১. জীবনের পড়ন্ত বেলায়

দি আদার সাইড অফ মী (এই আমি একা অন্য) – সিডনি সেলডন

০১.

জীবনের পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে অনেক কিছু মনে পড়ে।

তখন আমি সতেরো বছরের কিশোর। চিকাগো শহরের এক ওষুধের দোকানে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করছি। এই কাজটা আমার খুবই ভালো লেগেছিল। কারণ আমি অনেকগুলো ঘুমের বড়ি সংগ্রহ করেছিলাম। আত্মহত্যা করব বলে। জানতাম না, কটা ট্যাবলেটের দরকার। হয়তো গোটা কুড়ি। হ্যাঁ, একটু একটু করে সংগ্রহ করছি, যাতে কারও নজরে না পড়ি।

আমি জানতাম, হুইস্কি এবং ঘুমের ট্যাবলেট হল মারাত্মক সংমিশ্রণ। হ্যাঁ, তাদের মেশাতে হবে। কারণ আমি মরতে চাই!

শনিবার, আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানি, সপ্তাহের শেষে মা-বাবা বাড়িতে থাকবে না। আমার ভাই রিচার্ড, এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাবে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটা থাকবে একেবারে ফাঁকা।

সন্ধ্যা ছ টা, ফার্মাসিস্ট বললেন- এবার বন্ধ করতে হবে।

উনি জানতেন না, ওনার এই কথাটার মধ্যে একটা আলাদা অর্থ লুকিয়ে ছিল। হ্যাঁ, এবার সবকিছুই বন্ধ করতে হবে।

.

১৯৩৪– আমেরিকার ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে কালো মেঘ। স্টক মার্কেট, একটার পর একটা ব্যাঙ্ক দরজা বন্ধ করছে। ব্যবসায়ে দেখা দিয়েছে মন্দা। এক কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। তখন তারা বেপরোয়া। দশ লক্ষ ভবঘুরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু-লক্ষ শিশুর মুখে অন্ন নেই। হ্যাঁ, আমরা সাংঘাতিক অর্থনৈতিক অবনতির মোকাবিলা করছি। আগে যাঁরা ছিলেন কোটিপতি তাঁদের অনেকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, বিখ্যাত আধিকারিকরা পথেঘাটে আপেল বিক্রি করছেন।

তখনকার সবথেকে জনপ্রিয় গান ছিল  বিষণ্ণ রবিবার !

হ্যাঁ, এই জগতটা একেবারে অন্ধকার। আমি হতাশার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছি। জীবনের কোনো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছি না।

আমরা লেক মিশিগানে থাকতাম, সমুদ্র থেকে কয়েক কদম দূরে। একরাতে আমি সেখানে চলে গিয়েছিলাম। সে এক পাগল হাওয়ার ডাক, আকাশে মেঘের ওড়াওড়ি। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম– যদি ঈশ্বর বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে আমাকে আলো দেখাও।

হঠাৎ আমি দেখলাম, মেঘেরা একটা সুন্দর মুখচ্ছবি তৈরি করেছে। বিদ্যুৎ রেখা। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ভয়ে আমি বাড়িতে পালিয়ে এলাম।

রজারস পার্কের তিনতলার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে পরিবারের সঙ্গে বাস করতাম। সেখানে দিনগুলো কোনোরকমে কেটে যেত।

শেষ অব্দি আমি আমার ওই ভয়ংকর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলাম। একেবারে ফাঁকা। মা-বাবা বেরিয়ে গেছে। ভাইও নেই। আমার পরিকল্পনার অন্তরায় বলতে কেউ নেই।

আমি ছোট্ট বেডরুমে গেলাম। রিচার্ড আর আমি সেখানে থাকি। ড্রয়ারের ভেতর ঘুমের ট্যাবলেট লুকোনো ছিল। আমি কিচেনে গেলাম। সেলফ থেকে জলের বোতল বের করলাম। আবার তাকালাম ট্যাবলেটগুলোর দিকে। হ্যাঁ, এবার কাজটা শুরু করতে হবে। হুইস্কি খেয়ে ফেললাম, গলা বুজে এল। তারপর? কয়েকটা ঘুমের ট্যাবলেট। কে যেন বলল, তুমি কী করছ?

আমি চারদিকে তাকালাম– হ্যাঁ, বাবা দাঁড়িয়ে আছে। বেশ, তুমি মদ খাচ্ছো?

আমি অবাক– আমি ভেবেছি তুমি চলে গেছে।

–একটা জিনিস ভুলে গিয়েছিলাম। বাবা ছুটে এল। আমার হাত থেকে হুইস্কির বোতলটা নিয়ে নিল।

আমার মন বলার চেষ্টা করছে, কিছুই না।

 বাবা রেগে গেছে- সিডনি, কী হয়েছে?

বাবা ঘুমের ট্যাবলেটগুলো দেখল, কী হচ্ছে? এগুলো কেন?

আমি শান্তভাবে বলেছিলাম আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না।

কিছুক্ষণের নীরবতা।

বাবা বলল- তুমি এত বিষঃ কেন?

তুমি আমাকে বাধা দিতে পারবে না। আজ অথবা কাল আমি আত্মহত্যা করবই।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল– এটা তোমার জীবন, যা খুশি করতে পারো। চল, আমরা একটু বেড়িয়ে আসি।

আমি জানি না, বাবা কী ভাবছে। আমার বাবা একজন সেলসম্যান। সে হয়তো আমার মন পাল্টাবার চেষ্টা করছে।

আমি বললাম ঠিক আছে, চলো।

–কোটটা পরে নাও, ঠান্ডা লাগিয়ে কী লাভ?

পাঁচ মিনিট বাদে বাবা আর আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছি। রাস্তাঘাটে কেউ নেই, তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

অনেকক্ষণের নীরবতা ভেঙে বাবা বলল- তুমি কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে?

এ প্রশ্নের জবাব কী দেব? আমি কী জানি? আমার সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমার অতীত গ্লানিময়।

কলেজ যেতে চেয়েছিলাম, পকেটে পয়সা নেই। ভেবেছিলাম, লেখক হব, বারোটা ছোটো গল্প লিখেছিলাম। বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠিয়েছি। হ্যাঁ, প্রত্যেকটা ফেরত চলে এসেছে। শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করেছি, জীবনের বাকি দিনগুলো এই দরিদ্রতার মধ্যে কাটাতে পারব না।

বাবা গল্প করছিল– হ্যাঁ, সিডনি, তুমি পৃথিবীর অনেক জায়গাতে যাওনি।

আমি বাবার দিকে তাকালাম, বাবা কি আজ যাবে না? তা হলে আমার পরিকল্পনাটা সফল হবে না!

-তুমি কী রং ভালোবাসো?

বাবা কি এভাবে আমাকে বদলাতে পারবে?

সিডনি, তুমি একজন লেখক হতে চাইছ, তাই তো?

 –এটা গতকালের ঘটনা, আমি বললাম।

–তাহলে আগামীকাল কী বলবে?

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম জানি না।

সিডনি, জীবন এক উপন্যাসের মতো। এখানে উত্তেজনা আছে। তুমি জানো না, শেষ পাতায় কী রহস্য অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

আমি জানি, সেখানে আছে কেবল শূন্যতা।

–না, প্রত্যেকটি পাতা আলাদা গল্প বলে, সিডনি। তুমি পাতাগুলো উল্টে যাও।

আমি বাবার দিকে তাকালাম– প্রত্যেকটা আগামীকাল কি নতুন সফলতা নিয়ে আসে?

আমরা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।

 বাবা বলল- সিডনি, সত্যি তুমি যদি জীবনের শেষ পর্বে পৌঁছোতে চাও, তাহলে তা করতে পারো। কিন্তু আমি বলব, এখনও সময় হয়নি, তোমাকে অনেক কিছু লিখতে হবে, নিজের হাতে। তা না হলে জীবনটা পরিপূর্ণ হবে না। বইটা এখন বন্ধ করো না, কাল কোনো একটা অভাবিত ঘটনা ঘটতে পারে।

জানি না, বাবার কথার মধ্যে কী জাদু ছিল, কয়েক পা হেঁটে আমি ঠিক করলাম, এখনই এই পরিকল্পনাটা মুলতুবি রাখতে হবে।

সম্ভাবনার দুয়ার তো উন্মুক্ত রইলই।

.

০২.

চিকাগোয় জন্মেছিলাম, একটা কিচেন টেবিলে, যেটা নিজের হাতে তৈরি করেছিলাম। আমার মা নাতালিয়া, তেমন কথাই বলে থাকে। আমার মা আমার জীবনের ধ্রুবতারা। আমার সর্বক্ষণের সঙ্গিনী। আমি ছিলাম মায়ের সবথেকে বড়ড়া সন্তান। মা আমার সাথে সর্বক্ষণ কথা বলত। আমি নাকি ছোটোবেলায় ছিলাম বুদ্ধিদীপ্ত। দেখতে সুন্দর, ঝকঝকে ব্যক্তিত্বের অধিকারী তখন আমার ছ-মাস বয়স।

মা-বাবাকে কখনও মা-বাবা বলে ডাকিনি। ডাকতাম নাতালিয়া-অটো বলে। কারণ বয়সে তারা ছিল খুবই ছোটো।

মা জন্মেছিল রাশিয়াতে। ওডেসা শহরের কাছে। জারের শাসনের সময়। দশ বছর বয়সে মা আমেরিকাতে চলে আসে দিদিমা আনার সাথে। মা সত্যি এক চিরবিস্ময়কর সুন্দরী। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। মসৃণ বাদামি চুল। ধূসর দুটি চোখের তারায় বুদ্ধির বিকাশ। অসাধারণ তনুবাহার। আত্মার ভেতর রোমান্টিক উদ্ভাবনা। অন্তর্মুখী সম্ভাবনা। মায়ের কোনো ব্যবহারিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু নিজে নিজে পড়তে শিখেছিল। শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতে ভালোবাসত। বই পড়ত পাগলের মতো। ভেবেছিল, রাজকুমারকে বিয়ে করবে। সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াবে।

শেষ অব্দি ওই রাজকুমার হল অটো। চিকাগো শহরের এক সংগ্রামী। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার পর স্কুল ছেড়ে চলে এসেছে। দেখতে ভারী সুন্দর। তাই নাতালিয়া তাকে ভালোবেসে ফেলল। শেষ অব্দি ভালোবাসাটা বিয়েতে পর্যবসিত হল।

আমার বাবা, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত। বেশির ভাগ স্বপ্নই সফল হত না। তাতে কী আসে যায়!

দুভাই– স্যান এবং অ্যাল, তিন বোন– পাউলিন, নাতালি এবং ফ্যান। এই হল আমার মামার বাড়ির বংশ পরিচয়।

এবার বাবাদের কথা বলি। দুভাই হ্যারি এবং অটো, পাঁচ বোন– রোজ, বেথ, এমা, মিলগ্রেড এবং টিলি।

বাবারা ছিল বহির্মুখী। মায়ের বাড়ির সকলে অন্তর্মুখী। সুসংহত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। দুটি পরিবারের মধ্যে অনেক তফাৎ। কিন্তু ভাগ্য তাদের এক জায়গায় নিয়ে এল।

আমার জ্যাঠামশাই, হ্যারি, এই পরিবারের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। পাঁচ ফুট দশ। পৌরুষ ঝরে পড়ছে চেহারাতে। ব্যক্তিত্বের চমক। বিয়ে হয়েছিল পাউলিনের সাথে, অর্থাৎ আমার মাসি। চারটি সন্তানের জন্ম হয়- সিমুর, এডি, হাওয়ার্ড, এবং স্টিভ। সিমুর আমার থেকে বছর ছয়েকের বড়ো। কিন্তু মনে হত সে যেন আরও বেশি ভারিক্কি।

মামার বাড়ির সকলের মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। বিশেষ করে অ্যালের কথা বলতে খুবই ইচ্ছে করছে। সে কথা বলে সবাইকে জয় করত। হ্যাঁ, এক অসাধারণ চরিত্র।

কাকারা এক জায়গায় জমা হলে হৈ হৈ বেধে যেত। মাঝে মধ্যে তারা একটা রহস্যজনক বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। যাকে আমরা যৌনতা বলতে পারি। আমি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে ওঠার জন্য প্রার্থনা করতাম।

বাবা দুহাতে খরচ করত, ভবিষ্যতের জন্য ভাবত না। দামী রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুদের খাওয়াত। বিল এলে কারও কাছ থেকে টাকা ধার করত।

নাতালি এই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারত না। ভীষণ দায়িত্ব জ্ঞান ছিল তার। আমি বড়ো হলাম। বুঝতে পারলাম, ওরা একে অন্যের পরিপন্থী। আমার মা এমন এক জনকে বিয়ে করেছে যাকে শ্রদ্ধা করতে পারে না। এমন একটা জীবন কাটাচ্ছে, যা ওই পুরুষ কোনোদিন বুঝতে পারবে না।

তারা সবসময় ঝগড়া করত। মাঝে মধ্যে ঝগড়ার মধ্যে তিক্ততা ঝরে পড়ত। আমি ঝগড়া থামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারতাম না। তখন আমি পালিয়ে যেতাম হার্ডি বয়েজের রহস্যজগতে, সেখানে প্রাণের শান্তি মিলত।

একদিন স্কুল থেকে বাড়ি এলাম। বাবা মা চিৎকার করছে, অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করছে। আমি ঠিক করলাম, এখানে আর থাকব না। কিন্তু যাব কোথায়? মাসি পাউলিনের কাছে গেলাম। মাসি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।

পাউলিন আমাকে বলল কী হয়েছে?

আমার চোখে জল– মা বাবার ঝগড়া। আমি কী করব?

–তোর সামনে?

আমি ঘাড় নাড়লাম।

-ঠিক আছে, সিডনি, ওরা দুজনেই তোকে ভালোবাসে, ভবিষ্যতে ওরা যখন ঝগড়া করবে, তুই থামাবার চেষ্টা করবি, কেমন?

মাসির উপদেশ ফলে গেল। আমি ঝগড়া হলেই সামনে যেতাম। বলতাম, না, আমার সামনে ঝগড়া করতে লজ্জা করছে না।

ওরা দুজনেই দুঃখ পেত। সন্ধি করত, আবার ঝগড়া এবং আবার সন্ধি।

এক শহর থেকে অন্য শহরে আমার বাবা তখন চাকরির সন্ধানে মগ্ন। কিন্তু এভাবে কি দিন কাটে? টেকসাসে সে একটা জুয়েলারি দোকানে কাজ করল। চিকাগোতে একটা কাপড়ের দোকানে। আরিজোনাতে একটা রুপোর খনিতে। লস এঞ্জেলসে হল সেলসম্যান।

 বছরে দুবার অটো আমাকে নিয়ে যেত দোকানে। দামী জামাকাপড় কিনে দিত। আহা, আমার মন আনন্দে ভরে উঠত।

১৯২৫- রিচার্ডআমার ভাইয়ের জন্ম হল। তখন আমার বয়স আট বছর। আমরা তখন ইন্ডিয়ানা প্রদেশের গ্যারিতে বাস করছি। ভাইকে পেয়ে আমার মন আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম, ভাইকে নিয়েই আমার দিনগুলো আনন্দে কেটে যাবে।

এল অর্থনৈতিক মন্দা। অ্যালিসের মতো আমি এক অদ্ভুত জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। অটো তখন বেশির ভাগ সময় বাইরে কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। নাতালিয়া, রিচার্ড আর আমি একটা সঁতসেঁতে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।

হঠাৎ একদিন বাবা এসে বলল সে নাকি প্রতি সপ্তাহে হাজার ডলার করে পাবে। আমরা অন্য একটা শহরে সুন্দর পেন্ট হাউসে থাকব। এবার বোধহয় স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে।

কিন্তু স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল। কয়েক মাস বাদে বাবার এই পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেল। আবার আমাদের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসতে হল। অন্য একটা শহরে।

নিজেকে যাযাবর বলে মনে হত। সব সময় বোধহয় একটা সুস্থিতির সন্ধানে চলেছি। স্কুলে যেতে ভালো লাগত না, যে কোনো স্কুলে আমি তখন অচেনা আগন্তুক।

বাবা এক বিখ্যাত সেলসম্যান। আমি যখন স্কুলে যেতাম, সে সব সময় প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করত। আমাকে এক গ্রেড উচুঁতে ভর্তি করার জন্য আবেদন করত। তার ফলে কী হত? ক্লাসে আমি সবার ছোটো। কারও সাথে বন্ধুত্ব হত না। লজ্জা এসে আমাকে গ্রাস করত। একাকীত্বের যন্ত্রণায় দগ্ধ হতাম। সেটা হল ছন্নছাড়া জীবন।

কোথা থেকে টাকা আসছে আমি জানি না। মা একটা পুরোনো পিয়ানো কিনল। আমাকে শেখাতে শুরু করল। মা বলেছিল, পিয়ানো বাজালে মনটা শান্ত থাকবে।

বাবা কখনও জীবনে কোনো বই পড়েনি। মা কিন্তু বই পড়ত, মায়ের কাছ থেকেই বই পড়ার নেশাটা আমাকে পেয়ে বসল। আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে ভর্তি হলাম। বইয়ের জগতে ঢুকে গেলাম।

বাবা বলত– বই পড়ে পড়ে চোখের বারোটা বাজিও না। তুমি কেন তোমার ভাই সিমুরের মতো হও না, ও তো ফুটবল খেলে।

আমার জ্যাঠা আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলেছিল– সিডনি, এত পড়ো না। জীবনটা উচ্ছন্নে যাবে।

তখন আমার বয়স দশ বছর। লিখতে শুরু করলাম। একটা ছোটোদের পত্রিকাতে কবিতার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আমি একটা কবিতা লিখলাম। বাবাকে বললাম, সেটা ওখানে পাঠিয়ে দিতে।

আমি লিখছি, এ খবরটা বাবাকে শিহরিত করে তোলে। হ্যাঁ, আমি কেন কবি হব? আমি জেনেছিলাম, পাছে কবিতাটা অমনোনীত হলে বাবার খারাপ লাগে, তাই জন্য সে আমার নামটা কেটে কাকা অ্যালের নামটা বসিয়ে দিয়েছিল।

দু-সপ্তাহ কেটে গেছে। অ্যালের সাথে বাবা লাঞ্চ খাচ্ছে।

কাকা বলল– অটো, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। উইসডম কাগজ আমাকে পাঁচ ডলার চেক পাঠিয়েছে।

এটাই হল আমার লেখা প্রথম কবিতা, অ্যাল মার্কাসের নামে ছাপা হয়েছিল।

একদিন আমার মা অ্যাপার্টমেন্টে ছুটে এল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- সিডনি, আমি এই মাত্র বিফ ফ্যাকটরের কাছ থেকে আসছি। সে আমাকে যা বলেছে, তা শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি।

 বিফ ফ্যাকটর মার একজন বন্ধু। সে কী বলেছে?

গত শতাব্দীর বিশের দশকে চিকাগো ছিল একটা মস্ত বড়ো শহর। তবে সেখানে শুধু মানুষের কোলাহল ছিল না, তারই পাশাপাশি আরও অনেক শব্দ শোনা যেত। মানুষজন আনন্দে উল্লাস ধ্বনি করত।

এই শহরের ছিল অনেক আকর্ষণ, একদিন সকালে আমি স্কুলে গেছি, তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। কোনো এক ছাত্রের কথায় শিক্ষয়িত্রী খুবই চটে গিয়েছিলেন। তিনি কলমদানিটা নিয়ে ছুঁড়ে মারেন। একটু হলে সেটা আমাকে আঘাত করত। আমি স্কুল থেকে ভয়ে পালিয়ে এলাম।

স্কুলে ইংরেজি পড়তে ভালো লাগত। তখন থেকেই ছোটো গল্পের পোকা হয়ে উঠেছি। ভাবছি, কবে এরকম লিখতে পারব।

রিচার্ড তখন বছর পাঁচেকের। তাকে নিয়ে আমি একটা সুইমিং পুলে চলে যেতাম, দুজনে মনের সুখে সাঁতার কাটতাম। একবার রিচার্ড ডুবতে বসেছিল, আমি তাকে টেনে তুলে বাঁচিয়ে ছিলাম।

তখন থেকে আরও সাবধানী হয়ে উঠি।

.

তখন আমার বয়স বারো বছর। মার্শাল ফিল্ড গ্রামার স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। চিকাগো শহরে ইংরেজি ক্লাসে আমাকে একটা প্রোজেক্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, নাটক অভিনয় করলে কেমন হয়?

হঠাৎ নাতালির কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, বিফ ফ্যাকটরের অনুমান বোধহয় ঠিক হতে চলেছে, দেখিস, তোর ছেলে একদিন জগদ্বিখ্যাত হবে।

এভাবেই শুরু হল, ক্লাসের সর্বত্র সংবাদটা ছড়িয়ে পড়ল। কে কোন ভূমিকাতে অভিনয় করবে তা জানতে চাইছে। এই নাটকটা আমি পরিচালনা করব। এতে অভিনয় করব।

এর আগে কখনও পরিচালনা করিনি, তাই কিছুই জানতাম না।

আমি ভূমিকা বন্টন করতে শুরু করলাম। রিহার্সাল শুরু হল, সবকিছু আমাকে দেখতে হল।

এটা আমার জীবনে সব থেকে সুখের সময়। এভাবেই হয়তো একটা সুন্দর পেশার জন্ম হয়েছিল। ওই বয়সে আমি চিত্রনাট্য লিখেছি, কতটা পেরেছি, তা জানি না। কিন্তু ভয়টা ভেঙে গেছে।

ফাইনাল ড্রেস রিহার্সাল, ভারী সুন্দরভাবে শেষ হল।

আমি আমার টিচারের কাছে গিয়ে বললাম আমি তৈরি, কখন নাটকটা হবে?

উনি বলেছিলেন– কালই হতে পারে।

সারারাত চোখের তারায় ঘুম আসেনি। আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ওই নাটকটার ওপর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি একটার পর একটা সংলাপ বলেছিলাম। কোথায় কোন ভুলত্রুটি হচ্ছে, তা ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম। না, সংলাপ অসাধারণ হয়েছে। গল্পটা সুন্দরভাবে এগিয়ে চলেছে। শেষের দিকে একটা অনভিপ্রেত মোচড় আছে। সকলেই এটা ভালোবাসবে।

সকালবেলা স্কুলে গেলাম, শিক্ষয়িত্রী একটা খবর দিয়ে আমাকে অবাক করলেন সিডনি, তোমার জন্য সুখবর আছে। আমি সমস্ত ইংরেজি ক্লাস আজ বন্ধ রেখেছি। সব ছাত্রছাত্রীরা অডিটোরিয়ামে এসে তোমার নাটক দেখবে।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এত বড়ো সফলতা এইটুকু বয়সে?

 সকাল দশটা। অডিটোরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। শুধু ইংরেজি ক্লাসের ছেলেরাই আসেনি, প্রিন্সিপাল নিজে এসেছেন। টিচাররা সকলে উপস্থিত হয়েছেন। তারা এক শিশুপ্রতিভার বিকাশ দেখতে চাইছেন।

উত্তেজনার মধ্যেও আমি শান্ত ছিলাম, ভীষণ শান্ত, একটা বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে। অথচ তার আগাম অনুমান নেই।

নাটকটা এবার শুরু হবে। কলকাকলি থেমে গেছে। নীরবতার আবরণে বন্দি অডিটোরিয়াম।

একটা ছোট্ট লিভিংরুম। একটি ছেলে আর মেয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছে। তাদের একজন বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। তারা সোফাতে মুখোমুখি বসে আছে।

আমি এখানে এক গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম, আমি উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। এবার ঢুকতে যাব।

একটি ছেলে বলল– ইন্সপেক্টর এক্ষুনি আসরে।

এই কথাটা বলতে গিয়ে সে বলেছিল, যে কোনো মুহূর্তে , হা, কথাটা গুলিয়ে গেল। সে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল। সকলে হৈ-হৈ করে উঠেছে। আমি হাসতে চেষ্টা করেছিলাম। তারপর? আমি হেসে উঠলাম। যারা স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় বসেছিল, তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তখন হো-হহা করে হাসছি। অসহায় হয়ে গেছি।

শেষ অব্দি আমি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম। আমার শিক্ষয়িত্রীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সিডনি, এখানে এসো।

আমি স্টেজে গিয়ে দাঁড়ালাম– কী আশ্চর্য, আমার শিক্ষয়িত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন- এখনই এসব তামাশা বন্ধ করো।

দর্শকেরা উঠে যাবার চেষ্টা করছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, আমি কিছু একটা করার ভান করলাম। কেউ বুঝতে পারেনি। নাটকটা আবার শুরু হল।

.

০৩.

১৯৩০ সালে আমেরিকার অবস্থা হয় শোচনীয়। আমি মার্শাল ফিল্ড গ্রামার স্কুল থেকে। গ্র্যাজুয়েট হলাম। ওষুধের দোকানে চাকরি নিলাম। নাতালি তখন একটা দোকানে ক্যাশিয়ারের কাজ করছে। জীবনটা একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে।

অটো সেলসম্যানের চাকরিতে উন্নতি করেছে। একদিন হৈ হৈ করে সে বলল এবার নতুন একটা কাজ করব আমরা।

আমরা ডালাসে চলে যাব। অথবা আরিজোনাতে। কিংবা অন্য কোথাও।

 ভালো লাগছে না, এই ছন্নছাড়া জীবন।

অবশেষে আমরা ক্রিকল্যান্ডে এলাম। বাবা সেখানে একটা রুপোর খনি কিনেছে। ফোনেক্স থেকে ১০৪ মাইল দূরে। গ্যাস স্টেশন আছে। শহরটা মোটেই ভালো নয়। বাবা উন্নতি করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই হল না।

জ্যাঠা হ্যারির ফোন এল কেমন চলছে তোমার রুপোর কারবার?

–মোটই ভালো না, বাবার কণ্ঠে হতাশা।

–ডেনভারে চলে এসো। এখানে একটা স্টক ডোভারেজ কোম্পানি খোলা হবে। তুমি এখানে যোগ দাও।

–হ্যাঁ, যাচ্ছি।

আমরা ডেনভারে যাব, বাবা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল।

ডেনভার শহরটা সত্যি চমৎকার। জীবনের উন্মাদনা আছে। সেখানে গিয়ে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিলাম।

হ্যারি এবং পাউলিনের অবস্থা খুবই ভালো। তারা দোতলা বাড়িতে বসবাস করে। তাদের বাড়ির পেছন দিকে একটা মস্ত বড়ো পার্ক আছে। আমি আমার ভাই সিমুর, হাওয়ার্ড, এডি, স্টিভ– সবাই মিলে হৈ-হুঁল্লোড় শুরু করলাম।

সিমুর ইতিমধ্যেই বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে। সে তার থেকে বড়ো মেয়েদের সাথে ঘোরা ঘুরি শুরু করে দিয়েছে। এডিকে একটা ছোট্ট টাটুঘোড়া দিয়েছে। হাওয়ার্ড টেনিসের নামকরা খেলোয়াড়। এখানকার পরিবেশটা একেবারে আলাদা। কোথায় চিকাগো, আর কোথায় এই ডেনভার। মনে হচ্ছে, স্বর্গ আর নরকের তফাৎ।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমরা কি হ্যারি আর পাউলিনের সঙ্গে থাকব?

তারা বলেছিল- না, আমরা এখানে একটা বাড়ি কিনব।

বাড়িটা দেখতে গেলাম, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। মস্ত বড়ড়া বাড়ি, ম্যারিয়ন স্ট্রিটের শান্ত শহরতলীতে। ঘরগুলো বড়ো সুন্দর ভাবে সাজানো। ভালো ভালো ফার্নিচার কেনা হয়েছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।

আমার বাবা এই বাড়িটা কিনবে, আমার এখানে বিয়ে হবে। আমার ছেলেমেয়েরা বড়ো হবে।

এই প্রথম আমার মনে হল, টাকার কত দরকার। জ্যাঠামশাইয়ের ব্যবসাটা তাহলে ভালোই চলেছে।

১৯৩০ সালের বসন্ত। আমার বয়স তখন তেরো বছর। আমি ইস্ট হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। অভিজ্ঞতাটা ভারী সুন্দর। ডেনভারের শিক্ষকরা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছেন, তাঁরা কখনও ছাত্রদের দিকে কাঁচের দোয়াত ছুঁড়ে মারেন না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

পারিবারিক শান্তি ফিরে এল।

একদিন জিমনেসিয়াম ক্লাসে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। শরীরে ব্যথা লেগেছিল। অসহ্য যন্ত্রণা, চলাচল করতে পারছি না।

ডাক্তার এসে আমাকে দেখলেন। জানতে চাইলাম স্যার, আমাকে কি সারা জীবন খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে?

না, তোমার পায়ের মাংসপেশিতে টান ধরেছে, স্পাইনাল কর্ডে আঘাত লেগেছে। তাই যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু এটা বেশি দিন থাকবে না। তোমাকে দু-দিন শুয়ে থাকতে হবে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে।

একটা অ্যাম্বুলেন্স আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তিনদিন কাটিয়ে দিলাম।

আমি জানি না, এই ঘটনাটা ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করবে কিনা।

একদিন আমি ডেনভারে, একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। এরোপ্লেন চালাতে হবে।

আমি অটোকে বলেছিলাম- আমি যাব।

বাবা বলল- ঠিক আছে।

প্লেনটা ভারি সুন্দর লিঙ্কন কমান্ডার। সেখানে গিয়ে আমার মন আনন্দে ভরপুর।

 পাইলট জানতে চাইলেন প্রথমবার।

–হ্যাঁ, প্রথমবার।

.

প্লেনটা উড়ল। দূরে-আরও দূরে। ভালো লাগছে, সত্যি ওই দিনটা আমি মনে রেখেছি।

১৯৩৩- বসন্তের সকাল। বাবা আমার কাছে এল। বলল- সবকিছু গুছিয়ে নাও, আমাদের চলে যেতে হবে।

-কেন? আমার চোখে প্রশ্ন

 –আমরা চিকাগোতে ফিরে যাব।

–সত্যি?

–হ্যাঁ।

বাবা চলে গেল। আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম কী হয়েছে?

–তোর বাবা আর জ্যাঠার মধ্যে গোলযোগ দেখা দিয়েছে।

আমি চারদিকে তাকালাম, বললাম– এই বাড়িটা?

 মায়ের কণ্ঠে বিষণ্ণতা। মা বলল- এটা আমরা কিনছি নারে!

.

চিকাগোয় ফিরে যাওয়া, ক্লান্তিকর এক অভিযান। কী হয়েছে, মা-বাবা সে বিষয়ে একটা কথাও বলেনি। ডেনভারের তুলনায় চিকাগো নরকের অন্ধকার। আমরা একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে বাধ্য হলাম। চরম বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। বাবা আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। মা একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেলস ক্লার্ক হিসেবে কাজ করছে। কলেজ যাবার স্বপ্ন মরে গেল। টিউশন নেব, এমন অর্থ কোথায়? সব কিছু তখন ঘন অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে।

আমি কখনওই এখানে থাকব না, আমি ভাবলাম! হ্যাঁ, আমাকে টাকা রোজগার করতেই হবে।

তখনই আমি ভেবেছিলাম, আত্মহত্যা করব। বাবার সাথে দেখা না হলে হয়তো সেদিনই মরে যেতাম।

সেপ্টেম্বর এল। আমি সিন হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। বাবা তখনও রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়ো বড়ো ব্যবসার স্বপ্ন দেখছে। মাকে একটা ড্রেস শপে সারাদিন কাজ করতে হচ্ছে। বেশি টাকা হাতে আসছে না। আমি কীভাবে সাহায্য করব?

আমি আমার মামা স্যানের কথা ভাবলাম। লুপ শহরে কয়েকটা হোটেলে মামার ভালো যোগাযোগ ছিল। সেখানে মামা চেকরুমের দেখাশোনা করত। এই সব চেকরুমে সুন্দর চেহারার মেয়েরা কাজ করত। খদ্দেরদের মন ভোলানোর চেষ্টা করত। খদ্দেররা দয়াপরবশ হয়ে তাদের হাতে খুচরো পয়সা তুলে দিত।

.

মামার সঙ্গে দেখা হল। মামা শেরম্যান হোটেলে বসেছিল।

সে আমাকে দেখে আনন্দে অধীর হয়ে বলল- সিডনি, তোর জন্য কী করব?

–আমার একটা চাকরি চাই।

কী কাজ করবি?

–আমি চেকরুমে কাজ করতে চাই। তোমার একটা হোটেলে। সাহায্যকারী হিসেবে।

মামা আমাদের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কথা জানত। সে বলল- ঠিক আছে, তোকে তো সতেরো বছরের থেকেও বেশি মনে হচ্ছে। তুই বিশমার্ক হোটেলে চলে যা।

পরের সপ্তাহ থেকে আমার কাজ শুরু হল। কাজটা খুবই সহজ। খদ্দেররা কোট আর হ্যাট তুলে দেয় সাহায্যকারিনীদের হাতে। তারা প্রত্যেকটার ওপর একটা নম্বর লিখে রাখে। তারপর সেগুলো আমার হাতে তুলে দেয়। আমি র‍্যাকে তুলে রাখি। যখন খদ্দের ফিরে আসে তখন আবার তার হাতে সবকিছু তুলে দিতে হয়।

.

দুপুর তিনটে পর্যন্ত স্কুলের পড়া। স্কুল থেকে ছুটি ট্রেন ধরতে। বিশমার্ক হোটেলে পৌঁছে যাই। পাঁচটা থেকে না বন্ধ হওয়া পর্যন্ত আমাকে হোটেলে থাকতে হয়। কখনও কখনও মাঝরাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। আমি প্রত্যেক রাতে তিন ডলার করে মাইনে পাই। মায়ের হাতে পুরো টাকাটা তুলে দিই।

শনি আর রোববার দম ফেলার সময় থাকে না। হোটেলে হোটেলে পার্টির আয়োজন। তখন ভীষণ কাজ করতে হয়। ছুটির দিনগুলো কোথা দিয়ে ফসকে যাচ্ছে। বিশেষ করে বড়োদিন আর নতুন বছরের সময়। হৈ হুল্লোরের সঙ্গে ছোটা ছোটো ছেলেমেয়েরা মা বাবার সাথে আনন্দ করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকি। নিজের কথা ভাবি। মা কাজে ব্যস্ত, বাবার কোনো পাত্তা নেই। রিচার্ড আর আমি একা। আমাদের উৎসব কবে শুরু হবে?

রাত আটটা, সকলেই ছুটির দিনে ডিনার খেতে ব্যস্ত। আমি তাড়াতাড়ি একটা কফি শপে ঢুকে পড়ি, কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে, যা তোক কিছু খেয়ে আবার কাজে ফিরে আসি।

মাসি ফ্রান্সেসকে আমার খুবই ভালো লাগে। আমার মায়ের সবথেকে ছোটো বোন। সে মাঝে মধ্যে বিশমার্ক হোটেলে কাজ করতে আসে। ছোটোখাটো চেহারা, মাথায় একরাশ বাদামী চুল। হৈ হুল্লোড় করতে ভালোবাসে। খদ্দেররা সকলেই তাকে আলাদা চোখে দেখে।

নতুন একটা মেয়ে এল, জুয়ান, আমার থেকে বছর খানেকের বড়ো। অসাধারণ রূপবতী। আমি তাকে দেখে আত্মহারা হয়ে গেলাম। কীভাবে কথা বলব ভেবে পাচ্ছি না। হাতে কোনো পয়সা নেই, কিন্তু তাকে ভালোবাসতেই হবে। আমরা একে অন্যকে ভালোবাসব, বিয়ে করব। একগাদা ছেলেপুলে হবে এমন একটা কষ্টকল্পনা।

এক সন্ধ্যায় সে বলল আমার কাকা-কাকিমা রোববার লাঞ্চের ব্যবস্থা করছে। তুমি যাবে?

স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে।

এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা, ইতালিয় পরিবার, অনেক মানুষের ভিড়। মস্ত বড়ো ডাইনিং রুম। কত কী খাবার থরে থরে সাজানো আছে!

জুয়ানের কাকা, মানুষটি বড়ো চমৎকার। তিনি ইউনিয়ানের প্রেসিডেন্ট, আমি চলে আসব, সকলকে ধন্যবাদ জানালাম। জুয়ানের কানে কানে শুনিয়ে দিলাম আমার সুখের কথা। হ্যাঁ, আমাদের সম্পর্ক তৈরি হল।

পরের দিন সকালবেলা, একটা অভাবিত ঘটনা ঘটে গেল। ভদ্রলোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিপক্ষ রাজনৈতিক দল এটা করেছে। জুয়ান হারিয়ে গেল, আমার স্বপ্ন মরে গেল।

শনিবার ডাক স্টোরে আসি। একটুখানি সময় পাওয়া যায়। বাড়িতে টেনশন অনেকটা কমে গেছে, কিন্তু অন্য কিছু শোনা যাচ্ছে।

একদিন বাবা বলল- আমি ফার্মে যাচ্ছি, এখনই আমাকে যেতে হবে।

আমি অবাক, আমিও যাব বলে বায়না ধরলাম।

 বাবা বলল না, তোমার যাওয়া যাবে না।

-কেন?

–অসুবিধা আছে।

কবে ফিরবে?

–তিন বছর।

তিন বছর, আমি বিশ্বাস করছি না।

নাতালি ভেতরে এল। বলল- সিডনি, একটা খারাপ খবর শুনতে হবে। তোমার বাবা কিছু খারাপ লোকের সঙ্গে মিশেছিল, তারা দোকানে ভেনডিং মেশিন বিক্রি করত। তোমার বাবা এই ব্যাপারটা জানত না। একটা লোক সব টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। তারা ধরা পড়ে। তোমার বাবাকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাকে জেলখানায় যেতে হবে।

আমার দুচোখে জল– তাহলে এই হল ফার্ম? তিনবছর আমি চিৎকার করেছিলাম।

 হ্যাঁ, আমাকে এখন চিন্তা করলে চলবে না।

বারো মাস কেটে গেছে, বাবার বোধহয় আসার সময় হল। বিজয়ীর বেশে।

.

০৪.

খবরের কাগজের পাতায় আমরা সেই খবর পড়েছিলাম। রেডিওতে বারবার ঘোষিত হচ্ছিল। বাবার মুখ থেকে সবকিছু শুনতে হবে। আমি জানি না, এখানে মানুষ কী করে। আমি ভেবেছিলাম, বাবা হয়তো আরও বিবর্ণ হয়ে গেছে। বোঝার চাপে অবনত।

বাবা সামনের দরজা দিয়ে এগিয়ে এল। আগের মতো উৎফুল্ল– আমি ফিরে এসেছি।

আমরা সকলে এগিয়ে এসে বললাম- কী হয়েছে বলে তো?

বাবার মুখে হাসি– হা, এই গল্পটা আমি বারবার বলব। কিচেন টেবিলে বসে বাবা শুরু করল।

আমি জেলখানায় কাজ করছিলাম, সাফাই করার কাজ। পঞ্চাশ ফুট দূরে একটা মস্ত বড়ো রিজার্ভার। ওখানে জল থাকে। চারপাশে দশ ফুট উঁচু পাঁচিল। আমি দেখলাম, একটা ছেলে বেরিয়ে এসেছে। তিন-চার-বছর হবে। আমি সেখানে একাই ছিলাম।

..ছেলেটা ওই রিজার্ভারের ওপর উঠে গেল। একেবারে ওপরে পৌঁছে গেছে। এক্ষুনি তলিয়ে যাবে। আমি দেখলাম কাছাকাছি কেউ নেই। আর এক মুহূর্তের প্রতীক্ষা। সে রিজার্ভারে পড়ে গেল। টাওয়ার থেকে একটা গার্ড সব দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু আমি জানি সে আসতে পারবে না।

…আমি ছুটতে শুরু করলাম। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি। আমি ওপরে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম সে তলিয়ে যাচ্ছে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলের মধ্যে, তাকে টেনে তুললাম। শেষ অব্দি মৃত্যুর উপত্যকা থেকে জীবনের উন্মাদনায়।

…আমি সকলকে ডাকলাম, আমাকে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কারণ অনেকটা জল খেয়ে ফেলেছিলাম। হঠাৎ লাফিয়ে পড়ায় আঘাত লেগেছিল।

আমরা প্রত্যেকটা শব্দ গেলবার চেষ্টা করছি।

ছেলেটা ওয়ার্ডেনের ছেলে। ওয়ার্ডেন এবং তার স্ত্রী আমার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে এলেন। তারপর? তারা যখন শুনলেন, আমি সাঁতার জানি না, তখন অবাক হয়ে গেলেন। আমি এক হিরো হয়ে গেলাম। খবরের কাগজে আমার নাম প্রকাশিত হল। একের পর এক ফোনের কল আসছে। চিঠির পাহাড় জমছে। টেলিগ্রাম- আমি তো ভাবতেই পারছি না, এমনটি ঘটতে পারে।

ওয়াড্রেন এবং গভর্নর একটা সিদ্ধান্তে এলেন। তারা বললেন, যেহেতু আমার অপরাধ খুব একটা বেশি নয়, তাহলে আমাকে ক্ষমা করা যেতে পারে।

তাই আমি এখানে ফিরে এসেছি।

আবার আমরা এক হলাম।

.

আমি একটা স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম। সেটা পেয়ে গেলাম।

 ব্যাপারটা অলৌকিক। আমি এবার কলেজে যাব। একটা পাতা সবেমাত্র ওলটানো শেষ হয়েছে। আমি ভাবলাম, একটা ভবিষ্যৎ হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

কিন্তু? চেকরুমে আর কাজ করতে পারব কি? এলাম ইলিনয়িসে। নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটিতে। চিকাগো শহর থেকে বারো মাইল দূরে। ২৪০ একরের ওপর মস্ত বড়ো এক ইউনিভারসিটি, লেক মিশিগানের ধারে অবস্থিত।

সোমবার সকাল নটা, আমি রেজিস্টারের অফিসে পৌঁছে গেলাম।

আমার নাম বললাম, কী কোর্স আমি পড়ব জানতে চাওয়া হল।

আমি সব কিছু পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহিত্য আমার প্রথম প্রেম। 

আমি তাকিয়ে দেখলাম, ভদ্রমহিলার দিকে। শেষ পর্যন্ত আমি অনেক কিছু শিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ল্যাটিন কোথায়? উনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন– তুমি সবকিছু সামলাতে পারবে?

আমার মুখে বিশ্বজয়ী হাসি- হ্যাঁ, আমি পারব।

ল্যাটিন?

সেখান থেকে কাফেটেরিয়া কিচেন। এখানে একটা কাজ করতে হবে। যে কোনো কাজ। আমি হয়তো চেকরুমে আর যেতে পারব না।

তারপর? চলে গেলাম ডেইলি নর্থ ওয়েস্টার্ন নামে একটা পত্রিকার অফিসে। আমি সেখানে গিয়ে কাজ করব। সে কাজটাও আমি পেয়ে গেলাম। তখন ব্যস্ততার মধ্যে আমার সময় কেটে যাচ্ছে। আমি ভাবতে পারছি না, কীভাবে দিনগুলো পাল্টে গেল।

চেকরুমে তখনও কাজ করছি। প্রতি শনিবার ডাক স্টোরে যাই। তারই পাশাপাশি অনেকগুলো বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে হচ্ছে। এত কাজ মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাও এতটুকু ক্লান্তি লাগছে না।

একদিন সকালবেলা ফুটবল ফিল্ডে গেলাম। দলটা প্র্যাকটিস করছিল। একজন এগিয়ে এল আমার দিকে। বলল- তুমি কি খেলতে চাইছ?

–হ্যাঁ, ফুটবল আমি খেলব।

–তুমি কোথায় পড়ো?

–আমি ইউনিভারসিটিতে পড়ি। কিন্তু জীবনে কখনও ফুটবল খেলিনি।

ভদ্রলোক বললেন- তুমি এ ব্যাপারটা ভুলে যাও। চট করে কেউ ফুটবল খেলতে পারে না।

ওই স্বপ্নটা মরে গেল!

.

নর্থ ওয়েস্টার্নের অধ্যাপকেরা সাংঘাতিক ভালো। ক্লাসগুলো উত্তেজক। ডিবেটিং টিমে যোগ দিলাম। নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হল। আমার বক্তব্য পরিষ্কারভাবে তুলে ধরলাম। হল ভর্তি সকলে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমার কথা শুনে সকলে হাততালির ঝড়, বইয়ে দিল।

আমার নাম ঘোষিত হল। হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, গণতন্ত্র বনাম সাম্যবাদ বিষয়ে, আমি জানতাম না কী বলতে হবে। যা মনে এল, তাই বলেছিলাম। কী আশ্চর্য, সকালের বুলেটিনে দেখলাম, আমার নাম রয়েছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো অন্য কেউ। কিন্তু সত্যি? আমি জিতে গেছি।

আমার নামটা সর্বত্র প্রচারিত হল। আমাকে নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির ডিবেটিং টিমে নিয়ে নেওয়া হল।

তার মানে, জীবন উপন্যাসের আর একটি পাতা উল্টাতে পারলাম।

.

আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। কিন্তু কীসের যেন অভাব। একটা স্বপ্ন তখনও দেখা হয়নি। একটা অদ্ভুত অনুভূতি। কী একটা আকুতি। কবে সফল হবে?

কোনো কোনো দিন হতাশ হয়ে পড়তাম। মনে হত আকাশ ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন। শেষ অব্দি আমি এক মনস্তত্ত্ববিদের শরণাপন্ন হলাম।

কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি তো সুখী মানুষ হতে পারি। কিন্তু হতে পারছি না কেন?

টাকাপয়সা ক্রমশ কমে আসছে। বাবা চাকরি পাচ্ছে না। মা সপ্তাহে ছদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে। আমি মাঝরাত অব্দি কাজ করছি। শনিবারের সন্ধ্যেগুলোতেও কাজ করতে হচ্ছে। তবু টাকা আসছে কই? ১৯৩৫ সালের ফ্রেব্রুয়ারি, বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে গেছে। একরাতে মা বাবার কথা শুনতে পেলাম। মা বলছিল– রাতে কাজ করতে পারলে ভালো। হয়, না-হলে চলবে না বোধহয়।

না, মা সারাদিন কাজ করে, রাতে এসে আমাদের জন্য রাতের খাবার তৈরি করে। অ্যাপার্টমেন্টটা পরিষ্কার রাখে। মাকে আমি আর কাজ করতে দেব না।

পরের দিন সকালবেলা আমি নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলাম।

 মাকে সব কথা বলেছিলাম, মা শিউরে উঠে বলেছিল- সিডনি, তুই একাজ করিস না। মায়ের চোখে জল, আমি চালিয়ে নেবার চেষ্টা করছি।

আমি জানতাম, কোনো কিছুই চলবে না। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। একটা চাকরি পেতে হবে।

১৯৩৫– অর্থনৈতিক মন্দা আকাশ ছুঁয়েছে। কোনো কিছু পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

রেডিও স্টেশনে ইন্টারভিউ দিলাম। ম্যান্ডেল ব্রাদারস নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলাম। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। জনাছয়েক সেলসম্যান চিৎকার করছে। কাস্টমারদের সেবা করছে। আমি এখানে কী কাজ করব, হা, কিছু একটা করতেই হবে।

একজন এগিয়ে এসে বলল তুমি কী চাইছ?

–আমি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলব।

–আমি মিঃ ইয়ং, এখানকার ম্যানেজার।

–কোনো চাকরি আছে?

–তুমি কি মেয়েদের জুতো বিক্রি করতে পারবে?

–হ্যাঁ, পারব।

–এ ধরনের কাজ করেছ?

–হ্যাঁ, বানিয়ে বললাম। থম ম্যাকক্যান, ডেনভারে।

–অফিসে এসো।

তারপর আমার কাজ শুরু হল। এক নতুন অভিজ্ঞতা। মিথ্যের ওপর ভিত্তি করে মাল বেচতে হবে। একের পর এক খদ্দের আসছে। দাম বলতে হচ্ছে, পায়ে জুতো পরাতে হচ্ছে। এভাবেই আমার নতুন জীবন শুরু হল।

কিন্তু কিছুটা গোলমাল হয়ে গেছে। উল্টোপাল্টা সাইজ বলছি আমি। খদ্দেরটা রেগে কই। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করল। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ। এভাবেই আমার ওই পেশাটা হারিয়ে গেল।

সেদিন বিকেলবেলা আমাকে অন্য একটা জায়গায় যেতে হল। নতুন জগতে!

.

০৫.

ম্যান্ডেল ব্রাদারসের অফিস, হাবার্ডশেরিতে, অসম্ভব পরিশ্রম। তার পাশাপাশি চেকরুমে কাজ করতে হচ্ছে। শনিবারের সন্ধ্যেবেলাতেও যাই। অটো একটা আংশিক সময়ের কাজ পেয়েছে বয়লার রুমে।

এবার নতুন কাজে যোগ দিয়েছে। মাঝরাতে অটো বাড়ি ফেরে। অভিজ্ঞতার কথা বলে। তাকে সাতদিনই কাজ করতে হয়। রোববার মাথা থেকে হারিয়ে গেছে।

আমি এক রোববার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। যখন আমি গেলাম, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। চারদিকে গরম হাওয়া, ভাবাই যাচ্ছে না। এখানে বাবা কী করে কাজ করে।

সত্যি, জীবন কত দুর্বিসহ।

ম্যান্ডেল ব্রাদারসের কাজটা ভালো লাগছে না। একটা চ্যালেঞ্জ দরকার, একটা উন্মাদনা। কিন্তু পাব কোথায়? এই দেশের সর্বত্র ম্যান্ডেল ব্রাদারসের দোকান আছে। অন্য কোথাও গেলে কেমন হয়?

একদিন আমার বস মিঃ ইয়ং এসে বললেন- তোমার জন্য একটা খারাপ খবর আছে।

 আমার দুচোখে বিস্ময় কী?

–তোমার চাকরিটা আর থাকবে না।

–কেন আমি কিছু ভুল করেছি?

না, লোক কমাতে হবে। খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তোমাকেই আমরা শেষবারের মতো চাকরি দিয়েছি। তাই তোমাকেই আগে যেতে হবে।

আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে। একটা চাকরি দরকার। কী করব? কোথায় যাব? কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঋণের পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে। মুদির বিল বাকি আছে। বাড়িওয়ালা মাঝে মধ্যে চিৎকার করে। অন্যান্য জিনিস কিনতে পারছি না।

পথে পথে শুরু হল আমার পরিভ্রমণ।

আমার বাবার এক বন্ধু চার্লি ফাইন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি একটা মস্ত বড়ো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির এগজিকিউটিভ। তাকেই শেষ পর্যন্ত ধরতে হল।

সেখানে পৌঁছে গেলাম। এই কোম্পানি অটোমোবাইল গিয়ার তৈরি করে। পাঁচতলা বাড়িতে ফ্যাক্টরিটা অবস্থিত। ডাইভারসি স্ট্রিট জুড়ে।

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন- মেশিনের বিষয়ে তোমার কোনো অভিজ্ঞতা আছে।

আমার অভিজ্ঞতা ছিল না, তিনি সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সেখানে একটা নতুন জগত। কাজ শুরু হল।

এই কাজটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। তবু কাজে মন দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিছু তো একটা করতেই হবে।

বাবা তখন এক ভ্রাম্যমান সেলসম্যান। মা সপ্তাহে ছদিন ড্রেস শপে কাজ করছে। রিচার্ড স্কুলে যাচ্ছে। ওখানকার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের মধ্যে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কোনো ঘটনা নেই। সন্ধ্যেগুলো আরও সাংঘাতিক। আমি এল ডাউন টাউনে চলে আসি। হোটেলে কাজ করি। ওভারকোট নিতে হয় এবং ফেরত দিতে হয়। জীবনটা এত কুৎসিত কেন? এই গোলকধাঁধা থেকে কবে বাইরে আসতে পারব?

.

এক রাতে চিকাগো ট্রিবিউনে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। পল অ্যাশ একটা অ্যামেচার কনটেস্টের ব্যবস্থা করছে। –শো বিজনেসে নাম করতে চান কি?

পল অ্যাশ হলেন জনপ্রিয় ব্যান্ডলিডার। চিকাগোর থিয়েটারে একাধিকবার অভিনয় করেছেন। এই বিজ্ঞাপনটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমি জানি না, অ্যামেচার কনটেস্ট বলতে কী বোঝায়?

শনিবার আমি ড্রাগস্টোরে গেলাম, তার আগে চিকাগো থিয়েটার আমার চোখ কেড়ে; নিল। আমি পল অ্যাশের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম।

আমার নাম কী বলব? আমার টাইটেলটা বড়োই খটমটে, কী টাইটেল নেওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বললাম, আমার নাম সিডনি সেলডন।

ভদ্রলোক লিখে নিলেন। বললেন, আগামী শনিবার এখানে এসো, সেলডন ছটার সময় তখন দেখা হবে।

আমি মা-বাবার কাছে খবরটা দিয়েছিলাম। রিচার্ডও খবর শুনে উত্তেজিত। আমি বললাম।

–আমি একটা অন্য নাম ব্যবহার করেছি। আজ থেকে আমি সিডনি সেলডন।

মা বাবা অবাক হয়ে বলল- কেন?

আসল কারণটা বললাম, সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। শেষ অব্দি একটা শুভ সূচনা হতে চলেছে। আমাকে এই কনটেস্টটা জিততেই হবে। যখন পল অ্যাশ আমাকে একটা সুযোগ দেবেন, ওনার দলের হয়ে আমি সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করব।

শনিবার, সন্ধ্যেটা এসে গেল। আমি চিকাগো থিয়েটারে গেলাম। একটা ছোট্ট ব্রডকাস্ট রেডিও, আরও কয়েকজন প্রতিযোগী বসে আছে। একজন কমেডিয়ান, একজন গাইয়ে, এক জন মহিলা পিয়ানোবাদিকা, একজন অ্যাকরডিয়ান বাদক।

ডিরেক্টর বললেন- সেলডন।

আমার মনে রোমাঞ্চ। এই প্রথম কেউ আমার নতুন নাম ধরে ডাকছে।

–যখন আমি ইঙ্গিত করব, তুমি মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে যাবে। তোমার সবকিছু দেখাতে শুরু করবে। তুমি বলবে, শুভ সন্ধ্যা, ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের সকলকে পল অ্যাশ অ্যামেচার কনটেস্টে স্বাগত সম্ভাষণ জানানো হচ্ছে। আমি হলাম আপনাদের ঘোষক সিডনি সেলডন। আমরা একটা উত্তেজক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে চলেছি। বুঝতে পারলে?

পনেরো মিনিট কেটে গেছে। ভদ্রলোক স্টুডিওর ঘড়ির দিকে তাকালেন। হাত তুললেন– সকলে শান্ত হয়ে যান। তিনি গুনতে শুরু করেছেন। আমার দিকে তাকালেন। আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি। আমি জানি, এভাবেই একটা সাংঘাতিক জগতের দুয়ার উন্মোচিত হবে।

আমি মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর গলাটাকে সুন্দর করে বললাম– শুভ সন্ধ্যা।

কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল, নামটা আটকে গেল। হায়, নতুন পদবিটা উচ্চারণ করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেছি।

অন্য প্রতিযোগীদের সাথে দেখা হল। তারা মোটামুটি ভালোভাবেই তাদের অনুষ্ঠান করেছে। অ্যাকরডিয়ানবাদক একটা অসাধারণ সুর বাজিয়েছে। কমেডিয়ান হাসিয়েছে। গায়ক গান গেয়েছে ভালোভাবে। কোনো কিছু গোলমাল হয়নি। শেষ পর্যন্ত ওই মহিলা পিয়ানোবাদিকার পরিচয় দিলাম তার নাম ঘোষণা করলাম। সে কাঁদতে শুরু করল। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। আমি জানি না কী করব। আমায় কী ঘোষণা করতে হবে।

আমি মাইক্রোফোনের পাশে সরে গিয়ে বললাম- ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়রা, আমরা সকলেই অ্যামেচার, পরবর্তীকালে আমরা পেশাদার হয়ে যাব।

আমি কথা দিয়ে মন ভোলাবার চেষ্টা করছি।

তারপর? পরিচালক আমার কাছে এসে বললেন- তোমার নাম কী? তুমি নামটা বলতে গিয়ে এমন কেন করছিলে?

এভাবেই আমার সামনে ওই জগৎটাও বন্ধ হয়ে গেল।

পল অ্যাশ আমাকে তার সাথে ভ্রমণের অনুমতি দেননি, তবে এখান থেকে একটা সুবিধা হয়েছিল। আমাদের পরিবারের সকলেরই পদবি পাল্টে সেলডন হয়ে গিয়েছিল। শুধু জ্যাঠামশাই, হ্যারি ছাড়া। সে তখনও তার পুরোনো পদবিটাকে আঁকড়ে ধরে ছিল।

মে মাসের শুরু। আমার ভাই সিমুর বিয়ে ঘোষণা করল। খবরটা আমাদের অবাক করে দিয়েছে। তার বয়স মাত্র উনিশ বছর। মনে হয় সে বোধহয় ছোটো থেকেই পাকাপোক্ত হয়ে জন্মেছে।

আমি হব নিতবর। ভারী আনন্দের দিন। তার ভাবি বউয়ের সঙ্গে দেখা হল, সিডনি সিনগার। হ্যারির ব্রোকারেজ অফিসে চাকরি করে। সিমুরের সাথে সেখানেই পরিচয়। মেয়েটার মধ্যে উষ্ণতা আছে, আছে কৌতুকবোধ।

বিয়ের অনুষ্ঠানটা ছিমছাম। পরিবারের সকলে উপস্থিত হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে আমি সিমুরকে অভিনন্দন জানিয়ে বললাম, মেয়েটা সাংঘাতিক। তোকে সারাজীবন ভালোবাসবে।

ছ-মাস কেটে গেছে, তাদের ডির্ভোস হয়ে গেল।

আমি প্রশ্ন করে ছিলাম- সিমুর?

–ও বলছে, আমার নাকি আর একটা পরকীয়া প্রেম আছে।

তার ফলে ডির্ভোস?

–না, ও আমাকে শাস্তি দেয়নি।

এবার কী করবি?

–ও অন্য কারোর সাথে আমাকে দেখেছে।

–সত্যি?

-না, ও আমার মুখ দর্শন করতে চাইছে না। হলিউডে চলে গেছে। সেখানে ওর এক ভাই আছে, ডরোথি আরজনার নামে এক মহিলা পরিচারিকার কাছে কাজ করবে।

.

রেডিওর প্রতি আকর্ষণ আমার যায়নি। রেডিওর মাধ্যমে আমি একটা নতুন পেশার সন্ধান করতে পারি। বিভিন্ন রেডিও স্টেশনে হুঁ মারছি, ঘোষক হিসেব চাকরি পাওয়া যায় কি?

এক রবিবার বিকেলবেলা। অ্যাপার্টমেন্টে কেউ নেই। আমি পিয়ানোর সামনে বসে আছি। একটা সুর ভাজছি মনে মনে একটা গান লেখা যায় কি? যদি বলি আত্মত্যাগ সম্ভাষণ?

চেষ্টা করতে হবে। ১৯৩৬- বড়ো বড়ো হোটেলের বলরুমে নাচের আসর বসছে। বিশমার্ক হোটেলের অর্কেস্ট্রা লিডার ফিল লেভান্ট, আমি কখনও তার সঙ্গে কথা বলিনি। মাঝে মধ্যে তাকে দেখতে পাই। আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ি।

আমার লেখা নতুন গানটা তাকে শোনালাম। শুনে সে কি অবাক হল? আমি জানি না।

আমি তার হাতে গানের একটা পাণ্ডুলিপি তুলে দিলাম। আমি ভাবলাম, সে বোধহয় খুশি হবে। সে তাকাল না, এই স্বপ্নটাও হয়তো ব্যর্থ হল।

এক ঘন্টা কেটে গেছে ফিল লেভান্ট চেকরুমে ফিরে এসেছে।

 সে বলছে- এই গানটা তুমি লিখেছ?

 আমার নিঃশ্বাস বন্ধ কেন?

-এটা অসাধারণ। এটা হিট হবে। আমি কি এটাতে সুর দেব?

–হ্যাঁ, দারুণ কী?

পরের দিন সন্ধ্যেবেলা, আমি কোট আর হ্যাট সাজাতে ব্যস্ত। বলরুম থেকে শব্দ ভেসে এল। কে যেন আমার গানটা পিয়ানোতে বাজাচ্ছে। শরীরের সবকটা রোমকূপে উত্তেজনা। এই অর্কেস্ট্রা সারা দেশ জুড়ে তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে। দেশের সবাই আমার নাম শুনতে পাবে।

কাজ শেষ হতে হতে মাঝরাত, আমি বাড়িতে গেলাম, বিধ্বস্ত, গরম জলে স্নান করলাম। বাবা বাথরুমের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা টেলিফোন এসেছে।

এই মধ্যরাতে কে?

 উনি বলছেন– ফিল লেভান্ট।

আমি চমকে উঠেছি। তোয়ালে জড়িয়ে এগিয়ে এসেছি– মিঃ লেভান্ট?

–সেলডন?

–হ্যামস মিউজিক কোম্পানি নামে এক পাবলিসার তোমার গানটা রেডিওতে শুনেছে। তারা এটা প্রকাশ করতে চাইছে।

আমার হাত থেকে রিসিভারটা খসে পড়ে গেল।

–তুমি কি এখন আসতে পারবে?

 –আমি এখনই যাচ্ছি।

আমি গামছা নিয়ে ছুটলাম।

বাবা জানতে চাইল- কী হয়েছে?

আমি বললাম পুরো ব্যাপারটা।

বাবা গাড়িটা দিল, চাবি দিল। বলল- সাবধানে যাস।

আমি ছুটছি, বিসমার্ক হোটেলে পৌঁছোতেই হবে। আমার মনটা ঘোড়ার বেগে ছুটে চলেছে। আমার প্রথম গান প্রকাশিত হবে। সাইরেনের শব্দ। লাল আলো। একজন পুলিশ মোটরসাইকেল থেকে নেমে আমার কাছে এগিয়ে এসেছে।

–এত তাড়াতাড়ি কেন?

–অফিসার আমাকে ক্ষমা করবেন, বিশমার্ক হোটেলে এক পাবলিশারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি সেখানকার চেকরুমে কাজ করি। আমার গান একজন প্রকাশ করতে চাইছে।

এক নিঃশ্বাসে বলে গেলাম।

 ভদ্রলোকের কঠিন মুখ ড্রাইভারের লাইসেন্স?

–হ্যাঁ, লাইসেন্স দেখালাম।

উনি বললেন আমাকে অনুসরণ করো।

আমার চোখে বিস্ময়–কোথায়? আমাকে টিকিট দিন। আমি এখনই চলে যাই।

–এটা একটা নতুন পদ্ধতি, তাই না? আমরা এখন থেকে কাউকে আর টিকিট দেব না। আমরা অপরাধীদের সোজা পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাব।

আমার হৃদয় ডুবে গেছে অফিসার, বিশেষ করে আমার ব্যাপারটা দেখুন। আমাকে যেতেই হবে। টিকিট দিন।

–আমাকে অনুসরণ করো।

আমার সামনে কোনো উপায় ছিল না। উনি মোটরসাইকেল চালু করলেন। আমাকে পেছনে রাখলেন। আমি তাকে অনুসরণ করছি। হায়, নতুন প্রকাশকের সঙ্গে কথা হবে। আর এখন কিনা আমি চলেছি থানার উদ্দেশ্যে।

আলো পরিবর্তিত হচ্ছে। হলুদ থেকে লাল, আমি থেমে গেছি। কখন সবুজ হবে, আমি যাবার চেষ্টা করছি। মোটর সাইকেলে বসা পুলিশম্যানকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি কি এবার পালাব? বড়ো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছি। উনি বোধহয় আমার কথা ভুলে গেছেন। অন্য কাউকে ধরবার চেষ্টা করছেন। আমি আরও বেশি জোরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম।

বিশমার্ক হোটেলে পৌঁছে গেছি। কী আশ্চর্য, বিশ্বাস করতে পারছি না। সেই পুলিশের লোকটি দাঁড়িয়ে আছেন।

জ্বলন্ত চোখে আগুন–কী হে ছোকরা, আমার হাত থেকে পালাবে ভেবেছিলে?

আমি আমতা আমতা করছি স্যার, আমি পালাতে চাইনি। আমি তো আপনাকে আমার ড্রাইভারের লাইসেন্স দিয়েছি। আমি এখানে আসছি, বলেছি।

–ঠিক আছে, চলো, আমরা পুলিশ স্টেশনে যাব।

আমি বেপরোয়া– বাবাকে ডাকব?

–অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।

–এক সেকেন্ড সময় লাগবে।

–যাও, এখনই করো।

আমি বাড়ির নাম্বারে ফোন করলাম। বাবা ফোন ধরল।

বাবা?

কী হয়েছে?

–আমি এখন পুলিশ স্টেশনে যাচ্ছি। পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বললাম।

বাবা বলল- আমি একবার অফিসারের সঙ্গে কথা বলব।

আমি পুলিশম্যানকে বললাম আমার বাবা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

লোকটা বলল- ঠিক আছে, না, আমি শুনব না। আপনার ছেলেকে নিয়ে থানায় যাচ্ছি। কী? ব্যাপারটা ভালোই, তার মানে? আমার একজন শালা আছে, তাকে চাকরি দিতে হবে। ঠিক আছে, আমি ঠিকানাটা নিচ্ছি।

উনি লিখতে বসলেন। তারপর বললেন– মিঃ সেলডন, কাল সকালে পাঠিয়ে দেব, কেমন? আর আপনার ছেলের জন্য চিন্তা করতে হবে না।

আমি ওদের সংলাপ শুনছিলাম। অবাক হয়ে গেছি। অফিসার রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। আমার হাতে ড্রাইভারের লাইসেন্সটা তুলে দিয়ে বললেন- আর কখনও এভাবে যাবার চেষ্টা করো না, কেমন?

আমি কাউন্টারে গিয়ে বললাম– ফিল লেভান্ট কোথায়?

-উনি অর্কেস্ট্রা রুমে আছেন।

ম্যানেজারের অফিসে গিয়ে আমি একজন ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম, মধ্য পঞ্চাশ . বয়স।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। উনি বললেন–তা হলে এই হল সেই বিস্ময়কর প্রতিভা। আমার নাম ব্রেন্ট, আমি টি. বি হার্মসের সঙ্গে আছি।

টি, বি. হার্মস হল সবথেকে বড় সংগীত বিষয়ক প্রকাশক।

উনি আমাকে বললেন- ওরা নিউইয়র্কে তোমার গান শুনেছে। এটা প্রকাশ করতে চাইছে।

আমার অন্তর আনন্দে গান গাইতে শুরু করেছে।

 উনি বললেন একটা সমস্যা।

–কী সমস্যা?

—ফিল লেভান্টকে দিয়ে এই কাজটা হবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষকে দিয়ে এই কাজটা করতে হবে।

আমার হৃদয় বসে গেল। আমি তো আর কাউকে চিনি না।

–ড্রেক হোটেলে হোরেস হেইডট সংগীত পরিচালনা করেন। ব্রেন্ট বললেন- তুমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারো। তাকে তোমার গানটা শোনাতে পারো।

হোরেস হলেন এই দেশের সবথেকে জনপ্রিয় ব্যান্ড লিডার।

উনি আমার হাতে হোরেসের কার্ড দিলেন। বললেন– ওনাকে বলো আমাকে একটা ফোন করতে। উনি আমার ঘড়ির দিকে তাকালেন, প্রায় বারোটা বাজে। হোরেস এখন হয়তো বাজাচ্ছেন।

আমি বাবার গাড়িতে করে ড্রেক হোটেলে পৌঁছে গেলাম। সেখানে নামলাম। বলরুমের দিকে যাব। সেখানে হোরেস বসে আছেন।

ডেস্কে বসে থাকা ভদ্রমহিলা বললেন- আপনার কি রিজার্ভেশন আছে?

-না, আমি হোরেসের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি।

উনি একটা ফাঁকা টেবিল দেখিয়ে বললেন- এখানে অপেক্ষা করুন।

পনেরো মিনিট কেটে গেছে। হোরেস এগিয়ে এসেছেন, আমি বললাম- মিঃ হেইডট, আমার নাম সিডনি সেলডন, আমি আপনাকে একটা গান শোনাতে চাইছি।

দুঃখিত, আমার হাতে সময় নেই।

 –কিন্তু হামস এটা করতে বলেছেন।

উনি চলে যাচ্ছেন, আমি চিৎকার করছি– হার্মস এটা প্রকাশ করতে চাইছেন। কিন্তু আপনি সাহায্য না করলে হবে না।

উনি থেমে দাঁড়িয়ে বললেন– দেখি।

আমি ওনার হাতে গানের লেখাটা তুলে দিলাম। উনি পড়ে বললেন- আহা, ভারী সুন্দর গান।

–আপনি সুর সংযোজনা করবেন তো?

–কিন্তু মোট লাভের অর্ধেকটা আমায় দিতে হবে।

আমি একশো শতাংশ দিতে রাজী ছিলাম ঠিক আছে। আমি ওনার হাতে ব্রেন্টের দেওয়া কার্ডটা তুলে দিলাম।

কালকে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করো।

পরের দিন রাতে আমি ড্রেক হোটেলে এলাম। আমি শুনতে পেলাম হোরেস হেইডট আমার গানটা বাজাচ্ছেন। অর্কেস্ট্রার অসাধারণ বৃন্দবাদন। ফিল লেভান্টের থেকে অনেক শ্রুতিমধুর। আমি বসলাম। হোরেস উঠলেন।

আমি বললাম– মিঃ ব্রেন্টের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে কি?

-হ্যাঁ, আমরা একটা শর্ত করেছি।

আমি হাসি। আমার গানটা এবার প্রকাশিত হবে।

 পরের দিন সন্ধ্যেবেলা ব্রেন্ট আমার সঙ্গে বিশমার্ক হোটেলে দেখা করতে এসেছে।

 আমি প্রশ্ন করলাম– সব কিছু ঠিক আছে?

-না, একটা সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা।

-হেইডট পাঁচ হাজার ডলার অ্যাডভান্স চাইছেন, কিন্তু একটা নতুন গানের জন্য আমরা কখনওই এত টাকা খরচ করতে পারব না।

আমার সমস্ত শরীর জমে পাথর। কাজ শেষ হল। আমি ড্রেক হোটেলে ফিরে গিয়ে হোরেসের সঙ্গে দেখা করলাম।

আমি বললাম– মিঃ হেইডট, আমি অ্যাডভান্সের কথা চিন্তা করছি না। আমি চাই, আমার প্রথম গানটা প্রকাশিত হোক।

উনি বললেন– এই গানটা প্রকাশিত হবে। এটা আমি নিজেই প্রকাশ করব। আমি আসছে সপ্তাহে নিউইয়র্কে যাব। সেখানে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পাবে।

রাতে হোরেসের অনুষ্ঠান থাকে। এছাড়া তিনি প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

তাহলে? আমার মাই সাইলেন্ট সেলফ  গানটা নিউইয়র্ক থেকে বেতারে সম্প্রচারিত হবে। সারা দেশের মানুষ শুনতে পাবে! কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি নিয়মিত হোরেসের অনুষ্ঠান শুনতে থাকি। হ্যাঁ, উনি ঠিক কথাই বলেছিলেন। বোরবার আমার গানটা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এটা কখনওই প্রকাশিত হয়নি।

এই ঘটনাতে আমি কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়িনি। বরং নিজস্ব প্রতিভার ওপর আমার আস্থা আরও বেড়ে গেল। আমি যদি এমন একটা গান লিখতে পারি, তাহলে আরও অনেক লিখতে পারব। আমি তাই করলাম। ফাঁকা সময় পেলেই পিয়ানোর সামনে বসে পড়ি। শব্দ সাজিয়ে গান লিখি। ভাবলাম, বারোটা গান হলে নিউইয়র্কে পাঠাব। বারোটা গান হল, নিজে গেলে কেমন হয়? সেখানে গেলে তো কাজেরও একটা সন্ধান হতে পারে।

মা আমার গান শুনত, সব সময় উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠত।

-ডার্লিং, তুই তো আরভিন হারলিনের থেকে অনেক সুন্দর গান লিখতে পারছিস। কবে নিউইয়র্ক যাবি?

আমি মাথা নেড়ে বললাম না, এখানে তিন তিনটে চাকরি। আমি কী করে নিউইয়র্ক যাব।

মা শান্তভাবে বলেছিল- তোকে যেতেই হবে। নিজে না গেলে কোনো কাজ হবে না।

–অনেক খরচ।

–ডার্লিং, একটা মস্ত বড় সুযোগ, এই সুযোগ হাতছাড়া করিস না।

 আমি জানি না, মা কীভাবে আমাকে উদ্দীপ্ত করতে চাইছে।

রাতে অনেক আলোচনা হল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, আমি নিউইয়র্কে যাব। সেখানে একটা চাকরি করব, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার গান ভালোভাবে বিক্রি না হচ্ছে।

পরের শনিবার যাত্রা করব। মা আমাকে নিউইয়র্কে যাবার একটা টিকিট কেটে দিয়েছিল। গ্ৰেহাউন্ড বাসে।

রিচার্ড আর আমি সমস্ত রাত গল্প করেছিলাম।

 রিচার্ড বলেছিল– আরভিন হারলিনের মতো তুই গান লিখবি?

আমি বলেছিলাম হ্যাঁ।

–তা হলে? অনেক টাকা আসবে, আমার মাকে আর কাজ করতে হবে না!