১. পেনসিলভানিয়া এ্যাভিনিউ

দি স্কাই ইজ ফলিং (আকাশ যখন ভাঙল) — সিডনি সেলডন

হোয়াইট হাউস থেকে একটা ব্লক দূরে পেনসিলভানিয়া এ্যাভিনিউ-এর উপর দিয়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ডিসেম্বরের কনকনে শীত। তখন, বিমান আক্রমণের সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে উঠল। হঠাৎ সে সারাজেড়োয় ফিরে গেল এবং বোমা ফেলার বুক কাঁপানো আওয়াজ শুনতে পেল। আকাশ আগুন রঙা। বিমান থেকে বোমাবর্ষণের আওয়াজ পাওয়া গেল। কাছাকাছি ঘরবাড়িগুলোর দরজা জানলা, দেওয়াল বোমার আঘাতে ভেঙে পড়ছে। মানুষজন ছুটছে।

বহুদূর থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন এল,–তুমি ঠিক আছ তো?– মেয়েটি তার চোখ খুলল।

–হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।– মেয়েটিকে সে বলে–তুমি ড্যানা ইভান্স তো? আমি WTN এ তোমার ওপর নজর রাখি প্রতি রাতে। তোমার সব বেতার ভাষণ শুনি। যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কি তুমি উত্তেজিত হয়ে ওঠো?–

–হ্যাঁ, কারণ ছিন্নভিন্ন মানুষের দেহ, শিশুদের দেহ, কুয়োয় পড়ে যাওয়া এসব মানুষকে উত্তেজিত করে।–

হঠাৎ ইভান্স-এর পেটের যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় সে ক্ষমা চেয়ে চলে গেল।

মাস তিনেক আগে ড্যানা যুগোস্লাভিয়া থেকে ফিরে এসেছে। স্মৃতি টাটকা এখনও। সারাজেভোয় মানুষের মনে হাসি ছিল না, ছিল শুধু মর্টার বিস্ফোরণের শব্দ।

ড্যানার মনে হল, জন ডোনিই ঠিক। কোন মানুষই একটা দ্বীপনয়। পৃথিবীব্যাপী ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে নিরন্তর।

স্যান্টিয়াগোয় দশ বছরের মেয়েকে তার ঠাকুরদা ধর্ষণ করে। নিউইয়র্কে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা চুমু খায়। ফ্ল্যাঙ্গার্সে সতেরো বছরের মেয়ে পঙ্গু সন্তানের জন্ম দেয়, শিকাগোয় একজন দমকল কর্মী নিজের জীবন বিপন্ন করে একটা বেড়ালের প্রাণ বাঁচায়, সাওপাওলোয় ফুটবল দেখতে গিয়ে স্টেডিয়াম ভেঙে শতশত মানুষ প্রাণ হারায়। পিসায় মা তার শিশুকে প্রথম হাঁটতে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে।

ড্যানা ভাবল ষাট সেকেণ্ডের মধ্যে এসব অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।

সাতাশ বছর বয়সের ড্যানাকে দেখতে সুন্দরী। পাতলা রোগাটে চেহারা, কোমর ছুঁই ছুঁই চুল, বুদ্ধিদীপ্ত ধূসর চোখ, গোল মুখ, উষ্ণ হাসি। ড্যানার বাবা সৈন্যবাহিনীর নির্দেশক। কর্মসূত্রে সব জায়গায় ঘুরেছেন। তার সঙ্গে ড্যানাও অভিযানের স্বাদ পেয়ে গেছে। তার কোন ভয় নেই। ড্যানা মৃত্যুকে পরোয়া না করে যুদ্ধের খবর বেতারে লাইভ টেলিকাস্ট করেছে। এতে তার খ্যতি বেড়েছে।

পেনিসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ দিয়ে দ্রুত হোয়াইট হাউস অতিক্রম করতে গিয়ে ড্যানা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে মিটিং-এ যেতে দেরি হয়ে গেল।

সিক্সথ স্ট্রিট-এর পুরো ব্লকটাই ওয়াশিংটন ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজ-এর দখলে, চারটি বিল্ডিং-খবরের কাগজ ছাপানোর অফিস, স্টক অফিস, এক্সকিউটিভ টাওয়ার, টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং কমপ্লেক্স। কমপিউটারের কী বোর্ডের শব্দে সবসময় জায়গাটা সরগরম থাকে।

এখানে জেফ বার্নসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল ড্যানা। জেফ ওয়াশিংটন ট্রিবিউন নেটওয়ার্কের স্পোর্টস রিপোর্টার। তিরিশের ভেতর বয়স। লম্বা ও রোগাটে চেহারা। আকর্ষণীয় মুখ। জেফ ও ড্যানা প্রেমে পড়েছে। ওয়াশিংটন ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজের প্রাক্তন মালিক স্টুয়ার্ট তার এই কোম্পানি ইলিয়ট ক্রমওয়েলেকে বিক্রি করে দিয়েছেন। ম্যাট বেকার এবং ইলিয়ট ক্রমওয়েলের সঙ্গে মিটিং শুরুর মুখে ম্যাট-এর সহকারী অ্যাবি ল্যাসম্যান ড্যানাকে অভিবাদন জানাল। ম্যাট বিরক্ত হয়ে বলল,–তুমি দেরী করে ফেলেছ।– ম্যাট বেকারের পঞ্চাশ বছর বয়স। রূঢ় প্রকৃতির মানুষ। অবিন্যস্ত পোশাক। WTN টেলিভিশন অপারেশন পরিচালনা করেন তিনি।

ইলিয়ট ক্রমওয়েলের বয়স ষাট, বন্ধুসুলভ, কোটিপতি মানুষ। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন খবর প্রকাশ করা তাঁর কাজ যা সর্বদা সুখকর নয়। ড্যানাকে তিনি বললেন,–ম্যাটের কাছে শুনলাম তোমার বাজারদর ক্রমশ বাড়ছে। বেতারে সংবাদ প্রচার আমি শুনি। তোমারটা একেবারে আলাদা।–

–ধন্যবাদ– ড্যানা বলল। সে জানে সে সাংবাদিক হিসাবে হাড়ির খবর টেনে বার করে আনে, অন্যদের মত ভাসা ভাসা খবর সে পরিবেশন করে না। তাই সে এত জনপ্রিয়।

ম্যাট বেকার জানতে চাইলেন,–আজও তো ইন্টারভিউ নিতে যাচ্ছ তুমি?–হ্যাঁ, গারি উইনথ্রপের। সে আমেরিকার প্রিন্স চার্মিং। প্রবীণ, সুপুরুষ।– ক্রমওয়েল বললেন,–শুনেছি সে ব্যক্তিগত প্রচার চায় না। তাই ভাবছি তুমি কি করে তাকে রাজি করালে?–আসলে আমাদের ছবি একই। সে ভ্যানগগের আর মনেট-এর ছবি কেনে আর আমি কিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকি। তার নিউজ কনফারেন্সের একটা টেপ করে নেব। এটাই আজ বিকেলের কভার। তারপরেও সাক্ষাৎকার চালিয়ে যাব।–

তাদের পরিকল্পনা মাফিক নেটওয়ার্কের নতুন শো-এর ব্যাপারে, ঘণ্টাখানেক ধরে আলোচনা চলল। সেটা অপরাধ জগতের অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা করা যা ড্যানা দীর্ঘস্থায়ী হিসাবে প্রযোজনা করতে যাচ্ছে। ম্যাট বলে,–বেতারে অনেক বাস্তব তুলে ধরা হয়েছে। তাই আরও ভাল কিছু আমাদের তুলে ধরতে হবে। অর্থলিপ্সার মত বিষয়কে আঁকড়ে ধরে থাকব যাতে শ্রোতাদের আর্কষণের সঙ্গে সঙ্গে–…ইন্টারকম বেজে উঠল কথার মাঝে। ম্যাক বিরক্ত হল,–তোমাকে না বলেছি এখন কোন কথা নয়।–

অ্যাবি বলে–দুঃখিত, কিন্তু এটা মিস ইভান্সের। ফেনাল-এর স্কুল থেকে ওর খোঁজ করা হচ্ছে।– ড্যানা রিসিভারটা নিয়ে কথা বলে। ম্যাট জানতে চাইলেন,–কার ফোন?– ড্যানা উত্তেজিত হয়ে বলল,–ফেনালকে নিয়ে আসার জন্য ওরা আমাকে স্কুলে যেতে বলল।–

ইলিয়ট জিজ্ঞেস করলেন,–সারাজেভো থেকে যে ছেলেটিকে তুমি নিয়ে এসেছিলে এ কি সে?–হ্যাঁ। বোমায় ওর একটা হাত উড়ে গেছে। আমি ওকে পোয্য নিতে চলেছি। আমি ওর অভিভাবিকা।–

থিওডোর রুজভেল্ট মিডল স্কুলে পৌঁছে ড্যানা সহকারী প্রিন্সিপালের অফিসে গিয়ে হাজির হল। ফেনাল বারো বছরের। সে একটা চেয়ারে বসেছিল। সহকারী প্রিন্সিপাল ডেরা কসটফের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। অফিসের পরিবেশ খুবই থমথমে।

হ্যালো মিসেস কসটফ–, ড্যানা বলল–ফেনাল কি আপনাদের সমস্যায় ফেলেছে?– তাঁ, বলে তিনি একটা কাগজ দিলেন ড্যানাকে। তাতে vodja, pijda, zbosti, fukati, ne zakonski, otrok, umreti, tepec… এই সব লেখা রয়েছে।

ড্যানা বলল,–এগুলো কি?– মিসেস কসকফ রেগে বললেন,–এগুলো সারবিয়ান শব্দ। এই সব কথা ফেনাল স্কুলে যখন তখন ব্যবহার করছে। আমি একটু প্রশ্রয় দিয়েছি আর ও সেই সুযোগ নিচ্ছে। ও আমাকে pijda বলে সম্বোধন করে। সব সময়েই ঝগড়া করে। আমাকেও আপমান করে।–

ড্যানা বলে,–আপনি তো জানেন ওর সঙ্গে মোকাবিলা করা কত কঠিন।– মিসেস কসটফ বললেন,–আপনি ওকে নিয়ে যান। আমি রিপোর্ট কার্ড তৈরি করে রেখেছি।–

বাড়ি ফেরার পথে ফেনাল চুপ করে রইল। ড্যানা ভাবল একে নিয়ে এখন কী করি? তাকে অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে ড্যানা বলল,–আমি স্টুডিওতে ফিরে যাচ্ছি। তুমি ভাল হয়ে থেকো।– ড্যানা এবার রিপোর্ট কার্ড দেখল–ইতিহাস, ইংরেজি ও বিজ্ঞানে ডি, সোসাল সার্ভিসে এফ আর অঙ্কে এ। ড্যানা ভাবল পরে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

ড্যানার সঙ্গে ফেনাল ভাল ব্যবহারই করে সর্বদা। তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন ড্যানা। উইক এন্ডে ড্যানা এবং জেফ ওয়াশিংটন চষে বেড়াল ফেনালকে সঙ্গে নিয়ে। ন্যাশনাল চিড়িয়াখানা ফেনালের খুব ভাল লাগল। ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম দেখে তারা খেতে গেল। ড্যানা কাজে বেরোলে ফেনাল কেমন যেন হিংস্র হয়ে ওঠে। হাউস কীপার ড্যানাকে রাতে সব বলে। যেন কোন হরর কাহিনী।

তখন বেতারে WTN-এর সান্ধ্য সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল। ড্যানার কো-অ্যাঙ্কার সুদর্শন রিচার্ড মেল্টন এবং জেফ কর্নোস তার পাশে বসেছিল। ড্যানা বলছিল বিদেশ বার্তায় ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স পাগলা গরুর রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি এখনও…দুরদর্শনের পর্দায় ফ্রান্সের শহরতলির একটা দৃশ্য। উচ্চাকাঙ্খী প্রযোজক টম হকিন্স বলল,–ড্যানা তুমি গ্যারি উইনথ্রপকে জানো? নিশ্চয়ই। সে খুব সুন্দর। চল্লিশ বছর বয়স। উজ্জ্বল দুটি চোখ মুখে হাসি।–

ড্যানা আমরা আবার একত্র হলাম। আমাকে আহ্বান করার জন্য ধন্যবাদ। –আপনাকেও ধন্যবাদ।– ড্যানা দেখল আধডজন সেক্রেটারিই স্টুডিওয় যাওয়া জরুরি মনে করল। রিচার্ড মেল্টন বলল,–আপনি আমার পাশে এসে বসুন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনার অংশটা আসছে। তারা করমর্দন করল। –আপনি জেফ কর্নোসকে চেনেন তো?–হ্যাঁ, আপনি খেলার মাঠে গিয়ে খেলেন না কেন?– জেফ বিষণ্ণভাবে বলল,–তাই তো ইচ্ছে আমার।–

ফ্রান্সের দৃশ্য দেখানো শেষ হল। এবার বাণিজ্যিক চ্যানেলের দিকে সুইচটা ঘুরিয়ে দিল। গ্যারি উইনথ্রপ তা দেখতে লাগল। জর্জ টাউন আর্ট মিউজিয়ামের বহিঃদৃশ্য। ভাষ্যকার হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বললেন, মিউজিয়ামের ভেতর মিঃ গ্যারি উইনথ্রপ মিউজিয়ামের উন্নতিকল্পে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন। মিউজিয়ামের ভেতরে দেখা যায় প্রশস্ত জায়গা। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা গ্যারি উইনথ্রপের চারপাশে। গ্যারি উইনথ্রপ বললেন, আশা করি এতে আমেরিকার তরুণ শিল্পীরা তাদের প্রকাশের সুযোগ পাবে। উপস্থিত দর্শকরা করতালি দিয়ে উঠল। এবার টেপে ঘোষক বলে উঠল, এখন স্টুডিওয় ড্যানার কাছে ফেরত যাচ্ছি। ক্যামেরার লাল আলো জ্বলে উঠল।

ধন্যবাদ।– ড্যানা বলল, মিঃ উইনথ্রপ, এই খাতে ব্যয় হবে না এর পুরোটাই তরুণ শিল্পীদের সাহায্যে ব্যয় করা হবে? আপনি কি সেনেটের নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন?–আমি ভাবছি। আমার দেশের স্বার্থে আমি কিছু করতে চাই।–ধন্যবাদ মিঃ উইনথ্রপ।–

–ধন্যবাদ।– গ্যারি উইনথ্রপ স্টুডিও ছেড়ে চলে গেল।

জেফ কর্নোস বলল, তোমাদের কী খবর বলো? ফেনালের কথা জিজ্ঞেস কোর না। ড্যানা বলল। অ্যানাগটাসিয়া ঘোষণা করল, এখন খেলাধূলা নিয়ে আলোচনা করা হবে। জেফ কর্নোস তৈরি হোন।

রাত দুটো নাগাদ গারি উইনপ্রপের টাউন হাউস ওয়াশিংটনের উত্তর পশ্চিমের সেরা জায়গায়। দুজন লোক ড্রইংরুমের দেওয়াল থেকে পেন্টিংগুলো সরাচ্ছিল। দুজনের মুখে মুখোশ।

একজন বলল, আবার কখন প্যাট্রল শুরু হয়? ভোর চারটেয়। তাদের এই নির্ধারিত সময়টা আমাদের পক্ষে খুব ভাল তাই না?–

হ্যাঁ।– একটা পেন্টিং খুলে সে আছড়ে ফেলল মেঝের ওপর। শব্দে গ্যারির ঘুম ভেঙে যায় কিনা দেখার জন্য। এই শব্দে উপর তলায় গ্যারি উইনথ্রপের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। কোন শব্দ নেই। হঠাৎ ড্রইংরুমে দুজন মুখোশ পরা লোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন,–কে তোমরা?–

মুহূর্তে সাইলেন্সর লাগানোবোরটার ট্রিগার টিপল মুখোশধারীদের একজন। গ্যারি উইনথ্রপের বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল। খুশি হয়ে তারা দেওয়াল থেকে পেন্টিং খুলতে লাগল।

.

টেলিফোনের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ড্যানার। ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় বসে রিসিভার তুলল। ম্যাটের ফোন। তাকে তাড়াতাড়ি স্টুডিওতে চলে আসতে বলছে। ভোর পাঁচটা এখন। দ্রুত পোশাক বদলে সে পাশের প্রতিবেশিনী ডরোথি হোয়ারটনের দরজায় নক করল, ডরোথি তাকে দেখে চমকে উঠল–কি ব্যাপার? কিছু যদি মনে না করো ফেনালকে স্কুলে পৌঁছে দেবে? নিশ্চয়ই। ওকে প্রাতঃরাশ করিয়ে স্কুলে দিয়ে আসব। ধন্যবাদ ডরোথি।

ড্যানা অফিসে গিয়ে ঢুকল। ম্যাট বললেন, আজ খুব ভোরে গ্যারি উইনথ্রপ খুন হয়েছেন। ড্যানা চেয়ারে বসে পড়ল ধপাস করে। কে খুন করল ওকে?–ওঁর বাড়িতে ডাকাতি হয়ে গেছে। ডাকাতরাই ওঁকে খুন করেছে। এটা হল ওদের পরিবারের পঞ্চম দুঃখজনক ঘটনা।–

ড্যানা বিস্মিত হল, পঞ্চম দুঃখজনক ঘটনা? হ্যাঁ। গতবছর গ্যারির বাবা টেলর উইনথ্রপ ও তার স্ত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। দুমাস পরে তাদের বড় ছেলে পল দুর্ঘটনায় মারা যায়। ছ সপ্তাহ পরে, তাদের মেয়ে স্কাইং করতে গিয়ে মারা যায়। আর আজ খুন হলেন গ্যারি।

জেফ বলে চলেন, ড্যানা, উইনথ্রপরা সকলেই খুব সৎ মানুষ ছিলেন। দানশীল হিসাবে বিশ্ববিখ্যাত ছিলেন। গ্যারিদের পরিবার এক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে গেল।

কি যে বলব আমি বুঝতে পারছি না। জেফ বললেন, মিনিট কুড়ির মধ্যে তোমাকে বেতারে বসতে হবে।

গ্যারির মৃত্যুর খবরে সবাই শোকাহত হয়ে পড়ল। নেতারা তাদের বক্তব্য রাখলেন। দেশে এখন বিষাদের সুর।

 পরদিন স্টুডিওয় যেতে যেতে জেফ বললেন, রাচেল এখন টাউনে। ড্যানা ভাবল কি ভাবলেশহীন হয়ে কথাটা বলল জেফ। রাচেল জেফের প্রাক্তন স্ত্রী। সে মডেল। খুব সুন্দরী। ড্যানা বলল,–তোমাদের বিয়েটা ভেঙে গেল কেন? জেফ বলল, রাচেল শুরুতে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করত। যদিও সে বেসবল খেলাটাকে ঘৃণা করত। রান্না করতে ভালবাসত। সে খুব সফল। সারা পৃথিবী জুড়ে তার কাজ। আমার বেসবল খেলা সীমাবদ্ধ ছিল আমার দেশের মধ্যেই। তাই আমাদের সন্তানও হয়নি কারণ রাচেল রাজি ছিল না সৌন্দর্য হারাবার ভয়ে। তারপর রাচেল একদিন হলিউডের পরিচালক রডরিক মার্শাল-এর ডাকে হলিউডে চলে যায়। তারপর তো সে আমার কাছে ডিভোর্স চায়। সে সিনেমায় নামেনি। তবে মডেলিং করছে। আর আমার হাত ভেঙে যাওয়ায় আমি ক্রীড়া ভাষ্যকার হয়ে যাই। তোমার কথা রাচেলকে বলেছি। সে তোমার সঙ্গে মিলিত হতে চায়।

পরদিন তারা মধ্যাহ্নভোজ সারতে গেল একসঙ্গে। ড্যানা দেখল রাচেল খুবই সুন্দরী। দীর্ঘাঙ্গী, পাতলা ছিপছিপে চেহারা। টানটান চামড়া, ড্যানার সঙ্গে রাচেলের পরিচয় করিয়ে দিল জেফ। রাচেল বলল, সারাজেভো থেকে তোমার বেতার ভাষণ অবিশ্বাস্য। তুমি খুব দুঃসাহসী কাজ করেছ। এখন চল স্ট্রেটস অব মালায় রেস্তোরাঁয় খেতে যাই। এখান থেকে দুটো ব্লক দূরে। চলো হেঁটেই যাই। ড্যানা ভাবল এই ঠান্ডায় হেঁটে যাওয়ার কেনা মানেই হয় না। ভিড়ে ঠাসা রেস্তোরাঁ। খুব নোংরা। ড্যানা ভাবল না এলেই ভাল হত। রেস্তোরাঁর মালিক তাদের দেখেই চিনতে পারল। বলল, দুঃখিত আপনাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। একটু বাদে একটা খালি টেবিল পেয়ে তারা বসল।

জেফ-এর দিকে চোখ রেখে রাচেল বলল, তোমার সেই রাতটার কথা মনে পড়ে যখন তুমি আর আমি… ড্যানা বলল, উডাং গোরেংটা কি? রাচেল জবাব দেয়, নারকেল দুধে মেশানো বাগদা চিংড়ি। জেফ এর দিকে তাকিয়ে সে আবার বলে, যে রাতে তুমি… লাকসাটা কি? ড্যানা জিজ্ঞেস করে। রাচেল বলে ওটা মশলাদার একটা নুডল স্যুপ।

আবার জেফকে বলল, তুমি বলেছিলে… পোপিয়াটাই বা কি? ড্যানাকে রাচেল বলে, ওটা নানা সবজির সঙ্গে মেশানো জিকামা স্টার ফ্রায়েড। ড্যানা ঠিক করল, আর প্রশ্ন করবে না। খেতে খেতে ড্যানা বুঝল সে এখন নিজের বদলে রাচেল স্টিভেন্সকেই বেশি । পছন্দ করতে শুরু করেছে। তার একটা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আছে। রাচেল অন্য মডেলদের মত অহংকারী নয়। তার কেনা জড়তাও নেই। জেফ একে ছেড়ে দিল কেন?– ড্যানা জানতে চাইল,–তুমি কতদিন ওয়াশিংটনে থাকবে?–কালই চলে যাচ্ছি।– এবার কোথায় যাবে? হাওয়াই। আর ওয়াশিংটনে ফিরব না বলেই মনে হয়। তুমি আর জেফ সুখী হও। তোমার সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল।–আমিও খুশি।– ড্যানা বলল আর ভাবল সে সত্যিই তাই মনে করে।

ডিসেম্বরের শুরু। এখন থেকেই ক্রিসমাস পালনে মেতে উঠেছে সবাই। ড্যানা ভাবল তাকেও মা, ফেনাল, ম্যাট, জেফ এবং তার বসের জন্য কেনাকেটা করতে হবে। সে একটা ট্যাক্সিতে উঠে হেচটোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সেটা একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স। কেনাকেটা করে উপহার সামগ্রী রাখার জন্য তার অ্যাপার্টমেন্টে গেল। ক্যালভার্ট স্ট্রিটে তার আর্কষণীয় সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট। উপহারগুলি রেখে স্টুডিওয় যাবার জন্য পা বাড়াতেই টেলিফোন এল। তার মা ফোন করেছে। মা বলল, কাল তোমার বেতার ভাষণ শুনলাম। তুমি কি বিষণ্ণতার কথা ছাড়া আর কিছু শোনাতে পার না? এ মাসে কিছু টাকার দরকার পড়েছে। ড্যানার বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর তার মাকে সে হাত খরচ দেয়। মায়ের তা কখনোই যথেষ্ট মনে হয় না। ড্যানা বলে, মা, তুমি কি আমার সঙ্গে দর কষাকষি করছ? কখনো না। লাস ভেগাস খুবই ব্যয়বহুল শহর। তাছাড়া ফেনালকে নিয়ে এসো। ওকে দেখতে চাই।

সঞ্চালিকা ড্যানা প্রতিদিন সকাল নটায় স্টুডিওতে ঢোকে আর আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দেওয়া তার কাজ। লন্ডন, প্যারিস, ইতালি ও অন্যান্য জায়গা থেকে শেষ সংবাদ সংগ্রহ করা। প্রতি সন্ধ্যায় বেতারে দুবার করে খবর প্রচার করাও তার কাজ। মা বলে, তুমি খুব ভাগ্যবতী তাই এমন একটা সহজ কাজ পেয়েছ। ধন্যবাদ মা। ড্যানা ভাবে ফেনালকে শিগগিরই মায়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জেফ আর সে বিয়ে করলে ফেনাল একটা পরিবার পাবে।

সেদিন অফিস থেকে ফিরে ডরোথির সঙ্গে দেখা। সে তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল ফেনালকে দেখার জন্য। ডরোথি বলল, এ আমার সৌভাগ্য। ডরোথি আর তার স্বামী হাওয়ার্ড বছরখানেক আগে এই বিল্ডিং-এ এসেছে। হাসিখুশি মাঝবয়সী ক্যানাডিও দম্পতি তারা। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হাওয়ার্ড। একদিন সে বলেছিল তার বিশ্বাস ওয়াশিংটন তার কাজের উপযুক্ত জায়গা। মিসেস হোয়ারটন বলেছিল, আমরা ওয়াশিংটন ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। একে আমরা ভালবেসে ফেলেছি।

ড্যানা যখন তার অফিসে ফিরে এল তখন তার ডেস্কের ওপর ওয়াশিংটন ট্রিবিউনের শেষ সংস্করণটা পড়েছিল। সামনের পৃষ্ঠা উইনথ্রপ পরিবারের খবর ও ছবিতেই ঠাসা। তার মনটা বেদনায় ভরে ওঠে। এক বছরের মধ্যেই তাদের পরিবারের মধ্যে পাঁচজন মৃত এটা ভাবতেই কেমন অবিশ্বাস্য লাগে।

ওয়াশিংটন ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজের এক্সিকিউটিভ টাওয়ারের একটা প্রাইভেট ফোনে তখন কথা হচ্ছিল–এইমাত্র আমি নির্দেশ পেলাম। –পেন্টিংগুলোর ব্যাপারে তুমি ওদের কী করতে বল? ওগুলো পুড়িয়ে ফেলাই ভাল?—

তুমি কি পাগল হয়ে গেছ! কম করে কয়েক মিলিয়ন ডলার দাম ওগুলোর।– সব কিছুই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শেষটা আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। এগুলো পুড়িয়ে ফেল। ইন্টারকমে ড্যানার সেক্রেটারি অলিভিয়া ওরাটফিন্স-এর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে

মিঃ হেনরি এই নিয়ে তিনবার ফোন করলেন। মানে থিওডোর রুজভেল্ট মিডল স্কুলের প্রিন্সিপাল থমাস হেনরি।–

ড্যানা রিসিভার তুলল–শুভ অপরাহ্ন মিঃ হেনরি। একবার এখানে আপনার যাত্রা বিরতি করেন তো খুব ভাল হয়।

নিশ্চয়ই। আর দুএক ঘন্টার মধ্যে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করছি।

.

ফেনালের কাছে স্কুলটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সে তার ক্লাসে সর্বকনিষ্ঠ। সহপাঠীরা তাকে নাটা, খর্বকায় ষাঁড়, কুচো মাছ ইত্যাদি উপনাম দিয়েছে। অঙ্কে আর কমপিউটারে তার আগ্রহ। দাবা খেলা পছন্দ করে। আগে ফুটবল খেলাও পছন্দ করত। তবে জার্সির অভাবে কোচ তাকে বাতিল করে দেয়।

ফেনাল রিকি আন্ডারউডকে পছন্দ করে না। মধ্যহ্নভোজের সময় সে তার পেছনে লাগে ও খারাপ কথা বলে। –ওহে অনাথ বালক। তোমার পাপী সম্মা তোমায় কবে ফেরত পাঠিয়ে দেবে? ফেনাল উত্তর দিল না। আমি যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি তা বুঝতে পারছ না উটমুখো? তোমার ঐ সত্য যুদ্ধ সংক্রান্ত খবর আদান প্রদানের সংবাদদাতা। তোমার মত পঙ্গুকে আশ্রয় দিয়ে সে সুনাম কিনতে চায়।

ফেনাল গালগাল দিল। তারপরে সে রিকির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রিকিও প্রস্তুত। দুজনের মারামারি লেগে গেল। রিকি ফেনালের পেটে ও মুখে ঘুষি মারল। যন্ত্রাণায় ফেনাল মেঝেতে পড়ে গেল। ফেনাল ভাবল রিকি যা বলল তা যদি সত্যি হয়। সারজেভোয় তার অভিভাবকেরা এবং বোন যখন নিহত হল ফেনাল ভেবেছিল তার জীবন শেষ হয়ে গেল। প্যারিসের বাইরে একটা অনাথ আশ্রমে তাকে পাঠানো হয়েছিল। প্রতি শুক্রবার বিকেলে তাদের দেখতে আসত পালক পিতামাতারা। যারা তাদের মধ্যে থেকে কাউকে নিয়ে যেত। প্রতি শুক্রবারই তার একটা হাত কাটা বলে সে বাতিল হয়ে যেত।

ড্যানা একদিন তার সব হতাশা দূর করে দিল। ফেনাল ড্যানাকে একটা চিঠি লিখেছিল, ড্যানা তাকে ফোন করে জানায় সে তাকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায়। ফেনাল এক অভূতপূর্ব আনন্দের স্বাদ পেল। তার মনে হল সে একা নয়, কিন্তু রিকি আন্ডারউড তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ড্যানা কোনদিন মত পরিবর্তন করে তাকে আবার অনাথ আশ্রমে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।

ফেনাল জানে স্কুলে ঝগড়া মারামারি করার জন্য ড্যানা তাকে ঘৃণা করে। রিকি তাকে বলে,–ওহে বাঁটকুল নাটা, তুমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আজ সকালের খবর, তোমার কুত্তি সত্য তোমাকে যুগোস্লাভিয়ায় ফেরত পাঠাতে যাচ্ছে।–

 ফেনাল অশ্রাব্য গালিগালাজ করে। তারপরেই দুজনের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। রক্তাক্ত দেহ নিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সত্যি ঘটনাটা ড্যানাকে বলতে পারেনি। যদি ড্যানা জানতে পারে তাহলে তাকে যদি সত্যিই ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

প্রিন্সিপাল থমাস হেনরির অফিসে প্রবেশ করে ড্যানা তাকে গম্ভীর মুখে পায়চারি করতে দেখল। ফেনাল একটা চেয়ারে বসেছিল। –সুপ্রভাত মিস ইভান্স। বসুন।–

হেনরি একটি বড় ছুরি নিয়ে বলেন এটা ফেনালের কাছে পাওয়া গেছে।

 ড্যানা ক্রুদ্ধভাবে ফেনালকে জিজ্ঞেস করল, কেন তুমি ঐ ছুরিটা নিয়ে স্কুলে এসেছো?

–বন্দুক নেই বলে।–কি বললে?– ড্যানা বলল মিঃ হেনরি, আমি আপনার সঙ্গে একা কথা বলতে পারি? হেনরি ফেনালকে বাইরে যেতে বললেন। ড্যানা বলল, মিঃ হেনরি ফেনালের বয়স মাত্র বারো। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বছরের পর বছর সে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে শুনতে বড় হয়েছে। তার বাবা, মা ও বোন নিহত হয়েছে। বোমায় তার একটা হাত উড়ে গেছে। ও অনাথ ও পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন আমরা যদি ওর প্রতি একটু সহানুভূতিশীল না হই তবে ও তো আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব এমন কাজ ও আর করবে না।

মিঃ হেনরি বললেন, আমি আপনার কথা মনে রাখব। তবে ফেনাল আবার এমন কাজ করলে তাকে শাস্তি দিতে আমি বাধ্য হব।

বাড়ি ফেরার পথে ফেনাল বলল–ড্যানা, তোমায় কষ্ট দেবার জন্য আমি দুঃখিত। না, আমি কষ্ট পাইনি। তবে তুমি আর কখনও ছুরি নিয়ে স্কুলে যাবে না।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে ড্যানা বলল, আমাকে এখন স্টুডিতে ফিরে যেতে হবে। তোমার সঙ্গে রাতে আলোচনা করব।

বেতারে সান্ধ্য খবর শেষ হতেই জেফ জানতে চাইল, তোমাকে আজ চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

যা হয়। ফেনালকে নিয়ে কী যে করব বুঝতে পারছি না। জেফ বলে ওর এখন একটু স্নেহভালবাসা আর সহানুভূতি দরকার।

ড্যানা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ফেনালকে ডাকে। বলে, স্কুলের নিয়মকানুন তোমাকে মানতেই হবে। সহপাঠীরা তোমার পেছনে লাগলেও তাদের সঙ্গে মারামারি না করে বোঝাঁপড়া করতে হবে। মারামারি করলে মিঃ হেনরি তোমাকে স্কুল থেকে বার করে দেবেন।

আমি পরোয়া করি না।

পরোয়া তোমায় করতেই হবে। তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর করে গড়ে তুলতে গেলে শিক্ষালাভ তোমায় করতেই হবে। মিঃ হেনরি সেই সুযোগ দিচ্ছেন তোমায়…

–তাকে অগ্রাহ্য করো।–

ফেনাল। ড্যানা তার গালে একটা চড় মেরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সে দুঃখিতও হয়। ফেনাল স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে পড়ার ঘরে গিয়ে, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

টেলিফোন আসে। জেফ, ড্যানা বলে, আমি খুব ঘাবড়ে গেছি। ফেনাল আবার ঝামেলা করেছে। ও অসহ্য হয়ে উঠেছে এবার। ওকে ওর মত করে বোঝাবার চেষ্টা করো। ড্যানা ভাবে তা কী করে হয়। ওর মনোভাব আমি কী করে জানব? আমি কী করে ওর দুঃখ বেদনা বুঝব?

ড্যানা তার শয়নকক্ষে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। উইক এন্ড-এ জেফ তার বাড়িতে বেশ কয়েক রাত কাটিয়ে গেছে। তার কিছু পোশাক ফেলে রেখে গিয়েছিল। ফেনাল আসার আগেই সে জেফ-এর জলি শর্টস এবং শার্ট ও ট্রাউজার পরতে শুরু করল। এভাবেই ফেনালকে রোজ সকালে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দিতে হয়।

ড্যানা ভাবল সব কিছু মানিয়ে নেবার জন্য জেফকে আরও সময় দেওয়া দরকার। আমার বাবা, মা আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। নতুন করে এয়োদশ ঐশ্বরিক নির্দেশ লেখা উচিত–যারা তোমায় ভালবাসে তাদের কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়।

ড্যানা ধীরে ধীরে নিজের পোশাক পরতে গিয়ে ফেনালের প্রিয় গানগুলোর কথা ও সুর মনে করার চেষ্টা করল।

ফেনালের স্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্টটা হাতে নিয়ে ড্যানা দেখল অঙ্কে গ্রেড এ পেয়েছে এটা খুবই ভাল লক্ষণ। এতেই তার ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।

স্টাডিরুমের দরজা খুলে ড্যানা দেখল ফেনাল বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছ। তার পান্ডুর মুখে জলের ছাপ লেগে রয়েছে। তার চিবুকে চুমু খেল ড্যানা। ফিসফিস বরে বললো, আমাকে ক্ষমা করো ফেনাল।

আগামীকাল দিনটা ভাল যাবে।

পরদিন সকালে ফেনালকে নিয়ে ড্যানা অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ উইলিয়াম উইলক্স এর চেম্বারে গেল। তিনি বললেন, ফেনালের দেহে প্রসথেথিস স্থাপন করতে কুড়ি হাজার ডলার খরচ পড়বে। ওর বয়স তো বারো। সতেরো আঠারো অবধি ওর শরীরের বৃদ্ধি চলবে। কয়েক মাস অন্তর এই সময়টায় প্রসথেসিস করাতে হবে। তাই প্রচুর আর্থিক সঙ্গতি থাকা চাই।

ড্যানা দমে গিয়ে বলল,–তাই বুঝি।–

ফেনালকে তার স্কুলে পৌঁছাতেই তার সেলফোনে ম্যাট-এর ফোন এল। –আজ দুপুরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে উইনথ্রপ খুনের ব্যাপারে একটা প্রেস কনফারেন্স হতে যাচ্ছে। তুমি ওটা কভার করবে।–

–ঠিক আছে। আমি ঠিক সময়ে হাজির হব।–

পুলিশ চিফ ড্যান বারনেট যখন গভর্ণরের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন তখন মেয়র দ্বিতীয় লাইনে অপেক্ষা করছিলেন। তারপর সেক্রেটারি জানাল চার নম্বর লাইনে হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি রয়েছেন। সারা সকাল, এভাবেই কাটল। চিফ বারনেট দুপুরে কনফারেন্স রুমে হাজির হলেন। বললেন,–গ্যারি উইনথ্রপের খুন সারা বিশ্বের ক্ষতি। তাই আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি খুনিকে ধরার। এবার আপনারা প্রশ্ন করুন। একজন সাংবাদিক জানতে চাইলেন, পুলিশ কোন সূত্র পেয়েছে কি না।–

বারনেট বললেন–রাত তিনটেয় গ্যারির বাড়ির গাড়িবারান্দায় একজন সাক্ষী দুজন লোককে ভ্যান থেকে নামতে দেখে। গাড়ির নাম্বার সে নিয়েছিল। সেটা একটা চুরি করা ট্রাকের।–এর বাড়ি থেকে কি চুরি গেছে?—

–প্রায় এক ডজন দামী পেন্টিং। টাকা বা গয়না চুরি না যাওয়ায় মনে হয় চোর শুধু সেগুলোই চুরি করতে এসেছিল।–

–চোরেরা বাড়িতে ঢুকল কী করে?–

–সেটাই ভাবছি। গেট বা দরজা ভাঙার কোন চিহ্নই তো নেই। বাড়ির কর্মচারীরা বহু বছর রয়েছেন। তারা এ কাজ করছে বলে মনে হয় না।–গ্যারি কি তখন বাড়িতে একা ছিলেন?–।– ড্যানা জিজ্ঞেস করল, চুরি যাওয়া পেন্টিং-এর কোন তালিকা আছে কি? –হ্যাঁ আছে। সেগুলো পরিচিত। তালিকা মিউজিয়াম, আর্ট ভিলা এবং সংগ্রাহকদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।– ড্যানা ভাবল চোরেরা এখনই নিশ্চয়ই পেন্টিংগুলো বিক্রি করবে না। তারা পেন্টিং চুরি করলই বা কেন আর খুনই বা করল কেন? গ্যারির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা হল পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম গির্জা ন্যাশনাল ক্যাথেড্রালে। সিক্রেট সার্ভিস এবং ওয়াশিংটন পুলিশ চারদিক ঘিরে ফেলেছে। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট, কয়েক ডজন সেনেটর ও কংগ্রেস সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, ক্যাবিনেট অফিসার ও সম্মানিত অতিথিরা হাজির ছিলেন। আর এসেছিল জনসাধারণ তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। উইনথ্রপ পরিবারকে তারা খুবই শ্রদ্ধা করত। কারণ তারা কয়েক বিলিয়ন ডলার দান করে গেছেন স্কুল, গির্জা, আশ্রয়হীন, ক্ষুধিতদের জন্য। গ্যারি উইনথ্রপও সেই দানের ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। এহেন মহান মানুষকে চোররা কেন যে খুন করল!

রাতে ড্যানার ঘুম এল না। অনেক দেরিতে যদিও বা ঘুমোল সেই ঘুম হল দুঃস্বপ্নে ভরা। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই তার মনে হয় এক বছরের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচ জন খুন হলেন। এ যে অবিশ্বাস্য।

তুমি কি আমাকে কিছু বলবে? ম্যাট বলে। আমি বলতে চাইছি এক বছরের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন খুন হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কি?–ড্যানা, তোমাকে ভাল করে না জানলে আমি সাইকিয়াট্রিস্টকে বলতাম একটা মেয়ে আমার অফিসে এসে বলছে আকাশ ভেঙে পড়ছে। তোমার কি মনে হয়, আমরা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লেনদেন করছি? তাহলে এর পেছনে কে আছে? ফিদেল কাস্ত্রো? অলিভার স্টোন? সি. আই. এ.? বিখ্যাত কেউ খুন হলে সংবাদমাধ্যম এমন ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদে বসে।– ড্যানা বলল,–আমরা এই কেসটা অপরাধের নিরিখে তদন্ত করব।–

ওয়াশিংটন ট্রিবিউনের বেসমেন্টের স্টোররুমে বসে লুরা লি হিল টেপগুলো ক্যাটালগ বন্দি করছিল। ড্যানাকে সে বলল,–তুমি ভাল কাজ করেছ গ্যারির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্প্রচার। –ধন্যবাদ। উইনথ্রপ পরিবারের কিছু টেপ দেখাও তো।– সুরা লি হিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে ঐ পরিবারের প্রচুর টেপ আছে।– ড্যানা একটা টেপ ভি. সি. আর-এ পুরে সুইচ অন করে দিল। দূরদশর্নের পর্দায় এক সুপুরুষের ছবি ভেসে উঠল। তার পাশে এক যুবক বসে। ভাষ্যকার বলে–টেলর উইনথ্রপ উষার নির্জন এক প্রান্তে শিশুদের জন্য একটি অনাথ আশ্রম খুলেছেন। তার ছেলে পলও রয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টেলর উইনথ্রপ ব্রাসেলসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবেন।– ড্যানা আবার টেপ বদল করল। হোয়াট হাউসে প্রেসিডেন্টের সামনে টেলর উইনথ্রপ। প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি ওঁকে ফেডারেল রিসার্চ এজেন্সির প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করেছি। এই সংস্থা সারা বিশ্বের উন্নতিশীল দেশগুলিকে সাহায্য করে। এর পরের দৃশ্য রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দর। দেশের বহু গণ্য ব্যক্তি টেলরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। টেলর এখানে ইতালি ও আমেরিকার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছেন। আবার টেপ বদলালো ড্যানা। প্যারিসে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে টেলর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দন করছেন। ফ্রান্সের সঙ্গে আমেরিকার ঐতিহাসিক বাণিজ্যচুক্তি সম্পন্ন করলেন টেলর উইনথ্রপ।

আর একটি টেপে দেখা যায় একটা কম্পাউন্ডে টেলর উইনথ্রপের স্ত্রী ম্যাডিলিন একদল বিকৃত ছেলেমেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি এদের জন্য একটা নতুন কেয়ার সেন্টার নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আর একটা টেপ চালিয়ে দেখা গেল হোয়াইট হাউসের সামনে টেলর উইনথ্রপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সঙ্গে তার স্ত্রী, গ্যারি, পল, জুলি। স্বাধীনতার পদক নিচ্ছেন টেলর। এবার ওভাল অফিসের দৃশ্য-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করছেন, মিঃ টেলরকে আমি রাশিয়ায় আমাদের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করছি। এই ঘটনার পরেই টেলরের পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। কালোরাডো অ্যাসপেনে অগ্নিদগ্ধ একটা বাড়ির বাইরে দৃশ্য। একজন ঘোযিকা বললেন,–রাষ্ট্রদূত উইনথ্রপ ও তার স্ত্রী ম্যাডিলিন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। বৈদ্যুতিক গন্ডগোলের জন্যই আগুন লেগে থাকবে। ড্যানা আর একটা টেপ। লাগাল। ফরাসি, রিভিয়ে ব্লয় গ্র্যান্ড করনিকের দৃশ্য। একজন সাংবাদিক বললেন,–এই সেই পথের বাঁক, সেখানে পল উইনথ্রপের গাড়িটা লাফিয়ে উঠে রাস্তা থেকে খাদে পড়ে যায় এবং পল মারা যান।– ড্যানা অন্য টেপ চালান। ঘোষক বলনেল–আলাস্কা, জুনিয়াতে পাহাড়ের বরফের ওপর স্কিইং করতে গিয়ে জুলি উইনথ্রপ দুর্ঘটনায় পড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়। গতকাল রাতে এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেন তিনি রাতে স্কিইং করতে গেলেন তা জানা যায়নি।– এর পরের টেপের দৃশ্যটা এইরকম–ওয়াশিংটনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে টাউন হাউসের চারপাশে সাংবাদিকরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। গ্যারি উইনথ্রপ গুলিতে নিহত হয়েছেন। পেন্টিং চুরি করতে এসে বাধা পেয়ে চোরেরা তাকে হত্যা করে।– ড্যানা ভাবতে থাকে কারা এই পরিবারটিকে শেষ করে দিল? কেন দিল?

হার্ট সেনেট অফিস বিল্ডিং-এ সেনেটর পেরী লেফ-এর সঙ্গে ড্যানা এক সাক্ষাৎকারের আয়োজন করল। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স লেফ-এর। উৎসাহী ও আবেগপ্রবণ মানুষ। ড্যানা তাকে বলল–সেনেটর টেলর উইনথ্রপের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন আপনি, তাই তো?–হ্যাঁ, নানা কমিটিতে আমরা কাজ করেছি।–আপনি ওঁর সম্বন্ধে কতটুকু জানেন?– লেফ বললেন,–টেলর উইনথ্রপের মত সুন্দর মানুষ আমি আর দেখিনি। তিনি মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে মিশতেন। মানুষকে ভালবাসতেন। এমন মহান মানুষের মৃত্যু সত্যিই খুব দুঃখজনক।– টেলরের সেক্রেটারি ষাটোর্ধ্ব ন্যান্সি প্যাটকিলের সঙ্গে ড্যানা কথা বলছিল। তিনি বলেছিলেন তিনি দীর্ঘ সময় টেলরের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার ছেলের অসুখের সময় তিনি পারিবারিক ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন এবং বিল মিটিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ছেলের মৃত্যু হলে তিনি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচপত্র দেন এবং আমাকে ইউরোপ পাঠান নিজের খরচায় পুত্রশোক কাটিয়ে উঠতে।– তিনি কেঁদে ফেললেন।

ড্যানা FRA-এর ডিরেক্টর জেনারেল ভিক্টর বুস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করল। টেলর এই এজেন্সির প্রধান ছিলেন। নিরাপত্তার নানা বাধা ডিঙিয়ে জেনারেল বুস্টারের সঙ্গে ড্যানার সাক্ষাতের অনুমতি মিলল। জেনারেল বুস্টার আফ্রো-আমেরিকান। টান টান মুখ। তিনি ড্যানাকে বসত বললেন। ড্যানা বলল,–আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ধন্যবাদ। –মিস ইভান্স। আপনারা সাংবাদিকরা কি মৃত মানুষকেও ছেড়ে দেবেন না? কুৎসা ছড়াবার জন্য কি কবর থেকে তুলে আনবেন তাকে?– ড্যানা দুঃখিত হল। বলল,–জেনারেল বুস্টার, অন্যের কুৎসা ছড়ানোর কোন উৎসাহ নেই আমার। আমি টেলরের একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকতে চাই তাই তার সম্বন্ধে জানতে এসেছি।–

ঝুঁকে পড়ে বললেন জেনারেল বুস্টার,–উনি একজন সৎ মানুষ ছিলেন। এই সংস্থা ওর মত ভাল পরিচালক আর পায়নি। এই হত্যা অত্যন্ত দুঃখজনক। –মিস ইভান্স, প্রেসকে আমি একেবারেই পছন্দ করি না। আপনার সারাজেভার কভারেজ আমি দেখেছি। আপনার বেতার ভাষণ কিন্তু আমাদের কোন ভাবেই সাহায্য করতে পারেনি।– ড্যানা রাগ চেপে বলে,–আপনাদের সাহায্য করতে আমি সেখানে যাইনি। নিরীহ মানুষরা কিভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে তা রিপোর্ট করতেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম।– ড্যানার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে জেনারেল বুস্টার বললেন,–আমি আপনাকে কিছু উপদেশ দিচ্ছি। আপনি তার জন্য দুঃখ করলে বহু শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে। গুডবাই।–

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ড্যানা বেরিয়ে এল। জেনারেলের সহকারী জ্যাক স্টোন ছুটে এসে ডানার কাছে জেনারেলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইল। ড্যানা তাকে বলল,–আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আমরা কোথাও বসতে পারি কি?–জ্যাক স্টোন বলে কে স্ট্রিটে শোল-এর কলোনিয়াল ক্যাফেটেরিয়া আছে। সেখানেই যাওয়া যাক।–বেশ।– ক্যাফেটেরিয়া ফাঁকা রয়েছে। জ্যাক স্টোন বলল,–আমাদের এই সাক্ষাতের কথা জেনারেল বুস্টার যেন জানতে না পারেন। তাই এটা রেকর্ডের বাইরে হবে। তিনি প্রেসকে একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই প্রেসের সঙ্গে আমি কথা বলেছি তা যেন তিনি জানতে না পারেন। এখন বলুন টেলরের সম্বন্ধে কী জানতে চান?

ড্যানা বলল,–টেলর সম্বন্ধে আমরা জেনেছি যে ভালোর সঙ্গে তার চরিত্রে কিছু দোষত্রুটিও ছিল।–হ্যাঁ। তবে ভাল দিকটাই ছিল বেশি। তিনি মানুষকে প্রকৃতই ভালবাসতেন। অন্যের সমস্যার সমাধান করতেন। পরিবারের প্রতিও তিনি দায়িত্বশীল ছিলেন। স্ত্রী ও সন্তানদের ভালবাসতেন। তবে তিনি তার সৌন্দর্য ও প্রতিভার জন্য মেয়েদের কাছে ছিলেন আকর্ষণীয়। তাই টেলরের মহিলাঘটিত নানা ঘটনা ঘটেছে। তবে মহিলা সংক্রান্ত নানা ঘটনায় জড়ালেও সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলো গোপনই ছিল।– ড্যানা বলল,–মিঃ স্টোন, কে বা কারা টেলরের পরিবারকে হত্যা করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?– জ্যাক স্টোন বললেন–আপনার কি মনে হয় তারা খুন হয়েছেন? যা আমি এ ব্যাপারে যত কম জানব ততই ভাল। আমার মতে আপনিও এ ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোবেন না। যদি একান্তই না পারেন, খুব সাবধানে এগোবেন।– একথা বলে জ্যাক স্টোন চলে গেল। ড্যানা ভাবতে লাগল যদি তার কোন শত্রু না থাকে তবে কি। তার স্ত্রী বা সন্তানই তাকে খুন করল?

ড্যানা জেফকে জ্যাক স্টোনের সঙ্গে তার কথোপকথন খুলে বলল। জেফ বলল,–বেশ আগ্রহ হচ্ছে।– ড্যানা বলল,–টেলর উইনথ্রপের ছেলে পল-এর বাগদত্তা হ্যারিয়েট বার্ক এর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।– জেফ বলল,–আমি এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আছি।– ড্যানা বলল,–তা জানি। আমি স্রেফ কিছু খবর নেব।–

একটা সুন্দর অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন হারিয়েট বার্ক। বয়স তিরিশ। পাতলা চেহারা, সোনালি চুল। সলজ্জ হাসি। ড্যানা বলল,–আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ধন্যবাদ।–মিস ইভান্স, আমি কেন যে আপনার সঙ্গে দেখা করছি জানি না।–পল-এর ব্যাপারে আমি কিছু জানতে চাই। অবশ্য আপনাদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে চাই না, আমি জানতে চাই পল কী রকম মানুষ ছিলেন?—

একটু নীরব থেকে হারিয়েট বার্ক বললেন,–পল-এর মত মানুষ আমি দেখিনি। দয়ালু, ভাবপ্রবণ মানুষ ও নিজেকে রুচিশীল মানুষ হিসাবে তুলে ধরেছিল। রসিকও ছিল। সামনের অক্টোবরে আমরা বিয়ে করব ঠিক ছিল।–

ড্যানা বলল,–আপনার কী মনে হয় পল-এর কোন শত্রু ছিল?– হ্যারিয়েট কেঁদে ফেলল। –পলকে কেউ কি খুন করতে পারে? ওর মত মানুষের শত্রু থাকা কী সম্ভব?

বাবুর্চি স্টিভ রেক্সফোর্ডের সঙ্গে সে জুলি উইনথ্রপের কাজ করত। মাঝবয়সী ইংরেজ। –জুলি উইনথ্রপের ব্যাপারে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই।–হ্যাঁ, বলুন।–কেমন মানুষ ছিলেন তিনি?–খুব ভাল মানুষ তিনি। মুখে হাসি লেগেই থাকত।–তার কি কোন শত্রু ছিল।–না।–মিস উইনথ্রপ কি কাউকে প্রত্যাখান করেছিলেন?–মিস জুলি ছিলেন মহান। তিনি ঐ ধরনের মেয়ে ছিলেন না যে কাউকে আঘাত করবেন।–

এবার ড্যানা জর্জটাউন আর্ট মিউজিয়ামের ডিরেক্টর মরগান অরমন্ড-এ সাক্ষাৎকার নিতে গেল।

মিঃ অরমন্ড, শিল্প জগতে একটা বিরাট প্রতিযোগিতা হয়েছিল না?–প্রতিযোগিতা?–একই শিল্পের পিছনে তো কখনও কখনও বহু লোক ছোটাছুটি করে?–হ্যাঁ, কিন্তু মিঃ উইনথ্রপ তেমন লোক ছিলেন না। ব্যক্তিগত প্রচুর সংগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মিউজিয়ামগুলোর প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন তিনি।–ওঁর কি কোন শত্রু ছিল?–

না, না। এ হতেই পারে না।–

ড্যানা এবার ম্যাজিলিন উইনথ্রপের খাস পরিচারিকা রোজালিন্ড লোপেজের সাক্ষাৎকার নিতে গেল। সে বলল,–উনি একজন চমৎকার মহিলা ছিলেন।–তুমি তো তার সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাটিয়েছে?–হ্যাঁ।–তার কোন শত্রুও তো থাকতে পারে।–না। তিনি অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন। সবাই তাকে ভালবাসত।–

ড্যানা অফিসে যেতে যেতে ভাবছিল, হয়তো সেই ভুল করছে।

ম্যাট বেকারের সঙ্গে দেখা করতে গেল প্রথমেই। ম্যাট বলল,–শার্লক হোমসের খবর কী?–

ওয়াটসন, আমি ভুল করেছিলাম। এর মধ্যে অপরাধমূলক কোন গল্প নেই।– ড্যানার মা এইলীনের ফোন এল। মা বলল,–একটা খবর আছে। আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।–কী বললে?– ড্যানা চমকে ওঠে।

আমি ওয়েস্টপোর্টে গিয়েছিলাম বন্ধুর কাছে। সেখানেই এই চমৎকার মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হয়।–ওঁর চাকরি আছে তো?—

উনি একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানির সেলসম্যান। আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়। তোমরা অবশ্যই আসবে। ফেনালের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি অস্থির।–

ড্যানা ভাবল উইকএন্ডে গেলেই হয়। ফেনালকে স্কুল থেকে আনবার সময় সে বলল, তুমি শিগগিরই তোমার দিদিমার সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছ। সেখানে কদিন আদর খেয়ে নিও।– ফেনাল বলল–তুমিও থাকবে তো?–হ্যাঁ, থাকব।–

ব্লাইন্ড ব্রুক রোডে পিটার টমকিন্সের বাড়িটা ছিমছাম একটা কটেজ। দরজায় এইলীন ইভান্স দাঁড়িয়েছিলেন। বয়স হলেও তার সৌন্দর্য এখনও রয়ে গেছে। তিনি ড্যানাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন–ড্যানা ডার্লিং, আর এ হল ফেনাল আমার নাতি।–

পিটার টমকিন্স বলল–ড্যানা তোমার কথা আমি মক্কেলদের বলেছি। আর এই ছেলে যে পঙ্গু তা তো বলেনি।– ড্যানা দেখল ফেনালের মুখ বিষণ্ণ হয়ে গেল। পিটার টমকিন্স আবার বলল, ওর যদি ইনসিওরেন্স করা থাকত আমার কোম্পানিতে তাহলে ও বিত্তবান হয়ে যেত। চলো ভেতরে চলে তোমরা।– ড্যানা দৃঢ়স্বরে বলল,–মা, আমরা এখনই ফিরে যাব। ঈশ্বরের কাছে প্রর্থনা করি তোমরা সুখী হও।–ড্যানা– ড্যানা আর ফেনালকে, গাড়িতে উঠে চলে যেতে দেখে তার মা অবাক হয়ে গেল। পিটার বলল,–আমি কি এমন বললাম?– এইলীন বলল,–না এমন কিছু তো বলনি।–

ফেনাল নির্বাক হয়ে আছে দেখে ড্যানা বলল–আমি দুঃখিত। কিছু মানুষ একেবারেই অজ্ঞ। তারা কোথায় কি বলতে নেই জানে না।–উনি তো ঠিকই বলেছেন। আমি তো পঙ্গু।–না, তুমি পঙ্গু নও। হাত পা দিয়ে মানুষের বিচার হয় না। তুমি একজন টিকে থাকা মানুষ। তোমার জন্য আমি গর্বিত। কিন্তু আমার খুব খিদে পেয়েছে।–

ফেনাল বিছানায় শুতে যাবার পরে ড্যানা চিন্তায় মগ্ন হল। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরিয়ে যেতে লাগল সে। সেখানে গ্যারি খুনের পর্যবেক্ষণের খবর দিচ্ছিল। ড্যানা একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে উঠে কফি খেতে খেতে তার মনে হল টাকা বা অলংকার না নিয়ে চোরেরা শুধু পেন্টিং নিয়ে গেল কেন? নিশ্চয়ই কোন বিত্তবান নিজের সংগ্রহে রাখার জন্য ভাড়াটে চোরেদের দিয়ে এই কাজ করিয়েছে।

পরদিন ফেনালকে স্কুলে পৌঁছে ড্যানা ইন্ডিয়ানা অ্যাভিনিউয়ে পুলিশ স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল। আবহাওয়া খুব ঠান্ডা। বরফ পড়ছে। গ্যারির খুনের কেসের ভারপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ফোনিঙ্গ উইলসন বলল–কোন সাক্ষাৎকার দেওয়া হবে না।– ড্যানা বলল, আমি চুরি যাওয়া ছবির তালিকাটি নিতে এসেছি। যা প্রচার করব। –এটা অবশ্য মন্দ নয়। এতে চোরেরা অসুবিধায় পড়বে ছবিগুলি বিক্রি করতে। তারা বারোটি পেন্টিং চুরি করেছে আর তারও বেশি ফেলে রেখে গেছে।– এই বলে সে উঠে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুটো ফটোকপি নিয়ে এসে ড্যানাকে দিল। একটা চুরি যাওয়া আর অন্যটা চুরি না যাওয়া ছবির তালিকা।

ড্যানা বাইরে এসে বিশ্ববিখ্যাত অকসন হাউস–ক্রিস্টিস–এর দিকে এগিয়ে চলল। বাইরে তখন প্রবল ঠান্ডা। সবাই বাড়ির দিকে যাচ্ছে ঠান্ডা ও বরফের হাত থেকে বাঁচতে। ক্রিস্টিসের ম্যানেজার তাকে চিনতে পারল। ড্যানা তাকে বলল,–এখানে পেন্টিং-এর দুটো তালিকা রয়েছে। এর দাম বলে দিতে হবে।–একটু অপেক্ষা করুন।–

ঘণ্টা দুয়েক পরে ড্যানা ম্যাট বেকারের অফিসে পৌঁছল। বলল,–আবার ষড়যন্ত্রের মতবাদেই যেতে হবে মনে হচ্ছে?–কেন?– দুই তালিকায় দেখ ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, হ্যাঁন্স, মেসিসী, পিকাগো, মনেট, আর অন্য তালিকায় দেখ কামিলি পিসাররা, মেরি লাওরেনসিস, পল ক্লী, মওরিস উট্রিলো, হেনরি লেবাসকিউ। চোরেরা যে পেন্টিংগুলো নিয়ে গেছে তার দাম দুলক্ষ ডলারের চেয়েও কম। আর পেশাদার চোর হলে গহনা, টাকাও নিয়ে যেত। কেউ হয়ত দামি পেন্টিং চুরি করতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাদের কোন জ্ঞান না থাকায় কম দামি ছবিগুলো নিয়ে গেছে। তাই মনে হয় নিরস্ত্র গ্যারিকে খুন করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।– ম্যাট বলল,–বেশ ধরে নিলাম। কিন্তু টেলর উইনথ্রপ যদি শত্রুর দ্বারা নিহত হন তবে তার পুরো পরিবারকে কেন খুন হতে হল?–সেটাই আমি জানতে চাই।–

ওয়াশিংটনের বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আরমন্ড ডিটস। সত্তর বছর বয়স।

ড্যানা তাকে বলল–আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। উইনথ্রপ পরিবারের খুনগুলো সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?–খুন? খুন কেন হবে? ওগুলো তো দুর্ঘটনা। গ্যারিই শুধু খুন হয়েছেন।–না, এগুলো খুন।– ডাঃ আরমন্ড ঝুঁকে পড়ে ড্যানাকে দেখতে লাগলেন। বললেন,–আপনি তো কিছুদিন আগে সারাজেভোয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঘুরে এসেছেন? তাই সেই ভয়ংকর যুদ্ধের পরিবেশ আপনার মধ্যে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। সেই খুনের ঘটনাগুলো আপনার কাছে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হবে। এখন আপনার অবচেতন মন কল্পনা করে যে…–ডক্টর। আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেনি। প্রমাণ না থাকলেও উইনথ্রপের মৃত্যু যে দুর্ঘটনাজনিত নয় তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। আপনি একটু বলুন যে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কি কেউ একটা গোটা পরিবারকে মুছে ফেলতে পারে?–হ্যাঁ, পারে। গৃহবিবাদ, প্রতিহিংসা থেকে এমন হতে পারে। এছাড়া অর্থজনিত কারণ তো খুনের সবচেয়ে বড় মোটিভ হতে পারে।–

উইনথ্রপ পরিবারের আইনি পরামর্শদাতা ওয়াল্টার ক্যালকিন এখন বয়সের ভারে বাতের ব্যথায় প্রায় পঙ্গু। তবে মনটা সতেজ। তিনি বললেন,–এই অঘটন আমার কাছে অবিশ্বাস্য।– ড্যানা বলল–গত বছর আইনি বা আর্থিক ব্যাপারে কি অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিল মিঃ ক্যালকিন?—

মানে?–ওদের পরিবারের কোন এক সদস্যকে নিয়মিত ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছিল?–। –না, আমি জানি না।– ড্যানা বলল তারা সবাই এখন মৃত তাই তাদের এই বিশাল সম্পত্তি এখন কে পাবে?–

–আমি মক্কেলের ব্যাপারে কারো সঙ্গে আলোচনা করি না তবুও বলছি তাদের সব সম্পত্তি চ্যারিটিতে যাবে।–

সান্ধ্য সংবাদ পরিবেশন শেষ হতেই ড্যানা দেখল ক্যামেরার লাল আলো জ্বলে উঠল। টেলিপ্রিন্টার নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠেই ফের জ্বলে উঠল। ড্যানা পড়তে শুরু করল–নিউইয়ার্স ইভে আমরা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই।– ড্যানা চমকে গেল। দেখল সামনে দাঁড়িয়ে হাসেছে জেফ। ড্যানা কামেরার দিকে তাকিয়ে বলল,–বিজ্ঞাপন বিরতির পর আমরা আবার ফিরে আসব।– ড্যানা নল রাগে বলল,–জেফ।– জেফ বলল, তোমার এ ব্যাপারে কী মত?– তারা দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হল, বলল, আমাদের দুজনেরই তাই মত।–

স্টুডিওর কর্মীরা তাদের অভিনন্দন জানিয়ে গেল।

জেফ বলল,–কেমন ধরনের বিয়ের আয়োজন তোমার পছন্দ?–

ড্যানা ছোটবেলা থেকে তার বিয়ের কথা ভেবে আসছে। লেস লাগানো সাদা গাউনটা পা ছুঁই ছুঁই হবে। এখন তাদের প্রচুর কাজ…অতিথিদের তালিকা তৈরি করা, ক্যাটারার বাছা, গির্জা বুক করা। তার এতদিনের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।– ড্যানা ভাবল ঘটা করে বিয়ের আয়োজন করলে মা ও তাঁর স্বামীকেও নিমন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু ফেনাল তাতে দুঃখ পাবে। তাই সে বলল, চল আমরা ইলোপ করি।

ফেনাল তাদের বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়ে বলল,–তার মানে জেফ আমাদের সঙ্গে থাকবেন?–হ্যাঁ, তুমি পরিবার পাবে।– ফেনাল ঘুমোবার পর ড্যানা কমপিউটার খুলে বসল–আমাদের একটা অ্যাপার্টমেন্ট চাই-দুটো শোওয়ার ঘর, বসার ঘর, দুটি বাথরুম, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর। গ্যারি টাউন হাউসের কথা মনে হল তার। সেটা নিশ্চয় খালি পড়ে আছে। সেদিন রাতে কী ঘটেছিল? চোর ঢুকলই বা কী করে?

উইনথ্রপ পরিবারের জন্য চুয়ান্নটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। ড্যানা অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধানে যখন ওয়েবসাইট পরিবর্তন করতে যাবে তখন এলোমলো অনেক কিছুই চলে এল। উইনথ্রপ, টেলর-মামলা-এর প্রাক্তন সেক্রেটারি জোয়ান সিনিসি একটি মামলা করে এবং পরে তা তুলে নেয়। ড্যানা ভাবে কী ধরনের মামলা হতে পারে এটা? ফোন করে সে এর ওপর রিপোর্ট চাইল।

পরের দিন অফিসে এসে টেলিফোন ডাইরেক্টরির পাতা ওল্টাতে লাগল। না, জোয়ান সিনিসির নাম পেল না। শো-এর প্রযোজক টম হকিন্সকে সে বলল,–টেলিফোন কোম্পানির কাউকে তুমি চেন?–হ্যাঁ।–জোয়ান সিনিসির নামে কোন টেলিফোন আছে কিনা আমায় জানাতে পারবে?–হ্যাঁ-সিনিসি টেলর উইনথ্রপের নামে একটা মামলা করেছিল এখন মনে পড়ছে।– পনেরো মিনিট পরে টম হকিন্স ফোনে বলল–খোঁজ নিয়েছি। সিনিসি এখনও ওয়াশিংটনেই আছে। ফোন নম্বর ৫৫৫২৬৯০।–ধন্যবাদ।– ড্যানা এবার ৫৫৫২৬৯০ নম্বরে ডায়াল করল। একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। –হ্যালো,–আমি ড্যানা ইভান্স বলছি। মিস সিনিসির সঙ্গে কথা বলতে চাই।–ধরুন।– একটু পরে নরম গলার এক মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল,–হ্যালো,– মিস সিনিসি? –হ্যাঁ–। –আমি ড্যানা ইভান্স বলছি।–আমি আপনার খুব ভক্ত। প্রতিদিন রাতে আমি আপনার বেতার সম্প্রসারণ দেখি,–ধন্যবাদ, আপনি যদি কয়েক মিনিট সময় দেন আমাকে, আমি একটা কথা বলতাম।–হ্যাঁ, আগামীকাল দুপুর দুটোয় আমার বাড়ি আসুন।– জোয়ান সিনিসি তার ঠিকানা দিল।

পরদিন ড্যানা সিনিসির বাড়ি গেল। এক আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট। ইউনিফর্ম পরিহিত দারোয়ান। তাকে জিজ্ঞেস করে ড্যানা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছল। বারোটি ঘরের অ্যাপার্টমেন্ট। পরিচারিকা তাকে লম্বা হলঘর পেরিয়ে বড়, সুন্দর করে সাজানো ড্রইংরুমে নিয়ে গেল। ছোটখাট রোগাটে চেহারার একজন মহিলা বসেছিল কৌচের ওপর। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল–মিস ইভান্স, আমি খুব খুশি আপনাকে সামনাসামনি দেখে।–আমিও।– চশমার নীচ থেকে সিনিসির বাদামি চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল। সে পরিচারিকাকে চা নিয়ে আসতে বলে। বিশাল দামী অ্যাপার্টমেন্টটা দেখে ড্যানার মনে হল সেক্রেটারির কাজ করে এটা সে কী করে কিনল?

জোয়ান সিনিসি বলল,–আমার মনে আছে সারাজোভা থেকে আপনি যখন সংবাদ পরিবেশন করতেন আমার ভয় হত বোমায় আপনার যদি কিছু হয়।–আমারও ভয় করত খুব।– চা খেতে খেতে ড্যানা বলে,–আমি আপনার সঙ্গে টেলর উইনথ্রপের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।– চা ছলকে পড়ে জোয়ানের স্কার্টে। ফ্যাকাসে হয়ে যায় তার মুখ। –কী হল আপনার?–না, কিছু না, তবে আমি টেলরের চাকরি বছর আগেই ছেড়ে এসেছি।–হ্যাঁ কিন্তু আপনি ওর বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিলেন– সেঁক গিলে সিনিসি বলে,–হ্যাঁ ওটা একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। তাই আদালতে আর তুলিনি কেউ আমাকে মিঃ উইনথ্রপ সম্বন্ধে ভুল বুঝিয়েছিল। পরে আমি আর মিঃ উইনথ্রপ চুক্তি করে সমঝোতায় আসি।

ড্যানার চকিতে মনে হয়, এই পেন্টহাউস বোধহয় মিঃ উইনথ্রপই কিনে দিয়েছিলেন মামলা তুলে নেওয়ার শর্ত হিসাবে।

ড্যানা মন থেকে জোয়ান সিনিসিকে সরাতে পারছিল না। কী মামলা সে করেছিল ঈশ্বরই জানেন। ড্যানার একথাও মনে হল, জোয়ান তাকে কিছু বলতে চায়। তার বাড়িতে–ফোন করল। পরিচারিকা গ্রেটা বলল,–মিস সিনিসি কোন ফোন ধরছেন না।–

পরদিন সকালে ফেনালকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে স্টুডিওর দিকে গেল ড্যানা। সূর্য উঠেছে। সান্টা জরা চ্যারিটি ঘন্টা বাজাচ্ছে। স্টুডিওয় গিয়ে খবরগুলো সম্পাদনা করল কোনটা কখন সম্প্রসারিত হবে। তারপর আবার সিনিসিকে ফোন করল। গ্রেটা বলল,–উনি আর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন না।– ড্যানা ম্যাট বেকারের সঙ্গে দেখা করতে গেল। অ্যাবি ল্যাসমান তাকে অভিনন্দন জানাল বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার জন্য।

ম্যাট-এর অফিসে গেল ড্যানা। বলল,–টেলর উইনথ্রপের প্রাক্তন সেক্রেটারির সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সে…–তুমি এখনও ওদের নিয়ে পড়ে আছ?– ড্যানা সিনিসির সব কথা ম্যাটকে বলল। ম্যাট বেকার বললেন,–সে যে তার জীবনের আশঙ্কা করছে একথা কি সে বলেছে?–না–,–তবে তুমি কী করে জানলে?–

WTN-এ সান্ধ্য সংবাদ শুনছে জোয়ান সিনিসি। ড্যানা বলছিল,–গত বারো মাসে আমেরিকায় অপরাধের হার শতকরা সাতাশ ভাগ কমে গেছে…– জোয়ান সিনিসি ড্যানার মুখটা ভাল করে নিরীক্ষণ করে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয় সে ড্যানাকে সব জানাবে।

পরদিন ড্যানা অফিসে ঢুকতেই অলিভিয়া বলল কেউ তিনবার ড্যানাকে ফোন করেছে। নাম বলেনি। নিজের ফোন নম্বরও বলেনি। আধঘন্টা পরে আবার সে ফোন করল। ড্যানা ফোন ধরল। অপর প্রান্তে জোয়ান সিনিসি। সে বলল ড্যানার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তবে বাড়িতে নয়। কারণ কেউ বোধহয় তার ওপর নজর রাখছে। চিড়িয়াখানার পক্ষীশালার সামনে যেতে বলল।

ঘন্টাখানেক বাদে ড্যানা সেখানে পৌঁছে গেল। পার্কটা ফাঁকা। ডিসেম্বরের প্রবল হিমেল হাওয়ার জন্য ভিড় ছিল না। কিন্তু ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষা করার পরও জেয়ান এল না। ড্যানা অফিসে ফিরে ফোন করল জোয়ানের বাড়িতে। রিং হয়েই গেল। কেউ তুলল না।

পরদিন সকালে খবর শুনছিল ড্যানা। স্থানীয় খবরে বলল, পেন্টহাউস অ্যাপার্টমেন্টের ১৩তম তলা থেকে একজন মহিলা পড়ে মারা গিয়েছে। তার নাম জোয়ান সিনিসি। টেলর উইনথ্রপের প্রাক্তন সেক্রেটারি। পুলিশ এর তদন্ত করছে। খবরটা শুনে ড্যানার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল।

ম্যাটকে সে বলল,–টেলর উইনথ্রপের সেক্রেটারির কথা বলেছিলাম না আপনাকে, সে মারা গেছে। গতকাল সে আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে বলে চিড়িয়াখানায় যেতে বলে। কিন্তু আমি অপেক্ষা করে চলে আসি। ফোনে সে বলেছিল তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে, আমি ওর পরিচারিকার সঙ্গে কথা বলব।–যা করবে ভেবেচিন্তে কোর।–

পেন্টহাউস বিল্ডিং-এর লবিতে পৌঁছে ড্যানা দেখে অন্য এক দারোয়ান। সে তাকে দেখে এগিয়ে আসে। ড্যানা বলে,–আমি ড্যানা ইভান্স। জোয়ান সিনিসির মৃত্যুর ব্যাপারে : খোঁজ নিতে এসেছি। কি দুঃখজনক ঘটনা।–হ্যাঁ। উনি শান্ত, নিরহঙ্কারী মহিলা ছিলেন।–ওঁর সঙ্গে কি অনেকেই দেখা করতে আসত?–না, উনি একা থাকতেই পছন্দ করতেন।–দুর্ঘটনার সময় কি তুমি ডিউটিতে ছিলে?–না। ডেনিস ছিল। তাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে।–আমি মিস সিনিসির পরিচারিকা গ্রেটার সঙ্গে কথা বলতে চাই।–

–সে তো বাড়ি চলে গেছে। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। ড্যানা একটু চিন্তা করে বলল–WTN-এর জন্য আমার বস মিস সিনিসির মৃত্যুর ব্যাপারে একটা কাহিনী তৈরি করতে বলেছেন আমাকে। তাই তার অ্যাপার্টমেন্টটা দেখতে চাই।–চলুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।–

জোয়ানের ফ্ল্যাটে সবই রয়েছে শুধু জোয়ান ছাড়া। টেরাসে এসে দারোয়ান বলল–এখান থেকেই মিস সিনিসি পড়ে গিয়েছিলেন।–

ড্যানা দেখল সেটা চারফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দিলে । সেখান থেকে কারও পক্ষে পড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

.

পুলিশ স্টেশনে প্রবেশ করে ড্যানা বলে–ডিটেকটিভ মার্কাস আব্রাহামের সঙ্গে দেখা করব।–ডানদিকে তৃতীয় দরজা দিয়ে ঢুকে যান।– ডিটেকটিভ আব্রাহাম ফাইলিং ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বিরাট চেহারা। বাদামি চোখ। ড্যানাকে দেখেই বলে,–আমি আপনাকে চিনি। আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?–

–জোয়ান সিনিসির কেসটা সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।–এটা হয় দুর্ঘটনা নয়তো আত্মহত্যার কেস। ঘটনা যখন ঘটে তখন সেখানে এক পরিচারিকা ছাড়া কেউ ছিল না। সে আবার কিচেনে ছিল।–তার ঠিকানা দিতে পারেন?–

কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে ডিটেকটিভ আব্রাহাম একটা কাগজ এনে দিল–গ্রেটা মিলার। ১১৮০ কানেকটিকাট অ্যাভিনিউ। কিন্তু সেটা একটা পার্কিংলট। জেফ বলল,–তোমার কি মনে হয় সিনিসিকে টেরেস থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।–কেউ কি জরুরি ব্যাপারে কারও সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে আত্মহত্যা করে?–আমার মতে তোমার আর এব্যাপারে না এগোনোই ভাল।–এখন আর পিছিয়ে আসতে পারি না।–

–তোমার মতে তাহলে ছজন খুন হল?–, আর এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে পুলিশকে জাল ঠিকানা দিয়ে পরিচারিকাটি উধাও হয়ে গেছে। জোয়ান সিনিসিকে নার্ভাস লাগলেও সে যে আত্মহত্যা করবে এমন মনে হয়নি।–কিন্তু আমাদের কাছে তার খুনের কোন প্রমাণ নেই।–ঠিকই। কিন্তু আমার ধারণা ভুল নয়। টেলর উইনথ্রপের নাম বলতেই জোয়ান সিনিসি ভীত হয়ে ওঠে। তার অভিযোগ গুরুতর ছিল বলেই জোয়ানকে মোটা টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল। এবার ম্যাট বললেন,–রজার হাডসনের সঙ্গে দেখা কর। তিনি সেনেটে ছিলেন এবং টেলরের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।– ড্যানা বলল,–ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিন না।– ঘন্টাখানেক পরে ম্যাট বেকার ড্যানাকে ফোন করে বললেন,–আগামী বৃহস্পতিবার দুপুরে রজার হাডসন আপনার সঙ্গে তার জর্জ টাউনের বাড়িতে দেখা করবেন।–ধন্যবাদ।– ম্যাট বেকার অফিস থেকে বেরোবার সময় ইলিয়ট ক্রমওয়েল ঢুকল। বলল,–ড্যানা, এ ব্যাপারে অহতুেক বিতর্কের সৃষ্টি করছেন। উইনথ্রপের পরিবার খুব ভাল ছিল।–তবে তো কোন চিন্তাই নেই।– ক্রমওয়েল থমকে গিয়ে বলল–এটা কি নিরাপদ লাইন?–া, WTN-এর সব খবর এক্সিকিউটিভ টাওয়ার থেকে আসছে।–