প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৯. প্রয়োজন

এই পরিচ্ছেদ শেষ করবার আগে আর মাত্র দু’-একটা কথা তোলা দরকার।

আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই প্রথা চলে আসছে, দার্শনিক আলোচনার শুরুতে চারটি কথা খুব খোলাখুলিভাবে বলে নেওয়া : অধিকার, বিষয়, সম্বন্ধ, প্রয়োজন। বিষয় ও সম্বন্ধের কথা কিছুটা বলা হয়েছে। প্রয়োজন ও অধিকারের কথাও তোলা দরকার।

লোকায়ত দর্শন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনটা কী? প্রয়োজনের প্রসঙ্গ নিশ্চয়ই স্থান-কাল নিরপেক্ষ হতে পারে না। তাই, প্রশ্নটা হবে, আজকের দিনে আমাদের দেশে লোকায়ত দর্শনের চর্চার কী প্রয়োজন?

দেশের বাস্তব পরিস্থিতির কথা থেকেই শুরু করা দরকার।

সাধারণ মানুষ,—কাজ করে, আমাদের দেশে সে-শ্রেণীর মানুষের ধ্যানধারণারই নাম লোকায়তিক,—তারা নানা রকম সমস্যার ঘূর্ণিতে পড়ে শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক সমাধানের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছে। ফলে, অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণা বর্জন করে তারা চাইছে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের কাছ থেকেই পথনির্দেশ পেতে। কিন্তু সেই সঙ্গেই শোনা যায় আর একদল বলছেন, এ সবই শুধু বিদেশ থেকে আমদানি করা মতবাদ। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্যবাদেরও সম্পর্ক নেই, বস্তুবাদেরও নয়।

সাধারণ মানুষের পক্ষে তাই আজ ভেবে দেখা প্রয়োজন, এই আপত্তিগুলি সত্যি কিনা। প্রয়োজনটা শুধুমাত্র জ্ঞানের খাতিরে নয়। জীবনের তাগিদেও।

সাম্যসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন অতীত কোনো দেশের বা কোনো জাতিরই হতে পারে না। তার কারণ, আগেই বলা হয়েছে, পশুর রাজ্য পিছনে ফেলে এগিয়ে আসবার পথটা পৃথিবীর সব-দেশের সব-মানুষের পক্ষেই এক। আজকের দিনের যে-কোনো জাতি সভ্যতার যতো উঁচু শিখরেই পৌঁছুক না কেন, এককালে তাকে আদিম সাম্য-সমাজেই বাস করতে হয়েছে। এদিক থেকে অন্যান্য দেশের সংগে আমাদের দেশের তফাত প্রধানত দুটো। প্রথমত, আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে আজো নানান রকম মানুষ সেই পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় টিকে আছে, এ-ঘটনা পৃথিবীর সমস্ত দেশে দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের উন্নত ও সংস্কৃত মানুষদের রচনাতেও এমন অনেক চিহ্ন থেকে গিয়েছে যেগুলিকে এই আদিম সাম্যসমাজের স্মারক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

কিন্তু বস্তুবাদ? বস্তুবাদের কথা তো আগেই তুলেছি। এমন কথা একবার নয়, বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে যে আমাদের দেশের ঐতিহ্যটা বিশুদ্ধ অধ্যাত্মবাদ—এ-দেশে অধ্যাত্মবাদী চিন্তা যেন তৈলধারার মতোই অবিচ্ছিন্ন।

কিন্তু এ-কথা কি ঠিক? উত্তরটা নিশ্চয়ই নির্ভর করবে, দেশের ঐতিহ্য বলতে ঠিক কী বোঝায়, এই প্রশ্নের উপর। কার চিন্তাধারা,—কোন শ্রেণীর মানুষের? যদি শোষক-শ্রেণীর চেতনাকেই দেশের একমাত্র দার্শনিক ঐতিহ্য বলে মনে করেন তাহলে মানতেই হবে দেশের ঐতিহ্যে বস্তুবাদী চেতনার কোনো স্থান ছিলো না। কিন্তু সাধারণ মানুষ কোন ধরনের ধ্যানধারণায় বিশ্বাস করেছে?—এ-প্রশ্ন যদি দেশের দার্শনিক ঐতিহ্য নির্ণয় করবার সময় প্রাসঙ্গিক হয় তাহলে মানতেই হবে বস্তুবাদী চেতনা আমাদের দেশের দার্শনিক ঐত্যহ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিলো। কেননা, সাধারণ মানুষ ভাববাদে বিশ্বাস করে নি, বিশ্বাস করেছে দেহাত্ববাদেই, বস্তুবাদেই। প্রমাণ, প্রচীনদের অজস্র উক্তি। তাঁরা বলেছেন,—বারবার বলেছেন,—লোকায়ত মানে হলো সাধারণ মানুষের দর্শন, আর এই দর্শন অনুসারে মূর্ত জড় জগৎটাই একমাত্র সত্য : আত্মা নেই, ঈশ্বর নেই, পরলোক নেই, পুরুষার্থ বলতে শুধু অর্থ ও কাম।

তাই দেশের সাধারণ মানুষ যদি তাদের দার্শনিক ঐতিহ্যটি চিনতে চায় তাহলে লোকায়ত দর্শনের আলোচনা বাদ দিয়ে চলবে কী করে?

কিন্তু লোকায়ত দর্শন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন শুধুমাত্র এই নয় যে দেশের জনসাধারণ নিজেদের দার্শনিক ঐতিহ্যটিকে স্পষ্টভাবে জানতে ও চিনতে পারবে। প্রয়োজন আরো আছে। আরো একটি বড় প্রয়োজন হলো আজকের দিনে ওই লোকায়তিক চিন্তাধারার সংকীর্ণতাকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে, এবং তাকে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পর্যায়ে তুলে আনবার চেষ্টা করতে হবে।

যেমন ধরুন, আদিম সাম্যবাদের নজিরের উপর আধুনিক সাম্যবাদী অতোখানি জোর দেন কেন? তা কি এই কারণে যে আজকের দিনে সেই সাম্যসমাজে ফিরে যাবার কোনো তাগিদ আছে? নিশ্চয়ই নয়। তার বদলে আসলে প্রয়োজন হলো, বিরুদ্ধ-প্রচারকে খণ্ডন করে এইটুকুই দেখানো যে ব্যক্তিগত-সম্পত্তি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদি সনাতন নয়। মানুষের ইতিহাসে একটা সময় ছিলো যখন এগুলির জন্মই হয়নি। মানুষের ইতিহাসে এমন একটা সময় আসছে যখন এগুলির কোনো প্রয়োজন থাকবে না।

আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ লুইস হেনরী মর্গানকে কেউই অবশ্য সাম্যবাদের প্রচারক বলবেন না। তার বদলে তাঁকে বৈজ্ঞানিক নৃতত্ত্বের প্রবর্তকই বলতে হবে। কিন্তু ভূয়োদর্শনের প্রভাবে তিনি স্পষ্টভাবেই না এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন(৬৮) :

A mere property career is not the final destiny of mankind, if progress is to be the law of the future as it has been of the past. The time which has passed away since civilization began is but a fragment of the past duration of man’s existence; and but a fragment of the ages yet to come. The dissolution of society bids fair to become the termination of a career of which property is the end and aim; because such a career contains the elements of self-destruction.

অর্থাৎ, অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও যদি প্রগতির নিয়মই সত্য হয় তাহলে মানতেই হবে যে ব্যক্তিগত সম্পত্তিই মানুষের চরম নিয়তি হতে পারে না। সভ্যতার শুরু থেকে যেটুকু সময় কেটেছে তা মানুষের পুরো অতীতটার তুলনায় যে-রকম চোখের পলক সেই রকমই চোখের পলক হলো পুরো ভবিষ্যৎটার তুলনায়। যে-সমাজের একমাত্র উদ্দেশ্য শুধু সম্পত্তিই তার শেষ ঘনিয়ে এসেছে; কেননা, সে-উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে আত্মনাশের বীজ।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি সনাতন নয়—আদিম সমাজের দিকে চেয়ে দেখলে এই কথাটি আমরা স্পষ্ট ভাবে জানতে পারি। জানতে পারবার দরকার আছে। সেইদিকে পিছু হটবার জন্যে নিশ্চয়ই নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রভাবমুক্ত আগামীকালের সমাজ-ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলবার জন্যেই।

আমাদের দেশের লোকায়তিক চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হবার প্রয়োজনও প্রায় অনুরূপ। এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই আমরা বুঝতে পারবো যে ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী চিন্তার ঐতিহ্যই দেশের একমাত্র দার্শনিক ঐতিহ্য নয়। কিন্তু তাই বলে, ওই লোকায়তিক ধ্যানধারণার দিকে পিছু হটবার কোনো তাদিগই থাকতে পারে না। মনে রাখবে হবে, উৎপাদন-পদ্ধতির এক অতি অনুন্নত পর্যায়ে এই ধ্যানধারণার জন্ম হয়েছিলো। মনে রাখতে হবে, সে অবস্থায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যেটুকু সম্যক পরিচয় তা অতি নগণ্য। তাই, বৈজ্ঞানিক তথ্যের দিক থেকে এই লোকায়ত-দর্শনের একেবারেই দীনহীন দশা, প্রকৃতি সম্বন্ধে যে সংবাদ লোকায়তিকেরা উদ্ধার করতে পারেন নি, সেটুকুকে কল্পনা দিয়ে পূরণ করে নেবার চেষ্টা ছাড়া তাঁদের পক্ষে আর কোনো উপায় ছিলো না। ওই রকম একটা কল্পনা থেকে বামাচারী বিশ্বাসের জন্ম। এবং, ওই অবস্থায় প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞানের দৈন্য যে কী ভয়াবহ তা ওই বামাচারী বিশ্বাস থেকেই প্রমাণ হয়।

আজকের দিনে বৈজ্ঞানিক তথ্যে সম্বৃদ্ধ যে-বস্তুবাদের দিকে মানুষ এগিয়ে যাবে তার তাৎপর্যের সঙ্গে নিশ্চয়ই অতীতের ওই লোকায়তিক চেতনার কোনো তুলনাই হয় নাই। তাই সেদিকে ফেরা নয়, বস্তুবাদী চেতনাকেই উন্নত পর্যায়ে নিয়ে আসা—এই প্রয়োজনটির কথা মনে রেখে লোকায়ত দর্শনের আলোচনা করতে হবে।

———————————-
৬৮. Ibid 561; cf. G. Thomson AA 426 “…such a study must be undertaken by scholars, who, like Morgan, believe that ‘a mere property career is not the final destiny of mankind’.”