১. ঘরে ঢোকে ছায়া দেবনাথ

ঘরে ঢোকে ছায়া দেবনাথ। জানালার সামনে বসা রোগী অমলকুমার দাসকে উদ্দেশ্য করে বলে গুড মর্নিং অমলবাবু। তারপর কেমন আছেন? আসুন প্রেসারটা দেখি। প্রথম প্রথম ছায়া অমলকুমার দাসকে দু-একবার দাদু সম্বোধন করে ফেলেছিল। রোগী অত্যন্ত বিরক্ত। দাদুফাদুবলবেনা। বুড়োবুড়ো লাগে। পরের দিন ছায়া ডাকল, মেসোমশাই। আবার ভুরু কোঁচকায় অমলকুমার দাস। অত মেসোমশাই পিসেমশাইয়ের দরকার কি। আত্মীয়তা পাতাতে আসো কেন,অ্যাঁ? নার্স নার্সের মতো থাকতে পারো না?

অতঃপর অমলবাবু।

রক্তচাপ মেপে জ্বরকাঠিটা মুখে চুষির মতো গুঁজে দিয়ে ছায়া লোহার খাটের পাশে টেবিলে ফাঁইল খুলে লিখতে থাকে।

–বাঃ কাল রাতে তো দিব্যি ঘুমিয়েছেন দেখছি, নাইট্রাসুন, ভ্যালিয়াম কিচ্ছু লাগেনি। কাঠিটা অমলের মুখ থেকে বের করে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে দ্রুতহাতে লেখে ৯৮.৬।

—এক্কেবারে নরম্যাল। খুব ভাল আছেন, নো প্রবলেম। কাল কথাটথা বলেছেন তো?, অমলকুমার দাস কাল কথাটথা বলেনি। অমল কোনদিনই কথাটথা বলে না। নার্স ডাক্তার সবাই চেষ্টা করে তাকে কথাটথা বলাতে। কিন্তু অমল কথা বলে না, কারণ বলার মতো কোনও কথা তার নেই। সে শুধু শোনে। প্রতিদিন এক কথা।

-আপনি খুব ভাল আছেন।

—আপনার গলব্লাডার অপারেশন সাকসেসফুল।

—আপনার প্রস্টেটে আর অসুবিধা নেই।

—আপনার ব্লাডসুগার ইউরিক অ্যাসিড কোলেস্টেরল সব কন্ট্রোলে।

—আলট্রা সাউন্ডে প্যানক্রিয়াসে যে দাগ দেখা দিয়েছিল সেটা আর বাড়েনি।

–আপনি খুব ভাল আছেন। নো প্রবলেম। কিন্তু অমল জানে সে ভাল নেই। সে ভাল ছিল না, ভাল থাকতে পারে না। তাই সে এখানে। কী যেন নাম, সর্বদা গুলিয়ে যায়। লুম্বিনী পাকনা ক্লিনিকনা হোম। না কি লুম্বিনী বন। কোথায় যেন জায়গাটা। মনে করতে চেষ্টা করে। একটা বাজারের কাছে। হ্যাঁ রাস্তাটা হচ্ছে রাজা গোপালাচারী সরণী সংক্ষেপে আর এস, মুখের কথায় আরো অনেক কাল আগে অমলদের আমলে অর্থাৎ যে সময়টাকে অমল নিজেদের সময় মনে করে যখন সে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে, কাজকর্ম করেছে-এককথায় যখন সে আর পাঁচজনের মতো কথাটথা বলত—তখন এ জায়গাটার নাম ছিল লেক মার্কেট। সেই বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে চেতলা পর্যন্ত গোটা বড় রাস্তাটা ছিল রাসবিহাবী অ্যাভিনিউ। এখন তিনটে ভাগ। পূর্বদিকে রাস্তা-এ, শেখ আবদুল্লা, মাঝখানে সাবেকী রাসবিহারী, তারপর পশ্চিমে শেষ অংশ আরেস। ধর্মনিরপেক্ষ বহুভাষী ইন্ডিয়ার একটা মহানগরীর এত বড় জনপথ শুধু রাজ্যের সংখ্যাগুরু বঙ্গভাষী হিন্দুর নামে থাকাটা অনুচিত বিবেচিত হওয়ায় একভাগ মুসলমান অন্যভাগ তামিল নাম। ভাষা-ধর্ম সব কিছুতেই তো সংখ্যালঘুদের আলাদা সত্তা। আর তাকে স্বীকার করেই ইন্ডিয়া।

সত্যি কথা বলতে কি স্বীকার করতে অমলেরও কোনদিন আপত্তি ছিল না। আর পাঁচটা উচ্চশিক্ষিত বাঙালির মতো হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে সে উদাসীন। আর বাঙালিয়ানার বাই তার কস্মিনকালেও নেই। শুধু যে সময়ে সে জন্মেছে, বড় হয়েছে, চাকরি করেছে সেই সময়টাকে সে ছাড়তে পারে না। তার বাস অতীতে। পুরনো বরাবরের চেনাজানা বাস্তবটা পালটে গেছে সেটাই তার ধাতস্থ হয় না। বর্তমানকে কেমন তার ভয়-ভয় করে। যেন পায়ের তলার মাটিটা সরে-সরে যাচ্ছে। অতএব, তার ঠিকানা রুম নম্বর ৩০২ লুম্বিনী পার্ক না ক্লিনিক না হোম না কি বন, ২৪ নং রাজা গোপালাচারী সরণী, আরেস।

কতদিন আছে অমলকুমার দাস এখানে? সামনে সাদা দেওয়ালে চৌকো কার্ড ক্যালেন্ডারে পর পর বদলে যায় দিন মাস সাল। অমল আজ অবাক চোখে দেখে সন ১৯১২, অক্টোবর ১৯। এই যে সিস্টার, হঠাৎ ডেকে ওঠে অমল। ছায়া দেবনাথ থমকে দাঁড়ায়।

—ওটা কী তারিখ লাগিয়ে রেখেছেন?

—কেন? ঠিকই তো আছে। রাতের সিস্টার সকালে রোগীর স্নান ব্রেকফাস্টতদারকি বিছানা ঠিকঠাক সেরে তারিখটা পালটে দেয়। আজও দিয়ে গেছে।

–বলেন কি? এটা দু হাজার বারো? আজ উনিশে অক্টোবর?

—আপনার কী মনে হয়? অন্য কিছু? যেন একটু রহস্যের ছলে প্রশ্ন করে ছায়া। আজকের নিউজপেপার দেখেননি?

প্রতিদিনের মতো আজও সকালে চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ ঘরে এসেছে। প্রতিদিনের মতো নিপাট ভঁজসহ পড়ে আছে ন্যাশনাল ডেইলি। প্রথম চার পৃষ্ঠা হিন্দি, তারপর দুপৃষ্ঠা ইংরেজি ও শেষ এক পৃষ্ঠা বাংলা। ইন্ডিয়ার সব রাজ্য থেকে বেরোয় ন্যাশনাল ডেইলি। প্রথম ছপাতা দিল্লি থেকে আসে সপ্তম পাতা আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী থেকে জুড়ে দেওয়া হয়। ঠিক টিভি প্রোগ্রামের মতো। বেশির ভাগ চ্যানেল হিন্দি,দু-তিনটে ইংরেজি, নামমাত্র কয়েকটি আঞ্চলিক অর্থাৎ আগে যাকে মাতৃভাষা বলা হত সেটি টিমটিম করছে। তবে অমল বহুকাল টিভি দেখে না। কাগজও পড়ে না। দেশে বিদেশে ঘরে বাইরে কত কিছু না কি ঘটে। হবেও বা। অমলের কিছু যায় আসে না।

—আচ্ছা সারাটা দিন আপনি এত চুপচাপ কাটান কী করে? আমি তো বাবা কথা না বলে থাকতেই পারি না। অমলবাবু ও অমলবাবু? কানের কাছে এসে বেশ জোরে জোরে ডাকে মেয়েটা। যেন কানে খাটো কারও সঙ্গে কথা বলছে। আবার কাছে এসে ঝুঁকে মুখের সামনে হাতের আঙুলগুলো মেলে ধরে এপাশ থেকে ওপাশ নাড়ে হাতপাখার মতো।

—আঃ কী করছ কি। বিরক্ত হয় অমল।

—যাক বাবা, শুনছেন তাহলে। হ্যাঁ, বলছিলাম রুগী তো বিশ্রাম করে। ফ্লোর সিস্টার বকবক শুনলেই খইচ্যা যায়। কী করি। কিছু কাগজ রাখি ব্যাগের মধ্যে। প্যাটের মধ্যে কথা জইম্যা যখন ফুইল্যা ঢাক হইয়া যায় এক একটা পাতা বাইর করি আর হাবিজাবি লিখি।

—ও।

মেয়েটা বড্ড ফালতু কথা বলে। নতুন এসেছে বোধহয়। কথায় বাঙাল টান প্রকট। এখন তো প্রতিবেশী বিদেশি স্বদেশি রাজ্য থেকেই নার্স আমদানি হয়। এ রাজ্যের মেয়েরা। গেল কই? তাদের বোধহয় আর চাকরি-বাকরির দরকার নেই। আহা দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি। কে যেন লিখেছিল? মনে পড়ে না।

–জানেন অমলবাবু আমার বড় ইচ্ছা লেখালিখি করি। কিন্তু বাপ পড়াইতে পারল না। তাই এই লাইনে আইলাম।

–লিখতে গেলে পড়তে হয় বুঝি? অমল হঠাৎ প্রশ্ন করে।

–এইটা একটা জব্বর কথা কইসেন, কলকল করে ওঠে ছায়া দেবনাথ।

—আসলে কী জানেন, আমি ল্যাখতে চাই কিন্তু কী লিখুম? আমার তো এই ছাব্বিশ বৎসর বয়স, কীই বা দ্যাখসি।

—শোনো,তুমি আগে বাংলাটা ঠিক করে বলার চেষ্টা করে তোকইসেননয়,বলেছেন। ল্যাখতে নয়, লিখতে। লিখুম নয়, লিখব। ছাব্বিশ বৎসর বয়স নয়। ছাব্বিশ বছর বয়েস। দ্যাখসি নয়, দেখেছি। এতকথা অমল একসঙ্গে আগে কবে বলেছে?

বাঃ আপনি দেখি আমারে বাংলাদেশ বেতারের বাংলা শিখাইতে পারেন। একটা কাজ করবেন? আপনার লাইফ হিস্ট্রিটা আমারে বলেন। আর আমি লিখি। আপনি কত দ্যাশ, মানে, দেশ ঘুরসেন। বড় চাকরি করত্যান। কত মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সম্পর্ক হইসে। আমার তো কিছুই অভিজ্ঞতা হয় নাই। দেখি নাই কিছুই। কিন্তু আমার লিখতে ইচ্ছা আসে আপনার নাই। আপনি কইয়া যাবেন আর শুইন্যা শুইন্যা, থুরি, শুনে শুনে আমি লিখে যাব।

–না না আমার দ্বারা অত বলাটলা হবে না। বকবক করা আমার পোষায় না। আর তুমি লিখবে কী? তোমার তো বাংলাই ঠিক নেই।

—দেখেন অমলবাবু, আমার বাংলা তো তবু এক পদের বাংলা। আপনাদের দ্যাশ ইন্ডিয়াতে বাংলার কী অবস্থা? একটা কথা বাংলা তো তিনটা হিন্দি দুইটা ইংরেজি। আপনাদের বাংলা তো একটা খিচুড়ি। একবার রাস্তাঘাটে ব্যারাইয়া দেখেন না। ট্রানজিসটর অ্যাকটা দিই, শুনবেন? টিভি তো আপনি দ্যাখতে চান না। কত ঘরে ছোট টিভি আসে। যান গিয়া দুইটা বাংলা সিরিয়াল দ্যাখেন। তখন আমার বাঙ্গাল টান নিয়া এত কচকচানি বন্ধ হইয়া যাইব। যাক বাংলা ভাষার কথা রাখেন। আপনার লাইফ হিস্ট্রিটা বলবেন তো?

-আমি কি একটা অসাধারণ মানুষ যে আমার বলার মতো একটা হিস্ট্রি থাকবে। যাও যাও বকবক কোরো না। মাথাটা ধরে গেল।

-রাগ করেন ক্যান। আসেন। ন্যান জল খান। জল গড়িয়ে দেয় প্লাস্টিকের জগ থেকে ছায়া।

–না থাক। তুমি এখন যাও তো। আমাকে একলা থাকতে দাও।

.

লাইফ হিস্ট্রি। আমার আবার লাইফ তার আবার হিস্ট্রি। আমি কে? কেউ না। পুরো মানুষই তো নই। যে সব যন্ত্রপাতি কলকজায় একজন মানুষের শরীর জীবনের রাস্তাটা দিয়ে চলে তার অর্ধেকই তো কেটেকুটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি যা আছে তা এমন ঝরঝরে যে হ্যান্ডেল মেরে মেরে স্টার্ট করতে হয়। প্রতিদিন দুবেলা কতগুলো বড়ি খাই আমি যাকে ডাক্তার নার্স বেয়ারা সকলে হাসিহাসি মুখে রোজ বলে আপনি খুব ভাল আছেন। এদের কথার কোনও মানে নেই। কোনও মানুষেরই কথার কোনও মানে হয় না। সেই যে মৈত্রেয়ী আমাকে বলে গেল শরীরটার যত্ন নিও। ভাল থেকো। কোনও মানে ছিল কী? আমি সেই থেকে কারোর সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যেই যাই না।

.

বাঙালের গোঁ বলে কথা। সমানে লেগে থাকে ছায়া দেবনাথ, যার আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুর সাব-ডিভিশনের ডোমসার গ্রামে অধুনা কাগজ-কলমে মুর্শিদাবাদ। শেষমেষ কথা বলতে বাধ্য হয় অমল। মেয়েটা একেবারে এঁটুলি, ছাড়েই না। গায়ের চামড়াও মোটা। ধমক দিলেও হাসে। বড় জোর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দুঘণ্টা পর আবার হাসিমুখে হাজির। শ্যামলা রং, ছোটখাটো পাতলা, সামনে দাঁত দুটো উঁচু। বিয়ে হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। তার ওপরে অতি দুঃস্থ পরিবার এবং অন্য দুঃস্থ পরিবারের মতো পুষ্যি অনেক। অথচ সে সব নিয়ে মেয়েটার মন খারাপ তো দূরের কথা কোনও মাথাব্যথাই নেই। সর্বদা হাসির ছরা, কলকল কথা। এ গল্প সে গল্প, ক্যারিকেচার। বাঘের মতো কোনও কড়া ডাক্তার মাঝরাতে সারপ্রাইজ রাউন্ড দিতে আসেন। কুমড়োমোটা মেট্রন হাঁসফাঁস করে কথা বলেন। খ্যাংড়াকাঠি কেরলি ফ্লোর সিস্টার কেমন সেদোটানে ইংরিজি বলে। নকল করতে ছায়া দেবনাথ ওস্তাদ। শুনতে শুনতে অমল একদিন বলে ফেলে,

–তুমি তো দিব্যি অভিনয় করতে পার। এ শহরে তো একসময় অনেক শৌখিন নাটকের দল ছিল। বাংলা নাটক-টাটকও প্রচুর হত। তোমার সঙ্গে চেনাজানা হয়নি?

—কোথায় বাংলা নাটক? কই কোনও দলটলের কথা শুনি না তো। হ্যাঁ, গাঁয়েগঞ্জে বাংলা যাত্রা হয়। শুক্রবারের কাগজে শেষ পৃষ্ঠায় আঞ্চলিক সংস্কৃতির খবর থাকে। আমি ওসব দেখিটেখি না। আপনাদের ভারতীয় বাংলা কি আমার আসে? আমার তো বাঙালি বাংলা। হাসিহাসি মুখে বলে অমল,

–বাঙালি না ঘেচু। বলো বাঙালের বাংলা। ওটা শোধরানো দরকার বুঝেছ। দেশটা একেবারে বাঙালে ছেয়ে গেল।

-আরে রাখেন ওসব কথা। এই তো চেহারা, চোখে দেখেন না? কে আমারে হিরোইন করব? খিলখিল হেসে গড়িয়ে পড়ে ছায়া। যেন ভারি মজার কথা। হ্যাঁ, ছায়া দেবনাথের সব কিছুতেই হাসি। সবসময় মুখে খই ফুটছে। অমল জবাব না দিলে নিজের মনে বকে যায়। এত হাসি, এত কথার ছোঁয়াচ বাঁচানো শক্ত। একদিন ছায়া যেই বলেছে,

—জানেন অমলবাবু, আপনারে আমি একটা নাম দিলাম,রামগডুর। সেই যে রামগড়ুরের ছানা হাসতে তাদের মানা। আপনি যা গম্ভীর। রামগডুরের ছানার বাপ। অমনি অমলও একটু ফিক করে হেসে ফেলেছিল।

ছায়া দেবনাথের হাসি আর কথার সঙ্গে পাল্লা দেয় তার কৌতূহল। সকলের সব কিছুতে তার নাকগলানো চাই। তার কাছে শুনে শুনে এখন অমলের অনেক ডাক্তার নার্স রোগীর জীবনচরিত জানা হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি কাহিনীর আগে বলে নেবে,

–জানেন, এটা কিন্তু আমার বলা উচিত নয়, অন্য পেমেন্টের অসুখের কথা বলা মানা জানেন তো? শুধু আপনারে বলসি। অমলের বিশ্বাস প্রত্যেককেই ছায়া একই ভূমিকা দেয়। অবশেষে একদিন এল সেই অবধারিত প্রশ্ন।

–আচ্ছা অমলবাবু, আপনার দ্যাশ, মানে দেশ কোথায়?

–কলকাতা।

–তাহলে তো আপনার দ্যাশ বলতে কিছুই নাই।

—সে আবার কী। কলকাতা কিছুই নেই।

–কলকাতা কি আর আছে, কবে উইঠ্যা গেসে। যেন জোর করে বেজার মুখ করে ছায়া। ধড়মড় করে উঠে বসে অমল।

-মানে? একটা জলজ্যান্ত এত বড় শহর উঠে গেছে মানে?

-কেন? এই স্টেটের কত কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য উইঠ্যা গেসে, উইঠ্যা গেসে টালিগঞ্জের বাংলা ফিল্ম। কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের বাজার। তবে শহরটা উইঠ্যা যাইব না ক্যান?

অমলের কেমন হাত-পা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। চারিদিকে যেন সব অজানা অপরিচিত। ধমক লাগায়।

–বাজে কথা রাখো। খালি ফাজলামি। আমার জন্মস্থান কলকাতা। কলকাতা বরাবর কলকাতা। মানুষ মরে যায়। সময় বদলায়, কিন্তু জায়গা, মাটি এক থাকে বুঝলে। সেটা অদৃশ্য হতে পারে না। কলকাতা আমার পায়ের তলার মাটি। কলকাতা…..

—আরে, চটতাসেন ক্যান। আপনি তো তাজ্জব মানুষ। মনে নাই? সেই যে বোম্বাই হইল মুম্বাই, মাদ্রাজ হইল চেন্নাই। আর গৌহাটি তো কবেই গুয়াহাটি। আর সকলে ছি-ছি করতে লাগল। বাঙ্গালি লোক আভি তক আংরেজ কা গুলাম। আমি তখন কত ছোট, মাইনর স্কুলে পড়ি। বাবা একদিন বাসায় আইস্যা বলল, ইন্ডিয়াতে সকলে কী বলতাসে জানস? ইংরাজরা আসার আগে যা ছিল তাই আমাগো নিজস্ব, তাই ঠিক। বিদেশির চিহ্ন মুইছা ফ্যালো। সেই অবস্থায়, সেই সময়ে ফিইর্যা চলল। জব্বর গণ্ডগোল লাগসে ওয়েস্ট ব্যাংগলে। কইলকাতা আসিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একনম্বর শহর। ইংরাজি চক্রান্ত সেইখানে সবচাইতে বেশি। দ্যাখনা,সুতানুটি, গোবিন্দপুর দুইটারে বেমালুম বাইদ দিয়া খালি কলিকাতা, ক্যালকাটা, ক্যান রে অ্যাকচোখোমি? আপনার কি কিসুই মনে পড়ে না? কত সোরগোল, রোজ ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোকের সভা। মিছিলে কদিন রাস্তাঘাট এমন জ্যাম হইল যে লোকে আর বাড়ি ফিরতে পারে না। আপিসকাছারিতে রইয়া গেল। কাজকর্ম বন্ধ। শ্যাষে সিনথেসিস নামে কম্পুটার সমাধান বাতলাইল, সুতানুটির সু, গোবিন্দপুরের গো আর কলিকাতার ক লইয়া টুয়েন্টিফাস্ট সেনচুরিতে এ শহরের নাম হইল খাঁটি দিশি সুগোক। আর সাথে সাথে ওয়েস্টটা কাইটা রইল শুধু ব্যাংগল। বাংলা বানান সংস্কারের পর তার নতুন রূপ হইল বংগো। ঠিক কংগোর সঙ্গে ম্যালে। শুধু তো ন্যাশনাল হইলে চলব না ইন্টারন্যাশনাল হইতে হইব। এসব নিয়া কত কী হইয়া গেল আর আপনার কিছুই মনে নাই।

ছায়া দেবনাথ যখন একটানা কথা বলে তখন বাংলাদেশ বেতার আর বিক্রমপুরের ডোমসার গাঁ আলাদা থাকে না। মিলেমিশে ছায়াভাষা। শুনে শুনে অমলের আর এখন ততটা কানে লাগেনা কিন্তু সুগোক কথাটা কি সত্যি অমল কখনও শুনেছে? কই একেবারে তো মনে পড়ে না। তবে মেয়েটা যখন এত করে বলছে তখন হবেও বা।

—আমার কথাটার জবাব কই? আপনার দ্যাশ বললেন কইলকাতা। তা সেই আগের নামটাই না হয় ধরলাম। কিন্তু শহর কারো দ্যাশ হয় নাকি। আদি বাস কোথায় ছিল। কোন্ জেলায় কোন্ গ্রামে চোদ্দোপুরুষের ভিটা সেটা বলবেন তো?

হ্যাঁ, গাঁ একটা ছিল বটে। জেলা বর্ধমান, মহকুমা সদর গ্রামের নাম হাট গোবিন্দপুর। তবে যাতায়াত নেই বহুঙ্কাল। নামটামও পারতপক্ষে কেউ করে না। সেই কবে কোকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পাদে ঠাকুরদার বাবা বাস করতেন চোদ্দোপুরুষের ভিটেয়, নিজে হাতে জমিতে লাঙল চষতেন। যেমন বাস করেছেন তার বাবা, তাঁর বাবা ও ঊর্ধ্বতন কত পুরুষ। বংশানুক্রমিক বসবাস। বংশানুক্রমিক কায়িক শ্রম এবং বংশানুক্রমিক দারিদ্র, অসহায় বিলাপ। দুই কানেতে টান দুদিক থেকে। ব্রাহ্মণ জমিদারের প্রাপ্য খাজনা, সোনার বেনে মহাজনের প্রাপ্য সুদ–অসুখবিসুখ, বিয়েথাওয়া শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি দায়বেদায়ে নেওয়া ধারের বোঝ। পাঁচজনের দেখাদেখি ঠাকুরদার বাপ কানুচরণের চোখ খুলল। একটু দলিল দস্তাবেজ পড়তে পারা নাম সই যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ জানা ব্যস, জমিদার মহাজন দুই হ্যাচকা টান থেকে নিষ্কৃতি। তাই সর্বকনিষ্ঠ পুত্র বিষ্ণুপদকে পাঠানো হল পাঠশালায়। আধুনিক সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষালাভ প্রায়ই বিঘ্নিত। বিষ্ণুপদর পাঠশালাছুট অর্থাৎ ড্রপ আউট হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু বাস্তব বড় গোলমেলে সব ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বের আধিপত্য খাটে না। বালক বিষ্ণুপদ বংশের প্রথম পড়ুয়া, পাঠশালার পাঠক্রম শেষ করে ফেললেন। অতঃপর বাপদাদার সঙ্গে লাঙল ধরার সময়। ইতিমধ্যে কবছর জ্যাঠা-কাকা জ্ঞাতিকুটুম্বের বিদ্রূপ শোনা হয়ে গেছে। চাষা ছেলে নামতা শিখে নাম সই করে কি জুড়িগাড়ি হাঁকাবে! পণ্ডিতমশাইও কতবার বলেছেন কলিকাল কি আর সাধে বলে। ক অক্ষর যাদের গোমাংস সেইসব চাষাভুষোদের বিদ্যাদান করতে হচ্ছে। ইংরেজ রাজত্বে জাতধর্ম আর রইল না। সব মিলিয়ে বিষ্ণুপদ দাসের একটিই মনস্কামনা, তিনি লাঙল ছোঁবেন না, লেখাপড়া করবেন। এবারে ধিক্কারে জ্যাঠা-কাকার সঙ্গে বাবা দাদা মেসো পিসের যোগদান।

বিষ্ণুপদ চললেন ছোটবাবুর কাছে। ছোটবাবু অর্থাৎ ছোট তরফের জমিদার চন্দ্রমোহন। গাঁয়ের যুবসমাজের হিরো। তার নেশা কলকাতা। অর্থাৎ গান বাজনা নাটক সমাজসংস্কার শিক্ষাবিস্তার। অর্থাৎবঙ্গে যে নবজাগরণ ঘটেছে বলে শোনা যায় তিনি তারই প্রতিভূ। তার জমিদারিতে আগমন মানে কিছু না কিছু অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা, দীনবন্ধু বা মাইকেলের নাটক থেকে পাঠ। কখনও ভাল যাত্রা। গাঁ-সুদ্ধ বালক কিশোর যুবকের মতো বিষ্ণুপদও ছোটবাবুর একান্ত ভক্ত অনুগামী। এখন পরিবার আত্মীয়বর্গের সঙ্গে বিরোধে ছোটবাবুর শরণাপন্ন হন বিষ্ণুপদ। প্রার্থনা, দুই তরফের স্বৰ্গত পিতামহের নামে প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ চাই। জমিদার মাত্রেই মুখ অত্যাচারী মাতাল, চাষি বউ মেয়ের সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারী দানব হওয়ার কথা, এক্ষেত্রে কিন্তু সেরকম কিছুই দেখা গেল না।

বিষ্ণুপদ দাস ছোটবাবুর দাক্ষিণ্যে শুধু বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের সুবিধাই লাভ করলেন না তার ক্রমাগত উৎসাহ ও সাহায্যে (কিরে বিষ্ণু বইটই পাচ্ছিস? নে দুটো পয়সা বা আয় আমার লাইব্রেরিতে ছুটির দিনে বসে বই পড়) স্কুলের শেষ ধাপটিও অতিক্রম করে গেলেন। আলোকপ্রাপ্ত ধনীর আনুকূল্যে ও ব্যক্তিগত উদ্যমের মিলিত ধাক্কায় ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন সনাতন গ্রামীণ হিন্দু জীবিকা জীবনচর্যা ও আবহ থেকে। পাড়ি দিলেন কলকাতা, যেখানে ইতিমধ্যে জমিদারির আয় মূলধন করে কাগজের ব্যবসায় নেমেছেন ছোটবাবু। সাহেবসুবো কারবারিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় চলছে। তার সুপারিশেদু-চারদিন হাঁটাহাঁটির পর ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড ম্যাকলয়েড কোম্পানিতে বিষ্ণুচরণের চাকরি জুটে গেল। সাহেব পুঁজিপতিরা ঔপনিবেশিক শোষক, কর্মীদের কাছ থেকে তাদের দাবি নিষ্ঠা ও শ্রম। পরিশ্রমী বিষ্ণুপদর ধীরে ধীরে উন্নতি হল। না, কুঁড়েঘর থেকে মর্মর প্রাসাদ পর্যন্ত নয়। তিরিশ বছর বিশ্বস্ত আন্তরিক কার্যদক্ষতায় মাঝারি গোছের সুপারভাইজারি র‍্যাংকে উঠলেন। শ্রমিক চাষার বংশে চাষার পরিবারে জন্মে বিষ্ণুপদ দুপাতা ইংরেজি পড়ে ইংরেজদের গোলামী করে হলেন ভদ্রলোক। এবং দুপয়সা হাতে আসতে মুখসুখ গরিব বাপমা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে সকলের ছিছিক্কারে কানে আঙুল দিয়ে একগলা ঘোমটা টানা অক্ষরজ্ঞানহীন স্ত্রীকে এনে তুললেন কলকাতার ভাড়া বাড়িতে।

এসব কথা কি ছায়াকে বলা যায়। বাঙাল মেয়ে কিছুই বোঝে না হয়তো বলে বসবে বলেন কি আপনার পূর্বপুরুষ ছিল চাষা! বা আপনার ঠাকুরদা মানুষটা মোটেই সুবিধার ছিলেন না। অ্যাকনম্বরের নিমক হারাম। বাপ মা ভাইবোনকে দ্যাখলেন না। শুধু নিজেরে লইয়া থাকলেন। ছি ছি। কিন্তু আমি বুঝি ঠাকুরদা কেন চোখ কান বুজে গা থেকে পালিয়ে গেলেন। দশজনের পরিবারে যদি দুজন তলায় পড়ে থাকে বাকি আটজন তাদের টেনে ওপরে তুলতে পারে। কিন্তু যদি একজনই মাত্র ওপরে, নজনই তলায়, তখন সেই একজন পালাতে বাধ্য, নইলে নজনের টানে সেও তলাতে পড়ে যাবে। অতএব ছায়াকে শুধু বলি,

–কলকাতা আমার দেশ। আমাদের তিন পুরুষের বাস এই শহরে।

.

বিবেকানন্দ রোড আর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ের কাছে বাঁ-হাতি গলি। তার দুটো বাড়ি ছাড়িয়েই রকওয়ালা আড়াইতলা বাড়িটা। লালচে গোলাপি রং, জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রীতিতে গড়া। নতুন পুরনো পাশাপাশি উপর-নিচ সহাবস্থান। তাদের তিন পুরুষের বাস। সামনের সদর দরজার ওপরের দেওয়ালে আধখানা চাঁদ আকৃতির কারুকার্য বজলক্ষ্মী স্মৃতি নামের তলায় সন ১৯১০। বাড়ির আদত মালিক যিনি বাড়িটি তৈরি করেছিলেন তার স্ত্রীর নাম ছিল বঙ্গলক্ষ্মী। ভদ্রমহিলার জন্ম সেই সময় যখন আঞ্চলিকতাবাদ কথাটা অভিধানে ঢোকেনি, যখন বাঙালির দেশ ছিল বাংলা, গণিতের কোনও যাদুমন্ত্রে সপ্তকোটি সন্তান চল্লিশ কোটি ভারতীয়তে পরিণত হয়নি। অর্থাৎ যখন সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মাতৃভূমি ছিল বাঞ্ছিত ভূমি। সেই সময়। তবে মালিক ভদ্রলোক নিজে শ্বশুরের মতো দেশপ্রেমিক ছিলেন কিনা জানা না গেলেও পত্নী-প্রেমিক যে ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অকালে মৃত স্ত্রীর স্মৃতিতে নামকরণ করলেন সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থে তৈরি ইট কাঠ চুন বালি সিমেন্টের নির্মাণটির।

প্রথম কবছর বিষ্ণুপদ দাস এ বাড়িতে ছিলেন একতলায় ভাড়াটে। অপুত্রক বাড়িওয়ালার মৃত্যুর পর হলেন গোটা বাড়ির মালিক। প্রবাসী বিবাহিতা দুই মেয়ের কাছ থেকে বলতে গেলে জলের দামেই কিনেছিলেন বাড়িটা। তারপর নিজের ক্রমবর্ধমান পরিবারের প্রয়োজনে যতটুকু যে দিকে বাড়ানো যায় বাড়িয়ে ফেললেন। ছেলেদের অর্থাৎ অমলের বাবাদের যুগের যার যেমন শখ ও ট্যাকের জোর সেই অনুযায়ী অদলবদল নবীকরণ। বাড়িটার জগাখিচুড়ি চেহারা তাদের তিনপুরুষের তিনটি সময়ের সাক্ষ্য। শুধু পুরনো নামটার পরিবর্তন হয়নি। সেই বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি। আদি ও অকৃত্রিম।

ছায়া দেবনাথ খসখস করে লিখে চলেছে। দেখে দেখে একসময় অমল বলে,

–তুমি কি যা বলি সব কথা লেখো না কি?

–বাঃ! লিখুম না! বললাম তো আমি আপনার জীবনী লিখতাসি। এই দ্যাখেন। ব্যাগের তলা থেকে এক তাড়া পুরনো খাতা ছেঁড়া রুলটানা কাগজ দেখায়।

—যা যা আপনার কাছে শুনি, প্রথমে আমার স্পেশ্যাল সর্টহ্যান্ডে মানে যারে কই ছায়াভাষা তাতে লিইখ্যা লই। বাসায় যাইয়া ভাল কইর‍্যা লিখি। লিখতে লিখতে আমার বাংলাটা একটু ভদ্র হইতাসে না?

–না, তোমার বাংলা কিছুই হচ্ছে না। আর এত কাগজ নষ্ট করো কেন? জানো কাগজ বানাতে গাছ নষ্ট হয়? যদি লেখালেখি করতেই হয়–যদিও কেন করবে তার কোনও মাথামুণ্ডু পাই না–তবে এক কাজ কর। একটা স্লেট আর কটা পেনসিল কিনে এনো। আজ যা লিখবে কাল তা মুছে ফেলবে। আবার লিখবে আবার মুছবে। একটা স্লেটেই শুধু আমার কেন এই লুম্বিনী ক্লিনিকের (না পার্ক না বন, যাকগে) সব রোগীর জীবনী এঁটে যাবে।

–কী যে বলেন। লেখাটা যদি মুইছা ফেলি তবে পড়বেটা কে? কেউ তো দ্যাখতেই পারব না। সঙ্গে সঙ্গে শ্যাষ হইয়া যাইব।

–কেন তুমি, তুমি তো শুনছ জানছ পড়ছ। ওই একজন জানলেই হবে। তুমি কি মনে করো কাগজে লিখে রাখলেই সকলে জানতে পারে? পড়তে পারে? চিরকাল থাকে? এই বাংলাতেই তো কত শত শত লোক কত কী লিখে গেছে। তাদের কজনের নাম জানো? কটা লেখা পড়? যখন লেখা হয়েছে তখনই বা কজন পড়েছে?

—তা যা বলসেন। আমার তো পড়াশুনার বড় ইচ্ছা, কিন্তু সময় নাই। সময় যদিই বা পাই বইটইগুলা বড় শক্ত লাগে। আপনাগো বাংলা এত ভিন্ন। জানেন তো আপনাগো সংহতি কম্পুটার যারে কয় কম্পদেবতা তার আশীর্বাদে সব আঞ্চলিক ভাষায় শতকরা তিরিশভাগ হিন্দি আইস্যা গেসে? আরও আসব। মডেল হইসে টিভি চ্যানেলগুলা। দ্যাখেন তো সরকারি দূরদর্শনে শতকরা পঁচাত্তরভাগ অনুষ্ঠান কার্যক্রম হিন্দিতে।

—তাহলে তুমিই দেখো আর এক জেনারেশন পরে বাঙালি ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্ৰই পড়তে পারবেনা। বঙ্কিমের তো প্রশ্নই উঠছেনা। যে ভাষার, যে সাহিত্যের এই হচ্ছে অবস্থা সেখানে অমলকুমার দাসের মতো এক হরিদাস পালের জীবনী লিখে কাগজ নষ্ট করার মানে কী?

—মানে আর কী। সবই হইতাসে ছায়ার ছায়াবাজি। খিলখিল করে হেসে গড়ায় ছায়া। মেয়েটার সব কিছুতে হাসি। লঘুগুরু জ্ঞান নেই। অমল গম্ভীর হয়।

—ঠিকই বলেছ ছায়াবাজিই বটে। সবই অনিশ্চিত, মায়ামাত্র। যখনকার ঘটনা শুধু সেই মুহূর্তেরই অস্তিত্ব। আমি বলার জন্য বলি, তুমি লেখার জন্য লেখো। তার বেশি কিছু নয়। ছায়ার মুখে এখন আর হাসি নেই।

—আপনি মানুষটা বড় অদ্ভুত। এত বড় বড় কথা আপনার মনে। কিন্তু সাধারণ কথাটা নাই। জন্ম-শিক্ষাদীক্ষাকাজকর্ম পরপর বলবেন তো। কাহিনী মানেই তো নায়ক বানায়িকার জন্ম থেকে তারপর কী হইল।

—দেখো ওইটি একেবারে চলবে না। তারপর কী-হলর জুলুম। আমি কি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি নাকি। আমার যখন যেমন যা যতটুকু মনে আসে ঠিক তেমন ঠিক ততটুকু বলব। শুনতে হয় শোনো, লিখতে ইচ্ছে হয় তো লেখো। নইলে থাক তোমার ছায়াবাজি।

.

হ্যাঁ থাক। অত তারপর কী হল তারপর কী হল করার আছেটাই বা কী। সব তারপর এর শেষ তো এখানে, তিনশো দুই নম্বর ঘর, লুম্বিনী ক্লিনিক না পার্ক না হোম না কি বন। অর্ধেক পুরুষ। আধমরা মানুষ। এটা নেই সেটা নেই। শুধু বুকের কাছে ধুক ধুক ধুক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *