১৯. সন্ন্যাসী

সন্ন্যাসী সকালে সুস্থভাবেই অল্প মাথা তুলে শুয়ে রয়েছেন। যন্ত্রণা নেই। বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। জীবন দত্তকে দেখে বললেন–আইসো রে ভাই মহাশয়, আইসো! কাল রাতে তুমি আসিয়েছিলে ভাই, তখন আমি ঘুমিয়েছি। ওহি শশী বেটা কী একঠো দাওয়াই দিলে—ব্যস, পাঁচ মিনিট কো ভিতর বে-হোঁশ হইয়ে গেলাম।

–আজ তো ভাল আছেন। ওষুধে তো ভাল ফলই হয়েছে। হাসলেন জীবন।

–কে জানে ভাই! ঘাড় নাড়লেন।

–কেন? কোনো যন্ত্রণা রয়েছে এখন? আর অসুখ কী?

–ঠিক সমঝতে পারছি না। হাতটা তুমি দেখ ভাই। দেখ তো দাদা, ছুটি মিলবে কি না।

–ছুটি নিতে ইচ্ছে হলেই মিলবে। ইচ্ছে না-হলে তো আপনাদের ছুটি হয় না।

–সে পুণ্য আমার নাই ভাই।

সে পুণ্য সন্ন্যাসীর নাই তা জীবন দত্ত বুঝেছেন। থাকলে বুঝতে পারতেন—কালকের অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে গাঁজা না খাওয়ার যন্ত্রণাটাই ছিল ষোল আনার মধ্যে বার আনা কি চোদ্দ আনা। সে সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁর গিয়েছে, মন জীর্ণ হয়েছে বেশি। যাদের যোগের সাধনা থাকে তাদের মন অদ্ভুত শক্তিশালী, দেহের জীর্ণতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না, মনে তখন বাসনা জাগে জীৰ্ণ দেহ ত্যাগ করে নূতন দেহ লাভের। এ কথা এ দেশের পুরনো কথা-বাবার কাছে শুনেছেন, আরও অনেক প্রবীণের কাছে শুনেছেন। প্রদ্যোতেরা একথা বিশ্বাস করবে না হাসবে; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন। মশায় সন্ন্যাসীর হাতখানি তুলে নিলেন।

সন্ন্যাসী ক্ষীণকণ্ঠেই বললেন–মনে নিছে ভাই কি ছুটি মিলবে। কাল রাতে যেন মনে হইল। রে ভাই কী-উধার থেকে দশবারটা খড়মকে আওয়াজ উঠছে। আউর মনে হইল রঘুবরজীর আওয়াজ মিলছে। ওহি জঙ্গলের পঞ্চতপার আসনসে হকছে, আও ভাইয়া! আও!

কথাগুলির অৰ্থ বুঝতে জীবন মশায়ের বিলম্ব হল না।

ও–ধারে–জঙ্গলের মধ্যে এখানকার পূর্বতন মহান্তদের সমাধি আছে। সেখান থেকে খড়মের আওয়াজ শুনেছেন সন্ন্যাসী। অর্থাৎ তারা এসেছিলেন একে আহ্বান জানাতে। রঘুবরজী এই সন্ন্যাসীর গুরুস্থানীয় এবং এর ঠিক আগের মহান্ত। তিনি ছিলেন সত্যকারের যোগী। যোগ সাধনায় দেহের ভিতরের যন্ত্রগুলিকে যেমন শক্তিশালী করেছিলেন, বিচিত্র ব্রত পালন করে বাইরে প্রকৃতির প্রভাব সহ্য করবার শক্তিও তিনি তেমনি আয়ত্ত করেছিলেন। বৈশাখে পঞ্চতপ ব্ৰত করতেন—সূর্যোদয়ের সঙ্গে পাঁচটি হোমকুণ্ড জ্বেলে—ঠিক মাঝখানে আসন গ্রহণ করতেন, সারাদিন আসনে বসে পর পর কুণ্ডে কুণ্ডে আহুতি দিয়ে সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পর সে দিনের মত হোম শেষ করে উঠতেন। আবার শীতে ওই গাছতলায় অনাবৃত দেহে বসে জপ করতেন; প্রথম। পাখির ডাকের পর আসন ছেড়ে হিমশীতল পুষ্করিণীতে নেমে সূর্যোদয় পর্যন্ত অর্থাৎ উত্তাপ সঞ্চয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জলে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকতেন তিনিও তাঁকে ডেকেছেন, বলছেন।

সাধারণ মানুষ মৃত্যুর পূর্বে মৃত স্বজনকে দেখেন। তাঁরা নাকি নিতে আসেন।

সন্ন্যাসীর স্বজন বিস্মৃতির গহনে হারিয়ে গিয়েছে। এখানকার মহান্তেরাই তাঁর স্বজন, পূর্বপুরুষ—তাদেরই তিনি দেখেছেন।

নাড়ি দেখে হাত নামিয়ে জীবন দত্ত বললেন–বাবা। ছুটি আসছে আপনার। আজ সন্ধ্যার পর। কাল যখন অসুখ খুব বেড়েছিল—সেই সময়। সেই রকম মনে হচ্ছে বাবা।

এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল সন্ন্যাসীর বিশীর্ণ বার্ধক্যশুষ্ক ঠোঁট দুটিতে। আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাসও ফেললেন তিনি।

আজ চল্লিশ বৎসর সন্ন্যাসী এখানে আছেন। তিরিশ বৎসরের উপর তিনি এই দেবস্থানের মহান্ত। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে এখানে প্রথম এসেছিলেন তিনি। কিন্তু দেখে মনে হত তিরিশ বছরের জোয়ান। লম্বা-চওড়া কুস্তি-করা পালোয়ানী শরীর। শাস্ত্রটাস্ত্র জানতেন না, গাঢ় বিশ্বাস আর কয়েকটি নীতিবোধ নিয়ে মানুষটির সন্ন্যাস। সন্ত না থোক, সাধু মানুষ ছিলেন।

প্রথম পরিচয় হয়েছিল বিচিত্রভাবে।

দেশের তখন একটি ভয়াবহ অবস্থা। মড়ক চলছে, মহামারী কলেরা লেগেছে দেশে। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম—সেখান থেকে আর এক গ্রাম; বৈশাখের দুপুরে খড়ের চালের আগুনের মত লেলিহান গ্রাস বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ল। সেকালে তখন কলেরার কোনো ওষুধ ছিল না। ক্লোরোডাইন সম্বল। কবিরাজিতে ওলাউঠার ওষুধ তেমন কার্যকরী নয়। ক্লোরোডাইন দেবারও চিকিৎসক নাই। যারা আছে তারা নিজেরাই ভয়ে ত্রস্ত। হরিশ ডাক্তার কলেরায় যেত না। হোমিওপ্যাথ ব্রারোরী তখন পালিয়েছে। থাকলে সেও যেত না। নতুন একজন ডাক্তার এসেছিল নবগ্রামে, সেও একদিন রাত্রে পালিয়ে গেল—কলেরা কেসে ডাকের ভয়ে।

চারদিকে নানা গুজব। সেকালের বিশ্বাসমত ভয়ঙ্কর গুজব। কলেরাকে নাকি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার মুখে তাকে দেখা যায়। শীর্ণ কঙ্কালসার শরীর, চোখে আগুনের মত দৃষ্টি, পিঙ্গল রুক্ষ চুল, দন্তুর একটি মেয়ে; পরনে তার একখানা ক্লেদাক্ত জীৰ্ণ কাপড়, বগলে একটা মড়া-বওয়া তালপাতার চাটাই নিয়ে সেই পথ ধরে গ্রামে ঢোকে—যে পথ ধরে গ্রামের শব নিয়ে শ্মশানে যায়। সন্ধ্যায় ঢোকে, যার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় সেই হতভাগ্যই সেই রাত্রে কলেরায় আক্রান্ত হয়। মরে। তারপর রোগ ছড়ায় ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায়।

লোকে পালাতে লাগল গ্রাম ছেড়ে।

অবস্থাপন্নেরা আগে পালাল। নবগ্রামের বাবুরা তার মধ্যে সর্বপ্রথম। তারপর সাধারণ লোকেরা।

থাকল গরিবেরা আর অসমসাহসী জনকয়েক, তার মধ্যে মাতাল গাঁজালেরা সংখ্যায় বেশি। মদ খেয়ে গাঁজা টেনে ভাম হয়ে বসে থাকত। কালীনাম হরিনাম করে চিৎকার করত।

তিনিও হরিনাম করতেন।

চিরকালই তিনি সংকীর্তনের দলের মূলগায়েন করেন। গলা তার নাই, সুকণ্ঠ তিনি নন, তবে গান তিনি বোঝেন এবং গাইতেও তিনি পারেন। হ্যাঁ, তা পারেন। দশ কুশীতে সংকীর্তন এখনও তিনি গাইতে পারেন। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেবার লোক এখন আর নাই। থাকবে কোথায়? এসব বড় তালের গানের চর্চা উঠে গেল। কতই দেখলেন। হারমোনিয়াম-গ্রামোফোন, এখন রেডিও। নবগ্রামের কয়েকজনের বাড়িতেই রেডিও এসেছে। শুনেছেন তিনি। সে গান আর এ গান! সেই—দেখে এলাম শ্যাম—সাধের ব্ৰজধাম—শুধু নাম আছে। হায় হায়! শুধু নামই আছে আর কিছু নাই শ্যাম! রাধা স্বৰ্ণলতা তমালকে শ্যাম ভেবে জড়িয়ে ধরে ক্ষতবিক্ষত দেহে ধুলায় ধূসরিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে হতচেতন হয়ে!।

তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সংকীর্তনের দল নিয়ে পথে পথে ঘুরতেন। বিশ্বাস করতেন এই নামকীর্তনে অকল্যাণ দূর হয়। গ্রামে গ্রামে মদ্যপায়ীরা রক্ষাকালী পূজা করাত। তাদেরও সে বিশ্বাস ছিল গভীর।

গভীর রাত্রে পথ-কুকুরে চিৎকার করে চিরকাল। সে চিৎকার যেন বেশি হয়েছে। এবং সে চিৎকারের একটি যেন গূঢ় অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। চিৎকারের মধ্যে ক্ৰোধ নাই ভয় আছে। তারা রাত্রে ওই পিঙ্গলকেশিনীকে পথে বিচরণ করতে দেখতে পায়। ভয়ার্ত চিৎকার করে তারা। ঘরে ঘরে অর্ধঘুমন্ত মানুষেরা শিউরে ওঠে।

জীবন ডাক্তারের মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি ঘুরতেন। কিন্তু কী করবেন ঘুরে?

শেষে ছুটে গিয়েছিলেন রঙলাল ডাক্তারের কাছে। বলুনওষুধ বলে দিন।

দীর্ঘকাল পরে বৃদ্ধ রঙলাল তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল জার্নাল পেড়ে বসলেন। তারপর প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন-ওয়ান সিক্সথ গ্রেন ক্যালোমেল আর সোডা বাইকার্ব। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় খাওয়াও। এ ছাড়া এখানে এ অবস্থায় আর কিছু করবার নাই।

অনেক প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল ওই ওষুধে। দিন নাই রাত্রি নাই জীবনমশায় ঘুরতেন। পিতৃবংশের সম্মান! গুরু রঙলালের আদেশ! নিজের প্রাণের বেদনা।

রঙলাল ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—ভাল কথা, জীবন, তুমি নাকি খুব তারস্বরে চিৎকার করে হরিনাম সংকীর্তন করে কলেরা তাড়াচ্ছ?

অট্টহাস্য করে উঠেছিলেন।

জীবন লজ্জিত যে একেবারে হন নি তা নয়। তা হলেও অপ্রতিভ হন নি। বলেছিলেন কী করব? লোকেরা বিশ্বাস করে ভরসা পায়।

—তুমি নিজে?

জীবন একটু বাঁকা উত্তর দিয়েছিলেন–সবিনয়ে বলেছিলেন-আপনি তো জানেন আমি কোনোদিনই নাস্তিক নই।

–তাতে আমি অসন্তুষ্ট নই, আপত্তিও করি না জীবন। নাম-সংকীর্তন করলেও আপত্তি করব না, তবে সে সংকীর্তন শুধু সপ্ৰেমে কীর্তনের জন্য হওয়া উচিত। আমাকে দাও, আমাকে বাঁচাও, আমার শত্ৰু নাশ কর, এই কামনায় সংকীর্তন আমি পছন্দ করি না। ওতে ফলও হয় না।

জীবন বলেছিলেন—আগুন-লাগা বনের পশুর মত মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে। জানেন, আমি যেন চোখে দেখছি।-উত্তেজিত হয়ে আবেগের সঙ্গেই জীবন সেদিন রঙলাল ডাক্তারের সামনে দার্শনিকতা করে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন—মরণ তেড়ে নিয়ে চলেছে জীবনকে। একেবারে এলোকেশী এক ভয়ঙ্করী-হাত বাড়িয়ে ছুটেছে, গ্রাস করবে, অনন্ত ক্ষুধা! আর পৃথিবীর জীবকুল ভয়ে পাগলের মত ছুটছে। ছুটতে ছুটতে এলিয়ে পড়েছে, মৃত্যু তাকে গ্রাস করছে। অহরহই ওই তাড়ায় তেড়ে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু। এখানে ভগবানের নাম করে তাকে ডেকে ভরসা সঞ্চয় করা ছাড়া করবে কী মানুষ?

রঙলাল ডাক্তার এর উত্তরে সেদিন ব্যঙ্গ করেন নি। প্রসন্ন হেসে বলেছিলেন, ব্যাপারটা তাই বটে জীবন। হারজিতের একটা লড়াই-ই বটে। কিন্তু ওইটেই যেমন চোখে পড়েছে তেমনি চোখ যদি আরও তীক্ষ্ণ হত তবে দেখতে পেতে, এক-একটা মানুষ কেমন করে ঘুরে দাঁড়ায়, বলে,—এস! তুমি যে ওই ভয়ঙ্কর বেশে আসছ, তোমার আসল রূপটা দেখি। কিংবা বলে–তোমাকে আমি ধরা দিচ্ছি, কিন্তু যারা পালাচ্ছে বাঁচতে দাও। তখন মরণের ভয়ঙ্কর মুখোটা খসে যায়। দেখা যায় সে বিশ্ববিমোহিনী। তা ছাড়া তুমি জান না, মরণ যত গ্রাস করছে তার দ্বিগুণ জীবন জন্ম নিয়ে চারদিক থেকে কুক দিয়ে বলছে—কই ধর তোে! হারছে না তারা। আরও একটা কথা বলি। মানুষ হারে নি। মহামারীতে কতবার কত জনপদ নষ্ট হয়েছে। আবার কত জনপদ গড়েছে। শুধু গড়েই ক্ষান্ত হয় নি। সে রোগের প্রতিষেধক বার করে চলেছে। ওখানেই তাকে হারানো যায় নি। সে হারে নি। মরবে সে। কিন্তু এইভাবে সে মরবে না। মহাগজের মত মরবে না। যেদিন বৃদ্ধ হবে, জীবনের আস্বাদের চেয়ে মৃত্যুর আস্বাদ ভাল লাগবে, সেইদিন মহাগজ যেমন নিবিড় অরণ্যে গিয়ে শত বৎসরের এক খাদের মধ্যে আকাশ বিদীর্ণ করে ধ্বনি। তুলে আমি চললাম বলে দেহত্যাগ করে, তেমনি করে মরবে। হাতিরা এইভাবে পুরুষানুক্রমিক শ্মশানভূমিতে গিয়ে দেহত্যাগ করে থাকে। কেন জান? পাছে তার রোগ বা পচনশীল দেহ থেকে রোগ উৎপন্ন হয়ে অন্য হাতিদের আক্রমণ করে।

এই মহামারী থামবার পর সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ। এই মহামারীর পর এখানে তিনি সমাজের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন। নবগ্রামের বাবুদের উপেক্ষা করে সরকার তাকে প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত মনোনীত করছিলেন। সেই প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত হিসেবে একটি কলহের মীমাংসায় তিনি এসেছিলেন এই মহাপীঠে।

সন্ন্যাসী এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল—আরে ভাইয়া, তুমহারা নাম জীওন মহাশা। তুমি নাকি বড়া ভারি বীর? আও তো ভাই পাঞ্জা লঢ়ে এক হাত।

পাঞ্জার লড়াইয়ে তিনি হেরেছিলেন, কিন্তু সহজে হারাতে পারে নি সন্ন্যাসী। বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল।

তারপর কতদিন কত কথা আলাপ হয়েছে।

একদিনের কথা মনে পড়ছে। এই চণ্ডীতলার মেলায় জুয়া খেলার আসরে শেষ কপদক হেরে সন্ন্যাসীর কাছে এসে বলেছিলেন আমায় একশো টাকা দিতে হবে গোঁসাইজী। কাল পাঠিয়ে দেব।

তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে গোঁসাই টাকাটা তাকে দিয়েছিলেন এই দেবস্থলের তহবিলের টাকা। ডাক্তার এসে আবার বসেছিলেন জুয়ার তক্তপোশে। ঘণ্টাখানেক পরেই গোঁসাই এসে তাকে হাত ধরে টেনে বলেছিলেন-আব উঠো ভাই। বহুত হুয়া।

জুয়াড়ীকে বলেছিলেন–জানতা হ্যায় ইন্ কোন হ্যায়? হিয়াকে বড়া ডাগরবাবু আওর প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। ইনকা রুপেয়া যো লিয়া—দে দেও ইনকে।

ডাক্তার বলেছিলেন না। আর মাত্র কুড়ি টাকা হেরে আছি। ওটা ওর প্রাপ্য। চলুন।

পথে সন্ন্যাসী বলেছিলেন-কথাটা তার অন্তরে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে বলেছিলেন-কাহে ভাই মহাশা-তুম মহাশা বন্শের সন্তান মহাশা-তুম ভাই জুয়া খেলো, রাতভর দাবা খেলো, খানাপিনামে এই হল্লা করো–এ কেয়া ভাই? ভগবান তুমকো কেয়া নেহি দিয়া, বোলো? কেঁও, তুমহারা ঘরকে মতি নেহি?

ওঃ! সে একটা সময়! দেহে অফুরন্ত সামৰ্থ, মনে দুরন্ত সাহস, বিপুল পসার, মানসম্মান, ঘরকা সংসার কোনো কিছুই মনে থাকত না। তবে কোনো অন্যায় করতেন না। জুয়ো খেলাটা ছিল শখ। ওটা সে আমলের ধারা। তবে সংসারে যদি–।

অকস্মাৎ তাঁর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।

একটা প্রশ্ন জেগে উঠল মনের মধ্যে। বিপিনরতনবাবুর ছেলে বিপিনের জীবনে কি? সংসারজীবনে বিপিনের গোপন দুঃখ ছিল? অশান্তি? বাইরে ছুটে বেড়াত প্ৰতিষ্ঠা যশ কুড়িয়ে বেড়াত কিন্তু তবু তৃষ্ণা মিটত না, ক্ষুধা মিটত না। ছুটত ছুটত ছুটত। অথবা রিপু? মানুষের সাধনার পথে আসে সিদ্ধি। সে আসার আগে আসে প্রতিষ্ঠা। জাগিয়ে তোলে লালসা। আরও চাই। ওই তো রিপু। ওর তাড়নায় ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মানুষ। সামনে এসে দাঁড়ায় সেই পিঙ্গলকেশিনী।

***

রতনবাবুর ছেলে বিপিনের হেঁচকি থামে নি, তবে কমেছে। রক্তের চাপও খানিকটা নেমেছে। রতনবাবু প্রসন্ন হাস্যের সঙ্গেই বলছেন—তোমার ওষুধে ফল হয়েছে জীবন। তুমি একবার নাড়িটা দেখ। আমার তো ভালই লাগছে।

জীবনমশায়ও একটু হাসলেন। হাসির কারণ খানিকটা কথাগুলি ভাল লাগার জন্য; খানিকটা কিন্তু ঠিক বিপরীত হেতুতে। হায় রে, সংসারে ব্যাধিমুক্তি যদি সহজে সম্ভবপর হত! এত সহজে যদি ভাল হয়ে উঠত মানুষ!

হাসির কারণ আরও খানিকটা আছে। রতনবাবুর মত মানুষ। পণ্ডিত মানুষ, জ্ঞানী ব্যক্তি, একমাত্র সন্তানের এই ব্যাধি হওয়ার পর তিনি ডাক্তারি বই আনিয়ে এই ব্যাধিটি সম্পর্কে পড়াশুনা করে সব বুঝতে চেয়েছেন, বুঝেছেনও; এবং পৃথিবীতে মানুষের জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের মর্মান্তিক তত্ত্বও তিনি ভাল করেই জানেন—তাকেও এইটুকুতে আশান্বিত হয়ে উঠতে দেখে হাসলেন।

রতনবাবু আবার বললেন–দেখ, আমার অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল যে, কবিরাজি মতেই চিকিৎসা করাই। বিলাতি চিকিৎসার অদ্ভুত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু ওদের ওষুধগুলো আমাদের দেশের মানুষের ধাতুর পক্ষে উদ্র। আমাদের ঠিক সহ্য হয় না। ক্রিয়ার চেয়ে প্রতিক্রিয়ার ফল গুরুতর হয়।

বৃদ্ধ এই নৈরাশ্যের তুফানের মধ্যে একগাছি তৃণের মত ক্ষীণ আশার আশ্রয় পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠেছেন, কথা বলতে তার ভাল লাগছে।

—তবে আমার মনের কথা আমি কাউকে বলি না। বুঝেছ ভাই। ওটা আমার প্রকৃতিধর্ম নয়। বিপিনের নিজের বিশ্বাস নাই। বউমার নাই। বিপিনের বড় ছেলে এম. এ. পড়ছে, সে তো একটু বেশি রকমের আধুনিকপন্থী। তাদেরও বিশ্বাস নাই। আমি বললে তারা কেউ আপত্তি করবে না, সে আমি জানি; মুখ ফুটে কেউ কোনো কথা বলবে না কিন্তু অন্তরে অন্তরে তো তাতে সায় দেবে না; মনের খুঁতখুঁতুনি তো থাকবে। সেক্ষেত্রে আমি বলি না, বলব না। তবে কাল যখন ডাক্তারেরা সকলেই বললেন– যে, হেঁচকি থামাবার আর কোনো ওষুধ আমাদের নাই, তখন। আমি তোমার কথা বললাম। আজ সকালে ডাক্তারদেরও ডেকেছি, তারাও আসবেন, হাসপাতালের প্রদ্যোত ডাক্তার, হরেন সবাই আসবেন। সকলে মিলে পরামর্শ করে একটা ব্যবস্থা কর ভাই।

গম্ভীর হয়ে উঠলেন জীবনমশায়। বললেন–দেখ রতন, শুধু হেঁচকি বন্ধ করবার জন্য আমাকে তোমরা ডেকেচ্ছ। আমি ভাই তার ব্যবস্থাই করেছি। তা কমে এসেছে, হয়ত আজ ওবেলা পর্যন্ত হেঁচকি বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর একটা পথ ধরতে হবে। আমি কবিরাজিও জানি অ্যালোপ্যাথিও করি। আমি বলছি ভাই-দু নৌকায় দু পা রেখে চলা তো চলবে না। হয় কবিরাজি নয় অ্যালোপ্যাথি দুটোর একটা করতে হবে। ওঁরাও ঠিক এই কথাই বলবেন।

একটু চুপ করে থেকে বললেন–আর আজ এখন তো আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আমার বাড়িতে কয়েকজন রোগীই বসে আছে। ভোরবেলা চণ্ডীতলার মোহান্তকে দেখতে গিয়েছিলাম। পথে বিপিনকে দেখে যাচ্ছি। হেঁচকি কমেছে, আমি নিশ্চিন্ত। আমি বিপিনকে দেখে যাই, তারপর ওঁরা আসবেন দেখবেন, পরামর্শ করে যা ঠিক হবে আমি ওবেলা এসে। শুনব।

বৃদ্ধ রতনবাবু বিষণ্ণ হলেন, তবুও যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করে প্রসন্নভাবেই বললেন– বেশ! তাই দেখে যাও তুমি। তুমি যা বলবে ওঁদের বলব।

বিপিন সত্যই একটু ভাল আছে। নাড়িতে ভাল থাকার আভাস পেলেন জীবন দত্ত। কিন্তু ভাল থাকার উপর নির্ভর করে আশান্বিত হয়ে উঠবার মত বয়স তার চলে গেছে। বললেন, ভালই যেন মনে হচ্ছে। তবে ভাল থাকাটা স্থায়ী হওয়া চাই রতন।

–নাড়ি কেমন দেখলে, বল।

—যা দেখলাম তাই বলেছি রতনবাবু! তোমার মত লোকের কাছে রেখেঢেকে তো বলার প্রয়োজন নাই এবং তা আমি বলব না। তোমাকে আমি জানি।

রতনবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

জীবনমশায় হেসে বললেন–আমি কিন্তু নৈরাশ্যের কথা কিছু বলি নি রতন। এই ভাবটা যদি স্থায়ী হয় তা হলে ধীরে ধীরে বিপিন সেরে উঠবে। হেঁচকি আজই থামবে। তারপর আর যদি কোনো উপসর্গ না বাড়ে তা হলে দশ-বার দিনের মধ্যে যথেষ্ট উন্নতি হবে। ভাল থাকাটাকে স্থায়ী ভাব বলব, বুঝেছ? বলব হ্যাঁ আর ভয় নাই। সাবধানে থাকতে হবে। আর এখান ওখান প্র্যাকটিস করে বেড়ানো চলবে না। ওই বাড়িতে বসে যা হয়, তাও বেশি পরিশ্রম চলবে না।

–ওই তো! ওই তো রোগের কারণ। বার বার বারণ করেছি। বার বার। কিন্তু শোনে কি? কী বলব? কী করব? উপযুক্ত ছেলে। গণ্যমান্য ব্যক্তি। জীবনের কোনোখানে কোথাও কোনো দোষ নাই, অমিতাচার নাই, অন্যায় নাই, আহারে লোভ নাই, অন্যায় পথে অর্থোপার্জনের মতি নাই, কোনো নেশা নাই; সিগারেট পান পর্যন্ত খায় না; ক্রোধ নাই; বিলাসী নয়; শুধু ওই প্র্যাকটিস। প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। তাও তোমাকে বলছি ভাই, প্র্যাকটিস যে অর্থের জন্যে তাও নয়। ওই মামলা জেতার নেশা। এ জেলা ও জেলা, এ কোর্ট ও কোর্ট সে কোর্ট। তারপর মাসে দুবার তিনবার হাইকোর্টে কেস নিয়ে গিয়েছে। ওই মামলা জেতার নেশা, যে মামলায় হার হয়েছে, হাইকোর্টে তাই ফিরিয়ে আনতে হবে। তা এনেছে। ও নেশা কিছুতেই গেল না। ঘর দেখে নি, সংসার দেখে নি, ছেলেপুলে স্ত্রী নিয়ে আনন্দ করে নি, আমার ঘাড়ে সব ফেলে দিয়ে ওই নিয়ে থেকেছে। আমি কতবার বলেছি–বিপিন, এও তোমার রিপু। রিপুকে প্রশ্রয় দিয়ো না। প্রশ্রয় পেলে রিপুই ব্যাধি হয়ে দেহ-মনকে আক্রমণ করে হয়ত–। বাপ হয়ে কথাটা তো উচ্চারণ করতে পারতাম না ভাই।

জীবন দত্ত বললেন– যাক এবার সেরে উঠুক। সাবধান আপনিই হবে।

একটি কিশোর ছেলে এসে দাঁড়াল, আপনার ফি। এইটিই বিপিনের বড় ছেলে। চমৎকার ছেলে।

—এ কী? চার টাকা কেন? আমার ফি দু টাকা!

দুটি টাকা তুলে নিয়ে জীবনমশায় পকেটে ফেলে বেরিয়ে পড়লেন। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল। বলল—আপনি কি ডাক্তাররা যখন আসবেন তখন থাকবেন না?

–আমি? আমি থেকে কী করব?

–আপনার মতামত বলবেন।

–আমি তো শুধু হিকার জন্য ওষুধ দিয়েছি। ওটা একটা উপসর্গ। মূল চিকিৎসা তো ওঁরাই করছেন। হাসলেন জীবন ডাক্তার।

ছেলেটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ বললে—ওবেলা একবার আসবেন না?

—আসব? আচ্ছা আসব।

ডাক্তার চলে গেলেন।

বিপিন বোধহয় বাঁচবে না। ভাল খানিকটা মনে হল বটে কিন্তু আজ যেন স্পষ্টই তিনি নাড়ি দেখে অনুভব করেছেন—মৃত্যু আসছে। আসছে কেন ইতিমধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছে। ছায়া পড়ছে তার। রনবাবুর কথা ভাবলেন। বড় আঘাত পাবে রতন। নিজের কথা মনে পড়ল। তার ছেলে বনবিহারী মারা গেছে। বিপিনেরই বয়সী সে। একান্ত তরুণ বয়সে বনবিহারী মারা গেছে; নিজের অমিতাচারে, মদ্যপান এবং তার আনুষঙ্গিক অনাচার করে নিজেকে জীৰ্ণ করেছিল, তার উপর ম্যালেরিয়ায় ভুগে নিজেকে ক্ষয় করেছিল সে। বিপিন নিজেকে অতিরিক্ত কৰ্মভারে পীড়িত করে ক্ষয় করেছে।

রতনবাবুর কথাগুলি মনে পড়ল। ঘর দেখে নি, সংসার দেখে নি, ছেলেপুলে স্ত্রী নিয়ে আনন্দ করে নি। শুধু কাজ, কাজ, মামলা মামলা মামলা। কতবার রতনবাবু বলেছেন–বিপিন, এও তোমার রিপু–!

রিপুই বটে। বড় ভয়ঙ্কর রিপু। বড় ভয়ঙ্কর। তিনি নিজে ভুগেছেন যে! জীবন্তে মৃত্যু ঘটেছে বলে তিনি তার হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। বনবিহারীর মৃত্যুর পর তিনি চিকিৎসায় অমনোযোগী হয়েছেন এবং কাল অগ্রসর হয়ে তাকে পুরনো জীর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। আজ তাঁর অবস্থা গজভুক্ত কপিথের মত। সত্য বলতে গেলে এ তো তার মৃত্যু।

–কেমন দেখে এলি? রতনবাবুর ছেলেকে?

–সেতাব?

সেতাবের বাড়ি এসে পড়েছেন, খেয়াল ছিল না।

—কী দেখলি?

—দেখব আর কী? আমি তো দেখছি না। দেখছে ডাক্তাররা। আমাকে ডেকেছিল হিষ্কা বন্ধের জন্যে। তা কমেছে। বোধহয় সন্ধ্যা পর্যন্ত হিক্কা থেমে যাবে।

–কিন্তু নাড়ি দেখলি তো?

–দেখেছি।

–কী দেখলি তাই তো শুধাচ্ছি রে!

–প্রদ্যোত ডাক্তারসুদ্ধ যখন দেখছে তখন কী দেখলাম তা বলা তো ঠিক হবে না সেতাব। একালে ওদের ওষুধপত্রের খবর তো সব জানি না ভাই, কী করে বলব?

—হুঁ। তা তুই ঠিক বলেছিস। তবে রতনবাবু তো আমাদের গায়ের লোক, ঘরের লোক সেই জন্যে। বুঝলি না, অবস্থা আছে, চিকিৎসা করাতে পারেন। কলকাতা নিয়ে যেতে পারেন।

–কলকাতা থেকে আসাটাই ভুল হয়েছে। কলকাতায় থাকলেই ভাল করতেন। এলেন। বিশ্রাম হবে বলে। কিন্তু হঠাৎ রোগ বাড়লে কী হবে সেটা ভাবলেন না। ওই হয় রে। সংসারে দীর্ঘকাল চিকিৎসা করে এইটেই দেখলাম যে, ভ্ৰম হয়, সেবার ত্রুটি হয়, এটা-ওটা হয়। কলকাতা নিয়ে যাওয়া আর চলবে না। মানে

—তা হলে? কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে সেতাব কথা বলে উঠল; কিন্তু নিজেও কথাটা শেষ করতে পারলে না, নিজেই থেমে গেল।

—না-না সে বলি নি, বলবার মত কিছু পাই নি। তবে বুঝলি না? তবু যেন ভরসা। পাচ্ছি না।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। এরপর দুজনেই চুপ করে বসে রইলেন।

ডাক্তার হঠাৎ উঠে বললেন– চললাম, রোগী বসে আছে বাড়িতে। চণ্ডীতলা হয়ে যাব। গোঁসাই এখনতখন, জানিস?

–শুনেছি কাল। আজ বোধহয় ভাল আছেন একটু। নিশি ঠাকরুন গিয়েছিল চণ্ডীতলা মায়ের স্থানে জল দিতে; সে বলছিল। শশী নাকি ভাল করেছে গোঁসাইকে একদাগ ওষুধে। বলছিল—কাল জীবনমশায় ভাইঝিটাকে দেখে বললে, জলবারণ খাওয়াতে হবে। তা—শশীকেই দেখাব আমি।

চমকে উঠলেন জীবন দত্ত। শশীকে দেখাবে? হতভাগিনী মেয়েটার মুখ মনে পড়ল। কচি মেয়ে। কত সাধ কত আকাঙ্ক্ষা মনে। মেয়েটাকে হত্যা করবে। শশী একটা পাপ হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে আর-একটি তরুণীর মুখ মনে পড়ল।

সেতাব বললে–তুই কাল নিশির ভাইঝিকে দেখেছিলি নাকি? জলবারণের কথা বলেছিলি?

–বলেছিলাম। আমার বিদ্যেতে ওই একমাত্র ওষুধ। কিন্তু ও কথা থাক। কী বলে–গণেশ ভটচাজের মেয়ের খবর কিছু জানিস? কাল রাত্রে–

–খুব কাহিল। এখন-তখন অবস্থা শুনছি। কাল তো তুই শুনলাম বলে দিয়েছিলি নাড়ি দেখে।

—না তো? জীবনমশায় চমকে উঠলেন।–আমি তো নাড়ি দেখি নি প্রসবের পর। হাসপাতালের ডাক্তার

কথার উপর কথা দিয়ে সেতাব বললে–হাসপাতালের ডাক্তার শুনলাম কোমর বেঁধে লেগেছে। শুনলাম খুব ইনজেকশন দিচ্ছে। অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে। গণেশকে বলেছে আর-একটা অক্সিজেন আনতে হবে।

চললাম। জীবনমশায় অকস্মাৎ চলতে শুরু করলেন যেন। তরুণ ছোকরাটি বাহাদুর বটে, বীর বটে। শক্তিও আছে, নিজের উপর বিশ্বাসও আছে। যুদ্ধ করছে বলতে গেলে। একবার দেখে যাবেন।

 

প্রদ্যোত গম্ভীর মুখে বসে আছে আপিসে। গণেশ নই, গণেশের স্ত্রী আধ-ঘোমটা দিয়ে বসে আছে বারান্দায়। মশায়কে দেখে সে মৃদুস্বরে কেঁদে উঠল।—ওগো মশাই, আমার অৰ্চনার কী হবে গো? একবার

–কাঁদবেন না। গম্ভীর স্বরে প্রদ্যোত বললে।

মশায় বললেন–কেঁদো না মা। দেখ, ভগবান কী করেন। এতে তার হাত মা। প্রদ্যোত কুঞ্চিত করে বললে–আপনি কি নাড়ি দেখতে চান নাকি?

মশায় বললেন–না-না। আমি যাচ্ছিলাম পথে, ভাবলাম একবার খবর নিয়ে যাই। বলেই তিনি ফিরলেন।

–একটু বসবেন না?

–না। দু-চারটে রোগী এখনও আসে তো। তারা বসে আছে।

প্রদ্যোত বললে—মতির মায়ের এক্স-রের রিপোর্ট এসেছে। দেখবেন? বিশেষ কিছু হয়। নি। এতক্ষণে একটু হাসলে প্রদ্যোত।

—ভালই তো। আপনার দয়াতেই বুড়ি বাঁচল। মশায় গতি দ্রুততর করলেন। একবার মনে হল—বলেন–বিপিনের হিকা থেমে এসেছে। কিন্তু তা তিনি বলতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *