১৯. বেণীবাবুর আলয়ে বেচারামবাবুর গমন, বাবু রামবাবুর পীড়া ও গঙ্গাযাত্রা, বরদাবাবুর সহিত কথোপকথনান্তর তাঁহার মৃত্যু।

প্রাতঃকালে বেড়িয়া আসিয়া বেণীবাবু আপন বাগানের আটচালায় বসিয়া আছেন, এদিক ওদিক দেখিতে দেখিতে রাম প্রসাদী পদ ধরিয়াছেন —”এবার বাজি ভোর হল” —পশ্চিম দিকে তরুলতার মেরাপ ছিল তাহার মধ্যে থেকে একটা শব্দ হইতে লাগিল —বেণীভায়া বেণীভায়া —বাজি ভোরই হল বটে। বেণীবাবু চমকিয়া উঠিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারামবাবু বড়ো ত্রস্ত আসিতেছেন, অগ্রবর্তী হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন —বেচারাম দাদা! ব্যাপারটা কি ? বেচারামবাবু বলিলেন —চাদরখানা কাঁধে দেও, শীঘ্র আইস— বাবুরামের বড় ব্যারাম—একবার দেখা আবশ্যক। বেণীবাবু ও বেচারাম শীঘ্র বৈদ্যবাটীতে আসিয়া দেখেন যে বাবুরামের ভারি জ্বর বিকার —দাহ পিপাসা আত্যন্তিক –বিছানায় ছট্‌ ফট্‌ করিতেছেন –সম্মুখে শসা কাটা ও গোলাপের নেকড়া কিন্তু উকি উদ্‌গার মুহুর্মুহু হইতেছে। গ্রামের যাবতীয় লোক চারিদিগে ভেঙে পড়িয়াছে, পীড়ার কথা লইয়া সকলে গোল করিতেছে। কেহ বলে –আমাদের শাকমাছখেকো নাড়ি –জোঁক, জোলাপ, বেলেস্তারা হিতে বিপরীত হইতে পারে, আমাদিগের পক্ষে বৈদ্যের চিকিৎসাই ভালো, তাতে যদি উপশম না হয় তবে তৎকালে ডাক্তার ডাকা যাইবে। কেহ কেহ বলে হাকিমী মত বড়ো ভালো, তাহারা রোগীকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া আরাম করে ও তাহাদের ঔষধপত্র সকল মোহনভোগের মতো খেতে লাগে। কেহ কেহ বলে যা বলো কহ এসব ব্যারাম ডাক্তারে যেন মন্ত্রের চোটে আরাম করে –ডাক্তারি চিকিৎসা না হলে বিশেষ হওয়া সুকঠিন। রোগী এক একবার জল দাও জল দাও বলিতেছে, ব্রজনাথ রায় কবিরাজ নিকটে বসিয়া কহিতেছেন, দারুণ স্যন্নিপাত –মুহুর্মুহু জল দেওয়া ভালো নহে, বিল্বপত্রের রস ছেঁচিয়া একটু একটু দিতে হইবেক, আমরা তো উহার শত্রু নয় যে এ সময়ে যত জল চাবেন তত দিব। রোগীর নিকটে এইরূপ গোলযোগ হইতেছে, পার্শ্বের ঘর গ্রামের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতে ভরিয়া গিয়াছে তাহাদিগের মত যে শিবস্বস্ত্যয়ন, সূর্য অর্ঘ, কালিঘাটে লক্ষ জবা দেওয়া ইত্যাদি দৈবক্রিয়া করা সর্বাগ্রে কর্তব্য। বেণীবাবু দাঁড়িয়ে সকল শুনিতেছেন কিন্তু কে কাহাকে বলে ও কে কাহার কথাই বা শুনে –নানা মুনির নানা মত, সকলেরই আপনার কথা ধ্রুবজ্ঞান, তিনি দুই-একবার আপন বক্তব্য প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিলেন –কিন্তু মঙ্গলাচরণ হইতে না হইতে একেবারে তাঁহার কথা ফেঁসে গেল। কোনো রকমে থা না পাইয়া বেচারামবাবুকে লইয়া বাহির বাটীতে আইলেন ইতিমধ্যে ঠকচাচা নেংচে নেংচে আসিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে পৌঁছিল। বাবুরামের পীড়ার জন্য ঠকচাচা উদ্বিগ্ন –সর্বদাই মনে করিতেছে সব দাঁও বুঝি ফস্‌কে গেল। তাহাকে দেখিয়া বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন –ঠকচাচা ! পায়ে কি ব্যথা হইয়াছে ? অমনি বেচারাম বলিয়া উঠিলেন –ভায়া ! তুমি কি বলাগড়ের ব্যাপার শুন নাই –ঐ বেদনা উহার কুমন্ত্রণার শাস্তি, আমি নৌকায় যাহা বলিয়াছিলাম তাহা কি ভুলিয়া গেলে ? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা পেঁচ কাটাইবার চেষ্টা করিল। বেণীবাবু তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন –সে যাহা হউক, এক্ষণে কর্তার ব্যারামের জন্য কি তদ্‌বির হইতেছে ? বাটীর ভিতর তো ভারি গোল। ঠকচাচা বলিল –বোখার শুরু হলে এক্রামদ্দি হাকিমকে মুই সাতে করে এনি –তেনারি বহুত জোলাব ও দাওয়াই দিয়ে বোখারকে দফা করে খেচ্‌রি খেলান, লেখেন ঐ রোজেতেই বোখার আবার পেল্টে এসে, সে নাগাদ ব্রজনাথ কবিরাজ দেখছে, বেরাম রোজ জেয়াদা মালুম হচ্ছে –মুই বি ভালো বুরা কুচ ঠেওরে উঠতে পারি না। বেণীবাবু বলিলেন –ঠকচাচা রাগ করো না –এ সম্বাদটি আমাদিগের কাছে পাঠানো কর্তব্য ছিল –ভালো, যাহা হইয়াছে তাহার চারা নাই এক্ষণে একজন বিচক্ষণ ইংরেজ ডাক্তার শীঘ্র আনা আবশ্যক। এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে রামলাল ও বরদাপ্রসাদবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাত্রি জাগরণ, সেবা করণের পরিশ্রম ও ব্যাকুলতার জন্য রামলালের মুখ ম্লান হইয়াছে –পিতাকে কি প্রকারে ভালো রাখিবেন ও আরাম করিবেন এই তাঁহার অহরহ চিন্তা। বেণীবাবুকে দেখিয়া বলিলেন –মহশয় ! ঘোর বিপদে পড়িয়াছি, বাটীতে বড়ো গোল কিন্তু সৎপরামর্শ কাহার নিকট পাওয়া যায় না। বরদাবাবু প্রাতে ও বৈকালে আসিয়া তত্ত্ব লয়েন কিন্তু তিনি যাহা বলেন সে অনুসারে আমাকে সকলে চলিতে দেন না –আপনি আসিয়াছেন ভালো হইয়াছে এক্ষণে যাহা কর্তব্য তাহা করুন। বেচারামবাবু বরদাবাবুর প্রতি কিঞ্চিৎকাল নিরীক্ষণ করিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন –বরদাবাবু। তোমার এত গুণ না হলে সকলে তোমাকে কেন পূজা করিবে। এই ঠকচাচা বাবুরামকে মন্ত্রণা দিয়া তোমার নামে গোমখুনি নালিশ করায় ও বাবুরাম ঘটিত অকারণে তোমার উপর নানা প্রকার জুলুম ও বদিয়ত হইয়াছে কিন্তু ঠকচাচা পীড়িত হইলে তুমি তাহাকে আপনি ঔষধ দিয়া ও দেখিয়া শুনিয়া আরাম করিয়াছ, এক্ষণেও বাবুরাম পীড়িত হওয়াতে সৎপরামর্শ দিতে ও তত্ত্ব লইতে কসুর করিতেছ না –কেহ যদি কাহাকে একটা কটুবাক্য কহে তবে তাহাদিগের মধ্যে একেবারে চটাচটি হয়ে শত্রুতা জন্মে, হাজার ঘাট মানামানি হলেও আপন মনভার যায় না কিন্তু তুমি ঘোর অপমানিত ও অপকৃত হইলেও আপন অপমান ও অপকার সহজে ভুলে যাও –অন্যের প্রতি তোমার মনে ভ্রাতৃভাব ব্যতিরেকে আর অন্য কোনো ভাব উদয় হয় না –বারদাবাবু। অনেকে ধর্ম ধর্ম বলে বটে কিন্তু যেমন তোমার ধর্ম এমন ধর্ম আর কাহারো দেখিতে পাই না —মনুষ্য পামর তোমার গুণের বিচার কি করবে কিন্তু যদি দিনরাত সত্য হয় তবে এ গুণের বিচার উপরে হইবে। বেচারামবাবুর কথা শুনিয়া বরদাবাবু কুণ্ঠিত হইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া থাকিলেন পরে বিনয়পূর্বক বলিলেন –মহাশয়। আমাকে এত বলিবেন না –আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি –আমার জ্ঞান বা কি আর ধর্মই বা কি। বেণীবাবু বলিলেন –মহশয়েরা ক্ষান্ত হউন এ সকল কথা পরে হইবেক এক্ষণে কর্তার পীড়ার জন্য কি বিধি তাহা বলুন। বরদাবাবু কহিলেন –আপনাদিগের মত হইলে আমি কলিকাতায় যাইয়া বৈকাল নাগাদ ডাক্তার আনিতে পারি, আমার বিবেচনায় ব্রজনাথ রায়ের ভরসায় থাকা আর কর্তব্য নহে। প্রেমনারায়ণ মজুমদার নিকটে দাঁড়াইয়া ছিলেন –তিনি বলিলেন –ডাক্তারেরা নাড়ির বিষয় ভালো বুঝে না,তাহারা মানুষকে ঘরে মারে, আর কবিরাজকে একেবারে বিদায় করা উচিত নহে বরং একটা রোগ ডাক্তার দেখুক –একটা রোগ কবিরাজ দেখুক। বেণীবাবু বলিলেন –সে বিবেচনা পরে হইবে এক্ষণে বরদাবাবু ডাক্তারকে আনতে যাউন। বরদাবাবু স্নান আহার না করিয়া কলিকাতায় গমন করিলেন, সকলে বলিল বেলাটা অনেক হইয়াছে মহাশয় এক মুটা খেয়ে যাউন –তিনি উত্তর করিলেন –তাহা হইলে বিলম্ব হইবে, সকল কর্ম ভণ্ডুল হইতে পারে।

বাবুরামবাবু বিছানায় পড়িয়া মতি কোথা মতি কোথা বলিয়া অনবরত জিজ্ঞাসা করিতেছেন কিন্তু মতিলালের চুলের টিকি দেখা ভার, তিনি আপন দলবল লইয়া বাগানে বনভোজনে মত্ত আছেন, বাপের পীড়ার সন্বাদ শুনেও শুনেন না। বেণীবাবু এই ব্যবহার দেখিয়া বাগানে তাহার নিকট লোক পাঠাইলেন কিন্তু মতিলাল মিছামছি বলিয়া পাঠাইলেন যে, আমার অতিশয় মাথা ধরিয়াছে কিছুকাল পরে বাটীতে যাইব।

দুই প্রহর দুইটার সময় বাবুরামবাবুর জ্বর বিচ্ছেদকালীন নাড়ি ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। কবিরাজ হাত দেখিয়া বলিল –কর্তাকে স্থানান্তর করা কর্তব্য –উনি প্রবীণ, প্রাচীন ও মহামান্য, অবশ্য যাহাতে উঁহার পরকাল ভালো হয়, তাহা করা উচিত। এই কথা শুনিবামাত্রে পরিবার সকলে রোদন করিতে লাগিল ও আত্মীয় এবং গ্রামবাসীরা সকলে ধরাধরি করিয়া বাবুরামবাবুকে বাটীর দালানে আনিল। এমতো সময়ে বরদাবাবু ডাক্তার সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইলেন, ডাক্তার নাড়ি দেখিয়া বলিলেন –তোমরা শেষাবস্থায় আমাকে ডাকিয়াছ –রোগীকে গঙ্গাতীরে পাঠাবার অগ্রে ডাক্তারকে ডাকিলে ডাক্তার কি করিতে পারে? এই বলিয়া ডাক্তার গমন করিলেন। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় লোক বাবুরামবাবুকে ঘিরিয়া একে একে জিজ্ঞাস করিতে লাগিলে –মহাশয় আমাকে চিনিতে পারেন –আমিকে বলুন দেখি ? বেণীবাবু বলিলেন –রোগীকে আপনারা এত ক্লেশ দিবেন না –এরূপ জিজ্ঞাসাতে কি ফল ? স্বস্ত্যয়নী ব্রাহ্মণেরা স্বস্ত্যয়ন সাঙ্গ করিয়া আশীর্বাদী ফুল লইয়া আসিয়া দেখেন যে তাঁহাদিগের দৈব ক্রিয়ায় কিছুমাত্র ফল হইল না। বাবুরামবাবুর শ্বাসবৃদ্ধি দেখিয়া সকলে তাঁহাকে বৈদ্যবাটীর ঘাটে লইয়া গেল, তথায় আসিয়া গঙ্গাজল পানে ও স্নিগ্ধ বায়ু সেবনে তাঁহার কিঞ্চিৎ চৈতন্য হইল। লোকের ভিড় ক্রমে ক্রমে কিঞ্চিৎ কমিয়া গেল –রামলাল পিতার নিকট বসিয়া আছেন –বরদাপ্রসাদবাবু বাবুরামবাবুর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন ও কিয়ৎকাল পরে আস্তে আস্তে বলিলেন মহাশয় ! এক্ষণে একবার মনের সহিত পরাৎপর পরমেশ্বরকে ধ্যান করুন –তাঁহার কৃপা বিনা আমাদের গতি নাই। এ কথা শুনিবামাত্রেই বাবুরামবাবু বরদাপ্রসাদবাবুর প্রতি দুই-তিন লহমা চাহিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। রামলাল চোখের জল মুছিয়া দিয়া দুই-এক কুশী দুগ্ধ দিলেন –কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া বাবুরামবাবু মৃদু স্বরে বলিলেন –ভাই বরদাপ্রসাদ ! আমি এক্ষণে জানলুম যে তোমার বাড়া জগতে আমার আর বন্ধু নাই –আমি লোকের কুমন্ত্রণায় ভারি ভারি কুকর্ম করিয়াছি, সেই সকল আমার এক একবার স্মরণ হয় আর প্রাণটা যেন আগুনে জ্বলিয়া উঠে –আমি ঘোর নারকী –আমি কি জবাব দিব ? আর তুমি কি আমাকে ক্ষমা করিবে ? এই বলিয়া বরদাবাবুর হাত ধরিয়া বাবুরামবাবু আপন চক্ষু মুদিত করিলেন। নিকটে বন্ধু-বান্ধবেরা ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিতে লাগিল ও বাবুরামবাবুর সজ্ঞানে লোকান্তর হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *