১. আমার স্বদেশ

দি বিগ ফোর (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি

০১.

আমার স্বদেশ ইংল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে আমার দু-চোখ জলে ভরে উঠল। জীবিকার তাগিদে আমাকে আর্জেন্টিনায় থাকতে হয়। স্ত্রীকে সেখানে রেখে, মাস কয়েকের জন্যে দেশে ফিরছি। ভেবেছি, পুরোন বন্ধু এরকুল পোয়ারোর ফ্ল্যাটে হঠাৎ হাজির হয়ে ওকে চমকে দেব।

পোয়ারো একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা। তবে সে এখন আর রহস্যভেদের নেশায় ইংল্যান্ডের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটোছুটি করে না। গোয়েন্দা না বলে তাকে এখন কনসালটিং ডিটেকটিভ বলাই ভালো।

লন্ডনে পৌঁছে, একটা হোটেলে মালপত্র রেখে পোয়ারোর ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়ে তাকে চমকে দিলাম।

–আরে হেস্টিংস, বলে সে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরল আমাকে।

আমি তার কাছে থাকার অভিপ্রায় জানালে সে আমাকে দুঃখপ্রকাশ করে জানালো যে, দেড় বছর বাদে আমি আর্জেন্টিনা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরলাম, আর এক ঘন্টার মধ্যে তাকে ইংল্যান্ড থেকে আর্জেন্টিনায় যেতে হচ্ছে। জাহাজ (তখনও বিমানযাত্রা এত স্বাভাবিক হয়নি) কারণ মার্কিন কোটিপতি আবে রাইল্যান্ডের সেক্রেটারী তার সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছিল, তাদের রিয়ো-ডি-জেনিরোর একটা মস্তবড় কোম্পানিতে নাকি মস্ত একটা গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। সে যেন সে সম্পর্কে রিয়োতে গিয়ে তদন্ত করে। ব্যাপারটা নাকি খুবই গোেপনীয়। তাই ঘটনাস্থলে পোয়ারোকে পৌঁছে সবকিছু জানাতে হবে। ফী হিসাবে রাইল্যান্ড নাকি বিরাট অঙ্কের টাকা দিতে রাজি হয়েছে; পোয়ারো ঠিক করেছে এই কেসটার পর আর্জেন্টিনাতে একটা সম্পত্তি কিনে বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দেবে।

পোয়ারো বলল, মোটা অঙ্কের টাকাটা না পেলে আমি যেতে রাজি হতাম না। কারণ, নিজেরই উদ্যোগে আর একটা ব্যাপারে আমি এখানে তদন্ত শুরু করেছিলুম। চতুরঙ্গ বলে একটা মস্ত অপরাধী সঙ্রে ব্যাপারে। ওরা সারা পৃথিবীতে জাল পেতেছে আর চারজন লোক তাদের চালাচ্ছে।

আমি পোয়ারাকে বললাম, তাহলে তোমার এখানেই থাকা উচিত, রাইল্যান্ডের কাজটাকে নাকচ করে দাও।

শুনে পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার কথার কখনও নড়চড় হয় না, তা তো তুমি জানো। একমাত্র যদি কারো প্রাণসঙ্কট হয়, তবেই আমি থাকতে পারি।

হঠাৎ আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনলাম, ভিতরের ঘর থেকে যেন একটা আওয়াজ এলো।

-কে, কে ওখানে?

পোয়ারো হেসে বলল, কোনো আগন্তুক হয়তো।

-কিন্তু ভেতরকার ঘরের তো একটাই দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে আমাদের সামনে দিয়ে ছাড়া যাবার উপায় নেই।

-বুদ্ধি খাটাও।

–ও, হা জানলা আছে বটে।

বলতে না বলতে ভিতরকার ঘরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। দেখলাম, সর্বাঙ্গে ধূলা-কাদা মাখা একটা পাংশু, শীর্ণ মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে তারপর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। ওর মুখে খানিকটা ব্র্যান্ডি ঢেলে দিলাম। জ্ঞান ফিরতে জিজ্ঞেস করলাম, কাকে চান? কী চান আপনি?

–মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো, ১৪ নম্বর ফারাওয়ে স্ট্রীট।

পোয়ারো আমাকে ডাক্তার রিজওয়েকে ফোনে ডাকতে নির্দেশ দিলো। তিনি এলেন। রোগীকে দু-একটা প্রশ্ন করতে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। কাগজ পেন্সিল এগিয়ে দিতে সে দুর্বল হাতে গোটা গোটা অক্ষরে শুধু লিখলো : ৪, ৪, ৪, ৪ ডাক্তার বললেন, খুব সম্ভব ও লিখতে চায় ১৪; ১৪ ফারাওয়ে স্ট্রীট। যাই হোক, বিকেলে আমি ওকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করবো। পোয়ারোর বিদেশযাত্রার কথা শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে, এখানে ও একাই থাকুক, ল্যান্ডলেডী যেন মাঝেমধ্যে ওকে একটু দেখে যান। তিনি চলে গেলেন।

পোয়ারো বলল, ব্যাপারটা রহস্যময়। ঠিক তখনই আমাদের অপরিচিত অতিথি হঠাৎ উঠে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলল : লি চ্যাং ইয়েন।…চতুরঙ্গের বড়কর্তা। আমি তাই নাম দিয়েছি পয়লা নম্বর। দোসরার নাম কেউ কখনও উল্লেখ করে না। তার প্রতীক হচ্ছে পেটকাটা এস–অর্থাৎ ডলার। মনে হয়, সে আমেরিকার মস্ত ধনী লোক। তিননম্বর একটি ফরাসী মহিলা। আর চার নম্বর

ব্যগ্র গলায় পোয়ারো বলল, কে সে?

-সে হচ্ছে জল্লাদ–বলতে বলতে লোকটি আবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। আমরা ওকে শুইয়ে রেখে সাদামটনের ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছলাম। কিন্তু সাদামটনের কয়েক মাইল আগে লাইন ক্লিয়ার না পেয়ে ট্রেনটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। পোয়ারো চিৎকার করে বলল, লাফিয়ে পড়ো হেস্টিংস, বলে পোয়ারো লাইনের উপর লাফ দিলো।

-সুটকেসগুলো ফেলে দাও, নেমে এসো।

নামলাম, ট্রেনও তখুনি স্টার্ট দিলো।

ব্যাপার কি? জিজ্ঞেস করতে পোয়ারো বলল, ব্যাপারটা এতক্ষণে স্পষ্ট বুঝলাম। চলো এখুনি, আমাদের লন্ডনে ফিরতে হবে।

.

০২.

 আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে ফিরে চললাম। পোয়রো বলল, জান হেস্টিংস, চতুরঙ্গ আমাকে তাদের পথের কাটা মনে ভাবে, তাই আমাকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল।

-তার মানে?

–মানে, অতি সহজ। সেই অচেনা অতিথির কোনো বিপদ ঘটবেই।

ফ্ল্যাটে ফিরলাম। ল্যান্ডলেডী দরজা খুলে দিলো। তার মুখে শুনলাম কেউ আমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকেনি। তাড়াতাড়ি আমরা ঘরে গেলাম।

পোয়ারো আমাকে জানালো, হেস্টিংস, সে..সেই মানুষটি…মারা গেছে। মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক আগে সে মারা গেছে।

ডাক্তার চলে যাবার পর স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডে ফোন করে পোয়ারো ইন্সপেক্টর জ্যাপকে ডাকল। সে তার পুরনো বন্ধু।

খানিক বাদেই মিসেস পিয়ারসন এসে খবর দিলেন যে, হ্যাঁনওয়েলের উন্মাদাশ্রম থেকে ইউনিফরম পরা একজন রক্ষী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

আমরা তাকে ওপরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। সে এলো। জানালো, আমাদের গারদ থেকে একজন পাগল কাল রাতে পালিয়েছে। আপনাদের ফ্ল্যাটে সে ঢোকেনি তো?

ঢুকেছিল। সে মারা গেছে। শুনে যেন লোকটা খুশী হল। বলল, বাঁচা গেছে। এমনিতে লোকটা শান্ত ছিল। আজগুবি সব কথা বলত। বলত কে যেন এক চীনেম্যান ওকে খুন করতে চায়। প্রায় দু-বছর সে গারদে ছিল।

লোকটাকে সনাক্ত করার জন্য পোয়ারো রক্ষীকে ভিতরকার ঘরে নিয়ে গেল। সে দেখে বলল, হ্যাঁ সেই বটে। আচ্ছা এখনি চলি, মরাটাকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করি গে। আর তদন্ত যদি হয়, আপনাদের সাক্ষী দিতে হবে।

লোকটা চলে যাবার খানিক বাদে জ্যাপ এসে পৌঁছাল। সব শোনার পর মৃতদেহ দেখে সে চমকে উঠল, আরে এ যে মেয়ার লিং।

কে মেয়ার লিং?

–পুলিশের লোক নয়, সিক্রেট সার্ভিসের লোক। বছর পাঁচেক আগে রাশিয়ায় গিয়েছিল। তারপর আর কেউ ওর খোঁজ পায়নি। সবাই ধরেই নিয়েছিল, বিদেশে ও খুন হয়েছে।

জ্যাপ চলে যাবার পর পোয়ারো বলল, আচ্ছা হেস্টিংস, ওকে রেখে চলে যাবার সময় তুমি কি জানলাগুলো খুলে দিয়েছিলে?

-না তো। জানলা তখন বন্ধই ছিল।

তবে ঘরে ঢোকার জন্যে যদি কেউ জানলা খুলে থাকে, তাহলে মাত্র একটা জানলা খুললেই তো চলতো। তাহলে এ-ঘরের আর বসবার ঘরের সমস্ত জানলাগুলো সে খুলতে গেল কেন? আমার মনে হচ্ছে, আমরা বেরিয়ে যাবার পর কেউ এ ঘরে ঢুকে ওর মুখের ওপর প্রুসিক অ্যাসিড চেপে ধরে ওকে হত্যা করেছে।

বলো কি? পোস্টমর্টেমে এসব নিশ্চয় টের পাওয়া যাবে।

–কিচ্ছু টের পাওয়া যাবে না। নাকের ওপর প্রুসিক অ্যাসিড চেপে ধরলে মৃত্যু অনিবার্য। শুধু ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা তীব্র গন্ধ থেকে যায়। হত্যাকারী গন্ধ হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার জন্যে জানলাগুলো খুলে দিয়েছে। শরীরে কোনো চিহ্ন না থাকার জন্যে সবাই ভাবছে এ মৃত্যু স্বাভাবিক।

মুখ তুলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো উত্তেজনায় চীৎকার করে উঠল, ঘড়ি! দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখো হেস্টিংস। চারটে বাজে, কিছু বুঝছো?

আমি ঘাড় নাড়লাম। পোয়ারো বলল, মেয়ার লিং আততায়ীর পরিচয় জানিয়ে একটা সঙ্কেত রেখে গেছে। কাটা ঘুরিয়ে বাজিয়ে, ঘড়িটাকে সে বন্ধ করে দিয়েছে। কেন? অর্থাৎ হত্যাকারী চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তা সেই জল্লাদ।

পোয়ারো এরপর হালওয়েল উন্মাদাশ্রমে ফোন করে জানালো সেখান থেকে কাল রাত্তিরে কোনো পাগলা পালায়নি।

ফোন রেখে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, আমার ধারণা উন্মাদাশ্রমের ঐ রক্ষীই হচ্ছে চার নম্বর। তুমি ভাবছো অসম্ভব। কিন্তু সবই মেকআপ আর ছদ্মবেশের ব্যাপার। খানিক বাদেই তার সাজ পোষাক, গলার আগের স্বর সবকিছু পাল্টে যাবে। একেবারে অন্য মানুষ ভবিষ্যতে কেউ চিনতে পারবে না।

-তাহলে ভবিষ্যতে দেখা হবে?

নিশ্চয়ই। প্রথম রাউন্ডে ওরা জিতে গেল। কিন্তু রাউন্ড এখনও বাকি আছে। ওরা ভেবেছিল আমাকে লন্ডন থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় সরিয়ে দেবে। তাতে ওরা হেরেছে। আর পোয়ারো যে লন্ডনে আছে, এটা ওদের কাছে নিশ্চয়ই সুখবর নয়।

.

০৩.

বলা বাহুল্য আমরা যাকে উন্মাদাশ্রমের রক্ষী ভেবেছিলাম, সে আর ফিরে আসেনি। যাই হোক, ময়না তদন্তের সময় পোয়ারো স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই বলে জুরিকে বিশ্বাস করানো যাবে না এই ভেবে এবং চতুরঙ্গের কারসাজিটা আমরা টের পেয়েছি, এটা তারা বুঝতে পারলে সতর্ক হয়ে যাবে, এই সমস্ত চিন্তা করে চুপ করে রইল।

জুরি রায় দিলেন, এ মৃত্যু আকস্মিক। কয়েকদিন চুপচাপ কাটানোর পর পোয়ারো প্রস্তাব দিলো, চলো তোমাকে মিঃ জন ইনগ্লেসের কাছে নিয়ে যাই, চীনা গুপ্ত সমিতিগুলো সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট খবরাখবর রাখেন।

মিঃ ইনগ্লেসের বাড়িতে গেলাম। চীনা ভৃত্য দরজা খুলে দিল। মিঃ ইনগ্লেস বললেন, বসুন। আপনাদের চিঠি পেয়েছি। কার সম্বন্ধে খবর চান আপনারা? পোয়ারো বলল, লি চ্যাং ইয়েন সম্পর্কে।

নাম শুনে ইনগ্লেস যেন চমকে উঠলেন, বললেন চিনি, তবে যতটা চেনা দরকার ততটা নয়। পৃথিবীর একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যাবতীয় সামাজিক এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার–সে ওলট-পালট ঘটিয়ে দিতে চায়। তেমন ওলট পালট যে এখানে ওখানে ঘটছে, আমার বিশ্বাস সেটা লি চ্যাং-এর নির্দেশেই। সে চায়, পৃথিবী জুড়ে তার ক্ষমতার জাল বিছাতে। তার টাকার অন্ত নেই। বিশ্ববিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানীকেও সে হাত করেছে।

–কোথায় থাকে সে? কেউ তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেনি?

–পিকিংয়ে থাকে। আমি যতদূর জানি চারজন তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছে এবং তারা এখন কেউ জীবিত নয়। প্রথমজন একটা কাগজে প্রবন্ধ লিখেছিল, তাতে সে পিকিংয়ের দাঙ্গার জন্য চ্যাং দায়ী এরকম আভাস দেওয়ায় ছুরিকাহত হয়। দ্বিতীয়জন এবং তৃতীয়জন বক্তৃতায় লি চ্যাংয়ের নামোল্লেখ করাতে তাদেরও এক সপ্তাহের মধ্যে একজনকে বিষ খাইয়ে মারা হল, অন্যজন কলেরায়; অথচ কলেরায় আক্রান্ত হবার মতো কোনো কারণই ছিল না। চতুর্থজনকেও বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কোনো আততায়ী ধরা পড়েনি। প্রমাণও কিছু থাকে না বলে মামলাগুলো আদালতে খোপে টেকে না। বছর কয়েক আগে এক অল্পবয়সী চীনা কেমিস্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাকে দিয়ে জঘন্য সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করানো হতো। সে হতাশায় ভেঙে পড়ে আমার কাছে এক রাত্তিরের জন্যে আশ্রয় চায়। আশ্রয় তাকে দিয়েছিলুম। ভেবেছিলাম রাত্তিরটা কাটলে পরেরদিন তাকে সব প্রশ্ন করবো। কিন্তু সেই রাত্তিরেই আমার বাড়িতে আগুন লাগল। সে পুড়ে মরলো। প্রমাণ কিছু নেই।

পোয়ারো বলল, দিন কয়েক আগে আমার ফ্ল্যাটেও একজন অচেনা আগন্তুকের মৃত্যু হয়। সে চারজন মানুষের code নাম দিয়েছিল। প্রথমজন লি চ্যাং; দ্বিতীয়জন এক মার্কিন কোটিপতি, তৃতীয়জন একজন ফরাসী মহিলা। চতুর্থজন–সে বলছিল একজন জল্লাদ। আপনি চতুর্থজনের নাম শুনেছেন?

শুনেছি। আমার এক আলাপী বন্ধু আছে, লোকটি পাঁচ মাতাল, ভবঘুরে গোছের। হাতে কিছু পয়সা জমলেই সে জাহাজে উঠে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াত। সম্প্রতি সে আমাকে একটা চিঠি লিখেছে, তাতে সে আমার কাছে অবিলম্বে দুশো পাউন্ড চেয়ে পাঠিয়েছে। টাকাটা না পাঠলে সে নির্ঘাত চতুরঙ্গের হাতে মারা পড়বে। কেননা টাকা তার আছে কিন্তু সে টাকা তুলতে গেলেই সে মারা পড়বে। তার ঠিকানা হল, গ্লানিট বাঙ্গলো, হপাটন, ডার্টমুর। সত্যি বলতে কি আমি টাকা পাঠাইনি, আমি জানি এটা তার কিছু টাকা হাতাবার কারসাজি। কিন্তু এখন ব্যাপারটা আপনাদের কি মনে হচ্ছে?

-খুবই গুরুতর মঁসিয়ে। এক্ষুনি আমরা হপাটনের দিকে রওনা দেব।

–আমি যদি যাই আপত্তি আছে?

 –কিছুমাত্র নয়? পোয়ারো বলল।

 হপাটন স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রথমে একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম, গ্রানিট বাঙ্গলোটা কোনোদিকে?

-কেন? পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দেখা করতে চান? এই বাড়িতে একটা খুন হয়ে গেল যে।

–কে খুন হয়েছে?

 –কেন, বাড়ির মালিক। বৃদ্ধের জবাব, নাম জোনাথন হোয়েলি।

আমরা কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি গ্রানিট বাঙ্গলোয় পৌঁছালাম। আমরা জ্যাপের বন্ধু শুনে তিনি বললেন, আসুন আজ সকালেই খুনটা হয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছিল প্রায় সত্তর।

আমরা ঘরে পৌঁছে দেখলাম, মেঝের উপর গলা কাটা একটা লাশ পড়ে। চারদিকে রক্ত ভাসছে। ইন্সপেক্টর মেডোজ বলতে লাগলেন, এ বাড়িতে যে মেয়েটা রান্না করে তার নাম বেটসী। সে স্থানীয় বাসিন্দা। বাড়ির অপর মানুষ হল চাকর রবার্ট গ্রান্ট। সে সকালে দুধ আনতে গিয়ে পড়শীর সঙ্গে মিনিট কুড়ির মতো গল্প জুড়েছিল। এই ধরুন দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে মিনিট কুড়ি। খুনটা হয় তারই মধ্যে। গ্রান্ট প্রথমে ফিরে আসে। তারপর আসে বেটসী। গ্র্যান্ট নিজের ঘরে চলে যায়। বেটসীই প্রথম দেখতে পায় কর্তা খুন হয়েছে। সে চীৎকার করে ওঠে। অর্থাৎ খুনের সময় দুজনেই বাইরে ছিল। অন্ততঃ তাদের কথানুযায়ী। আমরা আমাদের কাজ শুরু করলাম। রক্তের ওপর জুতোর ছাপ ধরে আমি গ্রান্টের ঘরে পৌঁছলাম। দেখলাম, তার জুতোর সঙ্গে ছাপ মিলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। বৃদ্ধ জোনাথনের কতকগুলো চীনা পুতুল ছিল। যেগুলো সে আগলে রাখতো, সেই পুতুলগুলো গ্রান্টের ঘর থেকে পাওয়া গেল, তার ঘরে পাওয়া কাগজপত্র থেকে জানা গেল তার আসল নাম আব্রাহাম বিগস। চুরির দায়ে ওকে এর আগে একবছর জেল খাটতে হয়েছিল। সুতরাং তাকে আমরা গ্রেফতার করলাম।

হুম, পোয়ারো বলল, এর আগে কোনো খুনীকে এত প্রমাণ রেখে বোকার মতো কাজ করতে দেখিনি। যাই হোক, চলুন, তার ঘরটা একবার দেখে অসি। আমি ঈষৎ চাপা গলায় পোয়ারোকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপার কি এরকুল, এর মধ্যে আবার কোনো রহস্যের গন্ধ পেলে নাকি?

–ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে দেখ। হোয়েলি তার চিঠিতে লিখেছিল চতুরঙ্গ তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু গ্রান্ট যদি সত্যিই চতুরঙ্গের লোক হতো তবে কি সে পুলিশের হাত ধরা পড়ার জন্যে বসে থাকত। তাও এমনভাবে প্রমাণ সাজিয়ে? না, হেস্টিংস আমি হয়তো জুতোর ছাপ মাপবো না; কিন্তু বুদ্ধি খাটাবো।

.

০৪.

 লাশ সরিয়ে নেবার পর ইন্সপেক্টার আমাদের ঐ ঘরে বসতে বললেন। গ্রান্টের জুতোজোড়া এনে বললেন, এই জুতোর সঙ্গে মেঝের ছাপ মিলিয়ে নিতে পারেন। আমি একটা কাজ সেরে আসছি, বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাবার পর আমরা দেখলাম লাশটার জায়গা থেকে দু-সারি ঢুকবার আর দু-সারি বেরিয়ে যাবার দাগ রয়েছে। ছাপ জুতোজোড়ার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।

পোয়ারো বলল, হুম, খুনী যদি খুন করে বেরিয়ে যায়, তো দুসারি দাগ থাকবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে দু-সারি ঢোকার, দু-সারির বেরিয়ে যাবার দাগ। তবে কি খুনী বেরিয়ে যাবার পর আবার কিছু নিতে দ্বিতীয়বার এঘরে ঢুকেছিল? ঐ পুতুলগুলো? পুতুলগুলো তো গ্রান্টের ঘরে পাওয়া গেছে।

ঘুরতে ঘুরতে আমরা ভাড়ার ঘরে ঢুকলাম। সেখানে পোয়ারো বরফের কুচি মাখানো একখানা খাসীর ঠ্যাং আবিষ্কার করে চীৎকার করে উঠল। খুব সম্ভবত কসাই-এর ডেলিভারি দিয়ে গেছে। সেটা আবার আলমারীতে সে রেখে দিল। আমরা আবার বসবার ঘরে গিয়ে বসলাম। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর মেজাজে এসে গেলেন।

পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞেস করল, হেস্টিংস আজ কি বার?

–সোমবার।

-খুনীরা এটুকু বোঝে না যে, সপ্তাহের প্রথম দিনে, উষ্ণতা সত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইট তখন অন্ততঃ কসাইয়ের ছদ্মবেশে খুন করতে নেই।

তার কথার মাথামুণ্ড কিছুই আমাদের মাথায় ঢুকল না। এরপর পোয়ারো ইন্সপেক্টর মেডোজের দিকে তাকিয়ে বললো, একটা অনুরোধ, আমি একবার গ্রান্টের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারজন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অনুমতি আমি আনিয়ে দেব। সাক্ষাৎটা খুবই জরুরী। আমি জানি গ্রান্ট খুনী নয়। যে খুন করেছে সে অল্পবয়সী। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, হাতে ছোরা নিয়ে ঢুকেছিল। তারপর হোয়েলের গলায় ছোরা বসিয়ে, বেরিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে সে চলে যায়।

তাই যদি হতো, কেউ তাকে দেখতে পেত না?

-ইন্সপেকটর মেজােজ, পরে আপনাকে সব বলব, আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন, খুনীকে সবাই লক্ষ্য করেছে কিন্তু নজর করেনি।

সবাই মিলে থানায় গেলাম। আমি আর পোয়ারো গ্রান্টের কাছে গিয়ে, তাকে সব কথা খুলে বলতে লাগলাম, যদি সে জেল থেকে ছাড়া পেতে চায়।

গ্রান্ট অনেক ইতস্ততঃ করে বলল, আমি দুধ নিয়ে এসে সরাসরি কর্তার ঘরে ঢুকেছিলুম। কর্তা খুন হয়েছেন দেখে, আমি ভাবলাম আমার পালানো উচিত। কারণ আমি এর আগে চুরির দায়ে বারকয়েক জেল খেটেছি। তাই তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে এলুম। ইতিমধ্যে বেটসী এসে চীৎকার করে ওঠায় সকলে চলে আসে। যার ফলে আমি আর পালাতে পারিনি।

–আর ঐ পুতুলগুলো? ওগুলো তোমার ঘরে এলো কি করে?

গ্রান্ট একটু লজ্জিতভাবে জানালো, ওগুলো কর্তার ঘর থেকে বেরোবার সময় নিজের ঘরে নিয়ে চলে আসি।

মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, স্বভাব যায় না মলে। তোমার মনে হল, পালাবেই যদি, তখন একটা কিছু হাতিয়ে পালানো যাক। যাকগে এবার বলল একাজটা তোমাকে কে জুটিয়ে দিয়েছিল।

-এক ভদ্রলোক, নাম সণ্ডার্স। তার মাথায় কালো টুপী আর চোখে চশমা ছিল। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন যে, আমি যদি সৎপথে থাকি তাহলে তিনি একটা কাজ জুটিয়ে দেবেন।

পোয়ারো বলল, আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তোমার নিশ্চয়ই একজোড়া জুতো কেনবার পয়সা ছিল না। তাই মিঃ সণ্ডার্স তোমাকে একজোড়া জুতো দান করেছিলেন, তাই না? গ্রান্ট অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ দিয়েছিলেন। সেই জুতোই আমি পরতুম।

হাজত থেকে বেরিয়ে–আমি, পোয়ারো আর মিঃ ইনগ্লেস একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম।

ইনগ্লেস বললেন, কী, রহস্য পরিষ্কার হল?

-জলের মতো পরিষ্কার। এ কাজ যে চতুরঙ্গের; তাতে কোনো সন্দেহই নেই। সণ্ডার্স আসলে ওদের লোক। খুনের পরিকল্পনা করেই সণ্ডার্স একই সাইজের দু-জোড়া জুতো কেনে এবং গ্রান্টকে একজোড়া দেয়। নিজে সেই জুতো পায়ে দিয়ে আসে এবং খুন করে জুতোজোড়াকে হাতে ঝুলিয়ে গাড়িতে ওঠে। ঘরের মধ্যে দু-জোড়া একই রকম ছাপ দেখেছি কারণ দু-জোড়া জুতোই একই রকমের।

ইনগ্লেস বললেন, কিন্তু দিনদুপুরে তাকে কেউ দেখতে পেল না?

মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, খুনী এসেছিল কসাইয়ের ছদ্মবেশে। দৃশ্যটা এতই স্বাভাবিক ছিল যে কেউ নজর করে দেখেনি।

আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম, খাসীর ঠ্যাংটা দেখে তুমি সব বুঝতে পেরেছো, তাই না?

–ঠিক। গতকাল ছিল রবিবার, কসাইয়ের দোকান বন্ধ থাকে। অথচ ও মাংস শনিবারের হওয়াও সম্ভব নয়, কারণ এই সত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইট টেম্পারেচারে মাংসের গায়ে নিশ্চয়ই বরফের কুচি লেগে থাকত না। সণ্ডার্স তার ছদ্মনাম এবং বেশটাও ছদ্মবেশ।

.

০৫.

 খুনের আসামী হিসেবে রবার্ট গ্রান্টকে আদালতে পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ ছিল, এরকুল পোয়ারোর সাক্ষ্যের পর সেগুলি আর ধোপে টিকলো না।

সপ্তাহ কয়েক পরের কথা। পোয়ারোর ফ্ল্যাটে একদিন সকালবেলায় কথাবার্তার সময় ইন্সপেক্টর জ্যাপ এসে হাজির। তার সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক।

জ্যাপ বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই ভদ্রলোকের নাম ক্যাপ্টেন কেন্ট। ইনি মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের একজন কর্মী। ইনি আপনাকে কিছু বলতে চান। ক্যাপ্টেন কেন্ট বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি জানি আপনি খুবই ব্যস্ত মানুষ। তাই কোনো ভূমিকা না করেই বলি, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে, মাস কয়েক আগে আমেরিকার উপকূলের কাছে পরপর কয়েকটা জাহাজডুবি হয়েছিল। তার ঠিক আগেই জাপানে ভূমিকম্প হয়। আমরা ভূমিকম্পের ফলে জলস্ফীতির, কারণে জাহাজডুবি হয়েছে বলে মেনে নিলাম। তার কিছুদিন পরে একদল দুবৃর্তের কাছ থেকে যে সব কাগজপত্র পাওয়া যায়, তাতে বলতে পারি জাহাজডুবির অন্য কোনো কারণ থাকা সম্ভব। আরও জানতে পারি চতুরঙ্গ নামে একটা সংগঠনের কাছে এমন একটা অস্ত্র আছে যা দূর থেকে মারণ রশ্মি বিকিরণ করে কোনো বস্তুকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমরা এ ব্যাপারে খোঁজখবর করার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত আমাকে আমেরিকা থেকে ব্রিটেনে পাঠানো হয়। আমাকে একজন বিজ্ঞানীর কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই বিজ্ঞানী এক বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তৃতায় বলেন, মারণরশ্মি আবিষ্কার করা এবং অস্ত্র হিসেবে তাকে কাজে লাগনো মোটেই অসম্ভব ব্যাপার নয়।

ক্যাপ্টেন থামতেই পোয়ারো বলল, বিজ্ঞানীর নাম কী?

–মিঃ হ্যালিডে। এঁর বয়স খুব অল্প।

–তার সঙ্গে দেখা করেছেন?

–না। সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন।

 চমকে উঠে পোয়ারো প্রশ্ন করল, কতদিন আগে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিল?

-প্রায় ছ-মাস হবে।

পোয়ারো এবারে ইনস্পেক্টর জ্যাপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইন্সপেক্টর, এই ভদ্রলোকটি নিখোঁজ হবার পর তার আত্মীয় স্বজনরা কি পুলিসকে সে কথা জানিয়েছিল?

জ্যাপ বলল, হ্যাঁ, তার স্ত্রী নিজে আমাদের কাছে এসে বিস্তর কান্নাকাটি করেছিলেন।

-কেন?

–মুচকি হেসে জ্যাপ বলল, প্যারিসে গিয়ে যারা নিরুদ্দেশ হয়, তাদের কখনও পাওয়া যায় না।

প্যারিসেঃ মিঃ হ্যালিডে কি প্যারিসে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন নাকি?

–হ্যাঁ, এতে অবাক হবার কি আছে?

–অবাক হচ্ছি…কারণ মেয়ারলিং-এর কথানুযায়ী চতুরঙ্গের তিননম্বর কর্তা একজন ফরাসী মহিলা! এখন তুমি শুধু মিসেস হ্যালিডের ঠিকানাটা আমাকে দাও। কালই তার সঙ্গে আমি দেখা করব।

জ্যাপ ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দিয়ে বিদায় নিল।

পরদিনই আমরা মিসেস হ্যালিডের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার পাশেই দাঁড়িয়ে বছর পাঁচেকের একটি ফুটফুটে মেয়ে। তার একমাত্র সন্তান।

মিসেস হ্যালিডে বললেন, দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার খ্যাতির কথা আমি শুনেছি। ফরাসী পুলিশের ধারণা, প্যারিসে গিয়ে আমার স্বামী কোনো ফরাসী সুন্দরীর প্রেমে পড়েছেন এবং গা ঢাকা দিয়েছেন কিন্তু আমার স্বামী ছিলেন সত্যিকারের বিজ্ঞানসাধক।

পোয়ারো বললেন, মাদাম, আমি আপনার স্বামীকে খুঁজে বার করব, কথা দিচ্ছি। এখন বলুন আপনার স্বামী কবে প্যারিসে গিয়েছিলেন? কি কাজে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আপনাকে কোনো চিঠি দিয়েছিলেন কিনা, দয়া করে সব খুলে বলুন।

-আমার স্বামী ২০শে জুলাই প্যারিস যান। বৃহস্পতিবার। কথা ছিল, প্যারিসে পৌঁছে তিনি মাদাম অলিভিয়ের এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করবেন।

-তারপর? প্যারিসে গিয়ে আপনার স্বামী কোথায় উঠেছিলেন?

-সন্ধ্যা নাগাদ প্যারিসে পৌঁছে তিনি ক্যাস্তিলিয়ন হোটেলে ওঠেন। পরদিন সকালে তিনি অধ্যাপক বুর্গোনুর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি কাফে রয়্যাল-এ যান এবং সেখানে লাঞ্চ সারেন। টুকিটাকি কাজ সেরে যান প্যাসি অঞ্চলে। সেখানে মাদাম অলিভিয়ের সঙ্গে দেখা করে তিনি বিকেল ছটা নাগাদ আবার পথে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় তিনি কোথায় গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। রাত এগারোটা নাগাদ তিনি হোটেলে ফিরে জিজ্ঞেস করেন তার নামে কোনো চিঠি এসেছে কিনা। এরপর তিনি নিজের ঘরে চলে যান। পরদিন সকালে তিনি হোটেলে থেকে বেরিয়ে যান। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি।

–সকালে কটার সময়ে তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন?

–খুবই সকালে।

–এমনও তো হতে পারে যে, সকালে নয়, রাত্তিরে হোটেলে ফিরে এসে আবার রাত্তিরেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন?

-না, আমার তা মনে হয় না। হোটেলে সারারাত দারোয়ান থাকে, সে নিশ্চয়ই তাহলে লক্ষ্য করত।

-ঠিক কথা। তার মালপত্র কি হোটেলেই পড়েছিল?

-না, সব মালপত্র নয়। হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তাঁর সঙ্গে একটা সুটকেশ ছিল। পোয়ারো বলল, মাদাম, আপনার স্বামী নিরদ্দেশের সন্ধ্যাটা কোথায় কাটিয়েছিলেন, সেটা জানলে অনেকখানি জানা যাবে। আচ্ছা সেদিন হোটেলে কি কোনো চিঠি এসেছিল?

-হ্যাঁ, আমার মনে হয় সে চিঠি আমারই লেখা। তার প্যারিস যাত্রার দিনই আমি তাকে একটা চিঠি পাঠাই।

শুনে পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, আমার মনে হয় এখানে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। কালই আমি প্যারিসে যাব।

বিদায় নেবার আগে পোয়ারো মিসেস হ্যালিডেকে জিজ্ঞেস করলেন, মাদাম, আপনার স্বামী কখনও আপনার কাছে চতুরঙ্গ নামে কোনো সমিতির কথা বলেছেন?

-চতুরঙ্গ? এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাদাম বললেন, না, এমন নাম কখনও শুনেছি বলে আমার মনে হয় না।

.

.

 প্যারিসে পৌঁছে আমরা অধ্যাপক বুর্গোনুর সঙ্গে দেখা করলাম। তার থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। পোয়ারোর সন্দেহ যে, হ্যালিডেকে গুম করে দেওয়া হয়েছে, গুম করেছে চতুরঙ্গ।

এরপর আমরা গেলাম মাদাম অলিভিয়ের বাড়িতে, অবশ্যই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। দীর্ঘাঙ্গী মুখখানি লম্বা শীর্ণ, গালের উপরে একটি পোড়া দাগ। বছর তিনেক আগে তার ল্যাবরেটরিতে একটা মারাত্মক বিস্ফোরণে মাদামের স্বামী মারা যান। গালের ঐ দাগটা বোধহয় তারই স্মৃতিচিহ্ন।

মাদাম জানালেন যে, তিনি দুঃখিত, হ্যালিডের নিখোঁজের ব্যাপারে তিনি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, মঁসিয়ে হ্যালিডে তার বিজ্ঞান সম্মেলনের বক্তৃতায় যে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের কথা বলেছিলেন, আপনি কি মনে করেন যে, তা তৈরি করা সম্ভব?

–অবশ্যই সম্ভব। এ বিষয়ে আমিও কিছু গবেষণা করেছি। রেডিয়াম-সি-নামক পদার্থ থেকে যে রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, তার আকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে এমন কিছু রহস্য আমার কাছে ধরা পড়েছে, যার ফলে, মঁসিয়ে হ্যালিডের কথাকে মোটেই আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তার গবেষণা সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। সেই বিষয়েই আমাদের আলোচনা হয়েছিল ঐদিন।

-আপনারা ল্যাবরেটরি একবার দেখতে পারি?

–বিলক্ষণ। আমাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হলো। যে দরজা দিয়ে আমরা ঢুকেছিলাম সেটা ছাড়া ল্যাবরেটরিতে আরও দুটি দরজা রয়েছে। একটি দিয়ে বাগানে যাওয়া যায়, অন্যটি দিয়ে ছোট্ট চেম্বারে।

মাদাম, পোয়ারো প্রশ্ন করল, মঁসিয়ে হ্যালিডের সঙ্গে যখন আপনার কথা হয় কেউ শুনেছিল।

-না, আমার সহকারী দুজন এঘরে ছিল না। তারা পাশের ঐ ছোট্ট চেম্বারে ছিল। সেখান থেকে কোনো কথা শোনা সম্ভব নয়।

-আচ্ছা মাদাম, মঁসিয়ে হ্যালিডে আপনার এখান থেকে বিদায় নেবার পর কোথায় থাকবেন সে বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?

-না।

 আমরা বিদায় চাইলাম। ল্যাবরেটরি থেকে আমরা হলঘরে বেরিয়ে দেখি, হলঘরের সদর দরজা দিয়ে একজন মহিলা এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছেন। মুখটা দেখা গেল না। তাঁর স্বচ্ছন্দ হাঁটাই বলে দিচ্ছে তিনি ঐ বাড়ির বাসিন্দা।

কম্পাউণ্ডে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, অদ্ভুত মহিলা।

আমি বললাম, ওঁর মুখটা পর্যন্ত তুমি না দেখে অদ্ভুত মহিলা কিভাবে বলছো?

–একথা মনে হবার কারণ এই যে, ওঁর হাতে ছিল চাবির গোছা। এখন বাড়ির বাসিন্দা যদি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়ে দেখে যে, ভিতর থেকে দুজন অপরিচিত মানুষ বেরিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক, এক্ষেত্রে উনি আমাদের দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। আচরণটা একটু অদ্ভুত। কিন্তু এ কি…সরে যাও…সরে যাও।

ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিতেই দেখি একটা মস্ত গাছ ভেঙে পড়ল আমাদের ঠিক পাশেই।

পোয়ারো বলল, একটুর জন্যে বেঁচে গেলাম। চতুরঙ্গ জানে না আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সোজা নয়। আমি পোয়ারোকে বলি, এখন আমরা কি করব?

–চিন্তা করি। শুক্রবার রাত্রে দারোয়ান তাকে শেষ দেখা দেখেছিল। কিন্তু দারোয়ানতো তাকে আগে কখনও দেখেনি। চতুরঙ্গের চারনম্বর কর্তাটি একটি পাকা অভিনেতা। সে সেদিন রাত্রে হ্যালিডের ঘরে ঢুকে রাত কাটিয়ে পরদিন বেরিয়ে যায়। খুব সম্ভব বিকেলবেলাতেই হ্যালিডে চতুরঙ্গের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে হ্যালিডে মাদামের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তারপর?

হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত চেপে ধরে বলল, চলো হেস্টিংস এবার নিরুদ্দেশ নাটকের দৃশ্যে অভিনয় করা যাক।

মাদামের বাড়ির প্রবেশপথের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে পোয়ারো বলল, এবারে আমরা পথে নামব। হ্যালিডে যেমন নেমেছিলেন।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পোয়ারো বলল, পথ এখানে ডাইনে মোড় নিয়েছে। হয়তো এপথে এগোতেই হ্যালিডেকে খুব সম্ভব কোনো নারী এসে বলেছিল, মঁসিয়ে মাদাম অলিভিয়ের আপনাকে আর একবার ডেকেছেন। শুনে হ্যালিডে যেতে রাজী হলেন। মেয়েটি তখন তাকে এদিকে এই নির্জন পথে নিয়ে গেল। আর হ্যালিডেকে বলেছিল, এইপথে আসুন শর্টকাট হবে, এবার জনাকয় লোক হ্যালিডের ওপর চড়াও হয়। তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় ওপাশের ঐ বাড়িটার দিকে।

-তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কি?

এখন আমরা ঐ মহিলার সঙ্গে দেখা করব যিনি আমাদের মুখটা পর্যন্ত দেখাতে চাননি। ঐ মহিলাই হয়ত মাদামের সেক্রেটারি।

মাদামের বাড়িতে বেল টিপে আমরা ঐ মহিলার বর্ণনা দিতে দারোয়ান তাকে ডেকে দিল। তিনি নিঃশব্দে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে আমরা অবাক হয়ে গেলাম? এ যে আমাদের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্টেস রসাকোফ। পোয়ারো বলল, কাউন্টেস রসাকোফ…

শ শ শ, এখানে আমাকে ও-নামে ডাকবেন না। আমার নাম এখন ইনেজ ভেরোনু। আপনার জ্বালায় লন্ডন থেকে পালিয়ে প্যারিসে এলাম, এখানেও নিস্তার নেই। আমার আসল পরিচয় ফাস করে দিয়ে চাকরীটা খতম করার জন্যে এখানে এসেছেন?

-না, মাদাম। আমি ওদিককার বাড়িটায় একবার ঢুকতে চাই। আমি জানি মঁসিয়ে হ্যালিডেকে ওখানে রাখা হয়েছে। আমি ওঁকে উদ্ধার করে আনতে চাই।

–তিনি ও বাড়িতে নেই।

 –কোথায় আছেন?

–যদি না বলি।

-তাহলে হেস্টিংসকে আপনার পাহারায় দেখে পুলিশে জানাব, লন্ডনে আপনার নামে গোটা পাঁচেক মামলা ঝুলছে।

একথার পর কাউন্টেস ফোন তুলে বলল, কে, আঁদ্রে? আমি ইনেজ বলছি। এখানে। বেলজিয়াম গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো ঝামেলা বাঁধিয়েছে। তোমরা যদি হ্যালিডেকে ছেড়ে না দাও তাহলে আমি বিপদে পড়ব। তাকে হোটেলে পৌঁছে দাও। কাউন্টেস বলল, এবারে আপনি খুশী তো।

না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে হোটেলে যেতে হবে। ওখানে হ্যালিডেকে দেখলে আপনাকে ছেড়ে দেব।

কাউন্টেসকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে হ্যালিডেকে আমাদের ঘরে দেখতে পেলাম। পোয়ারো তার বাঁ হাতের একটা জড়ুল চিহ্ন পরীক্ষা করে নিল।

এবার কাউন্টেসের দিকে ফিরে পোয়ারো বলল, মাদাম, এবার আপনি যেতে পারেন। একটা প্রশ্ন, আপনার সঙ্গে চতুরঙ্গের যোগাযোগ ঘটল কবে থেকে।

 মাদাম কোনো উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা এবার হ্যালিডের কাছে সব জানতে চাইলাম। তিনি বলেন, আমার কিছুই বলার নেই। আমার উপর কী অত্যাচার যে গেছে, তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। মঁসিয়ে পোয়ারো চতুরঙ্গের নাম আপনি শুনেছেন?

–শুনেছি।

–তারা যে কতখানি শক্তিশালী আর নিষ্ঠুর আপনি জানেন না। আমি যদি তাদের সম্বন্ধে একটা কথাও ফাস করি, তাহলে শুধু আমাকে নয়, আমার স্ত্রী কন্যাকেও হত্যা করা হবে। অতএব আমার বলার কিছুই নেই।

চেয়ার থেকে উঠে হ্যালিডে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন।

কাউন্টেস বেরিয়ে যাবার পর আমি একটা চিরকূট পেলাম। পোয়ারো বলল, ইচ্ছে করেই ফেলে যাওয়া হয়েছে, ওটা।

চিরকুটে লেখা, আবার দেখা হবে। I.V.”।

মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, I.v. অর্থাৎ ইনেজ ভেরোনু। কিন্তু, রোমান হরফে ওটা চার-ও হতে পারে। চার হচ্ছে চতুরঙ্গের প্রতীক। শুনে শিউরে উঠলাম।

.

০৭.

 পরদিনই হ্যালিডে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে। আমি আর পোয়ারো প্যারিসেই রইলাম।

আমি পোয়ারোকে বললাম, দোহাই পোয়ারো, এবারে উঠে পড়ে লাগো।

-কার বিরুদ্ধে আমরা উঠে পড়ে লাগব

 –কেন চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে।

-ভালো, কিন্তু চতুরঙ্গের ঘাঁটি কোথায়, ওদের বিরুদ্ধে অস্পষ্ট কোনো প্রমাণও আমাদের হাতে নেই। তার চেয়ে চুপচাপ আঘাতের প্রতীক্ষায় বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, তাদের প্রতিটি কাজই আমাদের জন্য হাসিল হচ্ছে না। সুতরাং আমাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা তারা করবেই।

পোয়ারোর কথার মধ্যেই একটি অপরিচিত লোক আমাদের ঘরে এসে ঢুকল। গায়ে। ওভারকোট, টুপিটা চোখ অবধি নানামো।

–অনুমতি না নিয়ে ঢোকার জন্যে ক্ষমা করুন। আমি একটা দরকারে আপনার কাছে এসেছি মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি আমার বন্ধুদের কাজে বাধা দিচ্ছেন কেন?

–কে আপনার বন্ধু?

 লোকটি টেবিলের ওপর চারটি সিগারেট পাশাপাশি সাজালো। মুখে কিছু বলল না।

পোয়ারো বলল, বুঝেছি। কিন্তু চতুরঙ্গ আমার কাছে কী চায়?

–তারা চায় ছোট খাট চুরি-ডাকাতির কেস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। রাঘব-বোয়ালদের ঘাঁটাতে যাবেন না।

–তাদের অনুরোধ যদি না শুনি?

–বড়ই কষ্ট পাবে আমাদের বন্ধুরা। কিন্তু তাতে কি কোনোও মৃত মানুষ জীবিত হয়?

সোজাসুজি বল, তাহলে আমাকে হত্যা করা হবে এই তো? আর যদি অনুরোধ শুনি, তার বিনিময়ে কি পাব?

–বিনিময়ে আপনি দশলক্ষ ফ্রা পাবেন। তার মধ্যে এক লক্ষ ফ্রা আমি এখুনি দিচ্ছি। মানিব্যাগ খুলে লোকটি নোট বার করল। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, আপনার এতবড় সাহস আপনি পোয়ারোকে ঘুষ দিতে চান?

শান্ত গলায় পোয়ারো বলল, উত্তেজিত হয়োনা হেস্টিংস। তারপর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বলল, যদি আপনাকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দিই।

–আমাকে এখানে আটকে রাখা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

–পোয়ারো ফোন তুলতেই আমি আগন্তুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আশ্চর্য, আমাকে একটা প্যাঁচে ধরাশায়ী করে সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

একটা চিরকূট ফেলে গেছে তাতে লেখা আগামী শুক্রবার সকাল এগারোটায়, ৩৪ নং রু দ্য এস্কেল-এ আমাদের পরবর্তী বৈঠক হবে।

পোয়ারো বলল, স্বেচ্ছায় কারো ফাঁদে পা দেবার ইচ্ছে আমার নেই। সবই সাজানো ব্যাপার। ভেবেছে ঐ চিরকূট পড়ে আমি ওদের ফাঁদে পা দেব। না। আমরা এখনেই বসে থাকবো। আসবার হলে চতুরঙ্গের লোকেরাই এখানে আসবে।

ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় একজন লোক এল। সে এসেছে মাদাম অলিভিয়ের কাছ থেকে। মাদাম একটি চিঠি পাঠিয়েছে। পত্রপাঠ আমরা যেন তার সঙ্গে দেখা করি।

আমরা মাদামের বাড়িতে গেলাম।

 পোয়ারো মাদামকে বলল, কী ব্যাপার?

 মাদাম বললেন, ব্যাপার গুরুতর। শুনলাম, কাল আমার সঙ্গে দেখা করবার পর আবার আপনারা আমার সেক্রেটারি ভেরোনুর সঙ্গে দেখা করেন। তারপর ইনেজ আপনাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। আর সে ফিরে আসেনি।

–আর কিছু বলার আছে? পোয়ারো বলল।

–আমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে জরুরী কিছু কাগজপত্র চুরি করেছে। আমার বড় সিন্দুকটা তারা ভাঙতে পারেনি। নইলে আরো মূল্যবান জিনিষ চুরি করতে পারত।

পোয়ারো বলল, মাদাম, আপনার সেক্রেটারি ইনেজ একটি পাকা চোর। তার আসল নাম কাউন্টেস রসাকোফ। বিজ্ঞানী হ্যালিডে যে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, তার জন্যে কাউন্টেসই দায়ী। সে কতদিন এখানে চাকরি করছে?

–মাস পাঁচেক।

–আমার মনে হয়, ইনেজ খুব সম্ভব চোরেদের গোপনে জানিয়ে দিয়েছিল। আপনার ল্যাবে কাগজপত্রগুলোর ব্যাপারে। কিন্তু, মাদাম আরো কী দামী জিনিষ তারা চুরি করতে পারেনি! গহনা?

-না মঁসিয়ে। রেডিয়াম। হ্যাঁ, রেডিয়াম। সামান্য কিছু রেডিয়াম আমার নিজেরই আছে। এরপর আরো কিছু রেডিয়াম গবেষণার কাজে দরকার পড়ায় আমি ধার করেছি। পৃথিবীতে আবিষ্কৃত রেডিয়ামের মধ্যে আমার কাছে সংগৃহীত রেডিয়ামের মূল্য হবে কয়েক কোটি ফ্রাঁ। এই মূল্যবান ধাতু আমার সিন্দুকে আছে। বাইরে থেকে সিন্দুক বলে মনে হলেও, ওটার আসলে অনেক মিলিয়ে মিলিয়ে তালা খুলতে হয়। ওটি দারুণ মজবুত।

-এই রেডিয়াম আর কতদিন আপনার কাছে থাকবে?

-আর মাত্র দুদিন। তারপর আমার এক্সপেরিমেন্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে ফেরৎ দিয়ে দেব।

-ইনেজ কি এসব কথা জানে?

–জানে।

–উত্তম। সুতরাং আজকালের মধ্যেই আর একবার হামলা হবে। আপনার সঙ্গে আমার রেডিয়ামের ব্যাপারে কথা হয়েছে এটা যেন কেউ জানতে না পারে। আর আমি আপনার রেডিয়াম রক্ষা করব, কথা দিচ্ছি। আপনি শুধু ল্যাবের থেকে যে দরজাটা দিয়ে বাগানে যাওয়া যায় তার চাবিটা আমাকে দিন। আমি রাত্রে আপনার বাড়িতে ফিরে আসব আর পাহারা দেব।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার অভয়বাণী শুনে স্বস্তি পেলাম।

.

রাত এগারোটায় আবার প্যাসি অঞ্চলে আমরা ফিরে এলাম। কেউ আমাদের অনুসরণ করেনি এটা নিশ্চিন্ত হয়ে দেয়াল টপকে আমরা মাদাম অলিভিয়ের বাগানের মধ্যে গেলাম। সামনেই ল্যাবরেটরি। রাত কাটাতে হবে।

হঠাৎই জনা দশেক লোক হয়তো এরাই চোর এসে আমাদের মুখে কাপড় গুঁজে, হাত পা। বেঁধে ল্যাবরেটরিতে টেনে নিয়ে গেল। চোরেদের মধ্যে একজন গিয়ে বড় সিন্দুক খুলে ফেলল। দেখলাম সিন্দুকের মধ্যে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। এই সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিলো আমাদের। আমরা একটা কুঠুরি ঘরে পৌঁছলাম। দেখলাম, আমাদের সামনে একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। মুখে মুখোশ আঁটা। চতুরঙ্গের তিননম্বর কর্তা একজন ফরাসী মহিলা–ইনিই কি সেই মহিলা? নাকি ইনি ভেরোনু? কিন্তু ভেরোনু তো এত ঢ্যাঙা নয়।

মহিলা আমাদের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের মুখের বাঁধন খুলে দিলেন। হাত পা বাঁধাই রইল।

হঠাৎ একটানে তাঁর মুখোশটা খুলে ফেললেন তিনি। সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি স্বয়ং মাদাম অলিভিয়ার!

চোখের দৃষ্টিতে আগুন জ্বলছে।

তিনি বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। সবাই বলে যে, আপনি একজন মস্ত গোয়েন্দা। এখন আপনি একজন নারীর কাছে পরাজিত। আপনাকে লোক পাঠিয়ে সতর্ক করলাম, আপনি শুনলেন না। যাই হোক। এবার মৃত্যুর আগে ইষ্টনাম জপুন আর আপনার শেষ ইচ্ছে বলুন, নেহাত অসম্ভব না হলে আপনার মনস্কামনা আমি মিটিয়ে দেব।

-মাদাম, পোয়ারো বলল, আমার মৃত্যুর আগে যদি অনুমতি করেন তাহলে শেষবারের মতো একটা সিগারেট খাব।

–অর্থাৎ আপনার হাত-দুটোকে খুলে দিতে হবে, না, মঁসিয়ে। অত বোকা আমি নই।

মাদাম পোয়ারোর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে প্রায় মুখে গুঁজে দিল, জিজ্ঞেস করল, দেশলাই আছে তো?

পোয়ারোর গলায় একটা ঠাট্টার সুর বাজল যেন, নড়বেন না। মাদাম। যদি আর এক পাও যদি নড়েন আমার সিগারেটের ব্লোপাইপ থেকে তক্ষুনি বিষাক্ত উঁচ ছুটে যাবে আপনার শরীরে। তাহলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই মরতে চান না মাদাম। সুতরাং আমি বলি কি, আমার বন্ধু হেস্টিংসের বাঁধনটা আপনি খুলে দিন। রাগে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে আমার বাঁধন মাদাম খুলে দিলেন। তক্ষুনি পোয়ারের আদেশে আমি মাদামকে বেশ শক্ত করে বাঁধলাম। তারপর পোয়ারোর বাঁধন খুলে দিলাম।

মাদামকে সেই কুঠুরির মধ্যে ফেলে রেখে আমরা বাইরে বেরিয়ে পা টিপে টিপে বাগানটা পার হয়ে রাস্তায় এলাম। আমি পোয়ারোকে বললাম, এরকুল, এখন কি আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া কর্তব্য?

মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, পাগল, ভুলে যেও না, মাদাম একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। আসলে তিনি যে একটা জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত, একথা পুলিশ বিশ্বাস তো করবেই না, উল্টে আমাদের পাগলা-গারদে পাঠিয়ে দিতে পারে।

.

০৮.

প্যারিসে আর সময় নষ্ট না করে আমরা লন্ডনে ফিরলাম। অনেক চিঠির মধ্যে মিঃ রাইল্যান্ডের লেখা একটা চিঠি পড়ে পোয়ারো বলল, জানো হেস্টিংস, রাইল্যান্ড লিখেছেন যে, তার কথামতো আমি আর্জেন্টিনায় না গিয়ে কথার খেলাপ করেছি। তোমার মেয়ারলিংয়ের কথা মনে আছে তো? মরার আগে সে বলেছিল। চতুরঙ্গের দু-নম্বর কর্তার প্রতীক হচ্ছে ডলার। আমার অনুমান এই আবে রাইল্যান্ডই হচ্ছেন সেই কর্তা; তা না হলে আমাকে চতুরঙ্গের রহস্য উদঘাটনের সময়ে আর্জেন্টিনায় সরিয়ে দিতে চাইবেন কেন? এবার আমার সন্দেহটা কতখানি সত্য সেটা জানবার জন্যে তার ওপর নজর রাখতে হবে। ভদ্রলোক এখন ইংল্যান্ডেই আছেন। সুতরাং কাজটা বিশেষ, কঠিন হবে না আশা করি।

দিনকয়েক পরে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বের হলো যে, আবে রাইল্যান্ড একজন সেক্রেটারি চান। পোয়ারো আমাকে হোম সেক্রেটারির সুপারিশ সমেত একটা দরখাস্ত পাঠাতে বলল। করলাম যথাসময়ে উত্তরও এলো, তাতে লেখা ছিল : স্যাভয় হোটেলে মিঃ রাইল্যান্ডের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে। চেহারাটা আর্টিস্ট ডাকিয়ে যথাসম্ভব পালটিয়ে আমি স্যাভয় হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ডাক পড়ল আমার। একটা মস্ত টেবিলের সামনে তিনি বসে আছেন। রোগা, ঢ্যাঙা, নাকটা বাঁকানো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ মুখে কালো চুরুট। টেবিলে থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, হোম সেক্রেটারি আপনার চাকরির জন্যে আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আপনার কাজটা হল মাঝে মাঝে আমি হয়তো পার্টি দেব।

সে-সব পার্টিতে কাকে; কোথায় বসাতে হবে, তা আপনার জানা চাই। এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে তো মিঃ নেভিল?

বলতে ভুলে গেছি চেহারার সঙ্গে আমি নামটাও পালটে নিয়েছি। আমার নাম এখন আর্থার নেভিল। হোম-সেক্রেটারীর সুপারিশেও ঐ ছদ্মনামটা উল্লেখ ছিল।

আমি উত্তর দিলাম, এ কাজ আমি আগেও করেছি। অসুবিধা হবে না। আমাকে কি লন্ডনে থাকতে হবে?

-না। বেশির ভাগ সময় আমি লোমশায়ারে থাকি। সেখানকার ডিউকের বাড়িটা আমি ভাড়া নিয়েছি। প্রচুর জায়গা, সুতরাং পার্টির আয়োজন করতে আপনার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। চাকুরীটা সুখের চাকরী।

বাড়িটার নাম হ্যাটন চেস। সেখানে গিয়ে জানলাম রাইল্যান্ডের একজন মার্কিনী সেক্রেটারী এবং একটি মেয়ে স্টেনো আছে। মার্কিনী সেক্রেটারীর নাম মিঃ অ্যাপলবি। আমার সঙ্গে মেয়ে স্টেনো মিস্ মার্টিনের বেশ ভাব জমে গেল। বয়স তেইশ হবে। স্পষ্ট করে কোনো কথা না বললেও ওর কথায় আমি বুঝেছিলাম মিঃ রাইল্যান্ডকে ও বিশেষ পছন্দ করে না। হপ্তা তিনেক হ্যাটন চেস্ এ থাকার পর আমার মনে হল, এই রাইল্যান্ডের সঙ্গে চতুরঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। এরমধ্যে রাইল্যান্ডকে আমি জানাইনি যে, পোয়ারোকে আমি চিনি।

একদিন আমি আর মিস মার্টিন ঘুরে বেড়াচ্ছি। মিস মার্টিন কথায় কথায় বলল, একটা কথা বলবো?

আমি বললাম, বলুন,

ভাবছি এ চাকরিটা আমি ছেড়ে দেব।

–সেকি! কেন?

–মিঃ রাইল্যান্ড আমাকে অতি ইতর ভাষায় গালমন্দ করেছে, তার নীলকাগজে লেখা একটা চিঠি আমি ভুলবশতঃ পড়ে ফেলেছিলাম বলে। নীল কাগজে লেখা এমন কিছু চিঠি তার কাছে আসে, যেগুলি আমার পড়বার হুকুম নেই।

–চিঠিগুলোর কোনো বিশেষতঃ আছে?

 –আছে। নীলকাগজে লেখা চিঠিগুলোর এককোণে লেখা থাকে : ৪।

চিঠিতে কি লেখা ছিল আপনার খেয়াল আছে?

–ছোট্ট চিঠি। তার প্রতিটি কথাই আমার মনে আছে।

 –কী লেখা ছিল তাতে?

-লেখা ছিল, সম্পত্তিটা দেখাই এখন জরুরী কাজ। সম্পত্তির সঙ্গে খনি চান তো সেই সতেরো হাজার পাউন্ড পড়বে। এগারো পার্সেন্ট কমিশন কেন? চার পার্সেন্টই যথেষ্ট। ব্যাস, এটুকুই লেখা ছিল। দেখুন তো, নিতান্ত ব্যবসায়িক একটা চিঠি পড়ে ফেলেছি বলে মিঃ রাইল্যান্ড যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করলেন।

–আচ্ছা, মিস মার্টিন চিঠির তলায় কারও স্বাক্ষর ছিল?

–ছিল আর্থার লেভারশ্যাম নামে এক ভদ্রলোকের। এরপর মিস মার্টিনের সঙ্গে দু-একটা কথা বলে আমি তার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ফিরে এসে নোটবুক খুলে চিঠিখানার ভাষাটা টুকলাম। আর বারবার চোখ বুলিয়ে তার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

খুব বেশি সময় লাগল-না। চতুরঙ্গের চারটে সংখ্যাটিকে চাবিকাঠি হিসেবে ধরে নিতেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখলাম, চিঠির ভাষার মধ্যে তিনটে করে শব্দ বাদ দিয়ে চতুর্থ শব্দটিকে যদি গ্রহণ করি তাহলে চিঠিটা এইরকম দাঁড়ায় :

জরুরী খনি সতেরো চার।

শেষের ঐ চার শব্দটা নিশ্চয়ই চতুরঙ্গের প্রতীক। বাকী থাকছে তাহলে চারটি শব্দ : জরুরী খনি সতেরো এগারো। এর মানেটা কি? আমি জানতাম লোমনশায়ারের আমাদের বাড়িটার কাছে একটা খনি আছে। সতেরো তারিখ এগারোটার সময় সেখানে উপস্থিত থাকার জন্যে কি চতুরঙ্গ কিছু জরুরী নির্দেশ দিচ্ছে? এগারোটা মানে নিশ্চয়ই রাত এগারোটা, দুপুর এগারোটা নয়। আজ ষোলই অক্টোবর। কাল সতেরো। এরকুলকে এক্ষুনি একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়ে দিই, সে যেন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এসে চতুরঙ্গের রাঘব-বোয়ালদের ধরে ফেলে। পাঠিয়েও দিলাম।

পরদিন সতেরোই অক্টোবর সারাদিনটা আমার চাপা উত্তেজনার মধ্যে কাটল। স্টেশনে গিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করে খনির দিকে নিয়ে যাবো ভাবলাম। কিন্তু রাইল্যান্ড কিছু জরুরী কাজ দিল। সেগুলি সারতে আমার দশটা বেজে গেল। সাড়ে দশটা বাজতেই তিনি আমাকে ছুটি দিলেন।

ঘরে গিয়ে একটা কালো ওভারকোট চাপিয়ে পা চালিয়ে আমি খনির ধারে একটা ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইলুম। তখন দশটা পঞ্চাশ বাজে। মিনিট পাঁচেক বাদেই দেখলাম রাইল্যান্ড চারিদিকে একবার তাকিয়ে খনিতে নেমে গেলেন।

এক-পা এক-পা করে আমিও এগোলাম। নিচের থেকে কিছু কথাবার্তা কানে আসতে বুঝলাম চতুরঙ্গের অন্যান্য সদস্যরা হাজির হয়েছেন। আমি পা টিপে টিপে নিচে নামতে লাগলাম। আমার পকেটে একটা রিভলবার ছিল। চতুরঙ্গের সদস্যদের সামনে ওটা উঁচিয়ে বলব…

-হ্যান্ডস আপ! চমকে উঠে দেখি রাইল্যান্ড। বললেন আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমরা। রাইল্যান্ডের রিভলবার আমার দিকে তাক করা।

আমাকে বেশ ভালো করে হাত পা বাঁধা হলো। মুখের মধ্যে রুমাল গুঁজে দিয়ে শুইয়ে রাখা হল।

রাইল্যান্ড বললেন, ওহে নেভিল, পোয়ারোর চর, তোমার আসল নাম হেস্টিংস তা আমি জানি। পোয়ারো তোমার কাছ থেকে খবর পেয়ে নিশ্চয়ই এখানে আসবে। চমৎকার। দুজনেই খতম হবে কেমন। খনির মধ্যে ধস নামবার ব্যবস্থা করব আমরা। তারপর জ্যান্ত কবর।

হে ঈশ্বর! পোয়ারো যেন কোনো কারণে এখানে এসে না পৌঁছায়–আমি ভাবতে লাগলাম।

বৃথাই প্রার্থনা। একটু বাদেই পোয়ারোর চেনা পদশব্দ আমার কানে এল।

অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাইল্যাণ্ড। পোয়ারো আসতেই রিভলবার উঁচিয়ে বললেন। হ্যাণ্ডস আপ।

পোয়ারো হাত তুলে দাঁড়ালো। বলল, ব্যাপার কী?

-ব্যাপার কিছুই নয়। আপনাদের দুজনকে আজ হত্যা করব। আপনারা নিজেরাই আমাদের জালে পা দিয়েছেন।

পোয়ারো হেসে বলল, জাল তো আমি ফেলেছি।

তার মানে?

-মানেটা খুবই সোজা। অন্তত ঘণ্টা খানেক আগে আমরা অর্থাৎ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জনা দশেক বাছাই করা লোক। জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে তারা। কী, মানেটা বোধগম্য হল?

মিঃ রাইল্যাণ্ডের চোয়াল স্কুলে পড়ল। পোয়ারো শিস্ দিতেই জনা দশেক প্রহরী রাইল্যান্ড আর তার চাকরের রিভলবার কেড়ে নিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করল।

.

খনি থেকে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, নাঃ এইভাবে শত্রুর কবলে তোমাকে পাঠিয়ে আমি খুব অন্যায় করেছিলুম। সবটাই আমার জানা ব্যাপার। আমি জানতাম তোমার মারফতেই ওরা আমাকে ধরবার চেষ্টা করবে। ঐ মিস মার্টিন চতুরঙ্গেরই চর। চিঠিটা ভুয়ো। টেলিগ্রাম পেয়েই বুঝেছিলাম এটা একটা ফাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টর জ্যাপকে সব জানিয়ে পাল্টা ফাঁদের ব্যবস্থা করলাম।

খেল কিন্তু খতম হলো না। পরদিন সকালে লন্ডনে ফিরে পোয়ারোর ঘরে বসে আছি। এমন সময় জ্যাপ এসে জানাল, মিঃ রাইল্যাণ্ড যাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি সে আসলে রাইল্যাণ্ডের বেয়ারা জেমস। রাইল্যাণ্ডের খাস চাকর জর্জের সঙ্গে জেমস নাকি বাজি ধরেছিল যে সে রাইল্যান্ডের ছদ্মবেশ ধারণ করে সবাইকে বোকা বানাবে। নেহাত একটা খেলা ছাড়া কিছু নয়। তাদের গ্রেপ্তার করার পর হ্যাটন চেজ-এ গিয়ে দেখি মিঃ রাইল্যান্ড ঘুমচ্ছেন। তিনি আমাদের যাচ্ছেতাই রকমের গালমন্দ করলেন, জানি না তিনি আবার পুলিশের নামে মানহানির মামলা করবেন কিনা।

জ্যাপ ঝড়ের বেগে চলে গেল।

পোয়ারো মৃদু হেসে বলল, রাইল্যান্ড অতি চালাক লোক। গোটা ব্যাপারটাকে ছেলেমানুষী বলে চালিয়ে দিতে তার অসুবিধা হবে না।

-কিন্তু জেমসের পক্ষে এত নিপুণ ছদ্মবেশ ধরা কি করে সম্ভব হলো?

–সম্ভব হল, তার কারণ, জেমসই হয়তো চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তা অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ সেই জল্লাদ।

.

০৯.

পোয়ারো বল, মুষড়ে পড়ার কিছু নেই হেস্টিংস। চতুরঙ্গের এখন সুদিন যাচ্ছে, কিন্তু শেষ হাসিটা আমরাই হাসব, মনে রেখো।

সে যাক, ইতিমধ্যে খবরের কাগজে সুঁই-রহস্য” বলে একটা মৃত্যু রহস্য নিয়ে খুব হৈ চৈ পড়ে গেল। এই কেসটার জন্যে জ্যাপ আমাদের সাহায্য চাইছিল। রাইল্যান্ডের চাকরি ছাড়ার প্রায় মাস খানেক বাদে আমরা উস্টারের দিকে রওনা হলাম, এই শহরই হচ্ছে জুই রহস্যের ঘটনাস্থল।

পোয়ারো বলল, হেস্টিংস। জুই রহস্য তুমি বেশ গুছিয়ে বলো তো আমায়।

বললাম, বেশ; এই রহস্যের কেন্দ্র চরিত্র হচ্ছেন মিঃ পেন্টার। ইংরেজ বয়স পঞ্চান্ন, ধনী, শিক্ষিত মানুষ, ইংল্যান্ডের হ্যাণ্ডফোর্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। আত্মীয় বলতে একটিমাত্র ভাইপো জেরাণ্ডাকে তিনি খুঁজে বার করে তাকে অনুরোধ করেন তার সঙ্গে বসবাস করার জন্যে। এ প্রায় মাস সাতেক আগের কথা। তারপর এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভাইপো ছাড়া তার বাড়িতে ছিল সাতটা চাকর, তার মধ্যে একটি ভৃত্য ছিল চীনে, নাম আ-লিং।

গত মঙ্গলবার রাত্তিরের খাবার খেয়ে মিঃ পেন্টার অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার এসে তাকে পরীক্ষা করার সময় কেউ ঘরে ছিল না বা পেন্টারের সঙ্গে কি কথা হয় তা কেউ শোনেননি। তবে বিদায় নেওয়ার সময় ডাক্তার বলেন, পেন্টারের হার্ট খুব দুর্বল, তাকে একটা ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার চাকর বাকরদের গুটিকয় প্রশ্ন করেন, কার বাড়ি কোথায়, কে কতদিন যাবৎ কাজ করছে। এই প্রশ্নে পরিচারিকারা বিস্মিত হয়ে পড়ে। যাই হোক পরদিন সকালে পেন্টারের পড়বার ঘর থেকে একটা চিমসে গন্ধ পাওয়া গেলে ঝি দরজা ঠেলে দেখে ভিতর থেকে বন্ধ। তখন সে চীনে ভৃত্যটাকে এবং জেরাণ্ডাকে ডেকে আনে। তারা দরজা ভেঙে ঢুকে দেখে মিঃ পেন্টার গ্যাস উনুনের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন। মুখখানা পুড়ে গিয়ে চেনার অযোগ্য হয়ে গেছে।

–সবাই ভেবেছিল যে হঠাৎ হয়তো মাথা ঘুরে তিনি গ্যাসের উনুনে পড়ে গিয়েছেন। এমনটা ভাবার কারণ, তিনি ছিলেন অসুস্থ এবং তাকে কুয়েন্টিনের মতে কড়া ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু তারপরই একটা অদ্ভুত জিনিষ চোখে পড়ল, একটা খবরের কাগজে কাঁপা কাঁপা হাতে বড় বড় অক্ষরে কে যেন লিখে রেখেছে; জুই। মিঃ পেন্টারের ডান হাতের তর্জনী কালি মাখা এবং উল্টানো দোয়াত দেখে কোনো সন্দেহ রইল না যে, কথাটা মিঃ পেন্টারই লিখেছেন।

–কিন্তু তিনি জুই কথাটার দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। পেন্টারের বাড়িতে লতানে জুইয়ের ঝাড় ছিল।

–জানা গেল ডাঃ কুয়েন্টিন এ পরিবারে নতুন ডাক্তার। তার আগে ডাঃ বেলিথোই মিঃ পেন্টারের নিয়মিত চিৎকার করতেন। মাসখানেক তিনি ছুটিতে বাইরে যাওয়ায়, ঠিক হয় ডাঃ বেলিথোর অনুপস্থিতিতে ডাঃ কুয়েন্টিন চিকিৎসা করবেন। ডাঃ কুয়েন্টিনের সাক্ষী থেকে জানা গেল : মিঃ পেণ্টার ঘটনার দিন তাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল। আসলে সেদিন এমন একটা তরকারি তাকে পরিবেশন করা হয়, যার গন্ধটাই কেমন সন্দেহজনক। আ লিঙয়ের অগোচরে সেই তরকারী কিছু অংশ তুলে রেখেছিলেন, তারপর ডাঃ কুয়েন্টিনকে সে তরকারীটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেন। পেন্টারের ধারণা হয়েছিল তাকে বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টা চলছে।

-সাক্ষ্যে কুয়েন্টিন আরো জানান, যদিও সেদিন মিঃ পেন্টার অসুস্থ বোধ করছিলেন না তবুও সাবধানতার জন্যে তাকে তিনি একটা স্ট্রিকানন ইজেকশান দেন। ল্যাবরেটরিতে তরকারী পরীক্ষা করে দেখা যায়; তাকে গুড়ো আফিং মেশানো রয়েছে। সবটা বলে আমি চুপ করলাম।

পোয়ারো বলল, এসো, ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যাক। তরকারীটা রান্না করেছিল আ-লিং। কিন্তু সে আফিং মিশিয়ে পেন্টারকে মারতে চাইবে কেন? এদিকে জেরাল্ডকেও সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না, কারণ, তাড়াতাড়ি জ্যাঠার সম্পত্তি পাবার লোভে সে তাকে মারতে চেয়েছিল। আরো দেখা যাচ্ছে, জ্যাঠার সঙ্গে একসাথে খেলে তাকেও ঐ তরকারী পরিবেশন করা হবে, তখন না খেলে সন্দেহজনক দেখাবে। তাই সেদিন জেরাল্ড বাইরে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে ডিনার সেরেছিল।

আমি বললাম, খাওয়া সেরে অনেক রাতে জেরাল্ডা বাড়ি ফিরে দেখে জ্যাঠার ঘরে আলো জ্বলছে সে বুঝল, প্ল্যান ভেস্তে গেছে, বুড়ো মরেনি। তাই সে বুড়োকে গ্যাস উনুনে ঠেসে ধরল।

-কিন্তু হেস্টিংস, পোয়ারো বলল, ব্যাপার অদ্ভুত লাগছে না? বুড়ো নিশ্চয়ই বাঁচবার জন্যে একটু ধস্তাধস্তি বা চীৎকার করবে। কিন্তু পেন্টারের ঘরে ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল না। চীৎকারও কেউ শোনেনি। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষনীয় মিঃ পেন্টার দীর্ঘদিন চীনে ছিলেন, অতএব এখানেও লি চ্যাং ইয়েনের হাত থাকলে, আমি অবাক হবে না। কিন্তু, না চলো, আমাদের গন্তব্যস্থল এসে গেছে। নামা যাক।

.

১০.

প্ল্যাটফরমে জ্যাপ দাঁড়িয়েছিল। আমরা তার সঙ্গে ক্রন্ট ল্যাগুস অর্থাৎ মিঃ পেন্টারের বাড়ি গেলাম।

সুন্দর সাদা, ছোট বাড়ি। জুই লতা উঠে গেছে। পোয়ারো বলল, কী মনে হয় জ্যাপ, দুর্ঘটনা না খুন?

-তরকারীতে আফিং মিশিয়ে কেউ তাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল যেহেতু, সেহেতু আগুনে পুড়ে মারা যাবার ঘটনাকে নেহাত দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

-বাঃ, বেশ বুদ্ধিমানের মতো কথা বলছো জ্যাপ। যে ঘরে পেণ্টার মারা গিয়েছিল সেই ঘরে গেলাম আমরা।

পোয়ারো প্রশ্ন করল, জানালায় ছিটকিনি লাগানো ছিল না?

ঘাড় চুলকে জ্যাপ বলল, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার পরীক্ষা করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে যায়। পরদিন ঝি দরজা ঠেলে দেখল ভিতর থেকে খিল দেওয়া। আ-লিং বলছে, জানলায় ছিটকিনি লাগানো ছিল না। ডাঃ কুয়েন্টিন বলেছেন, জানালাটা ভেজান ছিল বটে কিন্তু খুব সম্ভব তাতে ছিটকিনি লাগানো ছিল না। ঝি বলছে, সকলে দরজা ভেঙে ঢোকার পর জানালাটা খুলে দেওয়া হয়, ছিটকানি আঁটা ছিল কিনা তার মনে নেই।

–আমার প্রশ্ন, এটাকে যদি খুন বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে কার লাভ হবে? পোয়ারো বলল জ্যাপকে।

-শুনেছি জেরাণ্ডা ছোকরা খুব উজ্জ্বল ছিল। বিস্তর ধার দেনা করেছে হয়তো, পাওনাদারদের তাগাদায় অস্থির হয়ে, ধার শোধ করবার জন্যে সে হয়তো জ্যাঠাকে খুন করেছে।

পোয়ারো গম্ভীর হয়ে বলল, দ্যাখো জ্যাপ, চালাকি করো না। জেরাল্ডা-এর মেটিভ সম্পর্কে তুমি নিশ্চিত নও। খালি হয়তো এর ওপর নির্ভর করে কাউকে সন্দেহ করা যায় না।

এরপর সন্দেহ জাগে আ-লিঙের ওপর; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যবান কিছু কি খোয়া গেছে?

–না। টাকাকড়ি। গয়নাগাটি সব ঠিক আছে; কিন্তু একটা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যাচ্ছে না।

মিঃ পেণ্টার বইখানাকে প্রকাশ করার জন্যে পাবলিশারের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ হয়েছিলেন।

–পাণ্ডুলিপির কথাটা তুমি কার কাছে শুনলে?

–ভাইপো জেরাল্ডার কাছে।

–বইয়ের বিষয়টা কি ছিল?

–চীনের বিষয়ে। নাম দিয়েছিলেন চীনের চক্রান্ত”।

–আ-লিংকে ডেকে পাঠাও।

 আ-লিং এল। পরণে চীনা জোব্বা।

তাকে প্রশ্ন করে জানা গেল, মালিকের হত্যাকারী কে? সে বলতে পারে না। সেদিন রাত্রের খাবার সেই রান্না করেছিল।

কিন্তু আফিং সে মেশায়নি। আর সে জুই-কথাটার অর্থ জানে না। চতুরঙ্গের নাম শুনে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, কোনোদিন চতুরঙ্গের নাম শোনেনি বলে সে পোয়ারোকে জানাল। তারপর চলে গেল।

সে চলে যাবার পর পোয়ারো বলল, মনে হচ্ছে এ চতুরঙ্গেরই কাজ। হয়তো পেন্টার চতুরঙ্গের পয়লা নম্বর কর্তা লি-চ্যাং ইয়েনের সম্পর্কে কোনোও গোপন তথ্যের উল্লেখ করেছিলেন, তারা চায়নি সেটা প্রকাশ হোক।

কথা বলতে বলতে ঘরে এসে ঢুকল জেরাল্ড। তাকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করা হল, সে রাত্রে আপনি কোথায় খেয়েছিলেন?

–এক প্রতিবেশীর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল।

–প্রতিবেশী ভদ্রলোকের নাম?

 –মিঃ উইচার্লি।

বাড়ি ফিরেছিলেন কখন?

–রাত এগারোটা নাগাদ। ডুপ্লিকেট চাবি ছিল।

বাড়িতে ঢুকবার পরে কি, এমন কিছু আপনার চোখে পড়েছিল যা সন্দেহ জনক?

বাড়িতে ঢুকে দেখলাম, চাকর বাকররা সব আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্যাঠার ঘরেও আলো জ্বলছিল না। চুপচাপ নিজের ঘরে যাবার সময় দেখলাম, বারান্দায় উপর থেকে একটা মানুষের ছায়া সরে গেল। মনে হল, আ-লিং তবে আমি নিশ্চিত নই। ভুলও হতে পারে।

পোয়ারো বলল, শুনেছি দীর্ঘকাল জ্যাঠার সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ ছিল না। এর আগে আপনার জ্যাঠার সঙ্গে আপনার শেষ কবে দেখা হয়েছিল?

তখন আমার বয়স হবে দশ? তারপরে আমার বাবার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

–এতদিন বাদে আপনাকে খুঁজে বার করতে জ্যাঠার অসুবিধা হয়নি?

–আমার খোঁজ চেয়ে জ্যাটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। ভাগ্য ভালো বিজ্ঞাপনটা আমার চোখে পড়ে। আমি দেখা করি।

–আপনি এখন যেতে পারেন, আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।

এরপর আমরা গেলাম ডাঃ কুয়েন্টিনের চেম্বারে। তার থেকে নতুন কিছু জানা গেল না। তার সন্দেহ আং-লিং-এর ওপর।

এরপর পোয়ারো একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে একটা বই কিনলো। তারপর হোটেলে ফিরে ঘুম। পরদিন সকালে ঘুমচোখ খুলে দেখি পোয়ারো ঐ বইখানা উল্টেপাল্টে দেখছে।

আমার ঘুম ভেঙেছে দেখে পোয়ারো বলল, রহস্যের কিনারা করবার জন্যে যে তথ্যটা জরুরী, মিঃ পেন্টার আমাদের সেটা জানিয়েই গেছেন।

-মানে?

–লোকটা মরবার আগে হঠাৎ ফুলের নাম লিখতে গেল কেন? জুই শুধু ফুলের নাম নয় বিষেরও নাম। ইয়েলো জ্যাসমিন (সোনাজুই) অতি মারাত্মক বিষ। এই বইটা থেকে জানতে পারলাম। এতে লেখা আছে, ঐ বিষ কারোর শরীরে ঢুকিয়ে দিলে তার মৃত্যু অবধারিত। বিষপ্রয়োগে হত্যা করে, তারপরে তাকে আগুনে ঠেসে ধরা হয়। মৃত্যুর আসল কারণটাকে চাপা দেবার জন্যে এই প্রয়াস। পুলিশ যদি শোনে আফিং মেশানো তরকারী তিনি খাননি, তাহলে দ্বিতীয়বার বিষ প্রয়োগের চেষ্টা হেসে উড়িয়ে দেবে।

-তরকারীতে তাহলে আফিং ছিল না, আমি বললাম।

–না। ডাঃ কুয়েন্টিন পরীক্ষা করার আগে তরকারীতে আফিং মিশিয়ে নিয়েছিলেন। সেদিন রাত্তিরে মিঃ পেন্টারকে ডাক্তার যে ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাতে আসলে ছিল ইয়োলো জ্যাসমিন। পেণ্টার মারা যাবার পর কেউ ঘরে ঢুকে আসল কারণটা চাপা দেবার জন্যে তার মৃতদেহটা আগুনে চেপে ধরে। মুমূর্ষ পেন্টারের লেখাটা অপরাধীরা কেউ জানতে পারেনি। জানলে নিশ্চয়ই সরিয়ে ফেলত।

–কে মিঃ পেন্টারকে আগুনে ঠেসে ধরেছিল? আ-লিং?

–না। চতুরঙ্গের নাম সে জানত। জেরার সময় তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাবার কারণ, সে চতুরঙ্গের নাম শুনে ভয় পেয়েছিল।

–তাহলে জেরাল্ডা কি মিঃ পেন্টারের ভাইপো নয়?

–ঠিক সে চতুরঙ্গের সেই ছদ্মবেশী চার নম্বর কর্তাটি। সে ভাইপো সেজে ঢুকেছিল।

–জেরাল্ডাই কি তাহলে জল্লাদ?

-না, ডাঃ কুয়েণ্টিন সেই জল্লাদ। সেও আসল ডাক্তার নয়, চতুরঙ্গের লোক। আমি জ্যাপকে বলেছি ওদের দুজনকে নজরে রাখতে।

বলতে না বলতে জ্যাপ এসে ঢুকে বলল, জেরাল্ডা পালিয়েছে, ডাঃ কুয়েন্টিনেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। যাই হোক, আমরা ওদের গ্রেপ্তার করবই।

বিষণ্ণ হেসে পোয়ারো বলল, অসম্ভব।