলের মুখ মাটির দিকে নামান। তারা চ্যাপেলের দিকে এগিয়ে চলেছেন। মনে হচ্ছে, এরা বুঝি একদল পেঙ্গুইন, সিস্টার লুসিয়া ভাবলেন। এই মহিলারা কী জীবন কাটাচ্ছেন? যৌন উত্তেজনা নেই, ভালো পোশাক পরছেন না, ভালো খেতে পারছেন না, এইসব জিনিস ছাড়া কেন বেঁচে আছেন? কীসের আশায়? নিকুচি করেছে এই যাচ্ছেতাই নিয়মনীতির।

যখন সিস্টার লুসিয়া প্রথম এই কনভেন্টে প্রবেশ করেছিলেন, পরম শ্রদ্ধেয়া মাদার তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- এখানে তোমায় কতগুলো নিয়ম মনে রাখতে হবে। সব সময় হাত জড়ো করে রাখবে। ছোটো ছোটো পা ফেলবে। ধীরে ধীরে হাঁটবে। কখনও অন্য কোনো সিস্টারের চোখের দিকে চোখ মেলে দেবে না। তাদের অবলোকন করবে না। কথা খুব কম বলবে। মনে রাখবে, তোমার কান দুটি শুধু ভগবানের কথা শোনার জন্য উৎকীর্ণ হয়ে আছে।

–হ্যাঁ, পরম শ্রদ্ধেয়া মাদার।

পরবর্তী মাসে লুসিয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হল।

যারা এখানে আসে, তারা একে অন্যের নাম পর্যন্ত জানবে না। ঈশ্বরের সঙ্গেই আমাদের সংযুক্তি মনে রেখো। আত্মাকে জাগাতে হলে নৈঃশব্দ্যের আবরণ চাই। আমরা ঈশ্বরের সাথে এক হব, তাই নীরবতার মধ্যে দিয়ে সময় কাটবে।

-হ্যাঁ, মহামান্যা মাদার। 

সবসময় চোখের তারায় নীরবতার চাউনি মেলে দেবে। অন্য কারোর দিকে তাকাবে না। তাহলে তুমি এক অদ্ভুত দৃশ্যকল্প দেখবে।

-হ্যাঁ, মহামান্যা মাদার।

–তোমায় প্রথম যে শিক্ষা দেব, তা হল অতীতকে ভুলতে হবে। পুরোনো অভ্যেসকে পাল্টাতে হবে। পার্থিব সম্পদের প্রতি কোনো আকর্ষণ থাকা চলবে না। অতীতের কোনো ছবি যেন তোমার মনকে ভারাক্রান্ত করতে না পারে, দেখতে হবে। তুমি মনকে আরও পবিত্র করবে। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে পাল্টাবে। নিজেকে ভালোবাসবে। আত্মবিশ্বাসে মেতে উঠবে। ব্যাপারটা সহজে আসবে না। অতীতের ঘটনা আমাদের নানাভাবে বিব্রত করে। অতীতের কোনো অপরাধবোধ মনকে আচ্ছন্ন করে। দেখবে, তুমি যদি এই নিয়মগুলি পালন করো, তাহলে অচিরেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাবে। ঈশ্বরের পবিত্র আভায় তোমার চরিত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তুমি তোমার পাপগুলিকে ভুলে যাবার চেষ্টা করবে, ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো দিন পাপকাজ করতে না পারো, সেদিকে সচেষ্ট হবে।

-হে মহামান্য মাদার, আপনার সব কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।

তুমি ইন্দ্রিয়পরায়ণতার সঙ্গে লড়াই করবে। জানোত, জন অফ দ্য ক্রশ বলেছিলেন, রাত্রি এইসব কামনামদির মুহূর্তগুলিকে নিয়ে আসে।

-হ্যাঁ, মহামান্য মাদার।

প্রত্যেক উপাসিকা নৈঃশব্দ্যের মধ্যে বিচরণ করবে। মনে হবে, তুমি যেন স্বর্গেই পৌঁছে গেছে। এই পবিত্র সুন্দর নীরবতা তোমাকে আরও আনন্দ দেবে। তুমি তোমার মনের ভেতর একটা আলোকশিখা দেখতে পাবে। মনে হবে, ঈশ্বর তোমার মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন, অথবা তুমি ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারছ।

প্রথম মাস শেষ হয়ে গেল। লুসিয়া তার প্রতিটি শপথকে মনে রেখেছেন। এবার আনুষ্ঠানিক উৎসব শুরু হবে। তার মাথার চুল কেটে দেওয়া হল। ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা। এই কাজটা মহামান্য মাদার নিজের হাতে করেন। তিনি লুসিয়াকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে গেলেন। তাকে বসতে আদেশ করলেন। লুসিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। লুসিয়া কিছুতেই টের পেলেন না, শুধু কঁচির কচকচানি শব্দ শুনতে পেলেন। বুঝতে পারলেন, তার মাথা থেকে কিছু একটা খসে পড়ল। তিনি বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন এই ব্যাপারটা ভালোই হল। এতে ছদ্মবেশ ধারণ করা সহজ হবে। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম, চুল ভবিষ্যতে বেড়ে যাবে। লুসিয়া ভেবেছিলেন, এবার আমাকে এইভাবেই থাকতে হবে। আমি বোধহয় একটা ডানাছাটা মুরগি।

লুসিয়া ওই কিউবিকলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাকে অনেক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেন। এটা হল সাপের গর্ত। এই মেঝের কোথাও কোনো ফাঁক ফোকর নেই। চারপাশে উঁচু জানালা। আকাশ চোখে পড়ে না। কিন্তু একটা খবরের কাগজ পেলে ভালো হত। কোথায় পাওয়া যায়? এই জায়গাটার কথা খবরের কাগজে কখনও লেখা হয় না। এখানে কোনো রেডিও আনার অনুমতি দেওয়া হয় না। টেলিভিশনের প্রবেশ নিষেধ। বাইরের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখা যাবে না। এমনই বিচ্ছিরি নিয়ম।

লুসিয়া চিন্তা করতে থাকলেন। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ডুবে গেলেন। কোথায় যোগাযোগ আছে? হাতের সাহায্যে। আর? এই ভালো মানুষটি সব কথা বলতে পারে? যখন ঝাটার দরকার হয়, লুসিয়া ডানহাতে বিশেষ ইঙ্গিত করেন। ডান আঙুলকে বাঁ আঙুলের দিকে নিয়ে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট বস্তুটি এসে যায়। যখন তার ওপর মহামান্যা মাদার রাগ করেন? তিনি লুসিয়াকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁর শরীরের সামনে তিনবার আঙুল ইঙ্গিত করেন। অন্য আঙুলগুলো ধরা থাকে। লুসিয়া বুঝতে পারেন, কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে। মহামান্যা মাদার মাঝে মধ্যে তার ডানহাতের ওপর চাপ দেন, বোঝা যায়, তিনি লুসিয়াকে শাস্তি দিতে চাইছেন। লুসিয়া দোষ স্বীকার করে নেন। তিনি বুঝতে পারেন, এইভাবে কাজ করলে হয়তো তাঁকে এই কনভেন্ট থেকে বিতাড়িত করা হবে।

হায় যিশুর দোহাই, লুসিয়া ভাবলেন, এইভাবে মানুষ কি বেঁচে থাকতে পারে?

তারা চ্যাপেলে পৌঁছে গেছেন। ধর্মযাজিকারা নীরবতার মিছিল করে এগিয়ে চলেছেন। শতাব্দী প্রাচীন বেদীমূলে তারা পৌঁছে গেলেন। এখান থেকে যাত্রা শুরু হবে প্যাটানস্টারের দিকে। সিস্টার লুসিয়ার চিন্তা এখন আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঈশ্বরের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তিনি বাইরের জগতের কথা চিন্তা করছেন।

— আর একটা মাস, কিংবা দুমাস। এবার বোধহয় পুলিশ আর আমাকে খুঁজবে না। আমি তখন একেবারে স্বাধীন হব। এই পাগলাখানা থেকে আমাকে মুক্ত হতেই হবে।

সকালের প্রার্থনা শেষ হয়ে গেছে। সিস্টার লুসিয়া ডাইনিং রুমে চলে এলেন। নিয়মনীতি ভাঙবার চেষ্টা করলেন। রোজই তিনি এই নিয়ম ভাঙেন। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন অন্য উপাসিকাদের মুখের দিকে। সেখানে শুধুই আনন্দের বিচ্ছুরণ। ভাবতে পারা যাচ্ছে না, ওরা কীভাবে এই জঘন্য নিয়মটাকে মেনে নিয়েছে?

সিস্টার বুঝতে পারলেন কোনো কোনো মুখে ঔৎসুক্য আছে, কোনো মুখ বয়সের ভারে ভারাক্রান্তা, কোনো মুখে লাবণ্যের ছটা, কেউ কেউ অত্যন্ত সুন্দরী। কেউ কুৎসিত। সকলকে এত খুশী দেখাচ্ছে কেন? এমন একটি মুখের সন্ধান লুসিয়া পেলেন না, যেখানে দুঃখের ছাপ আছে। সিস্টার থেরেসা, হা, ষাট বছর বয়স্কা এই ভদ্রমহিলার মুখখানি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। তাকে সুন্দরী বলা যায় কি? তার শরীরের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক অলৌকিকতার স্পর্শ আছে। মনে হয় তিনি সর্বদা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসেন। মুখের কোণে হাসি ফুটেছে। ওই হাসির মধ্যে করুণা ঝরছে। লুকিয়ে আছে একটা গোপন অভিলাষ।

আর এক যাজিকাকে লুসিয়ার খুবই ভালো লাগে। তিনি হলেন সিস্টার গ্রাসিলা। এক অসাধারণ রূপবতী মহিলা। তিরিশ বছর বয়স হয়নি। অলিভ পাতার মতো তার ত্বকের রং, অসাধারণ দেহবল্লরী, চোখের মধ্যে কালো দাগ আছে, সেই দাগ সবসময় জ্বলে উঠছে।

ওই ভদ্রমহিলা একজন অভিনেত্রী হতে পারতেন, লুসিয়া ভাবলেন। ওনার গল্পটা কী? উনি কেন এমন একটি বন্দীশালায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন?

তৃতীয় যে ধর্মযাজিকা লুসিয়ার আগ্রহ কেড়ে নিয়েছিলেন, তিনি হলেন সিস্টার মেগান। নীল চোখের অধিকারিনী, চোখের তারা সোনালি, ছোটো ছোটো চিহ্ন আছে, খুব কমই বয়স। সবেমাত্র কুড়ির গণ্ডি পার হয়েছেন, মুখের ওপর একটা অসাধারণ সারল্য খেলা করছে।

ওই মেয়েটি কেন এখানে এসেছেন? উনি এখানে থেকে কী করবেন? ওনার কি কোনো গোপন গল্প আছে? এমন কোনো অপরাধ, যা চেপে রাখার জন্য এই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দিনী জীবন যাপন করছেন? আরামবিহীন খাটে শুতে বাধ্য হচ্ছেন, সারাদিনে আট ঘণ্টা প্রার্থনা করছেন, আট ঘণ্টা কায়িক পরিশ্রম করছেন, সামান্যক্ষণ ঘুমোচ্ছেন।

আমার মতো ওদের সকলের একটা অতীত ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসটা ভয়ংকর। তাই বোধহয় ওরা সকলে…

লুসিয়া ভাবলেন, আমার অবস্থান ওঁদের থেকে অনেক ভালো। আমি সারা জীবন এই বন্দীশালায় থাকব না। একমাস, অথবা দুমাস বাদে আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। হয়তো তিন মাস, লুসিয়া ভাবতে থাকেন। লুকিয়ে থাকার পক্ষে এটা একটা আদর্শ জায়গা। এতদিন আমি কেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। দুই-একমাস বাদে পুলিশ ভাববে, আমি মরে গেছি। আমি আমার টাকা নিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যাব। তারপর এই জায়গা সম্পর্কে একটা বই লিখব। পৃথিবীর মানুষ এই কনভেন্টের আসল কথা জানতে পারবে।

.

ডেকে পাঠানো হল লুসিয়াকে মহামান্যা মাদারের কাছে। তাকে একটা কাগজে সই করতে হবে। তখনই তিনি ফাইলের দিকে তাকাবার ফুরসত পেলেন। কিন্তু মাদারের চোখে ধরা পড়ে গেলেন।

মাদার বেটিনা কঠিন চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন- তুমি কেন আমাদের নিয়মনীতি ভঙ্গ করছ বলল তো?

সিস্টার লুসিয়া হাতে ইঙ্গিত করে বললেন– হ্যাঁ, মহামান্যা মাদার। আমি অপরাধ স্বীকার করছি।

লুসিয়াকে আবার তার সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। করিডরে ধর্ম্যাজিকাদের পায়ে হাঁটার শব্দ শোনা গেল। বোঝা গেল, কাউকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। বারংবার কারোর পিঠে চাবুকের আঘাত। কেন? এই আঘাত সিস্টার লুসিয়াকে করা হয়েছে? নানেরা অবাক হয়ে গেছেন। তারা ঘুমোত পারছেন না, লুসিয়া কী অপরাধে অপরাধী!

রিফ্ল্যাক্টরিতে ওঁরা বসে আছেন। চল্লিশ জন যাজিকা। বিশাল একটি টেবিলের চারপাশে সিস্টারসিয়ানে খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে। এখানে নিরামিষ আহার বন্টন করা হয়। কারণ যদি আমরা মাছ-মাংস খাই তাহলে শরীর আরও চিকনবতী হয়ে উঠবে। ভোর হবার আগে এক কাপ চা কিংবা কফি দেওয়া হয়। দেওয়া হয়, কয়েক আউন্স শুকনো পাউরুটি। বেলা এগারোটার সময় দুপুরের খাবার বণ্টন করা হয়। কী থাকে, সেখানে? পাতলা স্যুপ, কয়েক টুকরো সবজি, কোনো কোনো সময় এক টুকরো ফল।

এখানে আমরা এসেছি শরীরকে কষ্ট দিতে, আমরা ঈশ্বরকে খুশী করব।

আমি এই প্রাতরাশ জীবনে খাইনি। সিস্টার লুসিয়া ভাবতে থাকেন। মাত্র দুমাস। দুমাস পর কী হবে? আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, ইতিমধ্যে আমার ওজন দশ পাউন্ড কমে গেছে। আহা, ঈশ্বর কি তাই চাইছেন?

প্রাতরাশের আসর শেষ হয়ে গেছে। দুজন উপাসিকাকে দেখা গেল, তাদের থালাবাসন ধুয়ে রাখছেন। তারা থালাবাসন টেবিলের এক কোণে সাজিয়ে রাখবেন। তারা সিস্টার লুসিয়ার দিকে তাকালেন। এখানকার নিয়ম খুব কঠিন। একজনের ওপর এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন আবার তোয়ালে দিয়ে সব কিছু মুছে দিচ্ছেন। পাঠিয়ে দিচ্ছেন তার মালিকের হাতে। জলটা গরম এবং কেমন একটা গন্ধ আছে তার মধ্যে।

আহা, এইসব মহিলারা সারা জীবন এই নরকের যন্ত্রণা ভোগ করবেন। সিস্টার লুসিয়া ভাবতে থাকলেন। আমি কার কাছে অভিযোগ জানাব? বলা যেতে পারে, জেলখানায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর থেকে এই জীবনটা তো ভালো।

আহা, কেউ যদি আমাকে একটা সিগারেট দিত, তাহলে আমার আত্মা তৃপ্তি লাভ করত।

যেখানে কনভেন্টের অবস্থান তার থেকে পাঁচশো গজ দূরে, রাস্তায় তখন শুরু হয়েছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। কর্নেল র‍্যামন আকোকার নেতৃত্বে চব্বিশজন মানুষকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তারা চিন্তা করছেন, কখন কনভেন্টের ওপর বহু প্রতীক্ষিত অভিযান শুরু হবে।

.

০৪.

কর্নেল র‍্যামন আকোকার মধ্যে এক শিকারীর মনোভাব রয়ে গেছে। সব সময় তিনি অনুসরণ করতে ভালোবাসেন। শেষ অব্দি হত্যা করাতেই তার মনে অসীম আনন্দ জেগে ওঠে। একদা তিনি তার এক বন্ধুর কাছে স্বীকারোক্তি করেছিলেন– হত্যা করার মুহূর্তেই আমি আত্মরতির চরম সীমায় পৌঁছে যাই। আমি কখনও ভেবে দেখি না, সে হরিণ, খরগোশ, নাকি মানুষ। যখন তুমি কাবোর প্রাণ নিচ্ছো, নিজেকে ভগবানের প্রতিস্পর্ধী ভাবতে পারো।

আকোকা মিলিটারী ইনটেলিজেন্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে এক বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হিসেবে সহজেই নাম কিনেছিলেন। তাঁর মন নির্ভীক, তিনি নির্মম, প্রজ্ঞাবান এই তিনটি বিষয়ের সম্মেলন তাঁকে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অন্যতম সহকারীতে পরিণত করেছে।

তিনি ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিন বছরের মধ্যে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন। তাঁর কাজকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ত্রুটির অনুসন্ধান কেউ এখনও পর্যন্ত করতে পারেনি। তাকে ফ্যালাইনজিস নামে একটি বিশেষ দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই দলভুক্ত মানুষদের কাজ ছিল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধবাদীদের ওপর আতঙ্ক ঘন পরিবেশ সৃষ্টি করা।

গৃহযুদ্ধের সময় অপাসমুন্ডো নামে একটি গোপন সংগঠন তাকে ব্যবহার করেছিল।

আমরা যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এতে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অনুমতি আছে তো?

ইয়েস স্যার।

কর্নেল, আপনার কাজকর্মের ওপর আমরা তীক্ষ্ণ নজর রেখেছি। আপনার কার্যধারাতে আমরা খুশি হয়েছি।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার।

মাঝে মধ্যে আপনার হাতে আমরা গোপন কাজের দায়িত্ব তুলে দেব। কাজগুলো ভয়ংকর। একটু ভুল হলেই মৃত্যু অনিবার্য।

–আপনার কথা বুঝতে পারছি স্যার।

মনে রাখবেন, আমাদের অনেক গোপন শত্রু আছে। আমরা যে ধরনের কাজ করছি, জনগণ সেই কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারে না। তারা মাঝে মধ্যেই বিরুদ্ধাচরণ করে।

–আমি জানি স্যার।

-কোনো কোনো সময় তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আমরা এটা হতে দেব না।

না স্যার।

কর্নেল, আপনার মতো এক মানুষের দরকার। আশা করি আমরা পরস্পরকে বুঝতে পেরেছি।

–হ্যাঁ, স্যার। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে, আমি নিজেকে সম্মানিত বলে মনে করব।

আমি চাইছি, আপনি আরও কিছুদিন এই আর্মির সঙ্গে যুক্ত থাকুন। আপনার সাহায্য আমাদের কাজকে ত্বরান্বিত করবে। মাঝে মধ্যে আপনাকে এই বিশেষ প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হবে।

এজন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার।

কখনও অন্তরঙ্গ মহলেও এই বিষয়ে আলোচনা করতে পারবেন না।

–না, স্যার।

ডেস্কের অন্তরালে বসে থাকা মানুষটি আকোকার স্নায়ুপুঞ্জকে কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজিত করে তুলেছিল। তাকে দেখেই বোঝা যায়, তিনি আতঙ্ক এবং শিহরণের প্রতীক।

সেই থেকে কর্নেল আকোকাকে মাঝে মধ্যে ডেকে পাঠানো হত। অপাসমুন্ডার জন্য তিনি বেশ কিছু গোপন কাজ করেছিলেন। এই কাজগুলো ছিল ভয়ংকর এবং গোপনীয় তার চূড়ান্ত পর্দা দিয়ে ঢাকা।

এমন একটি অভিযানে আকোকা একবার এক পরিবারের রূপসী যুবতীর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। তখনও পর্যন্ত তার সঙ্গিনীরা ছিলেন বাজারের বারাঙ্গনা অথবা ক্যাম্পে বেড়াতে আসা কলগার্লরা। আকোকা তাদের সাথে নির্মম আচরণ করতেন। কেউ কেউ অবশ্য সত্যি সত্যি আকোকাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আকোকার পৌরুষ তাদের আকৃষ্ট করেছিল। আকোকা কিন্তু কাউকে ভালোবাসা দেননি। এইসব বাজারি মেয়েছেলেদের জন্য তিনি শুধু ঘৃণা আর করুণা জমিয়ে রেখেছিলেন।

কিন্তু সুসানা করিডিলা, সে ছিল এক অন্য জগতের বাসিন্দা। তার বাবা ছিলেন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। সুসানার মা ছিলেন আইনজ্ঞ। সুসানা সপ্তদশী, তখনই পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছে। মুখখানি দেখলে মনে হয় সে বুঝি এক জলপরী। অথবা তাকে আমরা ম্যাডোনার সাথে তুলনা করতে পারি।

র‍্যামন আকোকা এই ধরনের মহিলার সংস্পর্শে আগে আসেননি। একদিকে নারীত্বের পূর্ণ বিকাশ, অন্যদিকে শিশু-সরলতা। ওই মেয়েটি বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, কিন্তু মুখে ঝরছে অপূর্ব সরলতা। তাই বোধহয় কর্নেল আকোকা মেয়েটিকে পাগলের মতো ভালো বেসেছিলেন। এই ভালোবাসা যে কতদুর পৌঁছে গিয়েছিল, তিনি হয়তো তা বুঝতে পারেন নি। অবাক করা কথা, সুসানাও কিন্তু ভালোবাসার প্রতিদান দিতে ছিল উন্মুখ।

মধুচন্দ্রিমা, আকোকা তখনও পর্যন্ত আর কোনো মেয়েকে ভালোবাসেননি। কামনার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে। কিন্তু ভালোবাসার সঙ্গে আবেগের এমন সম্মেলন, এ অভিজ্ঞতা আগে তার কখনও হয়নি। 

বিয়ের পর তিন মাস কেটে গেছে। একদিন সুসানা জানাল, সে গর্ভবর্তী, এই খবর শুনে আকোকা বন্য উন্মাদনায় উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তখন তারা আনন্দঘন মুহূর্ত কাটাবার জন্য ক্যাসটিলবাংকা নামে একটা ছোট্ট গ্রামে এলেন। এই গ্রামটি বার্ক কাউন্টিতে অবস্থিত। ১৯৩৬ সালের শরৎকাল। গৃহযুদ্ধ তখন চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। একদিকে গণতন্ত্রপ্রেমীরা, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদীরা, মাঝখানে দুস্তর ব্যবধান।

এক শান্ত সমাহিত রবিবারের সকালবেলা। র‍্যামন আকোকা এবং তার নববধু ভিলেম প্লাজাতে বসে কফি খাচ্ছিলেন। হঠাৎ সেখানে বার্কস সমর্থকদের দেখা গেল। তারা চিৎকার করছেন।

আকোকা বললেন আমি তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসি। মনে হচ্ছে কোনো একটা ঝামেলা হবে।

কিন্তু তোমার?

–আমার জন্য ভেবো না। নিজেকে বাঁচানোর মতো যথেষ্ট সাহস আছে আমার।

দেখা গেল উত্তেজিত জনতা চারপাশ ঘিরে ধরেছে।

র‍্যামন আকোকা তার নববধূকে নিয়ে ওই জনগণের কাছ থেকে চলে গেলেন। তাঁরা একটা কনভেন্টের দিকে চলে গেলেন। এই কনভেন্টটি স্কোয়ারের একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত। সুসানা সেখানে পৌঁছল। কনভেন্টের দরজা খুলে গেল। ভেতরে বসে ছিলেন সশস্ত্র বাসকোয়েস। সেখানে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। তিনি বেরিয়ে এলেন। হাতে উদ্যত পিস্তল। আকোকা চোখের সামনে মৃত্যু দেখলেন। এক ঝাঁক বুলেট এসে তাঁর প্রিয়তমার হৃদয় বিদীর্ণ করল। তখন থেকেই তিনি বাসকোয়েসের পরম শত্রুতে পরিণত হন। এই ঘটনার অন্তরালে চার্বাকেও দায়বদ্ধ করা যায়।

এখন আকোকা আভিলাতে বসে আছেন, আর একবিটল ভেনেন্টর বাইরে। এবার প্রতিহিংসা, শুধু প্রতিশোধ আর প্রতিশোধ।

***

কনভেন্টের ভেতর শেষ রাতের অন্ধকার। শেষ তারাটি এবার ঘুমোতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। সিস্টার থেরেসা আরও কঠিন কর্তব্য নিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনি দুটি হাত জোড় করলেন। বুকের ওপর ক্রুশের চিহ্ন আঁকলেন। মনে হল কেউ যেন উচ্চকিত কণ্ঠস্বরে বাইবেল থেকে কিছু পাঠ করছে। কিন্তু কে হতে পারে? তিনি চিৎকার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে শব্দের নিষেধ। তাই আর্তনাদটা মনের মধ্যে রাখতে বাধ্য হলেন। যিশু, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, আমি যে পাপ করেছি, নিজেই সেই পাপের জ্বালায় পুড়ে মরছি। তোমার ক্ষমা না পেলে আমি বাঁচব কী করে? আমি শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করেছি। আমাকে আরও যন্ত্রণা দাও, আরও যন্ত্রণাদগ্ধ প্রহরের বাসিন্দা করে ভোলো।

যন্ত্রণায় তিনি প্রায় অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে তিনি আরও অনেক বার নিজেকে এইভাবে কষ্ট দিয়েছেন। রক্ত বেরিয়ে এসেছে। তবুও উপশম করার চেষ্টা করেন নি। প্রতি মুহূর্তে তাকে এইভাবে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। চাবুকের আঘাত, চোখ মুখ বন্ধ করে তাও সয়েছেন। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, পাপের শাস্তি এভাবেই দিতে হয়।

সেদিন সকালে সিস্টার থেরেসার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত রূপান্তর দেখা দিয়েছিল। তিনি করিডরের একপ্রান্তে বসেছিলেন। চোখ দুটি বন্ধ। চোখ খুললেন। সিস্টার গ্রাসিলার দিকে চোখ পড়ে গেল। অবাক হলেন। সিস্টার থেরেসা তাকালেন সিস্টার গ্রাসিলার মুখের দিকে। সিস্টার থেরেসা বুঝতে পারলেন, কিছু একটা ঘটেছে। মহান মাদার বেটিনা এসে কথা বলবেন। তিনি এসে ভাষণ দেবেন। ডান হাতটি এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে নিয়ে যাবেন তিনবার, মনে হবে তিনি যেন চাবুক হাঁকাচ্ছেন। তার আঙুলের প্রান্তভাগ ধরা থাকবে অদৃশ্য ভঙ্গিতে।

সারা রাত বিছানাতে শুয়ে ছটফট করেছেন সিস্টার থেরেসা। সেই সুন্দর মুখটির কথা ভুলতে পারেননি। ওই দুটি উৎসুক চোখ কেন তাকে পর্যবেক্ষণ করছে? সিস্টার থেরেসা জানেন, তিনি কখনও ওই মেয়েটির সাথে কথা বলতে পারবেন না। ওই মেয়েটির দিকে আর কখনও এভাবে তাকাতে পারবেন না। যদি তাদের মধ্যে সামান্যতম অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে, তাহলে চরমতম শাস্তি পেতে হবে। এখানে নৈতিকতার বাঁধন অত্যন্ত কড়া। শারীরিক সম্পর্ক দূরে থাক, মানসিক দিক থেকে যাতে কেউ কারো কাছে আসতে না পারে তার জন্য একাধিক বিধি নিষেধ চালু আছে। এখানে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। দুজন সিস্টার পাশাপাশি কাজ করেন। একে অন্যের নীরব সাহচর্য উপভোগ করেন। মহান শ্রদ্ধেয়া মাদারের দৃষ্টি সব দিকে। যদি দেখেন এমন ঘটনা ঘটছে, তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান রচনা করেন। দুজন সিস্টারকে পরপর দুদিন পাশাপাশি বসার অনুমতি দেওয়া হয় না। চার্চ এ ব্যাপারে নিজস্ব ধারা উপধারা তৈরি করেছে। একজন উপাসিকা অন্য একজনের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না। এমন সম্ভাবনা থাকলে দুজনকেই কঠিন শাস্তির মুখে দাঁড়াতে হয়। এই নিয়ম ভাঙার জন্য সিস্টার থেরেসাকে কয়েকবার শাস্তি পেতে হয়েছে।

ঘণ্টা বেজে উঠেছে। সিস্টার থেরেসা সেই ধ্বনি শুনতে পেলেন। ঈশ্বর তাকে ডাকছেন, বলছেন, এখনই অনুশোচনা করতে হবে।

***

পাশের ঘরেও ঘণ্টাধ্বনি পৌঁছে গেছে। সিস্টার গ্রাসিলা এতক্ষণ স্বপ্ন-সমুদ্রে সাঁতার কাটছিলেন। ঘণ্টাধ্বনি তার মনের গতিপ্রকৃতি একেবারে পালটে দিল। মনে হল, কে যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে উলঙ্গ অবস্থায় এক মুখ। তার পৌরুষ তাকে আকৃষ্ট করেছে। হাত দুটি সামনের দিকে প্রসারিত করে সে ছুটে আসছে।

সিস্টার গ্রাসিলা চোখ খুললেন। ঘুম ভেঙে গেল। বুকটা ধড়ফড় করছে। তিনি চার পাশে তাকালেন। আতঙ্কিত হলেন। ছোট্ট এই কক্ষে তিনি একা। ঘণ্টাধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

সিস্টার গ্রাসিলা বিছানা থেকে নামলেন। হাঁটু মুড়ে বসলেন –হে যিশু, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমাকে অতীত থেকে বর্তমানে নিয়ে এসেছ। তোমার আলোকে আমার জীবন আলোকিত হয়ে উঠেছে। আমি পৃথিবীর সর্বত্র তোমার করুণার কথা বলব। হে আমার প্রিয়তম, আমার প্রতি আরও ভালোবাসা প্রদর্শন করো। আমি যেন তোমার পবিত্র হৃদয়ের দিকে তাকাই। আমার দুঃখ ভুলে যাই।

সিস্টার গ্রাসিলা উঠে দাঁড়ালেন। বিছানা গুটিয়ে রাখলেন। তারপর? যোগ দিলেন সেই নীরব শোভাযাত্রায়, যে শোভাযাত্রা চ্যাপেলের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখনই মার্টিনস নামে প্রার্থনা সভা শুরু হবে। তিনি প্রজ্বলিত মোমের সুগন্ধ অনুভব করলেন। বুঝতে পারলেন, তার স্যান্ডেল পরিহিত পায়ের তলায় পাথরের টুকরো আছে। এলোমেলো পথ, এবড়ো খেবড়ো, চলে গেছে স্থির নির্দিষ্ট সীমারেখা ধরে। 

যখন সিস্টার গ্রাসিলা প্রথম এই কনভেন্টে এসে প্রবেশ করেছিলেন, এখানকার নিয়মনীতি কিছুই বুঝতে পারেননি। মাদার প্রাওরেসের ভাষণ বুঝতে পারতেন না। তিনি ভাবতেই পারতেন না একজন রমণী কীভাবে সাধারণ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে এভাবে বিসর্জন দেয়। তখন সিস্টার গ্রাসিলা এক চতুর্দশী, তিনটি বছর কেটে গেছে। আরও কত বছর কেটে গেল। সতেরো বছর। এখন তিনি সবই বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন, আত্মা কেন আবেগে অধীর হয়ে ওঠে। তিনি নীরবতার মধ্যে হেঁটে যেতে ভালোবাসেন। তার চোখ দুটিতে এখন এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে।

হে মহান পিতা, আমি আমার ভয়ংকর অতীতকে ভুলতে পেরেছি। এর জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি সবসময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছ। আমি তোমার ওপর আমার সবকিছু সমর্পণ করেছি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মার্টিনস শেষ হয়ে গেছে। উপাসিকারা তাদের নিজস্ব কক্ষে ফিরে আসছেন। এবার তারা আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবেন। পুব আকাশে সূর্য উঠবে, কর্মব্যস্ত দিনের জয় যাত্রা শুরু হবে। লাউডস নামে আর একটি প্রার্থনা সভার আসর বসবে।

***

বাইরে কর্নেল র‍্যামন আকোকা এবং তাঁর অনুগামীরা অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত চলাফেরা করছেন। ধীরে ধীরে তারা কনভেন্টের কাছে পৌঁছে গেলেন। কর্নেল আকোকা বললেন

জাইমে মিরো এবং তাঁর অনুগামীদের হাতে অস্ত্র আছে। তাই আমরা সামান্যতম সুযোগ দেব না।

তিনি কনভেন্টের সামনের দিকে তাকালেন। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এখানে থমথমে নীরবতা আছে। মনে হল, এই কনভেন্ট খুললেই বাসকোর সৈন্যদল বেরিয়ে আসবে। সুসানাকে একঝাক বুলেটের সামনে পড়তে হবে।

তিনি বললেন জাইমে মিরোকে আমি জীবিত অবস্থায় রাখব না। এটাই আমার শপথ।

অন্ধকার, তা না হলে আমরা দেখতে পেতাম, প্রতিহিংসার আগুনে কর্নেলের চোখ দুটি ধিকিধিকি জ্বলে উঠেছে।

***

নৈঃশব্দ্যের মধ্যে জেগে উঠলেন সিস্টার মেগান। এটা একটা অন্য ধরনের নীরবতা। বাতাসের বুকে আলোড়ন। কয়েকটি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি হেঁটে যাচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। কিন্তু কী যেন একটা শব্দ হচ্ছে। পনেরো বছর ধরে তিনি এই কনভেন্টের বাসিন্দা। এমন শব্দের সমাহার আগে কখনও শুনতে পাননি। হঠাৎ তার মনে হল, কোথাও কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ভয়ংকর একটা ঘটনা, যার জন্য আপসোস করতে হবে।

অন্ধকারের মধ্যেই তিনি শান্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তার ছোট্ট ঘরের দরজাটা খুলে দিলেন। কী আশ্চর্য, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না, পাথরের তৈরি দীর্ঘ করিডরে একদল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। একটা বিশাল আকারের মানুষের মুখ হঠাৎ ভেসে উঠল। উনি মহান মাদারের সেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাদারের দিকে তার উদ্যত বন্দুক। মেগান আহত আর্তনাদ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। এটা কি একটা দুঃস্বপ্ন? মেগান ভাবলেন, বাইরের পুরুষ এখানে আসবে কী করে?

–আপনি ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? কর্নেল আকোকা জানতে চাইলেন।

 মহতী মাদার বেটিনা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন কর্নেলের দিকে। আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। উনি বললেন এভাবে কথা বলবেন না। এটা ঈশ্বরের মন্দির। এখানকার পরিবেশ নষ্ট করবেন না।

বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, মাদার বেটিনার কণ্ঠস্বর কাঁপছে।

আপনারা এখনই এখান থেকে চলে যান।

সাহস এবং শক্তি সঞ্চয় করে তিনি কোনোমতে বললেন।

কর্নেল শক্ত করে মাদারের হাত চেপে ধরেছেন। তিনি মাদারের শরীরটা নাড়াতে নাড়াতে প্রশ্ন করলেন সিস্টার, মিরোকে এখনই আমার হাতে সমর্পণ করুন। না করলে ফল ভালো হবে না।

না, এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, এটা একটা জ্বলন্ত বাস্তব।

অন্যান্য কক্ষের দরজা খুলে গেছে, একটি একটি করে। ধর্মযাজিকারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছেন। চোখে মুখে একটা অদ্ভুত ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। এতদিন ধরে তারা এখানে আছেন, কত ঘটনা ঘটে গেছে, কিন্তু এমন পরিবেশ আর পরিস্থিতি? না, এর আগে এ অভিজ্ঞতা হয়নি তাদের।

কর্নেল আকোকা মাদার বেটিনাকে টানতে টানতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্যাটরিসিও অ্যারিয়েটা। কর্নেল আকোকার বিশ্বস্ত সহচর। তিনি বললেন, এবার অনুসন্ধান শুরু কোর। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।

আকোকার মুখ থেকে শব্দগুলো বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল অনুসন্ধান। চ্যাপেলের ভেতর তার অনুগামীরা ঢুকে পড়েছে। রিফ্ল্যাক্টরিতেও তারা পৌঁছে গেছে। প্রত্যেকটি সেলকে আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে। কোন কোন জায়গাতে উপাসিকরা এখনও ঘুমিয়ে আছেন। তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া হল। তাদের করিডরের ওপর এনে দাঁড় করানো হল। তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না। নীরবতার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে গেলেন। মেগানের কাছে এই দৃশ্যের সাথে ফিল্ম শু্যটিং-এর সাদৃশ্য ছিল। এই ভাবেই তো শু্যটিং হয়, কিন্তু শব্দ ছাড়া হয় কি?

আকোকার অনুগামীরা চারপাশে আতঙ্কঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তারা সকলে ফ্যালানজির দলভুক্ত। তারা জানে কীভাবে চার্চ তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে ছিল, গৃহযুদ্ধের সময়। তারা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। সমর্থন করেছে বিরুদ্ধবাদীদের। এবার প্রতিহিংসার আগুন জ্বালতে হবে। প্রতিশোধের পালা এসে গেছে। ওই সন্নাসিনীদের শক্তি কতটুকু? তারা কী করতে পারবেন?

আকোকা একটি ছোট্ট ঘরের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। আর্তনাদের শব্দ ভেসে এল। আকোকা দেখলেন, কী হচ্ছে? অনুগামীরা এক সন্ন্যাসিনীর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে? আকোকা চোখ বন্ধ করলেন। সামনের দিকে পা রাখলেন।

***

 সিস্টার লুসিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। বাইরে পুরুষের কণ্ঠস্বর, তিনি আতঙ্কের মধ্যে বসেছিলেন। পুলিশ আমাকে খুঁজে পাবে এটাই ছিল তার প্রথম চিন্তা। আমাকে এখুনি এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কনভেন্ট থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই। একটিমাত্র প্রবেশ পথ আছে, সেখান দিয়েই পালাতে হবে।

তিনি তাড়াতাড়ি করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেন। এ কী? বিস্ময়ে আবিষ্ট হলেন তিনি। করিডর ভরতি একাগাদা পুরুষ কিন্তু তারা তো পুলিশ নন, তাদের পরনে সাধারণ মানুষের পোশাক। কাঁধে অস্ত্র। তারা একটির পর একটি আলোকস্তম্ভ ভেঙে দিচ্ছেন। টেবিল তছনছ করছেন। কী ঘটনা ঘটেছে, সিস্টার লুসিয়া বুঝতে পারলেন না।

মাদার বেটিনাকে এককোণে দেখা গেল, তিনি চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছেন। আহা, তাঁর প্রিয় কনভেন্টের এ কী অবস্থা। সিস্টার মেগান তার পাশে ছুটে গেলেন। একটু বাদে লুসিয়া সেখানে পৌঁছে গেলেন।

-কী হচ্ছে? এঁরা কারা? লুসিয়া ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে জানতে চেয়েছিলেন।

 কনভেন্টে প্রবেশের পর এই প্রথম তিনি কথা বলার অনুমতি পেলেন।

 মহতী মাদার বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকলেন। যে চিহ্ন বোঝাল, এখন লুকিয়ে থাকতে হবে।

লুসিয়া অবিশ্বাসী ভঙ্গিতে তাকালেন–আমরা এখন কথা বলতে পারি। এখান থেকে পালাতে হবে, ঈশ্বরের দোহাই।

প্যাটরিসিও অ্যারিয়েটা, কর্নেলের ডানহাত। আকাকোর দিকে এগিয়ে গেলেন কর্নেল, আমরা সব জায়গা খুঁজে দেখেছি। জাইমে মিরো অথবা তার অনুগামীদের কোনো চিহ্ন নেই।

–আর একবার খুঁজতে হবে, আকোকার কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতা।

 মনে পড়ে গেল মাদারের এই কনভেন্টে একটা মহান মহার্ঘ্য সম্পত্তি আছে। তিনি অতি দ্রুত সিস্টার থেরেসার কাছে পৌঁছে গেলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন-তোমার ওপর একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করব। তুমি এখনই চ্যাপেল থেকে সোনার ওই ক্ৰশটাকে সরিয়ে ফেলল। এটাকে নিয়ে মেনডাভিয়ার দিকে চলে যাও। তাড়াতাড়ি করতে হবে। হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।

সিস্টার থেরেসা এই কথাগুলো শুনে একবার মাত্র মাথা নাড়লেন। তিনি তাকিয়ে থাকলেন মহতী মাদারের দিকে। চোখে মুখে ভয়ের অভিব্যক্তি। সিস্টার থেরেসা গত তিরিশ বছর এই কনভেন্টের মধ্যে বসবাস করছেন। এই কনভেন্ট ছেড়ে কোনো দিন বাইরের পৃথিবীতে আসতে পারবেন, এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। তিনি হাত তুললেন। বোঝ গেল, তিনি পারবেন না।

তাহলে? মাদারের চোখে মুখে ভয়ের অভিব্যক্তি।

–ওই ক্রশ যেন এই শয়তানদের হস্তগত না হয়। হে যিশু, তুমি বলে দাও এখন আমি কী করব? . আলো এসে পড়ল সিস্টার থেরেসার মুখের ওপর। তিনি ইঙ্গিত করলেন, চ্যাপেলের দিকে তাকালেন।

সিস্টার গ্রাসিলাকে দেখা গেল, অন্যদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মধ্যেও এক ধরনের বিভ্রান্তি জেগেছে।

আগন্তুকেরা আবার অসভ্য আচরণ করতে শুরু করেছে। চোখের সামনে যা পাচ্ছে, তাই ভেঙেচুড়ে দিচ্ছে। কর্নেল আকোকা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, ওই পৈশাচিক অভিযানে তাঁর নীরব সমর্থন আছে।

লুসিয়া, মেগান এবং গ্রাসিলার দিকে তাকালেন। আমি আপনাদের দুজনকে জানি না, কিন্তু এখনই এখান থেকে পালাব। আপনারা কি আমার সঙ্গে যাবেন?

তারা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। উত্তর দেবার মতো মানসিক অবস্থা নেই।

সিস্টার থেরেসা অতি দ্রুত তাদের কাছে ছুটে এসেছেন। ক্যানভাসে মোড়া কিছু একটা হাতে রয়েছে তার। এবার আগন্তুকরা চলে গেছে রিফ্ল্যাকটরিতে।

লুসিয়া জিজ্ঞাসা করলেন আসবেন কি?

সিস্টার থেরেসা, মেগান এবং গ্রাসিলা এক মুহূর্ত ইতস্তত করেছিলেন। তারপর তারা লুসিয়াকে অনুসরণ করলেন। তারা সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তারা দীর্ঘ করিডরের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলেন। তারা দেখতে পেলেন, ওই বিরাট দরজাটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।

কোনো একজন সামনে এগিয়ে এল। বলল–হে মহিলারা, আপনারা কোথায় চলেছেন? কোথাও যাবেন না। আমার বন্ধুরা আপনাদের জন্য একটা সুন্দর পরিকল্পনা করেছে।

লুসিয়া হাসলেন আপনার জন্য একটি উপহার আছে।

তিনি ধাতুর তৈরি একটা বাতিদান হাতে ধরলেন, হলের টেবিলের ওপর এটা বসানো ছিল।

লোকটির চোখে মুখে কৌতূহল এটা নিয়ে আপনারা কী করবেন?

–এটা, লুসিয়া ওই বাতিদানটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন পুরুষটির মুখের ওপর। এক মুহূর্তের মধ্যে রক্ষী অচেতন হয়ে গেল।

বাকি তিনজন উপাসিকা পরস্পরের দিকে তাকালেন, আতঙ্ক এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টি ভঙ্গিতে।

–সামনে এগিয়ে চলুন। লুসিয়া বললেন।

 এক মুহূর্ত কেটে গেছে। লুসিয়া, মেগান, গ্রাসিলা এবং থেরেসা কনভেন্টের বাইরে এসে পা রেখেছেন। না, আরও একটি পথ বাকি আছে। ওই বিরাট মাঠ, তখন সেখান দিয়ে তারা ছুটছেন। অন্ধকার রাত। কাছে-পিঠে কোনো শব্দ নেই।

লুসিয়া বললেন আমি আপনাদের ছেড়ে যাচ্ছি। সকলে একসঙ্গে থাকাটা উচিত হবে না। এখুনি তল্লাশি শুরু হবে। যে যার মতো প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করুন।

লুসিয়া এখন মুক্ত স্বাধীন। একটু আগেও তিনি এটা ভাবতে পারেননি। তিনি পাহাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলেন। আমি কোথায় থাকব? পাহাড়ের চূড়ায় কোনো একটি গুহাতে লুকিয়ে থাকতে হবে। আগে তল্লাশি শেষ হোক। তারপর সুইজারল্যান্ডের দিকে যাত্রা করব। হায় আমার ভাগ্য, এই বেজন্মারা না এলে আমি এভাবে মুক্তি পেতাম না।

লুসিয়া এগিয়ে চলেছেন। তাকিয়ে দেখলেন চারপাশে। তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে আরও দূরে তারা চলে যাচ্ছেন। তারা কোথায় যাচ্ছেন? আরও তাড়াতাড়ি হলে না হলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা।

***

ওঁরা কোথাও যেতে পারছেন না। মনে হচ্ছে কেউ যেন জাদুদণ্ড দিয়ে ওদের সমস্ত চেতনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এইমাত্র যে ঘটনাটা ঘটে গেল, তার জন্য ওঁরা মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত ছিলেন না। উপাসিকারা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। চিন্তা হারিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই কনভেন্টের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দী জীবন যাপন করেছেন। বিশ্বপ্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে দিন কাটিয়েছেন। এই কনভেন্ট তাদের কাছে নিরাপত্তার প্রতীক ছিল। এখন চার দেওয়ালের বাইরে এসে তারা ভয়ে কাঁপতে থাকলেন। মনের ভেতর বিভ্রান্তি জেগেছে। জেগেছে আতঙ্ক। তারা জানেন না কোথায় ঝবেন, কী করবেন। কনভেন্টের ভেতরের জীবন ছিল সুশৃঙ্খল, নিয়মিত এবং নিয়ন্ত্রিত। খাবার দেওয়া হত, শয্যা ছিল, কী করতে হবে তাও বলে দেওয়া হত। তারা একটা নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে জীবন কাটাতেন। এখন কোনো নিয়ম নেই। ঈশ্বর এখন আমাদের কাছ থেকে কী চাইছেন? এটা কি তাঁরই ইচ্ছা? অনেকক্ষণ তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কথা বলতে পারছেন না। এত ভয় পেয়েছেন যে, একে অন্যের দিকে তাকাতে পারছেন না।

শেষ পর্যন্ত সিস্টার থেরেসা আভিলার আলোর দিকে তাকালেন। ইঙ্গিত করলেন, ওই দিকে এগোতে হবে। তার মানে? এলোমেলো পদক্ষেপে তখন তারা অনাহুতের মতো শহরের দিকে এগিয়ে চলেছেন।

পাহাড়ের মাথা থেকে লুসিয়া তাকিয়ে থাকলেন। আঃ, ওখানে লুকোবার ভালো জায়গা নেই। এটাই আপনাদের সমস্যা। আপনাদের কথা আমি আর ভাবব না। নিজের সমস্যা নিয়েই এখন আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে।

লুসিয়া সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। এখন কোথায় যাওয়া যায়? দেখতে পাওয়া গেল, তিনজন যাজিকা এলোমেলো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করছেন। নাঃ, ওঁরা বোধহয় আর বেঁচে থাকবেন না। লুসিয়া ক্ষণমুহূর্ত ভাবলেন।

তিনি পাহাড় থেকে নামার চেষ্টা করলেন। বললেন, থামুন-থামুন, আর একটু থামুন।

কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সিস্টাররা থেমে গেছেন।

লুসিয়া হাঁফাচ্ছিলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললেন– আপনারা ভুল পথে যাচ্ছেন। কেন ভাবছেন না, ওরা কিন্তু শহরেই খোঁজ খবর করবে। অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করুন।

নীরবতার মধ্যে তিনজন সিস্টার লুসিয়ার দিকে তাকালেন।

লুসিয়া অধৈর্যভাবে বললেন চলুন, আমরা পাহাড়ের চূড়ায় চলে যাই। আমাকে অনুসরণ করুন।

লুসিয়া পিছন ফিরলেন, আবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে দৌড়োত থাকলেন। অন্যেরা তাকে নিরীক্ষণ করলেন। এক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর একে একে তারা লুসিয়াকে অনুসরণ করলেন।

ছুটতে ছুটতে লুসিয়া মাঝে মধ্যে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন। ওঁরা কি আমাকে অনুসরণ করছেন? কিন্তু আমি কেন আমার নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারছি না, লুসিয়া ভাবলেন। ওঁদের কী হবে, সেটা দেখা তো আমার দরকার নেই। আমরা সকলে একসঙ্গে থাকলে সমস্যা বাড়তে পারে। লুসিয়া পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছেন। তখনও পর্যন্ত নজর রেখেছেন ওই তিন সিস্টারের ওপর।

ওঁরা কী করবেন? প্রতি মুহূর্তে ওঁদের গতি কমে আসছে। লুসিয়া বাতাসের বুকে শব্দ ছুঁড়ে দিলেন আরও তাড়াতাড়ি করুন, যিশুর দোহাই, জীবনটা এইভাবে নষ্ট করবেন না।

লুসিয়া মনে মনে ভাবলেন, সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে এই সঙ্গ ছেড়ে মামাকে চলে যেতে হবে।

***

অ্যাবেতে অভিযান শেষ হয়ে এসেছে। হতভম্ব উপাসিকারা অবাক হয়ে গেছেন। দৈনন্দিন জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। সর্বত্র রক্তের ছাপ। তারা জানেন, আর কখনও আগের নিয়মনীতি, ফিরে আসবে না।

–এদের মাদ্রিদে নিয়ে যাও, আমার হেড কোয়ার্টারে, প্রত্যেককে আলাদাভাবে রাখবে। কর্নেল আকোকা আদেশ দিলেন।

-কী অভিযোগে?

–উগ্রপন্থীদের সাহায্য করেছে, এই অভিযোগে।

কর্নেল, প্যাটরিসিও অ্যারিয়েটা বলল, চারজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

.

কর্নেল আকোকা ঠান্ডা মাথায় বললেন এখুনি অনুসন্ধান শুরু হোক।

***

কর্নেল আকোকা মাদ্রিদে ফিরে এলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট পৌঁছে দিলেন– আমরা কনভেন্টে পৌঁছোবার আগে জাইমে মিরো সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী মার্টিনেজ মাথা নেড়ে বললেন আমি শুনতে পেয়েছি।

তিনি তখনও চিন্তা করছেন, সত্যি সত্যি জাইমে মিরো ওই কনভেন্টে ঢুকেছিলেন কিনা? হয়তো ঢুকেছিলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত চিহ্ন কোথায়? কর্নেল আকোকার কাজকর্ম আর তার ভালো লাগছে না। কনভেন্টের ওপর এই যে আক্রমণ হল, গণমাধ্যম এর প্রতিবাদ করবে। জনগণ বিক্ষোভ দেখাবে।

প্রধানমন্ত্রী ধীরে ধীরে বললেন সাংবাদিকরা এসে গেছে, কনভেন্টে কী ঘটেছে, তা জানতে চাইছে।

–সাংবাদিকরা চাইছে এই সন্ত্রাসবাদী নেতাকে দেশের নায়কে পরিণত করতে। আকোকার কণ্ঠস্বর, মনে হয় গলায় পাথর জমেছে, আমরা কিন্তু কিছুতেই মাথা নত করব না।

কর্নেল, উনি একাই তো সরকারকে নাড়িয়ে দিচ্ছেন, আর ওই চারজন উপাসিকা। যদি তারা কথা বলতে শুরু করেন?

এ বিষয়ে চিন্তা করবেন না, তারা বেশি দূর যেতে পারবেন না, আমি তাদের ধরে ফেলব। মিরোকেও আমি গ্রেপ্তার করব।

প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন, এ ব্যাপারে আর কোনো সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। তিনি বললেন কর্নেল, যে ছত্রিশজন সিস্টারকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের সকলের প্রতি ভালো ব্যবহার করা উচিত। আমি বলছি, মিরোকে খুঁজে বের করার জন্য আবার অনুসন্ধান শুরু হোক। আপনি কর্নেল সসটিরোর সঙ্গে একসাথে কাজ করুন।

দীর্ঘক্ষণের নীরবতা আপনি ঠিক করে বলুন, কার ওপরে এই অপারেশনের দায়িত্ব দেবেন?

আকোকার চোখে বরফের শীতলতা।

 ঢোক গিলে প্রধানমন্ত্রী বললেন–যেমন আপনার ওপর দায়িত্ব ছিল তেমনটিই থাকবে।

***

লুসিয়া এবং তিন সিস্টার ভোরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তারা পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব অংশে পৌঁছে গেছেন। আভিলা এবং কনভেন্ট থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছেন। সিস্টাররা নীরবতা বজায় রেখেছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে ছোটো ছোটো শব্দ হচ্ছে। শব্দ হচ্ছে তাদের আলখাল্লার খসখসানিতে। জুতোর মৃদুমন্দ আওয়াজে। চুলের দুলে ওঠা। দীর্ঘশ্বাস আরও কত কী। পথ উঁচু থেকে আরও উঁচুতে চলে গেছে।

শেষ অব্দি তারা গুয়ারডারমা পাহাড়ের একটি মালভূমিতে এসে পৌঁছোলেন। সামনে পাথরের প্রাচীর দেখা গেল। একদল মোষ আর ছাগল চরছে। সকাল হয়েছে। তারা ভিলা কাসটিন নামে একটি ছোটো গ্রামের প্রান্তসীমায় এসে পড়েছেন।

লুসিয়া মনে মনে ভাবলেন এখনই এই তিন সিস্টারের সঙ্গ ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। ঈশ্বরের হাতে ওনাদের ভবিষ্যৎ সমর্পণ করতে হবে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমার থেকে ভালোভাবে ওনাদের সামলাতে পারবেন। চিন্তাটার মধ্যে তিক্ততা ছিল। এখান থেকে সুইজারল্যান্ড অনেক দূর। আমার পকেটে কোনো পয়সা নেই, পাশপোর্ট নেই, আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে? এক ভবঘুরে? তাহলে? আমি কোথায় যাব? এবার অনুসন্ধান শুরু হবে। আমাদের না পাওয়া পর্যন্ত অনুসন্ধান শেষ হবে না। তাহলে? খুব তাড়াতাড়ি অভিযানটা শেষ করতে হবে।

একটু বাদে একটা ঘটনা ঘটে গেল। ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনা একেবারে পালটে গেল।

সিস্টার থেরেসা গাছের তলা দিয়ে হাঁটছিলেন। এতক্ষণ ধরে তিনি একটা প্যাকেট সাবধানে বহন করছিলেন। হঠাৎ সেটা মাটিতে পড়ে গেল। ক্যানভাসের আবরণ খুলে গেছে। লুসিয়া তাকিয়ে থাকলেন। এ কী? ঝকঝক করছে সকালের সূর্যালোকে। নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি ক্রুশচিহ্ন।

এটা আসল সোনা, লুসিয়া ভাবলেন। তাহলে? এই ক্ৰশই আমার উদ্ধার কর্তা হতে পারে। এর গায়ে সুইজারল্যান্ডের টিকিট লেখা আছে।

লুসিয়া দেখলেন, সিস্টার থেরেসা পরম মমতায় ওই ক্রশটিকে তুলে নিলেন। সেটিকে আবার ক্যানভাস কাপড় দিয়ে মুড়ে দিলেন। লুসিয়া তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন–অতি সহজেই এটা আমি ছিনিয়ে নিতে পারি। এই সিস্টাররা কিছুতেই বাধা দিতে পারবেন না!

***

আভিলা শহরের অবস্থা মুখে বর্ণনা করা যায় না। কনভেন্টের ওপরে জঘন্য আক্রমণের সংবাদ অতি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফাদার বেরেনডো কর্নেল আকোকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে নামতে চাইছেন। ভদ্রলোকের বয়স সত্তর ছাড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। তিনি যে কোনো ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করতে পারেন। এখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন।

কর্নেল আকোকা তাকে একঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখলেন। তারপর ওই পাদরিকে তার অফিস ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন।

ফাদার বেরেনডো কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি বললেন আপনি এবং আপনার অনুগামীরা কোনো কারণ ছাড়াই কনভেন্ট আক্রমণ করেছেন। এটাকে আমরা উন্মত্ত আচরণ বলতে পারি।

–আমরা আমাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। কর্নেল শান্তভাবে বললেন। ওই কনভেন্টে জাইমো মিরো এবং তাঁর সন্ত্রাসবাদী অনুগামীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। সিস্টারদের জবানবন্দীতে এমন কথাই আছে। আমরা ওঁদের ধরে এনেছি আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব বলে।

আপনি কি জাইমে মিরোকে ওই কনভেন্টে পেয়েছেন?

রাগের প্রশ্ন ছুটে এল পাদরির মুখ থেকে।

কর্নেল আকোকা শান্তভাবে বললেন না, আমরা সেখানে যাবার আগেই ওই শয়তান পালিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা ওকে ধরে ফেলবই। আর ওঁদের ওপর সুবিচার করা হবে।

কর্নেল আকোকা হাসলেন। সুবিচার, কে নির্ধারণ করবে? এখানে প্রধান বিচারপতির আসনটা আমাকেই অলংকৃত করতে হবে।

.

০৫.

সিস্টাররা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন। জামাকাপড়ের অবস্থা শোচনীয়। স্যান্ডেল অত্যন্ত পাতলা। পাথুরে ভূমিখণ্ড থেকে পা-কে রক্ষা করতে পারছেন না। এভাবে দীর্ঘ পথ চলার অভ্যেস তাদের কোনোদিন ছিল না। সিস্টার থেরেসা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন। দুহাতে ওই মূর্তিটিকে ধরে থাকতে হয়েছে। মাঝেমধ্যেই গাছের শাখাপ্রশাখার আক্রমণ।

দিনের আলো পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। স্বাধীনতা শব্দটা কানের কাছে ঝমঝমিয়ে বাজছে। ভগবান কি এই সিস্টারদের বাইরে নিয়ে এসেছেন? ইডেন উদ্যানের বাইরে? জঘন্য পৃথিবীর ঘটনাবহুল আবর্তে? ভগবান কি এখন তাদের ওপর অসীম করুণা বর্ষণ করবেন? তারা কীভাবে জীবন কাটাবেন? কোথায় যাবেন? কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কোনো মানচিত্র নেই, কোনো কম্পাস নেই, উত্তর-দক্ষিণ ধরা যাচ্ছে না। কত দিন? কত দিন এভাবে থাকা যায়? নিরাপত্তার ওই প্রাচীরগুলো হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তারা বুঝি নগ্না এবং উন্মুক্তা। সর্বত্র বিপদের গন্ধ। আশ্রয় কোথায় পাবেন? এখানে তারা বিদেশী। বুঝতে পারা যাচ্ছে, দেশ জুড়ে এবার চরম বিতর্ক শুরু হবে। পতঙ্গের হাতছানি, পাখির কুজন, নীল আকাশ, সুন্দর প্রকৃতি কিন্তু ওই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কে দেখবে? ওঁদের মন এখন বিরক্ত, ক্ষুব্ধ এবং আহত। 

যখন ওনারা প্রথমে কনভেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কেউ কারও মুখের দিকে তাকাননি, তখনও নিয়মনীতি মাথায় ছিল। অবশেষে তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালেন। অনেক বছর নীরবতার মধ্যে সময় কেটে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কথা বলার অভ্যেস নেই তো। অবশেষে ওনারা কথা বলতে শুরু করলেন। মনে হল, শব্দগুলো কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক পরিশ্রমে তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। মনে হল কথা বলা এমন একটা শক্তি যা বহুদিন ব্যবহার করা হয়নি। নিজেদের কানের কাছে মুখ থেকে ছুটে আসা এই শব্দগুলো কেমন অদ্ভুত বলে শোনাল। লুসিয়া অবশ্য অন্য মনের। তিনি জানেন, ওই তিনজন সিস্টারকে এখুনি বশীভূত করতে হবে। আমার আচরণের মধ্যে কর্তৃত্বের ব্যঞ্জনা আনতে হবে। চারজনের এই দলে তিনিই হবেন সর্বাধিনায়িকা।

আগে পারস্পরিক আলাপটা সেরে ফেলা যাক। লুসিয়া বললেন, আমি সিস্টার লুসিয়া।

একটা অদ্ভুত নীরবতা। গ্রাসিলা ধীরে ধীরে লাজুক স্বরে জবাব দিলেন –আমি সিস্টার গ্রাসিলা।

আহা, সূর্যদীপ্ত গায়ের রং। ভারী সুন্দরী।

–আমি সিস্টার মেগান।

অল্প বয়সের ওই সোনালি চুলের কন্যাটি, চোখের তারায় নীলাভ দ্যুতি।

-আমি সিস্টার থেরেসা। আমাদের দলের মধ্যে প্রবীণা, কত বয়স? পঞ্চাশ অথবা যাট।

তারা গ্রামের পাশে একটি বনের ভেতর প্রবেশ করলেন।

লুসিয়া ভাবতে থাকলেন ওনারা হলেন পাখির শাবক। এই প্রথম নীড় ছেড়ে বাইরে উড়তে শিখেছে। কিন্তু এই অবস্থাটা বেশিক্ষণ থাকবে না। তার আগেই কাজ করতে হবে। ক্ৰশটা হাতাতে হবে। ওটা নিয়ে সুইজারল্যান্ডে পালাতে হবে।

লুসিয়া পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। গাছের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট গ্রামটিকে দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। কিন্তু যারা কনভেন্টের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, তাদের কাউকে চোখে পড়ছে না। এখন, লুসিয়া ভাবলেন, এখানেই আমাকে সুযোগ নিতে হবে।

তিনি অন্য তিনজনের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন– খাবার আনতে আমি গ্রামে যাচ্ছি। আপনারা এখানে অপেক্ষা করবেন। তিনি সিস্টার থেরেসার দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনি কি আমার সঙ্গে আসবেন?

আহ্বানে সিস্টার থেরেসা অবাক হয়ে গেলেন। তিরিশ বছর ধরে তিনি মহতী মাদার বেটিনার আদেশ পালন করেছেন। এখন এই অচেনা অজানা সিস্টার মাদার বেটিনার আসন গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যা কিছু ঘটছে সব ঈশ্বরের আদেশানুসারে, সিস্টার থেরেসা ভাবলেন, ঈশ্বর আছেন, তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।

তিনি ঈশ্বরের সাথে কথা বললেন এই সোনার ক্রশটিকে নিয়ে মেনডাভিয়ার কনভেন্টে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

–ঠিক আছে, আমরা কখন সেখানে যাব? কীভাবে যাব?

তারা দুজন পাহাড় থেকে নীচে নামতে শুরু করলেন। ছোটো ওই গ্রামের দিকে এগিয়ে চললেন। লুসিয়া সমস্ত সমস্যার ওপর নজর রেখেছেন। আশেপাশে সন্দেহজনক কেউ আছে কি? না, কাউকে চোখে পড়ল না।

তাহলে কাজটা সহজ হবে, লুসিয়া ভাবলেন।

তারা ওই ছোট্ট গ্রামের প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়ালেন। সেখানে একটা চিহ্ন রয়েছে– ভিলাকাসটিন। সামনে প্রধান পথ। বাঁদিকে ফাঁকা একটা রাস্তা।– ঠিক আছে, লুসিয়া ভাবলেন, এই ঘটনার কোনো সাক্ষী থাকবে না।

লুসিয়া বাঁদিকের ফাঁকা পথে ঢুকে পড়লেন আমরা এই পথ ধরে যাব। এখানে ধরা পড়ার আশঙ্কা কম।

সিস্টার থেরেসা মাথা নাড়লেন। লুসিয়াকে অন্ধের মতো অনুসরণ করতে বাধ্য হলেন।

লুসিয়ার মনে এখন একটাই প্রশ্নের উতরোল, কীভাবে সোনার ক্রশটা ছিনিয়ে নেব আমি?

আমি চট করে এটা কেড়ে নিয়ে ছুটতে পারি, লুসিয়া ভাবলেন। কিন্তু সিস্টার থেরেসা চিৎকার করবেন। অনেকের নজর আমার ওপর পড়ে যাবে। না, এমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সিস্টার থেরেসা নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হন।

সামনে গাছের একটা ডাল পড়ে আছে। লুসিয়া একমুহূর্ত কী যেন চিন্তা করলেন। গাছের ডালটা খুবই শক্ত। আঃ, এটা একটা ভালো অস্ত্র হতে পারে। তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। সিস্টার থেরেসা কাছে এসে গেছেন।

-সিস্টার থেরেসা, লুসিয়া একবার ডাকলেন।

  সিস্টার থেরেসা তাকালেন লুসিয়ার দিকে। আর এক মুহূর্ত, গাছের ডালটা গদার মতো আঘাত করবে সিস্টার থেরেসার কপালের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল। কণ্ঠের উৎস খুঁজে পাওয়া গেল না।

–সিস্টার, ঈশ্বর আপনাদের সহায় হবেন।

ভয় পেয়ে লুসিয়া চারপাশে তাকালেন। পালাবার চেষ্টা করলেন। একজন মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বা বাদামী রঙের আলখাল্লা তার পরনে। মাথার ওপর টুপি। তিনি অত্যন্ত দীর্ঘ এবং শীর্ণ। মুখের ভেতর মধ্যযুগীয় ছাপ। বুঝতে পারা যায় তিনি এক মহান যাজক। লুসিয়া এমন মূর্তি কখনও দেখেননি।

ওই ভদ্রলোকের চোখ দুটিতে আলো জ্বলে উঠেছে। তার কণ্ঠস্বর কোমল এবং করুণায় ভরা।

–আমি ফ্রায়ার মিগুয়েল কারিলো। উনি থেমে থেমে বললেন।

লুসিয়ার মন ছুটে চলেছে। লুসিয়া চেয়েছিলেন, এখনই কথা থামিয়ে দিতে। কিন্তু তার উপায় নেই। লুসিয়া পরিস্থিতি বিবেচনা করে বললেন হায় ভগবান, শেষ পর্যন্ত আপনি আমাদের খুঁজে পেয়েছেন।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। তিনি জানতেন, এই সিস্টাররা কোথা থেকে এসেছেন।

–আমরা আভিলার কাছে সিস্টারসিয়ান কনভেন্ট থেকে আসছি। লুসিয়া ব্যাখ্যা করলেন, গত রাতে কয়েকজন আততায়ী আমাদের কনভেন্টে চড়াও হয়েছিল। তারা সমস্ত সিস্টারকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। আমরা চারজন কোনোরকমে পালাতে পেরেছি।

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, তার কণ্ঠস্বরে রাগ-বিরক্তি-ঘৃণা একই সঙ্গে ঝরে পড়ছে –আমি সেন্ট জেনেরোর মনাস্ট্রি থেকে আসছি। কুড়ি বছর ধরে আমি সেখানেই ছিলাম। পরশু রাতে আমাদের আশ্রমকে আক্রমণ করা হয়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মনে হচ্ছে, ঈশ্বর বোধহয় আমাদের জন্য অন্য কোনো পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু এখন আমাকে স্বীকারোক্তি করতেই হবে। আমি বুঝতে পারছি না, চারপাশে এমন ঘটনা ঘটছে কেন?

–ওই আততায়ীরা আমাদের সন্ধানে পাগল হয়ে উঠেছে। লুসিয়া বললেন। খুব তাড়াতাড়ি স্পেন থেকে অন্য কোনো দেশে চলে যেতে হবে। আপনি কি একটা উপায় : বাতলাতে পারেন?

ফাদার কারিলো হেসে ফেললেন মনে হচ্ছে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারব। সিস্টার, ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আপনারা আমাকে অনুসরণ করতে পারেন।

লুসিয়া ওই ভদ্রলোককেও তাদের দলভুক্ত করে নিলেন।

লুসিয়া বললেন ইনি হলেন ফ্রায়ার কারিলো, গত কুড়ি বছর ধরে তিনি একটা মনাস্ট্রিতে বসবাস করছেন। তিনি আমাদের সাহায্য করতে চাইছেন।

বাকি তিনজন সাধিকা ওই যাজককে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মনের ভেতর মিশ্র অনুভূতির জন্ম হয়েছে। গ্রাসিলা তার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে ভয় পাচ্ছেন। মেগান পরিষ্কার দৃষ্টিতে ভদ্রলোককে পর্যবেক্ষণ করলেন। চোখের তারায় কৌতূহলের আভাস। সিস্টার থেরেসার চোখে ইতিমধ্যেই উনি ভগবান প্রেরিত এক দেবদূত হিসেবে গণ্য হয়েছেন। উনি হয়তো মেনডাভিয়া কনভেন্টের পথ দেখাতে পারবেন।

ফ্রায়ার কারিলো বললেন কী জন্য ওরা আমাদের কনভেন্ট আক্রমণ করেছে? হয়তো কোনো উদ্দেশ্য ছিল। আর আপনারাও এখন নিরাপদ নন। ওরা নিশ্চয়ই হন্যে কুকুরের মতো আপনাদের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই পোশাক পালটানো দরকার।

মেগান মনে করালেন পালটাবার মতো কোনো পোশাক তো আমাদের সঙ্গে নেই।

কারিলোর মুখে একটা রহস্যঘন হাসি ফুটে উঠল- মহান ঈশ্বরের হাতে মস্ত বড়ো ওয়ারড্রোব আছে। আপনারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে আমাকে অনুসরণ করুন। আমরা এখন শহরে যাব।

বেলা দুটো বেজেছে। কারিলো এবং চারজন সিস্টার প্রধান রাজপথ দিয়ে হেঁটে চলেছেন। তারা গ্রামের পথেই চলেছেন। চারপাশ দেখছেন সতর্ক দৃষ্টিতে। অপরিচিত কোনো আগন্তুককে দেখা যাচ্ছে কি? দোকানগুলো বন্ধ। রেস্টুরেন্ট এবং বার খোলা আছে। সেখান থেকে সংগীতের শব্দ ভেসে আসছে। এলোমেলো কিছু আওয়াজ। উল্লসিত মানুষের চিৎকার।

ফাদার কারিলো সিস্টার থেরেসার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন –এ হচ্ছে রক অ্যান্ড রোল। তরুণ-তরুণীদের কাছে আদর্শ নাচের বাজনা।

দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন একটি বারের সামনে। সেবিকারা সেখান দিয়ে চলে গেলেন। তারা একবার মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। পরনে অদ্ভুত পোশাক। সিস্টাররা ভাবলেন, একজন এত ছোটো একটি স্কার্ট পরেছে, কোনোরকমে সেটি তার দেহের কিছু অংশকে ঢেকে রেখেছে। আর একজন লম্বা স্কার্ট পরেছে। কিন্তু সেটি মাঝখান থেকে বিসদৃশ ভাবে কাটা। তারা অন্তর্বাস পরেছে একদম চাপা। কোনো ফাঁকা নেই।

সিস্টার থেরেসা ভাবলেন, ঈষৎ চিন্তিত হয়ে একেই বোধহয় নগ্না অভিব্যক্তি বলে।

দরজাতে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। চিত্র বিচিত্র সোয়েটার তার পরনে। জ্যাকেট আছে কিন্তু কলার নেই। গলাতে একটা পেনডান ঝুলছে।

এমন একটা গন্ধ নাকে এল, যা মনকে চঞ্চল করে তোলে। নিকোটিন এবং হুইস্কি, বোঝা গেল।

মেগান রাস্তার অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন।

কারিলো জানতে চাইলেন কী হয়েছে?

তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।

মেগান দেখলেন, এক মহিলা একটি শিশুকে বহন করছে। কত দিন হয়ে গেল, তিনি কোনো শিশুর মুখ দেখেননি। কোনো ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সেই অনাথ আশ্রমের কথা মনে পড়ে গেল, চোদ্দো বছর। অতর্কিত এই আক্রমণ মেগানকে জীবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তুলল। তার মানে এতদিন আমি বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নিঃসঙ্গ দ্বীপে অবস্থান করছিলাম।

সিস্টার থেরেসাও ওই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি অন্য কিছু ভাবছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, বাচ্চাটি বোধহয় ঈশ্বরেরই সন্তান। বাচ্চাটি ক্ষিদেতে চিৎকার করছে। কেন? মনে হচ্ছে, আমি তাকে সাহায্য করতে পারছি না। তাই সে আকুল হয়েছে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। তিরিশ বছর কেটে গেছে, সিস্টার থেরেসা তাকালেন, বাচ্চাটির কান্না তার অন্তরকে ব্যথিত করেছে। তারা এগিয়ে চললেন।

তাঁরা একটা সিনেমা হলকে পেছনে ফেলে এলেন। পোস্টারে লেখা আছে–গ্রী লার্ভাস, দেখা যাচ্ছে স্বল্পবাস এক রমণী খোলা বুকের এক পুরুষকে আলিঙ্গন করছে।

-কেন? কেন সর্বত্র নগ্নতার ছড়াছড়ি।

সিস্টার থেরেসা বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

কারিলো ভুরু ভঙ্গিতে বিরক্তি এনে বললেন ঠিকই বলেছেন, এই ধরনের সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি পায় কী করে? এই ফিল্মটাকে আমরা এক সস্তা পর্ণগ্রাফি বলতে পারি। মানুষের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ভাব-ভালোবাসার মুহূর্তগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এই ভাবেই আমরা ঈশ্বরের সন্তানদের জন্তুতে পরিণত করি।

তারা একটা হার্ডওয়ারের দোকান পেরিয়ে গেলেন। একটা হেয়ার ড্রেসিং সেলুন চোখে পড়ল। ফুলের দোকান, মিষ্টির দোকান–সিয়েসটা উৎসবের জন্য সব বন্ধ আছে। প্রত্যেকটি দোকানের সামনে সিস্টাররা কিছুক্ষণ থমকে থেমেছিলেন। জানলার ভেতর দিয়ে উৎসুক জিজ্ঞাসু চোখে তাকাচ্ছিলেন। সব জায়গাতেই জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব জিনিস থেকে তারা কত বিচ্ছিন্ন।

তারা মহিলাদের পরিচ্ছদের দোকানে এলেন।

কারিলো বললেন- দাঁড়ান।

 সামনের দরজা খুলে গেল। একটা আলো জ্বলে উঠল, বন্ধ হয়ে গেছে।

–এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করুন, কেমন?

চারজন ভদ্রমহিলা তাকিয়ে থাকলেন। ভদ্রলোক চোখের বাইরে চলে গেলেন। তারা সবাই শূন্য চোখে একে অন্যকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি কোথায় চলেছেন? উনি যদি না আসেন তাহলে কী হবে? আশঙ্কা এবং হতাশার অনুভূতি।

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। তারা সামনে একটা শব্দ শুনলেন। কারিলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।

তিনি বললেন তাড়াতাড়ি করতে হবে।

তারা সকলে দোকানের ভেতর চলে এলেন। ভদ্রলোক দোকানের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

লুসিয়া জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কী করে একাজ করলেন?

–যেমন সামনে দরজা আছে, তেমন পেছনে একটি দরজা আছে। ভদ্রলোক শান্তভাবে জবাব দিলেন। তার কণ্ঠস্বরে এমন এক ভয়, মেগান হেসে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ভয় মেশানো শ্রদ্ধায় সিস্টাররা চারদিকে তাকালেন। অসংখ্য পোশাক থরে থরে সাজানো আছে। রং আর রং-এর খেলা। সোয়েটারের পাশাপাশি অন্তর্বাস, মোজাও চোখে পড়ল। হাইহিল জুতো এবং আরও কত ফ্যাশান সামগ্রী। এমন বস্তু অনেক বছর তারা চোখে দেখেননি। স্টাইল অনেকটা পালটে গেছে। অদ্ভুত কিছু স্টাইল। হ্যান্ডব্যাগও চোখে পড়ল। রুমালও আছে। কিছু ব্লাউজ টাঙানো আছে। এত কিছু নেওয়া সম্ভব নয়। চারজন সিস্টার অবাক হয়ে অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে, কারিলো মনে করালেন। খুব তাড়াতাড়ি এই দোকানটা ছেড়ে চলে যেতে হবে। সিয়েসটার শেষ হলে কিন্তু দোকান খুলবে। এবার আপনারা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করুন। যেটা ঠিক হয়েছে বলে মনে হবে, সেটাই পরে নিন। দেখবেন, চেহারাটা একেবারে বদলাতে হবে। চট করে কেউ যেন আপনাদের চিনতে না পারে।

লুসিয়া হেসে ফেললেন হায় ঈশ্বর, আমি শেষ পর্যন্ত আবার রমণীসুলভ পোশাক পরব? তিনি পোশাকের র‍্যাকের কাছে চলে গেলেন। পোশাক বাছতে শুরু করলেন। একটা সুন্দর স্কার্ট তার পছন্দ হল। ট্যান সিল্কের একটা ব্লাউজ। হ্যাঁ, এর সঙ্গে চলতে পারে। হয়তো খুব একটা ফ্যাশান দুরস্ত নয়, কিন্তু কী করা যাবে। তিনি একটা প্যান্টি বের করলেন। একটি ব্রা এবং কোমল বুট জুতো। যেখানে পোশাক আছে, তার আড়ালে চলে গেলেন, সম্পূর্ণ নগ্ন হলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পোশাক পালটে বেরিয়ে এলেন।

ইতিমধ্যে অন্য সিস্টাররাও উপযুক্ত পোশাক পরে নিয়েছেন।

গ্রাসিলা পছন্দ করেছিলেন সাদা স্মৃতির পোশাক। তার কালো চুলের সাথে তা মানিয়ে গেছে। সূর্যদীপ্ত তার গায়ের চামড়া, তাই সাদা পোশাকে তাকে বেশ ভালোই দেখাচ্ছিল। পায়ে একজোড়া স্যান্ডেল গলিয়ে দিয়েছেন।

মেগানের পছন্দ প্যাটার্ন করা নীল সুতির পোশাক। ফ্রকটা হাঁটুর নীচে নেমে গেছে। তিনি একটা প্লাটফর্ম হিলের জুতো পরলেন।

সিস্টার থেরেসা কী পোশাক পরবেন ভাবতেই পারছিলেন না। কিছু একটা পরতে তো হবে, এখানে যা আছে সবই খুবই উজ্জ্বল, সিল্ক আছে, ফ্লানেল আছে, কুইট এবং চামড়ার পোশাক। সুতিও চোখে পড়ল। টুইল এবং কোরুডয়। কোনোটাতে চেক, কোনোটাতে স্ট্রাইপ, কোনোটাতে প্লেট আছে। এসব পোশাক পরলে নিজেকে কেমন উদ্ভট বলে মনে হবে। সিস্টার থেরেসার মনে তখন একটিই চিন্তা, কীভাবে তিনি নিজেকে পালটে ফেলবেন? গত তিরিশ বছর ধরে সন্ন্যাসিনীর সাদা আলখাল্লা পরে থাকতেন। এখন তাকে নতুন পোশাক পরতে বলা হচ্ছে। হায় ভগবান, আমি এই বিশ্রী পোশাকগুলো কী করে পরব? শেষ পর্যন্ত তিনি একটিমাত্র লং স্কার্ট খুঁজে পেয়েছিলেন। পুরো হাতা, উঁচু কলার দেওয়া একটি সুতির ব্লাউজ।

ফ্রায়ার কারিলো বললেন তাড়াতাড়ি সিস্টাররা, খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।

এবার পোশাকগুলো পরতে হবে। কিন্তু কী করে? আগের পোশাকগুলো খোলা দরকার।

 কারিলো হেসে বললেন আমি অফিসে অপেক্ষা করছি, কেমন?

উনি দোকানের পাশে অফিসে চলে গেলেন।

সিস্টাররা এবার দ্রুত পোশাক পাল্টাতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা দুঃখদায়ক, কিন্তু কী করা যাবে। এখন সময় খুবই কম।

অফিসে বসে কারিলো বাইরের দিকে তাকালেন। ভাবলেন ওই সিস্টাররা এখন কী করছেন? মুহূর্তের মধ্যে চোখ সেদিকে পড়ে গিয়েছে। তিনি চিন্তা করলেন, কাকে প্রথম গ্রহণ করা যেতে পারে।

***

মিগুয়েল কারিলো তার জীবন শুরু করেছিল একজন চোর হিসেবে। তখন তার বয়স মাত্র দশ বছর। জন্ম হয়েছিল তার কোঁকড়ানো সোনালি চুল নিয়ে, দেবদূতের মতো সরলতা এবং নিষ্পপতা লুকিয়ে ছিল মুখের মধ্যে। এইজন্য সে বোধহয় তার ঈঙ্গিত পেশাটি সহজেই বেছে নিয়েছিল। শুরু করেছিল একেবারে নীচু থেকে। প্রথম প্রথম হাতব্যাগ চুরি করে পালাত। দোকান থেকে এটা সেটা তুলে নিত। তারপর বয়স বাড়ল। তার পেশা আরও বিস্তৃত হল। সে তখন মাতালদের পকেট হাতড়াচ্ছে। ধনী মহিলাদেরও আক্রমণ করছে। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিল তার। তাই প্রতিটি কাজে সে সফল হত। এবার সিঁদকাটা শিখে ফেলল। নিত্য নতুন আবিষ্কারে নিজেকে আরও দুরন্ত করে ফেলল। দুর্ভাগ্য, শেষ অভিযানটা মোটেই সার্থক হয়নি। আর সেবারই সে ধরা পড়ে যায়।

নিজেকে সে দূরবর্তী এক মনেস্ট্রির যাজকের ভূমিকাতে সাজিয়েছে। কারিলো এক চার্চ থেকে অন্য চার্চে ঘুরে বেড়ায়। মধ্য রাতের অভিযান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। সকাল হয়। প্রধান ধর্মযাজক এসে দরজা খুলে দেন। অবাক হয়ে দেখেন চার্চের অনেক মূল্যবান সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল সেগুলো? কিন্তু সব সময় ভাগ্য কি এইভাবে সাহায্য করে? দু-রাতের আগের ঘটনা, আভিলার কাছে একটা ছোট্ট শহর বেনজা। ধর্মর্যাজক মাঝরাতে ফিরে এসেছিলেন। মিগুয়েল কারিলোকে পাওয়া গেল চার্চ ট্রেজারির মধ্যে বসে থাকতে। ধর্মযাজক ছিলেন অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ। তিনি কারিলোর সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করে দিলেন।

শেষ পর্যন্ত কারিলোকে ভয় দেখালেন, বললেন, এখনই পুলিশে ফোন করবেন। মাটির ওপর মস্ত বড় একটা রুপোর পাত পড়েছিল। কারিলো সেটাকেই তুলে নিল। সজোরে আঘাত করল ওই যাজকের মাথার ওপর। তখন কী হল? হয়তো আঘাতটা খুব গুরুতর হয়েছিল। কিংবা ধর্মর্যাজকের মাথার খুলিটা ছিল খুবই পাতলা। তিনি মরে গেলেন। রক্তের স্রোত বেরিয়ে এল। মিগুয়েল কারিলো পালিয়ে গেল। মনে আতঙ্ক জেগেছে। খুব তাড়া তাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে। সে আভিলার দিকে চলে গেল। কর্নেল আকোকা কনভেন্ট আক্রমণ করেছেন, এই খবরটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। সে এই খবরটা পেয়েছিল। এখন ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিল। ভাগ্যই তাকে ওই চারজন পলাতকা যাজিকার সামনে নিয়ে এসেছে।

এখন তাকে অনুমানের ওপর ভর করে হাঁটতে হবে। ইতিমধ্যেই সে ওই চার সন্ন্যাসিনীর নগ্ন দেহ দেখে ফেলেছে। এখন কী হবে? কর্নেল আকোকা এবং তার আততায়ীরা নিশ্চয়ই কুকুরের মতো খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। এই চার মহিলাকে কর্নেল আকোকার হাতে তুলে দিতে হবে। তাহলে? কত টাকা পাওয়া যেতে পারে?

ছিঁচকে চোর মনে মনে একটা হিসাব করছিল। একমাত্র লুসিয়াই পোশাক পরিহিতা, বাকি তিনজন তখনও পর্যন্ত নতুন পোশাকে শরীর ঢাকতে পারেননি। তারা নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কারিলো নীচু চোখে সব কিছু দেখে নিল। ভাবল, নতুন এই পোশাকে তাদের কেমন দেখাবে? একটু বাদেই তাদের পোশাক পরা শেষ হয়ে গেল। তারা বোম লাগিয়ে দিলেন। ক্লিপ আটকে দিলেন। খুব তাড়াতাড়ি তাদের বাইরে আসতে হবে।

সময় এগিয়ে চলেছে। কারিলো ভাবল, সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। দোকানে পৌঁছে গেল। সিস্টারদের সামনে গিয়ে তাকাল। বলল ভারী সুন্দর হয়েছে। এই পৃথিবীর কেউ। আপনাদের আর যাজিকা বলে চিনতে পারবে না। মাথার ওপর স্কার্ফ লাগিয়ে নিলে ভালো হয়। সে সকলের জন্য আলাদা স্কার্ফ বের করল। চারজন সিস্টার মাথায় স্কার্ফ পরে নিলেন।

এবার মিগুয়েল কারিলো তার পথ ঠিক করল। গ্রাসিলাকে প্রথমে নিয়ে যেতে হবে। তিনি হলেন অত্যন্ত রূপবতী এক কন্যা। এমন রূপসী নারীর সাথে মিগুয়েল-এর আগে দেখা হয়নি। আহা, রক্ত মাংসের এই শরীর। ঈশ্বরের নামে একে নষ্ট করে কী লাভ? আমি মেয়েটিকে দেখাব, কীভাবে জীবনে আনন্দ পেতে হয়।

সে লুসিয়া, থেরেসা আর মেগানকে বলল মনে হচ্ছে, আপনারা সকলেই খুব ক্ষুধার্ত। আমরা একটা কাফেতে যেতে চাইছি। আপনারা তিনজন সেখানে গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করুন। আমি চার্চে যাব। যাজকের কাছ থেকে কিছু টাকা ভিক্ষে করব, যাতে আমাদের খাবারের সংস্থান হয়।

তারপর সে গ্রাসিলার দিকে তাকিয়ে বলল–সিস্টার, অনুগ্রহ করে আপনি আমার সঙ্গে যাবেন কি? আপনি গেলে কনভেন্টের ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝিয়ে বলা যেতে পারে। আপনার কথা শুনে হয়তো পাদরি সাহেব খুশি হবেন। আমার মুখ থেকে এসব কথা শুনলে উনি রাজী হবেন না।

-ঠিক আছে।

কারিলো অন্যদের বলল আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমার মনে হয়, আপনারা পেছনের দরজাটা ব্যবহার করতে পারেন।

সে লুসিয়া, থেরেসা এবং মেগানের দিকে তাকাল তিন সিস্টার শান্ত মনে এগিয়ে চলেছেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এবার সে গ্রাসিলার দিকে তাকাল। আহা, এমন রূপ যৌবন, সে ভাবল, মেয়েটিকে আমার রক্ষিতা করে রাখলে কেমন হয়? মাঝে মধ্যে ভাঙিয়ে খাব। ভবিষ্যতে সে হয়তো আমার পরম উপকারী বস্তু হয়ে দাঁড়াবে।

গ্রাসিলা তার দিকে তাকিয়ে বললেন আমি প্রস্তুত।

না, এখনও পোশাক সম্পূর্ণ হয়নি। কারিলো অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সিস্টারকে নিরীক্ষণ করল। না, এই পোশাকটা আপনাকে ঠিক মানাচ্ছে না। এটা খুলে ফেলতে হবে।

-কেন কী হয়েছে?

–এটা আপনার গায়ে ঢলঢল করছে। যে কোনো লোক দেখলেই বুঝতে পারবে। কারিলো চিন্তা করে বলল, আমার মনে হচ্ছে আপনি এই পোশাক পরে লোকের মনে অহেতুক সন্দেহের সৃষ্টি করবেন।

গ্রাসিলা ইতস্তত করছিলেন। তারপর একটা র‍্যাকের পাশে চলে গেলেন।

তাড়াতাড়ি, সময় কিন্তু ক্রমশ কমে আসছে।

গ্রাসিলা পোশাক খুললেন। প্যান্টি এবং ব্রেসিয়ার পরা। ঠিক তখন কারিলো সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।

সব কিছু খুলতে হবে, কণ্ঠস্বরের মধ্যে জেগেছে ব্যক্তিত্ব।

গ্রাসিলা তার দিকে তাকালেন কী বলছেন? গ্রাসিলা আর্তনাদ করে উঠলেন –না না, আমাকে এভাবে বাধ্য হতে বলবেন না।

কারিলো ক্রমশ আরও কাছে এগিয়ে এসেছে সিস্টার, আমি কি আপনাকে সাহায্য করব?

হাত আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত দ্রুত সে ব্রেসিয়ার খুলে দিল। প্যান্টি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিল।

না, আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। এটা আপনি করতে পারেন না। আপনি চলে যান।

কারিলো চিৎকার করছে– শুরু হবে, এখনই শুরু হবে। এটাকে ভালোবাসতেই হবে।

তারপর? দুটি সবল বাহু সামনের দিকে এগিয়ে আসে। আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। গ্রাসিলাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। উন্মত্ত পশুর মতো কারিলো তার পোশাক খুলতে ব্যস্ত এখন।

গ্রাসিলার মনে এখন কী চিন্তা? মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে, এক মুর বোধ হয় তাকে অপমান করছে। মৃত্যুর ঘণ্টা তিনি শুনতে পাচ্ছেন। তার মায়ের আর্তনাদ ভেসে উঠছে।

গ্রাসিলা ভাবলেন না, আর নয়, কিন্তু কে শোনে কার কথা?

তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ওই নরদস্যুর সাথে লড়াই করতে। এই লড়াইতে তিনি কি জয়যুক্ত হবেন? পারছেন না। আবার সেই আর্ত চিৎকার।

কারিলো চিৎকার করে বলল শয়তান, তুই কতক্ষণ এভাবে আমার সঙ্গে লড়াই করবি?

চড়ের আঘাত, গালের ওপর। গ্রাসিলা পেছন ফিরে পড়ে গেলেন। অবাক হয়ে গেছেন তিনি।

বুঝতে পারলেন, তাঁকে সময়ের সাথে তাল রেখে চলতেই হবে।

তখন? তখন চারদিকে শুধুই অন্ধকার।