১. ফরাসী অভিনেত্রী

দ্য আদারসাইড অফ মিডনাইট (মধ্যরাতের ওপারে)
সিডনি সেলডন

এক অসামান্যা রূপবতী ফরাসী অভিনেত্রী। সারা জীবন যে বাসানার জন্য তাড়িত হয়েছিল, অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খ তাকে প্যারিসের রঙ্গমঞ্চ থেকে এক কোটিপতির বেডরুমে। নিয়ে যায়। ওই ভদ্রলোক হলেন বিশিষ্ট গ্রিক ব্যবসায়ী, যিনি কখনও অপমান ভুলতে পারেন না, আঘাতের প্রত্যাঘাত করেন, এরই পাশাপাশি আর এক যুদ্ধফেরত যুবাপুরুষ, চরিত্রের দিক থেকে বিচিত্র স্বভাবের।

প্যারিস থেকে ওয়াশিংটন, হলিউড থেকে গ্রিসের দ্বীপপুঞ্জ, দি আদারসাইড অফ মিডনাইট, অথবা মধ্যরাতের ওপারে, এইভাবে চারজন প্রতিপত্তিশালী মানুষের গল্প শুনিয়েছে। যার মধ্যে আছে আবেগের ঝংকার, প্রতিশোধের স্পৃহা এবং শেষ না হওয়া ভালোবাসার কাহিনী।

সিডনি সেলডন আরও একবার প্রমাণ করেছেন, কেন তাকে এ যুগের সবথেকে জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত সাহিত্যিক বলা হয়।

.

ভূমিকা

এথেন্স, ১৯৪৭।

ঘষা জানালা দিয়ে পুলিশ চিফ জর্জিয়াস তাকিয়ে ছিলেন অফিস বাড়িগুলির দিকে। এথেন্সের ডাউন টাউন, চারপাশ কেমন যেন শান্ত সমাহিত।

তিনি ভাবলেন, আগস্টের এই তপ্ত দহন জ্বালা, তাই বোধহয় পথঘাটে লোকজন কম।

বারোটা বেজে দশ মিনিট, রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। দু-একজন ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলেছে। তার গন্তব্য এথেন্স শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এয়ারপোর্ট। অন্য সময় হলে তিনি হয়তো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে থাকতেন। এই দগ্ধ দাবদাহে কাজ করত তার অধীনস্থ কর্মচারীরা। এখন কিন্তু অবস্থাটা একেবারে অন্যরকম। তাই জর্জিয়াস সকোরিকে বেরোতে হয়েছে।

কেন? পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অনেক বিখ্যাত মানুষ উড়ানপাখির সওয়ার হয়ে এথেন্স এয়ারপোর্টে নামছেন। কাস্টমস বিভাগের ঝামেলা আছে। যথাসম্ভব সহজে তা পালন করতে হবে।

আর একটি কথাও মনে রাখতে হবে। এয়ারপোর্টে এখন বিশ্বের নানা প্রান্তের সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রিদের সমারোহ। সকোরি বোকা নন, তিনি জানেন এখন তাকে সব দিক ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হবে।

এই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি দুজন মহিলার সঙ্গে কথা বলেছেন–একজন তার স্ত্রী, অন্যজন তার রক্ষিতা। তার স্ত্রী অ্যানা, মধ্যবয়সিনী, সুরূপা, চেহারায় গ্রাম্যতার ছাপ, অশিক্ষিত, বলেছেন, এয়ারপোর্টে তাকে সম্মানজনক দূরত্বে থাকতে। তা হলে কোনো ঝামেলার দায় পেপাহাতে হবে না।

কিন্তু ওই অসামান্যা রূপসী রক্ষিতা মেলিনা, বলেছে, তাকে এয়ারপোর্টে গিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। এই ব্যাপারটা সকোরিকে আন্তর্জাতিক পরিচিত এনে দেবে।

ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে সকোরি শেষ পর্যন্ত হাজির হতে চলেছেন এয়ারপোর্টে বলা যায় না, এই ঘটনাই হয়তো হয়তো তার ভাগ্যোন্নতির সহায়ক হবে।

আসল ব্যাপারটা কী? এটাই বোধহয় ভাগ্যের চরম পরিহাস, মেলিনা তার স্ত্রী এবং অ্যানা তাঁর উপপত্নী? ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

সকোরির মাথায় অনেক চিন্তা। বারোজন সশস্ত্র সঙ্গীকে নেওয়া হয়েছে। চারদিকে এখন সাজ-সাজ রব পড়ে গেছে। সকোরিকে ছ-ছবার ইন্টারভিউ করা হয়েছে। ছটি বিভিন্ন ভাষায়- জার্মান, ইংরাজি, জাপানি, ফরাসি, ইতালিয় এবং রাশিয়ান ভাষায় কথা অনুবাদ করা হয়েছে। আহা, এই নতুন জীবন, এই উন্মাদনা, এর কোনো তুলনা আছে কি?

গাড়ি এগিয়ে চলেছে এভিনিউ দিয়ে, দূরে সমুদ্র দেখা গেল। হঠাৎ সকোরির মনে হল পেটের ভেতর কেমন গোলমাল। মাত্র পাঁচ মিনিট, তার পরেই এয়ারপোর্ট, তিনি শেষবারের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিলেন। আজ রাতেই তাদের এথেন্সে শুভ পদার্পণ পড়বে।

.

আরমান্দ গটিয়ার বিমানে উঠলে শরীর খারাপ লাগে তার। মনে হয় তিনি বোধহয় বিমান থেকে পড়ে যাবেন। কিন্তু কেন? বাইশ বছর বয়সে তিনি ফরাসি জগতের মুভি ইনডাসট্রিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তারপর থিয়েটারের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। এখন তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা পরিচালকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কুড়ি মিনিট আগে পর্যন্ত এটা ছিল এক আরামদায়ক উড়ান। অনেকেই তাকে চিনতে পেরেছেন। এয়ার হোস্টেসরা সাধ্য মতো যত্নের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

সহযাত্রীদের অনেকে গায়ে পড়ে আলাপ করেছেন। ওই বিখ্যাত ডিরেক্টরের মনে একটি মুখ আঁকা হয়েছে। সে হল এক রূপসী ব্রিটিশ তনয়া, অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যানে কলেজের ছাত্রী। সে থিয়েটারের ওপর একটা থিসিস লিখছে। কী আশ্চর্য, আরমান্দ গটিয়ারকে নিয়ে দুজনের কথাবার্তার মধ্যে নোয়েলে পেজের নাম উঠেছিল।

মেয়েটি বলল আপনিই তো নোয়েলের পরিচালক? ব্যাপারটা কি বুঝিয়ে বলবেন? ট্রায়ালটা কেন হচ্ছে?

গটিয়ারের মনে হল, তিনি বোধহয় সিট থেকে পড়ে যাবেন। নোয়েলের কথা মনে, পড়লেই কেমন একটা যন্ত্রণা। গটিয়ার নোয়েলের গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটা শুনেছিলেন তিনমাস আগে। তারপর এ ব্যাপারটা ভুলে গেছেন। তখন চিঠি লিখেছিলেন। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। উত্তর আসেনি। ট্রায়ালে যোগ দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। কিন্তু তিনি জানেন, সংবাদমাধ্যম তাকে এই ব্যাপারের সঙ্গে জড়াবার চেষ্টা করবে।

পাইলটের ধাতব কণ্ঠস্বর ইন্টারকম মারফত শোনা গেল। তিন মিনিটের মধ্যে বিমানটি এথেন্স এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে। আহা, নোয়েলের সঙ্গে আবার দেখা হবে কি? আরমান্দ গটিয়ার তার শারীরিক অসুস্থতার কথা ভুলে গেলেন।

কেপটাউন থেকে এথেন্সে উড়ে আসছেন ডঃ ইসরায়েল কাটজ। তিনি এক বিশিষ্ট নিওরো সার্জেন। বিরাট হাসপাতালের একচ্ছত্র অধিপতি। তাকে এই ব্যাপারে অন্যতম সেরা গবেষক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তিনি একটি বি. ও এ সি বিমানে বসে আছেন। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। মুখের মধ্যে সাহস এবং বুদ্ধির ছাপ। চোখের তারা গভীর বাদামি। হাত দুটো উত্তেজনায় কাঁপছে। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, তিনি বেশ ক্লান্ত। ডান পায়ে একটু একটু ব্যথা হচ্ছে। ছ-বছর আগে তাঁর একটি পা বাদ দিতে হয়েছিল। তাই বোধহয় যন্ত্রণা!

বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর মিটিং আছে। তাই তাকে এখানে আসতে হয়েছে।

এর পাশাপাশি আর একটি বিষয়– নোয়েলে পেজের ঘটনা। বউ এসথার বারণ করেছিলেন। ইসরায়েল শোনেননি। এক কথার মানুষ।

প্লেনটা কি দুলতে শুরু করেছে? ভালো লাগছে না। কে এই হত্যার অন্তরালে? উড়ান পাখি এবার এগিয়ে চলেছে তার নির্দিষ্ট গন্তব্য পথের দিকে। তখনই ডাক্তারের মনে পড়ল প্যারিসের একটি মারাত্মক হত্যার ঘটনা।

.

ফিলিপ্পে সোরেল তার ইয়াটের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখছেন পাইরেসের বন্দর ধীরে ধীরে কাছে আসছে। আহা, এই অসাধারণ সমুদ্র অভিযান, ফ্যানেদের কাছ থেকে কিছুদিন দূরে থাকার প্রয়াস। সোরেলকে এক বিখ্যাত অভিনেতা বলা হয়। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছেন। বক্সারের মতো মুখ। যে বক্সার অন্তত ছটা খেলায় হেরে গেছেন। নাকটা কয়েকবার ভেঙে গেছে। চুল পাতলা, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। এসব কিছুই মনে হয় না। কারণ ফিলিপ্পে সোরেলের আছে অসম্ভব যৌন আবেদন। শিক্ষিত, স্বল্পভাষী, সুভদ্র এবং সুপরিচিত।

নোয়েলের বিচার, তাকেও আসতে হবে। তিনি জানেন, নোয়েলের সঙ্গে আবার দেখা হবে। কী হয়েছে? কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

.

ধীরে ধীরে প্রমোদ তরণী গ্রিসের উপকূলের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্যান আমেরিকান ক্লিপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বসে আছেন। বিমান এখন এথেন্স এয়ারপোর্টের ১৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করছে। উনি উইলিয়াম ফ্রেসার, বছর পঞ্চাশ বয়স। মাথার চুল ধূসর, মুখটা অদ্ভুত। বোঝা যায় ব্যক্তিত্বের প্রতীক। হাতে একটা ব্রিফ, এখনও পর্যন্ত একটি পাতাও ওলটান নি। উনি জানেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ দারুণ পরিশ্রমের মধ্যে কাটবে। দূরে গ্রিসের উপকূল দেখা যাচ্ছে কি?

.

 অগসটে ল্যাঙ্কন– তিনদিন ধরে দারুণ অসুস্থ। নৌকো ভ্রমণ, ভালো লাগে না। মারসেইল-এর দিকে যাত্রা, তারপর ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া। অগসটে ল্যাঙ্কন, বছর ষাট বয়স, মাথায় টাক পড়তে শুরু হয়েছে। চোখ দুটো কুতকুতে, ঠোঁট পাতলা, সব সময় সস্তার সিগার ঝুলছে। মারসেইলে একটা ড্রেসশপের মালিক। আরও কত কী? কিন্তু এত খরচ? না, এটা কি শুধু ছুটি কাটাতে যাওয়া?

তা কেমন করে হবে? কতদিন বাদে প্রিয়বান্ধবী নোয়েলেকে দেখতে পাবেন। ছাড়াছাড়ির পর কত বছর কেটে গেল।

নোয়েলে যখন প্রথম অভিনয়ে এসেছিল, তখন কী ঘটেছিল? উনি পাগলের মতো নোয়েলের চলচ্চিত্র দেখতেন, বারবার। এভাবেই ভালোবাসা, হ্যাঁ, এই ভ্রমণটা যথেষ্ট খরচের। অগসটে ল্যাঙ্কন জানেন, তাকে খরচটা করতেই হবে। পুরোনো দিনের স্মৃতি এত সহজে কি ভোলা যায়?

শুধু একটা চিন্তা, স্ত্রী কি আমার এই গোপন অভিসারের খবর জানতে পারবে?

.

এথেন্স শহর, ফ্রেডরিক স্ট্যাভরস কাজ করছেন তার ল অফিসে। পুরোনো দিনের বাড়ি, শহরের প্রাণকেন্দ্রে। একা তাকে অনেক কাজ করতে হয়। তিনি সহকারী রাখতে পারেন নি। ভদ্রলোক শান্ত স্বভাবের। জয়কে ছিনিয়ে নেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন? এলেনাকে বিয়ে করা সম্ভব কি? পারিবারিক জীবন? ভালো অফিস, বিখ্যাত ক্লাবের সদস্যপদ। না, ঘটনা কি ঘটতে শুরু করেছে? এখন তাকে অনেকে কি চিনতে পারে?

তিনি হলেন ল্যারি ডগলাসের বিপক্ষের এক আইনবিদ। এভাবেই হয়তো জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছে। নোয়েলে পেজের পক্ষ সমর্থন করতে পারলেই খুশি হতেন। তার বদলে ল্যারি ডগলাস? কখন যে কী হয়ে যায়। যদি নোয়েলে পেজকে নিরপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়? ল্যারি ডগলাসকে শাস্তি দেওয়া হয়? তাহলে কী হবে? স্ট্যাভরস কেঁপে উঠলেন। তা হলে? না, বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

নেপোলিয়ান ছোটাস, নোয়েলের হয়ে মামলা লড়ছেন। পৃথিবীতে তার মতো চতুর ক্রিমিন্যাল লইয়ার আর একজনও নেই। ছোটাস আজ পর্যন্ত কোনো লড়াইতে হারেন নি। তার কথা মনে হল, ফ্রেডরিক স্ট্যাভরসের মুখে হাসি। যাক, নেপোলিয়ান ছোটাসকে হারাতে হবে, দাঁতে দাঁত চেপে ছোট্ট একটি প্রতিজ্ঞা।

.

ফ্রেডরিক স্ট্যাভরস তার ছোট্ট ল অফিসে বসে আছেন। নেপোলিয়ান ছোটাস তখন একটা ডিনার পার্টিতে উপস্থিত হয়েছেন। এথেন্সের কোনো এক অভিজাত অঞ্চলে। ছোটাস, নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে ভালোবাসেন। তবে এখন আসন্ন বিচার সম্পর্কেই বেশি চিন্তিত। এই নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা চলেছে।

কেউ জানতে চাইলেন– নোয়েলে পেজ সম্পর্কে আপনার অভিমত?

 ছোটাস বললেন– ভদ্রমহিলা সত্যিই অসাধারণ রূপসী এবং বুদ্ধিমতী।

না, আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নোয়েলে পেজের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ।, কোনো মক্কেলের সাথে আমি কখনও আবেগের সম্পর্ক স্থাপন করব না। দেখা যাক, কী হয়!

মনে পড়ল, একটি নাম, কার ফোন? বাটলারের হাতে রিসিভার কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস!

.

হেলিকপ্টার অথবা প্রমোদ তরণী, এছাড়া ওই দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করা অসুবিধা। এয়ারফিল্ড আছে, আছে ব্যক্তিগত বন্দর, সারাদিন সশস্ত্র প্রহরীরা পাহারা দেয়। সঙ্গে থাকে জার্মান দেশের কুখ্যাত শেফার্ড কুকুরের দল। এটা হল কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য। আমন্ত্রণ ছাড়া কেউ এখানে প্রবেশের ছাড়পত্র পায় না। অনেক দিন ধরেই তিনি এটি বানিয়েছেন। বিশ্বের নানা দেশের রাজা এবং রানিরা এসেছেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিরা, চলচ্চিত্রের অভিনেতা, অপেরার গায়ক-গায়িকা, বিখ্যাত লেখক এবং শিল্পীরা, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তারা এসেছেন। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি বলা হয়। তিনি হলেন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মানুষ। তিনি জানেন, কীভাবে অর্থ খরচ করতে হয়, জীবনকে উপভোগ করতে হয়।

তিনি তার সুন্দর সাজানো লাইব্রেরিতে বসে আছেন, আর্মচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন।

ঠোঁটে ঝুলছে মিশরের সিগারেট, তার জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা। প্রেস অনেকদিন ধরে তার সঙ্গে কথা বলতে উদগ্রীব। তিনি নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন।

নোয়েলের সম্পর্কে চিন্তা? বন্দীশালায় কেমন আছে মেয়েটি, ঘুমিয়ে, নাকি জেগে? ক্লান্ত, নাকি পরিশ্রান্ত?

নেপোলিয়ান ছোটাসের সঙ্গে শেষ আলোচনা, মনে পড়ে গেল। ছোটাসের ওপর নির্ভর করা যায় কি? না, ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। দেখাই যাক কী লেখা আছে।

.

প্রথম পর্ব

ক্যাথারিন, শিকাগো, ১৯১৯-১৯৩৯

০১.

প্রত্যেক বড়ো শহরের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এমন এক ব্যক্তিত্ব যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। বিশ শতকের শিকাগো, এক বিশাল ঘুমন্ত দৈত্য। অশিক্ষিত, বর্বর। এই শহর থেকে কত, মানুষের জন্ম হয়েছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার এই শহরই মস্তানদের জন্মদাতা। কত নাম করা যায়?

ক্যাথারিন আলেকজান্ডারের অনেক স্মৃতি। বাবা তাকে নিয়ে একটা বারে ঢুকছেন। হালকা আলো জ্বলছে, উঁচু, উঁচু টুল। বাবা বিয়ারের অর্ডার দিলেন। আর মেয়েটির জন্য গ্রিনরিভার, বয়স তখন পাঁচ, বাবার গর্বিত মুখ। অনেকেই তার রূপের প্রশংসা করছেন। তারপর, ছোটো ছোটো স্মৃতির উৎসার।

বাবাকে নানা কাজে বাইরে থাকতে হয়। তিনি একজন সেলসম্যান। কাজের চাপ বড্ড বেশি।

ক্যাথারিনের যখন সাত বছর বয়স, বাবাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। জীবনটা পাল্টে গেল। শিকাগো থেকে ইন্ডিয়ানার গ্যারিতে চলে আসা। জুয়েলারির দোকানে বাবা তখন যোগ দিয়েছেন। ক্যাথারিন প্রথম স্কুলে ভরতি হল। অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে আলাপ পরিচয় হল। তখন থেকেই ক্যাথারিন নিজস্ব জগতের বাসিন্দা।

কয়েক বছর ধরে ক্যাথারিন উদাসীনতার মধ্যে সময় কাটিয়েছিল। অদ্ভুত একটা জীবন। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।

 বই পড়াকে সে মোটেই পছন্দ করত না। বয়স হল চোদ্দো, শরীরটা তখন পরিপূর্ণ যুবতীর মতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নাতে নগ্ন দেহের প্রতিফলন দেখত সে। আহা, গোলাপ কুঁড়ি বুঝি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। অনেকেই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অনেক পুরুষ গায়ে পড়ে ভাব করতে চাইছে। কিন্তু ক্যাথারিন? নিজের সম্বন্ধে সচেতন।

আগামী গ্রীষ্ম, ক্যাথারিন পঞ্চদশী, অনেক কথাই জেনে গেছে সে। আয়নার সামনে। দাঁড়িয়ে শরীরের দিকে তাকাচ্ছে।

শিকাগো থেকে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট, রজারস পার্কে, সস্তার ভাড়া। দেশ জুড়ে অথনৈতিক সংকট, দিন চালানো মুশকিল। ক্যাথারিন আরও রূপসী, আরও বুদ্ধিমতী।

একদিন সে আবিষ্কার করল টমাস উলফেকে, তার বই? আনন্দিত? জীবনের প্রতি ভালোবাসা।

ক্যাথারিন এল নতুন হাই স্কুলে। আয়নার সাথে কথা বলল। চুল এখন দাঁড়কাকের মতো কালো, গায়ের চামড়া কোমল, মনে হয় কেউ যেন ক্রিম মাখিয়ে দিয়েছে। চেহারাটা চমৎকার, মুখখানা আবেদনি। চোখের তারা কিছু বলতে চাইছে।

এল মন্দা, জীবন আরও দুর্বিসহ, বাবাকে নানা কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। কোনো কাজেই তিনি সফল হতে পারছেন না। এখন কী করা যায়?

ছোটো ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করলেন। র‍্যালফ, বলা হল, যথাসময়ে টাকা ফেরত দিতে হবে।

শুরু হল বিপর্যয়। এখন কী হবে?

ইতিমধ্যে ক্যাথারিন এক পরিপূর্ণা তরুণী। টনি কোরম্যান যোগ দিল ল ফার্মে। ক্যাথারিনের থেকে লম্বায় অন্তত এক ফুট ছোটো। ভালোবাসার বিনিময়। চোখের তারায় সজল অভিব্যক্তি।

আর একজন ডিন ম্যাকডরমট। মোটা এবং বোকা। দাঁতের ডাক্তার হতে চেয়েছিল। এবার রন পিটারসন। না, তাকে কোন্ দলভুক্ত করা যেতে পারে। রন ভালো ফুটবল খেলত। অনেকে ভেবেছিল ভবিষ্যতে সে খেলোয়াড় হবে। লম্বা, চওড়া কাঁধ। ম্যাটিনি আইডলের মতো চেহারা। স্কুলে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

ক্যাথারিন হয়তো রনকেই ভালোবাসত, কিন্তু এর মাঝে কিছু ঘটে গেল কি? না, ক্যাথারিন ভাবতে থাকে, অসহায়ভাবে।

.

আর্থিক সমস্যা আরও ঘণীভূত হচ্ছে। তিনমাসের বাড়ি ভাড়া বাকি আছে। কেন তাড়িয়ে, দেওয়া হচ্ছে না? বাড়িউলিকে ক্যাথারিনের বাবা খুবই ভালোবাসেন। মাঝে মধ্যে গোপন সম্পর্ক। ক্যাথারিনের মনে উদাসি ভাবনা- আহা, কী করে এই সমস্যার সমাধান হবে।

শেষ পর্যন্ত ক্যাথারিন ভেবেছিল, স্বপ্ন দেখে লাভ কি? যে স্বপ্ন সফল হবে না।

এপ্রিল, ক্যাথারিনের মা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। মৃত্যুর সাথে ক্যাথারিনের প্রথম মোলাকাত। বন্ধুরা এল, আত্মীয় স্বজনেরা, ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে, শোক জ্ঞাপন করল। তারপর? চোখের জল।

এবার কী হবে? ক্যাথারিনের মনে চিন্তা। কিছু একটা করতে হবে। কী করা যায়? কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। জীবিকা উপার্জন?

সব কাজ হয়ে গেল। কাকা র‍্যালফ এলেন, ক্যাথারিনের সঙ্গে কথা বলতে চান।

-আমি জানি, তোমাদের আর্থিক অবস্থা কী শোচনীয়। র‍্যালফ দাদাকে বললেন, তুমি স্বপ্ন দেখেই দিন কাটালে। আমি তো তোমাকে ডুবতে দিতে পারছি না। পউলিন আর

আমি এ নিয়ে কথা বলেছি। তুমি কি আমার হয়ে কাজ করবে?

-ওমাহাতে?

-হ্যাঁ, থাকা পরার অভাব হবে না। ক্যাথারিনকেও আনতে পারো আমাদের একটা বড়ো বাড়ি আছে।

ওমাহা! ক্যাথারিন ভাবল, সব স্বপ্নের অবশেষ।

 বাবা বলেছিলেন- একটু ভেবে দেখি।

কাকা র‍্যালফ বললেন- ছটার ট্রেন ধরব, যাবার আগে জানতে হবে তো?

ক্যাথারিন এবং বাবা, একা। বাবার আর্তনাদ- ওমাহা? না, ওখানে একটা সুন্দর সেলুন পর্যন্ত নেই।

কিন্তু ক্যাথারিন? বিকল্প কোনো কিছু হাতে আছে কি? ক্যাথারিন ভাবল, জীবন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখন আমাকে ডানা ভাঙা পাখি হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

পরদিন সকালবেলা ক্যাথারিন তার প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করল। বলল, আমি ওমাহাতে চলে যাচ্ছি। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট লাগবে।

ভদ্রমহিলা বলেছিলেন– ক্যাথারিন, তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা। তুমি নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির ফুল স্কলারশিপ পেয়েছ।

সমস্ত রাত ধরে আলোচনা। ঠিক করা হল, বাবা চলে যাবেন ওমাহাতে, ক্যাথারিন নর্থওয়েস্টার্নে। ডরমিটরিতে থাকবে, ক্যাম্পাসে, দশদিন কেটে গেছে, লাস্টটালেস স্ট্রিট স্টেশন, সিঅফের ঘটনা। ক্যাথারিন এখন একেবারে একা। চারপাশে বিপদের পরিমণ্ডল। পাশাপাশি উত্তেজনা। নিজস্ব জীবন। জীবনে এই প্রথম। ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার শরীরটা ক্রমশ দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। শেষবারের মতো তাকাল সে। আহা, এক সুন্দর সুপুরুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, একদিন তিনি বিশ্বের সম্রাট হবেন।

স্টেশন থেকে ক্যাথারিন একা ফিরছে। ওমাহা, না, জীবনটা কি একেবারে শেষ হয়ে গেল?

.

নর্থ ওয়েস্টার্ন, অসামান্য উত্তেজনা। ক্যাথারিনের কাছে এই স্কলারশিপের মূল্য অপরিসীম। সে ভাবতেই পারেনি, জীবনটা তার এভাবে পাল্টে যাবে।

সেখানে কতজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব। ক্যাথারিন ঠিক করল, সকলের সাথেই ভালোভাবে মিশবে সে। কাজ নিল, এক স্যান্ডউইচের দোকানে ক্যাটসা পদে। প্রতি সপ্তাহে পনেরো ডলার। আহা, খুব একটা খরচ হয়তো করতে পারবে না। কিন্তু বই? আরও অন্যান্য জিনিস? সবই পাবে সে?

কিছুদিন কেটে গেছে, ক্যাথারিন বুঝতে পারল, ক্যাম্পাসে সে-ই একমাত্র অস্পর্শিতা কুমারি। এভাবেই সে বড়ো হয়েছে। গুরুজনরা যৌন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। দু-একটা শব্দ তার কানে গেছে। আর এখানে? পরিস্থিতিটা একেবারে অন্যরকম। যারা পড়াশুনা করে, তারা শুধু যৌনতা নিয়ে আলোচনা করে। ডরমিটরিতে, ক্লাসঘরে, ওয়াশরুমে। সর্বত্র, এত সহজে তারা এটা বলে, ক্যাথারিনের গা ঘিন ঘিন করে। সে ভাবতেই পারে না, কত সাহসী এরা।

.

ক্যাথারিন ভাবল, এইসব শব্দগুলো অশ্লীল। প্রত্যেক শব্দকে না শোনার ভান করত সে। এটা কি এক ধরনের আত্মাভিমান? মেয়েরা অনায়াসে তাদের যৌন বিপর্যয়ের কথা বলছে। ক্যাথারিন স্বপ্ন দেখত– একটি ছেলের সাথে শুয়ে আছে। বুনো প্রেমে মাতোয়ারা। ক্রমশ একটা অনুভূতি। নিজের হাতে নিজেকে সুখ দেবার চেষ্টা, আঘাত করার পরিকল্পনা। হায় ঈশ্বর, আমি কি কুমারী অবস্থাতেই মারা যাব নাকি? এই নরকের অন্ধকারে?

যে নামটা মেয়েদের কথাবার্তার মধ্যে বারবার ঘুরত– সে হল রন পিটারসন। অ্যাথলেটিক স্কলারশিপ নিয়ে এখানে এসেছে। এর মধ্যেই যথেষ্ট জনপ্রিয়, তাকে ক্লাস প্রেসিডেন্ট করা হল। ল্যাটিন ক্লাসে তার সঙ্গে ক্যাথারিনের দেখা হল। হ্যাঁ, দেখার মতো চেহারা।

দুজনে কথা, এইভাবে? নাকি সবটাই কল্পনা।

ক্যাথারিন আলেকজান্ডার?

–হ্যালো রন।

 তুমি কি এই ক্লাসের ছাত্রী?

–ইয়েস।

আমার সাথে ব্রেকে আসবে?

–কেন?

-কেন? আমি ল্যাটিনের কিছুই জানি না। তুমি তো এই ব্যাপারে জিনিয়াস। আমরা ভারী সুন্দর গান বাজাব। আজ রাতে কী করছ?

কিছুই না, আমরা কি একসঙ্গে পড়ব?

–বিচের ধারে চলে এসো, আমরা একা থাকব। পড়াশোনা যখন খুশি হতে পারে।

এসবই ক্যাথারিনের ভাবনা, রন ক্যাথারিনের দিকে তাকাল। নাম জানার চেষ্টা করল। ক্যাথারিন নামটা বোধহয় ভুলে গেছে– কাঁপতে কাঁপতে বলল– ক্যাথারিন, ক্যাথারিন আলেকজান্ডার।

জায়গাটা কেমন? ফ্যানট্যাসটিক, তাই তো?

ক্যাথারিনের উন্মাদনা, কিছু বলার চেষ্টা।

সোনালি চুলের এক ছাত্রী। ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করছে। এক মুখ হাসি। তারপর? রন হারিয়ে গেল।

সিন্ডেরালার গল্প এখানেই শেষ। ক্যাথারিন ভাবল, এরপর? তারা সুখে শান্তিতে সংসার জীবন যাপন করল। সেই বোকা কথা, তাই তো?

তখন থেকে মাঝে মধ্যেই ক্যাথারিন রনকে দেখতে পেত। নানা মেয়েকে নিয়ে অহংকারের ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে। একজন-দুজন-তিনজন। হায় ঈশ্বর, ছেলেটা কি কোনো ব্যাপারে ক্লান্ত হয় না? একদিন ক্যাথারিন স্বপ্ন দেখল, রন এসে তার কাছে ল্যাটিনের ব্যাপারে জানতে চাইছে। কিন্তু রন কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলেনি। অর্থাৎ স্বপ্নটা সত্যি হয়নি।

রাতের বেলা, ক্যাথারিন একাকিনী শয্যায় শুয়ে আছে। অন্য মেয়েদের কথা ভাবছে। তারা চিৎকার করে বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে আলোচনা করছে। কেউ তো আমার সঙ্গে দেখা করছে না। মনে মনে সে নিজেকে নগ্নিকা করল। আহা, রনের শরীর থেকে একটি একটি করে পোশাক খুলে নিচ্ছে। যেমনটি সে পড়েছে রোমান্টিক উপন্যাসে। প্রথমে শার্ট, তার হাত খেলা করছে বুকের ওপর। এবার ট্রাউজার্সের জিপে হাত রেখেছে। শর্টসটাও খুলে দিল। আহা, দুজনে দুজনকে আদর করছে। এই সময় ক্যাথারিনের ভাবনা ভেঙে যেত। সে আবার ছটফট করত। মুখ দিয়ে আর্তনাদ আমি বোকা, আমি কি ফ্যানটাসি নিয়ে বেঁচে থাকব? না, আমাকে বোধহয় এক কনভেন্টে চলে যেতে হবে। ওই যাজিকারা কি এমন যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করে? তারা কি আত্মরতিতে মেতে ওঠে? নাকি এটা মহাপাপ। হঠাৎ ক্যাথারিন ভাবল, ধর্মযাজকরা? তারা কি কখনও সঙ্গমে অংশ নিয়েছেন?

আহা, এই সুন্দর শহর, রোমের পাশের ছোট্ট একটি অঞ্চল। সূর্যদীপ্ত জল, কবেকার পুকুর, কে জানে? একজন যাজক প্রবেশ করলেন। তার পরনে আলখাল্লা। তিনি রনের মতো দেখতে। তিনি বললেন- কে তুমি?

ক্যাথারিন কিছু বলার চেষ্টা করেছিল।

উনি বললেন- তোমাকে আমি স্বাগত সম্ভাষণ জানাচ্ছি।

 বাকিটুকু? বাকিটুকু কি লেখা আছে?

 ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন, তার চোখে একটা অদ্ভুত দ্যুতি।

ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে। ক্যাথারিন বলল–এ কী? আপনি আমাকে আলিঙ্গন করছেন কেন? আপনি তো একজন ধর্মযাজক?

উনি হাসলেন, উনি আরও বেশি চাপ দিলেন ক্যাথারিনের শরীরে। বললেন- আমি প্রথমে একজন মানুষ, তারপর একজন যাজক। তাই তো?

সিট ছোট্ট একটা শব্দ বেরিয়ে এল সদ্য জাগরিতা ক্যাথারিনের মুখ থেকে।

.

রন পিটারসন রুসটে প্রত্যেকদিন খেতে আসে। এক কোণে একটি চেয়ারে বসে থাকে। তার বন্ধুরা হৈ-হৈ করে ঢুকে পড়ে। হৈ-হুল্লোড়। ক্যাথারিন কাউন্টারের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন পল ঢোকে, সে মাথা নাড়ে। সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। কী আশ্চর্য, ছেলেটা কি আমায় ভুলে গেল নাকি? ক্যাথারিন ভাবে।

মুখের হাসি চওড়া, ছেলেটি কি হ্যালো বলবে না? ডেটের জন্য আবদার? এক গ্লাস জল? আমার কুমারিত্ব? না, আমি কি তার কাছে একটুকরো ফার্নিচার?

এখানে অন্য যেসব মেয়েরা আসে, তাদের থেকে আমি অনেক সুন্দরী, তা হলে? অবশ্য জ্যানের কথা আলাদা, অথবা দক্ষিণ দেশের সেই সোনালি চুলের মেয়েটি, অথবা নাম না-জানা সেই বাদামি কেশের কন্যাটি।

ওদের মধ্যে কী কথা হচ্ছে? ক্যাথারিন বোঝার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারছে না। এমন কিছু আলোচনা, যা ক্যাথারিনের মুখকে লজ্জায় লাল করেছে।

কী বিষয়ে? হ্যাঁ, সমকামিতা! পারস্পরিক আলাপন! আরও কত কী!

ক্যাথারিন ভাবতে পারছে না, কত সহজে?

কেউ একজন বলেছিল, কে? জ্যান অ্যানে ক্যাথেরিন তুই আমাদের মতো নোস। তুই একেবারে শান্ত শিষ্ট। সতীত্বের ঢাকনা পরা।

ওরা হৈ-হৈ করতে করতে চলে গেল। ক্যাথারিন অবাক হয়ে গেছে।

 সে রাত, ক্যাথারিন বিছানাতে শুয়ে আছে, ঘুমোতে পারছে না। ছটফট করছে।

কে যেন বলল- মিস আলেকজান্ডার? তোমার বয়স হল কত?

–উনিশ।

 –তুমি কি কোনো পুরুষের সাথে যৌন সংসর্গ করেছ?

না।

–পুরুষদের তোমার কেমন লাগে?

ভালো লাগে কি?

–এক মেয়ের প্রেমে পড়বে?

ক্যথারিন ব্যাপারটা আবার চিন্তা করল। অনেকগুলো বান্ধবীর মুখ তখন তার মনের সরণি দিয়ে মিছিল করে এগিয়ে চলেছে। অথবা কোনো অধ্যাপিকা? না, কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। সে মনে মনে স্বপ্নের জগতে ভেসে গেছে। আহা, একটি কোমল হাত, তার শরীরের সবখানে হাত রেখেছে। সে চিৎকার করছে। শেষ পর্যন্ত সে বলল–না, আমি এক সাধারণ মেয়ে, আমি সমকামী হব না।

— তাহলে? এভাবেই আমার দিন কেটে যাবে?

আকাশ এবার একটু ফরসা হতে শুরু করেছে? পুবাকাশে সূর্য আসবে। ক্যাথারিনের চোখ দুটো তখনও খোলা। সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার আমাকে কুমারিত্ব হারাতেই হবে। কে? রন পিটারসন ছাড়া আর কে হতে পারে?

.

০২.

 নোয়েলে, মারসেইল, প্যারিস ১৯১৯-১৯৩৯

সে ছিল এক রাজকন্যা।

তার গল্পটা এভাবেই শুরু হতে পারে। ছোট্টবেলার স্মৃতি? কত কিছুই মনে পড়ে যায় তার। লেস বসানো ক্যানোপি, গোলাপি রিবন দিয়ে বাঁধা, আরও কত কী? সে জানত তার জন্যে থরে থরে সাজানো আছে কত উপহার। যখন তার ছমাস বয়স, বাবা তাকে নিয়ে প্যারাম্বুলেটারে বেড়াচ্ছিল। ফুলের জলসাঘর। বাবা বলেছিলেন- রাজকন্যা, এগুলো কত সুন্দর। কিন্তু তুমি বোধহয় এদের থেকেও সুন্দরী।

বাড়িতে সে তার বাবার সান্নিধ্য অনুভব করত। বাবা মাঝে মধ্যেই মেয়েকে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতেন। আবার লুফে নিতেন। জানলা দিয়ে সে তাকিয়ে থাকত বিরাট বাড়ির ছাদের দিকে। কিছু বলার চেষ্টা করত। বাবা বলতেন, এটা তোমার সাম্রাজ্য যুবরানি। দেখছ, এই সব বিরাট জাহাজগুলো, একদিন তুমি এই সব জাহাজের অধীশ্বরী হবে।

ওই দুর্গে অনেক অতিথি আসতেন, তার সঙ্গে দেখা করতে। তবে সবাইকে অনুমতি দেওয়া হত না। বিশেষ জনেরা তার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারত। অন্যরা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। এমন কিছু কথা বলত, যা তাকে আরও আনন্দে ভরিয়ে তুলত।

হ্যাঁ, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, এ হল সত্যিকারের রাজকুমারী।

বাবা কানে কানে বলতেন- একদিন এক রাজার কুমার এসে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে।

তখন তার বয়স একটু একটু করে বাড়ছে। এটাই ছিল নোয়েলে পেজের নিজস্ব সাম্রাজ্য।

বাবার বন্ধুরা বলতেন না, মেয়েটির মাথায় এমন কল্পনা ঢুকিয়ে দিও না। জ্যাকুইস, এখন থেকে সামলাবার চেষ্টা করো। ওকেও তো এই পৃথিবীর বাসিন্দা হতে হবে।

মারসেইল, এক বিচ্ছিরি শহর। এখানেও এখন প্রাচীন বর্বরতা বজায় আছে। এখানকার নিজস্ব আইন আছে। আছে নিজস্ব নীতি।

জ্যাকুইস পেজের প্রতিবেশীরা হিংসা প্রকাশ করতেন। এমন এক সুন্দরী কন্যা। সত্যিই রাজার দুলালী।

নোয়েলের বাবা-মা জানতেন এই মেয়ে একদিন মর্ত্যের সেরা সুন্দরী হয়ে উঠবে। নোয়েলের মাকে দেখতে মোটেই ভালো ছিল না। পৃথুলা শরীর। ঝুলে আছে, এমন দুটি বুক। মোটা উরুদেশ এবং নিতম্ব।

বাবার চেহারা মোটামুটি খারাপ নয়। চোখের মধ্যে সন্দেহের আকুল দৃষ্টি। চুলের রং দেখলে মনে হয়, বৃষ্টি স্নাত বালুকবেলা। নরমান্ডিতে যেমনটি দেখা যায়।

এমন মেয়ে কী করে হল? অনেকে কানাকানি করত।

সত্যিই তো, কখন যে কী হয়ে যায়?

এভাবেই নোয়েলে বড়ো হয়ে উঠল। বাবাকে সে ভীষণ ভালোবাসত। বাবাই ছিল তার খেলার সাথী। বাবার সাথে কত গল্প।

মাঝে মধ্যে নিজেকে মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করত সে। মা না থাকলে বাবা বোধহয় সবটুকু ভালোবাসা আমাকেই দিত উজার করে- এমন কথাও ভাবত সে।

বাবা সবসময় নোয়েলের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। নোয়েলকে নিয়ে ডকে ঘুরে বেড়াতেন। কীভাবে মানুষজন কাজ করছেন, সব দেখতেন। তখন থেকেই নোয়েলে ডক সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পেরেছিল। জানত সে একদিন ওই বিশাল জাহাজের অধীশ্বরী হবে।

বাবাকে খুশি করার চেষ্টা করত। বলা যেতে পারে, বাবার সাথেই তার সুন্দর সম্পর্ক।

সপ্তদশী নোয়েলে, সৌন্দর্যের রাজরানি। আহা, তাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। অসামান্যা রূপবতী, লাবণ্যের আধার তার তনুবাহার, চোখের রং বাদামি, চুল ঈষৎ সোনালি। গায়ের চামড়ায় সূর্যের আভা। মনে হয়, সে যেন মধু আর দুধ মেশানো জলে স্নান করেছে।

আরও কত কী? তার কিশোরী স্তন, সরু কোমর, গোলাকৃতি বতুল নিতম্ব, লম্বা দুটি পা– সব মিলিয়ে সে বুঝি স্বপ্নসুন্দরী। কথা বলত মধুর স্বরে, কোমল এবং অসাধারণ শব্দচয়নে। ছিল তার আবেদন। সকলকেই তখন সে এক অদ্ভুত আকর্ষণে কাছে ডাকছে।

নোয়েলের বাবা মেয়ের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। জ্যাকুইস পেজ ভেবেছিলেন, নোয়েলেকে এবার বিশ্বে পা দিতে হবে। কিন্তু? যৌনতা নিয়ে আলোচনা? মেয়ের সামনে? না, বাবা-মা জানতেন, নোয়েলে এখনও পুরোপুরি কুমারী। যে সতীত্ব হল একজন মেয়ের সব থেকে বড়ো সম্পদ। কিন্তু ভবিষ্যতে?

শেষ পর্যন্ত বাবা ঠিক করলেন, মেয়েকে ভালোভাবে শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা যা তাকে জগতের বুকে দাঁড় করাবে।

তখন এক রাজনৈতিক সংকট, যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। নাজিরা অস্ট্রিয়ার ওপর তাদের অধিকার কায়েম করেছে। ইওরোপ স্তব্ধ হয়ে গেছে। কয়েক মাস কেটে গেল। নাজিরা শ্লোভাকিয়াকে আক্রমণ করেছে। হিটলার বলেছিলেন, তিনি আক্রমণ করবেন না। কিন্তু কথা রাখেন নি।

ফরাসি দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি তখন ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়েছে। কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। জ্যাকুইস ভাবলেন, এখন কী করা যায়? তার আসল সমস্যা হল, রূপবতী কন্যার জন্য এক প্রেমিকের সন্ধান করা। তার দুর্ভাগ্য, শহরের কোনো বিত্তবান পুরুষের সাথে তার পরিচয় ছিল না। বন্ধু-বান্ধব সকলেই ছিলেন তার সমগোত্রীয়। জীবনে হেরে যাওয়া মানুষ।

গত কয়েক মাসে নোয়েলে অশান্ত হয়ে উঠেছে। ক্লাসে পড়াশুনা সে ভালোই করে। কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবইতে সে মন বসাতে পারে না। অবশেষে নোয়েলে ঠিক করল, সে চাকরি করবে। বাবার কাছে গিয়ে শান্তভাবে তার মনের কথা জানাল।

বাবা জানতে চেয়েছিলেন- কী ধরনের চাকরি?

নোয়েলে জবাব দিয়েছিল কেন? আমি কি এক মডেল হতে পারি না?

প্রস্তাবটা বাবার মনে ধরে ছিল। জ্যাকুইস পেজ এবার শুরু করলেন তাঁর অভিযান, শেষ পর্যন্ত তিনি পরিচিত ল্যাঙ্কনের কাছে পৌঁছে গেলেন। ল্যাঙ্কন, বছর পঞ্চাশ বয়স, মুখটা কুৎসিত। মাথায় টাক, পা দুটো থরথর কাঁপছে। স্ত্রী এক ছোটোখাটো চেহারার রমণী। ফিটিংরুমে কাজ করেন। দরজিদের সঙ্গেই সময় কাটাতে ভালোবাসেন।

জ্যাকুইস বুঝতে পারলেন, সমস্যা হয়তো সমাধান হবে।

তিনি ল্যাঙ্কনকে সোজাসুজি বলেছিলেন আমার মেয়েকে একটা চাকরি দিতে হবে। আমি কি কাল আসব?

পরের দিন সকাল নটা। অগসটে দেখলেন জ্যাকুইসকে প্রবেশ করতে। মুখখানা রাগে থমথম হয়ে উঠল তার। মন্দাগণ্ডার বাজারে কে চাকরি দেবে? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে চাইছিলেন, কিন্তু অসামান্যা রূপবতী নোয়েলেকে দেখে তার মন একেবারে পাল্টে গেল।

অগসটে নোয়েলেকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে শুরু করলেন। লোভী নেকড়ের মতো।

নোয়েলের মুখে আমন্ত্রণী হাসি গুডমর্নিং সিয়ে, আমি শুনেছি, এখানে নাকি চাকরি খালি আছে?

অগসটে ল্যাঙ্কন কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন।

তোতলাতে তোতলাতে উনি বললেন- মনে হচ্ছে, তোমার জন্য একটা জায়গা আমি বার করতে পারব।

এবার জরিপ করা শুরু হল। মুখ থেকে বুক পর্যন্ত সব কিছু। পাছা অথবা অন্য কোনো কিছুই বাদ গেল না।

জ্যাকুইস পেজ বললেন আমি যাচ্ছি, আপনারা দুজনে পরিচিত হোন, কেমন?

প্রথম কয়েক সপ্তাহ নোয়েলের মনে হয়েছিল, সে বুঝি অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেছে। এই দোকানে যারা আসে, তারা সুন্দর পোশাক পরা মহিলার দল। কী সুন্দর তাদের কথাবার্তা। তাদের সঙ্গে যেসব ভদ্রলোকেরা আসে, তাদের দেখে মনে হয়, তারা বুঝি এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয়। তাদের জীবনটা অন্য ছন্দে এগিয়ে চলেছে।

মাঝে মধ্যেই বাবা এখানে আসতেন, মঁসিয়ে ল্যাঙ্কনের সঙ্গে ভারী বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তারা দুজনে বসে কগনাক খান, অথবা বিয়ার।

প্রথম দিকে নোয়েলে কিন্তু মঁসিয়ে ল্যাঙ্কনকে মোটেই পছন্দ করত না। এই লোকটা কেমন যেন লোভী, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। এখানে যেসব মেয়েরা কাজ করে, তাদের কাছ থেকে ল্যাঙ্কন চরিত্রের অনেক কেচ্ছাই শুনেছে নোয়েলে। একবার নাকি স্টকরুমে ল্যাঙ্কনের সঙ্গে এক মডেলকে দেখা গিয়েছিল। জড়াজড়ি অবস্থায়। মেয়েটি খেপে গিয়েছিল। শেষ অব্দি অনেক কষ্টে ব্যাপারটা ধামা চাপা দেওয়া হয়।

নোয়েলে বেশ বুঝতে পারে, ল্যাঙ্কনের লোভী দুটো চোখ তার সর্বাঙ্গ লেহন করছে। কিন্তু মুখে সে তার রাগ প্রকাশ করে না। সে ভাবে, চাকরিটা হারিয়ে গেলে কী হবে?

বাড়ির পরিস্থিতি এখন অনেকটা পাল্টে গেছে। এখন শুয়োরের মাংস হচ্ছে। আরও কত কিছু। ডিনারের পর নোয়েলের বাবা নতুন পাইপে অগ্নি সংযোগ করতে পারেন। আহা, কী সুন্দর তামাকের গন্ধ। চামড়ার পাউচ থেকে বের করেন। রোববার নতুন পোশাক পরেন।

বিশ্বের পরিস্থিতি ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে। বাবার বন্ধু-বান্ধবেরা গল্প করেন।

১৯১৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর। হিটলারের সেনাবাহিনী পোল্যান্ড অভিযান করল। দুদিন বাদে গ্রেট ব্রিটেনও ফ্রান্স ও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।

রাস্তাঘাটে তখন শুধুই ইউনিফর্ম পরা সৈন্যদের আনাগোনা। সবকিছুতেই রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ফরাসিদের সঙ্গে জার্মানদের মুখোমুখি যুদ্ধ লেগে গেছে বোধহয়। আবার হাজার বছরের যুদ্ধ?

একদিন নোয়েলে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলল। যে ছেলেটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসত, অন্ধকার রান্নাঘরে তাকে জাপটে চুমু খেল। তখনই লাইট জ্বলে উঠল। জ্যাকুইস দাঁড়িয়ে আছেন, রাগে কাঁপছেন।

তিনি চিৎকার করে বললেন– দূর হও হতভাগা, তুই আর কখনও আমার মেয়ের দিকে লোভীদৃষ্টি দিবি না, কেমন? রাস্তার শূয়োর কোথাকার?

ছেলেটা ভয়ে পালিয়ে গেল। মেয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, তারা অন্যায় কিছু করেনি। কিন্তু রাগী বাবাকে দেখে বোঝাতে সাহস পেল না।

বাবা চিৎকার করে বললেন– এমন করলে তোকে আমি বাড়ি ছাড়া করব। ওই ছেলেটা তোর যুগ্যি? তুই আমার রাজকন্যা, আর ও পথের ভিখারি।

সমস্ত রাত নোয়েলের চোখের তারায় ঘুম আসেনি। সে শুধু বাবার কথাই ভেবেছে। হায়, বাবা আমাকে এত ভালোবাসে? না, আমি কখনও বাবার মনে দুঃখ দেব না।

একদিন সন্ধ্যেবেলা, একজন কাস্টমার দোকানে এসেছেন। ল্যাঙ্কন নোয়েলেকে বললেন, কয়েকটা পোশাক বের করতে। নোয়েলের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ল্যাঙ্কন এবং তার বউ ছাড়া দোকানে আর কেউ ছিল না।

নোয়েলে ফাঁকা ড্রেসিং রুমে চলে গেল। পোশাক পাল্টাতে হবে। ব্রা আর প্যান্টি পরে। দাঁড়িয়ে আছে। তখনই ল্যাঙ্কন সেই ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। নোয়েলেকে এই অবস্থায় দেখে লোভী নেকড়ের মতো জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলেন। নোয়েলে পোশাক পরার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু পোশাকে হাত দেবার আগেই ল্যাঙ্কন তাকে ধরে ফেললেন। তার শরীরটাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করলেন। নোয়েলে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। হাত ছাড়িয়ে দেবার প্রচণ্ড প্রয়াস। কিন্তু সে পারল না।

ল্যাঙ্কন হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–তুমি কতো সুন্দরী, আমি তোমাকে অনেক কিছু দেব।

ঠিক সেই সময় ল্যাঙ্কনের বউ চিৎকার করে ডেকে উঠলেন। ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। নোয়েলে জামাকাপড় পরার সুযোগ পেল।

বাড়ি ফিরে নোয়েলে ভেবেছিল, বাবাকে এই ঘটনাটা বলবে কিনা। বাবা জানতে পারলে হয়তো ল্যাঙ্কনকে মেরেই ফেলবেন। না, ব্যাপারটা চেপে রাখতে হবে। চাকরিটা আমার ভীষণ দরকার।

পরের শুক্রবার, ম্যাডাম ল্যাঙ্কন একটা খবর পেয়েছেন, ভিসিতে যেতে হবে, মা অসুস্থ। ল্যাঙ্কন গাড়ি করে বউকে রেলরোড স্টেশনে পৌঁছে দিলেন। দোকানে ফিরে এলেন। নোয়েলকে অফিসে ডাকলেন। বললেন, তাকে নিয়ে উইকএন্ডে বেড়াতে যাবেন। এই কথা শুনে নোয়েলে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ল্যাঙ্কনের মুখের দিকে। ভেবেছিল, এসব বোধহয় মিথ্যে পরিকল্পনা।

ভদ্রলোক বললেন- আমরা ভিয়েনাতে যাব। ভিয়েনাতে এমন রেস্টুরেন্ট আছে, বিশ্বে তার তুলনাই নেই। সেটি হল লে পিরামিড, খরচ খুব বেশি, কিন্তু এতে কিছুই আসবে যাবে না। তুমি কি তৈরি আছো? 

নোয়েলে এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারবে কি? মঁসিয়ে ল্যাঙ্কন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

এক ঘণ্টা বাদে নোয়েলের বাবা দোকানে এলেন। তাকে দেখে নোয়েলের মুখে নিরাপত্তার অঙ্গীকার।

নোয়েলে বলল- বাবা, তুমি আসাতে আমি খুবই খুশি হয়েছি।

-মঁসিয়ে ল্যাঙ্কন, আমাকে সবকিছু বলেছেন। উনি একটা ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন। তুই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করছিস?

নোয়েলে অবাক হয়ে গেছে কী বলছ? উনি আমাকে নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যেতে চাইছেন।

–আর তুই কিনা না বলেছিস?

নোয়েলে জবাব দিতে পারছে না। তার বাবা গালে থাপ্পড় মারতে শুরু করেছেন। সে অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্ত শরীরটা ঝিমঝিম করছে। এ কী? বাবা কি আমাকে বেচতে চাইছে?

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়িটা ধীরে ধীরে চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে, নোয়েলে আর মঁসিয়ে ল্যাঙ্কন চলেছেন ভিয়েনার উদ্দেশ্যে।

.

হোটেলটা ভারী সুন্দর, বিরাট একটা ডবল বেড। বেসিন আছে এককোণে। মঁসিয়ে অবশ্য বাজে কাজে খরচ করতে চান না। ছোটো অবস্থা থেকেই তিনি আজ এত বড়ো হয়েছেন।

তিনি নোয়েলের বুকের দিকে তাকালেন। নিজের হাতে বৃন্ত মুচড়ে দিলেন।

বললেন- হায় ঈশ্বর, তুমি দেখছি খুব রূপসী। তিনি স্কার্ট খুলে দিলেন। প্যান্ট খুঁড়ে ফেলে দিলেন। বিছানার ওপর। নোয়েলে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনে হল, সে বুঝি অসুস্থ। কিন্তু? বাধা দেবে কী করে?

-তোমার বাবা সবকিছু বলেছে, এখনও তুমি তোমার কুমারিত্ব হারাওনি, তাই তো? আমি তোমাকে সব কিছু শেখাব।

ভদ্রলোক নোয়েলের ওপর চেপে বসলেন। পুংদণ্ডটা দুপায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন। আরও–আরও শক্ত, নিজেকে নিঃশেষে উজাড় করে দিতে হবে। নোয়েলের কোনো অনুভূতি নেই। বাবার কথাই মনে হচ্ছে। র্মসিয়ে ল্যাঙ্কনের মতো এক ভদ্রলোক, তার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার? ওনাকে খুশি রাখার চেষ্টা করবি। আমার জন্য।

অন্য মেয়েরা এমন সুযোগ পেলে হয়তো বর্তে যেত? আর আমার সুযোগ এসেছে। নোয়েলে ল্যাঙ্কনের দিকে তাকাল। শুয়োরের মতো চেহারা, কুতকুতে দুটি চোখ। এই হল রাজকুমার? বাবা এর কাছে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। হু-হু করা একটা কান্না। কিন্তু কিছুই করার নেই।

কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। নোয়েলের মনে হল, তার বুঝি নবজন্ম হল। রাজকুমারী মরে গেছে, এক হতভাগিণী কন্যার জীবন। সেসব কিছু বুঝতে পারল। তার মনে তীব্রতম ঘৃণা। না, সে শুধুমাত্র ল্যাঙ্কনকে ঘৃণা করছে না। পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি তার উদাসীনতা। নোয়েলে ঠিক করল, এবার তাকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে। ঈশ্বর যখন এমন শরীর দিয়েছে, এই শরীরটাকে ব্যবহার করতে হবে। হ্যাঁ, বাবা তো ঠিক কথাই বলেছেন। সে হল এই পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী। না, আজ থেকে তাকে নতুন পথের পথিক হতেই হবে।

সে মঁসিয়ে ল্যাঙ্কনের দিকে তাকাল। পুংদণ্ডটি কেমন করে ব্যবহার করতে হয়, সেটা তাকে যত্নে শিখতে হবে।

আহা, ওই নগ্ন শরীর তাকে অধিকার করতে হবে। মধ্যবয়স, স্ত্রীর কাছ থেকে শুধুই উপেক্ষা আর অবহেলা। কিন্তু আমি? শেষ পর্যন্ত বাজারের বেশ্যা হয়ে যাব? না, আমি তা কখনওই হতে দেব না।

ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয়। নোয়েলের সাথে আবার শরীর সংসর্গ।

নোয়েলে ঠান্ডা মাথায় বলল- আপনি চুপটি করে শুয়ে থাকুন। আমি দেখছি, কী করে আপনাকে উত্তেজিত করতে পারি।

এবার জিভের খেলা শুরু হল। আহা, বোধহয় নতুন একটা খেলনা। সে ধীরে ধীরে মঁসিয়ের দেহের স্পর্শকাতর অংশে জিভের পরশ রাখল। ল্যাঙ্কন চিৎকার করছেন আনন্দে এবং উত্তেজনায়। আহা, এতগুলো বোতাম? খুলে দেওয়া হচ্ছে ধীরে ধীরে। চরম সময়ে পৌঁছে গেছেন ল্যাঙ্কন। এত সহজ নয়, এটা বোধহয় একটা স্কুল। ছাত্রকে সবকিছু শেখাতে হবে। এভাবেই নোয়েলে প্রথম কামনার স্বাদ পেল।

তিনটি দিন কেটে গেল। তারা কেউই লে পিরামিড হোটেলে খেতে যায়নি। দিন আর রাত্রি, শুধুই যৌন বিষয়ে আলোচনা। নোয়েলে ইতিমধ্যে আরও অভিজ্ঞ।

তারা মারসেইলে ফিরে এলেন। ল্যাঙ্কন তখন ফরাসি দেশের সব থেকে সুখী মানুষ। আহা, কী ভাবেই না দিন কেটে গেছে? আর এখন? সবকিছু নতুন ভাবে শুরু করতে ইচ্ছে করছে।

উনি বললেন- আমি তোমাকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট দেব নোয়েলে, তুমি কি রান্না করতে পারো?

নোয়েলের জবাব– হ্যাঁ, পারি।

-আমি প্রত্যেক দিন সেখানে লাঞ্চ খেতে আসব। তোমাকে ভালোবাসব, সপ্তাহে দু দিন-রাত তোমার সঙ্গে থাকব।

নোয়েলের মুখে হাত দিয়ে ভদ্রলোক বললেন- কেমন শোনাচ্ছে আমার প্রস্তাব?

নোয়েলে বলল- ভারী ভালো শোনাচ্ছে।

–তোমাকে আমি আরও বেশি টাকা দেব। কিন্তু যা দেব, তা দিয়ে তুমি অনেক কিছু কিনতে পাবে। তুমি সম্পূর্ণ আমার তাই তো?

নোয়েলের মুখে দুষ্টু হাসি তুমি যা বলবে অগসটে, আমি তো তোমার কেনা বাঁদি হয়ে গেছি।

ল্যাঙ্কন হাসলেন। শান্তস্বরে বললেন- আহা, কেউ এভাবে আমাকে ভালোবাসেনি। তোমাকে আমার এত ভালো লাগে কেন? তুমি কি তা জানো?

–কেন অগসটে?

–তুমি আমার জীবনটা অনেক বছর কমিয়ে দিয়েছ। আমরা দুজনে একটা সুখী সম্পৃক্ত জীবন খুঁজে পাব কেমন?

মারসেইলে তারা পৌঁছে গেলেন সন্ধ্যেবেলা। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে গেছে। ল্যাঙ্কন তার নিজস্ব স্বপ্নে বিভোর।

কাল সকাল নটায় দোকানে দেখা হবে কেমন, যদি খুব ক্লান্তি বোধ করো, তাহলে সাড়ে নটার সময় এসো, কেমন?

-তোমাকে অনেক ধন্যবাদ অগসটে।

অগসটে একমুঠো ফ্রাঙ্ক নোয়েলের হাতে তুলে দিলেন।

কাল বিকেলে আমি অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজতে বেরোব। ঠিক আছে।

নোয়েলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার হাতের ফ্রাঙ্কের দিকে।

ল্যাঙ্কন বললেন কিছু ভুল কি?

নোয়েলে বলেছিল- একটা সুন্দর জায়গা দিও কিন্তু, যেখানে আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে পারব।

ভদ্রলোক প্রতিবাদ করে বলেছিলেন- আমি কিন্তু খুব বড়োলোক নই।

 তারপর? আর একটু বেশি ফ্রাঙ্ক। শেষ পর্যন্ত নোয়েলের ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি।

নোয়েলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। এক নতুন পৃথিবীর নতুন জগত, এই জগতে সে এক উজ্জ্বল বাসিন্দা।

এবার তাকে নতুন ফ্ল্যাটে আসতে হবে। আহা, সূর্য সম্পৃক্ত দিন। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। কোথায় আমি যাব? অনেকগুলো ট্যাক্সি সারবন্দী দাঁড়িয়ে আছে। .

কোথায় যাবেন?

একজন ড্রাইভার জানতে চাইল।

নোয়েলে বলল- একটা কম দামী হোটেল।

 আপনি কি এই শহরে নতুন এসেছেন?

হ্যাঁ।

-আপনি কি চাকরি করবেন?

হ্যাঁ।

–আপনি কখনও মডেলিং করেছেন?

হ্যাঁ, আমি দুই একবার মডেলিং-এর কাজ করেছি।

নোয়েলের বুকটা তখন লাফাচ্ছে। ছোট্ট একটা মিথ্যে কথা বলল সে।

–আমার বোন একটা ফ্যাশান হাউসে চাকরি করে। ড্রাইভার বলছে, এই সকালে সে আমার সাথে কথা বলছিল। একটা মেয়ে নাকি কাজ ছেড়ে চলে গেছে। আমি দেখব, চাকরিটা খালি আছে কিনা।

নোয়েলে বলল- আপনার প্রস্তাবটা খুব সুন্দর।

যদি আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই, দশ ফ্রাঙ্ক খরচ হবে কিন্তু।

— নোয়েলে ব্যাকসিটে বসে পড়ল। ট্যাক্সি এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভার নানা গল্প করছে। নোয়েলে কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে শহরের দৃশ্য দেখছে। আহা এখন কি ব্ল্যাক আউট শুরু হবে? এই শহরের সবকিছু পাল্টে গেছে? তারা নোতরদামকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। বুলেভার্দের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি ছুটে চলেছে।

একটু দূরে নোয়েলে আইফেল টাওয়ার দেখতে পেল। এই মিনারটা বোধহয় গোটা শহরটাকে শাসন করছে। রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে ড্রাইভার দেখল নোয়েলের মুখের অভিব্যক্তি।

–অসাধারণ তাই না?

–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, নোয়েলে শান্তভাবে জবাব দিল। সে ভাবতেই পারছে না। সে এখানে এসেছে। এটা হল এমন একটা রাজ্য যেখানে রাজকন্যারাই ঘুরে বেড়াবে।

ট্যাক্সি একটা ধূসর পাথরের বাড়ির সামনে এসে থামল।

ড্রাইভার বলল- আমরা এসে গেছি। মিটারে দু ফ্রাঙ্ক। আমার জন্য দশ ফ্রাঙ্ক, কি তাই তো?

–আমি কী করে জানব, চাকরিটা এখনও খালি আছে?

ড্রাইভারের কাঁধ ঝাঁকানি। আমি তো আগেই বলেছি, মেয়েটি আজ সকালে কাজ ছেড়ে চলে গেছে। যদি আপনি যেতে না চান, তাহলে আপনাকে আমি স্টেশনে পৌঁছে দেব।

নোয়েলে শান্তভাবে বলল- না, সে পার্স খুলল, বারো ফ্রাঙ্ক বের করে ড্রাইভারের হাতে তুলে দিল।

ড্রাইভার একবার টাকার দিকে, তারপর নোয়েলের দিকে তাকাল। সে বোধহয় কিছু বলছে।

নোয়েলে তার হাতে আর একটা ফ্রাঙ্ক দিল।

ড্রাইভার মাথা নাড়ল, মুখে হাসি নেই, দেখল, মেয়েটি ট্যাক্সি থেকে তার সুটকেস বের করছে।

নোয়েলে প্রশ্ন করল– আপনার দিদির নাম কী?

জেনেট্টে।

ট্যাক্সিটা চোখের সামনে থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। নোয়েলে বাড়িটার দিকে তাকাল, সামনে কোনো চিহ্ন নেই। সে বুঝতে পারল, এমন ঘটনা অনেক সময় ঘটে। ফ্যাশানেবল ড্রেস হাউসের কোনো চিহ্ন থাকে না। সকলেই সেটাকে চেনে এবং সেখানে চলে আসে। নোয়েলে সুটকেস হাতে নিয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। কলিংবেলে হাত দিল।

একটু বাদে এক পরিচারিকা দরজাটা খুলে দিল। শূন্য চোখে সে তাকাল নোয়েলের দিকে।

নোয়েলে বলল- আমি শুনেছি, এখানে নাকি মডেলের জন্য চাকরি খালি আছে?

মেয়েটি ভালোভাবে নোয়েলেকে দেখে বলল– কে আপনাকে পাঠিয়েছে?

-জেনেট্টের ভাই।

–ভেতরে আসুন। সে দরজাটা ভালো করে খুলে দিল। নোয়েলে রিসেপশন হলে ঢুকে পড়ল। উনিশ শতকের আদলে গড়া। একটা বিরাট ঝাড়বাতি সিলিং থেকে ঝুলছে। কয়েকটা এপাশে ওপাশে ছড়ানো ছেটানো। ফাঁকা দরজা দিয়ে নোয়েলে দেখতে পেল, সিটিং রুমে অ্যান্টিক ফার্নিচারে ভরা। সিঁড়ি ওপরতলায় উঠে গেছে।

পরিচারিকা বলল- একটু বসুন। আমি দেখি মাদাম ডিলাইসের সময় আছে কিনা?

নোয়েলে বলল- ধন্যবাদ। সুটকেস নামিয়ে রাখল। দেওয়ালে আটকানো আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। ট্রেনে চড়ে এসেছে। জামাকাপড়ের অবস্থা শোচনীয়। নাঃ, একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এলে ভালো হত। মডেলিং-এর ক্ষেত্রে দেখার ব্যাপারটাই প্রধান। যাক, এখনও আমি যথেষ্ট সুন্দরী, সে ভাবল। সে জানে, এই সৌন্দর্য তার অন্যতম সম্পদ। অন্য যে কোনো সম্পদের মতো বুঝে সমঝে খরচ করতে হবে। নোয়েলে আবার তাকাল। এক রূপবতী মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। হ্যাঁ, শরীরটা লোভনীয়, সে একটা লম্বা বাদামি স্কার্ট পরেছে। হাইনেক ব্লাউজ। নোয়েলে বুঝতে পারল। এখানকার মডেলদের চালচলন একেবারেই আলাদা। সে নোয়েলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিল। তারপর ড্রয়িং রুমের দিকে হেঁটে গেল।

একটু বাদে মাদাম ডিলাইস ঘরে প্রবেশ করলেন। বছর চল্লিশ বয়স হয়েছে, শরীরটা খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। চোখের তারায় শৈত্যতার আভাস। আছে অনুভবী চিন্তা। তিনি এমন একটা গাউন পরেছেন, নোয়েলের মনে হল, তার দাম অন্তত দু হাজার ফ্রাঙ্ক হবে।

-রেজিনা বলল, তুমি নাকি চাকরি চাইছ? ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

–হ্যাঁ, ম্যাডাম। নোয়েলের উত্তর।

তুমি কোথা থেকে আসছ।

–মারসেইলে।

মাদাম ডিলাইস নাকে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করলেন। মাতাল নাবিকদের আস্তানা।

নোয়েলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। মাদাম ডিলাইস নোয়েলের কাঁধে হাত রেখে বললেন এতে কিছুই হয় না ডারলিং। তোমার বয়স কত?

আঠারো।

মাদাম ডিলাইস মাথা নেড়ে বললেন- ঠিক আছে, মনে হয়, আমার কাস্টমাররা তোমাকে পছন্দ করবে। প্যারিসে তোমার পরিবারের কেউ আছে?

না।

বাঃ, চমৎকার। তুমি কি এখন থেকেই কাজটা শুরু করতে চাও?

–হ্যাঁ, এখন থেকেই। নোয়েলে আগ্রহের সঙ্গে বলল।

ওপরতলা থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল। একটু বাদে এক লাল চুলের মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। তার হাতে এক মোটা মাঝবয়সী পুরুষের হাত। মেয়েটার পরনে ফিনফিনে রাত পোশাক।

মাদাম ডিলাইস জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপারটা হয়ে গেছে? লোকটা চিৎকার করে বলল- আমি অ্যাঞ্জেলাকে কেটে টুকরো টুকরো করেছি। হঠাৎ নোয়েলের দিকে নজর পড়ল তার। সে বলল- এই রূপকথার রানিটা কে?

মাদাম ডিলাইস বললেন– ও হল ইভেট্টি, আমাদের নতুন আমদানি। তারপর বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বললেন, ও এসেছে অ্যান্টিকেস থেকে, এক যুবরাজের কন্যা।

লোটার সমস্ত শরীরে বিস্ময় আমি কখনও যুবরানির সঙ্গে সঙ্গম করিনি। কত পড়বে?

–পঞ্চাশ ফ্রাঁ।

–তুমি বোধহয় আমার সাথে মজা করছ, তাই না? তিরিশ।

চল্লিশ। বিশ্বাস করো যা দেবে তার দ্বিগুন পাবে।

–আচ্ছা তাই দেব আমি।

তারা নোয়েলের দিকে তাকাল। নাঃ, নোয়েলের চিহ্নমাত্র পাওয়া গেল না।

.

প্যারিসের রাজপথে নোয়েলে একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কোথায় যাবে, কিছুই ঠিক করতে পারছে না। জুয়েলারি আর পোশাকের দোকান। চামড়ার জিনিস এবং পারফিউম। প্যারিস এত স্বাস্থ্যবতী শহর? চোখ যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। শেষ অব্দি সে ভিক্টর হুগো এভিনিউতে এসে পৌঁছোল। হ্যাঁ, ভীষণ খিদে পাচ্ছে। তেষ্টাও পেয়েছে। পার্স খুলল। সে কী? এটা তো নেই? স্যুটকেস, পার্স সবকিছু মাদাম ডিলাইসের ওই ঘরে পড়ে আছে। না, সেখানে যাবার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। তবে জিনিসগুলো?

যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য নোয়েলে বিস্মিত হয়নি, মন খারাপও করেনি। সে জানে এক মহিলা মডেল কন্যা এবং বাজারের বেশ্যার সঙ্গে কী তফাত? বেশ্যারা ইতিহাসের ধারাকে পাল্টাতে পারে না, রূপসী সুন্দরীরা তা পারে।

এখন তার হাতে কোনো পয়সা নেই। বেঁচে থাকার একটা উপায় বের করতেই হবে। পরের দিন অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনায়মান হতে শুরু করেছে। দোকানে দোকানে ব্ল্যাকআউটের প্রস্তুতি। কালো পর্দা দিয়ে সব ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু, কাউকে তো দরকার, যে খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে। কোথায় যাওয়া যায়? চারপাশে কেমন যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিবেশ। নোয়েলে শান্তভাবে পথ দিয়ে হাঁটছে। সে একটা শপিংমলের ভেতর ঢুকে গেল। এলিভেটরের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল। নাঃ, অগসটে ল্যাঙ্কনের মতো এক ভদ্রলোকের সাথে লড়াই করেছি। মানুষের মন অত্যন্ত সরল, পুরুষদের ক্ষেত্রে? কাউকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যার কাছে সাহচর্য দিলে রাতের ডিনারটা জমে উঠবে?

সে লবির চারপাশে তাকাল, যে কোনো এক যুবা পুরুষ অথবা বৃদ্ধ, যার পিছুটান নেই। আসছে সে?

আমায় ক্ষমা করবেন মামজেল।

নোয়েলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বিরাট আকৃতির একটি মানুষ। কালো স্যুট পরা। নোয়েলে জীবনে কোনোদিন ডিটেকটিভ দেখেনি। কিন্তু এই ভদ্রলোক যে গোযোন্দো এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

-মামজেল কি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন?

-হ্যাঁ, নোয়েলে জবাব দিল। গলা ঠিক রাখার চেষ্টা করল, আমি এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি।

তার মুখে চিন্তার ছাপ। তার হাতে কোনো পার্স নেই!

আপনার বন্ধু কি এই হোটেলের গেস্ট?

এবার নোয়েলের সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। না, ঠিক তা নয়।

ভদ্রলোক নোয়েলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর বলল আমি কি আপনার পরিচয়পত্র দেখতে পারি?

নোয়েলে তোতলাতে থাকে সেটা আমার সঙ্গে নেই, ওটা আমি হারিয়ে ফেলেছি।

ভদ্রলোক বলল- মামজেল, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

ভদ্রলোক নোয়েলের হাতে হাত দিল। নোয়েলে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হল।

 একটু বাদে অন্য কেউ একজন তার অন্য হাতটি ধরে ফেলেছিল।

–আমার দেরি হয়ে গেল, আমি জানি এই ককটেল পার্টিতে কী ঝামেলা হয়। এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করছ।

নোয়েলে অবাক হয়ে গেল, বক্তার দিকে তাকিয়ে। লম্বা, শরীরটা রোগা, অদ্ভুত একটা ইউনিফর্ম পরেছে। তার নীল কালো চুল, ধরাচূড়া পরা, চোখের রং কালো৷ কে? মনে হয় সে বোধহয় এক পুরোনা ফ্লোরেনটাইন মুদ্রা। এমন চেহারা নোয়েলে খুব একটা দেখেনি। পাশাপাশি দুজন মানুষ, কথা বলছে, গল্প করছে, নোয়েলের কেবলই মনে হল, ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে না তো?

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল– এই লোকটা আপাকে জ্বালায়নি তো?

 কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য আছে, অদ্ভুত কিছু শব্দের বিচ্ছুরণ।

নোয়েলে বলল না।

-স্যার, প্রথম মানুষটি বলল, আমি বুঝতে পারিনি। এখানে নানা সমস্যা হচ্ছে। মামজেল, আমাকে ক্ষমা করবেন, কেমন?

দ্বিতীয় আগন্তুক নোয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল- ঠিক আছে, এবার যাওয়া যাক।

নোয়েলে কীভাবে ওই মঁসিয়েকে ধন্যবাদ জানাবে বুঝতে পারল না। সে বলল আপনি কে, আমি জানি না। তবুও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আগন্তুক বলল– পুলিশদের আমি মোটেও পছন্দ করি না। আমি কি আপনাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেব?

নোয়েলে তার দিকে তাকাল। সে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করে বলল- না।

লোকটা বলল- ঠিক আছে। তা হলে শুভরাত। ভদ্রলোক স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। ট্যাক্সিতে ওঠার চেষ্টা করল। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল, নোয়েলে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলের ডোরওয়েতে ওই ডিটেকটিভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। আগন্তুক চিন্তা করল। নোয়েলের কাছে এগিয়ে এল। বলল, এখান থেকে এখনই চলে যান। আমার বন্ধু কিন্তু আপনার ওপর নজর রেখেছে।

–আমার যাবার কোনো জায়গা নেই।

 লোকটা পকেটে হাত দিল। ব্যাগটা বের করার চেষ্টা করল।

টাকার দরকার নেই। নোয়েলে শান্তভাবে বলল।

 আগন্তুক অবাক হয়েছে- আপনি কী চাইছেন?

–আমি আপনার সঙ্গে ডিনার খেতে চাইছি।

 লোকটির মুখে হাসি দুঃখিত, একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এখনই দেরি হয়ে গেছে।

–তাহলে আপনি চলে যান, আমাকে বিরক্ত করবেন না।

লোকটা পকেটে ব্যাগটা পুরে রাখল হানি, ধন্যবাদ, জানি না, দেখা হবে কিনা।

সে আবার ট্যাক্সির দিকে হেঁটে গেল। নোয়েলে তাকাল। বুঝতে পারছে না। কেন লোকটা তাকে সাহায্য করল না। লোকটার দিকে তাকিয়ে নোয়েলের মনে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এমন একটা আবেগ যা সে কখনও পায়নি। এই ভদ্রলোকের নাম জানে না। হয়তো এর সঙ্গে আর কখনও তার দেখা হবে না। নোয়েলে হোটেলটার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ওই ডিটেকটিভ পা ফেলে ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা তারই ভুল, তার উচিত ছিল এখান থেকে চলে যাওয়া। পিঠে কার হাত? হ্যাঁ, ওই লোকটা আবার ফিরে এসেছে। তাকে ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ট্যক্সির দরজাটা খুলে গেল। নোয়েলে ভেতরে বসল। সে একটা ঠিকানা দিয়েছিল। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে। ডিটেকটিভ বুঝতে পারছে না, কী করবে এখন।

নোয়েলে জানতে চাইল আপনার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল?

–এটা একটা পার্টি, না এতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি ল্যারি ডগলাস, তোমার নাম কী?

নোয়েলে পেজ।

–নোয়েলে, তুমি কোথা থেকে আসছ?

নোয়েলে ডগলাসের চোখের দিকে তাকাল। সে বলল– অ্যান্টিবেস, আমি এক রাজকুমারের কন্যা।

লোকটা হেসে উঠল। তার সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠেছে।

–তাহলে তোমাকে আমি রাজকুমারী বলব?

আপনি কি ব্রিটিশ?

–আমেরিকান।

–আমেরিকা কি যুদ্ধে যোগ দিয়েছে?

লোকটা বুঝিয়ে বলল- আমি ব্রিটিশ র‍্যাফের সঙ্গে কাজ করছি। তারা আমেরিকান ফায়ারসের একটা দল তৈরি করেছে। নাম দেওয়া হয়েছে ঈগল স্কোয়াড্রন।

–আপনারা কেন ইংল্যান্ডের হয়ে লড়াই করছেন?

কারণ ইংল্যান্ড আমাদের হয়ে লড়ছে। তাই, আর কিছু আমি জানি না। নোয়েলে মাথা ঝাঁকাল হিটলার সম্বন্ধে আপনি কী ভাবেন? কৌতুকের মতো তার ভূমিকা।

-হতেই পারে। জার্মানদের ছাড়া আর কাউকে তিনি ভালোবাসেন না। উনি চাইছেন : পৃথিবীর রাজা হতে।

নোয়েলে শুনছিল, অবাক চোখে। ল্যারি অবলীলায় হিটলারের কথা বলছিল। তারপর লীগ অফ নেশনস-এর কথাও বলল। হ্যাঁ, ইতিহাস সম্পর্কে ল্যারির অগাধ জ্ঞান।

এই রকম কোনো পুরুষের সাথে নোয়েলের এ পর্যন্ত দেখা হয়নি। হ্যাঁ, এই জাতীয় মানুষকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অসম্ভব এক শক্তি লুকিয়ে আছে তার অনন্ত পৌরুষের মধ্যে। কাছে যে আসবে, সে তার কক্ষপথে ঘুরতে শুরু করবে।

ওরা পার্টিতে এসে পৌঁছে গেল। একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট। অ্যাপার্টমেন্টে মানুষের চিৎকার। লোক হৈ-হৈ করছে। বেশির ভাগই অল্পবয়সী তরুণ-তরুণী। ল্যারি নোয়েলের সাথে পার্টি অধিকন্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দিল। যৌনবতী এক রমণী, তারপর? তারপর আর কী? নোয়েলের মনে হল, পাটির সবাই তাকে চাখতে শুরু করেছে, অনেক তরুণী, তার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করছে। এমন কী যেসব ছেলেরা মেয়েদের হাত ধরে কথা বলছিল, তাদের চোখ এখন নোয়েলের দিকে নিবদ্ধ।

নোয়েলে বুঝতে পারল, আমার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা আমাকে সকলের কাছে এত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তাহলে? আমি কেন এই লুকোনো শক্তিটা ব্যবহার করব না।

কিছুক্ষণ বাদে একটা কণ্ঠ- এবার আমাদের যেতে হবে।

আহা, শান্ত সুন্দর বাতাস বইছে। শহরটা অন্ধকারের ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকেছে। আকাশে অদৃশ্য জার্মান বিমানের হানা। মাঝে মধ্যে বাড়ির আলো জ্বলছে। মনে হচ্ছে, কালো সমুদ্রে আলোকিত মাছের সমাহার।

ট্যাক্সি পাওয়া গেল না, এখন হাঁটতে হবে। তারা হেঁটে চলেছে। কত প্রশ্ন। নোয়েলে সংক্ষেপে তার ফেলে আসা জীবনকথা বলেছে। সদ্য পরিচিত যুবাপুরুষ জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ বোস্টন থেকে এসেছে। তার মা কেরি কাউন্টিতে জন্মেছিল।

নোয়েলে জানতে চাইল আপনি এত সুন্দর ফরাসি বলছেন কী করে?

–আমি আমার হোটোবেলা কাটিয়েছি এই দেশে। তাই এই ভাষাটি রপ্ত করেছি।

এবার অন্য আলোচনা, আমেরিকার স্টক মার্কেট। নোয়েলে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। সে শুধু শ্রোতার ভূমিকায়।

তুমি কোথায় থাকো?

কোথাও না, নোয়েলে সত্যি কথাটা বলে দিল।

 সব গল্প, কীভাবে ট্যাক্সিটা তাকে বোকা বানিয়ে মাদাম ডিলাইসের কাছে নিয়ে গেছে, বোকা লোকটা ভেবেছে, সে বোধহয় সত্যি এক রাজকুমারী। তাকে ভোগ করার জন্য চল্লিশ ফ্রাঙ্ক অনায়াসে তুলে দিয়েছে।

সব শুনে ল্যারি হেসে উঠল। তারপর বলল দেখা যাক রাজকুমারী, এই সমস্যার সমাধান তো আমাকেই করতে হবে।

আবার সেই পুরোনো বাড়ি। একই পরিচারিকা দরজা খুলে দিল। আমেরিকান যুবা পুরুষকে দেখে তার চোখের তারায় দ্যুতি। কিন্তু নোয়েলেকে দেখে মুখ চুপসে গেল।

আমরা মাদাম ডিলাইসের সঙ্গে দেখা করতে চাইছি। ল্যারি বলল, নোয়েলেকে নিয়ে সে রিসেপশন হলের দিকে হেঁটে গেল। ড্রয়িংরুমে কয়েক জন মেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

কয়েক মিনিট বাদে মাদাম ডিলাইস প্রবেশ করলেন।

–শুভ সন্ধ্যা মঁসিয়ে, তারপর নোয়েলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন- কী, মত পাল্টেছো?

ল্যারি বলল, না, তার কোনো প্রশ্ন নেই।

-তাহলে?

–এই মেয়েটির পার্স আর স্যুটকেস ফেরত নিতে এসেছি।

 মাদাম ডিলাইস এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন, ঘর থেকে চলে গেলেন।

 কিছুক্ষণ বাদে ওই পরিচারিকা ঢুকে পড়ল, নোয়েলের পার্স আর স্যুটকেস।

ল্যারি নোয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল– এবার যাওয়া যাক রাজকুমারী।

সেই রাতে নোয়েল ল্যারির সাথে একটা ছোট্ট পরিষ্কার হোটেলে গিয়েছিল। হ্যাঁ, এটা নিয়ে আলোচনা করার কিছুই নেই। ভালোবাসা, শরীর সংযোগ সবকিছুই ঘটে গেল। নোয়েলে সমস্ত রাত ল্যারির বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল। তাকে আঁকড়ে ধরেছিল। আহা, একটা স্বপ্ন সফল হয়েছে। অথচ, কী আশ্চর্য কয়েক ঘণ্টা আগে তারা কেউ, কাউকে চিনত না।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল, ভালোবাসার অবাধ উচ্চারণ, এবার শহরটা আবিষ্কার করতে হবে। ল্যারি এক অসাধারণ গাইড। তারা দামী হোটেলে লাঞ্চ খেল। সন্ধ্যেটা কাটাল ম্যালমেশনে। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াল কিশোর-কিশোরীর মতো। সবশেষে নোতরদাম। প্যারিসের সবথেকে পুরোনো অঞ্চল, চতুর্দশ লুইস তৈরি করেছিলেন। আজও ভ্রমণার্থীদের কাছে সেরা আকর্ষণ।

প্যারিসে এত কিছু দেখার আছে? ভাবতেই পারা যায় না। ল্যারিকে ধন্যবাদ, অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ল্যারি বলল– প্যারিসকে আমি ভালোবাসি। আমার কাছে এটা এক মন্দিরের মতো। এখানে এত সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। এই শহরটাকে রূপ, খাদ্য আর ভালোবাসার তীর্থ বলা যায়। তারপর নোয়েলের দিকে তাকিয়ে সে বলল- আমি যেভাবে বললাম, ঘটনাগুলো কিন্তু সেভাবে পরপর ঘটে না।

এবার আবার সেই হোটেল ঘর। ভালোবাসার অবাধ উচ্চারণ। হ্যাঁ, সব কথাই নোয়েলের মনে পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাবার কথা। বাবা কী ধরনের ব্যবহার করল।

অগসটে ল্যাকন না, সব পুরুষ একই ধাচের নয়। ল্যারি ডগলাস, এই যুবাপুরুষকে তার, মনে ধরেছে।

কথায় কথায় ল্যারি বলল- রাজকুমারী, বলো তো পৃথিবীতে মানুষের সেরা আবিষ্কার কী?

নোয়েল জানতে চাইল কী?

এরোপ্লেন। উড়ান পাখি না হলে আমরা এত সহজে ভ্রমণ করতে পারতাম কি? তুমি কখনও প্লেনে চড়েছ?

নোয়েল মাথা নাড়ল।

–আমি তোমাকে প্লেনে চড়াব। মনটেকে আমাদের একটা ছোটো জায়গা আছে। লঙ আইল্যান্ডের একেবারে শেষে। যখন আমি ছোটো ছিলাম, তখন সেখানে বেড়াতে যেতাম, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সিগালের দিকে। আহা, এখনও মনে পড়ে। হাঁটতে আমার মোটেই ভালো লাগে না। আমার উড়তে ভালো লাগে। ন বছর বয়সে আমি উড়ান পাখির সওয়ার হই। চোদ্দো বছরে শিখেছিলাম, কীভাবে প্লেন চালাতে হয়। এখনও আমি বেঁচে আছি। আহা, ভোরের বাতাস আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

শিগগিরই একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। জার্মানিরাই এটা বাঁধাবে।

ল্যারি, ফ্রান্স কিছুতেই আক্রান্ত হবে না। ম্যাগিনট লাইন পার হওয়া কি অত সহজ?

–তুমি একটা বোকা মেয়ে, আমি অন্তত একশোবার ওই লাইনটা পার হয়েছি। রানিসাহেবা, অবশ্যই উড়ান পাখির সওয়ার হয়ে। মনে রেখো, এটা হবে আকাশ যুদ্ধ।

একটু বাদে ল্যারি বলল- তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?

এভাবেই নোয়েলের জীবনে সুখীতম প্রহর নেমে এসেছিল।

.

রোববার। আলসেমো ভরা দিন। তারা মনতি মারতে আউটডোর কাফেতে ব্রেকফাস্ট সারল। ঘরে ফিরে গেল। সারাদিন বিছানাতে খুনসুটি করে কাটাল। নোয়েলে ভাবতেই পারছে না, কেউ এত উত্তেজক এবং আবেদনি হতে পারে। ল্যারি অশান্ত হয়ে ঘরময় পায়চারি করছে। কত গল্প বলার আছে। ফেলে আসা জীবনের গল্প। আহা, প্রতিটি শব্দ নোয়েলেকে আঘাত করছে। ভালোবাসার মৃদু শিহরণ।

ল্যারি বলল– যুদ্ধ শেষ হবার আগে আমি কিন্তু বিয়ে করতে পারব না। রানিসাহেবা, তোমার মত আছে তো?

নোয়েলে অবাক কেন? এখন বিয়ে করলে কী দোষ?

না, বিয়ে নিয়ে আমার নানা পরিকল্পনা আছে। জাঁকজমক হবে, লোকজন আসবে।

 দুজনের হাতে হাত। ল্যারি বলল- তুমি কি সত্যি আমায় ভালোবাসো?

 নোয়েলে জবাব দিল আমার জীবনের থেকেও বেশি।

দু-ঘণ্টা কেটে গেছে, ল্যারি এবার ইংল্যান্ডে যাবে। এয়ারপোর্ট অব্দি নোয়েলেকে সে নিতে চাইছে না।

সে বলল- আমি চোখের জল পছন্দ করি না।

অনেকগুলো ফ্রাঙ্ক নোয়েলের হাতে তুলে দেওয়া হল। বলা হল– রানিসাহেবা, আমার ছোট্ট রাজকুমারী, তুমি একটা সুন্দর বিয়ের গাউন কিননা, কেমন? আসছে সপ্তাহে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

সাতটা দিন কেটে গেল এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে। যেখানে ল্যারিকে নিয়ে নোয়েলে ঘুরেছিল, সেখানে আবার গেল। ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে, তা নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখল। দিনগুলো বুঝি আর কাটতে চাইছে না।

অনেক দোকানে গেল সে, বিয়ের পোশাক দেখল। শেষ পর্যন্ত একটা পেয়ে গেল। অসাধারণ সাদা অরগ্যাঞ্জা, উঁচু গলা বডিস, হাত অব্দি স্লিভ, ছটা মুক্তোর বোম। তিনটে ক্রাওল ক্রিনোলাইন পেটিকোট। নোয়েলে যা ভেবেছিল, তার থেকে বেশি খরচ হয়ে গেল। ল্যারির দেওয়া টাকা প্রায় ফুরিয়ে গেছে। নিজের টাকাও শেষ হবার মুখে। আহা, এখন তার সব কিছুই ল্যারিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। মনে হচ্ছে সে বুঝি আবার স্কুল জীবনে ফিরে গেছে।

শেষ অব্দি শুক্রবার এল। মনের ভেতর আশঙ্কা, আহা, দু ঘন্টা ধরে সে চান করল, পোশাক পরল, পাল্টাল, আবার পাল্টাল। কোন্ পোশাকে তাকে সবথেকে সুন্দরী দেখাবে, সে বুঝতেই পারছে না।

 সকাল দশটা, নোয়েলে তার বেডরুমের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহা, আজ আমাকে সত্যি স্বর্গের অপ্সরা বলে মনে হচ্ছে। ল্যারি আমায় দেখে নিশ্চয়ই ভালোবাসবে। কিন্তু সময় এগিয়ে যাচ্ছে। বারবার ফোনের দিকে সে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা ছটা বেজে গেল। এখনও ল্যারির কাছ থেকে কোনো খবর আসছে না কেন? মধ্যরাত, নোয়েলে চুপ করে চেয়ারে বসে আছে। ফোনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, যে কোনো সময় ফোনটা আর্তনাদ করে উঠবে। ভাবতে ভাবতে চেয়ারে সে ঘুমিয়ে পড়ল। তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে পোশাকটা কুঁকড়ে গেল। আহা, সে বুঝতেও পারল না।

সারাদিন সে ঘরে বসে রইল। মাঝে মধ্যে ভোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। ল্যারি নিশ্চয়ই আসবে। তাকে ফেলে কোথায় যাবে? ল্যারির প্লেন কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? ল্যারি কি হাসপাতালে শুয়ে আছে? আহত রক্তাক্ত? অথবা মারা গেছে? নোয়েলের মনে নানা দুঃস্বপ্নের আক্রমণ। সে শনিবার সমস্ত রাত জেগে কাটাল। অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘরটা ছাড়তে ভয় পাচ্ছে। কীভাবে ল্যারির কাছে পৌঁছোবে বুঝতে পারছে না।

রোববার দুপুরবেলা, ল্যারির কোনো খবর নেই। কোনো টেলিফোন নম্বর নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে খবর পাঠানো কি সহজ? সে জানে, ল্যারি আর এ এফ–এর সঙ্গে গেছে, আমেরিকান স্কোয়াড্রনে। সে টেলিফোনটা নিয়ে সুইচবোর্ড অপারেটরের সাহায্য চাইল।

অপারেটর বলল– অসম্ভব, এভাবে কারও সন্ধান করা যায় না।

নোয়েলে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করল। কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। দু ঘণ্টা বাদে সে লন্ডনের যুদ্ধমন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলল। সেখান থেকেও সাহায্যের কোনো আশ্বাস নেই। একে একে অনেকের সাথে কথা বলল। শেষ অব্দি সে বোধহয় হিস্টিরিয়াতে আক্রান্ত হল।

কী করা যাবে? নোয়েলে রিসিভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো এক ল্যারি মারা গেছে, কিন্তু কে? আমার প্রিয়তম কি?

একজন জানতে চাইল–আপনি কোন ল্যারির খোঁজ করছেন? ঈগল স্কোয়াড্রনের? তারা তো ইয়র্কশায়ারে লড়াই করছিল। আমি.ঠিক বুঝতে পারছি না।

ফোনটা স্তব্ধ হয়ে গেল, রাত এগারোটা। নোয়েলে আর ফোন করতে পারছে না।

 তবুও শেষ পর্যন্ত ফোন করল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর।

 কে?

অবশেষে নোয়েলে তার পরিচয় দিল।

অনেক দূর থেকে আবছা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

নোয়েলের মনে হল, কেউ বোধহয় একটা সত্যি গোপন করার চেষ্টা করছে।

কে? কে কথা বলছ? লেফটেন্যান্ট ল্যারি ডগলাসের কোনো খবর আছে?

–হ্যাঁ, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।

নোয়েলের মনে হল, সময় বুঝি অনন্ত।

কে যেন বলল- লেফটেন্যান্ট ডগলাস সপ্তাহ শেষে ছুটিতে গেছেন। ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি দরকার হয় তা হলে হোটেল স্যাভয় বলরুমে যোগাযোগ করুন। লন্ডনে, জেনারেল ডেভিসের পার্টিতে।

ফোনটা কে যেন কেটে দিল।

পরের দিন সকালবেলা পরিচারিকা এসেছে ঘর পরিষ্কার করার জন্য। দেখা গেল নোয়েলে মেঝের ওপর শুয়ে আছে, অচেতন অবস্থায়। কাজের মেয়ে তার দিকে তাকাল। নিজের কাজে মন দিল। ঘর থেকে চলে গেল। সে নোয়েলের মাথায় হাত দিল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

কাজের মেয়েটি নীচে নেমে গেল। ম্যানেজারকে ডেকে আনল। নোয়েলে তখন অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডাক্তার এসে তাকে পরীক্ষা করলেন। বললেন– নিউমোনিয়া হয়েছে। মেয়েটিকে এখান থেকে সরাতে হবে।

তারা নোয়েলকে স্ট্রেচারে তুলল। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে। তাকে একটা অক্সিজেন টেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। চারদিন বাদে নোয়েলের জ্ঞান এল। তখনও নোয়েলে জানে না, সে কোথায় আছে। তার মনে হল, সে বোধহয় আর কখনও জীবন্ত পৃথিবীতে ফিরতে পারবে না। নোয়েলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অবচেতনের অবস্থায় পৌঁছে গেল। তার মনে হল, ল্যারি বোধহয় তার কাঁধে হাত রেখেছে। নোয়েলে চোখ খুলল। সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন তার পালস্ দেখছে- ঠিক আছে, শেষ পর্যন্ত আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। 

আমি কোথায়?

–সিটি হাসপাতালে।

—আমি এখানে কী করছি?

 –আপনার ডবল নিউমোনিয়া হয়েছিল। আমি ইসরায়েল কাটজ।

ভদ্রলোকের বয়স বেশি নয়। মুখে বুদ্ধির ছাপ। চোখের রং ঘন বাদামী।

–আপনি কি আমার ডাক্তার?

না, আমি ইনটার্ন। আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনি সেরে উঠেছেন।

–আমি কদিন এখানে আছি?

চারদিন।

–আপনি কি অনুগ্রহ করে একটা কাজ করবেন?

–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

হোটেল লাফাইয়েতে ফোন করবেন, আমার জন্য কোনো খবর আছে কি?

 দেখছি, আমি কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত।

নোয়েলে কাটজের হাত ধরল, মিনতি করল ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার প্রেমিক আমার সঙ্গে যোগযোগ করতে পারছে না।

–ঠিক আছে, আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না। এখন আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন।

–না, আপনার কাছ থেকে খবর না পাওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমোতে পারব না।

কাটজ চলে গেল, নোয়েলে দাঁড়িয়ে থাকল। সে ভাবল, ল্যারি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে।

দু ঘন্টা কেটে গেল। ইসরায়েল কাটজ এলেন। তিনি বললেন- আপনার জামাকাপড় নিয়ে এসেছি। আমি নিজে হোটেলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো খবর নেই।

নোয়েলে অবাক চোখে তাকাল, তার চোখের জল সব তখন শুকিয়ে গেছে।

.

দুদিন বাদে হাসপাতাল থেকে নোয়েলেকে ছেড়ে দেওয়া হল। ইসরায়েল কাটজ বললেন– কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন? হাতে কোনো চাকরি আছে কি?

নোয়েলে অসহায়ের মতো মাথা নাড়ল।

কী ধরনের কাজ আপনি পছন্দ করেন?

আমি একজন মডেল।

 –আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারব।

ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথা মনে পড়ে গেল। মাদাম ডিলাইস, নোয়েলে বলল না, কারও সাহায্য আমার দরকার নেই।

ইসরায়েল কাটজ এক টুকরো কাগজে কী যেন লিখলেন–যদি মন পরিবর্তন হয়, এখানে যাবেন। একটা ছোট্ট ফ্যাশান হাউস, আমার এক কাকিমা এর মালিক। আমি আপনার ব্যাপারে আলোচনা করব। সঙ্গে টাকা আছে কি?

নোয়েলে কথা বলল না।

–এই নিন, ভদ্রলোক কিছু ফ্রাঙ্ক নোয়েলের হাতে তুলে দিলেন। আমার কাছে এখন আর নেই, জানেন তো? ইনটানদের বেশি টাকা দেওয়া হয় না।

-অনেক ধন্যবাদ।

নোয়েলে একটা ছোটো স্ট্রিট কাফেতে বসল। কফিতে চুমুক দিল। কী করবে ভাবতে থাকে। কীভাবে বাঁচবে? না, বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য আছে কি?

ল্যারি ডগলাসের ব্যাপারটা তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। ল্যারিকে শেষ করতেই হবে, কিন্তু ল্যারি কেন এমন ব্যবহার করল।

এখন তাকে একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে। রাতে মাথা গোঁজার আস্তানা। নোয়েলে তার পার্স খুলল। কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবল, দেখাই যাক না।

দেখা হল কাকিমার সঙ্গে, মধ্যবয়স, মাথার চুল ধূসর। মুখের ভাব তীক্ষ্ণ। মনটা বোধহয় দেবদূতীর মতো। তার নাম মাদার রোজ। তিনি কিছু টাকা নোয়েলের হাতে তুলে দিলেন। অগ্রিম বাবদ। একটা ছোটো অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করলেন। নোয়েলে তার বিয়ের পোশাকটা ক্লোসেটের সামনে টাঙিয়ে রাখল, যাতে সবসময় এটা চোখে পড়ে।

.

নোয়েলে বুঝতে পারল, সে গর্ভবতী, পরীক্ষার দরকার নেই, তার মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। একটা নতুন জীবন তার পেটের ভেতর ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। রাতের অন্ধকার, বুনো জন্তুর মতো চোখ জ্বলতে থাকে।

ইসরায়েল কাটজকে ফোন করল, লাঞ্চে যাবার আমন্ত্রণ।

সে বলল– আমি গর্ভবতী।

 –কোনো পরীক্ষা করেছেন?

 –পরীক্ষার দরকার নেই।

 –নোয়েলে, অনেকে এই ধরনের মিথ্যে ধারণা করে থাকে। কটা পিরিয়ড হয়নি?

 –আমি আপনার সাহায্য চাইছি।

 –গর্ভপাত করাবেন তো? ছেলের বাবার সাথে কথা হয়েছে?

–না, বাবা এখানে নেই।

 –আপনি কি জানেন গর্ভপাত বেআইনি? আমাকে গভীর সমস্যায় পড়তে হবে।

 নোয়েলে এক মুহূর্ত তাকাল আপনার মূল্য কত?

 রাগত কণ্ঠস্বর- আপনি কি টাকা দিয়ে সব কিছু কিনতে চাইছেন নোয়েলে?

–অবশ্যই, যে কোনো জিনিসই কেনাবেচা করা যায়।

তার মানে আপনি নিজেও?

 হ্যাঁ, আমার দাম অনেক, আপনি দিতে পারবেন না। আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?

-হা, করব। কিন্তু কয়েকটা পরীক্ষা করতে হবে।

–ঠিক আছে, শুরু করুন।

পরের সপ্তাহে ইসরায়েল কাটজের পরীক্ষা শুরু হল। হাসপাতালের ল্যাবোরেটরিতে নোয়েলেকে আনা হল। দুদিন বাদে এই সব পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেল।

কাটজ বললেন– আপনার অনুমান সঠিক, আপনি গর্ভবতী। আমি একটা ব্যবস্থা করেছি। আমি বলেছি, আপনার স্বামী মারা গেছে, একটা অ্যাকসিডেন্টে। আপনি ছেলেটিকে আর রাখতে চাইছেন না। আগামী শনিবার অপারেশান হবে।

-না, শনিবার নয়। আমি এখনও ভাবতে পারছি না, অ্যাবরসন করব কিনা, কদিন বাদে আমার মতামত জানাব।

মাদাম রোজ নোয়েলের ব্যবহারে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, নোয়েলের শরীর থেকে একটা আলোর দীপ্তি ক্রমশ বিকিরিত হচ্ছে। নোয়েলের মুখে লেগে আছে আত্মবিশ্বাসের হাসি। সে যেন একটা মহান সত্যকে গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

মাদাম রোজ জানতে চাইলেন– তুমি কি তোমার প্রেমিককে খুঁজে পেয়েছ? তোমার চোখ কিন্তু তাই বলছে?

-হ্যাঁ, ম্যাডাম।

–সে কি তোমার উপযুক্ত?

–হ্যাঁ, যতদিন আমি তাকে সহ্য করতে পারব।

 তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। ইসরায়েল কাটজ ফোন করলেন আপনার কাছ থেকে কোনো খবর পাচ্ছি না কেন? আপনি কি আমাকে ভুলে গেছেন?

না, নোয়েলের সংক্ষিপ্ত জবাব। আপনার কথা সব সময় মনে পড়ে।

–আপনি কেমন আছেন?

খুব ভালো।

 –আমি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আছি, কবে অপারেশনটা হবে?

–আমি এখনও তৈরি হয়নি।

 তিন সপ্তাহ কেটে গেছে, ইসরায়েল কাটজের আবার ফোন।

–আপনি কি আমার সঙ্গে ডিনার খাবেন?

 –আমি আসছি।

 একটা সস্তার কাফে। নোয়েলে ভালো রেস্টুরেন্টের কথা বলেছিল। কিন্তু ইসরায়েলের আর্থিক অবস্থার কথা শুনে চুপসে গেল।

ইসরায়েল অপেক্ষা করছিলেন। তারা অনেক বিষয়ে আলাপ করল। ডিনার শেষ হয়ে গেছে।

ইসরায়েল জানতে চাইলেন– আপনি কি অ্যারবশন করাবেন না?

-হ্যাঁ, করাব।

–তাহলে? এখনই করুন। দুমাস কেটে গেছে। কিন্তু…।

না, এখন নয় ইসরায়েল।

–এটা কি আপনার প্রথম গর্ভ?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমার কাছে কিছু উপদেশ শুনে রাখুন। তিনমাস পর্যন্ত আপনি সহজেই এটা করতে পারবেন। তারপর কিন্তু অসুবিধা হবে।

এসব কথা শুনে নোয়েলের কোনো ভাবান্তর হল না। শেষ পর্যন্ত কাটজ বললেন– নোয়েলে, আপনি কি ছেলেটাকে মানুষ করতে চাইছেন? এর কোনো পিতৃপরিচয় থাকবে না। যদি আপনি চান, তাহলে, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারি, তাহলে ছেলেটি অন্তত একটা সামাজিক স্বীকৃতি পাবে। . নোয়েলে অবাক আমি তো আপনাকে বলেছি, আমি এই ছেলেটিকে চাইছি না। আমি অ্যাবরশন করাব।

–তাহলে? যিশুখ্রিস্টের দোহাই, এটা এখনই করুন।

ইসরায়েল চিৎকার করলেন। বুঝলেন, অন্য খদ্দেররা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

–যদি আর একটু অপেক্ষা করেন তা হলে ফরাসি দেশের কোনো ডাক্তার কিন্তু রাজি হবেন না। আশা করি আমার কথার আসল অর্থ আপনি বুঝতে পেরেছেন।

–হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। যদি আমি এই বেবিটিকে রাখতে চাই তাহলে, আমায় কী ধরনের খাবার খেতে হবে?

ডাক্তার অবাক– অনেক দুধ আর ফল। কিছু মাংস।

সেই রাতে নোয়েলে মার্কেটে গিয়ে থামল। দুধ কিনল, ফলের ঝুড়ি।

দশদিন কেটে গেছে। নোয়েলে মাদাম রোজের অফিসে গেল। বলল, সে গর্ভবতী, তাকে কদিনের ছুটি দিতে হবে।

মাদাম রোজ জানতে চাইলেন- কত দিন?

ছ থেকে সাত সপ্তাহ।

মাদাম রোজ বললেন– ঠিক আছে, ছুটি নাও, তোমার হাতে কিছু অগ্রিম দেব কি?

–মাদাম, অনেক ধন্যবাদ।

.

পরবর্তী চার সপ্তাহ ধরে নোয়েলে কিন্তু অ্যাপার্টমেন্টেই ছিল। মাঝে মধ্যে মুদিখানায় যেত। খিদে তেষ্টা সব কমে গেছে। তবুও সে জোর করে অনেকটা দুধ খাচ্ছে। ওই বেবিটার জন্য। সে এই অ্যাপার্টমেন্টে এখন আর একা নয়। মাঝে মধ্যে বেবিটার সাথে কথা বলে। নোয়েলে জানে, এটা একটা ছেলে। তার নাম দিয়েছে ল্যারি।

সে বলল- তুমি অনেক বড়ো হয়ে উঠবে, অনেক শক্তিশালী। দুধ খেতে খেতে, তুমি স্বাস্থ্যের ঝলক দেখাবে।

সে বিছানাতে শুয়ে রইল। ল্যারির বিরুদ্ধে কী করে প্রতিশোধ নেবে? এই ছেলেটা তো তার একার নয়। এই ছেলেটা ল্যারিরও অংশ, ছেলেটাকে হত্যা করতে হবে। এই স্মৃতিটা নিয়ে নোয়েল বাঁচতে চায় না। নাঃ, কোনো কিছু আর ভাবতে পারছে না।

হায়, ইসরায়েল কাটজ, আমার মনের অবস্থা কী করে বুঝবেন।

প্রথমে ল্যারির ছেলেকে মারতে হবে। তারপর ল্যারিকে।

ফোনটা বেজে উঠল। নোয়েলে বিছানাতে শুয়ে আছে। স্বপ্ন হারিয়ে গেল। সে জানে, ইসরায়েল কাটজ।

এক সন্ধ্যাবেলা দরজাতে কার হাতের আওয়াজ। নোয়েলে বিছানাতে শুয়ে আছে। শব্দটা সে শুনতেই পাচ্ছে না।

ইসরায়েল কাটজ দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে গম্ভীরভাব। নোয়েলে, কখন থেকে তোমাকে ডাকছি।

দরজা খুলে গেছে। নোয়েলে উঠে এসেছে।

একী? নোয়েলের দিকে তাকালেন ইসরায়েল। বুঝতে পারলেন, এখনও বাচ্চাটা হয়নি।

–আমি ভেবেছিলাম, কোথাও কাজটা হয়ে গেছে।

না, এটা আপনাকেই করতে হবে।

–আমি বলিনি এখন এটা কেউ করতে পারবে না।

ডাক্তার অবাক হয়ে দেখলেন, চারপাশে দুধের শূন্য বোতল। টেবিলের ওপর পরিষ্কার ফল।

তার মানে? আপনি কি বেবিটাকে চাইছেন? তাহলে সেটা স্বীকার করছেন না কেন?

ডাক্তার বলুন তো, এখন বেবিটার কী অবস্থা? তার কি চোখ হয়েছে? কান হয়েছে? আঙুল? সে কি যন্ত্রণা অনুভব করে?

–নোয়েলে, কী বলতে চাইছেন?

–কিছুই না, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কী বলব।

শেষ পর্যন্ত ডাক্তার অবাক হলেন। তিনি বললেন- সত্যিই কি অ্যাবরসন চাইছেন না? আমার একজন বন্ধু আছে, তার পরামর্শ নিতে পারেন।

নোয়েলে বলল- না, এখনও সময় হয়নি। সময় হলে আমি বলব।

.

তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। ভোর চারটে। ইসরায়েল ঘুমিয়ে ছিলেন। কাজের লোকটি বলল- মঁসিয়ে, আপনার টেলিফোন। রাতের পেঁচা বোধহয়।

ইসরায়েল উঠলেন, হল পার হয়ে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।

–আমি ইসরায়েল।

 অন্যপ্রান্তের কণ্ঠস্বর তিনি বুঝতে পারছেন না।

–কে বলছেন?

ইসরায়েল, আপনি এখনই আসুন। আমি নোয়েলে, আসুন, এটা এখনই করতে হবে। আমি আর থাকতে পারছি না।

ইসরায়েল অবাক হলেন। ফোনটা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রিসিভারটা রাখলেন। মনে নানা ভাবনা। তিনি জানেন, এখন কিছু করা সম্ভব নয়। সাড়ে পাঁচ মাস কেটে গেছে। উনি কতবার বলেছেন। মেয়েটি কথা শোনেনি। এটা এখন তার দায়িত্ব, তিনি এই ঝামেলার জড়াতে চাইলেন না।

অতি দ্রুত পোশাক পরে নিলেন। তার মনের ভেতর ভীতির সঞ্চারণ।

.

ইসরায়েল কাটজ অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে পৌঁছে গেলেন। রক্তের স্রোতে নোয়েল ভাসছে। তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝি খুব ক্লান্ত। সে বিয়ের পোশাকটা পরেছে।

ইসরায়েল পাশে বসলেন– কী হয়েছে? কীভাবে?

–যিশু। রক্ত আরও গড়িয়ে আসছে।

–আমি কি অ্যাম্বুলেন্স ডাকব?

নোয়েলে উঠে দাঁড়াল। অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সে।

সে বলল– ল্যারির বাচ্চাটা মরে গেছে তার সমস্ত মুখে প্রতিশোধের আগুন।

ছজন ডাক্তার পাঁচ ঘণ্টা ধরে চেঞ্জ করলেন, নোয়েলেকে বাঁচাতে। তার সমস্ত শরীরটা সেপটিক হয়ে গিয়েছিল। আরও অনেক কিছু। না, নোয়েলে বোধহয় বাঁচবে না। পরের দিন সকাল ছটা। নোয়েলের বিপদ কেটে গেল। দুদিন বাদে সে কথা বলল। ইসরায়েল দেখতে এসেছেন।

–নোয়েলে, ডাক্তাররা বলছেন, এটা এক অলৌকিক ঘটনা।

নোয়েলে জানে, এখনও তার মরার সময় হয়নি। প্রথম প্রতিশোধের পালা শেষ হল। এটাই এক শুভ সূচনা। আরও অনেক–আরও অনেক প্রতিশোধ তাকে নিতে হবে।

.

০৩.

ক্যাথারিন, শিকাগো ১৯৩৯-১৯৪০।

যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ইওরোপের সর্বত্র এখন হিংসার বাতাবরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে উন্মাদনা আছড়ে পড়ছে।

নর্থ ওয়েস্টান ক্যাম্পাস, আরও কয়েকজন ছেলে সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

অক্টোবরের এক বিকেলবেলা। ক্যাথারিন আলেকজান্ডার ভাবল, যুদ্ধ আমাদের জীবন কতখানি পাল্টে দেয়। সব কাজ তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিন্তু কত তাড়াতাড়ি?

ক্যাথারিন রুস্টের দিকে তাকাল। যাকে চাইছে, তাকে দেখতে পারছে না। রন এল, জিয়ান এল, ক্যাথারিনের মনে হল, আনন্দের ফানুস আকাশে উড়েছে। এখন অনেক কাজ করতে হবে। রনের পাশে সে বসল। খাওয়া দাওয়া গল্প গুজব।

ক্যাথারিন বুথের দিকে হেঁটে গেল। রন মেনুর দিকে তাকাল। রন বলল–কী খাব বুঝতে পারছি না।

জিয়ান জানতে চাইল- তুই কি খুব ক্ষুধার্ত

-হ্যাঁ, কদিন ধরে উপোস চলছে।

–তাহলে ওকে খা।

সকলে অবাক হয়ে গেল। ক্যাথারিন বুথে দাঁড়িয়ে আছে। সে রনের হাতে একটা চিরকুট তুলে দিল। ক্যাশ রেজিস্টারে চলে গেল।

রন কাগজটা খুলল, হাসিতে ফেটে পড়ল। জিয়ান তাকাল।

–এটা একান্ত ব্যক্তিগত কি?

–হ্যাঁ, যা বলেছিস।

রন এবং জিয়ান বেরিয়ে গেল। রন কোনো কথা বলেনি। ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়েছে। সন্দেহ আকুল দৃষ্টিতে। হেসেছে। জিয়ানকে কাছে টেনে নিয়েছে। ক্যাথারিন তাকিয়েছে। নিজেকে বোকা বলে ভেবেছে।

ক্যাথারিন ভাবল, এবার আসল খেলা খেলতে হবে। কবোষ্ণ শরত সন্ধ্যা। সুন্দর বাতাস। লেক থেকে উঠে আসছে ভালোবাসা। আকাশ, লাল আর বাদামির সংমিশ্রণ। ভারী সুন্দর, কোমল মেঘেদের সঞ্চালন। নক্ষত্রেরা হাতের বাইরে। এমন সুন্দর এক সন্ধ্যা। ক্যাথারিন ঘটনাগুলোকে সাজাল

আমি বাড়ি ফিরে যাব, চুল ধোব।

 লাইব্রেরিতে যাব। কাল আমার ল্যাটিন পরীক্ষা।

মুভি দেখতে যাব।

 আমি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকব, প্রথম যে নাবিক আসবে, তাকে ধর্ষণ করব।

আমি নিজের কাজ নিজে করব- এটাই আমার শপথ।

 সে ক্যাম্পাসের দিকে এগিয়ে গেল। ল্যাম্পপোস্টের পাশ থেকে কে যেন এল।

ক্যাথি, তুই চললি কোথায়?

রন পিটারসন, মুখে হাসি। ক্যাথারিনের মনে আনন্দ। সে কাছে এগিয়ে এল। রন তাকে দেখছে– হ্যাঁ, দেখারই কথা।

কোথায়?

রন ভাবল।

একে কি এখনই নিতে হবে?

ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

রন জানতে চাইল তুই কি কিছু একটা করতে চাইছিস?

ক্যাথারিন বলল– এখন আমি তোমার, তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো।

 উপন্যাসে পড়া শব্দ।

রন বলল- চল্ আমরা এগিয়ে যাই।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। অনেক কথা বলার আছে। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না।

রন জিজ্ঞাসা করল ডিনার খেয়েছিস?

ডিনার? না।

–তাহলে? চাইনিজ ফুড খাবি?

–এটা আমার হট ফেভ। চাইনিজ সে ভালোবাসে না। কিন্তু এখন সব ব্যাপারে ঘাড় নাড়তে হবে।

চল আমরা চাইনিজ রেস্তোরাঁতে যাই। তুই নাম শুনেছিস?

না, এ কথাটা সে বলতে পারল না। রনকে আটকে রাখতে হবে।

তারা রনের গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। রিও কনভারটেবল। রন দরজাটা খুলে দিল। ক্যাথারিন ভেতরে বসল। সে জানে, এই সিটে বসার জন্য মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। রনের স্বাস্থ্য চমৎকার। এক বিখ্যাত অ্যাথলেট। যৌনতার সার্থক প্রতিমূর্তি। আহা, এই মুভিটার কী নাম দেওয়া যেতে পারে? যৌনকাতর পুরুষ এবং কুমারী কন্যা। আমি হয়তো ওই কুমারী কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করব।

–আমরা এখন এগিয়ে চলেছি।

ক্যাথি, তুই কিন্তু আমাকে বোকা বানিয়েছিস।

–সত্যি?

আমরা তোকে হাঁদাগঙ্গা ভাবতাম। আমরা ভাবতাম, কোনো ছেলের প্রতি তোর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই।

কথাটা অপমানজনক। ক্যাথি ভাবল। তার মানে বন্ধু-বান্ধবীরা তাকে লেসবিয়ান অর্থাৎ সমকামী বলে ভেবেছে।

তোকে পেয়ে আমার ভালো লাগছে।

–আমিও, ক্যাথি সংক্ষেপে জবাব দিল। সে জানে, রন ভালোভাবেই প্রেম দিতে পারবে। রনের কাছে শরীর দিলে অনন্ত সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। শেষ অব্দি? নাটকের ঘটনা প্রবাহ কোন দিকে এগিয়ে যাবে?

গাড়ি এগিয়ে চলেছে। হ্যাঁ, এবার কি সময় হয়েছে?

শেষ অব্দি ক্যাথি হলুদ বইয়ের কথা ভাবল। সেখানে সঙ্গমের কত রগরগে বর্ণনা থাকে। বাস্তব জীবনে তা ঘটে কি?

হাঁ, এবার বোধহয় সেটা শুরু হয়েছে। কোথায়? কিছু বোঝা যাচ্ছে না। স্বপ্ন, না সত্যি? রন সেই বস্তুটা শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। শিকারের শব্দ। কেউ কোনো কথা বলছে না।

রন তার দিকে তাকাল, কী করবে, বুঝতে পারছে না। হ্যাঁ, এসব বোধহয় স্বপ্ন। চাইনিজ রেস্তোরাঁ। ডিনারের সুস্বাদু আহবান। আহা, এত সুন্দর জীবন।

এক ওয়েটার এগিয়ে এল। ওরা মদ খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করল। এর আগে ক্যাথারিন বেশ কয়েকবার হুইস্কি খেয়েছে। এখন, নতুন বছর শুরু হতে চলেছে, চতুর্থ তারিখ, জুলাই মাস। কুমারী জীবনের অবসান, উৎসবের পরিবেশ, এখনই তো মদ খেতে হয়।

শেরি? কে যেন অর্ডার দিল। রন বলল– স্কচ আর সোডা।

ওয়েটার চলে গেল। ক্যাথারিন তাকাল, ওই প্রাচ্যদেশীয় রমণীর দিকে।

–তুই কি আর কারও সাথে কোথাও গেছিস? আমি বলতে চাইছি পুরুষবন্ধু? তোকে তো সবথেকে সুন্দরী মেয়ে বলা হয় এই ইউনিভারসিটিতে।

-না, এসব আমার সম্পর্কে বানিয়ে বলা হয়।

–না, ভ্যানতারা করিস না। তুই কিন্তু সত্যিই সুন্দরী।

-তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

গলাটা কেমন? অ্যালিস আদমে ক্যাথারিন হেপবান যেমন বলেছিল? না, এখন আমি আর ক্যাথারিন আলেকজান্ডার নই। আমি একটা সেক্স মেশিন। আমি ক্লিওপেট্টা, আমি যৌন

ওয়েটার মদের গ্লাস নিয়ে এসেছে। ক্যাথি সেটা শেষ করল। রন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রন বলল- আস্তে, আস্তে।

ক্যাথি বলল– না, আমি সহ্য করতে পারব। আমার অভ্যেস আছে।

–আর এক রাউন্ড হবে কি? রন জানতে চাইল।

 রন এগিয়ে গেল। আঃ, সত্যি ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছে।

খুব চালাকি দেখালে চলবে না। যে করেই হোক রনকে অধিকার করতে হবে।

সে বলল- তোমার কথা আমি অনেক দিন ধরে ভেবেছি।

–তাহলে এতদিন চেপে রেখেছিস কেন?

হাসছে, রন। তার নেশা হয়েছে।

ক্যাথি জোরে জোরে কথা বলছে। সে আরও সাহসী হবার চেষ্টা করল। সে বলল আঃ, পৃথিবীর যত কুমারী কন্যা, তাদের অবস্থা ভেবে আমার কষ্ট হয়। রন বলল, তাদের স্বাস্থ্য পান করা যাক। সে গ্লাসটা ওপর দিকে তুলল। দুজনে আনন্দসাগরে ভাসছে। ক্যাথারিনের মনে অনেক চিন্তা। রনকে কবজা করতে হবে। কিন্তু কী করে? নিরাপত্তা নেব কি? যা হবার তাই হবে?

ছ কোর্সের ডিনার, ক্যাথারিন সবকিছু খাবার চেষ্টা করল। চাইনিজ কাপর্বোডে যা কিছু আছে। ধীরে ধীরে সে খাচ্ছে, বিন্দুমাত্র উত্তেজনার চিহ্ন আঁকছে না তার চোখের তারায়।

রন জিজ্ঞাসা করল- কী হয়েছে? তোকে এমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে কেন?

ক্যাথারিন জবাব দিল না, এই প্রথম তোমার সঙ্গে এলাম তো, তাই।

 রন আবার তাকাল। বলল- হ্যাঁ, আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

ওয়েটার এসে ডিশগুলো নিয়ে গেল। রন চেকে টাকা মিটিয়ে দিল। রন ক্যাথরিনের দিকে তাকাল। ক্যাথারিন উঠতে পারছে না।

রন জানতে চাইল- তুই কি আর কিছু খাবি?

-নাহ, আর কিছু না। একটা সাম্পান হলে ভালো হত। আমরা ভেসে যেতাম। ক্যাথারিন বলার চেষ্টা করেছিল। তারপর সে বলল, না, আর কিছু খাব না।

কোনোরকমে একটা শব্দ উচ্চারণ করল রন। তারা উঠে দাঁড়াল। হ্যাঁ, মদ শরীরে কাজ করতে শুরু করেছে। ক্যাথারিনের পা দুটো থরথর করে কাঁপছে।

তারা বাইরে এল। এক সুন্দর রাত। বাতাস বইছে। ক্যাথারিনের মনে হল, মাথার ওপর থেকে একটা মস্ত বড় বোঝা নেমে গেছে। আজ কি ও আমাকে বিছানাতে আমন্ত্রণ জানাবে? প্রথম দেখা হলে কি কেউ ধর্ষণের কথা বলে? ওর সঙ্গে আবার ডিনারে আসতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে ওর শরীর আর মন দখল করতে হবে। এটা আমার জীবনের মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।

–মোটেলে যাবি? রন জানতে চাইল।

ক্যাথারিন তাকাল, কোনো কথা বলতে পারছে না। তার মানে? আজই আমার স্বপ্ন সফল হবে?

মোটেলে? সেখানকার ঘরে? হ্যাঁ, এটাই আমি চাইছি এবং ভীষণভাবে।

রন এবার ক্যাথারিনের কাঁধে হাত দিয়েছে, ধীরে ধীরে হাতে চাপ দিচ্ছে। ক্যাথারিন বুঝতে পারছে, তার ভেতর একটা অসম্ভব যৌনযাতনা।

সে বলল- হা, সত্যি, আমি যাব।

রন বলল তাহলে যাওয়া যাক।

তারা রনের গাড়িতে গিয়ে উঠল। ক্যাথারিনের শরীটা কাঁপছে। মনে হচ্ছে সে যেন বরফ সমুদ্রের মধ্যে পড়ে গেছে। তার মনটা ছুটে চলেছে। পক্ষিরাজের সওয়ার হয়ে।

রন ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেল। সে বলল- তোর হাত দুটো ঠান্ডা।

ক্যাথি মুখে হাসল। বলল- ঠান্ডা হাত, আর গরম পা।

আমাকে আরও সাহসী হতে হবে। সিনেমার কথা মনে পড়ল।

তারা ক্লার্ক স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চলেছে। বড়ো বড়ো চোখ জ্বলছে, মানুষ নয়, বিপদ চিহ্নের।

অনেকগুলো হোটেলের বিজ্ঞাপন। কোনোটায় লেখা আছে–কাম ইন। কোথাও ওভার নাইট মোটেল। কোথাও ডাভলেস নেস্ট। স্বপ্ন ক্রমশ বাস্তব হচ্ছে।

রন একটা মোটেলের সামনে গেল। বলল- এটাই হল সবার সেরা।

সাইনবোর্ডে লেখা আছে– প্যারাডাইস ইন। জায়গা আছে।

আহা, স্বর্গে সবসময় জায়গা থাকে। ক্যাথারিন আলেকজান্ডার সেই জায়গাটা পূর্ণ করবে।

রন গাড়ির কাছে চলে গেল। তারপর আরো কাছে এল।

অনেকগুলো বাংলো।

 রন একটা বাংলোর কাছে গেল- এটা কেমন?

দান্তের ইন ফারনোর মতো? রোমের কলোসিয়াম? সেখানে খ্রিস্টানদের ছুঁড়ে ফেলা হত সিংহের মুখে? বেলসির মন্দির? না, ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

ক্যাথারিন বলল- অসাধারণ, ভাষায় বর্ণনা করা যাচ্ছে না।

রন হাসল– আমি এক্ষুনি আসছি। সে ক্যাথারিনের গালে হাত রেখেছে। তারপর? ধীরে ধীরে সেই হাত এগিয়ে যাচ্ছে তার উরু সন্ধির দিকে। চুমুচুমু ধেয়ে আসছে। গাড়ির ভেতর এসব হচ্ছে কী?

 সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। আঃ, আবার বিমান আক্রমণ শুরু হবে যখন-তখন।

ম্যানেজারের অফিস খুলে গেল। রন বেরিয়ে এসেছে। তার হাতে একটা চাবি। সে যেন। সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। সে আরও কাছে এসেছে। সে গাড়িটা খুলল।

সে বলল- সব কিছুর ব্যবস্থা হল।

তখনও সাইরেন শোনা যাচ্ছে। এখানে থাকার জন্য পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করতে পারে কি?

ক্যাথি ভাবল।

রন বলল চলে আয়।

-তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছো?

কীসের শব্দ?

সাইরেন গাড়িটা পাশ দিয়ে চলে গেল। অনেক দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তার শব্দ।

ক্যাথি বলল– পাখির আর্তনাদ? রাত জাগা পাখি।

রনের মুখে অধৈর্যের ছাপ কিছু হয়েছে কি? কোনো সমস্যা?

ক্যাথারিন বলল না, আমি এক্ষুনি আসছি?

 সে গাড়ি থেকে নামল। বাংলোর দিকে এগিয়ে চলেছে।

–আশা করি, তুমি আমার লাকি নাম্বারটা চিনতে পেরেছ।

কী নাম্বার?

ক্যাথারিন বুঝতে পারল, এখন এমনই আবোল তাবোল কথা তাকে বলতে হবে। তার সমস্ত ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।

সে বলল- না, এমনি বললাম।

তারা একটা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তেরো নম্বর লেখা আছে। এই নাম্বারটাই ক্যাথারিনের পছন্দ। সে যদি গর্ভবতী হয়ে যায়, তা হলে ভগবান হয়তো সেন্ট ক্যাথারিনকে দোষ দেবে।

রন দরজাটা খুলে ফেলল। সে আলো জ্বালল। ক্যাথারিন বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশাল একটা বিছানা, আর একটা ইজিচেয়ার, এককোণে। ছোট্ট একটা ড্রেসিংটেবিল, আয়না ঝুলছে দেওয়ালে, রেডিও রয়েছে, আরও কত কী?

এটাই সত্যিকারের স্বর্গ? ক্যাথারিন ভাবল। রন কী করে তা দেখতে হবে। হ্যাঁ, এবারই আসল খেলা শুরু হবে।

রন বলল- কীরে তোর ভয় করছে?

ক্যাথারিন হাসার চেষ্টা করল। এটা একটা আরোপিত হাসি।

না, আমাকে অত বোকা ভাবছ কেন?

–তুই কি এটা আগে করেছিস ক্যাথি? সত্যি করে বল?

–তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?

–তোর আচরণের মধ্যে কী এক রহস্য আছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। এবার আস্তে আস্তে নিজেকে ভাঙতে হবে। আজই কি আমি আমার সবকিছু দেব? ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

-মাঝে মধ্যে মনে হয়, তুই ভীষণ সেক্সি। আবার মনে হয়, তুই বোধহয় বরফের মতো শীতল। তোর মধ্যে দুটো সত্তা কাজ করে। তুই কি সত্যি ক্যাথারিন আলেকজান্ডার?

বরফের মতো শীতল, ক্যাথি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করল। সে বলল–আমি তোমাকে আসল খেলা দেখাব।

সে এগিয়ে এল। শক্ত করে হাতে হাত রাখল। ঠোঁটের ওপর চুমু দিল।

এবার রনের উত্তর দেবার পালা, দুটো শরীর এক হয়ে গেছে। রনের হাত আনমনে খেলা করছে ক্যাথির জাগতে থাকা বুকের ওপর। খুনসুটি আর আদর। এবার বুকডগাতে জিভের ছোঁয়া, ক্যাথারিনের মনে হল, তার ভেতরে বোধহয় ক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। হ্যাঁ, প্যান্টি ভিজে গেছে। এবার? এবার আমি কি আমার আসল মুখটা দেখাব নাকি? একটা উত্তেজনা। অসম্ভব। দমন করা যাচ্ছে না।

রন ভাঙা গলায় বলল- আয় জামাকাপড় খোলা যাক।

 সে তার জ্যাকেট খোলার চেষ্টা করল।

ক্যাথি বাধা দিল না, এমনটি করো না, তুমি লক্ষ্মী ছেলে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি তোমায় ল্যাংটো করব।

কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত আভিজাত্য। অনেক রাতের স্বপ্ন। আজ সফল হতে চলেছে।

রন বোধহয় স্কুলের ছাত্র। ক্যাথারিন যৌনবিজ্ঞানের শিক্ষয়িত্রী। অনেক কিছু শিখতে। হবে।

এবার জ্যাকেট খুলে গেল। বিছানাতে ছুঁড়ে দিল। তারপর টাইয়ের দিকে হাত বাড়াল।

হ্যাঁ, এটা থাক। এবার তোকে আমি ল্যাংটো অবস্থায় দেখব। ক্যাথারিন তাকাল। জিলারের দিকে এগিয়ে গেল। এখন তার পরনে ব্রা, প্যান্টি, জুতো আর মোজা।

খেলাটা কি এখানেই শেষ করবে? নাকি আর একটু বাড়াবে?

 আনমনে বিছানার ওপর বসে পড়ল। মোজা খুলল, জুতোটাও ছুঁড়ে দিল।

রন এসে তার ব্রা-র হুকে হাত রেখেছে। দাঁত দিয়ে হুকটা খোলার চেষ্টা করছে। একটু বাদে ব্রা-টা টান মেরে সে খুলে দিল। হ্যাঁ, এখন ক্যাথি একেবারে নগ্না। তার নগ্ন সৌন্দর্যে ঔদ্ধত্যের প্রতিফলন। সে বুঝতে পারছে, এবার তাকে আসল খেলাটা খেলতে হবে। এই খেলায় সে একেবারে অনভিজ্ঞ। কিন্তু সেটা ভাবলে চলবে কেমন করে।

রন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে ফুটেছে বিস্ময়। ক্যাথি তুই এতসুন্দর? সত্যি তোর মতো রূপ আমি কখনও দেখিনি রে?

সে নীচু হয়ে বুকের ওপর চুমু খেল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে ছবিটা দেখল ক্যাথি। মনে হচ্ছে, ওই ছেলেটি বোধহয় ফরাসি দেশের এক যোদ্ধা। শৌর্যের প্রতিমূর্তি।

ক্যাথি, রন কথা বলতে পারছে না, তোর মতো এত সুন্দরী একটি মেয়ে, হায় ঈশ্বর, আমি যে কেন এতদিন তোকে আবিষ্কার করিনি।

ক্যাথারিনের ভয় ক্রমশ বাড়ছে। রন দাঁড়াল। তার মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। তার পুংদন্ডটা শক্ত হয়ে গেছে। বুঝতে পারা যাচ্ছে, এখন সে বোধহয় আর ঠিক থাকতে পারবে না। এত বড়ো? ক্যাথারিন তার জীবনে এত বড়ো দেখেনি। অবশ্য দেখার সুযোগ কোথায় পেয়েছে?

কী দেখছিস অমন করে?

ক্যাথারিন বলল- তোমার ওটার দিকে তাকিয়ে আছি।

তারপর? একটা সুন্দর হাত নেমে এল। আদর, শুধু আদর আর সোহাগ।

তখন সমস্ত ইওরোপ জুড়ে যুদ্ধের কালো ছায়া। আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। হিটলারের হাজার বছরের কর্তৃত্ব করার স্বপ্ন হয়তো সফল হতে চলেছে। তৃতীয় রাইখ বিশ্বের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে। নাজিরা ডেনমার্ক দখল করল। নরওয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করল।

গত ছমাস ধরে ক্যাম্পাসে আর কোনো গল্প নেই। যৌনতা এবং জামাকাপড় এখন গৌণ বিষয়। এখন শুধুই যুদ্ধের আলোচনা। কলেজের আরও অনেক ছেলে এখন আর্মিতে নাম লেখাচ্ছে। একদিন এক ক্লাসমেট ক্যাথারিনের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল–ক্যাথি,আমি চলে যাচ্ছি।

–কোথায়?

ওয়াশিংটন ডিসিতে।

–কেন? অবাক হয়ে ক্যাথি জানতে চেয়েছিল।

–আমি সোনার খনির সন্ধানে যাচ্ছি। ওখানে একজন মেয়ের জন্য একশো জন পুরুষ অপেক্ষা করছে।

সে ক্যাথির দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আকাল- তুই এখনও এখানে বসে থাকবি? আমার সঙ্গে চল। দেখবি পৃথিবীটা কত বড়ো।

না, আমি এখন যাব না, ক্যাথারিন বলল। কেন, সে জানে না। শিকাগো শহরের প্রতি তার আলাদা কোনো আকর্ষণ আছে কি? বাবা এখন কোমাহাতে, কেমন আছে? টেলিফোনে মাসে একবার-দুবার কথা হয়। মনে হয়, বাবা বোধহয় বন্দী জীবন যাপন করছে।

ক্যাথারিনের নিজস্ব জগৎ এখন মুঠোবন্দি হয়েছে। সে ওয়াশিংটনের কথা ভাবল। ওয়াশিংটনে কতো উত্তেজনা আছে। সন্ধ্যাবেলা বাবাকে ফোন করল, স্কুল ছেড়ে দিয়ে সে ওয়াশিংটনে কাজ করতে যাবে। বাবা বিশ্বাস করতে পারেনি। বাবা বলেছিলেন কোমাহাতে চলে আসতে। ক্যাথারিনের কণ্ঠস্বরে উদাসীনতা।

পরের দিন সকালবেলা, ক্যাথারিনের উপযুক্ত জায়গাতে পৌঁছে গেল। সে স্কুলটা ছেড়ে দেবে এমন কথা বলল। টেলিগ্রাম পাঠানো হল বন্ধু সুসি রবার্টসের কাছে। পরের দিন সে ওয়াশিংটন ডিসির দিকে যাত্রা করল, ট্রেনে চড়ে!