১৯. কি দিন এল, সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল

কি দিন এল, সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল

পিথিমিতে এলম কিন্তুক পিথিমির কিছুই দেখলম না। কবে একদিন মায়ের প্যাট থেকে পড়লম, দুনিয়াতে এসে চোখ দুটি মেললম, হয়তো দুবার জোরে চিষ্কার করে কেঁদেছেলম, ঐ পয্যন্তই। তাপর এত কাল পার করলম, কিছুই দেখলম না পিথিমির। সারা জেবনে বাড়ি থেকে তিন কোশ চার কোশের বেশি যেতে হয় নাই। কেউ নিয়ে যায় নাই। মাঠ-ঘাট, ঘরবাড়ি, আসমান-জমিন ওইটুকুনই যা দেখলম। কবর কেমন হবে জানি না তবে মনে হয়, কবরের থেকে একটু বড় এই সোংসার। কবরের জায়গাটো তবু নিজের নিজের, সসাংসারের সবটো নিজের লয়। সংসারে থেকে যা দেখা যায়–আসমান-জমিন–সি তো কবরের বাড়া! সোংসার করতে করতে জান জ্বলে গেলে এইরকম মনে হয়। গাধার খাটুনি খাটতে খাটতে মনে হয়, পিতিদিন রাজ্যের লোকের পিন্ডির বেবস্তা করতে করতে হিমশিম খেয়ে গেলে মনে হয়। শাশুড়ি-ননদের বাঁদিগিরি করতে করতে মনে হয়। তারা নিজেরা বাঁদি-চাকর না ভাবলেও মনে হয়। জা-রা য্যাকন গিদের করে বসে থাকে, টিটেমি করে, গরজ ঠাওরায়, ত্যাকন ইসব মনে হয়। ত্যাকন যেন নিজের ছেলেমেয়ে-সোয়ামি-সংসার সবই বিষ। তা বিষ খেতে খেতে এমন হয়েছে যি অ্যাকন এই বিষেও নেশা লাগে।

গাঁ যিদিন পুড়ল সেইদিন রেতে আমার যে আর একটি খোঁকা হয়েছিল, সে তো মরেই যেছিল। বাঁচার কুনো আশা ছিল না। বর্ষার মরশুমটো টিকবে কি না তাই খুব সন্দ। সি-বার বর্ষাও হয়েছিল তেমনি। সারা দিন সারা রাত গদগদ করে আকাশ ঢালছে তো। ঢালছেই। তা ঢালুক চাষবাস সবই আসমানের মুখ চেয়ে! বর্ষায় পানি যেদি না হলো, ধান হয় রোয়াই হবে না, নাইলে মাঠের ধান মাঠেই শুকুবে। কিন্তুক সিবার হলো উল্টো। এতই বিষ্টি যি চাষের ফাঁক পাওয়া যেচে না, বীজতলা তলিয়ে যেচে, রোয়া ধান ভেসে যেচে। সারা মাঠ পানিতে তম তম করছে। এমন বাদলে কচি ছেলেটোকে বাঁচানো কঠিন হয়েছিল। তা শক্ত জান নিয়ে এয়েছিল ছেলে। বর্ষাকালও শেষ হলো, সে-ও বেশ ডাগর-ডোগর হয়ে উঠিল।

এই সোমায় কত্তা একদিন বললে, বাড়িতে যেসব কাগজ-টাগজ আসে সেসব কি চেয়ে কোনোদিন দ্যাখো, না, অক্ষর-টক্ষর সব ভুল মেরে বসে আছ! কত্তার ব্যাকা কথায় আমিও বাকা কথা বললম। সোংসারের বত্রিশ জনার পিন্ডি রাঁধতে রাঁধতে অক্ষর-ফক্ষর সব চুলোয় গেয়েছে।

সত্যিই তো, পড়তে একদিন শিখেছেলম, কিছুই অ্যাকন আর মনে নাই। কতো দিন কিছু লিখিও নাই, কিছু পড়িও নাই। হপ্তায় হপ্তায় বঙ্গবাসী কাগজটো আজও আসে, আরও কতো কিসব আসে। কত্তা দেখি আজকাল সবই পড়ে। লোকটোকে অ্যাকন আর চিনতে পারি না। খুব ভদ্দরলোক ভদ্দরলোক লাগে। কুনো সময় খালি-গা হয় না। ধুতির ওপর হাতাঅলা গেঞ্জি পরে, না-হয় একটো কুনো জামা পরে। চোখে চশমা লাগায়। কত্তা দূরে যেচে, আমি যেখানকার সেইখানেই আচি। কত্তর দিকে চেয়ে লরম করে বললম, সাংসারের কাজে এত বেস্ত থাকি, এক লহমার ফুরসৎ পাই না। দুনিয়ার খবর আর কি করে রাখব?

আবার যে সারা দুনিয়ায় যুদ্ধের আগুন লেগেছে। আর কিছু না হোক বঙ্গবাসী কাগজটা একটু কষ্টোমষ্টো করে দেখো।

দেখে কি করব? সোংসারের কয়েদখানায় সারা জেবনের মেয়াদে কয়েদ খাটচি-কুন্ দ্যাশে যুদ্ভু হচে, কে যুঘ্ন করছে, কত লোক মরছে, কতো লোক খোড়া হচে, কতো দ্যাশ, কতো ঘর-সসাংসার ছারেখারে যেচে, তা আর আমি কি জানব? আমি য্যাকন চোদ্দ বছরের মেয়ে, আমার বিয়ের সোমায়ে য্যাকন এমনি সারা দুনিয়া যুদ্ধ হয়েছিল–কই কিছুই তো বুঝতে পারি নাই। বেঁধেছি, বেড়েছি, খেয়েচি, ছেলেপুলে মানুষ করেছি, যুদ্ধ নিয়ে কুনোদিন ভাবি নাই। তা আবার অ্যাকন সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলছ, তা হলোই বা, নিজেরা তো কিছু ট্যার পাব না। তার চেয়ে জষ্টি মাসে গাঁয়ে যি আগুন লাগল, গোটা হিঁদু-পাড়াটো পুড়ে গেল, সি ধাক্কা জানে যেয়ে লেগেছে তোমার এই যুন্ধুর চেয়ে অনেক বেশি।

এবার বোধ হয় অত সহজ হবে না। যুদ্ধ আর আগের মতো নাই। কত্তা বললে, ঢাল-তরোয়াল নিয়ে সামনাসামনি মারামারি-কাটাকাটি হতো সেখানকার যুদ্ধ সেখানেই থাকত। যতো রক্তারক্তি হোক, ঐ জায়গার বাইরে আর যুদ্ধ নাই। ঢাল-তরোয়াল দিয়ে যুদ্ধ করে আর কত লোক মারা যায়? কিন্তু এখন যে যুদ্ধ হবে তা একদম আলাদা। লাখ লাখ লোক যুদ্ধে যাবে, যুদ্ধ করবে, মরবেও লাখে লাখে অথচ হয়তো শত্রুকে চিনবেও না, দেখবেও না। আবার যারা যুদ্ধে যায়ই তোমার আমার মতো খুব সাধারণ মানুষ, তাদেরকেও মরতে হবে লাখে লাখে। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের শহরে মানুষ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে তো, আঁধার আকাশ থেকে বোমা মেরে বাড়িঘর-দুয়োর দেবে মাটিতে মিশিয়ে। কতো লোক যে মরবে তার কেউ হিসাব করতে পারবে না। লাশই পাবে না। মা পাবে না ছেলের লাশ, ছেলে পাবে না বাপের লাশ। এক-একটা লাশ ছিড়ে-খুঁড়ে কোথা যে পড়বে তা কেউ জানতে পারবে না।

কতো দূরে যুদ্ধ হচে, আমরা ইয়ার কি বুঝব? উ নিয়ে তুমি অত মাথা ঘামাইছ ক্যানে? কই, সেই আগের যুদ্ধতে তো কিছুই বুঝতে পারা যায় নাই! ঐ বঙ্গবাসী কাগজ আর কি কি সব ছাইভস্ম বাড়িতে আসে, ওইগুননাই য্যাতো লষ্টের মূল।

কত্তা একটু হেসে বললে, দুনিয়া জুড়ে কতো বড় বড় ব্যাপার হচ্ছে, কোন্ এক গাঁয়ের এক কোণে আমরা সব ছা-পোষা মানুষ পড়ে আছি। ঠিকই, আমরা আর এসব কি বুঝব? তবে আগে সব জানালাদরজা বন্ধ ছিল। এখন একটা-দুটো কাগজ-টাগজ আসে, বাইরের দুনিয়ার হাওয়া খানিকটা বোঝা যায়। হাওয়া ভালো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আগুন যেখানেই লাগুক, সারা দুনিয়ায় ছড়াবে। দুনিয়াটা বেওয়ারিশ সম্পত্তি নয় মনে রেখো। এরও মনিব-চাকর আছে। যেমন এইদেশে ব্রিটিশ মনিব, আমরা চাকর।

দিন যেতে লাগল, বছর ঘুরে গেল, যুদ্বুর কিছু কিন্তু আমরা বুঝতে পারলম না। সব আগের মতুন–সোংসারের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছে। বাড়ির লোক কেরমাগত বেড়েই যেচে, ছেলেপুলেগুলো বড় হচে, একটি-দুটি করে জায়েদের সন্তান হচে। ঠিক আগের মতুনই সকালে সুয্যি উঠছে, সাঁঝবেলায় ডুবছে। বঙ্গবাসী কাগজটো এলে, কত্তার পড়া হয়ে গেলে, গাঁয়ের আর যারা পড়তে নিয়ে যায়, তারা ফেরত দিয়ে গেলে, একবার একবার চোখের ছামনে নিয়ে বসে থাকি। বিটিশ আর জারমেনি এই দুটো নাম দেখি বটে, আর আর নামও দেখি, তবে মনে থাকে না। ঐ দুটি নাম খুব বেশি দেখি বলে মনে থাকে। এক-একটো খবর ভালো করে পড়তে যাই, বিদ্যে কম, অ্যানেক কথাই বানান করে করে পড়তে হয়, তা-বাদে অতো কষ্ট করে পড়েও কিছু বুঝতে পারি না। বুঝব কি করে? উড়োজাহাজ দিয়ে একটো-একটো বড় শহরে বোমা ফেলছে, কামান-বন্দুকের গুলি মারছে–আহা আহা, সব ভেঙে গুঁড়িয়ে যেচে, সমুদুরেও আগুন লাগছে। কি ক্ষেতিই না হচে, কতো লোকই না মরছে! ইসবের হিশেব যি থাকছে না তা লয় কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছে না। একের পরে একটো শূন্য দিলে দশ হয়, দুটো দিলে একশো হয় আর তিনটো দিলে হাজার হয়। এই পয্যন্ত জানি আর হাজার হলে কতো হয় তা-ও একটু একটু বুঝতে পারি। কিন্তুক তারপরে য্যাতো শূন্যই দাও, তাতে কতো হয় তা আমি কুনোদিনই শিখতে পারব না। আর পারলেই বা কি? এক হাজার কতো তা-ই মাথায় ঢোকে না, এক লাখ হলে কতো হয় তা কি কুনোদিন বুঝতে পারব? আর কাগজে য্যাতো হিসেব সব শূন্য দিয়ে। এই লেগে কাগজ পড়তে গেলেই বুকের মদ্যে খালি খাঁ খাঁ করে। হায় হায়, তামাম দুনিয়ার সব্বোনাশ হচে!

কখনো কখনো মনে হয়, গাঁয়ের ভেতর ঘরের কোণে বসে আছি বলে কিছু বুঝছি না। শহরে হয়তো অনেক কিছুই হচে। কত্তা আগের মতুনই শহরে যায় বরঞ্চ এট্টু বেশিই যায়। ছোট দ্যাওর কোটে চাকরি করে। বিয়ে হয়েছে, একটি ছেলেও হয়েছে, তাদের নিয়ে শহরে বাসা করে থাকে। আমার ছোট ভাইটিও আর কলেজে যায় নাই। পড়াতে তার মন ছিল কিন্তুক তার আগে বাপের অভিশাপ কুড়নোর ইচ্ছা হয় নাই। সে-ও একটি বিয়ে করে ছোট একটি চাকরি জুটিয়ে শহরে বাসা ভাড়া করে থাকে। বাপজি মারা গেয়েছে আমার ছোট খোঁকাটি য্যাকন প্যাটে সে-ও তো ক-বছর হয়ে গেল। কিন্তুক একবার চাকরি আর সোংসারে ঢুকে পড়ে সে আর ল্যাখাপড়া করতে চাইলে না। দ্যাওর আর ভাইয়ের বাসা পাশাপাশি, বলতে গেলে একই বাড়ি। কত্তা শহরে গেলে এই দুই বাসাতেই যায়। বাড়ির সরু চাল, মুগ মুশুরি ডাল, ঘি এইসব দিয়ে আসে। শহরের খবর যা পাই, তার কাছ থেকেই পাই। কত্তা আজকাল পেরায়ই বলছে, যুদ্ধ লিকিনি পশ্চিমের দ্যাশগুনো থেকে আমাদের ইদিকে এগিয়ে আসছে।

তিলিপাড়ার আগুন বামুনপাড়ায় কেমন করে গেল দেখলে তোএইবার বুঝবে।

ছোট খোঁকাটি ত্যাকন দ্যাড়-দু বছরের হয়েছে, জম্মের পর কি অসুখ করেছিল, বাঁচার কথা ছিল না। নেহাত হেয়াত আছে তাই অ্যাকনো দুনিয়া দেখছে। বলতে গেলে অ্যাকন আর রোগ-বালাই কিছু নাই। বেশ মোটাসোটা হয়েছে, দু-হাতে দুই রুপোর বালা নিয়ে কাদাপানিতে খেলে বেড়ায়, শুদু বুকের ভেতর বিলুইয়ের মতুন ঘরর ঘরর আওয়াজটো আর গেল না।

ইয়ারই মদ্যে একদিন কত্তা বাড়ির ভেতরে এসে সেই আগের মতুন মা-বুনকে ডাকলে। গিন্নি এসে পাশে দাঁড়ালে বললে, বউদের কাপড় আনা হয়েছে, বছরে দু-জোড়া সবারই লাগে। মনে আছে, ছ-মাস আগে শাড়ি আনা হয়েছিল? এখন আর এক জোড়া করে সবারই লাগবে। তুমি সবাইকে যেমন যেমন দিয়ে দাও। কাছে এসে কাপড় দেখে গিন্নি বললে, ই কি কাপড় বাবা? এমন শাড়ি তো কখনো দেখি নাই। এ বাড়ির বউরা তো কুনোদিন এত মোটা শাড়ি পরে না। এ তুমি ফেরত দাওগা।

বাজারে আগুন মা, মিহি তাঁতের শাড়ি, চিরকাল যা তোমরা পরে এসেছ, সে আর বাজারে নাই। এ বড় বড় শহরে, কলকেতায় এখনো এখানে-ওখানে কিছু থাকতে পারে শহরগঞ্জে কোথাও তাঁতের মিহি শাড়ি আর নাই।

সে আবার কি বলছ, বাবা?

যুদ্ধের ফল এই বোধহয় শুরু হলো। ঘরে ঘরে সব তত বন্ধ। সুতো নাই, তাঁতিরা সব পেটে কাপড় বেঁধে বসে আছে। আজ সারাদিন বাজারে ঘুরে ঘুরে বহু কষ্টে এই মিলের শাড়ি কটি জোগাড় করেছি। বাজারে কাপড় মিলছে না, মিলছে না মানে মিলছেই না, এ কি কোনোদিন কেউ ভেবেছে? এই তত কাপড়, তার আবার কি চড়া দাম!

কাপড় দেখে আমাদের তো মাথায় হাত। চটের মতুন মোটা, মাড় কি দিয়েছে, জমিনে হাত দিলে হাত পিছলে যেচে, সুতো মিহি না মোটা বোঝাই যেচে না। একরঙা ম্যাড়মেড়ে সবুজ নাইলে খয়েরি পাড় আর কাপড়ের রঙ কি! শুনছি কোরা রঙ, ঘিয়েঘিয়ে, ধোপাবাড়িতে দিলে ধুয়ে শাদা করে দিতে পারবে। ই কাপড় ভিজলে যি কি ভার হবে, বোঝাই যেচে। জানি না, ই গরম দ্যাশে কেমন করে ই কাপড় পরব। ত্যাকন কি আর জানি, ই কাপড়ও আর দু-দিন বাদে জুটবে না। বোধায় ছ-মাসও যায় নাই, কত্তা এসে খবর বললে বাজারে কাপড় নাই। নাই তো নাই, কুনো কাপড়ই নাই, বিদ্যাশ থেকে কাপড় আনা হয় বন্ধ, নাহয় খুব কম। দিশি মিল-কারখানাগুলিনও কাজ করছে না। কুনো সুতো পায় না বলে গাঁয়ে গায়ে তাতিরাও সব তাঁত বন্ধ করে থুতনিতে হেঁটো দিয়ে বসে আছে।

উসবই কি যুদ্বুর লেগে? কবে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তিন বছর পেরিয়ে যেতে চলল। আর এতদিন বাদে পরনের কাপড় অমিল হবে?

কাপড় বেশ কিছুদিন থেকেই অমিল, কত্তা বললে, মেয়েদের কাপড় তবু এতদিন পাওয়া যাচ্ছিল, পুরুষদের জামা জোব্বা ফতুয়ার কাপড় অনেকদিন থেকেই টানাটানি। তা আমাদের এই গরম দেশে গরিব মানুষদের কজনই বা জামা পরে–ভদ্রলোকদেরও জামা-জুতো অতো না হলেও চলে যায়। কিন্তু মেয়েদের তো একটি শাড়িই সম্বল। যুদ্ধ কি, দেশের মানুষ এবার বুঝবে। এখন তো শুধু কাপড় অমিল মনে হচ্ছে মানুষ কি তবে ন্যাংটো থাকবে? একটিমাত্র জিনিশের অভাব হলে কি হয় দ্যাখো! বাঁচতে মানুষের বেশি কিছু লাগে না। তবু দু-একটি যা লাগে তার অভাব হলেই ভয়ানক কাণ্ড! কাপড় নাই, এর পর আর একটিই জিনিস যেমন ধরো ভাত নাই, তখন কি হবে?

যুদ্বুর কুনোকিছু তো এখনো ই-দ্যাশে হয় নাই। তাইলে হঠাৎ হঠাৎ এক একটো জিনিশ ক্যানে নাই হবে?

গাঁয়ের টিউবওয়েল থেকে পানি পাচ্ছ, প্রতিদিন, বাড়ির রাখালটা পানি নিয়ে আসছে, তাই তো? একদিন সে এসে বললে, পানি নাই কলে। তুমি কি জানতে, মাটির তলার যে পানি থেকে তুমি পানি পাচ্ছ, সেই পানি মাটির তলায় থাকবে যদি দূরের একটা নদীতে পানি থাকে। সেই নদীর পানি কবে শুকিয়ে গিয়েছে, তুমি জানোও না–কিন্তু একদিন দেখলে টিউবওয়েলে আর পানি নাই। এখনকার যুদ্ধই এইরকম, কিসের সাথে কিসের যোগ তুমি-আমি জানতেই পারি না। মাটি পাথর হচ্ছে, কেউ জানে না, তারপর দেখবে একদিন তামাম মাঠই পাথর চাষবাস সব শেষ!

ঐ হেঁয়ালি কিছুই বোঝলম না, কিন্তু বেশিদিন গেল না ছ-মাস না যেতেই শোনলম, চারিদিকে হাহাকার হচে, কাপড় নাই, মেয়েদের পরনে কিছুতেই কাপড় জুটছে না। কোথাকার মেয়েরা লিকিন কাপড়-বিহীন ন্যাংটো থাকছে। সে গাঁয়ে মেয়েরা দিনে তো কথাই নাই, রেতেও বাপ-ভাইয়ের ছামনে বেরুইতে পারছে না। বেশি কথা আর কি বলব–যা কুনোদিন ইসব দ্যাশে হয় নাই, এইবার তা-ও হতে লাগল। বরাবর দেখছি রেতে শোবার সোমায় কেউ দুয়োরে খিল দেয় না, বড়জোর ঠেসিয়ে রাখে। আমাদের বাড়ির কথা আলেদা। অন্য সব বাড়িতেই আমকাঠের দরজা, ত্যাড়াকা, একটো দিক হয়তো ভাঙা, হাঁসকল খুলে পড়ছে, খিল আছে কি নাই–দরজা তো লয়, যেন দরজার ছল। ও-তে আবার খিল দেবে কে? তার দরকারই বা কি?

এইবার খবর আসতে লাগল খুব কাপড় চুরি হচে। লতুন কাপড় লয়, পুরনো কাপড়ই চুরি হচে। সোয়ামি-স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে শুয়ে আছে, ভাঙা দুয়োরটো ঠেসানো–সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছে। বউটির পরনের একটি কাপড় কে নিয়ে গেয়েছে। দুটোর বেশি কাপড় ই দ্যাশে কারই বা থাকে? বড়লোকের বাড়ির বউ-ঝিদের দু-একটো তোলা-শাড়ি, বিয়ের বেনারসি কাপড় ইসব তোরঙ্গে ভোলা থাকে। সিসব লয়, ঐ গরিব বউ মানুষটিরই দুটি শাড়ির একটি, কিংবা একমাত্র শাড়িটি চোরে নিয়ে গেয়েছে। ভিজে কাপড় অ্যানেক-সোমায় বাইরে এগনেতেই দড়ি কিংবা তারে শুকোতে দেওয়া থাকে, এতকাল তা-ই থাকত। অ্যাকন আর তা কেউ করে না। ঘর থেকেই কাপড় চলে যেচে। এত দুঃখের মদ্যে বলতে হাসিও লাগে, একপাড়ার বউয়ের কাপড় ভিনপাড়ার বউয়ের পরনে লিকিন দেখা গেয়েছে। ই বেপারে হিঁদু-মোসলমান বাছাবাছি নাই। কাপড়ের টানাটানি সবারই। কাপড় লাগবে সবারই। বোঝাই যেচে, কাপড় যারা চুরি করছে তারা চোর লয় বরঞ্চ আসল চোরই অ্যাকন চুরি করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তুক তা বললে হবে ক্যানে? আমাদের সেবোর মায়ের কাপড় অমুকের বউয়ের পরনে দেখা যেচে যি!

এমনি কথা বলে বাড়ির পুরুষ মরদটো যেচে সেই বাড়িতে। এক রঙের কাপড় হয় না? তোমার বউয়ের শাড়ির মতুন রঙ কি দুনিয়ায় আর একটোও নাই? কারুর কাপড়ে কি নাম লিখে দিয়েছে কোম্পানি?

আমাদের সেবোর মায়ের শাড়ির এককোণে পাকা জামের রঙ লেগেছিল। এই দ্যাখো সেই কষ।

ক্যানে, জামের কষ কি আমাদের বাড়ির গোঁদানির মায়ের শাড়িতে লাগতে পারে না?

এইসব কথা নিয়ে মরদে-মরদে, বউয়ে-বউয়ে সি কি তুলকালাম ঝগড়া, মারামারি!

এমনি য্যান আবস্তা, ত্যাকন একদিন শোনলম, ছায়রাতুনবিবির লাতিনি মেয়েটি এখনো বিয়ে হয় নাই, সোমত্ত মেয়ে সেই মেয়ে ন্যাংটো হয়ে ঘরে বসে আছে। ছায়রাতুন বুড়ি ক্যানে বেঁচে আছে কেউ বলতে পারবে না, সোয়ামি-পুত্তুর-ভাই-বেরাদর কেউ নাই তার। সব পুড়িয়ে খেয়েছে, শুদু ঐ লাতিনটো আছে। বোধায় ঐ লাতিনটোর লেগেই বেঁচে আছে। তাদের মতুন তাদের ভিটেটোও বেআব্রু। একটোই মাটির কুটুরি। ভিটেঘেরা মাটির দেয়াল এককালে ছিল, এখনো তার কিছু কিছু চেহ্নত আছে, এই পয্যন্ত। ঘরটোর দেয়ালও জায়গায় জায়গায় ভাঙা, দরজার বালাই নাই, একটো ছেড়া চট টাঙানো থাকে, চোরে সিটি নেয় নাই–ভাগ্যিস নেয় নাই। পায়খানা-পেশাব করতে ঐ চটটো পিদে লাতিনি বাইরে আসে। বুড়ি লিকিনি বলেছে, নিজের শাড়িটি লাতিনিকে দিয়ে সে ন্যাংটো হয়ে বাড়িতে কাজ করবে, ন্যাংটো হয়ে গাঁয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। সে কি অ্যাকন আর মেয়েমানুষ যি লাজ-শরম থাকবে? উসব ধুয়ে-মুছে খেয়ে নিয়েছে সে। সে ন্যাংটোই ঘুরবে। বলেছে, দেখি গাঁয়ের লোকে কি করে! সিদিন রাতে খেতে বললে কত্তা এমন করে হাত নাড়লে যি আর একবার বলতে সাওস হলো না। গা-মাথা মোটা একটা কাপড় চাপা দিয়ে শুয়ে থাকলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *