১. উঁচু পাহাড়ের ঢাল

দ্য কোয়েস্ট – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ – শওকত হোসেন

লেখকের উৎসর্গ:
স্ত্রী মোখিনোসোকে

অনুবাদকের উৎসর্গ:
এদেশের রহস্য-সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট শ্রদ্ধেয় জনাব শেখ আব্দুল হাকিম (হাকিম ভাই)-কে

*

উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এল দুটি নিঃসঙ্গ অবয়ব। পথ চলায় জীর্ণ ফারের পোশাক ওদের পরনে, শীতের কবল থেকে বাঁচতে মাথার চামড়ার হেলমেটের কানের ফ্ল্যাপ চিবুকের নীচে বেঁধে রেখেছে। মুখে দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল, রোদে পোড়া চেহারা। পিঠে বইছে সামান্য সম্বলটুকু। এখানে আসতে গিয়ে বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে, তাড়া করে ফিরেছে ওদের যাত্রাটুকু। পথ দেখালেও কেন এখানে এসেছে ওরা তার কোনও ধারণা নেই মেরেনের, এখানে আসার কোনও ইচ্ছেও ওর ছিল না। ওর পেছন পেছন আসা বুড়ো মানুষটারই জানা আছে সেটা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঝেড়ে কাশার কোনও লক্ষণ চোখে পড়েনি তার ভেতর।

মিশর ছেড়ে আসার পর এপর্যন্ত অনেকগুলো সাগর, হ্রদ আর বিরাট বিরাট নদী পেরিয়েছে ওরা, বিস্তৃর্ণ, নিবিড় বন জঙ্গল, প্রান্তর পেছনে ফেলে এসেছে। বিচিত্র ও হিংস্র সব পশু-পাখীর দেখা পেয়েছে; দেখেছে তারচেয়েও অদ্ভুত ও বিপজ্জনক মানুষ। অবশেষে পাহাড়সারির মাঝে এসেছে ওরা, তুষার-ঢাকা চূড়ার সুবিশাল বিশৃঙ্খল, মুখ ব্যাদান করে থাকা গহ্বর, যেখানে ক্ষীণ হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছিল। শীতে পটল তুলেছিল ওদের ঘোড়াগুলো, একটা আঙুলের ডগা খুইয়েছে মেরেন। পুড়ে কালো হয়ে গেছে, গা জ্বালানো তুষারে পচেছে। তবে ভাগ্য ভালো, তলোয়ার ধরার বা বিশাল ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার কাজে লাগা আঙুল খোয়ায়নি।

শেষ খাড়া ক্লিফের কিনারে এসে থামল মেরেন। পাশে এসে দাঁড়াল বুড়ো। স্নো টাইগারের চামড়া দিয়ে বানানো তার পরনের ফারের কোট, মেরেনের উপর। হামলে পড়ার পর একটা মাত্র তীর ছুঁড়ে ওটাকে খতম করেছিল মেরেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদী আর নিবিড় সবুজ বনে ঘেরা অচেনা এক দেশের দিকে চেয়ে রইল ওরা।

পাঁচ বছর, বলল মেরেন। পাঁচ বছর ধরে চলার উপর আছি আমরা। আমাদের চলা কি তবে শেষ হলো, ম্যাগাস?

হ্যাঁ, মেরেন, অতদিন হয়নি বোধ হয়? জানতে চাইল তাইতা, তুষার শুভ্র

ভুরুর নিচে পরিহাসের ছলে ঝলকে উঠল ওর দুই চোখ।

জবাবে পিঠ থেকে সোর্ড স্ক্যাবার্ড নামিয়ে চামড়ায় আঁকা দাগগুলো দেখাল সে। প্রত্যেকটা দিনের হিসাব রেখেছি আমি, ইচ্ছে করলে গুনে দেখতে পারেন, বলল ও। তাইতাকে অনুসরণ করেছে ও, আয়ুর অর্ধেকের চেয়ে বেশি বার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার, কিন্তু এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারবে না মানুষটা সত্যি সিরিয়াস নাকি স্রেফ ওর সাথে ঠাট্টা করে চলেছে। আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি, সম্মানিত ম্যাগাস। আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছে?

না, হয়নি। মাথা নাড়ল তাইতা। তবে একটা ব্যাপারে স্বস্তি পেতে পারো। অন্তত ভালো একটা সূচনা করতে যাচ্ছি আমরা। এবার সামনে চলে এলো সে, ক্লিফের শরীর থেকে বের হয়ে আসা একটা সংকীর্ণ চাতাল ধরে আগে বাড়ল।

কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে রইল মেরেন। তারপর ওর রুক্ষ সরল সুদর্শন চেহারায় বিষণ্ণ হালছাড়া হাসি ফুটে উঠল। বুড়ো শয়তানটা কী কোনওদিনই থামবে না? পাহাড়ের উদ্দেশে প্রশ্ন করল ও, তারপর স্ক্যাবার্ড ফের কাঁধে ফেলে অনুসরণ করল ওকে। ক্লিফের নিচে এসে শাদা কোয়ার্ট পাথরের একটা টিলা পাশ কাটাল ওরা। ঠিক তখনই আকাশ থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর। স্বাগতম, পর্যটক! অনেকক্ষণ হলো তোমাদের অপেক্ষা করছি!

বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল ওরা, চোখ তুলে মাথার ওপরের চাতালের দিকে তাকাল। শিশুসুলভ একটা অবয়ব বসে আছে ওখানে, দেখে এগার বছরের বেশি হবে বলে মনে হলো না। ছেলেটা পরিষ্কার দৃষ্টিসীমায় থাকলেও ওকে অগে দেখতে না পাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক, চড়া রোদের আলো তাকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলে, শাদা কোয়ার্ট পাথরে ঠিকরে যাচ্ছে। উজ্জ্বল শাদা আভা ঘিরে রেখেছে তাকে, চোখ ঝলসে দিচ্ছে। বিদ্যা আর প্রজননের দেবী সরস্বতীর মন্দিরের পথ দেখিয়ে তোমাদের নিয়ে যেতে আমাকে পাঠানো হয়েছে, সুরেলা কণ্ঠে বলল ছেলেটা।

মিশরিয় ভাষায় কথা বলছ তুমি! মহাবিস্ময়ে বলে উঠল মেরেন।

মৃদু হেসে নির্বোধ মন্তব্য ফিরিয়ে দিল ছেলেটা। দুষ্টু বাঁদরের মতো বাদামি চেহারা, কিন্তু হাসিটা এত সুন্দর, পাল্টা না হেসে পারল না মেরেন।

আমার নাম গঙ্গা। বার্তাবাহক। চলো! আরও বেশ অনেকটা পথ বাকি। উঠে দাঁড়াতেই নগ্ন কাঁধের উপর ঘন চুলের বেনুনী লুটিয়ে পড়ল। এই শীতেও স্রেফ একটা নেংটি পরে আছে। নগ্ন ধড় গাঢ় চেস্টনাট রঙের, কিন্তু পিঠের উপর উটের কুঁজের মতো একটা কুঁজ বইছে সে। ভূতুড়ে, ভীতিকর। ওদের মুখের ভাব লক্ষ করে ফের হাসল ছেলেটা। এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তোমরা, আমাদের মতোই, বলল সে। চাতাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাইতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। এই দিকে।

পরের দুটো দিন নিবিড় বাঁশ বনের ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গঙ্গা। অসংখ্যা মোচড় আর বাঁক নিয়েছে পথ, সে না থাকলে কয়েক শো বার পথ হারাতে হতো ওদের। যতই নিচে নামছে, ততই উষ্ণ হয়ে উঠছে হাওয়া; এক সময় ফারের পোশাক খুলে মাথা উন্মুক্ত রেখেই পথ চলতে পারল ওরা। তাইতার চুল শীর্ণ, ঋজু, চকচকে; মেরেনের চুল গাঢ়, ঘন, কোঁকড়া। দ্বিতীয় দিন বাঁশ বনের প্রান্তে পৌঁছাল ওরা, নিবিড় জঙ্গলের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরল। এখানকার গাছপালা মাথার উপর মিলে সূর্যের আলো আড়াল করেছে। জমিনের সোঁদা গন্ধ ও পচা গাছের স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। মাথার উপর দিয়ে ঝলমলে পাখীর ঝক দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। কিচিমিচির আওয়াজ করছে ক্ষুদে বাঁদরের দল। মগ ডালে জমায়েত হয়েছে ওরা। ফুলে ভরা লতাপাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব, রঙিন নানা রকম প্রজাপতি।

নাটকীয়ভাবে জঙ্গল শেষ হয়ে গেল, একটা খোলা প্রান্তরে পৌঁছাল ওরা, প্রায় লীগখানেক দূরে জঙ্গলের উল্টোদিকের প্রাচীরের কাছে শেষ হয়েছে এটা। ফাঁকা জায়গার সীমান্তে একটা বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে। মাখনের মতো হলুদ পাথরের চাঁই থেকে বানানো ওটার মিনার, বুরুজ আর টেরেসগুলো। একটা পাথরের দেয়াল পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। বাইরের দিক ঢেকে রাখা মূর্তি আর প্যানেলগুলো নগ্ন পুরুষ ও ইন্দ্রিয়কাতর নারীদের মহাযজ্ঞ তুলে ধরেছে।

মূর্তিগুলোর খেলা দেখলে ঘোড়াও ভয় পাবে, সতর্ক কণ্ঠে বলল মেরেন, যদিও ওর চোখজোড়া ঝিলিক মারছে।

আমার ধারণা ভাস্কর্যের জন্যে দারুণ মডেল হবে তুমি, বলল তাইতা। হলদে পাথরের গায়ে মানবদেহের সম্ভব সব রকম ভঙ্গিমা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে দেয়ালের কোনও কিছুই নিশ্চয় নতুন নয় তোমার কাছে?

বরং উল্টো, অনেক কিছু শেখার আছে আমার, স্বীকার গেল মেরেন। এর অর্ধেকও কোনওদিন স্বপ্নে আর কল্পনায় আসেনি।

জ্ঞান আর বংশধারার মন্দির, ওদের মনে করিয়ে দিল গঙ্গা। এখানে প্রজননের কর্মকাণ্ডকে একাধারে পবিত্র ও সুন্দর মনে করা হয়।

মেরেনেরও অনেক দিন ধরে তাই ধারণা, শুষ্ক কণ্ঠে মন্তব্য করল তাইতা।

এখন ওদের পায়ের নিচের পথ মসৃণ, পথ ধরে মন্দিরের বাইরের প্রাচীরের তোরণের কাছে চলে এল ওরা। বিশাল কাঠের কবাট খোলা ছিল।

ভেতরে যাও! ওদের তাগিদ দিল গঙ্গা। অপ্সরারা অপেক্ষা করছে।

অপ্সরা? জানতে চাইল মেরেন।

মন্দিরের সেবাদাসী, ব্যাখ্যা করল গঙ্গা।

তোরণ পার হলো ওরা। তারপর এমনকি তাইতা পর্যন্ত বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে উঠল। এক অনন্য সাধারণ উদ্যানে নিজেদের আবিষ্কার করেছে ওরা। মসৃণ সবুজ আঙিনায় ফুলে ভরা গুল্ম ঝোঁপ আর ফল গাছের ছড়াছড়ি; এরই মধ্যে বেশির ভাগ গাছপালাই ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে: রসাল ফলগুলো তৃপ্তিকরভাবে, পেকে উঠছে। এমনকি অভিজ্ঞ বৃক্ষ বিশেষজ্ঞ ও উদ্যানবিদ তাইতা পর্যন্ত কিছু কিছু বিচিত্র প্রজাতির গাছ চিনতে পারল না। ফুলের কেয়ারিগুলোয় চোখ ধাঁধানো নানা রঙের সমাহার। তোরণের কাছে লনে বসে ছিল তিন জন তরুণী। পর্যটকদের দেখেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা, হালকা পায়ে ছুটে এল মিলিত হতে। উত্তেজনায় নাচছে, লাফাচ্ছে। তাইতা ও মেরেনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। প্রথম অপ্সরা ছিপছিপে, সোনালি চুল মাথায়, অসাধারণ সুন্দরী। মাখনের মতো মসৃণ ত্বকের কল্যাণে ওকেও বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে। শুভেচ্ছা, ভালোভাবেই দেখা হলো। আমি আস্ত্রাতা, বলল সে।

দ্বিতীয় অপ্সরার মাথায় ঘন চুল, চোখজোড়া তীর্যক। মৌচাকের মোমের মতো পলিশ করা স্বচ্ছ ত্বক। নিপূণ কারিগরের হাতে খোদাই করা হাতির দাঁতের মতো। নারী সত্তার পূর্ণ বিকাশে অনন্য সাধারণ লাগছে তাকে। আমি উ লু, বলল সে। মেরেনের পেশল বাহু সমীহের সাথে লক্ষ করতে লাগল। তুমি অনেক সুন্দর।

আমার নাম তানসিদ, বলল লম্বা মূর্তির মতো তৃতীয় অপ্সরা। চোখজোড়া বিস্ময়কর টারকোয়েজ সবুজ, দাঁতগুলো শাদা, নিখুঁত। তাইতাকে চুমু খেল সে, বাগানের কোনও ফুলের সৌরভের মতোই সুবাসিত মনে হলো ওর নিঃশ্বাস। তোমাকে স্বাগতম, ওকে বলল তানসিদ। তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। আমাদের জন্যে আনন্দ বয়ে এনেছ তোমরা।

উ লুকে এক হাতে জাড়িয়ে ধরে তোরণের দিকে চোখ ফেরাল মেরেন। গঙ্গা কোথায় গেল? জানতে চাইল ও।

গঙ্গা বলে কেউ কখনও ছিল না, ওকে বলল তাইতা। বুনো আত্মা সে। কাজ শেষ হওয়ায় ভিন্ন জগতে ফিরে গেছে। কথাটা মেনে নিল মেরেন। ম্যাগাসের সাথে অনেক লম্বা সময় কাটানোর পর এখন আর অদ্ভুত ও জাদুকরী কোনও ঘটনায়ও অবাক হয় না।

অপ্সরারা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে এল ওদের। বাগানের উজ্জ্বল রোদের পর উঁচু দেয়ালগুলো শীতল ও ম্লান ঠেকল। সরস্বতীর সোনার মূর্তির সামনে রাখা ধূপদানীর ধূপের সুবাসে সুবাসিত হয়ে আছে চারপাশের হাওয়া। ওগুলোর সামনে পূজা দিচ্ছে ঢিলেঢালা জাফরানি জোব্বা পরা পুরোহিত আর পুরোহিতীনিরা, অন্যদিকে আরও অনেক অপ্সরা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ছায়ার ভেতর। কেউ কেউ আগন্তুকদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে এগিয়ে এল। মেরেনের বাহু আর বুকে হাত বোলাল ওরা, বিলি কেটে দিল তাইতার রূপালি দাড়িতে।

সবশেষে উ লু, তানসিদ আর আস্ত্রাতা হাত ধরে একটা দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মন্দিরের আবাসিক মহলে নিয়ে এল ওদের। খাবার ঘরে গামলা ভরা সজির স্টু আর কাপে করে মিষ্টি লাল মদ খেতে দিল। দীর্ঘদিন সামান্য খাবারের উপর টিকে ছিল ওরা, এমনকি তাইতাও গ্রোগ্রাসে খেল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তাইতাকে ওর জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরে নিয়ে গেল তানুসিদ। পোশাক খুলতে সাহায্য করল ওকে, তারপর উষ্ণ পানি ভরা একটা তামার বেসিনে দাঁড় করিয়ে ক্লান্ত শরীর স্পঞ্জ করে দিল। যেন সন্তানের পরিচর্যা করছে কোনও মা, এতটাই কোমল ও স্বাভাবিক ওর ভঙ্গি। মেয়েটা ওর নপুংসক বানানোর বিভৎস ক্ষতে স্পঞ্জ বোলানোর সময়ও এতটুকু বিব্রত বোধ করল না তাইতা। গা মুছে দিয়ে ওকে। তক্তপাষের কাছে নিয়ে এল মেয়েটা, ওর পাশে বসে মৃদু কণ্ঠে গান গাইতে লাগল, যতক্ষণ না স্বপ্নহীন ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

মেরেনকে অন্য একটা কামরায় নিয়ে এল উ লু আর আস্ত্রাতা। তানসিদের মতোই ওকে গোসন করাল ওরা, তারপর তক্তপোষে শুইয়ে দিল। ওদের কাছে রাখার চেষ্টা করল মেরেন, কিন্তু পরিশ্রান্ত ছিল ও, ইচ্ছাটুকুও আন্তরিক ছিল না। খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল ওরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমে ঢলে পড়ল ও।

দিনের আলো ছুঁইয়ে ভেতরে না আসা অবধি ঘুমাল ও। জেগে উঠল তারপর। মনে হলো যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে, আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে। ওর পুরোনো মলিন পোশাক অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে জায়গায় টাটকা ঢিলেঢালা টিউনিক দেখা যাচ্ছে। পোশাক পরা শেষ করেছে কি করেনি, এমন সময় দরজার বাইরে মিষ্টি নারী কণ্ঠের হাসি আর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। চীনা মটির ডিশ আর ফলের রস নিয়ে হুড়মুড় করে হাজির হলো মেয়ে দুটো। খাবার সময় মেরেনের সাথে মিশরিয় ভাষায় কথা বলল দুই অপ্সরা, কিন্তু নিজেরা কথা বলার সময় পাঁচ মিশেলি ভাষা চালিয়ে গেল, সব ভাষাই যেন ওদের কাছে ডালভাত মনে হলো। তবে দুজনই স্পষ্টতই যার যার মাতৃভাষার প্রতিই বেশি পক্ষপাত দেখাল। আস্ত্রাতা লোনিয়, ওর সূক্ষ্ম সোনালি চুলের কারণ বোঝা গেল। উ লু দূর ক্যাথের সুরেলা ঘণ্টাধ্বনির মতো কথা বলে।

খাবার শেষ হলে মেরেনকে বাইরে রোদের আলোয় নিয়ে এল ওরা। একটা ফোয়ারা গভীর পুকুরে পানি ঢেলে দিচ্ছে এখানে। পরনের হাল্কা পোশাক ঝেড়ে ফেলে নগ্ন দেহে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনই। মেরেনকে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে নিতে ফিরে এল আস্ত্রাতা। ওর চুল ও শরীর পানিতে চকচক করছে। হাসতে হাসতে ওকে জড়িয়ে ধরল ও। ওর টিউনিক খুলে নিল, তারপর টেনে পুকুরে নামাল। ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল উ লু। ওকে পুকুরে নামানোর পর খুশিতে পানি ছিটাতে লাগল ওরা। অচিরেই ভদ্রতা বিসর্জন দিল মেরেন। ওদের মতোই খোলামেলা, নিঃসঙ্কোচ হয়ে উঠল। ওর চুল ধুইয়ে দিল আস্ত্রাতা, অবাক হয়ে ওর গিঁট পাকানো পেশির ক্ষত চিহ্নগুলো দেখতে লাগল।

দুই অপ্সরা ওর সাথে গা মেলানোর সময় ওদের খুঁতহীন দেহ সৌষ্ঠভে রীতিমতো অবাক হয়ে গেল মেরেন। পানির নিচে সারাক্ষণই ব্যস্ত ওদের হাত। ওরা দুজনে মিলে ওকে পুকুর থেকে তুলে গাছপালার নিচে একটা ছোট তাবুতে নিয়ে এল। পাথুরে মেঝেতে কার্পেট আর সিল্কের কুশনের তূপ। ওকে তার উপর শুইয়ে দিল ওরা, পুকরের পানিতে এখনও ভেজা ও।

এইবার দেবীর পূজা দেব আমরা, বলল উলু।

কীভাবে সেটা করতে চাও? জানতে চাইল মেরেন।

ভয় পেয়ো না। তোমাকে বাৎলে দেব, ওকে আশ্বস্ত করল আস্ত্রাতা। ওর পিঠে নিজের রূপালি শরীর সম্পূর্ণ মিলিয়ে দিয়ে পেছন থেকে কানে চুমু খেল। হাত

বাড়িয়ে উ লুকে সোহাগ করতে চাইল ও। সামনে থেকে মেরেনকে দুই পায়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ বাদে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যেন ওরা তিনজনই একসাথে ভেসে গিয়ে একটা মাত্র প্রাণে রূপান্তরিত হয়েছে, ছয় পা, ছয় হাত ও তিন মাথাঅলা একটা প্রাণী।

*

মেরেনের মতো সকাল সকাল জেগে উঠল তাইতা। দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত হলেও কয়েক ঘণ্টার ঘুমে শরীর-প্রাণ সেরে উঠেছে। তক্তপোষে উপুড় হয়ে বসে আছে ও, রোদের আলো চুঁইয়ে ঘরে আসছে। বুঝতে পারছে এখানে একা নয়

তক্তপোষের পাশে বসে ওর দিকে চেয়ে হাসছে তানসিদ। শুভ দিন, ম্যাগাস। আপনার খাবার আর পানীয় নিয়ে এসেছি। নিজেকে শক্তিশালী করে তোলার অবসরে কশ্যপ আর সুমনা আপনার সাথে পরিচিত হতে উদগ্রীব হয়ে আছে।

ওরা কারা?

কশ্যপ আমাদের সম্মানিত যাজক, সুমনা আমাদের সম্মানিত মা। আপনার মতোই দুজনই বিশিষ্ট ম্যাজাই।

মন্দিরের উদ্যানে কুঞ্জে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল সুমনা। অজ্ঞাত বয়সের সুন্দরী মহিলা সে, পরনে জাফরানি জোব্বা। ওর কানের উপরে ঘন চুলে রূপালি ছোপ দেখা যাচ্ছে, চোখজোড়া প্রচণ্ড বুদ্দিদীপ্ত। আলিঙ্গন সেরে তাইতাকে ওর পাশে মাৰ্বল বেঞ্চে বসার আমন্ত্রণ জানাল সে। মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রার কথা জানতে চাইল। খানিকক্ষণ আলাপের পর সুমনা বলল, আপনারা ঠিক সময় মতো যাজক কশ্যপের সাথে দেখা করার জন্যে আসায় আমরা দারুণ খুশি। আর বেশি দিন আমাদের সাথে থাকবেন না উনি। তিনিই আপনাদের জন্যে তোক পাঠিয়েছিলেন।

জনতাম, এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে, কিন্তু কে ডাক দিয়েছে, জানা ছিল না, মাথা দুলিয়ে বলল তাইতা। আমাকে কেন তলব করেছেন উনি?

নিজেই বলবেন তিনি, বলল সুমনা। এখন আমরা ওর কাছেই যাব। ওর হাত ধরল সে। তানসিদকে রেখে এটা সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল, মনে হলো ওটার শেষ নেই বুঝি। অবশেষে সর্বোচ্চ মন্দির মিনারের চূড়ার একটা ছোট বৃত্তাকার কামরায় পৌঁছুলো ওরা। ওটার চারপাশ খোলা, উত্তরে দূরের তুষার-ঢাকা পাহাড়সারি পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। মেঝের মাঝখানে গদি ভর্তি একটা নরম তক্তপোষে এক লোক বসে আছেন।

ওর সামনে গিয়ে বসুন, ফিসফিস করে বলল সুমনা। বলতে গেলে সম্পূর্ণ কালা উনি, কথা বলার সময় ঠোঁটের নড়াচড়া দেখতেই হবে। সুমনার কথামতো করল তাইতা। নীরবতায় কশ্যপ আর ও পরস্পরকে খানিকক্ষণ জরিপ করল।

প্রাচীন বুড়ো কশ্যপ। চোখজোড়া ম্লান, ফিকে; মাঢ়ী দাঁতহীন। গায়ের ত্বক প্রাচীন পার্চমেন্টের মতো শুষ্ক, কোঁচকানো। চুল, দাড়ি ও ভুরুজোড়া কাঁচের মতো মলিন ও স্বচ্ছ। নিয়ন্ত্রণের অতীত অবিরাম কেঁপে চলেছে মানুষটার মাথা ও হাত।

কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, ম্যাগাস? জানতে চাইল তাইতা।

কারণ আপনার মনটা ভালো, ফিসফিসে কণ্ঠে বললেন কশ্যপ।

আমার কথা কীভাবে জানতে পেরেছেন? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

গোপন বিদ্যা ও সত্তা দিয়ে, ইথারে এক ধরনের ঝামেলা ছড়িয়ে দেন আপনি, দূর থেকে টের পাওয়া যায়, ব্যাখ্যা করলেন কশ্যপ।

কী চান আমার কাছে?

কিছু না, আবার অনেক কিছু, হয়তো এমনকি আপনার জীবন।

খুলে বলুন।

হায়! অনেক দেরি হয়ে গেছে। মরণের কালো চাঁদ তাড়া করে ফিরছে আমাকে। সূর্যাস্তের আগেই চলে যাব আমি।

আমার জন্যে রাখা কাজটা কি অনেক গুরুত্বপূর্ণ?

এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর হতে পারে না।

কী করতে হবে আমাকে? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

আমি চেয়েছিলাম আপনার জন্যে অপেক্ষায় থাকা সংগ্রামের জন্যে আপনাকে তৈরি করে যাওয়া, কিন্তু এখন অপ্সরাদের কাছে জানতে পারলাম আপনি নপুংশক। আপনি এখানে আসার আগে জানা ছিল না কথাটা। যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে এখন আর আপনাকে আমার বিদ্যা শেখাতে পারব না।

সেটা কেমন? জানতে চাইল তাইতা।

দৈহিক বিনিময়ে।

ঠিক বুঝলাম না।

আমাদের যৌন মিলনের প্রয়োজন হতো। আপনার ক্ষতের কারণে সেটা সম্ভব নয়। নীরব রইল তাইতা। ওকে সম্পর্শ করতে শীর্ণ থাবার মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন কশ্যপ। কোমল কণ্ঠে কথা বললেন তিনি। আপনার আভা দেখে বুঝতে পারছি ক্ষতের কথা তুলে আঘাত দিয়ে ফেলেছি। সেজন্যে দুঃখিত। কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। সোজাসাপ্টা কথা বলতেই হচ্ছে।

নীরব রইল তাইতা। তো খেই ধরলেন কশ্যপ। সুমনার সাথে বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। ওর মনটাও খুব পরিষ্কার। আমি চলে যাবার পর আমার কাছ থেকে শেখা বিষয়টুকু আপনাকে শেখাবে ও। আপনাকে বিচলিত করার জন্যে দুঃখিত।

সত্যি কথা বেদনাদায়ক হতে পারে, কিন্তু আপনি তা নন। আমাকে যা করতে বলবেন তাই করব।

তাহলে আমার সারা জীবনের শিক্ষা আর বিদ্যা সুমনাকে দেওয়ার সময় আমাদের সাথেই থাকবেন। পরে আপনার সাথে তা ভাগ করে নেবে ও। তখন আপনার দায়িত্ব পবিত্র প্রয়াসের জন্যে তৈরি হয়ে যাবেন আপনি, যেটা আপনার নিয়তি।

মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল তাইতা।

জোরে হাত তালি দিল সুমনা, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল দুজন অচেনা অপ্সরা। দুজনই অল্প বয়সী, সুন্দরী; একজন কৃষ্ণকেশী, অন্যজন মধু রঙা চুলের অধিকারী। সুমনার সাথে দূরের দেয়ালের কাছে রাখা ছোট কাঁসারির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। কয়লার আগুনে তীব্র গন্ধঅলা এক গামলা গুল্ম সেদ্ধ করতে সাহায্য করল ওকে। আরক তৈরি হয়ে গেলে কশ্যপের কাছে নিয়ে এল। একজন ওর মাথা ধরে রাখল, অন্যজন ওর ঠোঁটে ছোঁয়াল বাটিটা। শব্দ করে আরকটা খেলেন তিনি, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল খানিকটা, তারপর ক্লান্ত হয়ে তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়লেন।

এবার দুই অপ্সরা সসম্মানে যত্নের সাথে নগ্ন করল ওকে। তারপর একটা অ্যালাবাস্টার শিশি থেকে সুগন্ধী মলম মাখাল কুঁচকিতে। গুঙিয়ে উঠলেন কশ্যপ। বিড়বিড় করে এপাশওপাশ মাথা দোলাতে লাগলেন। কিন্তু অপ্সরাদের নিপুন হাতের যত্ন ও ওষুধের প্রভাবে জেগে উঠল তার শিশ্ন।

সম্পূর্ণ ফুলে উঠলে ওর তক্তপোষের উপর সুমনা মিলিত হলো ওর সাথে এসে ফিসফিস করে তার কানে কানে কথা বলল: প্রভু, আমাকে আপনার যা কিছু দেবার আছে তা গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত।

 আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে তা হস্তান্তর করছি, ক্ষীণ ও অস্পষ্ট শোনাল কশ্যপের কণ্ঠস্বর। বুঝেশুনে কাজে লাগিয়ো। আবার এপাশ-ওপাশ মাথা দোলাতে শুরু করলেন তিনি। ভীতিকর ভঙ্গিতে হাঁ হয়ে আছে তার প্রাচীন চেহারা। তারপর সহসা আড়ষ্ট হয়ে গেলেন তিনি, গুঙিয়ে উঠলেন; তীব্র খিচুনীতে কেঁপে উঠল তার শরীর। প্রায় ঘণ্টাখানেক দুজনের কেউই নড়ল না। তারপর ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরিয়ে এল কশ্যপের গলা দিয়ে। তক্তপোষের উপর শিথিল হয়ে গেল তার দেহ।

আর্তনাদ ঠেকাল সুমনা। মারা গেছেন উনি বিপুল দুঃখ ও সহানুভূতির সাথে বলল ও। আস্তে করে কশ্যপের মরদেহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ম্লান খোলা চোখজোড়া বুজে দিল। তাইতার দিকে তাকাল এবার।

সূর্যাস্তের সময় ওর লাশ পোড়াব আমরা। সারা জীবন আমার গুরু ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কশ্যপ। আমার চোখে বাবার চেয়েও বেশি ছিলেন তিনি। এখন ওর সত্তা রয়েছে আমার সাথে। এক হয়ে গেছে আমার আত্মার সাথে। আমাকে ক্ষমা করবেন, মাগাস, কিন্তু এমনি ভীষণ অভিজ্ঞতা থেকে সামলে উঠতে অনেক সময় লাগবে আমার, ততক্ষণ আপনার কোনও কাজে আসব না আমি।

*

সেদিন সন্ধ্যায় ঘরের বাইরের অন্ধকার বেলকনিতে তানসিদের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের মন্দিরের উদ্যানে যাজক কশ্যপের মরদেহ চিতায় পোড়ানো প্রত্যক্ষ করল তাইতা। মানুষটার সাথে আরও আগে পরিচয় হয়নি বলে এক ধরনের গভীর দুঃখ বোধ করল ও। এমনি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের সময়টুকুতেও ওদের দুজনের আন্ত রিকতার ব্যাপারে সচেতন ছিল ও।

অন্ধকারে একটা কোমল কণ্ঠ কথা বলে উঠল, চমকে চিন্তায় ছেদ পড়ল ওর। ফিরে তাকাতেই সুমনাকে দেখতে পেল, চুপিসারে ওদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে।

কশ্যপও আপনাদের দুজনের মাঝে বাঁধন সম্পর্কে সজাগ ছিলেন, তাইতার অন্য পাশে এসে দাঁড়াল ও। আপনওি সত্যের সেবাদাস। সে জন্যেই এমন জরুরি ভিত্তিতে আপনাকে তলব করেছিলেন তিনি। অত দূরে যাবার মতো শক্তিতে কুলালে নিজেই যেতেন। আপনার দেখা দৈহিক বিনিময়ের সময় সত্যির খাতিরে চূড়ান্ত মহান বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। আপনাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমার কাছে একটা বার্তা দিয়েছেন কশ্যপ। তার আগে আমি যেন আপনার বিশ্বাস পরীক্ষা করি সেটা চেয়েছেন তিনি। বলুন তো, গালালার তাইতা, আপনার ধর্ম বিশ্বাস কী?

একটু ভাবল তাইতা। তারপর জবাব দিল আমার বিশ্বাস বিশ্বজগৎ দুটো শক্তিশালী বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র। তার প্রথমটি সত্যির দেবতাদের বাহিনী, দ্বিতীয়টি মিথ্যার দানোদের।

এই ভীষণ সংগ্রামে আমাদের মতো মরণশীলরা কী করতে পারে? জিজ্ঞেস করল সুমনা।

আমরা সত্যির প্রতি নিজেদের নিবেদন করতে পারি, কিংবা মিথ্যার কাছে গ্রস্ত হতে দিতে পারি।

সত্যির ডান দিকের পথ বেছে নিলে কীভাবে মিথ্যার অন্ধকার শক্তির মোকাবিলা করতে পারব?

চিরন্তন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যতক্ষণ না সত্যির রূপ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। সেটা অর্জন করার পর আমরা দয়াময় অমরদের দলে যোগ দিতে পারব। এরাই সত্যির যোদ্ধা।

এটাই কি সব পুরুষের নিয়তি?

নাহ! অল্প কয়েকজনের, কেবল সুযোগ্যরাই এই মর্যাদা লাভ করবে।

সময়ের শেষে সত্যি কি মিথ্যার বিরুদ্ধে জয়ী হবে?

 নাহ! মিথ্যা টিকে থাকবে, তবে সত্যিও। এই যুদ্ধ অন্তহীনভাবে সামনে পেছনে চলতে থাকে।

সত্যি কি ঈশ্বর নন?

তাকে রা বা আহুরা মাযদা, বিষ্ণু বা যিউস, ওদেন বা তোমার কানে মধুর যেকোনও নামে ডাকতে পারো। কিন্তু ঈশ্বর ঈশ্বরই, এক এবং অদ্বিতীয়। আপন বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি দিল তাইতা।

আপনার আভা থেকে দেখতে পাচ্ছি আপনার এই নিশ্চয়তায় মিথ্যার লেশ নেই, শান্ত কণ্ঠে বলল সুমনা, হাঁটু গেড়ে বসল ওর সামনে। আমার ভেতরে অবস্থানরত কশ্যপের আত্মা আপনি সত্যিই সত্যির পক্ষে থাকায় সন্তুষ্ট। আমাদের উদ্যোগে কোনও বাধা বা কুণ্ঠা নেই। এবার আমরা কাজে নামতে পারি।

তার আগে আমাদের উদ্যোগটা একটু বুঝিয়ে দাও, সুমনা।

এই কঠিন সময়ে মিথ্যা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। নতুন ভয়ঙ্কর এক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে গোটা মানবজাতিকে, বিশেষ করে আপনার প্রিয় মিশরকে। এই ভীষণ বস্তুর বিরুদ্ধে তৈরি করার জন্যেই এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল আপনাকে। আমি আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে দেব, তাহলে কোন পথ ধরে চলতে হবে সেটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। উঠে ওকে আলিঙ্গন করল সুমনা। তারপর আবার কথা বলল সে। এখন হাতে বেশি সময় নেই। সকালে শুরু করব আমরা। তার আগে অবশ্য একজন সাহায্যকারী বেছে নিতে হবে।

সেটা কাদের ভেতর থেকে? জানতে চাইল তাইতা।

আপনার অপ্সরা তানসিদ আগেও আমাকে সাহায্য করেছে। কী করতে হবে ও জানে।

তবে ওকেই বেছে নাও. রাজি হলো তাইতা। মাথা দুলিয়ে তানসিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সুমনা। তারপর আবার তাইতার দিকে তাকাল।

আপনাকেও সাহায্যকারী বেছে নিতে হবে, বলল সুমনা।

তাকে কী করতে হবে সেটা বলো।

তাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে, আপনার জন্যে দরদ থাকতে হবে। তার প্রতি আপনার অগাধ আস্থা থাকতে হবে।

একটুও দ্বিধা করল না তাইতা। মেরেন!

নিশ্চয়ই, সায় দিল সুমনা।

*

ভোরে পর্বতমালার পাদদেশ ধরে উঠতে শুরু করল ওরা চারজন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথ ধরে ঢাল বেয়ে উপরের বাঁশ বনে পৌঁছাল। একটা পাকা ডাল বেছে নেওয়ার আগে দোল খেতে থাকা অনেকগুলো হলদে বাঁশ পরখ করল সুমনা। তারপর মেরেনকে দিয়ে বড়সড় একটা টুকরো কাটাল। ওটা সহ মন্দিরে ফিরে এল ও।

বাঁশের ডাল থেকে বেশ কয়েকটা লম্বা কাঠি বানাল সুমনা ও তানসিদ। পলিশ করতে করতে এক সময় মানুষের চুলের মতো সরু অথচ সূক্ষ্মতম ব্রোঞ্জের চেয়েও তীক্ষ্ণ ও ঘাতসহ হয়ে গেল ওগুলো।

মন্দির সমাজের প্রশান্তিতেও এক ধরনের উত্তেজনা আর প্রত্যাশার আবহ টের পাওয়া যাচ্ছে। অপ্সরাদের উঁচু গলার হাসি ও প্রাণবন্ত ভাব চাপা পড়েছে। যখন তাইতার দিকে তাকাচ্ছে তানসিদ, ওর চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও করুণার ছাপ পড়ছে। অপেক্ষার বেশির ভাগ দিনগুলো পাশে থেকে বিপদের জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করছে সুমনা। অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ করছে ওরা। কশ্যপের প্রজ্ঞা ও কণ্ঠে কথা বলেছে সুমনা।

এক পর্যায়ে ওকে দীর্ঘ সময় ধরে খুঁচিয়ে চলা একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করল তাইতা: আমার বিশ্বাস তুমি একজন দীর্ঘায়ু, সুমনা।

আপনারই মতো, তাইতা।

এটা কীভাবে সম্ভব যে আমরা অল্পকিছু বাকিদের চেয়ে অনেক বেশিদিন বেঁচে থাকি? জিজ্ঞেস করল ও। এটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ।

আমার আর যাজক কশ্যপের মতো যারা তাদের ক্ষেত্রে এর কারণ সম্ভবত আমাদের জীবনযাত্রার কায়দা: আমাদের খাবার, পানীয়, আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের ব্যাপার। কিংবা হয়তো, আমাদের একটা লক্ষ্য আছে বলে, চালিয়ে যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য, ক্রমাগত খুঁচিয়ে চলা একটা পির।

আমার বেলায়? তোমার আর যাজকের তুলনায় নিজেকে কিশোর মনে হলেও সাধারণ লোকের মেয়াদ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি, বলল তাইতা।

হাসল সুমনা। আপনার মনটা ভালো। এ পর্যন্ত আপনার বুদ্ধির শক্তি আপনার দৈহিক দুর্বলতাকে পরাস্ত করতে পেরেছে, কিন্তু শেষ বিচারে কশ্যপের মতো আমাদের সবারই মরতে হবে।

আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব দিয়েছো তুমি, কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন আছে। কে আমাকে বেছে নিয়েছে? জানতে চাইল তাইতা, যদিও জানত এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না।

মিষ্টি হেঁয়ালিময় হাসি দিয়ে সামনে ঝুঁকে ওর ঠোঁটে উপর একটা আঙুল রাখল সুমনা। আপনাকে বাছাই করা হয়েছে, বলল ফিসফিস করে, এতেই সম্ভষ্ট থাকুন। তাইতা জানে ওকে জ্ঞানের শেষ সীমায় ঠেলে দিয়েছে ওঃ এরপর তার পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

দিনের বাকি সময় আর পরবর্তী রাতের অর্ধেকটা একসাথে ওদের ভেতর এপর্যন্ত যা কিছু বিনিময় হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করল ওরা। তারপর ওকে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে এলো সুমনা, ভোরের আলো চেম্বার ভরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মা আর শিশুর মতো পরস্পর গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমাল। ঘুম থেকে উঠে এক সাথে স্নান করল ওরা। তারপর ওকে উদ্যানের এক গোপন কোণের প্রাচীন পাথুরে দালানে নিয়ে এলো সুমনা। এখানে আগে আসেনি তাইতা। আগেই এসেছে তানসিদ। বিশাল মূল কামরার মাঝখানে রাখা একটা মাৰ্বল পাথরের টেবিলে কাজে ব্যস্ত। ওরা ঢুকতেই চোখ তুলে তাকাল। বাকি সুইগুলো তৈরি করছি, ব্যাখ্যা করল সে। তবে তোমরা একা থাকতে চাইলে আমি চলে যাব।

না, তুমি থাকো, প্রিয় তানসিদ, বলল সুমনা। তোমার উপস্থিতি আমাদের কোনও সমস্যা করবে না। তাইতার হাত ধরে গোটা কামরায় ঘুরে বেড়াল ও। গোড়াতে প্রথম দিকের যাজকরা এই কামরার নকশা করেছিলেন। কাজ করার জন্যে স্পষ্ট আলোর প্রয়োজন ছিল তাদের। মাথার উপর অনেক উঁচুতে বসানো বিরাট আকারের খোলা জানালাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল ও। এই অপারেশন টেবিলের উপর পঞ্চাশ প্রজন্মেরও বেশি যাজক অন্তর্চক্ষু খোলার অস্ত্রপচার করেছেন। রা প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানী, কথাটা দিয়ে আমরা গুরুকে বোঝাই, যারা অন্য মানুষ ও জীব জানোয়ারের আভা দেখতে পান। দেয়ালের খোদাই করা লেখাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল ও। আমাদের আগে শতাব্দীর পর শতাব্দী, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ যারা বিদায় নিয়েছেন, তাদের সবার কথা রয়েছে ওখানে। আমাদের ভেতর কোনও বাধা থাকতে পারবে না। আপনাকে মিথ্যা আশ্বাসও দেব না–কথা বলার আগেই যেকোনও রকম প্রতারণার প্রয়াস স্পষ্ট বুঝে যাবেন আপনি। তো আপনাকে সত্যি করে বলছি, সফল হওয়ার আগে কশ্যপের অভিভাবকত্বে চারবার অন্তর্চক্ষু খোলার চেষ্টা করেছিলাম আমি।

সবচেয়ে সাম্প্রতিক খোদাই লিপির দিকে ইঙ্গিত করল ও। এখানে আমার প্রয়াসের নথি দেখতে পাচ্ছেন। প্রথমে হয়তো আমার দক্ষতা আর নৈপূণ্য ছিল না। আমার রোগিরা হয়তো ডান দিকের পথে যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল না। একবার তো ফল ছিল মহাবিপর্যয়কর। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, তাইতা, এটা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক মুহূর্ত নীরব রইল সুমনা, ভাবছে। তারপর ফের খেই ধরল। আমার আগেও অনেকে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে দেখুন! দেয়ালের আরও দূরবর্তী প্রান্তের শেওলায় ঢাকা সুপ্রাচীন খোদাই লিপির কাছে নিয়ে গেল ওকে সুমনা। এগুলো এত পুরোনো হয়ে গেছে যে পাঠোদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে ওখানে কী লেখা আছে বলছি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে এক মহিলা এসেছিলেন এই মন্দিরে। এককালে এজিয়ান সাগরের তীরে লিয়ন নামে এক শহরের এক প্রাচীন জাতির জীবিত সদস্য ছিল সে। অ্যাপোলোর প্রধান পুরোহিতিনী। আপনার মতোই দীর্ঘায়ু। তার সাম্রাজ্যের পতন ও ধ্বংসের পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পৃথিবীময় ঘুরে জ্ঞান আর বিদ্যা আয়ত্ত করেছে। তখন এখানকার যাজক ছিলেন কর্মা। অচেনা মহিলা নিজেকে সত্যির প্রতিমূর্তি হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিল তার সামনে। এভাবে তার অন্তর্চক্ষু খোলাতে রাজি করাণ তাকে। এটা এমন এক সাফল্য ছিল যার ফলে যাজক বিস্মিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহিলা মন্দির ছেড়ে চলে যাবার বেশ পরেই সন্দেহ আর কুচিন্তায় ভরে ওঠে কমার মন। কয়েকটা মারাত্মক ঘটনার ফলে তিনি বুঝতে পারেন মহিলা সম্ভবত প্রতারক, চোর, বামপন্থার গুরু, মিথ্যার দাস হবে। অবশেষে তিনি জানতে পারেন, প্রকৃতপক্ষে যাকে বাছাই করা হয়েছিল তাকে হত্যা করার জন্যে ডাকিনীবিদ্যা কাজে লাগিয়েছে সে। নিহত নারীর পরিচয় ধারণ করে তাকে ভাওতা দিতে আপন পরিচয় যতটুকু সম্ভব আড়াল করতে পেরেছিল সে।

কী পরিণতি হয়েছে চিড়িয়াটার?

সরস্বতী দেবীর যাজকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে খুঁজে বের করা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজেকে আড়াল করে উধাও হয়ে গেছে সে। এতদিনে হয়তো মরে গেছে। সবচেয়ে ভালো এটাই আশা করতে পারি আমরা।

কী নাম তার? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

এই যে! এখানে খোদাই করা আছে। আঙুলের ডগা দিয়ে লেখা স্পর্শ করল সুমনা। নিজেকে সূর্যদেবতার বোনের নামে, ইয়োস পরিচয় দিয়েছিল সে। এখন আমি জানি, এটা তার আসল নাম না। তবে তার আত্মার চিহ্ন ছিল বেড়ালের থাবার ছাপ। এই যে এখানে।

আরও কতজন ব্যর্থ হয়েছে? বিষণ্ণ ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল তাইতা।

অনেক।

তোমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটা বলো।

এক মুহূর্ত ভাবল সুমনা, তারপর বলল, আমি যখন একেবারে নবীশ ছিলাম তখনকার একটা ঘটনার কথা বিশেষভাবে মনে আছে। তার নাম ছিল বোতাদ, দেবতা ভোদেনের যাজক ছিলেন তিনি। পবিত্র নীল টাটুতে ভরা ছিল তাঁর শরীর। শীতল সাগরের ওপারের উত্তরের দেশ থেকে আনা হয়েছিল তাঁকে। বিশাল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু বাঁশের সুইয়ের নিচে মারা গেছেন। অন্তরের মুক্ত শক্তির কাছে টিকে থাকার পক্ষে তার মহাশক্তি যথেষ্ট ছিল না। মগজ ফেটে গিয়েছিল, নাক কান থেকে রক্ত বের হয়ে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমনা। ভয়ঙ্কর কিন্তু দ্রুত ছিল মরণটা। হয়তো বোদ ওর আগে যারা এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন তাদের চেয়ে ভাগ্যবান ছিলেন। অন্তর্চক্ষু মালিকের উপরই বিগড়ে যেতে পারে, লেজ ধরে রাখা বিষাক্ত সাপের মতো। এতে ফুটে ওঠা কিছু আতঙ্ক এতই স্পষ্ট ও ভয়ঙ্কর যে, বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

সেদিনের বাকি সময়টুকু নীরব রইল ওরা। এদিকে পাথুরে টেবিলে নিজের কাজে ব্যস্ত রইল তানসিদ। অবশিষ্ট বাঁশের সুই পলিশ করে আর অস্ত্রপচারের সরঞ্জাম সাজিয়ে সময় কাটাল সে।

অবশেষে তাইতার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে কথা বলল সুমনা। এখন আপনি জানেন কোন ঝুঁকির ভেতর পড়তে যাচ্ছেন। চেষ্টা করতে বাধ্য নন আপনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সম্পূর্ণ আপনার।

মাথা নাড়ল তাইতা। আমার কোনও উপায় নেই। এখন আমি জানি, আমার জন্মক্ষণেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।

*

সেই রাতে তাইতার ঘরে ঘুমাল তানসিদ ও মেরেন। বাতি নেভানোর আগে তোইতাকে একটা চীনা মাটির গামলা ভর্তি গরম ভেষজ নির্যাস দিল তাসনিদ। ওটা খাওয়ার প্রায় সাথে সাথে তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা। ওর শ্বাস প্রশ্বাস পরখ করে দেখতে আর ভোরের শীতল হাওয়া ঘরে ঢুকতে শুরু করলে ওর গায়ে চাদর টেনে দিতে রাতে দুবার জেগে উঠল মেরেন।

ঘুম থেকে জেগে ওদের তিনজনকে দেখতে পেল তাইতা: সুমনা, তানসিদ ও মেরেন। ওর তক্তপোষ ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।

ম্যাগাস, আপনি তৈরি? সতর্ক কণ্ঠে জানতে চাইল সুমনা।

মাথা দোলাল তাইতা, কিন্তু মেরেন হড়বড়িয়ে কথা বলে উঠল, এই কাজ করতে যাবেন না, ম্যাগাস। নিজের উপর একাজ করতে যাবেন না, এটা অশুভ।

ওর পেশল বাহু হাতে তুলে নিয়ে শক্ত করে দোলাল তাইতা। ঝুঁকির কথা ভেবেই তোমাকে বেছে নিয়েছি। তোমাকে আমার দরকার। আমাকে হতাশ করো, মেরেন। কাজটা একা করতে হলে পরিণতি কী হবে কে বলতে পারে? একসাথে আমরা বিজয়ী হতে পারব, আগেও যেমন অনেকবার জিতেছি। বেশ কয়েকবার অনিয়মিত শ্বাস টানল মেরেন। তুমি তৈরি, মেরেন? বরাবরের মতো আমার পাশে থাকছ?

আমাকে ক্ষমা করবেন, দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি, তবে এখন আমি তৈরি, ম্যাগাস, ফিসফিস করে বলল ও।

উদ্যানের উজ্জ্বল রোদের আলোয় নিয়ে এলো ওদের সুমনা, সেখান থেকে প্রাচীন দালানে। মাৰ্বল টেবিলের এক কিনারে শৈল্য চিকিৎসকের সরঞ্জাম রাখা। অন্যপ্রান্তে একটা কয়লার ভাণ্ড রয়েছে; ওটার উপর তপ্ত হাওয়া কাঁপছে। নিচের মেঝেয় ভেড়ার পশমের গালিচা বিছানো। তাইতাকে কিছু বলার দরকার হলো না, টেবিলের দিকে মুখ করে গালিচার উপর হাঁটু গেড়ে বসল ও। মেরেনের উদ্দেশে মাথা দোলাল সুমনা, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আগেই ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে ও। তাইতার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ও। তারপর এমনভাবে দুহাতে আলিঙ্গন করল ওকে যাতে তাইতা নড়াচড়া করতে না পারে।

চোখ বন্ধ করো, মেরেন, নির্দেশ দিল সুমনা। দেখতে যেয়ো না। ওদের সামনে এসে দাঁড়াল সুমনা, তারপর একটা চামড়ার ফিতে বাড়িয়ে দিল তাইতাকে দাঁতে চেপে রাখতে। মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করল তাইতা। ডান হাতে একটা রূপার চামচ নিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল ও, তারপর অন্য হাতের দুই আঙুলে তাইতার ডান চোখের পাতা ফাঁক করল। সব সময়ই ডান চোখে দিতে হয়, ফিসফিস করে বলল ও। সত্যির দিক। চোখের পাতা বড় করে টেনে রাখল ও। শক্ত করে ধরে রাখ, মেরেন!

ঘোঁৎ করে সায় দিল মেরেন, আরও শক্ত করে চেপে ধরল তাইতাকে। এক সময় গুরুর চারপাশে ব্রোঞ্জের রিংয়ের মতো হয়ে উঠল ওর হাতের বাঁধন। চামচের প্রান্তটা দৃঢ়, নিশ্চিত হাতে তাইতার চোখের উপরের পাতার নিচে পিছলে ঢুকিয়ে দিল সুমনা, আস্তে অক্ষিগোলকের পেছনে নিয়ে গেল। তারপর আস্তে করে কোটর থেকে চোখটা বের করে আনল। তাইতার গালের উপর ডিমের মতো ঝুলে থাকতে দিল ওটাকে। অপটিক নার্ভের ফিতের সাথে ঝুলছে। শূন্য কোটরটা যেন গোলাপি গভীর গুহা, চোখের জলে চকচক করছে। রূপার চামচটা তানসিদের হাতে তুলে দিল সুমনা। ওটাকে একপাশে নামিয়ে রেখে একটা বাঁশের সূঁচ তুলে নিল তানসিদ। ডগাটাকে কয়লার আগুনের উপর ধরে রাখল ও, যতক্ষণ না সেটা পুড়ে শক্ত হয়ে গেল। ধোঁয়া ওঠা সঁচটা এবার সুমনার হাতে তুলে দিল ও। ডান হাতে সঁচটা নিয়ে তাইতার শূন্য কোটর বরাবর চোখ না আসা পর্যন্ত মাথা নামিয়ে আনল সুমনা। অপটিক পাথওয়ের করোটিতে ঢোকার পথের কোণ আর অবস্থান যাচাই করল।

ওর আঙুলের নিচে তাইতার চোখের পাতা নড়ছে, কাঁপছে, নিয়ন্ত্রণের অতীত পিটপিট করে চলেছে। গ্রাহ্য করল না সুমনা। আস্তে আস্তে সুইটা চক্ষু কোটরে ঢুকিয়ে দিল, যতক্ষণ না সেটা পাথওয়ের প্রবেশ মুখ স্পর্শ করল। চাপ বাড়াল ও, যতক্ষণ না আকস্মিকভাবে সুইটা পর্দা ভেদ করে স্নায়ুর কোনও ক্ষতি না করেই নার্ভের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে গেল। যাবার পথে বলতে গেলে কোনও বাধার মুখে পড়ল না। ক্রমে গভীরে প্রবেশ করল ওটা। মগজের ফ্রন্টাল লোবের প্রায় এক আঙুল সমান গভীরতায় ঢোকার পর ঠিক অনুভব করা নয়, সূঁচটা দুচোখের ভেতর থেকে বের আসা স্নায়ু তন্তুর বান্ডিল যেখানে অক্ষিকোটরের অপটিক খাদ পেরিয়েছে সেখানে কিঞ্চিত বাধা টের পেল সুমনা। বাঁশের ডগাটা পোর্টালে পৌঁছেছে। ওর অভিব্যক্তি শান্ত থাকলেও সুমনার নির্মল ত্বকের উপর ক্ষীণ স্বেদবিন্দুর আস্তরণ দেখা দিয়েছে। চোখজোড়া সরু হয়ে গেছে। টানটান হয়ে গেছে ও, শেষ ধাক্কাটা দিল এবার। তাইতার দিক থেকে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সুমনা বুঝতে পারল সূক্ষ্ম লক্ষ্যভেদ করতে পারেনিও। সামান্য পিছিয়ে আনল সুইটা, তারপর সেই আগের গভীরতায় ফের ঠেলা দিল। এইবার একটু উপরে।

কেঁপে উঠল তাইতা, মৃদু শ্বাস ফেলল। তারপর শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়ায় শিথিল হয়ে এল তার শরীর। এমন কিছু হবে বলে মেরেনকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। শক্তিশালী হাতে তাইতার চিবুকটা উঁচু করে রাখল ও, যাতে ওর প্রিয় মানুষটির মাথা সামনে হেলে না পড়ে। যেমন সাবধানে ঢুকিয়েছিল ঠিক একই রকম সাবধানতায় চক্ষু কোটর থেকে উঁচটা বের করে আনল সুমনা। রক্তের লেশমাত্র নেই ওতে। ওর চোখের সামনে সূক্ষ্ম ক্ষতের মুখটা আপনাআপনি বুজে গেল।

গুনগুন করে অনুমোদনসুলভ একটা শব্দ করল সুমনা। এবার চামচ দিয়ে ঝুলন্ত চোখটা আবার আস্তে করে কোটরে বসাল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুত জায়গামতো বসার পর দ্রুত পিটপিট করতে লাগল তাইতার চোখের পাতা। লিনেনের ব্যান্ডেজের দিকে হাত বাড়াল সুমনা। আগেই নিরাময়কারী মলমে ভিজিয়ে মাৰ্বল টেবিলের উপর রেখেছিল তানসিদ। তাইতার মাথার চারপাশে পেঁচিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।

যত তাড়াতাড়ি পারো, ওর জ্ঞান ফেরার আগেই ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাও, মেরেন।

দুধের বাচ্চার মতো কোলে তুলে নিল ওকে মেরেন। সুঠাম কাঁধের উপর ওর মাথা রাখল। তাইতাকে নিয়ে দৌড়ে মন্দিরে ফিরে এল ও, তারপর ওকে ওর ঘরে নিয়ে এল। সুমনা ও তানসিদ অনুসরণ করল ওকে। মেয়ে দুটি পৌঁছানোর পর অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল তানসিদ। আগেই ওখানে একটা কেতলি চাপিয়ে রেখেছিল ও। এক বাটি ভেষজ নির্যাস ঢেলে নিল। সুমনার কাছে নিয়ে এল ওটা।

ওর মাথা তুলে ধরো! নির্দেশ দিল সুমনা। তাইতার ঠোঁটের কাছে ধরল বাটিটা, তরলটুকু আস্তে আস্তে ওর মুখে তুলে দিয়ে গলা ডলে দিতে লাগল যাতে গিলতে পারে। বাটির সবটুকু তরল খাওয়াল ওকে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আড়ষ্ট হয়ে গেল তাইতা, ওকে অন্ধ করে রাখা ব্যান্ডেজের দিকে হাত বাড়াল। যেন প্লাস্টার করা, এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল ওর হাত। দাঁত কপাটি লেগে গেছে। তারপর দুপাটি এক করল ও। চোয়ালের গোড়ার পেশি শক্ত হয়ে উঠল। নিজের জিভ কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারে ভেবে ভয় পেল মেরেন। বুড়ো আঙুলে ম্যাগাসের দাঁত ফাঁক করার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু আচমকা আপনাআপনি খুলে গেল তাইতার মুখ, আর্তনাদ করে উঠল ও। পাকা কাঠের মতো গিঁট পাকিয়ে গেল ওর শরীরে সমস্ত পেশি। একের পর এক খিঁচুনি কাঁপিয়ে দিল ওকে। সত্রাসে আর্তনাদ করে চলল ও, হতাশায় গোঙাল, তারপর যান্ত্রিক হাসিতে ফেটে পড়ল। ঠিক যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি সহসা কাঁদতে শুরু করল, যেন ওর হৃদয় ভেঙে গেছে। তারপর ফের আর্তনাদ করে উঠল ও। পিঠ বেঁকে গেল, একেবারে গোড়ালি স্পর্শ করার যোগাড় হলো মাথার। এমনকি মেরেনও ওর দুর্বল নাজুক, প্রাচীন দেহটাকে সামলে রাখতে পারছে না, দানবীয় শক্তি ভর করেছে ওখানে।

ওর উপর কীসের আসর হলো? সুমনার উদ্দেশে মিনতিভরা কণ্ঠে জানতে চাইল মেরেন। নিজেকে শেষ করে ফেলার আগেই ওকে থামাও!

ওর অন্তর্চক্ষু এখন বিস্ফারিত। এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেনি। সাধারণ মানুষকে পাগল করে তোলার মতো এতই ভয়ঙ্কর সব ইমেজ বয়ে চলেছে ওর ভেতর, ওর মনকে ভরে দিচ্ছে। মানবজাতির সব ভোগান্তি সহ্য করছে ও। তাইতাকে তেতো ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সুমনাও এখন হাঁপাচ্ছে। সব ঘরের ছাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে তাইতা।

এই উন্মাদনাই উত্তরের বোতাদকে মেরে ফেলেছিল, তানসিদকে বলল সুমনা। ইমেজগুলো ওর মগজকে ফুটন্ত তেল ভর্তি ব্লাডারের মতো ফুলিয়ে দিয়েছিল, এক সময় ধরে রাখতে না পারায় ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ব্যান্ডেজ খামচানো থেকে বিরত রাখতে তাইতার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে ও। সব বিধবা আর সন্তানহারা মায়ের কষ্ট অনুভব করছে ম্যাগাস, যারা তাদের প্রথম সন্তানের মরণ প্রত্যক্ষ করেছে। রোগে শোকে কষ্ট পেয়ে প্রাণ হারানো প্রতিটি নারী পুরুষের ভোগান্তির স্বাদ পাচ্ছে। সমস্ত স্বৈরাচারীর নিষ্ঠুরতায়, মিথ্যার দৌরাত্মে অসুস্থ বোধ করছে। বিধ্বস্ত নগরীর আগুনে পুড়ছে, পরাস্তদের সাথে হাজার হাজার যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ হারাচ্ছে। জীবন্ত প্রতিটি জীবের প্রাণ হারানোর কষ্ট অনুভব করছে। নরকের গভীরে চোখ রাখছে।

এতে মারা যাবে ও! তাইতার মতোই সমান মাত্রার কষ্ট ভোগ করছে মেরেন।

যদি অন্তর্চক্ষু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, হ্যাঁ, সত্যিই প্রাণ হারাতে পারে ও। ওকে ধরে রাখো। ওকে নিজের মতো চলতে দিয়ো না। ভীষণভাবে এপাশ-ওপাশ পাক খাচ্ছে তাইতার মাথা, বিছানার পাশের পাথুরে দেয়ালে টক্কর খাচ্ছে।

এবার উঁচু কাঁপা কণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল সুমনা, ওর নিজের কণ্ঠস্বর নয় এটা। এই ভাষা এর আগে কখনও শোনেনি মেরেন। কিন্তু মন্ত্রে তেমন একটা কাজ হলো না।

নিজের বাহুতে তাইতার মাথা রাখল মেরেন। ওর দুপাশে অবস্থান নিলে সুমনা ও তানসিদ। নিজেদের দেহের সাহায্যে বাধা দিয়ে হিংস্র প্রয়াসে নিজেকে আহত করার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ওর খোলা মুখে সুবাসিত ফুঁ দিচ্ছে তানসিদ। তাইতা! চিৎকার করে ডাকল ও। ফিরে এসো! আমাদের কাছে ফিরে এসো!

তোমার কথা শুনতে পাবে না ও, বলল সুমনা। সামনে ঝুঁকে দুই হাত বাটির মতো করে তাইতার ডান কানের কাছে, সত্যির কান, ধরল। মন্ত্রের মতো একই ভাষায় মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। অর্থ না বুঝতে পারলেও প্রভাব টের পেল মেরেন। অপর ম্যাগাসের সাথে কথা বলার সময় তাইতাকে এই ভাষা ব্যবহার করতে শুনেছিল ও। ওদের গোপন ভাষা এটা, একে ওরা বলে তেনমাস।

শান্ত হয়ে এল তাইতা, মাথাটা একপাশে কাত করল, যেন সুমনার কথা শুনতে পাচ্ছে। ওর কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলেও তাতে তাগিদের ছাপ ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে জবাব দিল তাইতা। ওকে নির্দেশনা দিচ্ছে সুমনা, বুঝতে পারল মেরেন। বিধ্বংসী ইমেজ ও শব্দ থেকে উদ্ধার পেতে অন্তর্চক্ষু বন্ধ করায় সাহায্য করছে। যেন কীসের অভিজ্ঞতা লাভ করছে বুঝতে পারে, ওকে আঘাত দিয়ে চলা আবেগের জোয়ারের উপর নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পায়।

সেদিনের বাকি সময় ও পরবর্তী দীর্ঘ রাতের বেশির ভাগ সময় ওর পাশে রইল ওরা। ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমে ঢলে পড়ল মেরেন। ওকে জাগানোর চেষ্টা করল না মেয়েরা। বিশ্রাম নিতে দিল। মারপিট আর কঠোর শারীরিক প্রয়াসে মজবুত ওর শরীর, কিন্তু ওদের আধ্যাত্মিক প্রাণশক্তির সাথে পেরে ওঠার মতো যোগ্যতা নেই। ওদের পাশে ও শিশুর মতো।

তাইতার খুব কাছে রইল সুমনা ও তানসিদ। এক সময় মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে, আবার একবার মনে হচ্ছে অস্থির, ঘোরের ভেতরে যাওয়া আসা করছে। চোখের পট্টির ওপাশে যেন কল্পনা থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করতে পারছে না। একবার উঠে বসে ভীষণ শক্তিতে তানসিদকে বুকে টেনে নিয়েছিল ও। লস্ত্রিস! চিৎকার করে বলেছে। কথামতো ফিরে এসেছো তুমি। ওহ, আইসিস আর হোরাস। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম আমি। এতগুলো বছর তোমার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলাম। আমাকে আর ছেড়ে যেয়ো না।

ওর এমনি বিস্ফোরণে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি তানসিদ। ওর দীর্ঘ রূপালি চুলে বিলি কেটে দিয়েছে। তাইতা, নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। তোমার যতদিন প্রয়োজন, ততদিনই তোমার সাথে থাকব আমি। যতক্ষণ না ফের বোধহীনতায় ডুবে গেল ও, ততক্ষণ আলগোছে শিশুর মতো বুকের কাছে ধরে রাখল ওকে। তারপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সুমনার দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। লস্ত্রিস!

এককালে মিশরের রানি ছিল, ব্যাখ্যা করল সুমনা। অন্তর্চক্ষু ও কশ্যপের প্রজ্ঞা দিয়ে তাইতার মনে গভীরে তদন্ত চালিয়ে ওর স্মৃতি খুঁড়ে বের করে আনছে। লস্ত্রিসের জন্যে ওর চিরস্থায়ী ভালোবাসা এতই স্পষ্ট যে, সুমনার কাছে ওর নিজের ভালোবাসা মনে হচ্ছে।

এতটুকু থেকে ওকে পেলেপুষে বড় করেছে তাইতা। সুন্দরী ছিল সে। ওদের আত্মা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও মিলিত হওয়ার জো ছিল না। বিক্ষত শরীরের কারণে পুরুষত্বহীনতার দরুণ ওর পক্ষে কোনওদিনই বন্ধু ও রক্ষাকারীর চেয়ে বেশি কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরেও সারা জীবন ওকে ভালোবেসেছেন উনি, মরণের পরেও থেমে নেই তা। মেয়েটাও বিনিময়ে ভালোবেসেছে ওকে। ওর কোলে মাথা রেখে মারা যাবার সময় লস্ত্রিস বলেছিল, এই জীবনে মাত্র দুজন পুরুষকে ভালোবেসেছি আমি, তুমি তাদের একজন। পরজন্মে দেবতারা হয়তো আমাদের ভালোবাসাকে আরও করুণার চোখে দেখবেন।

সুমনার কণ্ঠস্বর ভেঙে এল। দুটি মেয়ের চোখই অশ্রুতে টলমল করছে।

এর পর নেমে আসা নীরবতা ভঙ্গ করল তানসিদ। আমাকে সব খুলে বলল, সুমনা। সত্যিকারের ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর কিছু পৃথিবীতে নেই।

লস্ত্রিস মারা যাবার পর, ম্যাগাসের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কোমল কণ্ঠে বলল সুমনা, ওকে আলিঙ্গন করেন তাইতা। ওকে সমাধিতে শোয়ানোর আগে মাথা থেকে এক গাছি চুল কেটে নিয়েছিলেন তিনি, সোনার লকেটে ভরে রাখেন। সামনে ঝুঁকে তাইতার গলায় সোনালী চেইনে ঝোলানো লস্ত্রিসের মাদুলি স্পর্শ করল ও। দেখেছো আজও ওটা পরে আছেন উনি। এখনও ওর ফেরার অপেক্ষা করছেন।

কেঁদে ফেলল তানসিদ। ওর দুঃখে সমব্যথী হলো সুমনা। কিন্তু চোখের পানিতে সেটা ধুয়ে ফেলতে পারল না। নিপূণ কারিগরের পথে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ায় এখন এই ধরনের স্বস্তিকর মানবীয় দুর্বলতা পেছনে ফেলে এসেছে। দুঃখ সুখেরই ভিন্ন চেহারা। শোকাকুল হওয়াই মানুষের চরিত্র। তানসিদের পক্ষে এখনও কান্নার অবকাশ আছে।

*

মহা বর্ষাকাল শেষ হওয়া নাগাদ বিপদ কাটিয়ে উঠল তাইতা, অন্তর্চক্ষু নিয়ন্ত্রণ শিখে গেল ও। ওর এই নতুন ক্ষমতা সম্পর্কে এখন সবাই সজাগ। এক ধরনের অলৌকিক স্থিরতার বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে ও। ওর কাছে থাকাটাকে স্বস্তিকর আবিষ্কার করেছে মেরেন ও তানসিদ, কথা না বললেও ওর সঙ্গে ভালো লাগছে।

অবশ্য, সজাগ থাকার বেশির ভাগ সময়ই সুমনার সাথে কাটাচ্ছে তাইতা। মন্দির দ্বারে দিনের পর দিন বসে থাকে ওরা, অন্তর্চক্ষু দিয়ে সামনে দিয়ে যারা যায় তাদের জরিপ করে। ওদের চোখে প্রতিটি মানবদেহ নিজস্ব আভায় জ্বলজ্বল করছে, বদলে যাওয়া আলোর মেঘ প্রত্যেকের আবেগ, ভাবনা ও চরিত্র মেলে ধরছে ওদের সামনে। এইসব সঙ্কেত ব্যাখ্যা করার কায়দা তাইতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সুমনা।

রাত নেমে এলে সবাই যার যার ঘরে চলে গেলে মন্দিরের অন্ধকার ঘরে দেবী সরস্বতীর প্রতিমার মাঝে ঘেরাও হয়ে বসে সুমনা ও তাইতা, সারা রাত কথা বলে পার করে, এখনও উচ্চ মর্যাদার দীক্ষাপ্রাপ্তদের প্রাচীন তেনমাস ভাষা ব্যবহার করছে ওরা, যার মাথামুণ্ড কিছুই বোঝে না মেরেন বা তানসিদ। যেন ওরা বুঝে গেছে বিদায়ের ক্ষণ শিগগিরই হাজির হবে ওদের সামনে। হাতের সময়টুকুর প্রতিটি সেকেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে হবে ওদের।

তুমি কোনও আভা বিলোচ্ছ না? চূড়ান্ত আলোচনার সময় জানতে চাইল তাইতা।

আপনিও না, জবাব দিল সুমনা। কোনও মোহন্তই বিলোয় না। এটাই আমাদের পরস্পরের কাছে পরিচয় দেওয়ার নিশ্চিত উপায়।

তুমি আমার চেয়ে অনেক প্রাজ্ঞ।

প্রজ্ঞার জন্যে আপনার আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতা আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে যাওয়ায় আপনি কুশলীদের চূড়ান্ত অবস্থানের ঠিক আগের জায়গায় পৌঁছে গেছেন। এখন আপনি যেখানে আছেন, আর মাত্র একটি পর্যায় আছে এরপর। সেটা হচ্ছে দয়াময় অমরত্ব।

রোজই নিজেকে আরও শক্তিশালী বোধ করছি। আগের চেয়ে পষ্টভাবে আহ্বান শুনতে পাচ্ছি। একে উপেক্ষা করা যাবে না। তোমাদের ছেড়ে যেতেই হচ্ছে আমাকে।

হ্যাঁ, আমাদের সাথে আপনার অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সায় দিল সুমনা। আমাদের আর কখনও দেখা হবে না, তাইতা। দুঃসাহসই যেন আপনার সাথী হয়। অন্তর্চক্ষু আপনাকে পথ দেখাক।

*

পুকুর ধারের তাঁবুতে আস্ত্রাতা ও উ লুর সাথে ছিল মেরেন। দৃঢ় পদক্ষেপে নতাইতাকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে চট করে কাপড়ের দিকে হাত বাড়াল ওরা। পোশাক পরে নিল। তানসিদ রয়েছে ওর পাশে। এই প্রথম যেন তাইতার পরিবর্তনের মাত্রাটুকু ধরতে পারল ওরা। এখন আর বয়সের ভারে নুয়ে নেই ও, দীর্ঘ, ঋজু ভঙ্গি, শক্তিশালী। ওর মাথার চুল আর দাড়িতে এখনও রূপালি আভা থাকলেও আগের চেয়ে ঢের ঘন, ঝলমলে মনে হচ্ছে। ওর চোখজোড়া এখন আর ম্লান, আবছা নয়, বরং পরিষ্কার, স্থির। এমনকি ন্যূনতম কল্পনাপ্রবণ মেরেনও এইসব পরিবর্তন ধরতে পারছে। ছুটে গিয়ে তাইতার সামনে নত হলো ও। নিঃশব্দে ওর পা জড়িয়ে ধরল। ওকে তুলে আলিঙ্গন করল তাইতা। তারপর সামনে ধরে সতর্কভাবে যাচাই করল। মেরেনের আভা যেন গাঢ় কমলা রঙের, মরুর বুকে ভোরের মতো। সৎ যোদ্ধার আভা, বীর ও সত্যিকারের যোদ্ধা। তোমার অস্ত্রশস্ত্র নাও, সৎ মেরেন, কারণ এবার আমাদের বিদায় নিতে হচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে মাটির সাথে যেন সেঁটে রইল মেরেন। কিন্তু পরক্ষণে আস্ত্রাতার দিকে চোখ ফেরাল।

ওর আভা যাচাই করল তাইতা। তেলের লণ্ঠনের স্থির শিখার মতো, পরিষ্কার, নির্মল। কিন্তু সহসা শিখাটাকে কেঁপে উঠতে দেখল ও। তারপর বিদায়ের বেদনা কাটিয়ে উঠতেই ফের স্থির হয়ে গেল। ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মন্দিরের আবাসিক এলাকায় চলে গেল মেরেন, খানিক পরে ফিরে এল আবার। কোমরে সোর্ডবেল্ট বেঁধে নিয়েছে, বাম কাঁধে ঝুলছে তীর ধনুক। তাইতার বাঘের ছালের জোব্বা গোল করে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে।

মেয়েদের এক এক করে চুমু খেল তাইতা। তিন অপ্সরার নৃত্যরত আভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ও। উ লু রূপালি মেঘের আড়ালে আবৃত হয়ে গেছে, তাতে কাঁপা

সোনালি রঙের ছোপ, অনেক জটিল, আস্ত্রাতার আভার চেয়ে গভীর। কুশলীদের পথে আরও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে সে।

তানসিদের আভা মদের বাটিতে ভেসে বেড়ানো মূল্যবান তেলের পর্দার মতো মুক্তো যেন, বারবার রঙ আর ভাব বদলাচ্ছে, আলোর নক্ষত্র ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওর আত্মা মহান, মনটা খুবই ভালো। নিজেকে কখনও সুমনার বাঁশ–সূঁচের খোঁচার নিচে যেতে দেবে কিনা ভাবল তাইতা। ওকে চুমু খেল। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বলতর ঝলকে কেঁপে উঠল ওর আভা। অল্প কদিনের পরিচয়ে আত্মার অনেক কিছুই বিনিময় করেছে ওরা। মেয়েটা ওকে ভালোবেসে ফেলেছে।

তোমার নিয়তি পূরণ হোক, ওদের ঠোঁট বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় ফিসফিস করে বলল তাইতা।

আমি মন থেকে জানি আপনি আপনার নিয়তি পূরণ করবেন, ম্যাগাস, কোমল কণ্ঠে জবাব দিল সে। আপনার কথা কোনওদিন ভুলব না আমি। সহজাতভাবে ওর গলা জড়িয়ে ধরল। আহা, ম্যাগাস, আমি যদি…কী যে ইচ্ছে করছে…

জানি কী ইচ্ছে করছে। ভালোই হতো সেটা, আস্তে করে বলল তাইতা। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার সম্ভব নয়।

মেরেনের দিকে ফিরল ও। তুমি তৈরি?

আমি তৈরি, ম্যাগাস, বলল মেরেন। আপনি পথ দেখান, আমি আসছি।

*

উল্টোপথে এগোল ওরা। চূড়ার কাছে যেখানে চিরন্তন হাওয়া বিলাপ করে ফিরছে অসেখানে পাহাড়ে উঠে তারপর বিশাল পাহাড়ি পথের গোড়াতে হাজির হলো, সেপথ ধরে এগোল পশ্চিমে। সমস্ত বাঁক ও মোড়, প্রতিটি চড়াই, পাস ও বিপজ্জনক ফোর্ড মনে আছে মেরেনের, ফলে সঠিক পথের খোঁজ করতে গিয়ে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করল না ওরা, দ্রুত আগে বাড়ল। আবার একবাতানার হাওয়াখেলানো প্রান্তরে পৌঁছুল ওরা, বুনো ঘোড়ার বড় বড় পাল দাবড়ে বেড়ায় এখানে।

প্রথম আগ্রাসী হিকস্‌স বাহিনীর সাথে মিশরে আবির্ভাব ঘটার পর থেকেই অসাধারণ পশুগুলোর সাথে খাতির জমে গিয়েছিল তাইতার। শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ওগুলোকে বন্দি করে ও, ফারাও মামোসের জন্যে ওর নকশা করা রথে জুততে প্রথম দলটাকে পোশ মানায়। এই সেবার বিনিময়ে ওকে দশ সহস্র রথের প্রভু উপাধি দিয়েছিলেন ফারাও। ঘোড়ার প্রতি তাইতার ভালোবাসা অনেক দিনের পুরোনো।

ঘেসো প্রান্তর হয়ে যাবার পথে উঁচু কঠিন পাহাড়ী পথ বেয়ে নেমে আসার পর ঘোড়ার পালের মাঝে থাকবার জন্যে বিরতি দিল ওরা। ঘোড়ার পাল অনুসরণ করে একটা মলিন, বৈশিষ্ট্যহীন ল্যান্ডস্কেপের মুখোমুখি হলো। গোপন একটা উপত্যকা, পরিষ্কার মিষ্টি পানি বুকে নিয়ে প্রাকৃতিক ঝর্নার একটা ধারা বয়ে চলেছে ওটার পাশ দিয়ে। উন্মুক্ত প্রান্তরকে ক্ষয়ে দেওয়া চিরন্তন হাওয়া অবশ্য ছায়া ঢাকা জায়গাগুলোতে পৌঁছেনি, ঘাস এখানে সবুজ, রসালো। অনেক ঘোড়া দেখা যাচ্ছে এখানে। ওদের উপভোগ করতে ঝর্নার ধারে শিবির খাটাল তাইতা। ঘাসো মাটি দিয়ে একটা কুঁড়ে বানাল মেরেন। শুকনো গোবর জ্বালানি হিসাবে কাজে লাগাল ওরা। পুকুরে মাছ আর জলো ইঁদুরের ছড়াছড়ি। ফাঁদ পেতে ওগুলো ধরল মেরেন, ওদিকে ভেজা জমিনে খাবার উপযোগি শ্যাওলা আর শেকড়ের সন্ধান করল তাইতা। ওদের কুঁড়ের চারপাশে, ঘোড়াগুলো যাতে মাড়িয়ে না দেয়, এমন কাছাকাছি দূরত্বে সরস্বতীর মন্দির থেকে আনা কিছু বীজ ছড়িয়ে দিল ও। বেশ ভালো ফসল ফলাল। বিশ্রামে সুস্থ হয়ে উঠল ওরা, পরের কঠিন যাত্রার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করছে।

ঝর্নার কাছে ওদের উপস্থিতিতে ঘোড়াগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অচিরেই তাইতাকে কয়েক কদম কাছে আসার সুযোগ করে দিল ওরা, কিন্তু তারপরই মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। সদ্য পাওয়া অন্তর্চক্ষুর ক্ষমতায় প্রতিটি ঘোড়ার আভা নিরীখ করল ও।

নিচু জাতের প্রাণীদের ঘিরে রাখা আভা মানুষের আভার মতো তীব্র না হলেও সুস্থ ও শক্তিশালী এবং পেশল ও হৃদয়বান ঘোড়াগুলোকে আলাদা করতে পারল ও। ওদের মেজাজ আর অবস্থাও যাচাই করল। কোনগুলো মাথা গরম, বা বেপরোয়া আর কোনগুলো কোমল ও বশ মানানোর উপযোগী সেটা স্থির করা গেল। বাগানের গাছগুলোর বড় হতে কয়েক সপ্তাহ সময় নিল। এই সময় পাঁচটা পশুর সাথে পরীক্ষামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলল ও। সবকটাই উন্নত বুদ্ধিমত্তা, শক্তি ও আন্তরিক মানসিকতার। ওগুলোর তিনটে মাদী ঘোড়া, বাচ্চাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে পায়ের কাছে। বাকি দুটো বাচ্চা, এখনও স্ট্যালিয়নগুলোর সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে বটে কিন্তু লাথি হাঁকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে ওদের আগে বাড়া ঠেকাচ্ছে। একটা বিশেষ বাচ্চা ঘোড়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করছে তাইতা।

ছোট্ট পালটাও ওর মতো আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে। ওদের কবল থেকে বাগান বাঁচাতে মেরেনের দেওয়া বেড়ার কাছে ঘুমাচ্ছে ওরা। ব্যাপারটা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে মেরেনকে। মেয়ে মানুষদের চেনা আছে আমার, ওই কুটিল মাদীগুলো বিশ্বাস করতে পারছি না। সাহস সঞ্চয় করছে ওরা। একদিন সকালে উঠে দেখব আমাদের বাগানের আর কিছুই বাকি নেই। বেশির ভাগ সময়ই বেড়াটাকে আরও মজবুত করা আর আগ্রাসীভাবে পাহারা দেওয়ার পেছনে ব্যয় করছে ও।

তাইতাকে ফসলের অংশ কাঁচা সীমের খানিকটা একটা ব্যাগে ভরে সেগুলো পটের কাছে আনার বদলে ছোট্ট পালটা যেখানে বসে আগ্রহের সাথে জরিপ করছিল সেখানে নিয়ে যেতে দেখে রীতিমতো ভীত হয়ে উঠল মেরেন। নিজের জন্যে পছন্দ করা বাচ্চা ঘোড়াটা ধোঁয়াটে ধূসর ছোপঅলা ক্রিম রঙা। তাইতাকে আগের চেয়ে ঢের কাছে যাবার সুযোগ দিল ওটা, দুই কান খাড়া করে ওর আদুরে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। অবশেষে তার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে গেল ও। মাথা নেড়ে দৌড়ে পালাল ওটা। থেমে পিছু ডাকল ওঃ তোমার জন্যে একটা উপহার ছিল, প্রিয়তমা। মিষ্টি মেয়ের জন্যে মিষ্টি। ওর কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা। মুঠো ভর্তি সীম বাড়িয়ে ধরল তাইতা। ঘাড়ের উপর দিয়ে ওর দিকে তাকাল ঘোড়াটা। চোখ পাকাল, চোখের পাতার গোলাপি কিনারা বেরিয়ে পড়ল। সীমের গন্ধ শুঁকতে নাক ফোলাল তারপর।

হ্যাঁ, সুন্দরী জানোয়ার, স্রেফ গন্ধ শুকো। কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবে আমাকে?

নাক দিয়ে একটা শব্দ করল ঘোড়াটা, সিদ্ধান্তহীনতায় মাথা দোলাল।

আচ্ছা, ঠিকাছে। নিতে না চাইলে মেরেন খুশি হয়েই নিজের পটে রাখবে এগুলো। বেড়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল ও। কিন্তু এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। গভীর মনোযোগের সাথে পরস্পরকে মাপল ওরা। ওর দিকে এক পা বাড়াল ঘোড়াটা। আবার থমকে দাঁড়াল। মুখের কাছে হাত এনে একটা সীম দাঁতের ফাঁকে রেখে মুখ খোলা রেখে চিবুল তাইতা। কি যে মজা বলে বোঝাতে পারব না, ওকে বলল ও। অবশেষে হার মানল ওটা। কাছে এসে নিপূণভাবে বাটির মতো করে ধরা হাত থেকে সীম তুলে নিল। মখমলের মতো নাকটা, নিঃশ্বাসে লেগে আছে নতুন ঘাসের গন্ধ। তোমাকে কী নামে ডাকব? ওকে জিজ্ঞেস করল তাইতা। তোমার সৌন্দর্যের সাথে মানানসই হতে হবে। আহ! তোমার উপযুক্ত নাম পেয়েছি। তোমার নাম হবে উইন্ডস্মোক।

পরের সপ্তাহগুলোয় জমিতে নিড়ানি দিল তাইতা ও মেরেন। তারপর পাকা সীম তুলে জলো ইঁদুরের চামড়ায় বানানো বস্তায় তুলে রাখল। রোদ-হাওয়ায় লতা শুকিয়ে বান্ডিল বানাল। বেড়ার উপর দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াগুলো, তাইতার দেওয়া সীমের লতা চিবুচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় শেষবারের মতো উইন্ডস্মোককে একমুঠো সীম দিয়ে ওটার ঘাড়ে হাত তুলে কেশরে বিলি কাটল তাইতা, মৃদু স্বরে কথা বলল ওটার সাথে। তারপর কোনওরকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই টিউনিকের স্কার্ট তুলে হাড়জিরজিরে পায়ে ওটার পিঠে চেপে বসল। মহাবিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল ঘোড়াটা, কাঁধের উপর দিয়ে দেখছে তাইতাকে, চোখজোড়া চিকচিক করছে। পায়ের আঙুলে ওটাকে গুঁতো দিল তাইতা, পশুটা এগোতে শুরু করল, ওদিকে মহা আনন্দে চিৎকার ছেড়ে হাত তালি দিল মোরেন।

ওরা পুকুর পারের শিবির ত্যাগ করার সময় উইন্ডস্মোকের পিঠে রইল তাইতা, মেরেন চালাচ্ছে অন্য একটা পুরোনো মেয়ার। ওদের মালসামান পিছনে মাস ঘোড়াগুলোর পিঠে বোঝাই করা।

এভাবে বিদায় নেওয়ার সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারল ওরা। কিন্তু গালালায় পৌঁছালো যখন, ততদিনে সাত বছর পার হয়ে গেছে। ওদের ফেরার খবর রাষ্ট্র হওয়ামাত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল গোটা শহরে। নগরবাসীরা অনেক আগেই ধরে নিয়েছিল ওরা মরে গেছে। সবাই যার যার পরিবার নিয়ে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে হাজির হলো। ওদের সম্মান দেখাতে ছোটখাট উপহার রয়েছে সবার কাছে। ওদের দূরে থাকার সময় অধিকাংশ বাচ্চাই বেড়ে উঠেছে। অনেকের বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চাদের আদর করল তাইতা, আশীর্বাদ করল।

কাফেলা চালকদের কল্যাণে ওদের প্রত্যাবর্তনের খবর মিশরের বাকি অংশে দ্রুত রাষ্ট্র হয়ে গেল। অচিরেই ফারাও নেফার সেতি আর রানি মিনতাকার বার্তাবাহকরা হাজির হলো থেবসের দরবারে। পাঠানো সংবাদে তেমন খুশির কিছু নেই: প্রথমবারের মতো রাজ্যে আবির্ভূত প্লেগের সংবাদ কানে এলো তাইতার। যত তাড়াতাড়ি পারো, চলে এসো, প্রাজ্ঞ, নির্দেশ দিয়েছেন ফারাও। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন।

আইসিসের নতুন চাঁদ উঠলেই আসব আমি, জবাব দিল তাইতা। ইচ্ছে করে অবাধ্যতা দেখাচ্ছে না ও, জানে ফারাওকে পরামর্শ দেওয়ার মতো আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি এখনও নেওয়া হয়নি ওর। বুঝতে পারছে, এই প্লেগ আসলে শ্রদ্ধেয় মাতা সুমনার আশঙ্কিত মহা অমঙ্গলের প্রকাশ, যার জন্যে ওকে সতর্ক করে দিয়েছিল সে। অন্তর্চক্ষুর অধিকারী হলেও এখনই মিথ্যার শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে না ও। অবশ্যই লক্ষণ বিচার করতে হবে ওকে, যাচাই করতে হবে, তারপর নিজের আধ্যাত্মিক সম্পদ একত্রিত করতে হবে। সহজাত প্রবৃত্তির জোরে ও জানে গালালায় ওর জান্যে নির্দেশনা আসবে, সেজন্যে অপেক্ষাও করতে হবে।

কিন্তু অনেক রকম বাধা আর বিচ্যুতি দেখা গেল। অচিরেই আগন্তুকদের আগমন ঘটতে শুরু করল, তীর্থযাত্রী ও ভিখিরির দল ভিখ মাঙতে শুরু করল, পঙ্গু আর অসুস্থরা এলো রোগমুক্তির আশায়। রাজণ্যদের দূতরা সাথে করে বিপুল উপহার নিয়ে এলেন, ভবিষ্যদ্বাণী ও ঐশী নির্দেশনা চাইলেন তাঁরা। আগ্রহের সাথে ওদের আভা বিচার করল তাইতা। আশা করল ওদের ভেতর ওর কাক্ষিত জন আছে। বারবার হতাশ হতে হলো, উপহারসহই ফেরত পাঠাল ওদের।

আমাদের কি কিছু খাজনা রেখে দেওয়া উচিত ছিল না, ম্যাগাস? আবেদন জানাল মেরেন। আপনি পবিত্র পুরুষে পরিণত হলেও তো খাবারের দরকার হবে, তাছাড়া আপনার টিউনিকও তো ন্যকড়ায় পরিণত হয়েছে। আমারও একটা নতুন ধনুক দরকার হয়ে পড়েছে।

মাঝে মাঝে হয়তো কোনও অতিথি ক্ষীণ আশা জাগিয়ে তুলছে, যখন আভার জটিলতা চিনতে পারছে ও। ওরা প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সন্ধানী, ম্যাজাইদের ভ্রাতৃসংঘের মাঝে ওর খ্যাতি জেনে হাজির হচ্ছে। কিন্তু ওরা ওর কাছে নিতে আসছে, কারওই ওর ক্ষমতার সাথে তাল মেলানোর ক্ষমতা বা বিনিময়ে কিছু দেওয়ার নেই। তারপরেও ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও, প্রতিটি কথা যাচাই করছে। তাৎপর্যপূর্ণ তেমন কিছুই নেই, তবু অনেক সময় কোনও বিক্ষিপ্ত মন্তব্য বা ভুল মতামত সঠিক পথে নিয়ে আসছে ওর মনকে। ওদের ভুলের ভেতর দিয়ে বিপরীত ও সঠিক উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছে ও। কশ্যপ ও সুমনার সতর্কবাণী সর্বক্ষণ মাথায়। রয়েছে ওর, আসন্ন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্যে ওর সর্বশক্তি, প্রজ্ঞা আর বুদ্ধির দরকার হবে।

*

মিশর থেকে এসে লোহিত সাগর তীরবর্তী পাহাড়ী বুনো সাগাফাগামী কাফেলা নিয়মিত মিশর মাতার খবর বয়ে আনছে। এমনি আরেকটা কাফেলা পৌঁছানোর পর কাফেলার সর্দারের সাথে আলাপ করতে মেরেনকে পাঠাল তাইতা। বিখ্যাত ম্যাগাস তাইতার আস্থাভাজন জানা থাকায় ওর সাথে সম্মানের সাথে ব্যবহার করল সবাই। সেদিন সন্ধ্যায় শহর থেকে ফিরে ও জানাল, কাফেলার বণিক ওবেদ তিন্দালি মহাদেবতা হোরাসের কাছে প্রার্থনার সময় তার নাম মনে রাখার আবেদন জানিয়েছে। সুদূর ইথিওপিয়া থেকে সবচেয়ে ভালো মানের কফির দরাজ উপহার পাঠিয়েছে আপনার কাছে, কিন্তু আপনাকে এখন নিজেকে স্থির করার জন্যে সাবধান করে দিচ্ছি, ম্যাগাস, কেননা ডেল্টা থেকে আপনার জন্যে স্বস্তিকর কোনও খবর বয়ে আনেনি সে।

চোখের আড়ালে খেলে যাওয়া শঙ্কা লুকোতে মুখ নিচু করল বুড়ো মানুষটা। এরই মধ্যে যেসব খবর পেয়েছে তার চেয়ে খারাপ সংবাদ আর কী হতে পারে? আবার মুখ তুলে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে কথা বলল ও। আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। না মেরেন। কিছুই লুকিয়ো না। নীল নদের বান শুরু হয়ে গেছে?

এখনও হয়নি, মৃদু কণ্ঠে, বিষণ্ণ সুরে জবাব দিল মেরেন। এই নিয়ে বিনা বন্যায় সাত বছর কেটে যাচ্ছে।

তাইতার কঠিন অভিব্যক্তি বদলে গেল। বন্যা আর দক্ষিণ থেকে বয়ে আসা উর্বর পলিমাটি ছাড়া মিশর দুর্ভিক্ষ, পঙ্গপাল ও মরণের ফাঁদে পড়বে।

ম্যাগাস, খবরটা আমার দুঃখ যারপরনাই বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আরও খারাপ খবর বাকি আছে এখনও, বিড়বিড় করে বলল মেরেন। নীল নদের যেটুকু পানি অবশিষ্ট ছিল সেটা রক্ত হয়ে গেছে।

ওর দিকে চেয়ে রইল তাইতা। রক্ত! পুনরাবৃত্তি করল ও। বুঝলাম না!

ম্যাগাস, এমনকি নদীর শুকিয়ে যাওয়া পুকুরগুলো পর্যন্ত গাঢ় লাল হয়ে গেছে, পচা লাশের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, বলল মেরেন। মানুষ বা পশু কেউই ওই পানি মুখে তুলতে পারছে না। ঘোড়া, গরু আর ছাগলগুলো তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছে। নদীর কিনারে সার বেধে পড়ে আছে ওদের মরদেহ।

প্লেগ ও ভোগান্তি! সময়ের আদিতেও এমন কিছু কখনও কেউ কল্পনা করেনি, ফিসফিস করে বলল তাইতা।

কিন্তু এটা কেবল একটামাত্র প্লেগ নয়, ম্যাগাস, গোঁয়ারের মতো বলে চলল মেরেন। নীলের রক্তাক্ত পুকুর থেকে কুকুরের মতো বিশাল আর ক্ষিপ্র কাঁটাঅলা ব্যাঙ উঠে এসেছে। ওদের বিষাক্ত শরীর ঢেকে রাখা ফুসকুড়ি থেকে দুর্গন্ধময় বিষ চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে। মড়া পশুগুলো খেয়ে নিচ্ছে ওরা। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। লোকে বলছে, মহান হোরেস যেন ক্ষমা করেন, দানবগুলো বাচ্চা আর বয়স্ক দুর্বল লোক, আর যাদের নিজেদের বাঁচানোর ক্ষমতা নেই, তাদেরও আক্রমণ করছে। আর্তনাদ ছেড়ে মোচড় খাওয়ার সময়ই গিলে নিচ্ছে ওদের। থেমে লম্বা শ্বাস নিল মেরেন। কী ঘটছে এই দুনিয়ায়? আমাদের উপর একি ভয়ানক অভিশাপ নেমে এলো, মহান ম্যাগাস?

ওদের একসাথে থাকার দশকগুলোয়, সেই ক্ষমতাদখলকারীদের বিরুদ্ধে মহান লড়াইয়ের সময় থেকে, নেফার সেতির উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত সিংহাসনে আরোহণের কাল থেকেই বরাবর তাইতার পাশে ছিল মেরেন। তাইতার দত্তক ছেলে ও, ওর ছেটে ফেলা পৌরুষ থেকে কোনওদিনই ওর পক্ষে জন্ম নেওয়া সম্ভব হতো না। না, মেরেন ওর কাছে সন্তানের চেয়েও বেশি, বুড়ো মানুষটার প্রতি ওর ভালোবাসা রক্তের বাঁধনও অতিক্রম করে গেছে। এখন ওর নিজস্ব দুর্দশা সবকিছু আচ্ছন্ন করে রাখলেও ওকে বিচলিত হতে দেখে আলোড়িত হলো তাইতা।

আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশে, আমাদের ভালোবাসার মানুষজনের কপালে, আমাদের প্রিয় রাজার ভাগ্যে, কেন এমন হচ্ছে? আবেদন ঝরে পড়ল মেরেনের কণ্ঠে।

মাথা নাড়ল তাইতা, অনেকক্ষণ নীরব রইল। তারপর সামনে ঝুঁকে মেরেনের বাহু স্পর্শ করল।দেবতারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, বলল ও।

কেন? লেগে রইল মেরেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন শঙ্কায় বলতে গেলে ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেছে এই মহাবীর যোদ্ধা ও সামনের কাতারের সঙ্গীটি। কী অন্যায় হয়েছে?

আমরা মিশরে ফেরার পর থেকে মনে মনে এই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজে ফিরছি। উৎসর্গ করেছি, লক্ষণের আশায় আকাশের আনাচে-কানাচে খোঁজ করেছি। কিন্তু ওদের ঐশী ক্ষোভের কারণ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। যেন ঘৃণায় ভরা সত্তায় ঢাকা পড়ে গেছে।

ফারাও ও মিশরের স্বার্থে, আমাদের স্বার্থে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতেই হবে, ম্যাগাস। আকুতি জানাল মেরেন। কিন্তু আর কোথায় খোঁজ করা বাকি আছে?

অচিরেই জবাব পেয়ে যাব, মেরেন। দৈবজ্ঞ আগেই এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। অপ্রত্যাশিত কোনও বার্তাবাহক নিয়ে আসবে খবরটা-হয়তো মানুষ বা দাবো, কোনও পশু বা দেবতা। সম্ভবত আকাশের বুকে তারার হরফে লেখা কোনও লক্ষণ হিসাবে দেখা দেবে। তবে এই গালালাতেই আমার কাছে আসবে উত্তরটা।

কখন, ম্যাগাস? এরই মধ্যে কি যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়নি?

সম্ভবত আজ রাতেই।

*

ক্ষিপ্রতার সাথে উঠে দাঁড়াল তাইতা। অনেক বয়স হলেও তরুণের মতোই মনড়াচড়া করতে পারে। ওর ক্ষিপ্রতা ও সজীবতা সব সময়ই মেরনকে বিস্মিত করে আসছে। এমনকি এতগুলো বছর ওর সাথে কাটানোর পরেও। টেরেসের কোণ থেকে ছড়িটা তুলে নিল তাইতা, হালকাভাবে ওটার উপর ভর দিয়ে সিঁড়ির নিচে গিয়ে উঁচু মিনারের দিকে তাকাল। গ্রামবাসীরা ওর জন্যেই বানিয়েছে ওটা। গালালা গ্রামের সবাই শ্রম দিয়েছে। বুড়ো ম্যাগাসের প্রতি ওদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার লক্ষযোগ্য প্রমাণ। শহরকে পুষ্টিতে ভরে তোলা ঝর্নার মুখ খুলে দিয়েছিল ও, নিজস্ব জাদুর অদৃশ্য কিন্তু জোরাল শক্তিতে ওদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে।

মিনারের বাইরের দিকে এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে তাকাল তাইতা; ধাপগুলো সরু, দুপাশ খোলা, রক্ষা করার জন্যে রেইলিং নেই। আইবেক্সের মতো উঠে গেল ও, পায়ের দিকে তাকাচ্ছে না। পাথরে মৃদু আওয়াজ তুলছে ওর ছড়ির ডগা। চূড়ার প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে রেশমী প্রার্থনার গালিচায় পুব দিকে ফিরে বসল ও। ওর পাশে রূপার একটা ফ্লাস্ক রাখল মেরেন। তারপর তাইতার প্রয়োজনে চট করে সাড়া দেওয়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে ওর পেছনে বসল, তবে এত কাছে নয় যে ম্যাগাসের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হবে।

ফ্লাস্কের শিংয়ের ছিপি খুলে তীব্র তেতো এক চুমুক তরল খেল তাইতা। ধীরে ধীরে গিলল, পেট থেকে শরীরের প্রতিটি পেশিতে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়া টের পাচ্ছে। স্ফটিকের মতো ঔজ্জ্বল্যে ভরিয়ে দিচ্ছে ওর মনটাকে। মৃদু শ্বাস নিল ও। তরলের কোমল প্রভাবে আত্মার অন্তর্চক্ষু খোলার সুযোগ করে দিল।

দুরাত আগে বুড়ো চাঁদটাকে গিলে নিয়েছে রাতের দানব। এখন আকাশটা তারার দখলে। অবস্থান অনুযায়ী তারাগুলো ফুটে ওঠার সময় খেয়াল রাখল তাইতা। সবচেয়ে উজ্জ্বল ও শক্তিশালী তারাটা রয়েছে সবার আগে। অচিরেই হাজার হাজার তারা উঠে গোটা আকাশ ভরে ফেলল, রূপালি আভায় ভাসিয়ে দিল মরুভূমি। জীবনভর তারা পর্যবেক্ষণ করেছে তাইতা। ভেবেছিল তারা সম্পর্কে যা কিছু জানার, বোঝার তার সবই ওর জানা বা বোঝা হয়ে গেছে; কিন্তু এখন ওর অন্তর্চক্ষু দিয়ে নতুন উপলব্ধি এবং বস্তুর চিরন্তর পরিকল্পনায় মানুষ ও দেবতাদের কর্মকাণ্ডে ওদের অবস্থান সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি গড়ে তুলছে ও। একটা বিশেষ উজ্জ্বল নক্ষত্রকে সাগ্রহে আলাদা করে নিল ও। জানে, ওর বসার জায়গা থেকে ওটাই সবচেয়ে কাছে। তারাটাকে দেখামাত্র উল্লসিত হয়ে উঠল ওর সমস্ত ইন্দ্রিয়: সেদিন সন্ধ্যায় তারাটা যেন সরাসরি মাথার উপর ঝুলে আছে বলে মনে হলো।

এই তারাটা রানি লস্ত্রিসকে মমি করার ঠিক নব্বই দিন পর, যেরাতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেরাতে আবির্ভূত হয়। ওটার আবির্ভাব ছিল অলৌকিক ঘটনা। মারা যাবার আগে লস্ত্রিস আবার ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করেছিল ওর কাছে, ওর দৃঢ় বিশ্বাস জাগল ওই তারাটিই রানির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ওকে কখনওই ছেড়ে যায়নি সে। এতগুলো বছর ওর নক্ষত্র ছিল ওর ধ্রুবতারা। ওটার দিকে তাকালেই রানির মৃত্যুর পর ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলা নিঃসঙ্গতা দূর হয়ে যায়।

এখন অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাকাতেই লখ্রিসের তারার চারপাশে ওর আভা লক্ষ করল ও। অন্যান্য মহাজাগতিক কাঠামোর তুলনায় বেশ ছোট হলেও স্বর্গীয় আর কোনও বস্তুই ওটার ঔজ্জ্বল্যের সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। লস্ত্রিসের জন্যে নিজের ভালোবাসা অবিরাম, হ্রাসহীনভাবে বয়ে যাওয়া অনুভব করল তাইতা, ওর আত্মাকে উষ্ণ করে তুলেছে। সহসা সতর্কতায় ওর গোটা দেহ আড়ষ্ট হয়ে গেল, শিরা উপশিরা হয়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে ধেয়ে গেল একটা শীতল অনুভূতি।

ম্যাগাস! ওর মেজাজের পরিবর্তন টের পেয়ে গেল মেরেন। কী হয়েছে? তাইতার কাঁধ আঁকড়ে ধরল সে। তলোয়ারের বাটের উপর অন্য হাত। কষ্টের ভেতর কথা বলতে না পেরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিল তাইতা, শূন্যে তাকিয়ে রইল।

শেষবার চোখ রাখার পর মাঝের সময়টুকুতে স্বাভাবিক আকারের চেয়ে কয়েক গুন স্ফীত হয়ে উঠেছে লস্ত্রিসের তারা। এক কালের উজ্জ্বল, অবিরাম আভা এখন মিটমিটে হয়ে গেছে, ওটার বিচ্ছুরণ যেন পরাস্ত সেনাদলের তাঁবুর মতো বেহাল অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। দেহ বিকৃত হয়ে গেছে, প্রান্তগুলো ফাঁপা, মাঝখানে দুমড়ে গেছে।

এমনকি মেরেনও পরিবর্তনটা ধরতে পারল। আপনার তারা! একটা কিছু হয়েছে ওটার। এর মানে কী? তাইতার কাছে ওটার গুরুত্ব জানে ও।

বলতে পারব না, ফিসফিস করে বলল তাইতা। আমাকে এখানে রেখে যাও, মেরেন। নিজের গালিচায় ফিরে যাও। আমার এখন মনোযোগ নষ্ট হওয়া চলবে না। ভোরে আমাকে নিতে এসো।

সূর্য ওঠার পর তারাটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত লক্ষ রাখল তাইতা। ওকে টাওয়ার থেকে নিয়ে যেতে এল মেরেন। লস্ত্রিসের তারাটার মরণ যাত্রার কথা জানে ও।

রাতের দীর্ঘ জাগরণের ফলে ক্লান্ত হলেও ঘুমাতে পারেনি ও। মৃত্যুপথযাত্রী নক্ষত্রের ইমেজ ওর মনটা ভরে রেখেছে, অন্ধকার, আকারহীন দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খেয়েছে ওকে। এটা ছিল অশুভের সবশেষ ও সবচেয়ে মারাত্মক প্রকাশ। প্রথমে মানুষ আর পশু ঘাতক প্লেগের আক্রমণ, এবার তারাদের ধ্বংসকারী ভয়ানক এই বৈরিতা। পরের রাতে টাওয়ারে ফিরল না তাইতা, তার বদলে সান্ত্বনার আশায় একাই মরুভূমিতে গেল। গুরুকে অনুসরণ না করার নির্দেশ থাকলেও দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিল মেরেন। অবশ্য তাইতা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে জাদুর মায়ায় নিজেকে আড়াল করে ফাঁকি দিল। গুরুর নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্ষিপ্ত, শঙ্কিত মেরেন সারা রাত খোঁজ করে বেড়াল। ভোরে অনুসন্ধানী দল গঠন করতে গালালায় ফিরে প্রাচীন মন্দিরের সিঁড়িতে তাইতাকে নিংসঙ্গ বসে থাকতে দেখতে পেল ও।

আমাকে হতাশ করলে, মেরেন। দায়িত্ব অবহেলা করে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো তোমাকে মানায় না, ওকে ভর্ৎসনা করল সে। এখন কি আমাকে উপোস রাখতে চাও তুমি? তোমার নতুন কাজের মেয়েটাকে তলব করো, আশা করো সুন্দর চেহারা তার রান্নার বারটা বাজায়নি।

সেদিন দিনের বেলায় ঘুমাল না ও, টেরেসের কিনারায় ছায়ায় বসে রইল। সন্ধ্যার খাবার শেষ হলে আরও একবার মিনারে উঠে গেল। সূর্যটা দিগন্তের মাত্র এক আঙুল নিচে, কিন্তু যখন তারাগুলো ওর চোখে ধরা দিতে শুরু করবে, অন্ধকারের একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি নয় ও। চোরের মতো দ্রুত ও নিঃশব্দে রাত নামল। তীক্ষ্ণ চোখে পুবে তাকাল তাইতা। রাতের আকাশের অন্ধকার হয়ে আসা খিলানে একে একে দেখা দিতে শুরু করেছে তারাগুলো। ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সহসা ওর মাথার উপর উদয় হলো দিল লস্ত্রিসের তারা। গ্ৰহপুঞ্জের সারিতে নিজের অবস্থান স্থির রেখেছে দেখে বিস্মিত হলো ও। গালালার মিনারের মাথার উপর লণ্ঠনের কম্পিত শিখার মতো ঝুলে আছে এখন।

এখন আর তারা নেই ওটা। শেষবার ওটায় চোখ রাখার পর অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একটা ভীষণ মেঘে বিস্ফোরিত হয়েছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। গাঢ়, অশুভ বাষ্প বের হয়ে আসছে চারপাশ থেকে। মাথার উপর গোটা আকাশকে আলোকিত করে তোলা বিশাল আগুনে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

অপেক্ষা করল তাইতা, দীর্ঘ অন্ধকার মুহূর্ত জুড়ে লক্ষ করতে লাগল। ওর মাথার উপরের অবস্থান থেকে নড়ল না তারাটা। সূর্যোদয়ের সময়ও একই জায়গায় রইল ওটা। রাতের পর বিরাট আলোকবর্তিকার মতো আকাশের বুকে স্থির হয়ে রইল তারাটা, নির্ঘাৎ স্বর্গের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওটার অলৌকিক আলো। ওটাকে ঘিরে রাখা ধ্বংসের মেঘ একবার বাড়ছে আবার কমছে। কেন্দ্রে ঝলসে উঠছে আগুন। তারপর মরে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ফের আরেক জায়গায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে।

ভোরে প্রাচীন মন্দিরে হাজির হলো শহরবাসীরা। হাইপোস্টাইল হলের বিশাল বিশাল কলামের ছায়ায় ম্যাগাসের কথা শুনতে অপেক্ষা করতে লাগল। তাইতা টাওয়ার থেকে নেমে এলে ঘিরে ধরল ওকে। ওদের শহরের উপর কুলন্ত বিশাল আগ্নেয় বিস্ফোরণের ব্যাখ্যার আবেদন জানাল। হে মহান ম্যাগাস, এটা কি আরেকটা প্লেগের আগাম লক্ষণ? দয়া করে এই ভীষণ কুলক্ষণের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন। কিন্তু ওদের স্বস্তি দেওয়ার মতো কিছুই বলতে পারল না ও। ওর গবেষণা লস্ত্রিসের তারার এমনি অস্বাভাবিক আচরণের জন্যে তৈরি করেনি ওকে।

নতুন চাঁদ আবার ভরে উঠল, বিস্ফোরিত নক্ষত্রের ভীতিকর ইমেজ কোমল করে তুলল ওটার আলো। কিন্তু আবার ওটা ক্ষয়ে যাবার পর ফের আকাশে আধিপত্য বিস্তার করল লস্ত্রিসের তারা। এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে যে অন্য তারাগুলোকে ওটার পাশে তুচ্ছ ঠেকল। যেন ওটার আলোতে আকৃষ্ট হয়েই দক্ষিণ থেকে ধেয়ে এল পঙ্গপালের ঝাক, নেমে এল গালালার বুকে। দুদিন থাকল ওগুলো, সেচের জমি তছনছ করে দিল, ধুরা ভুট্টার একটা কণা বা জলপাই গাছের ডালে একটা পাতাও অবশিষ্ট রইল না। ওদের ঝাঁকের ভারে ডালিম গাছের ডাল নুয়ে পড়ল, ভেঙে পড়ল তারপর। তৃতীয় দিন সকালে এক বিশাল সীমাহীন মেঘের আকারে আকাশে ভাসল, উড়ে গেল পশ্চিমে নীলের দিকে: নীল নদের বান না ডাকায় ইতিমধ্যে মরণোন্মুখ দেশের উপর আরও গজব নামাবে বলে।

গোটা মিশর ভীত, হতাশায় মুষড়ে পড়ল দেশের লোকজন।

*

এরপর আরেকজন অতিথি এলেন গালালায়। রাতের বেলায় হাজির হলেন নতিনি, কিন্তু লস্ত্রিসের তারাটা তেলের কুপির শেষ শিখার মতো এমন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল যে অনেক দূরে থাকলেও তাইতাকে কাফেলা দেখাতে পারছিল মেরেন।

বহুদূরের দেশ থেকে আসছে ওই মালবাহী পশুগুলো, মন্তব্য করল মেরেন। উট মিশরের প্রাণী নয়, এখনও ওর উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার মতো বিরল জিনিস। ক্যারাভান রুট ধরে আসেনি ওরা, এসেছে সোজা মরুভূমির উপর দিয়ে। গোটা ব্যাপারটাই অদ্ভুত। ওদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আমাদের।

ইতস্তত না করে সোজা মন্দিরের উদ্দেশে এগিয়ে এলো বিদেশী পর্যটকের দল। যেন কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। উট চালকরা ওদের পশু বাঁধল। তারপর শিবির খাটানোর স্বাভাবিক শোরগোল শুরু হলো।

ওদের কাছে যাও, নির্দেশ দিল তাইতা।দেখ কী জানতে পারো।

সূর্য বেশ উপরে উঠে আসার আগে ফিরল না মেরেন। মোট বিশজন পুরুষ রয়েছে ওখানে, সবাই চাকর বাকর। বলছে আমাদের কাছে আসতে নাকি বিশ মাস ধরে চলার উপর আছে ওরা।

ওদের নেতা কে? তার সম্পর্কে কী জানতে পেরেছ?

তার দেখা পাইনি। বিশ্রাম নিতে চলে গেছেন তিনি। শিবিরের মাঝখানের তাবুটাই তাঁর। সেরা উল দিয়ে বানানো। দলের সবাই অনেক শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে তার কথা বলে।

কী নাম তার?

জানি না। ওকে স্রেফ হিতামা বলছে ওরা, ওদের ভাষায় এর মানে মহান জ্ঞানী।

এখানে কী চান?

আপনাকে, ম্যাগাস। আপনার কাছেই এসেছেন। ক্যারাভান সর্দার নাম ধরে আপনার খোঁজ করছিল।

সামান্য বিস্মিত হয়েছে মাত্র তাইতা। আমাদের কাছে কী খাবার আছে? এই হিতামা নামের লোকটাকে ঠিক মতো আপ্যায়ন করতে হবে।

পঙ্গপাল আর খরার পর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার কাছে কিছু ঝলসানো মাছ আর লোনা পিঠা বানানোর মতো যথেষ্ট ভূট্টা আছে।

গতকাল যোগাড় করা ব্যাঙের ছাতাগুলোর কী হলো?

পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে এখন। গ্রামে হয়তো একটা কিছু মিলতে পারে।

না, বন্ধুদের আর ঝামেলায় ফেলো না। এমনিতেই ওদের জীবন বেশ কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের যা আছে তাতেই কাজ সারব। শেষমেষ অতিথির ঔদার্যের কল্যাণে রক্ষা পেল ওরা। ওদের সাথে সন্ধ্যার খাবারে অংশ নিতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন হাতিমা, কিন্তু চমৎকার একটা উটসহ ফেরত পাঠালেন তিনি মেরেনকে। পরিষ্কার বোঝা গেল এখানকার জনগণ দুর্ভিক্ষে কেমন কষ্ট পাচ্ছে তার স্পষ্ট ধারণা রাখেন তিনি। পশুটা জবাই করে সিনার মাংসের রোস্ট বানালো মেরেন। ওটার বাকি অংশ হিতামার ভৃত্য ও শহরের বেশিরভাগ লোকজনের খাবার হিসাবে যথেষ্ট হবে।

মন্দিরের ছাদে অতিথির জন্যে অপেক্ষায় রইল তাইতা। লোকটা কে হতে পারে জানতে কৌতূহল হচ্ছে। পদবী থেকে বোঝা যাচ্ছে ম্যাগাইদের একজন। কিংবা হয়তো অন্য কোনও প্রাজ্ঞ গোত্রের প্রধান পুরোহিত। ওর মন বলছে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু প্রকাশ পাবে ওর কাছে।

ইনি কি তবে ভবিষ্যদ্বাণীর সেই বার্তাবাহক, যার জন্যে এতদিন অপেক্ষায় আছি? ভাবল ও। তারপর মেহমানকে নিয়ে প্রশস্ত পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে মেরেনের উঠে আসার শব্দ পেয়ে নড়ে চড়ে বসল ও।

তোমাদের গুরুর দিকে লক্ষ রেখ। সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে, বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাহকদের বলল মেরেন। অবশেষে ছাদে পৌঁছাল ওরা। তাইতার তক্তপোষের কাছেই পর্দা ঢাকা হাওদা নামাতে সাহায্য করল ওদের। তারপর ওদের দুজনের মাঝখানে টেবিলে ডালিমের গন্ধঅলা শরবতের একটা রূপালি বাটি আর দুটো খাওয়ার বাটি রাখল। নিজের গুরুর দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকাল। আর কী করতে পারি, ম্যাগাস?

এবার তুমি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারো, মেরেন। খাবার জন্যে তৈরি হলে খবর দেব তোমাকে। একটা বাটিতে শরবত ঢেলে পর্দার মুখের কাছে ধরল তাইতা, শক্ত করে বাঁধা রয়েছে ওটার মুখ। শুভেচ্ছা, স্বাগতম। আমার দীন কুটিরে সম্মান বয়ে এনেছেন আপনি, অদৃশ্য অতিথির উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলল ও। কোনও জবাব মিলল না। পালকির উপর অন্তর্চক্ষুর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল ও। রূপালি পর্দার ওধারে জীবন্ত কোনও প্রাণীর আভা ধরতে না পেরে রীতিমতো অবাক মানল। প্রতিটি জায়গা সাবধানে পরখ করার পরেও প্রাণের কোনও চিহ্ন পেল না। ফাঁকা, বন্ধ্যা ঠেকল।কেউ নেই? চট করে উঠে পালকির দিকে এগিয়ে গেল ও। কথা বলুন! দাবি জানাল। এটা কী ধরনের শয়তানি?

একটানে পর্দাটা সরিয়ে দিল ও, বিস্ময়ে পিছিয়ে এল এক কদম। গদিমোড়া বিছানায় আসন পেতে বসে আছেন এক লোক, ওরই দিকে তাকিয়ে আছেন। পরনে স্রেফ রেশমি একটা নেংটি। কঙ্কালসার শরীর, টাক মাথাটা খুলির মতো; গায়ের ত্বক সাপের ছেড়ে দেওয়া খোলসের মতোই শুষ্ক, কোঁকড়ানো। প্রাচীন ফসিলের মতো জরাজীর্ণ তার অবয়ব, কিন্তু চেহারা অভিব্যক্তি প্রশান্ত, সুন্দরও।

আপনার কোনও আভা নেই! ঠোঁটের ফাঁক গলে কথাগুলো বেরিয়ে আসা ঠেকানোর আগেই সজোরে বলে উঠল ও।

মৃদু মাথা দোলালেন হিতামা। আপনারও তাইতা, তাইতা। সরস্বতীর মন্দির থেকে ফিরে আসা কেউই চোখে পড়ার মতো আভা বিলোয় না। আমরা আমাদের মনুষ্যত্বের একটা অংশ আলোকবাহী কশ্যপের কাছে রেখে এসেছি। এই ঘাটতি আমাদের পরস্পরকে চিনতে সক্ষম করে তোলে।

সময় নিয়ে কথাটা ভাবল তাইতা। সুমনার কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন হিতামা।

কশ্যপ বেঁচে নেই, দেবীকে সাক্ষী রেখে এক নারী তার জায়গা অধিকার করেছে। ওর নাম সুমনা। সে আমাকে বলেছে এমন আরও আছে। আপনার সাথেই প্রথম দেখা হলো।

আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকেই অন্তর্চক্ষু উপহার দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংখ্যা কমে গেছে। ভয়ঙ্কর একটা কারণ আছে এর পেছনে, সময় মতোই আপনাকে খুলে বলব। নিজের পাশে তক্তপোষের উপর খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিলেন তিনি। আমার পাশে বসুন, তাইতা। কানে তেমন একটা ভালো শুনতে পাই না। কিন্তু অনেক কিছু আলোচনার আছে, আমাদের হাতে আবার সময়ও খুব বেশি নেই। অতিথি এবার কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে যাওয়া মিশরিয় ভাষা বাদ দিয়ে কুশলীদের প্রচীন তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। আমাদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।

আমার খোঁজ পেলেন কীভাবে? পাশে বসার সময় একই ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।

তারা পথ দেখিয়েছে। পুব আকাশের দিকে মুখ ফেরালেন প্রাচীন গণক। ওদের আলাপের অবসরে রাত নেমে এসেছে, আকাশের বুকের অলঙ্করণ রাজকীয় ভঙ্গিতে জেগে উঠছে। লস্ত্রিসের তারাটা এখনও মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এখন আরও বদলে গেছে ওটার আকার আর বস্তু। এখন মাঝখানে আর কঠিন কোনও অংশ নেই। স্রেফ উজ্জ্বল গ্যাসের মেঘে পরিণত হয়েছে ওটা, সৌর হাওয়ায় দীর্ঘ পুচ্ছ ছেড়ে যাচ্ছে।

সব সময়ই ওই তারাটার সাথে নিবিড় সম্পর্কের ব্যাপারে সজাগ ছিলাম আমি, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।

তার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে, রহস্যজনকভাবে ওকে আশ্বস্ত করলেন বুড়ো। ওটার সাথেই আপনার নিয়তি মিশে আছে।

কিন্তু ওটা তো আমাদের চোখের সামনেই মরতে বসেছে।

বুড়ো ওর দিকে এমনভাবে তাকালেন, তাইতার আঙুলের ডগাগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠল। কিছুই মরে না। আমরা যাকে মৃত্যু বলি সেটা স্রেফ অবস্থার পরিবর্তন। সব সময়ই সে আপনার সাথে থাকবে।

লস্ত্রিস নামটা উচ্চারণ করতে মুখ খুলেছিল তাইতা, কিন্তু ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন বুড়ো মানুষটা।

জোরে ওর নাম নেবেন না। তাহলে হয়তো যারা আপনার অমঙ্গল চায় তাদের কাছে ওর অস্তিত্ব প্রকাশ করে বসবেন।

তবে কী নাম এত শক্তিশালী?

নাম ছাড়া কোনও সত্তার অস্তিত্ব থাকবে না। এমনকি দেবতাদেরও নাম প্রয়োজন হয়। একমাত্র সত্যিই নামহীন।

আর মিথ্যা, বলল তাইতা, কিন্তু মাথা নাড়লেন বুড়ো।

মিথ্যার নাম আহরিমান।

আপনি আমার নাম জানেন, বলল তাইতা, কিন্তু আপনার নামের বেলায় আমি অজ্ঞ।

আমি দিমিতার।

দিমিতার তো এক উপদেবতার নাম, নিমেষে নামটা চিনে ফেলল তাইতা। আপনি কী তাইতা?

দেখতেই পাচ্ছেন, আমি মরণশীল, হাত উঁচু করলেন তিনি, তিরতির করে কাঁপছে। আমি আপনার মতোই একজন দীর্ঘায়ু, তাইতা। অসাধারণভাবে দীর্ঘ সময় বেঁচে আছি। তবে অচিরেই মারা যাব। এরইমধ্যে মরতে চলেছি। সময় হলেই আমাকে অনুসরণ করবেন আপনি। আমরা কেউই উপদেবতা নই। আমরা দয়াময় অমর নই।

দিমিতার, আমাকে চট করে ছেড়ে যেতে পারবেন না আপনি। কেবল তো পরিচয় হলো। প্রতিবাদ করল তাইতা। আপনার খোঁজে অনেক সময় দিয়েছি। আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে আমার। নিশ্চয়ই সেকারণেই আমার কাছে এসেছেন। এখানে নিশ্চয়ই মরতে আসেননি?

সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা কাত করলেন দিমিতার। যতক্ষণ সম্ভব থাকব আমি, কিন্তু বয়সের ভারে আমি ক্লান্ত, মিথ্যার জোরে অসুস্থ।

আমাদের একটি ঘণ্টাও নষ্ট করা চলবে না। আমাকে জ্ঞান দিন। বিনয়ের সাথে বলল তাইতা। আপনার পাশে আমি ছোট্ট খোকার মতো।

আমরা তো শুরু করে দিয়েছি, বললেন দিমিতার।

*

সময় আমাদের মাথার উপরের নদীর মতো, মাথা তুলে চিবুক নেড়ে আকাশের বুকে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তজোড়া সীমাহীন তারার নদী ওশানাসের দিকে ইঙ্গিত করলেন দিমিতার। এর কোনও কোনও আদি-অন্ত নেই। আমার আগেও একজন এসেছিল, তার আগে আগত আরও সীমাহীন অনেকের মতো। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে। এটা এক দৌড়বিদের কাছ থেকে আরেক দৌড়বিদের হাতে চালান করা ঐশী ব্যাটনের মতো। কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে বেশি দূরে বয়ে নিয়ে যায়। আমার দৌড় প্রায় শেষের পথে। কারণ আমার ক্ষমতার বেশিরভাগই প্রকাশ করে ফেলেছি। এখন আপনার হাতে ব্যাটন তুলে দিতে হবে।

আমাকে কেন?

এটাই নির্ধারিত হয়ে আছে। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা বা কৌতূহল দেখানো আমাদের কাজ নয়। আপনাকে আমার কাছে খোলামেলা হতে হবে, তাইতা, যাতে আপনাকে যা দিতে চাই সেটা গ্রহণ করতে পারেন। আপনাকে সতর্ক না করে পারছি না, এটা একটা বিষাক্ত উপহার। হাতে পাওয়ার পর কখনও স্থায়ী শান্তির খোঁজ আর পাবেন না হয়তো। কারণ বিশ্বজগতের সমস্ত ভোগান্তি আর কষ্ট মাথায় নিতে চলেছেন আপনি।

নীরব হয়ে গেল ওরা, এই অবসরে বিষণ্ণ সম্ভাবনাটুকু খতিয়ে দেখল তাইতা। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পারলে প্রত্যাখ্যান করতাম। চালিয়ে যান, দিমিতার, কারণ অনিবার্যকে ঠেকাতে পারব না আমি।

মাথা দোলালেন দিমিতার। আমি যেখানে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছি সেখানে আপনি সফল হবেন, দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমার। মিথ্যার চ্যালাদের আক্রমণের মুখে সত্যির দুর্গ পথের প্রহরী হবেন আপনি।

দিমিতারের ফিসফিসানি জোরাল হলো, নতুন তাগিদের সুর ফুটে উঠল। দেবতা, উপদেবতা, কুশলী সাধক আর দয়াময় অমরদের কথা বলেছি আমরা। এথেকে বুঝতে পেরেছি আপনার এসবের গভীর জ্ঞান রয়েছে। তবে আপনাকে আরও বলতে পারি আমি। মহা বিশৃঙ্খলার সূচনা থেকেই দেবতাদের উত্থান হচ্ছে, তারপর ফের পতন ঘটছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে আর মিথ্যার দাসদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা। প্রাচীন দেবতা টাইটানদের পরাস্ত করেছিলেন অলিম্পিয় দেবতারা। এক সময় তারাও দুর্বল হয়ে যাবেন। কেউই আর ওদের বিশ্বাস বা পূজা করবে না। ওরা পরাস্ত হবেন, আরও তরুণ দেবতারা তাদের স্থান দখল করবেন কিংবা আমরা পরাজিত হলে, মিথ্যার বৈরী চররা ওদের অতিক্রম করে যেতে পারে। খানিক ক্ষণ নীরব রইলেন তিনি, কিন্তু আবার যখন খেই ধরলেন, বেশ অটল শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর। স্বর্গীয় ধারায় এই উত্থান-পতন মহা বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে আবির্ভূত স্বাভাবিক ও অপরিবর্তনীয় আইনি বিধানের অংশ। এইসব বিধান বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওরা জোয়ার ভাটার নির্দেশ দেয়, দিন রাতের পরিবর্তনের আদেশ দেয়। বাতাস ও ঝড়ের নিয়ন্ত্রণ করে। আগ্নেয়গিরি ও জলোচ্ছ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ও দিনরাতের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। দেবতারা স্রেফ সত্যির দাস। শেষ পর্যন্ত কেবল সত্যি আর মিথ্যাই টিকে থাকবে। অকস্মাৎ ঘুরে পেছনে চোখ ফেরালেন দিমিতার। অভিব্যক্তি নির্বিকার। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলেন। আপনি কি অনুভব করতে পারছেন, তাইতা? শুনতে পাচ্ছেন?

নিজের সমস্ত ক্ষমতা কাজে লাগাল তাইতা, তারপর চারপাশে ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল, অনেকটা লাশের উপর নেমে আসা শকুনের ডানা ঝাপ্টানোর মতো। মাথা দোলাল ও। কথা বলতে পারছে না, এতটাই অলোড়িত বোধ করছে। মহাঅশুভের বোধ ওকে প্রায় অভিভূত করে ফেলেছে। পাল্টা যুঝতে বলতে গেলে নিজের পুরো শক্তি ব্যবহার করতে হলো ওকে।

এরই মধ্যে আমাদের মাঝে এসে পড়েছে সে, নিচু হয়ে গেল দিমিতারের কণ্ঠস্বর, শ্রমসাপেক্ষ, রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠল, যেন কোনও অশুভ উপস্থিতির ভারে ওর ফুসফুস দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। গন্ধ পাচ্ছেন তার?

নাক ফোলাল তাইতা। পচন, অসুস্থতা আর পচা মাংস, প্লেগের তীব্র দুর্গন্ধ, ফাটা মলের পচা দুর্গন্ধ লাগল নাকে। বুঝতে পারছি, গন্ধ পাচ্ছি, জবাব দিল ও।

বিপদে পড়েছি আমরা, বললেন দিমিতার। তাইতার দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। হাত মেলান! নির্দেশ দিলেন। ওকে ঠেকাতে দুজনের শক্তি এক করতে হবে!

ওদের আঙুলগুলো পরস্পর মিলতেই মাঝখানে তীব্র নীল ঝলক বিস্ফোরিত হলো। হাত সরিয়ে নিয়ে যোগাযোগ নষ্ট করার ঝোঁকটা অতি কষ্টে দমন করল তাইতা। দিমিতারের হাত শক্ত করে ধরে আঁকড়ে থাকল। শক্তির আদান প্রদান হলো ওদের ভেতর। আস্তে আস্তে শক্তিশালী সত্তার উপস্থিতি মিলিয়ে গেল। আবার মুক্তভাবে শ্বাস টানতে পারল ওরা।

এটা অনিবার্য ছিল, হালছাড়া ভঙ্গিতে বললেন দিমিতার। আমি তার রূপ আর জাদুর মায়া কাটিয়ে পালিয়ে আসার পর থেকেই গত কয়েক শতাব্দী ধরে পিছু ধাওয়া করছে সে। কিন্তু এখন আমরা একসাথে হওয়ার পর এত জোরাল মনস্তাত্ত্বিক শক্তি সৃষ্টি করেছি যে অনেক দূর থেকেই টের পেয়ে গেছে, যেমনটা বড় আকারের হাঙর যেমন দেখার অনেক আগেই সার্দিন মাছের ঝাঁকের অবস্থান টের পায়। বিষাদভরা চোখে তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখনও ওর হাত ধরে রেখেছেন। এখন আমার মাধ্যমে আপনার কথাও জেনে গেছে মেয়েটা, তাইতা। আবশ্য আমার কারণে না হলেও ভিন্ন কোনও উপায়ে আপনার কথা জানতোই। নক্ষত্রমণ্ডলীতে পাঠানো আপনার সৌরভ অনেক শক্তিশালী। সে হচ্ছে চরম শিকারী।

আপনি মেয়ে বলছেন? এই মেয়েটা কে?

নিজেকে ইয়োস বলে সে।

নামটা আমি শুনেছি। পঞ্চাশ প্রজন্মেরও আগে সরস্বতীর মন্দিরে গিয়েছিল ইয়োস নামে এক মহিলা।

সে-ই।

ইয়োস সূর্য দেবতা হেলিয়াসের বোন ভোরের প্রাচীন দেবী, বলল তাইতা। এক অতৃপ্ত নিম্ফোম্যানিয়াক, তবে টাইটান ও অলিম্পিয়দের লড়াইয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। মাথা নাড়ল ও। সেই একই ইয়োস হতে পারে না।

ঠিক বলেছেন, তাইতা। ওরা এক নয়। এই ইয়োস মিথ্যার দাসী। নিপূণ ভণ্ড, ক্ষমতাদখলকারী, প্রতারক, তস্কর, শিশুখাদক। প্রাচীন দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে, তাঁর কণ্ঠ নকল করেছে। তবে তার কোনও গুণ আয়ত্ত করতে পারেনি।

ইয়োস পঞ্চাশ প্রজন্ম ধরে বেঁচে আছে ধরে নেব? তার মানে এখন তার বয়স দুই হাজার বছর, অবিশ্বাস-ভরা কণ্ঠে বলে উঠল তাইতা। আসলে সে কী? মরণশীল নাকি অমর? মানুষ না দেবী?

গোড়াতে মানুষই ছিল। অনেক বছর আগে ইম্বালিয়নের অ্যাপোলো দেবীর পুরোহিতিনী ছিল সে। স্পার্টানরা শহর দখল করার পর হত্যালীলা এড়িয়ে ইয়োস নাম ভাঁড়ায়, এখনও মানুষই আছে, তবে কীসে পরিণত হয়েছে তার বর্ণনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই।

ইম্বালিয়নের এই নারীর আবির্ভাবের উল্লেখ করা খোদাই লিপি দেখিয়েছে আমাকে সুমনা, বলল তাইতা।

সেই একই ব্যক্তি। কার্মা ওকে অন্তর্চক্ষুর উপহার দিয়েছেন। ওকে মনোনীত ভেবেছিলেন তিনি। নিজেকে আড়াল করা আর প্রতারণার বেলায় তার ক্ষমতা এত বেশি যে কাৰ্মার মতো মহান সাধু ও যাজক পর্যন্ত তা ভেদ করে দেখতে পারে নি।

সে অশুভের প্রতিভূ হয়ে থাকলে, সেক্ষেত্রে তাকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করাই হবে আমাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব।

পরিহাসের হাসি দিলেন দিমিতার। এ কাজেই সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু মহিলা যেমন অশুভ তেমনি চতুর। হাওয়ার মতোই অধরা। কোনও আভাই ছড়ায় না সে। জাদু আর কূটকৌশলে নিজেকে এমনভাবে বাঁচায় যা কিনা অতিলৌকিক বিষয়ে আমার জ্ঞানের বাইরে। ওকে যারা ধরার চেষ্টা করে তাদের জন্যে ফাঁদ পাতে সে। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারে। কার্মা স্রেফ তার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারপরেও একবার ওকে খুঁজে পেতে সফল হয়েছিলাম। নিজেকে আবার শুধরে নিলেন তিনি। কথাটা পুরোপুরি সত্যি না। আমি ওকে পাইনি। সেই আমাকে খুঁজে বের করেছিল।

সাগ্রহে সামনে ঝুঁকল তাইতা। এই চিড়িয়াকে আপনি চেনেন? সামনাসামনি তার দেখা পেয়েছিলেন? বলুন আমাকে, দিমিতার, দেখতে কেমন সে?

হুমকির মুখে পড়লে গিরগিটির মতো চেহারা পাল্টাতে ওস্তাদ। তবে তার অসংখ্য দোষের ভেতর অহঙ্কারের অস্তিত্ব আছে। সে যে কেমন সুন্দর চেহারা নিতে পারে কল্পনাও করতে পারবেন না। সব বুদ্ধি ঘোলা করে দেয়, যুক্তি বোধ লোপ পায়। সে এই রূপ ধরলে তখন কোনও পুরুষের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয় না। ওর চেহারা এমনকি সবচয়ে ভালো মানুষটিকেও জঘন্য পশুতে পরিণত করে। নীরব হয়ে গেলেন তিনি, বিষাদে ভারি হয়ে এলো দুচোখের পাতা। কুশলী সাধক হিসাবে আমার সমস্ত প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও আপন নীচ ইন্দ্রিয়কে সামাল দিতে পারিনি। ক্ষমতা আর পরিণাম আঁচ করার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছি। ওই মুহূর্তে আমার কাছে সে ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। কামনায় গ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। শরতের হাওয়া যেভাবে ঝরা পাতা নিয়ে খেলে ঠিক সেভাবে আমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে সে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে বুঝি সবই আমাকে দিচ্ছে সে। এই দুনিয়ার বুকের সব আনন্দ যোগাচ্ছে। আমাকে নিজের দেহ তুলে দিয়েছিল সে। মৃদু কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠলেন দিমিতার। এমনকি এখনও সেই স্মৃতি আমাকে প্রায় পাগল করে তোলে। প্রতিটি উত্থান-পতন, মোহনীয় মুখ, সুরভিত আলিঙ্গন…ওকে ঠেকানোর কোনও চেষ্টা করিনি, মরণশীল কোনও পুরুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তার অবয়বে ক্ষীণ। বিক্ষুব্ধ রঙের ছোঁয়া লাগল।

তাইতা, আপনি বলেছিলেন আসল ইয়োস এক অতৃপ্ত নিস্ফোম্যানিয়াক। কথাটা ঠিক। কিন্তু এই ভিন্ন ইয়োস ক্ষুধার দিক থেকে তাকেও হারিয়েছে। সে চুমু খাওয়ার সময় প্রেমিকের মূল রস শুষে বের করে আনে, ঠিক আমি বা আপনি যেভাবে পাকা কমলা থেকে রস বের করব। যখন কোনও পুরুষকে বিচিত্র, নারকীয় মিলনে বন্দি করে, তখন সে তার পুরো সত্তা, তার আত্মা বের করে আনে। পুরুষের সত্তাই তাকে পুষ্টি যোগানো অমৃত। এক ধরনের দানবীয় রক্তচোষা সে, মানুষের রক্তে টিকে থাকে। শিকার হিসাবে কেবল উন্নত সত্তা বেছে নেয়, ভালো মনের নারী-পুরুষ, সত্যির দাস, বৈচিত্র্যময় খ্যাতিমান ম্যাগাস বা প্রতিভাবান ভবিষ্যদ্বক্তা। শিকারের খোঁজ পেলেই নেকড়ে বাঘ যেভাবে হরিণের পিছু নেয় ঠিক সেভাবে তার পিছু ধাওয়া করে। সর্বভূক সে। বয়স বা চেহারা কোনও ব্যাপার নয়, শারীরিক দুর্বলতা বা পঙ্গুত্বেও কিছু আসে যায় না। তাদের মাংসে তার ক্ষুধা মেটে না, আত্মা লাগে। তরুণ-যুবা, নারী-পুরুষ সবাইকে গ্রাস করে সে। একবার আয়ত্তে পেলে, নিজের রূপালি জালে আটকাতে পারলে, তাদের পুঞ্জীভূত শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা শুষে নেয়। ওদের মুখে অভিশপ্ত চুমু দিয়ে শুষে নেয়। ঘৃণিত আলিঙ্গনে নিংড়ে নেয়। পড়ে থাকে স্রেফ একটা শুকনো খোসা।

এই দৈহিক বিনিময় দেখেছি, বলল তাইতা। কশ্যপ জীবনের প্রান্তে পৌঁছার পর তার জ্ঞান আর প্রজ্ঞা সুমনার কাছে হস্তান্তর করার সময়, ওকে নিজের উত্তরাধিকারী বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

আপনি দেখেছেন ইচ্ছাকৃত বিনিময়। ইয়োসের অশ্লীল কর্মকাণ্ড এক ধরনের জৈবিক আগ্রাসন, দখল। সে বিনাশী, আত্মার খাদক।

মুহূর্তের জন্যে বিস্মযে বাক রহিত হয়ে রইল তাইতা। তারপর জানতে চাইল, প্রাচীন ও অশক্ত? সম্পূর্ণ বা পঙ্গু? নারী আর পুরুষ? যাদের মিলিত হওয়ার ক্ষমতা নেই, তাদের সাথে কীভাবে মিলিত হয় সে?

তার এমন ক্ষমতা আছে যেটা কিনা আপনি আর আমি কুশলী সাধক হলেও ধারে কাছে যেতে পারব না বা পরিমাপ করতে পারব না। শিকারের দুর্বল শরীর এক দিনের জন্যে চাঙা করার কায়দা আবিষ্কার করেছে সে, কেবল তার মন আর খোদ সত্তাকে মুছে দিতে।

তারপরেও আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দেননি, দিমিতার। আসলে কি সে? মরণশীল নাকি অমর; মানুষ না দেবী? ওর বিরল সৌন্দর্যের কোনও মেয়াদ নেই? সে কি আপনার বা আমার মতো সময় বা বয়সের হাতে নাজুক নয়?

আপনার প্রশ্নের জবাব, তাইতা, আমি জানি না। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বয়স্কা নারী হতে পারে সে, দুহাত মেলে অসহায়ত্বের একটা ভঙ্গি করলেন দিমিতার। তবে সে এমন কোনও শক্তি আবিষ্কার করেছে যেটা এর আগে কেবল দেবতাদের জানা ছিল। তাতে কি দেবী হয়ে যাচ্ছে সে? জানি না। অমর না হাতে পারে, তবে নিশ্চিতভাবে জরাহীন।

আপনার প্রস্তাবটা কী, দিমিতার? ওর আস্তানার খোঁজ কীভাবে পাব?

ইতিমধ্যে আপনার খোঁজ পেয়ে গেছে সে। ওর দানবীয় ক্ষুধা জাগিয়ে তুলেছেন আপনি। এরই মধ্যে আপনার পিছু নিয়েছে সে। এবার আপনাকে কাছে টেনে নেবে।

দিমিতার, এমনকি এই চিড়িয়ার পাতা ফাঁদ বা প্রলোভনের শিকার হওয়ার সময় অনেক আগেই ফেলে এসেছি।

আপনাকে চায় সে, পেয়ে তবে ছাড়বে। তবে আমরা দুজন ওর জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছি। নিজের বক্তব্য নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি। তারপর আবার খেই ধরলেন। আমার যা দেওয়ার ছিল, বলতে গেলে সবই ছিনিয়ে নিয়েছে সে। আমাকে দূর করতে চাইবে, বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে আপনাকে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আপনার কোনও ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে তাকে। একা ওকে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব বলে আবিষ্কার করবেন আপনি। আমাদের মিলিত শক্তিতে হয়তো তাকে ঠেকানো যাবে, এমনকি তার আপাত অমরত্বকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দিতে পারব।

আপনাকে পাশে পেয়ে আমি খুশি, বলল তাইতা।

চট করে সাড়া দিলেন না দিমিতার। অদ্ভুত নতুন অভিব্যক্তি নিয়ে তাইতাকে জরিপ করলেন। অবশেষে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভয় বা বিপদের ভয় হচ্ছে না?

না, আমার বিশ্বাস আমরা একসাথে সফল হবো, বলল তাইতা।

আমার সত্যিকারের সতর্কবাণী নিয়ে ভেবেছেন আপনি। আমরা কোন শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যাচ্ছি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরেও দ্বিধা করছেন না। সবচেয়ে প্রাজ্ঞ পুরুষ হয়েও আপনার মাঝে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আমি জানি এটা অনিবার্য। বেপরোয়া আর ভালো মনেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে আমাকে।

তাইতা, আপনার গভীরতম কন্দরে অনুসন্ধান করুন। মনের ভেতর কোনও রকম আনন্দের বোধ টের পাচ্ছেন? শেষ কবে এমন উদ্যমী, এমন সজীব বোধ হয়েছে আপনার?

চিন্তিত দেখাল তাইতাকে, কিন্তু জবাব দিল না।

তাইতা, নিজের কাছে সম্পূর্ণ সৎ থাকতে হবে আপনাকে। এখন আপনার মনে হচ্ছে যে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেখান থেকে আর নাও ফিরতে পারেন? নাকি বুকের ভেতর আরেকটা অপ্রত্যাশিত আবেগের বোধ জেগেছে? নিজেকে প্রেমিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে যাওয়া রাজহাঁসের মতোই যে কোনও পরিণতির বেলায় বেপরোয়া ঠেকছে?

নীরব রইল তাইতা, কিন্তু ওর চেহারা বদলে গেল: গালের হালকা আভা মিলিয়ে গেল ওর, চোখজোড়া গম্ভীর হয়ে গেল। আমি ভীত নই, অবশেষে বলল ও।

আমাকে সত্যি বলুন। আপনার মন যৌনতার ইমেজে ভরে গেছে, অনিরুদ্ধ কামনা ভর করেছে, তাই না? চোখ ঢাকল তাইতা, শক্ত করে চোয়াল চেপে ধরল। নিষ্ঠুরের মতো বলে চললেন দিমিতার। ইতিমধ্যেই অশুভ ক্ষমতায় আপনাকে আক্রান্ত করেছে সে। জাদু আর প্রলোভনে বন্দি করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আপনার বুদ্ধি-বিবেচনা ঘোলা করে দেবে সে। অচিরেই সে আদৌ খারাপ কিনা সেই ভাবনাই খেলতে শুরু করবে আপনার মনে। ওকে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা যেকারও মতোই অসাধারণ, অভিজাত ও গুণবতী মনে হবে আপনার। শিগগিরই মনে হবে আসলে আমিই খারাপ। ওর বিরুদ্ধে আপনার মন বিষিয়ে তুলছি। সেটা ঘটালেই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে সে, তখন ধ্বংস হয়ে যাব আমি। নিজেকে স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছায় তার কাছে সমর্পণ করবেন আপনি। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে জিতে যাবে সে।

গোটা শরীর প্রবল বেগে ঝকাল তাইতা, যেন বিষাক্ত এক ঝাঁক কীটের কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায়। আমাকে ক্ষমা করবেন, দিমিতার! চেঁচিয়ে উঠল ও। এখন ওর কাণ্ড সম্পর্কে সাবধান করায় নিজের মাঝে জেগে ওঠা ক্ষতিকর দুর্বলতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছি। বিচার-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছিল আমার। আপনার কথাই ঠিক। অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষায় দুলছিলাম আমি। হায়, মহান হোরাস রক্ষা করুন। গুঙিয়ে উঠল তাইতা। আবার এমন কষ্ট বোধ করতে হবে ভাবিনি। ভেবেছিলাম অনেক দিন আগেই বুঝি কামনার নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে এসেছি।

আপনাকে ভাসিয়ে দেওয়ার উল্টো আবেগ প্রজ্ঞা ও যুক্তি থেকে আসেনি। এটা আত্মার এক ধরনের সংক্রমণ, ভয়ঙ্করতম ডাইনীর ধনুক থেকে ছোঁড়া বিষাক্ত তীর। ঠিক এভাবেই একবার তার হাতে ধরা পড়েছিলাম। আমার কী দশা হয়েছে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। অবশ্য, বেঁচে থাকার কৌশল শিখেছি আমি।

আমাকে সেটা শিখিয়ে দিন। ওর মোকাবিলায় সাহায্য করুন, দিমিতার।

অনিচ্ছাকৃতভাবে ইয়োসকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি আমি। ভেবেছিলাম তাকে ফাঁকি দিতে পেরেছি, কিন্তু আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্যে আমাকে শিকারী হাউন্ডের মতো কাজে লাগিয়েছে সে। এখন আপনি ওর শিকার। কিন্তু এখন আমাদের অবশ্যই একসাথে, একক হিসাবে থাকতে হবে। একমাত্র এভাবেই তার আক্রমণ ঠেকানোর আশা করতে পারি। তবে, সবার আগে গালালা থেকে চলে যেতে হবে। দীর্ঘ সময় এক জায়গায় থাকা চলবে না। আমাদের সত্যিকারের অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকলে, আমাদের উপর নিজের ক্ষমতা স্থির করা অনেক কঠিন হবে তার পক্ষে। আমাদের ভেতর অবশ্যই একটা চিরস্থায়ী আড়াল তৈরি করতে হবে যাতে চলাফেরা গোপন করা যায়।

মেরেন! তাগিদের সুরে ডাকল তাইতা। ঝটপট মনিবের কাছে চলে এল সে। কত দ্রুত গালালা ছাড়তে পারব আমরা?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘোড়া নিয়ে আসছি আমি। কিন্তু আমরা কোথায় যাব, প্রভু?

থেবস আর কারনাকে, জবাব দিল তাইতা, দিমিতারের দিকে তাকাল।

মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন তিনি। জাগতিক ও অলৌকিক সব উৎস থেকে সব রকম সাহায্য যোগাড় করতে হবে আমাদের।

ফারাও দেবতাদের মনোনীত পুরুষ, মানবজাতির ভেতর সবচেয়ে ক্ষমতাবান, সায় দিল তাইতা।

আর আপনি তার প্রিয়ভাজনদের মধ্যে প্রধান, বললেন দিমিতার। আজ রাতেই আমাদের তাঁর কাছে যেতে রওনা দিতে হবে।

উইন্ডম্মেকের পিঠে আসীন হলো তাইতা, ইকবাতানার সমভূমি থেকে নিয়ে আসা অন্য একটা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে খুব কাছে থেকে অনুসরণ করল মেরেন। উটের পিঠে নিজের দোল খাওয়া হাওদায় শুয়ে রইলেন দিমিতার। তার পাশাপাশি এগোল তাইতা। হাওদার পর্দা খোলা, কাফেলার নানা মৃদু শব্দ-ছাপিয়ে ছোট পেরেকের ঝুনঝুনানি, হলদে বালির বুকে ঘোড়া আর উটের পায়ের শব্দ এবং চাকা ও পাহারাদারদের নিচুকণ্ঠের কথোকথন পরস্পরের সাথে আলাপ করছিল ওরা। রাতে বিশ্রাম নিতে ও পশুদের পানি খাওয়াতে দুবার থামল ওরা। প্রতিবার বিরতির সময় আত্মগোপনের জাদুর অনুশীলন করল তাইতা ও দিমিতার। ওদের মিলিত শক্তি দুর্ভেদ্য, দুর্জয় হয়ে উঠল যেন: যদিও আবার পশুর পিঠে আসীন হওয়ার আগে চারপাশের নৈঃশব্দ্য ও অন্ধকারে তীক্ষ্ণ তল্লাশি চালালেও ইয়োসের ভীষণ উপস্থিতির নতুন কানও চিহ্ন বের করতে পারেনি ওরা।

আপাতত আমাদের হারিয়ে ফেলেছে সে, কিন্তু সব সময়ই ঝুঁকির ভেতর থাকব আমরা; ঘুমের সময় বিপদ হবে সবচেয়ে বেশি। একসাথে দুজনের ঘুমানো ঠিক হবে না, পরামর্শ দিলেন দিমিতার।

আমরা আর কখনওই সতর্কতায় ঢিল দিতে পারব না, বলল তাইতা। অযথা ভুলের ব্যাপারে সতর্ক থাকব। প্রতিপক্ষকে খাট করে দেখেছিলাম আমি। অসতর্ক অবস্থায় হানা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি ইয়োসকে। আমার এই বোকামি ও দুর্বলতার জন্যে দুঃখিত।

আপনার চেয়ে আমার দোষ শতগুন বেশি, স্বীকার গেলেন দিমিতার। আমার ক্ষমতা দ্রুত ক্ষয়ে যাবার ভয় হচ্ছে, তাইতা। আপনাকে আগেই পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু নবীশের মতো আচরণ করেছি আমি। এরপর আর আমাদের কোনও ভুল করা চলবে না। অবশ্যই প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে, তারপর সেই পথেই আক্রমণ শানাতে হবে। তবে নিজেদের প্রকাশ করা চলবে না।

আপনার সব কথা সত্ত্বেও ইয়োস সম্পর্কে আমার বিদ্যা ও উপলব্ধি বেদনাদায়কভাবে ক্ষীণ। নিজের বিপদের সময় মোকাবিলা করা ওর প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার মনে করতে হবে আপনাকে, সে যত তুচ্ছই হোক, কিংবা তাৎপর্যহীন মনে হোক, বলল তাইতা, নইলে সব সুবিধা থাকবে ওর পক্ষে, আমি অন্ধ থেকে যাব।

আমাদের মধ্যে আপনার ক্ষমতা অনেক বেশি, বললেন দিমিতার। তবে ঠিক কথাই বলেছেন। আমরা একসাথে হওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া কত ক্ষিপ্র ছিল ভেবে দেখুন, আমাদের মিলিত শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে সে। আমাদের দেখা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার ভেতর পাল্লা দিয়েছে। এখন থেকে আমার উপর তার আক্রমণ অবিরাম ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। ওর সম্পর্কে যা কিছু জানি তার সবটুকু আপনার হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়া চলবে না। সে আমাকে খুন বা আমাদের ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করার আগে কতটা সময় পাওয়া যাবে কে জানে। প্রতিটি ঘণ্টা মূল্যবান।

মাথা দোলাল তাইতা। তাহলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দিয়েই শুরু করা যাক। সে কে, কোত্থেকে এসেছে, জানি আমি। এবার জানতে হবে তার ঠিকানা। কোথায় আছে সে, দিমিতার? ওকে কোথায় খুঁজে পাব আমরা?

অনেক অনেক আগে আগামেনন ও তার ভাই মেনেলস ইম্বালিয়ন দখল করার পর অ্যাপোলোর মন্দির থেকে পালানোর পর থেকে অসংখ্য আস্তানায় আত্মগোপন করেছে সে।

তার সাথে আপনার সেই করুণ সাক্ষাৎ হয়েছিল কোথায়?

মধ্য সাগরের এক দ্বীপে, জলদস্যু ও ডাকাতের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল সেটা। সেই সময় এরনা নামের এক বিরাট অগ্নি-পাহাড়ের ঢালে থাকত সে। আগ্নেয়গিরি থেকে আগুন, অগ্নি পাথর আর বিষাক্ত ধোঁয়ার মেঘ বেরিয়ে সোজা আকাশের দিকে উঠে যেত।

অনেক আগের ঘটনা?

আমার বা আপনার জন্মেরও বহু শত বছর আগে।

শুষ্ক হাসল তাইতা। হ্যাঁ, তা বটে। অনেক আগের কথাই। আবার কঠিন হয়ে উঠল ওর অভিব্যাক্তি। এমন কি হতে পারে যে ইয়োস এখনও এরনাতেই আছে?

এখন আর ওখানে নেই সে, বিনা দ্বিধায় জবাব দিলেন দিমিতার।

নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?

তার কবল থেকে ফিরে আসার সময় আমার শরীর ও প্রাণশক্তি, দুটোই খানখান হয়ে গিয়েছিল, আমার মন বেসামাল হয়ে গেছে, আমাকে যেই বিপদে সে ফেলেছিল তার কারণে মানসিক শক্তি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এক দশকের কিছু বেশি সময় তার বন্দি ছিলাম, কিন্তু প্রতিটি বছর যেন আয়ুর সমান বুড়িয়ে গেছি আমি। তারপরেও পালানোর সময় নিজেকে আড়াল করতে আগ্নেয়গিরির বিশাল অগ্নৎপাতের সুযোগ নিয়েছিলাম। এরনার পুব ঢালে এক সামান্য দেবতার মন্দিরের যাজকদের সাহায্য পেয়েছিলাম। একটা ছোট নৌকায় সংকীর্ণ প্রণালী দিয়ে দ্রুত আমাকে মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে দিয়েছে ওরা। আমাকে পাহাড়ের গায়ে লুকানো গোত্রের আরেকটা মন্দিরের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায় তারপর। ওখানে ওদের ভাইদের হাওলায় রেখে যায়। ওই সৎ যাজকরা আমার অবশিষ্ট ক্ষমতা ফিরে পেতে সাহায্য করেছে, ইয়োসের পাঠানো এককভাবে বিষাক্ত জাদু টের পাওয়ার জন্যে সেটা দরকার ছিল আমার।

সেটা কি তার দিকেই ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন? জানতে চাইল তাইতা। তার জাদু দিয়েই তাকে ঘায়েল করতে পেরেছিলেন?

সে হয়তো আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল, কারণ আমার বাকি শক্তিকে খাট করে দেখেছিল বলে নিজেকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত করেনি। তার সত্তা লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালিয়েছিলাম আমি। অন্তর্চক্ষু দিয়ে তখনও টের পাচ্ছিলাম তা। খুব কাছে ছিল সে। আমাদের মাঝখানে কেবল সংকীর্ণ প্রণালীটা ছিল। আমার হামলা ঠিকই জোরালভাবে আঘাত করে তাকে। ইথারে তার অর্তনাদ শুনতে পেয়েছি। তারপরই উধাও হয়ে গেছে সে। কিছু সময়ের জন্যে তাকে শেষ করতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার মেজবানরা এরনা পাহাড়ের ঢালের ভাইদের সাহায্যে গোপন অনুসন্ধান চালিয়েছিল। ওদের কাছে জানতে পারি, উধাও হয়ে গেছে সে, তার সাবেক আস্তানা পরিত্যক্ত। বিজয়ের সুযোগ কাজে লাগাতে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করিনি। মোটামুটি গায়ে শক্তি ফিরে পাওয়ামাত্র নিরাপদ সেই আশ্রয় ছেড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দূর কোণে, বরফের মহাদেশে চলে গেছি আমি। ইয়োসের নাগাল থেকে এর বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। অবশেষে শান্তিতে থাকার মতো একটা জায়গার খোঁজ পাই, তখনও পাথর চাপা ব্যাঙের মতো সন্ত্রস্ত ছিলাম। অল্প কিছুদিন পর, পঞ্চাশ বছর বা তার কম হবে, ফের শত্রুর পুনরাবির্ভাব টের পাই। যেন বিপুলভাবে বেড়ে উঠেছিল তার ক্ষমতা। আমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া ভয়ঙ্কর তীরের গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল ইথারে। আমার সঠিক অবস্থান ধরতে পারেনি সে। তার অনেকগুলো তীর আমার অবস্থানের কাছাকাছি এলেও কোনওটাই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। তারপর থেকে প্রতিটি দিনই ছিল রীতিমতো সংগ্রাম, উত্তরাধিকারীকে খুঁজে ফিরছিলাম আমি। তার আক্রমণের জবাব দেওয়ার মতো ভুল করার সুযোগ ছিল না। যখনই টের পেয়েছি এগিয়ে আসছে সে, স্রেফ নীরবে অন্য কোথাও সরে গিয়েছি। অবশেষে বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর বুকে একটা জায়গাই আছে যেখানে আমার খোঁজ করবে না সে। তখন আবার গোপনে এরনায় ফিরে যাই। তার পুরোনো আস্তানা, আমার বন্দিশালা সেই গুহায় আশ্রয় নিই। তার অশুভ শক্তির জোরাল প্রতিধ্বনি তারপরও আমার নাজুক অস্তিত্ব ঢেকে দিচ্ছিল। পাহাড়ে গা ঢাকা ছিলাম আমি। এক সময় টের পেলাম আমার প্রতি তার আগ্রহ কমে গেছে। তার অনুসন্ধান এলোমেলো হয়ে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো ভেবেছে, আমি শেষ হয়ে গেছি বা আমার ক্ষমতা এমনভাবে নষ্ট করে দিয়েছে যে আমাকে আর ঝুঁকি মনে হয়নি। তারপর আপনার জোরাল অস্তিত্ব টের পাওয়ার সেই আনন্দময় দিন পর্যন্ত আত্মগোপনেই ছিলাম। সরস্বতীর যাজিকারা আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে দেওয়ার পর সে কারণে ইথারে তৈরি হওয়া অস্থিরতা টের পেলাম। এবার আপনি যে তারাটাকে লস্ত্রিস ডাকেন, সেটা দেখা দিল। নিজের বিক্ষিপ্ত স্থিরতা একত্রিত করে তারা অনুসরণ করে আপনার কাছে হাজির হই।

দিমিতারের কথা শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল তাইতা। উইন্ডস্মোকের পিঠে উবু হয়ে বসে আছে ও, ওটার সহজ দুলুনির সাথে দোল খাচ্ছে। মাথার চারপাশে জড়িয়ে রেখেছে জোব্বাটা। ওটার ফোকর দিয়ে কেবল ওর চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। তো এরনায় না থাকলে, অবশেষে জিজ্ঞেস করল ও। কোথায় আছে সে, দিমিতার?

বলেছি তো, আমার জানা নেই।

যদিও মনে হচ্ছে আপনার জানা নেই, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ওকে শুধরে দিল তাইতা। ওর কাছে কতদিন আটক ছিলেন? দশ বছর বললেন না?

দশ বছর, সায় দিলেন দিমিতার। প্রত্যেকটা বছর ছিল অনন্ত কালের মতো।

তাহলে তো অন্য যেকারও চেয়ে তাকে বেশি চেনেন আপনি। আপনার মাঝে তার অংশ আছে, ভেতর বাইরে নিজের ছাপ রেখে গেছে সে।

আমার কাছ থেকে নিয়েছেই শুধু, দেয়নি কিছু।

তার কাছ থেকে আপনিও নিয়েছেন বৈকি, হয়তো সমান নয়, তবে নারী পুরুষের কোনও মিলনই সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয় না। তার সম্পর্কে ধারণা রয়েছে আপনার। হতে পারে সেটা আপনার জন্যে প্রচণ্ড বেদনাদায়ক হওয়ায় আড়াল করে রেখেছেন। বের করে আনতে সাহায্য করতে দিন।

অনুসন্ধানীর ভূমিকা গ্রহণ করল তাইতা। নির্মম হয়ে উঠল ও, শিকারের শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতা ও ক্ষতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে এখনও ওর মাঝে রয়ে যাওয়া মহা ডাইনীর অবশিষ্ট সমস্ত স্মৃতি খুঁড়ে বের করে আনতে লাগল, তা যত ক্ষীণ বা গভীরভাবে চাপা থাকুক। দিনের পর দিন বুড়ো মানুষটার মন তছনছ করে চলল। তবে পথ চলা থামাল না। বুনো মরুসূর্যকে ফাঁকি দিতে রাতের বেলায় চলছে, ভোরের আগে আবার শিবির ফেলছে। দিমিতারের তাঁবু খাটানোমাত্র সূর্যালোক থেকে আশ্রয় নিচ্ছে ওরা। তারপর জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শুরু করছে তাইতা। অবশেষে বুড়ো মানুষটার ভোগান্তির সত্যিকার মাত্রা, ওর সাহস ও ইয়োসের বিপুল বিস্তারি নিপীড়নের কবল থেকে বাঁচতে তার শক্তির প্রয়োজন দেখে তার প্রতি জোরাল দরদ ও সমীহ বোধ করলেও নিজের কাজ থেকে বিরত হওয়ার মতো দয়া দেখাতে গেল না।

অবশেষে মনে হলো তাইতার শেখার মতো আর কিছু বাকি নেই, কিন্তু সম্ভষ্ট হতে পারল না ও। দিমিতারের জানানো তথ্যগুলোকে মনে হলো বাহ্যিক ও তুচ্ছ।

বাবিলনে আহুরা মাযদার পুরোহিতরা এক ধরনের জাদু চর্চা করে, অবশেষে দিমিতারকে বলল ও। মানুষকে মৃত্যুর কাছাকাছি গভীর ঘোরে পৌঁছে দিতে পারে ওরা। তারপর তার মনকে সময় ও স্থানের বিচারে সুদূরে, একেবারে জন্মের ক্ষণটিতে পর্যন্ত পাঠাতে পারে। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়, বলা বা শোনা সমস্ত কথা, প্রতিটি কণ্ঠস্বর ও চেহারা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার কাছে।

হ্যাঁ, সায় দিলেন দিমিতার। এসব কথা শুনেছি। আপনারও এই বিদ্যা জানা আছে সে, তাইতা?

আমার উপর আপনার আস্থা আছে? নিজেকে আমার হাতে তুলে দেবেন?

নিতান্ত অসহায়ের মতো চোখ বুজলেন দিমিতার। আমার ভেতর আর কিছুই বাকি নেই। আমি একটা শুকনো খোসামাত্র, যার ভেতর থেকে খোদ সেই ডাইনীর মতোই ক্ষুধার্তের মতো প্রতিটি ফোঁটা শুষে নিয়েছেন আপনি। থাবার মতো একটা হাত তুলে মুখ মুছলেন তিনি, বন্ধ করে রাখা চোখ ডললেন। চোখ মেলে তাকালেন তারপর। নিজেকে আপনার হাতে সঁপে দিচ্ছি। পারলে আমার উপর ওই জাদু প্রয়োগ করুন।

সোনার মাদুলিটা চোখের সামনে ধরে চেইনের উপর দোলাতে শুরু করল তাইতা। সোনালি তারার উপর মনোযোগ স্থির করুন। মন থেকে অন্য সব চিন্তা দূর করে দিন। নিজের আত্মার গভীর ছাড়া আর কিছু দেখবেন না, দিমিতার। আপন আত্মার অন্তস্তলকে আপনি ভয় পান। আপনাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ঘুমের কোলে ছেড়ে দিন নিজেকে। ঘুম যেন আপনার মাথার উপর পৌঁছে যায়, অনেকটা কোমল পশমী কম্বলের মতো। ঘুমান, দিমিতার, ঘুমান…

আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে এলেন বুড়ো মানুষটা। চোখের পাতা কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। খাটিয়ার উপর রাখা মড়ার মতো পড়ে রইলেন তিনি। মৃদু নাক। ডাকছে। আস্তে করে খুলে গেল একটা চোখের পাতা, উল্টে গেল ওটার পেছনে চোখটা, ফলে কেবল শাদা অংশটুকু দেখা গেল, অন্ধ, ঝাপসা। মনে হচ্ছে গভীর ঘোরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ওকে একটা প্রশ্ন করল তাইতা, উত্তর দিলেন তিনি। কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট, দুর্বল, স্বর তীক্ষ্ণ।

সময়ের নদী বেয়ে উল্টো দিকে এগিয়ে যান, দিমিতার।

হ্যাঁ, সায় দিলেন দিমিতার। অনেক বছর পেছনে চলে যাচ্ছি…পেছনে, পেছনে, পেছনে… শক্তিশালী হয়ে উঠল ওর কণ্ঠস্বর। আরও জোরাল।

এখন কোথায় আপনি?

আমি এখন ই-তেমেন-আন-কাই, মানে আকাশ ও পৃথিবীর ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে আছি, শক্তিশালী তরুণ কণ্ঠে জবাব দিলেন তিনি।

তাইতা জানে বাবিলনের কেন্দ্রের এক বিশাল কাঠামো ওটা। ওটার দেয়াল চকমকে ইটে তৈরি, আকাশ-মাটির যত রঙ আছে সব রঙের মিশেল। বিশাল পিরামিডের আকৃতির। কী দেখতে পাচ্ছেন, দিমিতার?

খোলা জায়গা, খোদ মহাবিশ্ব, আকাশ ও স্বর্গের অক্ষ।

দেওয়াল ও উঁচু টেরেস দেখতে পাচ্ছেন?

কোনও দেয়াল নেই, তবে শ্রমিক আর দাসদের দেখছি। জমিনে যত পিঁপড়া ও আকাশে যত পঙ্গপাল আছে তত। ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। এরপর নানা ভাষায় কথা বলে চললেন দিমিতার, মানুষের সব ভাষার মিশেল। কয়েকটা ভাষা বুঝতে পারল তাইতা, কিন্তু অন্যগুলো দুর্বোধ্য রয়ে গেল। সহসা প্রাচীন সুমেরিয় ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন দিমিতার। একটা মিনার বানাব আমরা, ওটা স্বর্গে পৌঁছে যাবে।

বিস্ময়ের সাথে তাইতা বুঝতে পারল, টাওয়ার অভ বাবেলের ভিত্তি স্থাপনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন তিনি। ফিরে গেছেন সময়ের সূচনায়।

এখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুরে চলেছেন আপনি। ই-তেমেন-আন-কাই-এর পূর্ণ উচ্চতায় পৌঁছানো দেখেছেন, রাজারা পূজা দিচ্ছেন, চূড়ায় রয়েছেন দেবতা বেল ও মারদুক। সময়ের আরও এধারে চলে আসুন! ওকে নির্দেশ দিল তাইতা, তারপর দিমিতারের চোখ দিয়ে বিশাল সব সাম্রাজ্যের উত্থান ও রাজাদের পতনের দৃশ্য দেখতে লাগল; ওদিকে দিমিতার সেই সব ঘটনার কথা বলে চললেন যার কথা প্রাচীন কালেই বিস্মৃত হয়েছে সবাই। অনেক শতাব্দী আগেই ধূলোয় রূপান্তরিত নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

অবশেষে পরাস্ত হলেন দিমিতার, শক্তি হারিয়ে ফেললেন। ওর ভুরুর উপর একটা হাত রাখল তাইতা। সমাধি প্রস্তরের মতোই শীতল ঠেকল। শান্ত হন, দিমিতার, ফিসফিস করে বলল। এবার ঘুমান। অতীতের স্মৃতি ছেড়ে বর্তমানে ফিরে আসুন।

কেঁপে উঠলেন দিমিতার, শিথিল হলো ওর শরীর। সূর্যাস্ত অবধি ঘুমালেন তিনি। তারপর জেগে উঠলেন স্বাভাবিকভাবেই, যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। তরতাজা, শক্তিশালী মনে হলো নিজেকে। তাইতার আনা ফল আর ছাগলের টক দুধ ক্ষুধার্তের মতো খেলেন। এই সময় কাজের লোকেরা তাঁবুর কাছে এসে উটের পিঠে রসদপত্র চাপাল। কাফেলা ফের রওয়ানা দেওয়ার সময় তাইতার পাশাপাশি খানিকটা পথ হাঁটার মতো শক্তি ফিরে পেলেন তিনি।

আমি ঘুমে থাকার সময় কি কি স্মৃতি খুঁড়ে এনেছেন? হাসিমুখে জানতে চাইলেন। কিছুই মনে করতে পারছি না, তার মানে আসলে কিছুই পাননি।

ই-তেমেন-আন-কাইয়ের ভিত্তি স্থাপনের সময় হাজির ছিলেন আপনি, ওকে জানাল তাইতা।

থমকে দাঁড়ালেন দিমিতার, সবিস্ময়ে তাইতার দিকে ফিরলেন। এ কথা বলেছি আমি?

জবাবে ঘোরে থাকার সময় দিমিতারের উচ্চারিত কয়েকটা ভাষা অনুকরণ করে শোনাল তাইতা। সাথে সাথে সেগুলো শনাক্ত করলেন দিমিতার। অচিরেই অবসন্ন হয়ে এল তার পাজোড়া, কিন্তু উৎসাহে ভাটা পড়ল না এতটুকু। নিজের পালকিতে উঠে শুয়ে পড়লেন গালিচার উপর। ওর পাশাপাশি এগোল তাইতা। দীর্ঘ রাত জুড়ে অব্যাহত রইল ওদের আলাপ। অবশেষে দুজনের জন্যেই বিশেষ গুরুত্ববহ একটা প্রশ্ন করলেন দিমিতার। ইয়োসের কথা বলেছি? গোপন কোনও স্মৃতি উদ্ধার করতে পেরেছেন?

মাথা নাড়ল তাইতা। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি। সরাসরি ওদিকে যাইনি। বরং আপনার স্মৃতিকে স্বাধীনভাবে চলে বেড়াতে দিয়েছি।

একপাল কুকুরসহ শিকারীর মতো, সহসা সশব্দ হাসির সাথে মন্তব্য করলেন দিমিতার। সাবধান, তাইতা, আমরা যেন ষাঁড়ের খোঁজ করতে গিয়ে মানুষখেকো সিংহীকে চমকে না দিই।

আপনার স্মৃতি এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে ইয়োসের খোঁজ করার মানে বিশাল সাগরের বিস্তারে বিশেষ একটা হাঙর খোঁজার মতো। আমাদের হয়তো তার স্মৃতির খোঁজ পেতে আরেকটা জীবন কাটিয়ে দিতে হতে পারে।

আমাকে সরাসরি ওর কাছে নিয়ে যেতে হবে, বিনা দ্বিধায় বললেন দিমিতার।

আপনার নিরাপত্তার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছি আমি, এমনকি আপনার জীবনাশঙ্কাও দেখা দিতে পারে, মন্তব্য করল তাইতা।

কাল ফের কুকুরের পাল পাঠাব আমরা? এবার কিন্তু সিংহীর গন্ধ শুকিয়ে দিতে হবে ওদের।

রাতের বাকি সময়টুকু নীরব রইল ওরা। যার যার ভাবনা ও স্মৃতিতে বিভোর। ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠলে এক ছোট উপকূলে পৌঁছাল ওরা। খেজুর বাগানে। যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিল তাইতা। পশুগুলোকে দানা-পানি খাওয়ানো হলো, এই অবসরে তাবু খাটানো হলো। তাইতা জানতে চাইল, দিমিতার, আবার চেষ্টা চালানোর আগে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে চান? নাকি এখনই শুরু করতে তৈরি আছেন?

সারা রাত বিশ্রাম নিয়েছি। আমি তৈরি।

ওর চেহারা পরখ করল তাইতা। ওকে দেখে শান্ত মনে হচ্ছে, স্লান চোখজোড়া প্রশান্ত। লস্ত্রিসের তাবিজ উঁচু করে ধরল তাইতা। চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করুন। অনেক শান্তি ও নিরাপদ বোধ করছেন আপনি। আপনার শরীর ভারি হয়ে এসেছে। আরাম বোধ করছেন। আমার কথা শুনুন। ঘুমের ধেয়ে আসা টের পাচ্ছেন…আশীর্বাদের ঘুম…গভীর, উপশমকারী ঘুম…

প্রথম প্রয়াসের চেয়ে ঢের দ্রুত ঘুমে তলিয়ে গেলেন দিমিতার: তাইতার কোমল পরামর্শের কাছে ক্রমবর্ধমানহারে বশ মানছেন।

আগুন আর ধোঁয়া উগড়ানো একটা পাহাড় রয়েছে। দেখতে পাচ্ছেন?

মুহূর্তের জন্যে মড়ার মতো নীরব রইলেন দিমিতার। ঠোঁটজোড়া ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার, কাঁপতে লাগল। তারপরই ভীষণভাবে মাথা নাড়লেন। কোনও পাহাড় নেই! পাহাড় বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না! চড়া হয়ে ভেঙে গেল ওর। কণ্ঠস্বর।

পাহাড়ের চূড়ায় এক মহিলা আছে, লেগে রইল তাইতা, সুন্দরী। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী। দেখতে পাচ্ছেন, দিমিতার?

কুকুরের মতো হাঁপাতে শুরু করলেন দিমিতার, হাপরের মতো ওঠানামা করছে। তাঁর বুক। তাইতার মনে হলো ওকে হারাতে বসেছে ও। ঘোরের বিরুদ্ধে লড়ছেন দিমিতার, বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। ও জানে এটাই ওদের শেষ চেষ্টা, আবার চেষ্টা করতে গেলে বুড়ো মানুষটা আর নাও বাঁচতে পারেন।

ওর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন, দিমিতার? মিষ্টি সুরেলা কথা শুনুন। কী বলছে সে আপনাকে?

এবার অদৃশ্য কোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন দিমিতার, তক্তপোষের উপর গড়াগড়ি যাচ্ছেন। পাগলের মতো বিড়বিড় করছেন তিনি। হাঁটু আর কনুই একসাথে করে বুকের কাছে এনে বলের মতো হয়ে গেছেন। পরক্ষণেই হাত-পা সোজা করে ফেললেন তিনি, বাঁকা হয়ে গেল পিঠটা। পাগলের মতো বকবক করছেন। প্রলাপ বকছেন, হাসছেন। দাতে দাঁত চেপে ধরলেন এবার, এক সময় মাঢ়ীর একটা দাঁত ভেঙে পড়ল। রক্ত আর লালার মিশেলের সাথে ওটা ছুঁড়ে ফেললেন।

শান্ত হোন, দিমিতার! ভয়ে ভয়ে উঠল তাইতার মন, যেন পাত্র ভরা পানি উতড়ানোর উপক্রম হয়েছে। স্থির হোন! নিরাপদে আছেন আপনি।

সহজ হয়ে এলো দিমিতারের শ্বাসপ্রশ্বাস, তারপরই তাইতাকে অবাক করে কুশলী সাধুর মতো প্রাচীন ভাষায় কথা বলে উঠলেন। কথাগুলো অচেনা, কিন্তু বলার ঢঙ আরও বেশি অচেনা। এখন আর বয়স্ক কারও মতো নয় ওর কণ্ঠস্বর, বরং তরুণীর মতো মিষ্টি, সুরেলা; এমন সুরেলা কণ্ঠ কখনও শোনেনি তাইতা।

আগুন, হাওয়া, জল ও মাটি, কিন্তু আগুনই এসবের প্রভু। প্রতিটি যন্ত্রণাদায়ী ওঠানামা তাইতার মনে খোদাই হয়ে যাচ্ছে। জানে এই শব্দ কোনওদিন মুছতে পারবে না ও।

আবার তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়লেন দিমিতার। শরীরের আড়ষ্টতা বিদায় নিল। চোখজোড়া কেঁপে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। স্থির হলো শ্বাসপ্রশ্বাস। সহজ হয়ে এলো বুকের প্রবল ওঠানামা। ওর হৃৎপিণ্ড বিস্ফোরিত হয়ে গেছে ভেবে ভয় হলো তাইতার। কিন্তু পাঁজরে কান পেতে চাপা অথচ ছন্দোময় কম্পনের শব্দ শুনে প্রবল স্বস্তির সাথে বুঝতে পারল এযাত্রা রক্ষা পেয়েছেন দিমিতার।

দিনের বাকি সময়টুকু ওকে ঘুমাতে দিল তাইতা। দিমিতার যখন জেগে উঠলেন, মনে হলো বিপদ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আসলেই কী ঘটেছে তার কোনও উল্লেখই করলেন না তিনি। মনে হলো যেন কোনও স্মৃতিই অবশিষ্ট নেই তার মনে।

ছাগলের দুধের স্যুপ খাওয়ার সময় কাফেলার দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে আলাপ করল ওরা। গালালা থেকে কতটা পথ দূরে এসেছে ও ফারাও নেফার সেতির অনন্য সাধারণ প্রাসাদে যেত আর কতটা পথ বাকি আছে আন্দাজ করার প্রয়াস পেল। আগেভাগেই ওদের আগমনের সংবাদ দিয়ে রাজার কাছে বার্তাবাহক পাঠিয়েছে তাইতা। তিনি কীভাবে ওদের অভ্যর্থনা জানাবেন বোঝার প্রয়াস পেল।

একমাত্র সত্যিকারের আলো আহুরা মাযদার কাছে প্রার্থনা করুন, হতভাগ্য আক্রান্ত এই দেশে যেন আর নতুন কোনও প্লেগ না আসে, বলে চুপ করে গেলেন দিমিতার।

আগুন, হাওয়া, জল ও মাটি… কথোপকথনের সুরে বলে উঠল তাইতা।

…কিন্তু আগুনই হচ্ছে এসবের প্রভু, নোট বইয়ের লেখা মুখস্থ করার মতো পুনরাবৃত্তি করল দিমিতার। নিমেষে হাত উঠে এসে মুখ চেপে ধরল তার, বুড়ো চোখে বিস্ময় নিয়ে তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। আগুন, হাওয়া, জল ও মাটি সৃষ্টির চারটি মৌল উপাদান। এখন ওগুলোর নাম বললেন না, তাইতা?

আগে বলুন আগুনকে কেন সবগুলোর প্রভু বলেছেন আপনি।

প্রার্থনা মন্ত্র, বললেন দিমিতার।

কার প্রার্থনা? কীসের মন্ত্র?

মনে করার প্রয়াসে ম্লান হয়ে গেল দিমিতারের চেহারা। জানি না। বেদনাদায়ক স্মৃতি খুঁড়ে আনতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছে তার। এর আগে কখনও শুনিনি।

শুনেছেন, এবার অনুসন্ধানী কণ্ঠে বলল তাইতা। ভাবুন, দিমিতার! কোথায়? কে? তারপর আচমকা আবার সুর পাল্টাল। নিখুঁতভাবে অন্যের কণ্ঠ নকল করতে পারে ও। ঘোরে থাকার সময় দিমিতারের উচ্চারণ করা সুরেলা মেয়েলী কণ্ঠে কথা বলল। কিন্তু এসবের প্রভু হচ্ছে আগুন।

ঢোক গিললেন দিমিতার, দুহাত কান ঢাকলেন। না! চিৎকার করে উঠলেন।

ওই সুরে কথা বলে ধর্মের অবমাননা করছেন আপনি। জঘন্য অপবিত্রতার কাজ করছেন। এটা মিথ্যার স্বর, ডাইনী ইয়োসের কণ্ঠস্বর! হেলান দিয়ে বসে ভাঙা কণ্ঠে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

নীরবে ওর সামলে নেওয়ার অপেক্ষা করল তাইতা।

অবশেষে মাথা তুলে দিমিতার বললেন আহুরা মাযদা দয়া করুন, আমার দুর্বলতা ক্ষমা করুন। কেমন করে এই মারাত্মক কথাগুলো ভুলে গেলাম?

দিমিতার, আপনি ভোলেননি। স্মৃতি আপনার কাছে ধরা দিতে চায়নি, আস্তে করে বলল তাইতা। এখন সব মনে করতে হবে-দ্রুত, ইয়োস অনুপ্রবেশ করে আটকানোর আগেই।

কিন্তু এসবের প্রভু হচ্ছে আগুন। এই মন্ত্র দিয়েই সবচেয়ে অপবিত্র আচার শুরু করেছিল সে, ফিসফিস করে বললেন দিমিতার।

এরনায়?

ওকে অন্য কোথাও দেখিনি।

আগুনের জায়গায় আগুনকে মহিমান্বিত করেছে, চিন্তিত কণ্ঠে বলল তাইতা। আগ্নেয়গিরির বুকের ভেতর ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে সে। আগুন তার শক্তির অংশ, কিন্তু ক্ষমতার উৎস থেকে চলে গেছে সে। তবু আমরা জানি তা আবার সজীব হয়ে উঠেছে। আপনি যে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন খেয়াল করেছেন সেটা? এখন আমরা জানি ঠিক কোথায় তার খোঁজ করতে হবে।

স্পষ্টই বিস্মিত দেখাল দিমিতারকে।

আগ্নেয়গিরির আগুনেই খুঁজতে হবে ওকে, ব্যাখ্যা করল তাইতা।

দিমিতারকে যেন ভাবনা গুছিয়ে নিচ্ছেন। হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, বললেন তিনি।

চলুন, ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু এগোনো যাক! বলল তাইতা। তিনটি উপাদানের অধিকারী আগ্নেয়গিরি: আগুন, মাটি ও হাওয়া। কেবল জলের অভাব রয়েছে। সাগরের পাশে এরনার অবস্থান। আস্তানার হিসাবে আরেকটা আগ্নেয়গিরি সন্ধান পেয়ে থাকলে কাছেই বিরাট জলের উৎস থাকতে বাধ্য।

সাগর? জিজ্ঞেস করলেন দিমিতার।

কিংবা বড় কোনও নদী, আন্দাজ করল তাইতা। সাগরের পাশে কোনও আগ্নেয়গিরি, দ্বীপের উপরও হতে পারে, কিংবা বিরাট কোনও হ্রদের ধারে। এমন জায়গাতেই ওর খোঁজ করতে হবে। দিমিতারের কাঁধ দুহাতে জড়িয়ে ধরল ও। আন্তরিক হাসল। তো, দিমিতার, অস্বীকার করলেও সে কোথায় লুকিয়ে আছে আপনার জানা ছিল।

এখানে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। আমার অপসৃয়মান স্মৃতি থেকে আপনার বুদ্ধির জোরেই সেটা বের করে এনেছেন আপনি, বললেন দিমিতার। তবে একটা কথা বলুন তো, তাইতা, আমাদের অনুসন্ধানের এলাকা কতখানি কমাতে পেরেছি? বর্ণনার সাথে মেলে এমন আগ্নেয়গিরির সংখ্যা কত? একটু থামলেন তিনি, তারপর নিজেই জবাব দিলেন। কয়েক হাজার হবে। নিশ্চয়ই বিস্তৃত জমিন আর সাগরের কারণে দূরে দূরে থাকবে সেগুলো। সবগুলোয় পৌঁছতে অনেক বছর লাগবে। মনে হয় না, এখন আর এমন কাজ করার শক্তি আছে।

গত কয়েক শো বছর ধরে থেবসের হাথরের মন্দিরের পুরোহিতরা পৃথিবীপৃষ্ঠের নিখুঁত গবেষণা করেছে। সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-নদীর বিস্তারিত মানচিত্র আছে ওদের কাছে। চলার পথে আমার জানা তথ্য ওদের কাছে চালান করেছি। ওদের সাথে ভালো জানাশোনা আছে। পানির কাছাকাছি সমস্ত আগ্নেয়গিরির তালিকা দিয়ে সাহায্য করবে ওরা। মনে হয় না সবগুলোর কাছে। যেতে হবে। আমরা দুজন আমাদের শক্তি এক করে দূর থেকে অশুভের উৎসারণ জানতে প্রত্যেকটা পাহাড়ের দিকে শব্দ পাঠাতে পারি।

তাহলে হাথরের মন্দিরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে, শক্তি সামলে রাখতে হবে। ইয়োসের বিরুদ্ধে এই সংঘাত আপনার শক্তি ও প্রতিরক্ষার শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিচ্ছে। আপনাকেও বিশ্রাম নিতে হবে, তাইতা। পরামর্শ দিলেন দিমিতার। দুদিন ধরে ঘুমাননি, অথচ ওকে বের করে আনার দীর্ঘ পথে এরইমধ্যে প্রথম পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছি আমরা।

এই পর্যায়ে ওদের তাঁবুতে এক বান্ডিল সুরভিত মরু ঘাস একে, বিছানা বানাতে লেগে গেল মেরেন। তার উপর বাঘের ছাল বিছিয়ে দিল। হাঁটু গেড়ে বসে মনিবের পায়ের জুতো খুলল, টিউনিকের ঢিতে ফিলে করে দিল। কিন্তু ওকে ধমকে উঠল তাইতা। আমি কচি খোেকা নই, মেরেন। নিজের পোশাক খুলতে পারি।

তাকে বিছানার উপর শুইয়ে দেওয়ার সময় আমোদিত হাসল মেরেন। আপনি কচি খোকা নন, সেটা আমাদের জানা আছে, ম্যাগাস। অবাক কাণ্ড, সাধারণত তো এমন আচরণ করেন না আপনি? প্রতিবাদ করবে বলে মুখ খুলল তাইতা, কিন্তু তার বদলে মৃদু নাক সিঁটকাল এবং পরক্ষণেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে।

আমি ঘুমানোর সময় ও পাহারায় ছিল। এবার আমি ওকে পাহারা দেব, সৎ মেরেন, বললেন দিমিতার।

এটা আমার দায়িত্ব, তাইতার দিকে খেয়াল রেখে বলল মেরেন।

মানুষ আর জানোয়ারের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে তুমি-তোমার চেয়ে ভালো পারবে না কেউ, বললেন দিমিতার। কিন্তু অকাল্টের সাহায্যে আক্রমণ করা হলে অসহায় হয়ে পড়বে। সৎ মেরেন, তোমার তীর-ধনুক নিয়ে যাও, আমাদের জন্যে তাগড়া একটা হরিণল শিকার করে আনো।

আরও কিছুক্ষণ তাইতার কাছে থাকল মেরেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে বের হয়ে গেল। তাইতার তক্তপোষের পাশে অবস্থান নিলেন দিমিতার।

*

তরঙ্গায়িত ঝিলমিল জলের পাশে তুষার-শাদা উজ্জ্বল সৈকতে সাগর তীর ধরে হাঁটছে তাইতা। জেসমিন ও লাইলাক ফুলের সৌরভ-মাখা হাওয়া পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে চোখে-মুখে, এলোমলো করে দিচ্ছে দাড়িগোঁফ। জলের কিনারায় এসে থামল ও, ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগল ওর পায়ে। সাগরের উপর দিয়ে দূরে চোখ ফেরাল। ওধারের গাঢ় শূন্যতাই দেখতে পেল শুধু। জানে। পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে ও, তাকিয়ে আছে চিরন্তন বিশৃঙ্খলার দিকে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকলেও অন্ধকারের দিকে ওর চোখ। তারাগুলো জোনাকপোকার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে তার উপর।

লস্ত্রিসের তারার খোঁজ করল ও। কিন্তু নেই। ক্ষীণতম আভাটুকুও অবশিষ্ট নেই। শূন্যতা থেকে এসেছিল, আবার শূন্যতায় ফিরে গেছে। ভীষণ বেদনাবোধে আক্রান্ত হলো ও। আপন নিঃসঙ্গতায় তলিয়ে যাবার অনুভূতি হলো। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় অবশেষে গানের আওয়াজ শুনতে পেল: তরুণ কণ্ঠস্বর নিমেষে চিনে ফেলল, যদিও অনেক দিন আগে শুনেছিল। বুকের পাজরে মাথা ঠুকছে ওর হৃৎপিণ্ড। আওয়াজ আরও কাছে সরে এলে বুনো একটা পশু মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠল।

যখন প্রিয়তমার মুখখানি দেখি,
আহত কোয়েলের মতো ডানা ঝাপ্টায় আমার হৃদয়;
ওর হাসির রোদ্রালোকে
ভোরের আকাশের মতো লাল হয়ে ওঠে আমার মুখ…

এটাই ছিল ওকে শেখানো ওর প্রথম গান, সব সময়ই প্রিয় গান ছিল ওর। সাগ্রহে ওকে খুঁজে পেতে ঘুরে দাঁড়াল ও। কারণ ওর জানা আছে এই গায়িকা লস্ত্রিস ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ওরই হেফাযতে ছিল সে, নদীর জরে ওর স্বাভাবিক মায়ের মৃত্যুর পরপরই দেখভাল ও শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওর ওপর। ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল ও, যেভাবে কোনও দিন কোনও পুরুষ কোনও নারীকে ভালোবাসেনি।

রোদের আলোয় উজ্জ্বল সাগরের বিপরীতে চোখ আড়াল করল ও। একটা অবয়ব দেখতে পেল জলের বুকে। কাছে এগিয়ে এল অবয়বটা, আরও কাছে আসতে লাগল। ক্রমে স্পষ্ট হয়ে এলো ওটার কাঠামো। দেখা গেল ওটা একটা বিরাট সোনালি ডলফিন, এত দ্রুত ও জাকের সাথে সাঁতার কাটছে যে, ওটার নাকের কাছে কুঁকড়ে যাচ্ছে জল, ফেনা তুলে সরে যাচ্ছে। ওটার পিঠে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে, দক্ষ রথ চালকের মতো ভারসাম্য বজায় রেখেছে। সাগরের শৈবালের লাগাম ধরে পেছনে হেলে আছে, লাগাম দিয়েই অসাধারণ প্রাণীটাকে সামলাচ্ছে, গান গাওয়ার সময় ওর উদ্দেশে মৃদু হাসছে মেয়েটা।

হাঁটু গেড়ে বালির উপর বসে পড়ল তাইতা। মিস্ট্রেস! চিৎকার করে বলে উঠল। মিষ্টি লস্ত্রিস!

আবার বার বছর বয়সে ফিরে গেছে ও, যখন প্রথম ওর সাথে জানাশোনা হয়েছিল। পরনে কেবল ব্লিচ করা একটা লিনেনের স্কার্ট, কড়কড়ে, ঝলমলে; সারসের ডানার মতো শাদা। ওর ছিপছিপে দেহের ত্বকের রঙ বিবলসের ওধারের পাহাড় থেকে আনা তৈলাক্ত সিডার কাঠের মতো চকচক করছে। সদ্য পাড়া ডিমের মতো ওর বুক, গোলাপি গার্নেট বসানো।

লস্ত্রিস, আমার কাছে ফিরে এসেছ। আহা, দয়াময় হোরাস! হে, করুণাময় আইসিস! ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ,ফুঁপিয়ে উঠল ও।

তোমাকে কোনওদিনই ছেড়ে যাইনি আমি, প্রিয় তাইতা, গানে বিরতি দিয়ে বলল লস্ত্রিস। ওর অভিব্যাক্তিতে দুষ্টুমি আর ছেলেমানুষি আমোদের ছাপ। ওর কমনীয় ঠোঁটজোড়া হাসিতে বেঁকে গেলেও চোখে কোমল সহানুভূতির ছাপ। নারীসুলভ প্রজ্ঞা ও উপলব্ধিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ও। তোমাকে দেওয়া আমার প্রতিশ্রুতির কথা কোনওদিনই ভুলিনি।

পিছলে সৈকতে উঠে এলো সোনালি ডলফিন। লাফ দিয়ে ওটার পিঠ থেকে মোহনীয় ভঙ্গিতে বালির উপর নেমে দাঁড়াল লস্ত্রিস। ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক পাশের কাঁধের উপর নেমে এসে বুকের মাঝখানে ঝুলছে ঘন চুলের গোছা। ওর মুখের প্রতিটি জায়গা ও রূপালি বাঁক খোদাই হয়ে আছে ওর মনে। কাছে এসো, তাইতা, বলতেই ওর দাঁতগুলো মুক্তো-মালার মতো ঝিকিয়ে উঠল। আমার কাছে ফিরে এসো, আমার সত্যিকারের ভালোবাসা!

ওর দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করল তাইতা। প্রথম কয়েক পদক্ষেপে বয়সের ভারে টলে উঠল ন্যূজ পাজোড়া, কিন্তু তারপরই নতুন শক্তি খেলে গেল ওর দেহে। সোজা হয়ে দাঁড়াল ও, অনায়াসে এগিয়ে গেল শাদা বালির উপর দিয়ে। টের পাচ্ছে ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে শরীরের পেশিগুলো। ওর পেশি এখন কোমল, উজ্জীবিত।

ও, তাইতা, তুমি কত সুন্দর! আহবান জানাল লস্ত্রিস। কত ক্ষিপ্র, শক্তিশালী, কী তরুণ, প্রিয় আমার। মেয়েটার কথাগুলো সত্যি জানে বলে অমোদিত হয়ে উঠল ওর হৃদয়-মন। আবার তরুণ হয়ে গেছে ও, প্রেমে পড়েছে।

ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিল সে। মরণ বাঁধনে ধরে ফেলল ওকে মেয়েটা। ওর আঙুলগুলো শীতল, হাড় সর্বস্ব, অস্থিব্যামোয় বাঁকা; শুষ্ক, কর্কশ ত্বক।

আমাকে সাহায্য করো, তাইতা, আর্তনাদ করে উঠল লস্ত্রিস। কিন্তু এখন ওর কণ্ঠস্বর নয় এটা, নিদারুণ বয়স্ক পুরুষের যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠস্বর। আমাকে বাগে পেয়ে গেছে সে!

মরণভীতিতে ওর হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে লস্ত্রিস। অস্বাভাবিক ঠেকছে ওর শক্তি-ওর আঙুল মুচড়ে দিচ্ছে, বেঁকে যাওয়া হাড়ের যন্ত্রণা টের পাচ্ছে ও, পেশি ভেঙে পড়ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল ও। ছেড়ে দাও! চিৎকার করে বলল। তুমি লসি নও। এখন আর তরুণ নেই ও। ওকে পূর্ণ করে তোলা এক মুহূর্ত আগের শক্তি উবে গেছে। বয়স ও হাতাশা গ্রাস করে নিল ওকে, আপন। স্বপ্নের বিস্ময়কর নকশা প্রকাশিত হতে দেখে ভীতিকর বাস্তবতার ভয়ঙ্কর ঝাপ্টায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ও।

বিপুল ভারের নিচে তাঁবুর মেঝেয় নিজেকে আবিষ্কার করল ও। ভারের কারণে বুক বসে যাচ্ছে; শ্বাস নিতে পারছে না ও। এখনও ওর হাতজোড়া চেপে ধরে রেখেছে কেউ। ওর কানের খুব কাছেই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ধ্বনি, এত কাছে, মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে যাবে বুঝি।

জোর করে চোখ মেলে তাকাল ও। ওর স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটুকু মিলিয়ে গেল। ওর মুখের মাত্র কয়েক ইঞ্চি উপরে দেখা যাচ্ছে দিমিতারের মুখ। বলতে গেলে চেনাই যায় না; যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে। ফোলা, পিঙ্গল। মুখটা হাঁ হয়ে গেল, হলদে জিভ বের হয়ে এলো। হাঁপানি ও মরিয়া ফোঁপানিতে মিলিয়ে যাচ্ছে ওর আর্তনাদ।

এখন ধাক্কা খেয়ে পুরোপুরি সজাগ তাইতা। তাঁবুর ভেতরটা সাপের গন্ধের মতো গন্ধে ভরা। বিশাল আঁশটে প্যাঁচে ঢেকে গেছেন দিমিতার, কেবল ওর মাথা আর একটা হাত মুক্ত রয়েছে। এখনও মুক্ত হাতে তাইতাকে আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি-অনেকটা ডুবন্ত মানুষের মতো। ওকে ঘিরে নিখুঁত সমান লুপ তৈরি করেছে প্যাঁচটা। পেশির নিয়মিত খিচুনিতে এঁটে বসছে। প্যাঁচ চেপে বসায় পরস্পরের সাথে ঘসা খাচ্ছে আঁশগুলো: দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে দিমিতারের নাজুক শরীর। সাপের ত্বকে সোনা, চকলেট আর লালচে বাদামী দারুণ নকশা করা। কিন্তু কেবল ওটার মাথা দেখেই ওদের হামলা চালানো প্রাণীটিকে চিনতে পারল তাইতা।

পাইথন, জোরে বলে উঠল ও। ওর দুহাতের মুঠি মেলালে যত বড় হবে তার দ্বিগুন সাপটার মাথার আকার। মুখ ব্যাদান করে রেখেছে ওটা, দিমিতারের হাড় সর্বস্ব কাঁধে বিধে আছে দাঁতগুলো। দাঁত কেলানো মুখের দু-কোণ থেকে চকচকে লালার ধারা গড়িয়ে নামছে-সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেওয়ার আগে শিকারকে এই তরলে ঢেকে নেয় সে। তাইতার দিকে চেয়ে থাকা ছোট গোল চোখজোড়া কালো, নিষ্করুণ। আরও একবার কুণ্ডলীটা চেপে বসল। মানুষ আর সাপের ভারের নিচে নিজেকে অসহায় মনে হলো তাইতার। দিমিতারের মুখের দিকে তাকাল ও, নীরবতায় আটকে গেছে বেচারার অন্তিম আর্তনাদ। এখন আর শ্বাস নিতে পারছেন না দিমিতার। কোটর থেকে ফেটে বের হয়ে আসার যোগাড় হয়েছে ওর ম্লান চোখজোড়া। নিদারুণ চাপে পাঁজরের একটা হাড় ভাঙার শুনল তাইতা।

কোনওমতে যথেষ্ট শক্তি এক করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা, মেরেন! জানে দিমিতার নেই বললেই চলে। ওর হাতের উপর মরণ মুঠি ঢিলে হয়ে এসেছে, নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও। কিন্তু এখনও ফাঁদে আটকে আছে। দিমিতারকে বাঁচাতে একটা কিছু অস্ত্র দরকার। এখনও মনের পর্দায় লস্ত্রিসের ইমেজ ভাসছে ওর, গলার কাছে উড়ে এলো ওর হাত। চেইনে ঝোলানো একটা সোনালি তারা ঝুলছে ওখানে। লখ্রিসের তাবিজ।

আমাকে শক্তি দাও, প্রিয়া আমার, ফিসফিস করে বলল ও। ভারি ধাতব অলঙ্কারটা ওর হাতের তালুতে খাপে খাপে এঁটে বসল। ওটা দিয়ে পাইথনের মাথায় আঘাত হানল ও। একটা গোল চোখের দিকে তাক করেছিল, তীক্ষ্ণ ধাতব ডগাটা চোখ ঢেকে রাখা স্বচ্ছ আঁশ ভেদ করে গেল। হিংস্র, বিস্ফোরক শব্দে হিসহিস করে উঠল সাপটা। কুণ্ডলী পাকানো শরীরে খিঁচুনি উঠল, পাক খেল ওটা। কিন্তু দাঁতগুলো দিমিতারের কাঁধে বিধে রইল। এমনভাবে কোনাকুনি এঁটে বসেছে যে, শিকার গেলার সময়ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়। প্রকৃতিগতভাবেই সহজে ছেড়ে দেওয়ার নয়। চোয়াল আলগা করে নেওয়ার প্রয়াসে বেশ কয়েকটা সহিংস উদগীরণের ভঙ্গি করল পাইথনটা।

ফের আঘাত করল তাইতা। সাপের চোখের ঠিক মাঝখানে হাকাল ধাতব তীক্ষ্ণ ডগাটা, তারপর প্যাঁচাতে শুরু করল। দিমিতারকে ছেড়ে পাইথনের সর্পিল শরীর কুণ্ডলী শিথিল হয়ে এলো। প্রবল বেগে এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে এক সময় দিমিতারের শরীর থেকে দাঁত তুলে নিল ওটা। দুটো চোখই উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ওদের উপর শীতল তেলতেলে রক্ত ছিটিয়ে সরে গেল সাপটা। বুকের উপর থেকে ভার সরে যেতেই ছোট করে শ্বাস টানল তাইতা। তারপর একপাশে সরিয়ে দিল দিমিতারের শিথিল শরীর, ওর চেহারা বরাবর আঘাত হানল ক্রুদ্ধ পাইথন। চট করে হাত ওঠাল ও, কব্জিতে দাঁত সেঁধিয়ে দিল সাপটা। কিন্তু তারা ধরে রাখা হাতটা এখনও মুক্ত। কব্জির হাড়ে তীক্ষ্ণ দাঁতের ঘর্ষণের অনুভূতি টের পাচ্ছে ও। কিন্তু ব্যথা নতুন করে শক্তি যোগাল ওকে। আহত চোখে ফের ডগাটা বসিয়ে দিল ও, এবার আরও গভীরে। খুলির ভেতর থেকে চোখটা বের করে আনল তাইতা, যন্ত্রণায় কুকড়ে গেল পাইথন। বিস্ফোরণ ঘটেছে যেন। আবার আক্রমণ করতে চোয়াল ছাড়িয়ে নিল ওটা। বর্ম পরানো মুঠির মতো যেন ওটার নাকের আঘাতগুলো। তাঁবুর মেঝেয় গাড়িয়ে বেড়াতে লাগল তাইতা। আঘাত এড়ানোর প্রয়াস পাচ্ছে। চিৎকার করে ডাকছে মেরেনকে। ওর বুকের চেয়েও চওড়া সাপটার দোলানো কুণ্ডলী ভরে রেখেছে গোটা তাঁবু।

এবার উরুতে একটা হাড়ের মতো কাঁটা বিঁধে যাওয়া টের পেল তাইতা, যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ও। জানে কীসে আঘাত করেছে ওকে। যৌন ছিদ্রের দুপাশে খাট ও মোটা লেজের নিচের দিকে ভয়ঙ্কর একজোড়া থাবা থাকে পাইথনের। সঙ্গীকে আঁকড়ে ধরতে ব্যবহার করে থাকে ওগুলো। এই হুক দিয়ে শিকারও পাকড়াও করে। কুণ্ডলীর জন্যে এক ধরনের গোজের কাজ দেয় ওগুলো, শক্তি বাড়িয়ে তোলে বহুগুন। মরিয়া হয়ে পা আলগা করে নেওয়ার চেষ্টা করল তাইতা। কিন্তু হুকগুলো ওর মাংসে গেঁথে গেছে। তেলতেলে প্রথম কুণ্ডলীটা পাচাতে শুরু করল ওকে।

মেরেন! আবার চিৎকার করল। ও। কিন্তু দুর্বল ওর কণ্ঠস্বর, আরেকটা কুণ্ডলী চেপে বসল। আবার মেরেনকে ডাকার চেষ্টা করল ও। কিন্তু হুশ করে ওর বুকের সব বাতাস বের হয়ে গেল। দুমড়ে গেল পাঁজর।

সহসা মেরেন এসে হাজির হলো তাঁবুর মুখে। এক মুহূর্ত থেমে সাপটার ফুটকিঅলা শরীরের অর্থ পুরোপুরি বুঝে নিল। পরক্ষণে এক লাফে সামনে বাড়ল। পিঠে ঝোলানো খাপ থেকে তলোয়ার বের করতে মাথার উপর হাত বাড়িয়ে দিল। তাইতার চোট পাওয়ার ঝুঁকি থাকায় ওটার মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করার সহস করল না। তো আক্রমণের কোণ বদলাতে নাচের ভঙ্গিতে একপাশে সরে গেল। পাইথনের নিক্ষিপ্ত মাথা এখনও শিকারের দিকে ব্যস্ত। কিন্তু তাইতার পায়ের আরও গভীরে হুক বিধানোর জন্যে খাট লেজটা স্থির করে রেখেছে। তলোয়ারের ফলার ঝিলিকে সাপটার হুকের উপরের লেজের দৃশ্যমান অংশ আলগা করে নিল মেরেন। তাইতার পায়ের সমান লম্বা একটা অংশ, ওর উরুর মতোই পুরু।

শরীরের ওপরের অংশটুকু প্রায় তাবুর সমান উঁচু করে ফেলল পাইথন। বিশাল হাঁ হলো ওটার মুখ, মেরেনের উপর ঝুলে থাকার সময় ঝিলিক দিয়ে উঠল ওটার নেকড়েসুলভ দাঁতগুলো। অবশিষ্ট চোখে ওকে জরিপ করার সময় এপাশ ওপাশ দোল খেয়ে চলল ওটার মাথা। কিন্তু আঘাতের ফলে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ায় থমকে গেছে ওটা। তলোয়ার উঁচু করে ওটার মুখোমুখি দাঁড়াল মেরেন। সামনে ছুটে এসে ওর মুখ লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাল সাপটা। কিন্তু তৈরি ছিল মেরেন, হাওয়ায় গুঞ্জন তুলল ওর তলোয়ার। পরিষ্কার সাপের গলায় ঢুকে গেল উজ্জ্বল ফলাটা। লুটিয়ে পড়ল মাথাটা। পাক খেয়ে চলল মুণ্ডহীন জানোয়ারটা, ওদিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খিচুনি খাওয়ার মতো ফাঁক হয়ে গেল ওটার চোয়াল। লাথি মেরে ওটার শিথিল হয়ে আসা কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল মেরেন, তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল। ওর কব্জিতে সাপের দাঁতের তৈরি ফুটো থেকে রক্ত ঝরছে। তাইতাকে মাথার উপর উঁচু করে ধরে তাঁবুর বাইরে নিয়ে এলো ও।

দিমিতার! দিমিতারকে বাঁচাতেই হবে! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল তাইতা। আবার দৌড়ে গেল মেরেন। আঘাত হানতে লাগল মুণ্ডহীন সাপের গায়ে। দিমিতারের পড়ে থাকার জায়গায় যাবার পথ তৈরির প্রয়াস পাচ্ছে। অবশেষে শোরগোলে সচেতন হয়ে অন্য ভৃত্যরাও দৌড়ে এলো। ওদের ভেতর সবচেয়ে সাহসীজন মেরেনকে অনুসরণ করে তাঁবুতে ঢুকল, সাপটাকে টেনে একপাশে সরিয়ে মুক্ত করল দিমিতারকে। অচেতন হয়ে আছেন তিনি, দরদর করে রক্ত বের হয়ে আসছে কাঁধের ক্ষতস্থান থেকে।

নিজের ক্ষত উপেক্ষা করে দ্রুত কাজে নামল তাইতা। বুড়ো মানুষটার বুক ক্ষতবিক্ষত, ক্ষতে ভরা। বুকে হাত বুলিয়ে অন্তত দুটি হাড় ভাঙার ব্যাপারে নিশ্চিত হলো ও, কিন্তু সবার আগে ওর কাঁধের ক্ষতের রক্তক্ষরণ বন্ধ করাই জরুরি। ব্যথায় জ্ঞান ফিরে এল দিমিতারের। তাঁবুর এক কোণে রাখা কাসারিতে জ্বলন্ত আগুনে মেরেনের ড্যাগারের ডগা তাতিয়ে কামড়ের জায়গাগুলো পরিষ্কার করার সময় ওকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করল তাইতা।

সাপের কামড় বিষাক্ত নয়। এটা অন্তত ভাগ্যের ব্যাপার, দিমিতারকে বলল।

হয়তো এই একটা ব্যাপারই আছে, ব্যথায় আড়ষ্ট দিমিতারের কণ্ঠস্বর। ওই সাপটা স্বাভাবিক নয়, তাইতা। শূন্যতা থেকে পাঠানো হয়েছে ওটাকে।

এ-কথার বিরোধিতার করার মতো স্বস্তিদায়ক কোনও যুক্তি খুঁজে পেল না তাইতা, তবে বুড়ো মানুষটার হতাশাকে প্রশ্রয় দিতে চাইল না ও। আরে, রাখুন, পুরোনো বন্ধু, বলল ও। এমন কিছু খারাপ হয়নি যাকে দুশ্চিন্তা করে আরও খারাপ করে তুলতে হবে। আমরা দুজনই বেঁচে আছি। ইয়োসের একটা যন্ত্র না হয়ে সাপটা স্বাভাবিকও হয়ে থাকতে পারে।

আগে কখনও মিশরে এমন প্রাণীর কথা শুনেছেন? জানতে চাইলেন দিমিতার।

দক্ষিণের দেশে এদের দেখেছি, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল তাইতা।

দক্ষিণে, অনেক দূরে?

হ্যাঁ, সত্যি, স্বীকার গেল তাইতা। এশিয়ার সিন্ধু নদেরও ওধারে, নীল নদ যেখানে দুটো ধারায় ভাগ হয়ে গেছে, তারও দক্ষিণে।

সব সময়ই গভীর জঙ্গলে, নাছোড়বান্দা দিমিতার। মরুভূমিতে কোনও সময়ই না? এত বিরাট তো নয়ই?

যা বলেন, হার মানল তাইতা।

আমাকে মারতেই পাঠানো হয়েছে ওটাকে, আপনাকে নয়। আপনার মৃত্যু চায় সে-এখনই না, চূড়ান্ত সুরে বললেন দিমিতার।

নীরবে পরীক্ষা চালিয়ে গেল তাইতা। দিমিতারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ হাড় ভাঙেনি দেখে স্বস্তি বোধ করল। পাতন করা মদে ওর কাঁধ ধুয়ে ক্ষতস্থান মলমে ঢেকে লিনেনের ফিতেয় ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিল ও। তারপরই কেবল নিজের ক্ষতের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ মিলল।

নিজের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর দিমিতারকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ও। মেরেন যেখানে দানবীয় পাইথনের লাশ রেখেছিল সেদিকে এগিয়ে যেতে সাহায়্য করল ওকে। মাথা আর লেজের অংশ বাদে পনেরটা টুকরোরই মাপ নিল ওরা। এমনকি মেরেনের পেশীবহুল বাহুও ওটার সবচেয়ে স্কুল অংশের বেড়া পেল না। বেশ অনেক আগেই মারা গেলেও অসাধারণ নকশা করা চামড়ার নিচে এখনও নাচছে পেশিগুলো, পাক খাচ্ছে।

ছড়ির ডগা দিয়ে সাপের খণ্ডিত মাথাটা নাড়ল তাইতা, তারপর খুঁচিয়ে খুলে ফেলল মুখটা। চোয়ালের বাঁধন আলগা করার ক্ষমতা ছিল ওটার, যাতে বিশালদেহী মানুষও গিলে ফেলার মতো বড় হাঁ করতে পারে।

মেরেনের সুদর্শন চেহারায় ঘৃণার ছাপ ঠিকরে পড়ছে। বিশ্রী, অশুভ প্রাণী। ঠিকই বলেছেন দিমিতার। দানবটা ঠিক শূন্যতা থেকে এসেছে। ওটার লাশ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলব আমি।

তেমন কিছুই করবে না তুমি, দৃঢ় কণ্ঠে বলল তাইতা। এমনি অতিপ্রাকৃত প্রাণীর চর্বিতে সক্রিয় জাদুকরী শক্তি থাকে। যদি, বেশ সম্ভবপর মনে হচ্ছে, এটা ডাইনীর জাদু বলে সৃষ্টি হয়ে থাকলে আমরা হয়তো ওটাকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব।

তাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানা না থাকলে, যুক্তি দেখাল মেরেন। কীভাবে ফেরত পাঠাবেন ওটাকে?

এটা তার সৃষ্টি, তারই অংশ। এটাকে অনেকটা ঘর চেনানোর পায়রার মতো তার কাছে পাঠাতে পারব আমরা, ব্যাখ্যা করলেন দিমিতার।

অস্বস্তির সাথে নড়ে উঠল মেরেন। এতগুলো বছর ম্যাগাসের সাথে থাকলেও এই ধরনের রহস্য ওকে বিভ্রান্ত ও হতাশায় ভরে দেয়।

ওর জন্যে করুণা বোধ করল তাইতা, বন্ধুসুলভ বাঁধনে ওর বাহুর উপরের অংশ ধরল। আবার তোমার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। তুমি না থাকলে দিমিতার আর আমি এখন ওই জানোয়ারটার পেটে থাকতাম।

কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মেরেনের উদ্বিগ্ন চেহারা। তাহলে আমাকে বলুন, ওটাকে নিয়ে কী করতে চান আপনারা। কম্পিত লাশের গায়ে একটা লাথি হাঁকাল ও। ধীরে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে বিরাট গোলকের আকার নিচ্ছে ওটা।

আমরা আহত। জাদুর শক্তি কাজে লাগানোর মতো সেরে উঠতে বেশ কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। ওটাকে এমন কোনও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাও যেখানে শকুন বা শেয়াল খেয়ে নেবে না। বলল তাইতা। পরে ওটার ছাল খসিয়ে পানিতে সেদ্ধ করব।

চেষ্টা করলেও পাইথনের লাশ উটের পিঠে ওঠাতে পারল না মেরেন। লাশের গন্ধে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল ওটা। চিৎকার করে কামড়ে দিতে চাইল; শেষে মেরেন আর পাঁচজন শক্তপোক্ত লোক মিলে টেনে ঘোড়াগুলোর কাছে নিয়ে গেল ওটাকে, তারপর হায়েনা ও অন্য মড়াখেকোদের হাত থেকে বাঁচাতে পাথরে ঢেকে দিল।

ফিরে এসে তাঁবুর মেঝেয় ম্যাজাইদের বসে থাকতে দেখল মেরেন, পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন ওরা। দুজনের শক্তি একত্রিত করতে পরস্পরের হাত ধরে রেখেছে, গোটা শিবিরের চারপাশে নিরাপত্তা ও আড়ালের এটা পর্দা নির্মাণ করেছেন। জটিল অনুষ্ঠান শেষে দিমিতারকে লাল শেপেনের এক ডোজ ওষুধ খাওয়াল তাইতা। অচিরেই ওষুধের প্রভাবে ঘুমে ঢলে পড়লেন বুড়ো মানুষটা।

এবার আমাদের একা থাকতে দাও, সৎ মেরেন। বিশ্রাম নাও, তবে ডাকলেই যেন শুনতে পাও এমন দূরে থেক, বলল তাইতা। নজর রাখার সুবিধার কথা ভেবে দিমিতারের পাশে বসল ও। কিন্তু ওর নিজের শরীরই বাধ মানছে না, গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল ও। ঘুম থেকে জেগে দেখল ওর আহত হাত প্রবল বেগে আঁকাচ্ছে মেরেন। ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসল ও। গর্জে উঠল, কী সমস্যা তোমার? কাণ্ডজ্ঞান খুইয়েছ নাকি?

ম্যাগাস, আসুন, জলদি!

ওর কণ্ঠের জরুরি তাগিদ আর মুখের অভিব্যাক্তি সতর্ক করে তুলল তাইতাকে। দিমিতারের দিকে চোখ ফেরাল ও। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল বুড়ো মানুষটা এখনও ঘুমাচ্ছেন। হাঁচড়েপাছড়ে উঠে দাঁড়াল ও। কী হয়েছে? জানতে চাইল, কিন্তু মেরেন চলে গেছে। ভোরের শীতল হাওয়ায় ওকে অনুসরণ করে বাইরে এলো তাইতা। ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে ছুটে যেতে দেখল ওকে। ওর কাছে যাবার পর নিঃশব্দে সরীসৃপকে ঢেকে রাখা পাথরের পটার দিকে ইঙ্গিত করল মেরেন। মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্ত বোধ করল তাইতা। তারপর দেখল পাথরগুলো একপাশে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

সাপটা চলে গেছে, হড়বড় করে বলল মেরেন। রাতের বেলায়ই অদৃশ্য হয়ে গেছে ওটা। বলির উপর রেখে যাওয়া পাইথনের ভারি দেহের ছাপ দেখাল। রক্তের কয়েকটা দলা শুকিয়ে কালচে বলের আকৃতি নিয়েছে। এছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ঘাড়ের পেছনের পশমগুলো খাড়া হয়ে গেছে, টের পেল তাইতা; ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ লেগেছে যেন। ঠিকমতো তল্লাশি করেছ তো?

মাথা দোলাল মেরেন। শিবিরের আশপাশের আধা লীগ এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোনও নিশানাই পাইনি।

কুকুর বা বুনো জানোয়ার খেয়ে নিয়েছে, বলল তাইতা, কিন্তু মেরেন মাথা নাড়ল।

কুকুরগুলোর ওটার কাছে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গন্ধ পেয়েই ওরা চেঁচামেচি জুড়ে দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল।

হায়েনা, শকুন?

না, কোনও পাখির পক্ষে ওই পাথরগুলো সরানো সম্ভব না, তাছাড়া ওই সাইজের একটা লাশ অন্তত শখানেক হায়েনার খাবার হতে পারত। গর্জন আর চিৎকারে রাতের অন্ধকারে মহাগ্যাঞ্জাম বাধিয়ে বসত ওরা। কোনও শব্দ হয়নি। আর কোথাও কোনও ট্র্যাক বা নাদি বা হ্যাঁচড়ানোর দাগও নেই। ঘন কোকড়া চুলে হাত চালাল ও। তারপর গলা নিচু করে বলল, দিমিতারের কথাই ঠিক, এখানে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। মাথা যোগাড় করে উড়ে গেছে, জমিন স্পর্শ করেনি। শূন্যতা থেকে আসা জানোয়ারই ছিল।

দাস আর উটচালকদের কাছে এই কথা বলা যাবে না, ওকে সতর্ক করল তাইতা। এমন কিছু সন্দেহ করলে আমাদের ফেলে চলে যাবে ওরা। ওদের বলবে রাতের বেলায় আমি আর দিমিতার জাদু দিয়ে গায়েব করে দিয়েছি ওটাকে।

*

দিমিতার ফের যাত্রা শুরু করতে পারবেন তাইতা এটা স্থির করার আগে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল, কিন্তু ওর পালকিবাহী উটের বেতাল পদক্ষেপ ভাঙা পাঁজরের ব্যথা আরও তীব্র করে তুলল। ওকে নিয়মিত লাল শেপেনের কড়া ডোজে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হলো তাইতাকে। একই সময়ে কাফেলার চলার গতিও কমাল ও, ওর আরও ভোগান্তি ও আঘাত এড়াতে প্রতিটি যাত্রার মেয়াদও হ্রাস করল।

সরীসৃপের আক্রমণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব থেকেও দ্রুত সেরে উঠল তাইতা। অচিরে উইন্ডস্মোকের পিঠে অনায়াসে সওয়ার হতে পারল ও। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় যাত্রার সময় মেরেনকে দিমিতারের দিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব দিচ্ছে, এই সময় ঘোড়া হাঁকিয়ে কাফেলার সামনে চলে যাচ্ছে ও। আকাশ পরখ করার জন্যে একা হওয়া দরকার ওর। নিশ্চিতভাবে জানে, ওদের গুরুত্বপূর্ণ এই মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাটি স্বর্গীয় বস্তুতে নতুন লক্ষণ ও আলামতে প্রতিফিলিত হয়েছে। অচিরেই চারপাশে প্রচুর আলামত দেখতে পেল। উল্কা ও ধূমকেতুর আঁকের রেখে যাওয়া লেজের আগুনের উজ্জ্বল ছায়ায় আকাশ জ্বলছে, গত পাঁচ বছরে যত দেখেছে এক রাতেই তার চেয়ে ঢের বেশি। আলামাতের এমনি প্রাচুর্য বিভ্রান্তিকর, স্ববিরোধী। বোঝার মতো পরিষ্কার কোনও বার্তা দিচ্ছে না, বরং একই সাথে রয়েছে ভীষণ সতর্কবাণী, আশার প্রতিশ্রুতি, ভয়াবহ হুমকী ও আশ্বাসের লক্ষণ।

সরীসৃপের অদৃশ্য হয়ে যাবার পর দশম রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল, বিরাট আলোকিত গোলক, উল্কার রেখে যাওয়া আগ্নেয় লেজ ম্লান করে দিল। এমনকি বড় বড় গ্রহগুলোকেও তুচ্ছ আলোক বিন্দুতে পরিণত করল ওটা। মধ্যরাতের বেশ পরে পরিচিত এক বিরান সমতলে চলে এল তাইতা। এখন নীলের ডেল্টার দিকে চলে যাওয়া ঢালের কিনারা থেকে পঞ্চাশ লীগেরও কম দূরে রয়েছে ওরা। শিগগিরই ফিরতে হবে ওকে, তাইতা উইন্ডস্মোকের লাগাম টেনে ধরল। ওটার পিঠ থেকে নেমে পথের পাশে একটা চ্যাপ্টা পাথরের আসনের খোঁজ পেল। নাক দিয়ে খোঁচা মারল ওকে মেয়ারটা, তো অন্যমনস্কভাবেই কোমরে ঝোলানো পোটলার মুখ খুলে ধুরা শ্যস্যের দানা খাওয়াল ওটাকে। পুর্ণ মনোযোগের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ও।

লস্ত্রিসের তারার অবশিষ্ট ক্ষীণ মেঘটাকে আলাদা করা যায় কি যায় না। ওটা চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে বুঝতে পেরে বিচ্ছিন্নতার তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করল ও। বিষণ্ণভাবে আবার চাঁদের দিকে চোখ ফেরাল। ফসলের মৌসুমের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে ওটা। পুনরুজ্জীবন ও পুনর্জন্মের মৌসুম। কিন্তু নদীতে বান না ডাকলে ডেল্টায় কোনও ফসলই চাষ করা যাবে না।

সহসা সোজা হয়ে বসল তাইতা। কোনও ভয়ঙ্কর নিগূঢ় ঘটনার সময় বরাবরের মতো শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া শীতল স্রোত টের পেল। ওর চোখের সামনে চাঁদের রেখা বদলে যেতে শুরু করেছে। প্রথমে ভেবেছিল কোনও কুহক হয়তো, কিন্তু কয়েক মিনিটের ভেতর যেন অন্ধকার কোনও দানব কামড়ে ওটার একটা টুকরো গিলে নিল। চোখ ধাঁধানো দ্রুততায় গোলকের বাকি অংশও একই নিয়তি বরণ করল। তার জায়গায় রইল কেবল একটা গাঢ় গহ্বর। তারার আবির্ভাব ঘটল আবার, কিন্তু শুষে নেওয়া আলোর তুলনায় সেসব ক্ষয়ে যাওয়া, রোগাটে।

মনে হচ্ছে, গোটা প্রকৃতি যেন হতচকিত হয়ে গেছে। হাওয়া পড়ে গেছে। এখন নিথর। চারপাশের পাহাড়সারির রেখা অন্ধকারে মিশে গেছে। এমনকি ধূসর মেয়ারটা পর্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে গেছে: কেশর নাচিয়ে আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। এবার পিছু হটল ওটা, তাইতার হাত থেকে লাগাম ছাড়িয়ে নিয়ে যে পথে এসেছিল। সেপথে দুড়দাড় করে ছুটতে শুরু করল দুদ্দাড়। ওকে যেতে দিল তাইতা।

ঘটমান মহাজাগতিক কোনও ঘটনার উপর প্রার্থনা বা মন্ত্রের প্রভাব নেই জানা থাকলেও চাঁদটাকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে জোরে জোরে আহুরা মাযদা ও মিশরের দেবনিচয়কে আহ্বান জানাল তাইতা। এবার আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল লস্ত্রিসের তারাটা। এখন একটা ম্লান দাগমাত্র, মাদুলিটাকে চেইনে ঝুলিয়ে তারাটার দিকে বাড়িয়ে ধরল ও। মনোযোগ এক করে অন্তর্চক্ষুর ক্ষমতা ও ইন্দ্রিয়কে স্থাপন করল ওটার উপর।

লস্ত্রিস! মরিয়া কণ্ঠে চিৎকার করল ও। সব সময় আমার হৃদয়ের আলো ছিলে তুমি! তোমার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দেবতাদের সাথে যোগাযোগ করো, ওরা তোমার কাতারের। আবার চাঁদটাকে জ্বালিয়ে আকাশ আলোকিত করে তোলো।

প্রায় সাথে সাথে চাঁদের প্রান্ত যেখানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ক্ষীণ এক চিলতে আলো দেখা দিল সেখানে। আকারে বেড়ে উঠতে লাগল ওটা। প্রথমে তরবারীর ফলার মতো বাঁকা উজ্জ্বল হয়ে তারপর ক্রমে যুদ্ধের কুড়ালের আকার নিল। মাদুলিটা উঁচু করে ধরে লস্ত্রিসের নাম ধরে ডাকামাত্র সমস্ত ঔজ্জ্বল্য ও আঁক নিয়ে ফিরে এলো চাঁদ। ফের স্বস্তির জোয়ার বয়ে গেল ওর মাঝে। কিন্তু ও জানে, চাঁদ পুনঃস্থাপিত হলেও গ্রহণের মাধ্যমে আবির্ভূত হুমকী রয়ে গেছে; অশুভ সঙ্কেত আর সব মহান শুভলক্ষণ নাকচ করে দিচ্ছে।

মরোখ চাঁদের ভীতিককর দৃশ্য সামলে নিতে গিয়ে অন্ধকারের অবশিষ্ট প্রায় সম্পূর্ণ সময়টুকুই লেগে গেল ওর, অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে ছড়িটা তুলে নিয়ে মেয়ারের ঘেঁজে নামল ও। লীগ খানেক এগোনোর পরেই দেখা মিলল ওটার। পথের পাশে একটা বেঁটে মরু ঝোঁপের পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে। ওকে দেখে খুশিতে ডাক ছাড়ল, তারপর নিজের অমার্জনীয় আচরণের জন্যে অনুতাপ দেখিয়ে ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে এলো। ওটার পিঠে চেপে বসল তাইতা, ফিরে এলো কাফেলার কাছে।

লোকজন চাঁদের গ্রস্ত হওয়ার দৃশ্য দেখেছে, এমনকি মেরেনের পক্ষেও ওদের সামলে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ওকে ফিরতে দেখেই কাছে এগিয়ে এলো সে। চাঁদের কী হয়েছে, দেখেছেন, ম্যাগাস? কী ভয়ঙ্কর অশুভ লক্ষণ! আপনার অস্তিত্ব নিয়েই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, চেঁচিয়ে বলল সে। আপনি নিরাপদে আছেন, হোরাসকে ধন্যবাদ। দিমিতার জেগে আছেন, আপনার ফেরার অপেক্ষা করছেন। তবে তার আগে কাফেলার কুকুরগুলোর সাথে একটু কথা বলবেন? নিজেদের খুপরিতে ঢুকে পড়তে চাইছে ওরা।

লোকজনকে আশ্বস্ত করতে সময় নিল তাইতা। ওদের বোঝাল, চাঁদের গায়ে যাওয়ার ভেতর কোনও কুলক্ষণ নেই, বরং নীলের বানের খবর বয়ে এনেছে। ওর খ্যাতি এমনই যে, সাথে সাথে কথাটা মেনে নিল ওরা। অবশেষে বেশ শান্তভাবে যাত্রা অব্যাহত রাখতে রাজি হলো। ওদের ছেড়ে দিমিতারের তাঁবুতে চলে এলো তাইতা। গত দশ দিনের ব্যবধানে পাইথনের হাতে কষ্টকর আক্রমণের পরিণতি থেকে কষ্টকরভাবে সেরে উঠছেন বুড়ো মানুষটা। এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। অবশ্য তাইতাকে গম্ভীর চেহারায় স্বাগত জানালেন তিনি। রাতের বাকি অংশ একসাথে নিরিবিলিতে বসে চাঁদের অন্ধকার হয়ে যাবার ব্যাপারে আলোচনা করল ওরা।

এমন আরও অনেক ঘটনা দেখার মতো আয়ু পেয়েছি আমি, কোমল কণ্ঠে বললেন দিমিতার। তবে খুব কমই এমন পূর্ণাঙ্গ লোপ চোখে পড়েছে।

মাথা দোলাল তাইতা। আসলেই এর আগে মাত্র দুবার এমন ঘটনা দেখেছি। সব সময়ই তা কোনও না কোনও বিপর্যয় ডেকে এনেছে-মহান রাজার মৃত্যু, সমৃদ্ধ সুন্দর শহরের পতন, দুর্ভিক্ষ বা পঙ্গপালের আক্রমণ।

এটা মিথ্যার অন্ধকার শক্তির আরেকটা প্রকাশ, বিড়বিড় করে বললেন দিমিতার। আমার বিশ্বাস ইয়োস ক্ষমতা জাহির করছে। আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে, মরিয়া করে তুলতে চাইছে আমাদের।

আমাদের আর এই পথে থাকা চলবে না; বরং জলদি থেবসে যেতে হবে, বলল তাইতা।

সবচেয়ে বড় কথা, কোনওভাবেই সতর্কতায় ঢিল দেওয়া চলবে না আমাদের। ধরে নিতে হবে, দিন কি রাতের যেকোনও সময় পরের হামলা চালাতে পারে সে। সিরিয়াসভাবে তাইতার মুখ জরিপ করলেন দিমিতার। পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার মতো ডাইনীর কূটকৌশল আর দক্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো যে কেমন ভয়ঙ্কর বোঝা কঠিন। আপনার মনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ইমেজ রোপন করার ক্ষমতা রাখে সে। আপনার ছোটবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারে, এমনকি এত স্পষ্টভাবে আপনার বাবা-মায়ের ছবি ফুটিয়ে তুলবে যে সন্দেহই হবে না।

আমার বেলায় তাতে কিছুটা সমস্যা হবে তার, তীর্যক কণ্ঠে বলল তাইতা। কারণ আমি কোনওদিন বাবা-মাকে দেখিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *