১. খৃষ্টপূর্ব যুগের পাটলিপুত্র

খৃষ্টপূর্ব যুগের পাটলিপুত্র। একটি রৌদ্র-ঝলমল প্রভাত। রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বার। দুই স্তম্ভের শীর্ষে সিংহ-মূর্তি। একটি স্তম্ভের মূলে শৃঙ্খলবদ্ধ একটি বিরাট হস্তী দাঁড়াইয়া শুণ্ড আন্দোলিত করিতেছে। অপর স্তম্ভের নিকট একটি বৃহদাকার দুন্দুভি; মুষলহস্তে একজন রাজপুরুষ মুষল উদ্যত করিয়া দণ্ডায়মান।

সিংহদ্বারের ভিতর দিয়া রাজপুরীর ভিন্ন ভিন্ন ভবনগুলি দেখা যাইতেছে। সম্মুখেই সভাগৃহ। তাহার আশেপাশে অস্ত্রাগার মন্ত্রভবন কোষাগার প্রভৃতি। প্রতীহার-ভূমিতে দুইজন ভীমকায় প্রতীহার পরশু স্কন্ধে লইয়া পরিক্রমণ করিতেছে।

যে রাজপুরুষ দুন্দুভির নিকট দাঁড়াইয়া ছিল সে উদ্যত মুষল দিয়া দুন্দুভির উপর বারংবার আঘাত করিতে লাগিল। দুন্দুভি হইতে গম্ভীর নিঘোষ নির্গত হইল।

সিংহদ্বারের সম্মুখে তিন দিকে পথ গিয়াছে। দুইটি পথ গিয়াছে প্রকারের সমান্তরালে, তৃতীয় পথ সিংহদ্বার হইতে বাহির হইয়া সিধা সম্মুখ দিকে গিয়াছে। দেখা গেল, দুন্দুভির শব্দে আকৃষ্ট হইয়া বহু জনগণ সিংহদ্বারের দিকে আসিতেছে। পুরুষই অধিক, দুই-চারিটি স্ত্রীলোকও আছে। তাহারা আসিয়া দুন্দুভি ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

জনতার মধ্যে একটি লোক বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাহার চোখের দৃষ্টি তীব্র, নাসিকার অস্থি ভগ্ন। নাম নাগবন্ধু। বয়স অনুমান পঁয়ত্রিশ বৎসর। সে একাগ্রদৃষ্টিতে রাজপুরুষের দিকে চাহিয়া ঘোষণার প্রতীক্ষা করিতেছে।

রাজপুরুষ যখন দেখিল বহু জনগণ সমবেত হইয়াছে, তখন দুন্দুভি বাদ্য স্থগিত করিল। দুই হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিয়া জনতাকে নীরব থাকিবার অনুজ্ঞা জানাইয়া গম্ভীরকণ্ঠে বলিল—

পাটলিপুত্রের নাগরিকবৃন্দ, শোনো…পরমভট্টারক শ্ৰীমন্মহারাজ চণ্ড যে দণ্ডাজ্ঞা দিয়েছেন শোনো…মন্ত্রী শিবমিশ্র মহারাজ চণ্ডের আদেশ উপেক্ষা করেছিল—

জনতার মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিল, বিশেষত নাগবন্ধু যে শিবমিশ্রের নামোল্লেখে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে তাহা তাহার ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পাইল। তাহার অধরোষ্ঠ নড়িতে লাগিল, যেন সে অস্ফুটস্বরে শিবমিশ্রের নাম উচ্চারণ করিতেছে।

ঘোষক রাজপুরুষ ইতিমধ্যে বলিয়া চলিয়াছে—

তাই মহারাজ চণ্ড তাকে দণ্ডাজ্ঞা দিয়েছেন—পাটলিপুত্রের মহাশ্মশানে বালুর মধ্যে শিবমিশ্রকে কণ্ঠ পর্যন্ত প্রোথিত করে রাখা হবে…রাত্রে শ্মশানের শিবাদল এসে শিবমিশ্রকে জীবন্ত ছিঁড়ে খাবে…।

জনতার চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া পড়িয়াছে। নাগবন্ধু শুষ্ক অধর লেহন করিয়া জ্বলন্ত চক্ষে ঘোষকের পানে চাহিয়া আছে।

নাগরিকবৃন্দ, স্মরণ রেখো, অমিতবিক্রম মগধেশ্বর চণ্ডের আজ্ঞা যে ব্যক্তি লঙ্ঘন করে তার কী ভয়ঙ্কর শাস্তি। সাবধান সাবধান!…আরও জেনে রাখো, আজ দিবারাত্র মহাশ্মশান ঘিরে সতর্ক রাজপ্রহরী পাহারায় থাকবে…যদি কেউ শিবমিশ্রকে শ্মশান থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করে তবে তার শূলদণ্ড হবে। সাবধান-সাবধান!

পুনরায় দুন্দুভি ধ্বনিত করিয়া রাজপুরুষ ঘোষণা শেষ করিল। জনতা স্থির হইয়া রহিল।

তারপর জনতার অগ্রভাগে ঈষৎ চাঞ্চল্য দেখা দিল। সিংহদ্বারের ভিতর হইতে প্রহরী পরিবেষ্টিত শিবমিশ্র বাহির হইয়া আসিলেন। তাঁহার আকৃতি শুষ্ক, দুই চক্ষু নীরবে অগ্নিবর্ষণ করিতেছে। হস্তদ্বয় শৃঙ্খলিত। নগ্ন স্কন্ধে উপবীত। আকৃতি দেখিয়া বয়স অনুমান পঞ্চাশ বছর মনে হয়।

জনতা নীরবে দ্বিধা ভিন্ন হইয়া পথ ছাড়িয়া দিল, শিবমিশ্র ও প্রহরিগণ অগ্রসর হইলেন। নাগবন্ধুর সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় শিবমিশ্র একবার তাহার পানে চক্ষু ফিরাইলেন। নাগবন্ধুর সর্বাঙ্গ শিহরিয়া কাঁপিয়া উঠিল, সে কিছু বলিবার জন্য মুখ খুলিল, আবার মুখ বন্ধ করিল।

শিবমিশ্র জনব্যুহে অদৃশ্য হইলেন, কেবল তাঁহার পদক্ষেপের তালে তালে শৃঙ্খল বাজিতে লাগিল–ঝনাৎ ঝন– ঝনাৎ ঝন্

.

বহু স্তম্ভযুক্ত রাজসভার অভ্যন্তর।

মহিষাকৃতি মহারাজ চণ্ড সিংহাসনে আসীন। সিংহাসনটি ভূমির উপর স্থাপিত নয়, চারিটি স্বর্ণশৃঙ্খল দ্বারা শুন্যে দোদুল্যমান; মহারাজ তাহার উপর পদ্মাসনে বসিয়া মৃদু দোল খাইতেছেন। সিংহাসনের দুই পাশে দুইজন যুবতী কিঙ্করী; একজন ময়রপুচ্ছের পাখা দিয়া মহারাজকে বীজন করিতেছে, অন্যটি মণিমুক্তাখচিত সুরাভৃঙ্গার হস্তে মহারাজের তৃষ্ণার প্রতীক্ষা করিতেছে। রাজসিংহাসনের সম্মুখে দশ হস্ত ব্যবধানে সভাসদগণের আসন। তাহারা ভিন্ন ভিন্ন আসনে উপবিষ্ট; তাহাদের মুখের গদগদ ভাব দেখিয়া বোঝা যায় তাহারা চাটুকার বয়স্য। ইহাদের মধ্যে বৃদ্ধ সভা-জ্যোতিষী পুঁথিপত্র সম্মুখে লইয়া নিমীলিত নেত্রে বোধকরি গ্রহ-নক্ষত্রের চিন্তায় নিমগ্ন হইয়াছেন।

এক ঝাঁক নর্তকী সভার এক প্রান্ত হইতে নাচিতে নাচিতে প্রবেশ করিয়া রাজা ও সভাসদগণের মধ্যবর্তী ব্যবধান স্থল দিয়া বসন্তের প্রজাপতির মত অন্য প্রান্তে চলিয়া গেল। রাজা প্রত্যেকটি নর্তকীকে ব্যাঘ্র-চক্ষু দিয়া নিরীক্ষণ করিলেন : তাহারা অন্তর্হিত হইলে ভৃঙ্গারধারিণী কিঙ্করীর দিকে হাত বাড়াইলেন। কিঙ্করী ত্বরিতে পাত্র ভরিয়া রাজার হাতে দিল।

এই সময় রাজা-অবরোধের কঞ্চুকী স্বস্তিবাচন করিয়া সিংহাসনের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। চণ্ড সুরাপাত্র মুখে তুলিতে গিয়া তাহাকে দেখিয়া ভ্রুভঙ্গ করিলেন। বলিলেন—

কঞ্চুকী! কি চাও?

আয়ুষ্মন্ কঞ্চুকী নত হইয়া চণ্ডের কানে কানে কিছু বলিল। চণ্ডের ক্ষুদ্র চক্ষু দুষ্ট কৌতুকে নৃত্য করিয়া উঠিল।

মোরিকার কন্যা জন্মেছে! হো হো

সুরাপাত্র নিঃশেষ করিয়া চণ্ড সভাসদমণ্ডলীর দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। জ্যোতিষীর ধ্যানস্থ মূর্তির উপর তাঁহার চক্ষু নিবদ্ধ হইল।

তিনি হুঙ্কার ছাড়িলেন—গ্রহাচার্য পণ্ডিত—

গ্রহাচার্য চমকিয়া চক্ষু মেলিলেন এবং ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

শুভমস্তু-শুভমস্তু। আদেশ করুন মহারাজ।

চণ্ড বলিলেন—শোনো। কাল মধ্যরাত্রে রাজ-অবরোধের এক দাসী এক কন্যা প্রসব করেছে। তার জন্মপত্রিকা প্রস্তুত কর।

গ্রহাচার্য আসন গ্রহণ করিয়া পুঁথি তুলিয়া লইলেন।–

শুভমস্তু। কন্যার পিতা কে মহারাজ?

এই সময় রাজবয়স্য বটুক ভট্টের তীক্ষোচ্চ হাসির শব্দ শোনা গেল। সিংহাসনের ঊর্ধ্বে শিকল অবলম্বন করিয়া বটুক ভট্ট মর্কটের মত ঝুলিতেছিলেন, তিনি মুখভঙ্গি করিয়া বলিলেন

গ্রহাচার্য মশায়, এটুকু বুঝতে পারলেন না। কন্যার পিতা আমি

চণ্ড ভ্রূকুটি করিয়া উধ্বে চাহিলেন। —

বটুক—নেমে আয়।

বটুক শিকল ধরিয়া সড়াৎ করিয়া নামিয়া আসিলেন। তাঁহার আকৃতি ক্ষীণ ও খর্ব, মাথার উপর কেশগুচ্ছ চূড়ার আকারে বাঁধা। বয়স ত্রিশ বত্রিশ। তিনি গ্রহাচার্যের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিলেন

শুনুন। মহারাজের অন্তঃপুরে দাসী মোরিকা কন্যার জন্ম দান করেছে—অন্তঃপুরে মহারাজ ছাড়া আর কোনও পুরুষের গতিবিধি নেই—সুতরাং কন্যার পিতা আমি। ইতি বটুকভট্টঃ। কেমন, বুঝেছেন তো?

গ্রহাচার্য অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন—শুভমস্তু এবার বুঝেছি—মহারাজের কন্যা—তা শুভমস্তু শুভমস্ত

বটুক ভট্ট আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলিলেন। —

আপনার মস্তকের বুদ্ধিও শুভমস্তু। ইতি বটুকভট্টঃ।

চণ্ড বলিলেন—এইবার কন্যার ভাগ্য গণনা কর।

এই যে মহারাজ

গ্রহাচার্য দারুপট্ট লইয়া খড়ি দিয়া আঁক কষিতে আরম্ভ করিলেন।

***

রাজ-অবরোধের একটি কক্ষ। রাজপ্রাসাদের তুলনায় কক্ষটি অত্যন্ত সাধারণভাবে সজ্জিত। কক্ষের এক কোণে ভূমির উপর শয্যা রচিত হইয়াছে। শয্যার উপর একটি যুবতী পাশ ফিরিয়া শুইয়া আছে; তাহার বুকের কাছে, বস্ত্রাচ্ছাদনের মধ্যে একটি সদ্যোজাত শিশু। যুবতী অসামান্যা সুন্দরী; কিন্তু বর্তমানে তাহার দেহ শীর্ণ, মুখ রক্তহীন।

মোরিকার বুকের কাছে বস্তুপিণ্ড ঈষৎ নড়িয়া উঠিল; তারপর তাহার ভিতর হইতে ক্ষীণ কাকুতি বাহির হইল। মোরিকা বস্ত্রাচ্ছাদন তুলিয়া শিশুকে দেখিল, আরও গাঢ়ভাবে বুকের কাছে টানিয়া লইল।

***

রাজসভায় গ্রহাচার্য জন্মকুণ্ডলী রচনা শেষ করিয়াছেন, অস্বস্তিপূর্ণ চক্ষে কুণ্ডলীর পানে চাহিয়া আছেন।

চণ্ড প্রশ্ন করিলেন—কি দেখলে? কন্যা ভাগ্যবতী?

গ্রহাচার্য কুণ্ডলী হইতে শঙ্কিত চক্ষু তুলিলেন। বলিলেন—

আয়ুষ্মন্ এই কন্যা—এহুম–বড়ই কুলক্ষণা, প্রিয়জনের অনিষ্টকারিণী—সাক্ষাৎ বিষকন্যা

চণ্ডের চক্ষু ঘুর্ণিত হইল

বিষকন্যা!

গ্রহাচার্য বলিলেন—হাঁ মহারাজ, গ্রহনক্ষত্র গণনায় তাই পাওয়া যাচ্ছে। আপনি একে বর্জন করুন—শুভমস্তু শুভমস্তু।

চণ্ডের ললাটে গভীর ভ্রূকুটি দেখা দিল। তিনি বলিলেন—বটে—বিষকন্যা। প্রিয়জনের অনিষ্টকারিণী—কোন্ প্রিয়জনের অনিষ্ট করবে?

গ্রহাচার্য আবার জন্মপত্রিকা দেখিলেন—মাতা-পিতা দুজনেরই অনিষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে—শুভমস্তু-মঙ্গল আর শনি পিতৃস্থানে পূর্ণ দৃষ্টি দিচ্ছে। তাই বলছি মহারাজ, আপনার কল্যাণের জন্য এই বিষকন্যাকে ত্যাগ করুন।

বটুক ভট্ট এক চক্ষু মুদিত করিয়া এই বাক্যালাপ শুনিতেছিলেন, তিনি তীক্ষ্ণকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন—বয়স্য, গ্রহবিপ্রের কথা শুনবেন না, বটুক ভট্টের কথা শুনুন। বিষকন্যা জন্মেছে ভালই হয়েছে। এই দাসী কন্যাটাকে সযত্নে পালন করুন; সে যখন বড়-সড় হবে তখন তাকে নগর-নটীর পদে বসিয়ে দেবেন। ব্যস, আপনার দুষ্ট প্রজারা সব একে একে যমালয়ে চলে যাবে। ইতি বটুকভট্টঃ।

চণ্ড সক্রোধে বটুক ভট্টের দিকে ফিরিলেন এবং বজ্রমুষ্টিতে তাঁহার চূড়া ধরিয়া ঝাঁকানি দিলেন; বটুক ভট্টের ঘাড় লটপট করিতে লাগিল।

বুটক, তোর জিভ উপড়ে ফেলব।

এই যে মহারাজ– বটুক দীর্ঘ জিহ্বা বাহির করিয়া দিলেন। চণ্ডের ক্রুদ্ধ মুখে ক্রমশ হাসি ফুটিল। তিনি বটুক ভট্টের চূড়া ছাড়িয়া দিয়া এক চষক সুরা পান করিলেন।

ইতিমধ্যে গণদেব নামে একজন সভাসদ সভায় প্রবেশ করিয়াছিল এবং একটি শূন্য আসনে বসিয়া পাশ্ববর্তী সভাসদের সহিত মৃদু বাক্যালাপ করিতেছিল। চণ্ড সুরাপাত্র নিঃশেষ করিয়া উদ্বিগ্নমুখে সভাসদগণের পানে চাহিলেন। বলিলেন

এখন এই বিষকন্যাটাকে নিয়ে কি করা যায়?

গণদেব নিজ আসনে উঁচু হইয়া হাত জোড় করিল—

মহারাজ, আমি বলি, মন্ত্রী শিবমিশ্রকে যে-পথে পাঠিয়েছেন এই বিষকন্যাকেও সেই পথে পাঠিয়ে দিন, রাজ্যের সমস্ত অনিষ্ট দূর হোক।

ক্রুর হাসিয়া চণ্ড গণদেবের পানে চাহিলেন—

মহামন্ত্রী শিবমিশ্র এখন কি করছেন কেউ বলতে পারো?

গণদেব বলিল—এইমাত্র দেখে আসছি। তিনি মহাশ্মশানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে শ্মশানশোভা নিরীক্ষণ করছেন। ব্রাহ্মণভোজন করাবো বলে কিছু মোদক নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু দেখলাম ব্রাহ্মণের মিষ্টান্নে রুচি নেই।

চণ্ড অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন। সভাসদগণও দেখাদেখি হাসিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কাহারও মুখে হাসি ভাল ফুটিল না। চণ্ডের মুখ আবার গম্ভীর হইল, তিনি গূঢ় গর্জনে বলিলেন—

শিবমিশ্র আমার কথার প্রতিবাদ করেছিল তাই তার এই দশা—আজ রাত্রে শিবাদল তাকে ছিঁড়ে খাবে। তোমরা স্মরণ রেখো।

সভাসদগণ হেঁটমুখে নীরব রহিলেন। বটুক ভট্ট হাই তুলিয়া তুড়ি দিলেন—

আজ তবে সভা ভঙ্গ হোক-ইতি বটুকভট্টঃ।

চণ্ড সিংহাসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বটুক ভট্ট অমনি সিংহাসনে গুটিসুটি পাকাইয়া শুইয়া পড়িলেন। চণ্ড গ্রহাচার্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন

গ্রহাচার্য, তুমি যা বলেছ তাই হবে। কন্যা আর তার মা দুজনকেই আজ রাত্রে মহাশ্মশানে পাঠাব, সেখানে মা তার মেয়েকে স্বহস্তে শ্মশানে সমাধি দেবে। তাহলে গ্রহদোষ দূর হবে তো?

গ্রহাচার্য কাঁপিয়া উঠিলেন—

মহারাজ! এত কঠোরতার প্রয়োজন নেই—শুভমস্তু–কন্যাকে ভাগীরথীর জলে বিসর্জন দিন, কন্যার মাতার কোনও অপরাধ নেই-তাকে দিয়ে এমন-~-

চণ্ড গর্জন করিয়া উঠিলেন—অপরাধ নেই! সে এমন কুলক্ষণা কন্যার জন্ম দিয়েছে কেন?

গ্রহাচার্য আরও কিছু বলিবার উপক্রম করিলে চণ্ড উদ্ধতভাবে হাত তুলিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিলেন—

থাক, তোমার বাক্-বিস্তার শুনতে চাই না। যা করবার আমি স্বহস্তে করব।

চণ্ডের মুখ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করিল।

***

রাত্রি। রাজ-অবরোধের দাসী মোরিকার ঘরের কোণে দীপ জ্বলিতেছে। দাসী মোরিকা শয্যার উপর নতজানু হইয়া ব্যাকুল ঊর্ধ্বমুখে মহারাজ চণ্ডের পানে চাহিয়া আছে। তাহার পাশে বস্ত্রপিণ্ডের মধ্যে সদ্যোজাত শিশু। মহারাজ চণ্ডের মুখে কঠিন ক্রোধ, হস্তে একটি লৌহ খনিত্র।

মোরিকা বলিল—মহারাজ, দয়া করুন—

চণ্ড বলিলেন—দয়া! বিষকন্যা প্রসব করে দয়া চাও! তোমাকে হত্যা করব না এই দয়া কি যথেষ্ট নয়?

মোরিকা গলদশ্রুনেত্রে বলিল-আমাকেই হত্যা করুন মহারাজ। কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশু—আপনার কন্যা-দয়া করুন-দয়া করুন—

মোরিকা চণ্ডের পদতলে পড়িল। কিন্তু চণ্ডের হৃদয় দ্রব হইল না। তিনি বলিলেন

যা আদেশ করেছি পালন করতে হবে—নিজের হাতে একে মহাশ্মশানের বালুতে জীবন্ত সমাধি দিতে হবে।

পদতল হইতে মুখ তুলিয়া মোরিকা হাত জোড় করিল—

ক্ষমা করুন—দয়া করুন। নিজের সন্তানকে নিজের হাতেনা না, আমি পারব না।

চণ্ড ভয়ঙ্কর স্বরে কহিলেন—পারবে না!

চণ্ড হেঁট হইয়া বস্তুপিণ্ডসুদ্ধ শিশুকে বাম হস্তে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিলেন

পারবে না! তবে তোমার চোখের সামনে এই সর্পশিশুকে মাটিতে আছড়ে মারব—

বস্তুপিণ্ডের মধ্যে শিশু কাঁদিয়া উঠিল। মোরিকা দুই বাহু তুলিয়া আর্তব্যাকুল স্বরে বলিল

না, দিন, আমাকে দিন—আমি—আপনার আদেশ পালন করব

চণ্ড শিশুর বস্তুপিণ্ড নামাইলেন, মোরিকা তাহা নিজ বক্ষে আঁকড়াইয়া ধরিল। চণ্ড দ্বারের দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন

যাও-এই নাও খনিত্র।

মোরিকা খনি লইল। প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাস তাহার বক্ষ হইতে নির্গত হইল। সে স্খলিতপদে দ্বারের দিকে চলিল। সে দ্বারের কাছে পৌঁছিলে চণ্ড বলিলেন—

মহাশ্মশান থেকে তুমি ফিরে আসতে পার, কিন্তু বিষকন্যা যেন ফিরে না আসে।

মোরিকা দ্বারের কাছে একবার দাঁড়াইল, তারপর আবার চলিতে আরম্ভ করিল।

***

চন্দ্রালোকিত মহাশ্মশান।

যতদূর দৃষ্টি যায় ধূ ধূ বালুকা; কেবল উত্তরদিক ঘিরিয়া ভাগীরথীর ধারা কলঙ্করেখার মত দেখা যাইতেছে। বালুকার উপর অসংখ্য নরকঙ্কাল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; মাঝে মাঝে লৌহশূল উচ্চ হইয়া আছে। শূলশীর্ষে কোথাও বীভৎস উলঙ্গ মনুষ্যদেহ বিদ্ধ হইয়া আছে, কোথাও বা শূলমূলে মাংসহীন কঙ্কাল পুঞ্জীভূত হইয়াছে। বহু দূরে গঙ্গার তীরে অনির্বাণ চুল্লীতে রক্তবর্ণ অঙ্গার জ্বলিতেছে।

এই মহাশ্মশানের ভিতর দিয়া মোরিকা চলিয়াছে। ডান হাতে বুকের কাছে বস্ত্রাচ্ছাদিত শিশুকে ধরিয়া আছে, বাঁ হাতে খনিত্র। সে ত্ৰাস-বিস্ফারিত চক্ষে চারিদিকে চাহিতেছে আর ক্লান্ত পদযুগল টানিয়া টানিয়া চলিতেছে। একটা নিশাচর পাখি কর্কশ ডাক দিয়া তাহার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল।

মোরিকা ভয় পাইয়া বালুর উপর পড়িয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার উঠিয়া চারিদিকে চাহিল। বস্ত্রপিণ্ডের মধ্যে শিশু ক্ষীণকষ্ঠে একবার কাঁদিল। মোরিকা তাহাকে বুকে চাপিয়া দ্রুত পলায়ন করিবার জন্য একদিকে ছুটিল।

একটি শূলের অর্ধপথে একটা নরদেহ বীভৎস ভঙ্গিতে বিদ্ধ হইয়া আছে, দুইটা শৃগাল ঊর্ধ্বমুখ হইয়া সেই দুষ্প্রাপ্য খাদ্যের দিকে তাকাইয়া আছে; চন্দ্রালোকে তাহাদের চক্ষু জ্বলিতেছে। মোরিকা এই দিকে আসিতেছিল, হঠাৎ শূল দেখিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, তারপর বিপরীত দিকে ছুটিতে আরম্ভ করিল।

শৃগালের মিলিত ঐক্যনাদ শুনা যাইতেছে। দূর হইতে দেখা গেল, একপাল শৃগাল বালুর উপর চক্রাকারে বসিয়া ঊর্ধ্বমুখে ডাকিতেছে। মোরিকা সেই দিকে ছুটিতে ছুটিতে আবার পড়িয়া গেল। বস্তুপিণ্ডের মধ্যে শিশু তাহার বাহুবন্ধন হইতে ছিটকাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল।

মোরিকা উঠিয়া বসিল; তাহার চক্ষে অর্ধোম্মাদ দৃষ্টি। সে সহসা খনিত্র লইয়া বালু খনন আরম্ভ করিল। অনতি-গভীর একটি গর্ত হইলে মোরিকা দুই হস্তে বস্তুপিণ্ড লইয়া তাহার মধ্যে নিক্ষেপ করিল, তারপর বালু দিয়া গর্ত পূর্ণ করিতে লাগিল। শিশুর কণ্ঠে আবার ক্ষীণ আকুতি শুনা গেল।

কিন্তু গর্ত পূর্ণ হইবার পূর্বেই মোরিকা আবার শিশুকে তুলিয়া লইয়া বুকে চাপিয়া ধরিল। তাহার উন্মত্ত দৃষ্টি পড়িল দূরে গঙ্গার শ্যামরেখার উপর। সে বিকৃত কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল

গঙ্গা! মা জাহ্নবী, তুমি আমাদের কোলে স্থান দাও

এক হাতে খনিত্র, অন্য হাতে শিশুকে বুকে চাপিয়া মোরিকা গঙ্গার অভিমুখে ছুটিয়া চলিল।

গঙ্গার নিকটে অনির্বাণ চুল্লী। চুল্লীর পশ্চাৎপটে দেখা গেল, একদল শৃগাল কোনও অদৃশ্য কেন্দ্রের চারিধারে ব্যুহ রচনা করিয়াছে। শৃগালচক্রের মধ্য হইতে হঠাৎ মনুষ্যকণ্ঠের তর্জন ফুঁসিয়া উঠিল কিন্তু মনুষ্য দেখা গেল না।

মোরিকার মুহ্যমান চেতনা মনুষ্যের কণ্ঠস্বরে যেন ঈষৎ সজাগ হইল, পাশ দিয়া যাইতে যাইতে সে থমকিয়া দাঁড়াইল। আবার মনুষ্যকণ্ঠের তর্জন শুনা গেল; শৃগালেরা পিছু হটিল। তখন মোরিকা ভয়ার্ত চক্ষে দেখিল, শৃগালচক্রের মাঝখানে বালুর উপর একটি নরমুণ্ড। দেহ নাই—কেবল মুণ্ড।

মোরিকার কণ্ঠ হইতে অস্ফুট চিৎকার বাহির হইল; সে কোন্ দিকে পালাইবে ভাবিয়া পাইল না, অবশ দেহে দাঁড়াইয়া রহিল।

সহসা সেই নরমুণ্ড উচ্চৈঃস্বরে কথা কহিল—

কে তুমি? প্রেত পিশাচ নিশাচর যে হও আমাকে রক্ষা কর

মোরিকা অবশে সেই দিকে দুই পদ অগ্রসর হইল; শৃগালেরা তাহাকে আসিতে দেখিয়া ক্রুদ্ধ অনিচ্ছায় আরও দূরে সরিয়া গেল।

মোরিকা কম্পিতকণ্ঠে কহিল–কে তুমি?

আকণ্ঠ প্রোথিত শিবমিশ্রের দুই গণ্ড শৃগালদষ্ট, রক্ত ঝরিতেছে। তিনি তীব্র ব্যাকুল কণ্ঠে বলিলেন—

ভয় নেই—আমি মানুষ। আমার নাম শিবমিশ্র। তুমি যে হও আমাকে বাঁচাও

মন্ত্রী শিবমিশ্র!

মোরিকা ছুটিয়া আসিয়া শিবমিশ্রের নিকট নতজানু হইল, শিশুকে মাটিতে রাখিয়া প্রাণপণে খনিত্র দিয়া বালু খুঁড়িতে লাগিল।

মোরিকা বালু খুঁড়িয়া শিবমিশ্রকে বাহির করিয়াছে; তিনি বালুর উপর শুইয়া অতি কষ্টে দীর্ঘনিশ্বাস গ্রহণ করিতেছেন। মোরিকার ক্লান্ত দেহও মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে; তাহার প্রাণশক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে।

কিছুক্ষণ পরে শিবমিশ্র কথা বলিলেন

তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ, তোমার পরিচয় জানতে চাই। কে তুমি? এত রাত্রে এই ভয়ঙ্কর মহাশ্মশানে কি জন্য এসেছ?

মোরিকা উত্তর দিল না, কেবল অঙ্গুলিনির্দেশে বস্ত্রাবৃত শিশুকে দেখাইল। শিশু এই সময় ক্ষীণ শব্দ করিল।

শিবমিশ্র উঠিয়া বসিলেন, গণ্ডের রক্ত মুছিয়া বলিলেন

শিশু! শিশু নিয়ে এত রাত্রে শ্মশানে এসেছ! কে তুমি? তোমার নাম কি?

মোরিকা নিমীলিত কণ্ঠে বলিল—

আমার নাম—মোরিকা। আমি রাজপুরীর দাসী

শিবমিশ্রের চক্ষে বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল

রাজপুরীর দাসী—ময়ুরিকা! বুঝেছি-তুমি কবে এই সন্তান প্রসব করলে?

মোরিকা বলিল—কাল রাত্রে

কিছুক্ষণ নীরব। মোরিকা কয়েকবার দীর্ঘনিশ্বাস টানিল, যেন তাহার শ্বাসকষ্ট হইতেছে।

শিবমিশ্র বলিলেন—হতভাগিনি! মহারাজ চণ্ডের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছ তাই তোমার এই দণ্ড?

মহারাজ আজ্ঞা দিয়েছেন কন্যাকে নিজের হাতে শ্মশানে সমাধি দিতে হবে—

কিন্তু কেন? কী তোমার কন্যার অপরাধ?

সভাপণ্ডিত গণনা করে বলেছেন আমার কন্যা বিষকন্যা-পিতার অনিষ্টকারিণী—তাই।

শিবমিশ্রের চক্ষু ধ্বক করিয়া জ্বলিয়া উঠিল—

বিষকন্যা! পিতার অনিষ্টকারিণী! দেখি—আমি বিষকন্যার লক্ষণ চিনি—

শিবমিশ্র উঠিয়া শিশুকে তুলিয়া লইলেন; সন্তর্পণে বস্ত্রাবরণ সরাইয়া দেখিলেন। কিন্তু চন্দ্রালোকে ভাল দেখা গেল না। শিবমিশ্র তখন শিশুকে লইয়া অনির্বাণ চিতার নিকট গেলেন। চিতার নিকট অনেক ইন্ধনকাষ্ঠ পড়িয়া ছিল, একটি কাষ্ঠখণ্ড লইয়া জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করিলেন; দপ করিয়া আগুনের শিখা জ্বলিয়া উঠিল। তখন সেই আলোকে শিবমিশ্র নগ্ন শিশুর দেহ-লক্ষণ পরীক্ষা করিলেন। পরীক্ষা করিতে করিতে পৈশাচিক উল্লাসে তাহার মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। তিনি শিশুকে বুকে লইয়া দ্রুত মোরিকার কাছে ফিরিয়া গেলেন। বলিলেন—

তোমার কন্যা বিষকন্যাই বটে

মোরিকা উত্তর দিল না, ভূমিশয্যায় পড়িয়া শেষবার অতি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল। শিবমিশ্র জানিতে পারিলেন না, মোরিকার পাশে নতজানু হইয়া আগ্রহ-কম্পিত স্বরে বলিলেন

বৎসে, তুমি তোমার কন্যা আমাকে দান কর, কেউ জানবে না। তুমি রাজপুরীতে ফিরে গিয়ে বোলো যে রাজাজ্ঞা পালন করেছ

মোরিকার নিকট হইতে কোনও সাড়া না পাইয়া শিবমিশ্র থামিলেন, নত হইয়া মোরিকার মুখ দেখিলেন; তারপর তাহার শীর্ণ মণিবন্ধে অঙ্গুলি রাখিয়া নাড়ী পরীক্ষা করিলেন। তাঁহার অঙ্গুলি হইতে মোরিকার মৃত হস্ত মাটিতে পড়িল। শিবমিশ্র শিশুকে সবলে বুকে চাপিয়া ঊর্ধ্বে আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলিলেন।

এই ভাল। এ কন্যা এখন আমার।

এই সময় আকাশের অঙ্গে আগুনের রেখা টানিয়া রক্তবর্ণ উল্কা পিণ্ডাকারে জ্বলিয়া উঠিল। সেই আলোকে শিবমিশ্র শিশুর মুখের দিকে চাহিলেন। নিজ মনেই বলিলেন

এ প্রকৃতির ইঙ্গিত। তোমার নাম রাখলাম——উল্কা! উল্কা!

মোরিকার মৃতদেহ পশ্চাতে ফেলিয়া শিবমিশ্র গঙ্গার অভিমুখে চলিলেন। শিবাদল দূরে সরিয়া গিয়াছিল, এখন আবার মোরিকার দেহ ঘিরিয়া ধরিল।

গঙ্গার জলে একটি ক্ষুদ্র ডিঙা দেখা গিয়াছিল। ডিঙার আরোহী মাত্র একজন; সে দাঁড় টানিয়া শ্মশানের দিকেই আসিতেছে। শিবমিশ্র থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন, তাঁহার মুখ সংশয়াকুল হইয়া উঠিল।

ডিঙার আরোহী তীরে ডিঙা ভিড়াইয়া লাফাইয়া নামিয়া পড়িল। শিবমিশ্র চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া তাহাকে চিনিবার চেষ্টা করিলেন।

কে তুমি?

দ্বিতীয় ব্যক্তি দৌড়িয়া কাছে আসিল এবং শিবমিশ্রের পদতলে পতিত হইল—

আর্য শিবমিশ্র—

সে যখন আবার উঠিয়া দাঁড়াইল, শিবমিশ্র তখন তাহাকে চিনিতে পারিলেন—ভগ্ননাসিক নাগবন্ধু।

নাগবন্ধু! তুমি?

নাগবন্ধু বলিল—প্রভু, অতি কষ্টে নৌকোয় করে শ্মশানে এসেছি। আপনি কি করে বালু-সমাধি থেকে মুক্তি পেলেন জানি না। কিন্তু আর বিলম্ব নয়, চলুন, রাত্রি শেষ হবার আগেই আপনাকে গঙ্গার পারে লিচ্ছবি দেশে পৌঁছে দেব।

শিবমিশ্র বলিলেন—নাগবন্ধু, তুমি আমার দুর্দিনের বন্ধু। চল, লিচ্ছবি দেশেই যাব—সেখানে রাজা নেই

শিবমিশ্র শিশুকে বুকে লইয়া নৌকায় উঠিয়া বসিলেন। নাগবন্ধু দাঁড় টানিতে আরম্ভ করিল।

***

দুইদিন পরের ঘটনা। বৈশালীর মন্ত্রভবনে উচ্চ বেদীর উপর তিনজন বয়স্থ কুলপতি পাশাপাশি বসিয়া আছেন। শিবমিশ্র তাঁহাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া। তাঁহার গণ্ডে এখনও রক্ত শুকাইয়া আছে, ক্রোড়ে বস্ত্রাচ্ছাদনের মধ্যে শিশু। পশ্চাতে নাগবন্ধু দাঁড়াইয়া আছে। দুইজনেরই আকৃতি শুষ্ক ক্লান্ত ধূলিধূসর!

শিবমিশ্র শান্ত অবিচলিত কণ্ঠে বলিতেছেন—

লিচ্ছবির মহামান্য কুলপতিগণ, আমি মগধ থেকে আসছি। আমার নাম হয়তো আপনাদের অপরিচিত নয়, আমি মগধের ভূতপূর্ব মহাসচিব শিবমিশ্র।

প্রথম কুলপতি বলিলেন—শিবমিশ্র! চণ্ডের মহাসচিব শিবমিশ্র!

শিবমিশ্র বলিলেন—হাঁ। মহারাজ চণ্ড আমাকে শ্মশানে আকণ্ঠ প্রোথিত করে রেখেছিলেন; তাঁর ইচ্ছা ছিল, রাত্রে শিবাদল এসে আমার দেহ ছিঁড়ে খাবে। মহারাজের অভিলাষ কিন্তু সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয়নি (নিজ গণ্ড স্পর্শ করিলেন), দৈববশে আমি রক্ষা পেয়েছি। মগধে আমার স্থান নেই, তাই আমি বৈশালীতে এসেছি

দ্বিতীয় কুলপতি বলিলেন—আর্য শিবমিশ্র, শত্রু হলেও আপনি মহামান্য ব্যক্তি—আমাদের অতিথি। আসন গ্রহণ করুন আর্য।

শিবমিশ্র বলিলেন—আগে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করুন, তবে আসন গ্রহণ করব।

তৃতীয় কুলপতি বলিলেন—কী আপনার প্রার্থনা জ্ঞাপন করুন।

শিবমিশ্র কহিলেন—আমি যতদিন মগধের মহামন্ত্রী ছিলাম ততদিন বৈশালীর শত্রুতা করেছি—মগধের শত্রু তখন আমার শত্রু ছিল। কিন্তু আজ মগধ আমাকে ত্যাগ করেছে। কুলপতিগণ, শুনুন, আমি শপথ করছি—চণ্ডকে উচ্ছেদ করব, মগধ থেকে শিশুনাগ বংশের নাম লুপ্ত করব। শিশুনাগ বংশ বিষধর সর্পের বংশ, ও বংশে বাতি দিতে কাউকে রাখব না—

দ্বিতীয় কুলপতি সানন্দে বলিলেন—সাধু! সাধু! আমরাও তাই চাই!

শিবমি বলিতে লাগিলেন—আপনাদের কাছে আমার প্রার্থনা, আপনারা গোপনে আমাকে আশ্রয় দিন; আমি যে বৈশালীতে এসেছি বা জীবিত আছি একথা যেন কেউ না জানতে পারে। আজ থেকে আমার নাম শিবমিশ্র নয়—শিবামিশ্র।

তিনি নিজের গণ্ড স্পর্শ করিলেন। কুলপতি তিনজন পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলেন।

প্রথম কুলপতি বলিলেন—আমরা আপনার প্রার্থনা সানন্দে পূর্ণ করব। যদি আর কিছু অভিলাষ থাকে বলুন।

শিবামিশ্র বলিলেন—আর কিছু না। শিশুনাগ বংশকে আমি নিজে ধ্বংস করতে চাই, কারুর সাহায্য চাই না। আপনারা শুধু আমাকে একটি পর্ণকুটির দান করুন।

দ্বিতীয় কুলপতি বলিলেন—পর্ণকুটির! আপনাকে অট্টালিকায় বাস করতে হবে। শিবামিশ্র মহাশয়, বৈশালী রাজতন্ত্র নয়, প্রজাতন্ত্র; কিন্তু তাই বলে বৈশালীতে গুণীর আদর নেই এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না।

শিবামিশ্র আশীর্বাদের ভঙ্গিতে এক হাত তুলিলেন—

ধন্য আপনারা ধন্য।

এই সময় বস্ত্রপিণ্ডের মধ্যে শিশু ক্ষীণ শব্দ করিল। কুলপতিরা চমকিয়া চাহিলেন।

প্রথম কুলপতি বলিলেন—এ কি! শিশুর কান্না!

শিবামিশ্র বলিলেন—হাঁ—একটি কন্যা।

আপনার কন্যা?

এখন আমারই কন্যা। মহাশ্মশানে ওকে কুড়িয়ে পেয়েছি, মহাশ্মশানের অনির্বাণ চুল্লী থেকে এই অগ্নিকণা তুলে এনেছি—একদিন এই অগ্নিকণা দাবানলের মত শিশুনাগ বংশকে ভস্ম করে দেবে।

শিবামিশ্র নাগবন্ধুর দিকে ফিরিলেন

নাগবন্ধু, তুমি মগধে ফিরে যাও বৎস। গোপনে গোপনে চণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জাগিয়ে ভোলো। এক দিনের কাজ নয়, এ সর্পবংশ নির্মূল করতে অনেক দিন লাগবে; ধৈর্য হারিও না। মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে যেও। মগধের সঙ্গে তুমিই আমার একমাত্র যোগসূত্র—এস বৎস।

নাগবন্ধু নতজানু হইয়া শিবামিশ্রের পদস্পর্শ করিল, শিবামিশ্র তাহার মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *