১. চারজনের আর জায়গা

একা একা – উপন্যাস – বিমল কর

০১.

পাশাপাশি চারজনের আর জায়গা হল না। মালপত্রেই গাড়ির বারো আনা ভরে গিয়েছিল; শরদিন্দু যেরকম লটবহর জুটিয়েছেন, মনে হচ্ছিল, আধখানা সংসারই তুলে এনেছেন। হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সিঅলাদের যা ধরন, তাতে এই পর্বতপ্রমাণ মালপত্র তারা কিছুতেই এক গাড়িতে নিত না। কাঠফাটা দুপুররোদে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি-ট্যাক্সি করতে হত। ছেলেটার কষ্ট হত খুব, চোখের যন্ত্রণায় হয়তো ছটফট করত। শরদিন্দুও রোদে-তাতে অস্থির হয়ে উঠতেন। সাতপাঁচ ভেবে নীহার বাড়ি থেকে বেরুবার সময় একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন; দেবু দত্তদের গাড়ি, কখনও-সখনও তাঁকে এরকম দু-চার ঘণ্টার জন্যে ভাড়া নিতে হয়। ড্রাইভার কেষ্ট ছেলেটিও ভাল, দরকারে সাহায্য করে সবরকম। সোয়া এগারোটার গাড়ি এল পৌনে একটায়। এতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা, গরমে পচে যাওয়া; তবু কেষ্ট একটুও বিরক্ত নয়। নীহার কুলিদের বাবা বাছা করে, কেষ্টর খবরদারিতে মালপত্র সব তুলিয়ে নিয়ে শরদিন্দুকে সামনে বসতে বললেন। সামনেও কিছু মালপত্র রাখতে হয়েছে। নীহাররা বসলেন পেছনে; নীহার, তনুশ্যাম আর রিনি।

গাড়ি ছাড়লে নীহার মাথার কাপড় নামিয়ে ঘাড়-গলার ঘাম মুছতে লাগলেন; চেহারা দিন দিন ভারী হয়ে উঠেছে, তার ওপর এই দুপুরের রোদ, গরম, প্ল্যাটফর্মে বসে অপেক্ষা, ভিড়।

নীহারের পাশে তনুশ্যাম। ছেলেটাকে জানলার পাশে বসাতে সাহস হয়নি নীহারের। গরমের হলকা যদি চোখে লাগে বেচারার খুব কষ্ট হবে। তনুর পাশে ডান দিকের দরজা ঘেঁষে বসে আছে রিনি, নীহারের মেয়ে। রিনি নিজেই হাওড়া স্টেশনে আসতে চেয়েছিল। নীহারও চেয়েছিলেন রিনি আসুক। তিনি একলা আসার চেয়ে মা-মেয়ে মিলে শরদিন্দুদের নিতে আসছেন, এটাই ভাল দেখায়।

রিনি যে শরদিন্দুদের দেখার পর থেকে আগাগোড়া হেসে মরে যাচ্ছে–এটা তেমন বোঝার উপায় নেই। হাসিটাকে সে নানাভাবে কখনও মুখ ফিরিয়ে, কখনও একেবারে উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কখনও বা ঠোঁট কামড়ে, মুখ আড়াল করে লুকিয়ে রাখছে। যখন আর সামলাতে পারছে না, হেসেই ফেলছে। নীহারের অবশ্য মেয়ের অত হাসি দেখার সময় কই! কুলি আর মালপত্রের দিকেই নজর তাঁর। শরদিন্দুও যেন নীহারের ব্যবস্থাপনা দেখছেন। আর তনুশ্যাম অবাক হয়ে দেখছে হাওড়া স্টেশন, লোকজন, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, আশপাশ।

শরদিন্দুর সাজপোশাকটাই রিনির কাছে খুব হাস্যকর লাগছিল। চার-পাঁচ, কি বড়জোর ছশো মাইল দূর থেকে আসছেন শরদিন্দুমামা; কিন্তু পোশাক দেখলে মনে হবে, খাস বিলেত থেকে এইমাত্র উড়ে এসে নেমেছেন। তাও আবার এখনকার বিলেত নয়, কেননা সেটা রিনি ছবি-টবিতে সিনেমায় দেখেছে। মামার পোশাকটা যেন ডেভিড কপারফিল্ডের লোকজনের মতন। রিনি ইংরেজি সিনেমায় সেকেলে বিলেতি পোশাক-আশাক চক্ষে দেখেছে বলে তার এই রকম মনে হচ্ছিল। এই পচা গরমেও বিচিত্র সুট, টাই, ভেস্ট এবং টুপি। মার ধমকে টুপিটা অবশ্য এখন মামার কোলে; কিছু কাঁচা, কিছু পাতলা সাদা চুল টুপির চাপে পাট হয়ে বসে আছে মাথায়।

মামার ছেলেটি যদিও পোশাকে-আশাকে মামার মতন নয়, তবু তার প্যান্টের কাটছাঁট, চেককাটা জামাটার বাহার দেখলে মনে হবে, এ একেবারেই খোট্টাই ছাঁট। নামেরই কী বাহার ছেলেটার। তনুশ্যাম! ঘনশ্যাম হতে দোষ ছিল কোথায়? রিনিদের কলেজে এক ঘনশ্যাম ছিল, ঘণ্টা বাজাত। রিনিরা তাকে বলত, ঘণ্টাশ্যাম। একে তো আর তা বলা যায় না। শরদিন্দুমামার ছেলে, মার খুব আদরের জন। অথচ মা ছেলেটাকে নাকি দেখেইনি; একবার মাত্র দেখেছিল, তখন তনুশ্যাম একেবারে বাচ্চা, হাফপ্যান্টও হয়তো ঠিক মতন পরতে পারত না। তা হলে রিনি তখন কত? মানে বয়েস কত রিনির? মা বলে, রিনি তখন কাঁথা ভেজাত। দমকা হাসি এসে গেল রিনির, সে হেসে ফেলে গলা চাপবার চেষ্টা করল, রুমালটা কোলের আশেপাশে কোথায় পড়ে গেছে, আঁচলটাই মুখে চেপে ধরল।

নীহার এবার ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাসছিস?

রিনির জবাব দেবার কিছু ছিল না; সে খুব বুদ্ধি করে আঙুল দিয়ে দরজার বাইরেটা দেখাল। হাসির উপাদানটা কোথায় তা জানার উপায় থাকল না। গাড়ি চলছে। রিনি তার জানলার দিকেই আঙুল দিয়ে বাইরে কিছু দেখিয়েছে। কাজেই উপাদান যদি কিছু থেকেই থাকে সেটা পেছনে পড়ে গেছে এবং আড়ালে। নীহার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি বরং দেখলেন, গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছে। তনুশ্যামকে হাওড়া ব্রিজ আর গঙ্গা দেখাতে লাগলেন নীহার। তনুশ্যামও অবাক হয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখতে লাগল।

শরদিন্দু সামনে থেকে বললেন, আমাদের সময়ে ছিল কাঠের পুল–ফ্লোটিং ব্রিজ। নতুনটা সবে তৈরি হচ্ছিল। বলে শরদিন্দুও যেন সেই পুরনো ব্রিজটার ছিটেফোঁটা অস্তিত্ব খুঁজতে লাগলেন। ধরতে পারলেন না।

নীহার বললেন, তোমাদের সময়ের কলকাতার কতটুকুই আর আছে। সে কলকাতার সঙ্গে এখানকার আর মিল খুঁজে পাবে না।

তাই শুনি, শরদিন্দু বললেন আস্তে করে, পুরনো কলকাতা মরে গেছে।

রিনির পায়ের কাছে একটা বাস্কেট, তার ওপর একটা হাত দেড়েকের সুটকেস, কোনও রকমে রিনি পায়ের আঙুলগুলো রেখে গোড়ালি তুলে বসে আছে। তার কোমরের তলার দিকের বিশ্রী চাপ পড়ছিল তনুশ্যামের ওপর। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল রিনির। একদিকে ভার দিয়ে বসেও সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তনুশ্যামও নড়তে পারছে না; তার ওপাশে মা, জলের ফ্রেমসমেত কুঁজোটা তনুর পায়ের তলায়, কোলের ওপর টাইমটেবল, কাগজপত্র, বই। রিনির পা যদি ভার রাখতে পারত তাকে এভাবে হেলে পড়তে হত না ছেলেটার দিকে। তবু রিনি চেষ্টা করল যাতে তার পায়ের দিকের চাপটা আলগা করা যয়। মার তনুশ্যামের তনুটি রোগা-সোগা, বড় জোর বলা যায় ছিপছিপে। গায়ের চেককাটা পুরো হাতার মোটা শার্টটার জন্যে রোগাটে ভাব অতটা বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটার রং শ্যামলা, প্রায় কালচে। বোধহয় সেইজন্যেই নাম হয়েছে তনুশ্যাম। মুখটি খুব মোলায়েম, মেয়েমেয়ে ঢঙের, মানে–মেয়েলি নয়, কিন্তু নরম, শান্ত ধরনের। সারা মুখে পাতলা দাড়ি, মাথার চুলগুলো রুক্ষ, লালচে, পাতলা। চোখে মোটা কাচের চশমা, সাদা কাচের চশমা নয়, রঙিন চশমা–তাতে আবার কানের দিকটাও আড়াল করা। চশমাটা এমনই যে চোখ পুরোপুরি ঢাকা তনুশ্যামের, চোখ দেখা যায় না। রিনি যতবার চোখ দেখার চেষ্টা করেছে, ঘন নীলচে কাঁচ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। অথচ তনু তার গগলস ধরনের চশমার ভেতর থেকে নিশ্চয় রিনিকে দেখতে পাচ্ছে। রিনির এতে কেমন এক আপত্তি হচ্ছিল, তুমি আমায় দিব্যি দেখবে আর আমি তোমায় দেখব না তা হয় না।

গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে এসেছে কখন। ডান দিকে আসতে আসতে আবার যখন বাঁয়ে মোড় নিল, রিনি একেবারে আচমকা বালিশের মতন ধপ করে তনুশ্যামের কোলে ঢলে পড়ল। তার মাথাটা তনুর বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে একেবারে কোলে কাগজপত্রের ওপর।

রিনি ভীষণ অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে শুনল তনুই হাসছে।

নীহার মেয়ের গড়িয়ে পড়া দেখে অবাক। তারপর হেসে ফেললেন, ঘুমে ঢুলছিলি নাকি?

 রাগ করে রিনি বলল, ধত, এভাবে বসা যায়?

নীহার বললেন, কেন যাবে না। আমরা বসে নেই? তুই যদি বসে বসে ঢুলিস, তবে আর বসার দোষ কী!

রিনি বলল, আমি মোটেও ঢুলিনি। মার চেয়েও তার বেশি রাগ হল, তনুর ওপর। ছেলেটা কেমন করে হাসল! অসভ্য একেবারে। রিনি যেন জেদ করেই তনুকে পাশ থেকে চেপে কোমর দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিজের বসার জায়গা করতে লাগল। তনু আরও গুটিয়ে নিতে লাগল নিজেকে। শরদিন্দু হঠাৎ বললেন, নীহার, হাইকোর্ট।

নীহার হেসে বললেন, তুমি দেখো তোমরা তো কোনও কালে বাঙাল ছিলে শুনেছি।

তনু এদিক ওদিক তাকিয়ে হাইকোর্ট খুঁজছিল, রিনি চট করে আঙুল দিয়ে ইডেন গার্ডেনসের দিকটা দেখিয়ে দিল। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো আর কী! তারপর মুখ ফিরিয়ে হাসতে লাগল।

গড়ের মাঠের কাছে এসে নীহার তনুকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখাচ্ছিলেন, রিনি দাঁতে ঠোঁট কেটে টুক করে বলল, পাশেই সবটা গড়ের মাঠ। বলে, মুখ ফিরিয়ে হাসল।

শরদিন্দু বললেন, নীহার, আমি কখনও ওই মেমোরিয়ালের ভেতরে যাইনি।

নীহার হেসে বললেন, কলকাতায় থাকতে তুমি বাপু দুটি মাত্র জিনিস দেখেছিলে, এক তোমার কলেজ আর ঠনঠনিয়ার কালীবাড়ি।

শরদিন্দু হাসির গলায় বললেন, আরে না না, আরও কত কী দেখেছি। আমি বছরে বার-দুই করে জু-য়ে বেড়াতে যেতাম।

নীহার বেশ জোরেই হেসে ফেললেন। হেসে কী মনে হল, তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি তো শিবপুরেই বেশি যেতে।

হ্যাঁ, বটানিকসে।

তা তো যাবেই; ওই গাছ-গাছড়াই তোমার জিনিস…এলে যখন আর একবার দেখে যেয়ো৷

যাব, একবার।

মামা, রিনি বলল, আমি আপনাকে এবার একদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘুরিয়ে নিয়ে যাব।

শরদিন্দু বললেন, বেশ তো, একদিন সবাই মিলে বেড়াতে আসা যাবে।

 শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কেন–নীহার বললেন, তোর মামাকে নিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়াস। কবে কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় ছিল, সে কলকাতা আর নেই। কত দেখার জিনিস হয়েছে! বলে তনুর দিকে তাকালেন, ছেলেটাও কলকাতায় এল প্রথম, ওকে সব দেখাতে হবে।

গাড়ি পি জি হাসপাতালের কাছাকাছি আসতে তনুশ্যাম আস্তে করে নীহারকে বলল, আমি চশমাটা খুলব একটু?

নীহার মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি বললেন, না না, না বাবা। এই দুপুর, রোদ গনগন করছে, গরম বাতাস, দেখছ না।

শরদিন্দু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, চোখে জল পড়তে শুরু করবে, শ্যাম; ট্রেনেই যথেষ্ট অত্যাচার হয়ে গেছে।

তনুশ্যাম আর কোনও কথা বলল না।

রিনি মুখ ফিরিয়ে তনুশ্যামকে দেখছিল। মার কাছে সবই শুনেছে রিনি। তনু চোখের অসুখে ভুগছে অনেকদিন ধরে। বাচ্চা বয়স থেকেই। কয়েক বছর বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, চিকিৎসা করেছে; কিছু হয়নি। শরদিন্দুমামা ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন চোখের চিকিৎসার জন্যে। রিনির বাবা নিজেই চোখের ডাক্তার ছিলেন কিন্তু তিনি তো আর নেই, রিনির বছর তেরো বয়সে তিনি চলে গেছেন। বাবা থাকলে বাবাই তনুর চোখ দেখতে পারত। বাবা না থাকলেও কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার রয়েছেন, তাঁরা দেখবেন, বাবার বন্ধু হিসেবেও দু-একজনকে মা চেনেন, তাঁরা দেখবেন।

তনুশ্যামের জন্যে রিনির দুঃখই হল। মার কাছে যখন শরদিন্দুমামার চিঠি আসত, মা যখন এই ছেলেটির চোখের অসুখের কথা বলত-টলত, রিনি হয়তো সহানুভূতি বোধ করত কিন্তু তার তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না। তারপর সে শুনল শরদিন্দুমামারা কলকাতায় আসছেন। ইদানীং তার খানিকটা কৌতূহল হচ্ছিল। আজ তনুশ্যামকে দেখে রিনি বুঝতে পারছে বেচারির সত্যিই বড় কষ্ট। চোখ দুটো থেকেও যেন না থাকার মতন হয়ে আছে। রিনি তনুর চোখ দুটি কেমন তা দেখার জন্যে কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠল।

হরিশ মুখার্জি রোডে গাড়িটা ঘুরে যাবার পর রিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ফুটপাথ ঘেঁষে ছায়া পড়েছে খানিকটা, গাছের ছায়া। অন্যদিকে রোদ ঝলসে যাচ্ছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় কিছু খই পড়ে আছে ছিটিয়ে, কয়েকটা শুকনো ফুল। বোধহয় খানিকটা আগে হাসপাতাল থেকে কারও মৃতদেহ চলে গেছে, তারই কিছু চিহ্ন। রিনি বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকল।

বাড়ি এসে মালপত্র তুলতে তুলতে দুটো বেজে গেল। নীহার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জিনিসপত্র টানাহেঁচড়া খোলাখুলি করতে দিলেন না। মাঝদুপুর পেরোতে চলল, এখন রোদে-তাতে পোড়া মানুষগুলো আগে একটু জিরিয়ে স্নান-খাওয়া করে নিক, শরীরটা জুড়োক, তারপর বাক্স-বিছানা খুললে হবে।

ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নীহার রাখেনি। বাড়িটা এমন কিছু ছোট নয়। বাঁ দিকটায় দুঘর ভাড়াটে; তাদের সঙ্গে এদিকটার কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই। ওপাশটা আলাদা। এপাশে ডান দিকে নীচের তলায় একটা নার্সারি স্কুল, দোতলায় নীহাররা থাকেন, তিনতলাতেও দেড়খানা ঘর রয়েছে। নীহারদের দিকটা পড়েছে দক্ষিণে। বারান্দা ঘেঁষে পর পর ঘর, পুবের দিকে একটা বাঁক মতন আছে। শরদিন্দুর জন্যে তেতলার ঘরটাই রেখেছে নীহার। গরমের দিনে দুপুরটায় খানিক কষ্ট হলেও বিকেল পড়ে গেলে বেশ ভালই লাগবে। ঘরের লাগোয়া ছোট এক ফালি ছাদ, টবের কিছু গাছপালা, ফাঁকা, নিরিবিলি কাজ চালাবার মতন বাথরুমও আছে একটা। বাকি আধখানা ঘরে এ বাড়িটার নানান অব্যবহার্য জিনিস জমা করা ছিল। সেটা কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে, দরকারে জিনিসপত্র রাখা যেতে পারে।

দোতলায় একটা ঘর ঠিক করা হয়েছে তনুশ্যামের জন্যে। কোনার দিকের ঘর। ঘরটা ছিল রিনির পড়াশোনার, একপাশে তার গানবাজনার কিছু সরঞ্জাম থাকত, আর যত টুকিটাকি। সেই ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে জিনিসপত্র সরিয়ে খাট পেতে তনুর ঘর করে দেওয়া হয়েছে; পাশেই নীহারের ঘর। নীহারের ঘরের গায়ে গায়ে রিনির শোবার ঘর।

চওড়া বারান্দার সামনে উঁচু রেলিং; রেলিংয়ের মাথায় মাথায় রোদ-জল বাঁচাবার জন্যে কাঠের ফ্রেমে কাচের মোটা শার্সি বসানো, আগাগোড়া। সাদা এবং নীলচে রঙের শার্সিগুলো বাহারি। বারান্দার একদিকে বসার অন্যদিকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। নীহারের হাতের গুণে সবই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি।

স্নান খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে তিনটে বেজে গেল। তারপর নীহার বসলেন খেতে, রিনিও মার সঙ্গে বসল। শরদিন্দুকে তাঁর ঘরে পাঠানো হয়েছে বিশ্রামের জন্যে। তনুশ্যাম তার ঘরে শুয়ে আছে বোধহয়।

রিনি বলল, মা, আজ আর আমার মাধুরীদের বাড়ি যাওয়া হবে না। এরপর আর কখন বেরুব?

নীহার বললেন, আজ আর কী করে বেরুবি; বাড়িতে মানুষজন এল। বিকেলে ওদের গোছগাছ করে দিতে হবে না?

গোছগাছের আছে কী? তুমি তো সবই গুছিয়ে রেখেছিলে। ওরা যে কেন গন্ধমাদন বয়ে আনল বাপু কে জানে!

নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ওই রকম মানুষ যে!

বলে একটু থেমে আবার বললেন, কতদিন থাকবে তার তো কিছু ঠিক নেই, পনেরো দিন একমাস হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। তাই লটবহর বয়ে এনেছে।

রিনি এবার একটু দই মুখে দিল। স্বাদ পরখ করে সামান্য নুন মেশাল। বারান্দার শার্সিগুলো প্রায় সব বন্ধ। কাচের নীলচে রঙের জন্যে ছায়া পুরু হয়ে আছে: খোলা দু-এক পাট শার্সি দিয়ে আলো আর বাতাস আসছিল। মাথার ওপর হু হু করে পাখা ঘুরছে। বারান্দার বেসিনের দিকে পেতলের টবে একটা অর্কিড, তার প্রায় মাথার ওপর রিনির হাতের মানিপ্ল্যান্টের লতানো নকশা।

রিনি আরামের মুখে দই খেয়ে জিবের শব্দ করল বার কয়েক, তারপর বলল, এক মাসেরও বেশি! বাব্বা, ছেলেটার চোখে এত কী হয়েছে?

নীহার মেয়ের দিকে তাকালেন। ছেলেটা কীরে? তুই কি ওর নাড়ি কেটেছিস?

হেসে ফেলল রিনি। ভদ্রলোক বলব নাকি?

এর নাম নেই! অমন সুন্দর নাম-

ঘনশ্যাম।

নীহার প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও পরে রিনির ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে বললেন, রাখ; তোদের আজকালকার নামের যা ছিরি, নাম না খাঁড়ার ঘা, বোঝা যায় না। ও আমাদের তনুশ্যামই ভাল। আমিও তো শ্যাম বলি; তুই শ্যামদা বলবি।

রিনি হি হি করে হেসে উঠল। হাসির দমকে তার সারা গা কাঁপছিল।  তুমি মা একেবারে যাচ্ছেতাই, রিনি বলল, ওকে আমার শ্যামদা বলতে বয়ে গেছে।

নীহারেরও খাওয়া শেষ হয়ে আসছিল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলবি না?

ধ্যুত!

শ্যাম তোর চেয়ে বয়সে বড়।

কত বড়? দু-এক বছর? আবার কী?

না–নীহার বেশ হেলিয়ে মাথা নাড়লেন, কম করেও বছর তিনেকের। আমার বেশ মনে আছে, আমি যখন ওকে দেখি তখন ওর বছর পাঁচ বয়েস। তুই তখন কতটুকু। মার কাছে গেলাম তোকে নিয়ে, বাবা বলল–হ্যাঁরে নীহার, এ যে মাথায় দেড় ফুটও হয়নি। আমার বাবা তোকে বলত, ফুটকি। …

রিনি চেয়ার ঠেলে উঠি উঠি ভাব করল। আঃ মা–তোমার বাপের বাড়ির গল্প আর আমি শুনতে পারি না।

নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, তারপর বললেন, আমার বাপের বাড়ির গল্প তোকে আমি কত শোনাই রে? খুব যে বলছিস?

রিনি হেসে বলল, রোজ শোনাও।

 রোজ?

বেশ, রোজ না হয় না হল, একদিন অন্তর।

নীহার যেন অতিরিক্ত মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। রিনি, তুই মার সঙ্গে চালাকি করছিস?

এবার রিনি উঠে দাঁড়াল। তার খুব হাসি পাচ্ছিল। মার বাপের বাড়ির গল্প সে এত শুনেছে যে, মার বদলে সে নিজেই দাদুদের বাড়ির, পাড়ার, মানুষজনের, কে কবে জন্মেছে, কবে মরেছে, কোন আমগাছে কোন বছরে বাজ পড়েছিল সব বলে দিতে পারে। রিনি জানে, মার কাছে বাপের বাড়ি বড় বেশি নিজের জিনিস। মাকে সে মাঝে মাঝে রাগাতে চাইলেও সত্যি কি আর দুঃখ দিতে চায়! রিনি হেসে বলল, বেশ বাবা, হপ্তায় একবার, না-হয় মাসে একবার তোমার বাপের বাড়ির গল্প শুনেছি, হল তো? যাক গে, তোমার শ্যামচাঁদের বয়েস আমার চেয়ে এমন কিছু বেশি নয়। এ বড়জোর তেইশ; আমি কুড়ি। আমি ওকে দাদা-টাদা বলতে পারব না। আজকাল মেয়েরা কথায় কথায় অত দাদা বলে না। আমি ওকে শ্যামচাঁদ বলে ডাকব। বলে রিনি হাসি চেপে বেসিনে মুখ ধুতে চলে গেল।

নীহার খানিকটা চুপ করে বসে থেকে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের মুখ ধোওয়া দেখলেন। তারপর বললেন, তোর খুব ইয়ার্কি হয়েছে। শ্যামকে তুই শ্যামচাঁদ বলবি কেন? চাঁদটা তুই পেলি কোথায়?

রিনি বেসিনের কল বন্ধ করল। বলল, তোমার আঁচল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কুড়িয়ে নিয়েছি, বলে খিল খিল করে হেসে উঠল।

.

০২.

শরদিন্দু তখনও আলস্য বোধ করছিলেন। বেলা পড়ে গিয়েছে, বিকেলেও হয়ে গিয়েছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানেনা। মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ, পাশের জানলা খানিকটা ভোলা, পরদা ঝুলছে গাঢ় রঙের। পরদার ওপর দিয়ে বিকেলের ঝিমোনো রোদ দেখা যাচ্ছিল।

অল্প করে দরজা খুলে নীহার ঘরে পা বাড়ালেন। তাঁর প্রথমে মনে হয়েছিল, শরদিন্দু ঘুমোচ্ছেন, পরে সিগারেটের গন্ধে বুঝলেন মানুষটি নিশ্চয় জেগে আছেন।

ঘুমোচ্ছ? নীহার বললেন। ঘুমন্ত মানুষকে কেউ ঘুমোচ্ছ বলে না, নীহার নিজেই যেন মনে মনে হাসলেন।

সাড়া দিলেন শরদিন্দু।

দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নীহার; সাড়া পাবার পর দরজার পাট খানিকটা খুলে দিলেন। চৌকাঠ থেকে রোদ অনেক দূরে সরে গেছে। ঘরের মধ্যে এগিয়ে এসে নীহার বললেন, ওপরের ঘরে শুতে কষ্ট হল? গরম পেলে খুব?

না। তোমাদের কলকাতায় আর গরম কোথায়! গরম আমাদের দিকে।

 তোমাদের ওদিকে তো বলো পাহাড়।

পাহাড় মানে পাঁচমারি হিলসের একটা রেঞ্জ। আমাদের ওখান থেকে মাইল দশা শরদিন্দু বিছানা থেকে সামান্য উঠে বালিশে ভর দিলেন। এম পির ক্লাইমেট সব জায়গায় এক রকম নয়। কোথাও কোথাও বেজায় গরম পড়ে, আমাদের বিহারের মতন। কোনও কোনও জায়গায় মডারেট ক্লাইমেট। তবে শীতটা বেশিই হয়।

নীহারের মনে হল ঘুম থেকে শরদিন্দু বেশিক্ষণ ওঠেননি৷ হাই তুলছেন বড় বড়। জল খাবে? নীহার জিজ্ঞেস করলেন।

দাও। তোমাদের ঠাণ্ডা-জল নয়।

 ঘরেই জলের পাত্র ছিল। নীহার জল গড়িয়ে দিলেন।

শরদিন্দু তৃষ্ণার্ত হয়েছিলেন; জল খেয়ে আরামের শব্দ করলেন। তারপর কী মনে করে বললেন, আমার পেটে কলকাতার জল পড়ল কত বছর পরে বলো তো?

নীহার মুচকি হাসলেন। সে তো তোমারই মনে রাখার কথা।

 শরদিন্দু যেন হিসেব করছিলেন নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে। বললেন, বছর আটাশ হবে। হবে না?

নীহার সায় দেওয়া ঘাড় নাড়লেন, ওই রকমই হবে।

 আমি কলকাতা ছাড়লাম, যুদ্ধের মাঝামাঝি। ফরটি টুয়ে, অগাস্ট রেভুলেশনের বছর।

ছিলেই বা কবছর। নীহার এবার মাথার দিকের জানলা খুলে দিচ্ছিলেন। পাশের জানলাও পুরোপুরি মেলে দিলেন। ঘরে পড়ন্ত বিকেলের স্বাভাবিক আলো এল।

শরদিন্দু বললেন, কলকাতায় আমার বছর চারেক থাকা। কলেজের কটা বছর। যুদ্ধ লেগে সব এলোমেলো হয়ে গেল; আমি হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলাম।

নীহার সবই জানেন। তাঁর কাছে শরদিন্দুর জীবনের অন্তত গোড়ার ছাব্বিশ সাতাশটা বছর নিজের জীবনের মতোই জানা। বিছানার পায়ের দিকের দেওয়াল ঘেঁষে মালপত্র ডাঁই করা আছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন নীহার। তারপর বললেন, মুখ টুখ ধুয়ে এসো; চা খাও।

চা হয়ে গিয়েছে?

 হচ্ছে। পাঁচটা বাজতে চলল।

পাঁচ? …আমি বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছি তা হলে! শরদিন্দু এবার ছোট মাপের হাই তুললেন। তুমি এত খাওয়ালে, খেয়েদেয়ে আমি সেই যে এসে ব্যাঙের মতন চিত হলাম, আর এপাশ ওপাশ করতে পারি না শরদিন্দু হাসতে গিয়ে কাশি বাধিয়ে ফেললেন।

নীহার মজা করে বললেন, তুমি আর খেলে কোথায়? মাছের কাঁটা বাছতে ভুলে গেছ, খাবে কী?

বিছানা থেকে নেমে পড়তে পড়তে শরদিন্দু বললেন, লোক আগে আমাদের ছাতু বলত, মনে আছে নীহার। এখন আবার বলে মাছু। কেন যে বলে কে জানে। তা মাড়ুদের দেশে থাকতে থাকতে মাছ খাওয়া ভুলে গিয়েছি। …তবে তুমি আজ যত রকম মাছ খাইয়েছ সব বলতে পারি।

নীহার হেসে বললেন, আচ্ছা,.সে আর বলবে কী? খাবার সময়েই তো আমরা বললাম।

শরদিন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, বললে নাকি! তবে তো আমার আর বলার উপায় থাকল না। পারশে মাছের ঝালটা আমার মুখে লেগে আছে এখনও। কত বছর পরে পারশে মাছ খেলাম। শরদিন্দু যেন ঝালের স্বাদটা এখনও জিবের কোথাও রেখে দিয়েছেন এমন এক মুখ করলেন।

নীহার বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন। বুড়ো বয়সে কত যে করছ। যাও মুখ ধুয়ে এসো।

শরদিন্দু পরিতৃপ্ত মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

সামান্য পরে শরদিন্দু ফিরে এসে দেখলেন নীহার ঘরে নেই। চশমাটা খুঁজে নিয়ে বেতের হেলানো চেয়ারটায় তিনি বসলেন। বেতের ওপর পাতলা গদি পাতা রয়েছে: তুলোর গদি। গদিটা নতুন নতুন লাগছে। একরঙা একটা পিঠ কাপড়ও রেখেছেনীহার। শরদিন্দুর মনে হল, তাঁর জন্যেইনীহারের এত ব্যবস্থা। জানলার গা ঘেঁষেই বসলেন শরদিন্দু। পাখাটা আগের মতন ঘুরে যাচ্ছে।

বাইরে নীহারের গলা পাওয়া গেল। তেতলায় পা দিয়ে ঝি কিংবা চাকরকে কিছু বলছিলেন হয়তো, তারপর ঘরে এলেন।

তোমাকে আর নীচে নামালাম না, চা নিয়ে এলাম নীহার বললেন। তাঁর হাতে শরদিন্দুর চা।

 শ্যাম কী করছে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন।

চা খেয়ে এই তো উঠল,নীহার শরদিন্দুর চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট দেখছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কলকাতা দেখছে।

শরদিন্দু চায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বললেন, ওর কলকাতা দেখার খুব সাধ ছিল।

কার না থাকে, তোমারও ছিল. নীহার যেন মুচকি হাসলেন, চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শরদিন্দুর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। কলকাতায় পড়তে আসার জন্যে তোমার কী বায়না! আমার বাপু বেশ মনে আছে। জ্যাঠামশাইয়ের মোটে ইচ্ছে ছিল না তুমি কলকাতায় পড়তে আস। তিনি চাইছিলেন পাটনা পাঠাতে। কাছে হত। কলকাতা ওঁদের পছন্দ ছিল না। তা তোমার একেবারে ধনুকভাঙা পণ, সেই কলকাতাতেই এলে। জেদে তোমায় কে হারায়।

শরদিন্দু যেন পুরনো কথাটাকে তেমন করে গায়ে মাখলেন না, বললেন, আমি শখ করে কলকাতায় আসিনি। কলকাতায় পড়ার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। পুরো সাধটা আর মিটল কই। তার আগেই পালাতে হল। বলে চায়ের কাপে মুখ দিতে গিয়ে বললেন, তোমার চা?

আমি সন্ধের আগে চা খেতে পারি না আর। বলে সামান্য সরে এসে জানলার পরদাটা আরও গুটিয়ে দিলেন নীহার। রোদ আসছে না। বাতাসই আসছিল। মধ্যে অম্বল-টম্বল নিয়ে খুব ভুগেছিলাম। আলসারের মতন হয়ে গিয়েছিল। ধরাকাটা করে থাকতে হত। বিকেলে চা খেলে বুকটা জ্বালাজ্বালা করে। সন্ধেবেলাতেই খাই।

শরদিন্দু আয়েশ করে ধীরে সুস্থে চা খেতে লাগলেন। নীহার বললেন, আমি ভাবলাম, তুমি বসে বসে চা খাবে, আমি তোমার মোটঘাট খুলে যা-যা দরকার বের করে গুছিয়ে দেব।

শরদিন্দু বললেন, দেবেখন; একটু বোসো৷

বসব তো। আমি বসে বসেই কাজ করব। আমার কি আর দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা আছে। দেখছ না, কেমন ভারী হয়ে গিয়েছি।

ভারী–? শরদিন্দু হাসি হাসি মুখ করলেন।

 মোটা বলবে তো? বলল। নীহার হাসলেন।

শরদিন্দুনীহারকে দেখতে লাগলেন। এই নীহারের সঙ্গে পুরনোনীহারের তুলনা করা ঠিক নয়, বয়স মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই বদলায়, কখনও কখনও অতিমাত্রায়, চেনাই যায় না। নীহারকে কিন্তু চেনা যায়। মুখের অদলবদল সত্ত্বেও আদলটি তেমন কিছু পালটায়নি। চৌকো ধরনের মুখে সামান্য চাপা থুতনি নীহারকে চিনিয়ে দিত, আজও দেয়। তফাতের মধ্যে, তখন যা ছিল ছিমছাম পরিষ্কার এখন তা ভরাট হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখটাই প্রায় গোল দেখায়। নাকটি আরও ফুলে গিয়েছে, চোখ দুটি একেবারে সংসারী, মমতা মাখানো, মাসিপিসি ধরনের। নীহারের মাথার চুলও কোথাও কোথাও সাদাটে হয়ে আসছে। শরদিন্দুর মনে হল না, নীহারকে ঠিক মোটা বলা যায়, তবে বয়েসের মেদে কেমন এক গড়নভাঙা চেহারা হয়ে গিয়েছে নীহারের। নীহার এখনও সাদা থান পরে না, সরু কালো পাড়ের ধুতি পরে। হালকা হলুদ পাড়ের ধুতি পরে সে স্টেশনে গিয়েছিল। গায়ের জামা সাদা। গলায় সরু হার, হাতে সরু চুড়ি দু গাছা করে।

শরদিন্দু হেসে বললেন, তুমি আর মোটা কোথায়? ওই একটু..

নীহার হেসে জবাব দিলেন, মোটা নয়, তবে মোটামুটি–এই তো?

কথাটা উপভোগ করে শরদিন্দু হাসতে লাগলেন।

নীহার সামান্য অপেক্ষা করে বিছানার পায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন, মালপত্রের কাছে। তুমি কি সমস্ত সংসার উঠিয়ে এনেছ?

বাইরে বেরুলে কখন কী লাগবে বোঝা তো যায় না, নীহার। আমি দরকারিগুলোই নিয়েছি।

 এত জিনিস তোমার দরকারি! মোটা মোটা বিছানাগুলো বয়ে এনেছ কেন? আমি না তোমায় বিছানাপত্র আনতে বারণ করেছিলাম।

শরদিন্দু কী যে বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, তুমি লিখেছিলে ঠিকই। তবে আমি ভাবলাম, বেডিং-ফেডিং নেওয়া ভাল, দরকারে কাজে লাগবে।

তোমার ওই রকম ভাবনা। আমার বাড়িতে আর দুজনের বাড়তি বিছানা নেই!

শরদিন্দু অপ্রস্তুত বোধ করলেন।  তুমি যে কী বলো! ব্যবস্থা যা করে রেখেছ এ একেবারে রাজসূয়…।

তোমাদের বিছানা আমি খুলছি না। কাল রোদে দিয়ে আবার সব বেঁধেবঁধে রেখে দিতে বলব নারানদের। বেডিংয়ের মধ্যে তোমাদের দরকারি যদি কিছু রেখে থাকো কাল বের করে নিয়ো।

কী আছে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কাল দেখব।

ওই বড় ট্রাংকটা কার? তোমারই তো?

আমার। খোকারটা বোধহয় নীচেই থেকে গেছে।

 আর-একটা ছোট ট্রাংক?

 ওতে আমার জিনিস রয়েছে।

কী জিনিস? চাবি কোথায় তোমার?

 চাবি জামার পকেটে।

 সুটকেসে কী আছে?

 খুচরো জিনিস। ওষুধপত্র আছে কিছু।

 তোমার ওষুধ?

হ্যাঁ।

কী অসুখ তোমার?

ডেফিনিট কিছু নয়। ওই জেনারেল কমপ্লেন। বয়স বাড়লে যা হয়। এখানে ওখানে ব্যথা, অল্পসল্প দুর্বলতা, মাঝে মাঝে ঘুম না হওয়া–এই আর কি! ওষুধ-টষুধ তেমন একটা কিছু নেই, ক্রুশনসল্ট, হজমের দু-চারটে ওষুধ। তবে মাঝে মাঝে নিশ্বাসের একটা কষ্ট হয়, ব্রিদিং ট্রাবল..

নীহার দু পা এগিয়ে শরদিন্দুর ঝোলানো কোটের পকেটে হাত ডোবালেন। চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, নিশ্বাসের কষ্ট ভাল নয়। এখানে বড় কাউকে দেখিয়ে নাও। বুক নিয়ে অবহেলা করতে নেই।

শরদিন্দু চা খেতে লাগলেন।

পকেট হাতড়ে চাবিটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল। নীহার চাবি নিয়ে সোজা বাক্সর সামনে মাটিতে বসে পড়লেন।

তোমার কটা কাপড়-চোপড় আগে বের করে দিই। কোন ট্রাংক খুলব বলো?

 শরদিন্দু বললেন, তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমি নিজেই বার করে নিতে পারতাম।

নীহার ট্রাংকের তালার সঙ্গে চাবি মেলাতে লাগলেন। কথার কোনও জবাব দিলেন না।

শরদিন্দু উঠে গিয়ে সিগারেট, লাইটার নিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসলেন।

তোমায় দুটো পাজামা বের করে দিই, গেঞ্জিনীহার বললেন, কোন জামা পরবে? হাফ-হাতা ঢোলাগুলো?

দাও, যা হয় দাও; বাড়িতেই রয়েছি

নীহার বাক্স হাতড়ে কাপড়-চোপড় বের করতে লাগলেন।

সিগারেট ধরিয়ে নিলেন শরদিন্দু৷ আরও খানিকটা চা নিজেই কাপে ঢেলে নিতে নিতে বললেন, তোমাদের এই বাড়িটি বেশ। পাড়াটাও নিরিবিলি দেখছি।

নীহার হাতের কাজ সারতে সারতে জবাব দিলেন, নিরিবিলি আর কোথায়? এখন এখানে গায়ে গায়ে বাড়ি, একটুকরো জমি পড়ে নেই। কত লোক তরে এমনিতে পাড়াটা শান্ত-টান্ত। নীহার বাক্স হাতড়ে শরদিন্দুর পাজামা বের করে কোলের ওপর রাখলেন, একটা তোয়ালেও পাওয়া গেল। গেঞ্জি তাঁর চোখে পড়ছিল না।

শরদিন্দু নীহারকে দেখছিলেন। মাথার কাপড় নেমে কাঁধে পড়ে আছে। নীহারের চুল বেশ কোঁকড়ানো ছিল, এখন চুলের দীর্ঘতা কমে গিয়েছে, ঘনতা কমেছে, দু-এক জায়গায় ধূসর রং ধরেছে।

শরদিন্দুর মনে পড়ল নীহার একবার দুর্গামণ্ডপে পড়ে গিয়ে মাথার পেছনে কান ঘেঁষে বেশ জখম হয়েছিল। অনেকটা কেটে গিয়েছিল বেচারির। সেলাই পড়েছিল, জ্বর হয়েছিল বেশ। দাগটা নিশ্চয় এখনও আছে। শরদিন্দু প্রায় বলতে যাচ্ছিলেন কিছু, এমন সময় নীহার কথা বললেন।

নীহার বললেন, তুমি যদি আর দশ বারোটা বছর আগেও এখানে আসতে, ফাঁকা কাকে বলে বুঝতে পারতে! সন্ধের পর শেয়াল ডাকত। বিয়ের পর আমিই যখন এলাম, তখন সবে শ্বশুরমশাই একতলাটুকু করেছেন। আমাদের এই বাড়ি, আর ধরো আঙুলে গুনে তিনটে কি চারটে বাড়ি। রাজ্যের গাছপালা, বাদাড়, এঁদো পুকুর। অন্ধকার হল তো এই তল্লাট জুড়ে শুধু শিয়ালের ডাক, কানের পাশে ঝিঁঝি শুনছি সারাক্ষণ। ঘুটঘুট করত সব। ভয়ে আমি মরতাম বাপু। কী বিচ্ছিরি যে লাগত?

তোমার শ্বশুরমশাই না ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন?

ডিজাইনার; সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতেন। আমি যখন বিয়ের পর এলাম, তখন তাঁর বাতে অঙ্গ পড়ে গেছে। ডান হাতটা আর তুলতেও পারেন না উঁচু করে। ওঁর মুখে শুনেছি, এই জমি উনি হাজার দেড়েক করে কাঠা কিনেছিলেন। অনেক আগেই। আমাদের বাড়ি যখন হচ্ছে তখনই জমির দর চার-টার হয়ে গেছে। এখন তো জমিই নেই। বছর কয়েক আগেও পনেরো আঠারো হাজার টাকা কাঠা হয়ে গিয়েছিল।

শরদিন্দু মোটামুটি নীহারের শ্বশুরবাড়ির কথা জানেন। নীহারের শ্বশুর মোটামুটি সচ্ছলই ছিলেন। মানুষটিও খুব ভাল ছিলেন নিশ্চয়, নয়তো কে আর ডাক্তার ছেলের বিয়েতে একটা পাই-পয়সাও দাবি জানায় না। শরদিন্দুনীহারের শ্বশুরকে দেখেননি। তবে সবই শুনেছেন। নীহারের শ্বশুর স্বাস্থ্য বদলাবার জন্যে মাস দুয়েকের জন্যে বাইরে বেড়াতে যান। জায়গাটা অবশ্য মধুবনী শরদিন্দু আর নীহারের জায়গা। নীহারের কাকার সঙ্গে ভদ্রলোকের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। সেই সূত্র ধরেই নীহারের বিয়ে। শরদিন্দুর তখন মনে হত, পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে, ভদ্রলোক তাদের শহরে কেন জলহাওয়া বদলাতে এসেছিলেন? তিনি না এলেও কি ভাগ্যের অদলবদল কিছু হত? বোধহয় হত না।

নীহার কথা বললেন। শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, বাক্সর ডালা বন্ধ করেছেন নীহার।

এই বাড়ি নীহার বললেন, বারো আনাই শ্বশুরমশাই শেষ করে গিয়েছিলেন। তখন খরচপত্রও কম ছিল। বাবা নিজে সব জানতেন-টানতেন–তাঁর হাতে না হলে এ বাড়ি আর এমনটি হত না। বাক্সটায় তালা দিয়ে এবার স্যুটকেসটা টেনে নিলেন নীহার। খুললেন না। আমরা আর কতটুকু করেছি। এদিকে এই তেতলার ঘরটা আর ওদিকে দোতলার ছাদটাদ, বাকি কিছু টুকটাক করতে হয়েছে। বাড়িতে ভাড়াটে বসাতে হলে কিছু সুখসুবিধে দেখতে হয়।

তোমাদের ওপাশটায় পুরোটাই ভাড়া?

হ্যাঁ; দুঘর ভাড়াটে থাকে, নীচে আর ওপরে। ওদিকটা দোতলা। আর আমার এদিকে, নীচে গ্যারেজ আর খান-দুই ঘর নিয়ে মিসেস বাগচি নার্সারি স্কুল করেছেন। স্কুল আর কী, কাচ্চাবাচ্চা আসে কিছু পাড়ার, চেঁচামেচি করে, দোলনা দোলে, লাফালাফি করে খানিকটা, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ির মা মাসিরা দুপুরে জিরোতে পারে নিঝঞ্ঝাটে তারই ব্যবস্থা। নীহার হাসলেন।

শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, তুমি নার্সারি স্কুলের প্রেসিডেন্ট?

 দূর দূর– নীহার মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। কোলের জিনিসগুলো ঘরের আলনায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আমার নিজের দিকটায় আর ভাড়াটে বসাবার ইচ্ছে ছিল না। বড় ঝঞ্ঝাট করে। আগে বার-দুই ছিল। বাবা, সে কী বায়নাক্কা। তার ওপর হইচই, গণ্ডগোল। এ তোমার অনেক নির্ঝঞ্ঝাট। সকালের দিকে ঘণ্টা দুই-তিন, তারপর তো ফাঁকা।

কথা বললেন না শরদিন্দু; সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল, ছাইদান খুঁজতে লাগলেন। নীহারের চোখে পড়ল শরদিন্দু এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। নীহার ছাইদান তুলে নিয়ে টিপয়টা শরদিন্দুর চেয়ারের পাশে টেনে দিলেন।

এবার তোমার ওষুধপত্রগুলো বের করে রেখে দিই, নীহার বললেন।

থাক না, আমি নিয়ে নেব।

না না, ঘর জোড়া করে সব পড়ে আছে; পরিষ্কার করে দিলে তুমিও হাঁটাচলা করতে পারবে, দেখতে ভাল লাগবে। নীহার আবার মাটির ওপর বসে পড়লেন।

খানিকটা চুপচাপ থেকে শরদিন্দু বললেন, নীহার তুমি দেখছি বেশ ভাল ভাবেই হালটা ধরতে পেরেছে সংসারের, নয়তো কী যে হত…!

সুটকেসের চাবি বাছতে বাছতে নীহার শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। মাথার কাপড় আর তিনি তুলে দেননি, সেই রকমই ঘাড়ের কাছে পড়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমি না ধরলে আর কে ধরবে বলো? আমার আর কে ছিল? শ্বশুরমশাইয়ের ওই একটি মাত্র ছেলে, মেয়েটি বিয়ে থা করে তার বরের সঙ্গে সেই যে বিদেশ চলে গেল, আর ফিরল না। ফিরবেও না। আজকাল খোঁজখবরও করে না। বছরে এক আধখানা চিঠিও পাই না। শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর আমরাই তো ওর সব ছিলাম। কী দোষ করেছি জানি না সম্পর্কটাও রাখল না আর।

শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কলকাতায় নীহার এতটা একা তাঁর যেন জানা ছিল না। কী মন করে জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতায় তোমার শ্বশুরবাড়ির আরও আত্মীয়স্বজন ছিলেন শুনেছিলাম!

একেবারে নিজের কেউ নেই; জ্ঞাতিগোষ্ঠী আছে। আমার এক দেওর আছে, রিনির বাবার মাসতুতো ভাই; আর আছে এক বড় ননদ, ওদের জ্যাঠতুতো দিদি। দেওরটিই যা মাঝে সাঝে এসে খোঁজখবর করে যায়। সে বড় পাগলা। তেমন আপদে বিপদে সেই সম্বল। তবে গজেন ঠাকুরপো থাকে অনেক দুরে, পাতিপুকুরে। যখন তখন আসতে পারে না। ওদের ওদিকে আসা যাওয়াও মুশকিল, নিত্যি গণ্ডগোল। তা ছাড়া মানুষ আজকাল নিজেকে নিয়েই পারে না তো জ্ঞাতিগোষ্ঠী! নীহার কথা বলতে বলতে কাজ শুরু করলেন। ওষুধপত্রর শিশি, হট ওয়াটার ব্যাগ, এটা-সেটা বার করতে লাগলেন।

শরদিন্দু খানিকটা সোজা হয়ে বসলেন। শেষ বেলার এক ফলা আলো মেঝেতে পড়ে আছে, নীহারের বেশ কাছাকাছি। চারপাশে জিনিসপত্র ছড়ান। শরদিন্দু অলস চোখে নীহারকে দেখছিলেন: সব গোছগাছ শেষ না করে নীহার উঠবে না। এখনও যেন তার একরোখা ভাবটা রয়েছে।

ওরা কেউ আসে-টাসে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন, দুলালদা, মণি?

দাদা গত বছর এসেছিল একবার। মণিরা তো দিল্লি চলে গেছে..বাপ-মা যতদিন থাকে ততদিন মেয়েদের বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, তারপর সবাই ভুলে যায়, বুঝলে না। মা মারা যাবার পর আমিও আর ওদিকে যাই নি।

শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, বাপের বাড়ির দোষ দিয়ো না, নীহার। এই তো আমি এলাম। তোমার বাপের বাড়ির মানুষ।

নীহার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কাঁধ, ঘাড়, গলা খানিকটা মোটা হয়ে যাওয়ায় এখন ভাল করে ঘাড় ফেরাতে পারেন না। সামান্য পাশ ফিরেই বসতে হল। বললেন, তা ঠিক। তবে কত বছর পরে তার হিসেবটা করো।

কত বছর? শরদিন্দু নতুন করে সময়টার হিসেবটা করলেন না। হিসেব করাই আছে। আস্তে করে বললেন, বছর কুড়ি।

তার বেশি ছাড়া কম নয়। তোমায় আমি শেষ দেখেছি, রিনি যখন কোলে। মার কাছে গিয়েছিলাম। তুমি এসেছিলে ছুটিতে। শ্যাম তখন বছর চারেকের। তাই না?

শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ। তাই হবে।

বউদিকে সেই আমি প্রথম দেখলাম। কী সুন্দর মানুষ ছিল বউদি। কী কপাল তোমার অমন বউটিকে হারালে।

শরদিন্দু নীরব থাকতে থাকতে এক সময় নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কপালটাই বা ভাল কোথায়?

রিনির চুল বাঁধা শেষ হয়ে এসেছিল; লম্বা বিনুনিটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে সাদা রিবনের ফাঁস জড়াতে জড়াতে বারান্দায় এসেছিল, বেসিনে গিয়ে হাতটা একটু ধুয়ে নেবে, হেয়ার ক্রিমে হাত চটচট করছে। আচমকা ভেতর থেকে হাসি শুনল। বারান্দায় হাসবার মতন কেউ নেই। সরলাদি রান্নাঘরের দিকে কী একটা কাজ করছে, নারান নীচে। বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রিনি হাসির শব্দটা কান পেতে শুনল। মার ঘনশ্যাম হাসছে। তার ঘরে বসে বসে হাসছে। হেসে যেন গড়িয়ে পড়ছে। রিনির মাথায় এল না, নেহাত পাগল ছাড়া একলা ঘরে বসে কে আর হাসতে পারে! ছেলেটার মাথাও খারাপ নাকি?

হাত ধুয়ে, রিনি তনুর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। তনু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। রাস্তা দেখছে। কিংবা চিলড্রেন পার্কে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলাধুলো দেখছে হয়তো। রাস্তায় কিছু দেখে তনুর হাসি পেয়েছে নিশ্চয়।

রিনি সাড়া দিল।

তনু ফিরে তাকাল। এখন আর তার চোখে সেই দিনের বেলার চশমা নেই। রঙিন, চোখ-ঢাকা চশমার বদলে তার চোখে পুরু কাচের সাধারণ চশমা। তনুর চোখ দেখা যাচ্ছিল।

রিনি এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল, যেন জিজ্ঞেস করছিল, ব্যাপার কী? এত হাসির কী হয়েছে?

 তনু নিজের থেকেই বলল, কলকাতায় বহুত মজা আছে।

এবার রিনির নিজেরই হাসি পেল: শ্যামের কথাতেও মজা কম নয়। রিনি ভুরু তুলে যেন তনুশ্যামের মাথার মাপটা, কিংবা মগজের পরিমাপটা অনুমান করতে করতে বলল, মজাটা হল কোথায়? সে মজার স্থান কাল-পাত্র জানতে চাইছিল।

তনু জানলা দিয়ে বাইরের দিকটা দেখাল।

রিনি এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকাতে তেমন কিছু দেখতে পেল না। হঠাৎ সে পাখি-ডাকের শব্দ শুনল, তীব্র ডাক। রিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চিলড্রেন্স পার্কের গেটের সামনে একটা আধ-পাগলা ছেলে মাঝে মাঝে এসে বসে; মুখের সামনে মুঠো পাকিয়ে নানা ধরনের পশুপাখির ডাক ডাকে, রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা তাকে ঘিরে জটলা পাকায়, কেউ বলে, ঘুঘু ডাকো, কেউ বলে, কোকিল ডাকো। ঘুঘু, কোকিল, টিয়া, ময়না, কুকুর, বেড়াল, শেয়াল ডাকতে ডাকতে ছেলেটার দম ফুরিয়ে গেলে সে চুপ করে বসে বসে বিড়ি খায়। বাচ্চাগুলোও অদ্ভুত। তাদের যার যা থাকে, চিনেবাদাম, ডালমুট, চুইং গাম, লেবু লজেন্স–ছেলেটাকে উদার হাতে বিতরণ করে দেয়। দু-চারজন যে জ্বালাতন না করে তাও নয়, তবে সেটা তেমন কিছু না। ওই পাগলা ছেলেটা নাকি শীতকালে সার্কাসের দলে কাজ করেছে।

রিনি বুঝতে পারল, সেই পাগলা ছেলেটার চারপাশে বাচ্চাকাচ্চার ভিড় আর ছেলেটার বিচিত্র সব ডাক শুনে তনুর হাসি পেয়েছে। এতে হাসির যে কী আছে রিনি বুঝল না।

রিনি বলল, ও আধ-পাগলা। জীবজন্তুর ডাক ডাকে।

তনু বলল, পাগলরা খুব ট্যালেন্টেড হয়।

 রিনি প্রথমে অবাক হল, তারপর আড়চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হেসে ফেললে তনুকে খোঁচা মেরে ঠাট্টা করা যাবে না বলে হাসিটা চেপে কী বলবে কী বলবে ভাবছিল।

তনু নিজেই বলল, আমাদের ওখানে একটা পাগলা আছে, ফার্স্ট ক্লাস ডিজাইনার।

ডিজাইনার? কী ডিজাইন করে?

সব। তনু কথার শেষে বেশ একটা জোর দিল শব্দে, রিনিরা ঠিক এভাবে সব বলে না। আমাদের কলেজে আগে মালী ছিল বানোয়ারি; এখন পাগলা হয়ে গেছে। গার্ডেনের ডিজাইন করে, গেট ডিজাইন করে, প্যাণ্ডেল বানাতে পারে, দেওয়ালিতে দীপ সাজায়…ভেরি ট্যালেন্টেড।

রিনি চোখ বাঁকা করে খোঁচা মেরে বলল, তোমার ডিজাইনও ও করেছে?

তনু কেমন থমকে গেল। তারপর হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, এ ম্যান ইজ ডিজাইনড অ্যান্ড ডেস্টিনড বাই গড।

রিনি আর হাসতে পারল না। তার অমন ঠাট্টাটা মাঠে মারা যাওয়ায় যেন বিশ্রী লাগছিল।

তনুর সঙ্গে রিনির আলাপ-সালাপ হয়ে গিয়েছে আগেই, নীহার যেমন ওপরে গিয়েছিলেন শরদিন্দুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার ফাঁকা করে দিতে তেমন মেয়েকে ভার দিয়েছিলেন তনুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরটাকে পরিষ্কার করার। অবশ্য নিজেই তিনি মেয়েকে দিয়ে খানিকটা খানিকটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন, বাকিটা রিনি সেরে ফেলেছে। তনুর ঘরে লটবহর কমই জমা ছিল।

তনু আর রিনির মধ্যে আলাপটা তখনই ঘটে যায়। তারপর চায়ের সময় রিনি নিজের হাতে চা ঢেলে তনুকে নিয়েছে, দুজনে এক সঙ্গে বসে বসে চা খেয়েছে, গল্প করেছে।

রিনি তনুর চোখের দিকে তাকাল। চা খাবার সময়ই তনু চশমা বদল করে ফেলেছিল; রোদের আলোর ঝাঁঝ কমে গেলে রঙিন চশমাটা পরার কিংবা চোখ ঢেকে রাখার দরকার তার হয় না। তনুর চোখের চারপাশ তার গায়ের রঙের চেয়ে ফরসা। চোখ আড়াল রেখে রেখে এরকম হয়েছে। চামড়াটা পাতলা দেখায় চোখের পাশে, কেমন দুর্বল, বড় বড় চোখ করে সমস্ত পাতা মেলে তনু তাকাতে পারে না, চোখ ছোট করে তাকায়। রিনি লক্ষ করেছে তনুর চোখের পাতা যেন অনেকটা আধবোজা হয়ে থাকে, পলক পড়ে তাড়াতাড়ি। চোখের মণি খানিকটা কটা রঙের। আশ্চর্য লাগে কিন্তু চোখ দুটির দিকে তাকালে-কেমন যেন নরম, সরল, নিরীহ, সকৌতুক। পুরু কাচের চশমার আড়াল থেকেও ওর বিস্ময়, হর্ষ, ছেলেমানুষি স্পষ্ট ধরা পড়ে।

রিনি তনুর চোখ দেখতে দেখতে এবার বলল, বিদ্যের জাহাজ!

 জাহাজ?

যা বড় বড় কথা শুনছি।

বড় কথা কেন! বইয়ে এমন কথা পড়তে হয়। কোথাও পড়েছি

থাক, আর শিক্ষা দিতে হবে না। রিনি মজার ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বলল, পড়াশোনার কথা শুনলে, আমার জ্বর হয়।

মগর, তুমি কলেজে পড়।

আমি কলেজে যাই বেড়াতে, হুল্লোড় করতে, ফুচকা খেতে।

তনু ছেলেমানুষের মতন কৌতুক বোধ করে হাসছিল। তোমাদের কলেজ কোথায়?

 রিনি ঠাট্টা করে বলল, কমনরুমে, গড়িয়াহাটার মোড়ে, চায়ের দোকানে…

 তনু কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। হাসতে লাগল।

কী ভেবে রিনি হঠাৎ সদয় হল, বলল, আমাদের কলেজটা কোথায় তুমি বুঝবে না। কলকাতার কী চেন তুমি? এখান থেকে কলেজ খানিকটা দূরে।

তনু বলল, আমাদের কলেজ আর কোয়ার্টার্স পাশাপাশি। আমাদের কলেজের কম্পাউন্ড খুব বড়। পাশেই প্রফেসরদের কোয়ার্টার্স।

বুঝতে পারছি, রিনি এবার বিনুনিটা হাতের ঝাঁপটায় পিঠের দিকে ঠেলে দিল, ঘাড় নাড়ল। সামান্য, ঠাট্টা করে বললে, নয়তো গায়ে অত বিদ্যের গন্ধ থাকত না।

তনু হাসিমুখে রিনিকে দেখছিল; কোনও কথা বলল না।

রিনি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারছিল, বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে আর রোদ-টোদ নেই; ছায়া জমেছে। রাস্তায় বোধহয় বাতি জ্বলে ওঠার সময় হয়ে গেল।

কী মনে করে রিনি বলল, আমি একটু বাইরে যাব। যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে তনু মাথা নেড়ে সায় দিল। রিনি বলল, ঠিক আছে; যাবার সময় ডাকব।

রিনি ঘর ছেড়ে চলে এল। নিজের ঘরে আসতে আসতে রিনির হাসি পাচ্ছিল। মার শ্যাম বা শ্যামচাঁদ বেশ ক্যাবলা; হাঁদা টাইপের।

এমন বোকা, গণেশ মার্কা ছেলে, বাবা আর দেখা যায় না। কলকাতার ছেলেদের পাশে একেবারে অচল, গেঁয়ো। তনুকে যদি একবার রিনিদের কলেজের কমনরুমে নিয়ে যাওয়া যায়–মেয়েরা ওকে ঠুকরে ঠুকরেই শেষ করে দেবে। হেনা তো প্রথমেই বলবে, কোথাকার ডেসপ্যাঁচ রে রিনি, অ্যাস আইল্যান্ড থেকে? হেনাটা যেমন ফাজিল, তেমনই চতুর। মেয়েদেরই যা পেছনে লাগে, কাঁদিয়ে ছাড়ে, তা ছেলে! হেনা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তৈরি করে। তার মতন ঠোঁট কাটা মেয়েও বাবা দুটি নেই।

রিনি তাড়াতাড়ি শাড়ি জামাটা বদলে নিতে লাগল। তাকে একবার দোকানে যেতে হবে। মনিহারি দোকানে। কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। মা বলেছে। রিনিরও দু একটা জিনিস রয়েছে নিজের। কটা ক্লিপ দরকার, এক ডজন জামার হুক, গরমে ঘাড়ের কাছে ঘামাচি হচ্ছে, বোরেটেড পাউডার নিতে হবে। রিনি একটা ফোন করবে মাধুকে।

শরদিন্দুমামার ছেলেটি বোকাসোকা, হাঁদা যাই হোক এমনিতে কিন্তু বেশ। খুব সরল। রিনির সঙ্গে ভাব হবার পর গড়গড় করে নিজের কথা বলে গেল। তার চোখ ছেলেবেলা থেকেই খারাপ। স্বাস্থ্যও ছিল রোগা। আগে মাথা ধরত খুব, তারপর দূরের জিনিস দেখতে পেত না। আট ন বছর বয়স থেকেই চশমা উঠেছে চোখে। চশমার পাওয়ার বছর বছর এত বেড়ে চলল, সেই সঙ্গে আরও নানা উপসর্গ এমন হয়ে দেখা দিল যে তনুকে হরদম চোখের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হত। তার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মামাও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সাধারণ স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক ওষুধপত্র খেয়েছে তনু; তাতে শরীরে উপকার হলেও চোখের কিছু হয়নি। এক এক ডাক্তার এক এক রকম বলে, চিকিৎসা করে, শেষে চোখ দুটোর যায়-যায় অবস্থা। বাবার সঙ্গে তনু নানা জায়গায় চিকিৎসা করাতে গেছে। কিছু উপকার হয়নি। এক সময় তনুর এমন হয়েছিল যে, বই পর্যন্ত ছোঁয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতে হত। তারপর একজন ডাক্তার সন্দেহ করলেন, উলটোপালটা চিকিৎসার জন্যে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। পুরনো সব চিকিৎসা বন্ধ করতে হবে। করে দেখতে হবে চোখ আবার কতটা স্বাভাবিক হয়। তিনি কয়েকটা সাধারণ স্বাস্থ্যের ওষুধ দিলেন, আর চোখের কয়েকটা একসারসাইজ শিখিয়ে দিলেন। তাতে সত্যিই খানিকটা উন্নতি হল। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল তনুকে; আবার সে কলেজ যাতায়াত, পড়াশোনা শুরু করল। কিন্তু তার চোখের ব্যাধিটা যাচ্ছে না, নানারকম কষ্ট হয়, উপসর্গ দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। চশমার পাওয়ার বাড়িয়ে আর কতকাল চলবে! বাবা তাই কলকাতায় নিয়ে এসেছেন বড় ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাবেন।

রিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে আলতো করে পাউডার বুলিয়ে গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিল। সে এমন কোথাও যাচ্ছে না, যাবে পাড়ার দোকানে, সাজসজ্জায় ঘটা করল না। এমনিতেও সে সাজগোজের ঘটা বড় একটা করে না। তার ভাল লাগে না তেমন। রিনি ঘরের বাইরে এসে তেতলার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল, মার কাছে। কথা বলে নীচে নেমে এসে আবার মার ঘরে গেল, টাকা পয়সা নিয়ে বাইরে আসতে আসতে ডাকল তনুকে। নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে দোলাতে দোলাতে বাইরে এসে দেখে তনু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে রিনি হেসে বলল, মা বলল, তোমায় সব সময় চোখে চোখে রাখতে, হাত ধরে নিয়ে যেতে। রিনি একটু বাড়িয়ে বলল অবশ্য।

তনু বলল, কেন?

 কলকাতার রাস্তা, গাড়িঘোড়ার ভিড়, কে জানে কোন বিপদ বাধিয়ে বসো৷

কথাটা তনু হালকাভাবেই নিল, বলল, না না, আমি ঠিক আছি।

নীচে নার্সারি স্কুলের ঘরগুলো বন্ধ। সিঁড়িতে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে রিনি৷ নার্সারির পাশে এক চিলতে জমি, একটা দোলনা ঝোলানো রয়েছে। দশ পনেরো পা হেঁটে এসে ছোট কাঠের গেট। তারপর রাস্তা।

রাস্তায় এসে রিনি বলল, আমাদের পাড়াটা কিন্তু এখনও অন্য জায়গার চেয়ে ফাঁকা। খুব হইচই নেই। ফুটপাথ ধরে রিনি হাঁটতে লাগল।

তনু পাশে পাশে হাঁটছিল। বলল, এখানকার বাড়িগুলো খুব ডিসেন্ট। কত উঁচু-উঁচু। আমাদের শহরে ওল্ড টাউনে বিলকুল পুরনো বাড়ি। নিউ টাউনে বিশ-পঁচিশটা ভাল বাড়ি হয়েছে। আমরা থাকি টাউনের ওয়েস্ট সাইডে কলেজ এরিয়ায়। আমাদের দিকটা লোনলি।

রিনি শুধোল, খুব ফাঁকা?

বহুত ফাঁকা। পিচ রোড। দুপাশে গাছ। একটা পুরনো চার্চ আছে। চার্চটার খুব বিউটি। পাহাড়ের মতন উঁচু জমিতে চার্চ, চারদিকে গাছ, নীচে চার্চের তলায় ক্রিসমাসে ফিয়েস্টা হয়। …

ফিয়েস্টা?

 মেলা, তনু রিনির দিকে তাকাল, কোনও সেন্টস ডে সেলিব্রেট করাকে ফিয়েস্টা বলে। খুব আমোদ আহ্লাদ নাচগান করে ফিয়েস্টা হত। স্পেন-টেনে এখনও হয়। আরও অনেক জায়গায় হয়। ওটা একরকম ফেস্টিভ্যাল। আমাদের ওখানে মেলার মতন হয়, বহুত লোক আসে।

রিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের ক্রিশ্চান কলেজ তো?

হ্যাঁ; ওদিকে অনেক জায়গায় মিশনারি স্কুল কলেজ আছে। আমাদেরটা মেথডিস্ট চার্চের হাতে। ছোট কলেজ, মেনলি রেসিডেনসিয়াল।

রিনি আর কিছু বলল না। রাস্তায় মানুষজন কম নয়, সন্ধে হয়ে এল, বাতি-টাতি জ্বলে উঠেছে চারপাশে। আজ গরমটা মাঝামাঝি, তবু পিচের রাস্তার একটা ভাপ যেন অনুভব করা যাচ্ছে এখনও। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। শুকনো বকুল গাছটার তলায় ফুটপাথ ঘেঁষে একজোড়া ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সেজেগুজে মেয়েরা এসে উঠছে, বিয়ে বাড়ি-টাড়িতে যাবে হয়ত।

তনুকে মোটামুটি নজরে রেখে রিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। তনু অন্ধ নয়, তবু অন্ধেরই মতন। একেই তো হাঁদার মতন হাঁটছে, তার চোখ যে কোনদিকে তা খেয়াল করতে পারছে না রিনি। তনু রাস্তাঘাট, আলল, দোকান, বাড়ি, মানুষ কখন যে কোনটা দেখছে, দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ছে, এর তার গায়ে গিয়ে পড়ে সামলে নিচ্ছে–রিনি বুঝে উঠতে পারছিল না। দু-চারবার রিনিকে ডাকতে হল, সাবধান করতে হল। এরকম মানুষ নিয়ে পথ হাঁটা মুশকিল। তাও তো এই রাস্তায় বাস-টাস চলে না, নয়তো রিনিকে সত্যিসত্যিই তনুর হাত ধরে নিয়ে হাঁটতে হত।

তনু আর একটু হলেই খোঁড়া রাস্তার গর্তে পা ফেলত। রিনি বাঁচিয়ে দিল। তারপর ধমকের গলায় বলল, রাস্তা দেখে হাঁটো। এ তোমার এতোয়ারপুর নয়।

তনু রাস্তা দেখে হাঁটতে লাগল।

এখানটায় জাদা ভিড়।

ভিড় হবে না! সন্ধেবেলায় লোকে বাইরে বেরিয়েছে, মানুষজন অফিস-টফিস থেকে ফিরছে, এখন তো ভিড় হবেই।

সামনেই রিনিদের মনিহারি দোকান। রিনি দোকানের দিকে এগুল না। তনুকে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাবে বেড়াতে, তারপর ফিরবে। সোজা হাঁটতে লাগল রিনি। রাস্তায় নানা ধরনের জটলা। মোড়ের মাথায় এলে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ছে সে তনুকে নিয়ে, তারপর দুপাশ ভাল করে দেখে রাস্তা পেরোচ্ছে।

একটা আইসক্রিমের দোকান হয়েছে নতুন, সেখানে মেয়েদের খুব ভিড়। যত রাজ্যের পাড়ার মেয়ে বউ ভিড় করে আইসক্রিম খায়। তনুকে কলকাতার একটা আইসক্রিম খাওয়াতে ইচ্ছে হল রিনির। নিজেরও লোভ রয়েছে। কিন্তু ওই মেয়েলি ভিড়ে তনুকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না। রিনি তফাত থেকেই চেনা মুখ দেখতে পাচ্ছিল। কেউ ডেকে ফেলতে পারে ভেবে রিনি অন্যমনস্কর ভান করে জায়গাটা পেরিয়ে গেল।

ট্রামরাস্তার কাছাকাছি এসে রিনি সেই ছোঁড়াদের জটলাটাকে দেখতে পেল। চায়ের দোকানের সামনে এই জটলা রিনি তার বাচ্চা বয়স থেকেই দেখছে। কিছু কিছু মুখ অদল বদল হয়েছে এইমাত্র, নয়তো সেই একই ধরনের জটলা। এক দঙ্গল ছেলে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, এ ওর গলাটলা জড়িয়ে সারাটা সন্ধে এখানে আড্ডা মারে। রিনি এদের কাউকে কাউকে চেনে, এই পাড়ারই ছেলে, ছেলেবেলায় এক সঙ্গে খেলাধুলোও করেছে। এখনও ওই ছেলেগুলোর বাড়িতে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে রিনিদের যেতে হয় সামাজিকতা রাখতে। রাস্তায় কিন্তু পরস্পরের মধ্যে ব্যবহারটা অচেনার মতন। রিনি ওদিকে খুব কমই তাকায় না তাকিয়েও বুঝতে পারে কারা কারা আছে। ওই দলের মধ্যে একজনকে শুধু পছন্দ করে রিনি, শঙ্করদা। লম্বা চওড়া চেহারা, বছরে তিনবার চুল কাটে, হপ্তায় বার দুই দাড়ি কামায়, গলার আওয়াজ গমগম করছে, রাস্তা কাঁপিয়ে হাসে। আজকাল আবার হাতে বালা পরে, হিপিদের মতন জামা-টামা গায়ে চাপায়। রিনিকে মাঝেমধ্যে ডাকে শঙ্করদা। তবে জটলার মধ্যে ঠিক নয় এই রিনি বলে ডেকে নিজেই বন্ধুদের ভিড় থেকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি এসে দু-চারটে কথা বলে, খবরাখবর নেয়, তারপর অক্লেশে পঁচিশটা পয়সা চেয়ে বসে। রিনি দিয়ে দেয়। আসলে পঁচিশটা পয়সা সেই মুহূর্তে সিগারেট কেনার জন্যে দরকার, বন্ধুদের চা সিগারেট খাইয়ে, কাউকে আবার ট্রামভাড়া বাসভাড়া দিয়ে শঙ্করদার পকেট ফাঁকা। আপাতত রিনির পঁচিশ পয়সায় কটা চারমিনার হবে। তারপর আবার কাউকে ধরবে রাস্তায়। চেনা অচেনা বড় একটা গ্রাহ্য করে না। দিব্যি আছে শঙ্করদা। বলে, বুঝলি রিনি, আমার হচ্ছে মডেস্ট লাইফ, এ মংক ইন মডার্ন সোসাইটি। রিনি ভেঙিয়ে বলে মংকস লাইফ না আর কিছু! তার সাহস হয় না যে বলবে, এ তোমার মাংকিস লাইফ।

জটলাটাকে রিনি তফাতে রেখে চলে যেতে যেতে আড়চোখে একবার দেখে নিল। রিনি এবং তনুকে ওরা দেখছে। কে একজন আর-একজনকে হঠাৎ এমনভাবে তাড়া করলে যে তাড়া-খাওয়া ছোঁড়াটা ছুটে এসে প্রায় রিনিদের পাক খেয়ে আবার ফিরে গেল। এই রগড় বা ইতরামির অর্থ রিনি জানে। শঙ্করদা নিশ্চয় ওখানে নেই, থাকলে ওদের এই সাহস হত না।

বিরক্ত বোধ করে রিনি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। সামান্য এগিয়েই যমুনার সঙ্গে দেখা। যমুনা মুখ নিচু করে একপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলতেই রিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী রে? রিনি বলল।

 রিনি।

কোথায় গিয়েছিলি?

এই একটু কাজে– যমুনা বলল, তাকে কেমন চঞ্চল, বিব্রত দেখাচ্ছিল। রিনিকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে।

রিনি যমুনার এই বিব্রতভাব বুঝতে পারছিল না। অথচ ওটা এমনই যে চোখে না পড়ে যায় না। যমুনার সাজপোশাকটাও রিনির কাছে দৃষ্টিকটু লাগছিল। গলায় পাথরের মালা, হাতে একগাদা প্লাস্টিকের চুড়ি, চোখে বড় করে পেনসিল টেনেছে, মাথার চুলে ফোলানো খোঁপা। শাড়িটাও খুব বাহারে।

যমুনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও তার হাবভাব দেখে রিনি কিছু বলতে পারছিল না।

আমি যাই রে যমুনা পাশ কাটাবার জন্যে ব্যস্ত হল খুব। তারপর জবাবের জন্যে দাঁড়াল না, চলে গেল।

রিনি বেশ অবাক হল। যমুনাকে দেড় মাসের মধ্যে আর দেখেনি রিনি। মিল্ক বুথে চাকরি করত যমুনা, ছেড়ে দিয়েছে। কলেজ তো অনেক আগেই ছেড়েছে। ওর বাড়িতে নানারকম গোলমাল যাচ্ছিল রিনি শুনেছে। কিন্তু যমুনাকে আজ যেরকম মনে হল, বাড়ির গোলমালের জন্যে সেরকম হবার কথা নয়।

তনুকে ঘাড় ফিরিয়ে ডাকতে গিয়ে রিনি দেখে তনু নেই। আশেপাশে তাকিয়েও সে তনুকে দেখতে পেল না। আরে! দু পা পিছিয়ে গেল রিনি, ভাল করে দেখল, না, তনুকে দেখা যাচ্ছে না। এখানে এমন কিছু মানুষজনের ভিড় নেই যে, তনুকে দেখা যাবে না। কোথায় গেল তনু? কী আশ্চর্য। আচমকা কেমন এক উদ্বেগ বোধ করল রিনি। পেছনের দিকে না এগিয়ে রিনি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। অদ্ভুত ছেলে তো! এরকম মাথা খারাপ ছেলে সে আর দেখেনি, বাবা। এই পেছনে পেছনে আসছিল, পলকের মধ্যে বেপাত্তা! গেল কোথায়? রিনি চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে সামনে এগিয়ে চলল, যতদূর সম্ভব দ্রুত পায়ে। তনু যেভাবে রাস্তা হাঁটে তাতে ভরসা করা যায় না। সামনে ট্রামরাস্তা, ডবলডেকার বাস ছুটছে সবসময়, আরও হাজার রকম গাড়িঘোড়া। একটা বিপদ না বাধিয়ে বসে। বিপদের কথা মনে আসতেই রিনির বুক ধক করে উঠল। ট্রামরাস্তার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল রিনি৷

হঠাৎ রিনির নজরে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে, আদ্যিকালের পাকুড়গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে তনু খুব বিমুগ্ধচিত্তে কলকাতার সন্ধে দেখছে। ট্রামের আসাযাওয়া, তার চাকার শব্দ, ঘন্টি, ডবলডেকার বাসের আকাশ কাঁপানো গর্জন, প্রাইভেট বাসগুলোর গায়ে কন্ডাক্টরদের দামামা বাজাবার আওয়াজ, মানুষজন, রিকশা–সমস্ত যেন তনুকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। ট্রামের মাথায় ফুলকি জ্বলে উঠল, আলো ঝলসে গেল, বাসের পেছনে কালো ধোঁয়া উড়ে রাস্তা অন্ধকার করে দিল, নীলচে রঙের টিউব আলোর বিজ্ঞাপনটা জ্বলে উঠেছে–তনু সবই কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করছে।

রিনি একেবারে তনুর গায়ের পাশে গিয়ে ডাকল, এই! ডাকবার সময় তার খেয়াল ছিল না যে, সে তনুকে বেশ একটু ঠেলা মেরে দিয়েছে।

তনু তাকাল।

 রিনি খানিকটা ধমকের গলায় বলল, বাঃ, অদ্ভুত ছেলে তো! আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর তুমি দিব্যি হন হন করে এগিয়ে এলে? আমি এক্কেবারে বোকা। এদিক খুঁজছি, ওদিকে খুঁজছি। আশ্চর্য।

তনু বলল, আমি এইটুকু এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম।

এইটুকু? রিনি পাশ ফিরে তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই দূরত্বটা হাতের ইশারায় দেখাল।

 তনু বলল, কতটুকু আর?

রিনি ধমক দিল, কতটুকু আর! খুব মজা পেয়েছ। …একটা কিছু হলে তোমার নীহারপিসি আমার গলা কুপিয়ে দিত। খুব হয়েছে, আর বেড়িয়ে দরকার নেই। চলো।

তনু হেসে বললে, আমি সামনের রাস্তা পেরোইনি। তোমার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম।

 রিনি তার অভিভাবকত্বর মর্যাদা রেখে বলল, বেশ করেছিলে, এখন ফিরে চলো।

তনুকে নিয়ে রিনি আবার ফিরতে লাগল। তনু মাঝে মাঝে কথা বলছিল। রিনি জবাব দিচ্ছিল না। তেমন। তনুর কথার জবাব তার জানা ছিল না। যেমন, ট্রামের চাকা কতগুলো? ডিজেল ইঞ্জিনের এই ধোঁয়া শহরের বাতাস নষ্ট করছে কেমন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

হাঁটতে হাঁটতে রিনি তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে মনিহারি দোকানটার সামনে থামল। তনুকে বলল, এখানে দাঁড়াও, কোথাও যাবে না; আমি জিনিসগুলো কিনে আনি।

তনু দোকানের সামনে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকল।

 জিনিসপত্র কিনে রিনি কোথায় যেন আড়ালে চলে গেল ফোন করতে। ফোন সেরে রাস্তায় নেমে এল, হাতে ব্রাউন পেপারের প্যাকেট।

তনু হাত বাড়াল, আমায় দাও।

থাক।

 দাও, আমি নিচ্ছি।

রিনি হঠাৎ তার ডান হাতের মুঠো তনুর হাতের ওপর আলগা করে দিল। তনু দেখল, রিনি তার হাতে পুরু একটা চকোলেট বার ফেলে দিয়েছে। হেসে ফেলল তনু। বলল, চকোলেট আমার খুব ফেভারিট। তুমি জানলে কী করে?

ঘাড় বেঁকিয়ে রিনি বলল, হাত গুনে।

তোমার শেয়ার নাও।

তুমি খাও। তোমার এখনও টফি-চকোলেট খাবার বয়েস রয়েছে।

 তোমারও আছে।

তনু হাত বাড়িয়ে রিনির জিনিসপত্রের প্যাকেটটা ততক্ষণে নিয়ে নিয়েছে। রিনির হাতে সামান্য কটা জিনিস।

বাড়ির কাছাকাছি এসে রিনি বলল, পার্কে যাবে? না থাক..দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা ভাববে।

তনু বলল, কটা বেজেছে?

রিনি হাতে ঘড়ি পরেনি। তা হলেও তার অনুমান, সাতটা বেজেছে হয়তো। না, রাত নিশ্চয় হয়নি; কিন্তু নুকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, মা ভাবতে পারে। কী মনে করে রিনি বলল, আচ্ছা চলো, পাঁচ-দশ মিনিটে কী আর হবে–একটা পাক দিয়ে যাই।

রিনিদের বাড়ির সামনে চিলড্রেনস পার্কটা সন্ধের পর পাড়ার বড়দের একটু হাওয়া খাওয়ার জায়গা হয়ে ওঠে। গরমের দিনে অনেকেই এসে বসে থাকে, গল্পগুজব করে। সকালে বুড়োরা চক্করবে।

পার্কে এসে রিনি দেখল, বসার জায়গা কোথাও নেই। ছোট পার্ক। ঘাসের চিহ্নও বড় একটা দেখা।

যাচ্ছে না। রিনি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। বসবে? দরকার নেই বসে, যা ধুলো।

তনু বলল, তোমাদের কলকাতায় ঘাস নেই।

রিনি টপ করে বলল, আমাদের কলকাতায় গোরুঘোড়া কম।

তনু প্রথমটায় বোঝেনি, পরে বুঝল। বুঝে জোরে হেসে উঠল। আমি যদি বলি, বেশি। বেশি বলেই এই হাল।

রিনি আর জবাব দিতে পারল না। মার শ্যামচাঁদ একেবারে নেহাত গাধা নয়। বুদ্ধি ধরে।

তনু এর মধ্যে কখন চকোলেটটা ভেঙে ফেলেছে। রিনির হাতে আধখানা গুঁজে দিয়ে, নিজে বাকি আধখানা মুখে দিল।

ঠিক এমন সময় একটা বাচ্চা মতন ছেলে বেলফুলের মালা বেচতে সামনে এসে দাঁড়াল। রিনি মাথার চুলে মালা জড়ানো তেমন পছন্দ করে না, সেরকম কোনও সুযোগও তার আজ নেই, তবু কী মনে করে একটা মালা কিনে হাতব্যাগের মধ্যে রেখে দিল।

পার্কের বাইরে এসে রাস্তা পেরোবার সময় রিনি আবার যমুনাকে দেখল। রিকশায় বসে আছে, পাশে যেন একটা অবাঙালি লোক। রিকশাটা ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেল। রিনি অবাক হয়ে রিকশার পেছনটা দেখতে দেখতে রাস্তা পেরিয়ে এল।

.

০৪.

তেতলায় ঘরের সামনে ছাদটুকুতে শরদিন্দু বসেছিলেন। আকাশটা খুব পরিষ্কার, চারদিক জুড়ে তারা ফুটে আছে। শরদিন্দুর সামনে কিছু টবের গাছ, ফুল নেই, পাতাই চোখে পড়ে। সিঁড়ির দিকের বাতিটা জ্বলছিল। তার সামান্য আলো ছাদের অন্ধকারে পাতলা ভাবে মিশে আছে।

রিনি খানিকটা আগে ছাদে ছিল। শরদিন্দু তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তনুশ্যাম ছাদের আলসের কাছে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়ি, দুরের নারকোল গাছ, আকাশ দেখছিল। মাঝে মাঝে বাবা এবং রিনির কথাবার্তা তার কানে আসছিল। বাবা যে খুব গম্ভীর মানুষ তা নয়, কিন্তু কলেজে বাবাকে বেশ গম্ভীর, ভারিক্কি মনে হয়, বাড়িতে বাবা অনেক হালকা। তবু তনু বুঝতে পারছিল, বাবা রিনির সঙ্গে গল্প করার সময় আরও হাসিখুশি মজার মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। বাবা যেসব গল্প করছিল, তার অর্ধেকই পুরনো গল্প, নিজেদের বাড়িঘরের গল্প, নীহারপিসির গল্প। তনুর সঙ্গে বাবা বড় একটা এসব গল্প করে না। নীহারপিসি কেমন করে একবার নাকের মধ্যে সেফটিপিন ঢুকিয়ে ফেলেছিল, ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে তবে সেটা বার করা গেল: কবে যেন এক সাধু এসে পিসির মুঠোয় ছাই দিয়ে হাতের রুলি খুলে নিয়ে পালিয়েছিল–এইসব গল্প। রিনি যে কতটা অবাক হচ্ছিল কে জানে, মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছিল। তনুর মনে হল, রিনি এসব গল্পের বেশিটাই জানে। সে প্রায়ই বাবাকে বলছিল: এটা আমি জানি, ও গল্প আমি শুনেছি। নিজেই কোনও কোনও কথার খেই ধরিয়ে দিচ্ছিল। শেষে তনু ছাদ থেকে নেমে গেল।

রিনি গেল আরও খানিকটা পরে, নীহার ওপরে আসার পর। নীহার ছাদে এসে মেয়েকে বললেন, রিনি, তোর মামাকে একটু শরবত করে এনে দে। আর শ্যামকে জিজ্ঞেস কর, শরবত খাবে, না এখন দুধ খাবে খানিকটা। যদি দুধ খায়, ওভালটিন দিয়ে দিবি।

মনে মনে রিনি একটা সংলাপ সঙ্গে সঙ্গে ভেবে নিল। নীচে নেমে মার শ্যামকে সে বলবে: এই যে আসুন খোকাবাবু, মা আপনাকে দুধ খাইয়ে দিতে বললেন। কথাটা মনে করে নিজের মনেই রিনি হেসে ফেলল।

হাসিটা নীহার দেখতে পেয়েছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসছিস যে?

রিনি চট করে বলে ফেলল, না, মামার জন্যেও দুধ দিয়ে আসি বরং।

শরদিন্দু তাড়াতাড়ি বললেন, না দুধ নয়। দুধ আমি একবারই খাই, রাত্রে। তুমি আমায় বরং শরবতই করে দাও। সন্ধেবেলায় আমি ইশবগুলের শরবতই খাই লেবু আর মিছরি দিয়ে। …সে পরে হবে, আজ এমনি শরবত খাই।

রিনি চলে গেল।

শরদিন্দু বললেন, তুমি নাকি পুজোপাঠ করতে বসেছিলে?

নীহার গিয়েছিলেন জলের ট্যাঙ্কটার দিকে। রিনির ভিজে শাড়িটা বাতাসে জাপটে গিয়েছিল। তারে-মেলা শাড়িটা ছড়িয়ে দিলেন ভাল করে। সন্ধেবেলায় গা ধোয়ার অভ্যেসটা মেয়ের গেল না, বিকেলে গা ধুয়ে নিলে ক্ষতি কীসের! অনেক বলেও মেয়েকে এই অভ্যেস ছাড়ানো গেল না। গরম-ঠাণ্ডায় মাসের মধ্যে কুড়িদিন ওর গলা খুসখুস, টনসিল ব্যথা লেগে আছে। একসময় গানের গলা করেছিল চমৎকার, বেশ মিষ্টি, আজকাল সে-পাটও তুলে দিয়েছে। কী বলবেন আর মেয়েকে! নিজের মরজিতে ও চলে। একেবারে বাপের মতন। এই গরম বাতিক এখন চলল। খুব বাড়াবাড়ি করে বর্ষা নামার পর বাতিকটা ঘুচবে। শাড়ির পাশে ব্লাউজ, টপটপ করে জল পড়ছে এত ভিজে। নীহার জলটা নিংড়ে দিয়ে ফিরে এলেন।

আমায় কিছু বললে? নীহার শুধোলেন।

বলছিলাম, তুমি নাকি পুজোপাঠ করছ আজকাল?

তা একটু করছি বইকি। বুড়ি হয়ে গেলাম, এখনও যদি না করি, তবে আর কবে করব? নীহার মৃদু হাসলেন।

নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু দুহাত মাথার ওপর তুলে ক্যাম্বিসের চেয়ারের মাথায় রাখলেন। তুমি বুড়ি হয়ে গেলে? শরদিন্দু যেন সস্নেহে, এবং সকৌতুকে হাসলেন।

শরদিন্দুর মুখোমুখি বেতের চেয়ার ছিল একটা; পাশে মোড়া। নারান সন্ধের মুখে বাইরে বের করে রেখে গেছে সব। বেতের ছোট টেবিলে শরদিন্দুর চশমার খাপ, সিগারেট, দেশলাই, ছাইদান।

নীহার বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বুড়ি হতে আমার কিছু বাকি দেখছ নাকি?

শরদিন্দু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না। সামান্য পরে বললেন, তোমার কত বয়েস হল, বলল তো?

নীহার শরদিন্দুর চোখ, মুখ, আলস্যভরা চেহারা, বিশ্রাম উপভোগের হালকা ভাবটা লক্ষ করতে করতে বললেন, তুমিই বলো না। আমি বললে তো বয়সে কমাব।

কেন, কেন?

মেয়েরা যে নিজেদের বয়েস কমিয়েই বলে, নীহার মুচকি হাসলেন।

 শরদিন্দু হেসে ফেললেন। তোমার পঞ্চাশ হয়নি। পঞ্চাশ হতে এখনও দেরি আছে দু-চার বছর।

তোমার কি ষাট হয়ে গেল? নীহার কৌতুক করে বললেন।

 আমার ফিফটি ফোর চলছে। তোমাতে আমাতে ছ সাত বছরের তফাত।

 মেয়েদের বুড়ি হতে বয়েস শুনতে হয় না গো, এবেলার ফল ওবেলায় গলে যায়।

শরদিন্দু নীহারকে দেখলেন। যতটা নীহার বলছে অতটা বুড়ো হয়ে যাবার লক্ষণ তার চেহারায় নেই। এখনও ওর মুখে লাবণ্য আছে, বরং সাংসারিক সুখ-দুঃখের স্পর্শে সে লাবণ্য আরও ঘরোয়া আরও কোমল হয়েছে। তোমার কি গুরু-টুরু আছে?

গুরু–?

 দীক্ষা নাওনি?

না, সেভাবে আমার দীক্ষা নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে রামকৃষ্ণ আশ্রমের অনেকের মেলামেশা ছিল। আশ্রম থেকেই যেটুকু…

ও! শরদিন্দু চেয়ারের মাথার ওপর থেকে হাত দুটো নামিয়ে নিলেন।

 নীহার খানিকটা হালকা করেই শুধোলেন, তা তুমি কিছু করো না?

পুজোটুজো? না– মাথা নাড়লেন শরদিন্দু না, আমার ও পাট নেই। ঠাকুরদেবতা নিয়ে বসবার সময় কই?

নীহার ঠাট্টার গলায় বললেন, ছেলেবেলায় তো খুব ঠাকুর ভক্তি ছিল। দুর্গাপূজায় অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে, কালীপুজোয় রাত জেগে বসে থাকতে, সরস্বতীপুজোয় মাতব্বরি করতে। সে সব গেল কোথায়?

শরদিন্দু যেন স্মৃতির কেমন এক স্পর্শ অনুভব করে মুদু হাসলেন। ভক্তি আমার এখনও যে একেবারে নেই নীহার তা নয়, আছে। বারো-চোদ্দো মাইল ঠেঙিয়ে দুর্গাপুজো দেখতে যাই। কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে বির্ভুইয়ে থাকতে থাকতে আমাদের সংসারের আচার আচরণ অর্ধেক নষ্ট ঘরে ফেলেছি। আমাদের বাঙালি হিন্দুবাড়িতে মেয়েরা থাকলে তবু একটা আচার-ধর্ম চোখে দেখা যায়। সেসব পাটও চুকেছে আমার। তার ওপর ছেলেটা। ওর জন্যে মাথায় যে কতরকম ভাবনা থাকে। বলতে বলতে শরদিন্দু চুপ করে গেলেন, তাঁর গলার স্বর গাঢ় শোনাচ্ছিল। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেললেন। সামান্য পরে বললেন, চাকরি-বাকরি শেষ হয়ে এল। আর দু চারটে বছর, তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে ওই ভগবান-টগবান করেই জীবনটা কাটাতে হবে।

নীহার কিছু বললেন না। শরদিন্দুর মনের বারো আনা ছেলের মধ্যে রয়েছে। সারাদিন হয়তো সেই চিন্তাতেই কাটে। বোধহয় এখন ভগবান-টগবানে ভরসাও নষ্ট হয়ে এসেছে।

কাল একবার গুপ্তসাহেবের কাছে যাই, কী বলো? নীহার বললেন।

একটা খবর দিতে হবে না?

কিছু না। আমার সবই বলা কওয়া আছে। কালকেও আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। আমি বলেছি, তোমরা আজ এসে পৌঁছোচ্ছ। উনি জানেন সব। কাল সকালে রিনিকে দিয়ে না হয় বাড়িতে একটা ফোন করিয়ে দেব।

 কখন যেতে হবে?

বিকেলে। সকালে হাসপাতালে থাকেন। বিকেলে ওঁর চেম্বারে যাব। পার্ক স্ট্রিট।

শরদিন্দু অন্যমনস্ক হয়ে ফুলের টব-গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি তোমাদের খুব জানাশুনো?

হ্যাঁ নীহার ঘাড় হেলালেন, মানুষটি খুব ভাল। রিনির বাবার সিনিয়ার ছিলেন। একই হাসপাতালে ছিলেন একসময়। খুব ভালবাসতেন ওঁকে।

শরদিন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একেই গেরো বলে বুঝলে নীহার, সেই কলকাতায় আসতে হল, আগে যদি আসতুম, তোমার স্বামী থাকতে, কত সাহায্য পেতাম, হয়তো ছেলেটা এতদিনে ভাল হয়ে যেত।

নীহার বললেন, এলে না কেন।

 কেন যে শরদিন্দু আসেননি, তা তিনিও জানেন না। তাঁর তো সব জানা ছিল, নীহারের স্বামীর কথা, নীহারের ঠিকানা; এটাও জানতেন ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলে কোনও অনাদর তাঁর হত না। তবু শরদিন্দু আসেননি! সেটা কি অভিমান বশে? ক্ষোভটা দূর করতে পারতেন না? নাকি তাঁর মনে হত, নীহারের স্বামীর কাছে আসায় তাঁর কোনও গ্লানি, আছে? শরদিন্দু, যে কোনও কারণেই হোক, দূরে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন, কাছে আসতে চাননি। নীহার তখনও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, যেন জানতে চাইছেন–এলে না কেন?

শরদিন্দু বললেন, তখন যে এরকম অবস্থা ছিল না। ভুগছিল অবশ্য শ্যাম, কিন্তু চোখ খারাপ চোখ খারাপ করে কেটেছে। জেনারেল হেলথ আর চশমার ওপরই নজর ছিল। ওখানকার ডাক্তাররা আমায় কিছু অ্যাডভাইস করেনি। আস্তে আস্তে অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তো কত রকম করলাম। কলকাতায় পেশেন্ট নিয়ে আসা, থাকা, চিকিৎসা করিয়ে ফিরে যাওয়া, এ তো আমাদের পক্ষে সহজ ব্যাপার নয়, এই দেখো না, তোমাকে কবে থেকে লিখছি শীতের শেষাশেষি আসব। বলেছিলাম শীত, আসতে আসতে সামার পড়ে গেল।

রিনি আসছিল। তার পায়ের আওয়াজ হচ্ছিল সিঁড়িতে। বাড়িতে অর্ধেকসময় পায়ে চটি রাখে না রিনি, খালি পায়ে হাঁটতে নাকি তার আরাম লাগে খুব। সাদা ডিশের ওপর শরবতের গ্লাস নিয়ে সে দেখা দিল।

হাত বাড়িয়ে শরদিন্দু শরবত নিলেন। রিনি মার জন্যে পান সেজে এনেছে, নীহারের হাতে পান দিল।

শরদিন্দু রিনিকে বললেন, শরবতে বরফ-উরফ দাওনি তো?

না, রিনির মাথা নাড়ল, খাবেন বরফ? এনে দেব?

না না।

ও বলল, আপনি বরফ-টরফ খান না, গলা ধরে যায়।

শরদিন্দু রিনির ও শব্দটা শুনলেন, ও মানে শ্যাম। কানে কেমন যেন লাগল তাঁর, দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে শ্যাম আর রিনির সম্পর্ক বেশ হৃদ্য হয়ে উঠেছে।

নীহারও একসময় তাঁকে এই ভাবে ও বলত। শরদিন্দু কেমন স্নিগ্ধ বোধ করলেন।

নীহার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামকে দুধ-টুধ দিয়েছিস?

দুধ খাবে না। শরবত খাচ্ছে।

দুধ খাবে না কেন?

 কে জানে! আমি জানি না।

 দুধ খাওয়া নিয়ে তোরা ছেলেমেয়েরা যা করিস বাপু, আমার মাথা গরম হয়ে যায়। রাত্তিরেই খাবে তবে– নীহার বললেন।

শরদিন্দুর কী যেন মনে পড়ে গেল। নীহারের দিকে সকৌতুক চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমারও তো দুধ নিয়ে কত বাতিক ছিল।

নীহার বললেন, আমার সঙ্গে ওদের তুলনা কোরো না। ওদের এই বয়সে—

 বাধা দিয়ে শরদিন্দু বললেন, আমি কিন্তু তোমার ওই বয়েসের কথাই বলছি। এটা আমার জানার মধ্যে পড়ে কিনা।

নীহার বোধহয় জব্দ হয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর পান-খাওয়া ঠোঁটে রসের সঙ্গে হাসি এসে মিশে গেল।

রিনি হেসে ফেলেছিল। আর দাঁড়াল না। চলে গেল।

শরদিন্দু আস্তে আস্তে শরবত খেতে লাগলেন। তাঁর কয়েকগুচ্ছ পাকা চুল কানের পাশের কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে ছিল।

নীহার ধীরে ধীরে পান চিবোচ্ছেন। মাথায় কাপড় নেই। চুলের খোঁপাটা এলো করে জড়ানো।

 বসে থাকতে থাকতে নীহার বললেন, তুমি যেন কী বলছিলে?

 কীসের? শ্যামের কথা?

না, শ্যামের কথা নয়। শ্যামকে কাল নিয়ে যাই আগে তারপর। …তুমি অন্য কী বলছিলে না? রিটায়ার করে আবার নিজের বাড়ি-টাড়িতে ফিরে গিয়ে বসবে।

ও, হ্যাঁ; বলছিলাম। আমার সেইরকম ইচ্ছে। প্রবাসেই তো জীবনের বারো আনা কেটে গেল। এবার জীবতারা খসে যাবার আগে নিজের জায়গায় ফেরা ভাল। কী বলো? শরদিন্দু পরিহাস করে বললেন।

নীহার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির এখন খবর কী? তোমার আসা-যাওয়া ছিল বলে তো শুনিনি।

একেবারে ছিল না, তা বোলো না। মা যতদিন বেঁচে ছিল পুজোর ছুটিটা বাড়িতেই কাটাতাম। মা মারা যাবার পর দিদির জন্যে যেতে হত। দিদিও চলে গেল, আমারও আসা-যাওয়া ফুরোল। শরদিন্দু সামান্য থেমে আবার খানিকটা শরবত খেলেন। আমাদের সাধুকে তোমার মনে আছে। সাধুই বাড়িটা দেখাশোনা করত, থাকত। আমি কখনও-সখনও গিয়েছি। গত বছর পুজোতে গিয়েছিলাম। বাড়িটার কড়ি, দেওয়াল-টেওয়াল অনেক নষ্ট হয়েছে। বাগানটুকু জঙ্গল। অল্পসল্প মেরামত করিয়ে এসেছি। সাধুই করাচ্ছে, আমি টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিই। ও থাকতে থাকতে বাড়িটা আবার বাসযোগ্য করিয়ে নিলে আমার ঝঞ্জাট বেঁচে যায়।

নীহার প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। শরদিন্দুদের বাড়ির ছবিটি তাঁর মনে ভাসছিল। আমিও শুনছিলাম, তুমি বাড়িকাড়ি সারাচ্ছ।

আস্তে আস্তে সারিয়ে নিই, আমার তাড়াহুড়োর কোনও দরকার নেই।

ভালই করছ। বাইরে বাইরে আর কতকাল থাকবে!

শরবতের গ্লাসটা রেখে দিলেন শরদিন্দু, বেশ তৃপ্তি পেয়েছেন মনে হল শরবতটুকু খেয়ে। এবার হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই তুলে নিলেন। দেখো নীহার, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে একটা কেমন ভয়-ভয় ভাব হয়। তখন ইচ্ছে করে জানাশোনাদের মধ্যে থাকতে। যাদের চিনি-জানি তাদের মধ্যেই ভরসা খুঁজি। আমি যেখানে চাকরি করেছি এতকাল, সেখানে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। অনেকেই বলেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে হল না। ভালও লাগে না ওভাবে পড়ে থাকতে। তা ছাড়া ছেলেটা? তার কথা ভাবলে দুশ্চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। আমার নিজের মানুষ বলতে আর কেউ নেই। তবু নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারলে ছেলেটাকে অন্তত দেখার লোক জুটবে।

নীহার সমস্তই অনুভব করতে পারছিলেন: শরদিন্দুদের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দুঃখ। মানুষটিকে সান্ত্বনা ও ভরসা দিতে বড় ইচ্ছে হল, বললেন, তোমার অত দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। এখনও তো একেবারে থুথুরে বুড়ো হয়ে যাওনি। হেসেখেলে কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। শ্যামও বড়টি হয়ে গেছে। দু-চার বছরের মধ্যে সে মানুষ হয়ে যাবে। তোমার ভাবনা কী?

শরদিন্দু দেশলাই জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে নিলেন। নীহারের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আরও কুড়িটা বছর বেঁচে থাকতে বলছ?

নীহার পায়ের দিকের কাপড়টা গুছিয়ে নিতে হেঁট হয়েছিলেন, ঘাড় তুলে বললেন, ওমা, তা কেন থাকবে না! তোমার এমন কী বয়েস হয়েছে বাপু! সত্তর, পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকে না? বলছ কী তুমি! আমার শ্বশুরমশাই তো আটষট্টি বছর বয়সে গিয়েছেন।

শরদিন্দু নীহারের দিকে তাকালেন। সামান্য অপেক্ষা করে বললেন, বেঁচে থাকার কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে নীহার? তুমি নিজের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছ না, সংসারে ওই জিনিসটার সময় বলে কিছু নেই।

নীহার নীরব থাকলেন। জীবনে এই সত্যটা তাঁর অজানা নয়। শরদিন্দুর জীবনেও তেমন দুর্ভাগ্য না ঘটেছে এমন নয়, নীহার যেমন স্বামীকে হারিয়েছেন, শরদিন্দুও হারিয়েছেন স্ত্রীকে। নিজের বেদনা, শরদিন্দুর বেদনা–দুইই যেন নীহারের মধ্যে কেমন পাশাপাশি দুটি ধারার মতন বয়ে যেতে যেতে একসময় একত্রে মিশে যাচ্ছিল।

শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট খেতে খেতে পিঠ হেলিয়ে বসলেন আবার। তিনি যে কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন বোঝা যাচ্ছে না; আকাশের দিকে, নাকি অনেকটা দূরে–যেখানে নারকোল গাছের মাথায় অন্ধকার জমে মেঘের আকার নিয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আছেন!

নীহার শরদিন্দুকে দেখছিলেন। মুখটি চৌকো ধরনের, গালের চামড়ার টান পাতলা হয়ে আসছে, চোখের তলা কুঁচকে যাচ্ছে, চিবুক বেশ পাতলা। মাথায় পাকা চুলের মাত্রাটাই বেশি। চোখ দুটি অনেক স্তিমিত। গলার চামড়া ঝুলে এসেছে যেন। বয়স হিসেবে শরদিন্দুকে আরও প্রৌঢ় মনে হয়। গলার স্বরটি কিন্তু এখনও ভরাট।

নিশ্বাস ফেলে নীহার বললেন, তুমি পুরুষমানুষ। তোমার অত ভয়-ভাবনা সাজে না। কথাটা বলার পর নীহারের নিজের কাছেই কেমন অর্থহীন শোনাল।

শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে নীহারের দিকে তাকালেন। আমি অনেক সময় তোমার কথা ভাবতুম। লোকে বলত, তুমি খুব বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, সাংসারিক বোধবুদ্ধি তোমার কম নয়। আজ এখানে এসে তোমাদের দেখে আমি সত্যিই বেশ অবাক হয়েছি। তুমি তো মেয়ে হয়ে একলা বেশ টেনে এনেছ এই সংসার। তোমার সংসারটিও বড় সুন্দর লাগছে।

নীহার কেমন এক মুখ করে সামান্য হাসলেন। বললেন, মেয়েদের কি আর ছটফট করলে চলে গো? আমাদের পা-ছড়িয়ে বসে কাঁদার সময় কই! বলে বাঁ পা আস্তে করে চেয়ারের ওপর তুলে হাঁটু মুড়ে নিলেন। পা ঝুলিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে তাঁর কষ্ট হয়, বাঁ হাঁটুতে একবার জল জমেছিল। মৃদু গলায় বললেন, উনি যখন যান তখন আমি বড় একলা, অসহায় হয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎই চলে গেলেন, দুদিন আগেও বুঝতে পারিনি। কী যে ব্যাধি পুষছিলেন পেটে, রক্ত পড়তে শুরু করল সকাল থেকে, বিকেলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। পরের দিন ভোরে চলে গেলেন। আমার তখন যা অবস্থা–চোখের সামনে শুধু অন্ধকার দেখেছি। ভগবানের পায়ে শুধু মাথা খুঁড়েছি। ওই কচি মেয়ে, সম্বল বলতে এই বাড়িটা, আর সহায় বলতে নিজের কেউ না, বাইরের দু-একজন। কিন্তু বসে বসে কাঁদলে তো দিন চলে না। বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি। এখন আমার যা ভাবনা ওই মেয়েকে নিয়ে, আর কিছু নয়।

শরদিন্দু স্থির, শান্ত, সস্নেহ দৃষ্টিতে নীহারকে দেখছিলেন।

দুজনেই কিছুক্ষণ আর কথা বলার মতন কিছু পেলেন না। শরদিন্দু সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিলেন।

নীহারই কথা বললেন আবার, আমাদের ওখানে পালিতবাবুদের বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসেছিল একবার তোমার মনে আছে?

শরদিন্দুর খেয়াল করতে সময় লাগল। খেয়াল হলে মাথা নাড়লেন আস্তে করে।

সেই সাধু আমার হাত দেখে বলেছিলেন, কোনও কালেই আমার মনের শান্তি হবে না, নীহার বললেন।

নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু শুধোলেন, হয়নি?

কোথায় আর হল?

শরদিন্দু নীরব থাকলেন। নীহারের দুর্ভাগ্যই কি সব? তার সৌভাগ্যের দিনে সে কি শান্তি পায়নি? কথাটা পালটে নিয়ে নীহারকে ভরসা দেবার মতন করে বললেন, তোমার দায় তো শেষ হয়ে এসেছে।

ব্যস্ত ভাবে হাত নেড়ে নীহার বললন, বোলো না বোলো না। মেয়েটা আছে আমার গলার সঙ্গে জড়িয়ে। ওর বরাতে কী আছে–সেই ভেবে ভেবে আমার রাত কাটে।

শরদিন্দু নীহারের উদ্বেগটুকু অনুভব করলেন। তারপর হালকা করেই বললেন, তোমার মেয়েকে দেখলে তোমায় খানিকটা বোঝা যায়।

আমায়? নীহার অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন।

ওর বয়সে তুমিও অনেকটা ওই রকম ছিলে।

আমি আবার ওর মতন ছিলাম কোথায়! নীহার আপত্তি জানিয়ে বললেন, আমার চোখমুখ ও পায়নি, ওর বাবারটা পেয়েছে।

শরদিন্দু নরম গলায় হাসলেন। তোমারও পেয়েছে। তোমার গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়ন–সবই দেখছি তোমার মেয়ে পেয়েছে। কথাবার্তা বলার ধরনটাও প্রায় তোমার মতন।

নীহার হেসে ফেললেন। মাথা নেড়ে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি ওর মতন ছিলাম না।

শরদিন্দু কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না, হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, নীহার অতীতে কেমন ছিলেন তিনি তা বিলক্ষণ জানেন।

নীহার যেন হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, চোখ নামিয়ে শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। তারপর আচমকা বললেন, তুমি আমায় ভুলে গেছ।

শরদিন্দুর মুখের ভাব বদলাল না। নীহারের চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললেন, ভুলে গিয়েছি?

দুজনেই নীরব। যেন দুজনের মধ্যে দিয়ে কুড়ি বাইশটা বছরের জল গড়িয়ে যাচ্ছিল।

 শেষে নীহার বললেন, ভুলে যাওয়া আশ্চর্য কী। কতকাল পরে আবার আমায় দেখলে বলল তো?

তুমিই বলো।

আঠারো উনিশ বছর পরে। কুড়ি বছরই ধরো– নীহার অন্তরঙ্গ গলায় বললেন। তোমাকে আমি শেষবার দেখেছি, শ্যাম তখন বাচ্চা, বছর চার পাঁচ বয়েস। আমি মেয়ে কোলে করে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম, একেবারে কচি তখন রিনি, দাঁত উঠেছে সবে। তুমি শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলে। বউদিকেও আমি সেই প্রথম দেখলাম। এসব কি আজকের কথা! আজ রিনির বয়েস কুড়ি হতে চলল, শ্যামের তেইশ-টেইশ হবে। প্রায় দু যুগ পরে আবার আমায় দেখছ। ভুল হওয়ারই তো কথা।

শরদিন্দু বাঁ হাতটা পাতলা চুলের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক মমতা জড়ানো। ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। দু যুগ বলতে পারো। পুষ্প তখন বেঁচে ছিল। …তারপর অবশ্য দেখাসাক্ষাত আর হয়নি। কিন্তু খবরটবর পেতাম সবই।

নীহার আবার পা নামিয়ে নিলেন। হাঁটুতে সাড়া পাচ্ছেন না, চাপ লেগে যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, ব্যথাও করছিল। সরল গলায় বললেন, তা হলে আমি মন্দটা আর কী বলেছি বলো! আমার বিয়ের পর সেই আমায় প্রথম দেখলে, বিয়ের সময় তুমি ছিলে না, তার আগে যা দেখেছ। অতদিনের চেহারা কি তোমার মনে থাকার কথা?

শরদিন্দু সকৌতুক অথচ শান্ত গলায় বললেন, মনে না থাকলে আজ আমি তোমায় হাওড়া স্টেশনে চিনতে পারলাম কী করে?

নীহার যেন একথাটা ভেবে দেখেননি আগে। সামান্য থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর হেসে বললেন, থাক, ও বড়াই আর কোরো না। তুমি আমায় চেনার আগেই আমি তোমায় খুঁজে নিয়েছি।

শরদিন্দু মৃদু হেসে বললেন, তোমার সেই পুরনো অভ্যেস আজও আছে নীহার। এখনও তুমি তোমারটা আগে দেখবে। বেশ, তাই হল। তুমিই আমায় আগে খুঁজে নিয়েছ, আমি তোমায় পরে চিনেছি। ..খুশি হলে তো?

নীহার নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি স্নান, বিমর্ষ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বললেন, কে কাকে আগে চিনেছে সে ঝগড়া আর আমি করব না গো। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছ, এতকাল পরে, এতেই আমি খুশি।

.

০৫.

দোতলার বারান্দায় বসে শরদিন্দু কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন; তারপর ওপরে তেতলায় নিজের ঘরে চলে গেলেন। নীহার গেলেন গা ধুতে; গা ধুয়ে পুজোয় বসবেন। তনুশ্যাম বসে থাকল। তারা চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বিকেলে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছে।

দোতলার বারান্দায় এই বসবার জায়গাটুকুতে তনু দিনের বেশির ভাগ সময়টাই আজ কাটিয়ে দিল। সকালে অনেকটা বেলা পর্যন্ত বসে বসে কথা বলেছে, কাগজ দেখেছে, বই পড়েছে খানিকটা। বারান্দার রেলিংয়ের ওপর বসানো কাঠের পাল্লা আর শার্সি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে আসছিল, এখন কিন্তু সবই প্রায় খোলা, বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখাও চলছে।

হাত কয়েক দূরে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রিনি কিছু একটা ইস্ত্রি করছিল। ইস্ত্রি শেষ হলে সাজসরঞ্জাম নিয়ে সে তার ঘরের দিকে চলে গেল; সামান্য পরে ফিরে এসে তনুর মুখোমুখি দাঁড়াল।

একেবারে চুপটি করে বসে আছ যে–? রিনি শুধোল; একবার পার্ক স্ট্রিট গিয়েই হাঁপিয়ে পড়লে!

তনু রিনিকে দেখতে দেখতে বলল, না। চোখ দেখাবার পর মাথা ধরে যায়।

রিনি রগড় করে বলল, শির দরদ?

তনু হেসে ফেলে বলল, আমি তোমাদের কলকাতার বাঙালিদের চেয়ে খারাপ বাংলা বলি না।

তা দেখতেই পাচ্ছি। রিনি সোফার ওপর বসে পড়ল।

তনু রিনির হাসিভরা মুখ, ঝকঝকে চোখ, লতাপাতা করা ছাপা শাড়িটা দেখতে দেখতে তার বাঙালিত্ব প্রমাণ করার জন্যই যেন বলল, আমাদের ওখানে বাঙালি অনেক আছে। কলেজে তিন চার জন। গভর্নমেন্ট সারভিসে আছে আট দশ জন। বিজনেস আছে বাঙালির, সেলস-এজেন্ট কত আসে।

রিনি আগের মতোই মুখ করে বলল, তোমাদের ওখানে মানে পুরো মধ্যপ্রদেশ তো?

তনু সামান্য জোরেই হেসে ফেলল। বলার কিছু নেই। রিনি আজ সকাল থেকেই তার খুঁত ধরে তাকে খেপাবার চেষ্টা করছে। দু-চারটে শব্দ বা দু-চারটে কথায় কিছু হিন্দুস্থানি টান থেকে গেলে দোষের যে কী আছে তনু বুঝতে পারছেনা। রিনি যে নিজে চিঠিকে চিটি বলে তাতে কোনও দোষ নেই। আজ দুপুরে খাবার সময় টেবিলে বাবা, নীহারপিসি, রিনি আর তনু এই নিয়ে খুব হাসি-রগড়, মজা করেছে।

বাবাই সবচেয়ে মজার কথা বলেছিল। বলেছিল: নীহার তোমার আমার বাড়ি ছিল বিহারে, আমরা হলাম বেহারি বাঙালি, তুমি আমাদের দলে, রিনি হল পুরোপুরি কলকাতা। কলকাতাকে আমরা বলতাম, হালুম-হুঁলুমের দেশ, ওরা খেলুম, গেলুম, শুলুম করেই কাটায়। রিনি এখন বুঝে দেখুক কোন দেশেতে আছে।

তখনকার কথা মনে পড়ায় তনু একটু হাসল। রিনিদের কলকাতা হালুম-হুঁলুমের দেশ তবে!

তনু কিছু বলার আগেই রিনি বলল, মাথা ধরেছে বলে প্যাঁচার মতন মুখ করে বসে আছ! একটা ট্যাবলেট এনে দিই, খেয়ে নাও।

খেতে হবে তনু বলল, কপালটা ফেটে যাচ্ছে।

 রিনি ওষুধ আনতে উঠি উঠি ভাব করছিল, তনু বলল, চোখের ডাক্তাররা চোখ নিয়ে টরচার করে, ভীষণ স্ট্রেন হয়।

আমায় চোখ শিখিও না, আমি চোখের ডাক্তারের মেয়ে।

 জানি, তনু হাসল, শুনেছি আমি।

তা তোমার চোখের কথা গুপ্তসাহেব কী বললেন?

আমায় কিছু বলেননি। বাবার সঙ্গে কীসব কথা হয়েছে আসবার সময় ট্যাক্সিতে বাবা আর পিসি কথা বলছিল। মালুম হল, কমপ্লিকেটেড কেস। কী কী সব টেস্ট করতে হবে।

রিনিরও সেই রকম মনে হল। শরদিন্দুমামা এবং মার দু-একটা কথা শুনে, মুখ-চোখ দেখে তারও মনে হয়েছে, দুজনেই যেন খানিকটা মনমরা। তনুর সত্যিই খুব মাথা ধরেছে, না বেচারি খুব হতাশ হয়ে গেছে–মুখে সেটা বলছে না, রিনি বুঝতে পারল না, তবে চোখ দেখার সময় ডাক্তার যা করে তাতে ভাল চোখও টনটন করে ওঠে। মাথাও ধরে যায়। রিনি তনুর জন্যে মাথাধরার বড়ি আনতে উঠল।

তনু সোফার মধ্যে ডুবে পা টানটান করে বসে থাকল। বারান্দার ওপাশের বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছে রিনি, এপাশেরটা জ্বলছে। খোলা শার্সি দিয়ে সামনের বাড়ির সিঁড়ির প্যাসেজটা চোখে পড়ে। বাতি জ্বলছে। চারপাশে একটা কলরব যেন ভেসেই আছে। বেজায় জোরে কোথাও রেডিয়ো বাজছে। রিনি একসময় বাহারি মাছ পুষেছিল, অ্যাকুরিয়ামটা এখন ফাঁকা, একপাশে রাখা আছে, তার মধ্যে কীসের এক গাছ পুঁতে রেখেছে রিনি, পাতাগুলো বাড়ছে বেশ।

রিনি ওষুধ এনে দিল, জলের গ্লাস।

তনু ট্যাবলেটটা খেয়ে ফেলল। পুরো গ্লাস জলও।

রিনি বসে পড়ল। মা পুজো সেরে এসে চা খাবে। তখন তোমার পিসিকে ম্যানেজ করতে পারলে এক কাপ চাও পেতে পারো। মাথা ধরা ছেড়ে যাবে।

তনু বলল, চা পেলে গ্র্যান্ড হয়।

হয় ঠিকই; কিন্তু তোমার পিসি তোমায় হরিণঘাটা খাওয়াতে চাইবে।

তনু বুঝতে পারল না। হরিণঘাটা কী?

হরিণের দুধ, রিনি মুখটা গম্ভীর করে বলল, কলকাতায় আমরা হরিণের দুধ খাই। বলে মুহূর্ত পরে গাম্ভীর্য হারিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, কলকাতার মানুষকে যা ছোটছুটি করতে হয় তাতে গোরুমোষের দুধে চলে না, বুঝলে।

তনু ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে হেসে ফুলেছিল: বলল, তুমি হরিণ দেখেছ?

 অনেক।

কোথায় দেখেছ?

চিড়িয়াখানায়।

আমি হরিণের জঙ্গল দেখেছি। মোস্ট বিউটিফুল।

রিনি চোখের তারা বেঁকা করে নিরীহ গলায় শুধোল, হরিণের জঙ্গলে কারা থাকে।

 তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। কারা?

মানে কী থাকে? শুধু হরিণ?

না শুধু হরিণ কেন! আরও জীবজন্তু থাকে। হরিণ বেশি।

তা হলে আর হরিণের জঙ্গল বলছ কেন, বলো জঙ্গলের হরিণ। বনে থাকে বাঘ, খাটালে থাকে মোষ, বলতে বলতে রিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তনুও হাসতে লাগল।

রিনি এবার অন্য কথা পাড়ল। পার্ক স্ট্রিটে তো গেলে চোখ দেখাতে: পার্ক সার্কাস কেমন লাগল?

 তনু সকৌতুকে বলল, জাস্ট লাইক এ সার্কাস। গ্র্যাঞ্জার, ডেকোরেশান, লাইট, শো।

ইয়ার্কি?

ইয়ার্কি নয়। সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাবার সময় আমি দেখেছিলাম। আসবার সময় চোখের যা হাল, চাইতে পারছিলাম না। বড় ভিড়, আর শব্দ।

বাঃ, সার্কাসে ভিড় হবে না। ওটা সাহেবপাড়া। তুমি যদি বড়দিনের সময় আসতে পার্ক সার্কাসের চেহারা দেখতে।

তনু তার দু হাত ঘাড়ের তলায় রেখে খানিকটা আরামের চেষ্টা করল। বলল, বাবা তোমাদের কলকাতা দেখে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছে। বাবা যখন কলকাতায় থাকত স্টুডেন্ট লাইফে–তখন কলকাতা এরকম ছিল না। বাবা পিসিকে বলছিল, কলকাতার রাস্তায় বেরুলেই দম আটকে আসছে। বাবার।

মজার চোখ করে রিনি জিজ্ঞেস করল, তোমারও দম আটকে যাচ্ছে নাকি? তা হলে আগেভাগেই বলে রাখো, বাবা! এরপর তোমায় কলকাতা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমি ফ্যাসাদে পড়ব নাকি?

তনু ঘাড় নাড়ল। আমার দেখতে ভাল লাগে বহুৎ। কিন্তু ক্রাউড দেখলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই। আমার চোখের নার্ভগুলো সহ্য করতে পারে না, কেমন একটা ফিলিং হয়। বলতে বলতে তনু থামল, হঠাৎ বোধহয় কপালে তীব্র ব্যথা এসেছিল, চোখ বুজে কপাল কুঁচকে ব্যথাটাকে সে সইয়ে নিল। তারপর বলল, তোমাদের কলকাতায় ডবল ডেকার বাসগুলো দেখলে আমার ভীষণ ভয় হয়। মনে হয়, এই বুঝি সব চাপা পড়ল।

রিনি যেন তনুর ওপর করুণা করে হাসল। বলল, তুমি একেবারেই গাঁইয়া।

ট্রাম দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে–তনু বলল, ভেরি নাইস। আজ আমরা যখন যাচ্ছিলাম, আসছিলাম–গাছপালার গা দিয়ে মাঠের পাশে পাশে ট্রাম যাচ্ছিল। খুব নাইস লাগছিল।

রিনি হাসল খানিকটা। বলল, তোমায় কলকাতা দেখাতে নিয়ে আমিই পড়ব বিপদে। তোমার যে কোনটা নাইস হবে আর হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কে জানে! কলকাতার ট্রাফিক পুলিশও তোমার কাছে নাইস হয়ে যাবে হয়তো, কে জানে!

আমায় আগে তুমি প্ল্যানেটোরিয়ামটা দেখাও।

গেলেই হল একদিন, কাগজটা সকালে দেখে নিতে হবে, রোজ খোলা থাকে না।

তনু রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, খানিকটা অন্যমনস্ক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি, বুঝলে রিনি, আমার খুব ইচ্ছে ছিল অ্যাস্ট্রনমি পড়ব। ছেলেবেলা থেকেই আকাশ, তারা, ওই এন্ডলেস স্পেস দেখতে খুব ভাল লাগে আমার। ইট অ্যাট্রাক্টস মি। আমার চোখের জন্যে আমি আকাশটাও ভাল করে দেখতে পেতাম না। তবু আমার ভীষণ ভাল লাগত। খালি চোখে আমরা দু হাজারের মতন তারা দেখতে পাই, বুঝলে। আমি কত পেতাম কে জানে। পাঁচশো, সাতশো হয়তো। একটা তারা আছে সাড়ে ছশো লাইট-ইয়ার দুরে, তার মানে এখান থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে, সেই তারাটা আমাদের সুর্যের চেয়ে একানব্বই হাজার গুণ আলো ছড়ায়। তুমি ইমাজিন করতে পারো? কত দূর থেকে এই আলো আসছে ভাবলে গায়ের মধ্যে তোমার শিউরে ওঠে না? আমার গা শিউরে যায়…বুঝলে রিনি, আমাদের এই জগৎটাই কত বড়, কত রকম মিষ্ট্রি এর মধ্যে। কিন্তু ওই যে মাথার ওপর এটারন্যাল স্পেস ওটা আরও মিস্টিরিয়াস। ভাবাই যায় না। তোমায় একটা কথা শোনাই, প্রতিদিন ওখানে কত কী ঘটে যাচ্ছে ভাবতে পারবে না। ওখানে–ওয়ান্ডর্স ইন দি মেকিং, ওয়ার্ডস ডেড অ্যান্ড অ্যারিড, হোয়ারলিং ফ্রাগমেন্টস অব ওয়ান্ডর্স–অল পাস অ্যাবাভ আস ফ্রম নাইট টু নাইট।

রিনি তনুর মুখ দেখছিল। তনু যতটা পেরেছে চোখের পাতা খুলে ফেলেছে কথা বলতে বলতে, মুখটি যেন আবেগে ভরে উঠেছে। গলার স্বর বড় সুন্দর। রিনি বলল, তুমি অ্যাস্ট্রনমি পড়লে না কেন?

এই চোখ নিয়ে? চোখের জন্যে আমার পড়াশোনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তনু একটু থামল, তারপর আবার বলল, বাবা বটানির প্রফেসার, বাবার ইচ্ছে ছিল আমি বটানিটা যদি পড়তে পারি। তাও হল না।

তুমি এখন কী পড়ছ? ফিলজফি।

রিনি মুখ হাঁ করে চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত এক মজার ভঙ্গি করে বলল, দর্শন! ও বাব্বা, তাই বললা; তুমি হলে ফিলজফার। তাই তোমার মুখে অত জ্ঞান। রিনি হাসতে লাগল।

তনু কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে চুপ করে গেল। তার মুখেও স্নান হাসি।

রিনি বেশ নজর করে তনুকে দেখল। ঠাট্টাটা তনু ভাল মনে নেয়নি। কী ছেলে রে বাবা! রিনি বলল, বড় হয়ে তুমি তা হলে ফিলজফার হচ্ছ?

তনু রিনির দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমি অন্ধ হচ্ছি।

এবার রিনি যেন রাগ দেখিয়ে তনুকে ভেঙাল, বলল, অত শখে কাজ নেই। তুমি ফিলজফারই হও, তাও তো অন্ধ হওয়া।

নীহার ততক্ষণে এসে পড়েছেন। তাঁর পুজোপাঠ শেষ হয়েছে। গা ধুয়ে, কাপড়জামা বদলে, পুজো সেরে আসতে আজ তাঁর বেশি সময় লাগল না। তাঁকে খুব শুভ্র সতেজ দেখাচ্ছিল। তনুদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নীহার মেয়েকে বললেন, সারাদিন তুই কী যে হিহি করে হাসিস রিনি, দু দণ্ড শান্তিতে পুজো করাও দায় হল। অত হাসির কী হল?

রিনি বলল, যার পুজোয় মন থাকে সে হাসি শোনে না।

 তুই থাম। আমায় জ্ঞান দিচ্ছে। আমি তোর পেটে জন্মাইনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস।

রিনি হেসে ফেলল। পরে বলল, তোমার চা করে দিই। বলে রিনি উঠে পড়ল। চোখ দেখিয়ে এসে তোমার শ্যামের মাথা ধরে গিয়েছে। একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছি। এক কাপ চা খেতে চাইছে।

নীহার তনুর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তোর মাথা ধরেছে?

তনু ঘাড় নাড়ল।‘ যা করে ডাক্তাররা চোখ নিয়ে, মাথা ধরতেই পারে। তা তুই জামাকাপড় পরে বসে আছিস কেন তখন থেকে? যা হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে থাক খানিকটা, ধকল কাটলেই সেরে যাবে। বলে নীহার আদর করে তনুর মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

রিনি আড়চোখে সেটা দেখল, দেখে চলে গেল। মার তনুশ্যাম এবাড়িতে এসেই মার কাছে তুই হয়ে গেছে। বলা যায় না, এরপর মা হয়তো তার শ্যামের মাথা টিপতে বসে যাবে!

তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীহার ডাকলেন, শ্যাম।

উঁ–

তোর চোখ ভাল হয়ে যাবে। কলকাতায় কত বড় বড় ডাক্তার আছে। তুই দেখ না, আমি সকলকে দিয়ে তোকে দেখাব। ভাবিস না। …যা হাতমুখ ধুয়ে নিগে যা।

তনু জামাকাপড় ছেড়ে, বাথরুম থেকে ফিরে এসে তার ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিল। মাথার ব্যথাটা যে তার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে তা নয়, বরং রিনির কাছ থেকে অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে, ঠাণ্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে এসে এখন তার আরামই লাগছিল। কিন্তু শরীরটা কেমন ক্লান্ত লাগছিল তনুর। চুপ করে শুয়ে ছিল। শুয়ে শুয়ে এই ঘর দেখছিল, তাদের ঘরবাড়ির কথা ভাবছিল, চোখের ডাক্তারের চেম্বার, গুপ্ত সাহেবের জাঁদরেল চেহারা, আরও কত কী তার মাথায় আসছিল। হঠাৎ রিনির গলা কানে এল।

চা নিয়ে এসে রিনি বলল, এই যে ফিলজফার মশাই, উঠুন; চা নিন; দেখুন চায়ে চিনি হল, না নুন হল!

তনু বিছানার ওপর উঠে বসে চা নিল। তার পা খাটের পাশে ঝুলছে।

চা দিয়ে রিনি চলে গেল না। মার চা সে ওপরে দিয়ে এসেছে; চা আর পান। মা বলেছিল। শরদিন্দুমামার ইসবগুলের শরবত তৈরি করে মা নিজে ওপরে নিয়ে গেছে আগেই।

রিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঠাট্টা করে বলল, চায়ে চিনি-নুন ঠিক হয়েছে?

 তনু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, নাইস।

তা হলে তুমি চা খাও, আমি যাই।

বোসো না। তুমি এখন কী করবে?

 গ্রাস কাটিং।

 গ্রাস!

ঘাস কাটব। রিনির গলায় হাসির দমক উঠল।

তনু হেসে ফেলল। তুমি হরবখত তামাশা করো।

হরবখতই করি।

বোসো না। তনু আবার বলল।

রিনি বাস্তবিকই যাবার জন্যে আসেনি। চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বসে বলল, আমি ঘাস কাটতে যাব শুনে তুমি ইয়ার্কি ভাবলে। জানো, আমায় গিয়ে এখন পড়তে বসতে হবে।

তনু অবাক হয়ে বলল, পড়তে বসা, আর ঘাস কাটা এক হল?

আলাদা হবে কেন! আমার কাছে দুই-ই সমান। আমি কি তোমার মতন স্টুডেন্ট? আমি বইয়ের পাতা খুলে কচকচ করে কাটব। ব্যাস…। পড়াশোনা আমার ধাতে সয় না। কী হবে পড়ে। আমার কাঁচকলা হবে। কারুরই কিছু হয় না আমাদের। এক্সামিনেশনের সময় কী টুকলি! সে-ঘটা তো দেখনি?

তনু হাসছিল। তুমি টোকো!

 ওমা, টুকব না। কেনা টোকে! রিনি তনুর কথায় যেন একটু নাক সিঁটকে নিল।

তনু বলল, পেপারে দেখি, তোমাদের এখানে এক্সামিনেশনের সময় গোলমাল হয় বহুত?

রিনি বিনা প্রতিবাদে ঘাড় এক পাশে হেলিয়ে বলল, হয়। বহুত হয়। তোমাদের ওখানে হয় না?

হয়। কম হয়। তনু রিনির পা নাচানো দেখতে দেখতে বলল। রিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, পা নাচায় অনবরত। তনুর এই বদঅভ্যাস একেবারে নেই। সে চুপচাপ বসে থাকার সময় মাঝে মাঝে ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে দাঁতে নখ কাটে। তনু এবার জিজ্ঞেস করল, তোমার সাবজেক্ট কী?

আমার আলাদা কোনও সাবজেক্ট নেই। অনার্স-ফনার্স নেই, স্যার। আমার শুধু পাস।

অনার্স নাওনি?

 আহা নিতে চাইলেই দিত আর কী! আমি চাইনি, ওরাও দেয়নি। লেখাপড়ায় আমার মাথা নেই। কী হবে আমার পড়ে! আমি দিদিমণিও হব না, চাকরিও করব না।

তনু হেসে ফেলে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?

 রিনি এমন সহজ প্রশ্নটা আগে নিশ্চয় ভেবে নেয়নি৷ জবাব দেবার সময় হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, কিছুই করব না। বলে একটু থেমে কী যেন ভাবল, বলল, বাবা থাকলে আমার এত সুখ আর হত না। আমায় ডাক্তারি পড়তে হত। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। হয় আমায় ডাক্তারি পড়তে হত, না হয় বায়ো-কেমিস্ট্রি। বাবা বলত, আমাদে দেশে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে কেউ ভাবে না। আমি বাবা, বায়ো-কেমিস্ট্রি যে কী তা একেবারে জানি না।

তনু বলল, আমিও ঠিক জানি না। বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি মিলিয়ে সামথিং কিছু হবে। মালুম, ইট ইজ রিলেটেড টু মেডিক্যাল সায়েন্স।

সামথিং কিছু! ঘাড় দুলিয়ে ভেঙচে দিল রিনি, চোখ বাঁকা করে বলল, কী যে এক মালুম মালুম করো। ছাতু কোথাকার!

তনু হেসে উঠল।

 রিনিও মুখ ভেঙিয়ে বলল। আমাকে তো তখন খুব হালুম হলুম করলে, তুমিও বা কোন দেশের বাঘ?

চায়ের কাপটা তনু নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, তুমি ডাক্তার হলে রেপুটেশান হত। তোমার ট্যাবলেটটা ভাল। মাথা ধরা কমে এসেছে।

রিনি সামান্য চুপ করে থেকে জবাব দিল, বাবারই শখ ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। ডাক্তারি পড়লে আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হতাম। অন্য কিছু আমি হতাম না। আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হলে তোমার চোখ সারিয়ে দিতাম।

সরল মুখে হাসল তনু। ঠাট্টা করে নিজের কপালটা দেখাল। আমার কপাল খারাপ। বলে মুহূর্তখানেক পরে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশায় অনেকদিন মারা গেছেন, না?

বাবা! বাবা মারা গেছে অনেকদিন। আমার তখন তেরো বছর বয়েস। সাত বছর হতে চলল। রিনি ধীরে ধীরে বলল, অন্যমনস্কভাবে।

তনু বলল, আমার মা মারা গেছে আরও আগে। আমার সাত কি আট বছর বয়েস তখন। বলে তনু যেন উদাস মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। পরে বলল, নীহারপিসি আমার মাকে দেখেছে।

রিনি যেন তার বাবার কথা ভাবছিল। বলল, আমার বাবার ছবি তুমি দেখেছ। মার ঘরে আছে, আমার ঘরে আছে। আমার বাবাকে দেখলে তুমি অবাক হয়ে যেতে। কেমন লম্বা চেহারা, গায়ের রং ধবধব করত। বাবা যা মজা করতে পারত না, কী বলব! বাবা নীচের তলায় বসে হাসলে ওপরে আমরা শুনতে পেতাম। কী ভাল মানুষ ছিল বাবা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।

তনু রিনির কথা শুনতে শুনতে তার মার কথা ভাবছিল। তাদের বাড়িতেও মার ছবি আছে। মার কথা মনে পড়লে মার ছবির মুখটাই চোখের সামনে ভাসে। তনু বলল, আমার মার নাম ছিল পুষ্প পুষ্পলতা। মার রং ফরসা ছিল। মাথায় যা চুল ছিল–হাঁটু পর্যন্ত। লম্বা লম্বা চোখ। মা খুব বাইবেল জানত। আমায় কত গল্প বলত বাইবেলের।

রিনি বলল, তোমার মা কী করে মারা গেলেন?

তনু চুপ করে থাকল। তার চোখ-মুখের বিষণ্ণতা নজরে পড়ছিল। মাথার চুলে অন্যমনস্কভাবে হাত বুলিয়ে সে বলল, মার ডেলিভারি হচ্ছিল। কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, সাম কমপ্লিকেশানস। দুজনেই মারা গেল। আমি তখন খুব ছোট। আমার সব মনে নেই।

রিনি অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে তনুর কথা শুনছিল। তার পা নাচানো বন্ধ ছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎ রিনি বলল, তোমার মা, আমার বাবা! অদ্ভুত, না?

তনু কিছু বলল না, রিনির দিকে তাকিয়ে থাকল।

রিনি বড় করে নিশ্বাস ফেলল। আবার তার পা নাচানো শুরু হয়ে গেল। ঘাড়ের পাশ থেকে চুলের বিনুনিটা বুকের কাছে এনে হাতের ঝাঁপটায় দুলিয়ে খেলার মতন করল, তারপর হেসে ফেলে বলল, কী রকম মজা দেখো, আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা আর তোমার মা এখন স্বর্গে খুব গল্প করছে।

বলে রিনি থামল, যেন স্বর্গের সেই গল্প করার আসরটা উঁকি মেরে দেখে নিল; তারপর তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল, আর এখানে আমার মা আর তোমার বাবা তেতলায় বসে কথা বলছে। আমরাও বলছি–তুমি আর আমি। তিন জায়গায় তিন পেয়ার। কী অদ্ভুত, না?

তনু যেন খুব ধীরে মাথা দুলিয়ে জানাল, হ্যাঁ–বেশ অদ্ভুতই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *